রবিন হুড – ৬

ছয়

এই ঘটনার কয়েক দিন পরে রবিন হুড, লিটল জনকে নিয়ে একদিন বেড়াতে বের হলেন এবং ঘুরতে-ঘুরতে ক্রমে যে ঝরনার পোলের ওপর জনের সঙ্গে তাঁর ঝগড়া ও পরে বন্ধুতা হয়েছিল, সেই ঝরনার ধারে একটি ঝোপের ভেতর বসে তাঁরা বিশ্রাম করতে লাগলেন। খানিক পরে শুনতে পেলেন, একটি লোক গান করতে-করতে সেই রাস্তায় আসছে।

রবিন জনকে বললেন,—’লোকটির দেখছি খুব ফূর্তি। আমার মনে হয় এর কাছে টাকাপয়সাও আছে!’ একটু পরেই টুকটুকে লাল পোশাকপরা একজন লোক এসে হাজির। ঝোপের ভেতর থেকে বের হয়ে রবিন রাস্তার ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়াল। লোকটির ভ্রুক্ষেপও নেই, সটান চলে আসতে লাগল, রবিন হুডের দিকে চেয়েও দেখল না। এমনকী, আর একটু হলেই তাঁর ওপর এসে পড়ত।

রবিন হুড বললেন,–’তুমি তো ভারী অভদ্র হে! লোকের গায়ের ওপর এসে পড়ো কেন? দাঁড়াও!’

লোকটা বলল,—’—ওঃ!—লাট সাহেব আর কি, ওঁর কথায় দাঁড়াব!’ রবিন বললেন,–’দ্যাখো! এ পথে চললে আমাকে খাজনা দিতে হয়, তোমার থলিটি বার করো দেখি, কত টাকা আছে?’

‘হো-হো হো-হো―বেশ মজার লোক তো তুমি! থামলে কেন বাপু? বলে যাও।’

রবিন বললেন,–’আমার যা বলবার তা তো বলেছি। কিন্তু তুমি দেখছি ঠেঙানি না খেলে থলে বার করবে না! আচ্ছা তবে এসো। অপরিচিত লোকটি বলল,–ব্যাপার মন্দ নয়! রাস্তায় চাষাভুষা যে চাইবে, অমনিই টাকার থলিটা বার করে দিতে হবে? সেটি হচ্ছে না বাপু,আমার টাকার বড় দরকার। এখন পথ ছাড়ো দেখি, আমাকে যেতে দাও।’

এই বলে যেই সে এগিয়ে যাবে, অমনি রবিন লাঠি বাগিয়ে চোখ রাঙিয়ে বললেন—’থামো বলছি, নইলে এখনই মাথা ভেঙে দেব!’

লাল পোশাকপরা লোকটি বলল, ‘হায় ভগবান! কী বিপদেই পড়া গেল! যত মনে করি, কারও সঙ্গে আর ঝগড়া করব না ততই যেন ঝগড়া এসে কাঁধে চাপে!’ এই বলে সে তলোয়ার নিয়ে তৈরি হল।

‘তালোয়ার রেখে দাও বাপু! দেখছ না, আমার হাতে ওকের লাঠি? এর এক ঘা পড়লেই তো তোমার তলোয়ারের দফা রফা হয়ে যাবে! যাও আমার লাঠির মতো একটা লাঠি আনো!’

তখন তলোয়ার রেখে অপরিচিত লোকটি এক টানে একটা ওকের চারা শিকড়-সুদ্ধ উপড়িয়ে তুলল এবং ডালপালা হাতে টেনে পরিষ্কার করে নিল।

ঝোপের ভেতর থেকে জন এই ব্যাপারে দেখে মনে-মনে ভাবতে লাগল—’বাবা! ওকের গাছ এভাবে টেনে তোলা বড় যে সে লোকের কাজ নয়! আজ রবিন হুডকে বেগ পেতে হবে।’

রবিনও বুঝলেন, আজ বড় শক্ত লোকের পাল্লায় পড়েছেন। তারপর খেলা আরম্ভ হয়ে গেল। ঝোপের ভেতর থেকে জন সমস্তই দেখতে লাগল। অনেক চেষ্টায় রবিন অপরিচিত লোকটিকে বেশ এক ঘা মারলেন, কিন্তু সেও সহজে ছাড়ল না! রবিনের আঙুলের গাঁটে পালটা এমন এক ঘা মারল, যে তাঁর হাত অবশ হয়ে গেল, লাঠি ধরবার শক্তি রইল না। তারপর পাঁজরে আর এক ঘা খেয়ে রবিন তো মাটিতে গড়াগড়ি!

লিটল জন আর চুপ করে থাকতে পারল না। পাছে রবিনকে আর এক ঘা বসিয়ে দেয়, সেই ভয়ে ধাঁ করে বের হয়েই সে লোকটির লাঠি ধরে বলল,–খবরদার, আর মেরো না।’

অপরিচিত লোকটি বলল—’এ আবার কোথা থেকে এক ফাজিল এসে জুটল! খেলায় কেউ হেরে গেলে, তাকে আবার মারা আমার স্বভাব নয়। তুমি কি বাপু একলা, না সঙ্গে আর কেউ আছে? সবক’টাকে নিয়ে এসো, একসঙ্গে মজা দেখিয়ে দিই!’

রবিন বললেন—’থাক ভাই! আর লাঠালাঠিতে কাজ নেই। তোমার খাসা লাঠির হাত।’

রবিন হুডের গলার আওয়াজ কেমন চেনা-চেনা বোধ হওয়ায়, লোকটি তাঁকে জিগ্যেস করল, ‘আচ্ছা মশাই! আপনি কি সারউড বনের সেই প্রসিদ্ধ দস্যু রবিন হুড?’

‘হাঁ ভাই, তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু ‘প্রসিদ্ধ’ আর বলো কেন? তোমার লাঠির গুঁতোয় আজ আমার বাহাদুরি বেরিয়ে গিয়েছে।’

অপরিচিত লোকটি বলল,–আরে রাম। এ যে বড় অন্যায় হল। তোমাকে খুঁজতেই তো আমি বেরিয়েছি! মনে করেছিলাম, দেখলেই চিনতে পারব। প্রথম থেকেই তোমার মুখটা এবং গলার আওয়াজটা যেন কেমন চেনা-চেনা ঠেকছিল! আমাকে চিনতে পারছ না ভাই রব? গ্যামওয়েল লজের কথা কি ভুলে গেলে?’

রবিন বললেন,–’আরে তাই তো, এ যে উইল গ্যামওয়েল।’ এই বলে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন—আমি একটা আস্ত গাধা! তোমাকে ভাই আমি চিনতে পারলাম না। আরে ভাই, আমারই বা দোষ কি, কত দিন থেকে তোমার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি; তা ছাড়া, তোমার চেহারাও ঢের বদলে গিয়েছে।’

উইল বলল,—’ ‘আমিও ভাই তোমায় চিনতে পারিনি, তুমি ঢের বদলেছ। সারউড বনে যখন ছুটাছুটি করতাম তখনকার মতো ছোট্টটি তো আর তুমি নেই।

রবিন বললেন,–’তা তো বুঝলাম, কিন্তু আমাকে কেন খুঁজে বেড়াচ্ছ বলো দেখি? আমি যে এখন ডাকাত, ধরা পড়লেই যে আমার মাথা কাটা যাবে, তা কি জানো না? আচ্ছা, কাকাকে ছেড়ে তুমি কী করে এলে ভাই? ম্যারিয়ানের কোনও খবর জানো কি?

উইল তখন হেসে বলল,–’আরে ভাই, অনেকগুলো প্রশ্ন তো একসঙ্গে করে ফেললে! আচ্ছা তোমার শেষ প্রশ্নের উত্তরটাই আগে শোনো, সেটার জন্যই বোধ করি তুমি ব্যস্ত! সেই নটিংহামের মেলায় যে তুমি সোনার তির পেয়েছিলে, তার কিছুদিন পরেই ম্যারিয়ানের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তোমার সেই উপহারটা ম্যারিয়ান যত্ন করে রেখে দিয়েছে। তোমার সঙ্গে দেখা হলে বলতে বলেছে যে, তাকে শিগগিরই রানির কাছে ফিরে যেতে হবে। সারউড বনে খেলা করে ছেলেবেলাটা কত সুখে কেটেছে, সে কথা সে কোনওদিনও ভুলবে না!’

‘বাবার কথা জিগ্যেস করছ? তিনি এখনও বাতে বড় ভুগছেন। তোমার কথা তিনি কত বলেন। শেরিফকে জব্দ করে যখন সোনার তির পাও, সেই খবর শুনে তিনি ভারী খুশি হয়েছিলেন। বাবার সঙ্গে শেরিফের কেমন ভাব, জানোই তো? বারবার তুমি শেরিফকে নাকাল করছ, তাই তোমার ওপর বাবা বড়ই খুশি। বাবার জন্যেই আমিও তোমার মতো ডাকাত হয়ে বাড়ি ছেড়েছি! ব্যাপারটা কী হয়েছিল জানো? বাবার একজন স্টুয়ার্ড ছিল। আমি বোর্ডিং স্কুলে চলে গেলে পর লোকটা নানাভাবে বাবাকে খুশি করে তাঁর খুব প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। তারপর তার বেয়াদবি বেড়ে গেল। কাজকর্ম ভালো বুঝত বলে, বাবা তাকে কিছুই বলতেন না। তারপর আমি যখন বাড়ি ফিরে এলাম, তখন দেখি বেটা একেবারে বাড়ির কর্তা হয়ে পড়েছে! তার রকমসকম আমার একটুকুও ভালো লাগত না। প্রথম প্রথম অবশ্য সে খুব সাবধানেই আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলত, আমার সামনে বাবার নামে নিন্দা করতে সাহস পেত না। একদিন হঠাৎ শুনলাম সে বাবাকে ‘নিরেট বোকা’ বলে গালাগাল দিচ্ছে! আমার আপাদমস্তক জ্বলে গেল; তখনই সেই ঘরে ঢুকে ব্যাটাকে এক ঘুসি বসিয়ে দিলাম। আমার হাতে জোর নেহাত কম নয়, রাগের মাথায় ঘুঁসিটা একটু জোরেই মেরেছিলাম। ঘুসি খেয়ে সে যে মাটিতে পড়ল আর উঠল না—সেইখানেই তার লীলা শেষ হয়ে গেল। শেরিফের সঙ্গে বাবার যেরকম ঝগড়া, এ খবর পেলে তাঁকে নাকাল করতে কসুর করবে না! কাজেই বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ছাড়তে হল। তাঁকে বলে এসেছি সারউড বনে এসে তোমার দলে মিশব।

রবিন বললেন,–’কী সর্বনাশ! উইল, তোমার ঘাড়ে এতটা বিপদ! কিন্তু ভাই, তোমায় দেখে তো তেমন কিছুই মনে হয়নি। দিব্বি টুকটুকে লাল পোশাকটি পরে স্ফূর্তি করে গান গাইতে-গাইতে আসছিলে! আমি তো তোমার রকম দেখে, এই লিটল জনকে বলছিলাম যে, এর মেজাজটি হালকা দেখে মনে কোরো না, তার টাকার থলিটিও হালকা।’

‘লিটল জন? এই কি ভাই, তোমার সেই প্রসিদ্ধ লাঠি খেলোয়াড় লিটল জন? এসো লিটল জন, তোমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করি। একদিন আমার সঙ্গে ভাই তোমাকে লাঠি খেলতে হবে—অবশ্য বন্ধুভাবে।’

‘তা খেলব বইকি, একবার কেন যতবার বলবে।’ এই বলে জন নিজের হাতখানি বাড়িয়ে দিল। তারপর উইলকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার ভাই, শেষ নামটা কী বললে—গ্যামওয়েল?’

রবিন হুড বললেন,–’না না, ও নামটা বদলে নিতে হবে। তা না হলে কালকেই শেরিফের লোক সবাইকে পাকড়াও করবে। রসো, একটু ভাবতে দাও দেখি—ঠিক-ঠিক হয়েছে। উইল টুকটুকে স্কারলেট রং-এর পোশাক পরে এসেছিল, আমরা তাকে আজ থেকে উইল স্কারলেট বলে ডাকব। এসো ভাই উইল স্কারলেট, তুমি আমাদের সারউড বনে এসো, এখন থেকে তুমি আমাদেরই দলের একজন হলে। যত দিন বেঁচে থাকো, দলের জন্য প্রাণ দিয়ে খেটো।

উইল স্কারলেটও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে দস্যুদলে ভরতি হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *