রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সহকর্মিদ্বয়
রবীন্দ্রনাথের জীবন ও রচনার ওপর দেশি-বিদেশি কোন কোন মহাজন তথা কীর্তিমান লেখক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, সে বিষয় নিয়ে বাঙলাসাহিত্যে বহু বৎসর ধরে আলোচনা-গবেষণা হবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এমনও একাধিক সজ্জন আছেন যাদের সন্ধান রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে অতি সহজে পাওয়া যাবে না, যদিও এদের প্রভাব থাক আর না-ই থাক, এদের সাহচর্যে যে রবীন্দ্রনাথ উপকৃত হয়েছেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
যে একটি বিষয়ে অনুমতি পেলে আমি প্রথমেই বলতে চাই সেটি এই–দীর্ঘ পাঁচ বৎসর ধরে ছাত্রাবস্থায় আমি রবীন্দ্রনাথকে ক্লাস নিতে দেখেছি, সভাস্থলে সভাপতিরূপে, আপন প্রবন্ধ, ছোটগল্প, কবিতা, নাট্যের পাঠকরূপে এবং অন্যান্য নানারূপে তাকে দেখেছি। আমার মনের ওপর সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে, গুণী-জ্ঞানীর সঙ্গে তার কথোপকথন, কখনও কখনও সূর্যাস্ত থেকে রাত্রি দ্বিপ্রহর পর্যন্ত তর্ক, ভাবের আদান-প্রদান, আলোচনা। কিন্তু, এই সমস্ত আলোচনায় তাকে তার সৃজনী সাহিত্যের (ক্রিয়েটিভ লিটরেচারের) আঙ্গিকের (টেকনিকাল দিকের আলোচনা করতে শুনিনি। যেমন বেলা-র সঙ্গে খেলা মিলের চেয়ে পূর্ণিমা সন্ধ্যায়-এর সঙ্গে উদাসী মন ধায় অনেক ভালো মিল, কিংবা তারচেয়ে অনেক বড় সাধারণতত্ত্ব- লিরিকে কী গুণ থাকলে কবি এমনই শব্দের সঙ্গে শব্দ বসাতে পারেন যার ফলে পাঠক শব্দ অর্থ ধ্বনি সবকিছু পেরিয়ে অপূর্ব নবীন লোকে উপনীত হয়। তাঁর বহু বহু গান শুনে মনে হয়, এই যে অভূতপূর্ব শব্দ সম্মেলন, যার একটিমাত্র শব্দ পরিবর্তন করে অন্য শব্দ প্রয়োগ সম্পূর্ণ অসম্ভব–আর্টে এই পরিপূর্ণ সিদ্ধহস্তের কৃতিত্ব আসে কী প্রকারে তিনি কোন পদ্ধতিতে এখানে এসে পৌঁছলেন? কিংবা কোনও সুচিন্তিত পূর্ব-পরিকল্পিত পদ্ধতি যদি না থাকে তবে অন্তত সে পরিপূর্ণতায় পৌঁছবার পক্ষে নতুন নতুন বাঁকে বাঁকে তিনি কী দেখলেন, কী অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন?
বিষয়টি আমি খুব পরিষ্কার করে পেশ করতে পারলুম না, কিন্তু আমার মনে ভরসা আছে, যারা শুধু পাঠক নন, কবিতা বা গল্প সৃষ্টি করেন, তারা আমার বক্তব্যটি অনুমানে অনুভব করে নিয়েছেন।
অবশ্য শুনেছি, পরবর্তী যুগে কবি যখন তথাকথিত আধুনিক কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গল্প-কবিতা লিখতে আরম্ভ করেন তখন নাকি তিনি ওই নিয়ে বিস্তর আলোচনা তর্ক-বিতর্ক করেন। তার বোধহয় অন্যতম কারণ, আধুনিক কবিতার বহুলাংশ বুদ্ধিবৃত্তির ওপর নির্ভর করে বলে তাই নিয়ে আলোচনা করা সহজ; পক্ষান্তরে আমি পূর্বে যে বিষয়ের উল্লেখ করেছি সেটা প্রধানত বুদ্ধির ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এমনকি সঙ্গীতের রাগ-রাগিণী, ভিন্ন ভিন্ন সঙ্গীতের ভিন্ন ভিন্ন প্রসাদগুণ এবং ওই সম্পর্কে অন্যান্য নানা বিষয় তাঁকে আলোচনা করতে শুনেছি কিন্তু তিনি স্বয়ং যে তার গানে শব্দ ও সুরের পরিপূর্ণ সামঞ্জস্যে পৌঁছলেন সেটা কী পদ্ধতিতে হল, তার ক্রমবিকাশের সময় কোন কোন দ্বন্দ্ব কিংবা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল সে সম্বন্ধে বিশেষ কোনও আলোচনা করতে শুনিনি। আমি যে পাঁচ বৎসর এখানে ছিলুম, তখন তাকে বহু-বহুবার সঙ্গীতরাজ দিনেন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, খোশগল্প করতে শুনেছি, কিন্তু, যেমন মনে করুন, তার প্রথম বয়সের অপেক্ষাকৃত কাঁচা কথাসুরের সম্মিলিত গান থেকে তিনি কী করে নিটোল গানের পরিপূর্ণতায় পৌঁছলেন সে সম্বন্ধে কোনও আলোচনা করতে শুনিনি। স্বৰ্গত ধূর্জটিপ্রসাদ এবং শ্ৰীযুত দিলীপ রায়ের সঙ্গে তিনি সঙ্গীত নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন এবং এখানকার শিক্ষক শাস্ত্রজ্ঞ সুপণ্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রীর সঙ্গে তো অহরহই হত কিন্তু আমি এস্থলে যে বিষয়টির অবতারণা করেছি সেটি হত বলে জানিনে।
এবং এস্থলে আমার যদি ভুলও হয় তাতেও আমার মূল বক্তব্যের কোনওপ্রকার ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। আমার মূল বক্তব্য : চিন্তার জগতে রবীন্দ্রনাথ কাদের সঙ্গে বিচরণ করতেন।
রবীন্দ্রনাথের সর্বজ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ পিতার মৃত্যুর প্রায় এক বৎসর পর (১৯০৫/৬) শান্তিনিকেতনে এসে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে পরলোকগমন পর্যন্ত স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপনা করার পর থেকে রবীন্দ্রনাথ এখানেই মোটামুটি পাকাপাকিভাবে বাস করেন। সে-যুগে তাঁদের ভিতর কতখানি যোগাযোগ ছিল বলতে পারি না, কিন্তু ১৯২১ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত অর্থাৎ দ্বিজেন্দ্রনাথের জীবনের শেষ পাঁচ বৎসর দুজনাতে একসঙ্গে বসে দীর্ঘ আলোচনা করতে কখনও দেখিনি। অথচ এ সত্য আমরা খুব ভালো করেই জানি, দ্বিজেন্দ্রনাথের পাণ্ডিত্য, চরিত্রবল তথা বহুমুখী প্রতিভার প্রতি রবীন্দ্রনাথের অতি অবিচল শ্রদ্ধা ছিল এবং জ্যেষ্ঠভ্রাতাও রবীন্দ্রনাথের কবিপ্রতিভাকে অতিশয় সম্মানের চোখে দেখতেন। শুধু তাই নয়, আমি আশ্রমে কিংবদন্তি শুনেছি, দ্বিজেন্দ্রনাথ নাকি একদা এক আশ্ৰমাচার্যকে বলেন, আমাদের সকলেরই পা পিছলেছে, কিন্তু রবির কখনও পা পিছলায়নি। অবশ্য স্মরণ রাখা উচিত, রবীন্দ্রনাথ প্রতি উত্সব দিনে, কিংবা বিদেশ থেকে আশ্রমে ফিরলে সেখানে প্রবেশ করামাত্র জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে প্রণাম করতে আসতেন। সামান্য যে দু-একটি কথাবার্তা হত তা অতিশয় আন্তরিকতার সঙ্গে। তা ছাড়া দ্বিজেন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে ছোট্ট একটি কবিতা কিংবা অন্য এই ধরনের কোনওকিছু একটা লিখে কবিকে পাঠিয়ে মতামত জানতে চাইতেন। উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ভিন্ন অন্যকিছু রবীন্দ্রনাথকে প্রকাশ করতে শুনিনি।
রেভারেন্ড এন্ড্রুজ ও পিয়ার্সনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের হৃদ্যতা ছিল একথা সকলেই জানেন। এরা দুজনাই জীবনের শেষের ভাগ শান্তিনিকেতনের স্থায়ী বাসিন্দারূপে ছিলেন। তা ছাড়া লেভি, ভিনটারসিস, তুচ্চি, ফরমিকি, স্টেনকোনো, মর্গ্যানস্টিয়ের্নে, কলিনস বগদানফ(১) প্রভৃতির সঙ্গে তিনি ভারতীয় তথা পাশ্চাত্য সংস্কৃতি সম্বন্ধে বহু ঘন্টা, বহুদিনব্যাপী প্রচুর আলোচনা করেছেন, কখনও-বা সভাস্থলে (প্রধানত বিশ্বভারতী সাহিত্যসভায়, কখনও স্বগৃহের বারান্দায়। আর্ট কি, রস ও অলঙ্কার নিয়ে তিনি সর্বাধিক আলোচনা করেছেন শ্রীমতী স্টেলা ক্ৰামরিশের সঙ্গে। নন্দলাল স্বল্পভাষী গুণী–বরঞ্চ অসিতকুমারের সঙ্গে ওই নিয়ে তার মুখর আলোচনা হত বেশি। অবশ্য একথাও স্মরণ রাখা উচিত, আর্ট বলতে রবীন্দ্রনাথ কী বোঝেন নন্দলালই সেটি শুনেছেন বহু বৎসর ধরে এবং সবচেয়ে বেশি। এবং বৃদ্ধ বয়সে রবীন্দ্রনাথ যখন ছবি আঁকতে আরম্ভ করলেন তখন তাকে উৎসাহিত করেছেন নন্দলালই। নন্দলালই তাঁকে একাডেমিক আর্টের মরুপথে তার ধারা হারাতে দেননি।
কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতি, ভারতীয় সভ্যতা- ধর্মদর্শন কাব্য অলঙ্কার এ নিয়ে তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচনা করেছেন দুটি পণ্ডিতের সঙ্গে : স্বৰ্গত বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ক্ষিতিমোহন সেন। আলোচনা বললে অত্যন্ত কমই বলা হল। রবীন্দ্রনাথের চিন্তার জগতে ঐতিহ্যগত ভারতীয় সংস্কৃতি কতখানি বিরাট জায়গা জুড়ে রেখেছিল সেকথা আমরা সবাই জানি। বিধুশেখরের ছিল ওই একমাত্র জগৎ। ক্ষিতিমোহন সেন সে জগতে বাস করলেও দেশের গণধর্মের উৎপত্তি বিকাশের সত্য নির্ণয়ে তার ছিল প্রবল অনুরাগ। এই তিনজনের জীবন এবং রচনাতে বার বার মনে হয়– এঁরা যেন অভিন্ন। অথচ যেন ত্রিমূর্তির তিনটি মুখ দেখছি। যেন বেদের উৎস থেকে তিনটি ধারা বেরিয়ে এসেছে অথচ তিনটি ধারাই আপন আপন পরিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভূগর্ভেও যেন একে অন্যের সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষা করেছে। এস্থলে আমি অপরাধ স্বীকার করে নিচ্ছি যে, বিষয়টি আমার পক্ষে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করা কঠিন, কারণ এদের আলোচনা আমি শুনেছি অপরিণত বয়সে ও পরবর্তীকালে, এবং আজও আমার সংহিতাজ্ঞান এতই যসামান্য যে, ত্রিমূর্তির এই লীলাখেলা আমি প্রধানত অনুভূতি দিয়ে হৃদয়ঙ্গম করেছি, বুদ্ধিবৃত্তি দ্বারা বিশ্লেষণ– গবেষণা দ্বারা নয়। এস্থলে ত্রিধারা ত্রিমূর্তি বলার সময় আমি স্মরণে রেখেছি যে অনেকেই (যেমন ত্রিবেদী) চতুর্থ বেদ স্বীকার করেন না।
বিধুশেখর ও ক্ষিতিমোহন বাল্যবন্ধু, হয়তো-বা সতীর্থ ছিলেন। উভয়েই কাশীতে সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষালাভ ও সংস্কৃত চর্চা করেন। উভয়েই শাস্ত্রী।
বিধুশেখর ও ক্ষিতিমোহন উভয়েই অত্যুত্তম সংস্কৃত এবং পালি জানতেন।
এ স্থলে পালি ভাষার কথা বিশেষ করে উল্লেখ করতে হল। কারণ বৌদ্ধধর্ম তথা পালি ভাষার প্রতি সাধারণ সংস্কৃত পণ্ডিতের অনুরাগ থাকে না। পণ্ডিতজনোচিত বিশেষজ্ঞ না হয়েও রবীন্দ্রনাথ এ দুটি ভাষাই জানতেন। পরবর্তী যুগে সংহিতা পাঠের সুবিধার জন্য বিধুশেখর জেল-আবেস্তার ভাষা শেখেন।(২) ক্ষিতিমোহন গণধর্মের সন্ধানে হিন্দি, গুজরাতি, মারাঠি প্রভৃতি অর্বাচীন ভাষাগুলোর প্রতি মনোনিবেশ করেন। বেদ উপনিষদে তিনজনারই অবাধগতি।
কিন্তু সংহিতাই বিধুশেখরের প্রাণাপেক্ষা প্রিয়, বিশেষ করে ঋগ্বেদ। রবীন্দ্রনাথ তার অনুপ্রেরণা পেতেন উপনিষদ থেকে। এবং ক্ষিতিমোহনের সর্বাপেক্ষা আকর্ষণ ছিল ভারতীয় গণধর্ম তথা ক্রিয়াকারে সর্বপ্রাচীন ভাণ্ডার অথর্ববেদের প্রতি। আমি একাধিক পণ্ডিতের মুখে শুনেছি, ক্ষিতিমোহন যতখানি শ্রদ্ধাসহ, মনোযোগ সহকারে, পুত্থানুপুঙ্খরূপে অথর্ববেদ অধ্যয়ন করেছিলেন ততখানি এ যুগে অন্য কোনও পণ্ডিতই করেননি। সংহিতায় সুপণ্ডিত বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডার্সকে বলতে শুনেছি, অথর্ববেদ বড়ই অবহেলিত। তাঁর বিশ্বাস ছিল, পরবর্তী যুগের বহু রহস্যের সমাধান অথর্ববেদে আছে। অরবিন্দও নাকি এই মত পোষণ করতেন।
বিধুশেখর যখন ব্রহ্মবিদ্যালয়ে যোগদান করেন তখন তিনি এই দৃঢ়বিশ্বাস নিয়েই আসেন যে, তিনি বৈদিক যুগের আশ্রমেই প্রবেশ করেছেন। এখানে বেদমন্ত্র পাঠ হয়, ব্রাহ্মণসন্তান মাত্রই যজ্ঞোপবীতধারী, আমিষ পাদুকা আশ্রমে নিষিদ্ধ, ব্রহ্মচর্যের বহু ব্ৰত এখানে পালিত হয়, এবং গুরু শিষ্যের সম্পর্ক অতি প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যানুযায়ী। পাঠক এ যুগের ইতিহাস প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্র-জীবনীতে পাবেন।
বিধুশেখরের মতো নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ এ যুগে অল্পই জন্মেছেন। শুধু স্বপাকে ভক্ষণ, সন্ধ্যাত্মাফিক পালন তথা সশ্রদ্ধ বেদাধ্যয়নের কথা নয়– বাহ্যিক গুচি-অশুচিতে পার্থক্যও তিনি করতেন অনায়াসে অবহেলে, কিন্তু তার সর্বপ্রধান প্রচেষ্টা ছিল অন্তর্জগৎকে পরিপূর্ণ শুচিশুদ্ধ পবিত্র করার। তাঁর আদর্শ ছিল তাঁর কল্পনার ব্রহ্মচর্যাশ্রম এবং তার কল্পনার আচার্য। অনাসক্ত পূত পবিত্র।
ক্ষিতিমোহনও নিষ্ঠাবান বৈদ্য-সন্তান। কিন্তু তার সামাজিক আচার-ব্যবহার ছিল অনেকটা বিবেকানন্দের মতো।
আশ্রমে যতদিন বারো বত্সরের বেশি বয়স্ক ছাত্র নেওয়া হত না ততদিন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের রীতিনীতি পালন করা কঠিন হলেও অসম্ভব ছিল না। ইতোমধ্যে মহাত্মা গাধী কিছুদিনের জন্য আশ্রম পরিচালনার ভার স্বহস্তে গ্রহণ করে দেখিয়ে দিলেন, এতদিন আশ্রমবাসীরা যে জীবন কসাধনময় ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করছিলেন সেটা বাস্তবিক বিলাস পরিপূর্ণ। আশ্রমের মেথর-চাকর বিদায় দিয়ে তিনি এখানে যে বিপ্লবের সূত্রপাত করলেন সেটা এখানকার অনেক শুরুর পক্ষে অসহনীয় হয়ে দাঁড়াল। ফলে গাঁধী সাবরমতী চলে গেলেন। আশ্রমও ধীরে ধীরে তার রূপ পরিবর্তন করতে লাগল।
বিধুশেখর তবু তার ব্রহ্মচর্যাশ্রমাদর্শে আকণ্ঠ আলিঙ্গনাবদ্ধ।
রবীন্দ্রনাথ বললেন, হ্যারিকেন লণ্ঠন যখন আশ্রম ব্যবহার করেছে, বিজলিই-বা করবে না কেন?
বিধুশেখর বললেন, রেড়ির তেলে আমি সানন্দে ফিরে যাব। হ্যারিকেন আর রেড়ির তেল প্রায় একই বিজলির তুলনায়। বিজলি আনবে বিলাস। তার সর্বনাশের সর্বশেষ সোপান আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
পাঠক ক্ষণতরে ভাববেন না, বিধুশেখর সঙ্কীর্ণচেতা কৃপক ছিলেন। তাঁর প্রতি এরচেয়ে নির্মম অবিচার আর কিছুই হতে পারে না। ব্যক্তিগত জীবনে খ্রিস্টান পাদ্রি এক্রুজ যার অন্তরঙ্গ সখা, ব্রহ্মমন্দিরের আচার্যের আসনে বসে যিনি মুগ্ধ কণ্ঠে যবন ইমাম গজ্জালির কিমিয়া সাদ (সৌভাগ্য-স্পর্শমণি) আবৃত্তি করে ব্রহ্মলাভের পন্থা-বর্ণনা করছেন, যিনি মৌলানা শওকত আলিকে বাহুপাশে আবদ্ধ করে আত্রম ভোজনাগারে নিয়ে যাচ্ছেন, তিনি যদি সঙ্কীর্ণচেতা হন তবে প্রার্থনা করি সর্বভারতবাসী যেন এরকম সঙ্কীর্ণচেতা হয়।
বিধুশেখর না থাকলে যে রবীন্দ্রনাথ রাতারাতি ব্রহ্মবিদ্যালয়কে অক্সফর্ডে পরিণত করতেন তা নয়। বিধুশেখর ছিলেন প্রাচীন ভারতের মৃর্তমান প্রতীক। তার সন্তুষ্টি থাকলে রবীন্দ্রনাথ আপন কর্মপদ্ধতি সম্বন্ধে দ্বিধাহীন হতে পারতেন। এবং যখনই তিনি বিধুশেখরকে- তা সে যত অল্পই হোক না কেন আপন মতে টেনে আনতে পারতেন তখনই তার মনে হত তিনি যেন ঐতিয়াবদ্ধ ভারতকে, তার ধর্ম থেকে তাকে বিচ্যুত না করে, বর্তমান প্রাচীন সংসারের বিশ্বনাগরিকরূপে তার প্রাপ্য আসন নির্দিষ্ট করে দিতে পেরেছেন।
এই বিশ্বনাগরিক হওয়ার জন্য বিশ্বভারতীয় সৃষ্টি।
পূর্বেই বলেছি, আশ্রম যতদিন বারো বৎসরের বেশি বয়স্ক ছাত্র নিত না ততদিন ব্রহ্মচর্যাদর্শ সম্মুখে রাখা সম্ভবপর ছিল। কিন্তু ব্রহ্মচর্যাশ্রম যখন বিশ্বভারতীতে রূপান্তরিত হল (স্কুলের সঙ্গে কলেজও যুক্ত হল) তখন পূর্ণবয়স্ক কিশোর ও যুবাকেও গ্রহণ করতে হয়। এই বিশ্বভারতী নির্মাণে রবীন্দ্রনাথের প্রধান উৎসাহদাতা ও সচিব ছিলেন বিধুশেখর ও ক্ষিতিমোহন (সঙ্গীতে দিনেন্দ্রনাথ, চিত্রে নন্দলাল)। রবীন্দ্রনাথ যখন বললেন, এই শান্তিনিকেতনে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের গুণী-জ্ঞানীরা একত্র হবেন– সঙ্গে সঙ্গে বিধুশেখর সংস্কৃত থেকে উদ্ধার করে দিলেন, যত্র বিশ্ব ভবত্যেকনীড়ম।
বিধুশেখরের আনন্দের সীমা নেই। এতদিন আশ্রম-বালক তার কাছ থেকে সন্ধি-সমাস পূর্ণরূপে আয়ত্ত করার পূর্বেই অধাতক অবস্থায় আশ্রম ত্যাগ করত, এখন ভারতের সর্ব খণ্ড থেকে আসতে লাগল প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রছাত্রী। এরা লুপ্তপ্রায় যাঙ্কের নিরুক্ত অধ্যয়নে উগ্রীব, বিধুশেখরেরই সম্পাদিত ও অনূদিত পালি গ্রন্থ মিলিন্দা পহো থেকে তাকে বহুতর পঞহো (প্রশ্ন) শুধায়। বিধুশেখরের আনন্দ উচ্ছলিত হয়ে উপচে পড়ছে। এইবারে সত্য জ্ঞানচর্চা হবে। এইবারে তিনি তার জ্ঞানভাণ্ডার উজাড় করে দিতে পারবেন।
কিন্তু হায়, এইসব ছাত্রছাত্রীর অনেকেই ভো ব্রহ্মচর্যে বিশ্বাস করে না। এমনকি এদের ভিতর নাস্তিক চার্বাকপন্থীও একাধিক ছিল। খ্রিস্টান-মুসলমানও ছিল। এদের কেউ কেউ সমবেত উপাসনায় বেদমন্ত্র উচ্চারণ করতে অনিচ্ছুক। খ্রিস্টান ছেলেটির আপত্তি ছিল না কিন্তু সেই চার্বাকপন্থী তাকে বোঝাল খ্রিষ্টানের সর্বপ্রার্থনা যিশুর মারফত পাঠাতে হয়, বেদমন্ত্রে তা হয় না; এবং মুসলমানকে আল্লা-রসুলের দোহাই দিল। খ্রিস্টান ধাঁধায় পড়ল, মুসলমান বলল, পাঁচ বেককে সাত বেকৎ করতে তার আপত্তি নেই, কিন্তু বেদমন্ত্রদ্বারা উপাসনা করছে এ খবর পেলে তার পিতা অসন্তুষ্ট হবেন।
নাচার অধ্যক্ষ বিধুশেখর সিদ্ধান্তের ভার ছেড়ে দিলেন পাদ্রি এজের হাতে।
এন্ড্রুজ আবেগ-ভরা কণ্ঠে বিশ্বমানবিকতার শপথ নিয়ে বেদমন্ত্রের সর্বজনীনতা ব্যাখ্যা করলেন। আস্তিক-নাস্তিক সকলেই সম নতমস্তকে তার বক্তব্য শুনল। কিন্তু সংশয়বাদী তথা নাস্তিকদের মত পরিবর্তন হল না।
রবীন্দ্রনাথ ছাত্রছাত্রীদের সমবেত উপাসনায় যোগ দিতে বাধ্য করলেন না।
ক্ষিতিমোহন সমাজে সংস্কারমুক্ত ছিলেন বলে কেউ যেন মনে না করেন তিনি। শুচি-অশুচির পার্থক্য করতেন না। কিন্তু তাঁর কষ্টিপাথর মনু এমনকি ঋগ্বেদ থেকেও তিনি আহরণ করেননি। বেদ থেকে নিশ্চয়ই, কিন্তু সেটি আয়ুর্বেদ। একে তিনি বৈদ্যকুলোব, তদুপরি তিনি গভীর মনোযোগ সহকারে আয়ুর্বেদ অধ্যয়ন করেছিলেন; আহারবিহার তিনি তাই আয়ুর্বেদসম্মত পদ্ধতিতেই করতেন।
প্রাচীন-অর্বাচীন নিয়ে তার ব্যক্তিগত জীবনে কোনও দ্বন্দ্ব ছিল না। উপনিষদের বাণীর সন্ধান তিনি অহরহ পাচ্ছেন আউল-বাউলে। আবার আউল-বাউলের আচার-আচরণ তিনি পাচ্ছেন অথর্ববেদে। তার সম্মুখে বহু পন্থা, তিনি সবকটিতেই বিশ্বাস করেন।
তিনি ছিলেন বিধুশেখর ও রবীন্দ্রনাথের মাঝখানে সেতুম্বরূপ– এন্ড্রুজ যেরকম ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও গাঁধীর মাঝখানে। তিনি এ যুগে সনাতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের অসম্ভব আদর্শে বিশ্বাস করতেন না, আবার সখা বিধুশেখরের নিষ্ঠায় শ্রদ্ধাবান ছিলেন বলে তাকে সমর্থন করতে পারলে আনন্দিত হতেন। বিশ্বভারতীর আদর্শ, তার ধ্যানলোকের ঐতিহ্যের সন্ধানে বিধুশেখর শরণ নিতেন ঋগ্বেদের, আশ্রমের পাল-পার্বণের জন্য মন্ত্রসন্ধানে ক্ষিতিমোহন যেতেন অথর্ববেদে।
আজ বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় সরকারের অর্ধদানের ওপর নির্ভর করে, কিন্তু তার মূল্য যতই হোক না কেন, বিধুশেখর-ক্ষিতিমোহন যে মূলধন তাদের গুরুদেবের পদপ্রান্তে রেখেছিলেন তার ওপর নির্ভর করে চিন্ময় মৃন্ময় ধ্যানে এবং কর্মকাণ্ডে অদ্যকার ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিশ্বভারতী। অদ্য বাজশতান্তে সে যতই পরিবর্তিত হোক না কেন, এদের কাছে বিশ্বভারতী চিরঋণী।
———-
১. এদের ছাড়া আরও বহু পণ্ডিতের নাম করতে হয়। তাদেরই একজন কোষকার স্বর্গত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ইনি যৌবনকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শান্তিনিকেতনেই বসবাস করেন। অন্যজন ভগবদ্কৃপায় এখনও আমাদের মাঝখানে আছেন। গোস্বামীরাজ নিত্যানন্দবিনোদ। ইনি। ১৯২০/২১ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিস্তর শাস্ত্রালোচনা করেন।
২. বিধুশেখরের পালি ও আবেস্তাচর্চা, ক্ষিতিমোহনের পালিচর্চায় রবীন্দ্রনাথই প্রধান উৎসাহদাতা। হয়তো-বা ভুল বলা হবে না, রবীন্দ্রনাথের আদেশেই বিধুশেখর আবেস্তাচর্চা আরম্ভ করেন।