তেশই
রবিন হুড বিয়ের পর ম্যারিয়ানকে নিয়ে সুখে দিন কাটাতে লাগল। আমার গল্পটিও এখানে শেষ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বিয়ের পরও রবিন হুড সম্বন্ধে অনেক কথা শুনতে পাওয়া যায়। কাজেই আমার গল্প এখানে শেষ হল না।
রাজা রিচার্ড রবিন হুডের সাহায্যে নরম্যান ব্যারনদের সঙ্গে তাঁর পুরোনো ঝগড়া মিটমাট করে লন্ডনের দিকে রওনা হলেন। নতুন আরল-অব-হান্টিংডন সস্ত্রীক রাজার সঙ্গে গেলেন। লেডি হান্টিংডন লন্ডনে গিয়ে সকলের শ্রদ্ধা ও প্রীতি আকর্ষণ করলেন। তাঁর সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। শরীররক্ষক তিরন্দাজ দলটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করে, এক ভাগ লন্ডনে রেখে অপর ভাগকে রাজা বনরক্ষার জন্য, সারউড এবং বার্নসডেল বনে পাঠিয়ে দিলেন।
এর পর অনেক দিন কেটে গেল। অলসভাবে বসে থেকে–থেকে রবিন হুডের আর ভালো লাগে না। সারউডের জন্য তাঁর প্রাণ কেঁদে উঠছিল। তিনি আর কিছুতেই শহরে থাকতে পারলেন না। রাজার অনুমতি নিয়ে ম্যারিয়ানের সঙ্গে দেশ ভ্রমণে বের হলেন। এই দেশ ভ্রমণই রবিনের জীবনে দুঃখ আনল, তাঁর জীবনের একমাত্র সঙ্গিনী ম্যারিয়ান, প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে বিদেশে মৃত্যুমুখে পড়লেন।
ম্যারিয়ানের মৃত্যুর পর রবিন হুড পাগলের মতো নানা জায়গায় ঘুরতে লাগলেন। কিন্তু কিছুতেই শান্তি পেলেন না। অগত্য তিনি আবার লন্ডনেই ফিরে আসলেন। দুর্ভাগ্যবশত রাজা রিচার্ড তখন আবার ধর্মযুদ্ধে প্যালেস্টাইন চলে গিয়েছিলেন। রিচার্ডের অনুপস্থিতি কালে তাঁর ভ্রাতা যুবরাজ জন কর্তা। রবিন হুডের সঙ্গে তাঁর বনিবনাও ছিল না।
রবিন হুড ফিরে এলে, যুবরাজ জন বিদ্রুপ করে তাঁকে বললেন,—’এখানে আর কেন, তুমি গ্রিনউডেই ফিরে যাও, বেশ করে রাজার হরিণগুলো মেরে খাওগে। রাজা রিচার্ড ফিরে এলেই তোমাকে তাঁর প্রধানমন্ত্রী করে দেবেন!
যুবরাজ জনের এই বিদ্রুপ রবিন হুডের সহ্য হল না, তাঁকে তখনই অত্যন্ত কড়া কথা শুনিয়ে দিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে তাঁকে কারাগারে যেতে হল।
সপ্তাহ কয়েক আবদ্ধ থাকার পর, প্রভুভক্ত স্টাটলি আর তিরন্দাজদের সাহায্যে তাঁকে উদ্ধার করল। সবাই মিলে আবার সারউড বনে ফিরে এলেন।
বনের নির্মল বাতাস শরীরে লাগামাত্র, রবিন হুডের মন উৎসাহে নেচে উঠল। শিঙা নিয়ে সেই পুরোনো আহ্বানধ্বনি করামাত্র, বনরক্ষকরা সবাই এসে হাজির হল। তাঁকে তারা দলপতি করে দিন কাটাতে লাগল! কিন্তু হায়! দুর্ভাগ্যবশত রিচার্ড বিদেশেই মারা গেলেন। তাঁর মৃত্যুর পর জন ইংল্যান্ডের রাজা হলেন।
এরপর একদিন হঠাৎ লিটল জনও সারউডে এসে হাজির। তাকে দেখেই রবিন আলিঙ্গন করে জিগ্যেস করলেন,—’কী ভাই জন! আমাদের গ্রেপ্তার করতে এসেছ বুঝি?‘
জন বলল,–’তা নয়, ভগবানকে অনেক ধন্যবাদ! নতুন রাজা আমাকে জবাব দিয়েছেন। তা ভালোই হল, আমি তো তাই চাইছিলাম। এখানে আসবার জন্য আমার মন পাগল হয়ে উঠেছিল।
ক্রমে রাজার সৈন্যদল এসে দস্যুদের একেবারে অস্থির করে তুলল। রবিন হুড সারউড ছেড়ে, দলবল নিয়ে হ্যাডন হলের কাছাকাছি ডার্বিসায়ারে চলে গেলেন। আজ পর্যন্ত তাঁর প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ সেখানে দেখতে পাওয়া যায়। কথিত আছে যে, একবছর কাল পর্যন্ত নাকি রবিন রাজশক্তি অগ্রাহ্য করে এই প্রাসাদে বাস করেছিলেন।
এই সময়ে একটি যুদ্ধে রবিন হুড আহত হন। আঘাত তেমন গুরুতর ছিল না বটে। কিন্তু প্রতিদিন তাঁর জ্বর হতে লাগল, ক্ৰমে তাঁর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয়ে উঠল।
একদিন তিনি একটি ধর্মাশ্রমের কাছ দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ মাথায় রক্ত উঠে তাঁর মাথা ঘুরে গেল। অতি কষ্টে ঘোড়া থেকে নেমে ধর্মাশ্রমের দরজায় আঘাত করলেন।
তখন কালো কাপড়ে সমস্ত শরীর ঢাকা একজন সন্ন্যাসিনী এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন,—’কে তুমি দরজায় ঘা দিচ্ছ? এখানে পুরুষের প্রবেশ নিষেধ।’
রবিন হুড মিনতি করে বললেন,—’ভগবানের দোহাই, দরজা খুলে দিন। আমি রবিন হুড। জ্বরে কষ্ট পাচ্ছি।’
রবিন হুড নাম শুনেই সন্ন্যাসিনী চমকে উঠলেন। তারপর খানিকক্ষণ চিন্তা করে দরজা খুলে দিলেন। রবিন হুডকে অজ্ঞানপ্রায় দেখে, তাঁকে ধরে ওপরে একটি ঘরে নিয়ে গেলেন এবং মুখে ঠান্ডা জল ছিটিয়ে দিলেন। রবিন হুডের জ্ঞান হল। তখন সন্ন্যাসিনী বললেন,—’মশাই! আপনার শরীর থেকে খানিকটা রক্ত বার করে দিলে এখনই আপনার জ্বর ছেড়ে যাবে। আমার কাছে ছুরি আছে, বলেন তো আপনার শিরা কেটে রক্ত বার করে দিই।’
রবিন হুডের অনুমতি পেয়ে সন্ন্যাসিনী তাঁর শিরা কেটে দিলেন। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তপাতে রবিন হুডের শরীর বড়ই দুর্বল হয়ে পড়ল, তাঁর ওঠবার শক্তি রইল না।
এই সন্ন্যাসিনী সম্বন্ধে লোকের নানারকম মত দেখা যায়। কেউ–কেউ বলে, ভালোর জন্যই সন্ন্যাসিনী এই কাজ করেন। আবার কেউ বলেন, তিনি সেই শেরিফ-কন্যা—রবিন হুডকে হাতে পেয়ে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন।
যাই হোক, রবিন হুড, নিতান্ত অসহায় অবস্থায় পড়ে, দুর্বলকণ্ঠে যতটা পারেন, সাহায্যের জন্য ডাকাডাকি করতে লাগলেন; কেউই তাঁর কথার উত্তর দিল না! হঠাৎ তাঁহার শিঙার কথা মনে পড়ল। শিঙাটি নিয়ে দুর্বল শরীরে অস্পষ্ট তিনটি ফুঁ দিলেন।
লিটল জন কাছেই বনের মধ্যে ছিল বলে সেই শব্দ শুনতে পেল। সে ভাবল,–’এ যে আমার প্রভুর শিঙার আওয়াজ, এত দুর্বল আওয়াজ কেন? হায়! হায়! নিশ্চয়ই তাহলে তিনি মরণাপন্ন। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে জন আশ্রমের দরজার কাছে এসে হাজির হল। দরজা বন্ধ, বারবার আঘাত করেও কোনও উত্তর পেল না। ভাবনায় অস্থির হয়ে, পাগলের মতো দরজায় ভীষণ আঘাত করতে-করতে দরজা খুলে গেল।
তারপর ওপরে গিয়ে দেখল, রবিন মৃত্যুশয্যায়! কষ্টে জনের বুক ফেটে যেতে লাগল। তখন নিতান্ত কাতর হয়ে বলল,–’হায় প্রভু! কে আপনার এ দুর্দশা করল? নিশ্চয় কোনও বিশ্বাসঘাতকের কাজ! তা যদি হয়, তবে এই আশ্রম আমি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেব।’
ক্ষীণ কণ্ঠে রবিন বললেন,-–’না জন। তা কী করে হয়? শত্রুকে ক্ষমা করা উচিত। তুমি তো জানোই যে, জীবনে আমি কখনও স্ত্রীলোকের অনিষ্ট করিনি, এখন মরবার সময় কি আর তা করতে পারি?’
রবিন হুড আর কথা বলতে পারলেন না, চোখ বন্ধ করে বিছানার ওপর পড়ে গেলেন। লিটল জন মনে করল তিনি চলে গেলেন—তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।
কিছুক্ষণ পর রবিন হুডের জ্ঞান ফিরল। জনের হাতখানি ধরে বললেন, ‘জন আমাকে তুলে ধরো ভাই। মরবার সময় একবার একটু বনের হাওয়া খেয়েনি। আমার তিরধনু দাও, জানলা দিয়ে শেষবার একটি তির মেরে নিই। তিরটা যেখানে গিয়ে পড়ে, সেইখানে যেন আমাকে কবর দেওয়া হয়।
এই বলে শেষ চেষ্টায় রবিন হুড একটি তির ছুড়লেন। তির গিয়ে প্রকাণ্ড একটি ওক গাছে লেগে তার তলায় পড়ল। রবিন হুডও জনের বুকের ওপরে পড়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর খুব মৃদুস্বরে বললেন,—’ভাই জন, এইবার শেষ। আমি চললাম। সবাইকে বোলো, আমাকে যেন ওই গাছের তলায় রাখে, আমার ধনুকটিতে গুণ পরিয়ে যেন আমার পাশে রাখা হয়।
এরপর রবিন হুড খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। হঠাৎ তাঁর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তাঁকে দেখে মনে হল, যেন, তিনি আবার বনে দলের মধ্যে ফিরে এসেছেন। একবার ওঠবার চেষ্টা করলেন, তারপর অস্ফুটে বললেন,–’ওই যে সুন্দর হরিণটি যাচ্ছে, উইল! এলান, তুমি কী সুন্দর বীণা বাজাচ্ছ! কী সুন্দর আলো হয়েছে! আ–ম্যারিয়ান! এই যে আমার ম্যারিয়ান এসেছেন!’
প্রলাপ বকতে-বকতে রবিন চলে গেলেন।…