রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন-দেবতা’
[ বৈদিক উর্বশী, গ্রিক আফ্রোদীতে, সূফী বিশ্বপ্রিয়া ]
রবীন্দ্রনাথের ‘উর্বশী’ কবিতাটি বাঙলা ভাষায় উপলব্ধি ও কল্পনার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকাশরূপে বিদ্যমান, এবং বিশ্বসাহিত্যেও এইরূপ কবিতা সুদুর্লভ। বিশ্ব-প্রপঞ্চ ও মানবজীবন উভয়েরই মাধ্যমে কার্যকর জীবনের আধার এবং পটভূমিকারূপে শাশ্বত সত্তা ও সত্য নানাভাবে আপনি মানুষের কাছে দেখা দেয় ও ধরা দেয়—মানুষও নানাভাবে তাহাকে দেখিতে চায় ও ধরিতে চায়। মানুষের ব্যক্তিগত প্রকৃতি, রুচি ও আকাঙ্ক্ষা সংখ্যাতীত; শাশ্বত সত্যও বিশ্বের বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে সংখ্যাতীত পৃথক পৃথক রূপেই আত্মপ্রকাশ করে। সূফী দার্শনিক এই ভাবের কথাই বলিয়াছেন—‘ত্বু রুক-ল্লাহি কা-অদদি অনফাসি-ল-মখলূক্কাতি—অর্থাৎ সৃষ্ট বস্তুসমূহের নি:শ্বাসের সংখ্যার মতোই ঈশ্বরের প্রকাশলীলা অনন্ত। রবীন্দ্রনাথের মনে এই শাশ্বত সত্তা যেভাবে নিজেকে ধরা দিয়াছিল, তাঁহার যৌবনকালের ‘জীবন-দেবতা’ পর্যায়ের কবিতাগুলিতে (মুখ্যতঃ সোনারতরী ও চিত্রা-র এবং উৎসর্গ-র কতকগুলি কবিতায়, এবং প্রকীর্ণ অন্য কতকগুলি কবিতায়) তাহা অদ্ভুত মনোহরভাবে প্রকাশিত হইয়াছে। ভাব ও তাহার প্রকাশ উভয়ই চিরন্তন, এবং একাধারে নবীন ও প্রাচীন। নানা দেশে নানা যুগে নানা শ্রেণীর মানুষের মধ্যে শাশ্বত বস্তুর প্রকাশ বহুধা অর্থাৎ বহু বিভিন্নরূপে দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাহার মধ্যে একটি নূতন ভঙ্গী আনিয়া দিয়াছেন; তাহাতে এই চিরন্তন সত্তা আবার নূতনরূপে আমাদের সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, এবং আমাদের আকুল করিতেছে। এই বিশ্বজনীন আবার রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের বা ব্যক্তিগত উপলব্ধির রঙ্গে রঞ্জিত হইয়া, যেন বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথেরই সত্যদর্শন ও অনুভূতির বাণী বহন করিয়া উপস্থিত হইয়াছে।
একটি ছোটো ঘটনার উল্লেখ করিয়া বিষয়টির আলোচনা আরম্ভ করা যাউক। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ যখন ডচ ইণ্ডিয়া বা ইন্দোনেশিয়া অর্থাৎ দ্বীপময় ভারতে (যবদ্বীপ ও বলিদ্বীপে) ভ্রমণ করিতে যান, তখন আমাকেও তিনি সঙ্গে লইয়া যান। যবদ্বীপের বাতাভিয়া নগরে দুই-তিনদিন থাকিবার পরে আমরা সুরাবায়াতে যাই, এবং সেখান হইতে আমাদের বলিদ্বীপ যাত্রা হয়। বিকেল বেলায় আমরা সুরাবায়াতে জাহাজে চড়ি, তাহার পরের দিন ভোরে উত্তর-বলিদ্বীপের বন্দর বুলেলঙ-এ পৌঁছিবার কথা। সন্ধ্যার প্রথমেই জাহাজের যাত্রীদের সায়মাশ সম্পন্ন হইল। রবীন্দ্রনাথ উপরের খোলা ডেকে আসিয়া বসিলেন, ওলন্দাজ ও ইন্দোনেশীয় অনুরাগী সহযাত্রিগণ চারিদিকে তাঁহাকে ঘিরিয়া বসিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সদালাপ চলিতে লাগিল। আমি একটি ইন্দোনেশীয় ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্প করিতে করিতে ডেকের উপরে পায়চারি করিতেছি। একটু দূরে খোলা ডেকের উপরেই একটি ছোটো টেবিলের সামনে দুইখানি চেয়ারে একটি দম্পতি উপবিষ্ট—পোষাকে পুরুষটিকে আমেরিকান পাদরি বলিয়া মনে হইল। আড়চোখে চাহিয়া দেখিলাম, স্বামীটি একটু ভালোমানুষ গোছের সরলপ্রাণ ব্যক্তি; স্ত্রীটির ইচ্ছা, স্বামী গিয়া রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একটু আলাপ জমান, কিন্তু স্বামীটি মিশুক নহেন, ইতস্ততঃ করিতেছেন। শেষটায় দেখিলাম, বেচারা পাদরি স্ত্রীর তাড়নায় উঠিয়া রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচিত হইবার উদ্দেশ্যে আমার কাছেই আসিয়া উপস্থিত হইলেন—পরিষ্কার আমেরিকান নাকী টানের ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘Sir, you are travelling with Tagore, the poet?’ আপনি কি ঠাকুর-কবির সঙ্গে যাইতেছেন? আমি বলিলাম, ‘Yes, what can I do for you?’ হাঁ, আপনার জন্য কী করিতে পারি? পাদরি তখন আবার জিজ্ঞাসা করিলেন—‘Can I have a talk with him for two minutes by the clock?’—ঘড়ি ধরিয়া মাত্র দুই মিনিটের মতন তাঁহার সঙ্গে আলাপ করিতে পারি কি? আমি বলিলাম, একটু অপেক্ষা করুন, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া আসি। পাদরির সঙ্গে আমি যে কথা কহিতেছি, কবি তাহা লক্ষ্য করিয়াছিলেন। তাঁহার কাছে গিয়া বলিলাম, ভদ্রলোকটি ‘ঘড়ি ধরিয়া দুই মিনিট মাত্র’ আপনার সঙ্গে কথা কহিতে চান। কবি জিজ্ঞাসা করিলেন, কে ওটি? পাদরি মনে হইতেছে। আমি উত্তর দিলাম, হাঁ, পাদরি, আমেরিকান পাদরি। বিশেষ করিয়া আমেরিকান পাদরি শুনিয়া, রবীন্দ্রনাথ একটু সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিলেন। নোবেল পারিতোষিক পাইবার পরে যখন আন্তর্জাতিক নামযশ তাঁহার হইল, তাহার পরে জাহাজে ভ্রমণকালে দুই-দুইবার আমেরিকান পাদরি তাঁহার উপরে চড়াও হয়—তাঁহাকে যদি খ্রিস্টান করিতে পারা যায় এই চেষ্টায়। ঘর-পোড়া গোরু সিন্দুরে মেঘ দেখিয়া ডরায়—রবীন্দ্রনাথের সেই অবস্থা। আমি বলিলাম, যদি বেয়াদবি করে তাহা হইলে সরাইয়া লইয়া যাইব। তখন কবি নিরুপায়ভাবে বলিলেন, ‘আচ্ছা, ডেকে নিয়ে এসো।’ রবীন্দ্রনাথের সামনে আসিয়াই আমেরিকান কায়দায় হৃদ্যতা দেখাইয়া খুব জোরে তাঁহার হাত ধরিয়া ঝাঁকিয়া পাদরিটি বলিলেন, ‘Glad to make your acquaintance, Sir. After all, we follow the same religion’—মহাশয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়া সুখী হইলাম—আমরা তো মোটামুটিভাবে একই ধর্ম পালন করি। ধর্ম-বিষয়ে বিচারের উদ্দেশ্যে একেবারে সোজা মুখপাত। কবি শুধাইলেন— ‘How’s that?’ সেটা কীরকম? পাদরি ব্যাখ্যা করিলেন— ‘Aren’t our idea about God the same?’ ঈশ্বর সম্বন্ধে আমাদের ধারণা কি এক ধরনের নয়? কবি উত্তর দিলেন, ‘I doubt it very much’—সে-বিষয়ে আমার খুবই সন্দেহ আছে। তখন পাদরি বলিলেন, ‘Why, don’t we both worship God as Father?’ কেন, আমরা দুজনেই ঈশ্বরকে পিতা বলিয়া পূজা করি না? আমি দেখিলাম—এইবার God as Father বা ‘পিতা ঈশ্বর’, ইহার পরে God the Son বা ‘পুত্র ঈশ্বর’ এবং God the Holy Ghost বা ‘পবিত্র আত্মা ঈশ্বর’ আসিবেন—সেইজন্য তাড়াতাড়ি কবি কিছু বলিবার আগেই বলিলাম—‘Yes, we worship God as Father; we also worship as Mother, as Son, as Friend; we also worship him as a Lover; and we dare worship him even as Sweetheart’—আমরা পিতারূপে ঈশ্বরের আরাধনা করি; তা ছাড়া মাতারূপেও করি, পুত্র আর মিত্ররূপেও করি; আমরা ঈশ্বরকে প্রণয়াস্পদরূপেও আরাধনা করি; এমনকী তাঁহাকে প্রণয়িনী রূপেও আরাধনা করিবার সাহস রাখি। ‘সদা-প্রভু পরম পিতা’ পরমেশ্বরের সঙ্গে এ কী সৃষ্টিছাড়া সম্বন্ধের কল্পনা! পাদরিটি আমার কথা শুনিয়া রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকাইয়া রহিলেন—কিন্তু কবি নির্বাক, নিশ্চল, স্থির গম্ভীরভাবে বসিয়া রহিলেন, আমার কথার প্রতিবাদ করিলেন না। তখন পাদরিটি কিছু না বলিয়া হঠাৎ স্থান ত্যাগ করিয়া একেবারে গটগট করিয়া গিয়া অপেক্ষমানা স্ত্রীর পাশে চেয়ারে ধপ করিয়া বসিয়া পড়িলেন—বোধহয় স্ত্রীকে যাহা বলিলেন তাহা এই ধরনের কথাই হইবে—গিন্নী। এরা বলে কী! লোকগুলো উন্মাদ!
এই যে God the Sweetheart-এর কল্পনা, এটি একটু নূতন বস্তু নয়। মানব যখন হইতেই ঈশ্বর বা শাশ্বত সত্তার সহিত নিজের ব্যক্তিগত যোগের বা আকর্ষণের কথা ভাবিতে আরম্ভ করিয়াছে, তখন হইতেই তাহার সামাজিক পরিবেশের প্রসার বা উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ওই সত্তার সহিত সে নানাবিধ সম্পর্কের কল্পনা করিতে লাগিয়া গিয়াছে। পুরুষ ও নারীর সম্পর্ক পতি-পত্নীরূপে বা প্রেমিক-প্রেমিকারূপে যখন romantic অর্থাৎ রমন্যাস বা অনুরাগ-রঞ্জিত ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইল, দেহাশ্রয়ী সম্পর্ক যখন আতিদৈহিক পর্যায়ে sublimated বা উন্নীত হইল, বিশ্বস্রষ্টা ও বিশ্বনিয়ন্তা এবং বিশ্বাতিগ সচ্চিদানন্দস্বরূপ পরাৎপরের সহিত এই প্রকারের অনুরাগ-রঞ্জিত নিবিড়তম সংযোগকে তখন মানুষ অন্যতম চরম আকাঙ্ক্ষিত বস্তু বা পরমার্থ বলিয়া চিন্তা করিতে শিখিল। মানবসমাজে একদিকে যেমন শাশ্বত সত্যের সম্বন্ধে সচেতনতা দেখা দিতেছিল, এবং সেই সচেতনতাকে অবলম্বন করিয়া সত্যের বা পরমার্থের উপলব্ধি বা অনুভূতির আকাঙ্ক্ষা ধর্মসাধনারূপে প্রকট হইতেছিল, তেমনি অন্যদিকে নর-নারীর মধ্যে প্রেমের সম্পর্কও জীবনের অন্যতম প্রেয়ঃ এবং শ্রেয়ঃ বলিয়া পরিগণিত হইয়া শ্রেয়ের প্রতীক বা সাধনরূপে কবিদৃষ্টিযুক্ত মানব-মনের নিকট প্রতিভাত হইল। জ্ঞানের পথে ও কর্মের পথে যেমন শাশ্বত সত্তার উপলব্ধির চেষ্টা আরম্ভ হইল, তেমনি পরে এই অনুরাগের পথও আবিষ্কৃত হইল। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সৌন্দর্যবোধও জাগ্রত হইল। সমাজে সব বিষয়ে নেতা বা পরিচালক ছিল পুরুষ, এবং পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গীই সব বিষয়ে ছিল প্রবল—এমনকী মেয়েরাও অবস্থাগতিকে পড়িয়া পুরুষের চোখেই সমস্ত বিষয় দেখিতে অভ্যস্ত হয়। নারী সম্বন্ধে পুরুষের ধারণা যেমন-যেমন romantic বা অনুরাগের পর্যায়ে উঠিতে লাগিল, পুরুষও তেমনি-তেমনি কবিতায়, গানে, কাব্যে ও শিল্পে তাহার উচ্ছ্বসিত ও পরিপূর্ণ পরিচয় দিতে লাগিল। নারী তো নরসমাজে পরিবার ও গৃহের পত্তনের সঙ্গে সঙ্গে, গৃহধর্মের সহধর্মিণীরূপে প্রথম হইতেই ছিল। তাহার উপরে, নারী-প্রকৃতির সৌন্দর্য ও মাঙ্গল্য, শ্রী ও কল্যাণ আসিয়া ভাবুক পুরুষের কাছে নারীর মর্যাদা আরও উঁচুতে তুলিয়া ধরিল। বাস্তব ও কল্পনা, জৈব আকর্ষণ এবং মানসিক ও আধ্যাত্মিক জগতে তাহার উন্নয়ন—এই দুইয়ে মিলিয়া পুরুষের কল্পনার কেন্দ্র করিয়া তুলিল নারীকে। অপর, যে শাশ্বত বস্তুর সম্বন্ধে মানুষ এইভাবে সচেতন হইল—
নিত্য তোমায় চিত্ত ভরিয়া স্মরণ করি;
বিশ্ব-বিহীন বিজনে বসিয়া বরণ করি;
তুমি আছো মোর জীবন-মরণ হরণ করি—
মানবী আকৃতিতে তাহার যেন নানা রূপায়ণ মানবচিত্তে ঘটিল, নারী-মূর্তিও তাহার মধ্যে পুরুষ-আকৃতির প্রতিস্পর্ধী হইয়া দেখা দিল। নারী একাধারে প্রণয়িনী ও জননী; নারী আবার একদিকে নর্মসখী ও অন্যদিকে কল্যাণময়ী গৃহলক্ষ্মী। পুরুষের complementary বা পরিপূরক আবার নারী। সুপ্রাচীন যুগ হইতেই সব দেশের পুরুষ, সে যাহা আন্তরিকভাবে কামনা করে, তাহাকে নারী-প্রতীকেই পাইবার আকাঙ্ক্ষা করিয়াছে। The World’s Desire অর্থাৎ ‘বিশ্ববাসনা’ নিজ বিকশিত রূপ লাভ করিয়াছে নারী-মূর্তিতে; কবির এই উক্তি মানবসাধারণ—‘অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা’।
কিন্তু তাই বলিয়া সর্বত্রই যে নারী-প্রতীকে বিশ্বসত্তার বা শাশ্বত সত্যের আবাহন হইয়াছে, তাহা নহে। বিভিন্ন জনসমাজের সামাজিক পারিপার্শ্বিকের আধারে এ বিষয়ে সেই সমাজের চেতনাও গড়িয়া উঠিয়াছে। Patriarchal অর্থাৎ পিতৃনিষ্ঠ সমাজে মাতার স্থান পিতার পরে; আবার তেমনি Matriarchal অর্থাৎ মাতৃনিষ্ঠ সমাজে পিতার স্থান নগণ্য, মাতা-ই সেখানে রানী, মাতাই পরমা দেবী। পৃথিবী বা ধরণী বা ধরিত্রী—সকলকে ধরিয়া আছেন, ক্রোড়ে করিয়া আছেন এই প্রশস্ত ভূমিময় জগৎ—প্রায় সর্বত্র মাতারূপে কল্পিত—আমাদের ‘পৃথিবী মাতা’, ‘ধরতী মা’। এই মনোভাবও আদিম মানবের মনোভাব। পিতৃনিষ্ঠ ও মাতৃনিষ্ঠ উভয় পারিপার্শ্বিকের মিলনের ফলে আর্যদের ‘দ্যৌষ-পিতা’ ও ‘পৃথ্বী মাতা’ উভয়ের মিলিত কল্পনা গড়িয়া উঠে। এবং প্রাগ-আর্য যুগের পশ্চিম এশিয়া খন্ডের আর্যেতর জাতিসমূহের মধ্যে শিব-উমা বা শিব-শক্তির দর্শনমূলক প্রতিষ্ঠা ঘটে। অন্যান্য নানা জাতির মধ্যেও এইরূপ নর-নারী বা পিতা-মাতার অথবা পুরুষ-প্রকৃতির যুগ্ম কল্পনা দেখা যায়। ভারতের আদিবাসী কোল-জাতির মধ্যে ‘সের্মা’ (Serma) বা আকাশ ও ‘অতে’ (Ote) বা পৃথিবী ‘আপা-এঙা’ (Apa Enga) বা পিতা-মাতারূপে কল্পিত। পোলিনেশীয় জাতির মধ্যে ‘পাপা-রাঙি’ বা পাপালাঙি অর্থাৎ পৃথিবী (Papa) ও স্বর্গ বা আকাশ (Langi, Rangi), চীনাদের মধ্যে Yang ‘য়াঙ’ বা পুরুষ ও Yin ‘য়িন’ বা প্রকৃতি, এইরূপে বিশ্ব-প্রপঞ্চের মূল কারণ বলিয়া বিবেচিত।
এইরূপে দেখা যায় যে, শাশ্বত সত্তার সহিত মানব অন্তরঙ্গভাবে নানা সম্বন্ধের কথা স্থির করিয়াছে—প্রভু, পিতা, মাতা, পুত্র, সখা, পতি, প্রণয়িনী প্রভৃতি। এইরূপ নানা প্রকারের সম্বন্ধ মানুষ যে করিয়া থাকে, মানুষ করিতে বাধ্য, তাহা প্রাচীন ভারতে অতি সহজভাবেই স্বীকার করা হইয়াছে। ঋগ্বেদের ‘একং সদ, বিপ্রা বহুধা বদন্তি’, উপনিষদের ‘ত্বমেব মাতা চ পিতা ত্বমেব’, এবং ‘ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি, ত্বং কুমার উত বা কুমারী। ত্বং জীর্ণো দন্ডেন, বঞ্চসি, ত্বং জাতো ভবসি বিশ্বতোমুখঃ।।’ প্রভৃতি বচনে, এবং গীতার ‘গতির্ভত্বা প্রভু: সাক্ষী নিবাসঃ শরণং সুহৃৎ। প্রভবঃ প্রলয়ঃ স্থানং নিধানম বীজম অব্যয়ম।।’ প্রভৃতি শ্লোকে, এই বিশ্বতোমুখ ভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। পরে বৈষ্ণব চিন্তায় শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর, এই কয় পর্য্যায়ে এই ব্যক্তিগত সংযোগ শ্রেণী-নিবদ্ধ হয়। সময় বা অবস্থা অনুসারে একই ব্যক্তি একাধিক সম্পর্কের ভাবনা করিতে পারে ও করিয়া থাকে।
আমাদের দেশে, বিশেষ করিয়া গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে, এই রসাত্মক বা অনুরাগময় মধুর সম্পর্ক সর্বাপেক্ষা অন্তরঙ্গ এবং সর্বোচ্চ কোটির বলিয়া স্বীকৃত। এই সম্পর্কে, মানব অথবা মানবাত্মা হইতেছে ‘শাশ্বত নারী, এবং পরম সত্য বা চরম সত্তা হইতেছেন ‘পুরুষ—পুরুষোত্তম’; গোপী ও শ্রীকৃষ্ণ, এই দুই প্রতীকে এই সম্পর্ক বৈষ্ণব দর্শনে ও অনুভূতিতে রূপ গ্রহণ করিয়াছে। এই মধুর রসের বা অনুরাগের সম্পর্কের সাধনায় চিরকাল ধরিয়া ভারতবর্ষ সর্বত্র সব শ্রেণির সাধক, যাঁহারা শুষ্ক জ্ঞান ও বিচারের পথের বাহিরে প্রধানতঃ রসানুভূতির পথ গ্রহণ করিয়াছেন, ‘মানবাত্মা নারী-প্রকৃতি ও পরমাত্মা পুরষোত্তম, এই ভাবেরই ভাবুক হইয়াছেন। অবশ্য, একাত্মবোধের অবস্থায় নারী বা পুরুষ কাহারও এই বিভেদ-বুদ্ধি থাকে না—বৈষ্ণব সাধক পদকার যেমন বলিয়াছেন, ‘না সো রমণ, না হম রমণী’—কিন্তু সাধারণ ধারণায় এই ভাবের সিদ্ধান্ত বা আরোপ প্রচলিত। অবশ্য এই সাধারণ ধারণা বা বোধের ব্যত্যয়ও ভারতের আধ্যাত্মিক অনুভূতির ইতিহাসে আছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে পরমাত্মার সহিত জীবাত্মার মিলন বা সংযোগকে, অথবা জীবাত্মা কতৃক নিজের মধ্যে পরমাত্মার উপলব্ধি বা অনুভূতিকে, ‘প্রিয়া স্ত্রী’-র সঙ্গে পুরুষের মিলনের সহিত উপমিত করা হইয়াছে (বৃহদারণ্যক—৪/৩/২১)—‘তদ্বাস্যৈতদ-তিচ্ছন্দা অপহত-পাপ্নাভয়ং রূপং—তদ্যথা প্রিয়য়া স্ত্রিয়া সম্পরিষ্বক্তো ন বাহ্যং কিঞ্চন বেদ, নান্তরম, এবায়ম পুরুষঃ প্রাজ্ঞেনাত্মনা সম্পরিষ্বক্তো ন বাহাং কিঞ্চন বেদ, নান্তরং—তদ্বাস্যৈ-তদাপ্তকামমাত্মকামমকামং রূপং শোকান্তরম।’ ঋগ্বেদেও (১০/৭১/৪), কবি বা ঋষির কাছে বাগদেবীর আত্মপ্রকাশকেও অনুরূপ প্রতীকে দেখানো হইয়াছে—
উত ত্বঃ পশ্যন ন দদর্শ বাচম
উত ত্বঃ শৃন্বন শৃণোতি এনাম
উতো তুঅস্মৈ তনুঅং বিসস্রে—
জায়েব পত্য উশতী সুবাসা:।।
এবং উপনিষদে পাইতেছি—
যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্যস্তস্যৈষ আত্মা বি বৃণুতে তনুং স্বাম।।
সমগ্র ভারতীয় সাহিত্যে মধুর রসের সাধনায় পরমাত্মা বা শাশ্বত সত্তা হইতেছে পুরুষ, এবং মানব বা মানবাত্মা হইতেছে নারী। ইহার বিপরীত ভাব পাওয়া যায় না—উপরের অনুচ্ছেদে উদধৃত বৈদিক সাহিত্যের কতকগুলি উদাহরণ ভিন্ন। এমনকী মুসলমান সূফী প্রভাবে প্রভাবান্বিত, ও স্পষ্ট করিয়া নিজেদের ‘সূফী’ আখ্যা যাঁহারা দিয়াছেন এমন মুসলমান ও হিন্দু কবিগণ, এই ভারতীয় কল্পনাই রক্ষা করিয়াছেন—ঈশ্বর পুরুষোত্তম, মানব যেন ঈশ্বরের প্রেমাকাঙ্ক্ষিণী নারী। ইরান ও আরবের সূফী মতে কিন্তু ইহার বিপরীতটিই দৃষ্ট হয়। এ প্রসঙ্গে পরে আলোচনা করা হইতেছে। ভারতে সূফী-আধ্যাত্মিক ধারণা ও প্রকাশ-ধারা যাঁহারা পুরাপুরি মানিয়া লইয়াছেন, এবং প্রত্যক্ষভাবে ফারসী সাহিত্যের আওতায় যাঁহারা পড়িয়াছেন, এমন কতকগুলি উর্দু ভাষার কবি অবশ্য এই সনাতন বা ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেন নাই—ঈশ্বর তাঁহাদের কাছে ‘মাশূক্কা’ অর্থাৎ প্রেমের পাত্রী অথবা প্রেমের পাত্র, এবং মানব বা জীব হইতেছে ‘আশিক্ক’ অর্থাৎ প্রেমিক।
রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন-দেবতা’ বিষয়ক কবিতাগুলিতে কিন্তু ভারতীয় ধারার বিরোধী অন্য ভাবটিই পাইতেছি। এই ‘জীবন-দেবতা’ কে? এ বিষয়ে মতভেদ আছে। রবীন্দ্রনাথের কাব্য-চিন্তা বা ভাবধারার বিচার-বিশ্লেষণ যাঁহারা করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে কেহ-কেহ এই জীবন-দেবতা যে শাশ্বত সত্তা, পরমাত্মা বা ‘ঈশ্বর’ নহে, এইরূপ অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন। আমার মনে হয়, প্রচলিত বিভিন্ন মতবাদের গন্ডির মধ্যে সীমিত (সগুণ ব্রহ্ম, নির্গুণ ব্রহ্ম, সাকার দেবতা প্রভৃতি) ঈশ্বরীয় সত্তার বিভিন্ন বর্ণনা অথবা দার্শনিক প্রকৃতি নির্ণয়ের সঙ্গে, রবীন্দ্রনাথের অনুভূত ও ‘জীবন-দেবতা’ নামে অভিহিত এবং কবিতায় তাঁহার দ্বারা প্রকাশিত সত্য-শিব-সুন্দর-স্বরূপ (এবং কবি-দৃষ্টির সামনে বিশেষ করিয়া সুন্দর-স্বরূপ) বিশ্বনিহিত ও বিশ্বাতিগ শাশ্বত সত্তার সম্পূর্ণ মিল না পাইয়া, এই ‘জীবন-দেবতা’-কে ঐশ্বরিক সত্তা হইতে পৃথক বস্তু বলিয়া অনেকে ধরিয়া লইয়াছেন; এবং সেই বস্তুটি যে কী, তাহার নির্ণয়ের জন্য শব্দের মালা গাঁথিয়াছেন। যাহা হউক, এ সম্বন্ধে পূর্ণ আলোচনা করিবার যোগ্যতা আমার নাই। তবে আমার মনে হয়, যে বিশ্বশক্তি বা বিশ্বদেবতা ব্রহ্মান্ডময় লীলা করিতেছেন, মানব-জীবন সেই দেবতার অধিকারের বাহিরে নহে—‘খেলতি অন্ডে, খেলতি পিন্ডে’—সেই দেবতা বা সত্তা বা শক্তি বিশ্বব্রহ্মান্ডে ক্রীড়া করিতেছেন, আবার মানুষের দেহপিন্ডের অভ্যন্তরে তাঁহারই লীলা চলিতেছে; Macrocosm ও Microcosm, বৃহৎ বা ভূমা, এবং অণু বা কণা, উভয়ই তাঁহার লীলাক্ষেত্র, এবং সেই লীলার প্রকাশ বা ভঙ্গীও অনন্ত। রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধি, বিশ্বমানবের অনুভূতির রাজ্যে একান্তভাবে তাঁহার নিজের দান—তাঁহার কাব্যময় কৃতির মাধ্যমে ইহা প্রকাশিত হইয়াছে। এখানে এই বস্তুটি একটি পরিপূর্ণ সৌন্দর্যমন্ডিত হইয়া বিদ্যমান; এবং চিরকাল ধরিয়া ইহা রসের অফুরন্ত উৎস হইয়া থাকিবে। বাঙলা ভাষা লোপ পাইলে বা ইহার আমূল পরিবর্তন ঘটিলে, এই বস্তুর প্রকাশ-সৌন্দর্য সাধারণ ভবিষ্যদ-বংশীয়ের কাছে হয়তো ঢাকা পড়িয়া যাইবে; কিন্তু অনুবাদের মাধ্যমে তাহার রসবৈচিত্র্য বা রসবৈশিষ্ট্য একেবারে লুপ্ত হইবে না।
অনুরাগ-রঞ্জিত এই দৃষ্টি বা অনুভূতি, বিশ্বের প্রেয়সী, এবং ব্যক্তিগতভাবে কবির প্রেয়সী এই যে সৌন্দর্যময় নারী-মূর্তিতে প্রকটিত শাশ্বত সত্য, কবির কাছে আসিল কী করিয়া? এ সম্বন্ধে কার্য-কারণাত্মক বা ক্রম-বিচারমূলক অনুসন্ধান চলিতে পারে; তাহাতে এই অপূর্ব রসসৃষ্টির সৌন্দর্য বা গৌরব ক্ষুণ্ণ হয় না, বরং ইহাকে সম্যকরূপে বুঝিবার পক্ষে সহায়তা লাভ ঘটিতে পারে। Beauty in the Abstract, ভাবময় সৌন্দর্য, যাহা শাশ্বত সত্তারই রূপান্তর, তাহার সম্বন্ধে সূক্ত রচনা করিয়াছেন কবি তাঁহার ‘উর্বশী’ কবিতায়। এই নামের দ্বারায়, কবির অনুভূতি ও অনুভূতি-জাত রসসৃষ্টির অন্যতম আধার বা প্রেরণাকে আমরা গোচরীভূত করিতে পারি। ‘উর্বশী’-র প্রথম প্রকাশ বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে—ঋগ্বেদের কবিতাময় পুরূরবা-উর্বশী সূক্তে, শতপথ ব্রাহ্মণের গদ্য উপাখ্যানে। পরবর্তীকালে বিষ্ণুপুরাণেও উর্বশীর কথা পাই। প্রাচীন আর্য জগতের আখ্যানটির মৌলিক সরলতা ও মনোহারিতা বিষ্ণুপুরাণে কথিত গদ্যময় উপাখ্যান হইতে একেবারে বিলুপ্ত হয় নাই। অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন কালে কালিদাসের নাটকে, তথা অন্য পুরাণে, এই উপাখ্যান বহুসঃ পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হইয়া নিতান্ত অন্য ধরনের হইয়া গিয়াছে। সে যাহা হউক, রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন-দেবতা’ পর্যায়ের কাব্য-সর্জনার মধ্যে, বৈদিক উর্বশীর কল্পনা একটি মূলসূত্ররূপে বিদ্যমান।
‘উর্বশী’ কবিতার দ্বিতীয় অনুপ্রাণনা হইতেছে ইউরোপীয় সাহিত্য হইতে—প্রাচীন গ্রীক প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী Aphrodite আফ্রোদীতে-র কল্পনা হইতে; প্রাচীন গ্রীক সাহিত্য, ও তাহার আদর্শে গঠিত আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের মধ্যে যে সৌন্দর্যানুভূতি আছে, তাহাও ইহার দ্বিতীয় অনুপ্রাণনা। তৃতীয় অনুপ্রাণনা আমার মনে হয় কবি পাইয়াছিলেন পরোক্ষভাবে—সূফী কবিতা হইতে। ঈশ্বরের বিভূতিস্বরূপ কবির নিজের দিব্য প্রতিভা, অবশ্য এই কবিতা-সর্জনার মূল উৎস। কিন্তু যে রঙ্গীন আলোক এই উৎস-ধারার উপর পড়িয়া তাহাকে এমন বিচিত্র বর্ণোজ্জ্বল করিয়াছে, অন্ততঃ তাহা অংশতঃ এই তিন বিভিন্ন দিক হইতে আসিয়াছে।
উর্বশীর কল্পনার ও উপাখ্যানের মূল কথা—দেবকন্যার সহিত মানবের প্রেম। এইরূপ উপাখ্যান বা কল্পনা নানা জাতির মধ্যে আছে; কিন্তু মনে হয়, কল্পনাশীল ইন্দো-ইউরোপীয় (আদি-আর্য) জাতির মধ্যে ইহার পূর্ণ বিকাশ হইয়াছিল। আদি-আর্য (বা ইন্দো-ইউরোপীয়) জাতির বিভিন্ন শাখার মধ্যে এইরূপ এক বা একাধিক myth বা দেব-কাহিনী প্রচলিত ছিল। প্রাচীন ভারতীয় আর্য, প্রাচীন ইরানীয়, প্রাচীন গ্রীক, ইতালীয়, কেলতিক, জরমানিক ও স্লাব, ইন্দো-ইউরোপীয় জাতির সকল শাখার মধ্যেই এই ধরনের উপাখ্যান বা কথা পাওয়া যায়। অপ্সরা বা দিব্য-সৌন্দর্যমন্ডিত সুন্দরীকে দেখিয়া মানুষ প্রেমে পড়িল। অমানুষী নিজেকে মানুষের কাছে ধরা দিল; পরে পার্থিব জীবনে বিগতরুচি হইয়া দেবকন্যা বা সুন্দরীর তিরোধান; এবং শেষে ইহলোকেই অথবা পরলোকে মানুষ ও অমানুষী প্রেমিক-যুগলের মিলন ও মানুষের দেবত্ব-লাভ। এইরূপ উপাখ্যানে কতকগুলি খুঁটিনাটি আছে, সেগুলি আদি-আর্যজাতির মধ্যে উদ্ভূত এই myth বা দেব-কাহিনীর মূলরূপে বিদ্যমান ছিল। যেমন ‘আতি’ বা swan অর্থাৎ রাজহংসরূপে অমানুষী অপ্সরাগণের বিচরণ। ঋগ্বেদের দশম মন্ডলে, অপ্সরা উর্বশী ও তাঁহার মানুষপ্রেমিক ও পতি রাজা পুরুরবার কথোপকথনাত্মক আঠারো ঋকের একটি সূক্ত আছে (ঋগ্বেদ, ১০/৯৫); শতপথব্রাহ্মণে সংক্ষেপে বর্ণিত গদ্য উপাখ্যান হইতে এই কথোপকথনের সূত্র ঠিকমতো ধরা যায়।
অপ্সরা ও গন্ধর্ব বৈদিক দেব-জগতে Romance of the Supernatural অর্থাৎ অতিপ্রাকৃতের রমণীয়তার প্রতীক ও প্রকাশক। ঋগ্বেদের দেবতারা পুরাপুরি মানবধর্মী নহেন, তাঁহাদের প্রকৃতিতে নৈসর্গিক জগতের ছাপ বা ছোঁয়াচ বিদ্যামান—যদিও ইন্দ্র, ঊষা, সূর্য অশ্বিদ্বয়, রুদ্র প্রভৃতি কতকগুলি দেবতার মধ্যে মানবধর্মিতা যথেষ্ট পরিমাণে আসিয়া গিয়াছে। কিন্তু গন্ধর্ব ও তাহাদের সহিত সম্পৃক্ত অপ্সরাগণ—ইহাদের সম্বন্ধে যে কল্পনা, তাহা অন্য জিনিস। পৌরাণিক স্বর্গের মহামহিম সম্রাট, অমাত্য ও চাটুকার-পরিবেষ্টিত রাজা ইন্দ্রের সভার নাচুনীরূপে অপ্সরাদের অবনমন তখনও হয় নাই। অপ্সরাগণ জল, স্থল, অরণ্য ও আকাশমার্গে বিচরণশীল স্বাধীন দেবযোনি, গন্ধর্বগণ অপ্সরাদের সহচর, পতি। স্বেচ্ছাবৃত্ত চিরযৌবনা অপ্সরাগণ, গ্রীক দেবলোকের Naiad, Dryad, Nereid-দের কথা স্মরণ করাইয়া দেয়। ঋগ্বেদের দশম মন্ডলের কেশি-সূক্তে (১০/১৩৬) দেখিতেছি, দীর্ঘ কেশধারী মলিন কাষায়-বস্ত্র-পরিধানকারী শৈব যোগী, যিনি রুদ্রের সঙ্গে এক পাত্রে বিষ পান করেন (‘কেশী বিষস্য পাত্রেণ যদ রুদ্রেণাপিবৎ সহ’), তিনি নানা অলৌকিক শক্তির অধিকারী হন—সিদ্ধিলাভ করেন; তন্মধ্যে একটি কাম্য সিদ্ধি হইতেছে এই যে, তিনি অপ্সরা ও গন্ধর্ব এবং বন্য পশুর বিচরণভূমিতে ইচ্ছামতো চলিয়া-ফিরিয়া বেড়ান (‘অপ্সরস্যাং, গন্ধর্বাণাং, মৃগাণাং চরণে চরন।’)।
এইরূপ এক অপ্সরা, উর্বশী ছিল যাঁহার নাম, তিনি ইলাপুত্র রাজা পুরূরবাকে কামনা করিলেন, রাজা পুরূরবার পত্নীত্ব স্বীকার করিলেন। উর্বশীকে রাজা পত্নীরূপে পাইলেন, কিন্তু ইহার জন্য তাঁহার পক্ষে পালনীয় কতকগুলি তুচ্ছ প্রতিবন্ধ বা সময় বা শর্ত ছিল। উর্বশীকে আবার তাহাদের মধ্যে ফিরাইয়া পাইতে উৎসুক গন্ধর্বদের চেষ্টায় সেই প্রতিবন্ধ পুরূরবা অনিচ্ছায় ভাঙিয়া ফেলিলেন, সঙ্গে সঙ্গে উর্বশীও অন্তর্হিতা হইলেন। এদিকে রাজপত্নী উর্বশীর সন্তান-সম্ভাবনা। পুরূরবা প্রিয়াবিরহে তাঁহাকে খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। শেষে কতকগুলি অপ্সরা সহচরীর সহিত কুরুক্ষেত্রের হ্রদে আতি বা রাজহংসের রূপে তাঁহাকে জলক্রীড়া করিতে দেখিলেন। উর্বশী পুরূরবার সহিত আলাপ করিলেন। উভয়ে পূর্বের দাম্পত্য জীবনের কথার অনুস্মরণ করিলেন। এবং ভবিষ্যতে পুরূরবার সঙ্গে উর্বশীর আবার মিলন হইবে স্বর্গলোকে, বা গন্ধর্বলোকে এই কথার ইঙ্গিত করিয়া উর্বশী তিরোধান করিলেন।
এই তো উপাখ্যান। কিন্তু ঋগ্বেদের সূক্তসমূহে কতকগুলি বাক্য আছে, যেগুলিতে উর্বশীকে সামান্য একটি রূপকথার নায়িকার পদ হইতে মানুষের কামনার কেন্দ্রীভূত এক বিশ্বাবেশিনী নারীরূপী সত্তা বা শক্তিতে পরিণত করিতেছে। এই সত্তাকে মানুষ পাইয়াও পাইতেছে না—অমানুষী এই শক্তিকে মানুষ সেবা করিয়াছে, লাভ করিযাছে (‘পুরূরবো অনু তে কেতমায়ং; রাজা মে, বীর! তনুঅস তদাসী:’; ‘অমানুষীষু মানুষো নি সেবে’); কিন্তু এই শক্তি বা সত্তা এখন প্রথম ঊষার ন্যায় চিরতরে অন্তর্হিত, বায়ুর ন্যায় দূরপনেয় (‘প্রাক্রমিষম ঊষসাম অগ্রিয়েব… দূরাপনা বাত ইবাহমস্মি’)। কিন্তু তবুও আশা মনের কোণে জাগিয়া থাকে;—উর্বশী একবার দেখা দিয়া চলিয়া যাইতেছেন, পুরূরবার আকুল কামনা—
অন্তরীক্ষপ্রাং রজসো বিমানীমউপ শিক্ষামি উর্বশীং বসিষ্ঠঃ।
উপ ত্বা রাতি: সুকৃতস্য তিষ্ঠাৎ;নি বর্তস্ব—হৃদয়ং তপ্যতে মে।।—
অত্যন্ত কামনাযুক্ত হইয়া আমি উর্বশীকে আহ্বান করি—যে উর্বশী অন্তরীক্ষকে পূর্ণ করিয়া রাখে, ও আকাশ-মার্গকে পরিমাণ করে। আমার সমস্ত সুকৃতের বা পুণ্যকর্মের ফল তোমাতেই পহুঁছাক; ফিরিয়া আইস, আমার হৃদয় তপ্ত হইতেছে।
এই পুরূরবা-উর্বশীর ঋকগুলির মধ্যে, বিশেষ করিয়া উপরে উদ্ধৃত ঋকটিতে, রবীন্দ্রনাথের উর্বশীর মহীয়সী কল্পনার কতকগুলি বীজ যেন বিদ্যমান। উর্বশী নামটির মৌলিক অর্থ সম্ভবতঃ ইহাই ছিল—‘উরু’ অর্থাৎ প্রচুর বা ‘পূর্ণ’ ‘বশ’ অর্থাৎ কামনা যাহার বা যাহার জন্য (উরু + বশ + -ঈ)। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় ইহার প্রতিরূপ হইবে *Euru-wekia—*Eurekia। এই হিসাবে, ‘*উরু-বশী—উর-বশী, ‘উর্বশী’ শব্দের অর্থ হইতে পারে the World’s Desire,—রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘বিশ্ববাসনা’।
ঋগ্বেদের দশম মন্ডলের উর্বশী-পুরূরবা-সংবাদময় পঁচানব্বইয়ের সূক্তের উদ্ধৃত এই সতেরোর উপান্ত ঋকটিতে, অমানুষীর সহিত মানুষের প্রেমের কাহিনী বা রূপকথাটি সাধারণ পার্থিব সত্তা বা জীবনের ঊর্ধ্বে একেবারে অতীন্দ্রিয় লোকে উন্নীত হইতেছে। এখানে, এমনকী মানুষের নৈতিক জীবনের সার্থকতা হইতেছে জীবনের পিছনে অবস্থিত শাশ্বত সত্তাতে তাহার সমস্ত কর্মচেষ্টা, সমস্ত শুভ কার্য, সব সুকৃতের সমর্পণের মধ্যেই—এরূপ ইঙ্গিতও রহিয়াছে।
রবীন্দ্রনাথের জীবন-দেবতার পরিকল্পনার মধ্যে, গ্রীক দেবী (Aphrodite) আফ্রোদীতে ও আফ্রোদীতেকে আশ্রয় করিয়া পরবর্তী ইউরোপীয় সাহিত্যে (বিশেষ করিয়া গ্যেটে হইতে আরম্ভ করিয়া আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যে) বিশ্বমধ্যে লীলায়িত সর্বসুন্দরী দৈবশক্তির যে আবাহন ও অনুধ্যান চলিয়াছে, তাহারও প্রভাব আছে। আফ্রোদীতে প্রেমের ও কামের দেবী; তিনি মানব-সম্পর্কের ঊর্ধ্বে অবস্থিত অনৈতিক আকর্ষণশক্তি; জগতের সমস্ত সৌন্দর্যের বিগ্রহস্বরূপা তিনি। ‘আফ্রোদীতে’ নামটির সংস্কৃত প্রতিরূপ ‘*অভ্রদত্তা’ হইতে পারে—‘অভ্র বা মেঘের দান’, এই অর্থে; এবং মূলে হয়তো ইনি অপ-সরার মতো জলমধ্যে বিচরণশীলা দেবী ছিলেন। Sophocles (সোফোক্লেস), Euripides (ইউরিপিদেস) প্রমুখ প্রাচীন গ্রিসের প্রধান কবিগণ, দেবী আফ্রোদীতে, এই নামের মধ্যে অবস্থিত Cosmic অর্থাৎ বিশ্বম্ভর ও বিশ্বন্ধর ভাব বা কল্পনার পরিবেশ করিয়া গিয়াছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ গ্রীক কবিদের দুই-একটি উক্তি ইংরেজি ও বাঙলা অনুবাদে উদ্ধৃত করিয়া দেওয়া যায়—
My children, of a surety Cypris is
Not Cypris only, but bears many a name;
Death is her name, and Might imperishable,
And maniac Frenzy, and unallayed Desire,
And Lamentation loud. All is in her;
Impulse, and Quietude, and Energy;
For in the bosoms of all souls that breathe
This Goddess is instilled. Who is not prey
For her? She penetrates the watery tribe
Of fishes; She is in the four-legged breed
Of the dry land; in birds her wings bears sway
In brutes, in mortals, in the Gods on high… without spear,
Without a sword, Cypris cuts shorts all counsels
Both human and divine.
(সোফোক্লেস হইতে, Sir George Young-এর অনুবাদ; Cypris = Kupris, Aphrodite আফ্রোদীতের অন্য নাম।)
বৎসগণ, নিশ্চয়ই কুপ্রিস দেবী (আফ্রোদীতে) কেবল কুপ্রিসই নহেন, কিন্তু তিনি বহুনামযুক্তা! তাঁহার নাম ‘মৃত্যু’, এবং অবিনশ্বর ‘শক্তি’ এবং ‘উন্মাদনা’, এবং অতৃপ্ত ‘কামনা’, এবং নিনাদিনী ‘ক্রন্দসী’; সবকিছু তাঁহাতেই বিদ্যমান; ‘আকাঙ্ক্ষা’ এবং ‘শান্তি’, এবং ‘কর্মদ্যোতনা’। শ্বাসযুক্ত প্রত্যেক জীবের বক্ষোমধ্যে দেবী আসীনা আছেন। এমন কে আছে যে তাঁহার শিকার নহে? জলচর মৎস্যকুলের মধ্যে তিনি চরণশীলা; শুষ্ক পৃথিবীর উপরে চতুষ্পদ কুলের মধ্যেও তিনি বিরাজমানা; পক্ষিকুলের মধ্যে তাঁহারই পক্ষ কার্যকর। পশু, মানব, স্বর্গবাসী দেবতা, সকলেই তিনি। বর্শা বা তরবারীর সাহায্য না লইয়া, কুপ্রিস দেবী মানব ও দৈব সর্বপ্রকার বিচার করিয়া দেন।
She ranges with the stars of eve of morn,
She wanders in the heaving of the sea,
And all life lives from her.—Aye, this is she
That sows Love’s seed and brings
Love’s fruit to birth;
And great Love’s brethren are all we on earth !
(ইউরিপিদেস হইতে, Dr. Gilbert Murray-র অনুবাদ।)
সন্ধ্যা ও ঊষার তারকার মধ্যে দেবী বিচরণ করেন, সাগরের হিল্লোলে তিনি দোলায়িতা হন; সমস্ত জীবন তাঁহা হইতে প্রাণ পায়। হাঁ, ইনিই তিনি, তিনি প্রেমের বীজ বপন করেন ও প্রেমের ফল উৎপাদন করেন। মহৎ প্রেমেরই ভ্রাতৃরূপী আমরা সকলে—এই ভূমির উপরে।
নারী সম্বন্ধে মানুষের প্রেম ও কাম বিষয়ক সাধনা ও আগ্রহের নিয়ন্ত্রীরূপে প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যে আফ্রোদীতের এইরূপ বহু উল্লেখ আছে। গ্রীক স্ত্রী-কবি Psappha (প্সাপফা) বা Sappho (সাপফো)-র কতকগুলি গীতিকবিতার ভগ্নাংশের কথা বিশেষ করিয়া স্মরণ করা যায়।
নূতন করিয়া এ যুগে প্রাচীন গ্রীক সাহিত্য ও ভাবধারার পুনরাবিষ্কারের পরে ও ইহার পুনরালোচনার ফলে, এই বিশ্বনিয়ন্ত্রী সৌন্দর্যময়ীর কল্পনা আধুনিক ইউরোপকে আবার নূতন দৃষ্টি, নূতন প্রেরণা দিয়াছে।
গ্যেটের জীবনব্যাপী জ্ঞান ও সাহিত্যকলার সাধনার ফল Faust ‘ফাউস্ট’ নামক মহাকাব্যরূপী নাটকের শেষ কথা—
Das Ewig-Weibliche
Zieht uns hinan—
—শাশ্বত নারীরূপিনী আমাদিগকে ঊর্ধ্বে আকর্ষণ করিতেছে।
ইংরেজ কবি A.C. Swinburne (সুইনব্যরন) গ্রীক ভাবের (বিশেষ করিয়া ইউরোপে খ্রিস্টানধর্ম প্রসার লাভ করিবার পূর্বে যে প্রাচীন গ্রীকধর্ম গ্রীসদেশে প্রচলিত ছিল তাহার চিন্তাধারার) পুনরানয়নের চেষ্টায়, আধুনিক ইংরেজি-সাহিত্যে গ্রীক দিব্যদৃষ্টি আনিয়া দিবার আকাঙ্ক্ষায়, যেসব কবিতা ও যে দুখানি অপূর্ব নাটক রচনা করেন, সেগুলির মধ্যেও এই বিশ্বনিয়ন্ত্রী রমণীয়তারও প্রশস্তি উদার ছন্দে ও উদাত্ত ভাষায় গাহিয়া গিয়াছেন। তাঁহার Hertha কবিতা, The Last Oracle প্রভৃতি কতকগুলি কবিতা; এবং বিশেষ করিয়া তাঁহার গ্রীক রীতিতে রচিত নাটক Atalanta in Calydon-এ, আফ্রোদীতে বন্দনাময় Chorus অর্থাৎ সমবেত-পাঠ—আধুনিক ইউরোপীয় ও বিশ্বসাহিত্যের কতকগুলি অপূর্ব বস্তু; সুইনব্যরনের এই অনবদ্য সৃষ্টির সাক্ষাৎ প্রভাব রবীন্দ্রনাথের ‘উর্বশী’-তে আসিয়াছে বলিয়া কেহ কেহ মনে করেন; এইরূপ মনে করা অযৌক্তিকও নহে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যময় প্রকাশে এবং বিশেষ করিয়া ‘জীবন-দেবতা’-র কল্পনায় ইউরোপীয় সাহিত্যের অনুপ্রেরণা বা প্রভাব কতটা ছিল, তাহার বিচার হওয়া উচিত। রবীন্দ্রনাথের মতো বিরাট প্রতিভা ও মনীষা ছিল সর্বগ্রাহী; সবকিছু হইতেই তিনি ভাব ও প্রকাশ আত্মসাৎ করিবার শক্তি রাখিতেন। কিন্তু এখানেই তাঁহার মহত্ত্ব যে, তিনি যাহা গ্রহণ করিয়াছেন তাহার উপর তাঁহার স্বকীয় প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের জ্যোতি পড়িয়া, তাহাকে একেবারে তাঁহার নিজের জিনিস করিয়া দিয়াছে : ‘In literature, a thing becomes his who says it best.’
রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন-দেবতা’-র কল্পনায় ও অনুভূতিতে আর একটি দিক হইতে কতকটা প্রভাব আসিয়া গিয়াছিল মনে করি—ইহা হইতেছে—সূফী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাত্মাকে মানবের বা মানবাত্মার প্রেমাস্পদরূপে কল্পনা। সূফী সম্প্রদায়ের উদ্ভব, ইতিহাস ও সিদ্ধান্তের কথার সম্যক আলোচনার স্থান ইহা নহে। তবে সংক্ষেপে বলা যায় যে, প্রাথমিক ইসলামের মধ্যে মানুষ ও ঈশ্বরের সম্পর্ক এইভাবে কল্পিত হয়,—ঈশ্বর প্রভু, মানুষ তাঁহার দাস। ইহাই হইতেছে ইসলামের বাহ্য রূপ। আভ্যন্তর অনুভূতিতে লোকোত্তর চরিত্রের মানুষ ঈশ্বরের সহিত সখিত্ব বা মিত্রতার কোঠাতেও পহুঁছিতে পারে, ইহাও প্রাথমিক ইসলামের সিদ্ধান্ত ছিল। প্রথম যুগের ইসলামী (আরব) সাধকেরা একান্তে এই দাস্য-ভাবের সাধনা করিতেন—তাঁহাদের এই বিবিক্ত সাধনার মধ্যে সূফী মতবাদের বীজ নিহিত ছিল। আদ্য ইসলামের ‘মীরাবাঈ’, আরব সিদ্ধা রাবিয়া (তিরোধানের সময়, খ্রিস্টাব্দ ৮০১) দাস্য-ভাবের পরিবর্তে ঈশ্বরপ্রেম আনিয়া সূফী মতবাদের ও উপলব্ধির মোড় ফিরাইয়া দিলেন—এই প্রেম ঠিক বৈষ্ণব মধুর রস বা অনুরাগ নহে, কিন্তু তাহার আভাসস্বরূপ। রাবিয়া-র একটি প্রার্থনার অনুবাদ—
O my Lord, the stars are shining, and the eyes of men are closed, and kings have shut there doors, and every lover is alone with his beloved, and here am I alone with Thee.
প্রভু আমার, উপরে তারকাসমূহ জ্বল-জ্বল করিতেছে; মানবচক্ষু নিমীলিত; রাজারাও প্রাসাদদ্বার রুদ্ধ করিয়াছেন; প্রত্যেক প্রেমিক তাহার প্রেমিকার সঙ্গে একান্তে অবস্থান করিতেছে; আর আমিও এখানে একা, কেবল তোমার সঙ্গে।
উত্তরকালে এই ধর্ম-সাধনার ধারায় আসিয়া মিলিত হইল গ্রীক নব্য-প্লাতোনীয় দর্শনের gnosis বা মারিফাৎ অর্থাৎ তত্ত্বজ্ঞান, এবং ভারতীয় অদ্বৈত বেদান্তের ‘শিবোইহম’ বা ‘অহম ব্রহ্ম অস্মি’। কিন্তু রাগাত্মক সাধনা ও অনুভূতিও চলিল। পরবর্তী যুগের ঋষি মনসুর অল-হল্লাজ (মৃত্যুকাল ৯২২ খ্রিস্টাব্দ) হইতে আরম্ভ করিয়া ধারাবাহিকরূপে সূফী সাধকদের পাইতেছি, যাঁহাদের চেতনায় ও কাব্যময় প্রকাশে রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন-দেবতা’র-ই (আংশিকভাবে অন্ততঃ) পূর্বাভাস দেখিতে পাওয়া যায়। ইঁহাদের মধ্যে বিশেষ করিয়া নাম করা যায় এই কয়জনের—হকীম আবুল মজদ মজদূদ সনাঈ—পারসিক (একাদশ শতক); ফরীদুদ্দীন অত্তার—পারসিক (খ্রিস্টাব্দ ১১২০—১২৩০); ওমর ইবনু-ল-ফরীদ—মিশরীয় আরব (১১৮১—১২৩৫); মুহয়িউ-দ-দীন ইবনু-ল-অরবী—হিস্পান-দেশীয় আরব (১১৬৫—১২৪০); এবং জলালুদ্দীন রূমী—পারসীক (১২০৭—১২৭৩); শেখ সাদী—পারসীক (১১৮৪—১২৯১); সদুদ্দীন মহমূদ শবিস্তরী—পারসিক (১২৫০—১৩২০?); মুহম্মদ শমসুদ্দীন হাফেজ—পারসিক (মৃত্যু ১৩৯০); ও নূরুদ্দীন আব্দুর-রহমান জামী (১৪১৪—১৪৯২)। ইঁহাদের সকলের অনুভূতির কাব্যময় প্রকাশে, ইঁহাদের ‘জীবন-দেবতা’ হইতেছেন প্রেমাস্পদ—প্রেমের পাত্রী বা পাত্র, প্রেমিক পুরুষ নহেন;—এই প্রেমাস্পদ বা প্রেমের পাত্র, ক্বচিৎ সুন্দরী তরুণী নারীরূপিণী, ক্বচিৎ (পশ্চিম এশিয়াখন্ডের অধিবাসীদের সামাজিক জীবনের রীতি অনুসারে) সুন্দর কিশোররূপী নারীরূপে কল্পিত ‘জীবন-দেবতা’ বা শাশ্বত সত্তাকে আরবী ভাষায় ‘মাশূক্কা’ ma-‘shūqah’ (মাশূক্কৎহুন mā‘shūqathun’) আখ্যা দেওয়া হয়, ও কিশোর-রূপী হইলে ‘মাশূক্ক’ ma‘shūq’ (মাশূক্কুন mā‘shūqun’); এবং প্রেমিক জীবাত্মা বা মানব হইতেছে ‘আশিক্ক’ ‘āshiq’ (আশিক্কুন ‘āshiqun’)। এই শব্দগুলি আরবী ‘শিক্ক’ ‘shq’ ধাতু হইতে গঠিত; এই ধাতুর অর্থ ‘প্রেম করা, ভালোবাসা’।
সূফীদের প্রত্যক্ষ প্রভাব ভারতবর্ষের মধ্যযুগে খ্রিস্টীয় পনেরো শতক হইতে আসিতে আরম্ভ করে। কবীর প্রভৃতি সন্তগণের অনুভূতিতে ও শিক্ষায়, ও নানা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উপরে—আমাদের গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় ধরিয়াও—এই প্রভাব পড়িয়াছিল বলিয়া অনুমিত হয়। কিন্তু ভারতের অনুভূতিতে শাশ্বত সত্তা বা পরমাত্মা বা ঈশ্বরের প্রতি আরোপিত পুরুষোত্তমের কল্পনার পরিবর্তে, শাশ্বতী অনুরাগ-পাত্রী নারী-সত্তমা বা নারী-শ্রেষ্ঠার কল্পনা গৃহীত হয় নাই;—পরবর্তীকালের ফারসী কবিতার অন্ধ অনুকারক উর্দু কবিগণ ভিন্ন, ভারতীয় সূফীগণ, কি হিন্দু কি মুসলমান, পুরুষোত্তমেরই আবাহন করিয়াছেন।
নিম্নে সূফী কবিদের দুই-চারিটি কবিতাংশ বাঙলা অনুবাদে দেওয়া যাইতেছে—
ঘোমটায় মুখ ঢাকিয়া এই জগতের হাটে, আসিয়াছ তুমি কে?
তোমার টানেই সমগ্র মানব-জাতি তোমার সঙ্গে চলিয়াছে!
তোমার সুন্দর তনুর একটি রশ্মি
আমাদের বিশ্ব-মানবকে উদ্ভাসিত করিয়াছে;
তোমার বোনা ফসল প্রত্যেক গাছকে ফলবান করিয়াছে।
—ফরীদুদ্দীনঅত্তার।
তাহার কেশগুচ্ছের রাত্রির মধ্যে পূর্ণচন্দ্র উদিত হইয়াছে;
কালো নরগিস ফুল লাল গোলাপকে শিশির-সিক্ত করিয়াছে।
—ইবনু-ল অরবী।
‘সে (মাশূক্কা) যদি মনের মধ্যে ঠাঁই পায়, কল্পনা-ও তাহাকে পীড়িত করে; তাহাকে কি চোখে দেখা যায়?’ —ইবনু-ল-অরবী।
‘সে প্রীতির দিব্যমূর্তি, তার কথা ভাবিলেই সে মূর্তি গলিয়া যায়—দৃষ্টিপথের পক্ষে সে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম।’ —ইবনু-ল-অরবী।
জ্যোতির আকাশ তাহার পায়ের তলায়;
দ্যুলোক স্বলোকের ঊর্ধ্বে তাহার মুকুট।
—ইবনু-ল-অরবী।
আমার রজনী তাহার মুখের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত,
আমার দিন তাহার কেশ-জালের আঁধারে ভরা।
—ইবনু-ল-অরবী।
প্রাণের মধ্যে কোন এক নব-বধূর আগমন হইয়াছে।তাহার মুখেও প্রতিচ্ছবিতে, সমগ্র জগৎ,নব-বিবাহিত বর-বধূর হস্তের মতো হিল্লোলময় ও রাগ-রঞ্জিত হউক।
—জলালুদ্দীন রূমী।
আমি তোমার বীণা, আমার প্রত্যেক তারে তুমি আঘাত করিতেছ,
আমি তাহাতে রণরণিয়া উঠিতেছি!
—জলালুদ্দীন রূমী।
সূফী কবিদের রচনা হইতে এইরূপ বহু বহু ছত্র উদ্ধার করিয়া দেওয়া যায়, যেগুলি শ্রবণমাত্রেই রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন-দেবতা’ কবিতার কথা মনে পড়িয়া যায়। প্রত্যক্ষভাবে এইসব লেখার সহিত রবীন্দ্রনাথের পরিচয়ের সংবাদ আমরা জানি না। তবে তাঁহার পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, সূফী কবি হাফেজের ভক্ত ছিলেন, হাফেজের পদ ও পদাংশ তিনি আবৃত্তি করিতে ভালোবাসিতেন। হাফেজ প্রমুখ সূফী কবির এই মাশূক্কা-কল্পনার সহিত তাঁহার পিতার প্রসাদে রবীন্দ্রনাথ কিছু পরিমাণে হয়তো প্রথম পরিচিত হইয়া থাকিবেন। এইভাবে তাঁহার নিজের অনুভূতির অভিব্যক্তিতে সূফী ভাব-জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দান, এই World’s Sweetheart-এর অনুধ্যান, কিছুটা কার্যকর হইয়া থাকিবে। যেমন পরোক্ষভাবে আমাদের বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে জলালুদ্দীন রূমী প্রমুখ পারস্যের সূফী সাধকদের ভাবধারা কিছুটা অন্ততঃ আসিয়া গিয়াছিল, এরূপ অনুমানের পক্ষে সঙ্গত বা যুক্তিযুক্ত কারণ আছে বলিয়া মনে করি। গৌড়ীয় বৈষ্ণব দার্শনিক ধারা এবং কাব্যময় প্রকাশ, উভয় ব্যাপারের কর্ণধারস্বরূপ শ্রীরূপ ও শ্রীসনাতন দুইজনেই যে ফারসী ভাষাতেও পন্ডিত ছিলেন, তাহা সকলেই জানেন। তাঁহারা গৌড়ের স্বাধীন সুলতানের দরবারে কাজ করিতেন—একজন ছিলেন সুলতানের ‘দবীর-খাস’ বা খাস-মুনশী, অর্থাৎ Private Secretary বা অন্তরঙ্গ সহকারী, আর অন্যজন ছিলেন ‘সাগির মলিক’ অর্থাৎ ছোটো রাজা বা প্রতিরাজ, অর্থাৎ রাজপ্রতিভূ-পদাধিষ্ঠিত উচ্চ অমাত্য। রাজভাষা ফারসী এবং তৎসহ ফারসী সাহিত্য ইহাদের ভালো করিয়াই জানা ছিল।
এক-একটি পূর্ণ বস্তুকে বিশ্লেষ করিলে, তন্মধ্যে নানা উপাদান পাওয়া যাইবে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যময় প্রকাশ সম্বন্ধেও সেই কথা। কিন্তু পারিপার্শ্বিকের প্রভাবে, নানা স্থান হইতে লব্ধ বিভিন্ন উপাদানকে লইয়া, রবীন্দ্রনাথ যে পরিপূর্ণ নব-কলেবর দান করিয়া গিয়াছেন, তাহা একটি অভিনব ও বিস্ময়কর সর্বজনমনোহর রস-সৃষ্টি; এবং বিশ্বমানব সহৃদয়তার সহিত চিরকাল ধরিয়া এই রস আস্বাদন করিয়া ধন্য হইবে—অতীন্দ্রিয় শাশ্বত সত্তাকে আমাদের জীবনে ধরিবার মনোগত আকুতিকে জাগরিত ও উন্নীত করিবার পথে, এই রস-সৃষ্টি আমাদের চিরকাল ধরিয়া শক্তি ও আনন্দ দান করিবে।
এই প্রবন্ধ প্রথম প্রকাশিত হয় বাঙলা ১৩৫৬ সালের শারদীয়া বসুমতী-তে। পরে,
সংশোধিত ও কিঞ্চিৎ পরিবর্ধিত রূপে, ১৩৮৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত লেখকের
প্রবন্ধ-সংকলন সাংস্কৃতিকী প্রথম খন্ডে পুনর্মুদ্রিত হয়।