রবীন্দ্রনাথের আত্মত্যাগ

রবীন্দ্রনাথের আত্মত্যাগ

কেউ দেশের জন্য প্রাণ দেয়, কেউবা দয়িতের জন্য, কেউ বংশের সম্মানরক্ষার্ধে আত্মোৎসর্গ করে। যারা প্রাণ দিয়ে শহীদ হন তাদের অনেকেই তখন সুদ্ধমাত্র কর্তব্যবোধ থেকে, বিবেকের অলজ আদেশ পালন করার জন্যই নিজের জীবন বিসর্জন দেন। আবার কেউ কেউ তাবেন, কর্তব্যকর্ম না করলে তারা মুক্তি-মোক্ষ-নির্বাণ থেকে বঞ্চিত হবেন।

এদেশে সাধারণজনের ধারণা, মুক্তি বা মোক্ষের অর্থ নাসিকার্যে মনোনিবেশ করে কঠোর-কঠিন সাধন। অথচ আমাদের দেশে সর্ব দার্শনিক সর্ব ঋষি একবাক্যে বলেছেন মানুষের চরম কাম বা মোক্ষ বলতে বোঝায় পরিপূর্ণ, নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ যে আনন্দের সঙ্গে পার্থিব কোনও সুখেরই তুলনা হয় না। মুসলমান সাধকরা ওই কথাই বলেছেন, এবং ইহুদি মহাপুরুষ তো স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, As the bridegroom rejoiceth over the bride, so shall the Lord rejoice over thee এবং এইটিই খ্রিস্টানদের মূলমন্ত্র।

কয়েক মাস পূর্বে আমি মৃত্যু–হয়তো শোক বললে ভালো হতো নাম দিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখি এবং রবীন্দ্রনাথের জীবনে মৃত্যুদূত বার বার এসে তাকে যে কী গভীর বেদনা দিয়েছে তার বিবরণ দিই। আরও বহু, বহু বেদনা তিনি পেয়েছেন, যার স্মরণে আপন জন্মদিন উপলক্ষে পিছন পানে তাকিয়ে বলছেন–

পায়ে বিঁধেছে কাঁটা
ক্ষতবক্ষে পড়েছে রক্তধারা।
 নির্মম কঠোরতা মেরেছে ঢেউ
আমার নৌকার ডাইনে বাঁয়ে,
 জীবনের পণ্য চেয়েছে ডুবিয়ে দিতে
নিন্দায় তলায়, পঙ্কের মধ্যে।(১)

 এসব কিছু তিনি সয়ে নিয়েছিলেন তার অসাধারণ চরিত্রবল দিয়ে।

কিন্তু সবচেয়ে বেদনা পেয়েছেন, যখন তার আত্মজন পেয়েছে আঘাত। যেখানে তাকে শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়েছে, বেদনা-বেদনায় সে আত্মজনের ধূলিতলে অবলুণ্ঠন। সান্ত্বনা দেবার মতো ভাষাও খুঁজে পাননি তখন। নিজের বেলা তিনি অন্তরের দিকে তাকিয়ে নিরাশ হননি, কিন্তু আত্মজনের বেলা?

বলা হয়, পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন শোক পায় মা, যখন সে পুত্রহারা হয়। এবং সে মা-ও যদি দুঃখিনী হয়, এবং ওই পুত্ৰই যদি একমাত্র পুত্র হয়। এবং তার চেয়ে নির্মম আঘাত পান যদি সে মাতার আপন পিতা জীবিত থাকেন তবে তিনি। রবীন্দ্রনাথের বেলা তাই হয়েছিল। দুর্ভাগিনীকে মনক্ষুর সামনে রেখে বলছেন–

তোমার সম্মুখে এসে, দূর্ভাগিনী, দাঁড়াই যখন
নত হয় মন।
যেন ভয় লাগে
 প্রণয়ের আরম্ভেতে স্তব্ধতার আগে।
এ কী দুঃখভার,
 কী বিপুল বিষাদের স্তঙ্কিত নীরন্ধ্র অন্ধকার
ব্যাপ্ত করে আছে তব সমস্ত জগৎ
তব ভূত ভবিষ্যৎ।
 প্রকাণ্ড এ নিষ্কলতা
অভ্রভেদী ব্যথা
 দাবদগ্ধ পর্বতের মতো
খররৌদ্রে রয়েছে উন্নত
লয়ে নগ্ন কালো শিলাস্তূপ
ভীষণ বিরূপ।

 কী হৃদয়ভেদী তুলনা! যেন আগ্নেয়গিরি থেকে বেরিয়ে এসেছে লাভা হয়ে মাতার বাসল্যরস! তার পর সে মায়ের আকুলিবিকুলি

সব সন্ত্রনার শেষে সব পথ একেবারে
মিলেছে শূন্যের অন্ধকারে;
ফিরিছ বিশ্রামহারা ঘুরে ঘুরে,
 খুঁজিছ কাছের বিশ্ব মুহূর্তে যা চলে গেল দূরে
খুঁজিছ বুকের ধন সে আর তো নেই
বুকের পাথর হল মুহূর্তেই।

 এর চেয়ে নিদারুণতর বর্ণনা আর মানুষ কী দিতে পারে মায়ের পুত্রশোকের? আমার লেখাপড়া সীমাবদ্ধ। পাঠক, তুমি যদি পেয়ে থাকে, তবে সেটি আমায় পাঠিও। না, ভুল বললুম, পাঠিও না! পড়ে দরকার নেই।

চিরচেনা ছিল চোখে চোখে
অকস্মাৎ মিলালো অপরিচিত লোকে।

স্বল্পপরিচিত জনের মৃত্যুসংবাদ শুনেই আমরা শোকে, এক অজানা আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে যাই আর, এখানে কল্পনা করুন যে বাচ্চাটিকে মা ক্ষণতরে চোখের আড়াল হতে দিত না, যার কণ্ঠস্বরের সামান্যতম রেশ, যার ক্ষুদ্রতম অঙ্গভঙ্গি তার চেনা, আর সে যখন হঠাৎ খেলা ছেড়ে ছুটে এসে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলত, মা, সে হঠাৎ নেই হয়ে গেল? চিরতরে এ মহাশূন্যতা কল্পনায় এ যে আপন মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়েও নির্মম!

কিন্তু তার পর শুনুন, বীভৎসতার চূড়ান্ত :

দেবতা যেখানে ছিল সেথা জ্বালাইতে গেলে ধূপ,
সেখানে বিদ্রূপ।

চরম দুঃখে মা যখন কোনও সান্ত্বনা পেয়ে তার পুজোর ঘরে মাথা কুটতে গেল–ইষ্টদেবতার সামনে, যে-দেবতা যুগ যুগ ধরে এ-বংশের কত না দুঃখী, কত না দুঃখিনীর চোখের জল মুছিয়ে দিয়েছেন, সে-দেবতা তখন যদি লজ্জায় গা-ঢাকা দিতেন তা-ও কিছু বিচিত্র হত না, কিন্তু তার চেয়েও পৈশাচিক পরিস্থিতি। দেবতার জায়গায় হনুমান বসে মায়ের লোকের দিকে ভেংচি কাটছে।

***

এসব দুঃখ থেকে নিষ্কৃতির পথ কি রবীন্দ্রনাথ জানতেন না? জানতেন, খুব ভালো করেই জানতেন– অন্তত আমার মনে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

অ্যাকাডেমিক অর্থে রবীন্দ্রনাথ দার্শনিক ছিলেন না। অর্থাৎ কান্টের ধিং ই ইটসেলফ এবং বেদান্তের অ-সত্য একই বস্তু কি না, ব্ৰহ্ম যেখানে নিওঁণ সেখানে ত্রিগুণ তার ভিতরে লোপ পায়, না, তিনি তখন ত্রিগুণের অতীত এসব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কালক্ষেপ করতেন না। কিন্তু একথা তিনি খুব ভালো করেই জানতেন ভারতীয় দর্শনের চরম আদর্শ আনন্দ। এবং সাংখ্য দর্শনের গোড়ার কথাই হচ্ছে, দুঃখের কারণ কীভাবে, ঐকান্তিকরূপে সমূলে বিনষ্ট করা যায়। আমার সঙ্গে সকলে একমত না হলেও নিবেদন করি, যোগ যত না ব্রহ্মানন্দের পথ নির্দেশ করেছেন, তার চেয়ে বেশি পথ নির্দেশ করেছেন আনাতে স্থির হয়ে আপন আনন্দময় কোষ থেকে আনন্দ আহরণ করতে। বেদান্ত প্রণবমন্ত্রের অনুসরণে ত্রিভুবনে অর্থাৎ ভূঃ, ভূবঃ স্বঃ- যা কিছু আনন্দ আছে তা ব্রহ্মে লীন আছে জেনে সেই ব্রহ্মে যযাজিত হয়ে অনন্তকালব্যাপী অনন্ত-দেশব্যাপী পরিপূর্ণানন্দে লীন হতে আদেশ দেয়।

পাঠক! মা ভৈঃ! আমি তোমাকে দর্শনশাস্ত্রের গোলকধাঁধায় ঢুকিয়ে অযথা হয়রান করতে চাইন– যদিও আমার বিশ্বাস পতঞ্জলি, কপিল, শঙ্কর তাদের মূল বক্তব্য আমাদের মতো সাধারণজনের জন্যই বলে গেছেন, এবং সামান্য একটু শ্রদ্ধাভরে এদের মূল বক্তব্য বার বার পড়লে আপাতদৃষ্টিতে যা কঠিন বলে মনে হয় সেটি সরল হয়ে যায়। অবশ্য এরা প্রত্যেকেই যেস্থলে আপন বক্তব্য প্রমাণ করতে, অন্যের বক্তব্যের সঙ্গে আপন বক্তব্যের কোনখানে গরমিল সেটা বোঝাতে গিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তর্কের অবতারণা করেছেন সেগুলো বোঝা পরিশ্রম ও ধ্যান-সাপেক্ষ। যেমন স্বাস্থ্যবান হতে হলে বৈদ্যরাজ প্রদত্ত কয়েকটি মূলসূত্র পালনই যথেষ্ট; পুরো আয়ুর্বেদ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অধ্যয়ন করা পরিশ্রমসাপেক্ষ ও নিষ্প্রয়োজন।

এসব তত্ত্ব রবীন্দ্রনাথ খুব ভালো করেই জানতেন।

 এবং সেটা প্রমাণ করা কঠিন নয়।

***

রবীন্দ্রনাথ তার জীবনের শেষ কবিতা রচনা করে যান অস্ত্রোপচারের কয়েক ঘন্টা পূর্বে। এবং সকলেই জানেন, সে অস্ত্রোপচার ব্যর্থকাম হয়, ও কবি অন্য কোনও রচনাতে হাত দিতে পারেননি। এ কবিতা সকলেই পড়েছেন, তবু আলোচনার সুবিধার জন্য এটি তুলে দিচ্ছি :

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে
হে ছলনাময়ী।
 মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
 সরল জীবনে!
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;
 তার তরে রাখনি গোপন রাত্রি।
 তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে-পথ দেখায়।
 সে যে তার অন্তরের পথ,
 সে যে চির স্বচ্ছ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তারে চির সমুজ্জ্বল।
বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু,
এই নিয়ে তাহার গৌরব।
 লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত।
সত্যেরে সে পায়
আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে।
কিছুতে না পারে তারে প্রবঞ্চিতে,
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে
আপন ভাণ্ডারে।
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।
—শেষ লেখা, ৩০ জুলাই ১৯৪১

এস্থলে প্রথমেই বলে রাখা ভালো, রবীন্দ্রনাথ কোনও বিশেষ দার্শনিক তত্ত্ব বা বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণ করবার জন্য কবিতা লিখতেন না। একথা তিনি নিজেও একাধিকবার বলেছেন। কবিতা তার নিজের মহিমায় মহিমময়ী, দর্শন বিজ্ঞান এমনকি ধর্মের সেবা-দাসী হয়েও সে তার চরম মোক্ষের অনুসন্ধান করে না (ধর্মও ঠিক সেইরকম দর্শন বা বিজ্ঞানের মুখাপেক্ষী নয়)। কাল যদি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তাবৎ ঐতিহাসিক কড়ায় কড়ায় প্রমাণ করে দেন যে কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ আদৌ হয়নি, কৃষ্ণার্জুন সংবাদের তো কথাই ওঠে না, তা হলেও গীতার মূল্য কানাকড়ি কমবে না। মধুসূদন যখন উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়!

 তখন তিনি একথা সপ্রমাণ করতে কোমর বাঁধেননি যে, আশার ছলনে ভুলতে নেই। বস্তৃত তিনি তার পরও আশার ছলনে ভুলেছেন, বেঁচে থাকলে আরও ভুলতেন এবং না ভুললে আমাদের ক্ষতি হত।

আপাতদৃষ্টিতে আমাদের মনে হয়, পৃথিবী নিশ্চল এবং ধ্রুবতারা স্থির। বৈজ্ঞানিকরা কিন্তু বলেন, এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড- মায় ধ্রুবতারা প্রচণ্ড গতিবেগে কোনও অজানার দিকে যে ধেয়ে চলেছে সে খবর কেউ জানে না। তাই বলে রবীন্দ্রনাথ যখন লেখেন,

দেখিতেছি আমি আজি
এই গিরিরাজি,
এই বন, চলিয়াছে উন্মুক্ত ডানায়
দ্বীপ হতে দ্বীপান্তরে, অজানা হইতে অজানায়।

 তখন তিনি কোনও বৈজ্ঞানিক সত্য মস্তিষ্ক দিয়ে বুঝে, তার পর হৃদয় দিয়ে অনুভব করে সেটি কবিতার রসে প্রকাশ করছেন না। এটা প্রত্যক্ষ অনুভূতি, পুত্রশোকে মাতার কাতরতা যেমন সোজা অনুভূতি, প্রিয়জনবিরহ আমাদের বুকে যেরকম সরাসরি বেদনার অনুভূতি এনে দেয়, সেইরকম।

তাই যখন কবি বলছেন তোমার সৃষ্টির পথ বিচিত্র ছলনাজালে আকীর্ণ করে রেখেছ তখন তিনি একটি সহজ সত্য অনুভব করেছেন। এটি দার্শনিক গবেষণা নয়।

এখন প্রশ্ন, এই ছলনাময়ীটি কে?

তিনি পরব্রহ্ম হতে পারেন না, কারণ তার লিঙ্গ নেই, এবং এ-স্থলে শব্দটি পরিষ্কার স্ত্রীলিঙ্গে আছে।

তাই এখানে সাংখ্যদর্শনের আশ্রয় নিলে কবিতাটি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বোঝবার সুবিধে হয়– রসগ্রহণ অবশ্য অন্য ক্রিয়া।

কপিল মুনির চরম বক্তব্য কথা এই যে, প্রকৃতিই আপন অধিষ্ঠাতা পুরুষকে অর্থাৎ জীবাত্মাকে মোহে আচ্ছন্ন করিয়া তাহাকে সুখ-দুঃখাদির গুণদ্বারা বন্ধন করেন, এবং প্রকৃতিই মোহান্ধকার ক্রমে ক্রমে অপসারণ করিয়া সুখ-দুঃখাদির হস্ত হইতে জীবকে নিষ্কৃতি প্রদান করেন। (২)

এই টীকাটি করেছেন রবীন্দ্রনাথের সর্বজ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর গীতাপাঠ গ্রন্থে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মতে এর মতো তত্ত্বজ্ঞানী পুরুষ তিনি তার জীবনে আর দেখেননি।(৩) পাছে পাঠক ভাবেন আমি আমার নিজস্ব টীকা দিয়ে তাঁকে অতিশয় কঠিন বস্তু সাতিশয় সরল করে বুঝিয়ে দিচ্ছি তাই দ্বিজেন্দ্রনাথের টীকা উদ্ধৃত করলুম।

তা হলে দাঁড়াল এই :

হে ছলনাময়ী (অয়ি প্রকৃতি!), তুমি তোমার আপন হাতে সৃষ্টির পথ (যে-পথ দিয়ে মানুষ চলে) বিচিত্র ছলনা দিয়ে কন্টকাকীর্ণ করে রেখেছ। (যেমন দড়ির টুকরো দেখে সাপ ভেবে আঁৎকে উঠি, আবার ঝিনুকের টুকরোটাকে কোম্পানির টাকা ভেবে উল্লাসে নৃত্য করি)। তার পর কবি এই বিচিত্র ছলনা উদাহরণ দিয়ে পরিষ্কার করছেন, চতুর্থ ছত্রে, মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে। যে জীবন সরল বলে মনে হয়, সেখানে রয়েছে মিথ্যা বিশ্বাসের ছলনা (তাই প্রকৃতি ছলনাময়ী)। এই মিথ্যা বিশ্বাস কী সেটা রবীন্দ্রনাথ এ কবিতা লেখার সতেরো বছর পূর্বে বর্ণনা করেছেন তাঁর আপন জীবনে,

পিপাসার জলপাত্র নিয়েছে সে
 মুখ হতে, কতবার ছলনা করেছে সে হেসে হেসে,
 ভেঙেছে বিশ্বাস, অকস্মাৎ ডুবায়েছে সে ভরা তরী
তীরের সম্মুখে নিয়ে এসে।

আর একথা বুঝতে তো কণামাত্র অসুবিধা হয় না, সরলকেই ফাঁকি দেয় ধুরন্ধর! বিদ্যাসাগরের মতো সরল লোকই ঠকেছেন সবচেয়ে বেশি!

এর পর আবার একটুখানি সাংখ্যদর্শনে আসতে হয়। সাংখ্যাদি শাস্ত্রে যার নাম মহান দেওয়া হয়েছে সেই মহান শব্দের অর্থ বাধিত অপরিচ্ছিন্ন (বাঙলা মলিন অর্থে নয়, সংস্কৃত অর্থে অখণ্ডিত) বুদ্ধিতত্ত্ব।

এই মহান-ই চিরানন্দের পথ দেখায়।

সেই মহান-কে, হে ছলনাময়ী, তুমি মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতে
প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত

অর্থাৎ মহান-কে আচ্ছাদিত করেছ। সাংখ্যের সেই মহান-কে এখানে কবি মহত্ত্বরূপে ব্যবহার করেছেন। এর পর বোঝার সুবিধার জন্য একটি কিন্তু যোগ দিতে হবে।(৪) পড়তে হবে,

(কিন্তু) তার তরে রাখনি গোপন রাত্রি।

এরপর বাকি কবিতাটুকু সহজ; তাতে তিনটি কথা আছে :

১. যে-পথ দিয়ে জীবন ছলনা থেকে মুক্ত হয়ে শান্তির অক্ষয় অধিকার পায়, সেটা তার ভিতরেই আছে। সেটা তার অন্তরের পথ।

২. সে যখন মানুষকে সরল বিশ্বাস করে ঠকবে, সে হয়তো জানতেই পারবে না যে বুদ্ধিমতী (ছলনাময়ী) তাকে ঠকাচ্ছে, এবং অন্য লোক তার সরলতা ও ছলনাময়ীর নষ্টামি দেখে তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ-ন্দ্রিপ করবে–লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত।

৩. সে-ই শুধু শান্তির অক্ষয় অধিকার পায় যে অনায়াসে ছলনা সহিতে পারে। সেই লোক যে ছলনাময়ীকে। তা সে রমণীরূপেই দেখা দিক, আর পুরুষরূপেই দেখা দিক এসে ছলনা সে বেদনা-তিন প্রকারের হতে পারে :ক, বাহ্যবস্তু-ঘটিত ঋ, আপনা-ঘটিত কিংবা গ. দেবতা-ঘটিত অর্থাৎ অ্যাকসিডেন্টাল সে যখন তার বেদনার জন্য দায়ী দুষ্টকে কঠোর সাজা দিয়ে প্রতিহিংসা নেয় না, হাসিমুখে ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে নেয় সেই পায় শান্তির অক্ষয় অধিকার। (অবশ্য সে যখন লোকের কাছে আরও বেশি হাস্যাস্পদ, বিড়ম্বিত।}

আবার অন্তরের পথে ফিরে যাই। এ প্রবন্ধে সেইটেই মূল বক্তব্য।

এই অন্তরের পথের শেষ প্রান্তে আছেন জ্যোতির্ময় পুরুষ। কুরান শরিফও বলেন তিনি জ্যোতিস্বরূপ।(৫)

তাঁর সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ যে তার জীবনে কতবার উল্লেখ করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। তিনিই জীবন-দেবতা। যে পাঠক জীবন-দেবতা জাতীয় কবিতা কঠিন বলে মনে করেন তিনি যেন গল্পে গল্পে বলা– ওই বিষয় নিয়েই সিন্ধুপারে (চিত্র) কবিতাটি পড়েন। কবি এক গভীর রাত্রে হঠাৎ ডাক শুনতে পেয়ে, ঘুম থেকে জেগে উঠে, দুরুদুরু বুকে বাইরে এসে দেখেন, কৃষ্ণ অন্তে বসে আছে এক রমণীমূরতি- আরেক অশ্ব দাঁড়ায়ে অদূরে পুচ্ছ ভূতল চুমে। কবিকে নিয়ে রমণী উধাও বিদ্যুৎ বেগে ছুটে যায় ঘোড়া। তার পর কী হল, পাঠক নির্ভয়ে পড়ে নেবেন, ঠিক কথা ও কাহিনীর গল্পের মতো সরল সাসপেন্স নষ্ট হবে বলে আমি আর বাকিটা বললুম না।

একে তিনি ঠিক চিনতে পারেননি বলে রবীন্দ্রনাথ বার বার দুঃখ করেছেন :

জানি, জানি আপনার অন্তরের গহনবাসীরে
আজিও না চিনি।

 এবং এই ধরনের ক্ষোভ ও আক্ষেপ কবি বহু শত বার করেছেন। এ নিয়ে কৌতূহলী তরুণ পাঠক চর্চা করলে উপকৃত হবেন।

তা হলে প্রশ্ন, এই অন্তরের পথ ধরে তিনি সেই অন্তরের গহনবাসীর সম্মুখীন হলেন না কেন?

ভার অসাধারণ চরিত্রবল ছিল, জীবনমরণ পণ করে যে কোনও সাধনার পথে এগিয়ে যাবার মতো বিধিদত্ত বীর্যবল তার ছিল, তিনি জিতেন্দ্রিয় পুরুষোত্তম ছিলেন– এসব কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। ঋষিতুল্য দ্বিজেন্দ্রনাথ তার কনিষ্ঠতম ভ্রাতার সম্বন্ধে এখানকারই এক গুরুজনকে বলেন, আমাদের সকলেরই পা পিছলিয়েছে–রবির কখনও পা পিছলোয়নি!

তবে শেষদিন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ সে সাধনা করলেন না কেন, যাতে করে তিনি দুঃখবেদনার ওপারে চলে যেতে পারেন?

আমার মনে হয় এবং পাঠককে সাবধান করে দিচ্ছি, এইখানে এসে আপনার সঙ্গে আমার মতের মিল না-ও হতে পারে তা হলে তাকে কাব্যলক্ষ্মীর কাছ থেকে বিদায় নিতে হয়। আমার দুঃখানুভূতি হবে, আমার আনন্দোল্লাস হবে, পুত্রবিয়োগে, সন্তানহারা মাতার হাহাকারে আমার অনুভূতির কেন্দ্র, আমার হৃদয়ের অন্তরতম প্রদেশ উদ্বেলিত উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবে তবে তো আমি সেটাকে রসস্বরূপে প্রকাশ করতে পারব। যদি মহাপুরুষের বাণী

‘সর্বদা নিত্য প্রত্যক্ষ আত্মনে তন্ময় হয়ে থাকবে’

 বরণ করে নিই, তবে সুখদুঃখ আমাকে স্পর্শ করবে কী করে?

প্রাচীন যুগের কথা বলা কঠিন। এ যুগে দেখতে পাচ্ছি, যে-দ্বিজেন্দ্রনাথ (শুনেছি মধুসূদনের মতো কবি তার কবিতা পড়ে বলেছিলেন, ওই একটিমাত্র লোক কবিতা লিখতে পারে; হ্যাট অফ টু দ্যাট ম্যা–তাকে নমস্কার) স্বল্পপ্রয়াণের মতো অতুলনীয় কাব্য রচনা করে বান্দেবীর বরপুত্ররূপে স্বীকৃত হলেন, তিনি যেদিন থেকে তাঁর অন্তরের পথের প্রয়াণ আরম্ভ করলেন, সেদিন রুদ্ধ হল– কিংবা আপন হাতেই তিনি রুদ্ধ করলেন গোলাপের-পাপড়ি-ছড়ানো পথের শেষের (প্রিমরোজ পাথ টু ইটানেল বন-ফায়ার) কাব্যলক্ষ্মীর দেউল-দ্বার। স্বামী বিবেকানন্দের অতুলনীয় সৃজনীশক্তি ছিল; প্যারিসে (বোধ হয়) তিনি একখানা উপন্যাসও আরম্ভ করেছিলেন শেষ করলেন না কেন? শ্রীঅরবিন্দও কবিতা রচেছিলেন, কিন্তু সে তো গায়ত্রীর সমগোত্র আপনার আমার নিত্যদিনের হাসিকান্নার সন্ধান তাতে কোথায়? ঠাকুর রামকৃষ্ণ, দক্ষিণভারতের রমণ মহর্ষি উভয়ই এ যুগের বিখ্যাত পরমহংস, জীবন্মুক্ত। সাধারণজনের সুখদুঃব নিয়ে এর আলোচনা করেছেন অতি ললিত মধুর ভাষায় কিন্তু সে তো রসসৃষ্টি নয়।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, দাসী মুনিব-বাড়িতে কাজ করে নিতভাবে, কিন্তু তার মন পড়ে থাকে আপন বাড়িতে আপন বাচ্চার কাছে। আমরা এ সংসারের কর্তব্য-কর্ম করব দাসীর মতো, কিন্তু মন পড়ে রইবে ব্রহ্মার পদতলে!

এই উপদেশ নিয়ে কারও মনে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রশ্ন, দাসীকে যদি আদেশ করা হয়, তাকে কাপড় কাঁচা বাসন মাজার মেকানিক্যাল রুটিন কাজ নয়, তন্ময় হয়ে গাইতে হবে গান, কিংবা উদ্ভাবন করতে হবে কাঁথা সেলাইয়ের নিত্য-নব প্যাটার্ন পারবে কি সে? দাসী কেন, যদি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে বলা হত, জমিদারি চালানো বা ছাত্র-অধ্যাপনা নয়– এগুলো মোটামুটি মেকানিক্যাল কাজ– তোমাকে তনয় হয়ে গাইতে হবে গান কিংবা রচতে হবে কবিতা অথচ তোমার সর্বসত্তা পড়ে থাকবে পক্ষের পদপ্রান্তে, তবে তিনি কি সেটা পারতেন? এই ডবল তন্ময়তা কি সম্ভবপর হয়তো ধর্মসঙ্গীত রচনার সময় সম্ভবপর (যদিও কেউ কেউ বলেন, তাঁর ধর্মসঙ্গীত অনবদ্য হলেও তার প্রেম বা প্রকৃতি সঙ্গীতের তুলনায় নিচে} কিন্তু হৃদয়ের গভীরতম বেদনার স্মরণে তন্ময় হয়ে সে-বেদনাকে সর্বাঙ্গসুন্দর, বিশ্বজননমস্য রূপ দিয়ে সৃষ্টি করা কি সম্ভবপর দুঃখে যে-জন অনুদ্বিগ্নমনা, সুখে যে জন বিগতস্পৃহ সে তো শান্ত; শান্ত রস কি রস? খ্রিস্টান মিষ্টিক তরুণ সাধককে বলেছেন, যা বলার এই বেলা বলে নাও। ব্রহ্মপ্রাপ্তির পর যে অভূতপূর্ব আনন্দ পাবে তখন আর কোনও কিছু বলতে চাইবে না।

চতুর্দিক থেকে তারস্বরে প্রতিবাদ উঠবে– আমি জানি তবু ক্ষীণকণ্ঠে নিবেদন করে যাই, রবীন্দ্রনাথ সেই ব্রহ্মানন্দে লীন হতে চাননি। তিনি আমাদের মতো পাপীতাপীদের যে ভাঙা নৌকা, সেটা ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে চাননি। সুখের মলয় বাতাসে ঝাবাতের ক্র আঘাতে নিমজ্জমান তরীতে বসে তিনি আমাদের শুনিয়েছেন, আমাদেরই হৃদয়ের গীতি– যে গীতির প্রকাশক্ষমতা আমাদের নেই।

যুধিষ্ঠিরের মতো তিনিও স্বর্গারোহণ করতে চাননি।

———-

১. সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন,

যে খেয়ার কর্ণধার তোমাদের নিয়েছে সিন্ধুপারে আষাঢ়ের সকল ছায়ায়, তার সাথে বারে বারে হয়েছে আমার চেনা।– পূরবী

২. ঠাকুর রামকৃষ্ণ বোঝাতেন উপনিষদ দিয়ে : বিদ্যারূপিণী স্ত্রীও আছে আবার অবিদ্যা-রূপিণী স্ত্রীও আছে। বিদ্যারূপিণী শ্রী ভগবানের দিকে লয়ে যায়; আর অবিদ্যা-রূপিণী ঈশ্বরকে ভুলিয়ে দেয়, সংসারে ডুবিয়ে দেয়। তার মহামায়াতে এই জগৎ সংসার। এই মায়ার ভিতর বিদ্যামায়া, অবিদ্যামায়া দুই-ই আছে। বিদ্যামায়া আশ্রয় করলে সাধুসঙ্গ, জ্ঞান, ভক্তি, প্রেম, বৈরাগ্য এইসব হয়। অবিদ্যামায়া পঞ্চভূত আর ইন্দ্রিয়ের বিষয়, রূপ, রস, গ, স্পর্শ, শব্দ, যত ইন্দ্রিয়ের ভোগের জিনিস; এরা ঈশ্বরকে ভুলিয়ে দেয়। উপনিষদে আছে: অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যে অবিদ্যামুপাসতে,

ততো ভূয়ো ইব তে তমো য উ বিদ্যায়াং রতাঃ।

অর্থাৎ,

যাহারা অবিদ্যার উপাসনা করে তাহারা অন্ধ তিমিরে প্রবেশ করে।
তাহা অপেক্ষা আরো ঘোরতর অন্ধ তিমিরে প্রবেশ করে যাহারা বিদ্যায় রত।
—দ্বিজেন্দ্রনাথের অনুবাদ।

এখানে স্পষ্টত একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। সেটা সরল হয়, কান্ট যেটাকে thing-in-itself বলেছেন সেটাকে অবিদ্যা অর্থে নিলে। দ্বিজেন্দ্রনাথ সেই অর্থে নিয়েছেন। তার মতে, এই জিনিসই সাংখ্যের অচেতন প্রকৃতি, শোপেন-হাওয়ারের অন্ধ will, Mill-এর ইন্দ্রিয়চেতনার অধিষ্ঠাত্রী নিত্যাশক্তি, ইংরাজিতে Permanent possibility of sensation, বেদান্তের সদৃসদৃভ্যামনির্বাচনীয়া অবিদ্যা। সাংখ্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি বুঝবার চেষ্টা করলে সরল হয় বলে আমি সাংখ্য নিয়েছি।

 ৩. সুদ্ধমাত্র পণ্ডিত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ নাম করতেন স্বর্গীয় রাজেন্দ্রলাল মিত্রের।

৪. মনে রাখতে হবে এ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ডিকটেট করেন। যখন সেটি read-back করা হল তখন তিনি বলেছিলেন যে, ওটাকে আবার দেখে দিতে হবে। সে সুযোগ তিনি পাননি।

৫. কুরান শরিফ, ২৪ অধ্যায়, অন্-নূর (জ্যোতি) মণ্ডল দ্রষ্টব্য। বাইবেলেও মহাপুরুষ তার প্রভু ইয়াহূতেকে অগ্নিরূপে দেখেছিলেন। সর্বকলুষ পুড়ে গিয়ে জীবাত্মা যখন অগ্নিশিখারূপে পরিবর্তিত হয় তখন ব্রহ্মাগ্নিতে লীন হতে মাঝখানে আর কোনও প্রতিবন্ধ থাকে না। রবীন্দ্রনাথ তাই গেয়েছেন, কোণের প্রদীপ মিলায় যথা জ্যোতিঃ সমুদ্রেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *