রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাসাগর
রামানুজ মুখোপাধ্যায়
এক
১৫ ডিসেম্বর ১৯৩৯। শীতের সকালে শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রেল কর্তৃপক্ষ ট্রেনে একটি বিশেষ কামরার ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁর জন্যে। সঙ্গে ছিলেন আরও কয়েকজন স্নেহধন্য স্বজন। ক্ষিতিমোহন সেন, অমিয় চক্রবর্তী, কৃষ্ণ কৃপালনি, অনিল চন্দ, সুধাকান্ত রায়চৌধুরি এবং সজনীকান্ত দাস। সজনীকান্তই এর মূল ব্যবস্থাপক।১ প্রথম গন্তব্য হাওড়া স্টেশন। বেলা তিনটের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে গিয়েছিলেন সেখানে। ওই বিশেষ কামরায় প্রায় এক ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার আলোচনা হয়েছিল সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে।২ বেলা চারটেয় রবীন্দ্রনাথ কলকাতা পুরসভার খাদ্য ও পুষ্টি প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন। তারপর অভিমুখ বদলে চলেছিলেন মেদিনীপুরের উদ্দেশে। রাত্রি দশটায় তিনি পৌঁছেছিলেন মেদিনীপুর স্টেশনে। লোকে লোকারণ্য। প্ল্যাটফর্মের ভিতর থেকে বাইরের রাস্তা পর্যন্ত লাল কার্পেট পাতা। ট্রেন থেকে নেমে হুইল চেয়ারে বসে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন স্টেশনের বাইরে। সেখানে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে অপেক্ষা করছিলেন মহিষাদলের রাজকুমার দেবপ্রসাদ গর্গ, জেলাশাসক বিনয়রঞ্জন সেন, জেলাজজ-পুরপিতা-মহকুমাশাসক এবং আরও অনেকে। ছিলেন কয়েকজন ব্রিটিশ প্রতিনিধিও। কবিকে আনা হয়েছিল রামগড় রাজবাড়িতে। সেখানেই তাঁর থাকার ব্যবস্থা। এখন ক্ষুদিরাম নগরের কাছে এই বাড়িটি কৈবল্যদায়িনী কলেজ অব কমার্স নামে পরিচিত।৩ ১৬ ডিসেম্বর সকালে শুরু হয়েছিল শোভাযাত্রা।৪ বিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন কবি। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিদ্যাসাগর তিথির উৎসব।
মেদিনীপুরের জেলাশাসক বিনয়রঞ্জন সেনের স্ত্রী চিরপ্রভা সেন ছিলেন শান্তিনিকেতনের ছাত্রী। তাঁরা দু’জনেই কবির পূর্বপরিচিত। তাঁদের অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে কি তবে মেদিনীপুরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ? শরীর সুস্থ ছিল না বেশ কিছুদিন থেকে। অক্টোবরে সজনীকান্তকে তিনি জানিয়েছিলেন: ‘মেদিনীপুর যেতে হলে আমার পক্ষে একটা দৈহিক বিপ্লব হবে।’৫ হাঁটাচলা করতে কষ্ট হত। তাঁর মতো চিরচঞ্চল মানুষটিকেও এমন দিনে বলতে হয়েছিল: ‘এ ঘর থেকে ও ঘর আমার পক্ষে বিদেশ।’৬ এমনকী, মেদিনীপুর থেকে ফিরে আসার পরেও তাঁর শরীর ভাল ছিল না। সীতা দেবী ১৯৩৯-এর পৌষমেলায় শান্তিনিকেতনে এসে দেখেছিলেন:
কবির স্বাস্থ্য অতি দুর্বল… দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ, কানেও ভালো শুনিতে পান না… এখানে আসিয়াই শুনিলাম, বেশি লোকজন গিয়া ভিড় করিলে কবি বিরক্ত হন।৭
প্রায় দু’মাস মংপুতে কাটিয়ে ১৯৩৯-এর নভেম্বরের গোড়ায় কলকাতায় ফিরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দু’দিনের মধ্যে কলকাতা থেকে আসতে হয়েছিল শান্তিনিকেতনে। পুজোর ছুটির পর বিদ্যালয় খুলেই চলছিল ভাঙাগড়া, মেরামতির কাজ। বাইরের নানা কাজের ফরমায়েশ থেকেও নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পারছিলেন না তিনি। এমন পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন, মেদিনীপুর যাওয়া তাঁর পক্ষে ‘সঙ্কটজনক’, অথচ ‘অপরিহার্য এর কর্তব্যতা’।৮ কী সেই কর্তব্যের অপরিহার্যতা? বিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দিরটি গড়ে উঠেছিল মেদিনীপুরের তৎকালীন জেলাশাসক বিনয়রঞ্জন সেনের প্রচেষ্টায়। শুরু হয়েছিল বিদ্যাসাগর-গ্রন্থাবলি প্রকাশের উদ্যোগও। বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদের মেদিনীপুর শাখার উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছিল এর প্রথম খণ্ডটি। ১৯৩৮-এর মাঝামাঝি সেই বই পৌঁছেছিল রবীন্দ্রনাথের হাতে। মাস তিনেক পরে, সেপ্টেম্বরে বিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দিরের শিলান্যাস উপলক্ষে লেখা হয়েছিল ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ কবিতাটি।৯ আর দ্বারোদ্ঘাটন উৎসবের জন্যে লিখেছিলেন একটি অভিভাষণ। ‘কলম সহজে সরে না’, তবু রিক্ত হাতে লিখতে বসেছিলেন কবি।১০ মন যেখানে উৎসুক, অসক্ত শরীরকেও উপেক্ষা করা হয়তো সেখানে সহজ। এই ভালবাসার কারণ কি শুধুই সাহিত্যপ্রীতি? বিদ্যাসাগরকে রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের নিবিড় তিমির অঙ্গনে ‘প্রথম আলোর রশ্মি’। গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন:
… বঙ্গসাহিত্যে আমার কৃতিত্ব দেশের লোকে যদি স্বীকার করে থাকেন তবে আমি যেন স্বীকার করি একদা তার দ্বার উদ্ঘাটন করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।১১
এই বিশ্বাসই কি তবে দুর্বল শরীরেও কর্তব্য পালনের দুর্গম পথে চালিত করেছিল তাঁকে?
দুই
আমাদের ইতিহাসবোধ বলবে, এর শিকড় আছে হয়তো আরও গভীরে। ১৮৩৯-এর ৬ অক্টোবর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্থাপন করেছিলেন তত্ত্ববোধিনী সভা। তিনি মনে করেছিলেন, এর উদ্দেশ্য হবে আমাদের সব শাস্ত্রের নিগূঢ় তত্ত্ব ও বেদান্তপ্রতিপাদ্য ব্রহ্মবিদ্যার বিস্তার।১২ এই সভার লোকপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছিল।১৩ সভার ১৮৪৬-এর বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের সম্পাদকীয় নিবেদনে জানানো হয়েছিল, এ সভার সদস্যদের তালিকায় আছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামও। দেবেন্দ্রনাথ-রাজনারায়ণ-অক্ষয়কুমার তো ছিলেনই। সঙ্গে আরও ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, প্যারীচাঁদ মিত্র, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। ১৮৪২-এ দেবেন্দ্রনাথ যোগ দিয়েছিলেন ব্রাহ্মসমাজে। ১৮৪৩-এ তাঁর দীক্ষাগ্রহণ। ১৮৪২-এর এপ্রিল থেকে তত্ত্ববোধিনী সভা হয়ে উঠেছিল কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের তত্ত্বাবধায়ক ও পরিচালক। একটি বক্তৃতায় দেবেন্দ্রনাথ বলেছিলেন: ‘তত্ত্ববোধিনী সভার সহিত যোগ না হইলে ব্রাহ্মসমাজের কী পরিণাম হইত বলা যায় না। হয়তো আমরা ইহার কিছুই দেখিতে পাইতাম না।’১৪ দু’ দশকের মধ্যে লক্ষ করা গিয়েছিল এর বিপরীত একটি দৃশ্য। ১৮৫৯-এর ডিসেম্বরে নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হারিয়ে তত্ত্ববোধিনী সভা কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে মিশে যায়। ১৮৫৮-র মাঝামাঝি সময় থেকে এ সভার শেষ সম্পাদক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।১৫
১৮৪৩-এর ১৬ আগস্ট তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। এর প্রথম সম্পাদক ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। প্রাথমিকভাবে পত্রিকাটি ছিল ধর্মতত্ত্ব-বিষয়ক। অক্ষয়কুমারের সম্পাদনায় উঠে আসতে শুরু করেছিল সাহিত্য-সমাজ-বিজ্ঞান-পুরাতত্ত্ব বিষয়ে নানা উৎকৃষ্ট যুক্তিবাদী লেখালিখি। সূচনা হয়েছিল বাংলা ভাষায় জীববিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, ভূগোল বিষয়ে প্রথম সচেতন চর্চার। প্রথম পর্বে লেখা প্রকাশের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর ছিল পত্রিকাটি। ১৮৪৮-এ দেবেন্দ্রনাথ ‘পেপার কমিটি’ গড়ে দিয়েছিলেন। সহজ কথায় প্রবন্ধ-নির্বাচনী সভা। সভার সদস্যদের বলা হত ‘গ্রন্থাধ্যক্ষ’। অধ্যক্ষদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন রাজনারায়ণ বসু, আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ, প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী, আনন্দকৃষ্ণ বসু, শ্রীধর ন্যায়রত্ন, রাধাপ্রসাদ রায়, শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, রাজেন্দ্রলাল মিত্র। এবং অবশ্যই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।১৬ প্রবন্ধ-নির্বাচনী সভা অনুমোদন করলে তবেই কোনও লেখা ছাপা হত পত্রিকার পাতায়। অধ্যক্ষরা প্রয়োজনে সংশোধন-পরিমার্জন করতে পারতেন। এমনকী পত্রিকার সম্পাদক-সদস্য-অধ্যক্ষদের ক্ষেত্রেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম ছিল না। পত্রিকার দপ্তরে পাঠানো লেখাগুলি জমা পড়ত সম্পাদকের দপ্তরে। তিনি প্রাথমিক মনোনয়ন করতেন। তারপর সেগুলি পাঠানো হত গ্রন্থাধ্যক্ষদের কাছে। অধ্যক্ষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতই সেখানে চূড়ান্ত ছিল। প্রকাশলগ্ন থেকে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে এ পত্রিকার সম্পর্ক ছিল নিবিড়। প্রায় নব্বই বছর ধরে প্রকাশিত হয়েছিল এর সহস্রাধিক সংখ্যা। এই দীর্ঘ ইতিহাসে তেরোজন সম্পাদকের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন ঠাকুরবাড়ির সদস্য। দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, ক্ষিতীন্দ্রনাথ, ক্ষেমেন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ। ১৮৮৪-র সেপ্টেম্বর থেকে ১৯১২-র মে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক ছিলেন। ১৮৯১-এ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র একটি সম্পাদকীয় কলামে লেখা হয়েছিল:
বিদ্যাসাগর মহাশয় ইহাতে মহাভারতের অনুবাদ করিতেন। এবং এই পত্রিকায় যে সমস্ত প্রবন্ধ প্রকাশিত হইত তাহার সংশোধনের ভার তাঁহারও হস্তে ছিল। ফলত, তত্ত্ববোধিনী দ্বারা এক সময় যে বঙ্গভাষার অসাধারণ উন্নতি হইয়াছিল তাহাতে বিদ্যাসাগরের অনেকটা সহায়তা ছিল।১৭
অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-৮৬) বিদ্যাসাগরের সমবয়সি ছিলেন। দু’জনেই ছিলেন যুক্তিবাদী মনের মানুষ। অক্ষয়কুমারের লেখালিখি অনেক সময় সংশোধন করেছিলেন বিদ্যাসাগর।১৮ বেদান্ত যে অভ্রান্ত নয়, এই সত্য ব্রাহ্মসমাজে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন অক্ষয়কুমার। টলে গিয়েছিল দেবেন্দ্রনাথের দীর্ঘদিনের সযত্নলালিত বিশ্বাস। ১৮৫৩-য় শিক্ষাবিভাগকে লেখা একটি চিঠিতে সাংখ্য ও বেদান্ত দর্শনকে ভ্রান্ত বলে উল্লেখ করেছিলেন বিদ্যাসাগর।১৯ সেখানেও কি ছিল না অক্ষয়কুমারেরই কোনও সদর্থক প্রণোদনা?
ব্রাহ্মসমাজের পুরোধা ব্যক্তিত্ব রাজনারায়ণ বসুর (১৮২৬-৯৯) সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক ছিল মধুর।২০ মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে রাজনারায়ণের শিক্ষকতার নেপথ্যেও ছিল বিদ্যাসাগরের ভূমিকা। পত্রবিনিময়, মতামতের আদান-প্রদান তো ছিলই। ব্রাহ্মসমাজের বহু সুখ্যাত ব্যক্তিত্বের সঙ্গেই ঈশ্বরচন্দ্রের অন্তরঙ্গতা ছিল। একদিকে যেমন আছেন কেশবচন্দ্র সেন, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, আনন্দমোহন বসু, উমেশচন্দ্র দত্ত, শিবচন্দ্র দেব প্রমুখ, অন্যদিকে তেমনি রামতনু লাহিড়ী, ভগবানচন্দ্র বসু, শম্ভুনাথ পণ্ডিত। ১৮৫৬-র ৭ ডিসেম্বর কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটে প্রথম বিধবাবিবাহের অনুষ্ঠানে বহু মানুষের ভিড়ে ডিরোজিয়োর অনুগামী ইয়ং বেঙ্গলদের আর ব্রাহ্মদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বিদ্যাসাগরের ছোটভাই শম্ভুচন্দ্র জানিয়েছিলেন: ‘রাজা রামমোহন রায়ের পুত্র রমাপ্রসাদ রায়ের সহিত অগ্রজ মহাশয়ের অত্যন্ত প্রণয় ছিল।’২১ বিদ্যাসাগরের জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৫৮-১৯১৬) ছিলেন সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের বিশিষ্ট সভ্য। বিদ্যাসাগর তাঁকে বিশেষ স্নেহ করতেন। ব্রাহ্ম ব্যক্তিত্বদের মধ্যে বিদ্যাসাগরের সবচেয়ে পছন্দের মানুষ ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। শিবনাথের বাবা হরানন্দ ভট্টাচার্য, বড়মামা দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রের অন্তরঙ্গ সহমর্মিতা ছিল। শিবনাথ ছিলেন তাঁর সংস্কৃত কলেজের কৃতী ছাত্র। আত্মচরিত এবং মেন আই হ্যাভ সিন বইগুলিতে বারবার বিদ্যাসাগরের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছিলেন শিবনাথ। বাবার কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন:
আমার পূজনীয় পিতৃদেব হরানন্দ ভট্টাচার্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রিয়পাত্র ছিলেন। কেবল প্রিয়পাত্র নহে, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রকৃতির অনেক গুণ তাঁহাতে ছিল। শুধু গুণ কেন, তাঁহার প্রকৃতির অনেক দোষও আমার পিতার প্রকৃতিতে ছিল।২২
গুণের সঙ্গে কোন দোষগুলি ছিল? ছিল তেজস্বিতা, ‘উৎকট ব্যক্তিত্ব’, অন্যায়ের প্রতি বিদ্বেষ, আত্মমর্যাদাবোধ, অন্যের দুঃখে কাতর হতে পারার মতো মহৎ গুণ। আর অন্যদিকে নিজের অভিমতের প্রতি নির্বিচার পক্ষপাত, পরিণতির ব্যাপারে বিচক্ষণতার অভাব। ছিল না আত্মপরীক্ষা, আত্মসংশোধনের চেষ্টা।২৩ আজীবন বিদ্যাসাগরকে যে দুর্লভ দৃষ্টিতে দেখেছিলেন শিবনাথ, তা ‘প্রাণবান বীজের মত’ অঙ্কুরিত হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথেরও মনে।২৪
দেবেন্দ্রনাথ নিরাকার একেশ্বরের উপাসক ছিলেন। তাঁরই নিরন্তর উদ্যোগে রামমোহনের ‘বেদান্তপ্রতিপাদ্য ধর্ম’ হয়ে উঠেছিল ব্রাহ্মধর্ম। সংকলিত হয়েছিল ব্রাহ্মধর্ম্মঃ বইটি। সুখ্যাত সম্পাদক ও কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মাধ্যমে কৃতী ছাত্র অক্ষয়কুমার দত্তের সন্ধান পেয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। রীতিমতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সফল হয়ে অক্ষয়কুমার তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র প্রথম সম্পাদক নিযুক্ত হয়েছিলেন। সম্পাদক হিসেবে তাঁর সাফল্যের সাক্ষ্য ধরা আছে ইতিহাসের পাতায়।২৫ প্রাথমিক সাফল্যের রেশ কাটতে-না-কাটতেই শুরু হয়েছিল সংঘাত। সম্পাদকীয় বিভাগের সঙ্গে সংযুক্ত প্রবন্ধ-নির্বাচনী সভায় গড়ে উঠেছিল দু’টি গোষ্ঠী। দেবেন্দ্রনাথের অনুগামীদের তুলনায় অক্ষয়কুমারের অনুরাগীদের সংখ্যা ছিল বেশি।২৬ রাজনারায়ণ বসু আত্মচরিত বইটিতে জানিয়েছেন, ১৮৪৮ থেকে ১৮৫০-এর মধ্যবর্তী দিনগুলিতে ‘বেদ প্রত্যাদিষ্ট কিনা’ এই বিষয়ে ব্রাহ্মদের মধ্যে আলোচনা চলত।২৭ আরও কয়েক বছর আগেই হয়তো শুরু হয়েছিল এই প্রবণতা।২৮ ১৮৪৫ সালে দেবেন্দ্রনাথ একজন ছাত্রকে বেদ অধ্যয়নের জন্যে বৃত্তি দিয়ে কাশী পাঠিয়েছিলেন। পরের বছর পাঠিয়েছিলেন আরও তিনজনকে। ১৮৪৭-এ তিনি নিজেই কাশী গিয়েছিলেন বেদ অধ্যয়নের আগ্রহে। সেখানে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের কাছে শুনেছিলেন শাস্ত্রব্যাখ্যা।২৯ কাশী থেকে ফিরে তিনি বেদ পরিত্যাগ করেছিলেন। ব্রাহ্মধর্মের এই ঐতিহাসিক রূপান্তরে অক্ষয়কুমার দত্তের অবদান অনস্বীকার্য। ‘ব্রাহ্মসমাজে জ্ঞানমার্গের প্রহরীরূপে’ দাঁড়িয়েছিলেন অক্ষয়কুমার। এ কথা বলেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।৩০ শিবনাথ শাস্ত্রী আরও সহজ কথায় লিখেছিলেন:
ব্রাহ্মসমাজের ধর্ম অগ্রে বেদান্তধর্ম্ম ছিল।… ব্রাহ্মগণ বেদের অভ্রান্ততাতে বিশ্বাস করিতেন। অক্ষয়কুমার দত্ত মহাশয় এই উভয়ের প্রতিবাদ করিয়া বিচার উপস্থিত করেন। প্রধানতঃ তাঁহারই প্ররোচনাতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর উভয় বিষয়ে গভীর বিস্তার ও শাস্ত্রানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হন।৩১
অক্ষয়কুমারের পক্ষে এ কাজ সহজ ছিল না।৩২ ১৮৫১-র মাঘোৎসবে কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজ থেকে প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয়েছিল, বেদ-বেদান্ত-কে ঈশ্বরের আদেশ মনে করার কোনও কারণ নেই। বেদ-কে ব্রাহ্মসমাজের শাস্ত্র হিসেবে অস্বীকার করা হয়েছিল এই প্রথম।৩৩ দেবেন্দ্রনাথের অনুমতি নিয়ে অক্ষয়কুমার তাঁর বক্তৃতার মধ্যেই এই ঐতিহাসিক ঘোষণাটি করেছিলেন।৩৪ এ কাজে তাঁর প্রধান সহায় ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে অক্ষয়কুমারের সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছিল অন্য একটি কারণে। মেদিনীপুর ব্রাহ্মসমাজে প্রদত্ত রাজনারায়ণ বসুর একটি বক্তৃতা পড়ে শুনিয়ে ‘পরম সুখী’ হয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। সে-বক্তৃতার মধ্যে তিনি দেখেছিলেন ‘জ্ঞানের উজ্জ্বলতা, ভক্তির প্রগাঢ়তা, উৎসাহের প্রবণতা, ভাবের সরলতা’ জেগে আছে। বন্ধুরাও শুনে পরিতৃপ্ত হয়েছিলেন।৩৫ কিন্তু, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-য় সে-বক্তৃতা ছাপা হয়নি। ১৮৫৪-র গোড়ায় রাজনারায়ণকে একটি চিঠিতে দেবেন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন:
কতকগুলান নাস্তিক গ্রন্থাধ্যক্ষ হইয়াছে, ইহাদিগকে এ পদ হইতে বহিষ্কৃত না করিয়া দিলে আর ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের সুবিধা নাই।৩৬
এখানে ‘কতকগুলান’ বলতে নিশ্চয় একা অক্ষয়কুমারকে বোঝানো হয়নি, সঙ্গে বিদ্যাসাগর ও রাজেন্দ্রলালের কথাও ছিল।৩৭ বিদ্যাসাগর কখনও মন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ করেননি। সন্ধ্যা-আহ্নিক, পুজোপাঠে তাঁর আগ্রহ ছিল না। অন্যের উপর এ বিষয়ে নিষেধ জারি করেননি কখনও। নিজের বিশ্বাস রেখেছিলেন নিজের কাছেই। কখনও উপলব্ধি করেছিলেন: ‘এই দুনিয়ার একজন মালিক আছেন তা বেশ বুঝি।’৩৮ আবার কখনও অভিমানভরে বলেছিলেন: ‘তা তিনি থাকেন থাকুন, আমার দরকার বোধ হচ্ছে না।’৩৯ স্বভাবত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচর্চায় তিনি অনাগ্রহী ছিলেন। কোনও ধর্মমতের অকারণ প্রশংসা যেমন করেননি, তেমনি কোনও ধর্মমতের নিন্দাও করেননি। কর্মকেই তিনি ধর্মজ্ঞান করেছিলেন। দয়া, করুণা, স্বার্থহীন পরহিতকে তিনি মনে করেছিলেন জীবনের অনিঃশেষ ব্রত।৪০ বিদ্যাসাগর-চর্চাকারী গবেষকেরা প্রায় সকলেই স্বীকার করেছেন, তিনি ছিলেন সংস্কারহীন যুক্তিবাদী বিদ্বান।
১৮৫৫-য় অক্ষয়কুমার দত্ত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র সম্পাদক পদ ত্যাগ করেছিলেন, না কি তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, তা নিয়ে সংশয় আছে।৪১ এই সময়ে অক্ষয়কুমারের মাসিক বৃত্তি ছিল ষাট টাকা। ব্রিটিশ সরকারের কাছে সদ্য-প্রতিষ্ঠিত নর্মাল স্কুলের অধ্যক্ষ পদের জন্যে অক্ষয়কুমারের নাম প্রস্তাব করেছিলেন বিদ্যাসাগর। তিনি দায়িত্বে থাকাকালীন তত্ত্ববোধিনী সভার পক্ষ থেকে অসুস্থ অক্ষয়কুমারের জন্যে মাসিক পঁচিশ টাকা বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র জন্যে অক্লান্ত শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমই যে অক্ষয়কুমারের দুঃসহ ব্যাধির অন্যতম কারণ, সে কথা উল্লেখ করে সভায় একটি মর্মস্পর্শী প্রস্তাব পাঠ করেছিলেন বিদ্যাসাগর।৪২ দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে অক্ষয়কুমারের বিরোধের ধারা অবশ্য এর পরেও বহুদিন অব্যাহত ছিল।৪৩ মহেন্দ্র রায়ের বাবু অক্ষয়কুমার দত্তের জীবনবৃত্তান্ত (১৮৮৫) এবং আদি ব্রাহ্মসমাজ থেকে প্রকাশিত নকুড়চন্দ্র বিশ্বাসের অক্ষয়-চরিত (১৮৮৭) বইগুলিতে এ সংঘাতের ছবি স্পষ্ট। দেখা যেতে পারে ঠাকুরবাড়ির আনুকূল্যে লেখা অজিতকুমার চক্রবর্তীর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯১৪) বইটিও। সংঘাতের এ ইতিহাস কি রবীন্দ্রনাথের অজানা ছিল একেবারেই?
তিন
বিদ্যাসাগরের জীবনব্যাপী কর্মকাণ্ডের একটি বড় অংশ ছিল অবিভক্ত বাংলাদেশে শিক্ষাবিস্তারের প্রয়াসে নিবেদিত। প্রাচ্যবিদ্যার সঙ্গে পাশ্চাত্যবিদ্যার অনুশীলনকে তিনি মিলিয়েছিলেন। কখনও সরকারি কাজের সূত্রে, কখনও ব্যক্তিগত উদ্যোগে। সংস্কৃত কলেজ থেকে অব্যাহতি গ্রহণের পর তাঁর সবচেয়ে বড় কীর্তি মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন। প্রতিষ্ঠানটি ১৮৬৪-তে যাত্রা শুরু করেছিল। ১৮৭৩-এ তা কলেজে পরিণত হল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
বাঙালির নিজের চেষ্টায় এবং নিজের অধীনে উচ্চতর শিক্ষার কলেজ-স্থাপন এই প্রথম। আমাদের দেশে ইংরাজি শিক্ষাকে স্বাধীনভাবে স্থায়ী করিবার এই প্রথম ভিত্তি বিদ্যাসাগর-কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হইল।৪৪
বিদ্যাসাগর বাকি জীবনে প্রতিষ্ঠানটিকে সযত্নে লালন করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক রামসর্বস্ব বিদ্যাভূষণ ১৮৭৪-এর নভেম্বরে ঠাকুরবাড়ির গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে সংস্কৃত পড়তেন। তাঁরই প্রেরণায় অনুবাদ করেছিলেন কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্-এর অংশবিশেষ। আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশের পুত্র জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য মূলত ইংরেজি কবিতা পড়াতেন রবীন্দ্রনাথকে। তিনিই কুমারসম্ভবম্ বাংলা অনুবাদ করে পড়িয়েছিলেন। আরও একটি আশ্চর্য কাজ তিনি করেছিলেন। বড়বেলায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
… খানিকটা করিয়া ম্যাকবেথ আমাকে বাংলায় মানে করিয়া বলিতেন এবং যতক্ষণ তাহা বাংলা ছন্দে আমি তর্জমা না করিতাম ততক্ষণ ঘর বন্ধ করিয়া রাখিতেন। সমস্ত বইটার অনুবাদ শেষ হইয়া গিয়াছিল।৪৫
এই অনুবাদটি নিয়ে রামসর্বস্ব বিদ্যাভূষণের হাত ধরে রবীন্দ্রনাথ একদিন পৌঁছে গিয়েছিলেন বিদ্যাসাগরের বাড়িতে। ছোটবেলায় পড়েছিলেন তাঁর বোধোদয় (১৮৫১), ঋজুপাঠ (১৮৫১-৫২), শকুন্তলা (১৮৫৪), বর্ণপরিচয় (১৮৫৫), সীতার বনবাস (১৮৬০) বইগুলি। মনের মধ্যে আঁকা ছিল সম্ভ্রমের ছবি। ৯ জানুয়ারি ১৮৭৫। বইয়ে ভরা ঘর। বুক দুরুদুরু। প্রায় সাড়ে তিন দশক পরেও কত অনায়াসে রবীন্দ্রনাথ লিখতে পেরেছিলেন: ‘ইহার পূর্বে বিদ্যাসাগরের মতো শ্রোতা আমি তো পাই নাই; অতএব, এখান হইতে খ্যাতি পাইবার লোভটা মনের মধ্যে খুব প্রবল ছিল। বোধ করি কিছু উৎসাহ সঞ্চয় করিয়া ফিরিয়াছিলাম।’৪৬ বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় সাক্ষাৎকারটি আরও পরে। কলিকাতা সারস্বত সম্মিলন স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন দুই ভাই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ। ১৬ জুলাই ১৮৮২ জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বসেছিল তার প্রথম অধিবেশন। রাজেন্দ্রলাল মিত্র সভাপতি। রবীন্দ্রনাথের লেখা এই অধিবেশনের একটি কার্যবিবরণী লিপিবদ্ধ হয়ে আছে মালতীপুঁথি-তে।৪৭ বানানের উন্নতিসাধন, বিদেশি শব্দের বাংলা উচ্চারণ ও বাংলা তরজমা, ভৌগোলিক পরিভাষানির্ণয় বিষয়ে তাঁরা ভাবনাচিন্তা করেছিলেন। যাঁরা বাংলা সাহিত্যে খ্যাতিলাভ করেছিলেন, যাঁরা বাংলা ভাষার উন্নতিসাধনে অনুরাগী, তাঁরা এই সমাজের সভ্য হতে পারতেন। এমনটাই প্রথম অধিবেশনে স্থির হয়েছিল। উপস্থিত সভ্যদের সম্মতিক্রমে সে বছরের জন্যে সম্মিলনের অন্যতম সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সভায় আহ্বান করার জন্যে দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে একদিন গিয়ে হাজির হয়েছিলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। সভার উদ্দেশ্য, সভ্যদের নাম শুনে বিদ্যাসাগর জানিয়েছিলেন: ‘হোমরাচোমরা’দের লইয়া কোনো কাজ হইবে না, কাহারও সঙ্গে কাহারও মত মিলিবে না।’৪৮
প্রায় একই অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথও।৪৯ সারস্বত সম্মিলন ঈষৎ অঙ্কুরিত হয়েই শুকিয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন: ‘বিদ্যাসাগরের কথা ফলিল’।৫০ এই সাক্ষ্যগুলির ভিতর থেকে আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁদের পারস্পরিক স্নেহ-শ্রদ্ধার সম্পর্কটি।
চার
পিতৃদত্ত ঈশ্বরচন্দ্র নামে নয়, বিদ্যাসাগর নামেই তিনি সর্বত্র পরিচিত। তাঁকে নিয়ে গল্পের শেষ নেই। চারিত্রিক মহত্ত্বের কারণেই তিনি দয়ারসাগর, করুণাসাগর নামে পরিচিত হয়েছিলেন। তাঁকে নিয়ে প্রচলিত অধিকাংশ গল্পে অসহায় মানুষের প্রতি তাঁর সহানুভূতি, ক্ষেত্রবিশেষে একানুভূতি বড় হয়ে উঠেছে। সময়ের ব্যবধানে যে গুটিকতক গদ্যে ও অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন বিদ্যাসাগরের কথা, সেখানে তাঁর লোকপ্রিয় করুণাসাগর-মূর্তিটি নয়, উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল তাঁর ‘মহাপুরুষোচিত কারুণ্যের স্মৃতি’।৫১ রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছিলেন: তাঁর ‘প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা’, তিনি ‘বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী’, তিনিই প্রথম ‘বাংলা-গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন’। ‘বাংলায় সাহিত্যভাষার সিংহদ্বার উদ্ঘাটন’ করেছিলেন বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরের অ-বাঙালিসুলভ ‘চারিত্রবল’-ই ছিল রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে প্রিয়। গড়পড়তা বাঙালিরা চিরকাল ‘দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তাত্ত্বিক’। আমাদের যা-কিছু বাঙালিসুলভ, বিদ্যাসাগর ছিলেন তার বিপরীতে। আর সেই কারণেই ‘বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন’। এই ক্ষুধিত-তৃষিত-তাপিত বঙ্গে তাঁর ব্যক্তিত্ব যেন এক ‘অক্ষয় বট’। তার ছায়ায় আশ্রিত হয়ে আমাদের শিখে নিতে হবে তুচ্ছতা, ক্ষুদ্রতা, নিষ্ফল আড়ম্বরকে ত্যাগ করার মন্ত্র, ‘সূক্ষ্মতম তর্কজাল’ এবং ‘স্থূলতম জড়ত্ব’-কে বিসর্জন দেওয়ার পন্থা। আর অনুভব করতে হবে: ‘দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব।’৫২
বর্ণপরিচয়-এর গোপালকে আমাদের অনেকেরই মনে আছে। সে অতি সুবোধ বালক। বাবা-মায়ের আদেশ মান্য করে চলে। রাখাল ছিল তার উলটো। দুরন্ত এবং অবাধ্য। রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র যখন গোপালের বয়সি ছিলেন তখন রাখালের সঙ্গে ছিল তাঁর বাইরের মিল। ঈশ্বরচন্দ্রের শৈশবজীবন বহুচর্চিত, বহুশ্রুত। তাঁর নিজের লেখা বিদ্যাসাগরচরিত (১৮৯০) তার প্রধান আকর। ছিল বিহারীলাল সরকার আর চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দু’টি বিদ্যাসাগর-জীবনী। প্রথমটির প্রকাশকাল ১৯০০, আর দ্বিতীয়টির ১৯১৪। রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছিলেন শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের বিদ্যাসাগর জীবনচরিত (১৮৯১) বইটির কথা। সময়কালের বিচারে এই বইগুলি পড়া অসম্ভব ছিল না রবীন্দ্রনাথের পক্ষে। ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ প্রবন্ধে বিদ্যাসাগরের জীবনের যে ঘটনাগুলির দিকে রবীন্দ্রনাথ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, সেখানে তাঁর চরিত্রের অজেয় পৌরুষের দীপ্তিই ভাস্বর হয়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথ অকপটে বলেছিলেন, ‘তিনি বলিষ্ঠচিত্ত এবং মহৎ-লোক ছিলেন।’৫৩ রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে তাঁর সবচেয়ে বেশি মিল লক্ষ করেছিলেন কবি। কোথায় তাঁদের অন্তরের মিল? রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
বেশভূষায় আচার-ব্যবহারে তাঁহারা সম্পূর্ণ বাঙালি ছিলেন; স্বজাতির শাস্ত্রজ্ঞানে তাঁহাদের সমতুল্য কেহ ছিল না; স্বজাতিকে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের মূলপত্তন তাঁহারাই করিয়া গিয়াছেন—অথচ নির্ভীক বলিষ্ঠতা, সত্যচারিতা, লোকহিতৈষা, দৃঢ়প্রতিজ্ঞা এবং আত্মনির্ভরতায় তাঁহারা বিশেষরূপে য়ুরোপীয় মহাজনদের সহিত তুলনীয় ছিলেন।৫৪
রামমোহনকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘ভারতপথিক’, বলেছিলেন ‘সর্বকালের মানুষ’।৫৫ তিনি মনে করেছিলেন, দেশের মধ্যে যাঁরা ‘সকলের চেয়ে বড় মনীষী’ তাঁরা পশ্চিমের সঙ্গে পূর্বকে নিরন্তর মেলাবার চেষ্টা করেছেন। বিদ্যাসাগর সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথ সেই কথাটিই বলেছিলেন: ‘তিনি জানতেন বিদ্যার মধ্যে পূর্ব-পশ্চিমের দিগ্বিরোধ নেই।’৫৬ এমনকী, শেষ দশক পর্যন্ত রামমোহনকেই নিজের জীবনের নায়ক বলে স্বীকার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।৫৭ রামমোহনের সঙ্গে যখন তুলনা করেন, তখন আমরা উপলব্ধি করতে পারি, বিদ্যাসাগরের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা কতখানি গভীর। অক্ষয়কুমার-দেবেন্দ্রনাথের চিন্তাচর্চার সংঘাতের ছায়াটুকু পর্যন্ত সেখানে নেই।
পাঁচ
১৮৪৯-এর ৭ মে কলকাতায় বালিকা-বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন বেথুন সাহেব। স্কুলে সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের মেয়েরাই ভরতি হতে পারবে— প্রাথমিকভাবে এমনটাই ভেবেছিলেন তিনি। শুরুর থেকে এর সঙ্গে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার। ১৮৫০-এর ডিসেম্বরে বেথুন সাহেব ঈশ্বরচন্দ্রের হাতে অর্পণ করেছিলেন বিদ্যালয়ের অবৈতনিক সম্পাদকের দায়িত্ব।৫৮ শহরের দূরবর্তী প্রান্ত থেকে ছাত্রীদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসার জন্যে সচল থাকত একটি ঘোড়ার গাড়ি। বিদ্যাসাগর সেই গাড়ির গায়ে খোদাই করিয়ে দিয়েছিলেন একটি শাস্ত্রবচন— পুত্রসন্তানের মতো কন্যাসন্তানকেও যত্নে প্রতিপালন করতে হবে, শিক্ষা দিতে হবে।৫৯ নব্য বাঙালিরা আর ব্রাহ্মসমাজ-তত্ত্ববোধিনী সভার চিন্তাশীল বাঙালিরা যে সকলেই স্ত্রীশিক্ষার পক্ষে ছিলেন তা নয়। শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের মধ্যেও অনেকে ছিলেন স্ত্রীশিক্ষার সমর্থক। তীব্র সামাজিক প্রতিক্রিয়াকে উপেক্ষা করে উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ সরকার স্ত্রীশিক্ষার বিস্তারে যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তার প্রধান সহায় ছিলেন বিদ্যাসাগর।৬০ পূর্ব বর্ধমান জেলার জৌগ্রামে ১৮৫৭-র মে মাসে গ্রামাঞ্চলে প্রথম বালিকা-বিদ্যালয় স্থাপনের নেপথ্যেও ছিল বিদ্যাসাগরেরই প্রণোদনা। সিপাহি বিদ্রোহের সময়ে, ১৮৫৭-র নভেম্বর থেকে ১৮৫৮-র মে মাসের মধ্যে প্রায় পঁয়ত্রিশটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছিলেন তিনি। বিদ্যালয়গুলির অর্থসংকট মোচনের জন্যে একটি নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠা ভাণ্ডারও খুলেছিলেন। আড়াই-তিন দশকের মধ্যে এর অভূতপূর্ব বিস্তার ঘটেছিল অখণ্ড বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। ১৮৮৩-৮৪ নাগাদ মেয়েদের জন্যে প্রতিষ্ঠিত স্কুলের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল এক হাজার সাতশো পঁচাশিটি।৬১ ১৮৭৮ থেকে ছাত্রীদের সামনে খুলে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনোর দরজা।৬২ জীবনের শেষ পর্বে (১৮৯১) স্বরচিত বিদ্যাসাগরচরিত-এর পাতায় নিজের সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্র লিখেছিলেন: ‘আমি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী বলিয়া, অনেকে নির্দেশ করিয়া থাকেন। আমার বোধ হয়, সে নির্দেশ অসংগত নহে।’৬৩
এরই মধ্যে ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্রের পরম সুহৃদ কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্য। মধুসূদনের ব্যক্তিজীবনের এক অস্থির সময়ে লেখা হয়েছিল কবিতাগুলি।৬৪ প্রাচ্য পুরাণের আলোকপ্রাপ্তা নারীরা তাঁদের ভালবাসার মানুষকে চিঠি লিখেছিলেন। দীপ্তিময়ী নারীব্যক্তিত্বই ছিল সেসব চিঠির কেন্দ্রে। প্রথমা স্ত্রী রেবেকা এবং তিন সন্তানকে চিরতরে ছেড়ে ১৮৫৫-র ডিসেম্বরে যেভাবে মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন মধুসূদন, তা বিস্ময়কর।৬৫ তারও সাড়ে তিন দশক পরে, ১৮৯২-এর ২২ জুলাই শেষ হয়েছিল রেবেকার জীবন। ১৮৭৩ পর্যন্ত মধুসূদনের কবিজীবনও আমাদের অজানা নয়। রেবেকা কি বীরাঙ্গনা কাব্য-এর ব্যক্তিত্বময়ী নায়িকাদের মতো একটি পত্রিকা লিখে যেতে পারতেন মধুসূদনের উদ্দেশে? বীরাঙ্গনা কাব্য-এর চিঠিগুলির মধ্যে কি কোথাও লুকিয়ে ছিল না কবির আত্মগ্লানিও?৬৬ স্ত্রীশিক্ষার বিস্তারে ঈশ্বরচন্দ্র যে ছিলেন একজন মহানুভব অগ্রণী, সে নিয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই। অথচ, বিদ্যাসাগরের জীবনীকারেরা জানিয়েছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্রের স্ত্রী দিনময়ী দেবী এবং চার কন্যা হেমলতা-কুমুদিনী-বিনোদিনী-শরৎকুমারী দেবী বিদ্যাচর্চার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। বাবা-মায়ের অনুমতিক্রমে আট বছরের দিনময়ী দেবীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল চোদ্দো বছরের ঈশ্বরচন্দ্রের।৬৭ দিনময়ী দেবী উদার মনের ‘তেজস্বিনী’ নারী ছিলেন, সে কথা বিদ্যাসাগরের জীবনীকার বিহারীলাল সরকার উল্লেখ করেছিলেন।৬৮ পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে ঈশ্বরচন্দ্র স্ত্রী-কন্যাদের পড়াশুনোর কোনও উদ্যোগ নিতে পারেননি। সমাজ-ইতিহাসের গবেষক অশোক সেনও এদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।৬৯ ছোটবেলায় অনেক ক্ষেত্রেই ঈশ্বরচন্দ্র পিতার অবাধ্য সন্তান ছিলেন। পরিণত বয়সেও সব ক্ষেত্রেই যে তিনি বাবার একান্ত অনুগত ছিলেন, তেমন সাক্ষ্য তাঁর জীবনীগ্রন্থগুলিতে নেই। এক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্তই হয়তো যথেষ্ট হবে। ১৮৬৯-এ বীরসিংহ গ্রামের পৈতৃক ভিটে চিরতরে ছেড়ে আসার সময়ে বাবা-মায়ের অনুরোধকে তিনি দৃঢ়ভাবে অগ্রাহ্য করেছিলেন।৭০ বীরাঙ্গনা কাব্য-টি ‘বঙ্গকুলচূড়া’ বিদ্যাসাগরকে উৎসর্গ করেছিলেন মধুসূদন। অপূর্ব কোনও মন্ত্রবলে যদি দিনময়ী দেবীর হাতে থাকত একটি সৃষ্টিশীল কলম, তা হলে তিনিও কি বীরাঙ্গনা কাব্য-এর নায়িকাদের মতো ঈশ্বরচন্দ্রকে লিখতে পারতেন একটি অভিমান-ভরা চিঠি?
কাব্যে উপেক্ষিতা নারীদের মনোদুঃখকে কবিকল্পনার সূক্ষ্ম সংবেদনে স্পর্শ করতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধে তার সাক্ষ্য আছে। রবীন্দ্রনাথ প্রেমের কবি। জীবনের উপান্তে তিনি নিজেই বলেছিলেন: ‘একটিমাত্র পরিচয় আমার আছে, সে আর কিছু নয়, আমি কবি মাত্র।’৭১ এমনকী, তাঁর কথাসাহিত্যেও আছে নারী-পুরুষের সম্পর্কেরই চিরন্তন সুর। চোখের বালি, নৌকাডুবি, চতুরঙ্গ, ঘরে-বাইরে, যোগাযোগ, শেষের কবিতা— তাঁর উপন্যাসগুলি মূলত দাম্পত্য সংকটের কথাশিল্প। তাঁর কথাসাহিত্যের নায়িকারা অধিকাংশই পড়াশুনো জানা, ব্যক্তিত্বময়ী নারী। ‘অধ্যাপক’ (১৮৯৮) গল্পে ভবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা কিরণবালা দর্শনশাস্ত্রে সাম্মানিক, সাহিত্যেও প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণা। বি.এ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিল সে। নৌকাডুবি-র (১৯০৬) হেমনলিনী এফ.এ পরীক্ষা দিয়েছিল। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হয়েও সে ইংরেজি গল্পের বই পড়ত। তার শোবার ঘরে দেরাজের মধ্যে গোপন সমাদরে রক্ষিত ছিল ‘একখানি মরক্কো-বাঁধানো টেনিশন’। গ্রন্থাকারে গোরা-র প্রথম প্রকাশ ১৯১০ হলেও এর কাহিনিকাল ১৮৮২-৮৩ খ্রিস্টাব্দ। সেখানে পরেশবাবু-বরদাসুন্দরীর তিন কন্যা লাবণ্য-ললিতা আর লীলা পড়াশুনো শিখেছিল। লাবণ্যর খাতায় লেখা থাকত মুর ও লংফেলো-র ইংরেজি কবিতা। পরেশবাবু ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বিদ্যালয়-পরিদর্শক। সুচরিতা পরেশবাবুর বন্ধু-কন্যাকে পড়াতে যেত প্রতি সোমবার। সুচরিতা আর ললিতা নিজেদের বাড়িতে গরিব ব্রাহ্ম মেয়েদের জন্যে খুলেছিল একটি স্কুল। আশ্রম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্বে মৃণালিনী দেবী কবির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। সহধর্মিণী হয়ে উঠেছিলেন সহকর্মিণীও। আশ্রম বিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্রদের জলখাবার তৈরির দায়িত্ব নিয়েছিলেন নিজের হাতে।৭২ মৃণালিনী দেবীর উপর ছোটদের জন্যে রামায়ণ-এর কাহিনিগুলিকে সংক্ষিপ্ত করবার ভার দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পণ্ডিত হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের সাহায্যে মৃণালিনী দেবী আগাগোড়া রামায়ণ পড়ে তরজমার কাজ শুরু করেছিলেন।৭৩ কনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবীর স্মৃতিকথায় আমরা আশ্চর্য একটি দৃশ্য দেখতে পাই:
আর-একটা ছবি মনে পড়ে— শান্তিনিকেতন-বাড়ির দোতলার গাড়িবারান্দার ছাতে একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে, মার হাতে একটা ইংরেজি নভেল, তার থেকে বাংলায় অনুবাদ করে দিদিমাকে পড়ে শোনাচ্ছেন।৭৪
মৃণালিনী দেবী অল্পবয়সে ঠাকুরবাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলেন। সেখানে নিরন্তর পরিশীলন আর বিদ্যাচর্চা তাঁর ব্যক্তিত্বে এনেছিল মনন-মধুর দীপ্তি। ১৯০২-এর একটি চিঠিতে বড় মেয়ে মাধুরীলতাকে তিনি লিখেছিলেন, স্নেহভাজন সুরেন্দ্রনাথের ভাবী স্ত্রী এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়েছে। দেখতে ‘খুব সুন্দর’ না-হলেও সে ‘ধীর, শান্ত, ভাল মানুষ ও বুদ্ধিমতী’।৭৫ এই কথাগুলির ভিতর থেকে তাঁর মানসিক উচ্চতাকে বুঝে নিতে আমাদের অসুবিধে হয় না। নিজের লেখালিখি নিয়ে শত ব্যস্ততা থাকলেও পুত্র-কন্যাদের পড়াশুনো নিয়ে নিরন্তর ভাবিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, শিলাইদহে থাকার সময়ে বাবা তাঁদের পড়াশুনোর দিকে বিশেষভাবে নজর দিয়েছিলেন।৭৬ পত্নীবিয়োগের শোককাব্য স্মরণ (১৯০৩) রবীন্দ্রনাথের কাব্যিক সংবেদনশীলতার কথা মনে করিয়ে দেয়। কত সহজ কথায় রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালেই (১৯৩১) বলতে পেরেছিলেন অন্নদাশঙ্কর:
প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কীর্তি তাঁর জীবন। তাঁর অন্যান্য কীর্তি বিস্মৃত হয়ে যাবার পরও তাঁর এই কীর্তিটি জীবিত মানুষের আন্তরিকতম যে জিজ্ঞাসা— ‘কেমন করে বাঁচব?’— সেই জিজ্ঞাসার একটি সত্য ও নিঃশব্দ উত্তর হয়ে চিরস্মরণীয় হবে।৭৭
এতখানি সূক্ষ্ম-সংবেদনের-অধিকারী হয়েও রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর-চরিতের ব্যক্তিগত বৃত্তের ছায়ান্ধকার দিকগুলিকে স্পর্শ করতে পারেননি।
বিদ্যাসাগরের জীবনের অক্ষয় কীর্তি বিধবাবিবাহ প্রচলন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে এর প্রতি ছিল না কোনও সমর্থনের সুর। তার পরেও অক্ষয়কুমার দত্ত এবং বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ-বিষয়ক প্রথম অগ্নিগর্ভ লেখাগুলি প্রকাশিত হয়েছিল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র পাতায়। ১৮৯১-এর ২৯ জুলাই বিদ্যাসাগরের প্রয়াণ দিবস। আর বিদ্যাসাগরকে নিয়ে প্রথম অভিভাষণটি রবীন্দ্রনাথ পড়েছিলেন ১৮৯৫-এর জুলাইয়ে। এর মাঝখানে (বৈশাখ ১২৯৯, ১৮৯২) লেখা হয়েছিল একটি সুপরিচিত রবীন্দ্র-গল্প ‘ত্যাগ’। সে গল্পে আছে এক অ-ভূতপূর্ব দুঃসাহসিক প্রেমের আলেখ্য। কুসুম বালবিধবা। হেমন্তর সঙ্গে তাঁর অসবর্ণ বিবাহ ছিল সকালবেলার সূর্যালোকের মতো নির্মল। মনে পড়বে চতুরঙ্গ উপন্যাসের দামিনীকে। হয়তো ননীবালাকেও। এর প্রকাশকাল ১৯১৬ হলেও উপন্যাসের কাহিনির সময়কাল উনিশ শতকের একেবারে শেষ লগ্নে। বলেন্দ্রনাথের বিধবাপত্নী সাহানা দেবীর পুনর্বিবাহের চেষ্টায় মহর্ষির নির্দেশে বাধা সৃষ্টি করেছিলেন যে-রবীন্দ্রনাথ, তিনিই পাথুরিয়াঘাটার সতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বিধবা কন্যা ছায়া দেবীর সঙ্গে বিপত্নীক মধ্যম জামাতা সত্যপ্রসাদ ভট্টাচার্যের বিয়ের আয়োজন করেছিলেন। তার পরের বছরে, ১৯১০-এর গোড়ায়, পুত্র রথীন্দ্রনাথের বিয়ে সুসম্পন্ন হয়েছিল বালবিধবা প্রতিমা দেবীর সঙ্গে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ডায়ারিতে লিখে রেখেছিলেন: ‘আমাদের বাড়ীতে এই প্রথম বিধবা বিবাহ।’৭৮ রবীন্দ্রনাথের জীবনে আর সাহিত্যে এই ঘটনাগুলিও কি বিদ্যাসাগরের সেই অক্ষয় কীর্তিরই এক যোগ্যতর উত্তরাধিকার নয়?
টীকা ও সূত্রনির্দেশ
১. অনুত্তম ভট্টাচার্য, ২০০৩, রবীন্দ্রনাথ ও মেদিনীপুর (মেদিনীপুর: কে কে প্রকাশন), পৃ. ৩০।
২. প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক, চতুর্থ খণ্ড, (কলকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ২০১৩), পৃ. ২০৯।
৩. Souvik Mukhopadhyay, Partha Sankha Mazumdar, Ramanuj Mukherjee, Rabindranath & His Many Abodes (Kolkata: West Bengal Heritage Commission, 2014), p. 72.
৪. অনুত্তম ভট্টাচার্য, ২০০৩, পৃ. ১০।
৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিঠিপত্র, একাদশ খণ্ড, (কলকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ২০০৪), পৃ. ২৩।
৬. তদেব।
৭. সীতা দেবী, পুণ্যস্মৃতি (কলকাতা: বিশ্বভারতী, ২০১৫), পৃ. ২০১।
৮. মৈত্রেয়ী দেবী, ২০১১, স্বর্গের কাছাকাছি (কলকাতা: প্রাইমা পাবলিকেশন,২০১১), পৃ. ২৫২।
৯. কবিতাটি কোনও কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ‘প্রকীর্ণ কবিতাবলী’ দ্রষ্টব্য।
১০. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০০৪, পৃ. ২৩।
১১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র-রচনাবলী, একাদশ খণ্ড, (কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ১৯৮৯), পৃ. ১১৭।
১২. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মজীবনী, (কলকাতা: বিশ্বভারতী, ১৯৬২), পৃ. ২৮।
১৩. গৌতম নিয়োগী, অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়, তত্ত্ববোধিনী সভার কথা (কলকাতা: সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ, ২০১৮), পৃ. ৬।
১৪. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রাহ্মসমাজের পঞ্চবিংশতি বৎসরের বৃত্তান্ত (কলকাতা: সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ, ১৯৫৪), পৃ. ১৯।
১৫. ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১২), পৃ. ৫৫৯।
১৬. আশীষ লাহিড়ী, অক্ষয়কুমার দত্ত: আঁধার রাতে একলা পথিক (কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, ২০০৭), পৃ. ৫৯।
১৭. ইন্দ্রমিত্র, ২০১২, পৃ. ৫৬১।
১৮. তদেব, পৃ. ৫৬০।
১৯. তদেব, পৃ. ১১৪।
২০. গৌতম নিয়োগী, অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়, ২০১৮, পৃ. ১১৯-২০।
২১. শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস, (কলকাতা: চিরায়ত প্রকাশন, ২০১৯), পৃ. ৫৯।
২২. শিবনাথ শাস্ত্রী, আত্মচরিত, (কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, ২০০৩), পৃ. ২৭৩।
২৩. তদেব।
২৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র-রচনাবলী, ষোড়শ খণ্ড, (কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ২০০১), পৃ. ১১১১। রবীন্দ্রনাথের ‘বিদ্যাসাগরচরিত ২’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ভারতী (অগ্রহায়ণ ১৩০৫, ১৮৯৮) পত্রিকায়। পত্রিকাপাঠে সূচনার এই অংশটি গ্রন্থভুক্ত হওয়ার সময় বর্জন করা হয়েছিল:
‘আশ্বিন-কার্তিকের প্রদীপে শ্রীযুক্ত শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় ‘পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’-নামক যে প্রবন্ধ প্রকাশ করিয়াছেন তাহা পাঠমাত্র করিয়া সংক্ষেপে বিদায় করিবার জিনিস নহে। এই প্রবন্ধে শাস্ত্রী-মহাশয় যে সকল চিন্তা ফলাইয়া তুলিয়াছেন তাহা প্রাণবান বীজের মত পড়িয়া পাঠকহৃদয়ে আপনাকে নবজীবনে অঙ্কুরিত করিয়া তুলিতেছে।
বর্তমান প্রবন্ধে আমরা কোন নূতন কথা বলিবার জন্য উপস্থিত হই নাই। শাস্ত্রী-মহাশয়ের কথাকেই আমরা নিজের মত করিয়া ব্যক্ত করিতে উদ্যত হইয়াছি। আমরা তাঁহারই প্রবন্ধটিকে সাদরে লালন করিতেছি।…’
২৫. শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছিলেন: ‘তত্ত্ববোধিনী বঙ্গদেশের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ পত্রিকা হইয়া দাঁড়াইল। তৎপূর্ব্বে বঙ্গসাহিত্যের, বিশেষতঃ দেশীয় সংবাদপত্র সকলের অবস্থা কি ছিল, এবং অক্ষয়কুমার দত্ত সেই সাহিত্য-জগতে কি পরিবর্তন ঘটাইয়াছিলেন তাহা স্মরণ করিলে, তাঁহাকে দেশের মহোপকারী বন্ধু না বলিয়া থাকা যায় না।’ দ্র. রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, (কলকাতা: নিউ এজ, ২০০৯), পৃ. ১৩১।
২৬. বিনয় ঘোষ, বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা (কলকাতা: প্রকাশ ভবন, ২০০৯), পৃ. ২৭২।
২৭. রাজনারায়ণ বসু, আত্মচরিত (কলকাতা: অলকানন্দা পাবলিশার্স, ২০১২), পৃ. ৫২।
২৮. বিনয় ঘোষ, ২০০৯, পৃ. ২৭২।
২৯. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯৬২, পৃ. ১৩১-৩৯।
৩০. সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আমার বাল্যকথা (কলকাতা: কারিগর, ২০১৬), পৃ. ৯৪।
৩১. শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ (কলকাতা: নিউ এজ, ২০০৯), পৃ. ১৩১-৩২।
৩২. তদেব, পৃ. ১৩২।
৩৩. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯৬২, পৃ. ৪২৬।
৩৪. রাজনারায়ণ লিখেছিলেন: ‘বেদ ঈশ্বর-প্রত্যাদিষ্ট নহে, বিশ্ববেদান্তই প্রকৃত বেদান্ত, এই মত অক্ষয় বাবু দ্বারা ১৭৭২ শকের [১৮৫১] ১১ই মাঘ দিবসের সাম্বৎসরিক উৎসবের বক্তৃতাতে প্রথম ঘোষিত হয়।’ দ্র. ২০১২, পৃ. ৫৪।
৩৫. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পত্রাবলী (কলকাতা: অলকানন্দা পাবলিশার্স), পৃ. ১৮।
৩৬. তদেব।
৩৭. অলোক রায়, উনিশ শতক, (কলকাতা: প্রমা, ২০১২), পৃ. ১৪২।
৩৮. ইন্দ্রমিত্র, ২০১২, পৃ. ৫৭৫।
৩৯. তদেব।
৪০. তদেব, পৃ. ৫৮২।
৪১. আশীষ লাহিড়ী, ২০০৭, পৃ. ৬৪।
৪২. তদেব, পৃ. ৬৫।
৪৩. তদেব, পৃ. ৬৫-৬৬।
৪৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯৮৯, পৃ. ১৮১।
৪৫. তদেব, পৃ. ৩৯।
৪৬. তদেব।
৪৭. অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য সম্পাদিত, রবীন্দ্রনাথের মালতীপুঁথি, (কলকাতা: সিগনেট প্রেস, ২০১৭), পৃ. ৯৯-১০০।
৪৮. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯৮৯, পৃ. ৭৭।
৪৯. বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি (কলকাতা: সুবর্ণরেখা, ২০১২), পৃ. ৫৯-৬০।
৫০. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯৮৯, পৃ. ৭৭।
৫১. তদেব, পৃ. ২১৭।
৫২. তদেব, পৃ. ১৮৫।
৫৩. তদেব, পৃ. ১৮৯।
৫৪. তদেব, পৃ. ১৭৩-৭৪।
৫৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভারতপথিক রামমোহন রায়, (কলকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ২০০৮), পৃ. ২৯।
৫৬. তদেব, পৃ. ১৪৫।
৫৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯৮৯, পৃ. ২১৪।
৫৮. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, (কলকাতা: ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, ২০১১), পৃ. ২১৮।
৫৯. তদেব, পৃ. ২১৮। বিনয় ঘোষ জানিয়েছিলেন: ‘সম্পাদক বিদ্যাসাগর সেই গাড়ির পাশে কন্যাপ্যেবং পালনীয়াশিক্ষাণীয়াতিযত্নতঃ— এই শাস্ত্রবচনটি খোদাই করে দেন।’
৬০. স্বপন বসু লিখেছিলেন: ‘বেথুনের উদ্যোগে স্কুল চালু হওয়ার পর তীব্র সামাজিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো। বালিকা বিদ্যালয়ে যাঁরা মেয়ে পাঠান, সমাজে তাঁদের একরকম একঘরে করা হলো। মেয়েদের নিয়ে স্কুলের গাড়ি যখন রাজপথে বার হতো, তখন লোকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো। অনেকে ছোট ছোট মেয়েদের উদ্দেশে অভদ্র মন্তব্যও ছুঁড়ে দিতে ইতস্তত করতো না।’ দ্র. উনিশ শতকে স্ত্রীশিক্ষা, (কলকাতা: বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদ, ২০১৫), পৃ. ১৪।
৬১. স্বপন বসু, ২০১৫, পৃ. ১৮।
৬২. তদেব, পৃ. ১৯।
৬৩. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিদ্যাসাগর-রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড, (কলকাতা: মণ্ডল বুক হাউস, ১৯৬৯), পৃ. ৩৭৩।
৬৪. যোগীন্দ্রনাথ বসু, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, (কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, ২০১১), পৃ. ৩৪২।
৬৫. গোলাম মুরশিদ, আশার ছলনে ভুলি, (কলকাতা: আনন্দ, ২০১৩), পৃ. ১৪৬-৭।
৬৬. ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন আমাদের মাস্টারমশায় অধ্যাপক তপোব্রত ঘোষ।
৬৭. শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, ২০১৯, পৃষ্ঠা সংখ্যা উল্লেখ নেই। বইটির সম্পাদকীয় টীকায় জানানো হয়েছে: ‘বীরসিংহ গ্রামের নিকটস্থ ক্ষীরপাই গ্রামনিবাসী শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্যের আট বছরের কন্যা দিনময়ী দেবীর সঙ্গে চৌদ্দ বছরের ঈশ্বরচন্দ্রের বিবাহ হয়। ঠাকুরদাসের আপত্তির জন্য দিনময়ী দেবী লেখাপড়ার সুযোগ পাননি।’
৬৮. ইন্দ্রমিত্র, ২০১২, পৃ. ৪০৩।
৬৯. সমাজ-ইতিহাসের গবেষক অশোক সেন তাঁর Iswar Chandra Vidyasagar & His Elusive Milestones (Ranikhet: Permanent Black, 2016, p. 158) বইটিতে লিখেছেন:
…he [Iswar Chandra Vidyasagar] took no initiative for the education of his wife, who was married at the age of eight. Nor do we have evidence of Vidyasagar’s efforts for the education of his own daughters. All this was probably Vidyasagar’s domestic acquiescence in the dislike of his father for female education.
৭০. ইন্দ্রমিত্র, ২০১২, পৃ. ৪০০-১।
৭১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মপরিচয় (কলকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ২০১০), পৃ. ৭৩।
৭২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিঠিপত্র, প্রথম খণ্ড (কলকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ১৯৯৩), পৃ. ১৪৬।
৭৩. তদেব, পৃ. ১৫৭।
৭৪. মীরা দেবী, স্মৃতিকথা (কলকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ২০১১), পৃ. ১৯।
৭৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯৯৩, পৃ. ৭৪।
৭৬. তদেব, পৃ. ১৫৮।
৭৭. অন্নদাশঙ্কর রায়, রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে (কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, ২০১১), পৃ. ৪৫।
৭৮. প্রশান্তকুমার পাল, রবিজীবনী, ষষ্ঠ খণ্ড (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১০-১), পৃ. ১২৩।