কুড়ি
শেরিফ সহজে ছাড়বার পাত্র নন। প্রাচীরের ওপরের প্রহরীকে বললেন,—’ ‘শিগগির দরজা খোলো, রাজার হুকুম।’
স্যার রিচার্ড তখন প্রাচীরের ওপর এসে বললেন,–’কে হে বাপু তুমি! আমার বাড়ির সামনে এসে চেঁচামেচি করছ?’
শেরিফ বললেন,—’ওরে বিশ্বাসঘাতক নাইট! আমি কে তা তো তুমি বিলক্ষণ জানো। এখন ভালো চাও তো রাজার শত্রুদের বার করে দাও! জানো না, তুমি বেআইনি কাজ করছ?’
‘বিলক্ষণ জানি মশাই! কিন্তু আমার কাজের হিসাব আপনাকে দেওয়ার কিছু আবশ্যক নেই। আমি যা করেছি আমার নিজের জায়গাতেই করেছি, তার জবাব রাজার কাছেই দেব।’
শেরিফ রাগে অন্ধ হয়ে বললেন,–’বটে! তোমার এত বড় আস্পর্ধা! আমিও রাজার কাজই করতে এসেছি। এক্ষুনি যদি দস্যুদের বার করে না দাও, তাহলে তোমার প্রাসাদ পুড়িয়ে দেব।’
স্যার রিচার্ড বললেন,–’কার হুকুমে পোড়াবে? পরোয়ানা দেখাও।’
শেরিফ বললেন,–’পরোয়ানা আবার দেখাব কি? আমার কথাই পরোয়ানা। জানো না আমি নটিংহামের শেরিফ?’
‘সেটা আমার বিলক্ষণ জানা আছে, তবে কি না রাজার হুকুম ছাড়া আমার জায়গায় তোমার কর্তাগিরি খাটবে না। এখন যাও বাপু, মিছিমিছি বকাবকি কোরো না। বাড়ি গিয়ে তোমার স্বভাবটা শোধরাও।’
এই কথা বলে স্যার রিচার্ড ভেতরে চলে গেলেন। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে শেরিফও ফিরে যেতে বাধ্য হলেন।
এদিকে স্যার রিচার্ড রবিন হুডের কাছে ফিরে গিয়ে, আহ্লাদে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,–’-ভালো সময়েই তোমার সঙ্গে দেখা হল রবিন! ঈশ্বরের ইচ্ছায় এখন আমার দিন ফিরেছে। আজই মনে করেছিলাম যে, তোমার টাকাটা গিয়ে শোধ দিয়ে আসব।’
রবিন হুড হাসতে-হাসতে বললেন,–’টাকা তো শোধ দিয়েছেন স্যার রিচার্ড।’
‘তা কী করে হল রবিন? যা করেছি এ তো অতি সামান্য কাজ আমি বলছি তোমার ঋণের টাকার কথা।’
রবিন হুড বললেন,—’—সেটাও শোধ হয়ে গিয়েছে। হারফোর্ডের বিশপ নিজেই সে টাকা আমাকে দিয়েছেন।’
স্যার রিচার্ড জিজ্ঞাসা করলেন,–‘সব টাকা দিয়েছেন?’
চোখ টিপে রবিন বললেন,–’সব টাকা।’
স্যার রিচার্ড একটু হাসলেন কিন্তু তখন সে সম্বন্ধে আর কোনও কথা জিজ্ঞাসা করলেন না।
বিশ্রামের পর সকলে মিলে খাওয়াদাওয়া করলেন। খাওয়ার সময় লেডি রিচার্ডের সঙ্গে রবিন হুডের পরিচয় হল। লেডি রিচার্ডের স্বভাবটি বড়ই মধুর। ম্যারিয়ানকে নিয়ে তিনি অনেক ঠাট্টা তামাশা করলেন। স্যার রিচার্ডের ছেলেও সেখানে হাজির ছিল। বেশ সুশ্রী ছেলেটি। তার তেজস্বী চেহারা দেখলেই মনে হয়, বড় হয়ে সে বাবার মতোই যোদ্ধা হবে।
দস্যুদল প্রাসাদে রাত কাটিয়ে, পরদিন স্যার রিচার্ডের কাছে বিদায় নিল। স্যার রিচার্ড রবিন হুডকে সেই ঋণের চারশো মোহর নেওয়ার জন্য বড়ই পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। রবিন হুড কিছুতেই রাজি হলেন না। তিনি বললেন,–’বিশপের কাছ থেকে সে টাকা আদায় করে নিয়েছি স্যার রিচার্ড! এ টাকাটা আপনিই রাখুন, আপনার কাজে লাগবে।’
এদিকে শেরিফ কয়েক দিন পরই রাজার কাছে স্যার রিচার্ডের নামে অভিযোগ করবার জন্য লন্ডনে চলে গেলেন। রাজা রিচার্ড শেরিফকে ডেকে সব কথা শুনে বললেন,—’—তাই তো। এই রবিন হুডের কথা আমিও যেন শুনেছি। এদের তিরের খেলাও দেখেছি বলে মনে হয়। আচ্ছা, এরাই না ফিনসবারির টুর্নামেন্টে এসেছিল?’
শেরিফ বললেন,–’আজ্ঞে হাঁ মহারাজ! এরা তখন রাজার অভয় পেয়ে এসেছিল।’ ‘রাজার অভয় পেয়ে’, এ কথা বলে শেরিফ বড়ই ভুল করলেন। রিচার্ড তক্ষনি জিগ্যেস করলেন,–’আচ্ছা, সে দিন নটিংহামের মেলায় তারা কেমন করে এসেছিল—লুকিয়ে?
‘আজ্ঞে হাঁ মহারাজ, লুকিয়েই এসেছিল।’
‘তুমি কি তাদের আসতে বারণ করেছিল?’
‘আজ্ঞে না মহারাজ! আসতে ঠিক বারণ করিনি, তবে কি না—’
‘তবে কি না কী, থামলে যে? পরিষ্কার করে বলো।’
শেরিফ মহা ফাঁপরে পড়লেন। মুখ কাঁচুমাচু করে বলতে লাগলেন,—’ ‘মহারাজ! দেশের ভালোর জন্যই আমরাও অভয় দিয়েছিলাম বটে, কিন্তু এ দস্যুগুলো এমন—’
রাজা শেরিফকে বাধা দিয়ে বললেন,—’কী লজ্জার কথা! এমন বিশ্বাসঘাতকের কাজ তো অসভ্য লোকেরাও করে না! আর আমরা কিনা সভ্য খ্রিস্টান বলে বড়াই করি?’
শেরিফ লজ্জায় ও ভয়ে চুপ করে রইলেন। রাজা আবার বলতে লাগলেন—’ঠিক আছে, শেরিফ! আমি এ বিষয়ে খোঁজ করব। দস্যুদের অবশ্য শেখাতে হবে যে, ইংল্যান্ডের রাজা একজনই এবং তারই আইন মেনে চলতে হয়।’ এরপর শেরিফ বিদায় নিয়ে এলেন। পরিষ্কার কিছুই বুঝতে পারলেন না।
এই ঘটনার পনেরো দিন পর, রাজা রিচার্ড একদল নাইট সঙ্গে নিয়ে স্যার রিচার্ডের প্রাসাদে এসে হাজির হলেন। রাজার আগমন–বার্তা পেয়ে, স্যার রিচার্ড প্রাসাদের দরজা খুলে ব্যস্তসমস্ত হয়ে বাইরে এসে হাজির। তিনি রাজা রিচার্ডকে দেখতে পেয়ে হাঁটু গেড়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করলেন। রাজা রিচার্ড ঘোড়া থেকে নেমে স্যার রিচার্ডকে আলিঙ্গন করলেন।
প্রাসাদে হুলুস্থুল ব্যাপার! তুরি, ভেরি প্রভৃতি নানারকম বাজনা বাজিয়ে রাজার অভ্যর্থনা করা হল।
বিশ্রাম এবং আহারের পর রাজা স্যার রিচার্ডকে জিজ্ঞাসা করলেন,—’স্যার রিচার্ড! শুনতে পাই, তোমার বাড়িটা নাকি ডাকাতের আড্ডা হয়েছে?’
স্যার রিচার্ড বুঝতে পারলেন, যে শেরিফ রাজার কানে লাগিয়েছেন। তিনি তখন সব কথা খুলে বললেন। রাজার মন বীরত্ব–পূর্ণ। রবিন হুডের অসমসাহসিক সব কাণ্ড শুনে তিনি বড়ই সন্তুষ্ট হলেন। তারপর স্যার রিচার্ডকে রবিন হুড সম্বন্ধে আরও অনেক কথা জিগ্যেস করলেন। রবিন হুডের বাবার প্রতি অত্যাচারের কথা, রবিন হুডের শত্রুদের কথা, এমন আরও কত কথা—সমস্তই রাজা জানতে পারলেন।
তখন রাজা রিচার্ড হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বললেন,–’এমন লোকটাকে নিজের চোখে না দেখলে চলছে না! আমি সারউডে গিয়ে এই লোকটাকে একবার নিজে পরীক্ষা করে দেখব। আমার লোকজন সব রইল। একদিন পরে এদের নিয়ে আমাকে খুঁজতে যেও।’