তিন
এই ঘটনার কিছুদিন পরে স্টাটলির লোকেরা একটি হরিণ মারল। বনের আড়াল থেকে বাইরে হরিণটিকে আনতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ কোথা থেকে শেরিফের জন-কুড়ি তিরন্দাজ এসে হাজির! স্টাটলির লোকেরা তক্ষনি উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ল, আর শনশন শব্দে কতকগুলি তির তাদের মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল। স্টাটলির দলও তখন গাছের আড়ালে গিয়ে পালটা তির ছুড়তে ছাড়ল না। শেরিফের লোকেরা দেখল যে, ঘাঁটাঘাঁটি করে লাভ নেই, তার চাইতে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করা ভালো। এমন সময় দেখতে-দেখতে তাদের দলের তিনজনের গায়ে তিনটি তির এসে বিঁধল। আর রাখে কে? তখন ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে সবাই একেবারে শেরিফের কাছে গিয়ে হাজির হল।
শেরিফ সবকথা শুনে রাগে জ্বলে উঠলেন,–কী! আমার লোকেরা রবিন হুডের লোকদের ভয় পায়?’
এই ঘটনার দিনকয়েক পরে রবিন হুড দেখলেন যে, লিটল জন কোথায় চলে গেছে, তাকে কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দলের একজন লোক বলল,—’তাকে আমি একজন ভিখারির সঙ্গে কথা বলতে দেখেছিলাম, কিন্তু পরে যে কোথায় গেলেন তা বলতে পারি না।’ এর পরে আরও দুই দিন গেল, তবুও জনের কোনও খবর পাওয়া গেল না।
রবিন হুড়ের মন বড়ই অস্থির হয়ে উঠল। তিনি মনে-মনে ভাবলেন, তবে কি জন শেরিফের হাতে পড়ল? না, আর তো চুপ করে থাকলে চলছে না। রবিন হুড তিরধনুক নিয়ে তৈরি হয়ে দলে লোকদের বললেন ‘আমি নটিংহামে চললাম! শেরিফ আমাকে দেখবার জন্য বড় ব্যস্ত হয়েছেন, তাঁর সঙ্গে দেখাটাও করে আসি, আর আমার ঢ্যাঙা পালোয়ানটির তিনি কোনও খবর রাখেন কি না, সেটাও জেনে আসি।’
সকলে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য তৈরি হল। রবিন বাধা দিয়ে বললেন, ‘তোমাদের কারও যাওয়ার দরকার নেই। শেরিফ মশায়ের সঙ্গে আমার ভাব আছে, ভয় কী? তবে তোমরা এক কাজ করো, শহরের পশ্চিম-দরজার সামনে বনের আশেপাশে থেকো। হয়তো বা তোমাদের দরকার হতেও পারে।’
রবিন নটিংহামে চললেন। খানিকদূর গিয়ে ভালো করে চারদিক দেখে নিলেন, রাস্তা পরিষ্কার আছে কি না। পিছন দিক থেকে একখানা গাড়ি আসছিল, চাকার ঘড়ঘড় শব্দ তাঁর কানে পৌঁছল। খানিক পরেই রাস্তার বাঁক পার হয়ে গাড়িখানা এসে হাজির। রবিন হুড দেখলেন— মাংসের গাড়ি। স্থূলকায় কসাইটি খুব স্ফূর্তিবাজ, শিস দিয়ে গান করতে–করতে গাড়ি চালাচ্ছিল। ঘোড়া বেচারি অতিরিক্ত বোঝায় দরুণ কাহিল, চলতে পারছে না।
কসাইকে নমস্কার করে রবিন বললেন,–’ওহে কসাই ভায়া! তুমি কোথা থেকে আসছ, মাংস নিয়ে যাবে কোথায়?’
কসাই প্রতিনমস্কার করে, খুব ভদ্রভাবে উত্তর করল—আমি যেখান থেকেই আসি না কেন তাতে আপনার দরকার কী? আমি একজন কসাই। মাংসের গাড়ি নিয়ে নটিংহামের হাটে যাচ্ছি, আজ হাটের দিন। মশায়ের কোথা থেকে আসা হচ্ছে, মশায়ের নাম?’
রবিন বললেন,–’আমি এই লকলি শহর থেকে আসছি, আমার নাম রবিন হুড।’
‘রবিন হুড’ নাম শুনে ভয়ে কসাইয়ের মুখ শুকিয়ে গেল। সে বলল,–’দোহাই মশায়! আমাকে রক্ষা করুন; আমি শুনেছি, আপনি গরিবের বন্ধু। আমি বড় গরিব। মাংস বেচে যা দু-পয়সা হয়, তা দিয়েই কোনওমতে সংসার চালাই।’
রবিন বললেন,–’আরে তুমি এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন? তোমার কিছু ভয় নেই। তবে কি না, তোমাকে একটি কাজ করতে হবে।’ টাকার থলিটি বার করে বললেন,–’এই টাকা নিয়ে তোমার গাড়ি, ঘোড়া ও মাংস আমাকে বেচে ফেলো। আমার বড্ড ইচ্ছে হয়েছে, আজ কসাই সেজে নটিংহামের বাজারে মাংস বেচব।’
রবিনের প্রস্তাব শুনে কসাই বড়ই খুশি হল। তক্ষনি গাড়ি থেকে নেমে ঘোড়ার রাশ রবিন হুডের হাতে দিয়ে টাকার থলিটি নিল। তখন রবিন হুড বললেন,–’একটু সবুর করো ভাই। তোমার পোশাকটা আমাকে দাও, আর আমার এই পোশাক পরে তুমি শিগগির বাড়ি চলে যাও। দেখো সাবধান! বনের পাহারাওয়ালাদের হাতে পড়লে কিন্তু বড় মুশকিল!
কসাইবেশধারী রবিন তখন গাড়ি নিয়ে শহরে চললেন। শহরে পৌঁছে দেখলেন, দরজায় প্রহরী ভ্রুকুটি করে বসে আছে। তাকে সেলাম করে ঢুকলেন। গাড়ি নিয়ে একেবারে কসাইটোলায় গিয়ে হাজির হলেন। কী দামে মাংস বিক্রি করবেন সেটি পর্যন্ত তার জানা ছিল না; কী আর করেন, সাদাসিধে বোকা লোকটির মতো মুখের ভাব করে চিৎকার করে বলতে লাগলেন,
‘এসো ভাই, ভালো মাংস,
আমার কাছে কেনো।
এক আনায় তিন আনার মাংস।
পাবে নিশ্চয়ই জেনো।
রবিনের কথা শুনে অনেক লোক তার দোকানে জড়ো হল। সে মাংস বাস্তবিকই ভালো ছিল, সস্তাও খুব। সকলে তার দোকান থেকে মাংস কিনতে লাগল।
অন্য কসাইরা দেখল ব্যাপার গুরুতর। তাদের দোকানপাট বন্ধ হওয়ার জোগাড়। কেউ-কেউ বলল,–’এ হতভাগা লোকটা দেখছি ব্যাবসার কোনও ধারধারে না; বোধ করি বাপের টাকা পেয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে।’ অন্য একজন বলল,–আরে না—তা নয়। এ ব্যাটা নিশ্চয়ই চোর, কোনও কসাইকে মেরে তার মাংস নিয়ে বাজারে এসেছে!’
রবিন এসব কথা শুনে গ্রাহ্য করলেন না। বরং আরও চিৎকার করে লোক ডাকতে লাগলেন।
অন্য কসাইরা দেখল যে, এ তো ভারী মুশকিল। এর সঙ্গে ঝগড়া করে কোনও লাভ হবে না। তখন একজন কসাই রবিনকে বলল,–তুমি দেখছি নতুন ব্যাবসা করছ। আমাদের সঙ্গে যদি ব্যাবসা করতে চাও, তবে আমাদের নিয়মগুলিও মেনে চলতে হবে। আজ রাতে শেরিফের বাড়ি আমাদের নেমন্তন্ন, তোমাকেও ভাই যেতে হবে।’
রবিন হুড বললেন,–শেরিফের বাড়ি নেমন্তন্ন? নিশ্চয়ই যাব, আমি এখনই তৈরি হয়ে আসছি।’ তার মাংস সবই বিক্রি হয়ে গেছিল; রবিন তখন সরাইয়ের সহিসের কাছে গাড়ি ঘোড়া রেখে নিমন্ত্রণের জন্য তৈরি হলেন।
বাজারে কেনা-বেচার অনুমতির জন্য শেরিফ প্রত্যেক দোকানদারের কাছে থেকে কিছু-কিছু পেতেন। বাজারের পর দোকানদারদেরও তিনি নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। সেদিনও শেরিফ সেজেগুজে সকলের আগেই খাবার ঘরে এলেন। রবিন হুড এবং অন্য কসাইরা যখন আসল, শেরিফ খুব ভদ্রতা দেখিয়ে তাদের বসতে বললেন। ঘরের মাঝখানে প্রকাণ্ড টেবিল, তার ওপর নানারকমের ভালো-ভালো খাবার প্রস্তুত!
শেরিফ কসাইবেশধারী রবিন হুডকে তার ডান পাশে বসতে বললেন। এরকম কসাই রবিন হুডকে দেখে তার কানে-কানে ফিসফিস করে বলল,–মহাশয়! এই লোকটা বদ্ধ পাগল, আজ বাজারে আমাদের বেজায় নাকাল করেছে। এক আনায় বাজারদরের তিন-চার গুণ মাংস দিয়ে, আমাদের বিক্রি একেবারে মাটি করে দিয়েছিল। লোকটা ভারী বোকা। আমার বিশ্বাস, লোকটার হাতে ঢের টাকা, সে যা-তা করে খরচ করছে। একটু চালাক লোক এর পিছনে লাগলে, বেশ দু-পয়সা আদায় করে নিতে পারে।’
শেরিফ অত্যন্ত লোভী। কসাইয়ের কথা শুনে তার মাথায় একটা খেয়াল হল। রবিন হুডকে বললেন,–’তোমার বোধহয় প্রচুর টাকাপয়সা আছে, না? আজ বাজারে যেমন করে মাংস বেচেছ, তাতে মনে হয় তোমার ঘরে গরু-ছাগলও ঢের।’
রবিন উত্তর করলেন,—’আছে বইকি শেরিফ মশায়! আমার পাঁচশো জন্তু আছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটাও বেচতে পারলাম না। কী আর করি, অগত্যা কসাই সেজে বাজারে বেরিয়েছি। কিন্তু এখন দেখছি, ব্যাবসাটা আমার মাথায় একেবারেই ঢোকে না। তেমন লোক পেলে, আমি সব জন্তুগুলি বেচে ফেলতাম। কেউ যদি কুড়িটা মোহর দেয়, তা হলে আমার জন্তুগুলি দিয়ে দিই।’
শেরিফের আর দেরি সইল না। পাছে জন্তুগুলি হাতছাড়া হয় তাই তাড়াতাড়ি রবিন হুডকে বললেন,–’কিনবার লোক পাও না? আচ্ছা আমি সব কিনব। তোমার জন্তুগুলি সব কাল বাজারে নিয়ে এসো, তখনই তোমাকে টাকা দিয়ে নেব।’
রবিন বললেন,–’তা কী করে হয়? জন্তুগুলো সব বনে চরে বেড়ায়, চট করে ধরা মুশকিল। আপনি না হয় কাল আমার সঙ্গে চলুন, নিজে দেখেশুনে আনবেন এখন।’
‘বেশ, খুব ভালো কথা! তাহলে তুমি আজ রাতটা আমার এখানেই থাকো, কাল সকালে দুজনে এক সঙ্গেই যাওয়া যাবে।’
শেরিফের বাড়িতে থাকা রবিনের একেবারেই ইচ্ছা নয়। আবার কোনও আপত্তি করলে পাছে শেরিফের মনে সন্দেহ হয়, এই ভেবে তিনি তাতেই রাজি হলেন।
ঠিক এই সময়ে একজন কাজের লোক ঘরে ঢুকল। খাবারের পর সকলেই আমোদে ব্যস্ত। হারফোর্ডের বিশপও হাজির ছিলেন। তিনি ততক্ষণে ঘুমিয়েই পড়েছেন! লোকটিকে দেখামাত্র রবিন চমকে ওঠে, তখনই আবার নিজেকে সামলে নিলেন। লোকটাও তাকে দেখতে পেল। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে, যেন সে কোনও জিনিস ভুলে ফেলে এসেছে এইরকম ব্যস্তভাব দেখিয়ে হঠাৎ আবার চলে গেল।
চাকর অন্য কেউ নয়—স্বয়ং লিটল জন!
রবিন হুড মনে-মনে ভাবতে লাগলেন,–’তবে কি লিটল জন অবিশ্বাসী? কাউকে কিছু না বলে কেন সে শেরিফের বাড়িতে এসে চাকরি নিল? আমাকে কি ধরিয়ে দেওয়ার মতলব?’ আবার তখনই ভাবলেন,–’না, লিটল জন কিছুতেই অবিশ্বাসী হতে পারে না।
যা হোক, তিনি আবার খুব আনন্দের সঙ্গে শেরিফের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন।
খানিক পরেই লিটল জন পাত্রে করে মদ নিয়ে এল, ক্ৰমে–ক্রমে সকলের কাছে ধরল। রবিন হুডের কাছে এসে তাঁর আর মদ চাই কি না যেন তাই জিজ্ঞাসা করছে, এইরকম ভাবে তাঁর কানে–কানে ফিসফিস করে বলে গেল—আজ রাত্রে প্যানট্রিতে (খাবার জিনিস এবং বাসন রাখার ঘর) আমার সঙ্গে দেখা করবেন।’
তখন রাত অনেক। একে-একে সকলেই শেরিফকে নমস্কার করে বিদায় নিল। একজন লোককে রবিন হুডের শোওয়ার ঘর দেখিয়ে দিতে বলে, শেরিফ মহাশয়ও বিদায় নিলেন।
লিটল জন কী করে শেরিফের বাড়িতে কাজ নিল, এবার তার বলা দরকার।