রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১–১৯৪১) – শ্রেষ্ঠ বাঙালি মনীষা, পৃথিবীর মহত্তম সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১–১৯৪১) – শ্রেষ্ঠ বাঙালি মনীষা, পৃথিবীর মহত্তম সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলা, তথা বিশ্বসাহিত্যের এক বিরাট বিস্ময়। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিদের একজন তিনি। শুধু শ্রেষ্ঠ কবিই নন, মানব জীবনেরও এমন কোনও ক্ষেত্র নেই, যেখানে তিনি বিচরণ করেননি। তাঁর অমর কাব্যে ব্যথিত পাবে ব্যথাজয়ের প্রেরণা, দার্শনিক পাবেন প্রকৃত সত্যের সন্ধান, মৃত্যুপথযাত্রী পাবেন মৃত্যুজয়ের সান্ত্বনা। সমগ্র বাংলাভাষী মানুষ তাঁর ভাষায় কথা বলে।

তিনি বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, সঙ্গীত রচয়িতা, সুরস্রষ্টা, গায়ক, চিত্রশিল্পী, অভিনেতা, সমাজসংস্কারক, দার্শনিক এবং শিক্ষাবিদ।

এই মহান কবির জন্ম কলকাতার বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে। ঊনবিংশ শতকের সাহিত্য ও সংস্কৃতির পীঠস্থান ছিল জোড়াসাঁকের ঠাকুর পরিবার। এই পরিবারের শিক্ষাদীক্ষা, মার্জিত সাংস্কৃতিক চেতনা এবং পিতার আলোকিত ধর্মবিশ্বাস · রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বিস্ময়কর রূপে মূর্ত হয়ে উঠেছিল।

রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাতা সারদা দেবী। পরিবারটি পিরালি ব্রাহ্মণ বংশোদ্ভূত। দেবেন্দ্রনাথ মধ্যবয়সে রাজা রামমোহন রায় প্রবির্তিত ব্রাহ্মধর্মমতে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ফলে ঠাকুর পরিবারের অন্যান্য ধারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও দেবেন্দ্রনাথ-রবীন্দ্রনাথের বংশধারা ব্রাহ্মমতবাদের ধারা অনুসারী।

জোড়াসাঁকোর ঐতিহ্যমণ্ডিত এই বিশাল পরিবারেই ১৮৬১ সালের ৭ মে (বাংলা ১২৮৬ সালের ২৫ বৈশাখ) রবীন্দ্রনাথের জন্ম। তিনি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্দশ সন্তান।

এই বিশাল পরিবারের পুরুষ, মহিলা এবং ছোটদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল ভিন্ন ভিন্ন জগৎ। বিশেষ করে ছোটদের চলতে হতো কঠোর অনুশাসনের ভেতর দিয়ে। তাদের দেখা-শোনার দায়িত্ব ছিল পারিবারিক ভৃত্যকুলের ওপর। অবশ্য অবিভাবকদের নজরদারিও থাকত সর্বত্র।

রবীন্দ্রনাথেরও ছোটবেলা কেটেছে এই ভৃত্যকুলের তত্ত্বাবধানে। তাদের প্রহরাতেই তাঁর মনোবিকাশের শুরু। শৈশব থেকে কৈশোর উত্তীর্ণ হয়েছিল এদেরই পরিচর্যায়।

বাল্যস্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের এক চাকর ছিল, তার নাম শ্যাম। শ্যামবর্ণ চেহারার বালক, মাথায় লম্বা চুল, খুলনা জেলায় তাহার বাড়ি। সে আমাকে ঘরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসাইয়া আমার চারদিকে খড়ি দিয়া গণ্ডি কাটিয়া দিত। গম্ভীর মুখ করিয়া তর্জনী তুলিয়া বলিয়া যাইত, গণ্ডির বাহিরে গেলেই বিষম

বিপদ। বিপদটা আধি ভৌতিক কি, আখি দৈবিক তাহা স্পষ্ট করিয়া বুঝিতাম না। কিন্তু মনে বড় আশঙ্কা হইত।

“গণ্ডি পার হইয়া সীতার কি সর্বনাশ হইয়াছিল, তাহা রামায়নেই পড়িয়াছিলাম; এই জন্য গণ্ডিটাকে নিতান্ত অবিশ্বাসীর মতো উড়াইয়া দিতে পারিতাম না। চাকরদের মহলে যে সকল বই প্রচলিত ছিল তাহা পাইয়াই আমার সাহিত্য চর্চার সূত্রপাত হয়। তাহার মধ্যে চাণক্য শ্লোকের বাংলা অনুবাদ ও কৃত্তিবাস রামায়ণই প্রধান।

আগামীদিনে বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে বড় আসনটি যিনি লাভ করুবেন, বাল্যে তাঁর প্রতিভা এভাবেই লালিত হয়েছিল।

বালক রবীন্দ্রনাথকে শিক্ষার জন্য প্রথমে পাঠানো হয়েছিল ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে। পরে নরমাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি ও সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তবে স্কুলে যাওয়াই সার। কোনও স্কুলেরই পাঠ শেষ করতে পারেননি তিনি।

আসলে স্কুলের বাঁধাধরা শিক্ষা, শিক্ষকদের ব্যবহার এবং পরিবেশ কোনও কিছুই তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। এই জগৎ সম্পর্কে পরিণত বয়সেও তাঁর মনে ক্ষোভ ও অভিযোগ ছিল।

প্রথাগত বিদ্যাশিক্ষা না হলেও গৃহশিক্ষকের কাছে তিনি ইতিহাস, ভূগোল, গণিত, সংস্কৃত এবং ইংরেজি ভাষার পাঠ গ্রহণ করেন সুচারুভাবে।

সাধারণ বিষয় শিক্ষার পাশাপাশি সঙ্গীত অভিনয় এবং অঙ্কনবিদ্যাও তিনি শেখেন। তাঁর দু’চোখে ছিল অপার আগ্রহ। পৃথিবীর সবকিছুকে জানার ও বোঝার জন্য তাঁর আকুলতা ও চেষ্টার বিরাম ছিল না। প্রকৃতির পাঠশালার তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান ছাত্র।

এভাবেই তিনি দিনে দিনে পরিচিত হয়েছেন জগৎ ও জীবনের সঙ্গে। তাঁর এই জানাই পরবর্তীকালে তাঁর রচিত গানে, কবিতায়, গল্পে, প্রবন্ধে, নাটকে, উপন্যাসে বিধৃত হয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করে তুলেছেন।

একেবারে বালক বয়সেই দুটো ঈশ্বরস্তব লিখে পিতা দেবেন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। উৎসাহ পাওয়ায় দ্বিগুণ উৎসাহে শুরু হয় তাঁর কাব্যচর্চা।

‘হিন্দুমেলার উপহার’ কবিতা রবীন্দ্রনাথের নামে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘অমৃত বাজার’ নামে একটি দ্বিভাষিক পত্রিকায় ১৮৭৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। তারপর মাত্র পনের বছর বয়সে ১৮৭৬ সালে কবির প্রথম কাব্য ‘বনফুল’ প্রকাশিত হয়।

কাব্য সাধনার ক্ষেত্রে প্রথম জীবনে দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং তার পত্নী কাদম্বরী দেবীর কাছ থেকে যথেষ্ট উৎসাহ পেয়েছিলেন তিনি।

এর দু’বছর পর সতের বছর বয়সে পড়াশোনার জন্য তাঁকে যেতে হয় বিলেতে। কিন্তু সেখানেও বিদ্যালয়ের বিদ্যাচর্চা খুব একটা হয়নি। শুধু বছর কয়েক পাশ্চাত্য জীবনাচরণ, সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় পরিচয়ের যোগসূত্র স্থাপন এবং হৃদয়ে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সুরমূর্ছনা নিয়ে আবার ফিরে আসেন স্বদেশে। রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিলেত গিয়েছিলেন ১৮৭৮ সালে। সেখানে তিনি কিছুদিন ব্রাইটনে, পরে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে অধ্যাপক হেরি মরলির কাছে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। কিন্তু শেষ হওয়ার আগেই বছর দেড়েক পর দেশে ফিরে আসেন ১৮৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। দ্বিতীয়বার বিলেত যাত্রা করেন ১৮৮১ সালের এপ্রিল মাসে। কিন্তু যাওয়া আর হয়নি, মাদ্রাজ (চেন্নাই) থেকেই ফিরে আসেন তিনি।

বিলেত যাওয়ার আগেই ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ এবং ‘প্রতিবিম্ব’ পত্রিকায় তাঁর ‘বনফুল’ এবং ‘ভারতী’ পত্রিকায় (দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত) ‘কবিকাহিনী’ নামে দুটো রচনাকর্ম ধারাবাহিক প্রকাশিত হতে থাকে।

জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি থেকেই প্রকাশিত হতো ‘ভারতী’ ও ‘বালক’ পত্রিকা। এই দুটো পত্রিকাতেই তিনি নিয়মিত লিখতেন। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিনী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্রকাশিত হয়। ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা’ রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রবন্ধ। প্রকাশিত হয়েছিল ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায়।

বিলেতে বসবাসকালেই ‘ভারতী’ পত্রিকায় তাঁর ‘পত্রগুচ্ছ’ বের হতে থাকে ‘ইউরোপ প্রবাসী কোনো বঙ্গীয় যুবকের পত্র’ শিরোনামে। পরে তাঁর তিনটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এগুলো হলো ‘ভগ্নহৃদয়’ (গীতিকাব্য), ‘রুদ্রচণ্ড’ (নাটিকা) এবং পূর্বোল্লিখিত ‘যুরোপ প্রবাসীর পত্র’।

রবীন্দ্রনাথের অভিনয় জীবনের হাতেখড়ি হয় বিলেত থেকে ফিরে আসার পর। দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রচিত ‘মানময়ী’ নাটকে তিনি মদনের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এটাই ছিল তাঁর প্রথম অভিনয়।

রবীন্দ্রনাথ ১৮৮১ সালে রচনা করেন ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ গীতিনাট্য। পারিবারিক অনুষ্ঠানে তা অভিনীত হয়। কবি নিজেই বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর গীতিনাট্য ‘কালমৃগয়া’। এতে রবীন্দ্রনাথ অভিনয় করেন অন্ধমুনির ভূমিকায়।

এবছরই (১৮৮২) কবি রচনা করেন ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি। এর অব্যবহিত পরেই প্রকাশিত হয় তাঁর ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’ কাব্য। এই কাব্য পড়ে মুগ্ধ হয়ে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজের গলার মালা পরিয়ে দিয়ে কবিকে আশীর্বাদ করেন।

দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে বসবাসের সময় তিনি রচনা করেন প্রবন্ধ গ্রন্থ “বিবিধ প্রসঙ্গ’ (১৮৮৩) এবং উপন্যাস ‘বৌঠাকুরানীর হাট’।

এই বছরই অর্থাৎ ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তিনি বিয়ে করেন যশোরের মেয়ে ভবতারিনী দেবীকে। বিয়ের পর স্ত্রীর নাম পাল্টে রাখা হয় মৃণালিনী দেবী। বিয়ের অল্পকাল পরেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী রবীন্দ্রনাথের প্রায় সমবয়সী বৌঠান কাদম্বরীদেবী আত্মহত্যা করেন ১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল। এটা ছিল কবির জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কারণ, রবীন্দ্র মনন ও প্রতিভার বিকাশে কাদম্বরী দেবীর প্রভাব ছিল অসামান্য, রবীন্দ্রনাথ সারা জীবনে এই শোকের যন্ত্রণা ভুলতে পারেননি।

বিয়ের পরের বছরই (১৮৮৪) পিতার নির্দেশে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখাশোনার কাজ আরম্ভ করেন। এই সময় বৈষয়িক কাজে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষ করে শিলাইদহ ও শাহজাদপুর গিয়ে তাঁকে থাকতে হয় বেশ কিছু দিন।

১৮৮৫ সালে ‘বালক’ নামে একটি মাসিক কিশোর পত্রিকা বের হয় সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সম্পাদনায়। রবীন্দ্রনাথ এই ‘বালক’ পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। তাঁর অনেক শিশুতোষ কবিতা, প্রবন্ধ, হাস্য কৌতুক ও ভ্রমণকাহিনী প্রকাশিত হতো এই পত্রিকায়। এখানেই তিনি ধারাবাহিকভাবে তাঁর ‘রাজর্ষি’ উপন্যাস প্রকাশ করেন।

কবির প্রথম উল্লেখযোগ্য কাব্য ‘কড়ি ও কোমল’ প্রকাশিত হয় ১৮৮৬ সালে। তারপর ১৮৮৮ সালে তিনি রচনা করেন গীতিনাট্য ‘মায়ার খেলা’। ১৮৮৯ সালে রচনা করেন ‘রাজা ও রানী’ নাটক। ‘মানসী’ কাব্যের প্রধান কবিতাগুলো তিনি রচনা করেন ১৮৯০ সালে। ‘বিসর্জনের’ মতো ভাবাশ্রয়ী ট্রাজেডি নাটকও এ বছরেই লেখা। মাত্ৰ আড়াই মাসের বিলেত যাত্রার পরিণতিতে পরের বছরই অর্থাৎ ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়েরী’। ১৮৯১ সালের এপ্রিল মাস থেকে সাপ্তাহিক ‘হিতবাদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর ‘দেনা পাওনা’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘গিন্নি’, ‘রাম কানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’, ‘ব্যবধান’ ও ‘তারা প্রসন্নের কীর্তি’ নামের ছোট গল্পগুলো। একই বছরের শেষভাগে ঠাকুর পরিবার থেকে ‘সাধনা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করে। এতে ১৮৯১ সাল (১২৯৮ বঙ্গাব্দ) থেকে ১৮৯৬ সাল (১৩০২ বঙ্গাব্দ) পর্যন্ত কবির প্রায় ৩৬টি গল্প প্রকাশিত হয়।

১৮৯৪ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হলে নবীনচন্দ্র সেনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এই সংস্থার সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর তিনি জমিদারি কাজের তদারকি করার জন্য কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহ গমন করেন। সেখানে তিনি ১৮৮৭ সাল থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন। শিলাইদহ সাজাদপুর পদ্মানদী কবির ভাবচেতনাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। এই শিলাইদহে থাকার সময়েই তিনি ‘সোনার তরী’ কাব্যের অধিকাংশ কবিতা রচনা করেন এবং লেখেন বহু ছোটগল্প।

এই সময় তিনি মেজভাই সত্যেন্দ্রনাথের মেয়ে ইন্দিরা দেবীকে নিয়মিত পত্র লিখতেন। এইসব পত্রে গ্রামবাংলার চিরকালীন রূপ ফুটে উঠেছে। এই পত্রগুলো ১৮৯২ সালে ‘ছিন্নপত্র’ নামে সংগৃহীত হয়ে ছাপা হয়।

এই পর্বেই কবি রচনা করেন ‘চিত্রাঙ্গদা’ (১৮৯২), সোনার তরী’ (১৮৯৪) এবং ‘চিত্রা’ (১৮৯৬) নামের কাব্যনাট্য ও কাব্যগ্রন্থ। এছাড়াও রচিত হয়ে ‘গোড়ায় গলদ’ (১৮৯২) ও বৈকুণ্ঠের খাতা’ (১৮৯৭) নামের দুটো প্রহসন এবং ‘পঞ্চভূতের ডায়ারি’ নামে একটি প্রবন্ধের বই।

এসময় তিনি একবছরের জন্য ‘ভারতী’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এই পত্রিকায় তাঁর অনেক ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। তিনি ১৮৯৮ সালে কলকাতার পৈত্রিক ভবন ছেড়ে সপরিবারে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে চলে আসেন।

কবির পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নির্জনে ঈশ্বর উপাসনার উদ্দেশ্যে বীরভূমের বোলপুরে কুড়িবিঘা জমি ক্রয় করেছিলেন। সময় এবং সুযোগমত তিনি এখানে এসে বাস করতেন। এখানেই রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মচর্য আশ্রমের প্রতিষ্ঠা করেন ১৯০১ সালে। বর্তমানে যার পরিচয় ‘শান্তি নিকেতন’ নামে। পরে এই প্রতিষ্ঠানই বিশ্বভারতীতে রূপান্তরিত হয়েছে।

শান্তি নিকেতনে বিদ্যালয় স্থাপনের এগার মাস পরে ১৯০২ সালে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী এবং তার কয়েক মাস পর তাঁর সদ্য বিবাহিতা কন্যা রেণুকা দেবীর মৃত্যু হয়। ১৯০৫ সালে কবির পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কবির কনিষ্ঠ পুত্র .শমীন্দ্রনাথ মাত্র তেরো বছর বয়সে মারা যান।

এই সময় উপর্যুপরি পারিবারিক মৃত্যুশোক কবির ভেতরে ঘটাতে থাকে ভাবের রূপান্তর। এর থেকেই কবির ‘গীতাঞ্জলি’ পর্বের শুরু। ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্য প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে।

উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের শুরুতে কয়েকটি বছর রবীন্দ্রনাথকে সমাজ সংস্কারমূলক ও রাজনৈতিক কার্যকলাপে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করতে দেখা যায়। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনার প্রতিবাদে এদেশে শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথও এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। দেশবাসীকে স্বদেশ চেতনায় উদ্ধুদ্ধ করেছিল তাঁর গান ও কবিতা।

বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের প্রতিবাদে সৃষ্ট আন্দোলন উপলক্ষেই তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গান—

“বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার বায়ু বাংলার ফল পুণ্য হউক, পুণ্য হউক
পুণ্য হউক হে ভগবান।”

১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথ একটি শোভাযাত্রা পরিচালনা করেন এবং রাখী উৎসবের প্রচলন করেন।

রবীন্দ্রনাথ রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত না থেকেও লেখায় ও বক্তৃতার মাধ্যমে অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকের কাজের প্রতিবাদ করে গেছেন।

১৯১২ সালে কবির পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বঙ্গীয় সাহত্য পরিষদ তাঁকে সংবর্ধনা দেয়।

১৯১২ সালের ২৮ জানুয়ারি তিনি পুত্র ও পুত্রবধূসহ ইংল্যান্ড গমন করেন এবং পথিমধ্যে জাহাজেই ‘গীতাঞ্জলি’, ‘গীতিমাল্য’, নৈবেদ্য’ ও ‘খেয়া’ কাব্যের কিছু বাছাই করা কবিতা ও গান ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এই বাছাই করা কবিতাগুলোই Song offerings নামে ১৯১২ সালের নভেম্বরে বিলেতে প্রকাশিত হয়। লন্ডনে ইংরেজ শিল্পী রোদেনস্টাইন তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ হন। তাঁর মাধ্যমে কবি মে সিনক্লেয়ার, এজরা পাউন্ড ও ইয়েটস প্রমুখ কবি-লেখকের সঙ্গে পরিচিত হন। লন্ডন থেকে রবীন্দ্রনাথ আমেরিকায় গিয়ে বিভিন্ন সভায় বক্তৃতা দেন এবং সেখানকার খ্যাতনামা ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচিত হন।

১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ দেশে ফিরে আসেন। সেই বছরই ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সুইডেনের নোবেল কমিটি তাঁকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেন। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবির মর্যাদায় ভূষিত হন।

কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯১৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর কবিকে ‘ডি-লিট’ উপাধি দান করে।

ড. উপেন্দ্রনাথ ভট্টচার্য এই উপলক্ষে বলেন, “খেয়ার আকুল আকাঙ্ক্ষা ও প্রতীক্ষা, গীতাঞ্জলির হতাশা ও বিরহ-বেদনা, গীতিমাল্যের যুগল প্রেম ও বিরহানুভূতি গীতালিতে পরিপূর্ণ উপলব্ধি ও আত্মসমর্পণে সার্থকতা লাভ করল।”

ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট বা স্যার উপাধি প্রধান করেন ১৯১৫ সালের ২ জুন।

নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পাঁচমাস পর প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত মাসিক ‘সবুজপত্র’ (১৯১৪ সালে মে মাসে) প্রকাশের পর রবীন্দ্রনাথের কাব্যকৃতি নতুন দিকে মোড় নেয়। এই পত্রিকাতে তাঁর প্রায় একই সঙ্গে ছোটগল্প এবং ‘চতুরঙ্গ’ ও ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস দুটো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে (১৯১৪-১৯১৫)। ‘বলাকা’ নামে তাঁর ভিন্ন স্বাদের কাব্যগ্রন্থের বহু কবিতাও এই সময় (১৯১৫) ‘সবুজ পত্রে’ প্রকাশিত হয়।

১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের আমন্ত্রণ পান এবং তা রক্ষা করতে যাওয়ার পথে জাপান সফর করেন। সেখানে প্রদত্ত ভাষণে তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তাঁর মনোভাব প্রকাশ করেন।

১৯১৮ সালে কবির প্রথম কন্যা মাধুরীলতার অকাল মৃত্যু হয়। মেয়ের মৃত্যুশোকের স্মৃতি রোমন্থন করে কাব্য রচনা করেন ‘পলাতকা’ কাব্যের কবিতাসমূহ। তিনি পাঞ্জাবের অমৃতসরে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তাঁর পাওয়া ‘স্যার’ উপাধি বর্জনের কথা ঘোষণা করে বড়লাটের কাছে পত্র দেন। পত্রটি পরে (১৯১৯ সালের ২ জুন) প্রকাশিত হয়েছিল।

তিনি ১৯২০ সালের মে মাস থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত দেশের বাইরে ইংল্যান্ডে, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, হল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া ভ্রমণ করেন এবং ঐসব দেশের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের সমাবেশে ভাষণ দেন। তিনি স্বদেশে ফিরে ১৯২১ সারের ২৩ ডিসেম্বর বিশ্বভারতীকে সর্বসাধারণের হাতে তুলে দেন। গঠন করেন বিশ্বভারতী পরিষদ।

কবি ইউরোপের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও মাত্রাতিরিক্ত বাস্তবতাবাদের সংকটকে তুলে ধরার জন্য ১৯২২ সালে ‘মুক্তধারা’ এবং ‘রক্তকরবী’ (১৯২৬) নাটক দুটো রচনা করেন। ১৯২৪ সালে চীন সরকারের আমন্ত্রনে তিনি সে দেশ সফর করেন। তারপর দক্ষিণ আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি আর্জেন্টিনায় গিয়ে হিস্পানি কবি-সম্পাদিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বাগান বাড়িতে বেশ কিছু দিন অবস্থান করেন। এখানেই লেখা হতে থাকে পূরবীর’ (১৯২৫) কবিতাগুচ্ছ। ওকাম্পোর নাম দিয়েছিলেন তিনি ‘বিজয়া’। পূরবী তাঁকেই উৎসর্গ করা হয়।

১৯২৬ সালের জুলাই মাসে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-লিট উপাধি দেয়া হয়।

ওই একই বছর তিনি মুসোলিনির আমন্ত্রণে ইতালি সফর করেন। সেখান থেকে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, জার্মান, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, গ্রিস ও মিশর সফর করেন। ১৯২৭ সালে তিনি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ সফর করেন। ১৯২৯ সালে তিনি কানাডা, জাপান এবং ইন্দোনেশিয়া সফর করেন। এ বছরই (১৯২৯) কবির উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’ ও ‘যোগাযোগ’ প্রকাশিত হয়।

১৯৩০ সালে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হিবার্ট বক্তৃতা’ প্রদানের জন্য বিলেত গমন করেন। এখানেই তিনি মানবধর্ম বা ‘Religion of Man’ শিরোনামে বক্তৃতা দেন। এটাই তাঁর সর্বশেষ ইউরোপ ভ্রমণ। ১৯৩২ সালে তিনি ইরানের শাহানশাহ রেজা শাহ পাহলভির আমন্ত্রণে ইরান এবং সেখান থেকে ইরাকও সফর করেন।

১৯৩১ সালে তাঁর সত্তরতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কবিকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। সভায় কবি বলেন, “একটি মাত্র পরিচয় আমার আছে সে আর কিছু নয়। আমি কবি মাত্র।” এই উপলক্ষে কবিকে The golden Book of Tagore নামে এক দুর্লভ রচনা সংবলিত গ্রন্থ উপহার দেয়া হয়। প্যারিস ও বার্লিনে প্রদার্শিত হয় তাঁর শেষ বয়সের ‘প্রিয়া’ নামক ছবির প্রদর্শনী। পরিচিত হন বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সঙ্গে।

১৯৩৫ সালে কাশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কবিকে ডি-লিট উপাধি দেয়া হয়।

শান্তিনিকেতনে যে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার পরিচালনায় অর্থ-সমস্যা রবীন্দ্রনাথকে পীড়িত করত। দেশ-বিদেশ থেকে সংগৃহীত অর্থ তিনি এই বিদ্যালয়ের উন্নতির জন্যই ব্যয় করতেন। এই প্রতিষ্ঠানের অর্থসংগ্রহের জন্য বৃদ্ধ বয়সেও তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে সারা দেশে নৃত্যনাট্য প্রদর্শন করে অর্থ সগ্রহ করেছেন। এই সময় তাঁর স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে মহাত্মা গান্ধী ১৯৩৬ সালে তাঁকে ৬০ হাজার টাকা দান করেন।

১৯৩৭ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁর শরীর ভাঙতে শুরু করে। এবছরই বের হয় তাঁর ‘খাপছাড়া’ ও ‘ছড়ার ছবি’, প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘কালান্তর’ ও বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ ‘বিশ্বপরিচয়’।

১৯৪০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ‘ডি-লিট’ উপাধি দেয়। এই অসুখের মধ্যেও তাঁর লেখা থেমে থাকেনি। একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর গ্রন্থ ‘রোগশয্যায়’ (১৯৪০), ‘আরোগ্য’ (১৯৪১), ‘জন্মদিনে’ (১৯৪১)। মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় তার ‘ছড়া’ ও ‘শেষ লেখা’ ইত্যাদি গ্রন্থ।

১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ) জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে বিশ্বকবির মহাপ্রয়ান ঘটে। ২৫ বৈশাখের সূর্য অস্তমিত হয় ২২ শ্রাবণের নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়।

রবীন্দ্রনাথের রচিত সাহিত্যকর্মের বিবরণ নিম্নরূপ : কাব্যগ্রন্থ ৫৬, গীতিপুস্তক ৪, ছোটগল্প ১১৯, উপন্যাস ১২, ভ্রমণ কাহিনী ৯, নাটক ২৯, কাব্যনাট্য ১৯, কাব্যনাট্য ১৯, চিঠিপত্রের বই ১৩, গানের সংখ্যা ২২৩২টি এবং অঙ্কিত চিত্রাবলির সংখ্যা প্রায় দু’হাজার।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাঙালি সত্ত্বার এক মূর্ত প্রতীক। বৈদিক ঋষির মতো ছিল তাঁর প্রাজ্ঞ দৃষ্টি, বাল্মীকি কালিদাসের মতো ছিল তাঁর কবিহৃদয়, ছিল গ্যেটে ও তলস্তয়ের মতো গভীর সমাজ-চেতনা। সুন্দরের আরাধনায় ও মানবতার পূজায় তিনি তাঁর সমস্ত সাহিত্যকর্মকে করেছিলেন সঞ্জীবিত। তাই রবীন্দ্রনাথ শুধু এক ব্যক্তি বিশেষ নন, তিনি সকল দেশের, সকল কালের এবং সকল মানুষের তীর্থভূমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *