রবীন্দ্রনাথের নারীর ভাগ্যজয়

রবীন্দ্রনাথের নারীর ভাগ্যজয়

নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার
কেহ নাহি দিবে অধিকার
হে বিধাতা?

সুপরিচিত এই কবিতাংশে কবি নারীর নিজের ভাগ্য জয় করবার অধিকার সমর্থনই করছেন। অর্থাৎ স্বীকার করছেন যে, নারী আপন ভাগ্যের অধিকার পায়নি এবং পাওয়া তার প্রয়োজন আছে। মুশকিল শুধু এই যে, সে কাজের ভার নারী-পুরুষ কাউকে না দিয়ে দিলেন বিধাতাকে— যাঁর অস্তিত্বই সংশয়িত। মনে হয়, কাজটা নারীকে নিজেকে দিলে কী ক্ষতি হত? এ মনোভাবই এল অনেক পরে, সাধারণ দেশবাসীর মননের পশ্চাৎপটে অনেক অগ্রসর। তবু ‘কিন্তু’ থাকে। ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যের শেষে চিত্রাঙ্গদা নিজের সদম্ভ পরিচয় দেয়: ‘আমি চিত্রাঙ্গদা রাজেন্দ্রনন্দিনী’, কিন্তু তার অর্জুনকে নিয়ে জীবনযাপনের শর্ত হল: ‘পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে/সে নহি নহি/হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে/সে নহি নহি। যদি পার্শ্বে রাখ মোরে সংকটে সম্পদে/সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে/সহায় হতে/পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।’ এখানে কয়েকটি শব্দে কবির বক্তব্যের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়। ‘যদি পার্শ্বে রাখ মোরে’ নারীর স্থান পুরুষের সম্মুখে বা পশ্চাতে নয়, এ তো স্বতঃসিদ্ধ; কিন্তু সংকটে সম্পদে পার্শ্বে রাখতেও ‘যদি’ আছে এবং তা পুরুষের ইচ্ছার ওপরে নির্ভর করে, শেষ পর্যন্ত সম্মতিরও প্রয়োজন আছে কঠিন ব্রতে সহায় হতে— যেটা স্বতঃসিদ্ধ অধিকার মনে হয় তাও স্বামীর সম্মতি সাপেক্ষ। এবং কথাটা যে সে বলছে না, বলছে রাজেন্দ্রনন্দিনী, চিত্রাঙ্গদা। শেষ চরণটি গদ্যধর্মী। ওইখান পর্যন্ত কবিত্ব পৌঁছয়নি যেন। কেন? নারীকে শুধু নারী বলে চিনে নেওয়াটা তখনও পুরুষের কল্পনায় হয়তো খানিকটা আত্ম অবমাননার প্রস্তাব, হোক সে অবচেতনে। আগে শর্ত পূজা, হেলা কোনওটাই চিত্রাঙ্গদা গ্রহণ করবে না— কেন? তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় ওই দুটোই ছিল নারীকে দেখবার দৃষ্টিকোণ। পূজাটা মানবী নারীকে নয়— প্রতিমাকে আর হেলাটা প্রাত্যহিক, সর্বজনীন; রাজেন্দ্রনন্দিনী তার কোনওটাতেই সম্মত নন। একটি শব্দ উঠে আসে এ মনোভাব থেকে, ‘যদি পার্শ্বে রাখ মোরে সংকটে সম্পদে- পার্শ্বে? দুয়েকটি বিরল ব্যতিক্রম বাদে ও স্থানটি নারী পেত না তখনও। চিত্রাঙ্গদা বলেছেন কেবলমাত্র পাশে রাখলেই, অর্জুন তার পরিচয় পাবেন। পাশে কখন? সংকটে সম্পদে অর্থাৎ যুগল জীবনের সর্ব অবস্থান (অনেকটা খ্রিস্টান বিবাহের মন্ত্রের মতো শুনতে লাগে যেন), জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সুখে, দুখে নারী পুরুষের পাশে স্থান দাবি করে যা তার একান্ত প্রাপ্য। কিন্তু যা সে পায় না। তাই এতগুলি ‘যদি’ এবং এখানেই কবিতাটির চূড়ান্ত মুহূর্তে তার দুর্বলতা উঠে আসে। সব দাবি শর্তসাপেক্ষ, যদি পুরুষ নারীকে পূজা বা হেলা থেকে তুলে এনে পাশে স্থান দেয়। অনুক্ত রইল না-ও দিতে পারে, পূজা হেলার মধ্যেই অবসিত হতে পারে তার ভূমিকা। অর্থাৎ নারীর ভাগ্য জয় করবে হয় পুরুষ না হয় বিধাতা। খ্রিস্টান বিবাহে নারী পুরুষের একই প্রতিজ্ঞা — for better, for worse, for richer, for poorer, and in richness, in health, to love and to cherish till death us do part, আরও ভাল আরও মন্দ অবস্থায় সম্পদে দারিদ্র্যে রোগে স্বাস্থ্যে— প্রেমে আদরে গ্রহণ করছি যতদিন পর্যন্ত মৃত্যু আমাদের বিচ্ছিন্ন না করে।

নারীর প্রতি পুরুষের মনোভাব ইতিহাসে অনাদ্যন্ত কাল থেকে নির্ধারিতই ছিল পুরুষের পায়ের নীচে যার প্রতিবাদে নারীর দম্ভোক্তি:

আমি নারী আমি মহীয়সী
আমার সুরে সুর বেঁধেছে জ্যোৎস্নাবীণায় নিদ্রাবিহীন শশী
আমি নইলে মিথ্যা হত সন্ধ্যাতারা ওঠা।
মিথ্যা হত কাননে ফুল ফোটা।

সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রের মতে এতে উদ্দীপন বিভাব ও আলম্বন বিভাব দুই-ই আছে। এবং দু’টির মধ্যেই অত্যুক্তি আছে। সেই নারীর প্রেমের অনুষঙ্গে প্রকৃতির আয়োজন— সন্ধ্যাতারা, কাননের ফুল। এইটে কাজ করে উদ্দীপন বিভাবের। আবার নায়ক নায়িকার অদৃশ্য উপস্থিতি হল আলম্বন বিভাব। এগুলো শৃঙ্গার রসের পরিপূরক কিন্তু এ সবের অন্তরালে নারীর স্থান ভোগ্যবস্তুর। সংশয়ে সংকটে পুরুষের পাশে থাকার অধিকারও এ নারীর নেই। যদি পুরুষ দয়া করে পাশে রাখে তবেই থাকতে পারে, নতুবা নয়। কাজেই নারীর স্বাতন্ত্র্য নারীর হাতেও নয়, সে অর্জন করে নেবে তার সুযোগও কম।

খুব মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথ নারীকে স্বাতন্ত্র্যসন্ধানে চলতে দেখিয়েছেন, যেমন ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থের ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতায়। এখানে সাধারণ এবং অন্তঃপুরিকা মালতী নিজের নিষ্পরিচয় সাধারণত্বে ক্লিষ্ট হয়ে ক্রমে ক্রমে কেমন করে গণিতে প্রথম হল বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিলেতে গেল, যেখানে তার পূর্বমুগ্ধ পুরুষ নরেশ বারেবারে ফেল করে চলেছে। সেইখানে মালতীর অভ্যর্থনা-সভার এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে নরেশ। এই পর্যন্ত সবই ভাল, মুশকিল হল একটাই: সমস্তটাই কবির ইচ্ছাপূরক কল্পনা, বাস্তবে এর চিহ্নমাত্র নেই। কিন্তু মনে মনে কবি চান এমন মেয়ে হোক। আজ হয়েছেও অনেক; বিধাতার প্রসাদে নয়, স্বামীর দয়ায় নয় (কখনও স্বামীর আনুকূল্যে হলেও), বিশুদ্ধ নিজের চেষ্টায় জেদে একান্ততায়। নিজের স্বাতন্ত্র্যে।

এই স্বাতন্ত্র্যই একমাত্র চাবিকাঠি প্রতিকূল পরিবেশকে জয় করে নিজেকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করবার। এবং এখানে এসে কবি পায়ের তলায় বাস্তব মাটি না পেয়ে সম্পূর্ণ কল্পনার আশ্রয় নিয়ে এমন এক কল্পলোক সৃষ্টি করলেন যেখানে বাস্তবের পশ্চাৎপট ক্ষীণ হয়ে যায়। কিন্তু কখনওই তিনি বিস্মৃত হন না যে, নারী অবদমিত। কারণ, তার স্বামী, শ্বশুরবাড়ি এবং বৃহৎ সমাজব্যবস্থা তাই চায়। জনসাধারণ নারীর অধিকার সম্বন্ধে উদাসীন নয়, প্রতিকূল। ‘হৈমন্তী’ নামের অসাধারণ গল্পে নারীর ভালমন্দ, সুখদুঃখ, জীবনমৃত্যু সম্বন্ধে উপেক্ষা নয়, সক্রিয় প্রতিকূলতা সম্বন্ধে স্পষ্ট করে বলেছেন, হৈমন্তীর মৃত্যুর পর এ কথা অন্য ভাবে তার স্বামীর মুখে বলেছেন। পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে বিনা চিকিৎসায় হৈমন্তীর মৃত্যুর পরে তার স্বামী মনে মনে বলে, ‘স্ত্রীকে লইয়া জোর করিয়া বাহির হইয়া গেলেই তো হইত। গেলাম না কেন? কেন? যদি লোকধর্মের কাজে সত্যধর্মকে না ঠেলিব, যদি ঘরের কাছে ঘরের মানুষকে বলি দিতে না পারিব, তবে আমার রক্তের মধ্যে বহু যুগের যে শিক্ষা তাহা কী করিতে আছে। জান তোমরা, যেদিন অযোধ্যার লোকেরা সীতাকে বিসর্জন দিবার দাবি করিয়াছিল তাহার মধ্যে আমিও যে ছিলাম আর সেই বিসর্জনের গৌরবের কথা যুগে যুগে যাহারা গান করিয়া আসিয়াছে আমিও যে তাহাদের মধ্যে একজন’, এখানে পিতৃতন্ত্রের প্রভাবে নারীর উপর অত্যাচার, অনাদরের ফলে নারী যে নিগৃহীত, পদদলিত হয়ে মরতে বাধ্য হয়— আজও— সে কথা কবি স্পষ্ট করে বলেছেন। অন্য অনেক গল্পে প্রকারান্তরে এ কথা বলেছেন।

হৈমন্তী নিষ্প্রতিবাদে মৃত্যুবরণ করল, তার স্বামী মৌন প্রতিবাদ-সহ। এ তো গেল বহু ছোটগল্পে নারী নিগ্রহের চিত্র। এ ছাড়াও অনেক গল্পে নারীনির্যাতনের কাহিনি আছে, যেখানে নারী নির্বাক অত্যাচারিতা, কখনও অত্যাচার মৃত্যুতে গিয়ে ঠেকে। কোথাও বা ক্ষীণ প্রতিবাদ সে করে, ফল হয় না। পুরুষের অন্যায়ে প্রবল ঘৃণা ও বিদ্রূপের বাণী সে উচ্চারণ করে, যেমন চন্দরা’র অমর উচ্চারণ ‘মরণ’।

‘স্ত্রীর পত্র’-এ মৃণাল দীর্ঘকাল ধরে তার ব্যক্তিত্ব এবং মানবিক দাবি, তার জায়ের বোনের জন্য তাদের বাড়ির আশ্রয় ও নিরাপত্তা চেয়ে পায়নি; অবশেষে সে চিঠি লিখে গৃহত্যাগ করল। এ এক রকম পরাজয়-পলায়ন। কিন্তু ওই পরিবেশে ওই সমাজে বিকল্প কী হতে পারত? বেশ কিছু দাপুটে মেয়ের কথা বলেছেন লেখক, কিন্তু তাদের দাপটে তাদের ক্ষণিক জয় হলেও বা প্রতিপক্ষ তখনকার মতো হার মানলেও স্থায়ী কোনও স্বীকৃতি পায়নি তাদের ব্যক্তিত্ব, তাদের জয়ী সত্তা যা ভাগ্যকে পদদলিত করে, তা উন্নতগ্রীবা নারীর স্বাতন্ত্র্যের মহিমা প্রকাশ করেছে।

‘ল্যাবরেটারি’ গল্পের সোহিনী দেখাল নারীর সতীত্বের আধার তার শরীর নয়, তার চিত্তের নিষ্ঠা, দেহদানের বিনিময়ে সে স্বেচ্ছায় এক অধ্যাপকের সাধনার উপাদান জোগাল। ল্যাবরেটরিটিকে বাঁচাল, এক নিবেদিতপ্রাণ বৈজ্ঞানিকের সুদীর্ঘ সাধনাকে বাঁচাল, নিজেকে সে সাধনায় সর্বতো ভাবে সমর্পণ করে। সমস্ত প্রচলিত সমাজব্যবস্থার প্রতিকূলে গিয়ে সোহিনী ল্যাবরেটরিটিকে বাঁচাল। এখানে নারী এমন এক স্বতন্ত্র মহিমায় আত্মপ্রকাশ করে যা যথার্থই বিরল। এবং এ নারীকে কোনও পুরুষ গৌণ ভাবে বৈজ্ঞানিক ছাড়া আনুকূল্য দেয়নি। সমাজের কাছে সোহিনী অসতী কিন্তু চিরকালের মানদণ্ডে তার ঋজু মেরুদণ্ড একটি বিরল ব্যাপার। একক সিদ্ধান্তে সে বৈজ্ঞানিকের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। তাঁর সন্তান গর্ভে ধারণ করেছে, তাঁর সকল প্রকার পরিচর্যা করেছে। কোনও বিধাতা বা কোনও পুরুষ তাকে অধিকার দেয়নি, অধিকার সে অর্জন করেছে আপন দৃঢ় মনোবলে এবং একনিষ্ঠ থেকেছে তার সিদ্ধান্তে, জানা প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে। ভারতবর্ষে এত বড় এই আত্মত্যাগ এবং বিদ্যার মূল্যদান তা যে কোনও কালেই বিরল।

কবির নিজের মৃত্যুর ঠিক তিন মাস আগে লেখা ‘বদনাম’ গল্পের সৌদামিনী (দারোগার স্ত্রী), গোপনে উগ্রপন্থীকে প্রশ্রয় দেওয়া দিদি। ওই সম্পর্ক ও কাজটার জন্য কত মূল্য দিতে হবে তা সৌদামিনী ও অনিল দু’জনেই জানত। সৌদামিনী জানত, প্রচলিত সমাজ বিধির ওপরেও একটা মানবিক বিধি আছে, যেখানে অনিল সত্যকার সৎকাজে নিবেদিতপ্রাণ এবং সৌদামিনীকে দারোগাপত্নী রূপে ভাগ্য জয় করতে হবে অনিলের দেশসেবায় সহযোগিতা করে। গোপনে এবং প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে। এই নারী আপন ভাগ্য জয় করল একা আপন বিশ্বাস ও নিষ্ঠায়।

রবীন্দ্রসাহিত্যে নারীর ভাগ্য জয় করবার দায়িত্ব বিধাতার হাত থেকে খসে পড়ছে ক্রমেই। দেশবিদেশের ইতিহাসে স্বয়ম্ভর নারীর কাহিনি জানছেন তিনি, নিজের দেশের সাহিত্যেও দু’-চারটি বিরল ব্যতিক্রমের কথা পড়ছেন, সংবাদ পাচ্ছেন ঋজু মেরুদণ্ডের অধিকারিণী নারীর, যাকে বিধাতা কোনও অধিকার দেননি, পুরুষ কোনও আনুকূল্য দেয়নি, জাতীয় সংগ্রামে পতাকা হাতে উচ্চশির নারী সমাজমতের বিরুদ্ধে গিয়ে মৃত্যুবরণ করছে ধীরে ধীরে। কবি নারীর জীবনক্ষেত্র থেকে বিধাতাকে ইস্তফা দিয়ে পুরুষকে কেবলমাত্র সহায়কের ভূমিকায় রেখে বিবেকবুদ্ধির জোরে নেওয়া সিদ্ধান্তে অটল হয়ে থাকতে বললেন। দেখালেন, এ বিবর্তন সহজ ছিল না। তাই এতে সংলগ্ন রইল দুর্লভ এক মহিমা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রবীন্দ্রনাথের নারীর ভাগ্যজয়

রবীন্দ্রনাথের নারীর ভাগ্যজয়

রবীন্দ্রনাথের নারীর ভাগ্যজয়

নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার
কেন নাহি দিবে অধিকার
হে বিধাতা?

সুপরিচিত এই কবিতাংশে কবি নারীর নিজের ভাগ্য জয় করবার অধিকার সমর্থনই করছেন। অর্থাৎ স্বীকার করছেন যে নারী আপন ভাগ্যের অধিকার পায়নি এবং পাওয়া তার প্রয়োজন। আছে। মুশকিল শুধু এই যে সে কাজের ভার নারী-পুরুষ কাউকে না দিয়ে দিলেন বিধাতাকে— যাঁর অস্তিত্বই সংশয়িত। মনে হয়, কাজটা নারীকে নিজেকে দিলে কী ক্ষতি হত? এ মনোভাবই এল অনেক পরে, সাধারণ দেশবাসীর মননের পশ্চাৎপটে অনেক অগ্রসর। তবু ‘কিন্তু’ থাকে। ’চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাটের শেষে চিত্রাঙ্গদা নিজের সদম্ভ পরিচয় দেয়: ‘আমি চিত্রাঙ্গদা রাজেন্দ্ৰনন্দিনী’, কিন্তু তার অর্জুনকে নিয়ে জীবনযাপনের শর্ত হল: ‘পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে/ সে নহিনহি/হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে/ সে নহিনহি। যদি পার্শ্বে রাখ মোরে সংকটে সম্পদে/সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে/ সহায় হতে পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।’ এখানে কয়েকটি শব্দে কবির বক্তব্যের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়। ’যদি পার্শ্বে রাখ মোরে’ নারীর স্থান পুরুষের সম্মুখে বা পশ্চাতে নয়, এতো স্বতঃসিদ্ধ; কিন্তু সংকটে সম্পদে পার্শ্বে রাখাতেও ‘যদি’ আছে এবং তা পুরুষের ইচ্ছার ওপরে নির্ভর করে, শেষ পর্যন্ত সম্মতিরও প্রয়োজন আছে কঠিন ব্রতে সহায় হতে— যেটা স্বতঃসিদ্ধ অধিকার মনে হয় তাও স্বামীর সম্মতি সাপেক্ষ। এবং কথাটা যে সে বলেছে না, বলছে রাজেন্দ্ৰনন্দিনী, চিত্রাঙ্গদা। শেষ চরণটি গদ্যধর্মী। ওইখান পর্যন্ত কবিত্ব পৌঁছোয়নি যেন। কেন? নারীকে শুধু নারী বলে চিনে নেওয়াটা তখনো পুরুষের কল্পনায় হয়তো খানিকটা আত্ম অবমাননার প্রস্তাব, হোক সে অবচেতনে। আগে শর্ত পূজা, হেলা কোনোটাই চিত্রাঙ্গদা গ্রহণ করবে না কেন? তক্কালীন সমাজব্যবস্থায় ওই দুটোই ছিল নারীকে দেখবার দৃষ্টিকোণ। পূজাটা মানবী নারীকে নয় প্রতিমাকে আর হেলাটা প্রাত্যহিক, সর্বজনীন; রাজেন্দ্ৰনন্দিনী তার কোনোটাতেই সম্মত নন। একটি শব্দ উঠে আসে এ মনোভাব থেকে ‘যদি পার্শ্বে রাখ মোরে সংকটে সম্পদে’—পার্শ্বে দুয়েকটি বিরল ব্যতিক্রম বাদে ও স্থানটি নারী পেত তখনো। চিত্রাঙ্গদা বলেছেন কেবলমাত্র পাশে রাখলেই, অর্জুন তার পরিচয় পাবেন। পাশে কখন? সংকটে সম্পদে অর্থাৎ যুগল জীবনের সর্ব অবস্থান (অনেকটা খ্রিস্টান বিবাহের মন্ত্রের মতো শুনতে লাগে যেন) জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সুখে, দুখে নারী পুরুষের পাশে স্থান দাবি করে যা তার একান্ত প্রাপ্য। কিন্তু যা সে পায় না। তাই এতগুলি ‘যদি’ এবং এখানেই কবিতাটির চূড়ান্ত মুহূর্তে তার দুর্বলতা উঠে আসে। সব দাবি শর্তসাপেক্ষ যদি পুরুষ নারীকে পূজা বা হেলা থেকে তুলে এনে পাশে স্থান দেয়। অনুক্ত রইল না-ও দিতে পারে, পূজা হেলার মধ্যেই অবসিত হতে পারে তার ভূমিকা। অর্থাৎ নারীর ভাগ্য জয় করবে হয় পুরুষ না হয় বিধাতা। খ্রিস্টান বিবাহে নারী পুরুষের একই প্রতিজ্ঞা— for better, for worse, for richer for poorer, and in richneas, in health, to love and to cherish till death us do part, আরো ভালো আরো মন্দ অবস্থায় সম্পদে দারিদ্র্যে রোগে স্বাস্থ্যে— প্রেমে আদরে গ্রহণ করছি যতদিন পর্যন্ত মৃত্যু আমাদের বিচ্ছিন্ন না করে।

নারীর প্রতি পুরুষের মনোভাব ইতিহাসে অনাদ্যন্ত কাল থেকে নির্ধারিতই ছিল পুরুষের পায়ের নীচে যার প্রতিবাদে নারীর দম্ভোক্তি :

আমি নারী আমি মহীয়সী
আমার সুরে সুর বেঁধেছে জ্যোৎস্নাবীণায় নিদ্রাবিহীন শশী
আমি নইলে মিথ্যা হত সন্ধ্যাতারা ওঠা।
মিথ্যা হত কাননে ফুল ফোটা।

সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রের মতে এতে উদ্দীপন বিভাব ও আলম্বন বিভাব দুই-ই আছে। এবং দুটির মধ্যেই অত্যুক্তি আছে। সেই নারীর প্রেমের অনুসঙ্গে প্রকৃতির আয়োজন— সন্ধ্যাতারা, কাননের ফুল। এইটে কাজ করে উদ্দীপন বিভাবের। আবার নায়ক নায়িকার অদৃশ্য উপস্থিতি হল আলম্বন বিভাব। এগুলো শৃঙ্গার রসের পরিপূরক কিন্তু এসবের অন্তরালে নারীর স্থান ভোগ্যবস্তুর। সংশয়ে সংকটে পুরুষের পাশে থাকার অধিকারও এ নারীর নেই। যদি পুরুষ দয়া করে পাশে রাখে তবেই থাকতে পারে, নতুবা নয়। কাজেই নারীর স্বাতন্ত্র নারীর হাতেও নয়, সে অর্জন করে নেবে তার সুযোগও কম।

খুব মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথ নারীকে স্বাতন্ত্র্যসন্ধানে চলতে দেখিয়েছেন, যেমন ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থের সাধারণ মেয়ে’ কবিতায়। এখানে সাধারণ এবং অন্তঃপুরিকা মালতী নিজের নিষ্পরিচয় সাধারণত্বে ক্লিষ্ট হয়ে ক্রমে ক্রমে কেমন করে গণিতে প্রথম হল বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিলেতে গেল, যেখানে তার পূর্বমুগ্ধ পুরুষ নরেশ বারেবারে ফেল করে চলেছে। সেইখানে মালতীর অভ্যর্থনা-সভার এককোণে দাঁড়িয়ে আছে নরেশ। এই পর্যন্ত সবই ভালো, মুশকিল হল একটাই : সমস্তটাই কবির ইচ্ছাপূরক কল্পনা, বাস্তবে এর চিহ্নমাত্র নেই। কিন্তু মনে মনে কবি চান এমন মেয়ে হোক। আজ হয়েছেও অনেক; বিধাতার প্রসাদে নয় স্বামীর দয়ায় নয় (কখনো স্বামীর আনুকূল্যে হলেও) বিশুদ্ধ নিজের চেষ্টায় জেদে একান্ততায়। নিজের স্বাতন্ত্রে।

এই স্বাতন্ত্রই একমাত্র চাবিকাঠি প্রতিকূল পরিবেশকে জয় করে নিজেকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করবার। এবং এখানে এসে কবি পায়ের তলায় বাস্তব মাটি না পেয়ে সম্পূর্ণ কল্পনার আশ্রয় নিয়ে এমন এক কল্পনোক সৃষ্টি করলেন যেখানে বাস্তবের পশ্চাৎপট ক্ষীণ হয়ে যায়। কিন্তু কখনোই তিনি বিস্মৃত হন না যে নারী অবদমিত, কারণ তাঁর স্বামী, শ্বশুরবাড়ি এবং বৃহৎ সমাজব্যবস্থা তাই চায়। জনসাধারণ নারীর অধিকার সম্বন্ধে উদাসীন নয়, প্রতিকূল। ’হৈমন্তী’ নামের অসাধারণ গল্পে নারীর ভালোমন্দ, সুখদুঃখ, জীবনমৃত্যু সম্বন্ধে উপেক্ষা নয়, সক্রিয় প্রতিকূলতা সম্বন্ধে স্পষ্ট করে বলেছেন, হৈমন্তীর মৃত্যুর পর একথা অন্যভাবে তার স্বামীর মুখে বলেছেন। পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে বিনা চিকিৎসায় হৈমন্তীর মৃত্যুর পরে তার স্বামী মনে মনে বলে স্ত্রীকে লইয়া জোর করিয়া বাহির হইয়া গেলেই তো হইত। গেলাম না কেন? কেন? যদি লোকধর্মের কাজে সত্যধর্মকে না ঠেলিব, যদি ঘরের কাছে ঘরের মানুষকে বলি দিতে না পারিব, তবে আমার রক্তের মধ্যে বহুযুগের যে শিক্ষা তাহা কী করিতে আছে। জান তোমরা, যেদিন অযোধ্যার লোকেরা সীতাকে বিসর্জন দিবার দাবি করিয়াছিল তাহার মধ্যে আমিও যে ছিলাম আর সেই বিসর্জনের গৌরবের কথা যুগে যুগে যাহারা গান করিয়া আসিয়াছে আমিও যে তাহাদের মধ্যে একজন’ এখানে পিতৃতন্ত্রের প্রভাবে নারীর উপর অত্যাচার, অনাদরের ফলে নারী যে নিগৃহীত, পদদলিত হয়ে মরতে বাধ্য হয়— আজও সেকথা কবি স্পষ্ট করে বলেছেন। অন্য অনেক গল্পে প্রকারান্তরে একথা বলেছেন।

হৈমন্তী নিষ্প্রতিবাদে মৃত্যুবরণ করল, তার স্বামীর মৌন প্রতিবাদ-সহ। এ তো গেল বহু ছোটোগল্পে নারী নিগ্রহের চিত্র। এ ছাড়াও অনেক গল্পে নারীনির্যাতনের কাহিনি আছে, যেখানে নারী নির্বাক অত্যাচারিতা, কখনো অত্যাচার মৃত্যুতে গিয়ে ঠেকে। কোথাও বা ক্ষীণ প্রতিবাদ সে করে, ফল হয় না। পুরুষের অন্যায়ে প্রবল ঘৃণা ও বিদ্রূপের বাণী সে উচ্চারণ করে, যেমন চন্দরা’র অমর উচ্চারণ ‘মরণ’।

‘স্ত্রীর পত্র’-এ মৃণাল দীর্ঘকাল ধরে তার ব্যক্তিত্ব এবং মানবিক দাবি, তার জায়ের বোনের জন্য তাদের বাড়ির আশ্রয় ও নিরাপত্তা চেয়ে পায়নি; অবশেষে সে চিঠি লিখে গৃহত্যাগ করল। এ একরকম পরাজয় পলায়ন। কিন্তু ওই পরিবেশে ওই সমাজে বিকল্প কী হতে পারত? বেশ কিছু দাপুটে মেয়ের কথা বলেছেন লেখক, কিন্তু তাদের দাপটে তাদের ক্ষণিক জয় হলেও বা প্রতিপক্ষ তখনকার মতো হার মানলেও স্থায়ী কোনো স্বীকৃতি পায়নি তাদের ব্যক্তিত্ব, তাদের জয়ী সত্তা যা ভাগ্যকে পদদলিত করে, তা উন্নতগ্রীবা নারীর স্বাতন্ত্রের মহিমা প্রকাশ করেছে।

‘ল্যাবরেটারি’ গল্পের সোহিনী দেখাল নারীর সতীত্বের আধার তার শরীর নয়, তার চিত্তের নিষ্ঠা, দেহদানের বিনিময়ে সে স্বেচ্ছায় এক অধ্যাপকের সাধনার উপাদান জোগাল। ল্যাবরেটরিটিকে বাঁচাল এক নিবেদিতপ্রাণ বৈজ্ঞানিকের সুদীর্ঘ সাধনাকে বাঁচাল নিজেকে সে সাধনায় সর্বতোভাবে সমর্পণ করে। সমস্ত প্রচলিত সমাজব্যবস্থার প্রতিকূলে গিয়ে সোহিনী ল্যাবরেটরিটিকে বাঁচাল। এখানে নারী এমন এক স্বতন্ত্র মহিমায় আত্মপ্রকাশ করে যা যথার্থই বিরল। এবং এ নারীকে কোনো পুরুষ গৌণভাবে বৈজ্ঞানিক ছাড়া আনুকূল্য দেয়নি। সমাজের কাছে সোহিনী অসতী কিন্তু চিরকালের মানদণ্ডে তার ঋজু মেরুদণ্ড একটি বিরল ব্যাপার। একক সিদ্ধান্তে সে বৈজ্ঞানিকের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। তাঁর সন্তান গর্ভে ধারণ করেছে, তাঁর সকল প্রকার পরিচর্যা করেছে। কোনো বিধাতা বা কোনো পুরুষ তাকে অধিকার দেয়নি, অধিকার সে অর্জন করেছে আপন দৃঢ় মনোবলে এবং একনিষ্ঠ থেকেছে তার সিদ্ধান্তে, জানা প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে। ভারতবর্ষে এত বড়ো এই আত্মত্যাগ এবং বিদ্যার মূল্যদান তা যে কোনো কালেই বিরল।

কবির নিজের মত্যুর ঠিক তিনমাস আগে লেখা ‘বদনাম’ গল্পের সৌদামিনী দোরোগার স্ত্রী), গোপনে উগ্রপন্থীকে প্রশ্রয় দেওয়া দিদি। ওই সম্পর্ক ও কাজটার জন্য কত মূল্য দিতে হবে তা সৌদামিনী ও অনিল দুজনেই জানত। সৌদামিনী জানত প্রচলিত সমাজ বিধির ওপরেও একটা মানবিক বিধি আছে, যেখানে অনিল সত্যকার সকাজে নিবেদিতপ্রাণ এবং সৌদামিনীকে দারোগপত্নীরূপ ভাগ্য জয় করতে হবে অনিলের দেশসেবায় সহযোগিতা করে। গোপনে এবং প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে। এই নারী আপন ভাগ্য জয় করল একা আপন বিশ্বাস ও নিষ্ঠায়।

রবীন্দ্রসাহিত্যে নারীর ভাগ্য জয় করবার দায়িত্ব বিধাতার হাত থেকে খসে পড়ছে ক্রমেই। দেশবিদেশের ইতিহাসে স্বয়ম্ভর নারীর কাহিনি জানছেন তিনি, নিজের দেশের সাহিত্যেও দু চারটি বিরল ব্যতিক্রমের কথা পড়ছেন, সংবাদ পাচ্ছেন ঋজু মেরুদণ্ডের অধিকারিণী নারীর, যাকে বিধাতা কোনো অধিকার দেননি, পুরুষ কোনো আনুকূল্য দেয়নি, জাতীয় সংগ্রামে পতাকা হাতে উচ্চশির নারী সমাজমতের বিরুদ্ধে গিয়ে মৃত্যুবরণ করছে ধীরে ধীরে। কবি নারীর জীবনক্ষেত্র থেকে বিধাতাকে ইস্তফা দিয়ে পুরুষকে কেবলমাত্র সহায়কের ভূমিকায় রেখে বিবেকবুদ্ধির জোরে নেওয়া সিদ্ধান্তে অটল হয়ে থাকতে বললেন। দেখালেন এ বিবর্তন সহজ ছিল না। তাই এতে সংলগ্ন রইল দুর্লভ এক মহিমা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *