রবিন হুড – ১৫

পনেরো  

শীতকালটা রবিন হুড দলবল নিয়ে আগুনের চারদিকে বসে কাটালেন। শীতের পর বসন্তকাল এল এবং দেখতে-দেখতে তাও শেষ হয়ে আবার গ্রীষ্মকাল দেখা দিল। এই দীর্ঘকালের মধ্যে রাজা, শেরিফ কিংবা হারফোর্ডের বিশপ কেউই দস্যুদলকে কাবু করতে পারলেন না। বরং দস্যুরা দিন-দিন সংখ্যায় বাড়তে লাগল এবং তাদের অত্যাচারেরও সীমা রইল না।

এতদিনে শেরিফ মশায় নিশ্চয়ই বরখাস্ত হতেন, কিন্তু তাঁর সৌভাগ্যক্রমে হঠাৎ রাজার মৃত্যু হল। রাজা হেনরির মৃত্যুর পর, তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রিচার্ড-অব-দি-লায়ন-হার্ট, অর্থাৎ সিংহের মতো সাহসী রিচার্ড ইংল্যান্ডের রাজা হলেন।

এই খবর যখন সারউড বনে পৌঁছল, তখন রবিন হুড, সকলকে নিয়ে অনেক আন্দোলন-আলোচনার পর ঠিক করলেন, এই নতুন রাজার কাছে তাঁরা আত্মসমর্পণ করে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করবেন। আর রাজার অনুমতি হলে, তাঁরাই সকলে মিলে বন রক্ষা করবার ভার গ্রহণ করবেন। উইল স্কারলেট, স্টাটলি এবং লিটল জন এই তিন জনকে এই কাজের ভার দিয়ে লন্ডনে পাঠিয়ে দিলেন। কথা হল, লন্ডনে পৌঁছে তারা গোপনে ম্যারিয়ানকে এই কাজের ভার দেবে, ম্যারিয়ানই দস্যুদলের হয়ে রাজার কাছে এই প্রস্তাব করবেন। কিন্তু তারা অত্যন্ত দুঃসংবাদ নিয়ে লন্ডন থেকে ফিরে এল। নতুন রাজা রিচার্ড আগেই ধর্মযুদ্ধে (ক্রুসেড) বিদেশে চলে গেছেন। তাঁর অবর্তমানে যুবরাজ জনই কর্তা কিন্তু তাঁর সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত কাজ করা একেবারেই অসম্ভব! তাঁর স্বভাব নিষ্ঠুর ও বিশ্বাসঘাতক। রাজা রিচার্ড লন্ডন ছাড়বার পর থেকেই, যুবরাজ জন অনেক বড়লোকদের জমিদারি সামান্য কারণে বাজেয়াপ্ত করলেন। ম্যারিয়ানের বাবা আর্ল অব হান্টিংডনের মৃত্যুর পর তাঁর সম্পত্তিও দখল করে নিলেন।

ম্যারিয়ান বড়ই বিপদে পড়লেন। কেবল যে তাঁর পিতার সম্পত্তি থেকেই তাঁকে বঞ্চিত করা হল তা নয়, রানির সহচরীর কাজটি পর্যন্ত তার গেল। যুবরাজ জন বিধিমতে তাঁকে জ্বালাতন করতে লাগলেন।

হান্টিংডনের সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, এই খবর রবিন হুড তাঁর লোকেদের মুখে শুনতে পেলেন। ম্যারিয়ানের অন্যান্য বিপদের কথা বিন্দুবিসর্গ তাঁর কানে পৌঁছল না। কিন্তু তবু ম্যারিয়ানের জন্য তাঁর খুব চিন্তা হল। লন্ডনের টুর্নামেন্টের পর থেকে সবসময় ম্যারিয়ানের কথা তাঁর মনে জেগে থাকত।

গ্রীষ্মের পর শরৎকাল হাজির। সারউড বনের সৌন্দর্য চারদিকে ফুটে উঠেছে। একদিন সকালে রবিন হুড, একা বের হয়েছেন। বনের সৌন্দর্য দেখে ক্ষণকালের জন্য ম্যারিয়ানের চিন্তা তাঁর মন থেকে দূর হয়ে গেল, তিনি মুগ্ধ হয়ে রইলেন। সামনে একটা খোলা ময়দান, ময়দানের অন্যপ্রান্তে কতকগুলি হরিণ চরে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু তাঁর দৃষ্টি সে দিকে নেই।

হঠাৎ বন তোলপাড় করে একটা প্রকাণ্ড উন্মত্তপ্রায় হরিণ বের হল। রবিন হুডের সবুজ এবং সোনালি রং-এর পোশাক দেখে, হরিণটা আরও খেপে গিয়ে মাথা নীচু করে তাঁকে আক্রমণ করল। রবিন তিরধনুক হাতে নেওয়ারও অবসর পেলেন না, বেগতিক দেখে একটি গাছের পিছনে আশ্রয় নিলেন। মুহূর্তের মধ্যে উন্মত্ত হরিণ গাছের ওপর এসে হুড়মুড় করে পড়ল।

তখন ধনুকে তির পরাতে পরাতে রবিন হুড দেখলেন, হরিণটা বাঁ-পাশের একটা ঝোপের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। দেখতে–দেখতে ঝোপের ভেতর থেকে একটি বালক ভৃত্য বের হয়ে এল। বালক ভৃত্য আর কেউ নয়, স্বয়ং ম্যারিয়ান—তিনি আবার সারউডে ফিরে এসেছেন! ম্যারিয়ান এগিয়ে গেলেন। হরিণটা যে ভয়ানক খেপে গিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে এবং রবিন হুডও যে ভয় পেয়ে তাঁর দিকে চেয়েছেন, তিনি তা দেখতে পেলেন না।

ম্যারিয়ান ও হরিণ ঠিক এক লাইনে, কাজেই রবিন হুড, তিরও চালাতে পারেন না। ভীষণ গর্জন করে হরিণটা ম্যারিয়ানকে আক্রমণ করল। তিনি অস্ত্র বের করবার অবসর না পেয়ে, লাফিয়ে একপাশে সরে গেলেন বটে, কিন্তু একেবারে রক্ষা পেলেন না—হরিণের শিঙের আঘাত লেগে মাটিতে পড়ে গেলেন। হঠাৎ আক্রান্ত হওয়ায় ম্যারিয়ানের মাথায় ঘোর লেগে গেল। তিনি উঠবার চেষ্টা করতে লাগলেন।

এমন সময় রবিন হুডের চিৎকার তাঁর কানে পৌঁছল,–শুয়ে পড়ো ম্যারিয়ান!’ তক্ষনি ম্যারিয়ান শুয়ে পড়লেন এবং তাঁর মাথার ওপর দিয়ে শনশন শব্দে রবিনের তির হরিণটার কপালে গিয়ে বিঁধল আর হরিণের মৃতদেহ ম্যারিয়ানের ওপরই পড়ে গেল।

চোখের নিমেষে রবিন হুড ম্যারিয়ানের কাছে এসে হরিণটাকে তাঁর ওপর থেকে সরিয়ে, তাঁকে কাছাকাছি একটি ঝরনার ধারে বয়ে নিয়ে গেলেন। ভয়ে তাঁর বুক কাঁপছিল, পাছে ম্যারিয়ান মরে গিয়ে থাকেন। ঝরনার ঠান্ডা জল বারবার মুখের ওপর ছিটিয়ে দেওয়ায়, ম্যারিয়ানের চোখের পাতা নড়ে উঠল দেখে, রবিন দ্বিগুণ উৎসাহে আরও জল ছিটিয়ে দিতে লাগলেন। ক্রমে ম্যারিয়ানের জ্ঞান ফিরে এল। অতি মৃদুস্বরে জিগ্যেস করলেন,—’ ‘আমি কোথায় এসেছি? আমার কী হয়েছে?’

রবিন হুড উত্তর করলেন,—’তুমি সারউড বনে এসেছ, ম্যারিয়ান! কিন্তু দুঃখের বিষয়, বড়ই অভদ্রভাবে তোমার অভ্যর্থনা করেছি।’

কিছুক্ষণ পরেই ম্যারিয়ান চোখ মেলে উঠে বসলেন। তখনও তাঁর মাথা পরিষ্কার হয়নি, তিনি রবিনকে বললেন,—’ ‘মশাই! আমার মনে হয় আপনিই আমাকে এই বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন।’ এইমাত্র বলেই তিনি রবিন হুডকে চিনতে পারলেন, তাঁর মুখে আনন্দের হাসি ফুটে উঠল, মুখ লাল হয়ে গেল এবং ধীরে-ধীরে মাথাটি রবিন হুডের কাঁধে রেখে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। যেন বড়ই আরাম অনুভব করছিলেন। তখন মৃদুস্বরে বিড়বিড় করে বললেন,—’—ও রবিন! সত্যি–সত্যিই কি তুমি?’

রবিন বললেন,–’হাঁ ম্যারিয়ান, আমিই। ভগবানকে শতশত ধন্যবাদ যে তোমার এই বিপদের সময় আমি কাছে থেকে সাহায্য করতে পেরেছি।’ রবিন হুডের স্বর গম্ভীর এবং আবেগপূর্ণ হয়ে উঠল। আবার বললেন,–’ম্যারিয়ান আমি শপথ করেছি যে, আজ থেকে তোমাকে আর কখনও অন্যত্র যেতে দেব না।’

তারপর অনেকক্ষণ পর্যন্ত দুইজনে চুপ করে রইলেন। ম্যারিয়ান রবিনের বুকে মাথা রেখে পরম আনন্দ অনুভব করছিলেন, তাঁর কথা বলার ক্ষমতা ছিল না।

হঠাৎ রবিন হুডের খেয়াল হল। তিনি বললেন,—’বাঃ, আমি তো বেশ মজার লোক দেখছি। ম্যারিয়ান, তুমি এমন একটা আঘাত পেলে আর আমি কিনা দিব্যি চুপ করে বসে আছি! তোমার কি বড্ড লেগেছে?’

‘না, না রবিন! কিছু হয়নি। কোনওরকম চোট লাগেনি। শুধু হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। এখন বেশ ভালোই লাগছে। চলো, আমরা এখন যাই।’

রবিন বললেন— ‘না ম্যারিয়ান। এত ব্যস্ত হওয়ার দরকার কী? তোমার এবং লন্ডন শহরে খবর কী বলো দেখি?

ম্যারিয়ানের বাবার মৃত্যুর পর যুবরাজ জন তাঁদের সমস্ত সম্পত্তি কেড়ে নিয়েছেন এবং ম্যারিয়ান যদি তাঁকে বিবাহ করতে রাজি হন, তাহলে সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবে, অথচ এদিকে অন্য একজন রাজকন্যার সঙ্গে তাঁর বিবাহের কথাবার্তা চলছে,—’এই সব কথা ম্যারিয়ান রবিন হুডকে বললেন। আর এইসব কারণেই যে তিনি আবার বালকের বেশে সারউড বনে চলে এসেছেন, তাও বললেন।

ম্যারিয়ানের প্রতি এই অত্যাচারের কথা শুনতে-শুনতে রবিন হুডের মুখ লাল হয়ে উঠল। তিনি রানি ইলিনরের দেওয়া তলোয়ারখানি হাতে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন,–’ম্যারিয়ান! রানি ইলিনরের এই তলোয়ার হাতে করে আমি শপথ করছি, যুবরাজ জন তোমার কোনও অনিষ্ট করতে পারবে না।’

কুমারী ম্যারিয়ান গ্রিনউডের আড্ডায় ফিরে এলেন। সমস্ত দস্যুদল তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে রাজোচিত সম্মান প্রদর্শন করল। মধুর প্রকৃতি মিসেস এলান-আ-ডেলকে পেয়ে ম্যারিয়ানও পরম সুখী হলেন।

এদিকে রবিন হুড ও ম্যারিয়ানকে যখন হরিণ আক্রমণ করে, ঠিক সেই সময়ে লিটল জন, মাচ্চ, এবং উইল স্কারলেট বনের অন্য দিক দিয়ে বার্নস ডেলের রাস্তায় গিয়ে হাজির। তাদের উদ্দেশ্য, কোনও নাইট কিংবা পাদরিকে দেখতে পেলে, তার সবকিছু লুঠ করে নেবে। কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক ঘুরে তারা দেখল, একজন নাইট ঘোড়ায় চড়ে সেই রাস্তায় আসছেন। মুখখানি তাঁর বড়ই বিমর্ষ এবং নিরাশার ভাবে ভরা। কেবলমাত্র চেহারা দেখে সবসময় অনুমান ঠিক হয় না, তাই লিটল জন নাইটের সামনে এসে হাঁটু গেড়ে তাঁকে নমস্কার করে বলল,—’ ‘মশাই! অনুগ্রহ করে আজ আপনি আমাদের এই বনে আতিথ্য গ্রহণ করুন। আমাদের প্রভু আপনার অপেক্ষায় বসে আছেন, আপনি গেলে একসঙ্গে আহার করবেন।’

নাইট জিজ্ঞাসা করলেন,–’কে তোমাদের প্রভু?’

লিটল জন নাইটের ঘোড়ার রাশ ধরে বলল,–’আজ্ঞে, আমাদের প্রভু রবিন হুড।’

এই কথার পর নাইট দেখলেন, আরও দুইজন দস্যু তাঁর দিকে আসছে। তখন কেমন একটু উদাসীনভাবে বললেন,–’তাই তো তোমাদের নেমতন্নটা দেখছি নিতেই হবে। তবে চলো, আমার আর আপত্তি কী? একটা জায়গায় খাওয়া হলেই হল।’ তখন দস্যু তিনজন তাঁকে নিয়ে তাদের আড্ডায় চলল।

এদিকে ম্যারিয়ান তাঁর চাকরের বেশ বদলাবার অবকাশ পাননি। রবিন হুডের কাছে বসে আছেন। তখন দেখতে পাওয়া গেল যে, তিনজন দস্যু একটি যোদ্ধাকে নিয়ে আসছে। যোদ্ধাটিকে দেখামাত্রই ম্যারিয়ান চিনতে পারলেন—তিনি স্যার রিচার্ড-অব-দি-লি। রাজদরবারে তাঁর খুবই সম্মান। স্যার রিচার্ড পাছে ম্যারিয়ানকে চিনতে পারেন, সেই ভয়ে ম্যারিয়ান সেখান থেকে পালাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু রবিন একটু চোখ টিপে বললেন,–’আঃ! পালাও কেন ম্যারিয়ান? না হয় আজ একটু ভৃত্যের কাজটাই করলে!

ম্যারিয়ানও একটু চোখ টিপে হাসলেন এবং রাজি হলেন।

স্যার রিচার্ডকে দেখেই রবিন হুড নমস্কার করে, খুব ভদ্রতার সঙ্গে বললেন,—’আসতে আজ্ঞা হোক, স্যার নাইট! আপনি ঠিক সময়েই এসেছেন, আমরা সবেমাত্র খেতে যাচ্ছিলাম।‘

স্যার রিচার্ড বললেন,—’—’ভগবান তোমার মঙ্গল করুন মাস্টার রবিন। অনেকক্ষণ ধরে অনাহারে আছি, আমি অতি আহ্লাদের সঙ্গে তোমাদের সঙ্গে খাব।’

তখন একজন লোক স্যার রিচার্ডের ঘোড়াটিকে নিয়ে গেল। স্যার রিচার্ড তাঁর যুদ্ধের পোশাক খুলে রেখে, হাত-মুখ ধুয়ে সকলের সঙ্গে খেতে বসলেন। নানারকমের অতি উপাদেয় সুমিষ্ট খাদ্যদ্রব্য তৈরি, স্যার রিচার্ড তৃপ্তি করে খেলেন। গত তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনি এমন উত্তম সামগ্রী খেতে পাননি। তখন অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে বললেন,—’অনেক ধন্যবাদ মাস্টার রবিন। কোনওদিন যদি দয়া করে তোমরা আমার বাড়ি যাও, তাহলে এর প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করব।’

কিন্তু রবিন হুড তো আর প্রতিদানের আশা করেন না। স্যার নাইটকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন,–’স্যার নাইট! আমার মতো গরিব তিরন্দাজ কি আপনার মতো লোককে বিনা পয়সায় ভোজ দিতে পারে?’

এ কথায় স্যার রিচার্ড সরলভাবে উত্তর করলেন,–’কিন্তু মাস্টার রবিন! আমার কাছে যে টাকাপয়সা কিছু নেই! এত সামান্যই আছে যে সেটা দিতে লজ্জা বোধ হচ্ছে।’

রবিন হুড হেসে বললেন,–’আপনার কাছে কত আছে স্যার? কম হোক আর বেশি হোক, টাকা পেলেই আমরা খুশি হই।’

নাইট বললেন,–’আমার কাছে মোটে দশটি পেনি আছে, এই নাও।’

‘আচ্ছা স্যার নাইট! আপনাকে যে আমি এক সময়ে রাজা হেনরির দরবারে দেখেছি, তখন আপনার খুব ভালো অবস্থা ছিল বলেই মনে হয়। তবে এখন আপনার এরকম দুরবস্থা কী করে হল? আচ্ছা, বলুন দেখি, আপনি কি আগে সাধারণ তিরন্দাজ ছিলেন, তারপর নাইট করে দিয়েছে? না কি বাজে খরচ করে টাকাপয়সা উড়িয়ে দিয়েছেন? বলুন, কিছু লজ্জা করবেন না। যা বলবেন, কখনও তা বাইরে প্রকাশ হবে না।’

স্যার রিচার্ড বললেন,—’রবিন হুড! তবে শোনো আমার দুঃখের কথা! আমাকে কেউ নাইট করে দেয়নি, বংশানুক্রমেই আমরা নাইট। আমি চিরকাল সংযমে কাটিয়েছি। রাজদরবারে আমাকে দেখেছ, সে কথা ঠিক। রাজা হেনরির টুর্নামেন্টে আমিও হাজির ছিলাম, তোমার তিরের খেলা আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমার নাম স্যার রিচার্ড–অব-দি-লি। নটিংহাম শহরের ফটক থেকে আমাদের লি প্রাসাদ খুবই কাছে। পুরুষানুক্রমে আমরা এই লি প্রাসাদে বাস করে আসছি। বছর দুই তিন আগে পাঁচ ছয় হাজার টাকাকেও অতি সামান্য মনে করতাম। কিন্তু রবিন হুড! এখন আমার স্ত্রী, একটি ছেলে, এবং এই দশটি পেনিই আমার একমাত্র সম্বল।’

‘কী করে এত ধনসম্পত্তি হারালেন?’ স্যার রিচার্ড দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন,–’বুদ্ধির দোষে মাস্টার রবিন! বুদ্ধির দোষে সব হারিয়েছি। রাজা রিচার্ডের সঙ্গে আমিও ক্রুসেডে গেছিলাম। এই কিছু দিন হল ফিরেছি। আমার ছেলেটির এখন বিশ বছর বয়স, এরই মধ্যে সে যুদ্ধবিদ্যায় বেশ পটু হয়েছে। টুর্নামেন্ট প্রভৃতি খেলায় তার হাত খুবই পাকা; কিন্তু বরাতটি তার নেহাত মন্দ। একদিন একটা খেলায় একজন নাইটকে খুব জোরে আঘাত করায়, হঠাৎ সেই নাইট মারা যায়। এখন ছেলেটাকে বাঁচানো চাই! আমাকে জমিদারি বিক্রি করে, প্রাসাদ বাঁধা দিয়ে টাকা ধার করতে হল। কিন্তু তাতেও কুলোল না দেখে, শেষে বেজায় সুদে হারফোর্ডের বিশপের কাছ থেকে টাকা ধার করেছি।’

‘উপযুক্ত লোকের কাছ থেকেই ধার করেছেন দেখছি। আচ্ছা, কত টাকা বিশপ মশাই দিয়েছেন?’

‘বিশপের কাছ থেকে ছ’হাজার টাকা ধার করেছি। তিনি এখন ভয় দেখাচ্ছেন, এই মুহূর্তে টাকা না দিলে বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রি করে ফেলবেন।’

আচ্ছা, আপনার এমন কোনও বন্ধু নেই যে আপনার জামিন হতে পারে?’

‘একটি প্রাণীও নেই। অবশ্য রাজা রিচার্ড যদি এখন হাজির থাকতেন, তবে কোনও ভাবনাই ছিল না।’

রবিন হুড ম্যারিয়ানের কানে-কানে কী বললেন। ম্যারিয়ানও লিটল জন এবং উইল স্কারলেটকে ডেকে একটু আড়ালে গিয়ে কী জানি একটা পরামর্শ করতে লাগলেন। তারপর লিটল জন ও উইল স্কারলেট দলের অপর লোকদের সঙ্গে পরামর্শ করে কাছের গুহার মধ্যে গেল। একটু পরেই মোহর ভরতি একটি ব্যাগ নিয়ে রবিন হুডের কাছে এসে হাজির। স্যার রিচার্ড একেবারে অবাক হয়ে গেলেন, তাঁর সাক্ষাতে লিটল জন ব্যাগটি খালি করে চারশো স্বর্ণমুদ্রা রবিন হুডকে গুনে দিল।

রবিন হুড সেই চারশো স্বর্ণমুদ্রা স্যার রিচার্ডকে দিয়ে বললেন, স্যার রিচার্ড! এই টাকা আপনাকে ধার দিলাম, আপনি হারফোর্ডের বিশপের ঋণ শোধ করে দিন।’ স্যার রিচার্ড বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে রবিন হুডকে অন্তরের সঙ্গে ধন্যবাদ দিতে উদ্যত হলেন, রবিন হুড বললেন,—’না, না স্যার রিচার্ড। ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু দরকার নেই। এ তো কেবল নতুন জায়গা থেকে ধার করে পুরোনো ঋণ শোধ করলেন মাত্র। তবে এইটুকু বলতে পারি, হারফোর্ডের বিশপের মতো আমরা এত কড়াকড়ি করব না।’

স্যার রিচার্ডের চোখে জল এসে গেল। দস্যুদের মহত্ত্ব দেখে তিনি হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। ঠিক এই সময়ে কাছের গুহার মধ্য থেকে মাচ্চ একটি কাপড়ের বস্তা এনে বলল,–’স্যার রিচার্ডকে নতুন এক সুট পোশাক দেওয়াটাও উচিত নয় কি?’

রবিন হুড বললেন,–’ঠিক বলেছ মাচ্চ! এই বস্তা থেকে কাপড় কেটে স্যার রিচার্ডকে দাও।’

ম্যারিয়ান রবিন হুডের কানে-কানে বললেন,–’ওঁকে একটা ভালো দেখে ঘোড়াও দাও। এখন যা দেবে, আমি নিশ্চয়ই বলছি এর চারগুণ ফিরে পাবে। লোকটি খুব ভালো। আমি তাঁকে বেশ ভালো করেই জানি।’

স্যার রিচার্ডকে খুব ভালো দেখে একটি ঘোড়াও দেওয়া হল। রবিন হুড আর্থার-এ-ব্লান্ডকে বললেন,–’আর্থার! তুমি স্যার রিচার্ডের সঙ্গে যাও, তাঁকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসো।’

স্যার রিচার্ডের বিমর্ষভাব দূর হয়ে গেল। তিনি এতদূর কৃতজ্ঞ এবং সন্তুষ্ট হলেন, যে, ভালো করে ধন্যবাদটাও দিতে পারলেন না। মুখ দিয়ে তাঁর কথা বের হল না।

পরদিন সকালে স্যার রিচার্ড যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন। কৃতজ্ঞতায় তাঁর মন পূর্ণ, তিনি গম্ভীরস্বরে সকলকে বললেন,–’বন্ধুগণ! ভগবান তোমাদের মঙ্গল করুন। তোমাদের চিরকাল রক্ষা করুন। আমারও মন যেন তোমাদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকে।

বিদায়কালে রবিন হুড স্যার রিচার্ডের হাত ধরে বললেন, ‘স্যার রিচার্ড! আজ থেকে এক বৎসর পরে ঠিক এই জায়গায় আপনার

জন্য আমরা অপেক্ষা করব। আপনার অবস্থা ভালো হলে, তখন আমাদের এই ঋণ শোধ করবেন।’

‘মাস্টার রবিন! আমি স্যার রিচার্ড-অব-দি-লি প্রতিজ্ঞা করছি, আজ থেকে ঠিক এক বছরের মধ্যে এই ঋণ নিশ্চয় শোধ করব। আর, এখন থেকে আমায় তোমাদের একজন বন্ধু বলে মনে করো।’

বিদায়ের পর স্যার রিচার্ড এবং তাঁর স্কোয়ার আর্থার ঘোড়ায় চড়ে বনের ভেতর দিয়ে চললেন এবং দেখতে-দেখতে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *