রবীন্দ্রনাথের শেষজীবন
চার বছর আগে কবির সঙ্গে দেখা হয়েছিল আত্রাই নদীর বোটে। পতিসর থেকে ফিরে তিনি ট্রেনের অপেক্ষা করছিলেন। তারপরে আমরা প্ল্যাটফর্মে এলুম ও এক কামরায় উঠলুম। রবীন্দ্রনাথকে এত নির্জনে কোনো বার পাইনি। তখনই লক্ষ করেছিলুম তাঁর আননে অন্য এক সৌন্দর্য। সে-সৌন্দর্য গত বছর শান্তিনিকেতনে আবার লক্ষ করেছি। সর্বপ্রকার পার্থিব কামনার ঊর্ধ্বে উঠলে সংসার সম্বন্ধে সত্যসত্যই নির্লিপ্ত হলে শিল্পীপ্রকৃতির মানুষের জীবনে যে সৌন্দর্য বিকশিত হয় তার সঙ্গে যদি যোগ দেয় পরিণত বয়সের ‘all passion spent’ ক্ষান্তবর্ষণ শারদাকাশ তবে সেই শারদ-সৌন্দর্য বিভাসিত হয় শুক্ল কেশের কাশগুচ্ছের পটভূমিকায় প্রশান্ত উদাস ললাটে। রবীন্দ্রনাথকে এর আগে এত ভালো লাগেনি, এত সুন্দর মনে হয়নি। এই পরিচয় দিয়ে যাবার জন্যে তাঁর এতকাল জীবিত থাকার প্রয়োজন ছিল। জীবন যদি হয় পরিচয়জ্ঞাপন তবে আরও দীর্ঘ জীবনেরও প্রয়োজন আছে। বোধ হয় এইজন্যেই ঋষিরা বলে গেছেন, ‘পশ্যেম শরদং শতং জীবেম শরদং শতং।’
মৃত্যুর সমীপবর্তী হয়ে তাঁর মৃত্যুভয় ক্ষয় হয়েছে। মনে হয় তিনি সাগরসঙ্গমে অস্ফুট কল্লোল শুনতে পেয়েছেন। তাঁর ইদানীন্তন কবিতায় এই বিচিত্র উপলব্ধির বার্তা আছে। শারীরিক যন্ত্রণার সঙ্গে সংযুক্ত থাকলেও এটা একপ্রকার উপভোগ। নিরাসক্ত নিঃশঙ্ক নির্মল হয়ে জীবনকে তিনি চূড়ান্ত উপভোগ করছেন। ব্রাউনিং যে বলেছিলেন—
Grow old along with me
The best is yet to be—
তা এই উপভোগের আশায়। এ উপভোগ তখনই আসে যখন মানুষ যাবার জন্যে তৈরি হয়ে যানের অপেক্ষায় বসে। যা-কিছু সঙ্গে নেবার তাও গোছানো হয়েছে, যা-কিছু রেখে যাবার তাও গোছানো। কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা নেই, বাইরে কিংবা ভিতরে, পিছনে কিংবা সঙ্গে। কিছু এলোমেলো পড়ে থাকার ক্ষোভ নেই কিছু অসমাপ্ত রইল বলে খেদ নেই। তাই দু-দিন থেকে যাবার আগ্রহ নেই। তবে তিনি উতলাও নন। মানুষকে তিনি ভালোবাসেন, মানুষও তাঁকে ভালোবাসে। এই সম্পর্ক হঠাৎ ছিন্ন করবেন কী করে!
উতলা নন। অথচ তাঁর সঙ্গে কথা কইলে বোঝা যায়, যদিও তাঁর ব্যক্তিগত কোনো বাসনা নেই, তবু মানুষের কাছে তাঁর যে বিরাট প্রত্যাশা ছিল সে-প্রত্যাশার ক্রমিক অন্তর্ধান তাঁকে বিহ্বল করে তুলেছে। মানবজাতির অধঃপতন যে কত নিম্নে পৌঁছেছে তা মর্মে মর্মে অনুভব করে তিনি বেঁচে আছেন বলে গ্লানি বোধ করছেন। যে জার্মানিতে তিনি রাজসমারোহে অভিনন্দিত হয়েছিলেন সেই তাঁর অতি প্রিয় জার্মানি আজ কোথায়! কোথায় তাঁর আরও প্রিয় জাপান! আর ইংল্যাণ্ড? যে ইংল্যাণ্ড তার আবাল্য শ্রদ্ধাভাজন, যার শ্রদ্ধা তিনি প্রৌঢ় বয়সে লাভ করে বিশ্ববিখ্যাত হন, সেই ইংল্যাণ্ড! তাঁকে যাবার আগে এও দেখতে হল—এই পতন ও ধ্বংসের চিত্র! আর তাঁর দুর্ভাগ্য দেশ? দেশের জন্যে তাঁর যে আক্ষেপ তা বিলাপের তুল্য, কখনো কখনো প্রলাপের সদৃশ। গৌরব করবার কিছু নেই, আশা করবার কিছু নেই, শুধু দিনযাপনের গ্লানি, শুধু প্রাণধারণের পীড়া। তথাপি তাঁর আস্থা আছে ভারতের ওপর, গান্ধীজির ওপর। দেশ-বিদেশের নবজাতকদের প্রতি, নবীনদের প্রতি তাঁর আশীর্বাদ রয়েছে সবসময়। বিশ্বের অফুরন্ত যৌবনে তাঁর অফুরন্ত বিশ্বাস। তিনি আজকাল ভগবানে বিশ্বাস করেন কি না প্রশ্ন করে ধরাছোঁয়া পাইনি, কিন্তু প্রকৃতির অন্তর্নিহিত তারুণ্যে ও মানবের অন্তর্নিহিত মহত্ত্বে তিনি চিরদিনের মতো এখনও বিশ্বাসবান।
তাঁর জীবনের অস্তাচল যদিও মেঘাচ্ছন্ন তবু তিনি একমনে রশ্মি বিকিরণ করে চলেছেন। গ্যেটে ও টলস্টয়ের শেষজীবনের মতো তাঁর শেষজীবনও বিচিত্র প্রয়াসে পূর্ণ। তিনি যে এই বয়সেও প্রচুর লিখে আমাদের প্রত্যহ লজ্জা দিচ্ছেন তা আমরা কনিষ্ঠেরা স্বীকার করি। কিন্তু সেই তাঁর একমাত্র কাজ নয়। আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমি ছবি আঁকি কি না। আঁকিনে শুনে ক্ষুণ্ণ হলেন, যেন ওর মতো আনন্দ আর নেই। যেন চেষ্টা করলে সকলে পারে। এবার তাঁর ছবি আঁকতে বসা চাক্ষুষ করে এলুম। বললেন তুলি দিয়ে তিনি যেমন আত্মপ্রকাশ করতে পারেন তেমন লেখনী দিয়ে নয়। দুয়োরানির চেয়ে সুয়োরানির দিকেই তাঁর শেষ বয়সের টান। সম্পাদকেরা তাঁকে লিখতে বাধ্য করেন, নইলে তিনি বোধ হয় লিখতেন না, আঁকতেন। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ, তবু তুলির আঁচড় জোরালো ও ধারালো। সিংহের মতো থাবা ও নখর দিয়ে তিনি যা আঁকছেন তা এক হিসেবে লেখার চেয়েও দামি। তাতে তাঁর এই বয়সের আসল চেহারা ফুটছে। লেখেন তিনি অভ্যাসবশে। তেমন জিনিস গতানুগতিক না হয়ে যায় না। কিন্তু আঁকার বেলায় অন্য কথা। আমার মনে হয় তাঁর প্রকৃত পরিচয় এক এক বয়সে এক-একটি মিডিয়াম খুঁজেছে। এখনও তিনি গান রচেন, কিন্তু গানে আর তাঁকে তেমন করে পাওয়া যায় না, যেমন করে ছবিতে। পনেরো বছর আগে গানেই তাঁকে পাওয়া যেত, গদ্যে নয়। কবিতা অবশ্য তাঁর জীবনসঙ্গিনী। কিন্তু তাঁর কবিতাও ক্রমে তাঁর ছবির মতো খাপছাড়া হয়ে উঠেছে।
আমাকে বলছিলেন ছড়া লিখতে। বাংলা কবিতার নিজের রূপটি নাকি ছড়াতেই খোলে। ছড়ার কথা তিনি আমাকে এমন করে বোঝালেন যে আমি অতি সহজেই দীক্ষিত হলুম। তবে এখনও ছড়া লিখিনি। তিনি যেসব ছড়া লিখেছেন সেসব তাঁর ছবিরই আর-এক সংস্করণ। মনে হয় বিশুদ্ধ রেখার মতো বিশুদ্ধ শব্দের ভিতরে যে রস আছে সেই রস তিনি আস্বাদন করেছেন। অর্থের জন্যে তাঁর ভাবনা নেই। ছোটো ছেলেরা যেমন হিজিবিজি ও আবোল-তাবোলের রসে মুগ্ধ, কবিও তাঁর দ্বিতীয় শৈশবে সেই রসের রসিক। তবে এগুলি অর্থহীনও নয়, অর্বাচীনও নয়। তাঁর ছবিতে যে জিনিস সবচেয়ে চোখে ঠেকে সে তাঁর জোর, যে জোর ছিল প্রাগৈতিহাসিক মানবের। তাঁর ছড়ায় যে জিনিস কানে বাজে সে তাঁর বিস্ময়, যে বিস্ময়ের সহিত আদিমানব আবিষ্কার করেছিল শব্দের সঙ্গে শব্দ যোজনা করে শব্দধ্বনি। রবীন্দ্রনাথের ছবি ও ছড়া অবচেতন মনের প্রকাশ। যেন তাঁর মনের নীচের তলায় লক্ষ বছর আগের মন বাস করছে, তাকেই তিনি উপরে উঠে আসতে দিচ্ছেন।
কখনো ছবি আঁকছেন, কখনো ছড়া কাটছেন, কখনো গানে সুর দিচ্ছেন, কখনো নাচের মহড়া দেখছেন। শুনতে পাই গোপনে গোপনে রান্নার পরীক্ষাও চলে, আর হোমিয়োপ্যাথিক না বায়োকেমিক চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়া হয়। এই কর্মিষ্ঠতা তাঁর সারা জীবনের অভ্যাস। শিলাইদহে শুনেছিলুম তিনি নাকি একবার মাটিতে মাছ পুঁতে নতুন রকমের সার তৈরি করতে চেয়েছিলেন, পচা মাছের গন্ধে গাঁয়ের লোকের টেকা দায় হয়েছিল। চাষ করবেন তাঁর ছেলে, সেজন্যে তিনি তাঁকে আমেরিকায় পাঠিয়ে ক্ষান্ত হননি, একটা আস্ত চর কিনেছিলেন বা কিনতে যাচ্ছিলেন কৃষির জন্যে। শিলাইদহের কাছারিতে তাঁর হাতের খানকয় জমিদারি চিঠি পড়েছিলুম। সেসব চিঠিতে তাঁর যে পরিচয় তা একজন ঝুনো জমিদারের। তাতে সাহিত্যের স্বাদ ছিল না, তবে রচনার সৌষ্ঠব ছিল বটে। পতিসরে তাঁর জমিদারি চালনার নমুনা দেখেছি, আর দেখেছি তাঁর প্রজাহিতৈষণার চিহ্ন। প্রজারা যে তাঁকে ভালোবাসত ও ভুলতে পারেনি তা আমি প্রজাদের মুখেই শুনেছি। একবার এক বৃদ্ধের মুখে তাঁর যৌবনের যেসব কাহিনি শুনেছিলুম তার একটি মনে আছে। তাঁর পিতৃশ্রাদ্ধের সময় প্রজারা তাঁকে যেসব উপঢৌকন দিয়েছিল, প্রথম দিন তিনি সেসব নিয়েছিলেন, কেননা ওটা একটা প্রথা। কিন্তু পরদিন তিনি সেগুলি ফিরিয়ে দিলেন। ‘কী লজ্জা! আমার পিতার শ্রাদ্ধ! আমি নেব তোদের উপহার!’ এই বলে তিনি তাদের অবাক করে দিলেন। বোধ হয় এমন অপূর্ব উক্তি ভূভারতের কোনো জমিদারের মুখে শোনা যায়নি। প্রজারা যে তাঁকে ভক্তি করবে এটা স্বাভাবিক। সে-বার আত্রাইতে কবি বলছিলেন, ‘প্রজারা আমাকে দেখতে এসে বলল, পয়গম্বরকে আমরা চোখে দেখিনি। আপনাকে দেখে যাই।’
কিন্তু কর্মিষ্ঠতা যদিও রবীন্দ্রনাথকে গ্যেটে ও টলস্টয়ের সঙ্গে তুলনীয় করেছে তবু তাঁদের সঙ্গে তাঁর মূলত পার্থক্য আছে। কর্মের ভিতর দিয়ে তাঁদের যে চলা তা স্রোতের গতি, তার যতি নেই। আর রবীন্দ্রনাথের চলা পাখির ওড়া। আকাশে ওড়ে, নীড়েও ফেরে।
যেন আমার গানের শেষে
থামতে পারি সমে এসে—
একথা ইউরোপের নয়, ভারতের। রবীন্দ্রনাথের সাধনা এই সমে আসার সাধনা। তাঁর অন্তরের অন্তরালে একটি পরম আশ্রয় আছে, সেটি তাঁর নীড়। সেখানে তিনি তাঁর জীবনের পর্বে পর্বে ফিরেছেন, সেইখান থেকে যাত্রা করেছেন। তিনি পদে পদে মিলিয়ে নিয়েছেন আকাশের সঙ্গে নীড়কে, নীড়ের সঙ্গে আকাশকে। তাই তাঁর আদির সঙ্গে অবসানের, উদয়ের সঙ্গে অস্তের একটি গভীর সংগতি পাবে ভাবীকাল। এমন সংগতি, এমন ঐক্য অন্য কারও জীবনে পাবে না এ যুগে।
একদিক থেকে এটা একটা বাধাও বটে। পাখিকে বেশি দূরে উড়তে দেয় না তার নীড়। সে প্রতি রাত্রে ফিরে আসে তার কেন্দ্রে। রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রাচুর্য আছে, বৈচিত্র্য আছে, কিন্তু তাঁর পক্ষের বিস্তার সীমাহীন নয়, তাঁর জীবনের বাণী নিত্য বলেই তা পুনরুক্তিপরায়ণ। এই ত্রুটি তাঁর একার নয়। এটা তাঁর দেশেরও। আমাদের পক্ষের বিস্তার নেই—কী কায়িক, কী মানসিক, আছে কেবল বাচিক। আমরা ছুটে গেলে ছুটে আসি, উধাও হতে পারিনে। পক্ষান্তরে অমন একরোখা গতি সদ্গতি নয়। ওতে শান্তি নেই। গ্যেটে বা টলস্টয়ের শেষজীবন শান্তির ছিল না। দ্বিধায়-সংশয়ে, পতনে-উত্থানে, ব্যাকুলতায়-জটিলতায় আবর্তিত ছিল। সেই নিগূঢ় অন্তর্বিরোধ রবীন্দ্রনাথের জীবনে থাকলে তা অত্যন্ত সুশাসিত। তিনি তাঁর পিতার কাছে যে শিক্ষা পেয়েছেন, যে শিক্ষা পেয়েছেন প্রকৃতির কাছে, তার ফলে তাঁর মনে বাইরের বিরোধের ছায়া পড়লেও তাঁর অন্তর নির্দ্বন্দ্ব। সম্প্রতি জগতের অন্যায় ও অনাচার তাঁর মনের ওপর আঘাত করছে কিন্তু ভিতরে শান্তির নীড়।
রবীন্দ্রনাথের ভিতরের বাঁধুনি তাঁকে আজীবন রক্ষা করেছে, জীবনের কোনো অবস্থায় ভ্রষ্ট হতে দেয়নি। সে-বাঁধুনি এতই কঠোর যে এই আশি বছর বয়সেও তাঁর কথাবার্তা একটুও বেফাঁস নয়, তাঁর উক্তি অসংবদ্ধ নয়। তিনি যা বলেন গুছিয়ে বলেন, রসিয়ে বলেন। অনুপ্রাস ও উপমা এই বয়সেও আছে। হাস্য-পরিহাস এখনও তাঁর স্বভাব। শরীর অবশ্য জীর্ণ হয়েছে, কিন্তু মনের কোথাও জরার লক্ষণ নেই। স্মৃতি ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসছে তাই ভুল হয় মাঝে মাঝে, কিন্তু বুদ্ধি তেমনি মার্জিত, কল্পনা তেমনি রঙিন, ভদ্রতা তেমনি অবারিত, স্নেহ তেমনি অকুন্ঠিত। তাঁর মাজা দুর্বল হয়েছে, নুয়ে নুয়ে হাঁটেন, দেখলে কষ্ট হয়। কিন্তু মজ্জা তেমনি সবল। বুদ্ধির উপর কালের কুয়াশা নামেনি, প্রজ্ঞার দীপ্তি অম্লান। তাঁর ভিতরের বাঁধুনি তাঁকে শেষবয়সের চরম লজ্জা থেকে রক্ষা করেছে—ভীমরতি থেকে।
রবীন্দ্রনাথ কাজের লোক। উপনিষদে লিখেছে, ‘কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেচ্ছতং সমাঃ।’ কাজ করতে করতে তিনি আশি বছর অতিক্রম করতে যাচ্ছেন। কিন্তু তিনি কেবল কাজের লোক নন, তিনি ছুটির মানুষ। সে-ছুটি তিনি কাজের মাঝখানেই ভোগ করেন। যখনই তাঁর কাছে গেছি তখনই তিনি এমনভাবে অভ্যর্থনা করেছেন যেন তাঁর হাতে দেদার ছুটি, এমনভাবে কথা কয়েছেন যেন তাঁর সময় কাটছে না। কিন্তু সে আর কতক্ষণ! কয়েক মিনিট পরে আর কেউ গিয়ে হাজির। আসলে তাঁর সময় সিকি পয়সাও নেই, তিনি নিরন্তর ব্যাপৃত। অথচ তিনি তাঁর চারদিকে একটি ছুটির আবহাওয়া সৃষ্টি করে রেখেছেন। তাঁর ব্যস্ততা বা ত্বরা নেই। কোথায় যে তাঁর ছুটির উৎস আমি তার সন্ধান পাইনি। বোধ হয় মন মুক্ত হলে কাজ মানুষকে বাঁধে না। মানুষ খাটে, কিন্তু সে-খাটুনি খেলার মতো লাগে। রবীন্দ্রনাথ মুক্তপুরুষ, আধ্যাত্মিক অর্থে না হোক সাংসারিক অর্থে। তাঁর কোনো বাঁধন নেই, তাই তাঁর ভিতরে ছুটির ফুর্তি!
অন্যের বেলায় দেখি বয়স যত বাড়ছে রক্ষণশীলতাও তত প্রবল হচ্ছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কিনা মুক্তপুরুষ, তাই তিনি সংস্কারমুক্ত। শুনেছিলুম তাঁর সঙ্গে যেকোনো বিষয়ে আলাপ জমানো যায়, এমনকী promiscuity সম্বন্ধেও। তাঁর গত বছর প্রকাশিত ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পটি পড়ে প্রমাণ পেলুম। কোনো আধুনিক লেখক তাঁর চেয়ে আরও আধুনিক নন, তাঁর দুঃসাহস আমাদের অনেকের পক্ষে অসমসাহস। অথচ এমনই সংযত তাঁর শিল্পিত্ব যে মনে কোনো বিকার জাগে না। রবীন্দ্রনাথের মনের বাঁধুনি তাঁকে বর্মের মতো রক্ষা করেছে এখানেও। রবীন্দ্রনাথ চিরদিন এতটা সংস্কারমুক্ত ছিলেন না, তাঁর সতীত্বের সংস্কার একদা অতি দৃঢ়মূল ছিল। মনের মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে সংস্কারের বাঁধন আলগা হয়েছে। তা বলে তিনি তাঁর বর্ম ও কবচ ত্যাগ করেননি। বরং তাঁর মনের বাঁধুনি শক্ত আছে বলেই তাঁর মন ক্রমে ক্রমে মুক্ত হতে পেরেছে। দেহের বাঁধুনি শক্ত না হলে যেমন আয়ুর ভার বহন করা যায় না, মনের বাঁধুনি শক্ত না হলে তেমনি মনের বাঁধন খোলে না। তিনি যে গদ্য, কবিতা লেখেন সেক্ষেত্রেও সেই একই কথা। তাঁর ছন্দের সাধনা নিখুঁত বলেই তিনি ছন্দের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করতে পারেন, তাঁর মিলের হাতসাফাই আছে বলেই তিনি মিলকে সাফ অস্বীকার করতে পারেন। তিনি যে মুক্তক লেখেন তার পিছনে রয়েছে পদ্যের পদ্মাবতীর চরণচারণচক্রবর্তীপনা। জীবনব্যাপী পদসেবার পর তিনি একটু ঢিলে দিচ্ছেন। সে-অধিকার তাঁরই আছে।
রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবন তাঁর জীবনশতদলের মুক্তির ইতিহাস। এক-একটি করে দল খুলেছে, সেইসঙ্গে বন্ধন খুলেছে। সমাপ্তির তটে বসে তিনি প্রতীক্ষা করছেন চরম মুক্তির শেষ খেয়ার।