সাত
গ্রীষ্মের সময় রবিন হুড ও তাঁর দলের সকলে নানারকমের খেলা করে সময় কাটাতেন। ছোটাছুটি, তিরের খেলা, লাঠির খেলা, তলোয়ার খেলা, কোনওটাই বাদ পড়ত না। এইভাবে নানারকমের খেলা অভ্যাস করবার ফলে, দস্যুরা সকল বিষয়ে নিপুণ হয়ে উঠল।
রবিন হুডের নিয়মই ছিল যে ভালো-ভালো লোক নিজে বেছে দলে ভরতি করতেন। অমুক জায়গায় একটি ভালো লাঠি খেলোয়াড় আছে, অমুক জায়গায় একজন নামজাদা তিরন্দাজ আছে—যেই এই খবর শোনা, অমনিই তিনি নিজে গিয়ে পরীক্ষা করে তাকে দলে আনতেন। অনেক সময় এই নিয়ম পালন করতে গিয়ে তাকে বিপদগ্রস্ত ও অপদস্থ হতে হয়েছে, কিন্তু তিনি তা গ্রাহ্য করতেন না।
একদিন লিটল জন প্রায় তিনশো হাত দূরে একটি হরিণকে তির ছুড়ে মেরে ফেলে। তা দেখে রবিন হুডের মনে বড়ই আহ্লাদ হল। লিটল জনকে জড়িয়ে ধরে বললেন,–’আরে জন, তোমার মতো লোক কি সহজে মেলে? না, এমনটি আর কোথাও আছে বলে তো আমার মনে হয় না।’
রবিন হুডের কথা শুনে উইল স্কারলেট বলল,–’আরে ভাই! এত বড়াই কোরো না, আছে বই কি! ‘ফাউন্টেইনস য়্যাবি’ বলে সন্ন্যাসীদের একটা আশ্রম আছে, সেখানে টাক নামে একজন সন্ন্যাসী থাকে; সে তোমাদের দুজনকেই হারিয়ে দিতে পারে!
রবিন বললেন,–’বলো কি উইল? তাহলে তো সেই লোকটিকে খুঁজে দলে আনতেই হবে। আমি এই চললাম, সন্ন্যাসীকে দলে না এনে খাওয়াদাওয়া করব না।’
যেমন কথা তেমনই কাজ, রবিন হুড তখনই তৈরি হলেন। মাথায় স্টিলের টুপি, লিঙ্কান গ্রিনের নীচে লোহার চেনের জামা, পাশে তলোয়ার এবং হাতে তিরধনুক—এইরকম সেজে রবিন হুড বের হলেন। মনটা বেশ ফুরফুরে, বনের ভেতর দিয়ে চলতে-চলতে ক্রমে একটি খোলা ময়দানে এসে হাজির। ময়দানের পাশেই ঝরনা। এখন চিন্তা, কী করে পার হবেন। জলে নামলে জুতা ভিজে যাবে, লোহার পোশাক ভিজলে তাতে মরচে ধরবে। কাজেই ঝরনার ধারে বসে, পার হওয়ার উপায় চিন্তা করতে লাগলেন।
খানিকক্ষণ পরেই ওপার হতে গানের শব্দ তার কানে এসে পৌঁছল। তারপর শুনতে পেলেন, যেন, দুইজন লোকে তর্ক করছে। একজন বলছে,—’পুডিং জিনিসটা ভারী চমৎকার, অপর জন বলছে, —’পুডিং-এর চেয়ে মাংসের পিঠে ঢের ভালো।’
রবিন হুড ভাবলেন,–’লোক দুটির দেখছি বড় খিদে পেয়েছে! কিন্তু কী আশ্চর্য, দুজনের গলার আওয়াজ ঠিক একইরকম।
ঠিক এই সময়ে ওপারের উইলো গাছের ডাল হঠাৎ বাতাসে ফাঁক হয়ে গেল। রবিন দেখলেন, দুজন নয়, একই লোক দুটি জিনিস নিয়ে তর্ক করছে, তাই গলার আওয়াজ ঠিক একইরকম। অতি কষ্টে তিনি হাসি থামিয়ে রাখলেন।
লোকটি একজন সন্ন্যাসী, গায়ে লম্বা আলখাল্লা, মাথায় হেলমেট টুপি, চেহারাটি বেশ মোটা-সোটা। তখন তার তর্ক শেষ হয়ে মাংসের পিরেরই জিত হয়েছে। মাথাটি ঠান্ডা করবার জন্য সন্ন্যাসী হেলমেট খুলে রাখল। প্রকাণ্ড টাক, তালুতে এক গাছিও চুল নেই,—’ঠিক যেন ডিমের মতো চকচকে। গলাটি মোটা-সোটা, বেঁটে— ষাঁড়ের গলার মতো! চেহারা দেখলেই মনে হয়, লোকটির গায়ে অসাধারণ শক্তি। আলখাল্লার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল, সন্ন্যাসীর কোমরে তলোয়ার ঝোলানো রয়েছে। কিন্তু রবিন হুড ভয় পাওয়ার পাত্র নয়। ধনুকে তির লাগিয়ে, সন্ন্যাসীর দিকে লক্ষ করে হঠাৎ বলে উঠলেন,–’ওহে বাপু সন্ন্যাসী! উঠে এসো দেখি? আমাকে কাঁধে করে এই জলটুকু পার করে দাও। তা’ নইলে দেখতেই তো পাচ্ছ! আমার কিন্তু কিছু দোষ নেই।’
হঠাৎ রবিন হুডের কথা শুনে সন্ন্যাসী চমকিয়ে উঠে তলোয়ারে হাত দিল। তারপর মাথা তুলে দেখে, রবিনের তির একেবারে নিখুঁত বাগানো!
সন্ন্যাসী বলল,–’আরে থামো বাপু। ধনুক রাখো, আমি এখনই তোমাকে পার করে দিচ্ছি। দেখছ না আমি সাধু সন্ন্যাসী লোক, আমাদের কাজই হচ্ছে, পরের উপকার করা। তোমার সাজগোজ দেখে মনে হয়, তোমাকে একটু মান্য করা উচিত!’ এই বলে সন্ন্যাসী গায়ের আলখাল্লা ও তলোয়ার খুলে ফেলল। তারপর ওপার থেকে এসে, চুপচাপ রবিন হুডকে পিঠে করে পার করে দিল।
পার হয়ে রবিন হুড সন্ন্যাসীর পিঠ থেকে নেমে বললেন, ‘ধন্যবাদ সাধু বাবা! আমি বড়ই কৃতজ্ঞ হলাম।’
তখন সন্ন্যাসী তলোয়ার খুলে বলল,—’কৃতজ্ঞ যদি হয়ে থাকো তাহলে তা শোধ করো। আমার ওপারে একটু বিশেষ দরকার, এখন তুমি অনুগ্রহ করে আমাকে কাঁধে নিয়ে পার করে দাও—আশাকরি ধর্মের জন্য এই কাজটুকু তুমি নিশ্চয়ই করবে।
সন্ন্যাসী অতিশয় ভদ্রভাবে রবিনকে এই কথাগুলি বলল। রবিন কী আর করেন, অন্তত ভদ্রতার খাতিরেও রাজি হতে হয়! এদিকে আবার, জলে নামলে সমস্ত ভিজে যাবে। তখন ধীরে-ধীরে বললেন,–’তাই তো সন্ন্যাসী ঠাকুর! আমার যে পা-টা সব ভিজে যাবে!’
‘বটে! তোমার পা ভিজে যাবে! আমি তোমার জন্য সব ভেজাতে পারলাম আর তুমি কি না বলছ পা ভিজে যাবে! আচ্ছা স্বার্থপর লোক তো হে তুমি!’
‘সন্ন্যাসী ঠাকুর, চটো কেন? তোমার শরীরটি তো কম নয়, তার ওপর আবার যুদ্ধের পোশাক পরা! আমার গায়ে তোমার মতো শক্তি নেই। অজানা নদী, মাঝখানটায় গিয়ে যদি পা পিছলে পড়ে যাই?’
‘আচ্ছা, আমি না হয় সব খুলে রেখে দিয়ে একটু হালকা হয়ে নিচ্ছি। কিন্তু বলো, তাহলে তুমি আমাকে পার করে দেবে?’
‘হাঁ, নিশ্চয় দেব।’
তখন সন্ন্যাসী পোশাক, টুপি, তলোয়ার সমস্ত খুলে ফেলল, রবিন হুডও তাকে পিঠে করে তুলে নিলেন। সন্ন্যাসীর বিশাল দেহখানি পিঠে নিয়ে রবিন হুড বড়ই ফাঁপরে পড়লেন। প্রতিপদে তার পা পিছলে যেতে লাগল। হোঁচট খেতে-খেতে ঘর্মাক্ত কলেবরে অতি কষ্টে অপর পারে গিয়ে পৌঁছলেন। তারপর সন্ন্যাসীকে মাটিতে রেখে নিজের তলোয়ার খুলে চোখ রাঙিয়ে বললেন—’শোনো সন্ন্যাসী ঠাকুর! তোমারই শাস্ত্রে লেখা আছে যে পরের উপকার করতে কখনই অমত করবে না। তাই বলছি, ভালো চাও তো আমাকে আবার ওপারে পৌঁছিয়ে দাও।’
রবিন হুডের কথায় সন্ন্যাসী মনে-মনে চটে গেল। কিন্তু সে ভাব চেপে উত্তর করল—’তাই তো! তুমি তো দেখছি ভারী সেয়ানা! ঝরনার ঠান্ডা জলেও তোমার মেজাজটি ঠান্ডা হল না। আচ্ছা, এসো।’
রবিন সন্ন্যাসীর পিঠে আবার চড়লেন; মনে-মনে ভাবলেন যে, ওপারে পৌঁছে তাকে বেশ দুই কথা শুনিয়ে দেবেন। কিন্তু ঝরনার মাঝখানে এসে তিনি মহা মুশকিলে পড়ে গেলেন। সন্ন্যাসীর ঝাঁকানির চোটে তার পিঠে বসে থাকা দায় হল। বেগতিক দেখে দুই হাতে একটা কিছু ধরবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু ধরবেন কী? একে সন্ন্যাসীর শরীরটা নিটোল, তায় আবার মাথায় একগাছিও চুল নেই, কাজেই অসুবিধা হল। অবশেষে আর সামলাতে না পেরে, ঝরনার মাঝখানে ঝুপ করে পড়ে গেলেন।
তখন ‘কেমন জব্দ বাপু! এখন হয় সাঁতরাও, না হয় জলে ডোবো, তোমার যা খুশি!’ এই বলে সন্ন্যাসী ডাঙায় উঠল। রবিন হুড দেখলেন মহা মুশকিল। যাই হোক, অনেক কষ্টে গাছের ডালপালা ধরে অন্য পারে গিয়ে উঠলেন। রাগে তাঁর শরীর জ্বলে যেতে লাগল। তখন তিরধনুক নিয়ে সন্ন্যাসীকে লক্ষ করে ক্রমাগত তির চালাতে লাগলেন। সন্ন্যাসীর গায়ে বর্ম, তাতে লেগে তিরগুলো মাটিতে পড়ল। সন্ন্যাসী তো হেসে খুন! রবিনের তির গ্রাহ্যই করল না। দেখতে-দেখতে তৃণ শূন্য হয়ে গেল। তখন রবিন সন্ন্যাসীকে গালাগালি দিতে লাগল–’ব্যাটা ভণ্ড তপস্বী! তোকে হাতের কাছে পাই তো তোর ন্যাড়া মাথা খুব ভালো করে তলোয়ার দিয়ে মুড়িয়ে দিই।’
সন্ন্যাসী বলল,–’আরে বাপু আস্তে, অত গলাবাজি করছ কেন? তলোয়ার খেলতে চাও? আচ্ছা তাই হবে। নেমে এসো ঝরনার মাঝখানে।’
এই বলে নিজের তলোয়ার খুলে সন্ন্যাসী ঝরনার মাঝখানে এসে দাঁড়াল। রবিন হুডও বেজায় তেজিয়ান, রাগে গরগর করতে করতে ঝরনার মাঝখানে এসে হাজির হলেন। তখন দুই জনে মহাযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেল। সামনে পিছনে, ডাইনে বাঁয়ে উভয়ের তালোয়ার বিদ্যুদ্বেগে ঘুরতে লাগল। দুজনেরই জামার তলায় বর্ম আঁটা। কিন্তু আঘাতগুলোর এতই জোর যে দুইজনেরই পাঁজরে ব্যথা ধরে গেল। খেলতে খেলতে হঠাৎ রবিন হুড পা পিছলিয়ে হাঁটু গেড়ে পড়ে গেলেন। কিন্তু এমন সুযোগ পেয়েও সন্ন্যাসী তাকে আঘাত করল না।
সন্ন্যাসীর ভদ্রতা দেখে রবিন হুড বললেন,–’সন্ন্যাসী ঠাকুর! তোমার মতো খাঁটি খেলোয়াড় খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়! এখন তোমার কাছ আমার একটি প্রার্থনা আছে।
সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করল——সেটা কী, বলো।’ রবিন বললেন–আমার এই শিঙাটিতে তিনটি ফুঁ দিতে চাই।’
সেটা আর বেশি কথা কী? তোমার যদি ইচ্ছা হয়, গাল ফাটিয়ে শিঙা ফোঁকো।’
অনুমতি পেয়ে রবিন হুড শিঙায় তিনটি ফুঁ দিলেন আর তক্ষনি পঞ্চাশ জন তিরন্দাজ ধনুক বাগিয়ে এসে হাজির।
সন্ন্যাসী বলল—’এ কী! এরা সব কার লোক? এত শিগগির এল কোথা থেকে?’
‘এরা আমার লোক।’ রবিন হুড ভাবলেন যে এবারে সন্ন্যাসী ভারী জব্দ!
তখন সন্ন্যাসী বলল— ‘আচ্ছা বাপু! এখন আমার একটা কথা রাখো, আমাকে তিনবার শিস দিতে দাও।’
রবিন বললেন—’হাঁ বেশ তো, দাও।’ তখন সন্ন্যাসী মুখের ভেতর আঙুল পুরে তিনবার এমন শিস দিল যে, কানে তালা লেগে গেল;
রবিনের শিঙাকে হার মানতে হল। অমনি কোথা হতে প্রকাণ্ড পঞ্চাশটি কুকুর এসে হাজির! এপার থেকে তখন স্টাটলি, মাচ্চ, লিটল জন ও অন্য দস্যুরা কুকুরগুলিকে লক্ষ করে ক্রমাগত তির চালাতে আরম্ভ করল। কিন্তু কুকুরগুলো এরকম শিক্ষিত যে এদিক-সেদিক ডাইনে বাঁয়ে সরে, শুধু যে তিরগুলো ব্যর্থ করল তা নয়, আবার ছুটে গিয়ে সেগুলো মুখে করে সন্ন্যাসীর কাছে নিয়ে এল।
লিটল জন তো একেবারে অবাক! ‘কী সর্বনাশ, কুকুরের এই কাণ্ড! এ নিশ্চয়ই জাদুবিদ্যা, তা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না!’
উইল স্কারলেট একটু পিছনে ছিল। ততক্ষণে সেও এসে হাজির হয়েছে। দৃশ্য দেখে তো সে হেসে খুন। তখন সে চেঁচিয়ে বলল, ‘ফ্রায়ার টাক? তোমার কুকুরগুলোকে সামলাও!
‘ফ্রায়ার টাক’–এ নাম শুনেই রবিন হুড সবিস্ময়ে বললেন, ‘সন্ন্যাসী ঠাকুর! তুমিই কি ফ্রায়ার টাক? তাহলে তোমার সঙ্গে আমার ঝগড়া নেই। তুমি আমার বন্ধু, তোমাকে খুঁজতেই আমি এসেছিলাম।’
কুকুরগুলোকে সামলে নিয়ে ফ্রায়ার টাক বলল,–’হাঁ আমিই ফ্রায়ার টাক! বছরসাতেক যাবৎ এই ফাউন্টেইনস য়্যাবিতে আছি। সাধু সন্ন্যাসী মানুষ—ধর্ম-কর্ম নিয়েই থাকি। লোকের বিয়েটা, নামকরণটায় পুরুতগিরিও করি, আবার দরকার হলে যুদ্ধটুদ্ধও করে থাকি। গর্ব করছি না, কিন্তু এ পর্যন্ত কারও কাছে হার মানিনি। কিন্তু বাপু সত্যি বলছি, তোমার তলোয়ারের হাত বড় পরিষ্কার, তোমার নামটি কী বাবা?’
উইল স্কারলেট বলল,–টাক! এঁকে চেনো না? ইনি যে রবিন হুড!’
‘কে, রবিন হুড? তুমিই কি সে-ই প্রসিদ্ধ তিরন্দাজ রবিন হুড? তাহলে তো আমার বড় অন্যায় হয়েছে! আগে যদি জানতাম, তবে কি আর তোমার সঙ্গে ঝগড়া করি? খুশি হয়েই তোমায় কাঁধে নিয়ে পার করে দিতাম।’
রবিন হুড বললেন,—’সন্ন্যাসী ঠাকুর! তোমার কুকুরগুলো নিয়ে আমাদের সঙ্গে গ্রিনউডে চলো। তোমার জন্য আশ্রম বানিয়ে দেব; তোমার মুখে ধর্মের কথা শুনে আমাদের মঙ্গল হবে। তুমি আমাদের দলে আসবে না কি?’
‘নিশ্চয়ই আসব! চলো, তোমাদের সঙ্গেই সারউড বনে যাই! ‘