রবীন্দ্রনাথ
বর্তমান বাংলাসাহিত্যের মর্ম্ম-মূল হইতে তাহার শাখাপ্রশাখার পত্র-পল্লবে যে গূঢ়সঞ্চারী প্রাণরস প্রবাহিত হইয়াছে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাই যে তাহার প্রধান, অথবা প্রায় একমাত্র উৎস, এ কথা অত্যুক্তি নহে। রবীন্দ্রনাথ যেন ইহার ভিত্তি হইতে শিখর পর্য্যন্ত সমুদয় বদলাইয়া দিয়াছেন; তিনি কেবল এ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন নাই—ইহাকে নূতন করিয়া সংস্থাপিত করিয়াছেন। আর কোনও সাহিত্যে কোনও একজনের সৃষ্টিশক্তি এতখানি প্রভাবশালী হইতে দেখা যায় নাই।
ইতিপূর্ব্বে বাংলাসাহিত্যের অধিনায়ক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্কিমের প্রতিভাই বাংলাভাষায় সর্বপ্রথম আধুনিক সাহিত্যের পত্তন করিয়াছিল, বাঙালীর রসবোধের উদ্বোধন ও সাহিত্যিক-রুচির সংস্কারসাধনে ব্রতী হইয়াছিল। এই আধুনিক সাহিত্যের প্রবর্তনায় মাইকেল যেমন কবি-কল্পনাকে মুক্তির আশ্বাসে সঞ্জীবিত করিয়াছিলেন, বঙ্কিম তেমনই বাঙালীর রসবোধ জাগ্রত ও পুষ্ট করিবার প্রয়াস পাইয়াছিলেন; তাঁহার প্রতিভায় বাংলাসাহিত্যের কৌলীন্য প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল। সে হিসাবে বঙ্কিমই বাংলাসাহিত্যকে এক নূতন পথে প্রবর্ত্তিত করিয়াছিলেন। কিন্তু সে পথে অধিক দূর অগ্রসর হইবার পূর্ব্বেই বাংলাসাহিত্যের পুনরায় গতিপরিবর্ত্তন হইল; এই পরিবর্তন যেমন সম্পূর্ণ বিপরীত, তেমনই গভীর ও ব্যাপক। বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যসাধনায় আমরা যে মন্ত্রের পরিচয় পাই, পরবর্ত্তী যুগে যদি তাহারই প্রসার ঘটিত তবে বাংলাসাহিত্য তাহাতে কোনদিকে কতখানি লাভবান হইত সে আলোচনা এখানে অপ্রাসাঙ্গিক। আমরা জানি, সে সাধনার ধারা বাংলার সাহিত্য-ভূমিকে উর্ধ্বর করিয়া, পরে প্রায় লুপ্ত হইয়াছে, এবং তাহার স্থানে রবীন্দ্রনাথের সাধন—মন্ত্রই এ যাবৎ জয়ী হইয়া আছে। আমরা কেবল ইহাই দেখিব যে, এ ঘটনা সম্ভব হইল কেমন করিয়া, রবীন্দ্রনাথের সাধন-মন্ত্রের বৈশিষ্ট্য কি, সে প্রভাবের বিস্তার ও গভীরতা কতখানি। এজন্য প্রথমে রবীন্দ্রনাথের কবিমানস এবং একালে সেই মানস-ধর্ম্মের সাহিত্যিক-প্রয়োজন চিন্তা করিয়া দেখা আবশ্যক। ইহাই বৰ্ত্তমান প্রবন্ধের মুখ্য বিষয়; আশা করি, ইহা হইতেই আর সকল প্রশ্নের মীমাংসা হইতে পারিবে।
বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য-সাধনার একটা লক্ষণ এই যে, তাহাতে য়ুরোপীয় সাহিত্যের বিশিষ্ট প্রেরণা বাংলাসাহিত্যে সেই প্রথম পূর্ণভাবে সঞ্চারিত হইয়াছিল। বাঙালীর ভাবানুভূতির ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র যে কাব্যলোক উদ্ঘাটিত করিলেন তাহাতে মানুষের মনুষ্যত্ব-পিপাসার সঙ্গে একটি মহিমা-বোধ যুক্ত হইল, সাহিত্যে এই জগৎ ও জীবন এক নূতন ভাব-কল্পনায় মন্ডিত হইল; ভারতীয় সাহিত্যের সুচির প্রতিষ্ঠিত রসের আদর্শ বিচলিত হইল; কবিকল্পনা অতি গভীর হৃদয়সংবেদনাকে আশ্রয় করিয়া বাস্তবকেই এক নূতন রস-রূপে বৃহৎ ও মহিমময় করিয়া তুলিল। বহিঃপ্রকৃতি ও মানব-হৃদয় এই উভয়ের সাক্ষাৎ ঘনিষ্ঠতর পরিচয়ে অন্তর মথিত হইয়া যে রসের উৎসার হয়—প্রকৃতি ও পুরুষের মিলন-জনিত সেই গভীর অতৃপ্তির রসোল্লাস-সেই একজন বাঙালীর প্রতিভায় খাঁটি য়ুরোপীয় আদর্শে কাব্যসৃষ্টির শক্তি লাভ করিয়াছিল। রূপ-রস-পিপাসার সঙ্গে উৎকৃষ্ট কল্পনা-শক্তির সমাবেশ ঘটিলে কিরূপ কাব্যসৃষ্টি হয়—এই প্রকৃতি পারবশ্যই পুরুষের চিত্তে কি রস-প্রেরণার সঞ্চার করে, বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলিতে বাঙালী তাহার পরিচয় পাইল। কিন্তু এ রসের চর্চ্চায় তাহার স্থায়ী অধিকার জন্মিল না। অতি দুৰ্ব্বল ভাবপ্রবণ হৃদয়ে কল্পনার সংযম রক্ষা করা দুরূহ। এ সাহিত্যের রসবোধে যে বিবেক বা রুচির শাসন আবশ্যক, তাহা অতি সবল সুস্থ জীবন-চেতনা ব্যতীত সম্ভব নয়। তাই সাহিত্যে এই নবমন্ত্রের সাধনা বঙ্কিমের দৈবী প্রতিভায় যে সাফল্যলাভ করিয়াছিল, সে যুগের আর সকলের পক্ষে তাহা অনধিকারীর বিড়ম্বনা হইয়া দাঁড়াইল। কারণ, এ শক্তিসাধনার পক্ষে প্রাণ-মনের যে স্বাস্থ্যের প্রয়োজন, যে দৃঢ় ও অসঙ্কোচ অনুভূতিবলে বস্তু ও ভাবের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া সাহিত্যে সেই ধরণের রস-রূপ প্রতিষ্ঠা করা যায়—বাঙালীর জীবনধর্ম্মে তাহার অবকাশ ছিল না। তাই দেখা যায়, হেম-নবীনের কাব্য অধিকাংশ স্থলে ছন্দেগাঁথা উচ্ছ্বাসময় গদ্য; যে প্রাকৃত ভাব-বস্তুর উপাদানে তাঁহারা কাব্যসৃষ্টি করিতে প্রয়াস পাইয়াছিলেন তাহাতে ভাব অথবা বস্তু কোনটারই রস-পরিচয় নাই, তাই তাঁহাদের কাব্যের বাণীরূপ এত দীন, এত অপরিচ্ছন্ন। কিন্তু তাহাতেই সে যুগের বাঙালীর শব্দাড়ম্বর-প্রিয়তা ও অবোধ ভাবাতিরেক কিয়ৎপরিমাণে তৃপ্ত হইয়াছিল— সাধারণ শিক্ষিত বাঙালীর রসবোধ যে ইহার উপরে উঠিতে পারে নাই, তাহাতে আশ্চর্য হইবার কারণ নাই। যে কপালকুন্ডলা, কৃষ্ণকান্তের উইল, বিষবৃক্ষ পড়িয়া মুগ্ধ হয় তাহার নিকট বৃত্রসংহারও উপাদেয়!* তাহার কারণ, বাঙালীর অন্তরের বন্ধনদশা তখনও ঘোচে নাই,—অন্ধকার গৃহে বসিয়া সে রন্ধপথে আলোক-শলাকা দেখিয়া মুগ্ধ হয় বটে, কিন্তু আলোক-পিপাসা তাহার জাগে নাই। য়ুরোপীয় কাব্যের আদর্শ তাহার রসবোধের পক্ষে নিরর্থক-কাব্যের সে রস-রূপ তাহার দৃষ্টিগোচর হইলেও তাহাতে সাড়া দিবার মত চিৎ-শক্তি তাহার নাই। তাই বঙ্কিমের কল্পনা তাঁহার উপন্যাস কয়খানিতেই আবদ্ধ হইয়া রহিল, আর কাহারও প্রতিভায়, আর কোনও সাহিত্যক রূপ-সৃষ্টিতে, সে কল্পনার প্রসার ঘটিল না।
[* পরে বাংলার বিশ্ববিদ্যালয়ে হেমচন্দ্র ও গিরিশ ঘোষই স্থায়ী ও উচ্চ আসন লাভ করিয়াছেন—বিশ্বপণ্ডিতেরা এই জাতীয় মহাকবিদ্বয়ের পূজাকেই মহাপূজা বলিয়া মনে করেন।]
বঙ্কিমচন্দ্রের নায়কতায় বাংলাসাহিত্যে একটি বারোয়ারী উৎসবের আয়োজন হইয়াছিল, বাঙালী একটি সার্ব্বজনীন সাহিত্য-যজ্ঞের অনুষ্ঠানে বড় উৎসাহ বোধ করিয়াছিল; সাহিত্যক্ষেত্রে এই উদ্যম ও পুরুষকারকেই তিনি সৰ্ব্বাগ্রে চাহিয়াছিলেন। নিজে উৎকৃষ্ট কল্পনাশক্তি ও রসবোধের অধিকারী হইয়াও সাহিত্যবিচারে তিনি ছিলেন পুরামাত্রায় ক্লাসিসিস্ট (Classicist)। সাহিত্যের চিরন্তন আদর্শের মূল্য বিচার করিয়া সকল সংস্কারের আমূল পরিবর্ত্তন তিনি আবশ্যক মনে করেন নাই; খাঁটি সাহিত্য-বোধের উদ্রেক অপেক্ষা তিনি বাঙালীর জীবনে সৰ্ব্বাঙ্গীণ সংস্কৃতির প্রয়োজন বোধ করিয়াছিলেন। তাই সমসাময়িক সাহিত্যক্ষেত্র কতকগুলি স্থূল অনাচার হইতে মুক্ত থাকে, এবং বাঙালীর চিন্তাশক্তি ও বিদ্যাবুদ্ধির যাহাতে অধিকতর উন্মেষ হয়, ইহাই তাঁহার লক্ষ্য ছিল। একটা অতিশয় স্বতন্ত্র, ব্যক্তিগত, দূর-বিচ্ছিন্ন ভাবদৃষ্টি লইয়া, একটা পৃথক মনোভূমিতে দাঁড়াইয়া সর্ব্বসংস্কার-মুক্ত হইয়া, দেশ ও জাতির বর্ত্তমান পরিচয়কে একটা সার্বভৌমিক সত্যের মানদন্ডে যাচাই করিয়া লইবার আকাঙ্ক্ষা তাঁহার ছিল না। তিনি ছিলেন কিছু মুক্ত, কিছু জড়িত। তাই তিনি যেমন একদিকে বঙ্গভারতীয় দশভূজামূর্তি স্থাপনা করিয়া সাহিত্যের উৎসব জাঁকাইয়া তুলিলেন, তেমনই আর একদিকে সেই উৎসবের বাদ্য-কোলাহলে দেবীর বোধন মন্ত্র যে ভাল করিয়া শ্রুতি—গোচর হইল না–বাণীপূজায় বাঁশীর সুর অপেক্ষা কাঁসির আওয়াজই যে বাঙালীর কানে অধিকতর উপাদেয় হইবার উপক্রম করিল, জাতি-স্নেহমুগ্ধ বঙ্কিম সে আশঙ্কায় বিচলিত হন নাই।
কিন্তু সমস্যা শুধু ইহাই নয়। য়ুরোপীয় সাহিত্যের যে আদর্শ অতিশয় অভিনব, অনভ্যস্ত, এবং জাতির জীবন-সংস্কারের বিরোধী বলিয়া-চমক লাগাইলেও, সত্যকার রসবোধ উদ্ভিক্ত করে নাই বলিয়াছি—সাহিত্যের সেই আদর্শ সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দী ধরিয়া সেখানকার কাব্যেও বিশেষ বিচলিত ও পরিবর্তিত হইয়াছিল; এবং যে কারণে তাহা সেখানে অবশ্যম্ভাবী হইয়াছিল সেই যুগান্তরকারী ভাব চিন্তার প্রভাব আমাদের দেশে এই অপ্রবুদ্ধ জীবন-চেতনার মধ্যেও নিগূঢ়-ভাবে সঞ্চারিত হইতেছিল। এজন্য আমাদের দেশেও এই নূতন সাহিত্যিক উৎসাহের মূলে একটা সংশয়-বিমূঢ়তা ঘটিয়াছিল, তাহার ফলে য়ুরোপীয় সাহিত্যের যে ভঙ্গি আমরা অনুকরণ করিতেছিলাম তাহাতে আর তেমন আস্থা বা উৎসাহ রক্ষা করা ক্রমেই দুরূহ হইয়া উঠিল। ইহার মধ্যেও বাঙালীর জাতিগত কাব্যপ্রবৃত্তি, তাহার স্বাভাবিক গীতিরসপ্রবণতা, যেন পথ না পাইয়া গুমরিয়া মরিতেছিল তাই ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজী কাব্যের সঙ্গে যতই তাহার পরিচয় বৃদ্ধি পাইল ততই তাহার কল্পনা যেন পুনরায় নূতন করিয়া সঞ্জীবিত হইল। এই কাব্যসাধনার আদর্শে সে যেন একটি অপেক্ষাকৃত সহজ ও আত্মস্বভাব সুলভ পন্থা খুঁজিয়া পাইল; শুধু তাহাই নয়, ইহা হইতে ভাবের যে স্বাতন্ত্র্য-মন্ত্রে সে দীক্ষালাভ করিল, তাহাতে দেশ কাল ও বহির্জীবনের প্রতিকূল অবস্থা হইতে সে কতক পরিমাণ মুক্তির উপায় করিয়া লইল। অতএব এ যুগে আমাদের সাহিত্যে রবীন্দ্র-প্রতিভার অভ্যুদয় আকস্মিক বোধ হইলেও অপ্রত্যাশিত নয়। এইবার এ সম্বন্ধে আমি কিছু বিস্তারিত আলোচনা করিব।
রবীন্দ্রনাথের কাব্য যে মুখ্যতঃ গীতিধর্মী—তাহাতে বাঙালীর জাতিগত প্রতিভারই জয় হইয়াছে; কিন্তু তাহার মূলে যে কল্পনা-ভঙ্গি আছে তাহা ভারতীয় কাব্য—পন্থার অনুগত না হইলেও ভারতীয় সাধনার আদর্শেই অনুপ্রাণিত। রবীন্দ্রনাথের মত খাঁটি ভারতীয় মানস-প্রকৃতি বঙ্কিমচন্দ্রেরও নহে, বরং সে হিসাবে কবি বঙ্কিম য়ুরোপেরই মানস-পুত্র। রবীন্দ্রনাথের কাব্যে যাহা ফুটিয়াছে ভারতীয় তত্ত্বচিন্তায় তাহার প্রেরণা চিরদিন ছিল। ভারতীয় ভাবসাধনার যাহা বৈশিষ্ট্য—সমগ্র জগৎকে একটি রস-চেতনায় আত্মসাৎ করার সেই অপূর্ব্ব প্রতিভা—চিরদিন ভাবকে লইয়া তৃপ্ত হইয়াছে, রূপেরও অরূপ-সাধনা করিয়াছে। জীবনের প্রত্যক্ষ পরিচয়ক্ষেত্রে এই প্রকৃতির রূপ-রেখা-লিপির সুস্পষ্ট সঙ্কেতে, রস-স্বরূপ ব্রহ্ম যেভাবে মানুষের সহজ ইন্দ্রিয়-চেতনার পথেই আত্মসাক্ষাৎকার করাইতেছেন, কাব্যই যে সেই অনুভূতির বিশিষ্ট সহায়, এবং রসজ্ঞানী সাধক বা জ্ঞানরসিক ঋষি যাহা পারেন না—রূপের মধ্যেই ভাবকে প্রত্যক্ষ করা ও রূপের ভাষাতেই তাহাকে প্রকাশিত করা—তাহা যে কবিকর্মেরই আয়ত্ত, এই ভাব-সৰ্ব্বস্ব জাতি তাহা এতদিন ভাবিতে পারে নাই। মানুষের সার্ব্বজনীন অধিকার সম্বন্ধে সংশয়, এবং রূপকে ত্যাগ করিয়া অরূপে ভাবদৃষ্টি নিবদ্ধ করার প্রবৃত্তি—এই দুই কারণে ইতিপূর্বে আমাদের দেশে ভাবসাধনা কখনও উৎকৃষ্ট কবি-কল্পনার সঙ্গে যুক্ত হইতে পারে নাই।
য়ুরোপীয় কাব্যে যে কবি-প্রতিভা এতদিন রূপের আরাধনা করিতেছিল—প্রকৃতির সহিত দ্বন্দ্বে মানব-প্রাণের বিচিত্র বিক্ষোভকেই একটি অবশ আত্মমুগ্ধ রসপিপাসায় পরিণত করিয়া কল্পনার তৃপ্তি-সাধন করিতেছিল—ঊনবিংশ শতাব্দীতে সেই প্রতিভায় এক স্বতন্ত্র কবিমানসের উদ্ভব হইল; এ যুগের কবিগণ রূপের উপরে ভাবের প্রতিষ্ঠায় ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। তথাপি এই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যমূলক-সাধনার মূলে প্রকৃতির প্ররোচনাই প্রবল ছিল বলিয়া—এই বহিঃসৃষ্টির বহু-বিচিত্র রূপ—বিলাসের অন্তরালে এই সকল সাধকেরা স্ব-স্ব ভাব-কল্পনায় এক অব্যভিচারী চিন্ময় আদর্শের সন্ধান করিয়াছিলেন বলিয়া-এ প্রবৃত্তি কবিপ্রতিভারূপেই প্রকাশ পাইয়াছিল; এবং কাব্যের সঙ্গীতে ও কাব্যের ভাষায় ভাবকে রূপ দিবার এক প্রকৃষ্ট পন্থা প্রবর্ত্তিত হইয়াছিল। রূপের এই অভিনব ভাব-ভঙ্গি, অনির্ব্বচনীয়কে বাক্যের সাহায্যেই হৃদয়-গোচর করার এই বাণী-প্রতিভাই এ যুগের ভারতীয় কবিমানসকে আশ্বস্ত করিয়াছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজী, তথা য়ুরোপীয় কাব্য কেবল এই হিসাবেই রবীন্দ্র-প্রতিভার পরিপোষক হইয়াছিল বলিয়া মনে হয়। কারণ, রবীন্দ্রনাথের ভাব-মন্ত্র সম্পূর্ণ ভারতীয়; য়ুরোপীয় কবির ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য ও আত্মসাধনায় যথেষ্ট প্রভেদ আছে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যে ভারতীয় ভাবপন্থা য়ুরোপীয় কাব্যপন্থায় মিলিত হইয়াছে—এই মিলনের গূঢ় তাৎপর্য্য না বুঝিলে রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ প্রতিভার পূর্ণ পরিচয় মিলিবে না।
পূর্ব্বে বলিয়াছি, য়ুরোপীয় সাহিত্যের যে আদর্শে বাংলাসাহিত্য প্রথমে অনুপ্রাণিত হইয়াছিল তাহার সম্যক সাধনার পথে প্রধান অন্তরায় ছিল—নানা সংস্কারে আচ্ছন্ন বাঙালীর জীবন-চেতনা। জীবনের বাস্তব অনুভূতি-ক্ষেত্রে যে বস্তুর পরিচয় নাই, তাহাকে সাহিত্যে প্রতিফলিত করিবে কেমন করিয়া? অথচ য়ুরোপীয় সাহিত্যের রূপ তাহাকে মুগ্ধ করে, কাজেই বিড়ম্বনার অন্ত নাই। এই অবস্থায় সত্যকার সাহিত্য-সৃষ্টি করিতে হইলে, এ যুগে বাঙালীর পক্ষে যে মুক্তির প্রয়োজন, বাহিরে বাস্তব জীবন-ব্যাপারে সে মুক্তি বহুবিঘ্নময় বলিয়াই, তাহার একমাত্র পন্থা—স্ব-তন্ত্র ভাবসাধনা। ইহা এই ভারতের অধ্যাত্ম সাধনারই অনুপন্থী। চিত্তবৃত্তি-নিরোধের দ্বারা জগৎকে আত্মচেতনা হইতে বহিষ্কার করিয়া, অথবা, আত্ম-চেতনার প্রত্যয়ানন্দে এই জগতের এক আধ্যাত্মিক রস-রূপ কল্পনা করিয়া পরিত্রাণ লাভের যে উপায়, তাহা ভারতীয় প্রতিভার নিজস্ব সম্পদ। কিন্তু একালে মুক্তিসাধনার এই মিষ্টিক-পন্থা তেমন প্রশস্ত নহে, এবং কাব্যে তাহা কোন কালেই চলে না। কারণ, কাব্যে শুধু ভাব নয়, অরূপ-রসের অর্দ্ধব্যক্ত উল্লাসও নয়,–এই জগৎ ও জীবনের প্রত্যক্ষ-অনুভূতিকে রস-রূপে পূর্ণ প্রকাশিত করাই কাব্যের সার্থকতা। ঊনবিংশ শতাব্দীর য়ুরোপীয় কবিকল্পনায় যে মুক্তিপ্রয়াসের কথা বলিয়াছি, তাহাতেও এই বহিঃপ্রকৃতির প্ররোচনাই প্রবল, তাহাতে প্রকৃতিপ্রভাবজনিত জীবন-চেতনাই নিগূঢ়-ভাবেই বিদ্যমান রহিয়াছে। এ ধরণের প্রকৃতি-প্রভাব আমাদের জীবনে কোনও কালেই প্রবল হইতে পারে নাই। এই ভাব-সঙ্কটে রবীন্দ্রনাথের কবিকল্পনা এক অভিনব মুক্তির সন্ধান পাইল; এবং সে কল্পনার মূলে যে সেই ভারতীয় ভাব-সাধনার মন্ত্রই শক্তি সঞ্চার করিয়াছে, ইহাই বিস্ময়কর। যে প্রেরণা এতকাল কাব্যকে দূরে রাখিয়া ভাবসাধনার অন্যতর মার্গে ধাবিত হইয়াছে, রবীন্দ্রনাথ তাহাকেই ভাব হইতে রূপে নূতন পন্থায় প্রবর্ত্তিত করিলেন। ঋষির মন্ত্র-দৃষ্টিকে, সাধকের ইষ্ট-স্বপ্নকে, Mystic বা অপরোক্ষদর্শী রস-জ্ঞানীর প্রত্যয়ানন্দকে, তিনি অন্তর হইতে বাহিরে—এই বিচিত্ররূপা প্রকৃতির হাব-ভাবের মধ্যেই উদ্ভাসিত হইতে দেখিয়াছেন; তাঁহার কল্পনায় সেই মোহিনী অসতীই সতী—মূর্ত্তির কল্যাণ-শ্রীতে মণ্ডিত হইয়াছে। আমাদের দেশে কবির কাজ ছিল স্বতন্ত্র; কাব্যামৃত-রসাস্বাদকে সংসার-বিষবৃক্ষের অমৃত ফল বলিয়া উল্লেখ থাকিলেও, সংসারটা বিষবৃক্ষই ছিল। সেই বিষবৃক্ষ হইতে অমৃতফল আহরণ করিতে হইলে নিছক কল্পনা বা বাস্তব-বিস্মৃতির যে কৌশল—তাহারই নাম কবিকৰ্ম্ম। কাব্যশাস্ত্রবিনোদ একটা চিত্তরঞ্জন বা মন-ভুলানো ব্যাপার, অতএব বাস্তবজীবন—চেতনার কোন উৎপাত রস-সৃষ্টির পক্ষে নিতান্তই অবান্তর। সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রে রস একটি মিষ্টিক অনুভূতির অবস্থা মাত্র; এজন্য কাব্য-বিচারে কবি ও কাব্য অতি সহজেই অব্যাহতি পাইয়াছে—কাব্য-বস্তু বা কবিমানসের কোন বিশেষ পরিচয় বা মূল্যনিরুপণের প্রয়োজন তাহাতে নাই। এজন্য একদিকে কবি-কল্পনা ও তাহার বিষয়ীভূত বস্তু-জগৎ যেমন অতিশয় সঙ্কীর্ণ তেমনই কাব্যবিশেষের রস-নির্ণয়ে একটি অতি স্থূল পদ্ধতির প্রয়োগই যথেষ্ট। কতকগুলি সাধারণ লক্ষণেই যাহার প্রমাণ, যাহাতে কোনও বিশেষ বস্তু-পরিচয় বা মানস-পরিচয়ের অবকাশ নাই, তাহাতে কবি-কল্পনার প্রসার কোথায়? রসের এই ধারণা হইতেই বুঝা যায়, এদেশে জগৎ ও আত্ম-চেতনার মিলন-ক্ষেত্ররূপে কাব্যের সীমা-বিস্তার কেন হয় নাই। রসের আদর্শকে মহিমান্বিত করিলেও আলঙ্কারিকেরা কাব্যকে জীবন হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া তাহাকে অতি সঙ্কীর্ণ গন্ডির মধ্যে বাঁধিয়া রাখিয়াছিলেন। আলঙ্কারিক শিষ্য ইহার উত্তরে কি বলিবেন জানি; কিন্তু মুস্কিল হইয়াছে, আধুনিক মানুষ এমনই বেরসিক যে, তাহা বুঝিতে চাহিবে না। আধুনিক মানুষের রস—পিপাসায় কোন চিন্তালেশহীন, মানসিকতাবর্জিত তুরীয় অবস্থার আস্বাদন-কামনা নাই, কাব্যের মধ্যেও সে একটা জগৎকেই চায়, সে এমন জগৎ যেখানে এক উচ্চতর মানস-বৃত্তি পূর্ণ-লীলার অবকাশ পায়—এই জগতের সকল অসম্পূর্ণ অভিজ্ঞতাকে একটি অখন্ড রস-চেতনায় সুসমঞ্জস করিয়াই তাহার চিত্ত নিবৃতি লাভ করে। এই মানস-বৃত্তির আমরা বাংলা নাম দিয়েছি ‘কল্পনা’, ইহার সংজ্ঞা—নিৰ্দ্দেশে এখনও গোল আছে। দেশীয় কাব্যশাস্ত্রে এই বৃত্তির সম্যক সন্ধান নাই; তার কারণ, কাব্যসৃষ্টিতে কবির যে ভাব-দৃষ্টি সাক্ষাৎ ইন্দ্রিয়জ্ঞান সুন্দর-বোধের সাহায্যে এই জগৎ ও জীবনের রস-রূপ আবিষ্কার করে, রস-বাদী তাহাকে স্বীকার করিতে প্রস্তুত নহেন। জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে এই বৈরাগ্য ভারতীয় রসবাদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, এই রস ব্রহ্মাস্বাদ-সহোদর, তাহার আস্বাদনে যে মুক্তি ঘটে তাহা বাস্তব-মুক্তিও বটে। কিন্তু য়ুরোপীয় কাব্যে কবি-কর্ম্মের যে বিশিষ্ট লক্ষণ প্রকাশ পাইয়াছে, তাহাতে বাস্তবকে স্বীকার করিয়াই তাহার উপরে আধিপত্য—চেতনায় একরূপ রস মুক্তির পরিচয় আছে—সেখানে বাস্তবকেই কাব্যলোকে প্রতিষ্ঠিত করিবার প্রবৃত্তি আছে, সে কাব্যের রস শেষ পর্য্যন্ত বস্তুচেতনার উপরেই নির্ভর করে।
এক্ষণে দেখা যাইবে, যে-সাধনা আমাদের কাব্যে কখনও প্রশ্রয় পায় নাই, অথচ যাহা ভারতীয় মানস-প্রকৃতির সম্পূর্ণ অনুগত, রবীন্দ্রনাথের কবি-প্রতিভায় তাহা কেমন কাব্যসৃষ্টির অনুকূল হইয়াছে। যুগ-প্রভাব ও যুগ-প্রয়োজনের বশে এ সাধনা প্রথম প্রকাশ পাইয়াছিল কবি বিহারীলালের কাব্য-ভঙ্গিতে। তথাপি বিহারীলাল শেষ-পর্য্যন্ত মিষ্টিক, তিনি রূপ হইতে ভাবে আরোহণ করিয়া সেইখানে পরিতৃপ্তি লাভ করিয়াছেন; রবীন্দ্রনাথ “ভাব হ’তে রুপে অবিরাম যাওয়া আসার রহস্যে মুগ্ধ হইয়া জগতের এক নূতন রস-রূপ সৃষ্টি করিয়াছেন। বিহারীলালের সারদা—‘স্বপনে বিচিত্ররূপা দেবী যোগেশ্বরী’; রবীন্দ্রনাথ তাঁহার কাব্যলক্ষ্মীকে বন্দনা করিয়া বলিতেছেন—’জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে, তুমি বিচিত্ররূপিণী’। বিহারীলাল তাঁহার ভাব-দেবতাকে এই যে ‘দেবী যোগেশ্বরী’ বা ‘যোগানন্দময়ী তনু, যোগীন্দ্রের ধ্যান-ধন’ বলিয়াছেন, ইহা নিরর্থক নহে, অন্তর, ও বহির্জগতের এই যোগাত্মিকা রস-সাধনাই ভারতীয় ভাবুকতার আদর্শ। বিহারীলাল এই ভারতীয় আদর্শকেই সৰ্ব্বপ্রথম কাব্যে নিয়োজিত করিয়াছিলেন, কিন্তু কাব্যসৃষ্টিতে সে কল্পনা সিদ্ধিলাভ করে নাই। রবীন্দ্রনাথ এই অন্তর-গহনের দীপশিখাকেই বস্তু-পরিচয়ের মানস-রঙ্গভূমিতে প্রতিফলিত করিয়া কাব্যরস ধারাকে এক নূতন উৎস হইতে প্রবাহিত করিলেন। তাঁহার কল্পনায় ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ এক অভিনব ভোগবাদের সমর্থন করিতে বাধ্য হইয়াছে; বৈরাগ্য-সাধনার মুক্তি অপেক্ষা অন্যতম মুক্তির পন্থা—এই বহির্জীবনের নাট-মন্দিরে কবিকরধৃত বাণী-দীপের আরতি-আলোকে—সুপ্রকাশিত হইয়াছে। বহুকালাগত সংস্কারকে এমন করিয়া উল্টাইয়া ধরা কবির পক্ষেও কম দুঃসাহস নয়, তাহার ফলে আমাদের দেশের সাধারণ পাঠকের নিকট উহা এক মনোহর হেঁয়ালী হইয়া আছে। যাহারা পুরাতন কাব্যরসে অভ্যস্ত তাহারা এ রস—আস্বাদনে সঙ্কুচিত; যাহাদের রসবোধ অপেক্ষাকৃত উদার তাহারা সংস্কৃত অলঙ্কার—শাস্ত্রের কাব্য-মন্ত্র দ্বারা এ রস শোধন করিয়া তবে আস্বাদন করিয়া থাকে; যাহারা কোন রসেরই রসিক নয়, এ কাব্যের বিরুদ্ধে তাহাদের প্রাকৃত-সংস্কার বিদ্রোহী হইয়া উঠে।
রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাধনায় উচ্চতর ভাবসিদ্ধির কথা ছাড়িয়া দিলেও, আমার মনে হয়, রবীন্দ্র-সাহিত্যে মনুষ্য-জীবনের সে নবতন মহিমা-বোধ আমাদিগকে আশ্বস্ত করে,—মানুষের অতি ক্ষুদ্র সাধারণ সুখ-দুঃখের উপরে, অতি পরিচিত সাধারণ দৈনন্দিন জীবনের তুচ্ছতার উপরেও তাঁহার সর্ব্বাশ্রয়ী রস-কুতূহলী কল্পনা যে দিব্য আলোক প্রতিফলিত করিয়াছে—সর্ব্ববস্তুতে আব্রহ্মস্তম্ভব্যাপী বিরাট সত্তার যে রস-রূপ আবিষ্কার করিয়াছে, তাহাতেই আধুনিক বাংলাসাহিত্যের গতি-প্রকৃতি এমন বিভিন্নমুখী হইয়াছে। রবীন্দ্রনাথের কবি-কল্পনার এই অতি মৌলিক ভঙ্গি সেকালে আমাদের মত ব্যক্তিকেও কিরূপ মুগ্ধ ও সচকিত করিয়াছিল তাহাই বলিব তখন আমার বয়স ১৫/১৬, তাহারও পূর্ব্বে নিতান্ত বালক বয়সেই একপ্রকার কাব্য—প্রীতি জন্মিয়াছিল। মাইকেলের মেঘনাদবধ, বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুন্ডলা, নবীন সেনের পলাশীর যুদ্ধ তখন আমার সেই ক্ষুদ্র হৃদয় জয় করিয়াছে—বাংলাসাহিত্যের নব উৎসব প্রাঙ্গণে সেকালের তরুণ আমরা এইসব লইয়াই মাতিয়া উঠিয়াছিলাম। কিন্তু সে সময়েও, অর্থাৎ ১৯০০ হইতে ১৯০৪ সাল পর্যন্ত, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে নাই; অতি সামান্য যাহা ঘটিয়াছিল তাহাতে সে সুর কেমন অদ্ভুত মনে হইত। রবীন্দ্র-সাহিত্য তখনও সুপ্রচারিত হয় নাই; তা’ছাড়া, রবীন্দ্রনাথের মধ্যাহ্ন-প্রতিভাকেও তখনকার দিনের প্রচলিত সাহিত্য—সংস্কার যেন একটা মেঘাবরণে অন্তরাল করিয়াছিল। কিন্তু যেমনই স্কুল ছাড়িয়া কলেজের পাঠ পদ্ধতির তাড়নায় ইংরেজী কাব্যসাহিত্যের সঙ্গে বৃহত্তর ও ঘনিষ্ঠতর পরিচয়ের সূত্রপাত হইল, সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের একখন্ড ‘গল্পগুচ্ছ’ হাতে পড়িল; তারপর কি হইল তাহা তখন ঠিক বুঝি নাই; কারণ মুগ্ধ অবস্থায় আত্ম-পরীক্ষা সম্ভব নয়, তাহার প্রয়োজনও থাকে না। সেই কয়টি গল্প পড়িয়া যে নূতন মন্ত্রে দীক্ষিত হইয়াছিলাম, আমার সমস্ত মানস-শরীরে যে পরিবর্তন ঘটিয়াছিল, আজ তাহা বুঝিতে পারি। মনে হয়, এতদিন যেন পৃথিবী হইতে চন্দ্রলোকের স্বপ্ন দেখিতেছিলাম; কিন্তু ইহার পর যেন চন্দ্রলোক হইতে পৃথিবীকে দেখিতে লাগিলাম—যেন এমন একস্থান হইতে এমনভাবে এই নিত্যকার জগৎকে দেখিবার সুযোগ পাইলাম যাহাতে অতি—পরিচিতের মধ্যেই অপরিচিততম সৌন্দর্য্যের অফুরন্ত আয়োজন হৃদয়গোচর হয়। বাস্তবে ও স্বপ্নে যেন ভেদ নাই; সমগ্র ভাব-দৃষ্টির কেন্দ্রই অকস্মাৎ এমন একদিকে সংস্থাপিত হইল যে, বস্তুসকল এক নূতন ছায়া সুষমার এক নব-মূৰ্ত্তিতে প্রকাশ পাইল। এই ‘গল্পগুচ্ছ’ই ছিল আমার রবীন্দ্রকাব্য—প্রবেশিকা। এখন বুঝি, রবীন্দ্রনাথের কল্পনা-শক্তির মূলে আছে—অন্তর ও বাহির, ভাব ও বস্তু, চিন্তা ও অনুভূতির সঙ্গতিমূলক এক অপূৰ্ব্ব গীতি-প্রবণতা; ইহাতে তাঁহার মনের মুক্তি; সেই মুক্তির আনন্দে তাঁহার কল্পনা সকল সংস্কার সকল বিরোধ উত্তীর্ণ হইয়া এমন এক রস-ভূমিতে অধিষ্ঠান করে, যেখানে জীবনের সকল অসামঞ্জস্য, বাস্তবের সকল বৈষম্য কবির প্রাণে একটি ভাবৈক-পরিণাম রাগিণীতে সমাহিত হয়। গদ্যে হোক, পদ্যে হোক—তিনি যখন যাহা সৃষ্টি করিয়াছেন তাহার অন্তর্গত এই সঙ্গীত পাঠককে আবিষ্ট করে, তাহার সমগ্র চেতনাকে সেই সর্ব্বসমঞ্জসকারী গীতি-রাগে বিগলিত করিয়া যে ভাব-দৃষ্টির অধিকারী করে, তাহাতে জগতের কোন কিছুতেই উচ্চ—নীচ, ক্ষুদ্র-বৃহৎ, সত্যমিথ্যার অভিমান থাকে না—একটি সুগভীর সর্ব্বাত্মীয়তার প্রীতি-কল্পনায় ধুলিও পরম বস্তু হইয়া উঠে। ‘গল্পগুচ্ছে’র কথা-অংশে বস্তুগত রোমাঞ্চ-বিস্ময়ের আয়োজন নাই, তথাপি তাহা যে বিস্ময় রসে হৃদয় আপ্লুত করে তাহার কারণ, তুচ্ছতম বস্তুর উপাদানে লেখক মহত্তমের প্রকাশ দেখিয়াছেন; আকাশের গ্রহ-তারকা হইতে ধূলি-তল্পের তৃণপুঞ্জ পর্য্যন্ত যে একটি মহিমা অব্যাহত রহিয়াছে, প্রাণ তাহারই ভাবসঙ্গীতে পূর্ণ হইয়া ওঠে; তখন আর বাস্তবে ও কল্পনায় কোনও বিরোধ-বুদ্ধির অবকাশ থাকে না; কে বলিবে, ‘গল্পগুচ্ছে’র কতটুকু বাস্তব, আর কতটুকু কল্পনা? ‘গল্পগুচ্ছে’ এই ভাব যে রূপ পাইয়াছে তাহা সহজেই হৃদয় মনের গোচর হয়, এবং যে একবার এই ভাবমন্ডলের মধ্যে প্রবেশ করিতে পারিয়াছে রবীন্দ্র-সাহিত্যের মর্ম্ম-সঙ্গীত তাহার কানে ও প্রাণে কোথাও আর বাধা পায় না। ‘গল্পগুচ্ছে’র মধ্য দিয়াই আমার এই দীক্ষালাভ একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার হইলেও আমার মনে হয়, আমার মত সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে রবীন্দ্র প্রতিভার সহিত অতি সহজ পরিচয়ের উহাই উৎকৃষ্ট সোপান। এবং ইহাও আমার বিশ্বাস যে, ‘গল্পগুচ্ছে’র মধ্যে কবি দৃষ্টির যে অতি স্বতন্ত্র ও নিগূঢ় ভঙ্গি, এবং রস সৃষ্টির যে কৌশল আছে, তাহা এখনও আমাদের দেশের সকল রসিক চিত্ত আকৃষ্ট করিতে পারে নাই; পারিলে, অন্তত একদিক দিয়া রবীন্দ্র-প্রতিভার প্রকৃত মর্যাদা বুঝিবার পক্ষে এত প্রতিবন্ধক ঘটিত না।
বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব প্রমাণ করিবার আবশ্যকতা আর নাই। কিন্তু, আমরা রবীন্দ্রনাথের প্রতিভায় যে পরিমাণ মুগ্ধ হইয়াছি ততখানি সঞ্জীবিত হই নাই, ইহা অস্বীকার করিয়া লাভ কি? রবীন্দ্রনাথ বঙ্গবাণীকে ভাষায় ও ছন্দে যে নব-রূপ ধারণ করাইয়াছেন তাহাতেই একালের বাংলাসাহিত্য তাঁহার নিকট অশেষ ঋণে ঋণী। কিন্তু ওই বাণী-রূপের অন্তরালে যে ভাবের আত্মা আছে তাহা বাঙালীর রসবোধে সম্যক্ ধরা দেয় নাই—একটা স্বতন্ত্র ভাব-মুক্তির পরিবর্তে অন্ধ ভাবের ঘোর সৃষ্টি করিয়াছে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যকল্পনা আমাদিগকে মুগ্ধ করিয়াছে, তাহার সঙ্গীত কানে স্পষ্টতর হইয়া উঠিয়াছে; কিন্তু সেই কাব্য-কল্পনার মূল প্রেরণা অন্তরে প্রবেশ করিয়া আমাদের কল্পনাকে স্বতন্ত্র-মুক্তির সন্ধান দেয় নাই। এ যুগে যে কেহ বাংলা লিখিয়াছেন বা লিখিতেছেন তাঁহার ভাষা ও রচনা-ভঙ্গিতে রবীন্দ্রনাথের এই বাহ্য প্রভাব অপরিহার্য্য হইয়া উঠিয়াছে। বস্তু জগতের বৈচিত্র্যকেই ভাব-সঙ্গীতের সুষমায় মন্ডিত করিয়া প্রকাশ করিবার প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথের কবি—প্রতিভা বাংলাভাষাকে যে রূপ দান করিয়াছে, সে-রূপের প্রভাব অজেয়, বাংলাভাষা সেই সঙ্গীত-রসে বিগলিত হইয়া এমন একটি সৌষ্ঠব ও নমনীয়তা লাভ করিয়াছে যে অতঃপর সর্ব্ববিধ সাহিত্য-গঠন কৰ্ম্মে ভাষার এই রূপ শিল্পীমাত্রেরই বরণীয় হইতে বাধ্য। এখন যাহা সাধারণ বাংলা লেখকের অতি সুসাধ্য অনুকরণ-কর্ম্মের সহায় হইয়াছে, তাহাই যে একদিন নানা উৎকৃষ্ট প্রতিভার ভাব-প্রকাশ-পন্থাকে বহু পরিমাণে সুগম করিবে তাহাতে সন্দেহ নাই। এই হিসাবে বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সৰ্ব্বব্যাপী হইলেও, যাঁহারা সাহিত্যে রবীন্দ্রপন্থা অনুসরণ করিয়াছেন তাঁহাদের মধ্যে কচিৎ দুই একজন সত্যকার কবি-শক্তি বা মৌলিক সৃষ্টি-প্রতিভা দাবি করিতে পারেন, যাঁহারা সে প্রভাব স্বীকার করেন নাই তাঁহাদের রচনা প্রায়ই সাহিত্য—পদবাচ্য নহে। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক যে দুই চারিজন লেখক গদ্যে পদ্যে মৌলিকতার পরিচয় দিয়াছিলেন, স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও তাঁহাদের কল্পনা রবীন্দ্রবিরোধী নয়, এজন্য রবীন্দ্র-সাহিত্যের বৃহত্তর মন্ডলের মধ্যেই তাঁহারা নির্ব্বিরোধে অবস্থান করিতেছেন। অতএব বাংলাসাহিত্য বলিতে আমরা আজকাল যাহা বুঝি তাহা হইতে রবীন্দ্রনাথকে পৃথক করিয়া ধরিলে সে সাহিত্যের বিশেষ কিছুই অবশিষ্ট থাকে না; এ সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য অংশে রবীন্দ্রনাথের রচনাই এত অধিক, যে ইহাতে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব অপেক্ষা তাঁহার নিজের কীর্তিই সর্ব্বত্র দেদীপ্যমান হইয়াছে।
বর্তমান বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব খুব ব্যাপক হইলেও তাহা যে তেমন গভীর হইতে পারে নাই ইহার কারণ আপাততঃ এই বলিয়া মনে হয় যে, রবীন্দ্রনাথকে আমরা বুঝি নাই। বঙ্কিমচন্দ্রকে আমরা বুঝিয়াছিলাম, কিন্তু সে সাধনার শক্তি আমাদের ছিল না—অতিশয় সঙ্কীর্ণ জীবন-যাত্রার ক্ষেত্রে, এই নিতান্ত নিম্নভূমিতলে দাঁড়াইয়া আমরা সেই গগনবিহারী গরুড়ের পক্ষ ও বক্ষবল আয়ত্ত করিতে পারি নাই। রবীন্দ্রনাথ, এই ভূমিতলে দন্ডায়মান অবস্থাতেই আমাদের মানস—নেত্রের দৃষ্টি পরিবর্ত্তন করাইয়া ভিতর হইতেই যে মুক্তির উপায় করিয়া দিলেন, তাহাতে এককালে মনে হইয়াছিল, এ সাধনায় আমরা অচিরে সিদ্ধিলাভ করিতে পারিব। কিন্তু তাহা হয় নাই। অতিশয় বর্তমান কালে সাহিত্য-প্রেরণা মন্দীভূত হইবার যথেষ্ট কারণ আছে, কোনও জাতির জীবন-সঙ্কট-কালে যাবতীয় শক্তি অন্য প্রয়োজনে নিয়োজিত হয়, তখন রসকল্পনার তেমন স্ফুর্ত্তি আর আশা করা যায় না। তথাপি এ সাহিত্যে পূর্ব্ব হইতেই শক্তি ও সজীবতার অভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইয়াছে। রবীন্দ্র-প্রতিভার ছায়াতলে সাহিত্য-রচনার কৌশল, ভাষা ও ছন্দের কারিগরি যতটা সহজসাধ্য হইয়া উঠিয়াছে, তাহার অনুপাতে নব-সৃষ্টির প্রেরণা ক্রমশঃ মন্দীভূত হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। ইহাতে মনে হয়, বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভা বাঙালীর মনে সাড়া জাগাইলেও তাহার অনুকরণ যেমন দুরূহ ছিল, রবীন্দ্রনাথের সাধন-মন্ত্ৰ হৃদয়ঙ্গম না হইলেও তাহার বাণী-লীলার মোহময় ভঙ্গি তেমনই সহজ অনুকরণের বস্তু হইয়াছে। এমন হইল কেন? একদিকে রবীন্দ্রনাথের নিত্যনবোন্মেষশালিনী সৃষ্টি-প্রতিভা ও অপর দিকে সমসাময়িক সাহিত্যে তাহার প্রভাব ও প্রতি-প্রভাব লক্ষ্য করিয়া এ সম্বন্ধে আমার যে ধারণা হইয়াছে এক্ষণে তাহাই লিপিবদ্ধ করিব।
পূর্ব্বে বলিয়াছি রবীন্দ্রনাথের অভিনব কবিকল্পনা আমাদের রস-পিপাসাকে আশ্বস্ত করিয়া বিশুদ্ধ সাহিত্য-প্রীতির উদ্রেক করিয়াছিল। সাহিত্য-সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যে ধরণের সাহিত্য-সমালোচনা প্রবর্ত্তিত করিয়াছিলেন, তাহাতেও একটি সুস্থ রস-বোধ জাগিয়াছিল। হেম-নবীনের কাব্যে যে রসসৃষ্টির অভিপ্রায় আছে তাহার ব্যর্থতা আমরা অনুভব করিলাম, ইংরেজ কবি পোপ, এমন কি বায়রণও, আর তেমন করিয়া মুগ্ধ করিল না; স্কট অপেক্ষা জর্জ এলিয়টের উপন্যাস আমাদিগকে অধিকতর আকৃষ্ট করিল। এজন্য আধুনিক বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পূৰ্ব্ব হইতেই সেই রূপ-সৃষ্টির প্রেরণা দেখা দিয়াছিল, তাহাই যেন আরও পরিশুদ্ধ হইয়া একটা পূর্ণতর বাণী-সাধনার আশায় আমাদিগকে উন্মুখ করিয়াছিল। কিন্তু রবীন্দ্র-প্রতিভার এই প্রেরণা কবির নিজস্ব আত্মসাধনার প্রয়োজনে ভিন্ন পথে প্ৰয়াণ করিল—রূপ হইতে পুনরায় অরূপের পানে ভাবের ‘খেয়া’য় পাড়ি জমাইল—কবির কাব্য-সাধনায় আত্ম-ভাবসাধনাই প্রবল হইয়া উঠিল। তারপর হইতে আজ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ কাব্যকে প্রধানতঃ সঙ্গীতের অধীন করিয়া তাহার বস্তুভার হরণ করিয়াছেন, রূপের স্বরূপ কল্পনার পরিবর্তে তাহার অরূপ-রসে আকৃষ্ট হইয়াছেন। এই রবীন্দ্রনাথের পরিচয় য়ুরোপ পাইয়াছে; কিন্তু আমাদের সাহিত্যে ‘গীতাঞ্জলি’ই যদি রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ দান হইত তবে বাংলাসাহিত্যের কি কোনও ভরসা থাকিত?
রবীন্দ্রনাথের প্রতিভায় ভারতীয় মানস-প্রকৃতির যে প্রভাব সম্বন্ধে পূর্ব্বে আলোচনা করিয়াছি, তাহাই যেন সে-প্রতিভার যৌবন-শেষে তাঁহার কাব্যপ্রেরণাকে অভিভূত করিয়া তাহার স্বধর্ম্ম ঘোষণা করিয়াছে। এ ঘটনা প্রাচীন ভারতের পক্ষে গৌরবজনক হইলেও আধুনিক ভারতের ইহা সৌভাগ্য নয়। রবীন্দ্রনাথ যে এককালে সেই ভারতীয় ভাবসাধনার mysticism-কেই প্রতীচ্যের রূপ-সাধনার সঙ্গে যুক্ত করিয়া আমাদের সাহিত্যে কাব্য ও জীবনের অপরূপ সমন্বয় সাধনে সক্ষম হইয়াছিলেন, ইহাই ভারতের সৌভাগ্য ও রবীন্দ্রনাথের অনন্যসাধারণ গৌরব। রবীন্দ্রনাথের নিজেরই সাধনার এই যে পন্থা-পরিবর্তন, তাঁহার প্রতিভা ও সাহিত্য—কীর্তির সম্যক পরিচয়ের পক্ষে ইহাই বোধ হয়, সর্ব্বপ্রধান বাধা। শুধুই কল্পনা রা কাব্যের ভঙ্গি-বৈচিত্র্য নয়, ভাষা ও রচনার নিত্য-নব রীতি পরিবর্তনে অনধিকারীর চিত্তে একটা মোহময় প্রহেলিকার সৃষ্টি হয়; ইহার ফলে কোন একদিক দিয়া রবীন্দ্র-প্রতিভার একটা স্পষ্ট ধারণা হওয়া দুরূহ। এইজন্যই এই দীর্ঘকালেও রবীন্দ্র-কাব্যের একটি সুসঙ্গত আলোচনা কাহারও পক্ষে সম্ভব হইল না; এ পর্যন্ত যাহা কিছু হইয়াছে তাহাতে কোন সাহিত্যিক-আদর্শের সন্ধান নাই, তাহা ব্যক্তিগত ভাবোচ্ছ্বাস—সমালোচনা নয়, সুখালোচনা মাত্র। এক্ষণে এমন দাঁড়াইয়াছে যে, বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ দান যে ভাবের রূপ-সৃষ্টি—কোন প্রকার mysticism নয়—তাহা আমরা বুঝিতে সম্মত নই। তাঁহার কাব্যে সনাতনী ভাবধারা বা বিশ্ববাণী যে ভাবেই উৎসারিত হউক, তাহার মূলপ্রেরণা যে অতিমাত্রায় আধুনিক, এবং তাঁহার কবি-মানস যে আদৌ mysticism-এর অনুকূল নয়, ইহা বুঝিয়া লইবার প্রয়োজন আছে। আধুনিক মনের রসপিপাসা নিবৃত্তির যে একটি পন্থা তাঁহার কাব্য সাধনায় প্রকাশ পাইয়াছে তাহাই তাঁহার প্রতিভার বিশিষ্ট গৌরব। রবীন্দ্রনাথের কবি-প্রকৃতির যে একটি লক্ষণ সম্বন্ধে কাহারও ভুল হইতে পারে না তাহা এই যে, এমন সদাজাগ্রত মনোবৃত্তি, এমন সুনিপুণ ভাবগ্রাহিতা, এমন সৰ্ব্বতোমুখী বোধশক্তি এত বড় কবিপ্রতিভার সহিত মিলিত হইতে সচরাচর দেখা যায় না। ইহার ফলে তাঁহার কাব্যসৃষ্টি যেমন বিচিত্র, তেমনিই তাঁহার কল্পনায় কুত্রাপি অতি-সচেতন মানস-ক্রিয়ার অভাব লক্ষিত হয় না। রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাধনা যে রীতিই অবলম্বন করুক, তাঁহার কবি-চিত্ত ভাব ও বস্তুর যখন যেটাকে আশ্রয় করিয়া যত বিচিত্র-রসের সৃষ্টি করুক,—তাহাতে Idealism থাকিলেও mysticism নাই। ভাব ও বস্তু—Ideal ও Real এই উভয়ের দ্বন্দ্বে রবীন্দ্রনাথের কল্পনা ভারতীয় ভাবসাধনা ও য়ুরোপীয় রূপ-সাধনার যে সমন্বয়—সাধন করিয়াছে, তাহার উল্লেখ পূর্ব্বে করিয়াছি। বর্তমান প্রসঙ্গে আমার একটি প্রধান বক্তব্য তাহাই, এজন্য সেই কথাটাই আর একবার ভালো করিয়া বলিয়া লইয়া এ প্রসঙ্গ শেষ করিব। আমার বিশ্বাস, রবীন্দ্র-প্রতিভার যে দিকটা আধুনিক জীবন ও আধুনিক কাব্যের সঙ্গতি সাধনে অসামান্য শক্তির পরিচয় দিয়াছে সেই দিকটাই আমাদের লক্ষ্য-বর্হিভূত হইয়াছে; অথবা যাহা এককালে ক্রমশঃ লক্ষ্যগোচর হইতেছিল তাহা পরে আমাদের দৃষ্টি-বর্হিভূত হইয়াছে—রবীন্দ্রনাথের কবি-জীবন একটি সুস্পষ্ট ভেদরেখার দ্বিধা বিভক্ত হইয়াই আমাদের মনে এই দ্বিধার সৃষ্টি করিয়াছে। ‘সোনার তরী’ ও ‘বলাকা’ পাশাপাশি রাখিয়া পড়িলে এই ভেদ-রেখা কাহারও অগোচর থাকে না।
আমি বলিয়াছি, রবীন্দ্রনাথের প্রতিভায় আধুনিক মনের রস-পিপাসা নিবৃত্তির একটি প্রকৃষ্ট কাব্যপন্থা মিলিয়াছে, অথচ এই প্রতিভার উদ্বোধন করিয়াছে প্রাচীন ভারতের সেই ভাব-মন্ত্র। যে ভাব-মন্ত্রের সাধনায় রূপ কখনও প্রাধান্য লাভ করে নাই, যাহা প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়ানুভূতির ক্ষেত্রে অন্তর ও বাহিরের যোগ-সাধনায় তৎপর হয় নাই, যে মন্ত্রের সাধনায় কখনও কোন কবি-সাধক বস্তুজগতের রূপে তন্ময় হইয়া এই জীবনের সমস্যাকেই রসোজ্জ্বল করিয়া তোলে নাই, রবীন্দ্র-প্রতিভার যৌবন-কালে সেই মন্ত্রই কাব্যসাধনার অনুকূল হইয়াছিল। যাহা এতকাল তত্ত্ব ছিল তাহাই রসরূপে ধরা দিয়াছিল। আধুনিক মানুষের রস-পিপাসায় জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে যে প্রশ্ন-কাতরতা আছে তাহার নিবৃত্তি এইরূপ কাব্যসাধনাতেই সম্ভব। যে আধুনিক জীবন-জিজ্ঞাসা পশ্চিমের কাব্যকে আক্রমণ করিয়াছে রবীন্দ্রনাথ তাহারই সম্মুখে তাঁহার কাব্যের ভিত্তি অকুতোভয়ে স্থাপনা করিয়াছিলেন; তাঁহার কাব্যে তখনও বস্তু বা ভাবের কোনটাই নিরতিশয় প্রাধান্য লাভ করে নাই—বাস্তব হইতে পলায়ন করিয়া ভাবের দুর্গম দুর্গে আশ্রয় লইবার প্রয়োজন তখনও ঘটে নাই। রূপের জগতেই ভাবের সাম্য রক্ষা করিয়া, একসঙ্গে রস-পিপাসা ও বস্তু-জিজ্ঞাসা চরিতার্থ করাই আধুনিক কবির শ্রেষ্ঠ সাধনা। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভায় সেই সাধনাই জয়যুক্ত হইয়াছিল। আধুনিক য়ুরোপীয় রসের অভিব্যক্তি হইয়াছে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সাধনার এই বৈশিষ্ট্য কেবল কাব্যসৃষ্টিতেই প্রকাশ পায় নাই—তিনি তাঁহার কাব্য-মন্ত্রের সুস্পষ্ট নির্দ্দেশ, তাঁহার এই কবিধর্ম্মের আনন্দ-উল্লাস, বহুবার বহুবিধভাবে জ্ঞাপন করিয়াছেন। আমরা তাহা বুঝিতে চাহি নাই।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবি-জীবনের এই পূর্ব্বার্দ্ধভাগের, বা পূর্ণযৌবনের সাধনা তাঁহার উত্তর জীবনের সাধনার দ্বারা আপাততঃ আচ্ছন্ন হইয়া আছে। যাঁহারা আদি হইতে আজ পর্য্যন্ত, রবীন্দ্রনাথের এই দীর্ঘ কাব্য সাধনায় তাঁহার কল্পনার নিত্যনব ভঙ্গিকে একই কবিব্যক্তির মানস-পরিণতির বিভিন্ন স্তর-বিকাশ মনে করিয়া আশ্বস্ত হন, তাঁহাদের সঙ্গে এই হিসাবে আমার মত-বিরোধ নাই যে, সে ক্ষেত্রে কাব্যই মুখ্য নয়, কবি-মানসই মুখ্য—সে বিচারের ক্ষেত্রই স্বতন্ত্র। কিন্তু যেখানে কাব্য—বিচারই মুখ্য-উদ্দেশ্য সেখানে কাব্যের উপরে কবিকে স্থান দেওয়া কখনই সঙ্গত হইতে পারে না। আধুনিক কালের কাব্য-সমালোচনায় গীতিকাব্যের আদর্শই অতিরিক্ত প্রাধান্য লাভ করায়, কাব্যরস অপেক্ষা কবি-মানসই আলোচনার মুখ্য বিষয় বলিয়া বিবেচিত হয়। ইহাও আর একদিকে অতিচার। সংস্কৃত আলঙ্কারিকের কাব্য-বিচারে যেমন কবি-মানসের কোন স্থান ছিল না—তেমনই আধুনিক কাব্যবিচারে যদি কবি-মানসই সকল স্থান জুড়িয়া বসে, তবে কাব্য যে বস্তুকে ছাড়িয়া একেবারে ভাবের তুরীয়-লোকে রঙ্গীন ছায়া-রচনা হইয়া দাঁড়াইতে পারে, তাহা বোধ হয় কোন সত্যকার কাব্য-রসিক অস্বীকার করিবেন না। রবীন্দ্রনাথের কবি-প্রতিভার কৃতিত্ব-আলোচনায় আমি তাঁহার কাব্যে ভাব ও রূপের যে অভিনব সমন্বয়ের কথা বলিয়াছি তাহা আপনারা স্মরণ করিবেন; অথবা, আধুনিক যুগের কাব্য সাধনায় যে সমস্যার উল্লেখ করিয়াছি, তাহাও স্মরণ করিতে বলি। এ প্রবন্ধে কাব্যের আদর্শ সম্বন্ধে পৃথক আলোচনার অবকাশ নাই, তথাপি প্রসঙ্গক্রমে আমি এ সম্বন্ধে যে ধারণা ব্যক্ত করিয়াছি, আশা করি সুধীজন তাহা আগ্রাহ্য করিবেন না। কিন্তু যাহা বলিতেছিলাম। রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রভাবে আমাদের কাব্যবুদ্ধি স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছে, এই হত-চেতনার একটি প্রমাণ—রবীন্দ্রনাথের পূর্ব্বতন কবি-কীর্ত্তির পরিচয় আজকাল বড় কেহ রাখে না। বর্তমানে রবীন্দ্রনাথ যে ধরণের ভাব-সাধনায় নিমগ্ন আছেন, ভাষা ও ছন্দের ভিতর দিয়া তাহার যে সুর আমাদের কানে বাজিতে থাকে—বুঝি বা না বুঝি, চক্ষু মুদিয়া আমরা তাহারই রসাস্বাদনের ভান করি। এ সাধনার সঙ্গে আধুনিক কাব্যে এই প্রশ্ন-কাতরতা নিবারণের যত উপায় দেখা দিয়াছে তাহার কোনটিতেই কবি-কল্পনা সম্পূর্ণ জয়যুক্ত হইতে পারে নাই; এমন কি, ক্ষেত্রবিশেষে কাব্য স্ব-ধৰ্ম্ম ছাড়িয়া বিধৰ্ম্মের সাধনা করিয়াছে-কবি-কল্পনা রূপ হইতে অরূপে ফিরিবার প্রয়াসও করিয়াছে। এককালে য়ুরোপীয় কাব্যে আধুনিক মন যে ভাব-মন্ত্রের সাধনা করিয়াছিল, পরবর্ত্তী যুগের জ্ঞানবিষ-জর্জরিত ইংরেজ কবি তাহাতে সংশয়-মুক্ত হইতে পারেন নাই, তাই শেক্সপীয়ারের কবি-প্রতিভার উদ্দেশে তিনি হতাশভাবে বলিয়াছিলেন—
“Others abide our question-Thou art free!
We ask and ask-Thou smilest and art still,
Out-topping knowledge”.
শেক্সপীয়ারের কল্পনা যে-ভূমিতে আরোহণ করিয়াছে, সেখানে সকল জিজ্ঞাসা স্তম্ভিত, সে প্রজ্ঞা জ্ঞানকেও অতিক্রম করে। তাই ম্যাথু আর্ণল্ড শেপীয়ারের সেই উত্তুঙ্গ কবি-সিংহাসনের পানে চাহিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস মোচন করিয়াছিলেন। কিন্তু শেকসপীয়ারের এই সিদ্ধিলাভ ত’ অরূপ-সাধনায় ঘটে নাই—এতবড় রূপ-স্রষ্টা কবি আর কে জন্মিয়াছে! আর কে এমন করিয়া নিজে নির্ব্বাক্ থাকিয়া জগৎ-রঙ্গমঞ্চের দৃশ্যগুলি কেবলমাত্র উদঘাটন করিয়া দেখাইয়াছে? শেকসপীয়ারের মত নির্লিপ্ত নির্ব্বিকার বাস্তবজয়ী বস্তু-কল্পনা এ যুগে সম্ভব নয়; তথাপি শেকসপীয়ারের কাব্যসিদ্ধির দৃষ্টান্তে আমরা কাব্য সাধনার স্বরূপ সম্বন্ধে নিঃসংশয় হইয়াছি। এই বহির্জগৎ—এই সৃষ্টির মধ্যেই যে কল্পনা আপনাকে মুক্তি দিয়া যেন এক প্রকার বিশ্ব-চেতনার সঙ্গে আত্ম-চেতনা মিলাইয়া, সর্ব্ব-বিরোধ ও সর্ব্ব-বৈচিত্র্যের তীব্র তীক্ষ্ণ অনুভূতিকেই দ্বন্দ্বাতীত করিয়া তোলে, তাহাই উৎকৃষ্ট কবি-কল্পনা। আধুনিক—কাব্যের কবিকর্ম্ম আরও দুরূহ; এখনকার কালে কাব্যরসের আস্বাদনে এইরূপ আত্ম-বিলোপ অতিশয় দুঃসাধ্য, কারণ, তীব্রতর জগৎ-চেতনার ফলে এখন আত্ম—চেতনাও দুৰ্দ্ধৰ্ষ হইয়া উঠিয়াছে। তথাপি কবিকে কাব্যসৃষ্টি করিতে হইলে সেই চিরন্তন দ্বন্দ্বকেই অন্য উপায়ে উত্তীর্ণ হইতে হইবে; ভাবকে রূপের অধীন করিতে না পারিয়া কেবল রূপকে ভাবের অধীন করিলেই চলিবে না; য়ুরোপীয় কাব্যে সে পরীক্ষাও হইয়া গিয়াছে। এখন একমাত্র পন্থা—এই সজ্ঞান দ্বৈতের মধ্যেই অদ্বৈতের প্রতিষ্ঠা। রবীন্দ্রনাথের কাব্যে এককালে কবি-কল্পনার এই লীলাই আমরা দেখিয়াছি—সেখানে ভাব ও রূপের সাযুজ্য-সাধনে এক অপূৰ্ব্ব জীবন-চেতনার সহজ সম্পর্ক নাই, এবং উহার অন্তর্গত প্রেরণা খাঁটি কবি-কল্পনার অনুকূল নয়। তথাপি এই সঙ্গীতের মোহিনী-শক্তি অগ্রাহ্য করিবার নয়; তাই আধুনিকতম বাংলাসাহিত্যে একদিকে অস্পষ্ট ভাবের ঘোর এবং অপরদিকে তাহারই বিরুদ্ধে বিকৃত মানস—বিলাস প্রকট হইয়া উঠিয়াছে। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সাহিত্য-সাধনার গতি-প্রকৃতি যদি আমরা বুঝিতে পারিতাম, তাঁহার কবি-জীবনের আদি, মধ্য ও অন্তকে—সাহিত্যের আদর্শ ও তাঁহার ব্যক্তিগত সাধনার আদর্শ, এই উভয় আদর্শে—সম্পূর্ণভাবে বুঝিয়া লইবার সামর্থ্য যদি আমাদের থাকিত, তবে আমাদের সাহিত্যবোধ আরও সজাগ ও সজীব হইয়া উঠিত। কিন্তু তাঁহাকে কোন দিক দিয়াই আমরা বুঝি নাই। আধুনিক কালে সাহিত্যের যে আদর্শ, রসসৃষ্টির যে রহস্য, কাব্য-বিচারে যে নূতন সমস্যার সমাধান দাবি করিতেছে, রবীন্দ্রনাথের কবি-কীর্তির মধ্যে সেই সমস্যা পুরামাত্রায় বিদ্যমান; তাহার বিচারেও সেই রহস্যের সন্ধান, সেই আদর্শের প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। কিন্তু আমরা এই সাহিত্য-ধৰ্ম্মকে এখনও স্বীকার করি না, তাই রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাকে যথার্থভাবে বরণ করিয়া লইতে পারি নাই। এতকাল পরে এযুগেও কেহ কেহ যেভাবে কাব্য-জিজ্ঞাসা আরম্ভ করিয়াছেন তাহাকে, কাব্য-পরিমিতি কেন কাব্য-জ্যামিতি বলাও চলে। সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রের সূত্র অনুসারে তাঁহারা যে ভাবে রবীন্দ্র-কাব্যের রস-প্রমাণে যত্নবান হইয়াছেন তাহাতে বুঝা যায়—শুধুই রবীন্দ্র-সাহিত্য নয়, সকল আধুনিক সাহিত্যের রসাস্বাদে তাঁহারা এখনও পরাঙ্মখ।
রবীন্দ্রনাথের এমন দিব্য-প্রতিভাও যে এ যুগে বাঙালীর সাহিত্যিক-জীবনে আশানুরূপ শক্তি সঞ্চার করিতে পারিল না, ইহার কারণ অনুসন্ধান করিতে হইলে শুধুই রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাধনার ধারা বা তাঁহার কবি-মানসের পরিচয় করিলেই হইবে না, সেই সঙ্গে, বাঙালীর জীবন, তাহার শিক্ষা-দীক্ষা ও সাধারণ সংস্কৃতির কথা ভাবিয়া দেখিতে হয়। তাহা হইলে দেখা যাইবে, এই দুর্ভাগ্যের জন্য রবীন্দ্র—প্রতিভার গৌরবহানি হয় না। বাংলাসাহিত্যে তিনি যাহা দিয়াছেন—তাঁহার স্বতন্ত্র—সাধনা সত্ত্বেও, তিনি বাঙালী ও বাংলাভাষার জন্য যাহা করিয়াছেন, তাহার মূল্য বুঝিবার শক্তি যে তাহার নাই—ইহাও তাহার কম দুর্ভাগ্য নয়। আর একদিক দিয়া দেখিলে রবীন্দ্র-প্রতিভার গৌরবে বাঙালীর গৌরবান্বিত হইবার যথেষ্ট কারণ আছে। রবীন্দ্রনাথের কল্পনা, শুধু বাংলাদেশের কেন—বর্ত্তমান জগতের যুগ-প্রয়োজনে বাধ্য না হইয়া ভূত-ভবিষ্যৎ-বৰ্ত্তমান-বিসর্গী এক সার্বভৌমিক রস-প্রতিষ্ঠার সাধনা করিয়াছে—সে সাধনায় ভারতীয় অধ্যাত্মদৃষ্টি তাঁহার সহায় হইয়াছে। তথাপি এ সাধনায় যেমন একটি সুমহান্ আধ্যাত্মিক আদর্শ পরিস্ফুট হইয়াছে, ইহার প্রভাবে যেমন কূপ-মন্ডুক মহাসাগর-দর্শনের অধিকারী হয়, ইহা যেমন বাঙালীর মানস—মুক্তির একটি চিরস্থায়ী উপায় হইয়া থাকিবে, তেমনই, –দুঃখের বিষয় যে, ইহা তাহার বর্তমান দেহ-দশায় তাহার দুর্ব্বল প্রাণ-ধর্ম্মের পক্ষে উপযুক্ত পথ্য নয়; ইহাকে পরিপাক করিবার শক্তি তাহার নাই। রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাধনায় যে নূতন রস সৃষ্টির পরিচয় আছে তাহার স্বরূপ-নির্ণয় আমার মত ব্যক্তির সাধ্যায়ত্ত নয়; বাঙালী যদি বাঁচিয়া থাকে, যদি তাহার দেহ-মন-প্রাণ নবজীবনে সঞ্জীবিত হইয়া সত্য-সুন্দরের সাধনায় পূর্ণ শক্তি লাভ করে, তবে একদিন আমার প্রাণের এই ক্ষীণ প্রতিধ্বনির পরিবর্তে এ যুগের এই মহাকবির শ্রদ্ধা-তর্পণে বহুকণ্ঠের বিশুদ্ধতর মন্ত্রোচ্চারণ শোনা যাইবে। বিশ্বসাহিত্যের উদার প্রাঙ্গণে ভবিষ্য-কালের বিচারেও রবীন্দ্র-প্রতিভার মূল্য নির্ধারিত হইবে। আমার এমনও মনে হয় যে, এতকাল কবি-প্রেরণা যে পথে রসসৃষ্টি করিতেছিল তাহার মূলমন্ত্র যেমন শেপীয়ারের নাটকীয় কল্পনাতেই চূড়ান্ত সিদ্ধিলাভ করিয়াছে, তেমনই কাব্য-সাধনার যে আর এক পন্থা য়ুরোপীয় সাহিত্যে সূচিত হইয়াছে, যাহা ডাহিনে বামে নানা ভঙ্গিতে নানাদিকে আজও অগ্রসর হইয়া চলিতেছে— কাব্যসাধনার সেই পন্থায় যে চূড়ান্ত—সিদ্ধির সম্ভাবনা আছে, রবীন্দ্রনাথের ভারতীয় ভাবকল্পনা হয় ত তাহাতেও শক্তি সঞ্চার করিবে; প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সেই পূর্ণমিলন-মন্ত্রের উদগাতারূপেই বোধ হয় রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা সার্থক হইবে। সাহিত্যের সে রূপ এখনও সম্পূর্ণ হয় নাই—রবীন্দ্রনাথও সে সাহিত্যের মন্ত্রদ্রষ্টা মাত্র, রূপস্রষ্টা নহেন। য়ুরোপের রূপ—বাদ ও ভারতের ভাব-বাদ রবীন্দ্র-সাহিত্যে যেটুকু সমন্বয়ের অবকাশ পাইয়াছে, তাহাতেও মোটের উপর এ পর্যন্ত ভাবের প্রাধান্যই অধিক; তথাপি, কাব্যরস—পিপাসার সঙ্গে জগৎ-জিজ্ঞাসার যে অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ আধুনিক কালে উত্তরোত্তর প্রবল হওয়াই স্বাভাবিক, সেই অতিশয় আত্মসচেতন ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য-মূলক কল্পনাই এ পর্যন্ত আর কোথাও এমন বিশ্বাত্মীয়তার রসে পৌঁছিতে পারে নাই। এদিক দিয়া চিন্তা করিলে য়ুরোপই এ মার্গের নিকটতর অধিকারী—দেশের তুলনায় বিদেশে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত আদর যে অধিক, তাহা ক্ষোভের বিষয় হইলেও আশ্চর্য্যের বিষয় নয়। রবীন্দ্র-সাহিত্যের রসভূমিতে আরোহণ করিবার পূর্ব্বে বাঙালীকে এখনও অন্যতর মন্ত্রের সাধনা করিতে হইবে। রূপ-সাধনা না করিয়া ভাব-সাধনার গহন পন্থায় প্রবেশ করিবার আকাঙ্ক্ষা আজিকার অবস্থায় বাঙালীর পক্ষে সত্যও নহে, স্বাভাবিকও নহে। রবীন্দ্র-প্রতিভার মূলমর্ম্ম বুঝিতে না পারিয়া তাহার অনুকরণ করিলে, অথবা তাহার প্রতি আক্রোশ করিয়া সাহিত্যের চিরন্তন আদর্শকে ক্ষুণ্ণ করিলে বাংলাসাহিত্যের অপমৃত্যু ঘটিবে। এ সঙ্কট হইতে পরিত্রাণ-লাভের একমাত্র উপায়—রবীন্দ্র-সাহিত্যের সহিত বাঙালীর ঘনিষ্ঠতর পরিচয়-সাধনের চেষ্টা; এবং য়ুরোপীয় সাহিত্যের আধুনিকতম রূপটিকেই চরম আদর্শ মনে না করিয়া, সকল কালের সাহিত্য হইতে সাহিত্যের স্বরূপ ও স্বধর্ম্মকে উদ্ধার করিয়া উদার রসবোধের প্রতিষ্ঠা করা। তবেই বাংলাসাহিত্যে বাঙালীর প্রকৃত মানস-মুক্তি ঘটিবে, তখন রবীন্দ্র-সাহিত্যের দুর্লভ সম্পদকে আমরা আত্মসাৎ করিতে পারিব—সে প্রতিভার গৌরবে আমরা যথার্থ গৌরবান্বিত হইতে পারিব।
পৌষ, ১৩৩৮