রবি-পুরাণ

রবি-পুরাণ

রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে প্রচুর বক্তৃতা প্রচুরতর প্রবন্ধ এবং অল্প-বিস্তর বেতার কার্যকলাপের ব্যবস্থা এদেশের গুণী-জ্ঞানীরা করে থাকেন। সেই অবসরে কেউ কেউ আমাকেও স্মরণ করেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে এঁরা আমার কল্যাণ কামনা করেন; সরল জনের পক্ষে অনুমান করা অসম্ভব নয় যে এই করে হয়তো দেশে আমার নামটা কিঞ্চিৎ ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু আসলে যারা আমাকে স্মরণ করেন তাঁরা আমার প্রাণের বৈরী। এঁরা আমাকে সর্বজনসমক্ষে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলতে চান, ‘দেখো, এ লোকটা কত বড় গণ্ডমূর্খ; কবিগুরুর সংস্পর্শে এসেও এর কিছু হল না।’ সাধে কি আর তুলসীদাস রামচরিতমানসে বলেছেন,

‘মূরখ হৃদয় ন চেৎ, যদপি মিলয়ে
গুরু বিরিঞ্চি শত’
 ‘শত ব্রহ্মা গুরুপদ নিলেও মূর্খের ক
হৃদয়ে চেতনা হয় না’

 আমি মূর্খ হতে পারি কিন্তু এতখানি মূর্খ নই যে তাঁদের দুষ্টবুদ্ধিজাত নষ্টামির চিন্তা ধরতে পারব না।

তাই ওই সময়টায় আমি গা-ঢাকা দিয়ে থাকি। নিতান্ত কারও সঙ্গে দেখা হলে বলি, এনৃজাইনা থ্রম্বোসিস হয়েছে। এনজাইনা পিক্টরিস কিংবা করোনারি থ্রম্বোসিস-এর যে-কোনও একটার নাম শুনলেই সুস্থ মানুষের হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম করে– আমার ওই দ্বন্দ্বসমাস শুনে আমাকে তখন আর কেউ বড় একটা ঘ্যাঁটায় না।

অথচ রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে দু একটি কথা বলবার সাধ যে আমার হয় না, তা-ও নয়। অবশ্য তাঁর কাব্য, নাট্য কিংবা জীবনদর্শন সম্বন্ধে নয়। অতখানি কাণ্ডজ্ঞান বা কমনসেনস্ আমার আছে। আমার বলতে ইচ্ছে করে সেই জিনিস, ইংরেজিতে যাকে বলে লাইটার সাইড। এই যেমন মনে করুন, তিনি গল্পগুজব করতে ভালোবাসতেন কি না, প্রিয়জনের সঙ্গে হাস্যপরিহাস করতেন কি না, ডাইনিঙ-রুমে বসে চেয়ার টেবিলে ছুরিকাঁটা দিয়ে ছিমছামভাবে সায়েবি কায়দায় খেতেন, না রান্নাঘরের বারান্দায় হাপুস-হুঁপুস শব্দে মাদ্রাজি স্টাইলে পাড়া সচকিত করে পর্বটি সমাধান করে সর্বশেষে কাবুলি কায়দায় ঘোঁতঘোঁত করে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বাঙালি কায়দায় চটি ফটফটিয়ে খড়কের সন্ধানে বেরোতেন? কেউ তাঁকে প্রেমপত্র লিখলে তিনি কী করতেন? কিংবা ডিহি শ্রীরামপুর দুই নম্বর বাই লেন তাদের কম্বল বিতরণী সভায় তাঁকে প্রধান অতিথি করার জন্য ঝুলাঝুলি লাগালে তিনি সেটা এড়াবার জন্য কোন পন্থা অবলম্বন করতেন? কিংবা কেউ টাকা ধার চাইলে?

ভালোই হল টাকা ধারের কথা মনে পড়ল।

 ‘দেহলী’র উপরে থাকতেন তিনি, নিচের তলায় তাঁর নাতি দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ওরফে দিনুবাবু।

তাঁরই বারান্দায় বসে আশ-কথা-পাশ-কথা নানা কথা হচ্ছে। হতে হতে টাকা ধার নেওয়ার কথা উঠল। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘বুঝলি দিনু, আমার কাছ থেকে একবার একজন লোক দশ টাকা ধার নিয়ে গদগদ কণ্ঠে বলল, আপনার কাছে আমি চিরঋণী হয়ে রইলুম।’ সভায় যারা ছিলেন তাঁরা পয়েন্টটা ঠিক কী বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলেন। আফটার অল, গুরুদেবের পক্ষেও কালে-কম্মিনে কাঁচা রসিকতা করা অসম্ভব না-ও হতে পারে।

খানিকক্ষণ পরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শুরুদেব বললেন, ‘লোকটার শত-দোষ থাকলেও একটা গুণ ছিল। লোকটা সত্যভাষী! কথা ঠিক রেখেছিল। চিরঋণী হয়েই রইল।’

শ্ৰীযুত বিধুশেখর শাস্ত্রী, নেপালচন্দ্র রায় ইত্যাদি মুরুব্বিরা অট্টহাস্য করেছিলেন। আমরা, অর্থাৎ চ্যাংড়ারা, থামের আড়ালে ফিকফিক করেছিলুম।

এ গল্পটি আমি একাধিক লোকের মারফত পরেও শুনেছি। হয়তো তিনি গল্পটি একাধিক সভা-মজলিসে বলেছেন। এবং গল্পটি আদৌ তার নিজের বানানো না অন্যের কাছ থেকে ধার-নেওয়া সেকথাও হলফ করে বলতে পারব না। কারণ কাব্যানুশাসনের টীকা লিখতে গিয়ে আলঙ্কারিক হেমচন্দ্র বলেছেন, ‘নাস্ত্য চৌরঃ কবিজন নাস্ত্য চৌরো বণিকজনঃ;–অর্থাৎ ‘বড় বিদ্যাটি বিলক্ষণ রপ্ত আছে স্যাকরার এবং কবি মাত্রেরই।’

তা হোক। মহাকবি হাইনরি হাইনে তাতে কণামাত্র আপত্তি না তুলে বলেছেন, ‘যারা কবির রচনাতে “নির্ভেজাল” অরিজিনালিটি খোঁজে তারা চিবাক মাকড়ের জাল, কারণ একমাত্র মাকড়ই তার জালটি তৈরি করে আপন পেটের মাল দিয়ে, মোল আনা অরিজিনাল; আমি কিন্তু খেতে ভালোবাসি মধু, যদিও বেশ ভালোভাবেই জানি মধুভাণ্ডের প্রতিটি ফোঁটা ফুলের কাছ থেকে চোরাই করা মাল।’

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে প্রচলিত গল্পের ভিতর আমার সবচেয়ে ভালো লাগে ‘গুরুদেব-ভাণ্ডারে’ কাহিনী! অবশ্য আমার মনে হয়, গল্পটির নাম ‘ভাণ্ডারে গুরুদেব’ কাহিনী দিলে ভালো হয়, কারণ কাহিনীটি সম্পূর্ণ নির্ভর করছে, ভাণ্ডারের একটি সৎকর্মের ওপর। তুলনা দিয়ে বলতে পারি, অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু যখন তাঁর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার জগজ্জন সম্মুখে প্রকাশ করলেন তখন কালা আদমির কেরানি বরদাস্ত না করতে পেরে ইংরেজ আবিষ্কারটার নামকরণ করল ‘আইনস্টাইন-বোস থিয়রি’। স্বয়ং আইনস্টাইন তখন নাকি প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, ওটার নাম হয় হবে শুধুমাত্র ‘বোস থিয়রি’ নয় ‘বোস-আইনস্টাইন থিয়রি’। এসব অবশ্য আমাদের শোনা কথা। ভুল হলে পুজোর বাজারের বিলাস বলে ধরে নেবেন।

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাধারা ইংরেজ পছন্দ করত না বলে শান্তিনিকেতন আশ্রমটিকে নষ্ট করার জন্য ইংরেজ একটি সূক্ষ্ম গুজব বাজারে ছড়ায়– শান্তিনিকেতনের স্কুল আসলে রিফরমেটরি। অন্তত এই আমার বিশ্বাস।

খুব সম্ভব তারই ফলে আশ্রমে মারাঠি ছেলে ভাণ্ডারের উদয়।

স্কুলের মধ্য বিভাগে বীথিকা-ঘরে ভাণ্ডারে সিট পেল। এ ঘরটি এখন আর নেই, তবে ভিতটি স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। তারই সমুখ দিয়ে গেছে শালবীথি। তারই একপ্রান্তে লাইব্রেরি, অন্যপ্রান্তে দেহলী। গুরুদেব তখন থাকতেন দেহলীতে।

দেহলী থেকে বেরিয়ে, শালবীথি হয়ে গুরুদেব চলেছেন লাইব্রেরির দিকে। পরনে লম্বা জোব্বা, মাথায় কালো টুপি। ভাণ্ডারে দেখামাত্রই ছুটল তাঁর দিকে। আর সব ছেলেরা অবাক। ছোকরা আশ্রমে এসেছে দশ মিনিট হয় কি না হয়। এরই মধ্যে কাউকে কিছু ভালো-মন্দ না শুধিয়ে ছুটল গুরুদেবের দিকে।

আড়াল থেকে সবাই দেখল ভাণ্ডারে গুরুদেবকে কী যেন একটা বলল। গুরুদেব মৃদুহাস্য করলেন। মনে হল যেন অল্প অল্প আপত্তি জানাচ্ছেন। ভাণ্ডারে চাপ দিচ্ছে। শেষটায় ভাণ্ডারে গুরুদেবের হাতে কী একটা গুঁজে দিল। গুরুদেব আবার মৃদু হাস্য করে জোব্বার নিচে হাত চালিয়ে ভিতরের জেবে সেটি রেখে দিলেন। ভাণ্ডারে একগাল হেসে ডরমিটরিতে ফিরে এল। প্রণাম না, নমস্কার পর্যন্ত না।

সবাই শুধাল, ‘গুরুদেবকে কী দিলি?’

 ভাণ্ডারে তার মারাঠি-হিন্দিতে বলল, ‘গুরুদেব কৌন? ওহ তো দরবেশ হৈ।’

‘বলিস কী রে, ও তো গুরুদেব হ্যায়!’

 ‘ক্যা “গুরুদেব” “গুরুদেব” কর তা হৈ। হম উসকো এক অঠন্নি দিয়া।’

 বলে কী? মাথা খারাপ না বদ্ধপাগল? শুরুদেবকে আধুলি দিয়েছে!

 জিগ্যেসাবাদ করে জানা গেল, দেশ ছাড়ার সময় ভাণ্ডারের ঠাকুরমা তাকে নাকি উপদেশ দিয়েছেন, সন্ন্যাসী-দরবেশকে দানদক্ষিণা করতে। ভাণ্ডারে তাঁরই কথামতো দরবেশকে একটি আধুলি দিয়েছে। তবে হ্যাঁ, দরবেশ বাবাজি প্রথমটায় একটু আপত্তি জানিয়েছিল বটে, কিন্তু ভাণ্ডারে চালাক ছোকরা, সহজে দমে না, চালাকি নয়, বাবা, এ একটি পুরি অঠন্নি!

চল্লিশ বছরের আগের কথা। অঠন্নি সামান্য পয়সা, একথা কেউ বলেনি। কিন্তু ভাণ্ডারেকে এটা কিছুতেই বোঝানো গেল না যে তার দানের পাত্র দরবেশ নয়, স্বয়ং গুরুদেব।

ভাণ্ডারের ভুল ভাঙতে কতদিন লেগেছিল, আশ্রম পুরাণ এ বিষয়ে নীরব। কিন্তু সেটা এস্থলে অবান্তর।

ইতোমধ্যে ভাণ্ডারে তার স্বরূপ প্রকাশ করেছে। ছেলেরা অস্থির, মাস্টাররা জ্বালাতন, চতুর্দিকে পরিত্রাহি আৰ্তরব।

হেডমাস্টার জগদানন্দবাবু এককালে রবীন্দ্রনাথের জমিদারি-সেরেস্তায় কাজ করেছিলেন। লেঠেল ঠ্যাঙানো ছিল তাঁর প্রধান কর্ম। তিনি পর্যন্ত এই দুঁদে ছেলের সামনে হার মেনে গুরুদেবকে জানালেন।

আশ্রম-স্মৃতি বলেন, গুরুদেব ভাণ্ডারেকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ-রে, ভাণ্ডারে, এ কী কথা শুনি?’

ভাণ্ডারে চুপ।

শুরুদেব নাকি কাতর নয়নে বললেন, ‘হ্যাঁরে ভাণ্ডারে, শেষপর্যন্ত তুই এসব আরম্ভ করলি? তোর মতো ভালো ছেলে আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। আর তুই এখন আরম্ভ করলি

এমন সব জিনিস যার জন্য সক্কলের সামনে আমাকে মাথা নিচু করতে হচ্ছে। মনে আছে, তুই যখন প্রথম এলি তখন কীরকম ভালো ছেলে ছিলি? মনে নেই, তুই দান-খয়রাত পর্যন্ত করতিস? আমাকে পর্যন্ত তুই একটি পুরো আধুলি দিয়েছিলি? আজ পর্যন্ত কত ছাত্র এল-গেল, কেউ আমাকে একটি পয়সা পর্যন্ত দেয়নি। সেই আধুলিটি আমি কত যত্নে তুলে রেখেছি। দেখবি?’

***

তার দু এক বৎসরের পর আমি শান্তিনিকেতনে আসি। মারাঠি সঙ্গীতজ্ঞ স্বর্গীয় ভীমরাও শাস্ত্রী তখন সকালবেলার বৈতালিক লিড করতেন। তার কিছুদিন পর শ্ৰীযুত অনাদি দস্তিদার। তার পর ভাণ্ডারে।

চল্লিশ বছর হয়ে গিয়েছে। এখনও যেন দেখতে পাই ছোকরা ভাণ্ডারে বৈতালিকে গাইছে,

এ দিন আজি কোন ঘরে গো
খুলে দিল দ্বার।
আজি প্ৰাতে সূর্য ওঠা
সফল হল কার ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *