বাংলা প্রবন্ধ
Essays in English
পরিশিষ্ট

রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধ

রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধ

রবীন্দ্রনাথের মুখেই ঘটনাটি শুনেছিলাম! কবি যেবার কানাডা হয়ে আমেরিকা যান—এবং ফেরার পথে জাপান ঘুরে ভারতবর্ষে আসেন সেই ভ্রমণের সময়েরই একটি ঘটনা। সেবারের ভ্রমণে তাঁর সঙ্গী ছিলেন সম্ভবতঃ প্রিয়বর শ্রীঅপূর্বকুমার চন্দ। পশ্চিম কানাডা থেকে রবীন্দ্রনাথ আমেরিকায় প্রবেশ করলেন। এই সময় আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে এশিয়ার অধিবাসীদের বিরুদ্ধে এক চরম বর্ণবিদ্বেষের ভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। কালিফোর্নিয়ার ফুল, ফল, শাক, সবজি প্রভৃতি চাষবাসের কাজে আমেরিকাপ্রবাসী চীনা, জাপানী ও ভারতীয়রা বেশ সাফল্যের সঙ্গেই অর্থোপার্জন করত। এদের মধ্যে ভারতবাসীদের সংখ্যাই ছিল বেশি। নিদারুণ পরিশ্রমের বিনিময়ে ভারতীয়রা যে উপার্জন করতেন—অনেক বিত্তহীন আমেরিকান তা সহ্য করতে পারতেন না। অন্য কোনো উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত এইসব আমেরিকানরা নানাভাবে ভারতীয়দের বিপর্যস্ত ও নিগ্রহ করবার চেষ্টা করতে লাগল। অনেক ক্ষেত্রে সরকারী সাহায্য নিয়েও এরা ভারতীয়, চীনা, জাপানীদের জমি, জায়গা কেড়ে নিতে লাগল। অনেক ভারতবাসীই এর ফলে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেন।

এই সময় রবীন্দ্রনাথ আমেরিকার কোনো একটি স্টেশনে বিদেশ ভ্রমণের পথে নামলেন। সরকারী কর্মচারীরা রবীন্দ্রনাথের পাসপোর্ট ইত্যাদি পরীক্ষা করলেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি ভারতবাসী বুঝতে পেরে তাঁর সঙ্গে নিম্নপদস্থ সরকারী কর্মচারীরা খুবই দুর্ব্যবহার করলেন। কবির সঙ্গের জিনিসপত্রও তারা (সরকারী কর্মচারীরা) খুলে ফেলতে উদ্যত হলেন! বিশ্ববরেণ্য কবি সভ্য জগতের সর্বত্র সমাদৃত হয়ে আমেরিকার এক ছোটো স্টেশনে এইভাবে আদৃত হলেন! কবি কিন্তু কোনো প্রতিবাদ না জানিয়ে জিনিসপত্র খুলে দেখাতে সম্মত হলেন। ইতিমধ্যে একজন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী কবিকে চিনতে পেরে নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের কবির সঙ্গে সংযত ব্যবহার করতে বলেন। তিনি ঐ সব কর্মচারীদের বলেন যে, তারা যেন রবীন্দ্রনাথকে এভাবে বিরক্ত না করেন।

এরপর কাস্টমসের যে কর্মচারীটি কবির মালপত্র পরীক্ষা করে দেখতে চাচ্ছিলেন তিনি বলেন, যেহেতু তিনি বড়ো কবি ও নামী লোক, এইজন্য তারা তাঁকে আর বিরক্ত করবেন না। অন্য কোনো সাধারণ ভারতবাসী হলে তাঁকে ওরা রেহাই দিতেন না। রবীন্দ্রনাথ এই কথা শুনে অপমানিত বোধ করলেন এবং ক্ষোভের ও ক্রোধের সঙ্গে কবি বলেছিলেন—‘আমি তোমাদের কোনোরকম অনুগ্রহ চাইনা। আমার দেশের দীনতম লোকের সঙ্গেও তোমরা যেমন ব্যবহার করো—আমার ক্ষেত্রেও আমি তোমাদের কাছ থেকে সেইরকম ব্যবহারই আশা করি।’ কবির তেজস্বিতা ও দেশাত্মবোধে ওখানকার অধিবাসীরা বিস্মিত হলেন। শেষ পর্যন্ত অন্যান্য সরকারী কর্মচারীরা কবির কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন। কবি কোনো কথা না বলে নিজের মনের ভাব প্রকাশ না করেই সেখান থেকে চলে গেলেন। বিশ্বকবি তাঁর নির্দিষ্ট হোটেলে গিয়ে উঠলেন কিন্তু বিদেশে এই ধরনের বর্ণবিদ্বেষ দেখে তাঁর মন খুবই ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। কবি অপমানিত বোধ করলেন—তাঁর সঙ্গে ও তাঁর দেশবাসীর সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের এই ব্যবহার তাঁর মনে বিশেষ অশান্তির সৃষ্টি করেছিল। হোটেলে একজন শিখ ভদ্রলোক (প্রবাসী) স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। শিখ ভদ্রলোকটি নিজেদের দেশনায়ককে কাছে পেয়ে নি:সঙ্কোচে তাঁর সমস্ত অভাব, অভিযোগের কথা বললেন। শিখ ভদ্রলোকটি জঙ্গল কেটে জমি তৈরি করে শাক, সবজি চাষ করে কীভাবে জীবিকানির্বাহ করেন সবই কবিকে বুঝিয়ে বললেন। শিখ পরিবারটি চাষের জমিগুলি বহুদিনের জন্য ইজারা নিয়েছিলেন, এই আশায় যে, ভবিষ্যতে তারা স্থায়ীভাবে আমেরিকায় বসবাসের অধিকার পাবেন এবং এইসব জমিও তাঁরা নিজেদের অধিকারে আনতে পারবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা তো হচ্ছে না—উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী তাঁরা যে জমি চাষ করছেন তা থেকেও তাঁরা ভারতীয় বলে বঞ্চিত হতে চলেছেন। এইসব অবস্থায় শিখ পরিবারটি খুবই অসুবিধার মধ্যে পড়ে কবির কাছে সাহায্য ও পরামর্শের জন্য এসেছেন। তাঁরা আশা করছেন যে, কবি ব্যক্তিগত প্রভাবের দ্বারা তাঁদের এই সমস্যা সমাধানে সাহায্য করবেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের বললেন অন্য এমন কোনো সৎ-ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করতে, যাতে শ্বেতাঙ্গ অধিবাসীরা আর তাদের বিরক্ত করতে পারবে না! কবি এইসব দেখে খুবই দুঃখ পেলেন এবং তাঁর বিতৃষ্ণাও হল। কবি ঠিক করলেন যে যখন তিনি এই সমস্যার সমাধানের জন্য কার্যকরীভাবে কিছুই করতে পারছেন না, তখন যে দেশে তাঁর স্বজাতিগণ নিগৃহীত হচ্ছে সেই দেশের সরকারের সম্মানিত অতিথিরূপেও তিনি থাকতে পারেন না। শেষ পর্যন্ত বন্ধু, বান্ধব ও পরিচিতদের অনুরোধকে উপেক্ষা করে তিনি একটি জাপানী জাহাজে দেশে ফিরে এলেন। কবি এতই বিচলিত হয়েছিলেন যে বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা না করে (তিনি হয়তো ভেবেছিলেন যে বন্ধুরা তাঁকে হয়তো এখনই দেশে ফিরতে দেবেন না) নিজেই একটি জাপানী জাহাজ কোম্পানীতে গিয়ে দুই তিন দিনের মধ্যে দেশে ফেরবার ব্যবস্থা করে এলেন। আরও অনেক জায়গায় তাঁর যাবার ইচ্ছা ছিল সেসব পরিকল্পনাও তিনি পরিত্যাগ করেন।

গল্পভারতী বৈশাখ ১৩৬৭; পূর্ণিমা শারদীয় সংকলন ১৩৫৩-তে

প্রকাশিত রচনার সংশোধিত রূপ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *