রবির কুকুর
কী ওরা খাওয়াল কুকুরটাকে কে জানে, কুকুরটার হঠাৎ ডাক বন্ধ হয়ে গেল।
আট বছরের পোষা কুকুর, বাইরের কোনো লোক খাবার দিলে সাধারণত খায়ও না। তবুও ও খেল কেন? খাবারটাও তাহলে এমন কিছু ছিল, যাতে কোনো কুকুর লোভ সামলাতে পারে না।
এসেছিল তিনজন লোক। একজন কুকুরটাকে সামলেছে, আর দু’জন পেছনের বাগান দিয়ে ঢুকে রেলিং বেয়ে দোতলার বারান্দায় উঠেছে। যে দুটো ঘরে অন্য সবাই ঘুমোয়, সে—দুটো ঘরের দরজাই বন্ধ করে দিয়েছে বাইরে থেকে। কোণের ঘরটায় ঘুমোন শুধু বাবা একা। তাঁর মাথার কাছে টেবিলের দেরাজে থাকে রিভলভার। শুধু চোর—ডাকাতের ভয় নয়, এই জায়গাটাতে খুব সাপ আর নেকড়ে বাঘের উপদ্রব। মাত্র দু’মাস আগে তিনি এখানে বদলি হয়ে এসেছেন। পাহাড়ী জায়গা, খুব কাছেই জঙ্গল।
একটা আওয়াজ পেয়ে বাবার ঘুম ভেঙে গেল। উনি পাশ ফিরে চোখ মেলতেই জোরাল টর্চের আলো পড়ল তাঁর মুখে। একজন কেউ হিস হিস করে বলল, চুপ। একটু নড়লেই একেবারে খতম করে দেব! বাবা তবু মাথার দিকে হাত বাড়ালেন। তখনই ওদের কেউ কোনো একটা ভারী জিনিস দিয়ে বাবার মাথায় মারল।
তাতে বাবা জ্ঞান হারালেন না বটে, তবু অজ্ঞান হবার ভান করে রইলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে আর কিছু করতে গেলে ওরা তাঁকে মেরেই ফেলবে। সেই অবস্থাতেও বাবা ভাবতে লাগলেন, কুকুরটা কোথায়? অত বিশ্বাসী কুকুর!
বাবা টের পেলেন, ওরা আলমারি খুলে অনেক কিছু বার করে নিচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি ওরা কাজ সেরে বেরিয়ে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে বাবা ধড়মড় করে উঠে দেরাজে হাত ঢোকালেন। সেটা খালি। রিভলভারটাও ওরা আগেই নিয়েছে।
তিনি ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে দেখলেন দরজা বন্ধ।
একবার ভাবলেন চোর চোর বলে চ্যাঁচাবেন। তারপরই ভাবলেন, ওদের কাছে রিভলভার আছে। যদি ফিরে এসে গুলি করে।
অসহায়ভাবে চুপ করে রইলেন তিনি।
টের পেলেন বাগানে ওদের পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সব চুপচাপ হয়ে গেলে তিনি দরজায় দুম দুম করে ধাক্কা দিত লাগলেন।
নীচের তলায় একজন কাজের লোক আর একজন রান্নার লোক থাকে। দু’জনেই ঘুমোয় কুম্ভকর্ণের মতন। অনেকক্ষণ পরে আওয়াজ পেয়ে তারা ওপরে উঠে এল।
ততক্ষণে ডাকাতরা চলে গেছে অনেক দূরে।
বাব দারুণ সাহসী আর গোঁয়ার। সেই রাত্রেই তিনি থানায় খবর দিতে চান। থানা এখান থেকে তিন মাইল দূরে। বাবার জিপ—গাড়ি আছে।
মা কান্নাকাটি করতে লাগলেন।
জিনিসপত্র যা যাবার তো গেছেই, কিন্তু ওরা সাংঘাতিক ডাকাত। যদি কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে থাকে? যদি জিপ—গাড়ি দেখে গুলি চালায়!
বাবার মাথার চুলের একপাশে রক্ত জমে আছে, ওরা লোহার ডাণ্ডা দিয়ে মেরেছে।
রবি ঘুম ভেঙে প্রথমে কিছু বুঝতেই পারেনি। তাদের বাড়িতে ডাকাত এসেছিল? ডাকাত কী রকম দেখতে? হাতে স্টেনগান ছিল? মাথায় পাগড়ি বাঁধা ছিল? ইস, একটুর জন্যে ডাকাত দেখা হলো না।
বাবা বললেন, রবি, তোর কুকুর কী করছ দ্যাখ তো, একবারও তার সাড়া পেলুম না।
রবির কুকুর ভুলুকে রাত্তিরবেলা ছেড়ে রাখা হয়। সারা রাত্তির সে ইচ্ছামতন বাড়ির মধ্যে কিংবা বাগানে ঘোরে। সত্যিই তো, ভুলু থাকতে বাড়িতে ডাকাত এল কী করে? কোথায় ভুলু?
দেখা গেল, বাগানের মাঝখানে ভুলু অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
রবি গায়ে ঠেলা দিয়ে ডাকল কয়েকবার। তবু সে চোখ মেলে না। তাহলে কি ভুলু মরে গেছে?
রবির প্রায় কেঁদে ফেলার মতন অবস্থা।
রান্নার ঠাকুর ভব এসে বলল, ও খোকাবাবু, ভুলু মরেনি, ওকে বাণ মেরেচে।
বাণ মানে তীর, কিন্তু ভুলুর গায়ে তো কোনো তীর বিঁধে নেই।
ভব বলল, এ হলো অদৃশ্য বাণ। মন্ত্র দিয়ে ছোঁড়ে।
যাই হোক, সারা রাত জুড়ে তো অনেক হইহই হলো। বাবা সত্যিই জিপ নিয়ে শেষ রাত্রের মধ্যেই পুলিশ ডেকে আনলেন। পুলিশ বাবাকে বলল, আপনার কোনো চিন্তা নেই, স্যার। এ ডাকাত ঠিক ধরা পড়বেই।
পরের দিন ভুলুর ঘুম ভাঙল বেলা দশটায়। কিন্তু সে বোবা হয়ে গেছে। করুণভাবে রবির দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়তে লাগল।
রবি কেঁদেই ফেলল।
টাকাপয়সা, জিনিসপত্র যা ডাকাতি হয়ে গেছে সে—সম্পর্কে রবির কোনো দুঃখ নেই, সে তো বড়দের ব্যাপার। কিন্তু তার কুকুরটাকে ডাকাতরা বোবা করে দিয়ে গেল।
ভব বলল, চিন্তা করো না খোকাবাবু, আমি একজন সাধুবাবাকে চিনি, তার কাছে নিয়ে যাব। সে উলটো মন্ত্র পড়ে দিলেই তোমার কুকুরের মুখ খুলে যাবে।
রবি বলল, এখুনি চলো সেই সাধুবাবার কাছে। মা কিন্তু অনুমতি দিলেন না। কোনো সাধু আবার কুকুরের চিকিৎসা করে নাকি? যত সব বাজে কথা। সাধু—সন্ন্যাসীরা তো কুকুর সহ্য করতেই পারে না! তা ছাড়া বাড়িতে এরকম বিপদ, এখন রবির বাইরে কোথাও যাবার দরকার নেই।
কিন্তু ভুলু বোবা হয়ে গেছে, তা—ই নয়, সে কিছু খেতেও পারছে না। খাবার দেখলেই সে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
এরকম হলে তো ভুলু দু’দিনেই মরে যাবে।
মা আর বাবা খুব ভালবাসেন ভুলুকে। কিন্তু এইরকম জায়গায় তো কোনো কুকুরের ডাক্তার পাওয়া যাবে না।
পরের দিনও যখন ভুলু কিছু খেল না কিংবা একবারও ডাকল না, তখন মা ভবকে বললেন কোথায় তোমার সাধু? তাহলে সেখানেই ভুলকে নিয়ে যাও একবার।
জঙ্গলের ধারে একটা বট গাছতলায় সাধুর আখড়া। দিনের বেলাতেও আগুন জ্বালিয়ে সাধুজী সেখানে বসে ধ্যান করেন। পাশেই একট ছোট নদী।
ভুলুকে কোলে করে রবি সেখানে এল ভবর সঙ্গে। সাধুজী তো চোখ বুজেই বসে রইলেন অনেকক্ষণ। তখন কথা বলা যাবে না।
একটু পরে সাধুজী চোখ চাইলেন।
কী ব্যাপার?
ভব গিয়ে সাধুজীর কানে কী যেন ফিস ফিস করে বলল।
সাধুজী তা শুনে বললেন, হুম! তোমার আস্পর্ধা কি যে তুমি একটা কুকুর এনেছো আমার কাছে? এক্ষুণি অভিশাপ দিয়ে তোমাদের ভস্ম করে দিতাম, খুব জোর বেঁচে গেলে এই জন্যে যে, এটা আসলে কুকুর নয়। এ আসলে ছদ্মবেশী গন্ধর্ব। গত জন্মে সামান্য একটা পাপ করায় কুকুর হয়ে আছে।
তাই শুনে রবি খুব খুশি। সত্যিই তো, ভুলু যেন কুকুর নয়। অনেকটা মানুষের মতন!
সাধুজী খানিকটা চরণামৃত মন্ত্র পড়ে একটা শালপাতার ঠোঙায় রেখে দিয়ে বললেন, এটা ওকে খাইয়ে দাও।
কিন্তু খাওয়ানো যাবে কী করে! ভুলু তো কিছুই খায় না, এমন কি জলও না।
সাধুজী বললেন, জোর করে খাওয়াও।
রবি আর ভব দু’জনে মিলে ভুলুর মুখখানা জোর করে খুলে ধরল আর সাধুজী সেটা খাওয়াতে গেলেন। কিন্তু ভুলু কিছুতেই খাবে না। এতক্ষণ একেবারে নিস্তেজ হয়েছিল এবার দারুণ ঝটাপটি করতে লাগল। তারপর এক ঝটকায় ওদের হাত ছাড়িয়ে লাফিয়ে পড়ল নদীতে।
রবির বুকটা ধড়াস করে উঠল। যাঃ কী হবে? ভুলু ডুবে যাবে!
কিন্তু সব কুকুরই জন্ম থেকে সাঁতার জানে। ভুলু নদীতে কয়েকবার ডিগবাজি খেয়েই হঠাৎ ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল।
রবির মনে হলো, এমন মিষ্টি আওয়াজ সে কখনও শোনেনি।
নদীর জলে পড়ার ফলেই ভুলুর ক্ষমতা ফিরে এসেছে। এবার ওপরে উঠে সে ছুটল বাড়ির দিকে। রবি আর ভবও গেল তার পেছনে পেছনে।
বাড়িতে পৌঁছে বাগানে যে—জায়গাটায় ডাকাতরা ওকে বিষাক্ত খাবার খাইয়েছিল, সেখানে ভুলু গড়াগড়ি দিল কয়েকবার।
তারপর বাঘের মতন লাফিয়ে কামড়ে ধরলো ভবর গলার টুঁটি।
ভব আর্তনাদ করে বলে উঠল, ওরে বাবা রে, মরে গেলাম রে। ছাড়, ছাড়, আমি সব বলে দিচ্ছি।
বাবা ওপর থেকে দেখছিলেন, তরতর করে নেমে এলেন। ভবর গলা দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়ছে। ভুলু তখনও হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
ভব স্বীকার করে ফেলল যে, সে ডাকাতদের চেনে। সে—ই তাদের পথ দেখিয়ে এনেছে। ওই সাধুজীও ওদের দলের। আর দু’জন আছে শিলিগুড়িতে।
পরে ধরা পড়ল সবাই। শুধু রবি একটা ব্যাপারে নিরাশ হলো। ডাকাতদের ওই ভব কিংবা সাধুবাবার মতন সাধারণ দেখতে? ধুৎ!