রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য দৃষ্টি
‘তত্ত্ব’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ বস্তুর স্বরূপ বা স্বত্ব বা স্ব-ভাব। তত্ত্বের দুইটি দিক, একটি বিশিষ্ট, আর একটি অবিশিষ্ট। স্কুল কলেজের ছাত্ররা ন্যায়শাস্ত্রের প্রথম পাঠ গ্রহণের সময় জানতে পারে, মানুষের তত্ত্ব হ’ল মনুষ্যত্ব; যেখানে মানুষের অন্যান্য জীবের সঙ্গে মিল রয়েছে সেই অবিশিষ্ট জীবধর্ম, এবং যেখানে তার অন্যান্য জীব থেকে পার্থক্য রয়েছে সেই বিশিষ্ট বুদ্ধি বা মননধর্ম, এই বিশিষ্টতা ও অবিশিষ্টতা, এই স্বাতন্ত্র্য ও অস্বাতন্ত্র্য, সাধর্ম্য ও বৈধর্ম্য, এই নিয়ে ‘মনুষ্যত্ব’, যাকে তত্ত্বজ্ঞানোচিত গাম্ভীৰ্য্য নিয়ে বলা যেতে পারে মানুষের ‘তত্ত্ব’।
সাহিত্যেরও যদি কোন তত্ত্ব থাকে, তবে তার স্বভাবের ভিতরেও এই দুইটি দিক থাকাই স্বাভাবিক; যেখানে সে সাধারণ এবং যেখানে অসাধারণ। সমাজবদ্ধ মানুষের মনন ও ভাবনা সঞ্জাত অন্যান্য শাস্ত্রের সঙ্গে যেখানে তার সাধর্ম্য, এবং যেখানে তার ইতার-বিশিষ্ট বৈধর্ম্য, এই দুইটি দিকের সমন্বিত স্বরূপকেই বলা উচিত সাহিত্যের ‘তত্ত্ব’! কিন্তু সাহিত্যের তত্ত্বালোচনায় সাধারণতঃ সাহিত্যের অসাধারণ ধর্মটির উপরেই সমস্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে, যার ফলে বক্রোক্তি, অলঙ্কার, রস, ধ্বনি, চমৎকারিত্ব, এই বিষয়গুলিই তত্ত্ববিচারের প্রধান উপজীব্য হিসাবে উপস্থিত করা হয়। সাধারণ কথাকে অসাধারণ ক’রে বলার ভিতরে বাচনভঙ্গীর যে একটু চমৎকারিত্ব আছে। ঐটুকুই সাহিত্যের সার, অথবা কথার কারুকর্মের ভিতর নিয়ে ব্যঞ্জনাশক্তির মহিমায় যে একটি অনির্বচনীয় আনন্দঘন রসানুভূতির আস্বাদ পাওয়া যায় ঐটুকুই সাহিত্যের প্রাণ-এই দুইটি প্রধান মতবাদের যে কোনটিই গ্ৰহণ করিনা কেন, সমস্ত আলোচনা শেষ পৰ্যন্ত এমন একটি চরম সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বাধ্য যাতে আমাদের ইতয়জনের জিজ্ঞাসা পরিতৃপ্ত হয় না। কারণ, কথাটা শেষ পর্য্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়—সাহিত্য একটা অনুভুতির জিনিষ। সাহিত্যের স্রষ্টা ও উপভোক্তা উভয়েই অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন মহাজন, এই অন্তদৃষ্টির প্রসাদে আবিভূতি হয় এক বিচিত্র অপরোক্ষ অনুভূতি, এক আস্বাদন সর্বস্ব অভিজ্ঞতা-কি সুন্দর, কি চমৎকার! এই সৌন্দৰ্য্য ও চমৎকারিত্বের আর কোন নাম নেই, কারণ এ কেবল অনুভববেদনীয়, সুতরাং অনির্বচনীয়।
সাহিত্য অনুভূতির জিনিষ নয় এমন কথা কেউ বলবে না। কিন্তু অনুভূতিকে অনুভূতিসর্বস্বতা পৰ্যন্ত টেনে নিয়ে গেলে বিভ্ৰান্তি সৃষ্টি করার বিপদ অাছে। প্ৰচলিত দর্শনশাস্ত্রে ও মোক্ষশাস্ত্ৰে এ বিপদ বার বার মহামারীর আকারে দেখা দিয়েছে। একটা উদাহরণই দেয়া যাক। প্ৰত্যক্ষ জ্ঞানের স্বরূপ কি এ সমস্যা নিয়ে দর্শনশাস্ত্রে তর্কের ঝড় বয়ে গেছে, এখনও থামেনি, আধুনিক পাশ্চাত্ত্য দর্শনে এই ঝড়ের গতি বেশ বেগবতী। প্ৰত্যক্ষ জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে যদি বা কোনও রকমে একটা ঐকমত্যে উপস্থিত হওয়া গেল, কিন্তু প্ৰত্যক্ষ অনুভূতিটা যে স্বয়ং কি পদার্থ, কি তার উপকরণ, কি তার পরিধি এ সমস্যার আর সমাধান হয় না। কারণ, প্ৰত্যেক পণ্ডিতের ধারণা তার অনুভূতিটাই ঠিক। শুধুমাত্র অন্তমুখী বিশ্লেষণের দ্বারা যদি অনুভূতিকে চিনতে হয় তাহলে উপায়ও তো আর নেই। আমাদের দেশের প্রাচীন দর্শনের একজন দিকৃপাল নৈয়ায়িক জয়ন্ত ভট্ট খুব রসিক লোক ছিলেন। তিনি এই নিৰ্বাক অনুভূতির সবাক কোলাহল উপভোগ করে মন্তব্য করলেন-দেখুন, প্ৰত্যক্ষ জ্ঞানটা আমাদের শেষ আপীল-আদালত। কোন অপ্ৰত্যক্ষ বিষয়ে যখন মামলা ওঠে, তখন ঘটনাটা সম্ভব কি অসম্ভব বিচার করার জন্যে আমরা প্রত্যক্ষ জ্ঞানের আদালতে আপীল করি, এখন দেখছি প্ৰত্যক্ষ জ্ঞানটা যে কি তাই নিয়েই মামলা উঠেছে, প্রত্যক্ষ জ্ঞানে আমাদের কাছে কি যে প্রতিভাত হয় তাই জানি না। তাহলে প্রত্যেকে বুকে হাত দিয়ে শপথ করে বলুন, কার প্রত্যক্ষ কিরূপ? কিন্তু এ দ্বারা ত মীমাংসা হবে না। তাই হৃদয়ের শপথের পথ ত্যাগ করে আমাদের অন্য পথ ধরতে হবে। অবশ্য জয়ন্ত ভট্ট কি পথ ধরলেন তা আমাদের বিচাৰ্য্য বিষয় নয়। লোকোত্তর মোক্ষশাস্ত্রের রাজ্যে তি আরও ব্যাপক বিস্ত্ৰান্তি। মুক্তির স্বরূপ যে কি–তাই নিয়ে এক এক মহাত্মার এক এক রকমের অনুভূতি, আমাদের ইতরজনের জন্য বিধান, যে কোন মহাজনের পথ ধরে সন্ধান কর। কিন্তু আমাদের মুস্কিল, কোন মহাজন যে সত্যই মহান তা তো আর নিছক অনুভূতি দিয়ে যাচাই করতে পারি কিনা।
সাহিত্যকেও যখন লোকোভীর্ণ অনুভূতির রাজ্যে সন্ন্যাস নিয়ে রসোত্তীর্ণ করার দাবী তোলা হয়, তখন আমাদের মুস্কিল বাধে আরও বেশী। প্রথম কারণ সাহিত্যিকরা সকলেই আমাদের কাছে মহাত্মা বা মহাপুরুষ বলে প্ৰতিভাত হন না, যারা কলাকৈবল্যবাদী তাদের ও কৈবল্যের প্রতি অনুরাগ কতখানি আন্তরিক সে সম্পর্কে সন্দেহ জাগে, অনুরাগটা কথার তোড়ে ভাসমান বুদ্ধ,দ মাত্র কিনা এ প্রশ্ন মনে জাগে। দ্বিতীয়ত: আমরা সাধারণ মানুষ থাকি সংসারের সুখ দুঃখে জড়িয়ে, দিনযাপনের প্রাণধারণের গ্লানি আমাদের সর্বাঙ্গে মাখা : ঠাসাঠাসি দিনমুসাফিরের মালগাড়ীতে ওষ্ঠাগত। প্ৰাণটাকে অনেক সময় বইয়ের পাতা দিয়ে আটকে রাখি, তা সে পরীক্ষা পড়ুয়ার গণিত, ইতিহাস, ক্লাসের নোট বইই হ’ক, অথবা জানা অজানা সাহিত্যিকের বইই হ’ক। তখন কোথায় লোকোত্তর অনুভূতি, কোথায় কৈবল্যদায়িনী কলা, তার চেয়ে সিঙ্গাপুরী কদলীর ডাকে যে অনুভূতি জাগে তা কলাশাস্ত্রের লোকোত্তর সুড়সুড়ির চেয়ে অনেক বেশী রসোত্তীৰ্ণ। কিন্তু এহি বাহ, অন্তরঙ্গ কথা বলতে হবে। বাড়ী ফিরে একটু অবসর করে তদগত চিত্তে সাহিত্যের বই পড়ি, নানান দেশের নানান মানুষের বিচিত্র ভিড়, সে ভিড়ের ভিতরে নিজের মুখ, স্ত্রীর মুখ, ছেলেমেয়ে বন্ধুবান্ধবের মুখ দেখি, শত্রুর মুখ ও দেখি। চিনিনা এরকম লোক ও বিস্তর, তারাও চেনা হয়ে যায়। এই চেনা, অচেনা, নতুন চেনা মানুষের মিছিলটািই চোখের সামনে বড় হয়ে ভাসতে থাকে। এত ভিড় ঠেলে, পায়ের নীচে অনেক আবর্জনা ঠেলে, সামনের অনেক বাধা ঠেলে মানুষগুলি কিন্তু এগিয়ে চলেছে। মনে আশা জাগে, উৎসাহ জাগে। যে মানুষ মানুষের মূল্যকে পদদলিত করেছে সে রক্ষা পায়নি, অভিশাপ। মাথায় নিয়ে মাঝপথে কবরের কোলে থেমে গেছে। যে মানুষ মানুষকে ভালবেসেছে, মানুষের অপমান সইতে পারেনি, কিন্তু সবল সংগ্ৰামী বাহুর দ্বারা মনুষ্যত্বের মূল্যকে রক্ষা করার চেষ্টাও করতে পারেনি সেও তার সকল ব্যর্থতার অন্তর্জালা নিৰ্বাণ করেছে কবরের শান্তিতে; কিন্তু তার শেষ পরাভব হয়নি, মিছিলের পিছের মানুষগুলি সামনে এগিয়ে এসেছে, তাকে শ্ৰদ্ধা জানিয়েছে, দুঃখকরেছে, কিন্তু তার ব্যৰ্থতার গ্লানি গ্রহণ করেনি, সংগ্রামী মানবতার বাণী বহন করে পথ কেটে এগিয়ে চলেছে। যুগ থেকে যুগান্তরে সমস্ত যুগান্তকারী সাহিত্য এই মরণজয়ী মানুষের জয়যাত্রার উজ্জল ছায়াপথ। সব কোলাহল ছাপিয়ে এই জয়যাত্রার জয়ধ্বনি বেজে উঠল কবিকণ্ঠে–
“আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহামৰ্য্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্ৰতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি।”
একথাগুলি উচ্ছ্বাস না কোন গভীর অনুভূতির বাহন? এ সমস্যা তো কেবল অনুভূতি দিয়ে বিচার করা যাবে না। কোন কলাকৈবল্যবাদী যদি বলে বসেন-এত সাহিত্যিক অনুভূতি নয়, এ একটা সামাজিক অনুভুতি, যার ভিতরে একটা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে ধরা পড়েছে। সত্যিকারের সাহিত্যিক অনুভূতি নিরুদেশ নি-লক্ষ্য। কোন ইন্দ্ৰিয়বিকারলদ্ধ অভিজ্ঞতার একটি মুহুর্তকেও যদি উপযুক্ত ভাষার সাজে সাজাতে পারি, তবে রসবেত্তার কাছে ঐ একটি মুহুর্তই অনন্তকালে পরিণত হবে, গোস্পদও সাগরে পরিণত হবে, তিনি বারবার ঐ রত্নাকরে ডুব দেবেন; রত্ন তোলার প্রয়োজন নেই, শুধু অবগাহনেই আনন্দ। “বন্দীর বন্দনা”র বিকারপ্ৰমত্ত প্ৰলাপের ঘোরে যে বাচাল কবি রবীন্দ্ৰপ্ৰভাবমুক্তির কল্লোল তুলেছিলেন, এবং শেষ পৰ্য্যন্ত মার্কিন ডলার পুষ্ট “এশীয় সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার” আন্ডাখানায় কৈবল্যধর্মের সন্ধান পেয়েছেন, তার ও তা একটা অনুভুতি আছে। সে অনুভুতির কি দাম নেই? দাম আছে কিনা জানি না। তবে সরস্বতী স্বৈরিণী হ’লেও স্বৈরাচারের একটা হলাদিনী অনুভূতি আছে, সে যে নির্ভেজাল আধ্যাত্মিক, তাই অমূল্য। সঙ্গে সঙ্গে বক্ৰ অঙ্গুলির ডগায় যদি ব্যবহারিকমূল্যের ঘূত কিছুটা উঠেই আসে। তবে সেটা নিতান্ত আনুষঙ্গিক, পার্থিব বলেই ধর্তব্য নয়।
কথাটা এই জন্যেই উঠেছে যে কেবল উপলব্ধি দিয়ে সাহিত্যের মূল্য যাচাই করা যায় না, অর্থও বোধ হয় বোঝা যায় না। যেমন ধরুন ফরাসীপ্ৰেমিক বাঙ্গালী কবি সাহিত্যের ফরাসি বিছিয়েছেন, সেই ফরাসে বসে তিনি অনুভব করলেন, বিশ্বকবির “নিরুদ্দেশ যাত্রা” কোন ফরাসী কাব্যসুন্দরীর ছায়া নেমে এসেছে। এই সঞ্চারিণী ছায়ামূর্তিকে সর্বপ্রথম উপলব্ধি করার কৃতিত্ব তারই যিনি ব্যাখ্যা করে বুঝাতে লাগলেন-পশ্চিমী সভ্যতার সুন্দরী ভাবনা বিশ্বকবিকে ইসারা করেছে, এই ‘বিদেশিনী’। সুন্দরীর নিগুঢ় সংকেতে এক অনাম্বাদিত মিলনের আশায় বিশ্বকবি অকুল সাগরে পাড়ি জমিয়েছেন। যে মাজেছে সেই জানে-কি মনোহারিণী ব্যাখ্যা। কিন্তু উপলব্ধির প্রসাদবঞ্চিত যে ইতরজন ব্যাখ্যার পিছনেও যুক্তি খোজে। তার মন হরণ করা দুঃসাধ্য। সে কবিতার ব্যাখ্যা বুঝতেও নীরস তথ্যের সন্ধান করে। “নিরুদ্দেশ যাত্রা” কবিতাটির নীচে সন তারিখ দেওয়া আছে—২৭ অগ্রহায়ণ ১৩০০ সাল। এই সময়টাতে যার দুনিবার উপস্থিতি কবিচিত্ত উদ্বেলিত করেছিল তার নাম দেশাত্মবোধ। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতবাবুই এখানে কথা বলুন,-“বঙ্কিমচন্দ্রের মতো সরকারী পেনশনভোগী রায়বাহাদুর পর্য্যন্ত লিখলেন, “যতদিন দেশী বিদেশীতে বিজেতৃ-জেতৃসম্বন্ধ থাকিবে, ততদিন আমরা নিকৃষ্ট হইলেও পূর্ব গৌরব মনে করিব, ততদিন জাতিবৈর-শমতার সম্ভাবনা নাই এবং আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, যে যতদিন ইংরেজের সমতুল্য না হই ততদিন যেন আমাদিগের মধ্যে জাতিবৈরিতার প্রভাব এমনি প্ৰবল থাকে,”-দেশের মনোভাব এইরূপ, রবীন্দ্ৰনাথ নীরব থাকতে পারলেন না। তিনি ‘ইংরেজ ও ভারতবাসী’’ নামে প্ৰবন্ধ লিখলেন; … সভা হ’ল বিডন স্ট্রীটের চৈতন্য লাইব্রেরীতে, সভাপতি বঙ্কিমচন্দ্ৰ। কয়েকদিন পরেই বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যু হয়। ‘ইংরেজ ও ভারতবাসী’ ছাড়া এ সময়ে আরও কতকগুলি প্ৰবন্ধ তিনি লেখেন, যেমন, ইংরেজের আতঙ্ক, সুবিচারের অধিকার, রাজা ও প্ৰজা, রাজনীতির দ্বিধা প্ৰভৃতি। এই সব প্ৰবন্ধের মধ্যে রবীন্দ্ৰনাথের তীব্ৰ দেশাত্মবোধ প্ৰকাশ পেয়েছে প্ৰতি রচনাৱ প্ৰতি ছত্ৰে। তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, “য়ুরোপের নীতি কেবল নজরুলাপের জন্য, ভারতবর্ষীয়রা এতই স্বতন্ত্র জাতি যে সভ্যনীতি তাহদের পক্ষে উপযোগী নহে’’ (রবীন্দ্র-জীবনকথা পৃঃ ৫৮-৫৯)। ঐ একই সময় একদিন কটকে বিহারীলাল গুপ্তের বাড়ীতে এক ভোজসভায় রাভেনস কলেজের ইংরেজ অধ্যক্ষের মুখ থেকে ভারতীয়দের সম্পর্কে কুৎসিত মন্তব্য শুনতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। এই ঘটনার উল্লেখ করে তিনি লিখছেন, “একজন বাঙালির নিমন্ত্রণে এসে বাঙালির মধ্যে ব’সে যারা এরকম করে বলতে কুণ্ঠিত হয় না, তারা আমাদের কী চক্ষে দেখে!” (রবীন্দ্র-জীবনকথা, পৃ ৫৬)। সত্য পশ্চিমের বর্বর শাসনের বিরুদ্ধে যখন শিক্ষিত ভারতবাসীর মন বিষিয়ে উঠেছে, যখন রবীন্দ্ৰনাথ “অপমানের প্রতীকার” খুঁজে ফিরছেন, যখন বিদেশী ভাষার বদলে মাতৃভাষায় শিক্ষাপ্ৰচলনের অপরিহাৰ্য্য প্রয়োজন অকাট্য যুক্তিতে প্ৰতিপন্ন করে “শিক্ষার হেরফের” ঘটাবার চেষ্টা করছেন, ঠিক সেই সময়টির মাঝখানে কোন অলৌকিক স্বপ্নাবেশে পশ্চিমী সভ্যতার নিরুদেশ প্ৰেমাভিসারে বিমুগ্ধ প্রেমিকের মত কবি অকুলে তরী ভাসাতে পারেন, এমন অলৌকিক চিন্তা আমাদের মাথায় আসে না। “নিরুদেশ যাত্ৰা”র ব্যাখ্যায়। যদি নবীন বোধিসত্ত্বের বোধি আমাদের গ্ৰহণ করতে হয়, তবে বলতে হয় রবীন্দ্রনাথ এমন একটি Split-personality ছিলেন যাকে Jekyll and Hidye-এর এক সংস্কৃত সংস্করণ বলা চলে। কবি ভারতী যাতে “দুর্ব্যাখ্যা-বিষমূর্চ্ছিতা” না হয় সেদিকে দৃষ্টি দেবার প্রয়োজন পড়েছে, সেজন্য হয়তো দুর্বাসার বচনও দরকার হতে পারে। এই দুর্ব্যাখ্যার উৎস হল এমন একটি সাহিত্যতত্ত্ব যা নিজেই নিরুদেশের যাত্রী, যা সমাজ নিরপেক্ষ, যুগনিরপেক্ষ, বস্তুনিরপেক্ষ, মানুষের শুভাশুভ-নিরপেক্ষ, কেবলমাত্র রহস্য দীক্ষিতের উপলব্ধি-সাপেক্ষ।
এই একই সাহিত্যতত্ত্ব আবার অন্য এক বিপরীত দিক থেকে বিপদ ঘটাতে পারে। ভরতনাট্যশাস্ত্রের সবচেয়ে সেরা ব্যাখ্যাকার অভিনবগুপ্তের বিরাট প্ৰতিভার প্রসাদে ভারতের নাট্যরসতত্ত্ব প্ৰায় উপনিষদের ব্ৰহ্মতত্ত্বের পদবীতে উভীর্ণ হল। কাশ্মীরী শৈবাদ্বৈতের তান্ত্রিক সাধক ও দার্শনিক অভিনব গুপ্ত সাহিত্যরসকে এক অলৌকিক রহস্যানুভূতির পৰ্য্যায়ে উন্নীত করলেন। সমাধিমগ্ন যোগীর নির্বিকল্প আনন্দানুভূতি থেকে কাব্যর সানুভূতির পার্থক্যের একটি সূক্ষ্ম ভেদরেখা। তিনি টানলেন বটে, কিন্তু সে রেখাটি এত সূক্ষ্ম যে পরবর্তীকালে মন্মটভট্ট সাহিত্যরসাস্বাদকে প্ৰায় ব্ৰহ্মাম্বাদেরই মতো বলে তুলনা করলেন। বিশ্বনাথ কবিরাজ বললেন “ব্ৰহ্মাম্বাদ সহোদরঃ”। সাহিত্যের উৎপত্তি লৌকিক জগৎ থেকে, কিন্তু তার রাসানুভূতি অলৌকিক জগতে। এই সাহিত্যতত্ত্বের বিপদ হ’ল-সাহিত্যের মাতৃভূমিকে বিস্মৃত হওয়া এবং এই বিস্মরণকেই একক নিঃসঙ্গ অনুভূতির গৌরবরূপে প্ৰতিষ্ঠা করা’। আকাশচারী রসবোধ আর নীচের মাটির দিকে তাকাবার প্রয়োজন বোধ করে না। কারণ রস তখন স্বপ্রকাশ, লৌকিক সমাজের মৃত্তিকাই যে তাঁর জন্মভূমি এই উপলব্ধি তখন বিলুপ্ত। এর ফলে সাহিত্যের অর্থবোধে বাধা ও বিভ্ৰান্তি অবশ্যম্ভাবী। কারণ, অর্থবোধ ও রসবোধ অবিচ্ছেদ্য। উৰ্দ্ধবায়ুর প্রকোপে তখন রস ও অর্থ উভয়েই উৰ্দ্ধগামী। কোন সাহিত্যস্রষ্টার সৃষ্টি-কর্মের অর্থ বিচার করার সময় কোন সময়ে, কোন সমাজে, কোন পারিপাশ্বিকে সৃষ্টিকর্তাকে কাজ করতে হয়েছে, সমানকালীন গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ঘটনাবলীর প্রতি তার মনোভাব কিরূপে প্ৰকাশ পেয়েছিল, এই জাতীয় ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গী বিচারকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, বিচারের চেয়ে প্রাথমিক অনুভূতিটাই প্রখর হয়ে ওঠে। ফলতঃ, প্রাচীন আলঙ্কারিকেরা যে অপূর্ব ধ্বনিতত্ত্ব আবিষ্কারের গৌরব অর্জন করেছিলেন, সেই তত্ত্ব শুধু প্ৰাচীন ভাবনার ভিতরেই সংকুচিত হয়ে থাকে, তাকে অতিক্রম করে বর্তমান ও ভবিষ্যতের ধ্যান-ধারণায় প্রসার লাভ করতে পারে না। ধ্বনি বা ব্যঞ্জনাকে কাব্য বা নাটকের দু-একটি পংক্তির ভিতরেই ছোট্ট একটু ঠাই করে থাকতে হবে, একটি সমগ্র কাব্য বা নাটকের সামগ্রিকভাবে কোন একটি ব্যাপক ব্যঞ্জনাময় অর্থ থাকতে পারে না, এমন কোন রাজকীয় শাসন মান চলে না। ঠিক সেজন্যই কোনো মহাকবির সমগ্রজীবন, তার সাহিত্য জীবন ও সমাজজীবন, যখন আমাদের কাছে প্ৰতিভাত হওয়ার সুযোগ পায়, তখন আমরা দাবী করি, এই মহাকবির সমগ্র জীবনের গতি ও লক্ষ্য নিরূপণ করা, তার উপক্রম ও উপসংহার লক্ষ্য কর, তার সঞ্চারণপথের ঋজু ও কুটিল রেখাগুলি অনুসরণ করা, খুঁজে দেখি তার সমগ্র জীবনটারই একটা গভীর ব্যাপক অর্থ আছে কিনা, যে অর্থে তিনি তাঁর ব্যক্তি জীবন, সমাজজীবন ও সাহিত্যজীবনের মিলিত সার্থকতা অনুভব করেছেন। এ দাবীটা খুবই বড়, পূরণ করা পরিশ্রমসাধ্য, কিন্তু অযৌক্তিক নয়। সাহিত্যতত্ত্বের বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে সবচেয়ে বড় কথা ধ্বনি বা ব্যঞ্জনা। কার ধ্বনি, কার বাঞ্জন? আলিঙ্কারিক বললেন রসের ধ্বনি বা রসের ব্যঞ্জনাটাই বড় কথা। এখানেও আপত্তির কিছুই নেই। কিন্তু আপত্তি ওঠে তখনই যখন বস্তুধ্বনি থেকে রসাধ্বনিকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা হয়। প্ৰবন্ধের প্রারম্ভে আমরা একথা বলেছি, যে কোন তত্ত্বের মতই সাহিত্যতত্ত্বেরও দুইটি দিক আছে, একটি সাধারণ, আর একটি অসাধারণ; একটি অবশিষ্ট, আর একটি বিশিষ্ট। বস্তুধ্বনি থেকে রসধবনিকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করলে, সাধারণ থেকে অসাধারণের, অবিশিষ্ট থেকে বিশিষ্ট্রেয় বিচ্ছেদ ঘটে। সাধারণ ভূমি থেকেই যে অসাধারণ জন্ম, বস্তুভাবনা থেকেই যে রসচর্বণার অভিব্যক্তি এই সাধারণ সত্যটি তখন দৃষ্টিছাড়া হয়, আর রসবোধটিও হয়ে ওঠে সৃষ্টিছাড়া। কবি-মানসের পিছনে কবির যে ক্রিয়াশীল সমাজ-মানসটি কাজ করে যাচ্ছে, কোন সমানকালীন সামাজিক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সেই সমাজ-মানসটি কিরূপে আত্মপ্ৰকাশ করেছে, সে দিকে দৃষ্টি না দিয়েই যদি কোনো কবিকর্মের তাৎপৰ্য্য নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হয় তাহলে বস্তুদৃষ্টিহীন রসবোধ সত্যভ্ৰষ্ট হতে বাধ্য।
আমরা যে মহাকবিজীবনের কথা বলেছি তার বোধ হয়। সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন রবীন্দ্রনাথ। কাজেই রবীন্দ্ৰনাথের সৃষ্টিকর্ম থেকেই উদাহরণ টেনে আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট করে তোলার চেষ্টা করব। ‘নিরুদ্দেশ যাত্রার” সর্বাধুনিক ব্যাখ্যাবিভ্রাটে একবার আমাদের বক্তব্য যাচাই করার সুযোগ পেয়েছি। ‘রক্ত করবী’র ব্যাখ্যাবিভ্রাটে এ সুযোগ হয়তো আরও বেশী করে পাওয়া যাবে। কারণ, রক্তকরবীর ব্যাখ্যায় বিভ্ৰাট সৃষ্টি করার দায়িত্ব রবীন্দ্ৰনাথকেও গ্ৰহণ করতে হবে। রবীন্দ্ৰ সাহিত্যের বিচারশীল পাঠক মাত্ৰই জানেন রবীন্দ্ৰনাথ নিজে তার নাটকের কি ব্যাখ্যা দিলেন। র্তার প্রাথমিক ব্যাখ্যায় রক্তকরবীর তাৎপৰ্য্য হল—আধুনিক বৈজ্ঞানিক সভ্যতার দুরন্ত যান্ত্রিক বর্বরতার বিরুদ্ধে শান্ত স্নিগ্ধ কৃষিসভ্যতার মুক্তিস্নাত জয়গান। নন্দিনী এই মুক্তিস্নানের আনন্দ-উচ্ছল প্ৰাণমূতি যে যন্ত্রের বাঁধ ভেঙেছে, আপন হাতে সৃষ্টি করা বিকৃতির জালে আপনি আবদ্ধ মানুষের আত্মাকে মুক্তি দিয়েছে। এ হ’ল ১৩৩১ সালের কথা। কিন্তু মাত্র এক বছর পরে, রক্তকরবীর ইংরেজি অনুবাদ প্রচারিত হওয়ার পরে, রবীন্দ্ৰনাথ ইংরেজি ভাষায় তার নাটকের একটি ভাষ্য তৈরী করলেন, পশ্চিমী মনের কাছে তার আবেদন পৌঁছে দেয়ার জন্য। এই ব্যাখ্যায় তিনি একটি নতুন জিনিষ উপস্থিত করলেন-যা হয়ত পূর্ব ব্যাখ্যায় উহ্য ছিল-সে হ’ল প্ৰাচ্য দেশগুলির উপর পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের লোলুপ আক্রমণ। রবীন্দ্রনাথ সাম্রাজ্যবাদ কথাটি উচ্চারণ করেন নি, কিন্তু বলতেও বাকী রাখেননি। “The Giant who is not a gigantic man, but a multitude of men turned into a giagantic system……It is an organised passion of greed that is stalking Europe in the name of European civilisation…… The hungry purpose, having science for its steed, running about unchecked, trampling our life’s harvest, is not an intellectual generalisation unfit for imaginative literature.’ avic “organised passion of greed”—“একটি সংগঠিত লোভাতুর কামনা।” এই কথাটি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। আরও লক্ষণীয়, “The hungry purpose. having science for its steed…”, একটি ক্ষুধার্ত উদ্দেশ্য বিজ্ঞানের ঘোড়ায় চেপে পৃথিবীতে দৌরাত্ম্য আরম্ভ করেছে। প্রশ্ন ওঠে রবীন্দ্ৰনাথ এখানে কাকে দোষী করছেন, বিজ্ঞানকেই দোষী করছেন, না। যারা অপরিমেয় শোষণলালসা চরিতার্থ করার জন্য বিজ্ঞানের আশীৰ্বাদকে মানুষের অভিশাপে পরিণত করেছে তাদের দোষী করছেন; যন্ত্রকেই দোষী করছেন, না যারা যন্ত্রের মালিক হয়ে দেশের দশের ও বিদেশের মালিক হয়েছে তাদের দোষী করছেন, যন্ত্রসভ্যতাকে দোষী করছেন, না ‘যান্ত্রিক’ সভ্যতাকে দোষী করছেন। রক্তকরবীর ইংরেজি ভাষ্য থেকে ঠিক এই প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব পাওয়া যায় না। কারণ, এই ব্যাখ্যায় এমন পংক্তিও খুঁজে পাওয়া যাবে যার দ্বারা মনে হতে পারে রবীন্দ্রনাথ দুর্বল মানুষের দুৰ্গতির জন্য যন্ত্রকেই দায়ী করছেন -“I have a stronger faith in the simple personality of man than in the prolific brood of machinery that wants to crowd it out.’
সুতরাং যারা রবীন্দ্ৰনাথ পশ্চিমী সভ্যতার প্রেমে পড়েননি বলে স্বস্তি পেয়েছেন, তারা আরও নিশ্চিন্ত হলেন। পশ্চিমী সভ্যতা মানে জড় বিজ্ঞানের, যন্ত্রবিজ্ঞানের সভ্যতা। রবীন্দ্ৰনাথের রক্তকরবীতে এই সভ্যতার পরাজয় ঘটেছে, কৃষিনির্ভর তপোবনের শান্তির বাণী আবার ভারতবর্ষে ফিরে এসেছে কবিঋষির কণ্ঠে। এই তো রবীন্দ্ৰনাথ, উপনিষদের রবীন্দ্ৰনাথ যার সাহিত্যতত্ত্বের ছত্ৰে ছত্ৰে উপনিষদের তত্ত্ব প্ৰতিফলিত। কিন্তু বাদ সাধলেন। স্বয়ং রবীন্দ্ৰনাথ। কাব্য ও নাটকে কবি নিজে থাকেন। অন্তরালে, কিন্তু প্ৰবন্ধের ভিতরে তিনি প্ৰত্যক্ষ আত্মপ্রকাশের সুযোগ পান সকলের প্রসারিত দৃষ্টির সম্মুখে। রক্তকরবী প্ৰথম প্ৰকাশিত হয় ১৩৩১ সালে আশ্বিনের প্রবাসীতে। এক বছর পরে যখন কবি, তার ইংরেজী ভাষ্য রচনা করলেন, ঐ একই সময় তিনি লিখলেন তার বিখ্যাত “চরকা” প্ৰবন্ধ। সে প্ৰবন্ধে কবির বক্তব্য শোনা যাক-“য়ুরোপীয় সভ্যতায় বিজ্ঞান চর্চার সামনে যদি কোনো বড়ো নৈতিক সাধনা থাকে। সে হচ্ছে বাহু-প্ৰকৃতির হাতেীয় সব রকম মায় থেকে মানুষকে মাচানো, আয় হচ্ছে মানুষেরই মনটাকে যন্ত্রে না বেঁধে প্ৰাকৃতিক, শক্তিকেই যন্ত্রে বেঁধে সমাজের কাজ আদায় করা। এ কথা নিশ্চিত যে বিজ্ঞানকে একপাশে ঠেলে রেখে কেবল হাত চালিয়ে দেশের বিপুল দারিদ্র্য কিছুতে দূর হতে পারে না। মানুষের জানা এগিয়ে চলবে না, কেবল তার করাই চলতে থাকবে, মানুষের পক্ষে এত বড় কুলিগিরির সাধনা আর কিছুই নেই।–বিজ্ঞান মর্ত্যলোকে এই বিষ্ণুচক্রের অধিকার বাড়াচ্ছে একথা যদি ভুলি, তাহলে পৃথিবীতে অন্য যে সব মানুষ চক্রীর সম্মান রেখেছে তাদের চক্রান্তে আমাদের মরতে হবে।” আধুনিক যন্ত্রবিজ্ঞানের সাধনায় দেশের মানুষকে যে কবি এমন করে আহ্বান জানালেন ঐ একই মুহুর্তে তিনি আবার নাটকে ও ভাষ্যে যন্ত্রবিজ্ঞানকেই ধিক্কার দিলেন কেমন করে? তাই রক্তকরবীর মর্ম নিহিত রয়েছে ঐ প্রবন্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ কথার ভিতরে-“মানুষেরই মনটাকে যন্ত্রে না বেঁধে, প্ৰাকৃতিক শক্তিকেই যন্ত্রে বেঁধে সমাজের কাজ আদায় করা”। পশ্চিমী সভ্যতার দোষটা তা হলে বিজ্ঞান ও যন্ত্রের নয়, দোষটা হল সংগঠিত ধনিক সভ্যতার দুরন্ত লোভের, যার ফলে বিষ্ণুচক্রের আশীৰ্বাদ মানুষের অভিশাপে পরিণত হয়েছে, মানুষের মনটাকেই যন্ত্রে বাধা হয়েছে। মুক্তি চাই যন্ত্রবিজ্ঞানের হাত থেকে নয়, ঐ দুরন্ত লোভের হাত থেকে। এ ছাড়া কোন সংগত অর্থ আর রক্তকরবীর হতে পারে না।
মুক্তধারা সম্পর্কে ও ঐ একই কথা খাটে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ধিক্কারটা যন্ত্রের উপরেই বাৰ্ষিত হয়েছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখতে হয় মুক্তধারা থেকে রক্তকরবী পৰ্যন্ত সময়টাতে পাশাপাশি একটি স্বচ্ছ দ্ব্যর্থহীন প্ৰবন্ধের ধারাও চলেছে-‘শিক্ষার মিলন’ থেকে “স্বরাজ। সাধন” পৰ্য্যন্ত। বিশেষ করে ‘শিক্ষার মিলনের’ ভিতরে রবীন্দ্রনাথ পূর্ব-পশ্চিমের যে মিলনের আদর্শ তুলে ধরলেন তা দৃষ্টির প্রসন্নতা ও বুদ্ধির প্রখরতায় অতুলনীয়। উপনিষদীয় নির্লোভ আত্মিক সাধনার সঙ্গে পাশ্চাত্য বস্তুবিজ্ঞানের সাধনাকে মিলাতে হবে, না হলে মানুষ সম্পূর্ণ হবে না। পাশ্চাত্য সভ্যতার বিজ্ঞান সাধনাকে তিনি মুক্ত হৃদয়ে আশীৰ্বাদ জানালেন, ধিক্কার দিলেন তার শক্তিমত্ত লালসাকে, যাকে আধুনিক ভাষায় বলে পুজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ। -“মানুষের বুদ্ধিকে ভূতের উপদ্রব এবং অদ্ভুতের শাসন থেকে মুক্তি দেবার ভার যে পেয়েছে, তার বসিাটা পূর্বেই হোক আর পশ্চিমেই হোক তাকে ওস্তাদ বলে কবুল করতে হবে।–সেই আধিভৌতিক রাজ্যের প্রধান বিদ্যাটা আজ শুক্রাচাৰ্য্যের হাতে। ” সেই বিদ্যাটার নাম সঞ্জীবনী বিদ্যা। সেই বিদ্যার জোরে সম্যকরূপে জীবন রক্ষা হয়, জীবন পোষণ হয়, জীবনের সকল প্রকার দুৰ্গতি দূর হয়ে থাকে; অন্নের অভাব, বস্ত্রের অভাব, স্বাস্থ্যের অভাব মোচন হয়; জড়ের অত্যাচার, জন্তুর অত্যাচার থেকে এই বিদ্যাই রক্ষা করে। এই বিদ্যা যথাযথ বিধির বিদ্যা, এ যখন আমাদের বুদ্ধির সঙ্গে মিলবে, তখনই স্বাতন্ত্র্যলাভের গোড়াপত্তন হবে-অন্য উপায় নেই।” “অমৃত লোকের ছাত্র কচকেও এই বিদ্যা শেখাবার জন্যে দৈত্যপাঠশালার খাতায় নাম লেখাতে হয়েছিল।” কিন্তু “পশ্চিমী সভ্যতার অন্তরাসনে লোভ, রাজা হয়ে বসেছে।” “ফললাভের লোভে ব্যবসায়িকতাই যদি মানুষের মধ্যে প্ৰবল হয়ে ওঠে। তবে মানব সমাজ প্ৰকাণ্ড প্ল্যান হয়ে উঠতে থাকে,… …তখন ধন হয় সমাজের রথ, ধনী হয় রখী, আর শক্ত বাধনে বাধা মানুষগুলো হয় রথের বাহন।” এর কিছুদিন পরের প্রবন্ধ “সত্যের আহ্বানে’ও রবীন্দ্ৰনাথ একই কথা অন্য প্রসঙ্গে বললেন- “স্বরাজ গড়ে তোলার তত্ত্ব বহুবিস্তৃত…যাঁরা অর্থশাস্ত্ৰবিৎ তাদের ভাবতে হবে, যারা যন্ত্রতত্ত্ববিৎ তাদের খাটতে হবে, শিক্ষাতত্ত্ববিৎ রাষ্ট্রতত্ত্ববিৎ সকলকেই ধ্যানে ও কর্মে লাগতে হবে।” “বড়ো কলের দ্বারাও মানুষকে ছোট করা যায়, ছোট কলের দ্বারাও করা যায়। এঞ্জিনের দ্বারা ও করা যায়, চরকা দ্বারাও। …মানবমনের বৈচিত্র্যবশতই চরকা যেখানে স্বাভাবিক নয়, সেখানে চরকায় সুতা কাটার চেয়ে মন কাটা যায় অনেকখানি। মন জিনিষটা সুতার চেয়ে কম মূল্যবান নয়।” রবীন্দ্রনাথ দেখালেন আসল রোগ কলটা নয়, আসল রোগ লোভ ও স্বার্থ।
এর কিছু পরেই মুক্তধারার আবির্ভাব। কিন্তু এই প্ৰবন্ধগুলি যে পিছনের পটভূমি তৈরী করেছে মুক্তধারার তাৎপৰ্য্যকে তা থেকে বিচ্ছিন্ন করা কি রসবোধের সহায়ক হবে? মুক্তধারার প্রতিবাদ যন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়, এ প্ৰতিবাদ তাদেরই বিরুদ্ধে যারা উছিত অহঙ্কারে, শক্তির স্পর্ধায় যন্ত্রশক্তির অপপ্ৰয়োগ করেছে, শিবতারাইয়ের কৃষকদের জীবিকার জল থেকে বঞ্চিত করেছে। কলসী, গলায় বেঁধে যে আত্মহত্যা করল তার দুৰ্গতির জন্য কলসীটাকেই দায়ী করার মত অবিবেচক বোধ হয়। রবীন্দ্ৰনাথ ছিলেন না। পাশাপাশি প্ৰবন্ধগুলির ভিতরে রবীন্দ্রনাথের যে বুদ্ধিদীপ্ত প্রখর সামাজিক অনুভূতি স্পষ্টভাবে আত্মপ্ৰকাশ করেছে সমসাময়িক নাটকগুলিকে তাঁর জ্যোতিঃস্পর্শ থেকে আড়াল করে দেখবার চেষ্টা করলে ভারতীয় আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের গৌরব কতখানি রক্ষা পায় জানি না, কিন্তু রবীন্দ্ৰনাথের গৌরব নিশ্চয়ই রক্ষা পায় না।
সবচেয়ে মজার কথা হ’ল, যে পশ্চিমীবিকারগ্রস্ত আধুনিক কবি রবীন্দ্ৰ মানসকে পশ্চিমী সভ্যতার সন্তান বলে প্ৰমাণ করতে উদ্ব্যস্ত, আর যারা পশ্চিমের ‘জড়বাদ” বিরোধী নির্ভেজাল ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার একনিষ্ঠ ধারক ও বাহক বলে রবীন্দ্রনাথকে চিহ্নিত করতে ব্যতিব্যস্ত তাদের দুই বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গী। কিন্তু একটা জায়গায় এসে মিলে গেছে-মিলনটি হয়েছে এক নৈর্ব্যক্তিক নির্বিশেষ অনুভূতিসর্বস্ব সাহিত্যতত্ত্বে। জানিনা এ হেগেলীয় দর্শনের Identity of oppcsites-এর একটি উদাহরণ কিনা।
২
সাহিত্যতত্ত্ব সম্পর্কে রবীন্দ্ৰনাথের নিজের কি ধারণা ছিল, সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর তত্ত্বগত মত কি ছিল-এ প্রশ্নে এখন আমরা স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়েছি। সাহিত্যতত্ত্বের আলোচনায় রবীন্দ্ৰনাথ বার বার উপনিষদ আবৃত্তি করেছেন, ঔপনিষদিক তত্ত্বের সঙ্গে সাহিত্যতত্ত্বকে মিলিয়ে দেখার অনেক রকম চেষ্টা করেছেন; সৃষ্টির আনন্দ, প্ৰকাশের আনন্দ, অনির্বচনীয়, আপনাতেই আপনি সার্থক, প্রয়োজন ও উদ্দেশ্যের অতীত-এ জাতীয় শব্দপ্রয়োগ অনেক জায়গায় অনেকবার করেছেন। এর থেকে নৈর্ব্যক্তিক নির্বিশেষ রসাতত্ত্বের সাধনাই সাহিত্যের সাধনা-ইহাই রবীন্দ্রনাথের চুড়ান্ত মত বলে ধরে নেয়ার পিছনে যুক্তি আছে সন্দেহ নেই। রবীন্দ্ৰনাথ বলেছেন‘বলাবাহুল্য, বিশুদ্ধ সাহিত্য অপ্রয়োজনীয়; তার যে রন্স সে অহেতুক। মানুষ সেই দায়মুক্ত বৃহৎ অবকাশের ক্ষেত্রে কল্পনার সোনার কাঠি ছোওয়া সামগ্রীকে জাগ্রত করে জানে আপনারই সত্তায়। তার সেই অনুভবে অর্থাৎ আপনারই বিশেষ উপলব্ধিতে তার আনন্দ। এই আনন্দ দেওয়া ছাড়া সাহিত্যের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে ব’লে জানি নে” (সাহিত্যের পথে—সাহিত্যতত্ত্ব, পৃ ১২৫)। সাহিত্যের ভিতরে আমরা চোখের জলের মধ্যে দিয়েও একটা অনির্বচনীয় আনন্দ পাই, সাহিত্যের এই আনন্দময় উপভোগ্যতাই তার বৈশিষ্ট্য, এমত আমাদের প্রাচীন আলঙ্কারিকরা অনেক সূক্ষ্ম যুক্তি দিয়ে প্ৰতিপন্ন করেছেন। তাই করুণ, ভয়ানক, রৌদ্র, বীভৎস, সবই রস। মূল ভাব যাই থাকুক, সাহিত্যের পদবীতে উত্তীর্ণ হলে তা রসরূপে আনন্দ-স্বরূপে অভিব্যক্ত হয়। এরিষ্ট্যোটেল বলবেন, চোখের জলের ভিতর দিয়ে শুধু আমাদের চোখের ময়লাটাই কাটে না, অন্তরের ময়লাটাও কেটে যায়, অন্তর প্রসন্ন হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল সাহিত্যের সকল তত্ত্ব কি এই রস-স্বরূপেই নিঃশেষিত হয়ে যায়? এই কি রবীন্দ্ৰনাথের মত? সাহিত্যের সৃষ্টি বা উপভোগের আনন্দ নিশ্চয়ই দুমুল্যের বাজারে সস্তায় ভাল মাছ পাওয়ার আনদন, বা ফাটকাবাজারে দাও মারার আনন্দের সমগোত্রীয় নয়। তা হলে এ হ’ল সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যের দিক। কিন্তু বৈশিষ্ট্যটাই একমাত্ৰ তত্ত্ব নয়, তত্ত্বের উপরিভাগ, উপরিতলার অংশ। সমাজবদ্ধ মানুষের ভাবনার মাধ্যমে অন্যান্য শাস্ত্ৰ। যেমন মানুষের সমাজেই জন্মগ্রহণ করে, সাহিত্যেরও তেমনি জন্মভূমি হ’ল মানুষের সমাজ। এই জন্মভূমিটাই হ’ল সাহিত্যের সাধারণ বা অবিশিষ্ট দিক। এই ভিত্তিভূমির সঙ্গে উপরিতলার রসভূমির সম্বন্ধ নিরূপণ করতে না পারলে সাহিত্যতত্ত্বের মূলোচ্ছেদ ঘটার আশঙ্কা আছে। এ সম্পর্কে রবীন্দ্ৰনাথের বক্তব্য কি-তাই আমাদের আলোচ্য।
ঐ সাহিত্যতত্ত্ব প্ৰবন্ধ থেকেই কবির নিজের দেয়! একটি উদাহরণ দেখা যাক। কবির নিজের জীবনেরই ঘটনা। ভৃত্য মোমিন মিঞা অনেক দেরী করে বেলা দশটায় বাড়ী থেকে এল। কবি একটু রূঢ়স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন—কোথায় ছিলি। “সে বললে—‘আমার মেয়েটি মারা গেছে কাল রাতে।’ বলেই ঝাড়ন নিয়ে নিঃশব্দে কাজে লেগে গেল। বুকটা ধাকু করে উঠল। ভৃত্যরূপে যে ছিল প্রয়োজনীয়তার আবরণে ঢাকা তার আবরণ উঠে গেল। মেয়ের বাপ ব’লে তাকে দেখলুম, আমার সঙ্গে তার স্বরূপের মিল হয়ে গেল; সে হল প্ৰত্যক্ষ, সে হল বিশেষ”। “সেদিন করুণ রসের ইঙ্গিতে গ্ৰাম্য মানুষটা আমার মনের মানুষের সঙ্গে মিলল। প্রয়োজনের বেড়া অতিক্রম করে কল্পনার ভূমিকায় মোমিন মিঞা আমার কাছে হল ৰাস্তব” (সাহিত্যতত্ত্ব)। এখানে রবীন্দ্ৰনাথ প্রয়োজনের অতীত বলতে কি বুঝিয়েছেন? প্ৰভু ও ভূত্যের যে ভেদবুদ্ধিটা সৃষ্টি হয়েছিল ব্যক্তিম্বার্থের তাগিদে, তাকে অতিক্রম করে অভেদ বুদ্ধিটাই বড় হয়ে উঠল, ব্যক্তি ছড়িয়ে পড়ল সমাজের মানুষের মধ্যে। সপ্তানশোকাতুয় পিতৃঙ্গেই এক সাধারণ অনুভুতির ভূমিতে প্ৰভু আর ভৃত্যকে মিলিয়ে দিল। সাহিত্যের সবচেয়ে বড় কাজ এই “সাধারণীকৃতি’। ব্যক্তিস্বার্থের গণ্ডীকে ছাপিয়ে যায় বলে এ প্রয়োজনাতীত, কিন্তু মানুষ হিসাবে এর চেয়ে বড় প্ৰয়োজন বোধ হয়। আর কিছুই নেই।
একই জিনিষকে অন্য দিক থেকে দেখা যাক, সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্ৰনাথ উপনিষদের তত্ত্ব কি অর্থে বুঝেছেন, উপনিষদ সম্পর্কে আমাদের প্রাচীন ব্যাখ্যা কারদে ধারণা থেকে রবীন্দ্ৰনাথের ধারণা যে কত স্বতন্ত্র-সে কথাটাও বোঝা যাবে। “উপনিষদ ব্ৰহ্মস্বরূপের তিনটি ভাগ করেছেনসত্যম্, জ্ঞানম, অনন্তম।” রবীন্দ্ৰনাথ বলছেন সত্যেরই তিনটি দিক –I am, I know, I express। “আমি আছি”, এর ব্যাখ্যা করলেন–‘টিকতে হবে তাই অন্ন চাই, বস্ত্র চাই, বাসস্থান চাই, স্বাস্থ্য চাই।” বলা বাহুল্য ঔপনিষদিক সত্যের এ ব্যাখ্যা কোনও প্রাচীন ব্যাখ্যাকারের ভিতর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আরও এগিয়ে চলুন—“যে পরিমাণে মানুষ বলে অন্যের টিকে থাকার মধ্যেই আমার টিকে থাকা সেই পরিমাণে সে নিজের জীবনের মধ্যে অনন্তের পরিচয় দেয়, সেই পরিমাণে “আমি আছি’ এবং “অন্য সকলে আছে’ এই ব্যবধানটা তার ঘুচে যায়।” এরই নাম অনন্তের আস্বাদ, এর থেকেই আসে প্রকাশের প্রেরণা,-“যেখানে একলা মানুষ সেখানে তার প্রকাশ নেই। এই প্ৰকাশেই আনন্দ। সাহিত্য এই অনন্তের প্রকাশের ভিতর দিয়ে আনন্দ দেয়।” এই সাহিত্যের ব্যাখ্যাকে রবীন্দ্ৰনাথ কোথায় টেনে গিয়ে গেলেন তা লক্ষ্য করার মত। টাকার ঐশ্বৰ্য্য কোথায়?-যখন “সে কোনো একজন অমুক বিশেষ লোকের ভোগ্যতার মলিন সম্বন্ধ হতে মুক্ত হয়। অশেষের প্রসাদ বঞ্চিত সেই বিশেষ ভোগ্য টাকার বর্বরতায় বসুন্ধরা পীড়িত …টাকা যখন १८छद्ध वाश्न श्न उ२न তার চাকার তলায় কত মানুষ ধূলিতে ধুলি হয়ে যায়- “টিটাগড়ের পাটকলের কারখানায় যে মজুরেরা খেটে মরে তারা মজুরি পায়। কিন্তু তাদের হৃদয়ের জন্যে তো কারও মাথাব্যথা নেই। তাতে তো কল বেশ ভালই চলে। যে মালিকেরা শতকরা ৪০০ টাকা হারে মুনাফা নিয়ে থাকে, তারা ত। মনোহরণের জন্য এক পয়সাও অপব্যয় করে না।” বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যতত্ত্বের উপর গভীর বক্তৃতা দিতে গিয়ে কবিগুরু এ সব কি কথা বলছেন, উপনিষদের কথা দিয়ে আরম্ভ করে তিনি কোথায় চলে যাচ্ছেন? সাহিত্য ও শিল্প কলার “আসল কথা হচ্ছে এই যে, তারা আনন্দের ঐশ্বৰ্য্যকে প্ৰকাশ করেছে, প্রয়োজনের দৈন্যকে করেনি। সেই দৈন্যের রূপটা যদি দেখতে চাও তবে পাটকলের কারখানায় গিয়ে ঢোকো, যেখানে গরিব চাষীর রক্তকে ঘূনীচাকার পাক দিয়ে বহু শতকরা হারের মুনাফায় পরিণত করা হচ্ছে।” এই সব উদ্ধৃতিগুলিই “সাহিত্য” প্ৰবন্ধ থেকে। কিন্তু প্ৰবন্ধের উপসংহার হলো–“সেই আনন্দের মধ্যেই যখন প্ৰকাশের তত্ত্ব তখন এ প্রশ্নের কোনো অর্থই নেই যে আর্টের দ্বারা আমাদের কোনো হিতসাধন হয় কিনা।” এখানে ‘হিতসাধন” কথাটি রবীন্দ্ৰনাথ কি অর্থে গ্ৰহণ করেছেন তা বুঝতে হলে আরও এগিয়ে যেতে হবে। ‘সৃষ্টি” প্ৰবন্ধটির দিকে নজর দেয়া যাক-“মানুষের শ্রেষ্ঠ পরিচয় হচ্ছে, মানুষ সৃষ্টিকর্তা, আজকের দিনের সভ্যতা মানুষকে মজুর করেছে, মিস্ত্রি করেছে, মহাজন করেছে, লোভ দেখিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে খাটো করে দিচ্ছে …কোনখানে মানুষের শেষ কথা? যা সৌন্দৰ্য্যের সম্বন্ধ, কল্যাণের সম্বন্ধ, প্রেমের সম্বন্ধ, তারই মধ্যে, সেইখানেই মানুষের সৃষ্টির রাজ্য। …যেখানে একজন ধনী দশজনকে শোষণ করেছে, যেখানে হাজার হাজার মানুষের স্বাতন্ত্র্যকে হরণ করে একজন শক্তিশালী হচ্ছে, যেখানে বহু লোকের ক্ষুধার অন্ন একজন লোকের ভোগবাহুল্যে পরিণত হচ্ছে, সেখানে মানুষের সত্যরূপ শান্তিরূপ আপন সুন্দর সৃষ্টির মধ্যে প্ৰকাশ পেল না।” এই বক্তব্যের সঙ্গে ‘সাহিত্য” প্ৰবন্ধের উপসংহারী মন্ধব্যটির সংগতি কোথায়? প্ৰবন্ধগুলি সামগ্রিকভাবে পড়লেই সংগতি ধরা পড়ে। সাহিত্য বা আর্টের মধ্যে সৃষ্টি ও উপভোগের আনন্দটাই তার স্বকীয়তা। হিতসাধন করব বলে সাহিত্য শাস্ত্রবার্তার আসরে নেমে আসে না। কিন্তু সমাজে যখন বিপুল অহিত জমে ওঠে, একজনের ব্যক্তিহিতের স্বার্থে যখন সমষ্টির হিতস্বর্থ পদদলিত হয়, তখন এই পরম অকল্যাণের ভূমিতে সাহিত্যের রাসব্যক্তি পূর্ণ হতে পারে না, যদি তার “সাধারণীকৃতি” সার্থক না হয়। আর সাধারণীকৃতি সার্থক হতে পারে না। যদি তার কল্যাণের ভূমিকা না থাকে। এ কল্যাণের ভূমিকা কোনো প্ৰতিজ্ঞাপত্ৰ স্বাক্ষর করে আসে না। কল্যাণ করব বলে নোটিশ দিয়ে আসে না। কিন্তু যিনি আনন্দলোকের স্রষ্টা তার দরদীমন পদদলিত সামগ্রিক মানবতার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে, যেমন করেছিল কন্যা শোকাতুর মোমিন মিঞার সঙ্গে। এই ব্যাপক সাধারণীকৃতির পিছনে থাকে বৃহত্তম মানবিকতার আবেদন, অন্যের বাঁচার ভিতর দিয়েই আমি বাঁচি, এই পরম সত্যের প্রকাশ। হৃদয়ের বিপুল প্রসারজনিত আনন্দের মধ্যে বেদনাও তখন, মধুর হয়ে মিশে যায়–সাহিত্যের স্রষ্টা, উপভোক্তা ও সাহিত্যের জীবন্ত মানুষগুলি একাত্ম হয়ে মিশে যায়। এই একাত্মীয়তারই নাম সহস্ৰদয়ত। উপনিষদের আধ্যাত্মিক সত্যকে রবীন্দ্ৰনাথ যেমন মানবিক সত্যে পরিণত করলেন, সঙ্গে সঙ্গে প্ৰাচীন আলঙ্কারিকদের অলৌকিক সাধারণীকৃতি ও সহৃদয়তাকেও প্রসারিত করলেন মানবলোকে। “আমি আছি এবং আর সমস্ত আছে, আমার অস্তিত্বের মধ্যে এই যুগল মিলন। আমরা বাইরে যদি কিছুই অনুভব না করি তবে নিজেকেও অনুভব করিনে। বাইরের অনুভূতি যত প্ৰবল হয়। অন্তরের সত্তাবোধ ও তত জোর পায়। আমি আছি, এ সত্যটি আমার কাছে চরম মূল্যবান। সেই জন্য যাতে আমার সেই বোধকে বাড়িয়ে তোলে তাতে আমার আনন্দ। বাইরের যে কোনো জিনিসের “পরে আমি উদাসীন থাকতে পারিনে” (সাহিত্যতত্ত্ব)। রবীন্দ্রসাহিত্যতত্ত্বের মূল কথা— “উদাসীন থাকতে পারিনে?” এই কথাটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে। যে উদাসীন সে একক নিঃসঙ্গ, তার সংকুচিত ব্যক্তিত্বের ভারে সে অবনত, সে অনায়াসে লোভের কাছে আত্মবিক্রয় করে, পরকে পীড়ন করে আপনার শূন্য ব্যক্তিত্ব পূর্ণ করার চেষ্টা করে, তার ফলে ব্যাপক মানবতা থেকে আপনাকে আরও বেশী বিচ্ছিন্ন করে, তার একাকিত্বের দৈন্যকে আরও দুর্বাহ করে তোলে। তাই, যে সাহিত্য স্পর্ধিত একাকিত্বের সাধনা করে তার রস ব্যক্তি অপূর্ণ ও বিকৃত। মূল্যবোধহীন বিকৃত একক মানুষের আন্তরিক ও সামাজিক দৈন্তের ক্ষুধিত চেহারাটাই সে সাহিত্যেনৈর্ব্যক্তিক গৌরবের ঘোমটা পরে আত্মপ্রকাশ করে। ঐটুকুই তার সার্থকতা। কিন্তু তার রসবোধে ব্যাপ্তিও নেই, গভীরতাও নেই। প্রশ্ন উঠতে পারে ব্যাক্তি না থাক, গভীরতা থাকতে বাধা কি? সাহিত্যরস কুয়ার জলের মত নয় যে ব্যাপ্তি না হলেও গভীরতা থাকতে বাধা নেই। সাহিত্যরসের কথা বাদই দিলাম, স্কুল রসগোল্লার রসবোধও গভীর হতে পারে না। যদি তার ব্যাপ্তি না ঘটে। যে রসগোল্লা খেতে ভালবাসে সে যদি একা এক নিভৃত কোণে বসে গপগপ গিলতে থাকে। তার রসনা রসের তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। কিন্তু যখন দশজনে সভায় বসে তাকে আদরে ও আনন্দে খাওয়ায় তখন তার রসনার রসাতৃপ্তিও গভীর হয়। কারণ সামাজিক শ্ৰীতি ও সৌজন্যের ভিতরে সে তৃপ্তি ছড়িয়ে পড়ে। “আধুনিক কাৰ্য” প্ৰবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যে আধুনিক কবিদের নকল নৈর্ব্যক্তিকতার স্বরূপ উদঘাটিত করলেন তারা এই মানবিক মূল্যহীন একাকিত্বের সাধক। তাদের তিনি নাম দিলেন অঘোরপন্থী। সমাজের গলিত শবটাকে কথার তোড়ায় সাজিয়ে সদর রাস্তায় বের করাতেই আনন্দ। যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, ততঃ কিম। তার উত্তরের প্রয়োজন নেই। মানুষটা যে একদিন বেঁচেছিল তাও মিথ্যা, ভবিষ্যতে যে মানুষ বাঁচবে তাও মিথ্যা, মাঝখানের ঐ শবটাই সত্য, কারণ ও পথ জুড়ে পড়ে আছে। কফিন সাজাবার ভিতরেও শিল্প আছে, কিন্তু সব শিল্প যদি কফিন-সাজাতেই শেষ হয়ে যেত, জীবন্ত মানুষের জন্য যদি কিছুই বাকী না থাকত, তবে কফিন শিল্পটা ও গড়ে উঠত না, কারণ ওটা জীবনশিল্পের উচ্ছিষ্ট দিয়েই তৈরী।
যদি কেউ আপত্তি তোলেন রবীন্দ্ৰনাথের কায়দায় নিজের কথা বলা হচ্ছে, তাকে কবির নিজের কথাতেই নিয়ে যাওয়া যাক। তখন তিনি সত্তর বছরের বৃদ্ধি, কিন্তু ভবিষ্যৎ শিবের স্বপ্ন দেখছেন না। প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রস্তুতিপৰ্ব পৰ্যন্ত ইয়োরোপীয় ইতিহাসের অন্তরলোক বিশ্লেষণ করে “শব সাহিত্যে’র উৎপত্তির কারণ নিৰ্ণয় করলেন (সাহিত্যের পথে-“পঞ্চাশোৰ্দ্ধম”, পৃ: ২৩৭-২৩৮)। “সম্পদের জয়তোরণ তলার উপর তলা গেথে ইন্দ্ৰলোকের দিকে চুড়া তুলেছিল, সেই ঔদ্ধত্য ধরণীর ভারাকর্ষণ সইতে পারল না—একমুহূর্তে হ’ল ভূমিসাৎ। পুষ্টদেহধারী তুষ্টচিত্ত পুরাতনের মৰ্য্যাদা আর রইল না। নূতন যুগ আলুথালু বেশে অত্যন্ত হঠাৎ এসে পড়ল, তাড়াহুড়া বেঁধে গেল। অস্থায়িত্বের এই ভয়ংকর চেহারা অকস্মাৎ দেখতে পেয়ে কোনো কিছুর স্থায়িত্বের প্রতি শ্ৰদ্ধা লোকের একেবারে আলগা হয়ে গেছে। সমাজে সাহিত্যে কলা-রচনায় অবাধে নানাপ্রকারের অনাসৃষ্টি শুরু হ’ল।”
এই অনাসৃষ্টি দূর করার জন্য কবি নবীনদের আহ্বান জানালেন। এই আহ্বানের ভিতরে সাহিত্যের প্রতি কবির দৃষ্টিভঙ্গীটি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়—কেউ যদি এই দৃষ্টিভঙ্গীকে Socialist Realism-এর কাছাকাছি বলে প্রেরণা লাভ করতে চান তাকে বোধ হয় গাল দেওয়া চলে না। “যেটাকে মানুষ পেয়েছে সাহিত্য তাকেই যে প্ৰতিবিন্বিত করে তা নয়; যা তার অনুপলব্ধ, তার সাধনার ধন, সাহিত্যে প্রধানত তারই জন্য কামনা উজ্জ্বল হয়ে ব্যক্ত হতে থাকে। বাহিরের কর্মে যে প্রত্যাশা সম্পূর্ণ আকার লাভ করতে পারেনি, সাহিত্যে কলা-রচনায় তারই পরিপূর্ণতার কল্পরূপ নানাভাবে দেখা দেয়। শাস্ত্র বলে, ইচ্ছাই সত্তার বীজ-বিশেষ যুগের ইচ্ছা, বিশেষ সমাজের ইচ্ছা, সেই যুগের, সেই সমাজের আত্মরূপ সৃষ্টির বীজশক্তি।
“সাহিত্যে মানুষের ইচ্ছারূপ এমন ক’রে প্রকাশ পায় যাতে সে মনোহর হয়ে ওঠে, এমন পরিস্ফুট মূতি ধরে যাতে সে ইন্দ্ৰিয়গোচর বিষয়ের চেয়ে প্ৰত্যয়গম্য হয়। সেই কারণেই সমাজকে সাহিত্য একটি সজীব শক্তি দান করে; যে ইচ্ছা তার শ্রেষ্ঠ ইচ্ছা সাহিত্যযোগে তা শ্রেষ্ঠ ভাষায় ও ভঙ্গীতে দীর্ঘকাল ধরে মানুষের মনে কাজ করতে থাকে এবং সমাজের আত্মসৃষ্টিকে বিশিষ্টতা দান করে…যা আমাদের ভাল লাগে, অগোচরে তাই আমাদের গড়ে তোলে। সাহিত্যে শিল্পকলায় সেই ভালো লাগার প্রভাব কাজ করে। সমাজ সৃষ্টিতে তার ক্রিয় গভীর। এই কারণেই সাহিত্যে যাতে ভদ্রসমাজের আদর্শ বিকৃত না হয়, সকল কালেরই এই দায়িত্ব।” (পঞ্চাশোৰ্দ্ধম)।
ভবিষ্যৎ নূতন সমাজ সৃষ্টির কাজে সাহিত্যপ্রতিভাকে উৎসর্গ করার জন্য রবীন্দ্ৰনাথ নবীন সাহিত্যিকদের আহবান জানালেন। বাল্যাবধি যে বৃহত্তর মানবিকতার আদর্শ রবীন্দ্ৰ মানসে স্পষ্ট হতে স্পষ্টতার হয়ে গড়ে উঠেছিল এ তারই ন্যায়সংগত পরিণতি। এরই এক বছর আগে “সাহিত্য সমালোচনা” প্রসঙ্গে তিনি বললেন—“আমাদের সব সাহিত্যের গোড়াতেই যে মহাকাব্য, স্পষ্টই দেখি, তার লক্ষ্য মানুষের দৈন্য প্রচার–মানুষের লজ্জা ঘোষণা করা নয়—তার মাহাত্ম্য স্বীকার করা।” এই একই কবি যখন আবার বলেন, বিশুদ্ধ সাহিত্য অপ্রয়োজনীয়, আনন্দ দেয়া ছাড়া সাহিত্যের আর কোন উদ্দেশ্য নেই, তখন এই কথাগুলিকে আগের কথার সংগে মিলিয়ে দেখতে হবে। মানুষের গৌরব মানুষের সকল সৃষ্টির মধ্যেই প্ৰতিভাত; মানুষ যা কিছু সৃষ্টি করেছে, বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প, কলা, সাহিত্য সব কিছুর মধ্যেই এই একটি সাধারণ মিল রয়েছে-প্ৰত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে মানুষের সকল সৃষ্টি সকল বিদ্যা মানুষেরই বিজয় গৌরব ঘোষণা করেছে। সাহিত্যের কাজ আনন্দ দেওয়া, কিন্তু তার এই সাধারণ ধর্ম থেকে বিদ্যুত হয়ে সে কাজ করা সম্ভব নয়। সমাজের সংগে সাহিত্যের যে সম্বন্ধ তা মূলত এই গৌরবকে প্রতিফলিত করা, ভবিষ্যতের জন্য পরিবর্ধিত করা, পথের বাধাকে অপসারিত করার সম্বন্ধ। কদৰ্য্যতার দিকটাও সাহিত্যে প্ৰতিফলিত করা, ভবিষ্যতের জন্য পরিবর্ধিত করা, পথের বাধাকে অপসারিত করার সম্বন্ধ। কদর্য্যতার দিকটাও সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়, কিন্তু তা এই সৌন্দর্য্য ও গৌরবকে আরও ভাস্কর করার জন্য। সাহিত্য তার বিশেষ কারুকর্মের ভিতর দিয়ে, বক্ৰোক্তি, অলংকার, ব্যঞ্জনার ভিতর দিয়ে একাজটিই করে, তাই সে প্ৰকাশ পায় আনন্দরূপে; শৃঙ্গার, করুণ বীভৎস, ভয়ানক, রৌদ্র সব মিলিত হয় একটি আনন্দের স্বপ্ৰকাশ অনুভূতিতে। এখানে ম্যাকবেথ ও হামলেটেরও অত্যুচ্চ স্থান আছে। মানুষের গৌরবকে অবমাননা করলে তার পরিণতি কি সুকঠোর, আর সেই অবমাননার বিরুদ্ধে দুর্বার সাহসে সংগ্ৰাম করতে না পারলে তার পরিণতি কি মর্মান্তিক-সেই রহস্য অপূর্ব কলাকৌশলের সাহায্যে উদঘাটিত ক’রে ম্যাকবেথ আর হ্যামলেটও মানুষকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। এখানে আনন্দের প্রকাশ বেদনায় মধুর, কারণ ট্রাজেডি অন্তরাত্মাকে শুদ্ধ করার দাম দেয় বেদনার মধ্য দিয়ে।
তাই “আনন্দ দেওয়া ছাড়া সাহিত্যের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই” সাহিত্যের এই নিতান্ত বৈশিষ্ট্যগত তত্ত্বটিকে যখন মানবিক মূল্যবোধহীন সাহিত্যিকরা কফিন-সাহিত্য সৃষ্টির কাজে লাগিয়ে অনাসৃষ্টি শুরু করে, তখন কবিগুরুকেই রাশ টেনে ধরতে হয়, বলতে হয়-গোড়াঘাটের নোঙরটি ছিড়ে উধাও হয়ে না, জন্মাবধি মানুষের দুর্বার অগ্রগতির কথা ভুলো না, জড় প্রকৃতির উপর মানুষের জয়যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে ভাবি জগতেও তার গৌরব? দীপ্ত অভিযানের কথা ভুলোনা। ‘মানুষ বিশ্ব প্ৰকৃতির অন্তর্গত।…কিন্তু সে পৃথিবী তার ইচ্ছার সঙ্গে সম্পূর্ণ মিশ খায়নি, তাই আদিকাল থেকেই প্ৰাকৃতিক পৃথিবীকে মানব বুদ্ধিকৌশলে আপনি ইচ্ছানুগত মানবিক পৃথিবী করে তুলছে” – উপকরণ পাচ্ছে এই পৃথিবীরই কাছ থেকে, শক্তি ধার করছে। তারই গুপ্ত ভাণ্ডারে প্রবেশ করে। সেগুলিকে আপনি পথে আপন মতে চালনা করে পৃথিবীর রূপান্তর ঘটিয়ে দিচ্ছে।… মানুষের বিশ্বজয়ের এই একটা পালা বস্তু জগতে; ভাবের জগতে তার আছে আর একটা পালা। ব্যবহারিক বিজ্ঞানে একদিকে তার জয়ন্তম্ভ, আর একদিকে শিল্পে সাহিত্যে। যে দিন থেকে মানুষের হাত পেয়েছে নৈপুণ্য, তার ভাষা পেয়েছে অর্থ সেই দিন থেকেই মানুষ তার ইন্দ্ৰিয়বোধগম্য জগৎ থেকে নানা উপাদানে উদ্ভাবিত করেছে তার ভাবগম্য জগৎকে…কল্পনা দিয়ে তাকে এমন রূপ দিয়েছে, হৃদয় দিয়ে তাতে এমন রস দিয়েছে, যাতে সে মানুষের মনের জিনিষ হয়ে তাকে দিতে পারে আনন্দ” (সাহিত্যের তাৎপর্য্য)। কথাগুলি রবীন্দ্রনাথের—কোটেশন মার্ক না থাকলে মার্কস এঙ্গেলসের কথা বলেও মনে হতে পারতো।
সাহিত্যের আনন্দ, প্রকাশের আনন্দ, সৃষ্টির আনন্দ কোথায় ব্যাহত হচ্ছে, তুচ্ছ প্রয়োজন কোথায় এই আনন্দকে ব্যাহত করছে তার দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে রবীন্দ্ৰনাথ বার বার কেন নিঃসহায় দরিদ্রের উপর ধনীর লোলুপ শোষণের কথা উল্লেখ করছেন, উল্লেখ করতে গিয়ে তাঁর ভাষায় অমন তীব্র আবেগ কেন সঞ্চারিত হচ্ছে, গম্ভীর সাহিত্যতত্ত্বের আলোচনাকালে এই শোষক-শোষিত দ্বিধা বিভক্ত সমাজের কথা বার বার কেন তার মনে আসছে, কলাকৈবল্যবাদীদের নিশ্চয়ই এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে হবে। কিন্তু এ উত্তর তারা দিতে পারেন না-বলবেন, রবীন্দ্ৰনাথ এক split-personality। কিন্তু রবীন্দ্রসাধনার আজন্ম ও আমৃত্যু অগ্রগতির ধারা যারা সামগ্রিকভাবে অনুধাবন করেছেন তাদের পক্ষে এর উত্তর খুব সহজ। মুষ্টিমেয় মুনাফালোলুপ ধনিকের হাতে মানব সমাজের সামগ্রিক গৌরব লাঞ্ছিত। সাহিত্যের বিশুদ্ধ আনন্দরস যে মূল ভিত্তির উপর নির্ভর করে আত্মপ্রকাশ করতে পারে ধনিক সভ্যতা সেই ভিত্তিটাকেই ভেঙে দিচ্ছে, তাই রসের ধারা শুকিয়ে যাচ্ছে, সাহিত্য বন্ধ্যাত্ব প্রাপ্ত হয়ে উন্মার্গগামিতার ভিতরে প্রকাশের পথ খুঁজছে।
রবীন্দ্ৰনাথ মার্কসবাদী বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তার সিদ্ধান্তে পৌছাননি, মননধর্মী মানবিকতার আবেদন থেকে তিনি তার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। সমাজের সঙ্গে সাহিত্যের গভীর সম্পর্কও তিনি এদিক থেকেই বিচার করেছেন। আমাদের দেশের কাব্যশাস্ত্রের বিচারে এদিকটা প্ৰায় অনুপস্থিত। হয়তো বা সমাজ ও সাহিত্যের সম্পর্কটা স্ব-প্ৰতিভাত সিদ্ধান্ত বলেই অনুচ্চারিত রয়ে গেছে। কিন্তু এর ফলে কাব্যশাস্ত্রের তত্ত্বালোচনা একদেশদর্শী হয়ে পড়েছে, অলংকার, রস, ধ্বনি, চমৎকারিত্ব, সাহিত্যের এই বিশেষ ধর্মগুলির আলোচনাতেই নিঃশেষিত হয়েছে। তার ফলে মাতৃভূমির সঙ্গে সাহিত্যতত্ত্বের যোগসূত্রটা হারিয়ে গেছে। ভারতের নাট্যশাস্ত্রের ভূমিকায় একটা গভীর তাৎপৰ্যপূর্ণ উপাখ্যানের ভিতরে সাহিত্য ও সমাজের সম্পর্কের প্রশ্নটা একবার উথাপিত হয়েছিল, কিন্তু তারপর আঙ্গিক ও রসাতত্ত্বের চাপে তলিয়ে গেছে। ব্ৰহ্মা নাট্যবেদ সৃষ্টি করলেন, ভরতমুনি তার প্রচারক। এই নাট্যবেদকে বলা হল পঞ্চমবেদ এবং সকল বেদের শ্রেষ্ঠ। কারণ, চতুৰ্বেদে স্ত্রী ও শূদ্রের অধিকার নেই, এই নাট্যবেদে সমগ্ৰ জনসাধারণের সমান অধিকার। বিশ্বকর্ম রঙ্গমঞ্চ তৈরী করলেন, অভিনয় হবে। দানবরা এল রঞ্চমঞ্চ ভেঙ্গে দিতে, তারা নাটক অভিনীত হতে দেবে না। ব্ৰহ্মা তাদের ডেকে পাঠালেন-কি তাদের আপত্তি ? দানবরা উত্তর করল-দেবতাদের ইচ্ছায় আপনি নাট্যবেদ সৃষ্টি করছেন, সুতরাং তাদেরই স্বার্থে আমাদের চিত্রিত করা হবে কলঙ্কের দাগে। ব্ৰহ্মা বললেন, তোমাদের বা দেবতাদের কারুর পক্ষে বা বিপক্ষে কোন পক্ষপাতিত্বমূলক ভাবনা কোন নাট্যে থাকবে না, ত্ৰিভুবনের সত্য ঘটনাই নাটকীয় ভাবনায় রূপান্তরিত হবে। লোকসমাজ-বৃত্তান্তের অনুকরণই হবে নাট্য। এই নাট্যধর্ম, যশ, আয়ু, কল্যাণ, বুদ্ধি, ও লোকোপদেশ ধারণ করে আবিভূতি হবে। কাজেই তোমাদের দুঃখ ও ক্ৰোধ অমূলক। (নাট্যশাস্ত্র ১১০৩১১৫) আশ্চর্ঘ্যের কথা এই গুরুত্বপূর্ণ উপাখ্যানটির তাৎপৰ্য নিয়ে পরবর্তী কোনো কাব্যশাস্ত্রে আর আলোচনা হালনা। সমস্ত প্রশ্নটাই চাপা পড়ে গেল।
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য এ প্রশ্নটি নাট্যশাস্ত্রের সূত্র ধরে উত্থাপিত করেননি। তার নিজের সামাজিক ও সাহিত্যিক অভিজ্ঞতা এবং বিশ্ব-সাহিত্যের সমীক্ষা, সর্বোপরি তার উদার মানবিকতা থেকেই এ প্রশ্ন আলোচনা করলেন। ‘সাহিত্য অর্থেই একত্ৰ থাকিবার ভাব-মানুষের “সহিত’ থাকিবার ভাবমানবকে স্পর্শ করা, মানবকে অনুভব করা…উদ্দেশ্য না থাকিয়া সাহিত্যে এইরূপ সহস্র উদ্দেশ্য সাধিত হয়” (সাহিত্যের উদ্দেশ্য)। এ প্রসঙ্গে একটি প্ৰবন্ধ বিশেষভাবে অনুধাবণীয়, ১৩০১ সালের লেখা “সাহিত্যের গৌরব”। এখানে রবীন্দ্ৰনাথ হাঙ্গেরি ও পোল্যাণ্ডের দুই সাহিত্যরখীর আলোচনা প্রসঙ্গে সমাজ ও সাহিত্যের গভীর সম্পর্কের দিকটি আলোচনা করলেন, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে উচ্চগ্রামের সাহিত্য সৃষ্টির অন্তরায়ের কথাটি যেভাবে আলোচনা করলেন তা আজকের দিনে নূতন করে ভাববার কথা; ইয়োরোপীয় সাহিত্য আমাদের তুলনায় কেন এত অধিক অগ্রসর তার কারণ নির্ণয় করারও তিনি চেষ্টা করলেন।
রবীন্দ্ৰনাথের সাহিত্যতত্ত্ব-সমীক্ষার সামগ্রিক ফল হল রসতত্ত্বকে সমাজের ভিত্তিতে, বৃহত্তম মানবিকঐক্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করা। ভরতের নাট্যশাস্ত্রের ভূমিকাগত উপাখ্যানটিতে সাহিত্য ও সমাজের যে সম্পর্কের সমস্তাটি একবার মাত্র মুখ দেখিয়ে আঙ্গিকের তলায় তলিয়ে গেল, রবীন্দ্রনাথ তাকে নূতনযুগের নূতন ভাবনার ভিত্তিতে দাঁড় করালেন, প্রাচীন রসতত্ত্বকে সংস্কৃত ও পরিমাজিত করে এক উন্নততর মানবিক ভূমিতে রসের ও সমাজের মিলন ঘটালেন। এ কাজ করতে গিয়ে উপনিষদের আধ্যাত্মিক তত্ত্বকেও, হয়তো নিজেরই অজ্ঞাতসারে, পরিমাজিত ও পরিবর্ধিত করে আধুনিক ও ভবিষ্যৎ মানবসমাজের উপযোগী করে প্রকাশ করলেন। এই শেষের কথাটিতে অনেকের আপত্তি উঠতে পারে। অনেক জায়গাতেই একথা শুনতে হয়েছে -রবীন্দ্ৰনাথের মানবিকতা আর উপনিষদের আধ্যাত্মিকতা একই জিনিষ। কিন্তু এ কথাটির ভিতরে একটা মস্ত বড় ফ্যাক সৃষ্টি করেছে বাংলা ভাষার হ্রস্ব ই-কারটি। এই অক্ষরটি যাদুকর। একটুমাত্র স্থান বদল করে অর্থের ওলট-পালট ঘটিয়ে দেয়। যদি বলি “মানবিকতাই আধ্যাত্মিকতা’-মার্কসবাদীরাও আপত্তি করবেন না, কিন্তু অলৌকিক আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী অনেকেই আপত্তি তুলবেন। যদি বলি আধ্যাত্মিকতাই মানবিকতা, অলৌকিক রহস্যবাদীরা খুলী হবেন, কিন্তু বস্তুবাদীরা আপত্তি করবেন। কিন্তু একথা ধ্রুব সত্য যে রবীন্দ্ৰনাথ যে অর্থে উপনিষদের মন্ত্রগুলি ব্যবহার করেছেন তা আধ্যাত্মিকতা সম্বন্ধে আমাদের প্রচলিত ধারণার সঙ্গে মেলে না। “মানব সত্য’ প্ৰবন্ধটি যদি “মানুষের ধর্মের”। সারাংশ হয়ে থাকে, তবে এই সত্য কোনো অলৌকিক পারলৌকিক মুক্তির বাণী নয়, ইহলোকের মহামানবে ৫ পয়ম সৌভ্রাত্র ও শান্তির বাণী। “অমানব বা অতিমানব সত্যে উপনীত হওয়ার কথা যদি কেউ বলেন, তবে সে কথা বোঝবার শক্তি আমার নেই। কেননা, আমার বুদ্ধি মানব বুদ্ধি, আমার হৃদয় মানব হৃদয়, আমার কল্পনা মানব কল্পনা- “এই বুদ্ধিতে এই আনন্দে যাঁকে উপলব্ধি করি তিনি ভূমা, কিন্তু মানবিক ভূমা। তার বাইরে অন্য কিছু থাকা না থাকা মানুষের পক্ষে সমান। মানুষকে বিলুপ্ত করে যদি মানুষের মুক্তি, তবে মানুষ হলুম কেন” (মানব সত্য)। কিন্তু এই বিশ্বমানবের প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসটা ছিল আধ্যাত্মিক ধরণের। একটা অকুণ্ঠিত বিনয়নম্র ভক্তির ভাব ছিল প্রবল। হয়তো তিনি বিশ্বমানবের ভিতরেই প্রকাশমান এক বিশ্বমানবিক আত্মাতেই বিশ্বাস করতেন। কারণ, তিনি তাঁর বিরাট মানব-সত্যে পৌঁছেছিলেন স্বাভাবিসিদ্ধ মানব-প্রেম ও হৃদয়ের আবেগের ভিতর দিয়ে। এর ভিতরে অত্যুচ্চ মানবধর্মের সন্ধান পাওয়া গেলেও, ইতিহাসের বস্তুবাদী বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তিনি এ সত্যে পৌঁছাননি। কিন্তু এই সত্যে পৌঁছাতে হবে কঠোর দু:খ, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ভিতর দিয়ে এ স্থির প্রত্যয় তার কোনদিন এতটুকু শিথিল হয়নি। তাই তার নিজের কথায় ‘ফাল্গুনী’ নাটকার ব্যাখ্যা শুনলে চমকাতে হয়—“জরা সমাজকে ঘনিয়ে ধরে, প্রথা অচল হয়ে বসে, পুরাতনের অত্যাচার নূতন প্রাণকে দালন করে নির্জীব করতে চায়—তখন মানুষ মৃত্যুর মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে, বিপ্লবের ভিতর দিয়ে নববসন্তের উৎসবের আয়োজন করে। সেই আয়োজনই তো যুরোপে চলেছে। সেখানে নূতন যুগের বসন্তের হোলি খেলা আরম্ভ হয়েছে” (আত্মপরিচয় পৃ: ৬৬)। সোভিয়েট রাশিয়ার তীর্থভ্ৰমণের পর এই মানব-সত্যের আদর্শ হয়তো কবির কাছে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এর আগে এতো স্পষ্ট করে “মানব সত্যের” বক্তব্য আর কখনও তিনি তুলে ধরেন নি। তিনি সোভিয়েট সমাজের তত্ত্বের দিকটা গ্ৰহণ করতে পারেননি, কিন্তু মানবিকতার দিকটা খোলামনে গ্ৰহণ করেছিলেন। মানবসত্যকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্ৰনাথের কোনো সাহিত্যতত্ত্ব নেই, রসতত্ত্ব নেই।
যখন মানবসত্যের অবগুষ্ঠিতা প্ৰজ্ঞাবাণীকে কবি স্পষ্ট করে দেখতে পেলেন তখন তাঁর নিরুদ্দেশ যাত্রার তরী ‘সভ্যতার সংকট’ পার হয়ে এসে ভিড়লো রূপ-নারাণের কুলে—
জানিলাম এ জগৎ স্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম আপনার রূপ–