রবিন হুড – ২২

বাইশ  

‘মহারাজ! আমাদের ক্ষমা করুন। আমি রবিন হুড। আপনি যতদিন বেঁচে থাকবেন, আমি আমার এই দলের সঙ্গে আপনার সেবা করব।’

রাজা রিচার্ড সকলের দিকে চেয়ে জিগ্যেস করলেন,–’কেমন? তোমাদের দলপতি যা বলেছেন তা কি ঠিক?’

একশো চল্লিশজন দস্যু একবাক্যে বলে উঠল, ‘হাঁ মহারাজ! ঠিক।’

রবিন হুড বললেন,–’মহারাজ! আমরা অত্যাচারের জ্বালায় দস্যু হয়েছিলাম। এখন আমাদের অভয় দিন, আশ্রয় দিন। সারউড বন ছেড়ে আপনার সঙ্গে আমরা সকলেই যাব।’

রাজা রিচার্ড এই বলশালী দস্যুদলটিকে দেখে ভারী খুশি হলেন। মনে-মনে ভাবলেন, রাজার দেহরক্ষী হওয়ার উপযুক্ত দলই বটে।

তারপর রবিন হুডকে বললেন,–’তোমরা প্রতিজ্ঞা করো যে, আজ থেকে সকলে রাজার সেবা করবে।’

সকলে সমস্বরে বলল,–’হাঁ মহারাজ! আমরা প্রতিজ্ঞা করলাম, আজ থেকে রাজার সেবা করব।’

রাজা বললেন,–’আচ্ছা, তোমাদের সকলকে ক্ষমা করলাম। তোমাদের মতো তিরন্দাজদের সাজা দিয়ে রাখা বড়ই অন্যায়। কিন্তু তোমাদের আর বনে-বনে আমার হরিণ মেরে থাকতে দেব না, আজ থেকে তোমরা আমার শরীর-রক্ষক সৈন্যদল হলে। এখন বলো দেখি, তোমাদের মধ্যে লিটল জন কার নাম? এসো, এগিয়ে দাঁড়াও!’

লিটল জন অগ্রসর হয়ে মাথার টুপি খুলে বলল,–’এই যে মহারাজ! আমি লিটল জন।’

লিটল জনের চেহারাটি দেখে রাজার খুবই পছন্দ হল। তিনি বললেন,—’আচ্ছা লিটল জন! তুমি জেলার কোনও রাজকর্মচারীর কাজ করতে পারবে কি? তা যদি পারো, তবে আজ থেকে তোমাকে আমি নটিংহামের শেরিফ করলাম। আশা করি, এখন যিনি শেরিফ আছেন তাঁর চেয়ে তুমি ভালো কাজ করবে।

তারপর রাজা উইল স্কারলেটকে ডেকে বললেন,–’উইল স্কারলেট! তোমার কথা আমি সব জানতে পেরেছি। তোমার বাবা আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। তোমাকে আমি ক্ষমা করলাম। তোমার বাবা এখন বুড়ো হয়েছেন, এখন থেকে তুমিই তাঁর কাজকর্ম দ্যাখো এবারে যখন লন্ডনে দরবার হবে তখন তুমি যেও। তোমাকে আমি নাইট করে দেব।

তারপর রাজা উইল স্টাটলিকে ডেকে বললেন,–’স্টাটলি! আমি তোমাকে তিরন্দাজদের সর্দার করলাম।’

এরপর রাজা ফ্রায়ার টাককে ডাকলেন। ফ্রায়ার টাক হাতজোড় করে বলল,–’মহারাজ! আমি না জেনে রাজার ওপর হাত তুলেছি, আমাকে ক্ষমা করুন।‘

রাজা রিচার্ড হেসে বললেন,–’রাজার ওপর হাত তুলে তার শাস্তিটাও তো পেয়েছ! যা হোক, ধর্ম এবং রাজার মধ্যে ঝগড়া হয় সেটা আমি চাই না। তোমার ঘরে এক রাত আমায় খেতে ও থাকতে দিয়েছিলে। বলো, তার দরুন কী চাও বলো তো?’

‘মহারাজ! আমি আর কিছু চাই না, শুধু মনের শান্তি চাই। সাদাসিধে লোক আমি। পেট ভরে যদি দু-বেলা খেতে পাই, শরীরটা বেশ ভালো থাকে, মনটাও খুশি থাকে, তাহলেই ঢের হল। তা ছাড়া আমি আর কিছু চাই না।’

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রাজা রিচার্ড বললেন,–’আরে ভাই! তুমি যে সবচেয়ে উঁচুদরের জিনিস চাও দেখছি। মনের সুখ, সেটাই তো দেওয়া মুশকিল! আমার তো ভাই সেটা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তুমি সাধুসন্ন্যাসী লোক—ভগবানের কাছে মনের সুখ ভিক্ষা করো। যদি তুমি পাও, তবে তোমার রাজার জন্যও একটু চেয়ে নিও।

তারপর রাজা জিগ্যেস করলেন,–’এলান-আ-ডেল কে?’ এলান এসে রাজাকে নমস্কার করে দাঁড়াল। রাজা বললেন,–’বটে, তুমি এলান-আ-ডেল? আচ্ছা, প্লিম্পটন চার্চে এক মেয়ের বিয়ে হচ্ছিল, পুরুত-টুরুত সব হাজির ছিলেন, তুমি নাকি তখন মেয়েটিকে চুরি করেছিলে? এখন তোমার কী বলবার আছে, বলো দেখি।

এলান বলল,–’মহারাজ! আপনি যা শুনেছেন তা ঠিকই। আমি মেয়েটিকে খুব ভালোবাসতাম। মেয়েটিও আমাকে ভালোবাসত। কিন্তু সেই নরম্যান লর্ডটি মেয়ের সম্পত্তির লোভে তাকে জোর করে বিয়ে করতে যাচ্ছিলেন।’

‘জানি। আর সেই সম্পত্তি এখন হারফোর্ডের বিশপ মশাই দখল করেছেন। কিন্তু তাঁকে সেটা ছাড়তেই হবে। কাল থেকে তুমি তোমার স্ত্রীকে নিয়ে সেটা দখল করো এবং রাজার সেবায় সুখে দিন কাটাও।’

তারপর হঠাৎ রাজার রবিন হুডের কথা মনে পড়ল। রবিন হুড এতক্ষণ তাঁর না জানি কী শাস্তির ব্যবস্থা হয়, তাই ভাবছিলেন। রাজা তাঁর দিকে ফিরে বললেন,–’আচ্ছা রবিন হুড! তুমি না একটি মেয়েকে ভালোবাসতে? মেয়েটি রানির সখী ছিল, তার নাম না ম্যারিয়ান? তাকে কি তুমি ভুলে গিয়েছ? সে এখন কোথায়? ‘

রাজার কথা শুনে বালক ভৃত্যের মুখখানি লাল হয়ে উঠল। ধীরে-ধীরে রাজার সামনে হাজির হয়ে বলল,–’না মহারাজ। রবিন আমাকে ভুলে যাননি।’

ম্যারিয়ানকে দেখে রাজ রিচার্ড তাঁর হাতে চুম্বন করে বললেন,–’রবিন! আমি ঠিকই ভেবেছিলাম। তুমি রাজার চেয়েও সুখে আছ। আচ্ছা ম্যারিয়ান! তুমিই স্বর্গীয় আরল-অব-হান্টিংডনের একমাত্র মেয়ে?’

ম্যারিয়ান বললেন,—’ ‘হাঁ মহারাজ! কিন্তু লোকে বলে, যে, রবিন হুডের বাবাই আসল আরল-অব হান্টিংডন ছিলেন। যা হোক তাতে কারও কোনও সুবিধা হয় না, কারণ, সেই সম্পত্তি এখন কেড়ে নেওয়া হয়েছে।’

রাজা উত্তেজিত হয়ে বললেন,–’তা যদি হয়ে থাকে, তবে এখনই তা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। পাছে তোমরা দুজনে আবার তা নিয়ে ঝগড়া করো, তাই দুজনেকেই আমি সে সম্পত্তি দিলাম। এসো রবিন হুড! এগিয়ে এসো।’

রবিন এগিয়ে এসে রাজার কাছ হাঁটু গেড়ে বসলেন। রাজা রিচার্ড তাঁর তালোয়ার দিয়ে রবিন হুডের কাঁধ স্পর্শ করে বললেন,–’–’ওঠো রবার্ট ফিটজুত। তোমাকে আমি আজ আরল-অব-হান্টিংডন করলাম।’

রাজার এই কথা শুনে সবাই আনন্দে অধীর হয়ে জয়ধ্বনি করতে লাগল। তারপর রাজা আবার বলতে লাগলেন,–’লড হান্টিংডন! তোমাকে আমি প্রথম হুকুম করছি যে, শিগগির তুমি ম্যারিয়ানকে বিয়ে করো।‘

তখন ম্যারিয়ানকে তাঁর আরও কাছে টেনে নিয়ে রবিন হুড বললেন,—‘ভগবান করুন, আমি যেন মহারাজের হুকুম সবসময় মেনে চলি। আর যদি ম্যারিয়ান রাজি হন, তবে কালই আমাদের বিয়ে হতে পারে।’

‘কই, ম্যারিয়ান তো কোনও আপত্তি করছে না? তাহলে আমিই কন্যাকর্তা হয়ে বিয়ে দেব।’

এইরকম অনেকক্ষণ পর্যন্ত বনের এই অবাধ স্বাধীনতা উপভোগ করে রাজা রিচার্ড খুবই খুশি হলেন। ক্রমে খাওয়ার সময় এল। রাজা সকলের সঙ্গে এক জায়গায় বসে, পরম তৃপ্তির সঙ্গে খাবার খেলেন। খাওয়ার পর রাজার তুষ্টির জন্য এলান তার বীণা বাজিয়ে গান করল। রাজা রিচার্ড অনেকক্ষণ পর্যন্ত গান শুনলেন। বনবাসের এই শেষ রাত—রবিন হুডের এই আমোদ আহ্লাদের মধ্যেও একটু দুঃখের ভাব দেখা দিল। আবার তার পরক্ষণেই ভাবলেন, ম্যারিয়ানের সঙ্গে মিলিত হয়ে রাজসেবায় সুখে দিন কেটে যাবে।

ক্রমে রাত বেশি হওয়ায়, একে-একে সকলেই শুতে গেল। রাজা রিচার্ড ইচ্ছা করেই সবার সঙ্গে বাইরে শুলেন।

পরদিন সকালে সকলে মিলে নটিংহাম অভিমুখে যাত্রা করলেন। সর্বপ্রথম রাজা রিচার্ড, তাঁর পিছনে স্যার রিচার্ড ও তাঁর সৈন্যদল। তারপরে রবিন হুড ও ম্যারিয়ান, তারপর এলান ও তার স্ত্রী এবং আর সকলে দলবেঁধে চলল।

নটিংহামের দরজায় হাজির হলে, প্রহরী জিগ্যেস করল,—’আপনারা কে আসছেন?’

একজন বলল,—’ ‘দরজা খোলো শিগগির, রাজা রিচার্ড এসেছেন।’ প্রহরী তক্ষুনি দরজা খুলে দিল, পোল নামানো হল, রাজা দলবল নিয়ে শহরে এলেন। দেখতে-দেখতে রাজার আগমন বার্তা শহরময় ছড়িয়ে পড়ল। চারদিক থেকে জয় সম্রাটের জয়,’ বলে সকলে আনন্দধ্বনি করতে লাগল।

রাজার আসার খবর পেয়ে শেরিফ মশাই তাড়াতাড়ি এসে হাজির হলেন। রাজার সঙ্গে স্যার রিচার্ড এবং রবিন হুডকে দেখে তাঁর খুব রাগ হল। কিন্তু কিছু না বলে রাজাকে হাঁটু গেড়ে নমস্কার করলেন।

শেরিফকে দেখে রাজা বললেন,—’শেরিফ মশাই! আমার কথা ঠিক হল কি? এই দেখুন, সব ডাকাত নিয়ে এসেছি, এরা সকলেই এখন রাজার চাকর। পাছে আবার কোনও গোল হয়, তাই মনে করেছি, এ জেলার ভারটা এমন একজন লোকের ওপর দেব, যে নাকি কাউকে ভয় করে চলবে না। এই মাস্টার লিটল জন এখন থেকে নটিংহামের শেরিফ হলেন। আপনি শহরের চাবির গোছাটা এখনই একে দিন।‘

শেরিফ মাথা নীচু করে সম্মতি জানালেন। কিন্তু কোনও কথা বলতে সাহস পেলেন না। হারফোর্ডের বিশপও রাজার আসার খবর শুনে এসেছিলেন। তাঁকে রাজা বললেন—লর্ড বিশপ মশাই! আপনার দুষ্কার্মের গন্ধ আমাদের নাকেও এসেছে। আপনি অনেক লোকের সম্পত্তি গ্রাস করেছেন। এসব পাদরির উপযুক্ত হয়নি, আপনাকে পরে হিসাব দিতে হবে। আর আজ বিকালে নটিংহামের গির্জায় একটি বিয়েতে আপনাকে পুরোহিতের কাজ করতে হবে। এখন যান, তার জন্য তৈরি হোন গিয়ে।

বিশপ ভয় পেয়েছিলেন, না জানি কত তিরস্কার শুনতে হবে, তাই তাড়াতাড়ি রাজাকে নমস্কার করে, ‘যে আজ্ঞে’ বলে ফিরে গেলেন।

নটিংহামের প্রাসাদে সেদিন খুব সমারোহ করে দরবার হল। বিকেলে নটিংহাম চার্চে বিবাহ সভায় যাওয়ার জন্য সকলে প্ৰস্তুত হলেন। হারফোর্ডের বিশপ আগে থেকেই সেজেগুজে চার্চে হাজির ছিলেন। তাঁকে সাহায্য করবার জন্য ফ্রায়ার টাকও সেখানে প্রস্তুত ছিল।

বর-কনে আসার পর, বিবাহকার্য সম্পন্ন হয়ে গেল। রাজা রিচার্ড নিজে কন্যা সম্প্রদান করলেন।

বিয়ের পর উইল স্কারলেটের বিশেষ অনুরোধে, রাজা রিচার্ড দলবল নিয়ে গ্যামওয়েল লজে গেলেন। স্কারলেটের বৃদ্ধ বাবা স্কোয়ার জর্জ সকলকে পেয়ে খুব খুশি। আনন্দে তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। সেই রাতে গ্যামওয়েল লজে রাজার সম্মানার্থে মহা ভোজ হয়েছিল।

পরদিন স্যার রিচার্ডের নিমন্ত্রণে রাজা সকলকে নিয়ে প্রাসাদে গেলেন। এইরকম আমোদ আহ্লাদ এবং ভোজের ধূমধামে নতুন আরল-অব-হান্টিংডন রবিন হুডের শুভবিবাহ সুসম্পন্ন হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *