রঞ্জা-সুবীর

রঞ্জা-সুবীর

পুরনো যা কিছু, আপন যা কিছু মানুষকে কেমন টানে! এই পৃথিবীর রোদ জল মাটি যতটুকু যে আধারে আমার ভাগে পড়েছে, বাসের জন্য, বিচরণের জন্য সেই অপ্রাণ পৃথিবী-প্রকৃতিরই কী ভীষণ টান! সর্বত্রই তো এই একই আকাশ, চন্দ্র সূর্য তারা বিরাজ করছে। অথচ কিছু দিন বেড়াতে গেলে বা প্রবাসে গেলে একেক সময়ে কি মনে হয় না আমার আকাশ, আমার চন্দ্রসূর্য কোথায় গেল? কিছু দিন ভাবা চলো— হ্যাঁ সেই একই চন্দ্রাতপ বটে! কিন্তু তারপরই মনটা আকুল ব্যাকুল করতে থাকে। ঈশার যেমন করে। ‘খুব পরিষ্কার ঝকঝকে তকতকে শহর মা, মাধাপুরের দিকে যে নতুন সাইবার-নগর গড়ে উঠছে, সেখানে আমরা এর পরে থাকব— সেখানে থাকলে আর ভারত বলে জায়গাটা মনে হবে না— কিন্তু আমার কলকাতার আকাশ— টালিগঞ্জের, কসবার আকাশের জন্য মন পোড়ে। মনে মনে বলি— এমন করে মন পুড়িয়ো না আকাশ, শুধু আমার চেনা চেহারাটায় মাঝে মাঝে ধরা দাও, বড্ড যেন বিরহযাতনা মা, লোকে সয় কী করে?’

ফ্রায়েড রাইস, মাটন রেজালা, দমপোক্ত, এসব থেকে থেকে খাচ্ছ, ভাল লাগছে কিন্তু বাড়ির প্রতিদিনকার ডাল-ভাত-মাছের ঝোল তোমায় থাকতে হবে নইলে অতিরসে অতিরসে বিরস নীরস হয়ে যাবে সব কিছু। কিন্তু আশ্চর্য! রঞ্জার না কোনও কান্না জাগে টালিগঞ্জের বাড়ির জন্য, না মন কেমন করে শ্রীকৃষ্ণ লেনের জন্য। যে বাড়িতে ছোটবেলা কেটেছে সেটার প্রতি আকর্ষণ ঠিক কবে হারিয়ে গেছে সে জানে না। খুব সম্ভব যবে থেকে জায়গাটা ঘিঞ্জি হতে শুরু করল, প্রতিবেশীরা বদলে গেল, নিজের একটা বাহির তৈরি হল, আর বাড়িটা চলে যেতে লাগল দাদা-বউদিদের দখলে… তখন থেকে। বউদিদের সে খুব ভালবাসত, সেটা কোনও কথা নয়, কিন্তু বড়বউদি এল, মায়ের মানে মা বাবার ঘরটা দম্পতিকে ছেড়ে দেওয়া হল। মা রইলেন তার সঙ্গে এক ঘরে। দিদির আর তার একটা ঘর ছিল। দিদির বিয়ে হয়ে যাবার পর ঘরটা তার হয়ে যায়। খুব যত্ন করে গুছিয়ে রাখত সে ঘরটা। মেজবউদির বিয়ে হল, তার ঘরটাই নবদম্পতিকে দেওয়া হল। রান্নাঘরের পাশে খাবার ঘরটায় তার আর মার জায়গা হল। তৃতীয় দাদার বিয়ে হতে হল খুব মুশকিল। সেজদা আর ছোট একটা ঘরে থাকত। রাঙাদা ছাতের ঘরটায় একা একা থাকতে পছন্দ করত। সে ঘরে আরেকজন থাকতে হয়তো পারে কোনওক্রমে। কিন্তু রাঙাদার ধ্যানধারণা, যোগব্যায়াম এসব ছিল। সে একটা বোম ফাটাল। ‘একটা বাড়িতে এতগুলো ইউনিট বাস করতে পারে না। ইউরোপীয়দের নিয়মই ভাল। আগে নিজের ঘরের ব্যবস্থা করো, তারপর বিয়ে।’ ব্যস সেজদার মুখ অন্ধকার, মা বিব্রত। ছোটর পাতলা একটা খাট পড়ল মা আর তার সেই রান্নাঘর পার্শ্ববর্তী ঘরে। বিয়ের সমস্ত অনুষ্ঠানে সেজদা ও রাঙাদা মুখ গোমড়া করে রইল। তারপর মাস তিনেকের মধ্যে রাঙাদা চাকরি নিয়ে চলে গেল ইংল্যান্ড, তার ধ্যানধারণা, যোগাসন সবসুদ্ধু। সেজদাও মুম্বইয়ে ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেল। এসব যে-সময়ের কথা তখন ফ্ল্যাটের কালচার তৈরিই হয়নি। কোথাও ভাড়া নিলে হয় গোটা বাড়ি, না হয় একটা তলা। সিঁড়ি এবং মূল ফটক একটাই। ক্বচিৎ কোথাও কোনও কোনও বুদ্ধিমান বাড়িওয়ালা তিনটে তলা বা দুটো তলা আলাদা আলাদা করতেন।

বড়দা-বড়বউদি ও মেজদা-মেজবউদির সঙ্গেই সে কাটিয়েছে বেশিদিন। তারপর তার নিজের বিয়ে হয়ে গেল। বাড়ি বিক্রির কথা উঠল। দৃশ্যটা এখনও মনে পড়ে। মায়ের চোখ ছলছল করছে, উঠে গেলেন। বড়দা পেছন-পেছন যাচ্ছে— মা তোমাকে বুঝতে হবে এত বড়, এত পুরনো বাড়ি আর আমরা মেনটেন করতে পারছি না। সব ছাড়িয়ে করতে গেলে একটা নতুন বাড়ি করার ধাক্কা। স্ট্রাকচার ছাড়া কী আছে, বলো।

মা বললেন—বুঝেছি। যা হয় কর। সুতরাং বাড়ি বিক্রি হল। বোনেরা কিছু দাবি করেনি। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ভাগ হল। রাঙাদা নেবে না, তার ভাগটা বাকি চারজনের মধ্যে পুনর্বণ্টন হয়ে গেল। সে একবার বলেছিল— ওটা মায়ের জন্য রাখলেই তো হয়, —মেজদা বলল— মায়ের তো নিজেরও ভাগ ছিল, সেটাও তো আমাদেরই দিয়ে দিল।

সেকালের মেয়েরা বড় বিষয়বুদ্ধিহীন, বোকা, অভিমানী টাইপ হত। বেদবতীও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। আমার স্বামীর শ্বশুরের ভিটে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, ভীষণ অভিমান, যা খুশি করো গে যাও তোমরা। আমার বাড়িই রইল না। তার ভাগ। নানান জায়গায় চার ভাইয়ের ফ্ল্যাট হল। মায়ের কোনও নিজস্ব আশ্রয় নেই। সব ফ্ল্যাটে মায়ের নিজস্ব একটা ঘরও নেই। বড়দার ফ্ল্যাট এই বরানগরে বলে একটু কম দামের মধ্যে চার ঘরের ফ্ল্যাট পেয়েছে। মেজর বাড়িতে গেলে রুমকির অর্থাৎ নাতনির সঙ্গে এক ঘরে থাকতে হয়। ছোটর বাড়ি গেলে ভীষণ মুশকিল। সে বালিগঞ্জ গার্ডনস্‌-এ ফ্ল্যাট কিনেছে। তিন ঘরের ফ্ল্যাট। শোবার ঘর নয়। মোট ঘরই তিনটে। একটি অর্থাৎ বৈঠকখানা। মা গেলে ছেলে টুপুকে বৈঠকখানায় থাকতে হয়। টুপু আর কত দিন বিয়ে না করে থাকবে? বিয়ে হয়ে গেলেই ও বাড়ি থেকে মায়ের পাট উঠল। সেই পৈতৃক বাড়ি শ্রীকৃষ্ণ লেনের, কবেই মন থেকে হারিয়ে গেছে। ওখানে বেশির ভাগই ছিল ভাড়াবাড়ি। যতবার ভাড়াটে বদল হত, আরও খারাপ, আরও খারাপ প্রতিবেশী আসত। ছেলে-ছোকরাদের দল প্রতিবার আরও বেশি বেশি চাঁদা চাইত। রঞ্জার একটা বিতৃষ্ণাই এসে গেছে বাড়িটার প্রতি। কে জানে মায়ের কত সুখস্মৃতি ওখানে জমা আছে, তাই শ্রীকৃষ্ণ লেনের বাড়ির প্রসঙ্গ উঠলেই এখনও মায়ের মুখে আলো ফোটে। তারপর চোখ ছলছল করে।

সক্কালবেলা ঘুম ভাঙতেই সুবীর বলল— জানো, বাবাকে স্বপ্ন দেখলুম, আমাদের টালিগঞ্জের বাড়িতে, চটি ফটফট করে দোতলায় উঠছেন। কী মানে বলো তো এর?

—কী আবার মানে? তোমার কত বয়স পর্যন্ত ও বাড়িতে কেটেছে তোমার বাবা, মনে পড়বে না?

—মনে পড়ুক না, এমনিই মনে পড়ক। স্বপ্নে কেন?

—তা তো বলতে পারব না। মনে মনে সে বলল— পিতৃপুরুষরা পূর্বমাতারা এমনি করে আমাদের অক্লান্ত অনুসরণ করে যান বোধহয়।

দাদারা কী? মা-ও দিয়ে দিলেন, ওরাও নিয়ে নিল! যদি বা নিল প্রত্যেকের একটা করে ঘর মায়ের জন্য রাখা উচিত ছিল। একটা জমা টাকা, যার সুদ মা একা ভোগ করত! বাড়ি বিক্রির টাকায় তো সবটা কুলোত না, কুলোয়ওনি, প্রত্যেককেই নিজের পকেট থেকে কিছু খরচ করতে হয়েছে। সে কথা ঠিক। তবু… তবু… তবু। আসলে মেয়েদের কোনও নিজের জায়গা নেই। না বাপের বাড়ি। না শ্বশুরবাড়ি। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে কার বাড়ি। আর স্বামী কিনলে তো সেটা স্বামীরই বাড়ি হয়। বাড়ি যাচ্ছি— বলে বটে, মনে মনেও ভাবে সে। ঠিক। সাজসজ্জা ব্যবস্থাপনা সবই তার। কিন্তু আজ যদি দুজনের ছাড়াছাড়ি হয়! তাকেই এখান থেকে চলে যেতে হবে। সুবীরকে নয়। এইটে কঠিন সত্য। যদিও এ বাড়ির প্রত্যেকটি ফার্নিচার তারই কেনা।

যা ব্বাবা, এসব সে কেন ভাবছে! এই বয়সে ছাড়াছাড়ির কথা কেন?

ভাবতে ভাবতে তার মনে হল— কোনও কারণে কোনও ঝগড়া বা কথা কাটাকাটি হলেই সুবীর কথাটা বলে— আমার বাড়ি। আমার বাড়ি! ভুলেও ‘আমাদের বাড়ি’ বলে না। ওই। কঠিন সত্য। লক্ষ লক্ষ মেয়ে ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলে আছে, কোনটা কার নিজের জায়গা— বুঝতে পারছে না। সেজমামি যে সেজমামি— সাত ভাই চম্পার এক বোন পারুল— সেই সেজমামির তো বাপের বাড়ি যাওয়াই বন্ধ হয়ে গেছে, শরিকি ভাগাভাগির ফলে। সেজমামি বলেন— ভাগাড় ভাগাড়, শকুন ঘুরছে, ওখানে কোনও মানুষ যায়! কিন্তু বাগবাজারের বাড়ি যথেষ্ট বড় হলেও নাতিদের বিয়ের পর বিধবাদের এক ঘরে ঠাঁই হয়েছে। সেজমামি আর কনেমামি। একই জিনিস ঘটে চলেছে।

কী সব উলটো-পালটা অর্থহীন কথা ভাবছে সে! মানুষ বেড়ে যাচ্ছে, প্রতি সেকেন্ডে পৃথিবী ভরে যাচ্ছে। নতুন মানুষকে তো জায়গা দিতেই হবে! পুরনো মানুষকে জায়গা ছেড়ে দিতেই হবে। এই তো সোজা হিসেব। এত দিন বেঁচেও বুড়োমাকে জায়গা ছাড়ার কষ্ট সইতে হয়নি। তিনি বাগবাজারের বাড়িতে অবিসংবাদী মাতৃতন্ত্র গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু সবাই তো বুড়োমা নন। বুড়োমার মেয়ে বেদবতী জায়গা ছাড়তে ছাড়তে এক কোণে এসে পৌঁছেছেন। তাঁর মেয়ে রঞ্জা কিছু ভাল ডিগ্রি পেয়েছিল, অনেক খাটাখাটুনি করে, তাই তার হাতে নিজস্ব বেশ কিছু টাকা আছে। সে সংসারের আধাআধি দাত্রী। আধাআধির চেয়ে বেশি তো কম নয়। তবু তার এই ফ্ল্যাটকেও কি সেভাবে নিজের বলে সে ভাবতে পারে? আর তার মেয়ে ঈশা। ইশ্‌শ্‌শ্‌ কী করল মেয়েটা! নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে… কী ভীষণ বিপন্ন তারা সবাই। কিন্তু ঈশাই বা কী করবে? তারুণ্যের ধর্ম। তারুণ্য মানুষকে নানা ভাবে বোঝায়, আশ্রয় আছে। পূর্ণ ভালবাসার আশ্রয়। কোনও দিন কেউ কাড়তে পারবে না। ভুলিয়ে, প্রতারণা করে তার ধর্ম পালন করতে প্ররোচনা দেয়। বলে না— এসব তোমার মধ্যে যে হরমোন দিয়েছি, তারই ক্রিয়া। আনন্দ করো, বিশ্বাস করো, লুটে নাও মজা, তারপর আসতে পারে কঠিন দিন। যা স্বতঃসিদ্ধ ভেবেছিলে, দেখবে তা ভঙ্গুর, পরিবর্তমান। প্রতিমার ভেতরের কাঠামোর মতো নির্লজ্জ কুৎসিত মুখ বেরিয়ে পড়বে, জীবনের।

ডক্টর রায়চৌধুরী বললেন— কী হল রঞ্জাবতী! কী এত ভাবছেন? তখন থেকে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছেন না!

ভাবছিলেন? —আশ্চর্য হয়ে যায় রঞ্জা। সে শুনতে পায়নি!

—আপনার ভাবনার কোনও কারণ নেই। মেহেরগড় থেকে এগজিবিটগুলো এলে আমরা মিউজিয়ামে পাঠিয়ে দেব। কথাবার্তা হয়ে গেছে।

—হয়ে গেছে? বাঃ বাঁচালেন। আমাদের পক্ষে দায়িত্ব নেওয়া ভীষণ রিস্কি! নিজেদের পুথি, নিজেদের মুদ্রার কালেকশন বাঁচাতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। সোজা যাবে?

—হ্যাঁ। একেবারে সোজা।

—তা হলে আমরাও নিশ্চিন্তে চন্দ্রকেতুগড় স্টাডি করার সময় পাব। ফিল্ডে ক’দিন লাগবে? —রায়চৌধুরী রঞ্জার উদ্যম দেখে ঘাবড়ে গেছেন।

—আগে থেকে কী করে বলব? চন্দ্রকেতুগড়ের জিনিসগুলোর রেপ্লিকা কত দূর? ওই নিবারণ বিশ্বাস, একরাম আলি সব এত উদ্যোগী মানুষ। হেল্প করতে এমন করে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। নিবারণবাবু— তাঁর পুরো একটা লেখা খাতা পাঠিয়ে দিয়েছেন। পড়ছি একটু একটু করে— ডায়েরি, নোটস। নিয়ে রেখেছি জিনিসগুলো।

—আরও দিন পনেরো তো লাগবেই।

—তা হলে হতে থাক। আমরা এগোই। কী বলেন?

সোসাইটির ফেলো রায়চৌধুরীর নেতৃত্বেই নতুন একটা প্রজেক্ট হচ্ছে চন্দ্রকেতুগড় নিয়ে। তত্ত্বাবধায়ক রঞ্জাবতী দত্ত। এই সব কাজে সে ভাল থাকে। রুটিন কাজ, নিত্য-নৈমিত্তিক, বড় একঘেয়ে। বলতে গেলে সোসাইটির রিসার্চ উইংটার ঘুম এঁরা দুজনেই ভাঙিয়েছেন— রায়চৌধুরী আর রঞ্জাবতী।

চন্দ্রকেতুগড়ের রুইনস কলকাতার খুব কাছে। ডালহৌসি থেকে মাত্র বিয়াল্লিশ কিলোমিটারের মতো। তবু যে ওখানে কেন এক্সক্যাভেশনের কাজ বন্ধ হয়ে আছে ভগবান জানেন। আর্কিওলজিক্যাল সেন্টারের সঙ্গে কথা বলে সন্তুষ্ট হতে পারেননি রায়চৌধুরী। যথেষ্ট লোক নেই, কাগজপত্র দেখতে হবে, কোনও টেকনিক্যাল কি লিগ্যাল অসুবিধে আছে কি না— সে সময় এখন… সেই ’৫৬ ’৫৭ সালে আশুতোষ মিউজিয়াম তেড়েফুঁড়ে কাজ করেছিল। অনেক কিছু বার হয়েছিল তখন। ব্যস। তারপর আশুতোষ মিউজিয়ামও ঘুমিয়ে গেছে, চন্দ্রকেতুগড়ও চলে যাচ্ছে বিস্মৃতির অতলে। অন্য দেশ হলে একটা টুরিস্ট স্পট হয়ে যেত।

গৌড়-পাণ্ডুয়ায় ছাত্রছাত্রী নিয়ে এরকম কাজ করেছে রঞ্জা অন্তত বছর পনেরো আগে। তারপর কত দিন গড়িয়ে গেল। নিজের ব্যক্তিগত জীবনের ঝড়-ঝঞ্ঝা নিয়ে বিব্রত ছিল, সে হিসেবে এশিয়াটিক-এর কাজটা ছিল আদর্শ। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাজ। কিন্তু তার নিজের স্বভাবের মধ্যেই ছিল সত্যিকারের কাজের জন্য সন্ধান। স্কলার সঙ্গে আছে তিনজন মাত্র। অরবিন্দ, বর্ষা আর নেহা। কিছু দিনের মতো সংসারের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। নভেম্বরের মাঝামাঝি কি ডিসেম্বরের গোড়ায় শেষ করা দরকার। কেননা তখন ঈশা আসবে। ঈশা-শায়রী। নামগুলো মনে করলেই বুকের মধ্যে কেমন একটা টান ধরে। টনটন। আরেকজনও ছিল। আজ থাকলে চাকরি টাকরি করত। রঞ্জা ভেবে নাও সে দূর-বিদেশে তাই-ই করছে। আজকাল তো কারওই ছেলেমেয়ে কাছাকাছি থাকছে না। ভাববার অনেক চেষ্টা করেও যুবক বুবুন নয়নপথে আসে না। সেই মাথা-ভরা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল বুবুন, তখনও গোঁফের রেখাটুকুও দেখা দেয়নি। কী করে তাকে যুবক বলে ভাববে!

কাজের কথা শুনে সুবীর বলল— তোমার কি দিন দিন বয়স কমে যাচ্ছে নাকি? বেশ তো ছিলে। ঘাঁটাতে যাও কেন। যত সব নাকে তেল দিয়ে ঘুমোয় ততই ভাল। শেষ কথাগুলোর উত্তর হয় না, রঞ্জা বলল— আমি তো আর মাটি খুঁড়তে নামছি না। ইন ফ্যাক্ট এক্সক্যাভেশনের কাজই নয়।

কী কাজটার প্রকৃতি, জানবার জন্য সুবীরের কোনও উৎসাহ দেখা গেল না। রঞ্জা দু-তিন মাস ব্যস্ত থাকবে, বাড়ির দিকে মন দিতে পারবে না— এটাই তার মাথাব্যথা।

বলল—হ্যাঁ তারপর অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার নাভিশ্বাস। ছোটাছুটি তো খুব! হাসনাবাদের কাছে না জায়গাটা?

—দেগঙ্গা। প্রতিদিন যাওয়া আসা করা যাবে না। মাঝেমধ্যে থাকতে হতে পারে। সেসব ব্যবস্থা ডক্টর রায়চৌধুরী করবেন।

—সর্বনাশ। উনিও থাকবেন নাকি?

—থাকতে পারেন। কিন্তু সর্বনাশ কেন?

—সর্বনাশ মানে সর্বনাশ এই আর কী!

—এই বয়সে এসব ছেঁদো জেলাসি আর মানায় না সুবীর। উনি মানী লোক।

—এই বয়সেও তোমার যা জোশ, মানীগুণী ওসবে কিছু হয় না। আমি মাঝখান থেকে বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।

—বাজে কথা বোলো না। কোথায় আবার বুড়ো!

—আবার একটা বিয়ে করা যায় বলছ!

রঞ্জা এবার আর্ম-চেয়ারে বসা খবরের কাগজ পাঠরত সুবীরের দিকে অপাঙ্গে তাকাল। দর্শনের অধ্যাপক, অবসর নিয়েছে একটু আগে। এখনও এসব কথা মনে আসে? একবার অনেক কষ্টে ফিরিয়ে এনেছে। আবারও সেসব ভয় আছে নাকি? আগে-আগে অবসর নিল যে বইটা লিখবে বলে সেটা তো কই এগোচ্ছে না! সে আজকাল জিজ্ঞেস করা ছেড়ে দিয়েছে।

সুবীর অবশ্য তার স্খলন-পতনের কথা অম্লানবদনে অস্বীকার করে যায়। সে সাধুসন্ত লোক। রত্ন-অধ্যায় তাদের জীবনে বন্ধ অধ্যায়। নামটা উচ্চারণ করলেও খেপে যায় এখন। সবটাই নাকি রঞ্জার ঈর্ষার কল্পনা।

দাদা-দিদি-মা সবাইকার অমতে এই বিয়ে। দাদাদের কাছে ওকে প্লেবয়-প্লেবয় লাগত। এত খামখেয়ালি, রেলওয়েজ-এ কাজ পেয়েছিল, কত উন্নতির আশা, দুম করে ছেড়ে দিয়ে অধ্যাপনায় চলে এল। টাকার তফাত আকাশ-পাতাল। তবু। মানটা যে বেশি! রঞ্জা স্কলার হিসেবে যে সুনাম, কদর পাচ্ছে, তাকেও সেটাই পেতে হবে। সবাই বলত— এর দায়িত্বজ্ঞান বলে কিছু নেই রঞ্জা। কষ্ট পাবি। কথাটা ঠিক রঞ্জা জানত। কিন্তু ভালবাসার আগুন যে দুঃসহ। দায়িত্বজ্ঞান? তার অভাব পুষিয়ে দিতে সে তো রয়েছে। শতকরা শতভাগ দায়বদ্ধতা।

তখন তার মধ্য-ত্রিশ। কয়েকটা হিষ্ট্রি-কংগ্রেসে পরপর তার পেপার খুব সুনাম পাওয়ায় পণ্ডিতদের মনেযোগের কেন্দ্রে চলে এসেছে সে। বিদেশে ভাল ভাল অফার পাচ্ছে। সেগুলো নেওয়ার অবশ্য প্রশ্নই ওঠে না। যদিও সুবীর সে কথা মানতে নারাজ। তার চিরকালের ধারণা রঞ্জা ভীষণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী। সংসার, স্বামী, ছেলে-মেয়ে এসবের চেয়ে কেরিয়ার তার কাছে অনেক বড়। চারদিকে এর উলটো প্রমাণ ছড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও মাঝে-মাঝেই তুমুল কাণ্ড করত।

সুবীর তখন প্রচুর কোচিংও করত। রত্না নামে ছাত্রীটির ওপর তার দুর্বলতা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে ঠিকই বুঝেছিল রঞ্জা। সে ফিরছে। নিঝুম সন্ধ্যায়। ছেলেমেয়ে ওপরে। চাবি দিয়ে দরজা খুলে সে ঢুকে যাচ্ছে, বাইরের ঘরে পড়াচ্ছে সুবীর, রত্না তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। দিনের পর দিন। রত্নাকে তার বিষ লাগতে থাকল। কিন্তু শুধুই রত্নাকে। সুবীর তখনও তার খুব আপনজন। তারপর চোখে পড়ল, সুবীরের যেন কী হয়েছে, উড়ু-উড়ু অস্থির-অস্থির ভাব। কিছুতে যেন মন নেই।

—মায়ের ওষুধটা এনেছ?

—কোনটা?

—ওই যে প্রেশারের!

—নাঃ ভুলে গেছি। তুমি কাল ফেরবার পথে নিয়ে এসো না।

—বাঃ। বাড়িতে ফোন। প্রোফেসর সুবীর দত্ত আছেন?

—না তো। কলেজ গেছেন।

—কলেজ থেকেই ফোন করছি। তিন দিন হল আসছেন না।

কামাই করল, অথচ কোথায় গেল তার হিসেব পাওয়া গেল না। সে নাকি টেক্সট বুক লিখছে, বি.এ-র। তাই লাইব্রেরি গিয়েছিল। ন্যাশনাল।

—তোমার কী হয়েছে সুবীর?

—আমার? কী হবে? কেন?

—না, তোমাকে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে কিছু দিন।

—কল্পনা করো। সে ক্ষমতাটা তো তোমার ভালই আছে। হিস্টরিক্যাল ইম্যাজিনেশন। কোথায় যেন যাচ্ছ? কলাম্বিয়া?

—আমি কলাম্বিয়া নামিবিয়া কোথাও যাচ্ছি না, আমার ছেলে-মেয়ে-স্বামী শ্বশুর শাশুড়ি ফেলে। সে গুড়ে বালি।

—মানে?

—আমি গেলে তোমার খুব সুবিধে হয় মনে হচ্ছে! কল্পনা করতেও কিছু কারণ লাগে। ইতিহাসেও লাগে।

—বাজে কথা বোলো না।

—ছাত্রী পড়ানো তুমি ছেড়ে দাও সুবীর, ইটস মাই ডিমান্ড।

—মানে? অতগুলো টাকা!

—ছাত্ররাও সেই একই টাকা দেবে।

—আমি যদি বাইরে পড়াই তুমি টের পাবে? —বিরক্ত হয়ে বলল সুবীর। চোখ কিন্তু অন্য দিকে।

—দেখব না শুনব না। তুমি মিথ্যে বলবে, কিন্তু টের ঠিকই পাব। যেটাকে তুমি কল্পনা বলছ সেটা আসলে ইনটুইশন। অনেক কষ্ট করে, অনেকের আপত্তি অগ্রাহ্য করে বিয়ে করেছি সুবীর। আমার দুটো ছেলেমেয়ে আছে, কিছু ভাঙতে আমি দেব না।

চোখ ভরে আসছে, প্রাণপণে তাকে আটকে লড়ে যাচ্ছে রঞ্জা, ডিগনিটির লড়াই।

—আশ্চর্য! ভাঙা-টাঙা। তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?

—যেতে পারি, তুমি যদি অন্যায় করো।

তারপরই হল রঞ্জার জীবনের প্রথম ভয়ানক অসুখ। নার্ভাস ব্রেক-ডাউন। সে বেরোতে পারে না, কিছু করতে পারে না, পাগলিনির মতো চোখে চেয়ে থাকে, কিংবা চোখ বুজে এমন ভাবে শুয়ে থাকে যেন বা মৃত মানুষ। কারও দিকে তাকায় না, খায় না, খেলে বমি হয়ে যায়।

কেউ জানে না। একমাত্র ডাক্তার জানেন। অর্ধোন্মাদের মতো প্রলাপ বকেছে সে তাঁরই কাছে। বর্ষার ছাতে গিয়ে শ্যাওলার ওপর শুয়ে থাকে সে। যেন জলের জীব জলের কাছে জলজ উদ্ভিদের কাছে আশ্রয় খুঁজছে। মাটির তলায়, সেখানে বিশ্বাসঘাতকের হাত, হতাশার হাত পোঁছোয় না।

ডাক্তার শেষ পর্যন্ত বললেন, কী করছেন মা! আপনি এত হৃদয়হীন! এত নির্বোধ। এত বড় জীবন, স্বামী তার কতটুকু! ছেলেমেয়ে! তাদের দিকে চেয়ে দেখুন। জীবনের ওপর আপনার মুঠি আলগা হলে ওরা যে ভেসে যাবে, ভেসে যাচ্ছে।

শ্বশুর শাশুড়ি, যাঁরা বলতেন রঞ্জা তিনটে ব্যাটাছেলের ক্ষমতা রাখে, তাঁরা অবস্থা দেখে হতভম্ব।

—সবই যে বমি হয়ে যাচ্ছে ডাক্তার। আলসার, না কী?

—নাঃ। এসব সাইকো-সোম্যাটিক।

—সাইকো … সো… ম্যাটিক। বিমূঢ় শ্বশুর জিজ্ঞেস করছেন ডাক্তারকে।

—তার মানে মনের মধ্যে কোনও গণ্ডগোল, কোনও কষ্ট? দুশ্চিন্তা! কেন? কী? ডাক্তার চুপ।

বাবা ডেকে পাঠালেন ছেলেকে— সুবীর! বউমার সাইকো-সোম্যাটিক হয় কেন!

—রোগভোগের কারণ আমি কী করে জানব বাবা! সুবীরের মুখ শুকিয়ে গেছে। কাঠগড়ায় আসামির মতো লাগছে।

—আমি জানি না বউমা কীসে এত কষ্ট পেল যে খেতে পারছে না, শুতে পারছে না। কিন্তু সে তোমার স্ত্রী— তোমার জানা উচিত। যাও, জেনে নাও।

শাশুড়ি বললেন— রঞ্জা অকেজো হয়ে রয়েছে। আমার সংসারও অচল। ছেলেমেয়ে দুটো এলের দড়ি বেলের দড়ি হয়ে ঘুরছে। রঞ্জা, আমরা সবাই তোমার মুখ চেয়ে আছি মা, তুমি ওঠো।

রঞ্জা বলল— আমার দিকে আর চাইবেন না মা— আমি চাইবার অযোগ্য। আমার কিছু নেই। অস্তিত্বই নেই। যেটাকে রঞ্জা বলে ভাবছেন, সেটা একটা শূন্য ফাঁকা জায়গা।

—সে আবার কী!

—ওরকম হয় মা! কোনও কোনও মানুষ আছে যখন আছে, শত-সহস্র হয়ে আছে। যখন নেই, তখন এক কড়াও নেই।

—আমি তোমার কথা একবর্ণও বুঝতে পারছি না মা। আমি খাইয়ে দিচ্ছি, দুধ-ভাত তুমি ভালবাসো। চামচে করে একটুখানি খেয়ে নাও মা!

সেবার শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গ, সেবা, ছেলেমেয়ের নিষ্পাপ করুণ মুখ তাকে টেনে তুলেছিল।

সুবীরের ভূমিকা ছিল এত নিস্তেজ যে ভাবলেও করুণা হয়।

—কী হল রঞ্জা! তুমি এরকম করছ কেন?

—কী জানি! রোগী কি জানে তার রোগের মূল কোথায়! শুধু জানি আমি ডুবে যাচ্ছি। জলে খাবি খাচ্ছি এখন, সাঁতার জানি না।

—শোনো, একটা কথা জেনে রাখো আমার জীবনে কোনও, মানে আর কেউ নেই। তুমি সাধারণ হাসি-ঠাট্টা, ভুল বুঝেছ।

—কী জানি সুবীর আমার মনে হচ্ছে আমি কোনও স্ট্যাচুর তলায় বসে আছি, সন্ধে হয়ে আসছে। তুমি আমায় ফেলে চলে গেছ। কেউ আর কোথাও নেই। পেছনে মস্তানি দুয়ো; দুয়ো দিচ্ছে সমস্ত সংসার, পৃথিবী।

তিন চার মাস লেগে গেল সুস্থ হতে। শেষের দিকটা মা এসে ছিলেন কিছু দিন। তাঁকে প্রথমে কিছুই জানানো হয়নি। ছিলেন বড়মেয়ের কাছে। সুবীর যতবার বলেছে— মাকে ডাকি, মা আসুন, ততবার রঞ্জা বলেছে— ডিসিশন নেবার সময়ে মাকে ডাকিনি সুবীর, আজ কর্মফল ভোগার ভাগ একা আমার। মাকে আর কষ্ট পেতে দেব না।

সুবীরের মুখ ক্রমশ ভয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। এ কোন রঞ্জা? চকচকে চোখ বিষাদে স্তিমিত। আদর করতে গেলে ছিটকে সরে যায়। ভুলেও তার দিকে তাকায় না। সমানে ওষুধ খেয়ে যাচ্ছে। একদিন আচ্ছন্ন চোখ আধখানা খুলে স্বপ্ন দেখল সামনে মা দাঁড়িয়ে। শুকনো জুঁইফুলের মতো মুখটি। চুলগুলো গুছিয়ে বাঁধা, সরু কালো পাড় শাড়ি, হাতে একগাছি করে চুড়ি, গলায় সরু হার। ছোট ছোট কুঁচি গলার চামড়ায়। পৃথিবীর সুন্দরতম মূর্তি। মায়ের পাশে এসে দাঁড়াল আরও দুটি শুকনো প্রাণহীন মুখ। ঈশা। বুবুন। ছেলেটা ভয়ে দুঃখে দিদির পেছনে লুকিয়ে আছে। আবছা চোখে রঞ্জা সর্বমঙ্গলাকে খুঁজতে লাগল, তাঁর মা, তাঁর মা? মাতৃমূর্তির পরম্পরা নেই? ঝাঁকি দিয়ে জ্ঞানে ফিরে এল রঞ্জা। স্বপ্ন নয়, সত্যি। সত্যি মা। তারপর সে একখানা কান্না কাঁদল বটে। মাকে আকুল হয়ে ডেকে কান্না, কান্না, কান্না! মা হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন মাথায়, কিছু বলছেন না। মা বুঝতে পেরেছেন— এই কান্নাটা কাঁদা তার বড্ড জরুরি ছিল।

মা কোনও দিন জানতে চায়নি এ কান্না কেন! কীসের কষ্ট, মা অনুভবে জানেন এমন অনেক কষ্ট আছে যা মাকে বলতেও মুখ বুজে যায়। কিন্তু মাতৃস্পর্শ সেই কষ্টকে শমিত করে।

মায়ের পাশটিতে শুয়ে কী শান্তি। মায়ের পাশে শুয়ে জীবন আরম্ভ। আবার মাঝপর্বে আর কাউকে পাশে চাওয়া। রঞ্জা সেই চাওয়ার অবিমৃশ্যকারিতা, তুচ্ছতা বুঝতে পারত রোজ। সে মাঝখানে, এক দিকে মা, অন্য দিকে বুবুন, আর মাথার কাছে গুটিসুটি মেরে ঈশা। এই তার চারপাশে জাদুগণ্ডি। তার একান্ত নিজস্ব জগৎ। সেখানে সুবীর নেই। সুবীরের প্রতি সেই আঠালো প্রেমের হাত থেকে সে মুক্তি পেয়েছে।

কী ভয়ানক সেই রবার দিয়ে জীবন থেকে কাউকে মুছে দেবার শান্তি। তারপর আরও ভয়ানক বাকি ছিল। প্রেম ফুরিয়েও ফুরোয় না। ডাক্তারকে না দেখলে সে থাকতে পারে না। তার জাদুগণ্ডির বাইরে থেকে জিয়নকাঠি ছুঁইয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ডাক্তার। মিলিটারি কর্নেল, শান্ত, সৌম্য, ওঁদের রিটায়ারমেন্ট তাড়াতাড়ি, ফিরে এসে প্র্যাকটিস করছেন। যখনই ডাকো উনি আছেন, চোখে বরাভয়— দেখলেই অর্ধেক রোগ সেরে যায়। কী প্রিয় যে হয়ে উঠল সে মুখ তার কাছে! তখন যদি তার পঁয়ত্রিশ হয় তো ডাক্তার পঞ্চান্ন। তাঁকেই তার অবজ্ঞাত প্রেম উৎসর্গ করল রঞ্জা।

—ডক্টর রায়, প্লিজ কাল চেম্বারে যাবার আগে একবারটি দেখে যাবেন।

—কোনও প্রবলেম হয়েছে?

—আসুনই না একবার— গলায় করুণ আর্তি।

এসেছেন। ব্লাড প্রেশার চেক করলেন, কী কী খেয়েছে জিজ্ঞেস করলেন, নাড়ি দেখলেন। স্পর্শে যেন নতুন প্রাণ, দর্শনে জিজীবিষা।

সেই পঁয়ত্রিশ বছরে রঞ্জা জীবনে সবচেয়ে সুন্দর, সুঠাম, লাবণ্যময়ী ছিল। সবচেয়ে। অথচ তখনই তাকে ছেড়ে গেল প্রেম। এতদিনের তুমুল, সযত্নে লালন করা প্রেম। ডক্টর রায় নাড়ি দেখছেন— তার শিরায় শিরায় স্বর্গসুখ ছড়িয়ে যাচ্ছে। কী অদ্ভুত যে সে প্রেমের স্বরূপ! সব সময়ে ওঁকে চাই না। খালি দিনে একবার এসে বসবেন। বি.পি. মাপবেন। দুটো কথা বলবেন— আজ কেমন আছেন মা— বাস। মা এবং আপনি। কিছুই এসে যায় না তাতে। লোকে বলে প্লেটনিক লাভ বলে কিছু নেই। কিন্তু সে জানে, নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে জানে, আছে আছে সব আছে। শরীরপ্রধান প্রেম, যা তার আর সুবীরের, শরীর-বুদ্ধির যৌথ কারবার, যা তার আর সুবীরের, শরীরের ভূমিকা যেখানে অতি অতি নগণ্য, হৃদয়ের ভূমিকা বিশাল— সেই প্রেম তার আর ডক্টর রায়ের। ভুল বলা হল। ডক্টর রায় জানতেনই না। তিনি শুধু এক রোগিণীর একান্ত নির্ভর, আকুলতা দেখেছিলেন। মনের রোগীদের এরকমই হয়।

সুবীরও বলছে— ডঃ রায়, আপনার ওপর ইনজাস্টিস হচ্ছে জানি, তবু যদি রোজ একবার…।

তার মাথায়ও আসেনি প্রৌঢ় ডক্টর রায়ের প্রতি তার স্ত্রীর কী মনোভাব হতে পারে।

—আমি চেষ্টা করব।

আসতেন। কোনও না কোনও সময়ে একবার। এবং সেই ভিজিটগুলো নিতেন না কিছুতেই। মায়ার চোখে, ভরসার চোখে তাকাতেন। সে মনে মনে বলত— এ ভাবে চাইবেন না ডাক্তার। এতখানি জীবন পেরিয়ে এসে তবে আমি বুঝেছি প্রেম কী, আর প্রেম কী নয়। কোনটা প্রকৃতির দান, আর কোনটা প্রকৃতিকে মানুষের ছাড়িয়ে যাওয়া।

একদিন উনি বললেন—আপনার কিন্তু স্বাধীন হবার সময় হয়েছে মা। প্রতিদিন বি.পি. দেখার আর দরকার নেই। ফিক্সেশন ভাল নয়।

উনি কি বুঝে বলেছিলেন? না, না বুঝে!

সেই থেকে সুবীরের ঈর্ষাকাতর হবার পালা। কেন সেটা সে বোঝে। সুবীরের প্রতি তার আর সেই উদ্দামতা নেই যে! বাইশ থেকে পঁয়ত্রিশ। দীর্ঘ তেরো বছর শ্বশুর শাশুড়ির প্রাথমিক অসন্তোষ জয় করবার জন্য, পরপর বাচ্চা হয়েছে, তাদের দেখভাল, এবং কর্মজীবনের সঙ্গে তাল মেলাতে প্রাণপণ খেটেছে, সুদৃঢ় ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছে ছন্নছাড়া এই দত্ত পরিবার। সে যেমন নিজের সেক্রেটারি। তেমন সুবীরেরও। আনন্দ পেয়েছে জয় করতে পেরে, নিজেকে অকাতরে বিলিয়েছে সুবীরের আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের। সেই সুবীর অন্যের প্রতি আসক্ত হল? কখন? যখন তার প্রথম যৌবনের শীর্ণতা, অসম্পূর্ণতা আর নেই, ত্বকে ঔজ্জ্বল্য, চুলে ঢল, কণ্ঠে মধু, খেলোয়াড় রঞ্জার সাহস ও ব্যক্তিত্ব, প্রেমিকা ও মায়ের মাধুর্য, সফল কর্মীর আত্মবিশ্বাস ও স্বাভাবিক ভদ্রতাবোধের সংযোগে সে যখন সকলের চোখের মণি। তখন!

এখন তার মনে হয় সুবীর কোনও দিনই তাকে সেভাবে ভালবাসেনি। ওটা প্রথম যৌবনের কারিকুরি। সন্দেহ হয় পুরুষরা আদৌ সেভাবে ভালবাসতে পারে কি না! বোধহয় পারে না। সে ডেপ্‌থ্‌ নেই তাদের। লক্ষে একজন দুজন যদি-বা পারে তারা হয়তো আবার উলটোপালটা সঙ্গিনী পায়। কোটিতে একটি দম্পতি যদি সত্যিকার বস্তুটার সন্ধান পায় তো তারা জানে সে শরীর মন বুদ্ধি হৃদয়বৃত্তির কী অপূর্ব রসায়ন! তারই উদ্দেশে সারাজীবন চেয়ে থাকা। সুবীর মত্ত হয়েছিল মাত্র, বিয়ে দিয়ে সেটাকে আমরণ করে ফেলতে সুবীরের দ্বিধা ছিল। কথায় কথায় সে বলত, আমার বাবা-মায়ের কিন্তু আমি শেষ বয়সের সন্তান। দিদি দাদা অনেক বড়। দাদা ল্যভ ম্যারেজ করেছে। সে প্রায় শ্বশুরবাড়িতেই থাকে। আমি নিজে বিয়ে করতে চাইছি শুনলে আবার কী সব রি-অ্যাকশন হয় কে জানে! ভাবতেও ভয় পাচ্ছি।

রঞ্জা বোঝেনি এগুলো তাকে প্রস্তুত করা নয়। সূক্ষ্ম একটা দ্বিধার কথা জানানো। সে তা বোঝেনি। বুঝলেও কিছু করার ছিল না। সে তো আপাদমস্তক মগ্ন। সবাইকে রাগিয়ে কাঁদিয়ে রেজিস্ট্রি করা, ছ’মাসের মতো সব চাপাচুপি দিয়ে রাখা, তারপর বিনম্র ঘোষণা, হতভম্বীকরণ, দুজনেরই চাকরি পাকা, দুই পক্ষই গোমড়া, তারপর উপল-ব্যথিত-গতিতে সংসার যাত্রা শুরু হল।

গড়পড়তা পুরুষের নাকি এক নারীতে ক্লান্তি আসে। মেয়েদেরই কি আসে না? সমাজ বহুযুগ ধরে পুরুষকে ছাড়পত্র দিয়ে রেখেছে। সেভাবেই শিক্ষিত করেছে। রাজ-রাজড়া থেকে বস্তিবাসী পর্যন্ত। মেয়েদের সংসার ধরে রাখতে হবে। শিশু পালন করতে হবে। তাদের সংস্কার যাতে একমনস্ক হয় তার জন্য সমাজ কম শাস্তর লেখেনি। নিন্দা-মন্দ, কুৎসিত অপবাদ, চারদিকে গণ্ডিটানা, বিধিনিষেধ,—এবং সতীত্বের মহিমা কীর্তন, সতীদাহ, সতীপূজা, সতীমায়ের মেলা এবং সর্বশেষ চালাকি, দেবীপূজা। তুমি দেবীর অংশ, তোমাকে মর্ত্য মানুষের দুর্বলতা মানায় না।

কী উপকরণ বাহুল্য দেবী পূজার! অথচ জীবনে সেই দেবীদের প্রতিনিধিদের উপকরণ শাঁখা-সিঁদুর আর হাজার এটা কোরো না ওটা কোরো না। চরম অপমান, অবজ্ঞা, দুর্গতি। দিদিমা সর্বমঙ্গলা নাকি জীবনে কখনও একটা গোটা মাছের টুকরো খাননি। এত লোক, লোকের পর লোক, যখন খেতে বসলেন তখন হয়তো আরেকজন অসময়ে এসে গেছে। একাদশী, সধবাকে সেদিন অন্তত মাছ খেতেই হয়। তাই আধখানা অতিথির পাতে গেল।

মানুষ তুমি বড্ড বেশি স্ববিরোধিতা করছ। প্রতি মুহূর্তে দুরকম বিধান চালাচ্ছ। এ হয় না। এর ফল ভবিষ্যতে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। একদিন মেয়েরা হাতে ক্ষমতা পাবে, সংরক্ষণ দাও না দাও, শুধুমাত্র ক্ষমতা বুদ্ধি ও মোহিনী শক্তির ত্রিগুণে সমস্ত জয় করে নেবে। তুমি আজ যেখানে আছ পুরুষ, সেখানে নারী বসবে, সে সব সময়ে স্নেহময়ী ক্ষমাশীলা মা হবে না, নির্ভরশীল সহনশীল নিরুপায় স্ত্রী হবে না বা আদেশপালনকারী দাসী, তখন একই ক্ষমতা হাতে পেয়ে তারা যদি একইরকম অত্যাচারী, স্বেচ্ছাচারী হয়ে যায়? যাবার পুরো সম্ভাবনা, কেননা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় তারা দেখেছে ক্ষমতায় থাকার কৃৎ-কৌশল এইরকমই। বেশি কথা কী, পৃথিবীর যেখানে যেখানে নারী শাসকের ভূমিকায় এসেছে— এই স্বেচ্ছাচারিতার ইতিহাসই ফিরে ফিরে এসেছে। নারী বলেই মাতৃশক্তির শাসন কোথায় প্রতিষ্ঠিত হল? ক্ষমতার মডেল পুরোপুরি পুরুষের মডেল, তাকেই অনুসরণ করে রানি প্রথম এলিজাবেথ, ক্যাথারিন দ্যা গ্রেট, তাকেই অনুসরণ করে— ইন্দিরা গাঁধী, বেনজির ভুট্টো, জয়ললিতা, মায়াবতী, ব্যতিক্রম নেই। বড় কষ্ট হয় ভাবতে, দেওয়ার ক্ষমতা, বদলাবার ক্ষমতা ভেতরে থাকলেও মেয়েরাও তা ব্যবহার করেন না, পুরুষের কুটিলতা, চক্রান্ত ও অফুরান ক্ষমতা লিপ্সার অস্ত্র হাতে তুলে নেন। বিকল্প কিছু কেন নেই? কেন হয় না?

—শোনো এক কাজ করো। চন্দ্রকেতুগড়ের কাজটা খুব ইন্টারেস্টিং। তুমিও চলো না। যেদিন যেদিন আমায় থাকতে হবে, তুমিও থাকবে। ইচ্ছে হলে সাইটে যাবে, ইচ্ছে হলে ঘরে বসে লিখবে— লেখার কথাটা অনেক দিন পর উচ্চারণ করল রঞ্জা।

—কেন? তোমার ওপর নজর রাখতে?

—যা বলো।

—দুর, ঠাট্টাও বোঝে না! এক পঞ্চাশোত্তরের ওপর আর এক পঞ্চাশোত্তর নজর রাখবে! হাসালে। —সুবীর হাসল।

সুবীর খুব ভাল করে জানে তার ঈর্ষাটা অহৈতুকী। রঞ্জা আপাদমস্তক আন্তরিকভাবে একমুখী। জীবনে কোনও দিন মিথ্যেও বলেনি। অপর পক্ষে সুবীর তার সিগারেটের সংখ্যা, কোচিং-এর ছাত্রসংখ্যা, কোথাও কারও সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল এই সব সামান্য ব্যাপারেও মিথ্যে বলে। রঞ্জা বলে— এই বিপজ্জনক অভ্যাস ছেড়ে দাও। এত ছোটখাটো ব্যাপারে মিথ্যে বললে তোমার সত্য মিথ্যে যে আমার কাছে গুলিয়ে যাবে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *