চার
ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নটিংহামে আবার মেলার দিন হাজির। চারদিক থেকে লোকজন এসে, নানারকমের জিনিসপত্র নিয়ে মেলায় দোকান খুলল। মেলায় আমোদ-প্রমোদেরও আয়োজন যথেষ্ট—কুস্তি, লাঠিখেলা প্রভৃতির জন্য জায়গায় জায়গায় মঞ্চ তৈরি হয়েছে।
এরিক অব লিঙ্কান নামে একজন প্রসিদ্ধ লাঠি খেলোয়াড় একটি মঞ্চে দাঁড়িয়ে বড়ই আস্ফালন করছেন,—’কে আমার সঙ্গে লাঠি খেলবে এসো, মাথা ভেঙে দেব।’ বাস্তবিক এরিকের মতো লাঠি খেলোয়াড় তখন সে অঞ্চলে কেউ ছিল না। তার ডাকে যে দুই–একজন এল, তারা উত্তম মধ্যম মার খেয়ে, লজ্জিত ও অপমানিত হয়ে ফিরে গেল।
মঞ্চের কোণে অত্যন্ত ময়লা ও ছেঁড়া কাপড় পরা, অতি অদ্ভুত চেহারার একজন ভিখারি বসেছিল। এরিকের লাঠিখেলা দেখে সে হেসেই খুন! যেন সে ঠাট্টা করে বলছে,—’আরে যাও, তোমার মতো ঢের-ঢের খেলোয়াড় দেখেছি—ভারী ওস্তাদ।’ ভিখারির ঠাট্টা বুঝতে এরিকের দেরি হল না। রাগে তার চোখ লাল হয়ে উঠল। সে সিংহের মতো গর্জন করে বলল,–’চুপ রও বেটা বেয়াদব! লাঠির গুঁতোয় এখনই আদব কায়দা শিখিয়ে দেব।’ ভিখারি হাসতে-হাসতে উত্তর করল—তুমি আদবকায়দা শেখাবে? পোড়া কপাল আমার! আমার চেয়ে ওস্তাদ লোকের কাছ থেকেই আদবকায়দা শিখে থাকি।’
আর যায় কোথা! এরিক অব লিঙ্কানকে এতবড় অপমানের কথা! রাগে অন্ধ হয়ে এরিক ভিখারিকে লাঠি খেলায় ডাকল।
ভিখারি আস্তে-আস্তে, যেন অতি কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,–’একটু সবুর করো আমি যাচ্ছি, জাঁকটা না ভেঙে দিলে চলছে না! তোমরা কেউ ভাই আমাকে একটা লাঠি দিতে পারো কি?
প্রসিদ্ধ লাঠিয়াল এরিকের সঙ্গে একজন সামান্য ভিখারি লাঠি খেলবে, বড়ই আশ্চর্য কথা! কুড়ি-পঁচিশ জন লোক তাদের লাঠি এনে হাজির করল। তার ভেতর থেকে সকলের চেয়ে মোটা এবং লম্বা লাঠিটা নিয়ে, ভিখারি মঞ্চের ওপর গিয়ে উঠল। যেই মঞ্চের ওপর ওঠা, অমনই এরিক তাকে এক ঘা বসিয়ে দিল। লাঠি খেয়ে ভিখারি মঞ্চের ওপর ছুটতে লাগল, যেন তার বেজায় চোট লেগেছে! তারপর এরিক আর এক ঘা মারবার জন্য যেই লাঠি তুলেছে, অমনই বিদ্যুৎবেগে ভিখারি তাকে এমন এক ঘা মারল যে, এরিক একেবারে মঞ্চের ওপর সটান চিৎপাত!
এ এক নতুন দৃশ্য! এরিককে লাঠির ঘা খেয়ে গড়াগড়ি দিতে কেউ কখনও দেখেনি। সকলে একেবারে অবাক হয়ে গেল। এরিক অবশ্য তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল কিন্তু বেশ বুঝতে পারল যে, সে বড়ই শক্ত লোকের পাল্লায় পড়েছে। তারপর অনেকক্ষণ পর্যন্ত দুইজনের খেলা চলল। হঠাৎ ভিখারি আর এক ঘা মেরে এরিকের হাতের লাঠি ফেলে দিল, সঙ্গে-সঙ্গে ভিখারির শেষ ঘা খেয়ে এরিক মঞ্চের ওপর থেকে টলতে-টলতে, একেবারে দর্শকদের মাঝখানে গিয়ে পড়ল! অহঙ্কারী এরিকের দুর্দশা দেখে সবাই খুব খুশি।
লাঠি খেলার পর তিরের খেলা। শেরিফের বাছা-বাছা তিরন্দাজরা এসে হাজির হল। সেই অদ্ভূত ভিখারিও এসে হাজির। তাকে দেখে শেরিফ একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন,–’এই ভিখারিটা কে হে?’
সে বলল,—’আজ্ঞে হজুর! এই লোকটাই আজ লাঠি খেলায় এরিককে বেজায় জব্দ করেছে
তিরের খেলায় অনেকেই খুব বাহাদুরি দেখাল। সবার পর যখন ভিখারির পালা, তখন সে একটি ওকের ডাল দূরে মাটিতে পুঁতে বলল, —’শেরিফ মশাই! এই ডালটা আমার লক্ষ। এই লক্ষ যে বিঁধতে পারবে, তাকে বলি বাহাদুর।’ কিন্তু এইরকম অসম্ভব লক্ষ দেখে কেউ এগোল না। তখন ভিখারি তির মেরে অনায়াসে সেই ডালটিকে কেটে ফেলল! এই আশ্চর্য ব্যাপার দেখে শেরিফের তো চক্ষুস্থির! ভিখারিকে বললেন,—’ ‘ওহে বাপু! তোমার নামটি কী হে? তোমার বাড়ি কোথায়?’
ভিখারি বলল,—’হুজুর! আমার বাড়ি হলডারনেস শহরে, আমার নাম রেনোল্ড গ্রিনলিফ!’
শেরিফ বললেন,–’আচ্ছা রেনোল্ড গ্রিনলিফ! তুমি আমার কাছে চাকরি করবে? তোমাকে খাওয়াপরা ও উচিতমতো মাইনে দেব, তা ছাড়া প্রতি বছর তিনটি ভালো পোশাক দেব।’
ভিখারি বলল,–’খাওয়াপরা, মাইনে, আর বছরে তিনটে পোশাক!—হাঁ হুজুর, আমি আপনার চাকরি করব।’
পাঠক পাঠিকা! তোমরা বোধ করি এতক্ষণে বুঝতে পেরেছ, রেনোল্ড গ্রিনলিফ কে? রেনোল্ড গ্রিনলিফ হচ্ছে লিটল জন। চাকরি নিয়ে তখনই গ্রিনলিফ শেরিফের বাড়িতে গেল। কিন্তু কী কুক্ষণেই শেরিফ এই চাকরটাকে রাখলেন।
এই ঘটনার পর দুদিন কেটে গেল; চাকর হিসাবে রেনোল্ড বড় সুবিধের নয়। শেরিফ যা খাবেন, ঠিক তেমনটি না হলে রেনোল্ডের মন ওঠে না। সকলেই তার ওপর বিরক্ত। স্টুয়ার্ডের (খাবার টেবিলের কর্তা) তো তার ওপর মহা রাগ। কিছু বলবারও জো নাই, কেন না রেনোল্ড শেরিফের খাস লোক।
যেদিন শেরিফ দোকানদারদের নেমতন্ন করে খাওয়ান, আবার সেই ভোজের দিন আসল। বাড়ির সমস্ত চাকর-বাকর কাজ কর্মে মহা ব্যস্ত। রেনোল্ড গ্রিনলিফ প্রায় সমস্ত দিনই ঘুমে অচেতন ছিল। তারপর সকলে যখন খেতে বসেছে, তখন রেনোল্ড উঠে সেই ঘরে আসল এবং হঠাৎ রবিন হুডকে দেখতে পেল। প্রথম সাক্ষাতে দুজনে কেমন চমকে গিয়েছিল এবং কীভাবে সে ভাব সামলে গোপনে প্যানট্রিতে দেখা করবার পরামর্শ করেছিল, সে কথা তোমরা এরমধ্যে জানতে পেরেছ। দস্যুদের প্রধান সর্দার দুটোই যে তাঁর বাড়িতে, শেরিফ কিন্তু তার বিন্দু-বিসর্গও জানতে পারলেন না।
খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হতে অনেক রাত্রি হল। রেনোল্ড গ্রিনলিফ খিদেয় অস্থির, সমস্ত দিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছে, কিছুই খায়নি। স্টুয়ার্ড ভাঁড়ার বন্ধ করে শুতে যাবে, এমন সময় সে এসে বলল, ‘দোহাই স্টুয়ার্ড সাহেব! আমায় কিছু খেতে দিন, সমস্ত দিন কিছু খাওয়া হয়নি।’
স্টুয়ার্ড বিরক্ত হয়ে বলল,—’আরে যাও বাপু! এত রাতে খেয়ে দরকার নাই। দিনটা যখন কেটেছে, রাতটাও কেটে যাবে, এখন ঘুমাওগে যাও।’
রেনোল্ড গ্রিনলিফ বলল,–’বটে! তা হবে না। খিদেয় আমার পেট জ্বলে যাচ্ছে, খাবার দিতেই হবে।’ এই বলে সে ভাঁড়ার বাক্সর দরজা খুলবার চেষ্টা করতে লাগল। দরজা বন্ধ, স্টুয়ার্ডের হাতে চাবি। তার মুখে মুচকি-মুচকি হাসি দেখে গ্রিনলিফের আর সহ্য হল না, কামারের হাতুড়ির মতো তার বজ্রমুষ্টি বাক্সের ডালার ওপর দমাদম পড়তে লাগল। ডালা ভেঙে গেল! নীচু হয়ে গ্রিনলিফ খাবার খুঁজছে, এই ফাঁকে স্টুয়ার্ড চাবির গোছা দিয়ে তার মাথায় এক ঘা দিল গ্রিনলিফও ফিরে স্টুয়ার্ডকে পালটা এক ধাক্কা দিল। সেই ভীষণ ধাক্কা খেয়ে স্টুয়ার্ড একেবারে মাটিতে গড়াগড়ি। আর ভাবনা কী? রাস্তা পরিস্কার। গ্রিনলিফ তখন ভালো-ভালো জিনিস বের করে খেতে লাগল।
রান্নাঘরে শেরিফের বাবুর্চি থাকত। লোকটি অতিশয় বলবান ও সাহসী। গোলমাল শুনে সে প্যানট্রিতে এসে হাজির। ঘরের অবস্থা দেখে ব্যাপারটা বুঝতে তার বাকি রইল না। বাবুর্চি গ্রিনলিফকে গালাগালি তো দিলই, তার ওপর আবার তলোয়ার খুলে তাকে মারতেও এল।
গ্রিনলিফও তখন নিজের তলোয়ার খুলে বলল,–’বটে! তোমার তো আস্পর্ধা কম নয়? খাওয়ার সময় আমাকে ঘাঁটাতে এসেছ, তবে এখন সামলাও।’ এই বলে বাবুর্চিকে আক্রমণ করল। ঘণ্টাখানেক চেষ্টা করে কেউ কাউকে কাবু করতে পারল না। তখন গ্রিনলিফ বলল,–’আরে ভাই। আমি ঢের ঢের লোকের সঙ্গে তলোয়ার খেলেছি, কিন্তু তোমার মতো পরিষ্কার হাত কারও দেখিনি।’
বাবুর্চি বলল, ‘তুমিই বা কম কীসে? আমি মনে করেছিলাম, তোমায় কেটে টুকরো-টুকরো করে ফেলব, কিন্তু কত চেষ্টা করলাম, তোমাকে ছুঁতেও তো পারলাম না?’
গ্রিনলিফ বলল,–’তাই নাকি? আমিও মনে করেছিলাম, তোমার কান দুটো কেটে ফেলব, কিন্তু পারলাম কই? যাই হোক, সেটা আর এক সময় চেষ্টা করা যাবে। আচ্ছা ভাই! এখন বলো দেখি, তোমার এমন খাসা তলোয়ারের হাত, তুমি কেন শেরিফের বাড়ি বাবুর্চিগিরি করতে এসেছ? আর কারও কাজে লেগে যাও না।’
বাবুর্চি বলল,–’কার কাজে লাগব, বলো?’
ঠিক এই সময়ে কসাইবেশধারী রবিন হুড হঠাৎ ঘরে ঢুকে বললেন,—’–—এই যে! আমার কাজে লেগে যাও, আমি রবিন হুড!’