চোদ্দো
রবিন হুডকে ধরবার জন্য সেই ঝালাইওয়ালাকে পাঠিয়ে, শেরিফ-কন্যা অনেক দিন অপেক্ষা করলেন। তবুও তার কোনও খবর পেলেন না। ভাবলেন, লোকটা বোধ করি রবিন হুডের দেখা পায়নি। এদিকে, সে যে রবিন হুডেরই দলে মিশে তাদের অস্ত্রশস্ত্র পরিষ্কার করছে, তার বিন্দুবিসর্গও তিনি জানতে পারলেন না।
শেরিফ-কন্যা তখন অন্য একটি উপায় স্থির করলেন। নটিংহাম শহরে আর্থার-এ-ব্লান্ড নামে এক জন চর্মকার ছিল। লোকটি অতিশয় বলবান। লাঠিখেলা, কুস্তি এবং তিরের খেলা সব বিদ্যাতেই নিপুণ। কুস্তিতে তার সমান সে অঞ্চলে কেউই ছিল না। প্রায় তিন বছর ক্রমাগত প্রত্যেক টুর্নামেন্টে সকলকে হারিয়ে সে পুরস্কার পেয়েছে। নটিংহাম জেলার যাবতীয় লাঠিয়ালরা আর্থারের নামে ভয়ে জড়সড়ো হত।
এই আর্থারের কথা হঠাৎ শেরিফ-কন্যার মনে পড়ে গেল। তখন তাকে ডেকে এনে, রবিন হুডকে ধরতে নিযুক্ত করলেন।
চুরিচামারি করে কখনও-কখনও রাজার হরিণ মারার অভ্যাসটা আর্থারের ছিল। সুতরাং এই কাজে নিযুক্ত হওয়ার পর তার আনন্দ দেখে কে? সে এখন বুক ফুলিয়ে দিনের বেলাতেই হরিণ মারবে। বনে কোনও পাহারাওয়ালা যদি তাকে কিছু বলে, তখনই সে বলবে— ‘চোপ রও! আমি রাজার কাজে এসেছি।’
হরিণ মারাই আর্থারের প্রধান উদ্দেশ্য। দস্যুদের প্রতি তার কোনও বিদ্বেষের ভাব ছিল না। বরং তাদের স্বাধীন জীবন দেখে তার মনে হিংসাই হত।
আর্থার থলের মধ্যে রুটি আর মদ নিয়ে, তিরধনুক কাঁধে ঝোলাল। হাতে একটি মোটা লাঠি, মাথায় বেজায় শক্ত তিনপুরু চামড়ার টুপি। এইরকম সাজসজ্জা করে চর্মকার রাস্তায় বের হল এবং ক্রমে বনে ঢুকেই সে হরিণ খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
এদিকে রবিন হুড আর লিটল জন একসঙ্গে বের হয়েছেন। লিটল জন দলের জন্য পোশাকের কাপড় কিনতে যাচ্ছে, রবিন হুড তার সঙ্গে। দুজনে সেই হোটেলে এসে হাজির হলেন। খানিকক্ষণ বিশ্রাম করবার পর লিটল জন তার কাজে চলে গেল। রবিন হুড এদিক–সেদিক পায়চারি করতে-করতে, আবার বনে ঢুকেই দেখেন, একটা লোক চোরের মতো হামাগুড়ি দিয়ে একটা হরিণকে লক্ষ করে চলেছে। লোকটাকে দেখেই রবিন ভাবলেন,–’ব্যাটা নিশ্চয়ই চোর! লুকিয়ে হরিণ মারতে এসেছে; একে যেমন করে হোক জব্দ করতে হবে।’ তখন রবিন হুডও গাছের আড়ালে থেকে তার দিকে এগোতে হতে লাগলেন। ক্রমে চর্মকার হরিণের কাছাকাছি গিয়ে তির বের করতে গেল। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সময় রবিন হুড হোঁচট খেলেন। আর সেই শব্দ শুনে চর্মকার পিছন দিকে তাকাল। রবিন হুড ধরা পড়ে গেলেন।
কিন্তু রবিন সামলে নিলেন পরক্ষণে। অতিশয় গম্ভীর স্বরে বললেন,—’থামো! খবরদার তিরে হাত দিও না। তুমি কে হে বাপু? তোমার আস্পর্ধা তো কম নয়! চোরের মতো এসে হরিণ মারতে লেগেছ?’
চর্মকার বলল,–’হরিণ মারি না মারি সেটা আমি বুঝব। তোমার তাতে দরকার? তুমি কোথাকার কে হে বাপু?’
রবিন বললেন,–’আমি কে এখনই সেটা জানতে পারবে। তোমাকে কিছুতেই হরিণ মারতে দেব না।’
চর্মকার বলল,–তুমি একা, না তোমার সঙ্গে আর কেউ আছে? আমাকে বাধা দেওয়া তো একজনের কাজ নয়।’
রবিন বললেন,–’একা হব কেন? এই দ্যাখো আমার সঙ্গে তিরধনুক আছে, তা ছাড়া একটা তলোয়ারও রয়েছে। আর তুমি যদি একটু সবুর করো, তবে ওই ওক গাছ থেকে তোমার মতো একটা লাঠিও কেটে নিতে পারি। যে করেই হোক, তোমাকে একটু সাজা দিতেই হবে।’
চর্মকার বলল,–আরে বাপু, আস্তে! খালি লম্বাচওড়া কথা বললে আর কাজ হয় না! তোমার চেঁচামেচিতে আমার হরিণটি পর্যন্ত পালিয়ে গেল। এখন তবে একটা লাঠি কেটে নিয়ে এসো। তোমার তিরধনুক আর তলোয়ার আমি গ্রাহ্যও করি না, আমার লাঠির মুখে একবার তোমাকে পেলে হয়।’
রবিন হুড তিরধনুক মাটিতে রেখে, একটি ওকের চারা কেটে লাঠি তৈরি করলেন। লোকটার বেয়াদবি দেখে তাঁর সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে।
রবিন হুডকে তৈরি দেখে চর্মকার বলল,–’এসো বাপু! আমি ঢের-ঢের গরুর চামড়া ট্যান করেছি, আজ যদি তোমার চামড়া তার চেয়েও ভালো করে ট্যান না করতে পারি, তবে আমার নামই নয়।‘
রবিন হুড বললেন,–’একটু সবুর করো। আমার যেন মনে হয় তোমার লাঠির চাইতে আমার লাঠিটা লম্বা হয়েছে, এসো সমান করে নিই।’
চর্মকার বলল,–’রেখে দাও তোমার লম্বা আর বেঁটে। আমার লাঠি ঢের লম্বা, তা দেখতেই পাবে এখন। আমার এই সাড়ে আট ফুট লাঠির ঘায়ে গরু সাবাড় হয়ে যায়, তো তুমি কোন ছার!’
তখন লাঠি নিয়ে দুজনে কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুরতে লাগল।
এদিকে লিটল জন দোকানে গিয়ে নিজের কাজ সেরে, আবার বনের দিকে রওনা হল। রবিন হুড যে পথে ফিরেছিলেন, সেই পথ দিয়ে আসতে-আসতে হঠাৎ সে শুনতে পেল, যেন, দুজন লোকে ঝগড়া করছে। একজনের গলা শুনেই বুঝতে পারল, তিনি রবিন হুড! জন অবাক হয়ে গেল—’তাই তো! আমার প্রভু কার সঙ্গে ঝগড়া করছেন? তবে কি রাজার লোকের হাতে পড়েছেন? নাঃ, ব্যাপারটা কী, না দেখলে চলবে না।’
এই ভেবে চুপিচুপি গাছের আড়ালে-আড়ালে থেকে, লিটল জন এগোল। খানিক দূর এসেই দেখে, রবিন হুড ও আর্থার কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুরছে, দুজনেরই হাতে লাঠি আর রাগে রক্তবর্ণ চক্ষু! ব্যাপার দেখে জনের বড়ই আনন্দ হল। নিজে একজন অসাধারণ লাঠি খেলোয়াড়, কাজেই তার কাছে লাঠি খেলাই সবচেয়ে ভালো লাগে। সুতরাং চুপ করে একটি ঝোপের ভিতর বসে, সে তামাশা দেখতে লাগল।
এদিকে অনেক চেষ্টার পর রবিন হুড চর্মকারের পিছন দিকে এক ঘা বসিয়ে দিলেন, মাথা কেটে রক্ত পড়তে লাগল। চর্মকার রবিনকে পালটা এমন এক ঘা বসাল যে, সুদ সমেত আদায় করে নিল। এরকমভাবে প্রায় এক ঘণ্টা যাবৎ লাঠি খেলা চলল। দুজনেই ভাবল, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী তো সহজ খেলোয়াড় নয়!’
এমন সময় হঠাৎ একটি সুযোগ পেয়ে, রবিন হুড চর্মকারের মাথায় আবার ভীষণ আঘাত করলেন। কিন্তু তাহলে কী হয়, চর্মকারের মাথায় যে টুপি! তবু তার মাথা ঝনঝন করে উঠল এবং পড়ো-পড়ো হয়ে টলতে-টলতে সামলে উঠে, চোখের নিমেষে রবিন হুডকে দারুণ আঘাত করল! তিনি ঘাসের ওপর ছিটকে পড়ে বললেন,–’আর মেরো না বাবা! ঢের হয়েছে, এবারে থামো। তোমাকে এই সারউড বনে স্বাধীন হয়ে থাকতে দেব।’
চর্মকার বলল,—’ ‘আচ্ছা বেশ। আর মারব না। কিন্তু তুমি যা বললে, তার জন্য তোমায় ধন্যবাদ দেওয়ার কিছুই নেই। বরং আমার এই লাঠিটাকেই ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।’
‘আচ্ছা ভাই, তাই হোক। এখন অনুগ্রহ করে তোমার নামটি কী বলো দেখি? এমন ওস্তাদ খেলোয়াড়ের নামটি না জানলে চলছে না।’
‘আমি ভাই একজন চর্মকার। এই নটিংহাম শহরে অনেক দিন থেকে আছি। সত্যি বলছি ভাই, তুমি যদি আমার কাছে যাও, আমি বিনা পয়সায় তোমার চামড়া ট্যান করে দেব!
‘আরে ভাই, চামড়া ট্যান করবার আর দরকার নেই। আমার চামড়া আজ যা ট্যান করে দিয়েছ, ঢের দিন আমার সে কথা মনে থাকবে। তুমি ভাই তোমার ট্যানারি (যেখানে চামড়া ট্যান করে) ছেড়ে আমার সঙ্গে এসো, তোমার যদি টাকাপয়সার ভাবনা থাকে, তাহলে আমার নাম রবিন হুডই নয়।’
‘রবিন হুড’ নাম শুনেই আর্থার তাঁর হাতখানি ধরে বলল,–সত্যি বলছেন কি মশাই? আমি এখনই রাজি। কিন্তু আমি যে একটা বড় কাজের কথা ভুলে যাচ্ছি? শেরিফের বাড়ির একজন আপনাকে ধরতে আমায় সারউড বনে পাঠিয়েছিলেন!’
রবিন হুড হাসতে হাসতে বললেন,–’আরে ভাই! একজন ঝালাইওয়ালাও যে তাই করতে এসেছিল, সে তো এখন আমাদের দলে!’
‘তাই তো! দলের লোক বাড়াবার ফন্দিটা তো মন্দ করেননি দেখছি। আচ্ছা, আপনার দলে না লিটল জন আছে, সে এখন কোথায়? সে আমার মায়ের দিক থেকে কুটুম্ব হয়।
‘এই যে আমি, আর্থার!’ এই বলে ঝোপের ভেতর থেকে লিটল জন বের হল। ঝোপের ভেতর থেকে হাসতে-হাসতে তার পেট ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
চর্মকার অবাক হয়ে দেখল, সত্যি-সত্যিই লিটল জন তাঁর সামনে। অনেক দিনের পর দুজনে দেখা। আর্থার লিটল জনকে বুকে জড়িয়ে ধরল। জনও আনন্দে অধীর হয়ে আর্থারের পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে বলল,—’ ‘আর্থার! এমন মজার তামাশা আমি জন্মেও কখনও দেখিনি, আজ রবিন হুডকে তুমি কী ঠ্যাঙানিটাই না দিয়েছ!’
লিটল জনের কথা শুনে রবিন হুডের একটু রাগ হল। তিনি বললেন,—’ বটে, জন! লাঠির বাড়ি খেয়ে আমার পাঁজর ভেঙে গেছে, আর তুমি তাই নিয়ে দিব্যি আনন্দ করছ?’
আজ্ঞে না প্রভু! আপনি রাগ করছেন কেন? মনে পড়ে কি, আর একদিন আপনিও এরকম ঠ্যাঙানি খেয়েছিলেন, আমি ঝোপের ভেতর থেকে দেখছিলাম? আজ তাই সে কথা মনে পড়ে আমার বড় হাসি পেয়েছিল। সে যা হোক, আর্থারের হাতে মার খেয়ে আপনার লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আর্থার সাধারণ লোক নয়, নটিংহামশায়ারে তার মতো লাঠি খেলোয়াড় আর কেউ নেই।’
আর্থার বলল,—’না জন! তুমি বাড়িয়ে বলছ কেন? এরিক-অব-লিঙ্কান একাই আমার সঙ্গে পেরেছিল। আর তুমি তাকে কেমন জব্দই করেছিলে, তা আমি বেশ জানি।’
রবিন তখন বললেন,—’ ‘যাক এখন ওসব কথা। আজকের দিনে দেখছি আমি একটা মস্ত কাজ করে ফেলেছি। আজ যে লাঠিয়ালটাকে দলে আনতে পেরেছি, তার তুলনায় আমার পাঁজরের ব্যথা কিছুই না। এসো ভাই আর্থার! আবার তোমার হাতখানা দাও। তোমার শিকারটা আমি নষ্ট করেছি, চলো আবার একটা হরিণ খুঁজে বার করি গে।’
আর্থার বলল,–’খুব ভালো কথা। চলুন। এসো ভাই জন! চলো, এখন তোমরা যেখানে যাবে, আমি তোমাদের পিছনে-পিছনে আছি।’