অনুবাদ
2 of 2

রণ্টুর দাদু

রণ্টুর দাদু

রন্টুর বয়স পনেরো, কিন্তু এর মধ্যেই তার গানের গলা হয়েছে চমৎকার। সে সকালে ওস্তাদের কাছে একঘণ্টা গান শেখে। যে তার গান শোনে সেই বলে, এ ছেলে আর কয়েক বছরের মধ্যেই আসরে গান গাইবে। এ গুণটা যে সে কোথা থেকে পেল সেটা বলা শক্ত, কারণ রণ্টুর বাবা-মা কেউই গাইতে পারেন না। বাবা খুব ভাল ছাত্র ছিলেন, সে গুণ রণ্টু পেয়েছে, আর মার কাছ থেকে পেয়েছে মিষ্টি স্বভাব আর ফরসা রঙ। কিন্তু গান?

রন্টুর বাড়িতে থাকে তার মা বাবা, একটা সাত বছরের বোন আর বাহাত্তর বছরের বুড়ো দাদু। এই দাদুর বিষয়ে কিছু বলা দরকার, কারণ এঁকে নিয়েই গল্প। দাদু অমিয়কান্তি লাহিড়ী বিশ বছর বয়সে বি.এ. পাশ করে তাঁর বাবার পেশা হোমিওপ্যাথি ধরেন। ছাব্বিশ বছরে তাঁর ছেলে জম্মনোর কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর এক কঠিন ব্যারাম হয়, যা থেকে তিনি কোনওরকমে বেঁচে উঠলেও, তাঁর চিন্তাশক্তি আর সেইসঙ্গে তাঁর স্মরণশক্তি প্রায় লোপ পেয়ে যায়। ফলে তিনি কাজের অযোগ্য হয়ে পড়েন। ভাগ্যিস বাবা অনেক পয়সা রেখে গিয়েছিলেন, তাই অমিয়কান্তিকে বেকারত্বের দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়নি। তারপর একমাত্র ছেলে বিনয় যখন বি.এ.-তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে ভাল চাকরি পায়, তখন থেকে রণ্টুদের আর খাওয়া-পরার ভাবনা ভাবতে হয়নি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রণ্টুর দাদুর চিন্তাশক্তি কিছুটা বেড়েছে, সেইসঙ্গে স্মরণশক্তিও। অতীতের অনেক কথাই তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন। এরই মধ্যে কয়েকটা স্মৃতি হঠাৎ হঠাৎ জেগে ওঠে। কিন্তু দাদুর পুরনো দিনের কথা রণ্টু বিশ্বাস করে না। সে বলে, তুমি সব বানিয়ে বানিয়ে বলছ। আসলে তুমি সব কথাই ভুলে গেছ। দাদু-নাতি সম্পর্কটা বেশ রসালো। মাঝে মাঝে দাদুর মাথায় দুষ্টবুদ্ধিও খেলে; তবে তাঁর একটা আফসোস এই যে, তাঁর এমন। কোনও গুণ নেই যেটা নাতির মধ্যে প্রকাশ পেতে পারে।

রন্টুদের প্রতিবেশী বৃদ্ধ সীতানাথ বাগচি মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় রণ্টুদের বাড়িতে গল্পগুজব করতে আসেন। একদিন তিনি সঙ্গে তাঁর বন্ধু প্রমথ দত্তকে নিয়ে এলেন। রণ্টুর দাদুর পরিচয় পেয়ে এই ভদ্রলোকের ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি বললেন, অমিয়কান্তি লাহিড়ী? আপনার গান তো গ্রামোফোন রেকর্ডে ছিল–তাই না? রণ্টুর দাদু বললেন, তা তো বলতে পারব না। এক অসুখের ফলে আমার অনেক পুরনো স্মৃতি মন থেকে লোপ পেয়ে গেছে।

প্রমথ দত্ত বললেন, কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে। অমিয়কান্তি লাহিড়ী–হ্যাঁ, এই নাম। শ্যামাসঙ্গীত গাইতেন। বছর পঞ্চাশ আগের কথা। সে রেকর্ড ছিল আমাদের বাড়িতে। এখন অবিশ্যি আর নেই।

সীতানাথ বাগচি বললেন, মণিলালের কাছে খোঁজ করে দেখতে পারেন। তার রেকর্ড সংগ্রহের বাতিক ছিল।

দুই বুড়ো চলে যাওয়ার পর রণ্টুর দাদু চোখ বড় বড় করে নাতিকে বললেন, শুনলি তো–এককালে আমি গাইতে পারতুম। আমার গানের রেকর্ড ছিল।

রন্টু বলল, যদ্দিন পর্যন্ত না সে রেকর্ড নিজের চোখে দেখছি, তদ্দিন বিশ্বাস করব না।

রণ্টু তার বাবাকে কথাটা বলাতে বিনয় লাহিড়ী বললেন, বাবা যদি কোনওদিন গান গেয়েও থাকেন তবে সে আমার জন্মের আগে। আমার চেতনা হওয়ার পর বাবা গলা খোলেননি কখনও।

এদিকে রণ্টুর দাদু কিন্তু জেদ ধরলেন যে, তাঁর গাওয়া গানের একটা রেকর্ড জোগাড় করে তাঁর নাতিকে শোনাতেই হবে। আশ্চর্য–এমন একটা ব্যাপার মন থেকে একেবারে মুছে গিয়েছিল!

সীতানাথ বাগচি যে সেদিন এক রেকর্ড সংগ্রাহকের উল্লেখ করেছিলেন সে-কথা রণ্টুর দাদুর মনে। ছিল। তিনি বাগচি মশাইয়ের বাড়িতে গিয়ে তাঁর নাম-ঠিকানা জেনে নিলেন। মণিলাল সেন, ছাব্বিশ নম্বর আমহার্স্ট স্ট্রিট। বাগচি মশাই তাঁকে খুব আশা দিয়েছেন। বলেছেন, মণিলালের বাড়িতে তারাসুন্দরীর নাটক শুনেছি; দিনু ঠাকুরের গান শুনেছি; আপনার রেকর্ড তার বাড়িতে থাকা কিছুই আশ্চর্য না। অবিশ্যি তার সে বাতিক এখনও আছে কিনা জানি না। আমার সঙ্গে তার বহু বৎসর দেখা। নেই।

পরদিনই রণ্টুর দাদু ছাব্বিশ নম্বর আমহার্স্ট স্ট্রিটে গিয়ে হাজির হলেন। মণিলাল সেন বাড়িতেই ছিলেন, অমিয়কান্তিকে তিনি বৈঠকখানায় এনে বসালেন। ইনিও বৃদ্ধের দলেই পড়েন, সত্তরের কাছাকাছি বয়স। অমিয়কান্তি আর সময় নষ্ট না করে একেবারে আসল প্রসঙ্গে চলে গেলেন।

আপনার গ্রামোফোন রেকর্ডের ভাল সংগ্রহ আছে বলে শুনেছি।

তা আছে। প্রায় আট-নশো রেকর্ড আছে। অবিশ্যি এখন আর শোনার আগ্রহ নেই; এককালে ছিল।

অমিয়কান্তি লাহিড়ীর কোনও রেকর্ড আপনার আছে কি?

আপনি নিজের কথা বলছেন কি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি যুবা বয়সে রেকর্ডে গান গেয়েছি। এখন বার্ধক্যে সেগুলো শোনার বিশেষ আগ্রহ বোধ করছি।

এ ব্যাপারে আমি আপনাকে হেল্প করতে পারলাম না। এই নামে কোনও গাইয়ের রেকর্ড আমার সংগ্রহে নেই।

আর কারুর সংগ্রহে থাকতে পারে বলে জানেন?

বাগবাজারের বিশ্বনাথ ভটচায, ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি। সে আর আমি প্রায় একসঙ্গেই রেকর্ড সংগ্রহ আরম্ভ করি।

রণ্টুর দাদু বাগবাজারে বিশ্বনাথ ভট্টাচার্যের বাড়ি গিয়ে হাজির হলেন। প্রাচীন, জীর্ণ বাড়ি, তবে মালিক যে অর্থবান তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

অমিয়কান্তি লাহিড়ী?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

মানে, আপনি নিজের কথা বলছেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি তরুণ বয়সে রেকর্ডে গান গেয়েছিলাম। সে রেকর্ড আমার কাছে নেই।

সে রেকর্ড তো অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য।

তাই বুঝি?

তবে আমার কাছে তিনখানা আছে। দুটো শ্যামাসঙ্গীত আর একটা কীর্তন।

এবারে আমার একটা অনুরোধ আছে।

কী?

এই তিনখানার অন্তত একখানা যদি আমাকে দুদিনের জন্য ধার দেন তা হলে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ বোধ করব। আমি রেকর্ডের যতটা যত্ন করা দরকার ততটা করব, এবং অক্ষত অবস্থায় ফেরত দেব কথা দিচ্ছি।

তা আপনি যখন চাইছেন তখন দিচ্ছি–যদিও এমনিতে আমি রেকর্ড ধার দিই না।

এবার ভদ্রলোক একটা আলমারি থেকে বাক্সের পর বাক্স রেকর্ড বার করতে আরম্ভ করলেন। প্রত্যেকটি বাক্সের গায়ে তার ভিতর কী রেকর্ড আছে তা লেখা রয়েছে। পাঁচ নম্বর বাক্সে বেরোল অমিয়কান্তি রেকর্ড। তার মধ্যে একটি রণ্টুর দাদু নিয়ে নিলেন। তারপর বিশ্বনাথ ভট্টাচার্যকে ভালভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বাড়িমুখো রওনা দিলেন।

কই, রণ্টু কোথায়? বাড়ি এসে হাঁক দিলেন অমিয়কান্তি। রণ্টু তার পড়ার ঘরে পড়ছিল, সে দাদুর ডাক শুনে বেরিয়ে এল।

এটা দ্যাখনামটা ভাল করে পড়ে দ্যাখ।

রন্টু রেকর্ডটা হাতে নিয়ে লেবেলে নাম দেখে বলল, সত্যিই তো! তুমি তা হলে ইয়াং বয়সে গান গাইতে?

কীরকম গাইতুম সেটা শুনে দ্যাখ।

সেই ঘরেই গ্রামোফোন ছিল, রণ্টু রেকর্ডটা চালিয়ে দিল। দরাজ সুরেলা গলায় গাওয়া শ্যামাসঙ্গীতে ঘরটা ভরে গেল। রণ্টু অবাক হয়ে দাদুর দিকে চাইল। দাদুর ঠোঁটের কোণে হাসি।

কী? বিশ্বাস হল?

রণ্টুর অবাক ভাবটা যায়নি; তবু সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। তারপর বাবা-মাকে খবরটা দিতে বাড়ির ভিতরে ছুটে গেল।

পরদিন বিকেলে অমিয়কান্তি বাগবাজারে গেলেন রেকর্ডটা ফেরত দিতে। ভটচাষ মশাই রেকর্ডটা হাতে নিয়ে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন।

আপনি পেনেটি ছাড়লেন কবে?

পেনেটি? সেখানে তো আমি কোনওদিন ছিলাম না।

তা হলে এই রেকর্ডের অমিয়কান্তি আপনি নন। ইনি পেনেটির এক জমিদার বাড়ির ছেলে। শ্যামাসঙ্গীত গেয়ে খুব নাম করেছিলেন।

রন্টুর দাদুর বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল।

বাড়ি ফিরে এসে রণ্টুকে তিনি ব্যাপারটা বলেই ফেললেন।

কাল যে রেকর্ডটা শুনলি, সেটা আমার গাওয়া নয়; আমারই নামের আরেকজন গাইয়ের।

রণ্টু খুব বেশি অবাক হল না। বলল, আমি জানতাম তুমি বানিয়ে বানিয়ে বলছ। তুমি এককালে গান গাইলে এখনও মাঝে মাঝে গুনগুন করতে।

ঘটনাটা আর এগোলো না। রণ্টুর দাদু দুঃখটা কোনওরকমে সামলে নিলেন।

এর পর দুমাস কেটে গেছে। অমিয়কান্তির অতীতের টুকরো টুকরো স্মৃতি ফিরে আসে যখন তিনি রাত্রে বিছানায় শোন। আজও তাই হল। সবে তন্দ্রার ভাব আসছে, এমন সময় বায়স্কোপের ছবির মতো। একটা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল। বিকেলের পড়ন্ত রোদে হেদোর ধারে দাঁড়িয়ে তাঁর বন্ধু মোহিতলালের সঙ্গে কথা হচ্ছে। মোহিত বলছে, সেনোলাও রাজি হল না।

তা হলে আর কোন কোম্পানি বাকি রইল? হিজ মাস্টারস ভয়েস, টুইন, কোলাম্বিয়া, ওডিয়ন–সবাই-এর সঙ্গেই তো তুই কথা বলেছিস?

হ্যাঁ। আমি বলেছিলাম তোকে যে, ওস্তাদি গানের বাজার ভাল না। আর বাঙালি হিন্দু ওস্তাদকে কেউ পাত্তা দেয় না। তুই মুসলমান হলে ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে যেত। আর তা ছাড়া আরেকটা ব্যাপার আছে।

কী?

তোর নামে আরেক গাইয়ের রেকর্ড বাজারে বেরিয়েছে। সে শ্যামাসঙ্গীত গায়। ভাল বিক্রি। এক নামে দুজন গাইয়ে একসঙ্গে বাজারে চালানো খুব মুশকিল।

বুঝেছি।

অমিয়কান্তি বাধ্য হয়ে ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিলেন। তাঁর আর গান রেকর্ড করা হয়নি।

এই স্মৃতির কথাটা কি তিনি রণ্টুকে বলবেন?

অনেকে ভেবে অমিয়কান্তি নাতিকে কিছু না বলাই স্থির করলেন। সে হয়তো বিশ্বাসই করত না। আসল কথা হল এই যে, তিনি এককালে ওস্তাদি গান গাইতেন–তা সে ভালই হোক আর মন্দই হোক।

অর্থাৎ আজ যে রণ্টু গাইতে পারে তার একটা কারণ হল তার দাদু। এটা ভেবেই অমিয়কান্তির বুকটা খুশিতে ভরে উঠল।

শুকতারা, শারদীয়া ১৩৯৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *