রণজয় আর অলৌকিক শিশুরা
রণজয়ের জীবনে কোনও দিনের বেলা নেই। শুধু রাত্তির। কেননা, সারাদিন তাকে একটা অন্ধকার ঘরে লুকিয়ে থাকতে হয়। কোনও মানুষের সঙ্গে দেখা হয় না। দিনের বেলা তার ওই ঘর থেকে বেরুবার উপায় নেই। বেরুবে কী করে? তাকে দেখলেই যে সবাই ভয় পায়। সেই যে একবার অন্য গ্রহের প্রাণীরা তাকে ছুঁয়ে দিয়ে গিয়েছিল, তারপর থেকে সে ক্রমাগত লম্বা হতে শুরু করেছে। এখন সে সাধারণ মানুষের প্রায় ডবল লম্বা, সব ঘরের ছাদে তার মাথা ঠুকে যায়। গায়ের রংটা আরও বেশি নীল হয়ে গেছে, চোখের মধ্যেও সাদা অংশ নেই, পুরোপুরি নীল, মাথার চুলও নীল।
তার এই প্রকাণ্ড চেহারা আর নীল রং দেখে সবাই মনে করে দৈত্য।
এক সময় তার দাদা তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তখন রণজয় আশ্রয় নিয়েছিল জঙ্গলে। কিন্তু দিনের পর দিন কি কারুর জঙ্গলে থাকতে ভালো লাগে? রণজয় কিছুটা লেখাপড়া শিখেছে, তার বই পড়তে ভালো লাগে, সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করে, ফুটবল খেলার খুব শখ। জঙ্গলে সেসব কিছু নেই, শুধু একঘেয়ে জীবন।
তারপর রণজয় আবার চুপি-চুপি বাড়িতে ফিরে এসে মায়ের কাছে কাকুতি-মিনতি করেছিল। মা তাকে আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি অন্যদের বলে দিয়েছেন, যতদিন তিনি বেঁচে থাকবেন, রণজয়কে কেউ এ বাড়ি থেকে বিদায় করে দিতে পারবে না। চেহারা যেমনই হোক, তবু তো সে মায়েরই সন্তান।
কয়েকবার সে দিনের বেলা বাইরে বেরিয়েছে, কিন্তু সবাই তাকে দেখে ভয় পায়। দৌড়ে পালায়। পুলিশ ডেকে আনে। পুলিশরা তাকে গুলি করে মারতে চেষ্টা করে।
একদিন রণজয় গ্রামের বাজারের মধ্যে হঠাৎ হাজির হয়ে হাতজোড় করে করুণ। গলায় বলেছিল, আপনারা আমাকে দেখে ভয় পাবেন না। আমিও আপনাদের মতন মানুষ। আমি কারুর ক্ষতি করি না। আমার চেহারা এরকম বিশ্রী হয়ে গেছে, সে তো আমার দোষ নয়।
কিন্তু রণজয়ের গলার আওয়াজটাও এমন বাজখাই আর ঘর্ঘরে হয়ে গেছে যে তার অনেক কথাই লোকে বুঝতে পারে না, মনে হয় যেন মেঘ ডাকছে। যেটুকু লোকে বোঝে, তাও বিশ্বাস করে না। রূপকথার গল্পে যে-রকম দৈত্যের ছবি আঁকা থাকে, রণজয়ের শরীরটা যে ঠিক সে-রকমই হয়ে গেছে। আগেকার দিনের দৈত্যগুলো বোধহয় ওই নীল গ্রহ থেকেই এসেছিল। মহাভারতে হিড়িম্বা রাক্ষসীর ছেলে যে ঘটোৎকচ, তার সঙ্গেও রণজয়ের খুব মিল।
রণজয়কে অনেকবার গুলি করে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। একদল লোক তাকে বন্দি করে রাখতে চেয়েছে চিড়িয়াখানায়। আর একবার এক সার্কাস কম্পানির মালিক তার হাত-পায়ে শেকল বেঁধে ধরে নিয়ে গিয়ে ভেবেছিল, তাকে নিয়ে সার্কাসের খেলা দেখানো হবে।
কিন্তু রণজয়কে বন্দি করে রাখা সোজা নয়। লোহার শেকল সে পটপট করে। ছিঁড়ে ফেলতে পারে সুতোর মতন। তার গায়ে ছুরি বেঁধে না। গুলি করলেও সে মরে না।
ওরকম অসুরের মতন শক্তি নিয়ে সে ইচ্ছে করলে অনেক কাণ্ড করতে পারত। এখানকার সব লোকদের ভয় দেখিয়ে সে থাকতে পারত রাজার মতন। টাকাওয়ালা লোকদের মারধোর করে কেড়ে নিতে পারত টাকাপয়সা। কিন্তু তার যে ওসব কিছু একেবারে ইচ্ছে করে না। অতবড় চেহারা, তবু তার মনটা যে খুব নরম। সে কারুকে আঘাত দিতে চায় না। কোনওরকম অন্যায় করতে চায় না। সে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে বাঁচতে চায়।
তার সবচেয়ে বেশি দুঃখ, তার কোনও বন্ধু নেই।
দিনের বেলা তার ঘরে শুধু আসেন মা। তিনিই ওর খাবারদাবার দিয়ে যান। তার দাদার ছেলে পিকলু মাঝে-মাঝে লুকিয়ে উঁকি মারে। এ বাড়ির সবাইকে প্রতিজ্ঞা করানো হয়েছে, রণজয়ের কথা বাইরের কারুকে বলা চলবে না। পিকলুর বয়েস এগারো, সে সবসময় প্রতিজ্ঞা রাখতে পারে না। ইস্কুলে কোনও ছেলের সঙ্গে ঝগড়া-মারামারি হলে সে চোখ পাকিয়ে বলে, জানিস, আমাদের বাড়িতে একটা পোষা দৈত্য আছে? তাকে বলে দিলে সে তোর ঘাড় মটকে দেবে। পিকলুর কথা অবশ্য কেউ বিশ্বাস করে না। সবাই হাসে।
একদিন দুপুরে মা খাবার নিয়ে এসে দেখলেন, আগের রাত্তিরের খাবার সব ঢাকা দেওয়া অবস্থায় পড়ে আছে। রণজয় ছুঁয়েও দেখেনি। সে এখন ঘুমিয়ে আছে।
রণজয়ের শরীরের মাপে খাট তো জোগাড় করা অসম্ভব, তাই সে মেঝেতেই শোয়। একদিকের দেয়ালে তার পা ঠেকে যায়, আর একদিকে মাথা। নাক দিয়ে এত জোরে নিশ্বাস বেরোয় যেন ছোটখাটো ঝড় বইছে। মা রণজয়ের মাথার কাছে এসে বসে মাথায় হাত রেখে ডাকলেন, খোকা, এই খোকা ওঠ।
রণজয় চোখ মেলে তাকাল।
মা জিগ্যেস করল, তুই কাল রাত্তিরে কিছু খাসনি কেন? শরীর খারাপ হয়েছে? জ্বর তো নেই দেখছি।
রণজয় করুণ গলায় বলল, মা, আমার জ্বর হয় না। আমার খেতে ইচ্ছে করে না। আমার কিছুই ভালো লাগে না।
মা বললেন, খাবি না কেন? না খেলে শরীর দুর্বল হয়ে যাবে যে! ওঠ, খেয়ে নে।
রণজয় বলল, কেন আমাকে কয়েদির মতন এই ঘরের মধ্যে থাকতে হবে? আমি কী দোষ করেছি?
বাচ্চা ছেলের মতন সে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
মা তার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, কাঁদে না, সোনা, কেঁদে কী হবে।
তারপর নিজেই খুব জোরে কেঁদে উঠলেন। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। রণজয়ের মাত্র একুশ বছর বয়েস, তাকে বাকি জীবন এইভাবেই কাটাতে হবে।? এই তার ভাগ্য!
মাকে কাঁদতে দেখে রণজয় নিজের কান্না থামিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল। খুব আলতো করে মায়ের একটা হাত ধরে বলল, না, না, তুমি কেঁদো না। আমি ঠিক হয়ে গেছি। একটা কিছু হবেই।
মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় রণজয় ফিসফিস করে কথা বলে। জোরে কথা বললেই মায়ের কানে তালা লেগে যাবে। রণজয় কখনো রেগেমেগে একটা হুঙ্কার দিলে ঘরের দরজা-জানলাও কেঁপে ওঠে।
মাকে খুশি করার জন্য রণজয় শান্তভাবে সব খাবার খেয়ে নিল। সে বিশেষ কিছু খায় না। মাত্র পঞ্চাশখানা রুটি আর দশটা ডিমের ঝোল। অথবা এক হাঁড়ি ভাত আর তিনটে মুরগি।
তারপর রণজয় অপেক্ষা করে কখন দিন শেষ হয়ে রাত আসবে।
রাত্তির এগারোটার আগে সে বেরোয় না। তখন গ্রামের সব লোকই শুয়ে পড়ে। রণজয় তখন খোলামাঠে গিয়ে টাটকা বাতাসে নিশ্বাস নেয়। দৌড়োদৌড়ি করে শরীরের আড় ভাঙে। খেলা করতেও ইচ্ছে করে, কিন্তু একা-একা কি খেলা যায়?
রণজয়ের গায়ে যে কত শক্তি, তা সে নিজেই অনেক সময় মনে রাখতে পারে। না। সে একটা তালগাছে হেলান দিলে গাছটা অমনি হেলে পড়ে, তাতে রণজয়ই চমকে যায়। একটা বাঁশের সাঁকোর ওপর দিয়ে সারাদিন কত লোক যাওয়া-আসা করে, কিন্তু রণজয়, সেটার ওপর পা দিলেই সেটা ভেঙে পড়ে হুড়মুড়িয়ে। তখন অবশ্য রণজয়ই সেটা মেরামত করে দেয়। গ্রামের লোক অবাক হয়ে দেখে, ব্রিজটা রাতারাতি নতুন হয়ে গেছে, কে করেছে কেউ জানে না।
এ গ্রামে চুরি কিংবা ডাকাতি অনেক দিন বন্ধ। চোর বা ডাকাতরা আসবে কী করে, সারারাত ধরে রণজয়ই তো পাহারা দেয় গ্রামটা। একবার সে একটা ডাকাত দলের পাঁচ জনকে ধরে ধরে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল।
রণজয়ের এক বন্ধু ছিল, তার নাম গুটুলি। সে দারুণ বেঁটে, মাত্র চার ফুট, কিন্তু খুব বুদ্ধি। সেই যে একবার অন্য গ্রহের প্রাণীরা ধরে নিয়ে গেল রণজয়কে, সেখান থেকে ফিরে আসার পর সে আর গুটুলিকে খুঁজে পায়নি। সেই গুটুলির জন্যে তার এখনও মন কেমন করে।
রণজয়ের সন্দেহ হয়, অন্য গ্রহের প্রাণীরা মাঝে-মাঝেই পৃথিবীতে আসে। তারা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে লড়াই করতে চায় না, দেখাও দিতে চায় না, আসে খুব গোপনে। রাত্তিরে তারা ঘুরে বেড়ায়। কিছু কিছু জিনিস চুরি করেও নিয়ে যায়।
পুকুর কিংবা নদীর জল কমে গেলে মানুষ অবাক হয় না। সবাই ভাবে, একটা সময় পুকুর-নদী শুকিয়ে যায়, আবার ভরে যায় বর্ষাকালে।
রণজয়দের গ্রামের পাশে ছোট নদীটার নাম সরলা। এই নদীতেই রণজয় সাঁতার শিখেছে, এই নদীকে সে খুব ভালোবাসে। এক-এক রাত্তিরে সে এই নদীর ধারে এসে বসে থাকে। নদীর স্রোতের কুলুকুলু শব্দ ঠিক যেন, গানের মতন মনে হয়।
এক রাত্তিরে রণজয় দেখল, নদীর জল এক জায়গায় ফোয়ারার মতন হয়ে গেছে। ক্রমে ফোয়ারাটা উঁচু হতে লাগল, অনেক উঁচু। রণজয় ঘাড় তুলে দেখতে লাগল, ফোয়ারাটা উঁচু হতে-হতে যেন আকাশের মেঘ ছুঁয়ে ফেলেছে। হঠাৎ এক সময় সেটা থেমে গেল।
এটা কী হল? নিশ্চয়ই কেউ জল চুরি করছে। আকাশের অনেক গ্রহ-উপগ্রহেই এখনও জলের সন্ধান পাওয়া যায়নি। সেখানে যদি কোনও প্রাণী থাকে, তারা কি মাঝে মাঝে পৃথিবী থেকে জল চুরি করতে আসে? এইরকম পৃথিবীর অনেক নদী থেকে যদি খানিকটা করে জল নিয়ে নেয়, তাহলে মানুষ টেরও পাবে না।
আর এক রাত্তিরে একটা মাঠের মধ্যে এসে রণজয় চমকে গেল। গত রাতেও মাঠটা ঘাসে ভরা ছিল। রণজয় তো জুতো পরে না, অত বড় পায়ের মাপে জুতো পাবে কোথায়? খালি পায়ে ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটলে বেশ আরাম হয়। কিন্তু আজ রাতে সে মাঠে একটুও ঘাস নেই। যেন গোটা মাঠের ঘাস কেউ চেঁছে নিয়ে গেছে।
ঘাস তো খায় গরু-ছাগলে? অন্য কেউ ঘাস চুরি করবে কেন? কিন্তু এক রাতে এত বড় মাঠটার সব ঘাস চেঁছে নেওয়া তো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
আরও চমকপ্রদ ঘটনা ঘটল দু-রাত্তির পরে।
রাত তখন দুটো-তিনটে হবে। পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। চতুর্দিকে ফটফট করছে জ্যোৎস্না। গুনগুন করে গান গাইতে-গাইতে রণজয় হাঁটছে নদীর ধার দিয়ে। হঠাৎ এক জায়গায় সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভাঙা মন্দিরের পাশে একটা জবা ফুলের গাছ চলতে শুরু করেছে। রণজয় কি ভুল দেখছে? গাছ কখনো চলতে পারে নাকি? চোখ রগড়ে রণজয় আবার ভালো করে দেখল?
গাছ তো নয়, একটা ভেড়া।
এখানে কোনও জবা ফুলের গাছ ছিল আগে দেখেনি রণজয়। জায়গাটা তার খুব চেনা। কিন্তু প্রথমে সে একটা জবা ফুলের গাছ দেখল, তারপর সেটা ভেড়া হয়ে গেল। এ কি ম্যাজিক নাকি? হঠাৎ এখানে একটা ভেড়া এলই বা কী করে?
ভেড়াটা মনের আনন্দে লাফাচ্ছে। রণজয় কৌতূহলী হয়ে চলল তার পেছন পেছন। সাদা ধপধপে ভেড়া। একটু পরে সেটা হয়ে গেল নীল।
রণজয় লম্বা হাত বাড়িয়ে খপ করে ধরে ফেলল ভেড়াটাকে।
সঙ্গে সঙ্গে সেটা হয়ে গেল একটা বাচ্চা মেয়ে। এক বছরের শিশুর মতন। টলটলে দুটো চোখ। ঠোঁটে হাসি মাখা।
রণজয় জিগ্যেস করল, এই, তুই কে রে? তোর নাম কী?
বাচ্চা মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠল।
তারপরই কে যেন রণজয়ের চুল ধরে টেনে তুলল মাটি থেকে। মন্দিরের মাথা ছাড়িয়ে, গাছপালা ছাড়িয়ে, অনেক ওপরে সে উঠে গেল। দুলতে লাগল শূন্যে।
এই অবস্থায় তাকে যে-কেউ দেখলে নির্ঘাৎ দৈত্য ভাববেই। অতবড় চেহারা নিয়ে সে যেন উড়ে আসছে আকাশপথে।
দৈত্যের বুক কিন্তু ভয়ে ধড়াস ধড়াস করছে।
কে তাকে টেনে ধরল এইভাবে? শূন্যে সে ঝুলছেই বা কী করে?
রণজয় মাধ্যাকর্ষণের কথা জানে। কোনও মানুষ এক লাফে যতই ওপরে উঠুক, আবার সে ধপাস করে মাটিতে পড়বেই। মানুষের পক্ষে শূন্যে ঝুলে থাকা অসম্ভব। তার মানে, কেউ তাকে অদৃশ্য সুতো বা রশ্মি দিয়ে বেঁধে রেখেছে।
বাচ্চাটাকে সে শক্ত করে ধরে আছে, যাতে হাত থেকে ফসকে না যায়। যদি অদৃশ্য সুতোটা ছিঁড়ে যায়, তা হলে রণজয়ও এত উঁচু থেকে পড়লে হাত-পা ভেঙে মরবে।
এরপর কেউ যেন তাকে বলল, বাচ্চাটাকে ছেড়ে দাও।
বলল মানে কী, কারুকে দেখা গেল না, কোনও আওয়াজও শোনা গেল না, রণজয় নিজের মাথার মধ্যে ওই কথা শুনল।
রণজয় জিগ্যেস করল, তুমি কে?
মাথার মধ্যে উত্তর শুনল, তা জানবার দরকার নেই। তুমি বাচ্চাটাকে ছেড়ে দাও।
রণজয় বলল, এখান থেকে ছেড়ে দিলে ও নিচে পড়ে যাবে যে।
মাথার মধ্যে আবার শুনল, তা তোমাকে ভাবতে হবে না, তুমি ছেড়ে দাও।
রণজয় বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিল।
সঙ্গে সঙ্গে সেই বাচ্চাটা উড়তে লাগল পাখির মতন। ঠিক যেমন দেবদূতের ছবি দেখা যায়। উড়তে-উড়তে সে মিলিয়ে গেল।
রণজয়ও নামতে লাগল আস্তে-আস্তে। কেউ যেন সুতো ঝুলিয়ে তাকে নামিয়ে দিচ্ছে। তার পা মাটিতে লাগতেই সে শুয়ে পড়ল। ভয়ে এখনও তার বুক ধক ধক করছে।
এসব কথা তো কারুকে বলাও যাবে না। কেউ বিশ্বাস করবে না।
আরও কয়েক রাত পরে রণজয় ওইরকম বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দেখতে পেল। অনেকগুলো। এক বছরের শিশুর মতন, কিন্তু হাঁটতে পারে, দৌড়তে পারে। যখন-তখন তারা গাছ হয়ে যায়, ভেড়া কিংবা বিড়াল হয়, কিংবা পাখির মতন ওড়ে।
রণজয় বুঝতে পারল, এরা নিশ্চিত অন্য গ্রহ থেকে আসে। আমাদের মা-বাবারা যেমন বাচ্চাদের পার্কে বেড়াতে নিয়ে যায়, সেইরকম সেই গ্রহের মা-বাবারাও তাদের ছেলেমেয়েদের পৃথিবীতে বেড়াতে আনে। এরকম গাছপালা, নদী বোধহয় তাদের গ্রহে নেই। বাচ্চারা এখানে মনের আনন্দে খেলা করে। ওরা ইচ্ছেমতন চেহারা পালটায়। ওটাই ওদের খেলা।
রণজয় আড়াল থেকে বাচ্চাগুলোর খেলা দেখে। কারুকে ছোঁয় না। বাপরে বাপ, একবার একজনকে ধরে প্রাণ যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ওদের সভ্যতা অনেক উন্নত, ওরা মাধ্যাকর্ষণ জয় করতে পারে।
উন্নত সভ্যতা হলেও ওরা পৃথিবীর কোনও ক্ষতি করতে চায় না। কিছু-কিছু জল নিয়ে যায়, ঘাস নিয়ে যায়, আরও অন্য কোনও জিনিসও বোধহয় নিয়ে যায়, তার বদলে কিছু দিয়ে যায় কিনা কে জানে। মায়ের কাছে রণজয় শুনেছে যে এবারে এদিকে খুব ভালো ধান হয়েছে, আমও হয়েছে প্রচুর, হয়তো এ সবের জন্যে, অন্য গ্রহের প্রাণীদের কিছু কৃতিত্ব আছে।
কিছু দিক বা না দিক, ওদের আটকাবার ক্ষমতা তো রণজয়ের নেই। একবার যদি শূন্যে তুলে নিয়ে আছাড় দেয় তা হলেই শেষ। রণজয় আর ওদের ঘাঁটাতে চায় না।
বাচ্চাগুলোর খেলা দেখতে তার খুব ভালো লাগে।
ওদের মা-বাবাদের কিন্তু দেখতে পায় না রণজয়। নিশ্চয়ই বাচ্চাগুলোকে পাহারা দেয় কেউ না কেউ। তারা কি অদৃশ্য হয়ে থাকে?
পৃথিবীর কোনও লোকই জানে না গভীর রাতে, এখানকার বনে-জঙ্গলে, নদীর ধারে কতকগুলো ফুটফুটে শিশু খেলা করে, লাফায়, খলখল করে হাসে। আহা, ওরা কেন আমাদের বাচ্চাদের সঙ্গে ভাব করে নেয় না!
রণজয় লক্ষ করেছে, ওদের সবকটি শিশুই সমান। এক বছর বয়েস বলে মনে হয়, কেউ ছোট বা বড় নয়।
মাঝে-মাঝে রাত্তিরে খুব বৃষ্টি হয়। সারাদিন ঘরে বন্দি থাকে, তাই বৃষ্টি হোক বা না হোক, রাত্তিরে রণজয় বাইরে বেরুবেই। খুব ঝমঝমে বৃষ্টি হলে সে ভাঙা মন্দিরটার মধ্যে ঢুকে বসে থাকে। এই মন্দিরে কোনও ঠাকুর নেই, বহুদিন ব্যবহার হয়নি, দিন দিন আরও ভাঙছে।
একদিন প্রায় দু-ঘণ্টা টানা খুব তেড়ে বৃষ্টি হল।
তারপর বৃষ্টি খানিকটা কমল বটে, কিন্তু একেবারে থামল না।
মন্দিরে আর বসে থাকতে ভালো লাগছে না, রণজয় বেরিয়ে পড়ল।
খানিকটা যাওয়ার পর এক ধরনের কুঁ-কুঁ শব্দ শুনে সে থমকে গেল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে, হঠাৎ চোখে পড়ল একটা ঝোঁপের পাশে কী যেন নড়ছে।
কাছে গিয়ে দারুণ চমকে গেল। অন্য গ্রহের যেসব বাচ্চাদের সে দেখে, তাদেরই একটি। কিন্তু এ আবার আর্ধেকটা মেয়ের মতন, অর্ধেকটা পাখি। মুখটা মেয়ে। একটা হাতও ঠিক আছে, আর একটা হাত ডানার মতন, গাটা পাখির মতন, আবার পা দুটো ঠিক আছে। এ আবার কী কিম্ভুতকিমাকার চেহারা। সেটা একটু-একটু নড়ছে। আর কুঁ-কুঁ শব্দ করছে।
একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রণজয় ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারল।
বৃষ্টির জন্য অন্য বাচ্চাগুলো ফিরে গেছে। শুধু এই একটা যেতে পারেনি। ওদের পাহারাদার কি এর কথা ভুলে গেছে? এরকম ভুল তো হতেই পারে। এই বাচ্চাটাও পাখি হতে গিয়ে আটকে গেছে মাঝপথে। কোনও কারণে চেহারা বদলাবার ক্ষমতাও কাজ করছে না। তাই উড়ে যেতেও পারছে না।
কাছে গিয়ে রণজয় ভালো করে দেখল, বাচ্চাটা বৃষ্টিতে দারুণ ভিজেছে। সেই জন্যেই কাঁদছে?
এত বষ্টিতে ভিজলে মানুষদের ওইটুকু বাচ্চা ঠান্ডা লেগে মরে যেতে পারে। ওদেরও কি এমন ঠান্ডা লাগে?
ওঁকে ছুঁতে রণজয়ের ভয় করছে। আবার মায়াও হচ্ছে খুব।
দোনামোনা করতে করতে সে বাচ্চাটাকে তুলেই নিল দু-হাতে। একটু অপেক্ষা করল। কেউ তাকে এবার চুলের মুঠি ধরে শূন্যে তুলে নিল না।
অন্যদিন বাচ্চাটা হাসছিল। দেখলে এই আর্ধেক মেয়ে-আর্ধেক পাখিটার ঠোঁট কুঁকড়ে গেছে, দু-চোখে ভয়ের চিহ্ন। এমন কাঁপছে, যেন মরেই যাবে।
বাচ্চাটাকে সাবধানে ধরে, রণজয় লম্বা এক দৌড়ে চলে এল নিজের ঘরে। বাচ্চাটাকে বিছানায় শুইয়ে সে তাড়াতাড়ি হারিকেন জ্বালল। তারপর এক টুকরো কাপড় সেই হারিকেনের গায়ে লাগিয়ে গরম করে সেঁক দিতে লাগল বাচ্চাটার গায়ে।
আস্তে-আস্তে বাচ্চাটা চাঙ্গা হয়ে উঠল। রণজয়ের চোখের সামনে তার অর্ধেক পাখির ভাবটা মিলিয়ে গেল, সে হয়ে উঠল পুরোপুরি একটা বাচ্চা মেয়ে। রাত্তিরে খাবারের সঙ্গে রণজয়কে বড় এক বাটি দুধও দেওয়া হয়। দুধ খেতে তার ভালো লাগে না। তাই রোজ খায় না। আজকের দুধটা রাখা আছে। বাটিটা নিয়ে এসে রণজয় জিগ্যেস করল, কী রে সোনামণি, একটুখানি দুধ খাবি নাকি?
বাচ্চাটা কোনও উত্তর দেয় না। শুধু অবাক-অবাক চোখে চেয়ে রইল রণজয়ের দিকে–তার মুখের কাছে বাটিটা আনতেই সে দিব্যি চুকচুক করে দুধ খেতে লাগল।
এবারে কী করা যায়?
বাচ্চাটাকে বাড়িতেই রেখে দিলে কেমন হয়? তার দাদার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলবে। তারপরেই ভাবল, সেটা খুব বিপজ্জনক। ওর অভিভাবকরা খুঁজে বার করবেই। তারপর কী ভয়ংকর প্রতিশোধ নেবে কে জানে!
তার চেয়ে যেখান থেকে কুড়িয়ে এনেছে, সেখানে রেখে আসাই ভালো।
বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, চল, বাড়ি যাবি?
বাইরে এসে দেখল, বৃষ্টি একেবারে থেমেছে এতক্ষণে। রাতও প্রায় শেষ।
কয়েক পা হাঁটতে না হাঁটতেই হঠাৎ খুব ঝড় উঠল। নুয়ে-মুয়ে পড়তে লাগল গাছপালা। ঘন-ঘন চমকাতে লাগল বিদ্যুৎ। রণজয় আবার ঘরে ফিরে যাবে কি যাবে না ভাবছে, একটা বিদ্যুতের শিখা সোজা নেমে এল তার দিকে। বাচ্চাটাকে তার হাত থেকে তুলে নিয়ে আবার ওপর দিকে ঘুরে চলে গেল। ঝড়ও থেকে গেল তক্ষুনি।
রণজয় কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আমি তো ফেরৎ দিতে যাচ্ছিলাম, অত ঝড়-বিদ্যুৎ তোলার কি দরকার ছিল?
হাঁটতে হাঁটতে শিবমন্দিরটার সামনে পৌঁছতেই সে দেখল, আকাশ থেকে একটা আলোর বিন্দু নেমে আসছে। তার খুব কাছে এসে সেটা শুন্যে দুলতে লাগল। যদিও সেটা একটা ছোট বালবের মতন, কিন্তু মনে হয় যেন জীবন্ত। যেন কিছু বলতে চায়। কিন্তু রণজয় তার মাথার মধ্যে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না।
বেশ জোরে জোরেই রণজয় বলল, তুমি আবার কী চাও?
আলোটা দূলে উঠল।
রণজয় বুঝতে পারল না, বাচ্চাটাকে নিজের ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য এরা কি তার ওপর রাগ করেছে, না কৃতজ্ঞতা জানাতে চায়? কৃতজ্ঞতা জানানোই তো উচিত, সে বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে তুলেছে।
অবশ্য মানুষ যাকে কৃতজ্ঞতা বলে, ওরা কি সেরকম কিছু বোঝে? ওদের ভাবনা হয়তো অন্যরকম।
রণজয় শিবমন্দিরটার ভেতর ঢুকে দাঁড়াল, যাতে কোনও সুতো বা রশ্মি দিয়ে বেঁধে তাকে ওপরে না তুলতে পারে। ছাদ ফুঁড়ে তো আর তুলতে পারবে না। সে বুঝে গেছে, এদের কাছে গায়ের জোর দেখিয়েও কোনও লাভ নেই।
সেই আলোটা কিন্তু যাচ্ছে না, ঠিক যেন তার দিকে একটা চোখ তাকিয়ে আছে।
রণজয় হাতজোড় করে বলল, আমাকে ছেড়ে দাও। আমি কথা দিচ্ছি, তোমাদের কোনও ক্ষতি করব না। তোমাদের বাচ্চারা এখানে খেলা করতে আসে, আমি ধরব না কারুকে।
এবার রণজয় তার মাথার মধ্যে শুনতে পেল, কে যেন বলছে, তুমি আমাদের গ্রহে যাবে? তোমাকে নিয়ে যেতে পারি। তুমি আমাদের একটি শিশুকে বাঁচিয়েছ, তোমাকে আমরা ওখানে অনেক যত্নে রাখব।
রণজয় বলে উঠল, না, না, না। আমি আর অন্য কোথাও যেতে চাই না। এর আগে দুবার আমাকে যেতে হয়েছে। আমার সহ্য হয়নি। আমার এই পৃথিবীই ভালো।
এবার আলোটা মিলিয়ে গেল শূন্যে।
তারপর মনে হল, আকাশ থেকে থোকা-থোকা ফুলের মতন কী যেন নামছে। আরও কাছে এলে দেখা গেল, ফুল নয়, বাচ্চা ছেলে-মেয়ে। সকলের মুখে হাসি। তারা রণজয়কে ঘিরে নাচতে লাগল হাত তুলে তুলে।
ঠিক যেন দেবশিশু। সত্যি, এরাই কি দেবশিশু? কী সুন্দর দেখতে বাচ্চাগুলোকে। হাসছে, লাফাচ্ছে।
রণজয়ের মনে হল, এত সুন্দর দৃশ্য সে সারা জীবনে আর দেখেনি।
ভোরের আলো ফুটতে-না-ফুটতেই বাচ্চাগুলো সব উড়ে গেল পাখি হয়ে।
তাহলে ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগে মানুষ যে পাখির গান শোনে চতুর্দিকে, তার সবগুলো কি সত্যিই পাখি, নাকি এরকম কিছু দেবশিশু মিশে থাকে পাখিদের মধ্যে?
হতেও তো পারে।