রণজয়ের শহর অভিযান

রণজয়ের শহর অভিযান

ঘুম থেকে উঠে একটা মস্ত হাই তুলে রণজয় বললো, ধ্যুৎ, আর এই জঙ্গলে থাকতে ভালো লাগে না! দিনের পর দিন একই রকমের সবকিছু, একঘেয়ে হয়ে গেছে!

গুটুলি একটু দূরে বসে একটা ছুরি নিয়ে পেয়ারা গাছের ডাল কেটে একটা গুলতি বানাচ্ছিল। সে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলো, জঙ্গল ছেড়ে কোথায় যাবে?

রণজয় বললো, শহরে গিয়ে সিনেমা দেখবো, ফুটবল ম্যাচ দেখবো। দোকানের চা আর সিঙাড়া খাবো! ওঃ, কতদিন যে গরম গরম সিঙাড়া খাইনি!

গুটুলি বললো, তুমি তো শহরে যেতে পারবে না। আমি বরং গিয়ে তোমার জন্য সিঙাড়া এনে দিতে পারি। আর আমি সিনেমা দেখে এসে তোমাকে সেই গল্পটা শোনাতে পারি।

রণজয় চোখ বড় বড় করে বললো, তুই সিনেমা দেখবি, আর আমি সেই গল্প শুনবো? মারবো এক গাঁট্টা! কেন, আমি শহরে যেতে পারবো না কেন রে?

গুটুলি বললো, তুমি আট ফুট লম্বা মানুষ, আর তোমার গায়ের রং ফাউন্টেন পেনের কালির মতন নীল। তোমাকে দেখলেই যে সবাই দৈত্য ভাববে!

রণজয় বললো, দৈত্য আবার কী? আজকালকার দিনে দৈত্য বলে কিছু আছে নাকি? মানুষ হঠাৎ বেশি লম্বা হয়ে যেতে পারে না? শহরে কি এমন কিছু নিয়ম করা আছে যে এর বেশি লম্বা লোক সেখানে যেতে পারবে না?

গুটুলি বললো, তুমি শুধু শুধু আমাকে ধমকাচ্ছো কেন, ওস্তাদ? আমি শহরে যাবার চেষ্টা করেছি দু’একবার, লোকে ভয় পেয়ে পালিয়েছে, মনে নেই? শহরের লোকরা শুধু মাঝারি মাপের মানুষ পছন্দ করে। তুমি বেশি লম্বা বলে তোমাকে দেখে ভয় পায়, আর আমি খুব বেঁটে বলে আমার মাথায় সবাই চাঁটি মারে।

রণজয় উঠে দাঁড়িয়ে বললো, চল, এবার আমরা একটা বেশ বড় শহরে যাবো। লোকে ভয় পেলে আমি তার কী করতে পারি। আমি তো ইচ্ছে করে কারুকে ভয় দেখাচ্ছি না, কারুর কোনো ক্ষতিও করছি না।

গুটুলি তবু বললো, কী দরকার ঝামেলার মধ্যে গিয়ে! এই জঙ্গলে তো আমরা বেশ আছি।

রণজয় দু’হাত দিয়ে গুটুলিকে শূন্যে তুলে প্রচণ্ড চিৎকার করে বললো, আমার ভালো লাগছে না। আমার ভালো লাগছে না! আমার কিছু ভালো লাগছে না!

সেই আওয়াজে গুটুলির কান ফেটে যাবার জোগাড়। সে দু’হাতে কান চেপে ধরলো।

সন্ধে হয়ে এসেছে, একটু পরেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসবে। এর পর সারা রাত ধরে এখানে করার কিছুই থাকে না। রণজয় দিনের বেলা লম্বা ঘুম দিয়েছে, রাত্তিরে তার ঘুমও আসবে না।

রঘু নামে যে ডাকাতটা ওদের রান্নাবান্না করে দিত, সে দিন সাতেক আগে পালিয়েছে। রঘুর যে গ্রামে বাড়ি, সেই গ্রামটা চেনে গুটুলি। ইচ্ছে করলেই তাকে আবার ধরে আনা যায়। কিন্তু রণজয় আর উৎসাহ বোধ করেনি। ধরে আনলেও সে আবার পালাবার চেষ্টা করবেই। ডাকাত কখনো রান্নাবান্নার কাজে সন্তুষ্ট থাকতে পারে?

গুটুলিকে কাঁধের ওপর বসিয়ে রণজয় লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটতে শুরু করলো। শুকনো পাতার ওপর মচর মচর শব্দ হতে লাগলো। রণজয়ের পায়ের আওয়াজ পেলে হিংস্র প্রাণীরাও ভয়ে দূরে সরে যায়। একদিন একটা চিতাবাঘ রণজয়ের সামনে এসে পড়েছিল, তার পরেই সে কী জোর দৌড় লাগালো ল্যাজ গুটিয়ে! যেন একটা ভীতু নেড়ি কুকুর!

এই জঙ্গলের প্রায় মাঝখান দিয়েই একটা হাইওয়ে চলে গেছে। সেটা রণজয় চেনে। রাত্তিরের দিকেও সেই রাস্তা দিয়ে অনেক ট্রাক যায় নানারকম মালপত্তর নিয়ে। একবার রণজয় সেই রকম একটা চলন্ত ট্রাক থেকে একটা বস্তা তুলে নিয়েছিল। সেই বস্তাটায় ভর্তি ছিল আলু। রণজয় অনেকদিন আলুসেদ্ধ খায়নি, সেই বস্তাটা পেয়ে তার দারুণ আনন্দ হয়েছিল। পরপর তিন—চার দিন আলুসেদ্ধ খাওয়া হলো। তারপর আর একদিন রণজয় আর একটা বস্তা তুলে নিল, সেটাতে কিন্তু ছিল লোহালক্কড়! আর একটা বস্তায় পেল সিমেন্ট! আলুর বস্তা আর পায়নি।

সেই রাস্তাটার কাছাকাছি এসে গুটুলি বললো, ওস্তাদ, শহর কত দূরে তার তো কোনো ঠিক নেই। সারারাত ধরে হাঁটবে নাকি? পায়ে ব্যথা হয়ে যাবে না?

রণজয় বললো, হেঁটে না গেলে, কে আমাদের গাড়ি করে নিয়ে যাবে?

গুটুলি বললো, কোনো লরির ড্রাইভারকে অনুরোধ করলেই তো হয়। সব লরিই নিশ্চয়ই শহরে যায়?

রণজয় বললো, আমরা অনুরোধ করলেই শুনবে?

গুটুলি বললো, তুমি একটা লরি থামাও। আমি কথা বলবো!

বড় রাস্তাটার পাশে একটা পাথরের আড়ালে ওরা দাঁড়িয়ে রইলো একটুক্ষণ। পর পর দুটো মারুতি আর ফিয়াট গাড়ি গেল, কিন্তু কোনো লরির দেখা নেই। যেদিন যেটা দরকার, সেটা কিছুতেই পাওয়া যাবে না। ছোট গাড়িতে বসতেই পারবে না রণজয়, তার বাস কিংবা লরি দরকার।

দু’ঘণ্টা দাঁড়াবার পর রণজয় যখন ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে তখন দূরে দেখা গেল এক জোড়া জোরালো হেডলাইট। হ্যাঁ, এবার একটা ট্রাক আসছে বটে।

ট্রাকটা ফাঁকা, পেছনে কোনো মালপত্র নেই, তাই আসছে খুব স্পীডে। রণজয় রেডি হয়ে রইলো। কাছে আসতেই সে লম্বা হাত বাড়িয়ে পেছনটা চেপে ধরলো।

কিন্তু সে ধরে রাখতে পারলো না। হঠাৎ বাধা পেয়ে ট্রাকটা থরথর করে কাঁপতে লাগলো, ইঞ্জিনে ঝাঁ ঝাঁ শব্দ হতে লাগলো, আবার হুস করে বেরিয়ে গেল।

রণজয় আফশোসের সঙ্গে বললো, যাঃ!

ট্রাকের ড্রাইভারটি কিছু বুঝতে পারেনি। হঠাৎ ট্রাকটার এই রকম ব্যবহারে চিন্তিত হয়ে সে একটু দূরে গিয়ে ব্রেক কষলো। তারপর নেমে দেখতে এলো চাকাগুলো।

ড্রাইভার টর্চ জ্বেলে নিচু হয়ে চাকা দেখছে, অল্পবয়সী ক্লিনার ছেলেটিও তার সঙ্গে নেমেছে। রণজয় কাছে গিয়ে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এই এত দেরি করলি কেন রে? এতক্ষণ কোথায় ছিলি?

ক্লিনার ছেলেটি মুখ তুলে রণজয়ের সেই বিশাল মূর্তি দেখেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে ভূ—ভূ—ভূ বলতে বলতে মারলো টেনে দৌড়। মিলিয়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে।

ড্রাইভারটি সর্দারজী, সে এত সহজে ভয় পেল না, সে একলাফে খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে কোমর থেকে টেনে বার করলো কৃপাণ।

রণজয় বললো, আরে, এ যে দেখছি ওই পুচকে একটা ছুরি নিয়ে আমার সঙ্গে লড়াই করতে চায়!

এবার গুটুলি রণজয়ের আড়াল থেকে সামনে এসে বললো, সর্দারজী, বাঁচে গা, না মরে গা?

এবার সেই সর্দরজীর চোখ দুটো প্রায় বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। একবার সে প্রকাণ্ড চেহারার রণজয়কে দেখলো, আবার দেখলো একরত্তি চেহারার গুটুলিকে।

গুটুলি বললো, ও সর্দারজী, তুমি লড়াই করলে মর জায়েগা! আর লড়াই না করলে বাঁচে গা!

সর্দারজী তবু কৃপাণটি উঁচিয়ে ধরে রইলো।

গুটুলি বললো, ছুরি খাপ মে রাখ দেও। হামলোগ ভূত না, মানুষ। তুমি আমাদের শহরে পৌঁছে দেবে?

সর্দারজী এবার কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, মানুষ?

রণজয় বললো, হ্যাঁরে বাবা, মানুষ! একটু বেশি লম্বা হয়ে গেছি, তাতে কী হয়েছে? আমাদের কথা শুনে চলো, তা হলে তোমার কোনো ভয় নেই।

গুটুলি বললো, তোমার সাকরেদটি কোথায় ভয়ে পালালো? ডাকো তাকে।

রণজয় ড্রাইভারের পাশের সীটে বসে পড়ে বললো, ওঃ, কতদিন পরে গাড়িতে চাপছি। আমিও যে একসময় একটা ভদ্দরলোকের বাড়ির ছেলে ছিলাম, তা ভুলেই যাচ্ছিলাম প্রায়। একবারে জংলী হয়ে গেছি!

গুটুলি আর সর্দারজী মিলে খানিকক্ষণ ডাকাডাকি করলো ক্লিনারটিকে। কিন্তু তার আর পাত্তা পাওয়া গেল না।

এবার সর্দারজী উঠে বসে রণজয়কে আবার ভালো করে দেখলো। হাত বাড়িয়ে রণজয়ের গায়ে আঙুল ঘষলো এবার। রং করা হয়নি, রণজয়ের গায়ের চামড়া সত্যিই ঘন নীল। মুখখানা নীল।

ড্রাইভারটি জিজ্ঞেস করলো, এইসা ক্যায়সে হুয়া?

রণজয় বললো, সে অনেক লম্বা গল্প। তোমাকে চট করে বোঝানো যাবে না।

ড্রাইভারটি বললো, কুছ দাওয়াই খাকে হুয়া? হামকো দেও। আমার শরীরটাও তোমার মতন করে দাও।

রণজয় হেসে বললো, ওরে গুটুলি, ও যে আমার মতন হতে চায়!

গুটুলি ড্রাইভারটির দাড়িওয়ালা থুতনি ধরে নেড়ে দিয়ে বললো, অত সোজা নয়, চাঁদু। এবার গাড়ি স্টার্ট দাও তো!

গাড়িটা চলতে শুরু করার পর রণজয় বললো, ওরে গুটুলি, এরকম একটা নোংরা পরে শহরে যাবো কী করে? শহরে সেজে—গুজে যাওয়া উচিত, তাই না? আগে একটা পোশাকের দোকানে যেতে হবে!

গুটুলি বললো, তোমার মাপের কোনো জামা—প্যান্ট কি কোনো দোকানে পাওয়া যাবে? দর্জি দিয়ে বানাতে হবে! আমার কোনো অসুবিধে নেই। যে—কোনো দোকানেই বাচ্চাদের পোশাক পাওয়া যায়। সাত—আট বছরের ছেলেদের জামা আমার গায়ে লেগে যায়।

রণজয় বললো, আমি দর্জি দিয়ে জামা—প্যান্ট বানাবো। স্পেশাল অর্ডার দিয়ে জুতো বানাবো। আমি মোটেই আর জংলী সেজে থাকতে পারবো না।

গুটুলি মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো, পয়সা কোথায় পাবে?

রণজয় বললো, ইচ্ছে করলেই তো আমি যে কোনো ব্যাঙ্ক লুট করতে পারি!

সর্দারজী চমকে উঠে বললো, ব্যাঙ্ক লুট? হাঁ—হাঁ, ইয়ে তো আচ্ছা বাত হায়। আগে একটা ব্যাঙ্কে নিয়ে যাবো তোমাদের?

রণজয় বললো, না! ইচ্ছে করলে ব্যাঙ্ক লুট করতে পারি বলেছি, কিন্তু করবো না। আমি টাকা রোজগার করবো! শহরে কত রকম কাজ থাকে।

সর্দারজী বললো, হাঁ—হাঁ, আমি আপনাদের কাজ দেবো!

ট্রাকটা ছুটে চলেছে অন্ধকার ভেদ করে। জঙ্গল পাতলা হয়ে আসছে ক্রমশ। আকাশে চাঁদ নেই।

খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর রণজয় বললো, জানিস গুটুলি আমি মহাশূন্যে অনেকগুলো গ্রহ ঘুরেছি। কত রকম রকেট চালিয়েছি। অথচ আমি গাড়ি চালানো শিখিনি। আমি ইন্টার গ্যালাকটিক মিসাইল চালাতে পেরেছি, আর এই রকম একটা ট্রাক চালাতে পারবো না?

গুটুলি বললো, চেষ্টা করে দেখো না। পারতেও পারো।

—ঠিক বলেছিস তো। কখনো চেষ্টা করে দেখিনি। একবার চেষ্টা করতে দোষ কী?

—সর্দারজীকে সরে বসতে বলো।

—সর্দারজী, ব্রেক কষো! আমি একবার চালিয়ে দেখবো!

সর্দারজী প্রথমে কিছুতেই রাজী হতে চায় না। তখন রণজয় জোর করে সর্দারজীর পা দুটো তুলে দিল ওপরে। নিজেই ব্রেকে একটা লাথি কষালো। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল ট্রাক।

সর্দারজীকে পাঁজাকোলা করে তুলে পাশে সরিয়ে দিয়ে রণজয় নিজে বসলো স্টিয়ারিং—এ।

তারপর বললো, দেখে নিয়েছি, এটা সুইচ, এটা গিয়ার, আর এটা অ্যাকসিলারেটার! আর ব্রেক তো সবাই চেনে। যে পাইলট প্লেন চালায়, সে কি গাড়ি চালাতে পারবো না? জয় মা কালী! দেখা যাক কী হয়!

সুইচ দিয়ে অ্যাকসিলারেটারে চাপ দিতেই ট্রাকটা হঠাৎ বিরাট জোরে ছুটতে শুরু করলো।

সর্দারজী আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, রোকো! রোকো! মর জায়েগা!

রণজয় অ্যাকসিলারেটারের উপর পা আলগা করে বললো, প্রথমেই বেশি স্পীড হয়ে গেছে, এই তো? কমিয়ে দিচ্ছি! সেকেন্ড গীয়ার, থার্ড গীয়ার, ব্যস! এবার ঠিক আছে?

সত্যিই এবার ট্রাকটা বেশ স্বাভাবিকভাবে চলছে।

গুটুলি আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলো।

রণজয় বললো, গাড়ি চালানো তাহলে এমন কিছু শক্ত ব্যাপার নয়। ব্যস, এবারে শহরে গিয়ে জামা—কাপড় তৈরি করবো, কাজ করে টাকা রোজগার করবো, সিনেমা দেখবো, সিঙাড়া—কচুরি খাবো, গাড়ি নিয়ে বেড়াবো—

এরপর রণজয়ই ট্রাকটা চালাতে লাগলা, সর্দারজী তাকে বলতে লাগলো ডান দিকে না বাঁ দিকে যেতে হবে।

প্রায় রাত একটার সময় দেখা যেতে লাগলো পাকা বাড়িঘর। অনেকটা শহরের মতন।

সর্দারজী বললো, এখানে থামবে। এখানে আমার ট্রাকে ডিজেল ভরে নিতে হবে। আমার চেনা একজনের পেট্রল পাম্প আছে। সেখানে ভালো খানাপিনা হবে।

রণজয় বললো, তা থামা যেতে পারে।

গুটুলি বললো, খিদেও পেয়েছে বেশ!

পেট্রল পাম্পের পাশে ট্রাকটা থামাবার পর সর্দারজী বললো, আপলোগ আগে বসুন। আমি পাম্পের মালিকের সাথে বাতচিত করে আসি। প্রথমেই আপনাকে দেখলে ভয় পেয়ে যাবে।

রণজয় বললো, সেটা ভালো কথা!

সর্দারজী নেমে ভেতরে চলে গেলো।

পেট্রল পাম্পের পেছনের দিকে একটা লম্বা গুদামের মতন বাড়ি। কাছাকাছি আরও কয়েকটা দোকান রয়েছে, কিন্তু সেগুলো এখন বন্ধ। চতুর্দিক নিঝুম।

একটু পরেই সর্দারজীর সঙ্গে দু’তিনজন লোক এগিয়ে এলো এদিকে। তাদের মধ্যে একজনের পেটমোটা পিপের মতন চেহারা। সে ব্যস্ত হয়ে বললো, কোথায়? কোথায় রে দৈত্য?

সর্দারজী ট্রাকের দরজা খুলে বললো, নেমে আসুন বাবুজী!

রণজয় নেমে দাঁড়াতেই সবাই ভয় পেয়ে পেছিয়ে গেল। অন্যদের একজনের হাতে একটা রাইফেল, অন্য একজনের হাতে একটা শাবল।

রণজয় বললো, নমস্কার!

গুটুলিও তার পাশে দাঁড়িয়ে বললো, নমস্কার।

পেটমোটা লোকটি বললো, ওরে বাবা! সত্যিই যে দেখছি দৈত্য! আট ফুট কী বললে সর্দারজী, তার চেয়ে বেশি লম্বা মনে হচ্ছে!

রণজয় যতদূর সম্ভব গলার আওয়াজ নরম করে বললো, আজ্ঞে, আমার হাইট আট ফুট পাঁচ ইঞ্চি। কিন্তু আমি দৈত্য নই। একটা বিশেষ কারণে আমার চেহারাটা বদলে গেছে! আমি লেখাপড়া জানি, ভদ্রঘরের সন্তান।

পেটমোটা লোকটি বললো, ঠিক মানুষের মতনই তো কথা বলে।

রণজয় আবার বললো, আমরা সত্যিই মানুষ! আমরা আপনাদের কোনো ক্ষতি করবো না। এই আমার বন্ধু গুটুলি, তার চেহারা ছোট হলেও বুদ্ধি ছোট নয়।

সর্দারজী বললো, ভিতরে আসুন, ভিতরে আসুন। খানা তৈরি। এই শেঠজী আপনাদের দেখে খুব খুশি হয়েছেন।

পেটমোটা শেঠজী বললো, হাঁ হাঁ, আসুন! খানা খেয়ে নিন।

এরপর রণজয় আর গুটুলির জন্য খাতির—যত্নের ধুম পড়ে গেল। লম্বা গোডাউনের মতন বাড়িটা একটা সিনেমা হল। সেটারও মালিক ওই শেঠজী। তার আরও অনেক ব্যবসা আছে। একটা সার্কাস কোম্পানিও আছে তার।

গরম গরম রুটি আর আলুর তরকারি খেতে দেওয়া হলো ওদের। গুটুলি খেল তিনখানা রুটি, রণজয় পঁয়ষট্টিটা রুটি শেষ করার পর বললো, আর পারছি না। পেট ভরে গেছে।

খেতে খেতে রণজয় ওদের কাছে নিজের গল্প শোনালো। কী করে অন্য গ্রহের প্রাণীরা ওকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, কী করে শরীরটা এভাবে বদলে গেল।

রণজয় শহরে এসে থাকতে চায় শুনে শেঠজী বললো, আপনারা দু’জন আমার এখানেই থাকুন। আমি চাকরি দেবো। প্রত্যেকদিন পেট ভরে খেতে পাবেন।

রণজয় খুব খুশি হয়ে বললো, বাঃ তবে তো খুব ভালো। আপনি যা কাজ বলবেন, সব করে দেবো। আর রোজ রোজ সিনেমা দেখবো। এখানে সিনেমা ক’টার সময় শুরু হয়?

শেঠজী বললো, সিনেমা দেখবেন? এখুনি চালিয়ে দিচ্ছি। শুধু আপনাদের দু’জনের জন্য। যত ইচ্ছে সিনেমা দেখুন না!

সত্যি সত্যি সেই রাত্তিরেই সিনেমা চালু হয়ে গেল। দর্শক মাত্র দু’জন। হল অন্ধকার, পর্দায় ফুটে উঠলো একটা বিদেশী ছবি। বিকট গোরিলার মতন একটা প্রাণী জাপানের একটা শহর আক্রমণ করছে। প্রথম থেকেই মারামারি।

রণজয় তবু লেখাপড়া শিখেছে। সে এইসব বিদেশী সিনেমাও একসময় দেখেছে কিছু কিছু। গুটুলি গ্রামের যাত্রা ছাড়া আর কিছুই দেখেনি কখনো। সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতাই তার এই প্রথম।

সে প্রথম প্রথম দারুণ উৎসাহ নিয়ে দেখতে লাগলো। সিনেমার পর্দায় যখন আকাশের একটা প্লেন ভেঙে পড়ছে, সে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ভয়ের চোটে।

কিন্তু বেশিক্ষণ তার উৎসাহ রইলো না। একটু পরে সে ঘুমিয়ে পড়লো। রণজয় দু’তিনবার ঠেলা দিয়ে তাকে জাগাবার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হল না। কিছুতেই আর চোখ খুলে রাখতে পারছে না গুটুলি।

রণজয় একাই দেখতে লাগলো সিনেমা। অনেকদিন পর সে সত্যিকারের আনন্দ পাচ্ছে।

রণজয় এমনিই মন দিয়ে সিনেমা দেখছিল যে পেছনে কোনো পায়ের শব্দ শুনতে পায়নি। হঠাৎ একটা মোটা শেকল এসে পড়লো তার বুকের ওপর। তারপর কেউ সেটা টেনে তার গলা বেঁধে ফেললো।

চার—পাঁচজন লোক ঘিরে ধরল রণজয়কে।

পেটমোটা শেঠজী লাফাতে লাফাতে বললো, হাত বেঁধে ফেলো। পা বেঁধে ফেলো। পালাতে না পারে!

সরু গোঁফওয়ালা একজন লোক হাতে একটা রাইফেল নিয়ে বললো, এ তো গোরিলাদের চেয়েও অনেক লম্বা। ভালো খেলা দেখানো যাবে।

রণজয় দারুণ দুঃখের গলায় বললো, এ কী শেঠজী, আমাকে বাঁধলেন কেন? আমি আপনার কী ক্ষতি করেছি?

শেঠজী বললো, ডেঞ্জারাস অ্যানিমাল। তোমাকে কি ছেড়ে রাখা যায়!

রণজয় বললো, অ্যানিমাল? আমি মানুষ! আমি বললোম, আমি আপনার এখানে চাকরি করবো। আপনি তখন রাজী হলেন।

শেঠজী বললো, চাকরি তো করবেই। তুমি আমার সার্কাসের দলে চাকরি করবে। তোমাকে খাঁচায় ভরে রাখবো। হাজার হাজার লোক তোমাকে টিকিট কিনে দেখতে আসবে।

সরু গোঁফওয়ালা লোকটি বললো, এ তো মানুষের মতন কথাও বলে। একে বেশি কিছু শেখাতেও হবে না!

রণজয় তার দিকে ফিরে বললো, আমি মানুষ, মানুষের মতন কথা বলবো না? আমি লেখাপড়াও শিখেছি।

সরু গোঁফওয়ালা লোকটি বললো, বা—বা—বা—বা! তা হলে তো আরও ভালো। ইংরিজি জানো?

শেঠজি বললো, আমাদের সার্কাস এবার কলকাতায় নিয়ে যাবো। বিদেশে নিয়ে যাবো। কথা—বলা দৈত্য, ইংরিজি বলা দৈত্য, আর কেউ দেখাতে পারবে?

রণজয় গম্ভীরভাবে বললো, আমাকে ছেড়ে দিন!

শেঠজী বললো, ছাড়া হবে না তোমায়, বেঁধে রাখতেই হবে। এত বড় একটা প্রাণীকে খাঁচায় না রাখলে পুলিশ আপত্তি করবে। তোমার তো কোনো অসুবিধে নেই, দু’বেলা পেট ভরে খেতে পাবে! পঞ্চাশখানা করে রুটি পাবে!

তারপর সে উঁকিঝুঁকি মেরে বললো, আরে, সেই বাঁটকুলটা কোথায় গেলো? ওকেও ধরো! ওকেও কাজে লাগানো হবে!

লোকগুলো আসার সঙ্গে সঙ্গে গুটুলির ঘুম ভেঙে গেছে। সে চেয়ারের তলায় লুকিয়ে পড়েছে।

গোঁফওয়ালা লোকটা নিচু হয়ে দেখে বললো, ওই যে, ওই যে, ইঁদুরের মতন পালাচ্ছে!

শেঠজী বললো, ধর, ধর, ওকে ধর!

রণজয় চেঁচিয়ে বললো, গুটুলি, তুই পালা। ধরা দিবি না।

তিন—চারজন লোক মিলে তাড়া করে গেল গুটুলিকে। কিন্তু তাকে ধরা সহজ নয়। ইঁদুর—বিড়াল খেলার মতন গুটুলি এঁকেবেঁকে এদিক—ওদিক ওদের হাত এড়িয়ে পালাচ্ছে। এক একবার তাকে দেখা যাচ্ছে না। আবার তাড়া খেয়ে সে অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে পড়ছে।

এরই মধ্যে কী করে যেন গুটুলি উঠে গেল স্টেজের ওপর। সিনেমাটা এখনো চলছে। পর্দার সামনে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল গুটুলি। দু’জন লোক লাফিয়ে উঠে প্রায় তাকে ধরে ফেললো, গুটুলি তখন টিকটিকির মতন তরতর করে উঠে যেতে লাগলো একটা থাম বেয়ে। আর চ্যাঁচাতে লাগলো, আমি পুলিশ ডাকবো। পুলিশ ডাকবো!

সরু গোঁফওয়ালা লোকটি রাইফেল তুলে আচমকা একটা গুলি চালালো সেদিকে।

প্রচণ্ড একটা শব্দ আর ধোঁয়া। গুটুলি ধুপ করে পড়ে গেল ওপর থেকে। আর নড়লো না।

শেঠজী ফ্যাকাসে গলায় বললো, মেরে ফেললে?

সরু গোঁফওয়ালা বললো, ওই বেঁটেটাকে নিয়ে এতক্ষণ সময় নষ্ট করে কী হবে? এই দৈত্যটাকে এক্ষুণি চালান করে দেওয়া দরকার।

রণজয়ও উঠে দাঁড়িয়ে কান্না—মেশানো গলায় বললো, মেরে ফেললে? আমার বন্ধুকে তোমরা মেরে ফেললে? এবার আমি তোমাদের ছাড়বো না। তোমাদের আমি কোনো ক্ষতি করিনি। তবু তোমরা আমাকে মানুষের মতন বাঁচতে দিতে চাও না!

একটা জোরে ঝাঁকুনি দিতেই মট মট করে ছিঁড়ে গেল রণজয়ের হাতের শিকল। সে গলায় শিকলটা হাত দিয়ে টানাটানি করতে লাগলো।

সরু গোঁফওয়ালা লোকটা বললো সাবধান! এদিকে এক পা এগোবে না। হাত দুটো মাথায় তোলো!

রণজয় তার কথা গ্রাহ্য না করে খুলে ফেললো গলার শেকল। অন্য দু’জন লোক ডাণ্ডা তুলে মারতে গেল তাকে, রণজয় তাদের একজনকে শূন্যে তুলে মারলো এক আছাড়!

তারপর সে সরু গোঁফওয়ালা লোকটার দিকে এগিয়ে গেল!

সেই লোকটি বললো, মাথার ওপর হাত তোলো। নইলে তোমার বুকে গুলি করবো। এক গুলিতে তুমি ছাতু হয়ে যাবে!

শেঠজী বললো, মেরো না, ওকে মেরো না! ওকে বাঁচিয়ে রাখলে অনেক রোজগার হবে।

রণজয় সরু গোঁফওয়ালার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, তুমি আমার বন্ধুকে মেরেছো। তোমাকে আমি শেষ করবো!

সরু গোঁফওয়ালা লোকটি ভয় পেয়ে দড়াম করে চালিয়ে দিল গুলি!

ধোঁয়া সরে যাবার পরে দেখা গেল রণজয় এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ দুটো যেন জ্বলছে প্রচণ্ড রাগে। শেঠজী আর দু’তিনজন একসঙ্গে বলে উঠলো গুলি লাগেনি!

রণজয় বললো, কোনো গুলি আমার শরীর ভেদ করতে পারে না।

তারপরেই যেন শুরু হয়ে গেল একটা প্রলয় কাণ্ড!

রণজয় এক একটা চেয়ার তুলে ছুঁড়ে মারতে লাগলো ওই লোকগুলোর দিকে। ওরা ভয়ের চোটে হুড়োহুড়ি করে পালাতে গিয়েও আছাড় খেয়ে পড়ে গেল জড়াজড়ি করে। রণজয় প্রত্যেককে তুলে তুলে মাথা ঠুকে দিতে লাগলো দেওয়ালে।

তারা অজ্ঞান হয়ে গেলেও রণজয়ের রাগ কমলো না। সে তবু ভাঙ্গতে লাগলো সব চেয়ার। সিনেমার পর্দাটা ছিঁড়ে ফালা ফালা করে ফেললো। তারপর গুটুলির কাছে গিয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো, হায়, হায়, প্রিয় বন্ধু, তুমি আমায় ছেড়ে চলে গেলে!

গুটুলি অমনি তড়াক করে উঠে বসে বললো, আমার গায়ে আসলে লাগেনি। আমি মটকা মেরে পড়ে ছিলাম।

রণজয় বললো, তুমি বেঁচে আছো! বাঁচালে আমাকে! তোমাকে ছাড়া কী আমি কি করে বাঁচতাম! কিন্তু এ কী হলো? আমরা শহরে এলাম চাকরি করতে, আর এরা আমাকে খাঁচায় ভরে রাখতে চাইলো?

গুটুলি বললো, শহর এরকমই! শহরে সবাই খাঁচার মধ্যেই থাকে। দেখছো না বাড়িগুলোও কেমন খাঁচার মতন! চলো আমরা জঙ্গলেই যাই।

দু’জনে বারে বেরুতেই দেখলো, সেখানে বিরাট একটা ভিড় জমে গেছে!

সেই ট্রাক ড্রাইভার সর্দারজী অনেক লোককে জোগাড় করেছে এর মধ্যে। রণজয়কে দেখেই সে বলে উঠলো, পাকড়ো, পাকড়ো! গোরিলা! দৈত্য!

রণজয় দু’হাত দুলে বললো, ভাইসব, ভয় নেই। আমি গোরিলাও না, দৈত্যও না। আমি কারুর কোনো ক্ষতি করবো না।

অনেকে একসঙ্গে ইট—পাথর ছুঁড়ে মারলো তার দিকে।

রণজয় দু’তিনবার একই কথা বোঝাবার চেষ্টা করলো, কিন্তু কেউ যেন তার কথা বুঝতেই পারছে না। রণজয় যখন চেঁচিয়ে কথা বলে, তখন মেঘের আওয়াজের মতন শোনায়।

জনতা এমন চ্যাঁচামেচি করছে যে রণজয়ের কথা কেউ শুনছেই না। কয়েকটা পাথরের টুকরো লাগলো গুটুলির মাথায়। তার কপাল ফেটে রক্ত বেরুতে লাগলো।

তখন রাগে অন্ধ হয়ে রণজয় একটা লম্বা বাঁশ তুলে নিয়ে বললো, আজ সবাইকে শেষ করবো।

গুটুলি বললো, শুধু শুধু মানুষ মেরে লাভ নেই, বন্ধু। চলো, আমরা এখান থেকে চলে যাই।

সে এক দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়লো ট্রাকটায়। রণজয়ও বাঁশ ফেলে এসে ড্রাইভারের সীটে বসলো। সর্দারজী ছুটে এসে বললো, আরে, আরে আমার ট্রাক নিয়ে ভাগছে! পাকড়ো, পাকড়ো!

রণজয় হাত বাড়িয়ে সর্দারজীকে এক ধাক্কা দিতেই ছিটকে পড়ে গেল অনেক দূরে।

ট্রাকটা এবার গর্জন করে বেরিয়ে গেল। কিছু লোক পেছন পেছন ছুটে এসেও ধরতে পারলো না।

কিছুদূরে এসে, ফাঁকা রাস্তায় পড়বার পর রণজয় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

গুটুলি বললো, দুঃখ করো না বন্ধু। জঙ্গলই আমাদের ভালো।

রণজয় বললো, মানুষ কেন আমাদের দেখলেই মারতে আসে! শুধু চেহারার জন্য? আমরা কি কোনো দোষ করেছি?

গুটুলি বললো দ্যাখো, জঙ্গলের পশু—পাখি, গাছ—পালা তারা আমাদের ভালোবাসে, নদীর জলে তোমার আর আমার মুখের ছায়া পড়লেও নদী তো রাগ করে না।

রণজয় বললো, তা বলে কি আমরা আর কোনোদিন মানুষের সঙ্গে মিশতে পারবো না? চিরকাল জঙ্গলে নির্বাসন থাকতে হবে?

গুটুলি চুপ করে গেল। দু’জনেরই মন খারাপ। সর্দারজী আর শেঠজীর কথায় তারা খুব বিশ্বাস করেছিল। ওরা যে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করবে, গুটুলিরা একবারও ভাবতে পারেনি।

অনেকক্ষণ চুপ করে গাড়ি চালালো রণজয়। সে যে কোন রাস্তায় যাচ্ছে তা জানে না। যে কোনো একটা দিকে হলেই হলো। কোথাও একটা গভীর বন দেখলে সেখানে থামবে।

প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। হঠাৎ রাস্তার ধারে একটা গ্রামের নাম লেখা বোর্ড দেখে রণজয় বলে উঠলো, আরেঃ!

গুটুলি বললো, কী হলো?

রণজয় বললো, গুটুলি আমার এই দেশে থাকতেই ইচ্ছে করে না। এখানে আর একবার একটা জায়গায় যাবো। যদি সেখানেও খারাপ ব্যবহার পাই, তাহলে আর কোনোদিন এদেশে ফিরবো না।

গুটুলি জিজ্ঞেস করলো, এখানে কোন জায়গায়?

রণজয় বললো, এসোই না!

ট্রাকটা সে ছোট রাস্তায় ঢোকালো। তারপর অনেকগুলো বাঁক ঘুরে সে এসে থামলো একটা বাগানের ধারে।

ট্রাক থেকে নেমে রণজয় গুটুলির হাত ধরে নিয়ে এলো একটা পুকুরপাড়ে। কাছেই একটা ছোট দোতলা বাড়ি, সামনে ছোট্ট উঠোন, তার মাঝখানে তুলসীমঞ্চ।

রণজয় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেই বাড়িটার দিকে।

গুটুলি জিজ্ঞেস করলো, এটা কাদের বাড়ি?

রণজয় ধরা গলায় বললো, এই বাড়িতে আমি জন্মেছি। এখানে আমি বড় হয়েছি। এখান থেকেই অন্য গ্রহের মানুষরা আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কত কষ্ট করে আমি ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু আমার চেহারাটা বদলে গেছে, কেউ আমায় চিনতে পারেনি। সবাই আমাকে দেখে ভয় পায়। গ্রামের মানুষ আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল। আমার দাদা আমাকে চিনতে পারলেও বলেছিল, তুই এখান থেকে চলে যা, রণজয়। তুই দৈত্য হয়ে গেছিস। মানুষের মধ্যে তুই আর থাকতে পারবি না!

বাড়ি থেকে সাদা শাড়ি পরা একজন মাঝবয়েসি মহিলা বেরিয়ে এলেন উঠোনে। তুলসীমঞ্চের কাছে দাঁড়ালেন।

গুটুলি জিজ্ঞেস করলো, উনি কে?

রণজয় বললো, আমার মা। কত দিন পরে মাকে দেখলাম। আমার চেহারা আরও বদলে গেছে। আমি দিন দিন আরও বেশি লম্বা আর মোটা হচ্ছি। মুখখানাও অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে।

গুটুলি বললো, তা হলে তোমার মা—ও কি তোমাকে চিনতে পারবেন না? একবার কাছে গিয়ে দেখোই না!

রণজয় বললো, মা—ও যদি আমায় চিনতে না পারে, মা—ও যদি আমাকে দেখে ভয় পায়, তা হলে জীবনে আর কোনো মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবো না। মানুষ দেখলে খুন করবো। সত্যি সত্যি দৈত্য হয়ে যাবো!

রণজয় এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল উঠোনে। তারপর ফিসফিস করে ডাকলো মা, মা!

মহিলাটি চোখ তুলে একবার সেই পাহাড়ের মতন চেহারাটা দেখেই ভয়ে চোখ কপালে তুলে বললেন, ওমা? এ কে? ওরে বাবারে!

রণজয় বললো, মা, মা, আমি খোকন!

মহিলাটি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে গিয়েও আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। রণজয়ের মুখখানা ভালো করে দেখে বললেন, খোকন? তুই আমার খোকন? কোথায় ছিলি এতদিন?

মা ছুটে এসে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন রণজয়কে।

রণজয় হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। তারপর মায়ের কোলে মাথা রেখে একটা বাচ্চা ছেলের মতন কাঁদতে লাগলো। মা হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন তার চুলে।

আনন্দের চোটে গুটুলির চোখেও জল এসে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *