রনি-বনি ও যন্ত্র-সার
০১.
আমি ঝামাপুকুরের রনি। একশো তিপ্পান্ন নম্বর বাড়ির কুপুত্র। আমার মতিগতি বোঝা ভার। আমার ভাই বনি৷ সে ভালো ছেলে হওয়ার চেষ্টা করে। আমি বনির পেছনে লাগি, তবু সে আমায় ভক্তি করে। আমার গায়ে কত জোর, বনি জানে। তা ছাড়া বনি অমলেট খেতে ভালোবাসে। আমার জন্যই সকালে সেদ্ধ ডিমের বদলে রোজ ডাবল অমলেট পাচ্ছে বনি। মা-বাবা কেউ এই রহস্য জানেন না। অন্যের ডায়েরি পড়া অন্যায় তাই ডায়েরিতে সবাই সত্যি কথা লেখে। আমিও লিখছি নির্ভয়ে।
মা-বাবা, দাদু-ঠাকুমা যেসব কাজ করতে পারেন না, সেগুলো করে রোবিদা। মানে রোবটদাদা। রান্নাবান্না, কাপড় কাঁচা, ঘর ঝাড়া। রোবিদাদার একটা অদ্ভুত মাথা। সেখানে যা একবার ঢোকে, তার আর নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। মা রাত্তিরে পিসি যন্ত্রের সামনে। বসে টাইপ করে দেন, পরের দিন রোবিদা কার জন্য কী রাঁধবে। তারপর সেই নির্দেশ ভোরবেলা জেনে যায় রোবিদা। আমি রোজই মা শুয়ে পড়ার পর পিসি যন্ত্রের নির্দেশগুলো একটু করে বদলে দিই। দুধের জায়গায় মিল্ক শেক, দইয়ের জায়গায় আইসক্রিম বা স্টুয়ের জায়গায় কালিয়া। পিসি যন্ত্রের ডিস্কে এসব অদলবদল করা আমার কাছে জল ভাত। একবার শুধু একটা ফ্যাচাং হয়েছিল। মাগুর মাছের ঝোলের বদলে দই-ইলিশ টাইপ করে দিয়েছিলাম। ফ্রিজে সে দিন এক টুকরোও ইলিশ ছিল না। ব্রেকফাস্টের পর দুপুরের রান্না শুরু করার সময় রোবিদা একেবারে পাগল হয়ে গেল। ফ্রিজ খুলছে আর বন্ধ করছে। ডিপ ফ্রিজার থেকে বের করে পলিথিনের প্যাকেটগুলো বারবার খুলছে, দেখছে আর মুড়ে রাখছে। সে দিন ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি। মায়ের ভুলো মন। ভাবলেন, নিজেই বুঝি ভুল করে দই-ইলিশ বানাতে বলেছিলেন।
দাদু বলেন, রনিবাবু খুব বুদ্ধিমান, কিন্তু একটু চঞ্চল।
বাবা বলেন, এই হচ্ছে প্রবলেম-চাইল্ড।
দিদিমা বলেন, বংশের বড় ছেলেরা একটু বেয়াড়া হয়।
মা বলেন, সবার কি পড়াশোনায় সমান মাথা হতে পারে? বেশি চাপ দেওয়া ঠিক নয়।
কারও সঙ্গে কারও মতের মিল নেই। নিজেরা মাঝে মাঝে ঝগড়াঝাঁটি করে। আমি এসে পড়লেই অনেক সময় সবাই চুপ করে যায়। তখন বুঝতে পারি, কাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল। দাদু এবং মা আমাকে সবসময়েই দিদিমা আর বাবার হাত থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করেন, কিন্তু পেরে ওঠেন না। তখন আমাকে নিজেকেই একটা কিছু করতে হয়।
পরশু দিন কোনও হোমওয়ার্ক ছিল না। তার পরের দিন রবিবার। তবু সন্ধেবেলায় বাবা রাগারাগি শুরু করে দিলেন। পড়ার সময় গল্পের বই নিয়ে বসা চলবে না। আর চারটে পাতা হলেই অন্ধকারের শয়তানের কারসাজি ধরা পড়ত। দু-বার আপত্তি করতেই রেগে আগুন। আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ম্যাগিয়ার পোস্টার, সরি, হাঙ্গারির চার-চারখানা স্ট্যাম্প কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলল। আমার জন্যই কিনে এনেছিল কিন্তু।
দাদুর কাছে সঙ্গে সঙ্গে বকুনিও খেল, অমন চণ্ডাল রাগ দিয়ে কখনও ছেলে শাসন করা যায় না।
মা বললেন, ন-মাস, ছ-মাস পরে তো একদিন সময়মতো বাড়ি ফেরো। রাতারাতি মানুষ করতে চাও নাকি?
দিদিমা ঠাকুরঘর থেকেই চেঁচিয়ে পেঁচিয়ে আপন মনে বললেন, একজন শাসন করবে, আর একজন দেবে আশকারা। এমন কাণ্ড জন্মে শুনিনি বাপু।
কিন্তু আসল কাণ্ড তখনও হয়নি। অন্ধকারের শয়তান তো হস্তগত করলেন বাবা। তারপর একটা বই বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এর প্রথম কবিতাটা মুখস্থ করতে পারলেই ছুটি। তখন যত খুশি গল্পের বই পড়ে সময় নষ্ট কোরো।
আমি বললাম, আমার মুডটাই তখন নষ্ট হয়ে যাবে।
শুনলে? শুনলে, কী বলল? মা-র দিকে ঘুরে তাকালেন বাবা।
মা কিন্তু প্রায় হেসে ফেলেছিলেন। পাছে আমি দেখে ফেলি তাই ঘর থেকেই বেরিয়ে গেলেন। কারণ বাবা নিজেই কথায় কথায় বলেন, মুডটাই বিগড়ে গেল। আজও অফিস থেকে ফেরার পর রোবিদা চা দিতে দেরি করায় এইটাই বলেছিলেন। কবিতার বইটা হাতে নিয়ে বললাম, আমি কি বলেছি যে, মুখস্থ করব না! রাগ করছ কেন?
বাবা মুখের দিকে তাকিয়ে একটু চুপ করে রইলেন। নিশ্চয় ভাবছিলেন মতলবটা কী? তারপর বললেন, ঠিক আছে, জোরে জোরে পড়ো, পাশের ঘর থেকে যেন শুনতে পাই। পুরো মুখস্থ হলে পড়া দিতে আসবে। একবারও যদি আটকে যায় তাহলে কিন্তু…
না, না, পুরো তৈরি না হলে তোমায় ধরতে বলব না।
মহাকাশচারী-কবি অপূর্ব হালদারের মহাকাশে আমি একা নই। কাউন্টডাউন ফুরিয়ে আয়ন রকেট… নিঃশব্দে ধেয়ে যায়… কাউন্টডাউন ফুরিয়ে… কাউন্টডাউন…
জোরে জোরে আমি মুখস্থ করতে শুরু করি। ওপরতলাতে দিদিমাও শুনতে পান যাতে। কবিতাটা ছ-লাইন হলেও বেশ ভজকট। কিছুতেই মনে রাখা যায় না। প্রথম লাইনটা মুখস্থ হওয়ার আগেই বাবা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, আর কতক্ষণ লাগবে?
সেটা আমি বলব কী করে?
ঘণ্টা দেড়েক হয়নি তখনও। বাবা দড়াম করে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে বললেন, ভেবেছিসটা কী? এখনও দু-লাইন মুখস্থ হল না?
বাঃ! চেষ্টা তো করছি। না হলে কী করব?
না হলে কী করব! বাড়িসুষ্ঠু লোকের মুখস্থ হয়ে গেল। মাথা ঝিমঝিম করছে আর তোর…
আমি তো আর বনি নই যে, এবার পড়লেই…
আবার বাজে কথা বলতে লজ্জা করে না। রোবট চাকরটার অবধি মাথা বিগড়ে গেছে। সেই থেকে বিড়বিড় করছে কাউন্টডাউন, কাউন্টডাউন… আর তুই, তুই…
বাবা, রোবিদাকে তুমি চাকর বলেছ! এখুনি ক্ষমা চেয়ে নাও!
.
০২.
রনির ডায়েরি এখানেই শেষ। নতুন ঝকঝকে ডায়েরি। বাবাই কিনে দিয়েছিলেন। প্রত্যেক রবিবার সকালে টিভি-তে যখন ফাইটিং অন মুন চলে, ঠিক সেই সময়ে তাকে ডায়েরি লিখতে হবে। বাবার হুকুম। বিশ্ববিখ্যাত লোকেরা কে কীরকম ডায়েরি লিখতেন, বুঝিয়ে বলেছিলেন বাবা। এই অভ্যাস যদি আজীবন বজায় রাখতে পারে তাহলে ডায়েরিটা যে একদিন কী মূল্যবান হয়ে উঠবে, সেটা আর জানতে বাকি ছিল না। চেষ্টারও কোনও ত্রুটি করেনি রনি। প্রথম দিনেই ডায়েরির প্রায় চার পাতা ভরিয়ে ফেলেছিল। তা ছাড়া মনে রাখা দরকার, কী পরিস্থিতির মধ্যে লিখছিল রনি। টিভি-রুম থেকে মাঝেমধ্যেই ভেসে আসছে সোঁ-সাঁত-কুঁই-কুঁই শব্দে লেজার কামানের গর্জন, মেঘ ডাকার মতো পাহাড় ধসে পড়ছে আর পৃথিবীর অপরাজেয় কমান্ডোদের মাইক্রোফোন উল্লাস।
বাবা কিন্তু এসব কথা কিছুই বিবেচনা করলেন না। অন্যের ডায়েরি পড়া উচিত নয়, তবু পড়লেন। ছোটদের ডায়েরি নাকি পড়া যায়। তারপর রনির মুখের দিকে তাকালেন। রনি বুঝল, বাবা চাইছেন, সে একটু ভয় পাক। কিন্তু অন্যায় না করলে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই, এই নিয়ে একটা গল্প সে আগেই পড়েছে। জেসপ না কার যেন লেখা।
আবার চেয়ারে বসে দুলছ! বাবা ধমকে উঠলেন। রনি সঙ্গে সঙ্গে ভালো হয়ে বসে পড়ল, কিন্তু বাবা তবু ডায়েরিটা ফেরত দিলেন না। ডায়েরি হাতে উঠে গিয়ে হঠাৎ ডাকাডাকি শুরু করে দিলেন, শুনছ, শুনছ? কী হল? দিনরাত সবাই মিলে টিভি গিললেই চলবে! এ তো মহাজ্বালা দেখছি। কী হল, শুনতে পাচ্ছ?
মা-কে ডেকে নিয়ে গেলেন বাবা পাশের ঘরে। কী পরামর্শ হল কে জানে। তবে মোদ্দা কথা, ডায়েরিটা আর ফেরত এল না। লেখাটা ভালো হল কি খারাপ, কোনও কথাই নয়।
বাবা বললেন, রনি, কাল থেকে বিকেলে ঠিক পাঁচটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসবে। তোমার মাস্টারমশাই আসবেন সওয়া পাঁচটায়।
তাহলে তো আমার খেলাই হবে না। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতেই তো চারটে বেজে যায়।
খেলা আর খেলা। পড়াটা কিছু নয়, তাই না? যা বলছি, মনে রেখো। যদি শুনি, মাস্টারমশাইকে বসিয়ে রেখেছ, বাড়ির বাইরে পা দেওয়াই বন্ধ হয়ে যাবে।
রনি কোনও কথা না বলে পেছন ফিরে চলে যাচ্ছিল। বাবা ডেকে বললেন, কথাটা কি কানে ঢুকেছে?
হ্যাঁ, ঢুকেছে। বাড়ির বাইরে পা দেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। রনি উত্তর দিল। কিন্তু পেছন ফিরে তাকায়নি।
তুমি কিন্তু বড় বাড়াবাড়ি করছ। রনি বেরিয়ে যাওয়ার পর মা বললেন।
বাড়াবাড়ি মানে! ছেলেটা দিন দিন কী তৈরি হচ্ছে, তুমি নিজে চোখে দেখতে পাচ্ছ না! আমার পক্ষে তো আর উইক ডে-তে প্রতিদিন ওকে নিয়ে বসা সম্ভব নয়। কাজেই উপায় কী এ ছাড়া?
কিন্তু তুমি প্রাইভেট টিউটর রাখছ, সেটা তো বেআইনি। রনি বনির মতো না হোক, ডি-গ্রেড তো আর পায়নি। ডি-গ্রেড না পেলে তো বাড়িতে টিউটর রাখা যায় না।
তুমি যদি সবই বুঝে ফেলতে তাহলে আমার ভাবনা ছিল। শুধু পরীক্ষার ফল নয়, বুঝলে, কনডাক্ট ব্যবহার যদি খারাপ হয় তাহলেও স্পেশাল কেস হিসেবে প্রাইভেট টিউটর রাখা যায়। এ নিয়ে আমি উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করেছি। একদিক থেকে ডায়েরিটা লিখতে বলে ভালোই করেছি। ওটাই এখন সবচেয়ে বড় নিদর্শন, কেন টিউটর রাখা দরকার। আর এটাও জেনে রাখো, এটা কোনও আচমকা ব্যাপার নয়। অনেকদিন ধরেই ভাবছি আমি। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের কম্পিউটার সেন্টারে গিয়ে মাসখানেক আগেই কয়েকশো প্রাইভেট টিউটরের নামধাম, যোগ্যতা, পরিচয় ও চেহারা ভিডিয়ো স্ক্রিনে দেখে একজনকে পছন্দও করে রেখেছি। এখন একটাই কাজ বাকি, ইনফর্মেশন সেন্টার থেকে জেনে নেওয়া, লোকটা এখনও ফ্রি আছে কি না। আমি চাই, রবিবার ছাড়া ও প্রতিদিন আসবে। ঠিক সাড়ে পাঁচটায় এবং দু-ঘণ্টা করে পড়াবে।
.
০৩.
রনি তার মাস্টারমশাই শুভংকর সরকারকে দেখে বেশ অবাক হল। চোখে পুরু কাচের চশমা, তার মধ্যে একটা আবার ঘষা। একটু পা টেনে টেনে হাঁটেন। বোধহয় বাঁ পায়ের দোষ আছে। মায়ের চেয়েও বেঁটে ও রোগা। গলার স্বরটাও নরম। আর সবচেয়ে অদ্ভুত, ধুতি-পাঞ্জাবি পরেন উনি। অথচ বাবার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। ধুতি-পাঞ্জাবির নামটা রনি প্রথম জেনেছে দু-বছর আগে। দাদু যখন তাঁর এক বন্ধুর নাতির বিয়েতে ওই অদ্ভুত ড্রেসটা পরেছিলেন, বাবা-মা দূরের কথা, ঠাকুমাও বারণ করেছিলেন, তুমি আর লোক হাসিয়ো না বাপু! তবু জেদ করে পরেছিলেন দাদু।
আসলে রনি একজন এক্সট্রা-টেরিস্ট্রিয়াল মনস্টারের জন্য অপেক্ষা করছিল। বাবা তার জন্য এরকম একজন মাস্টারমশাই ঠিক করবেন, এটা ভাবতেই পারেনি। সত্যিই সে প্রথম দিন হতভম্ব। শুভংকর স্যারকে ভালো করে বুঝতে বুঝতেই দু-ঘণ্টা পার হয়ে গেল।
মাস্টারমশাই চলে যাওয়ার পর বাড়ি ফিরেছিলেন বাবা। রাত্তিরে খাওয়ার টেবিলে বসে রনিই ঘোষণা করল, বাবা, মাস্টারমশাই ধুতি পরেন।
বনি অমনই হাসতে শুরু করল। বাবা ধমক দিলেন, চুপ করো! বোকার মতো হাসতে নেই।
কিন্তু রনি বুঝল, কথাটা বাবার পছন্দ হয়নি। খাওয়ার পর গুড নাইট করতে গিয়ে শুনতে পেল, বাবা মা-কে বলছেন, ভিডিয়ো স্ক্রিনে তো শুধু মুখটাই দেখেছি। ও যে আবার পুরোনোপন্থী তা বুঝব কী করে! যা-ই হোক, কাল বলে দিয়ো, ওসব ধুতি-পাঞ্জাবি অন্তত ছাত্র পড়ানোর সময় বাদ দিলেই ভালো হয়!
রনির জিভের ডগায় এসে গিয়েছিল, জানো বাবা, স্যার কাঠবাঙাল। শু জুতোকে সু জুতো বলেন।
পরপর দু-দিন বাধ্য ছেলের মতো বিকেল পাঁচটার মধ্যে বাড়ি ফিরে এসেছিল রনি। তারপর স্প্রে ওয়াশ করে চুল আঁচড়ে মাস্টারমশাই আসার আগেই সুইচ টিপে ঘরের মধ্যে নিজের পড়ার কিউবিকুলটাকে খাড়া করে নিয়ে বসে পড়েছিল হাওয়া-গদির টুলে। কাউকে কোনও কথা বলারই সুযোগ দেয়নি।
ব্যাপার দেখে সবচেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল মা। যাক, মাস্টারমশাইকে তাহলে পছন্দ হয়েছে।
মা-র কথা শুনে বাবাও আপাতত আর ধুতি পরা নিয়ে আপত্তি জানানোটা তত জরুরি মনে করেননি। কিন্তু দ্বিতীয় দিনেই রনির পড়ার ঘরের মধ্যে যেটা ঘটেছিল, তার সাক্ষী শুধু দু-জন।
রনি তার স্যারকে দেখেই বুঝেছিল, এই রামধনু-রঙের ফোল্ডিং দেওয়ালওয়ালা পড়ার ঘর তিনি আগে দেখেননি। এখানে সুইচ টিপলেই পলিইউরিথিন ফোম-জমানো দেওয়ালের গায়ে আপনা থেকেই দরজা খুলে যায়। ইচ্ছেমতো চেয়ার ও টেবিল তৈরি করা বা টেবিলটার আকার বাড়ানো-কমানেনা শুধু কয়েকটা বোতাম টেপার খেলা।
মাস্টারমশাই হাতে করে একটা বই এনে টেবিলের ধারটায় রেখেছিলেন। বইটা হঠাৎ ধপাস করে খসে পড়ল মাটিতে। রনি ভুল করে একটা সুইচ টিপে টেবিলটাকে ছোট করে ফেলেছিল।
মাস্টারমশাই কিন্তু রাগ করেননি। উলটে বললেন, মজার কাণ্ড তো। বইয়ে পড়েছি, কিন্তু চোখে দেখিনি।
এরপরে স্বাভাবিকভাবেই রনিকে প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে শুভংকর স্যারকে বোঝাতে হল, কীভাবে পকেট-ক্যালকুলেটারের মতো চেহারার ছোট্ট যন্ত্রটার আটখানা সুইচ বা কি টিপে এই ঘর বা তার আসবাব তৈরি করতে হয়।
এবং কাজটা যে নেহাত সোজা নয়, সেটা মাস্টারমশাই স্বীকার না করে পারলেন না। একটা ভুল কি টিপে ফেলতেই বসার টুলটা আচমকা ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গিয়ে তাঁকে উলটে ফেলল মেঝের ওপর।
রনি সান্ত্বনা দিয়ে বলল, প্রথম প্রথম এরকম কত আছাড় খেয়েছি। পাঁচ-ছ-দিনের মধ্যেই দেখবেন, আর ভুল হচ্ছে না।
রনি অবাক হয়েছিল শুভংকর স্যার এ নিয়ে কোনও নালিশ না-করায়। কিন্তু তা বলে উনি যদি ভেবে থাকেন, রনি প্রত্যেকদিন খেলা ছেড়ে পাঁচটার মধ্যে বাড়ি ফিরবে, তা হতে পারে না।
পরের দিন। স্কুলের হেলিকপ্টার তাকে বাড়ির ছাদে নামিয়ে দেওয়ার পর থেকে রনি সেখানেই অপেক্ষা করছিল। খেলতে গেল না দেখে বাড়ির সকলেই একবার করে খোঁজ নিয়ে গেছে।
ঠিক পাঁচটার সময় রাস্তার মোড়ে মাস্টারমশাই দেখা দিলেন। দু-হাতে ভর রেখে রনি লাফিয়ে উঠল পাঁচিলে, তারপরেই লাফ মেরে নেমে এল কার্নিশের ওপরে।
জলে ডাইভ দেওয়ার আগে দু-হাত নাড়ার মতো ভঙ্গি করে রনি মাস্টারমশাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, খেলতে যেতে না-দেওয়ার প্রতিবাদে আজ আমি মরণ-ঝাঁপ দেব! টেন-নাইন-এইট-সেভেন
মাস্টারমশাই থমকে গেলেন। তারপর হাত তুলে বললেন, দাঁড়াও! দাঁড়াও! তার দরকার নেই। আমি এখুনি চলে যাচ্ছি।
রনি বলল, আমি আজকের কথা বলছি না। আজ তো পড়ব। কাল থেকে…।
কিন্তু তুমি ওখান থেকে নামবে কী করে? রেন-ওয়াটার পাইপ বেয়ে রনি সাঁ করে নেমে এল নীচে।
মাস্টারমশাই কথা দিয়েছেন, এরপর থেকে ছ-টার সময়ে আসবেন। উনি যে বেশ ঘাবড়ে গেছেন, তাতে সন্দেহ নেই। হোমওয়ার্ক কী আছে, একবারও জানতে চাইলেন না। পড়াশোনার বই অবধি ছোঁয়া হয়নি। সারাক্ষণ শুধু ডাকটিকিট সংগ্রহের গল্প করেই কেটে গেল।
মাস্টারমশাই জমিয়ে গল্প বলতে পারেন। অবশ্য এর ফাঁকে ফাঁকে একটু ইতিহাস ও ভূগোলের জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
শুভংকরদার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেছে। প্রত্যেকদিন নতুন নতুন বই নিয়ে আসেন তিনি। কিছুটা পড়ে শোনান, বা ছবি দেখান। রনির পছন্দ হলে বইটা রেখে যান। তবে ক্লাসের পড়ার দিকে রনির একটুও আগ্রহ নেই। শুভংকরদাও জোর দেন না।
.
০৪.
নিউ জিল্যান্ডের মহাকাশচারীর স্পেসস্যুট তখন বেগরবাই করছে। অক্সিজেন সরবরাহে টান ধরেছে। মহাকাশযানের গায়ে ওয়েল্ডিং করার সময় এই বিপদ। দ্বিতীয় প্রাণী নেই, যার সাহায্য চাইতে পারে সে। মহাকাশের আতঙ্কর আকর্ষণে স্কুল থেকে ফিরে খেলতে অবধি বেরোয়নি রনি।
বিকেলবেলায় বসে বসে বই পড়া, এ আবার কোন দেশি কথা রে! চোখের মাথাটা খাবি নাকি! ঠাকুমার কথা প্রথমটা কানেই তোলেনি রনি। ঠাকুমা কোনও কিছুতেই কমেন্ট না করে থাকতে পারেন না। তবু রনি রেহাই পেল না। ঠাম্মা একেবারে নন-স্টপ। খেলার সময় পড়া বা পড়ার সময়ে খেলা ইত্যাদির কুফল। এই বয়সে ওর বাবা কী করত! এবং শেষকালে বনির সঙ্গে তুলনা। আর থাকতে পারল না রনি! ফটাস করে বই বন্ধ করে একছুটে উঠে গেল তেতলায়।
রনিবাবু যেন উত্তেজিত মনে হচ্ছে? দাদুর কথা শুনে রাগ আরও বেড়ে গেল।
বনি ভালো ছেলে বলে ও বই নিয়ে বসলে সেটা হয় পড়া। আর আমি কিছু পড়লেই সেটা হয় গপ্পোর বই।
আহা, আগে হলটা কী, সেটা বলবি তো ভাই!
তোমায় বলে কোনও লাভ নেই। ঠাম্মা কি তোমার কথা শোনে? যা-ই হোক, তুমি আমায় বলেছিলে, তাই জানিয়ে দিচ্ছি–সংকট খুবই ঘনীভূত হবে আজকে। সাবধানে থেকো!
ছুটে বেরিয়ে গেল রনি।
শুভংকরদা, এদিকে আসুন। বাড়ির দরজায় পা দিতেই রনি তাঁকে বাঁদিকের ঘরে ডেকে নিয়ে এল। দোতলায় কারা যেন সব এসেছে। মা বললেন, আপনি এলে এদিক দিয়ে নিয়ে যেতে।
সিঁড়িতে পা দেওয়ার আগে শুভংকর চটি খুলতে যাচ্ছিলেন, রনি বারণ করল, না, না, একদম খুলবেন না। কোনও দরকার নেই।
শুভংকর পাপোশে পা ঘষছেন দেখে নিশ্চিন্ত হল রনি। একটু আগেই দু-মুঠো ধুলো এনে সারা পাপোশে ছড়িয়ে রেখেছে।
কয়েক ধাপ ওঠার পরেই রনি বলল, যাঃ, ব্যাটটা ফেলে এসেছি মাঠে। এখুনি নিয়ে আসছি। শুভংকরদা, প্লিজ, আপনি একটু ওপরের ঘরে বসুন…।
কথা শেষ না করেই এক-এক লাফে দু-ধাপ করে টপকে নেমে গেল রনি।
শুভংকর যে ঘরটায় এসে ঢুকলেন, সেটা ঠাম্মার ঠাকুরঘর। সদ্য নিজে হাতে গঙ্গাজলের ছড়া দিয়ে সিঁড়ির আপাদমস্তক মুছে ঠাম্মা ঠাকুরের সামনে হাত জোড় করে বসে ছিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরুতঠাকুরের আসার কথা। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রীরও এমন বুকের পাটা নেই যে, এই সিঁড়িতে পা রাখেন।
ঠাম্মার হাত থেকে জপের মালা খসে পড়ল। তারপর শুভংকর এক পা পিছোতেই তিনি আর্তনাদ করে উঠলেন। একবার নয়, দু-বার। দু-পায়ে দু-পাটি আস্ত চটি আবিষ্কার করার পর।
নড়াচড়া করার ফল কী হবে, বুঝতে না পেরে শুভংকর কাঠের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন, আর কয়েক মিনিটের মধ্যে বাড়ির যাবতীয় লোক সেখানে হাজির। ঠাম্মা কারও কথা কানে না তুলে মাস্টারমশাইকে তুলোধোনা শুরু করেছেন। রনির বাবার এ সময়ে বাড়ি ফেরার কথা নয়। কিন্তু তিনি এসে পড়ায় ঠাম্মার হাত থেকে অন্তত শুভংকর রেহাই পেলেন।
শুভংকরকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন বাবা। প্রায় আধ ঘণ্টা কী কথা হল তাঁদের মধ্যে, কেউ জানে না, কিন্তু রাত্তিরে খাওয়ার টেবিলে বসে বাবা বললেন, শোনো, কাল থেকে তোমার টিউটর আর আসবেন না। বারণ করে দিয়েছি।
রনি নিজে শাস্তি পাওয়ার জন্য তৈরি ছিল, কিন্তু মাস্টারমশাই… প্রথমটা সে থতমত খেয়ে গেল, তারপর প্রচণ্ড একটা ভয়…।
কী বলেছি, কানে ঢুকেছে তো? আমি খুব ভালো করেই জানি, আজকের এই কাণ্ডটার জন্য কে দায়ী। কিন্তু তোমার টিউটর মিথ্যে কথা বলেছেন তোমাকে বাঁচাবার জন্য। যে টিউটর তার ছাত্রকেই ভয় পায়… যাক গে… ওসব কথায় দরকার নেই। আসল কথা হল, আমি নিজেও স্যাটিসফায়েড নই। ইংরেজি উচ্চারণ খুব খারাপ। ক্লাস টেস্টের রেজাল্টেও বিন্দুমাত্র উন্নতি দেখা যায়নি। লাভের মধ্যে একটাই, শুধু আজেবাজে গল্পের বই সাপ্লাই করেছেন।
রনি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, শুভংকরদা ছাড়া আর কারও কাছে পড়ব না। কিছুতেই না।
অসভ্যতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছ রনি। তুমি এখনও অত স্বাধীন হওনি যে…
না, না, কিছুতেই না… রনি কান্না চেপে এক ধাক্কায় চেয়ার ঠেলে ছুটে পালাল।
কথা বলতে শেখার পর তাকে কোনও দিন কেউ কাঁদতে দেখেনি। মা বললেন, এ কথাগুলো তো খাওয়ার পরেও বলা যেত। দ্যাখো তো, খাওয়া ফেলে…
বাবা বললেন, একদিন না খেলে কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।
দাদু বললেন, রনি বড্ড জেদি। এরপর আর কেউ ওকে কন্ট্রোল করতে পারবে কি না ভেবে দেখিস কিন্তু মাস্টারকে বিদায় করার আগে…।
সে দায়িত্ব আমার। আমি অলরেডি ঠিক করে ফেলেছি। মানুষ দিয়ে হবে না। ওর জন্য চাই রোবট-টিচার। মগজে কম্পিউটার ভরা টিচার। যার কাছ থেকে প্রতিদিন আমি খবর নিতে পারব, কী করছে না করছে। যে টিউটর আমার আদেশ পুরোপুরি মেনে চলবে। এ ছাড়া উপায় নেই।
.
০৫.
নিউ কম্পিউটার মার্কেটের সাততলায় যে দোকান থেকে শেষ পর্যন্ত রনির মাস্টারমশাইকে নির্বাচন করা হল, তার সামনে বড় বড় হরফে লেখা ছিল: উচ্চোশীক্ষিত রোবট টিচার ভারা দেয়া হয়।
রনির বাবার ভুরু কুঁচকে গিয়েছিল। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যাদের ব্যাবসা, তারা যে একেবারেই অশিক্ষিত। অবশ্য এরা শুধু কেনাবেচা করে! রোবট তৈরি তো আর করে না। বেশ কয়েকটা রোবট-টিচারের ইন্টারভিউ নেওয়ার পর পনেরো বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন টেবল-টিচার মডেল ডি-থ্রি-কে পছন্দ হল।
পছন্দ করার পেছনে একাধিক কারণ ছিল। নিলু বা নিলুদা (এই নামেই তাকে সম্বোধন করতে হয়) কম করে পাঁচশোর বেশি ছেলেকে ইতিমধ্যে কোচ করেছে। তাদের পুরো কেস হিস্ট্রির খতিয়ান সে পেশ করেছে মুঠোর মধ্যে ধরা ছোট্ট আয়নার মতো পর্দাটায়। সঙ্গে সঙ্গে মুখেও বলেছে, সবচেয়ে বিচ্ছু ছেলেদের সে কীভাবে শায়েস্তা করেছে। ইন্ডাকশনের সাহায্যে হালকা ইলেকট্রিক শক–এইটা তার শাস্তিমূলক অন্ত্র। এবং খুব কার্যকর। শারীরিক কোনও ক্ষতিও তাতে হয় না। ক্লাস থ্রি থেকে সিক্স–দিল্লি, ম্যাড্রাস, কলকাতা কি বোম্বাইযে-কোনও বোর্ডের কারিকুলাম অনুসারে যে-কোনও ভাষার ছাত্রছাত্রীকে সে পড়াতে পারে।
অপছন্দের মধ্যে একটাই। তার চেহারা। আধুনিক রোবটদের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য অত্যন্ত কম। নিলু একটু সেকেলে। পলিমার দিয়ে তৈরি নয়, পুরো স্টিল বডি। আকারেও বামনের মতো। এর বসার জন্য লম্বা পা-ওয়ালা চেয়ার চাই। চোখে কৃত্রিম পাতা নেই, সবসময়ে কটমট করে চেয়ে থাকে। কিন্তু কাজের দিক থেকে কোনও অসুবিধে নেই।
রনির বাবার হাত থেকে ছাত্রের ছবিটা চেয়ে নিল নিলু। তারপর তার ডান হাতের একমাত্র আঙুলের সরু নখ ঠেকিয়ে ছবিটার নীচে ছাত্রের বাড়ির ঠিকানাটা লিখে রাখল।
নিলু এখন থেকে প্রতিদিন বিকেল সাড়ে পাঁচটায় পড়াতে আসবে। প্রথম দিনটা শুধু তাকে পড়ার ঘর অবধি পৌঁছে দিতে হবে। তারপর আর কিছু চিন্তার নেই।
.
নিলু এত বেঁটে যে, সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় চার হাত-পা কাজে লাগাতে হয়। বাবা প্রথমেই তার সঙ্গে বাড়ির সকলের পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরিচয় মানে একটা এক মিনিট লম্বা হ্যান্ডশেক। প্রত্যেকের হাত ধরে প্রায় মিনিটখানেক করে দাঁড়িয়ে রইল নিলু। তারপর প্রশ্ন, আপনার নামটা বলবেন দয়া করে? তাহলে ভবিষ্যতে আর আপনাকে চিনতে ভুল হবে না।
ষোলো বছরের কম বয়স্কদের নিলু অবশ্য তুমি বলে সম্বোধন করে। সেটা রনি ও বনি –দু-জনের বেলাতেই দেখা গেল।
রনি আর নিলুকে পড়ার ঘরে বসিয়ে বাবা চলে গেলেন। লম্বা চেয়ারের ওপর নতুন মাস্টারমশাই যেন কচ্ছপের মতো থেবড়ে বসেছেন। দুটোই চোখ, কিন্তু প্রত্যেক চোখের মধ্যে তিন রঙের বলয়। রনি তার মানেও জানে। কালার ভিশন–রং চিনতে পারার ক্ষমতা আছে।
নিলু বলল, আজ প্রথম দিন, তাই পড়াব না। শুধু জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছি, কীভাবে তোমাকে চলতে হবে। আমার কথা যদি একটু নড়চড় হয়…।
নিলু তার বাঁ হাতের তিনটে আঙুলকে একজোট করে উঁচু করে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে আপাদমস্তক শিউরে উঠল রনির। ইলেকট্রিক শক।
বুঝেছ তো? নিলু হাসছে। মানে হাসির শব্দ বেরোচ্ছ মুখ দিয়ে এই অবধি। যাক, ভয়। পেয়েছ দেখছি। তাহলেই হল। ভয় যারা পায় না, তাদের জন্য অবশ্য অন্য ব্যবস্থা আছে। আর-একটা কথা বলে রাখি, আমার বিনা অনুমতিতে আমার গায়ে হাত দিলে কিন্তু…।
রনির বাড়ির খাতাটা চেয়ে নিল নিলু। তারপর ডান হাতের আঙুলের সরু নখ ছুঁইয়ে লিখে দিল রুটিন। ঘণ্টা মেপে বিভিন্ন সাবজেক্ট পড়াবে নিলু। তারপর পরের পাতায় লিখল কালকের পড়া–তোমার বাংলা ও ইংরেজি বই থেকে একটা করে কবিতা মুখস্থ করে রাখবে (যে কবিতা পড়া হয়নি এবং চোদ্দো লাইনের কম নয়)।
কই, এবার তোমার স্কুলের বইখাতা নিয়ে এসো, দেখি।
রনির বইয়ের চেহারা দেখেই নিলু ছোট্ট একটা ইলেকট্রিক ধমক দিল, এরকম চেহারার খাতা-বই নিয়ে পড়াশোনা হয় না। খাতা-বই থাকবে একেবারে ঝকঝকে। আমি আজই তোমার বাবাকে বলে যাচ্ছি, স্কুল থেকে নতুন এক সেট বই কিনে আনবে। মলাট নিয়ে রাখবে। তারপর শুরু হবে পড়া।
রনি বুঝল, কম্পিউটার-মগজ ধুলো, ময়লা বা নোংরা এড়িয়ে চলতে চায়। আরও একটা জিনিস লক্ষ করেছে সে। যন্ত্র-স্যার কথা বলার সময় বা পড়ার সময় মাঝে মাঝে পেটের একটা জায়গা বাঁ হাত দিয়ে টিপে ধরে। প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। এখন মনে হচ্ছে ওটা বোধহয় মেমারি সুইচ। মনে রাখার মতো কথা বা ব্যাপার হলেই শুধু সুইচটা টিপে ধরে।
রনির ধারণাটা যে নির্ভুল, সেটা প্রমাণ হয়ে গেল নিলু যাওয়ার আগেই। নিলু বলল, কাল এসে প্রথমেই আমার লেখা হোমওয়ার্কের লিস্টটা দেখব কিন্তু। ওটা বুদ্ধি করে হারিয়ে ফেলার চেষ্টা কোরো না।
ছ-মাস ধরে পড়াচ্ছে নিলু। এর মধ্যে বড়সড়ো অঘটন কিছু ঘটেনি। শুধু দ্বিতীয় দিনে রনি সিঁড়ির একটা ধাপের দু-ধারে পেরেক পুঁতে লম্বা করে সরু একটা নাইলন কর্ড বেঁধে রেখেছিল। তাতে হোঁচট খেয়ে নিলু দু-ধাপ গড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু তারপরেই টিকটিকির থাবার মতো ভ্যাকুয়াম কাপের সাহায্যে নিজেকে সামলে নেয়। পুরো পনেরো ধাপ গড়িয়ে পড়লে একেবারেই অকেজো হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। শাস্তি হিসেবে সে দিন তারপর দু ঘণ্টা রনিকে শুধু একটানা হাতের লেখা করতে হয়েছে।
রবিবার ছাড়া রনির বিকেলে খেলা প্রায় বন্ধ। কিন্তু মা বা দাদু যেরকম ভয় করেছিলেন, তার কিছুই হয়নি। বেশ খোশমেজাজেই আছে রনি। সারাক্ষণ গল্পের বই চালাচ্ছে, তার যন্ত্র-স্যার আসার সময় হওয়ামাত্র বাধ্য ভালো ছেলে। মায়ের বেশ কয়েকবার মনে হয়েছে, এর মধ্যে বোধহয় কোনও রহস্য আছে। কিন্তু খুব বেশি ঘাঁটাতে সাহস হয়নি। আর তার দরকারই-বা কী! প্রত্যেক শনিবার নিলু উইকলি রিপোর্ট দিচ্ছে রনির বাবাকে। বাবা তো বেজায় খুশি, সবাইকে বলে বেড়িয়েছে, উন্নতি রিমার্কেবল!
চোখে পড়ার মতো ঘটনা আরও একটা ঘটেছে। রনি আর বনিতে এমন ভাব কখনও দেখা যায়নি। রনি তার স্ট্যাম্প অ্যালবামেরা খাতাটা বনিকে উপহার দিয়ে দিয়েছে। এখন থেকে সে নাকি শুধু কয়েন কালেক্ট করবে। কিন্তু আর কারও চোখে না পড়ক, মা দেখেছেন, বনিও এবার গল্পের বইয়ের দিকে ঝুঁকেছে। পড়ার টেবিলে বসে খাতার মধ্যে ভরে ছোরাছুরি আর রিভলভারের ছবিওয়ালা কী সব চটি চটি বই পড়ে। যা-ই হোক, পড়াশোনা যখন করছে, এ নিয়ে আর বলবার কী থাকতে পারে!
.
০৬.
অ্যানুয়াল রেজাল্ট বেরোবার পর বাড়িতে অ্যাটম বোমা ফাটল। রনি প্রোমোশন পায়নি। শুধু তা-ই নয়, বনিও প্রায় কুপোকাত। অভিভাবকদের ওয়ার্নিং দিয়ে এবারের মতো তাকে অব্যাহতি দিয়েছে।
সারা বাড়ি মহাকাশের মতো নিস্তব্ধ। বাবা জরুরি মিটিং ডেকেছেন। বাড়ির সক্কলে থাকবে সে দিন, নিলু টিউটর সমেত।
মা এবং দাদু দু-জনে বারবার করে বলেছেন বাবাকে, মাথা গরম কোরো না। দেখলেই তো তার ফল!
বাবা গুম হয়েই ছিলেন। মিটিং-এর দিন নিলুকে দেখামাত্র যত রাগ হঠাৎ ফেটে পড়ল।
তুমি, তুমি আমাকে মিসলিড করেছ। এর মানে কী? কৈফিয়ত দাও। আমি কিন্তু ছাড়ব না। এ তো চিটিং! আমি বলছি, কেস করব–রোবটিক্স ইনকর্পোরেশন–তোমার যন্ত্রের ম্যানুফাঁকচারার, কি রোবট-টিচার সেলারস–কেউ রক্ষা পাবে না।
নিলুর মুখে কোনও ভাব প্রকাশ পায় না। সে শুধু স্বাভাবিক গলায় বলল, আমার কাছেও এর কোনও নজির নেই, ব্যাখ্যা নেই। এমন সাংঘাতিক হতাশাজনক ফল আমার কেরিয়ারে কখনও ঘটেনি। এমনকী আমি স্কুলেও খোঁজ নিয়েছি। পরীক্ষার খাতা দেখেছি। রনি যে সব জেনে-শুনেও ইচ্ছে করে ভুল লিখেছে, সেটাও বলার উপায় নেই।
শুধু রনি কেন, বনিও তো একেবারে তলিয়ে গেল–তার কী ব্যাখ্যা…
বনির সঙ্গে আমাকে জড়াচ্ছেন কেন?
হঠাৎ রনি বলে উঠল, বাঃ, বনির হোমওয়ার্কগুলো তো আপনার সামনে বসে আমি করলাম। তাই তো বনি…
বাবা চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন।
ধমক লাগালেন দাদু, বোস তো। অনেক বাহাদুরি দেখিয়েছিস। রনিবাবু, বল তো ভাই, কী হয়েছে?
কী আবার হবে? যন্ত্র-স্যার সারা বছর ধরে আমাকে পড়াননি, পড়িয়েছেন বনিকে। আমি অবশ্য সামনে বসে থাকতাম। যন্ত্র-স্যার যখন নতুন বই কিনে আনতে বলেন, আমি তো আর আমার ক্লাস ফাইভের বই কিনিনি, কিনেছিলাম ক্লাস ফোরের বই। তা ছাড়া বনির কাছ থেকে ক্লাস ফোরের রুটিন আর হোমওয়ার্কগুলোও চেয়ে নিতাম। ইংরেজিতে বা বাংলায় বনিকে রনি করা তো খুবই সোজা। আসলে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, যন্ত্র স্যারকে কখনওই জানিয়ে রাখা হয়নি, আমি কোন ক্লাসের ছাত্র। আর যন্ত্র-স্যার আমাকে খুব মন দিয়ে পড়িয়েছেন, কিন্তু তাতে লাভ হয়েছে বনির। মানে, পড়া নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ও ডিটেকটিভ বই গুলে খেয়েছে।
রাত্তিরে খাওয়ার টেবিলে বসে বাবা বললেন, রনি, তুমি এরকম কেন করলে, সেটা বলবে কি?
বনিটার একেবারে গল্পের বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হচ্ছিল না। তাই ওর স্কুলের চাপটা একটু কমিয়ে…
অনেক চেষ্টা করেও বাবা হুংকারটাকে চাপতে পারলেন না, পড়বি না, সে কথা স্পষ্ট করে বলতে পারিস না…
রনি খাওয়ার দিকে খুব মন দিয়েছে।
মা বললেন, আমি কিন্তু শুভংকরকে খবর দিয়েছি। কালই আসবে বলেছে। তাহলে কি বারণ করে দেব?
রনির চোখ বড় বড়। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, শুভংকরদা! আসবেন? দুর্ধর্ষ! দুর্ধর্ষ!
[আনন্দমেলা, পূজাবার্ষিকী ১৯৯০]