রবিন হুড – ১৩

তেরো  

রবিন হুড দলের সকলকে নিয়ে নিরাপদে লন্ডন শহর ছাড়লেন। বলা বাহুল্য, যে, বিদায়কালে ম্যারিয়ানের মনে বড়ই কষ্ট হয়েছিল।

চল্লিশ দিন পর্যন্ত রবিন হুড এবং তাঁর দল নিরাপদেই কাটালেন। চল্লিশ দিন কেটে গেলে পর, শেরিফের ওপর কড়া হুকুম এল, ‘যেমন করে পারো, দস্যুদের জব্দ করতেই হবে। নইলে, তোমার কাজ যাবে।’

টুর্নামেন্টের পর দস্যুদের এই আশ্চর্য ক্ষমতার কথা গোটা ইংল্যান্ড দেশ তোলপাড় করে দিল। শেরিফ মশাই বারবারই অকৃতকার্য হতে লাগলেন, সকলে প্রকাশ্যভাবে তাঁকে ঠাট্টা বিদ্রূপ করতে লাগল। দস্যুদল যে বনের ভেতর কোথায় লুকিয়ে থাকে, শত চেষ্টা করেও শেরিফ তাদের খোঁজ পেলেন না।

শেরিফ-কন্যাকে নটিংহামের মেলায় রানি না করে রবিন হুড যে সকলের সামনে তাঁর অপমান করেছিলেন, সে কথা তিনি কিছুতেই ভুলতে পারেন না। সেই দিন থেকেই শেরিফ কন্যা, রবিন হুডকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখতেন। তাঁর বাবা বারবার রবিন হুডের থেকে অপদস্থ হচ্ছেন দেখে, দস্যুদলের ওপর তাঁর ঘৃণা দিন-দিন বাড়ছিল।

শেরিফ-কন্যা একদিন তাঁর বাবাকে বললেন,—’ দ্যাখো বাবা! লোকজন নিয়ে রবিন হুডের তুমি কিছুই করতে পারবে না, লোকটা খুব চালাক। আমাদেরও চালাকি খেলিয়ে তাকে জব্দ করতে হবে।’ শেরিফ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উত্তর করলেন,–হ্যাঁ মা, তুমি যা বলছ তা তো ঠিকই, কিন্তু পারি কই? শয়তানটার কথা ভেবে–ভেবে যে আমার রাত্রে ঘুম হয় না।’

শেরিফ-কন্যা বললেন,—’ আচ্ছা বাবা! আমি একটা মতলব ঠিক করছি। আমার মনে হয় তাতে তাকে জব্দ করতে পারব।’

শেরিফ বললেন,—’বেশ! অতি উত্তম। যে রবিন হুডকে ধরতে পারবে, তাকে রীতিমতো বকশিশ দেব।’

এর পর একদিন শেরিফ-কন্যা বসে ভাবছিলেন,–’তাই তো, কী করা যায়?’ এমন সময় একজন ঝালাইওয়ালা এল, তার নাম মিডল। সে বাড়ি-বাড়ি ঘুরে বেড়ায় এবং বাসনপত্র ঝালাই করে। লোকটা বেজায় গল্পবাজ। বাবুর্চিখানার পাশের ঘরে বসে, বাসন পিটতে-পিটতে বড়াই করছিল,–’হতভাগা রবিন হুডকে পেলে মজাটা দেখিয়ে দিতাম।’

শেরিফের মেয়ে মিডলের এই অহঙ্কার শুনে ভাবলেন— এই লোকটাকে দিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখা যাক না! চেহারাটা খুব ষণ্ডার মতোই দেখাচ্ছে, আর জাঁকটাও তো কম করছে না!’ তখন ঝালাইওয়ালাকে ডেকে বললেন,—’তুমি কেমন ডাকাত ধরতে পারো, আমি একবার পরীক্ষা করে দেখতে চাই। যদি রবিন হুডকে ধরতে পারো, তা হলে অনেক পুরস্কার পাবে। কেমন, এতে রাজি আছ?’

আহ্লাদে সবগুলি দাঁত দেখিয়ে মিডল বলল, —’আজ্ঞা হাঁ।’

শেরিফ কন্যা বললেন,–’তাহলে এখনই বেরিয়ে পড়ো। এই নাও পরওয়ানা। দেখো, পরওয়ানা যেন হারায় না।’

গ্রেপ্তারি পরওয়ানা নিয়ে মিডল তখনি বেরিয়ে পড়ল। ভারী স্ফূর্তি—রবিন হুডকে ধরবে। মাথার ওপর লাঠি ঘুরিয়ে আস্ফালন করতে-করতে, মিডল বার্নস ডেলের দিকে চলল। বেজায় গরম, রাস্তায় খুবই ধুলো। দুপুরের পর মিডলের পরিশ্রম বোধ হওয়ায়, রাস্তার ধারেই একটি হোটেল দেখতে পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। হোটেলে বসে মদ্যপান করতে-করতে মিডলের একটু ঘুমের ভাব এল।

তার পাশেই দাঁড়িয়ে হোটেলওয়ালা একজন লোকের সঙ্গে রবিন হুডের বিষয় আলোচনা করছিল,–’শুনতে পাই, শেরিফ মশাই না কি আরও লোকের জন্য লিঙ্কনে খবর পাঠিয়েছেন। সৈন্য এলে পরেই সারউড বন থেকে দুস্যদের একেবারে তাড়িয়ে দেবেন।’

হোটেলওয়ালার কথা শুনতে পেয়ে মিডল জিজ্ঞাসা করল, ‘কার কথা বলছ ভাই?’

হোটেলওয়ালা উত্তর করল—রবিন হুডের কথা বলছি। তা শুনে তোমার কী হবে! বেল পাকলে কাকের কী? তুমি ঘুমোও না বাপু।

মিডল বলল,–’মহাশয়, পচা শামুকেও পা কাটে! এত হেলা করছেন কেন?’

হোটেলওয়ালা বলল,–’আরে যাও! শেরিফ নিজে, আর তারপর গাই-অব-জিসবোর্ন প্রভৃতি আরও কত লোক ঘোল খেয়ে গেল, এখন বাকি আছে কি না তোমার মতো ঝালাইওয়ালা! যাও বাপু, রবিন হুডকে ধরা তোমার কাজ নয়

হোটেলওয়ালার কথায় মিডল ভারী গম্ভীরভাবে তার কাঁধে হাত দিয়ে বলল,–’এই নাও ভাই, টেবিলের ওপর তোমার টাকা রেখেছি! আমার জরুরি কাজ আছে, তোমার সঙ্গে বাজে বকাবকি করবার সময় নেই। তবে এটা বলে রাখছি যে, হয়তো বা ফিরবার সময় দেখতে পাবে রবিন হুডকে ধরে নিয়ে এসেছি।’ এই বলে মিডল আবার বার্নস ডেলের রাস্তায় চলল।

প্রায় সিকি মাইল আন্দাজ পথ চলবার পর, একটি যুবকের সঙ্গে মিডলের দেখা হল। যুবকের বয়স কম, মাথায় সুন্দর কোঁকড়ানো চুল-চেহারাটি বড়ই হাসিখুশি। বেজায় গরম, তাই তার লম্বা কোটটি হাতে ঝোলানো—যুবক প্রায় নিরস্ত্র, শুধুমাত্র একখানি তলোয়ার তার সঙ্গে।

মিডলকে দেখে যুবক নমস্কার করে জিগ্যেস করল,—’ভাই, তুমি কোথা থেকে আসছ? খবর কী বলো দেখি?’

মিডলও নমস্কার করে বলল,–’আরে ভাই, খবর আর কী, আমি কোনও খবর-টবর জানি না। বাড়ি-বাড়ি ঘুরে বাসন-পত্র ঝালাই-মেরামত করি।’

যুবক বলল,–’আমি ভাই একটা খবর শুনেছি। দুজন ঝালাইওয়ালা নাকি মাতাল হয়েছিল বলে শাস্তি পেয়েছে।’

মিডল বলল,’এই যদি বাপু তোমার খবর হয়ে থাকে, তাহলে সরে পড়ো শিগগির আমার সামনে থেকে। নইলে এই লাঠি দিয়ে ঠেঙিয়ে তোমায় রাস্তা পার করে দিয়ে আসব। আমি বড় জরুরি কাজে এসেছি। আমাকে বিরক্ত কোরো না বলছি।’

যুবক বলল,–’বটে! এমনকী জরুরি কাজটা ভাই?’

মিডল বলল,–’জরুরি কাজ নয়? রাজার নিজের শিল করা পরওয়ানা শেরিফ মশাই আমাকে দিয়েছেন, রবিন হুড বলে একটা ডাকাত আছে, সে বেটাকে ধরে নিয়ে যেতে হবে। তুমি যদি তার সন্ধান বলে দিতে পারো, তাহলে চট করে বড়লোক হয়ে যাবে।’

যুবক বলল, ‘আচ্ছা ভাই, পরওয়ানাটা দেখাও দেখি, তাহলে আমি তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য খুবই চেষ্টা করব।’

মিডল বলল,–’না ভাই তা হবে না। পরওয়ানা কাউকে দেখাব না। তুমি যদি সাহায্য না করো, তাহলে আমি নিজেই চেষ্টা করব। এই বলে তার লাঠি মাথার ওপর বনবন শব্দে ঘুরতে লাগল।

লোকটা বড়ই সাদাসিধে। তার রকম-সকম দেখে যুবকের হাসি পেল। যুবক বলল,–’আরে ভাই! এসব কথা এই গরমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি বলা চলে? চলো, একটু আগেই মোড়ের ওপর একটা হোটেল আছে, সেখানে বসে একটু ঠান্ডা হয়ে বলা যাবে এখন।

মিডল বলল,–’বেশ চলো। আমার কোনও আপত্তি নেই। ‘

দুই জনে মিলে তখন, মিডল যে হোটেলে গিয়েছিল সেই হোটেলে আবার গিয়ে হাজির। হোটেলওয়ালা দুজনকে দেখে একটু হেসে জিজ্ঞাসা করল,—’ ‘মশাইদের কী চাই?’

মিডল উত্তর করল—’এই বড় গরম কিনা, তাই আবার একটু ঠান্ডা হতে এসেছি। তুমি আমাদের কিছু মদটদ এনে দাও দেখি। ঠান্ডা হতে মিডলের অনেকক্ষণ লাগল। যুবক হুঁশিয়ার লোক, সে গ্লাস একেবারেই স্পর্শ করল না। ধীরে-ধীরে রবিন হুডকে ধরবার নানারকম পরামর্শ দিতে দিতে, খানিকক্ষণ পরেই দেখল, মিডল নাক ডেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর কথাটি নেই, যুবক আস্তে-আস্তে মিডলের পকেট থেকে পরওয়ানা বের করে নিজের পকেটে রেখে দিল। তারপর একটু মুচকি হেসে হোটেলওয়ালাকে বলল,–’আমি এখন চললাম, তোমার পাওনা–টাওনা সব ঝালাইওয়ালা ঘুম থেকে উঠে চুকিয়ে দেবে।’

‘চললাম’ বলল বটে, কিন্তু যাওয়ার জন্য একটুও ব্যস্ত হল না। ঘুম ভেঙে ঝালাইওয়ালাটি কী বলে সেটা শুনতেই হবে, তাই সে বাইরে গিয়ে জানলার নীচে লুকিয়ে রইল।

খানিকক্ষণ পরেই মিডল প্রকাণ্ড একটি হাই তুলে, যুবককেই যেন উদ্দেশ করে জিজ্ঞাসা করল, কী বলছিলে বন্ধু? সে ডাকাত ব্যাটাকে ধরবার না কি একটা মতলব ঠাওরেছিলে?’ এমন সময় হঠাৎ চোখ মেলে দেখল যুবকটি সেখানে নেই। তখন ‘আরে লোকটা গেল কোথায়?’ বলে চেয়ে দেখল, ঘরে অপর একটি প্রাণীও নেই–হোটেলওয়ালা, হোটেলওয়ালা বলে বারবার চিৎকার করাতে হোটেলওয়ালা এসে বলল,—’কেন মশাই! ডাকাডাকি কেন?’

মিডল বলল,–’ডাকছি কেন? তোমার টাকাপয়সা না দিয়ে সে ছোকরাটা গেল কোথা?’

তা তো আমি জানি না। টাকা বোধ করি তোমার ব্যাগেই রেখে গিয়েছে।

মিডল ব্যাগটি উলটপালট করে দেখল তাতে টাকা নেই। শুধু টাকা কেন, রবিন হুডকে ধরবার সে পরওয়ানাখানি নেই! তার চোখ স্থির হয়ে গেল,—’কী সর্বনাশ! কে চুরি করল? আমার ব্যাগ থেকে কে আমার সব বার করে নিয়েছে? দ্যাখো বাপু হোটেলওয়ালা! আমার সঙ্গে চালাকি করলে চলবে না, বিশ্বাসঘাতকতার দরুন এখনই তোমাকে ধরিয়ে দিতে পারি, জানো? তোমাকে বিশ্বাস করে তোমার ঘরে একটু বিশ্রাম করছিলাম, আর কি না আমার ব্যাগটি খুলে কে সব জরুরি কাগজপত্র বার করে নিল!’

হোটেলওয়ালা বলল,–’বাপু, অমন ষাঁড়ের মতো চেঁচাও কেন, একটু থামোই না? তোমার কী নিয়েছে?’

মিডল বলল,–’সব নিয়েছে! সব নিয়েছে! বড় জরুরি কাগজপত্র ছিল। একখানা পরওয়ানাও ছিল, সেই পাজি ব্যাটা দস্যু রবিন হুডকে ধরবার জন্য সঙ্গে করে এনেছিলাম। তা ছাড়া টাকাপয়সাও যে কিছু না ছিল তা নয়।’

হোটেলওয়ালা বলল,–’বাঃ! তুমি আচ্ছা তাজ্জব লোক হে বাপু! একটু আগেই দেখলাম, রবিন হুডের সঙ্গে বসে মদ খাচ্ছ, দুজনে ভারী বন্ধু। এখন সে চলে যেতে না যেতেই তার বাপান্ত করতে আরম্ভ করে দিলে?’

‘কী-ই-ই? ওই ছেলেটা রবিন হুড?’ বিস্ময়ে মিডলের চোখ দুটি বড় হয়ে গেল—মুখ হাঁ করে রইল। তারপর বলল,–’ও যদি রবিন হুড তাহলে তুমি আমাকে বললে না কেন?

‘বলবার দরকার? প্রথমবারে যখন এসেছিলে তখন তুমি বলেছিলে, ফিরে আসবার সময় হয়তো বা দেখতে পাবে, রবিন হুডকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।’ আমিও তোমার সঙ্গে যুবকটিকে দেখে তাই মনে করলাম। এতে আমার অপরাধটা কী হয়েছে বাপু?’

মিডল বলল,—’হাঁ ভাই, ঠিক বলেছ। এখন বুঝতে পারছি, যে রবিন হুডই আমাকে মদ খাইয়ে অজ্ঞান করে এসব কাণ্ড করেছে। আমার টাকাপয়সা, কাগজপত্র, পরওয়ানা সব নিয়ে ভেগেছে!’

হোটেলওয়ালা বলল, আরে হ্যাঁ। তা তো ঠিকই বলছ, আমি সব জানি। কিন্তু বাপু! এখন বাজে কথা রেখে দিয়ে, আসল কাজের কথা বলো দেখি! আমার পাওনাটা চুকিয়ে দাও।’

মিডল বলল,—’কী করে দেব? আমার কাছে তো কিছু নেই! আচ্ছা তুমি একটু সবুর করো, ও বেটাকে ধরে এনে তোমার সব পাওনা চুকিয়ে দেব।’

হোটেলওয়ালা বলল,–’ব্যস, তা হলেই হয়েছে আর কি! রবিন হুডকে ধরে এনে টাকা দেবে? তার চাইতে বলো না বাপু, আমার দোকানটাই বন্ধ করে দিই!’

মিডল বলল,–’আচ্ছা, তোমার কত পাওনা হয়েছে?’

হোটেলওয়ালা বলল,–ঠিক দশ শিলিং পাওনা হয়েছে।’

মিডল বলল,–’তাহলে এক কাজ করো, আমার হাতিয়ারের ব্যাগটি রেখে দাও, আমি এখনই সে বেটাকে ধরে নিয়ে ফিরে আসছি।’

হোটেলওয়ালা বলল,–’শুধু হাতিয়ারের ব্যাগ নিয়ে আমি কী করব? তোমার এই চামড়ার কোটটাও রেখে যেতে হবে।’

মিডল বলল,–’কী মুশকিল! এ যে দেখছি এক চোর যেতে না যেতেই, আর এক চোরের হাতে পড়া গেল! একবার চলো দেখি রাস্তার মাঝখানে, আচ্ছা করে দু-ঘা না দিলে তোমার হুঁস হবে না দেখছি।’

হোটেলওয়ালা বলল,–’কেন বাপু, বাজে বকাবকি করে আমার সময় নষ্ট করছ? জিনিসপত্রগুলো রাখো এখানে, তারপর তোমার লোকের পিছনে যাও।’

মিডল দেখল যে কথাটা নেহাত মন্দ বলেনি; কাজেই তখন জিনিসপত্রগুলি রেখে বেরিয়ে পড়ল।

প্রায় আধ মাইল যেতে না যেতেই মিডল দেখল, একটু আগের সেই যুবক বনের মধ্যে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে হাঁপাতে-হাঁপাতে তার কাছে গিয়ে বলল,—’তবে রে ব্যাটা চোর, শিগগির আমার টাকাকড়ি আর পরওয়ানা দে!’

রবিন বললেন,–’আরে, এ যে সেই ঝালাইওয়ালা দেখছি! তুমি না বাপু রবিন হুডকে খুঁজছিলে? সন্ধান পেলে কি?

মিডল বলল,–’পেয়েছি বইকি! এই দ্যাখো।’ যেমন কথা তেমনই কাজ। হাতের লাঠি বাগিয়ে মিডল এক লাফে এসে রবিন হুডের ওপর পড়ল।

রবিন নিজের তলোয়ার খোলবারও অবসর পেলেন না, ঠকাঠক–ঠকাঠক ক্রমাগত ঝালাইওয়ালার লাঠি তাঁর ওপর পড়তে লাগল। তলোয়ার খুলবেন কী, নিজের প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টাতেই অস্থির! অনেকক্ষণ পরে অতি কষ্টে তলোয়ার খুললেন। রানি ইলিনরের দেওয়া তলোয়ার, অতি উত্তম ইস্পাতের তৈরি। ঝালাইওয়ালার লাঠিটাও তেল খেয়ে-খেয়ে, লোহার ডান্ডার মতো শক্ত ও মজবুত হয়েছে।

মনে করলেন, মিডলের লাঠিগাছটা কেটে ফেলবেন কিন্তু লোহার মতো শক্ত লাঠি, তার কিছুই করতে পারলেন না।

ঝালাইওয়ালার লাঠিটি বেজায় লম্বা, দূর থেকেই সে রবিন হুডকে অনায়াসে উত্তম-মধ্যম কয়েক ঘা বসিয়ে দিল। তিনি বেদনায় অস্থির হয়ে বললেন,–’আরে থামো ভাই ঝালাইওয়ালা! আমার একটা কথা শোনো।’

মিডল বলল,—’থামব বইকি, তোকে ওই গাছে না ঝুলিয়ে আর থামছি না।’ রবিন হুড কি আর করেন, শিঙা বের করে তখন তিনটি ফুঁ দিলেন।

শিঙা বাজাতে দেখে মিডল বুঝতে পারল যে, রবিন হুড চালাকি খেলছেন, তাই তাড়াতাড়ি তাঁকে কাবু করবার জন্য দ্বিগুণ উৎসাহে আবার আক্রমণ করল।

এদিকে শিঙার শব্দ শুনেই, লিটল জন ও উইল স্কারলেট কুড়ি জন লোক নিয়ে এসে, চট করে পিছন দিক থেকে ঝালাইওয়ালাকে ধরে ফেলল।

তারপর জন রবিনকে জিজ্ঞাসা করল,–আজ্ঞে ব্যাপারটা কী, আপনি বসে-বসে হাঁপাচ্ছেন কেন? ‘

রবিন বললেন,–’আরে ভাই! এই ঝালাইওয়ালা বেটা আমাকে মেরে একেবারে পাট করে ফেলেছে!’

লিটল জন লাঠি খেলা পেলে আর কিছু চায় না। তা ছাড়া, ঝালাইওয়ালাকে কিছু শাস্তি দেওয়াটাও আবশ্যক মনে করে, রবিন হুডকে বলল—’আজ্ঞে! ঝালাইওয়ালার বোধ করি এখনও সাধ মেটেনি, তবে আমার সঙ্গেও খানিকটা হয়ে যাক।‘

তখন রবিন হুড বললেন,–’আরে, সেটা কি আর আমি পারতাম না? হতভাগা যে আমাকে একটুও অবসর দিল না। হাতে তলোয়ার ছিল, কিন্তু সেটা রানির উপহার—এমন চমৎকার জিনিসটি বেটার লোহার মতো শক্ত লাঠিতে মেরে নষ্ট করতে ইচ্ছা হল না। আর বলতে গেলে, ওর তেমন দোষ নাই। ওর কাগজপত্র সব আমি চুরি করেছিলাম।’

রবিনের কথা শুনে ঝালাইওয়ালা বলল, ‘কেবল কি কাগজপত্র চুরি? তা ছাড়া আমার টাকাপয়সা এবং খুঁটিনাটি আরও কত জিনিস ছিল।’

রবিন বললেন,–’আরে ভাই, আমি সবই জানি। তুমি যখন হোটেলওয়ালাকে চুরির জিনিসের হিসাব দিচ্ছিলে, আমি ঘরের বাইরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনতে পেয়েছিলাম। আচ্ছা ভাই, এই নাও তোমার জিনিসপত্র; আর বারোটি শিলিং ছিল বলছিলে, তার জায়গায় বারোটি মোহর তোমাকে দিচ্ছি। আর যদি তোমার রাগটা চলে গিয়ে থাকে, তাহলে এই নাও আমার হাত। এই বলে রবিন হুড, মিডল-এর দিকে হাতটি বাড়িয়ে দিলেন।

মিডল খুশি মনে রবিন হুডের হাত নিয়ে বলল,–’মশাই! আপনার ওপর আমার বড় শ্রদ্ধা হয়েছে। আপনারা যদি আমার মতো সামান্য লোককে আপনাদের দলে নেন, তবে আমি বড় খুশি হব। আপনাদের দলে কি কোনও ঝালাইওয়ালার দরকার নেই? আমি দলের

সকলের অস্ত্রশস্ত্র সাফ করব, বাসনপত্র মেরামত করব, তা ছাড়া দরকার হলে যুদ্ধও করব।’

রবিন হুড সকলের মত নিয়ে মিডলকে দলে ভরতি করে নিলেন। মিডলও তখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে সকলের সঙ্গে সারউড বনে প্রবেশ করল। শেরিফ-কন্যার কথা তার মনে আর স্থান পেল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *