নয়
বর-কনে নিয়ে দস্যুদল খুব আনন্দ করতে-করতে চলল। বিশপ গায়ের জ্বালায় অস্থির হয়ে, গাউন-শূন্য অবস্থাতেই গির্জা ছাড়লেন। কনের বিশেষ অনুরোধে পড়ে দস্যুরা তার ভাইকে ছেড়ে দিল বটে, কিন্তু বৃদ্ধ নাইটটিকে ছাড়ল না। জবরদস্তি করে তাকে একটা উঁচু গাছে চড়িয়ে দিল। বেচারি কী আর করে, গাছের ওপর বসে বর-কনেকে অভিসম্পাত করতে লাগল। দস্যুদের ভয়ে প্রহরীদের কিংবা গ্রামবাসীদের কেউ তাকে উদ্ধার করতে সাহস পেল না। গোটা রাতটাই বৃদ্ধ সেই গাছে বসে রইল। পরদিন লর্ড বিশপ মহাশয় বৃদ্ধ নাইটকে উদ্ধার করে নিয়ে শেরিফের বাড়ি চললেন—বিবাহ ব্যাপারে লজ্জিত ও অপমানিত হয়ে তাদের খুবই রাগ হয়েছিল। নটিংহামে পৌঁছেই তারা শেরিফের সৈন্যসামন্ত জোগাড় করতে লাগলেন, যেভাবেই হোক এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে হবে। প্রকাশ্যভাবে রবিন হুডের সঙ্গে বিরোধ করতে শেরিফের একেবারেই ইচ্ছা ছিল না।
দস্যুদেরকে বনের ভেতর আর জ্বালাতন করবেন না বলে তিনি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, হয়তো বা সে কথা মনে করেই তিনি ইতস্তত করলেন। তাঁর এইরকম ভাব দেখেই বিশপ ও নাইট চটে গিয়ে বললেন,–’শুনুন শেরিফ মহাশয়! আপনি যদি আমাদের সাহায্য না করেন, তবে নিশ্চয় জানবেন, আমরা একদম রাজার কাছে গিয়ে হাজির হব!’ তখন বাধ্য হয়েই শেরিফ মহাশয়কে রাজি হতে হল! তারপর একশোজন বাছা-বাছা সৈন্য নিয়ে, তাঁরা একেবারে সারউড বনে গিয়ে হাজির হলেন।
সৌভাগ্যবশত বনে ঢুকেই তাঁরা দেখলেন, জনা কুড়ি দস্যু হরিণ শিকার করছে। আর কথাটি নেই, তখন তাদের পিছনে-পিছনে তাড়া করলেন। দস্যুরা তিরের মতো বেগে বনের ভেতর ছুটল। আবার ছুটতে-ছুটতে মাঝে-মাঝে ঝোপের আড়াল থেকে শেরিফের সৈন্যদলের ওপর তির ছুড়তেও কসুর করল না। শেরিফের জনা পাঁচেক সৈন্য গুরুতর আঘাত পেল। একটি তির এসে শেরিফের টুপিটা উড়িয়ে দিল, ভয়ে জড়সড়ো হয়ে তিনি সটান ঘোড়ার গলার ওপর শুয়ে পড়লেন।
এদিকে শেরিফের সৈন্যরা যে একেবারে কিছুই করতে পারল না, তাও নয়। একজন দস্যু ছুটতে ছুটতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল দেখে, অপর দুজন তাকে সাহায্য করবার জন্য এল—এই তিনজন সেই বিধবার তিন ছেলে, উইল, লেস্টার ও জন। তাদের এই বিপত্তির সুযোগ পেয়েই, শেরিফের লোক এসেই মুহূর্ত মধ্যে তিন জনকে ঘেরাও করে ধরে ফেলল। শেরিফের লোকেরা তখন বেজায় খেপে গিয়েছে। দস্যু তিনটিকে কেটেই ফেলত, কিন্তু শেরিফ দূর থেকে চিৎকার করে বলে উঠলেন,–’থামো! খবরদার কাউকে প্রাণে মেরো না, বে-আইনি কাজ আমরা করতে চাই না। বেটাদের বেঁধে নিয়ে চলো, কাল সবক’টাকে ফাঁসি কাঠে ঝোলানো যাবে।’ শেরিফের কথায় তারা দস্যু তিনটের হাত-পা বেঁধে তাড়াতাড়ি নটিংহামে নিয়ে চলল।
রবিন হুড এই ব্যাপারে কিছুই জানতে পারলেন না। বিকালবেলায় যখন আড্ডায় ফিরে আসছিলেন, তখন পথে সেই পূর্বপরিচিত বিধবার সঙ্গে তাঁর দেখা। বিধবা কাঁদতে-কাঁদতে তাঁর কাছে হাজির হল।
রবিন হুড বললেন,—’বুড়িমা! তুমি কাঁদছ কেন, ব্যাপার কী?’ বৃদ্ধা বলল,–’দুঃখের কথা কী আর বলব বাচ্চা রবিন! শেরিফের লোকেরা আজ আমার তিনটি ছেলেকেই ধরে নটিংহামে নিয়ে গিয়েছে, কাল না কি তাদের ফাঁসি দেবে।’ এই বলেই বিধবা ভেউ–ভেউ করে কাঁদতে লাগল।
রবিন বললেন,–’তাই তো বুড়িমা, এ যে বড় খারাপ খবর দিলে! উইল, লেস্টার আর জন,—’তিনজনকেই যে আমি খুব ভালোবাসি! এদের ফাঁসি হলে তো চলবে না। আচ্ছা ফাঁসি কবে হবে বলতে পারো কি?
বৃদ্ধা বলল,–’আমি শুনেছি কাল দুপুর বেলা ফাঁসি হবে।’
রবিন বললেন,–’তোমার কিছু চিন্তা নেই বুড়িমা! আমাকে বিশ্বাস করো, যেভাবে পারি আমি তাদের উদ্ধার করবই করব।’
রবিন হুডের কথা শুনে বিধবা তাঁর দুটি পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে-কাঁদতে বলল,–’এ যে তোমাকে ভীষণ বিপদে ফেলছি, বাবা রবিন! তোমার মনটা বড়, সাহসটাও অসাধারণ, আমার বিশ্বাস যে বিধবার অনুরোধ তুমি রাখবেই রাখবে। ভগবান তোমাকে রক্ষা করুন।’
বিধবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, রবিন হুড তাড়াতাড়ি আড্ডায় ফিরে এলেন। ফেরামাত্রই দলের লোকেরা তাঁকে সব কথা বলল। রবিন হুড বললেন,—’ ‘বিপদ যা হওয়ার তা তো হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তা বলে চুপ করে থাকলে তো চলবে না। যেভাবেই হোক তাদের উদ্ধার করতেই হবে।
রবিন হুড মাথা নীচু করে চিন্তা করতে-করতে খানিক দূর এগিয়ে গেলেন। মনটা বড়ই অস্থির। কী করে লোক তিনজনকে বাঁচাবেন, শুধু তাই ভাবতে লাগলেন। এমন সময় হঠাৎ একজন ভিখারি সন্ন্যাসী তাঁহার সামনে এসে হাজির। ভিখারি দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করে বেড়ায়, ভিক্ষাই তার একমাত্র সম্বল। রবিন হুডকে দেখেই সে তাঁর সামনে এসে হাত পেতে ভিক্ষে চাইল।
রবিন হুড তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,–’ভিখারি বাবা, খবর কী? কত জায়গায় তো ঘুরে বেড়াও নতুন খবর কিছু বলতে পারো কি?’
ভিখারি বলল,–’খবর আর কী আছে, তবে কি না শহরে শুনে এলাম, তিন জন লোকের নাকি ফাঁসি হবে।’
ভিখারির কথা শুনে রবিন হুডের মনে হঠাৎ একটা খেয়াল হল এবং তাকে বললেন,–’এসো তো বাবাজি! আমার সঙ্গে তোমার পোশাক বদলাতে হবে। তোমাকে তার দরুন চল্লিশটা শিলিং দেব।’
ভিখারি বলল,–’আরে যান মশাই! কী বলছেন? আপনার এমন খাসা পোশাক, আর আমার ছেঁড়া টুকরো-টুকরো কাপড়। বুড়ো মানুষ দেখে মিছিমিছি কেন ঠাট্টা করছেন?’
রবিন হুড বললেন,–’আরে না না! ঠাট্টা করব কেন? এই নাও টাকা, এখন তোমার পোশাক দাও।’
রবিন হুড পোশাক বদল করে ভিখারির বেশ ধারণ করলেন। ভিখারির টুপিটা তাঁর মাথায় ভালোরকম বসল না। আলখাল্লাটি লাল, নীল ও কাল রঙের পট্টি-মারা, পা-জামাটিও নানা রং-এর কাপড়ের টুকরো দিয়ে প্রস্তুত। জুতা মোজা সবই তালি দেওয়া—রবিন হুডের সাজ খুব অদ্ভুতরকমের হল। রবিন হুডের মা যদি বেঁচে থাকতেন, তবে তিনিও তাঁকে চিনতে পারতেন কি না সন্দেহ।
পরদিন সকাল হতে না হতেই নটিংহাম শহরে হইচই পড়ে গেল। তিন-তিনটে ফাঁসি এক দিনেই হবে। এমনটা সচরাচর হয় না। শহরের দরজা খোলামাত্র চারদিক থেকে লোকজন ঢুকতে লাগল—দেখতে–দেখতে শহর ভরতি হয়ে গেল।
সকলের সঙ্গে সর্বপ্রথমেই সন্ন্যাসী বেশধারী রবিন হুডও শহরে ঢুকে, চারদিক দেখে বেড়াতে লাগলেন যেন এই প্রথম শহরে এসেছেন। ঘুরেফিরে ক্রমে তিনি যেখানে শহরের বাজার বসে, সেই খোলা ময়দানে এসে দেখতে পেলেন, তিনটি ফাঁসির জায়গা তৈরি করা রয়েছে। কাছেই একজন সৈনিক দাঁড়িয়েছিল, তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,–’এখানে কাদের ফাঁসি দেওয়া হবে?’
সৈনিক উত্তর করল,–’রবিন হুডের দলের তিনটি লোকের ফাঁসি হবে।’
রবিন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা বাবা! এদের গলায় কে ফাঁসি পরাবে বলতে পারো কি?’
সৈনিক বলল–’সেটা শেরিফ এখনও ঠিক করেননি। ওই যে তিনি আসছেন, তাঁকে জিগ্যেস করলেই জানতে পারবে।’
ততক্ষণে শেরিফ এসে সেখানে হাজির হলেন। সন্ন্যাসী বলে উঠল——জয় হোক বাবা! ভগবান আপনার মঙ্গল করুন। এখানে নাকি আজ তিনজন লোকের ফাঁসি হবে? আচ্ছা, ফাঁসি পরাবার কাজটা আমাকে দিন না!’
শেরিফ বললেন,–’তুমি কে হে বাপু? তোমাকে এ কাজের ভার কেন দেব?’
‘দেখতেই তো পাচ্ছেন, আমি একজন সাধু। মরবার আগে লোকের কানে ধর্মের কথা শুনিয়ে তাদের পাপের বোঝা হালকা করে দিই, আবার দরকার হলে গলায় ফাঁসিও পরিয়ে দিতে জানি।’
শেরিফ বললেন—’খুব ভালো! আচ্ছা, তোমাকেই তাহলে এই কাজের ভার দেওয়া গেল। এর জন্য যা পাওয়া দস্তুর তা তো পাবেই, তা ছাড়া এক সেট নতুন পোশাকও দেওয়া যাবে।’
‘জয় হোক শেরিফ মহাশয়ের?’—এই বলে সন্ন্যাসী সেই সৈনিকের সঙ্গে জেলখানায় গেল।
বারোটা বাজবার একটু আগে জেলখানার দরজা খুলে গেল। রাস্তার দু-ধারে সার দিয়ে লোক দাঁড়িয়ে আছে। প্রহরীবেষ্টিত হয়ে তিনজন কয়েদি বাইরে এল, তাদের আগে আগে সন্ন্যাসী। ফাঁসিকাঠের নীচে আসার পর, ফিসফিস করে সন্ন্যাসী কয়েদিদের কানে-কানে কী জানি কী বলল—যেন মৃত্যুর আগে শেষ সান্ত্বনার কথাই কিছু বলেছে। তখন অপরাধী তিনজন ফাঁসি-কাঠে চড়ল। তাদের হাত পিঠের দিকে শক্ত করে বাঁধা। পিছনে সন্ন্যাসী, চারদিকে লোকজন নীরব, নিস্তব্ধ!
তখন সন্ন্যাসী ফাঁসিকাঠের খুব কাছে এসে, বুক ফুলিয়ে বজ্র–গম্ভীর স্বরে বলল,–’শোনো, ওহে অহংকারী শেরিফ! তুমি মনে করছ, ফাঁসি দেওয়াটা আমার কাজ। আমি জীবনে কখনও তা করিনি, কোনওদিন করবও না। আমি আর তিনটি কথা বলে শেষ করব! কান পেতে শোনো।’
এই বলে সন্ন্যাসী জামার ভেতর থেকে শিঙা বের করে তিনটি ফুঁ দিল এবং চোখের নিমেষে ছুরি বের করে উইল, লেস্টার এবং জনের বাঁধন কেটে দেওয়া মাত্র, তারা কাছাকাছি প্রহরীদের হাত থেকে তলোয়ার কেড়ে নিতে উদ্যত হল। শেরিফ তখন চিৎকার করে বলে উঠলেন,—’পাকড়াও! বেটাদের পাকড়াও! এ আর কেউ নয়, রবিন হুড। বেটাকে ধরতে পারলে হাজার টাকা পুরস্কার পাবে।’
হারফোর্ডের বিশপও সেখানে হাজির ছিলেন। তিনি বললেন,–’-হাজারের জায়গায় দু-হাজার দেব! ধরো। শিগগির পাকড়াও করো!
রবিন হুড শিঙা ফুঁকবার সঙ্গে-সঙ্গে চারদিকে এমন একটা কোলাহল শুরু হল, শেরিফের কিংবা বিশপের কথা কিছু শুনতে পাওয়া গেল না। রবিন হুড তখন নিজের তলোয়ার খুলে লাফিয়ে মঞ্চ থেকে মাটিতে পড়লেন, তাঁর সঙ্গে-সঙ্গে বিধবার ছেলে তিন জনও নেমে এল। কাছে যেসব প্রহরী ছিল, তারা তাদেরকে ঘেরাও করে হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার জন্য চেষ্টা করতে লাগল। ঠিক এই সময়ে একদিক দিয়ে উইল স্টার্টলি এবং অন্যদিক দিয়ে লিটল জন তাদের দলবল নিয়ে হাজির। আশিজন অস্ত্রশস্ত্রধারী তিরন্দাজ জনতার সঙ্গে মিশে চারদিক থেকে প্রহরীদের আক্রমণ করল। রবিন হুডের শিক্ষিত তিরন্দাজদের সামনে শেরিফের প্রহরীদল কতক্ষণ টিকবে? তারা ভয়ে পিঠটান দিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। দস্যুরা তখন রবিন হুডকে মাঝখানে রেখে আস্তে-আস্তে দরজার দিকে চলল। শেরিফ দেখলেন শিকার পালাচ্ছে। তিনি তখন দিশেহারা হয়ে চিৎকার করতে লাগলেন—’পাকড়াও বেটাদের! চলে গেল যে। রাজার দোহাই দিয়ে বলছি, পাকড়াও। শিগগির সদর-দরজা বন্ধ করে দাও।’
দরজা বন্ধ করে দিলে বাস্তবিকই দস্যুদলের একটু মুশকিলে পড়তে হত! কিন্তু বন্ধ করে কে? উইল স্কারলেট ও এলান-আ-ডেল আগে থেকেই সে রাস্তা পরিষ্কার করে রেখেছে। প্রহরীদের হাত ও পা বাঁধা, দরজাটিও খোলা, দস্যুরা সেইদিকে এগোল।
শেরিফ তখন তাড়াতাড়ি যা পেলেন সৈন্য সংগ্রহ করে দস্যুদের পিছনদিক থেকে আক্রমণ করলেন। দস্যুদলও হঠাৎ ফিরে, শেরিফের সৈন্যকে লক্ষ করে একসঙ্গে কয়েকবার তির ছুড়ল। ভয়ে শেরিফের সৈন্য আর এগোল না। রবিন হুড দলবল সহ ক্রমে পাহাড়ের পথ অতিক্রম করে সারউড বনে এসে হাজির হলেন। বিধবার ছেলে তিনটিকে উদ্ধার করে সেদিন সারউড বনে দস্যুদের ধুমধাম দেখে কে!