রবিদাস কাহিনি
পনেরো বছর আগে যখন মোহনগড় হাসপাতালের ডাক্তার হয়ে আসি, তখনই কোয়ার্টারের মালি রাখোয়াল কুজুরের মুখে শুনেছিলাম রূপঠাকুরের গল্প। এরকম গল্প আমি অনেক জায়গায় শুনেছি। লোনাজলা গাঁয়ের রামপদ মণ্ডল একবার আমাকে বলেছিল বনবিবির কথা। সে নাকি নিজের চোখে দেখেছিল, বাঘের পিঠে চড়ে জগদ্ধাত্রী ঠাকুরের মতন বনবিবি মাঠ পার হয়ে বনের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন। অমাবস্যার রাতে রাবণ রাজার সিংহদরজা খোলার শব্দও তাদের গাঁয়ের লোকে নাকি প্রায়ই শুনত। এসব গল্প শুনে বেশ মজা পাওয়া যায়, যদিও জানি, এসব আজগুবি কাহিনিগুলো গাঁয়ের লোকের বানানো। তারা বনেবাদাড়ে ভূত দ্যাখে। তাদের আবার নানারকম চেহারা।
রাখোয়ালের গল্প আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। পনেরো নম্বর বেডের রোগী মারা যাবার আগে আমাকে যে চিঠি দিয়ে গেল, তাতে আবার নতুন করে সব মনে পড়ল। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যে একটা হতভম্ব ভাব আমাকে অনেক দিন ধরে চেপে রেখেছিল। আজও যখন ভাবি, তখন মনে হয়, সত্যিই কি হর্ষ ডাক্তার সত্যি কথা বলেছিলেন? নাকি তাঁর মস্তিষ্কবিকৃতিই হয়েছিল? রাখোয়ালের গল্পের সঙ্গে তাঁর কাহিনির অবিশ্বাস্যরকম যোগটা কি কাকতালীয়! কিন্তু গল্পটা পরে আমি অনেক শিক্ষিত লোকের কাছেও শুনেছি। চুনের খনির ম্যানেজার মি. চক্রবর্তীও বলেছিলেন ঘটনাটি সত্যি।
মোহনগড় হাসপাতালের বাঙালি ডাক্তারের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা কাগজেও বেরিয়েছিল। নামটা ছিল অদ্ভুত। হর্ষবর্ধন সাধ্য। আমি জানতাম না, ওরকম নাম-পদবি বাঙালিদের থাকে কি না। তাঁর খালি জায়গাতেই আমি চাকরি নিয়ে এখানে আসি। এসে হর্ষ ডাক্তারের সুনাম আর প্রশংসা অনেকের কাছেই শুনেছি। রোগীদের কাছে তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। পুরোনো ডাক্তাররা বলেন, তিনি ছিলেন এক অসাধারণ সার্জন। ভালুকে ফালাফালা করে চিরেছে এমন একাধিক রোগীকে তিনি শুধু বাঁচিয়েছেন তা-ই নয়, অদ্ভুত নিখুঁতভাবে তাদের চেহারা সারিয়ে তুলেছিলেন। এরকম একজন ডাক্তারের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটা সকলকে হতবাক করেছিল। কেউ তাঁর শত্রু ছিল না। সেই জন্যে ঘটনাটা আরও বিস্ময়কর, আরও রহস্যময়।
রাখোয়াল মালি হর্ষ ডাক্তারের কথার সঙ্গে সঙ্গে আরও নানারকম গল্প করত। রূপঠাকুরের গল্পও সেরকম একটা।
মোহনগড়ের লোকে অনেকেই দেখেছে রূপঠাকুরকে। রুপোর মতন দেহ থেকে জ্যোতি বেরোচ্ছে। দেবতার মতন সুন্দর চোখ-মুখও যেন রুপো দিয়ে তৈরি। গাঁয়ের লোকের যখনই কোনও বিপদ হয়েছে, রূপঠাকুর মুহূর্তের মধ্যে এসে বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। তারপর হরিণের মতো দ্রুতপায়ে কোথায় মিলিয়ে গিয়েছেন।
বিষ্ণু মোহান্তির মেয়ে যেবার নদীতে ডুবে গেল, গাঁয়ের লোকে শুধু নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে হায় হায় করছিল। কোথা থেকে দেবতার মতন ছুটে এলেন রূপঠাকুর। নদীতে ডুব দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে তুলে আনলেন অজ্ঞান মেয়েটিকে। তারপর তাকে পাড়ে শুইয়ে রেখেই চোখের পলক ফেলতে-না ফেলতেই অদৃশ্য। সেই গতির সঙ্গে মোটরগাড়িও পাল্লা দিয়ে পারবে না।
জালিয়া নায়ক যেবার বনের মধ্যে মহুয়া আনতে গিয়ে ভালুকের হাতে পড়ে, ওই রূপঠাকুরই তখন ভালুককে ঘুসি মেরে তাকে বাঁচিয়েছিলেন। বাঘে-ভালুকে তাঁর কোনও ক্ষতি করতে পারত না। শুধু বিপদত্ৰাতাই নন, আরও কতরকম উপকার করতেন তিনি। আবদুল গনির বলদজোড়া মরে গেলে সে হায় হায় করছিল, কী দিয়ে জমি চষবে, তার চিন্তায়। পরদিন সকালে খেতে গিয়ে সে অবাক। রাত্তিরেই কে তার জমি চষে রেখেছে।
এত সুন্দর চাষ সে। বলদ দিয়ে করতে পারত না। সেলিম মিয়াঁর ঘরের চালের খড় খসে পড়েছিল।
মাঝরাতে চালে খড়খড় আওয়াজ শুনে হইহই করে উঠে পড়েছিল সে। রাত্তিরে ভাম নামে একরকম জন্তু আসে পায়রা-মুরগি খেতে। কিন্তু কী দেখল সেলিম? জোছনার আলোয় পরিষ্কার দেখল, একটা রুপোর মূর্তি চাল থেকে নেমে বিদ্যুতের মতন দূরে মিলিয়ে গেল। চালের দিকে তাকিয়ে সে অবাক। নতুন খড় দিয়ে তার চাল ছাওয়া। আনন্দে-ভক্তিতে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলেছিল সেলিম মিয়াঁ।
সেই রূপঠাকুরই পরে হয়ে উঠেছিলেন আশপাশের সমস্ত গাঁয়ের বিভীষিকা। পাশের গাঁয়ের বড়লোক লক্ষ্মণ মহাপাত্রকে গলা টিপে মেরে তার সিন্দুক থেকে সব টাকাকড়ি, গয়নাগাটি নিয়ে চলে যান। এরপরে কত খুন, কত ডাকাতি। ঘরের মধ্যে রূপঠাকুরকে বাক্স ভাঙতে দেখেও কেউ বাধা দেয়নি। ইষ্টনাম জপ করেছে। পুলিশ এসেও কিছু করতে পারেনি এসব খুন-ডাকাতির। রূপঠাকুরের কথা বললে তারা অবিশ্বাসের হাসি হেসেছে। কিছু নিরীহ লোককে ধরে হেনস্থা করেছে। পরে গাঁয়ের হিন্দু-মুসলমান সবাই মিলে রূপঠাকুরের পুজো দিলে রূপঠাকুরের দৃষ্টি চলে যায় গাঁ থেকে। আর কোনও দিন তিনি আসেননি।
রাখোয়াল হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলেছিল, জানি না, রূপঠাকুর হঠাৎ কেন ভয়ংকর রূপ নিয়েছিলেন। হয়তো গাঁয়ের লোকদের ত্রুটি হয়েছিল কিছু। আজও মোহনগড়ের আদিবাসী হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টানরা মিলে শ্রাবণ পূর্ণিমায় রূপঠাকুরের পুজো দেয় খৈরি নদীর ধারে, যেখানে বিষ্ণু মোহান্তির মেয়েকে তিনি তুলেছিলেন।
পনেরো বছর আগেকার শোনা এই রূপঠাকুরের গল্প যে আরেক শিক্ষিত বিজ্ঞানবিদের গল্পের সঙ্গে মিশে গিয়ে আমাকে এভাবে হতভম্ব করবে, তা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।
সকালে হাসপাতালে আসতেই নার্স বলল, ডক্টর মিত্র, পনেরো নম্বর বেডের পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে এখুনি। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
পনেরো নম্বর বেডের কাছে এলাম। বেডের পাশে চার্টে নাম দেখলাম–সাধুবাবা। রোগ–সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস। সাধুবাবা মোহনদেবের মন্দিরে কিছু দিন হল ডেরা বেঁধেছিল। ক-দিনের মধ্যে ভক্তট জুটিয়ে নিয়ে দিন কাটাচ্ছিল বেশ। অসুস্থ হয়ে পড়তে ভক্তরাই তাকে হাসপাতালে ভরতি করে দেয়। বড় বড় চুল আর গোঁফদাড়ি ভরতি মুখটার মধ্যে চোখ দুটো যেন বেমানান। আমি যেতেই ইশারায় কাছে ডেকে সাধুবাবা বলল, ডাক্তার, যাওয়ার আগে একটা কথা বলে যাই। মোহনদেবের মন্দিরে আমার বাক্সের মধ্যে একটা কাগজ আছে। ওটা নিয়ে পড়বে। একটা জিনিস তোমাকেই জানিয়ে যেতে চাই। পড়ার পরে ছিঁড়ে ফেলতে পার কাগজটা।
আমি সাধুবাবাকে আশ্বাস দিয়ে বলি, তুমি নিশ্চয় সেরে উঠবে সাধু। ক’দিনের মধ্যেই তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
সাধুবাবা মৃদু হেসে বলল, ডাক্তার, সেরিব্রাল হেমারেজের মধ্যে মাঝে মাঝে সাময়িক একটা জ্ঞান ফিরে আসে। আমার তাই হয়েছে। এর পরে আসবে বড় ঢেউটা। তারপরেই শেষ। হর্ষ ডাক্তার ভুল বলে না।
ভয়ানক রকম চমকে উঠলাম। সেদিনই রাত্রে মারা গেলেন সাধুবাবা ওরফে ডাঃ হর্ষবর্ধন সাধ্য। হাসপাতালের অন্য ডাক্তার নার্স কর্মচারীরা চিনতে পারল গোঁফদাড়ির মধ্যে হর্ষ ডাক্তারের মুখটাকে। কিন্তু তার এই পরিণতির কারণ কিছুই জানতে পারল না। বিশ্বাস করল, হর্ষ ডাক্তারের হঠাৎ মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
কারণটা জেনেছিলাম আমি। কাউকে বলিনি। বলতে সাহস পাইনি আজও। কারণ নিজেই বুঝতে পারছি না, আমি কি সত্যিই তার কথা বিশ্বাস করেছি।
সাধুচরণের ভক্তদের মধ্যে রাখোয়ালও ছিল। সেই বাক্সটা নিয়ে এসে আমাকে দিয়েছিল। সহকর্মীরা হেসেছিল আমার খেয়াল দেখে। কেউ বলল, দেখুন, যদি কিছু মেডিক্যাল পেপার থেকে থাকে।
ডাক্তারি কোনও বইপত্র ছিল না। তার বদলে ছিল জগদীশ ঘোষের গীতা, রাজশেখর বসুর রামায়ণ-মহাভারত। আর ছিল সেই চিঠি। কাউকে উদ্দেশ্য করে নয়। জানি না কার জন্যে হর্ষ ডাক্তার লিখেছিলেন এই অকথিত কাহিনি। দারুণ বিস্ময়ের সঙ্গে পড়তে শুরু করলাম সেই আত্মকথা–
আমি হর্ষবর্ধন সাধ্য। জীবনে কোনও পরীক্ষায় প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হইনি কখনও। ইচ্ছে ছিল, বিজ্ঞানে গবেষণা করে বৈজ্ঞানিক হব। ইলে নির্ক্স আমার প্রিয় সাবজেক্ট ছিল। কিন্তু মামাবাড়ির চাপে ডাক্তারিতে ভরতি হতে হল। ছোটবেলাতেই আমার বাবা-মা মারা যাওয়াতে মামাবাড়িতেই আমি মানুষ।
ডাক্তারি পরীক্ষাতেও চরম সাফল্যের সঙ্গে বেরিয়ে এলাম। আমার ডিসেকশন অধ্যাপক আর ছাত্রদের মধ্যে একটা কিংবদন্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ডাক্তার হয়ে মামাদের ইচ্ছেমতো বিলেত না গিয়ে যখন মোহনগড় হাসপাতালের চাকরি নিলাম, তখন ভয়ানক রেগে গেলেন তাঁরা। সহপাঠীরাও অবাক হয়ে নাম দিল, ডাক্তার হর্স।
মোহনগড় অঞ্চলে আমার সুনাম ছড়িয়ে পড়ল অল্পকালের মধ্যেই। স্থানীয় লোকের কাছে আমার নাম বদলে গিয়ে অন্য রূপ নিল–সাধু ডাক্তার।
এরপরে গোপনে একটা ভয়ানক কাজে হাত দিলাম আমি, যা এ দেশে এখনও কেউ করেনি। একটা রোবট তৈরির কাজ। ডাক্তারি আর পদার্থবিদ্যার সংমিশ্রণে তৈরি করতে আরম্ভ করলাম এই রোবট। আমার তৈরি এই রোবটের শরীর হবে না যান্ত্রিক। প্রকৃতি স্বয়ং যে নিখুঁত দেহযন্ত্রটি গড়েছেন, সেটাকেই কাজে লাগাব ঠিক করলাম। তার জন্য দরকার একটা সদ্যোমৃত মনুষ্যশরীর। সেই দিনটা এল। গাঁয়ের একজন লোক সাপের কামড়ে মারা গেলে আত্মীয়স্বজনরা তার দেহ নদীতে ভাসিয়ে দিল। সাপের কামড়ে মৃত ব্যক্তির দেহ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়াই এখানকার রীতি। রাতের অন্ধকারে নদীর বুক থেকে চুরি করলাম সেই শবদেহ। এ কাজে আমার সহকারী ছিল আমার বিশ্বস্ত ভৃত্য ত্রিনাথ! ব্যাপারটা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্পের মতো মনে হচ্ছে, তাই না? না। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানবের ছিল নিজস্ব মস্তিষ্ক, কিন্তু আমার সৃষ্ট রোবটের নিজস্ব কোনও মস্তিষ্ক থাকবে না। একটা ইলেকট্রনিক ব্রেন থাকবে। সুইচ অন করলেই ব্রেনটা চালু হয়ে যাবে। একটা ট্রান্সমিটারে আমি তাকে কোনও আদেশ করলেই তার ইলেকট্রনিক ব্রেন সেটা গ্রহণ করবে, আর সঙ্গে সঙ্গে সেই আদেশমতো কাজ করতে এগোবে আমার তৈরি বেতাল এই রোবট। কাজ হয়ে গেলেই তার মাথার পেছনে অবস্থিত কমান্ড মডিউল তাকে আমার কাছে অর্থাৎ ট্রান্সমিটারের কাছে ফিরিয়ে আনবে। তখন আবার সুইচ অফ করে তাকে শুইয়ে রাখব।
অনেক দিনের অক্লান্ত সাধনায় একদিন মানুষ দেহধারী রোবট প্রাণ পেল। তার মুখ বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। আমি অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি একটা মুখোশে তার মুন্ডুটা ঢেকে দিলাম, মমির বেলায় যেমন করা হত। তাতে সুন্দর একটা রৌপ্যমূর্তির মতন তাকে দেখতে হল। দেহসন্ধিগুলো শুধু অনাবৃত রাখলাম, যাতে নড়াচড়া-চলাফেরা করতে অসুবিধা না হয়। আর একটা জিনিস আমি করলাম। আগের কনট্রোল ট্রান্সমিটারের সঙ্গে জুড়ে দিলাম একটা ভয়েসকাস্ট ট্রান্সমিটার। রিসিভার আর স্পিকারটা বসালাম রোবটের মুখগহ্বরে। ভয়েসকাস্ট ট্রান্সমিটারে পাঠানো আমার কণ্ঠস্বর রোবটের মুখে শোনা যাবে চমৎকারভাবে। রোবটের একটা নামকরণও করলাম–রবিদাস। রবি কথাটা আসলে রোবি, রোবট-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। আর দাস মানে তো ভৃত্য। আমার এই দুই ট্রান্সমিটার দশ মাইল দূরত্ব পর্যন্ত রবিদাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত।
আমি রবিদাসকে দিয়ে নানা কাজ করাতে লাগলাম। সকলের উপকার আর কল্যাণের কাজ। মানুষ হয়ে করতে যাতে অনেক বাধা, রবিদাসের পক্ষে তা ছেলেখেলা। তার কাজের গতিও হল অবিশ্বাস্যরকম দ্রুত। শক্তিতে সে একটা ছোটখাটো ক্রেনের সমান। কিছু দিনের মধ্যেই রূপঠাকুর নামে মোহনগড়ে তার পরিচয় হয়ে গেল। সরল বিশ্বাসী গাঁয়ের লোক ভাবল সে মোহনদেবেরই জাগ্রত রূপ। স্থানীয় এক ব্যাবসাদার বেআইনিভাবে সরষের তেল আর কেরোসিন তেল মজুত করে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করছিল। আমি রবিদাসকে রাতে তার কাছে পাঠিয়ে তাকে দিয়ে (আমার কণ্ঠে) বলালাম, কাল সকালেই সব মজুত মাল বের করে না দিলে তার মৃতদেহ খৈরির জলে ভাসবে। স্বয়ং রূপঠাকুরকে সামনে দেখে সে ভয় পেয়ে গেল। পরদিন থেকে তেলের অভাব আর থাকল না।
আমি ভাবলাম, এরকম আরও রবিদাসের সৃষ্টি করে দেশের সমস্যা সমাধানের কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দেব। হাজার রবিদাস মাঠে সোনা ফলাবে, গ্রাম-শহর পরিষ্কার রাখবে। তারা বাঁধ তৈরি করবে, বাড়ি তৈরি করবে, রাস্তা তৈরি করবে। কিন্তু সব স্বপ্ন, সব কল্পনা চুরমার হয়ে গেল অল্পকালের মধ্যেই।
স্থানীয় এক ডাকাতের সর্দার একদিন রাত্তিরে চলমান রবিদাসকে দেখে ফেলল। রূপঠাকুরের সামনে পড়ে গিয়ে সে ভয় শিউরে উঠল। অবশ্য তার ভয়ের কোনও কারণ ছিল না। তাকে সামনে দেখলেও রবিদাস কিছু করত না। কারণ তার ব্রেন আদেশ পেয়েছিল একটা জমি চাষ করার। সে সেই কাজ করেই আমার কাছে ফিরে আসছিল। ডাকাত মঙ্গল দেও রবিদাসকে দেখল আমার বাংলোয় ঢুকতে। পরদিনই সে ত্রিনাথকে রাস্তায় একলা পেয়ে তাকে ধরে নিয়ে গেল। তাকে লোভ দেখিয়ে পারল না। অবশেষে নানারকম অত্যাচার করে তার কাছ থেকে রবিদাস কাহিনি জেনে নিল। তাকে আটকে রাখল নিজেদের আখড়ায়। ত্রিনাথ কীভাবে একটা ছোট ছেলেকে দিয়ে তার ভাষায় লেখা একটা চিঠি পাঠিয়ে জানিয়ে দিল সব কথা আমাকে। যেখানে কাজ করতে হবে, সেখানকার লোকের ভাষা না-জানাটা আমি লজ্জার ব্যাপার মনে করতাম। কাজেই চিঠির বক্তব্য বুঝতে কোনও অসুবিধে হল না।
আগের দিন থেকে ত্রিনাথকে না দেখে চিন্তিত ছিলাম। এভাবে না বলে-কয়ে নিজের বাড়ি যায় না সে। চিঠি পেয়ে ডিউটি শেষ হওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে তাড়াতাড়ি কোয়ার্টারের দিকে রওনা দিলাম। মঙ্গল ত্রিনাথকে নিয়ে আগেই বাড়িতে ঢুকেছিল। তারপর রবিদাসের সুইচ চালু করে কনট্রোল ট্রান্সমিটারে আদেশ করল ত্রিনাথকে বেঁধে ফেলতে। রবিদাস তার হুকুম পালন করল। বিকট উল্লাসে মঙ্গল দেও লাফিয়ে উঠল। ঠিক সেই সময় আমি বাড়ি ঢুকলাম। আমাকে দেখেই মঙ্গল রবিদাসকে হুকুম করল, সাধু ডাক্তারকে হত্যা করো।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু সেটা এক মুহূর্তের জন্য। সংবিৎ ফিরে পেতেই পেছন ফিরে দৌড় লাগালাম। যদিও জানি, বৃথা এ দৌড়। রবিদাস হুকুম পালন না-হওয়া পর্যন্ত নিরস্ত হবে না। দেখলাম, হরিণের মতো রবিদাস ছুটে আসছে। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে সে? আমার দিকে তো আসছে না।
আমি মোহনগড় থেকে পালিয়ে গা-ঢাকা দিলাম। যেখানে এলাম, সেখানে আমাকে কেউ চেনে না। তবুও লোকমুখে কানে এসেছিল মোহনগড়ের হোমিয়োপ্যাথি ডাক্তার সাধুচরণ পট্টনায়কের খুনের খবর। সাধু আমার প্রকৃত নাম নয়। এই লোকের দেওয়া নামই আমাকে বাঁচিয়ে দিল। হর্ষ ডাক্তারের নিখোঁজ হওয়ার খবরও রটে গিয়েছিল দু-একদিনের মধ্যেই। তবে আরেকজনের নিখোঁজ হওয়ার খবর রটতে দেরি হয়েছিল। তার বাড়ি থেকে খোঁজ করতে এলে তখনই সবাই জানল যে সে-ও নিখোঁজ। বেচারি ত্রিনাথ। তার খবর আর পেলাম না।
আমি যে বেঁচে আছি, এটা মঙ্গল দেও নিশ্চয় জেনেছে। মোহনগড়ে ফেরা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কলকাতায় মামার বাড়ি ফিরে যাওয়া! কী কারণ দেখাব তাদের? পুলিশ যখন জেরা করবে, তাদেরই বা কী উত্তর দেব? আমার আত্মগোপনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একজনের খুন আর একজনের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা। দাড়িগোঁফের ছদ্মবেশে নিজেকে ঢেকে ফেলে মোহনগড়ের কাছেই কোনও জায়গায় দিন কাটাতে লাগলাম। শুনতে পেলাম রবিদাসের নানা কীর্তিকলাপের খবর। বুঝলাম, মঙ্গল দেও রবিদাসকে তার আস্তানায় নিয়ে গিয়ে তাকে দিয়ে এসব কাজ করাচ্ছে। আমার সৃষ্টি এইসব জঘন্য কাজ করছে এই চিন্তা আমার ক্ষুধা-তৃষ্ণা-ঘুম কেড়ে নিল। এটাকে বন্ধ করতেই হবে, এই হল এখন আমার একমাত্র ধ্যান, একমাত্র লক্ষ্য।
অবশেষে আরেকটা ট্রান্সমিটার তৈরি করলাম। কিন্তু পরীক্ষা করব কী করে?
ট্রান্সমিটারটা ঠিকমতো কাজ করছে কি না জানতে রোবটটাকেই দরকার। তার মানে মঙ্গল দেওয়ের আস্তানায় ঢুকে রবিদাসের সুইচ চালু করা। কিন্তু সেটা যে অসম্ভবের চেয়েও বেশি!
অবশেষে একদিন ট্রান্সমিটারটা হাতে করে সাধুর বেশে মঙ্গল দেওয়ের গ্রাম বীরসাপুরে ঢুকলাম। তার বাড়ির কাছাকাছি এক গাছতলায় থাকি, ব্যোম ব্যোম করি আর আড়চোখে লক্ষ রাখি তার বাড়ির দিকে। অবশেষে একদিন রবিদাসকে দেখলাম। রাত্তিরে সে বেরিয়ে আসছে মঙ্গলের বাড়ি থেকে। হায় রে, না জানি কার সর্বনাশ করতে যাচ্ছে সে!
মুহূর্তে আমার ট্রান্সমিটারটা চালু করে দিয়ে মাউথপিসে মুখ দিয়ে বললাম, রবিদাস, থামো!
বলার সঙ্গে সঙ্গে বুকের মধ্যে রক্ত যেন আনন্দে লাফিয়ে উঠল। দেখলাম, রবিদাস থেমেছে। আমার ট্রান্সমিটারের ফ্রিকোয়েন্সি তবে ঠিকই হয়েছে! এবার বললাম, রবিদাস, মঙ্গল দেওকে শেষ করো!
রবিদাস ফিরে চলল মঙ্গলের বাড়ির দিকে। এত তাড়াতাড়ি রবিদাসকে ফিরতে দেখে মঙ্গল বোধহয় একটু অবাকই হয়েছিল। তার ওপর রবিদাসের হাত খালি। কিন্তু সেই অবাক হওয়া বোধহয় এক মুহূর্তের জন্য। তার আগেই অ্যালুমিনিয়ামের পাতে মোড়া শক্ত হাত দুটো সজোরে বসে গেল তার কণ্ঠনালির ওপর।
আমার আরেকটা আদেশ পেয়ে সে মঙ্গল দেওয়ের ঘর থেকে ট্রান্সমিটারটা হাতে নিয়ে আমার কাছে ফিরে এল। দাঁড়িয়ে থাকল পরবর্তী হুকুম দেওয়ার অথবা সুইচ অফ করে দেওয়ার অপেক্ষায়।
এবার আমি আমার মনস্থির করে ফেলেছি। জগতের মঙ্গলের জন্য কিছু বৈজ্ঞানিক যা সৃষ্টি করেন, সেটাকে দিয়ে অকল্যাণসাধনের জন্যে আরও বেশি লোক সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। তাই সব সাধু উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়।
ভাগ্যিস আমি শত শত রবিদাস সৃষ্টি করিনি। তাহলে ভারত এত দিনে শ্মশান হয়ে যেত একদল শকুনের পায়ের তলায়।
আমি রবিদাসকে তার রোবট-জীবনের শেষ আদেশ করলাম। হুকুম দিতে আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। রবিদাস তো আমারই সৃষ্টি, আমারই মানসসন্তান।
আমি বললাম, রবিদাস, এই দুটো ট্রান্সমিটারই তুমি নিয়ে গিয়ে নদীর জলে ফেলে দাও। তারপর নিজেও ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেকে শেষ করে দাও।
হুকুম তামিল করতে আনন্দে ডগমগ হরিণের মতন ছুটে চলল রবিদাস। নদী অনেক দূরে। ঝপাং করে একটা শব্দ হবে কিছুক্ষণ পরে, সেটা আমি আর শুনতে পাব না। তবে জানি, রবিদাসের অ্যালুমিনিয়াম মোড়া ভারী দেহটা নদীতে তলিয়ে যাবে। আর উঠবে না।
এবার মোহনগড়ে ফিরতে আমার আর বাধা নেই। কিন্তু কীভাবে ফিরব? হর্ষ ডাক্তার হয়ে ফিরে কী বলব? পাগল ভেবে আমার ডাক্তারি লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করবে। তার চেয়ে এই থাক। সাধু ডাক্তার সাধু হয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিক।
[সন্দেশ, শারদীয়া ১৩৮৮]