রবিন হুড – ১৬

ষোলো  

পূর্বলিখিত ঘটনার কিছুদিন পর, একদিন আর্থার-এ-ব্লান্ড এসে রবিন হুডকে বলল,–’আমি শুনে এসেছি, আজ সকালেই নাকি হারফোর্ডের বিশপ মশায় এই পথে ঘোড়ায় চড়ে যাবেন।’

আর্থারের কথা শুনে উৎসাহে রবিন হুডের মন নেচে উঠল— ‘তাই তো! এ খুব ভালো কবর! কতদিন থেকে ভাবছিলাম, বিশপ মহাশয়কে একদিন সারউড বনে নেমতন্ন খাওয়াতে হবে। এমন সুযোগ হাতের কাছে পেয়ে ছেড়ে দিলে চলবে না! তোমরা এক কাজ করো, খুব মোটা দেখে একটা হরিণ মারো। আজ পাদরি মশাই আমার সঙ্গে খাবেন। তারপর খাওয়ার খরচটা তাঁর কাছে থেকে আদায় করতে হবে।’

বাবুর্চি মাচ্চ জিজ্ঞাসা করল,—’তবে কি হরিণটাকে এখনই কেটেকুটে ঠিক করে রাখব?’

রবিন হুড বললেন,—’না। চলো পাদরি মশায়ের সঙ্গে একটা চালাকি করা যাক। বড় রাস্তার ধারে গিয়ে হরিণটাকে কাটা যাক। সঙ্গে–সঙ্গে পাদরি মশায় আসছেন কিনা দেখাও যাবে এখন। কে জানে বাপু! অন্য কোনও রাস্তায় যদি চলে যান

রবিন হুড কাকে কী করতে হবে সব বলে দিলেন। দলের বেশিরভাগ লোক নিয়ে উইল স্টার্টলি ও লিটল জন বনের এক–একদিকে চলে গেল। অন্য কোনও পথে যদি পাদরি মহাশয় চলে যান, তাই সবদিকের পথগুলিই পাহারা দিতে হবে। রবিন হুড, উইল স্কারলেট, মাচ্চ এবং আরও চারজন লোক নিয়ে সদর রাস্তার দিকে গেলেন। তাঁর দলের সকলেরই রাখালের বেশ। রবিন হুডের মাথায় একটা পুরোনো উলের টুপি, তার পিছনের কি একটা লেজ তাঁর কানের ওপর দিয়ে ঝোলানো। টুপিটার ওপরে একটা ফুটো, সেটার ভেতর দিয়ে এক গোছা চুল বের হয়ে পড়েছে। মুখে এমন কাদা ধুলো মাখানো যে দেখলে চেনবার যো-টি নেই; গায়ে একটি অপরিষ্কার এবং ছেঁড়াখোঁড়া আলখাল্লা—এই হল রবিন হুড়ের সাজ। অন্য সকলেই যার যেমন ইচ্ছে তেমনই সেজেছিল। উইল স্কারলেট যে ফিট বাবুটি সেও এমনই বিশ্রী সাজল, যে দেখলে তার কাছে যাওয়ারও প্রবৃত্তি হয় না।

এই ছয়টি রাখাল বেশধারী দস্যু হরিণ মেরে রাস্তার ধারে রান্না করবার ব্যবস্থা করছে, এমন সময় তারা দেখল, দূরে রাস্তার ঠিক মাঝখানে ধুলো উড়িয়ে অন্ধকার হয়ে গেছে। খানিক পরেই বিশপ মশায় ঘোড়া ছুটিয়ে এসে হাজির হলেন। তাঁর পিছন-পিছন দশজন শরীররক্ষক। রাখালদের দেখতে পেয়েই, বিশপ তাদের কাছে এসে কর্কশস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,—’কে হে বাপু তোমরা? রাজার হরিণ মেরে বড় ফূর্তি করছ?’

‘আজ্ঞে! আমরা ক’জন রাখাল। আজ কি না আমাদের পরব, তাই একটা হরিণ মেরেছি। তা রাজার বনে হাজার-হাজার হরিণ, একটা না হয় মারলামই বা।’

পাদরি বললেন,–’বটে! এ কথা তবে রাজাকে বলতে হবে। হরিণটা কে মেরেছে?’

রবিন বললেন,–’আজ্ঞে হুজুর! আপনি কে দয়া করে বলুন। সেরকমভাবেই কথাবার্তা বলা যাবে।’

একজন শরীররক্ষক রেগে উঠে বলল,–আরে হতভাগা! এ আমাদের হারফোর্ডের লর্ড বিশপ মশাই। সাবধান! বেয়াদবি করবি তো দেখতে পাবি মজা।

শরীররক্ষকের কথা শুনে উইল স্কারলেট বলল,–’তবে তো দেখছি ইনি গির্জার পাদরি সাহেব! তা আমাদের সঙ্গে কেন গোলমাল করতে এসেছেন?

পাদরি রেগে জ্বলে উঠলেন,—’ ‘বটে রে ব্যাটারা! এত বড় আস্পর্ধা? আমার সঙ্গে বেয়াদবি! এক্ষুনি তোদের ধরে নটিংহামের শেরিফের কাছে নিয়ে যাব।’

রবিন হুড বললেন,–’দোহাই হুজুর! মাপ করুন। আমাদের নিয়ে ফাঁসিকাঠে ঝোলাবেন না।’

‘বটে! তোদের মাপ করব? সবকটাকে ফাঁসি কাঠে না ঝুলিয়ে ছাড়ব না। ধর তো ব্যাটাদের!’

রবিন হুড লাফ দিয়ে একটা গাছের আড়ালে গিয়ে শিঙায় তিনটি ফুঁ দিলেন। শিঙার আওয়াজ শুনেই পাদরি বুঝতে পারলেন যে, তিনি রবিন হুডের হাতে পড়েছেন, আজ তাঁর রক্ষা নেই। তখন ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে পালানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাঁর নিজের লোকেরাই ছত্রভঙ্গ হয়ে তাঁর পথ আটকে ফেলল। এদিকে শিঙার আওয়াজ শুনে, একদিক থেকে লিটল জনের লোক এবং অন্য দিক থেকে উইল স্টাটলির লোক এসে তাঁকে ঘিরে ফেলল।

কয়েক মুহূর্ত আগে যাকে ধরবার হুকুম দিয়েছিলেন, এখন তারই কাছে তাকে ক্ষমা চাইতে অনুনয় বিনয় করতে হল। তিনি বললেন, ‘ক্ষমা করো রবিন হুড, তুমি আমায় ক্ষমা করো। তোমাকে যদি চিনতে পারতাম, তবে এ পথে না এসে নিশ্চয়ই অন্য পথে যেতাম

‘ক্ষমা করবার কী আছে বিশপ মশায়? আপনি আমার সঙ্গে যেরকম ব্যবহার করতে যাচ্ছিলেন, তার চাইতে ভালো ব্যবহার আপনার সঙ্গে করব। চলুন। আহারের যথেষ্ট আয়োজন করা হয়েছে, আমার সঙ্গে আপনাকে খেতে হবে।’

সেই অর্ধেক রান্না করা হরিণের মাংস তাঁর ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে, বিশপকে তাঁর অনিচ্ছা সত্ত্বেও সকলে টেনে নিয়ে চলল। বার্নস ডেলের কাছে একটি খোলা জায়গায় এসে রবিন হুড থামলেন। বাবুর্চি মাচ্চ তখন ভালো করে হরিণের মাংস রান্না করতে লাগল। রান্নার সুগন্ধে, বিশপ মহাশয়ের পেটে যেন আগুন জ্বলে উঠল। রান্না শেষ হলে পর, বিশপ খুব আহ্লাদের সঙ্গে সকলের সঙ্গে খেতে বসলেন।

খাওয়াদাওয়ার পর পাদরি মহাশয় শেরিফের ভোজের কথা স্মরণ করে বললেন,–’রবিন হুড! এখন তা হলে আমি উঠি। খাওয়ার দিব্যি আয়োজন করেছ, খরচও কম হয়নি। কিন্তু অত টাকা তো আমার কাছে নেই। দেব কোথা থেকে?’

রবিন হুড বললেন,–’তাই তো বিশপ মশাই! আপনাকে নিয়ে আজ বেশ আমোদে কাটানো গেল। এখন খাওয়ার খরচটা যে কী ধরব তা তো বুঝতেই পারছি না।’

লিটল জন বলল,–’আচ্ছা বিশপ মশাই! আপনার টাকার থলেটি আমাকে দিন, হিসাবটা আমিই না হয় করে দিচ্ছি।’

লিটল জনের কথা শুনে বিশপের রাগে গা শিরশির করে উঠল। স্যার রিচার্ডের ঋণের টাকাটা সেই দিনই সকালে সংগ্রহ করেছেন এবং সেটা তাঁর সঙ্গেই ছিল। ভয়ে ভয়ে বললেন,–’আমার নিজের মাত্র গুটি কতক টাকা আছে। তা ছাড়া আমার ঘোড়ার জিনের মধ্যে যে মোহর আছে, সে আমার নিজের নয়, আমাদের চার্চের টাকা। তাতে অবশ্য তোমরা হাত দেবে না।’

বিশপ এই কথা বলবার আগেই লিটল জন বিশপের ব্যাগ থেকে চারশো স্বর্ণমুদ্রা এনে, তাঁরই ওভারকোট মাটিতে বিছিয়ে, তার ওপর রাখল। কয়েকদিন আগেই স্যার রিচার্ডকে রবিন হুড যে চারশো স্বর্ণমুদ্রা ধার দিয়েছিলেন, এ সেই টাকা।

মোহরগুলি দেখেই রবিন হুড বললেন,–’ধর্মসমাজের টাকা, সে খুব ভালো কথা! ধর্মসমাজ তো চিরকালই গরিবদের সাহায্য করে থাকেন। আমার এখন মনে পড়েছে, আমার একটি গরিব বন্ধু একজন পাদরির কাছ থেকে ঠিক চারশো মোহর ধার করেছিলেন। আচ্ছা, বিশপ মশাই! খাওয়ারের খরচটা আর আপনাকে দিতে হবে না, কিন্তু এই চারশো মোহর নিয়ে আমার সেই গরিব বন্ধুটিকে দেব।’

রবিন হুডের কথা শুনে বিশপের মুখখানি চুন হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে বললেন,–’না, না রবিন হুড! তুমি কখনই এমন অন্যায় কাজ করতে পারো না। রাজার হরিণ মেরেই তো আমাকে খাইয়েছ বাপু! তার জন্য গরিবের ওপর এত অত্যাচার কেন?’

রবিন হুড রেগে বললেন,–’গরিব বইকি! হারফোর্ডের বিশপ আপনি! আপনার অত্যাচারে আশপাশের লোক একবারে উচ্ছন্নে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে। কোথায় গরিব বেচারিদের সাহায্য করবেন, আর কিনা তাদের ওপরেই আপনার বেশি জুলুম। আমার কথা কিছু বলতে চাই না! আমাকেই কি আপনি কম জ্বালিয়েছেন? আপনি আমার বাবার একজন প্রধান শত্রু। আপনার এই টাকা আমি গরিবদের কাজেই খরচ করব, ভগবান আমার সাক্ষী রইলেন। আমি আর কিছু বলতে চাই না। এখন আপনাকে নিয়ে একটু আমোদ করব, আপনাকে একটু নাচতে হবে বিশপ মহাশয়। এলান! এসো তো ভাই, তোমার বীণাটা একটু বাজাও দেখি!’

বিশপ মশাইয়ের আর সহ্য হল না। তিনি রেগে বললেন, ‘বটে, এত বড় আস্পর্ধা। আমি কিছুতেই নাচব না।’

লিটল জন বলল,—’ বিশপ স্যার! আমরাই তাহলে আপনাকে নাচাব।’ তখন লিটল জন ও আর্থার দুইজনে স্থূলকায় পাদরিকে দুই দিক থেকে তুলে ধরে লাফাতে আরম্ভ করে দিল। তাঁর এই অদ্ভুতরকম নাচ দেখে দলের সমস্ত লোক তো হেসে খুন!

নাচ শেষ হলে, লিটল জন পাদরি মহাশয়কে তাঁর ঘোড়ার পিঠে তুলে লেজের দিকে মুখ করে খুব মজবুত করে বাঁধল। তারপর সদর রাস্তায় নিয়ে গিয়ে ঘোড়াটাকে চাবুক লাগানোমাত্র, ঘোড়া বিশপকে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে নটিংহামের দিকে ছুটে চলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *