রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী – পান্নালাল দাশগুপ্ত
১৯২১—২২ সালে গান্ধীজীর সাথে রবীন্দ্রনাথের এক বিরাট বিতর্ক হয়। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ বিদেশে। দেশে ফিরবার পথে তিনি রোঁমা রোঁলার কাছে বলেন যে, তিনি দেশে ফিরে গান্ধীজীকে সর্বপ্রকারে সমর্থন করবেন। কিন্তু তিনি গান্ধীজীর আন্দোলনের রূপ দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। গান্ধীজীর জীবনাদর্শ, কর্মপন্থা, কর্মোদ্যম, প্রত্যেক ব্যাপারেই কবিগুরুর মতানৈক্য ঘটলো। প্রথমতঃ তিনি বললেন, গান্ধীজীর এতটা অসহযোগিতাকে বা নন—কোঅপারেশন আন্দোলনের নেতিবাচক ভাবকে তিনি সমর্থন করেন না। ভারতের যা অবস্থা তাতে পশ্চিমের সভ্যতার সাথে সহযোগিতা করেই ভারত মুক্ত হতে পারে, কিন্তু গান্ধীজীর স্বাধীনতা আন্দোলন যত সমর্থনযোগ্যই হোক, তাতে এত বেশি পশ্চিম—বিরোধিতা আছে যে তাতে ভারত আরো পিছিয়ে পড়বে। পশ্চিমের যন্ত্রসভ্যতা ও বিজ্ঞানকে অকুতোভয়ে গ্রহণ করতে হবে। ভারতকে পশ্চিমের সভ্যতার ঐশ্বর্য্যকে আপন করে নিতে হবে। কিন্তু গান্ধীজী চরকা ও গ্রামীণশিল্পকে নিয়েই ভারতকে খুশি থাকতে বলেছেন, এতে ভারত এগোতে পারবে না। তাছাড়া জ্ঞানবিজ্ঞানবিমুখতাও সৃষ্টি হচ্ছে গান্ধী—আন্দোলনের ফলে। একটা অতীত—প্রীতি বা রিভাইভালজম হচ্ছে চারদিকে থেকে। পুরানো সভ্যতার উপর অযথা একটা পিছুটান থেকে যাচ্ছে। গান্ধীজীর অহিংসার বাণী ভারতেরই শেষ্ঠ কথা হলেও, গান্ধীজী অহিংসাকে একটা অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করাতে অহিংসার আদর্শও ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। অহিংসাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করাও হিংসারই নামান্তর। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের জীবন—আদর্শও গান্ধীজীর মতো কৃচ্ছ্রসাধন ও বৈরাগ্যধর্মী নয়। তিনি বলেছেন, ”বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়।” ঐশ্বর্য্যবান জীবনই তাঁর কাছে শ্রেয়। গান্ধী—আন্দোলনে বৈরাগ্য ও কৃচ্ছ্রসাধন ও ধর্মান্ধতার ঝোঁক বর্তমান। একটু বিশদভাবে একটা একটা করে এইসব অভিযোগগুলির বিচার করবো এবার। কারণ কেবলমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই গান্ধীজীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নয়, পশ্চিমীসভ্যতায় শিক্ষিত ভারতবাসী মাত্রেরই। তাছাড়া সোশিয়ালিষ্ট, কমিউনিষ্ট প্রভৃতি সকলেরই নালিশ গান্ধীজীর বিরুদ্ধে এই জাতীয়। স্বয়ং পণ্ডিত জহওহরলাল পর্যন্ত তাঁর আত্মজীবনীতে গান্ধীজীর বিরুদ্ধে এই সংশয় ও আশংকা বার বার প্রকাশ করেছেন। গান্ধীজীকে তাই শুধু রবীন্দ্রনাথকেই উত্তর দিতে হয়নি, সমস্ত প্রগতিশীল আন্দোলন ও নেতাদের এই জাতীয় আক্রমণ তাঁকে জীবনভরই সহ্য করতে হয়েছে; এবং পরে দেখাবো, এই আক্রমণ ও প্রতিরোধের সংগ্রামের গান্ধীবিরোধীরা কতটা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। উভপক্ষই যে যাঁর মৌলিক ধারণা নিয়ে স্থির হয়ে বসেছিলেন, তাই নয়, দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উভয়দলই উভয় দলের অনেক কথা মানতে বাধ্য হয়েছেন।
প্রথমে চরকা সম্বন্ধেই আলোচনা করা যাক। রবীন্দ্রনাথ এই চরকাসভ্যতায় ফিরে যেতে প্রস্তুত নন। চরকায় অতিরিক্ত শ্রমমহিমা দেওয়া হয়েছে। তিনি মনে করেন, গান্ধীজীর এই চরকাআন্দোলন ‘কুলিগিরির’ সাধনা মাত্র ও বিজ্ঞান—বিমুখতার নিদর্শন। (৪০৫—৬, ২৪’শ খণ্ড রবীন্দ্র রচনাবলী বিশ্বভারতী সংস্কারণ) শ্রম মহিমায় ”কেবল তার করাই চলতে থাকবে, মানুষের জানা এগিয়ে চলবে না।” বিজ্ঞানের ”চাকা অসংখ্য শূদ্রকে শূদ্রত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে।” (ঐ, পৃষ্ঠা ৪০৬) আমাদের জনতার এই পশুর মতো মেহনত করা থেকে রক্ষা পাবার একমাত্র উপায় হলো বিজ্ঞান ও যন্ত্রকে রক্ষা করা। চরকাসভ্যতায় জীবনের দারিদ্র ও কৃপণকে পূজা করা হচ্ছে। মানুষের মন তাতে কখনো সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। তিনি বলেন, ”ভূমৈব সুখম নাল্পে সুখমস্তি”। এই ভূমার আবেগ মানুষকে নিরন্তর বেড়ে চলবার প্রেরণা দিয়ে চলেছে, একে খর্ব করলে মানুষের ঐশ্বর্যবোধ নষ্ট হয়। কৃপণতার উপাসনা ও কৃচ্ছ্রসাধনের বিড়ম্বনায় ভারত বহু ভুগেছে। আর নয়, তাকে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এবারে পশ্চিমের সাথে সমান তালে এগিয়ে যেতে হবে। শৌর্য্যের বীর্য্যের ঐশ্বর্য্যের ভারতকে তিনি দেখতে চান। অতএব চরকার বাণী তিনি গ্রহণ করতে রাজী হলেন না, এবং দেশবাসীকে তা গ্রহণ করতে তিনি এক রকম নিষেধই করলেন।
গান্ধীজী রবীন্দ্রনাথকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন এবং গুরুদেব বলে অভিহিত করতেন। কিন্তু গান্ধীজী রবীন্দ্রনাথের সম্যক উত্তর দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি। তিনি তেজস্বিতার সাথে ও যুক্তির সঙ্গে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও চরকা ধরতে বললেন, আমরা সেকথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। তিনি দেখালেন, রবীন্দ্রনাথ মহান ভারতের ছবি দেখাচ্ছেন বটে, কিন্তু তিনি বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সম্যক পরিচিত নন। যে দারিদ্র্য ভারতের কোটি কোটি জনতাকে অন্নহীন, বৃত্তিহীন, বস্ত্রহীন করে ছেড়েছে, তাতে বিজ্ঞানের ও যন্ত্রের স্বপ্ন দেখলেই তার সমাধান হয় না। রোঁমা রোঁলা যেমন বলেছেন যে, ‘‘The problem is not an academic one but practical and pressing’’.
বছরে প্রায় ছয় মাস যারা নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকে তাদের হাতে কাজ যোগাড় করে দেওয়ার উপায় বর্তমানে চরকা ছাড়া অন্য কিছুতেই তিনি দেখতে পাননি। কেউ যদি তা দেখাতে পারেন, তিনি তা গ্রহণ করতেও রাজী আছেন। যে যন্ত্র ও বিজ্ঞানের কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সে যন্ত্র ও বিজ্ঞান জনতার হাতে দেবে কে? ইংরেজ দেবে না, দেশীয় ধনীরা তা দিতে পারে না, জনসাধারণের তা গ্রহণ করার শক্তির বাইরে। আমরা আজ বুঝতে পারি যে, যন্ত্র চাই বললেই যন্ত্র নেওয়া সম্ভব হয় না, সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্র দেশকে শিল্পায়ত করতে পারে না, যন্ত্রসভ্যতা যদি ভারতে ব্যাপকভাবে সকলের জন্য গ্রহণ করতে হয় তাহলে ঐসব সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থায় করা সম্ভব নয়, সমাজতন্ত্র ছাড়া অন্য কিছু সকলের স্বার্থে সকলকে যন্ত্র দিতে পারে না। কোন সামাজিক ব্যবস্থায় ভারতের জনতা শোষণহীন যন্ত্রসভ্যতা গ্রহণ করতে পারে, আশ্চর্যের বিষয়, রবীন্দ্রনাথ সে সম্বন্ধে কোনকথা বলে যান নি। এখানেই তার চিন্তার প্রকাণ্ড ফাঁক ধরা পড়ে। তিনি সেই যুগে সাম্রাজ্যবাদ কি তা ধরতে পারেন নি, সাম্রাজ্যবাদের যন্ত্রসভ্যতা ভারতের শিল্পকে চূর্ণ করে দিয়েছে এবং ভারতের শিল্পশক্তিকে পুনর্জাগরিত হতে দিচ্ছে না, দিতে পারে না, এমন জ্বাজ্যল্যমান কথাটা তিনি ধরতে পারেননি কি? শুধু তিনি কেন, তথাকথিত প্রগতিবাদী পশ্চিমীবাদী মাত্রেই এই ফাঁকটা ধরতে পারেননি বা ধরতে চাননি! তাঁরা বিজ্ঞান, যন্ত্র ইত্যাদি শক্তিগুলিকে নির্বস্তুক উপায়ে বা abstract উপায়ে ভাবতে চান। কোন সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থায় বিজ্ঞান ও যন্ত্র একটা উপনিবেশ গ্রহণ করতে পারে, এই কথাগুলো না বুঝে কেবল বৈজ্ঞানিকতার দোহাই দেওয়া সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ও অবাস্তব। ফলে দেখা গেছে ঐ সমস্ত বিজ্ঞানবাদীদের বক্তব্যটা এখন উড়ো কথায় পরিণত হতো মাত্র। সেটা একটা ফ্যাশন বা আধুনিকতার মোহ হয়ে দাঁড়াতো মাত্র। আমরা পূবেই দেখিয়েছি, গান্ধীজী বিজ্ঞান—বিরোধী ছিলেন না। বরং যা বাস্তব, যা সকলের জন্য সম্ভব এবং যা শোষণ ও অত্যাচারের হাতিয়ার হয়ে বসবে না, এমনভাবে বিজ্ঞানকে গ্রহণ করতে তিনি কারো চেয়ে কম আগ্রহী ছিলেন না। তিনি বলেছেন, ‘‘If we should have electricity in every village home, I should not mind villages playing their implements and tools with the help of electricity. But then the village communities or the state would own power-houses just as they have their grazing pastures. But where is no electricity what are the idle hands to do?’’
”যদি গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয় তবে গ্রামবাসীরা তাঁদের কাজকর্ম ও যন্ত্রপাতিতে বিদ্যুৎ ব্যবহারের করবেন, এতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তার পূর্বে দেখতে হবে যে গ্রামবাসীদের যেমন পশুচারণ ভূমি আছে তেমনি তাঁদের জন্য নিজেদের পরিচালিত বিদ্যুতাগার আছে অথবা সরকার থেকে তার ব্যবস্থা হয়েছে। তার পূর্ব্বে তাঁরা তাঁদের অলস সময়গুলিতে কি করবেন?”
এ জাতীয় প্রশ্নের উত্তর তথাকতিত বিজ্ঞানবাদীরা কেউ দিতে পারেন নি। এই আলস্য—পীড়িত দারিদ্রপীড়িত হতভাগ্য গ্রামবাসীদের অবস্থার সম্যক বিচার না করে বিজ্ঞানের নামে কুটিরশিল্পকে নিন্দে করা কার্য্যতঃ বিদেশী সম্রাজ্যবাদকেই জিইয়ে থাকার সাহায্য করে মাত্র এবং বিজ্ঞানের সাহায্য হয় না। অথচ গান্ধীজীকে যদি বলা হয়, তিনি কৃচ্ছ্রতাবাদী, অর্থাৎ বৈরাগ্য সাধন করতে ভারতকে বলছেন, তবে তার চেয়ে অন্যায় আর হয় না। তিনি কতবার কতরকমে বলেছেন, ভগবানকে যদি আজ দরিদ্রের কাছে উপস্থিত হতে হয়, তবে তাঁকে অন্নরূপে আবির্ভূত হতে হবে। তিনি জানতেন দারিদ্রের মধ্যে কতখানি গ্লানি আছে। তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একমত যে ত্যাগের দারিদ্রই ভূষণ, অভাবের দারিদ্র কুৎসিত। তিনি দরিদ্রকে কিভাবে দুটি পয়সা, দুটি অন্ন যোগাড় করে দিতে পারেন সেকথাই জীবনভর ভেবে গেছেন। আমরা পূর্ব্বেও দেখিয়েছি যে কার্য্যক্ষেত্রে গান্দীজি এদেশীয় মার্কসবাদীদের চেয়েও অথনৈতিক প্রয়োজনীয়তায় মূল্য বেশি বুঝতেন। তিনি ইকনমিক—প্রোগ্রাম নিয়ে জনতার কাছে উপস্থিত হতেন। ভাববাদী আইডিয়া সম্বল করে অগ্রসর হতেন না। তিনি দরিদ্রকে অন্ন বিতরণের সাহায্য করতে চাননি, তিনি মনে করেন, দানখয়রাতিতে তাদের আরো অধঃপতন হবে মাত্র, তাই তিনি কাজ দিতে চেয়েছেন। তাই রবীন্দ্রনাথ যখন গানের, ঐশ্বর্য্যের স্বপ্ন তৈরি করেছেন, তখন গান্ধীজী তেজস্বিতার সঙ্গে তাঁকে উল্লেখ করেই বলেছেন, ‘‘When all about us are dying for want of food, the only occupation permissible for me is to feed the hungry. India is a house on fire. It is dying of hunger because it has no work to buy food with. Khulna is starving. The ceded disticts are passing successively through a fourth famine. Orrisa is a land suffering from chronic famine. India is going daily poorer. The circulation about her feet and legs has almost stopped. And if we do not take care, she will collapse altogether……
‘‘To a people amishing and idle, the only acceptable form in which God can dare appear is work and promise of food as wages. God created man to work for his food and said that those who ate without work were thieves. We must think of millions who to-day are less than animals, almost in a dying state. Hunger is the argument that is drawing India to spinning wheel.
‘‘The poet lives for the morrow, and would have us to do likewise. He presents to our admiring gaze the beautiful picture of the birds in the early morning singing hymns of praise as they soar into the sky. Those birds had their day’s food and soared with rested wings in whose veins new blood had flown the previous night. But I have had the pain of watching birds who for want of strength could not be coaxed even into a flutter of their wings. The human bird under the Indian sky gets up weaker than when he pretended to retire. For millions it is an eternal vigil or an eternal trance. I have found it impossible to soothe the suffering patients with a song from Kabir.
‘‘Give them work that they may eat ! Why should I, who have no need to work for food, spin ?’ May be the question asked. Because I am eating what does not belong to me. I am living on the spoilaiton of my coutrymen. Trace the source of every coin that finds its way into your packet, and wou will realize the truth of what I write. Every one must spin. Let Togore spin, like the others. Let him burn his foreign clothes ; that is the duty to-day. God will take care of the morrow. As it says in Gita, Do right!’’ (Tagore ‘‘Great Sentinel’’, Young India, Oct. 13, 1921, Romain Rolland—‘‘Mahatama Gandhi’’ pp. 111.)
Non-cooperation বা অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথ বিরূপ হয়ে পড়লেন। কেন না তাঁর কাছে বিশ্বমানবতা এবং পূর্ব ও পশ্চিমের মিলনের স্বপ্ন তখন অত্যন্ত প্রবল। তিনি মনে করলেন স্বদেশী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিদেশীদের ‘বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ভারত কূপমণ্ডূকই থেকে যাবে। পশ্চিমের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করে রাখা তিনি কর্তব্য বলে মনে করতেন এবং বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বমানবতার পূজারী রবীন্দ্রনাথের কাছে স্বদেশী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনও একটা প্রতিক্রিয়া আন্দোলন বলে মনে হলো। ফলে তিনি রাজনৈতিক আন্দোলন থেকেই দূরে রয়ে গেলেন। অবশ্য ১৯০৮ সালেই তিনি রাজনীতি প্রত্যক্ষভাবে ত্যাগ করেছিলেন। অবশ্য গান্ধীজী ভারতে পদার্পণ করার সাথে সাথে তিনি আবার রাজনৈতিক কাজে নামতে চেয়েছিলেন বলে মনে হয়, কিন্তু অসহযোগের দুর্বার বিদেশীবর্জন ও চরকা গ্রহণের ছবি দেখে তিনি আবার পিছিয়ে গেলেন। তাঁর মনে হলো আন্তর্জাতিকতার নীতি এতেই নেই। কিন্তু এখানেও রবীন্দ্রনাথ অবাস্তব ও স্বপ্নবিলাসী মাত্র বলে প্রমাণিত হলেন। গান্ধীজীও বিশ্বমানবতায় বিশ্বাস করতেন, তিনিও ভারতকে কূপমণ্ডক করতে চাননি। কিন্তু বিশ্বামনবতা ও আন্তর্জাতিকতা স্থাপন করতে হলে কেবল ঐক্যের কথাটাই ভাসাভাসা ভাবে ভাবলে চলে না, বর্তমান পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ বিরোধগুলিকে অস্বীকার করলে চলবে না। সাম্রাজ্যবাদ পৃথিবীকে যেভাবে খণ্ড বিখণ্ড করে নিজেদের কুক্ষিগত করেছে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করে, তাকে পরাস্ত না করে, এই আন্তর্জাতিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করা যায় না এবং বিশ্বমানবতার abstract ডাক একটা নিস্ফল স্বপ্নে পরিণত হয় এবং অনেক প্রকার কপট বিশ্বপ্রেমের সৃষ্টি করে। যে ন্যাশনাল বা জাতীয় ও ক্লাস কনট্রাডিকশনগুলি বা শ্রেণি বৈষম্যগুলি আছে, তার সমাধান না করে উপর থেকে এক—বিশ্ব বা ঐক্য সৃষ্টি করা যায় না। যাঁরা মার্কসবাদী, তাঁদের একথা সবচেয়ে আগে বোঝা উচিত। অথচ তাঁরাও এদেশে এমন মোহগ্রস্ত হয়েছিলেন যে সাম্রাজাবাদ বিরোধী যে জাতীয়তার সংগ্রাম গান্ধীজী উঠিয়েছিলেন, তাকে কূপমণ্ডূকতা ও বুর্জোয়া জাতীয়তা মনে করে তাঁরাও গান্ধীজীর বিদেশি বর্জন ও স্বদেশী—আন্দোলনকে প্রাণ খুলে সমর্থন করতে পারেননি। মার্কসবাদীদের পক্ষে যদি এ ভুল করা সম্ভব হয়, তবে কবি রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এমন ভুল করা অসম্ভব হবে কেন? কবিধর্মী স্বপ্নচারী রবীন্দ্রনাথ তাই সংগ্রামকে আশংকার চোখে দেখতেন। যে কোন উপায়ে সকলে মিলিত হয়ে যাক, এমনি ধরনের একটা ভালোমানুষীভাব তাঁকে পেয়ে বসেছিল। ফলে তিনি ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করতে পারেননি। তাই বলে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমানবতার বাণীটি ব্যর্থ বা ভুল, তা নয়। কিন্তু বাস্তবতার দিক থেকে তা একপেশে ও স্বপ্নবিলাসী।
অনেকে বলেন এবং রবীন্দ্রনাথ নিজেও বলেছেন যে তিনি কবি, তাঁর পক্ষে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। তিনি কাব্যের মধ্য দিয়েই সত্যকে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন এবং তা সম্ভব এমন প্রত্যয়ও তাঁর ছিল কবি হলেই যে রাজনীতিতে থাকতে পারেন না, এমন কোন কথা নেই। আসলে তাঁর চিন্তাধারা ছিল অন্যরকম। তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনের গূঢ়তম তাৎপর্যটা ধরতে পারেননি। ফলে পশ্চিমের সম্পর্কে, ইংরেজের সম্পর্কে, বিশ্বমানবতা ও বিজ্ঞানের দিক থেকে ভ্রমাত্মক ধারণায় তিনি কিছুটা প্রভাবাম্বিত ছিলেন। কিন্তু শেষ বয়সে তিনি তাঁর ভ্রমটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। মিস রথবোনের কাছে লেখা চিঠি, সভ্যতার সংকট, এবং বিভিন্ন কবিতায় তাঁর সেই পূর্বেকার ভ্রম ও ইলিউশন কেটে গেছে বলে আমরা দেখতে পাই। তখন তিনি গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে তথাকথিত পশ্চিমী বিজ্ঞান সভ্যতাকে কোন গভীর ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। জাপানের কবি নোগুচির কাছে লেখা পত্রেও সেকথা উল্লিখিত আছে। কাজেই জীবনের মধ্যভাগে রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি থেকে সরে থাকার অযৌক্তিকতার দায় থেকে কেবলমাত্র কবি বলেই তাঁকে রেহাই দিতে পারা যায় না, নিরপেক্ষ ইতিহাসের বিচারে। একথা দ্বারা অবশ্য বোঝায় না যে জাতীয় আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের দান নেই। রবীন্দ্রনাথ জাতীয় আন্দোলনে অনেক কিছু দিয়ে গেছেন, বিশেষকরে ভাবের দিক থেকে ভাষার দিক থেকে, প্রাণ সম্পদের দিক থেকে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতিভা তাঁর লেখনীর সর্বশক্তি দিয়ে জাতীয় সংগ্রামকে যদি শক্তিমান করতে চাইতেন তবে আরো অনেক কিছু দিতে পারতেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। অথচ তিনি অনেক সময় অভিমানে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে গেছেন। এবং অনেক সময় নিরুৎসাহও করেছেন। সমস্ত দেশ যখন অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে মত্ত, তখন তিনি এমনও বলেছেন, ‘‘It is criminal to transform moral force into a force.’’ (Modern Review, 1924)
এই থেকেই তাঁর গান্ধী সংগ্রামের প্রতি বিরূপতা দেখা যায় কিন্তু তার বদলে রক্তাক্ত সংগ্রামকে চেয়েছেন, এমন নয়। তিনি রাজনৈতিক সংগ্রামটাকেই এড়াতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, দেশ দখল নয়, দেশ গঠন কর। গান্ধীজীও বলেছেন যে দেশের স্বাধীনতা গঠন কর। কিন্তু দুয়ের মধ্যে কত পার্থক্য! গান্ধীজীর গঠনকর্ম সংগ্রামেরই প্রোগ্রাম, আর রবীন্দ্রনাথের গঠনকর্ম সংগ্রাম এড়াবার প্রোগ্রাম। এই সংগ্রামকে কূপমণ্ডূপ, বিদ্বেষ—প্রসূত, বিজ্ঞানবিমুখ ও বিশ্বমানবতা বিরোধী ইত্যাদি ভারী ভারী কথার চাপে রিভাইভালজম বা পুনর্জাগরণ বলে নিন্দিত করা যায় কি? গান্ধীজীর সাথে রবীন্দ্রনাথের তৎকালীন তর্কটা বুঝবার জন্য রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি কথা তুলে দিচ্ছি এখানে:
”স্বরাজ সাধনের নাম করে তেত্রিশ কোটি লোককে চরকা কাটতে বলা, জগন্নাথকে বিলিতি বেগুন দেওয়া। আশা করি ভারতবর্ষে তেত্রিশ কোটি গুপী বেহারা নেই।” (রবীন্দ্ররচনাবলী, ‘চরকা’ ২৪ খণ্ড, পৃঃ ৪০৭)
(গুপীবেহারা নামক চাকরটি জগন্নাথকে একটি টমেটো দিয়েই ফলদানের দায় থেকে মুক্ত হয়েছিল, কারণ জগন্নাথকে যে ফল দেওয়া হয়, তা নাকি আর খাওয়া নিষেধ।)
”দেশশুদ্ধ লোক মিলে তাদের গায়ে যদি থুথু ফেলে তবে কামানবন্দুক সমেত তাদের ভাসিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এই থুথু ফেলাকে বলা যেতে পারে, দুঃখগম্য তীর্থের সুখসাধ্য পথ। আধুনিককালের বিজ্ঞানাভিমানী যুদ্ধপ্রাণালীর প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশের পক্ষে এমন নিখুঁত অথচ সরল উপায় আর নেই, একথা মানি। আর এ—ও না হয় আপাততঃ মেনে নেওয়া গেলো যে, এই উপায়ে সরকারী থুৎপ্লাবনে গোরাদের ভাসিয়ে দেওয়া অসম্ভব নয়; তবু মানুষের চরিত্র যারা জানে, তারা এটাও জানে যে, তেত্রিশ কোটি লোক একসঙ্গে থুথু ফেলবেই না। দেশের দৈন্য—সমুদ্র সেঁচে ফেলবার উদ্দেশ্যে চরকা চালানো সম্বন্ধেও ঐ কথা বলা চলে।” (রবীন্দ্ররচনাবলী ২৪শ খণ্ড, পৃঃ ৪০৮)
অবসর সময়টি চরকা কাটায় নিযুক্ত করার বিরুদ্ধে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাকে ভাতের ফেন ফেলে না দেওয়ারও মতো একটা আন্দোলনের সামিল মনে করতেন।
”স্বরাজ যদি প্রথমেই দীর্ঘকাল কেবল চরকার সুতো আকারেই দেখতে থাকি তা হলে আমাদের সেই দশাই হবে। এই রকম অন্ধ সাধনায় মহাত্মার মতো লোক হয়তো কিছুদিনের মতো আমাদের দেশের একদল লোককে প্রবৃত্ত করতে পারেন, কারণ তাঁর ব্যক্তিগত মাহাত্মের উপর তাদের শ্রদ্ধা আছে। এইজন্য তাঁর আদেশ পালন করাকেই অনেকে ফললাভ মনে করে। আমি মনে করি এরকম মতি স্বরাজ লাভের অনুকূল নয়।” (২৪শ খণ্ড, ‘স্বরাজসাধন’, পাতা ৪২০)।
”দেশের সকল শক্তির জাগরণেই দেশের জাগরণ, এবং সেই সর্বতোভাবে জাগরণই মুক্তি। মহাত্মাজীর কণ্ঠে বিধাতা ডাকবার শক্তি দিয়েছেন, কেননা তাঁর মধ্যে সত্য আছে, অতএব এইতো ছিল আমাদের শুভ অবসর। কিন্তু তিনি ডাক দিলেন একটি মাত্র সঙ্কীর্ণ ক্ষেত্রে। তিনি বললেন সকলে মিলে কেবলমাত্র সুতো কাটো, কাপড় বোনো। এই ডাক কি সেই ‘অয়ন্তু সর্বতঃ স্বাহা?’ এই ডাক কি নবযুগের মহাসৃষ্টির ডাক?” (সত্যের আহ্বান—২৪শ খণ্ড, পৃঃ ৩৩৩)।
আবার গান্ধীজী যে সত্যি সত্যি একজন ‘মহাত্মা’, সত্যিকার আবির্ভাব ভারতের জন্য, এ সত্য বুঝতেও রবীন্দ্রনাথের কোন সময় লাগে নি, তাই লিখছেন ১৯২০ সালেই, গান্ধীজীকে সাক্ষাৎ না দেখেই, ”বহুদিন ধরে আমাদের পোলিটিক্যাল নেতারা ইংরেজী পড়ার বাইরে তাকাননি। কেননা তাঁদের দেশ ছিল ইংরেজী ইতিহাস পড়া পুঁথিগত দেশ। সে দেশ ইংরেজি ভাষার বাষ্পরচিত একটা মরীচিকা, তাতে বার্ক, গ্ল্যাডস্টোন, ম্যাটসীনি, গ্যারিবল্ডির অস্পষ্ট মূর্তি ভেসে ভেসে বেড়াতো। তার মধ্যে প্রকৃত আত্মত্যাগ বা দেশের মানুষের প্রতি যথার্থ দরদ দেখা যায় নি। এমন সময় মহাত্মা গান্ধী এসে দাঁড়ালেন ভারতের বহুকোটি গরীবের দ্বারে, তাদেরই আপন বেশে। এবং তাদের সঙ্গে কথা কইলেন তাদেরই ভাষায়। এ একটা সত্যিকার জিনিস ও এরমধ্যে পুঁথির কোন নজির নেই। এইজন্য তাঁকে যে মহাত্মা নাম দেওয়া হয়েছে, এ তাঁর সত্য নাম। কেননা, ভারতের এত মানুষকে আপনার করে আর কে দেখেছে? আত্মার মধ্যে যে শক্তির ভাণ্ডার আছে, তা খুলে যায় সত্যের স্পর্শে। সত্যকার প্রেম ভারতবাসীর বহুদিনের রুদ্ধদ্বারে যে মুহূর্তে এসে দাঁড়ালো অমনি তা খুলে গেলো। কারো মনে আর কার্পণ্য রইল না, অর্থাৎ সত্যের স্পর্শে সত্য জেগে উঠল। চাতুরি দ্বারা যে রাষ্ট্রনীতি চালিত হয় সে—নীতি বন্ধ্যা। অনেকদিন থেকে আমাদের শিক্ষার দরকার ছিল। সত্যের যে কী শক্তি, মহাত্মার কল্যাণে আজ তা আমরা প্রত্যক্ষ দেখছি।” (রবীন্দ্ররচনাবলী, ২৪শ খণ্ড, পৃঃ ৩২৬।)
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মহাত্মা সম্বন্ধে আশঙ্কিত কম ছিলেন না, তা পূর্বেই দেখিয়েছি। আরো দেখুন তিনি বলছেন, ”অর্থশাস্ত্রকে বহিষ্কৃত করে তার জায়গায় ধর্মশাস্ত্রকে জোর করে টেনে আনা হলো। অপবিত্র (বিদেশি বস্ত্র অপবিত্র) কথাটা ধর্মশাস্ত্রের কথা, অর্থের নিয়মের উপরের কথা।” (রবীন্দ্ররচনাবলী, ২৪শ খণ্ড, পৃঃ ৩৩৫।)
”আজ এই বিশ্বচিত্ত উদ্বোধন প্রভাতে আমাদের দেশে কোনো জাতীয় প্রচেষ্টার মধ্যে যদি বিশ্বের সর্বজনীন কোনো বাণী না থাকে তাহলে তাতে তাদের দীনতা প্রকাশ করবে। আমি বলছিনে, আমাদের আশু প্রয়োজনের যা কিছু কাজ আছে তা আমরা ছেড়ে দেবো। সকাল বেলার পাখি যখন জাগে তখন কেবলমাত্র আহার অন্বেষণে তার সমস্ত জাগরণ নিযুক্ত থাকে না, আকাশের আহ্বানে তার দুই অক্লান্ত পাখা সাড়া দেয় এবং আলোকের আনন্দে তার কণ্ঠে গান জেগে ওঠে। আজ সর্বমানবের চিত্ত আমাদের ডাক পাঠিয়েছে, আমাদের চিত্ত আমাদের ভাষায় তার সাড়া দিক, কেননা ডাকের যোগ্য সাড়া দেওয়ার ক্ষমতাই হচ্ছে প্রাণশক্তির লক্ষণ। একদা যখন পরমুখাপেক্ষী পলিটিকসে সংসক্ত ছিলুম, তখন আমরা কেবলই পরের অপরাধের তালিকা আউড়ে পরকে কর্তব্যত্রুটি স্মরণ করিয়েছি, আজ যখন পরপরায়ণতা থেকে আমাদের পলিটিক্স ছিন্ন করতে চাই, আজও সেই পরের অপরাধ জপের দ্বারাই আমাদের বর্জন নীতি পোষণ করতে চাচ্ছি।” (রবীন্দ্ররচনাবলী, ২৪শ খণ্ড, পৃঃ ৩৩৯।)
গান্ধীজীর সঙ্গে এই বিতর্ক রবীন্দ্রনাথ অবশ্য আর চালান নি, কিন্তু রবীন্দ্রোত্তর অনেক তথাকথিত প্রগতিবাদী ও তথাকথিত বিপ্লববাদীরা গান্ধীজীর বিরুদ্ধে এই সুর বরাবরই রক্ষা করে গেছেন এবং আজও হয়তো করছেন। তবে আজকাল কমিউনিষ্ট সোশিয়ালিষ্টরাও কুটিরশিল্পের মধ্যে প্রতিক্রিয়াই দেখেন না। এটা সৌভাগ্যের বিষয় এবং স্বদেশী আন্দোলনের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রয়োজনীয়তা তাঁরা বুঝতে পারেন। একথাও তাঁরা আজ হয়তো বুঝতে পারেন যে, যন্ত্র চাই বললেই যন্ত্র হয় না, তার জন্য সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার হয়, দেশের স্বাধীনতার প্রয়োজন হয়, জনগণের হাতে—রাজ্যভার আসার দরকার হয়, এবং সমাজতন্ত্রের প্রয়োজন হয়। এখানে একথাও বলে রাখা দরকার, রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিকচেতনা, সাম্রাজ্যবাদের অবসান, সামন্ত্রতন্ত্র, জমিদারী—প্রথা ধনতন্ত্র প্রভৃতির অবসান চাওয়া পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তিনি কখনো সমাজতন্ত্র চাইতেন কিনা একথা শোনা যায় নি, এ সম্বন্ধে তিনি নীরব এমন কি ‘রাশিয়ার চিঠি’ নামক বইতেও একথা তিনি স্পষ্ট করে বলেন নি। অথচ গান্ধীজীর এসব সম্বন্ধে কত স্পষ্ট মতামত রয়েছে এবং তার জন্য তিনি সংগ্রাম করেছেন জীবনভর। এই থেকে বুঝতে হবে বাস্তবে বিজ্ঞানের নাম করেও রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট সমাজবিজ্ঞানী হতে পারেন নি। অথচ গান্ধীজী সর্বদা ‘রাম—নাম’ করলেও কার্যক্ষেত্রে বৃহত্তম সাম্রাজ্যবাদের অবসান ও ভারতের জনতার মুক্তির প্রয়োজনে সবচেয়ে বেশি দান করে গেছেন এবং ভারতকে বিজ্ঞানের পথে শোষণহীন সমাজের পথে এগিয়ে যেতে প্রভূত শক্তি দিয়ে গেছেন।
ভাবধারার দিক থেকে গান্ধীজীর সাথে রবীন্দ্রনাথের অনেক মিলও ছিল। পরস্পর পরস্পরকে অশেষ শ্রদ্ধা ও সাহায্য করতেন। দুজনেই ভগবদভক্ত ছিলেন অসাধারণরূপে। দুজনেই ভারতের অতীত দান সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন। তবে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গী আলাদা। গান্ধীজী কর্মযোগী, সংগ্রামবাদী, রবীন্দ্রনাথ কবি, সৌন্দর্যের পূজারী, ঐশ্বর্যের উপাসক। অথচ তিনি ভোগবাদী আদর্শ প্রচার করেন নি। তাঁর আনন্দরূপ মৃতম ও ভূমার আদর্শ সুখবিলাসী নয়, স্বেচ্ছায় দুঃখবরণ করাকে ও ত্যক্তেনভূঞ্জিখা—র বাণীকে তিনি মানতেন। তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের মিলনে যে সম্পূর্ণ এবং সমগ্র সভ্যতার সৃষ্টি হবে, তাকেই বিশ্বসভ্যতা বলে জেনেছেন। তিনি দেখেছিলেন পূর্ব ও পশ্চিম উভয়েই একপেশে দৃষ্টিভঙ্গিতে মত্ত হয়ে আছে। তাঁরই ভাষায় তাঁর আদর্শকে তুলে দিই :
”মানুষের উদ্যম যখন কেবলই একটানা চলিতে থাকে, তখন সে একটা জায়গায় আসিয়া আপনাকে আপনি ব্যর্থ করিয়া বসে। পূর্ণতার পথ সোজা নহে। সেইজন্য আজ য়ুরোপের যে বেদনা, আমাদের বেদনা কখনোই তাহা নহে। য়ুরোপের তাহার দেহকে সম্পূর্ণ করিয়া তাহার মধ্যে আত্মাকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহিয়াছে। আমাদের আত্মা দেহ হারাইয়া প্রেতের মতো পৃথিবীতে নিষ্ফল হইয়া ফিরিতেছে। সেই আত্মার বাহ্য প্রতিষ্ঠা কোথায়? তাহার মধ্যে যে ঈশ্বরের স্বধর্ম্য আছে, সে আপনার ঐশ্বর্য চিন্তা না করিয়া বাঁচেনা। সে যে আপনাকে নানা দিকে প্রকাশ করিতে চায়, রাজ্যে, বাণিজ্যে, সমাজে, শিল্পে, সাহিত্যে, ধর্মে,—এখানে সেই প্রকাশের উপকরণ কই? সেই উপকরণের প্রতি তাহার কর্তৃত্ব কোথায়? দেখিতেছি, তাহার কলেবর এক জায়গায় যদি বাঁধে তো আর এক জায়গায় আলগা হইয়া পড়ে। ক্ষণকালের জন্য যদি তাহা নিবিড় হইয়া দাঁড়ায় তবে পরক্ষণেই বাষ্প হইয়া উড়িয়া যায়। তাই আজ যেমন করিয়াই হোক আমাদের এই দেহতত্ত্ব সাধন করিতে হইবে। যেমন করিয়াই হোক আমাদিগকে এই কথাটা বুঝিতে হইবে যে কলেবরহীন আত্মা কখনোই সত্য নহে, কেন না কলেবর আত্মারই একটা দিক। তাহা গতির দিক, শক্তির দিক, মৃত্যুর দিক, কিন্তু তাহারই সহযোগে আত্মার স্থিতি, আনন্দ, অমৃত। এই কলেবর সৃষ্টির সম্পূর্ণতাতেই আমাদের দেশের শ্রীহীন আত্মা শতাব্দীর পর শতাব্দী হাহাকার করিয়া ফিরিতেছে। বাহিরের সত্যকে দূরে ফেলিয়া আমাদের অন্তরাত্মা কেবলই অবাধে স্বপ্ন সৃষ্টি করিতেছে। সে আপনার ওজন হারাইয়া ফেলিতেছে, এইজন্য তাহার অন্ধ বিশ্বাসের কোন প্রমাণ নাই, কোন পরিমাণ নাই; এইজন্য কোথাও বা সত্যকে লইয়া সে মায়ায় মত খেলা করিতেছে, কোথাও বা মায়াকে লইয়া সে সত্যের মতো ব্যবহার করিতেছে।” (আরব সমুদ্র—১৩ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৯। রচনাবলী—২৬শ খণ্ড, পৃঃ ৪৮৯—৯০।)
চিন্তার দিক থেকে এই সামগ্রিক ছবিটা কতই না সুন্দর। বস্তুত বিশ্বমানবতার ঐশ্বর্যবান অথচ ত্যাগমহান ছবি রবীন্দ্রনাথ অতি চমৎকার তৈরি করেছেন, কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে এর ব্যবহার এই চিত্রকে বাস্তব রূপ দিতে গেলে ইতিহাসকে যে আরো অনেক অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামের মধ্য দিয়েই মিটিয়ে নিতে হবে, এই কঠিন ও নির্মম সত্যকে তিনি পছন্দ করতে পারতেন না। তিনি কবি কীটসের মতো truth is beauty beauty is truth—এই কথাই মানতেন। গান্ধীজীর মতো Truth is God বলে এমন নির্মম ও দুর্গম পথ বেছে নিতে পারেননি। গান্ধীজীর truth, beauty খুঁজে বেড়াতো না, বরং জনজীবনের কুৎসিত, নির্মম, নিষ্ঠুর জীবন—সংগ্রাম তাঁকে আকর্ষণ করত। Beauty-র প্রতি কবিজনসুলভ আকর্ষণই অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে অত্যাচার, যুদ্ধ ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে বিক্ষুদ্ধ করে তুলতো। কিন্তু তিনি সেগুলিকে আকস্মিক ও অন্যায় উৎপাত বিশেষ মনে করে এড়াতে চাইতেন, ফলে তাঁকে যে লোকে escapist বলে অপবাদ দিয়েছিলেন, একথা একদম ভুল বলা যায় না। তাই দেখি রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান, গণসংগ্রামের ক্ষেত্রে আজ সংগ্রামী জনতার মুখে মুখে নেই, তা আজ ভদ্রসন্তানদের, শহরবাসীদের বিলাসপুরীতেই বেশি আদৃত হয়ে থাকে।
সৌন্দর্যের গান, ঐশ্বর্যের গান কবিসম্রাট গেয়েছেন, এবং বলেছেন যে বৈরাগ্য সাধন তার জন্য নয়। ভারতের জন্য কোন কৃচ্ছ্রসাধনের পথও গান্ধীজী প্রচার করেন নি। যদিও সাধক গান্ধী নিজের জন্য সে নীতি রেখেছেন। Plain living and high thinking-এর আদর্শ অবশ্য গান্ধীজী প্রচার করেছেন এবং বলেছেন, যা জনসাধরণের পক্ষে লভ্য নয় তা তিনি গ্রহণ করা অন্যায় বলে মনে করেন। জীবনকে উপভোগ করার কথা রবীন্দ্রনাথ, জওহরলাল, কমিউনিষ্ট, সোশিয়ালিষ্ট সবাই বলেন। All good things of life to be enjoyed. এই নীতি আজ সর্বত্রই প্রায় গ্রাহ্য। তথাপি গান্ধীজী এই জাতীয় আস্কারা ভারতকে খুব দেন নি, যতক্ষণ না জনসাধারণ সবাই উন্নতস্তরে এসে পৌঁছতে পারছে। তাছাড়া ক্যাডিলাক গাড়ি আর মিঙ্ককোট—এর বিলাসিতাকে চিন্তাশীল কমিউনিষ্ট জগৎও পছন্দ করেন না। এসব হলো ভবিষ্যৎ জীবন ধারণের মানদণ্ডের কথ মাত্র। আজকের যে দারিদ্রময় পরিস্থিতি, তাতে ঐ জাতীয় জীবন উপভোগ করতে চাওয়া মানে কপটতা ও শোষণের আশ্রয় নেওয়া। আজকের জন—জীবনের মান কত নীচে একথা কি ভুলতে পারা যায়? তাছাড়া সংগ্রামের পথে চলতে হলে জীবনকে শক্ত নিয়মে তৈরি করে নিতে হবে? বিলাসিতার কোমলতাকে প্রশ্রয় দিলে সংগ্রাম চলবে না। তাই সেনাপতি গান্ধী তাঁর দেশকে যুদ্ধের জন্য তৈরি করার পথে নিয়ম, কৃচ্ছসাধন ও কষ্টসহিষ্ণুতা ইত্যাদি শক্ত বিধানের সাহায্য নিয়েছিলেন, তাতে বৈরাগ্যপনা বোঝায় না। এছাড়া সংগ্রামের শক্তি সম্ভবই নয়। সংগ্রামের প্রয়োজনে আরো কত কি বর্জন করে চলতে হয়, সেকথা পূর্বেও আলোচনা করেছি।
তাই রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনকে গান্ধীজী একদিকে যেমন ভালোবাসতেন, আর একদিকে তেমনি মাঝে মাঝে হুঁসিয়ারও করে দিতেন, যেন দেশকে গান শেখানোর নাম করে যেন হালকা জীবন প্রচার করা না হয়। একথা ঠিক যে এই নিষ্প্রাণ জাতীয় জীবনে আনন্দ সৃষ্টি করার প্রয়োজন, প্রাণের মহান জাগরণের পথে আনন্দের দান, কলাশিল্পের দান সম্বন্ধে গান্ধীজী কম পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু একটা বিষয় তাঁর সর্বদা খেয়াল ছিল না, দেশ চায় সবার উপরে যে জিনিস সে হলো শক্তি, সংগ্রাম—শক্তি। তাই গান্ধীজী একবার শান্তিনিকেতনেই এক উৎসবে বলেছেন—‘‘I have a suspicion that, perhaps, there is more of music than warranted by life, or I will put thought in another way. The music of life is in dagner of being lost in hte music of voice. Why not music of walk, of the march, or every movement of ours and of every activity ? I think four boys and girls should know how to walk, how to march, how to eat, in short, how to perform every function of life.’’ (Mahatma Vol. II, page-28)
এখন revivalism সম্বন্ধে দু—একটা কথা বলা যাক। চরকা, কুটিরশিল্প, স্বদেশী, নৈতিকজীবন, অহিংসা, হরিজন ইত্যাদি আন্দোলন গান্ধীজী অবশ্য বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি থেকেই বিচার করে প্রবর্তন করেছেন, কিন্তু একথা অস্বীকার করা যায় না যে ভারতের মধ্যে পিছু হাঁটার দল কুসংস্কারবাদী প্রাচীনপন্থী সনাতনপন্থীরা ও অজ্ঞ জনসাধারণ এইসব আন্দোলনগুলিকে অনেকক্ষেত্রে এতটা বিকৃত করে ফেলতো যে তাকে revivalist আন্দোলন বলে সন্দেহ করা রবীন্দ্রনাথ বা জওহরলালের পক্ষে অন্যায় হতো না। গান্ধীজী যে—মতলব করেই এইসব আন্দোলন করুন না কেন, তাঁর অগণিত শিষ্যমণ্ডলী ও ভক্তবৃন্দ তাকে ভিন্ন অর্থ ও প্রতিক্রিয়াশীল রূপ দিতেও চেষ্টা করেছে। সনাতন ধর্মের পুনরুত্থান হচ্ছে মনে করে রবীন্দ্রনাথ ও অনেক প্রগতিবাদীরা আঁতকে উঠতেন। রবীন্দ্রনাথ ও প্রগতিবাদীরা এমন সব ভালো ভালো কথা, আপত্তি ও বিজ্ঞানসূলভ যুক্তি ও এবং দেশবিদেশের অভিজ্ঞতার কথা তুলতেন, যাতে মনে হতো গান্ধীজী বুঝি সত্যই প্রতিক্রিয়াশীল। কিন্তু আজ ইতিহাসের ধারাবাহিক বিচার করে যদি দেখি তবে দেখে আশ্চর্য হতে হয় যে বিজ্ঞানবাদী প্রগতিশীল প্রগতিবাদী নয়া সভ্যতাবাদীদের দান ভারতের সত্যিকার অগ্রগতির পক্ষে বাস্তবক্ষেত্রে গান্ধীজীর চেয়ে কত কম। তাছাড়া আরো একটা Paradox বা ঐতিহাসিক ধাঁধা দেখতে পাই যে, তথাকথিত বিজ্ঞান বিরোধী গান্ধীবাদী আন্দোলন কার্যতঃ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের কর্ণধারের কাজ করলো, অথচ বিজ্ঞানবাদী যুক্তিবাদীদের কার্যকলাপ বেশিরভাগই এই জীবনমরণ সংগ্রামে নিরপেক্ষ, এমন কি অপর পক্ষের সহায়ক হয়েও পড়লো স্থানে স্থানে। কিন্তু কেন এমন হলো? তার একটা দার্শনিক গূঢ় অর্থ আছে। সত্যের সংগ্রাম, প্রগতির সংগ্রাম, বিজ্ঞানের অগ্রগতি কেবলমাত্র নির্বস্তুক স্তরে জয়ী হতে পারে না, মাটির মানুষকে বা জনতাকে বহন করে যদি তা না অগ্রসর হতে চায়, তবে তাদের আপাতঃ প্রগতিশীল চেহারাটাও কার্যতঃ প্রগতি বিরোধী হয়ে পড়ে। Actual peoples’, struggle বা প্রকৃতরূপে জনগণের সংগ্রামের সাথে যদি আদর্শগত সংগ্রামের যোগ না হয়, তবে তা সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থও পেয়ে যেতে পারে। জনতার জাগরণ, জনতার ন্যায়সংগত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে ভাবধারার সৃষ্টি হয় তা প্রথম দৃষ্টিতে যত প্রতিক্রিয়াশীল, যত পরিপক্কই মনে হোক না কেন, তা কার্যতঃ এবং শেষ পর্যন্ত প্রগতিশীল হতে বাধ্য। আর যে ভাবধারা গণসংগ্রামের থেকে দূরে বৈঠকখানায় অথবা কৃষ্টির শীসমহলেই লালিতপালিত হয়, তা যতই বৈজ্ঞানিক বলে মনে হোক, কেন না শেষ পর্যন্ত তা কোন কাজে আসে না এবং তার বৃদ্ধি ও উন্নতিও হয় না। আমরা প্রথম থেকেই দেখেছি, গান্ধীজী যা কিছু বলেছেন, যা কিছু ভেবেছেন, সবই জনতার প্রয়োজনে, জনতার সংগ্রাম ও মুক্তির প্রয়োজনে। তাঁর চিন্তাধারায় রবীন্দ্রনাথের মতো বা জওহরলালের মতো বা কমিউনিষ্টদের মতো সুদূরপ্রসারী বিজ্ঞানসম্মত ধারণা হয়তো প্রথম থেকেই ছিল না, জ্ঞানবিজ্ঞানের বিচারক্ষেত্রে গান্ধীজী হয়তো তাঁদের তুলনায় ”অশিক্ষিত” বলেও কেউ কেউ দাবি করতে পারে, কিন্তু কি শক্তি তাঁকে শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সত্যদ্রষ্টা হিসেবে কার্যতঃ প্রতিপন্ন করে গেল? কেন আর সব প্রগতিবাদীরা তাঁর কাছে হার মেনে গেলেন, কেন তিনি শেষ পর্যন্ত ভারতকে সত্যি সত্যি প্রগতির পথেই প্রতিষ্ঠিত করে যেতে পারলেন? কেন সব বিজ্ঞানবাদীরা ম্লান হয়ে গেলেন? সেই একই শক্তি, অর্থাৎ জনতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের শক্তি। জনতার সংগ্রামের সাথে তাঁর ভাবধারাকে মিলাতে পেরেছিলেন বলে, জনতার জীবনমরণ সংগ্রামে তিনি ideology বা আদর্শের হাতিয়ার দিতে পেরেছিলেন বলেই সত্য ও বিজ্ঞান তাঁর হাতে বেশি করে সার্থক হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যদি তাঁর ভাবসম্পদকে এমনিভাবে গণসংগ্রামের সাথে যুক্ত করে দিতে পারতেন, তাহলে নিশ্চয়ই অন্য রকম চিত্র আমরা দেখতে পেতাম। কমিউনিষ্টরাও যদি তাঁদের প্রগতিশীল চিন্তাধারাকে ভারতের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাতে পারতেন, তবে তাঁরাই আজ ভারতের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ বা আইডিওলিজষ্ট বলে প্রতিপন্ন হতেন। যদি ইউরোপে মুক্ত—আসক্ত ইংরেজি শিক্ষিত নেতারা ভারতের গণসংগ্রামে নেতৃত্ব করবার ক্ষমতা দেখাতে পারতেন তবে তাঁরাই গান্ধীজীকে সত্যি সত্যি চালেঞ্জ জানাতে পারতেন। এমন কি যদি গান্ধীজী গণসংগ্রাম জাগাতে না পারতেন, তবে তাঁরও দশা একজন সনাতন ধর্মপ্রচারক বলেই প্রতিপন্ন হতো। বাস্তব ইতিহাস ও জনসংগ্রামের সাথে সামাজিক চিন্তাধারা বা সোশিয়াল আইডিওলজির এই অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধটা মনে রাখতে হবে। তাছাড়া পশ্চিমী সাম্রাব্যবাদের বিরুদ্ধে এশিয়া ও আফ্রিকার পরাধীন উপনিবেশগুলি স্বাধীনতা সংগ্রাম যখন শুরু করলো, তখন তাদের মধ্যে একটা বিভাইভালিষ্ট বা পুনরভ্যুত্থানের সুর ওঠা অপরিহার্য। কেন না পশ্চিমের যে যন্ত্রসভ্যতা ও জ্ঞানবিজ্ঞান, তা এই নিপীড়িত জনতার কাছে কোন মঙ্গলের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে নি। তারা দেখেছে যে, যন্ত্রসভ্যতা তাদের কুটিরশিল্পীকে দিয়েছে চূর্ণবিচূর্ণ করে, রেলগাড়ী তাদের দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছে, বিজ্ঞান তাদের নিরক্ষর করে ছেড়েছে। সাম্রাজবাদী সভ্যতার জ্ঞানবিজ্ঞান—যন্ত্র তাদের জীবনকে ধ্বংস করেছে, কাজেই তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে প্রথমটায় তাদের পুরোনো হৃতগৌরবের কাহিনী, ফেলে দেওয়া চরকা ও তাঁত, অপমানিত ধর্ম, এ সবের সাহায্যও নিতে হয়েছে, কাজেই জাতীয়তার সাথে সাথে একটা পুনরভ্যুত্থানের মোহও সঞ্চারিত হয়েছে। কিন্তু এই মোহ কখনও প্রতিক্রিয়ার পথে নিয়ে যেতে পারে না, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের চাপেই তাকে প্রগতিশীল ও বিপ্লবী হতে বাধ্য করে। তাই এশিয়ার কোন জাতিই আজ প্রতিক্রিয়াশীল নয়। তারা ইউরোপের চেয়ে ঢের বেশি অগ্রগামী চিন্তা গ্রহণ করেছে এবং সবাই সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হতে চাইছে। বস্তুতঃ প্রতিক্রিয়াশীলতায় শিকড় বা জড়, কায়েমী স্বার্থ ও সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের মধ্যেই প্রতিনিয়ত পুষ্ট হয়ে থাকে, হৃতসর্বস্ব জনতার জীবনে প্রতিক্রিয়াশীলতার শিকড় বেশি দূর যেতে পারে না। প্রগতির শক্তি জ্ঞানের উচ্চ স্তম্ভে লালিত ও বর্ধিত হয় না, হয় জীবনসংগ্রামের ন্যায্যতার মধ্যে, জনজীবনের মুক্তির অভিযানে। এই বিচারভঙ্গী থেকেই আমরা বুঝতে পারে যে কেন গান্ধীজী কার্যক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বেশি প্রগতিশীল বলে প্রমাণিত হয়ে গেছেন। প্রগতি ও মুক্তির শক্তি কেন জনতা গান্ধীজীর কাছ থেকেই বেশি পেয়েছে, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে গভীর শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও তাঁকে বলতে হয়েছে, ‘‘He explains his point of view in lines of great beauty, but detached from real life. His words are like the dance of Nataraja, a play of illusions…(p. 100….The bird-poet, the eagle-sized lark, as Heince called a master of our music, sits and sings on the ruins of time. He lives in lives in eternity. But the demands of the present are imperious,’’ (Mahatma Gandhi, page—109)
গান্ধীজীর নিজের কোন revivalist মোহ ছিল না। গান্ধীজীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের তেমন ভাবনা বা সংশয় ছিল না। কিন্তু গান্ধীবাদীদের বা গান্ধী—অনুগামীদের প্রাচীনপন্থী ঝোঁক সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা ছিল। গান্ধীজীর নিজেরও সে বিষযে লক্ষ্য ছিল, অর্থাৎ তাঁর নাম করে কেউ ভেজাল জিনিস চালিয়ে না দেয় সে সম্বন্ধে তিনি অনেকবার হুঁসিয়ার করেছেন। দু—একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে আমরা এ প্রসঙ্গ শেষ করবো। তিনি বলেছেন, ‘‘You will not therefore consider that I have given you a warning against being misled into wrong doing under the name of revival of culrture. (To the students–p. 115)
সিংহলে তিনি এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘‘And working along these lines of truth and non-violence, I also discovered that I must not attempt to revive ancient practices if they were inconsistent with, call if you will, modern life as it must be lived. Ancient practices may have been perfectly good and perhaps aboslutely necessary at the time those practices were adopted, but they may be entriely out of date with modern needs and still not be contrary to truth and non-violence.’’ (Gandhiji in Ceylon–pages–128-29)