রজনীবাবু ভাল আছেন

রজনীবাবু ভাল আছেন

প্রথম ঘটনাটা ঘটল অফিসে। সুখময় সামন্তর খাস বেয়ারা ক্ষিতীশ এসে রজনীবাবুকে বলল, স্যার আপনাকে ডাকছেন।

ক্ষিতীশের মুখে মিচকি মিচকি হাসি। যেন স্যারের ডাকাটা খুব মজার কোনও ঘটনা। তিনি ঘরে ডেকে জিজ্ঞেস করবেন, কী খাবেন ভাই? ঠান্ডা না গরম? যদি কিছু মনে না করেন, তা হলে দুটোই দিতে বলি। প্রথমে ঠান্ডা খেয়ে নিন। খানিক বাদে না হয় গরমটা খাবেন। সঙ্গে নোনতা বিস্কুট দিতে বলব? নাকি মিষ্টি ধরনের কিছু খাবেন? না না ভাই, ও-কথা বললে চলবে না। আমার ঘরে এসেছেন, একটা কিছু মুখে দিতেই হবে। আমি কিছুতেই শুনব না।

আসল ঘটনা কিন্তু একেবারে উলটো।

এই অফিসে ক্ষিতীশ হচ্ছে সবচেয়ে গম্ভীর স্বভাবের বেয়ারা। সবসময় মুখটা এমন করে থাকে যে, দেখলে মনে হয়, সে অফিসে কাজ করতে আসেনি। এসেছে অঙ্কের ক্লাস নিতে। পাঁচটা কথা জিজ্ঞেস করলে একটারও উত্তর দেয় না। উলটে তিন নম্বর প্রশ্নের পর থেকে এমন কড়া চোখে তাকায় যে, ভয় করে।

সেই ক্ষিতীশ মুচকি মুচকি হাসে একবারই। যখন সুখময় সামন্ত কোনও কর্মচারীকে বকুনি দেওয়ার জন্য নিজের ঘরে ডেকে পাঠান। তার এই ফাজিল হাসি দেখলেই বুক হিম হয়ে যায়। এই হাসি হল ঝড়ের পূর্বাভাসের মতো, বকুনির পূর্বাভাস।

ক্ষিতীশকে আড়ালে ডেকে এ-ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছে।

বকাঝকা দেওয়ার জন্য বড়সাহেব যখন আমাদের ঘরে ডেকে পাঠান, তুমি হাসো কেন?

ক্ষিতীশ রাগরাগ মুখ করে জবাব দিয়েছে, অত জানি না, হাসি পায় তাই হাসি।

এই উত্তর শুনে অফিসের অনেকেরই ইচ্ছে করেছে, লোকটার গালে দুটো চড় লাগাই। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। গত মাসে অন্য জায়গা থেকে বদলি হয়ে সুখময় সামন্ত এই অফিসের সর্বেসর্বা হয়ে এসেছেন। তিনি যেখানে বদলি হয়ে যান, সেখানে সঙ্গে করে ক্ষিতীশকেও নিয়ে যান। ফলে ক্ষিতীশের খুবই খাতির। সারাদিন সুখময় সামন্তর ঘরের বাইরে টুলে বসে ঝিমোয়। শুধু বকুনির জন্য কোনও কর্মচারীর ডাক পড়লেই মহা উৎসাহে চোখ কচলে উঠে পড়ে। তার চেয়ারের সামনে গিয়ে মুচকি হেসে বলে, স্যার আপনাকে ডাকছেন।

এরকম লোককে চড় লাগানো কঠিন কাজ।

ক্ষিতীশের হাসি দেখে রজনীবাবুর বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। তিনি তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। ওরে বাবা, আবার কী ঘটল? ইতিমধ্যেই এই সপ্তাহে তিনি দু’-দু’বার ধমক খাওয়ার ডাক পেয়ে গেছেন। এটা নিয়ে হ্যাটট্রিক হতে চলেছে। ফুটবল খেলায় হ্যাটট্রিক জিনিসটা ভাল। হাততালি পাওয়া যায়। বকুনিতে হ্যাটট্রিক খুব খারাপ ব্যাপার। তা ছাড়া আজ মনে হচ্ছে, গোলমাল বড় ধরনের হয়েছে। ক্ষিতীশের হাসিতে মিচকে ভাবটা একটু বেশি ছিল যেন।

ঢাকনা সরিয়ে ঢকঢক করে পুরো এক গেলাস জল খেয়ে ফেললেন রজনীবাবু। হাতটা কি একটু কাঁপছে? হ্যাঁ, কাঁপছে। একটু নয়, বেশ জোরে জোরে কাঁপছে। টেবিলের উপর যত ফাইল কাগজপত্র ছড়িয়েছিটিয়ে ছিল, সবই কাঁপা হাতে তুলে নিলেন। সুখময় সামন্তর মতো কড়া বস তিনি তাঁর দীর্ঘ চাকরি জীবনে কখনও দেখেননি। রোগা মানুষদের কোট-প্যান্ট পরলে এমনিতেই কেমন রাগীরাগী দেখায়। এই মানুষটার ভুরুদুটো ঘন আর সবসময় কোঁচকানো। এতে রাগ ভাগটা আরও বেশি হয়। শুধু অফিসে নয়, অফিসের বাইরেও ঝামেলা। কর্মীদের কাউকে হাতের কাছে পেলেই হল। যে-কোনও সময় যে-কোনও প্রশ্ন করে বসেন। এই তো কিছুদিন আগে তালুকদার তার এক শ্যালকের বিয়েতে গিয়ে দ্যাখে, বরযাত্রীদের সঙ্গে সুখময় সামন্তও বসে আছেন। বসে বসে পা দোলাচ্ছেন। তাঁকে দেখেই তালুকদার পালাতে গেল। ধরাও পড়ে গেল।

এই যে, যাচ্ছেন কোথায়? এদিকে শুনুন।

তালুকদার কাঁচুমাচু মুখে ফিরে এল। বলল, স্যার, আমায় কিছু বলছেন?

হ্যাঁ, বলছি। আপনি আমাদের অফিসে অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে আছেন না?

হ্যাঁ, স্যার। আছি স্যার।

ভেরি গুড। গত বছরের অডিট রিপোর্টটা একটু বলুন তো। পুরোটা বলবেন, বাদ দেবেন না কিছু। দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আমার পাশে বসে বলুন।

পাক্কা দেড় ঘণ্টা ধরে পুরো রিপোর্ট বলার পর তালুকদারের কী অবস্থা হয়েছিল তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে। খেতে বসে আর মুখে তুলতে পারল না কিছুই। খাবার নেড়েচেড়ে উঠে পড়তে হল। না-খেয়েই প্রচণ্ড বদহজম। ঢেকুরের পর ঢেকুর। লেবুর শরবত খেয়ে বাড়ি ফিরতে হল কোনওরকমে।

এই মানুষকে কোনও বিশ্বাস নেই।

রজনীবাবু টাইপরাইটারের মাথা থেকে আদ্দেক টাইপ করা কাগজটাও টেনে নিলেন। এটাও সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া ভাল। যদিও টাইপের ব্যাপারে রজনীবাবুর একটা সমস্যা আছে। অফিসের সব কর্মীর টেবিলেই এখন কম্পিউটার। যাবতীয় কাজকর্ম হচ্ছে কি-বোর্ড টিপে আর মাউস চালিয়ে। বাদ শুধু রজনীবাবু। অনেক চেষ্টাতেও রজনীবাবু কম্পিউটার জিনিসটা সামলাতে পারেননি। যত না পারেননি, তার চেয়ে বেশি ভয় পেয়েছেন। তিনি পারছেন না দেখে সহকর্মীরা যদি হাসিঠাট্টা করে? এই বুড়ো বয়সে সেটা বড় লজ্জার হবে। এই কারণেই তিনি এগোননি বিশেষ। ধরেই নিয়েছেন, এ তাঁর কম্ম নয়। কম্পিউটার হল অতি জটিল একটা ব্যাপার। এই জটিল ব্যাপারকে অতি সহজে নিজের আয়ত্তে আনার জন্য বুকে যথেষ্ট বল লাগে। পঞ্চান্ন বছর বয়সে নতুন করে বুকে সেই বল আনা সম্ভব নয়।

অন্যদের ক্ষেত্রে কড়া মনোভাব দেখালেও, রিটায়ারমেন্টের খুব বেশি দিন বাকি নেই বলে অফিস এ-ব্যাপারে রজনীবাবুর উপর এতদিন তেমন চাপ দেয়নি। তাঁর টেবিলে এখনও পুরনো টাইপরাইটার মেশিন রেখে দেওয়া আছে। তবে এই মেশিনের অবস্থা মোটেই ভাল নয়। এম এবং ওয়াই অক্ষর দুটো ক্ষয়ে গেছে। লেখার সময় এই দুটো অক্ষরের জায়গায় ফাঁক রেখে যেতে হয়। পরে হাতে লিখে নিতে হয়। স্বাভাবিক কারণেই এর জন্য এক-একটা টাইপের কাজ শেষ করতে অনেকটা সময় লেগে যায়। সব মিলিয়ে খুবই নাজেহাল অবস্থা। এই অবস্থা আর চলবে বলে মনে হচ্ছে না। সুখময় সামন্তর মতো কড়া মানুষ এক-একটা চিঠি তৈরি করতে সাড়ে তিনদিন সময় দেবেন কেন? কে জানে, হয়তো আজই রজনীবাবুকে সে-কথা জানিয়ে দেবেন। তার জন্যই ডাক পড়েছে।

রজনীবাবু খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে বড়সাহেবের ঘরের দিকে এগোলেন।

সুখময় সামন্ত যখন কর্মচারীদের ঘরে ডেকে বকাঝকা করেন, তখন তিনি তাঁর দামি গদি-মোড়া রিভলভিং চেয়ারটাকে নিয়ে ঘুরপাক খান। একটা ধমক দেন, একটা পাক খেয়ে নিয়ে আবার ধমক দেন। আবার একটা পাক, আবার একটা ধমক। এইভাবে চলতে থাকে। অফিসের সবাই আড়ালে এই ধমকের একটা নাম রেখেছে, ‘ঘুরপাক ধমক’।

আজ কিন্তু অন্যরকম হল।

রজনীবাবু ঘরে ঢুকে দেখলেন, সুখময় সামন্ত স্থির হয়ে বসে আছেন। শুধু হাত-পা স্থির নয়, সুখময় সামন্তর চোখও স্থির। তিনি স্থির চোখে রজনীবাবুর দিকে তাকিয়ে আছেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছে, এত রেগে গেছেন যে, চেয়ার নিয়ে ঘুরপাক খাওয়ার কথাটাও আজ আর তাঁর মাথায় নেই।

রজনীবাবুর বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। কর্মজীবনের শেষ প্রান্তে এসে এ কী ঝামেলায় পড়তে হল রে বাবা।

সুখময় সামন্তর হাতে একটা কাগজ। তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, এই চিঠি আপনার টাইপ করা?

রজনীবাবু উঁকি দিয়ে কাগজটা দেখতে গেলেন। সুখময় সামন্ত ধমকে উঠলেন, দেখছেন কী? অ্যাঁ, দেখছেনটা কী? এ-অফিসে আপনি ছাড়া টাইপ মেশিনে আর তো কেউ কাজ করে না?

রজনীবাবু আমতা আমতা করে বললেন, তা হলে বোধহয় আমারই হবে স্যার।

বোধহয় আমারই হবে, একথার মানে কী রজনীবাবু? বোধহয় টোধহয় না, এই ভয়ানক কাণ্ড আপনার ছাড়া আর কারও নয়।

রজনীবাবু মিনমিনে গলায় কোনওরকমে বললেন, কী কাণ্ড স্যার?

কাগজটা ছুড়ে দিয়ে সুখময় সামন্ত বললেন, দেখুন, নিজের চোখেই দেখুন কী কাণ্ড!

ছোড়া কাগজ হাতে তুলে নিলেন রজনীবাবু। কাঁপা হাতে কাগজ ঠিকমতো ধরা যাচ্ছে না। এদিক-ওদিক করছে। তবু তিনি যতটা সম্ভব দ্রুত চোখ বোলালেন। সত্যি, কাণ্ড ভয়ানক। তাঁরই টাইপ করা চিঠি। চিঠির একটা এ-তেও আঁকড়ি নেই! সবকটা গোল গোল ও-এর মতো লাগছে! এমন কী করে হল? টাইপ করবার সময় এ-র বদলে ও টাইপ হয়ে গেছে নাকি?

স্যার, ঠিক বুঝতে পারছি না।

এতক্ষণ পরে সুখময় সামন্তর রাগ বোধহয় সামান্য কমেছে। তিনি বাঁই করে চেয়ারে একটা পাক খেয়ে বললেন, বুঝতে পারবেন। ঠিক বুঝতে পারবেন। শেষ বয়সে জঙ্গলে বদলি করে দিলে বুঝতে পারবেন। হাতি, বাঘ, ভলুক এসে আপনাকে বুঝিয়ে ছাড়বে।।

বদলি করবার বকুনি খুবই অপমানজনক বকুনি। তবে সেই অপমান রজনীবাবু গায়ে মাখলেন না। এই বুড়ো বয়সে সত্যি সত্যি যদি জঙ্গলে বদলি হতে হয়, তা হলে মারাত্মক বিপদ। সেই বিপদের কাছে অপমান অতি তুচ্ছ জিনিস। রজনীবাবুর কপালে ঘাম জমতে লাগল। রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে ফেলবার বদলে তিনি ভুল করে চশমা খুলে মুছতে লাগলেন। তারপর কাগজটা আবার চোখের কাছে তুললেন।

এতক্ষণে ভুলের কারণ পরিষ্কার হল। ভুল তাঁর নয়। ভুল টাইপরাইটার মেশিনের। এতদিন শুধু এম আর ওয়াই অক্ষর দুটো নষ্ট ছিল, এবার এ অক্ষরও ক্ষয়ে গেছে। পুরোটা যায়নি, শুধু আঁকড়িটা উধাও হয়েছে, ফলে এ দেখাচ্ছে ও-এর মতো। রজনীবাবুর মনে খানিকটা সাহস হল। বুড়ো বয়সে বদলির হাত থেকে রক্ষা পেতে হবে। তিনি হাতের তালু দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললেন, স্যার, টাইপ মেশিনে গোলমাল হয়েছে।

চুপ করুন। একদম চুপ করুন। টাইপ মেশিনে গোলমাল হয়েছে মানে? কাজে ভুল করে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোটা আপনাদের একটা হ্যাবিট। এই চিঠি যদি নোটিশ বোর্ডে লাগানো হত, তা হলে কী ঘটত বলতে পারেন? এটা এ-রও কান নেই! সবাই আমাকে কান কাটা এ বলে ডাকত। ভাবত, আমি ইংরেজি বানান জানি না। ভাবত কিনা?

রজনীবাবু মাথা নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন, হ্যাঁ, ভাবত।

পাক খাওয়া শেষ করে রজনীবাবু বললেন, কাজ করবার সময় মনটা কোথায় থাকে? অ্যাঁ, কোথায় থাকে? যান, এবারও আপনাকে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু এই শেষবারের মতো। কথাটা মনে রাখবেন, দিস ইজ দ্য লাস্ট টাইম। এর পর হলে একেবারে ট্রান্সফার টু দ্য ফরেস্ট। জানেন তো, আমাদের কোম্পানি নর্থ বেঙ্গলের জঙ্গলে একটা নতুন ব্রাঞ্চ খুলছে। একেবারে ফরেস্টের মধ্যে। আপনাকে সেখানেই যেতে হবে। সেখানে বাঘ ভল্লুকের সঙ্গে বসে টাইপ করবেন।

যাক, এবারের মতো রক্ষে! বুড়ো বয়সে জঙ্গলে বদলি হওয়াও যা, ফাঁসি হওয়াও তাই। গভীর কৃতজ্ঞতায় রজনীবাবু মুখ তুলে বড়সাহেবকে ধন্যবাদ জানাতে গেলেন।

আর তখনই ঘটনাটা ঘটল।

আরে! কোথায় সুখময় সামন্ত? চেয়ার, টেবিল, ঘর, সবই ঠিকঠাক আছে। শুধু ঘন নীল সুট-টাই পরা লোকটা নেই। তাঁর বদলে রজনীবাবু দেখতে পাচ্ছেন, ছোট একটা ছেলেকে! সাত-আট বছর বয়স হবে ছেলেটার। অবাক কাণ্ড! এ কেমন ভুল দেখছেন তিনি? ছেলেটা পরেছে কালো হাফপ্যান্ট আর সবুজ রঙের শার্ট। বসে আছে সুখময় সামন্তরই গদি-মোড়া চেয়ারে। দু’চোখ দিয়ে টসটস করে জল গড়াচ্ছে। জামার হাতা দিয়ে মাঝে মাঝে সেই জল মুছে নিচ্ছে। ছেলেটা কে? কোথা থেকে এল? এ-ঘরে ঢুকলই বা কীভাবে? রজনীবাবু ভাল করে দেখলেন। চিবুকের কাছটা চেনা চেনা লাগছে। তাই তো! চিবুকটা ঠিক যেন সুখময় সামন্তর মতো লম্বাটে। ভুরু দুটোও তাই! সুখময় সামন্ত ছোট হয়ে গিয়ে তাঁর সামনে উপস্থিত হয়েছেন নাকি! অসম্ভব, এ জিনিস হতে পারে না। ছোট সুখময়ের হাতে কলম। সামনে একটা খাতা খোলা। ছেলেটা কাঁদছে কেন? রজনীবাবু সেই খাতার উপর উঁকি দিলেন। ওরে বাবা, এ তো মনে হচ্ছে, স্কুলের ট্রানস্লেশনের খাতা! ট্রানস্লেশন কঠিন বলে ডাকাবুকো সুখময় সামন্ত কাঁদছেন যে!

খুব বেশি হলে এক মিনিট। তার কম হলেও হতে পারে। ছবি সরে গেল চোখের সামনে থেকে। যেন সিনেমা শেষ হয়ে গেল।

রজনীবাবুর মাথা ঘুরছে, সেই মাথা ঘোরাতেই ঘোর কাটল তাঁর। তিনি ফিরে এলেন আগের অবস্থায়। চোখ কচলে, দেখলেন, সুট-টাই পরে বড় সুখময় সামন্ত বসে আছেন সামনে, নিজের জায়গায়। ছোট সুখময় উবে গেছে!

হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। যান, এবার থেকে মন দিয়ে কাজ করুন।

টলমল পায়ে রজনীবাবু ফিরে এলেন নিজের টেবিলে।

এ কী ঘটল? কীভাবে ঘটল? তিনি একটা বড় মানুষের একঝলক ছেলেবেলা দেখে ফেললেন! এ কখনও হতে পারে? কখনওই হতে পারে না। নিশ্চয়ই ধমকে ঘাবড়ে গিয়ে এমন হয়েছে। বেশি জ্বর হলে অনেক সময় মানুষ ভুল বকে। বেশি ভয় পেলেও হয়তো সেরকম কিছু হয়। মানুষ ভুল দেখতে পায়।

রজনীবাবুর পাশের টেবিলে বসে অসিত দত্ত। লোকটা মহাপাজি। কারও হেনস্থা দেখলে মনে মনে খুব খুশি হয়, মুখে আহা উহু করে। এখনও করল। রজনীবাবুর দিকে তাকিয়ে দুঃখ দুঃখ গলায় বলল, আহা, বকাঝকা বুঝি বেশি হয়ে গেল? যান রজনীদা, বাথরুমে গিয়ে মুখে চোখে ভাল করে জল দিয়ে আসুন। দেখবেন, ভাল লাগবে।

রজনীবাবু উঠে পড়লেন। সত্যি তাঁকে চোখে মুখে জল দিতে হবে। তবে বকাঝকার জন্য নয়, জল দিতে হবে অন্য কারণে। মনে হচ্ছে, মাথায় কয়েক মগ জল ঢালতে পারলে ভাল হত। যে-কাণ্ডটা ঘটল, তাতে মাথায় জল ঢালাটাই উচিত। কিন্তু অফিসে সেটা সম্ভব নয়।

বাথরুমে ঢুকে রজনীবাবু অনেকটা সময় নিয়ে মুখে জল দিলেন। বেশ লাগছে। অনেকটা স্বস্তি বোধ হচ্ছে। নিশ্চয়ই জলের ঝাপটায় মনের ভুলটাও ধুয়ে গিয়েছে। কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছেন। ঘাবড়ানো ভাবটা কাটল খানিকটা। প্রথমে ভেবেছিলেন, আজ আর টিফিনে কিছু খাবেন না। তবু জোর করে খেলেন। কলা, সেঁকা পাউরুটি, দুটো রসগোল্লা। পেট ভরতি থাকলে সব অসুখই পালায়। মনের অসুখও নিশ্চয়ই পালাবে। মানুষের ছেলেবেলা দেখতে পাওয়ার মতো ভয়ংকর বিপদের ঘটনা আর দ্বিতীয়বার ঘটবে না।

ভয়ংকর বিপদের ঘটনা দ্বিতীয়বারও ঘটল এবং সেটা ঘটল খুব তাড়াতাড়ি।

কলা, পাউরুটি, রসগোল্লা দিয়ে টিফিন সেরেও কাজে মন বসছিল না রজনীবাবুর। বয়স হয়েছে, মনের উপর এতটা চাপ চট করে নেওয়া মুশকিল। শরীরটা কেমন ভার ভার লাগছে। ফাইলপত্র গুছিয়ে রেখে, ছুটির প্রায় আধঘণ্টা আগেই অফিস থেকে চুপিচুপি বেরিয়ে পড়লেন। বেরোনোর সময় অসিত দত্ত মুখ টিপে হেসে বলল, যান, বাড়ি যান। বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম করুন। এই বয়সে এত বকাঝকা কি সহ্য হয়?

মাসের শেষ দিকটায় রজনীবাবু অফিস থেকে দুটো স্টপ হেঁটে এগিয়ে যান, তারপর বাস ধরেন। এতে ভাড়াটা পঞ্চাশ পয়সা কম পড়ে। বাজারের যা অবস্থা তাতে পঞ্চাশ পয়সা বাঁচানো কম কথা নয়। আজ আর হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। হাতের কাছে ট্রাম পেয়ে সেকেন্ড ক্লাসে উঠে পড়লেন। ট্রামে ভিড় নেই। জানলার পাশ দেখে একটা সিটে বসে পড়লেন রজনীবাবু।

বেশ ফুরফুরে লাগছে। জানলা দিয়ে ময়দান থেকে হাওয়া উড়ে আসছে। কলকাতার ট্রামগুলোয় এখনও একটা ঘটর ঘটর তাল আছে। রাজা-বাদশার মতো একটু দুলকি চালও রয়েছে। ঘটর ঘটর করে চলেছে। সবাই সরে সরে রাস্তা করে দিচ্ছে। বেশ মজা। রজনীবাবু ঠিক করলেন, রিটায়ারমেন্টের পর পুরো একটা দিন ট্রামে চেপে ঘুরবেন। নাতিকে সঙ্গে নেবেন। বিল্টুটার আবার খাইখাই স্বভাব আছে। ওকে নিলে জলের বোতল আর বিস্কুটের প্যাকেট সঙ্গে রাখতে হবে। সেটাও খারাপ নয়। বেশ একটা পিকনিকের মতো ব্যাপার হবে। ট্রামে পিকনিক। গিন্নিকেও যেতে বলবেন। তবে সে কি আর পারবে? মনে হয় না পারবে। বেচারির সংসারে যা কাজ। বেড়াবে কী, দু’দণ্ড বসতেই তো পারে না। তবে আজ তাকে বসতে হবে। না বলতে পারবে না কিছুতেই। বাড়ি ঢুকেই তিনি গিন্নিকে ডাকবেন। বলবেন, শোনো সুধাময়ী, শিগগিরই শোনো। আরে বাবা, সব কাজ ফেলে এসে গল্পটা শুনে যাও দেখি। হা হা। হাসছি কেন? দেখবে, গল্প শুনে হাসতে হাসতে তোমার পেটও ফাটবে। বুড়ো বয়সে কী কাণ্ড! আজ কী দেখলাম জানো? দেখলাম, আমাদের বড়সাহেব একেবারে এতটুকু হয়ে গেছেন! হাফ প্যান্টালুন পরা স্কুলের ছেলে। হোম টাস্কের ট্রানস্লেশন করছেন! হা হা! বড়সাহেব ট্রানস্লেশন করছেন! ইজ হবে না আর হবে, তাই নিয়ে একেবারে চোখের জলে, নাকের জলে অবস্থা! হা হা। আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, রজনীকাকু, প্লিজ একটু বলে দাও। আমি তো অবাক!

সুধাময়ী নিশ্চয়ই চোখ বড় বড় করে বলবেন, সে কী গো! তোমাকে জিজ্ঞেস করছেন?

না না করেননি, তবে ঘটনা যেমন সত্যি বলে মনে হচ্ছিল, তাতে জিজ্ঞেস করলে অবাক হতাম না।

এতটা পর্যন্ত ভেবে ট্রামের মধ্যেই আপনমনে হেসে ফেললেন রজনীবাবু। পাশের লম্বা লোকটা কটমট করে তাকিয়ে সরে বসল। সেদিকে তাকিয়ে রজনীবাবু মনে মনে বললেন, দাদা, ভয় পাবেন না। পাগল হয়ে যাইনি। আজ যা ঘটেছে আপনি শুনলেও হেসে ফেলতেন। একেই বলে চোখের ভুল। ভুলের মতো ভুল।

ঘটাংঘট আওয়াজ করে ট্রাম দাঁড়িয়ে পড়ল। রজনীবাবু জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলেন, শুধু ট্রাম নয়, রাস্তার সব গাড়িই দাঁড়িয়ে আছে। বিরাট যানজট। গাড়ির ড্রাইভাররা সব রাস্তায় নেমে খোশ গল্প শুরু করেছে। ড্রাইভাররা যখন গাড়ি থেকে নেমে পড়ে গল্প শুরু করে, তখন বোঝা যায়, গাড়ি সহজে নড়ছে না। আচ্ছা মুশকিল হল! কতক্ষণ বসে থাকতে হবে! খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে রজনীবাবুও নেমে পড়লেন। এক টাকার বাদাম কিনে নিলে কেমন হয়? বাদাম খেতে খেতে বাকি পথটা না-হয় হেঁটেই চলে যাবেন।

গাড়ি আর মানুষের ভিড় কাটিয়ে হাঁটতে লাগলেন রজনীবাবু। তাঁর মতো অনেকেই হাঁটছে। তাদের মধ্যে বয়স্ক মানুষ যেমন আছেন, তেমনই কাঁধে ভারী ব্যাগ নিয়ে স্কুলের ছোট ছেলেমেয়েরাও রয়েছে। কী আর করবে? গাড়িঘোড়ার যেমন জট পাকিয়েছে, তাতে ঘণ্টাখানেকের আগে কিছু হবে বলে তো মনে হচ্ছে না। বাপ রে, এত জ্যাম কীসের? নিশ্চয়ই কোনও গোলমাল টোলমাল হয়েছে। অ্যাক্সিডেন্ট? নাকি পথ অবরোধ?

অ্যাক্সিডেন্ট বা পথ অবরোধ নয়, আর-একটু এগোতেই ট্রাফিক জ্যামের কারণ জানা গেল।

একেবারে রাস্তার মাঝখানে স্টেজ বানিয়ে, মাইক বেঁধে মিটিং হচ্ছে। সেই কারণেই গাড়িটাড়ি সব থমকে গিয়েছে। রজনীবাবুও থমকে দাঁড়ালেন। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে একজন নেতাগোছের লোক স্টেজের উপর তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছে। আসলে লাফাচ্ছে না, ভাষণ দিচ্ছে। স্টেজের সামনে চেয়ারে বসে থাকা গুটিকয়েক মানুষ ঝিমোচ্ছে, আর মাঝেমধ্যে কী মনে হচ্ছে, ধড়মড় করে উঠে হাততালি দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, এদের বলা আছে, ভাষণ শোনো চাই না শোনো, দশ মিনিট অন্তর অন্তর কিন্তু তোমরা হাততালি দেবে।

রজনীবাবু লক্ষ করে দেখলেন, নেতা লোকটা কথায় কথায় হাত পা-ও ছোড়ে। বেশ একটা নাচের ভঙ্গি আছে। বাঃ, বেশ মজার ব্যাপার তো! রাস্তা আটকে নাচের অনুষ্ঠান! ভাল করে দেখবার জন্য রজনীবাবু স্টেজের একটু কাছে এগিয়ে এলেন। গলার শিরা ফুলিয়ে নেতা বলছেন, আজ শত্রুপক্ষ আমাকে বলছে চোর, আমাকে বলছে ডাকাত। ছি, ছি! আমার নামে এত বড় মিথ্যে অপবাদ! আমি যে কতখানি সৎ, সেকথা আর কেউ না-জানুক, আমি তো জানি। সারাজীবন সততা আঁকড়ে ধরে এগিয়ে চলেছি। আপনাদের সেবা করে চলেছি। ছেলেবেলায় আমার বাবা চোখের জল মুছতেন আর বলতেন, এই মিথ্যের যুগে, এই অন্যায়ের যুগে আমার সৎ ছেলেটার কী হবে গো!

এইরকম একটা সময় দ্বিতীয়বারের জন্য ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটল। রজনীবাবু দৃশ্যটা দেখতে পেলেন। দেখতে পেলেন না বলে, বলা ভাল, দৃশ্যটা ভেসে উঠল চোখের সামনে।

নেতা ছোট হয়ে গেছেন। শুধু মাপে নয়, বয়সেও ছোট। খুব বেশি হলে বছর বারো। গায়ের পাজামা পাঞ্জাবি দুটোই ঢলঢল করছে। এই অবস্থাতেও সে তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, ছেলেবেলা থেকেই এর তিড়িংবিড়িং করার দিকে একটা ঝোঁক আছে। তবে এখন না-লাফিয়ে কোনও উপায় নেই। সামনে দাড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোক হাতের স্কেল দিয়ে ছোট-হয়ে-যাওয়া নেতার পায়ে চটাস চটাস করে মারছেন। মারছেন আর বলছেন, বল, বল, আর কোনওদিন আমার পকেট থেকে পয়সা চুরি করবি? বল, আর করবি কোনওদিন? অ্যাঁ, এই বয়সেই পকেটমার, বড় হয়ে তো ডাকাত হবি!

ছোট সাইজের নেতা লাফাতে লাফাতে বলছে, আর করব না বাবা, আর চুরি করব না। সত্যি বলছি বাবা, আর করব না কখনও।

রজনীবাবুর চোখের সামনে এই দৃশ্য ভেসে থাকল দশ সেকেন্ড, খুব বেশি হলে পনেরো সেকেন্ড। তারপরই সব ভ্যানিশ! সামনের একটা ফাঁকা চেয়ার ধরে বসে পড়লেন তিনি।

প্রথমবার রজনীবাবু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। এবার তিনি ভয় পেলেন। ভীষণ ভয়। ভিতু প্রকৃতির ছাপোষা মানুষ তিনি। সর্দি, কাশি বা বাতের ব্যথা নিয়ে থাকেন। অমাবস্যা, পূর্ণিমায় সেই ব্যথা বাড়ে। ব্যথা কমাতে গরম তেল মালিশ করতে হয়। এ তাঁর কী ভয়ংকর অসুখ হল? মানুষের ছেলেবেলা দেখতে পাওয়া অসুখের নাম কী? সেই অসুখ সারে কোন ওষুধে?

বাকি পথ হেঁটে বাড়ি ফিরলেন রজনীবাবু। তিনি একই সঙ্গে ক্লান্ত এবং চিন্তিত।

সকালে ঘুম ভাঙল দেরিতে। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। মনে হচ্ছে, আরও খানিকটা শুয়ে থাকলে ভাল হত। সেটা হওয়ার উপায় নেই। তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়লেন রজনীবাবু। অফিসের দেরি হয়ে গেলে গোলমাল হবে। সুখময় সামন্ত এসে ঝামেলা শুরু করেছেন। সকালবেলা নোটবই হাতে অফিস গেটে দাঁড়িয়ে থাকছেন। পাশে গম্ভীর মুখে দাঁড়াচ্ছে ক্ষিতীশ। ক্ষিতীশের হাতে থাকছে একটা স্টপওয়াচ। স্টপওয়াচের কাঁটা কটকট করে ঘোরে। যেই কেউ গেট পেরিয়ে ঢুকছে, অমনই ক্ষিতীশ স্টপওয়াচ বন্ধ করে দিচ্ছে। এরপর সুখময় সামন্ত মুখ বাড়িয়ে ঘড়ি দেখবেন। নোট বইয়ে সময় টুকে নেবেন খসখস করে। একজনের সময় টোকা হয়ে গেলে ক্ষিতীশ আবার ঘড়ি চালিয়ে দিচ্ছে পরের জন্যের জন্য। কট কট কট…।

যারা দেরি করে আসছে, একটু বেলার দিকে তাদের নিজের ঘরে ডেকে পাঠাচ্ছেন বড়সাহেব। নোটবুক বের করে বলছেন, ব্যাপারটা কী? অ্যাঁ, ব্যাপারটা কী আপনার? আজ আপনি দশটা বেজে তিন সেকেন্ডে অফিসে এলেন যে বড়? তিন সেকেন্ডের কোনও দাম নেই ভেবেছেন? মাত্র কুড়ি দিন যদি তিন সেকেন্ড করে লেট হয়, সব মিলিয়ে কত হয় বলুন তো? পাক্কা এক মিনিট। এই এক মিনিটের দেরিটা যদি ষাট বার করে ফেলেন, তা হলেই আপনার লেট গিয়ে দাঁড়াবে এক ঘণ্টায়। জানেন সে-কথা? রেকর্ড খুলে দেখলাম, বছর কুড়ি চাকরির বাকি আছে আপনার। এবার হিসেব করে দেখুন। অফিস টাইম হল সাত ঘণ্টার। বছরে মোট সাত ঘণ্টা লেট চালাতে পারলেই পাক্কা একটা দিন কামাই হয়ে গেল আপনার। কুড়ি বছরে কুড়িটা দিন কামাই হয়ে যাবে নিঃশব্দে। কেউ জানতেও পারবে না। বিশ্বাস না হলে, এই দেখুন হিসেব।

এই পর্যন্ত শুনেই মাথা ঝিমঝিম করবে। মনে হবে, এত যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগের চেয়ে তিন সেকেন্ড আগে অফিসে আসা ভাল ছিল!

রজনীবাবু তাড়াতাড়ি চা খেতে গিয়ে জিভ পুড়িয়ে ফেললেন। যত খুশি পুড়ুক। সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টার অঙ্ক শুনে মুখ পোড়ানোর চেয়ে গরম চা খেয়ে জিভ পোড়ানো অনেক ভাল।

গরম চা কোনওরকমে শেষ করে রজনীবাবু থলি হাতে বাজারে ছুটলেন।

বাজারের সমস্যা হল, বাড়ি থেকে বেরোবার সময় যতই ফর্দ ঠিক করে আসা হোক না কেন, কেনবার সময় অনেক কিছু উলটোপালটা হয়ে যায়। ইচ্ছে থাকে, বেগুন কিনব, কিন্তু টকটকে লাল রং দেখে বেগুনের বদলে কেনা হয় যায় টম্যাটো। সজনে ডাঁটার দিকে কোনও মন থাকে না, তবু দোকানদার প্রায় জোর করে এক আঁটি ঢুকিয়ে দেয় ব্যাগে। সেও নিশ্চিন্ত মনে গুটিসুটি মেরে ব্যাগের কোনায় শুয়ে পড়ে। কুমড়োর জন্য হাত বাড়িয়ে থমকে যেতে হয়। পাশ থেকে নধর লাউ হাতছানি দেয়। কুমড়োর বদলে কিনতে হয় লাউ। হয়তো গাজর কেনবার কোনও পরিকল্পনাই ছিল না। দাম কম শুনে দুটো না-নিয়ে উপায় থাকে না। মনে হয়, ইস, না-কিনলে ঠকে যাব! ঠিক ছিল, শুধু পুঁইশাক কিনেই বাড়ি ফেরা যাবে। ফেরবার পথে পুঁইশাকের সঙ্গে অল্প কুচো চিংড়ি নিতে হয় শেষ পর্যন্ত।

রজনীবাবু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, আজ কিছুতেই এসব চলবে না। সময় নেই একটুও। হাতের কাছে আলু, পটল যা পাবেন তাই নিয়ে নেবেন। নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরবেন। সুখময় সামন্ত যত দিন এই অফিসে আছেন, তত দিন তরিবত করে তরকারি কেনবার সুযোগ নেই। আলু, পটল দেওয়া মাছের ঝোল খেয়েই থাকতে হবে।

প্রথমেই মাছের জায়গায় গেলেন রজনীবাবু! আগে মাছটাই কিনে ফেলা যাক চট করে। তারপর বাকিটুকু সেরে ফেলা যাবে। কিন্তু চট করে মাছ নেওয়া হল না।

একটা মাঝারি সাইজের ট্যাংরা নিয়ে মাছওলার সঙ্গে তুলকালাম শুরু করেছেন ঘোষবাবু। ট্যাংরার ওজনে নাকি গোলমাল ধরা পড়েছে। ঘোষবাবু মাছওলাকে এই মারেন তো সেই মারেন। মাছওলাও ছাড়বার পাত্র নয়। সেও লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। ভিড় জমে গেছে। মাছের বাজারে বেচাকেনা বন্ধ হওয়ার জোগাড়।

রজনীবাবু প্রমাদ গনলেন। আজ মাছ না-কিনেই বাড়ি ফিরতে হবে মনে হচ্ছে। এ-পাড়ায় ঘোষবাবুকে সকালেই চেনে। ঘোষবাবুর বাজার করতে আসা যেন ঝগড়া করতে আসা। উচ্ছে, ঝিঙে থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, ডিম সবকিছু নিয়ে উনি ঝগড়া করেন। দোকানে ঘুরে ঘুরে ঝগড়া। কখনও বলছেন জিনিস পচা, কখনও বলছেন ওজন কম, কখনও বলছেন নোংরা নোট নেবেন না। নিজের বাজার এবং অনার বাজার পণ্ড করতে একেবারে ওস্তাদ।

রজনীবাবু দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। আর-একটু দেখা যাক। ঝগড়া যদি তাড়াতাড়ি থেমে যায়। তা ছাড়া মাছ না-নিয়ে গেলে বেজায় সমস্যা। গিন্নি ছেড়ে কথা বলবেন না। আবার দেরি হলেও মুশকিল। আজ একেবারে জাঁতাকলে পড়ে গেছেন।

মাছওলা হাত নেড়ে বলল, ঘোমশাই, আপনার মতো ঝগড়ুটে খরিদ্দার এই বাজারে একজনও নেই। কোনও বাজারে আছে কি না তাই আমার সন্দেহ হচ্ছে।

ঘোষবাবু হুংকার দিয়ে বললেন, নেই তো নেই। নেই বলে তুমি ওজনে ঠকাবে?

মোটেই ঠকাইনি। এই তো আবার ওজন করলাম। আপনার সামনেই তো করলাম। ওজন তো ঠিকই আছে।

ওসব হল গিয়ে তোমাদের কারসাজি। একই জিনিসের তোমরা তিন রকম ওজন করতে পারো।

পারি তো পারি। তিন রকম কেন, সেরকম হলে পাঁচ রকম ওজন করব।

ঘোষবাবু তাঁর গোল গোল চোখ আরও গোল করে বললেন, করো না, যত রকম ইচ্ছে ওজন করো। পাঁচশো রকমের ওজন করলে আমিও পাঁচশো বার ঝগড়া করব। সেরকম হলে বাড়ি থেকে মোড়া নিয়ে এসে বসে ঝগড়া করব।

ভিড়ের মাঝখান থেকে কে একজন রসিকতা করে বলল, ছাড়বেন না ঘোষদা। ঝগড়া চালিয়ে যান। শুধু মোড়া কেন, সেরকম হলে আমরা খাট-পালঙ্ক এনে দেব, শুয়ে শুয়ে ঝগড়া করবেন।

না, আজ মাছের আশা ছাড়তে হল। এ জিনিস সহজে থামবে বলে মনে হয় না। হতাশ হয়ে রজনীবাবু চলে যেতে গেলেন, আর তখনই চোখের সামনে শাঁ করে ছোট হয়ে গেলেন ঘোষবাবু!

সেই গোল গোল চোখ, সেই বড় বড় কান! শুধু মানুষটার বয়স এক ঝটকায় যেন চল্লিশ বছর কমে গেছে! রজনীবাবুর পা নড়ছে না। হাতে থলি নিয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। এসব কি দেখতে পাচ্ছেন?

ছেলেবেলার ঘোষবাবু বাড়ির রোয়াকে বসে আছেন। হাতে আমের আচার। ঘোষবাবু আচার খাচ্ছেন আর মনের সুখে পা দোলাচ্ছেন। এমন সময় একদল ছেলে এসে হাজির। তাদের কারও হাতে ক্রিকেট ব্যাট, কেউ বল নিয়ে লোফালুফি করছে। একটা ছেলে এগিয়ে এসে ঘোষবাবুকে বলল, অ্যাই বিশু, কী খাচ্ছিস?

রজনীবাবু স্পষ্ট দেখতে পেলেন, ছেলেমানুষ ঘোষবাবু তাড়াতাড়ি হাতের আচার প্যান্টের পকেটে লুকিয়ে ফেলছেন। বাকি ছেলেগুলো ব্যাট বল ফেলে তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। হাতের আচার কেড়ে নিল হাসতে হাসতে। তারপর ভাগাভাগি করে খেতে শুরু করল মনের সুখে!

এখানেই ঘটনা শেষ নয়। রজনীবাবু অবাক হয়ে দেখলেন, বাজারের ঝগড়ায় এত বড় পারদর্শী ঘোষবাবু বন্ধুদের সামনে একেবারে চুপ! শান্তশিষ্ট, গোবেচারা মানুষ একজন। ঝগড়া তো দূরের, একটা কথাও যে বলতে পারছেন না। কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে থেকে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললেন!

রজনীবাবু গোটা বাজারটাই ভুল করে বাড়ি ফিরলেন। মাছের বদলে আনলেন ডিম। আলুর বদলে ট্যাঁড়স। অল্প পটল এনেছেন ঠিকই, কিন্তু সবকটাই শুকনো। মারাত্মক ব্যাপার হয়েছে কাঁচালঙ্কা কেনায়। কঁচালঙ্কার জায়গায় তিনি কিনেছেন কড়াইশুঁটি।

রান্নাঘরে বাজারের থলি নামিয়ে এসে ঘরে থম মেরে বসে আছেন রজনীবাবু। কী করবেন তিনি? এই ভয়ংকর বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী? মনে হচ্ছে না কোনও উপায় আছে। তা হলে কি বাকি জীবনটা এভাবেই কাটাতে হবে? বড়দের ছেলেবেলা দেখতে দেখতে? রজনীবাবুর নার্ভাস লাগছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। না, এভাবে চললে হবে না। মাথা ঠিক রাখতে হবে। বিপদে মাথা ঠিক রাখাটাই আসল। ডাক্তারের কাছে গেলে হয়। তাতেও ভয় আছে। ডাক্তারবাবু যদি বলেন, আপনি পাগল হয়ে গেছেন রজনীবাবু। মাথা খারাপ না হলে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে? সে আর-এক বিপদ। থাক, ভাক্তারের কাছে গিয়ে কাজ নেই। কারও সঙ্গে পরামর্শ করতে পারলে হত। অনেক সময় পরামর্শ করলে সমস্যা সমাধানের পথ বের হয়। কার সঙ্গে পরামর্শ করবেন? অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে? কিছুতেই নয়। ভীষণ হাসাহাসি শুরু হয়ে যাবে। বলা যায় না, অসিত দত্ত পাজিটা হয়তো বড়সাহেবের কানে কথাটা তুলে দিল। তা হলে কি গিন্নিাকে সব ঘটনা বলবেন? সেটাও মনে হয় না ঠিক হবে। সুধাময়ী তাঁর মতোই ভিতু। এসব শুনলে ঘাবড়ে যেতে পারে। তা ছাড়া ওর পেটে কোনও কথা গোপন থাকে না। হয়তো মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি থেকে ডেকে পাঠাবে। আত্মীয়স্বজনকে খবর দিয়ে বসবে। বাড়িতে লোকজন, পাড়াপ্রতিবেশী এসে একটা যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটাবে। সুতরাং গিন্নিকে বলা চলবে না। ব্যাপারটা নিয়ে এমন কারও সঙ্গে কথা বলতে হবে যার সাহস আছে, আবার কথা গোপনও করতে জানে। ঘটনা শুনে ঘাবড়াবে না। হাসবেও না। বরং মাথা ঠান্ডা করে তাঁকে একটা পরামর্শ দিতে পারবে। রজনীবাবু ভাবতে লাগলেন।

আচ্ছা, গণেশের কাছে গেলে কেমন হয়?

কলেজের বন্ধু গণেশ হালদার যে পুলিশ হয়েছে সে-কথা জানা ছিল না রজনীবাবুর। এমনিই পুলিশ নয়, একেবারে থানার ওসি। দারোগা যাকে বলে। সেদিন শ্যামবাজারের ফুটপাতে দাড়িয়ে গামছার দর করছিলেন রজনীবাবু। হঠাৎ পাশে একটা জিপ এসে দাঁড়াল। মুখ ফিরিয়ে দেখলেন, পুলিশের জিপ। জিপ থেকে হইহই করতে করতে নেমে এল গণেশ। একইরকম মোটাসোটা আছে। ভুঁড়িটা একটু বেড়েছে। গায়ে পুলিশের উর্দি। মাথায় টুপি।

রজনী, রজনী, কতদিন পরে দেখা হল। বলতে বলতে একেবারে জড়িয়ে টড়িয়ে ধরে একাকার কাণ্ড। গণেশটা চিরকালই আমুদে। অসম্ভব রকম খেতে ভালবাসত। একটা চিংড়ির কাটলেটের জন্য দু’কিলোমিটার হেঁটে যাওয়া ওর কাছে কোনও ব্যাপার ছিল না। পেটুক অনেকেই হয়। গণেশের মজা হল, ও একা একা কিছু খেতে পারত না। খাওয়ার সময় সঙ্গে কাউকে একটা চাই। নিজেও খাবে, তাকেও খাওয়াবে। বলত, ভাল জিনিস কখনও একা খেয়ে মজা নেই। সে তুই পোলাওই বল আর রাবড়িই বল।

গণেশের এই অদ্ভুত স্বভাবের জন্য কলেজের বন্ধুরা ওকে দারুণ ভালবাসত। যে-কোনও ইস্যুতে গণেশের খাওয়া চাই। বৃষ্টি পড়ছে, ফুলুরি খাব। গরম বেশি, ঘোল খেতে হবে। রেজাল্ট খারাপ, ফ্রিশফ্রাই না খেলে মন ভাল হবে না।

রজনীবাবু বললেন, কী রে গণেশ, তুই এখনও অমন খেতে পছন্দ করিস নাকি?

গণেশ হালদার হা হা করে হেসে বললেন, ভালবাসি মানে? আলবাত ভালবাসি, একশোবার ভালবাসি। এই বয়সেও আমার খাওয়া দেখলে তুই চমকে যাবি। বরং এখন আগের চেয়ে খাবারদাবার বেশি হজম হয়। চল রজনী, তোর সঙ্গে এত বছর পর দেখা হল, রেস্টুরেন্টে ঢুকে দু’প্লেট কষা মাংস সাঁটিয়ে দিই। জানিস তো, চিনে প্রবাদ আছে, পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে পুরনো দিনের মতো খাবার খেয়ে সেলিব্রেট করতে হয়।

রজনীবাবু হাসতে হাসতে বললেন, কষা মাংস খাওয়ার জন্য মিথ্যে কথা বলিস না। বুড়ো বয়সে কষা মাংস খেলে দেখতে হবে না। শুধু দাঁত নয়, শরীরটাও ঝনঝন করে উঠবে। আজ আমাকে ছেড়ে দে ভাই। বরং একদিন তোর কাছে জমিয়ে গল্প করে আসব।

গণেশ হালদার দুঃখ দুঃখ মুখ করে বললেন, আসিস, তোর জন্য দুধ-সাগুর ব্যবস্থা করে রাখব।

রজনীবাবু সিদ্ধান্ত নিলেন, গণেশের কাছেই যাবেন। কথায় বলে, পুলিশের সাহস। ওদের মাথায় প্যাঁচও অনেকরকম। এই ভয়ংকর বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একটা পথ নিশ্চয়ই বাতলে দেবে। বাতলে না-দিক, পরামর্শ তো দিতে পারবে। একা ভাবার চেয়ে দু’জনে মিলে ভাবলে সুবিধে বেশি। আজই অফিস থেকে ফেরবার পথে গণেশের থানা ঘুরে আসবেন।

গণেশের কথা মনে পড়তে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে উঠে পড়লেন রজনীবাবু। ইস, দেরি হয়ে গিয়েছে। চিৎকার করে গিন্নিকে বললেন, সুধাময়ী, তাড়াতাড়ি ভাত দাও। অফিসে লেট হয়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

কর্তার হাঁকডাক শুনে সুধাময়ীদেবী ঘরে ঢুকলেন। একেবারে রণমূর্তি। এক হাতে খুন্তি, অন্য হাতে একটা ঢ্যাঁড়স। ঝাঁকিয়ে উঠে বললেন, ব্যাপারটা কী তোমার? কী এনেছ আজ বাজার থেকে? ডিমের ডালনা কি ঢ্যাঁড়স দিয়ে রান্না হবে? বেলা পর্যন্ত ভোঁসভোঁস করে ঘুমোবে, ঘুমোতে ঘুমোতে বাজারে ছুটবে, উলটোপালটা আনাজপাতি কিনবে, আবার চিৎকার করে বলছ, তাড়াতাড়ি ভাত দাও। বলি ভেবেছটা কী?

গিন্নির চিৎকারে রজনীবাবু কিছু মনে করলেন না। সকালের দিকে কাজের চাপে সুধাময়ীর মাথাটা একটু বেশি গরম থাকে। তা ছাড়া, সত্যি তো! ঘোষবাবুর ঘটনার পর বাজারে খানিকটা গোলমাল হয়ে গেছে। সুধাময়ীর দোষ কী, চেঁচামেচি করাই উচিত। তিনি হলেও করতেন।

মাথায় তেল মাখতে মাখতে বাথরুমের দিকে ছুটলেন রজনীবাবু।

বাথরুমে ঢোকার অল্প কিছুক্ষণ পরেই চোখের সামনে সিনেমার ছবি ভেসে উঠল। এবার খোদ গিন্নিকে নিয়ে ছবি! ছবি নড়ছে চড়ছে, গানও গাইছে!

ছোট্ট সুধাময়ী বসে আছে ছাদে। শীত শুরুর নরম রোদের খানিকটা পড়ে আছে তার পায়ের কাছে। হলুদ ফুলকাটা একটা নীল ফ্রকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে। কোলের উপর পুতুল। পুতুলের ফ্রকও হলুদ। বেণী দুলিয়ে পুতুলকে গুনগুন করে গান শোনাচ্ছে আর চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে দিচ্ছে সুধাময়ী। কী গান বোঝা যাচ্ছে না। মনে হয়, কোলের পুতুলটা শুধু বুঝতে পারছে। এমন সময় এক মহিলার গলা ভেসে এল। রজনীবাবু কান পাতলেন।

সুধা, সুধাময়ী, লক্ষ্মী মা আমার, ছাদ থেকে নেমে আয় এবার। বেলা অনেক হয়েছে। আর কতক্ষণ খেলবি মা?

ছোট্ট সুধাময়ী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আর-একটু, আর একটুখানি। রোজই তো তাড়া দাও, আজ একটু খেলি না মা! প্লিজ মা!

রজনীবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। নড়তে পারছেন না। তাঁর হাতে জল-ভরতি মগ। সেই জল তিনি মাথায় ঢালতে পারছেন না। তাঁর শীত শীত করছে। এই শীত সাধারণ শীত নয়, অন্যরকম শীত। মানুষ যখন অসম্ভব ভয় পায়, তখন শরীরের ভিতরে এরকম শীত অনুভব করে।

অফিসে বেরোনোর জন্য শান্তভাবে তৈরি হয়েছেন রজনীবাবু। খাওয়া সেরে প্রতিদিনকার মতো একটু মৌরি মুখে দিয়েছেন। কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়েছেন ব্যাগে। টিফিন বাক্স, জলের বোতল পুরলেন। ড্রয়ারের চাবি পকেটে ঢোকালেন। হাতে ছাতা নিলেন। বেরোনোর সময় সুধাময়ীদেবী বললেন, মনে আছে তো? আজ কিন্তু ভবানীপুরে নেমন্তন্ন। তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরবে। দিদি জামাইবাবু অনেক করে যেতে বলেছে।

রজনীবাবু বললেন, ফিরব, তাড়াতাড়ি ফিরব।

অফিসে যাওয়ার জন্য বেরিয়েও রজনীবাবু আজ অফিসে গেলেন না। রাস্তা পেরিয়ে উলটো দিকের বাস ধরলেন।

টেবিলের উপর শালপাতার চেঙাড়ি, মাটির ভাঁড়। চেঙাড়িতে কচুরি, মাটির ভাঁড়ে তরকারি।

গণেশ হালদার কচুরি খাচ্ছেন।

তবে তিনি কচুরি একা খাচ্ছেন না, উলটোদিকে একটা চিমসে ধরনের লোক বসে আছে। তাকেও খাওয়াচ্ছেন। লোকটার মুখ ভরতি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চুল উসকোখুসকো। জামা-প্যান্টের অবস্থাও শোচনীয়। তাতে অবশ্য লোকটার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। সে মহানন্দে চেঙাড়ি থেকে কচুরি তুলছে, মাটির ভাঁড় থেকে তরকারি ঢালছে এবং মুখে পুরছে।

রজনীবাবু একটু পরেই বুঝতে পারলেন, চিমসে দেখতে লোকটার নামও চিমসে! গণেশ হালদার তাকে চিমসে বলেই ডাকছেন।

চিমসে একসময় মুখ তুলে বলল, স্যার, তরকারি ফুরিয়ে গিয়েছে। আর-একটু আনান দেখি।

গণেশ হালদার বললেন, ঠিকই বলেছ, আর-একটু তরকারি আনাই। দুটো গরম জিলিপি মেরে দেবে নাকি চিমসে? আনতে বলব?

চিমসে লজ্জা লজ্জা মুখে বললে, আবার জিলিপি বলবেন স্যার?

আরে কচুরি খাওয়ার নিয়মই হল, শেষপাতে গরম জিলিপি লাগবে। আরে বাবা, তুমি খেলে আমিও খেতে পারি। জিলিপি কখনও একা খাওয়া যায় না। খাওয়াদাওয়ার একটা নিয়ম আছে।

আপনি যখন এত করে বলছেন, তখন আনিয়ে ফেলুম। গরম হলে কয়েকটা বেশি করেই আনান। এই অবেলায় কি আর গরম জিলিপি পাওয়া যাবে?

গণেশ হালদার বেল বাজিয়ে হাবিলদারকে ডাকলেন। দশ টাকা হাতে দিয়ে কচুরির তরকারি আর গরম জিলিপি আনার অর্ডার দিলেন। রজনীবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই দেখছি, সেই কলেজের মতোই রয়ে গেলি রজনী। পেটরোগা। সেদিন কষা মাংস খেতে বললাম বলে ভয়ে পালিয়ে গেলি। আজ কচুরির জন্য এত সাধছি, তাতেও রাজি হচ্ছিস না। আরে বাবা, ভাত খেয়ে এসেছিস বলে কচুরি খাবি না! কোন বইয়ে এমন লেখা আছে বল দেখি? কী চিমসে, লেখা আছে?

চিমসে মাথা নেড়ে বলল, না স্যার, কোনও বইয়ে লেখা নেই।

রজনীবাবু বললেন, না না, ওসব কিছু নয়, আর-একদিন এসে না হয় খাওয়া যাবে। গণেশ, তোর কাছে একটা জরুরি দরকারে এসেছিলাম।

গণেশ হালদার হেসে বললেন, নিশ্চয়ই বাড়িতে চুরি-ডাকাতি কিছু একটা হয়েছে? পুলিশের কাছে জরুরি কাজে আসা মানেই হয় চোর পাকড়াও, নয় ডাকাত ধরো। তাই না চিমসে?

চিমসে আঙুল চাটতে চাটতে বলল, একদম তাই স্যার। চোরের খোঁজ পড়লে, তবেই পুলিশ ধরে টানাটানি। পুলিশ ধরলে, চোরও ধরা পড়বে।

গণেশ হালদার ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠলেন, দারুণ বললে হে, চোর খুঁজতে পুলিশ ধরো! হা হা।

রজনীবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, চুরিটুরির কোনও ব্যাপার নয়। আমি একটা বিচ্ছিরি ঝামেলায় পড়েছি। কী করতে হবে ঠিক বুঝতে পারছি না।

গণেশ হালদার ভুরু কুঁচকে বললেন, ব্যাপার সিরিয়াস মনে হচ্ছে রজনী?

রজনীবাবু বললেন, হ্যাঁ সিরিয়াস। এত সিরিয়াস যে, সাহস করে কাউকে বলতে পর্যন্ত পারছি না। ভয় হচ্ছে, সিরিয়াস কথা শুনে হাসাহাসি না পড়ে যায়!

ঠিক আছে, জিলিপি খেয়ে নিয়ে তোর কথা শুনছি। চিন্তা করিস না রজনী, ডান্ডা দেখলে অনেক সিরিয়াস জিনিস ঠান্ডা মেরে যায়।

রজনীবাবু খুশি মনে বললেন, সেই কারণেই তো তোর কাছে এলাম গণেশ। শুনেছি, ইচ্ছে করলে নাকি পুলিশরা সব পারে।

পুলিশ সব পারে কিনা বলা যাবে না। তবে এই ঘোর দুপুরে গরম জিলিপি নিয়ে আসা চাট্টিখানি কথা নয়। হাবিলদার কিন্তু ঠিক নিয়ে এল। রজনীবাবু দেখে সন্তুষ্ট হলেন। পুলিশের উপর আস্থা বাড়ল। না, গণেশের কাছে এসে ভুল হয়নি। মনে হচ্ছে, এবার একটা উপায় পাওয়া যাবে। তবে জিলিপি পাওয়া গেলেও তরকারি পাওয়া যায়নি। ফুরিয়ে গেছে। রজনীবাবু দেখলেন, সামান্য তরকারি নিয়ে গণেশ এবং চিমসে বিরাট হায় হায় করতে লাগল।

চিমসে বলল, আমি তখনই বুঝেছিলাম পাওয়া যাবে না। এ জিনিস বেশিক্ষণ পড়ে থাকার নয় স্যার।

দু’জনের বারবার অনুরোধে রজনীবাবুকে একটি জিলিপি খেতে হল। শুরুতে কেমন কেমন লাগলেও খাওয়া শেষ করে বেশ ভালই লাগল। তিনি আরও একটা খেয়ে ফেললেন।

খাওয়া শেষ করে চিমসে আড়মোড়া ভাঙল। গণেশ হালদারের দিকে তাকিয়ে বলল, তা হলে স্যার, এবার অনুমতি দিন, লকআপে ঢুকে পড়ি। ভাতঘুমের মতো একটা কচুরি-জিলিপি-ঘুম দিই!

রজনীবাবু অবাক হয়ে গেলেন। লোকটা বলে কী! লকআপে যাবে মানে! দারোগার সঙ্গে বসে কচুরি জিলিপি খাওয়া লোক লকআপে ঢুকে পড়বে!

গণেশ হালদার চিমসের দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ, সেই ভাল! লকআপে ঢুকে পড়ো। গড়িয়ে নাও একটু। আবার বিকেলে না হয় চা খাওয়ার সময় ডেকে নেব। আমি ততক্ষণ রজনীর সিরিয়াস কথাটা শুনে ফেলি। বেচারির অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেললাম।

চিমসে চলে যেতে রজনীবাবু চোখ বড় বড় করে বললেন, ব্যাপার কী রে গণেশ? কচুরি, জিলিপি খেয়ে লকআপে ঢুকে গেল মানে? লোকটা কে?

কার কথা বলছিস? চিমসে? হা হা। আরে, ও কিছু নয়! বেচারি আজ সকালে কোথা থেকে যেন একটা ট্রান্সজিস্টর চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে। লোকজন চড়চাপড় দিয়ে থানায় জমা দিয়ে গেল। তারপর থেকে লকআপেই আটকে আছে। ধমকধামক দিয়ে বুঝতে পারলাম, ছেলেটা আসলে খারাপ নয়। অভাবে পড়ে অন্যায় কাজটা করে ফেলেছে। তা হল কী জানিস রজনী? খানিক আগে হঠাৎ আমার কেমন যেন কচুরি খেতে ইচ্ছে হল। একা একা তো খাওয়া যায় না! বাধ্য হয়ে চিমসেকে ডেকে নিলাম। চোরের সঙ্গে বসে কচুরি খাওয়ার নিয়ম নেই বটে, তবে ভাল জিনিস খাওয়ার সময় অত নিয়ম মানলে চলে না। ছোকরা খাওয়ার সমঝদার আছে। এসব মানুষের সঙ্গে খেতে বসে আনন্দ। খারাপ করেছি? হা হা।

রজনীবাবু মুগ্ধ হয়ে গেলেন। ভাগ্যিস তিনি আজ গণেশের কাছে এসেছিলেন। এসেছিলেন বলেই তো এমন চমৎকার একটা ঘটনার সাক্ষী হতে পারলেন। ফিসফিস করে বললেন, না, খারাপ করিসনি। একেবারেই খারাপ করিসনি।

রজনী, এবার সমস্যার কথাটা বল তো শুনি। কাকে পাকড়াও করতে হবে?

রজনীবাবু গোড়া থেকে সব ঘটনা বললেন। একেবারে সেই অফিসের সুখময় সামন্তর হোমটাস্ক করা থেকে গিন্নির পুতুল খেলা পর্যন্ত। গণেশ হালদার গম্ভীর মুখে শুনলেন। কথা শেষ হলে আরও গম্ভীর হয়ে বললেন, সমস্যা জটিল। পুলিশের কাজ বড়দের নিয়ে, আর তুই দেখছি ছোটদের নিয়ে ঝামেলায় পড়েছিস। এখানে ডান্ডা, বন্দুক কোনও কাজে দেবে না। চিন্তায় ফেললি রজনী। বেশ চিন্তায় ফেললি।

কী হবে তা হলে? ভেবেছিলাম, ডাক্তারের কাছে যাই। শুনেছিলাম ব্লাডপ্রেশার কমবেশি হলে নাকি মনের মধ্যে উলটোপালটা হয়।

গণেশ হালদার ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বললেন, ছাই হয়! ব্লাড প্রেশারের সঙ্গে মনের কোনও সম্পর্ক নেই। তবু ডাক্তারের কাছে যেতে পারিস, তবে অফিসে লম্বা ছুটি নিয়ে যাস।

রজনীবাবু ঝুঁকে পড়ে বললেন, লম্বা ছুটি! লম্বা ছুটি নিয়ে যাব কেন?

বাঃ, ছুটি নিবি না? আমি নিশ্চিত, তোর মুখে এই অসুখের কথা শুনে ডাক্তার একটুও দেরি করবেন না। সঙ্গে সঙ্গে হাত-পা বেঁধে পাগলাগারদে পাঠিয়ে দেবে। যার-তার ছেলেবেলা দেখতে পাওয়া বদ্ধ পাগলামি ছাড়া আর কী হবে?

রজনীবাবু আঁতকে উঠে বললন, উরেব্বাস। এই ভয়টাই তো পাচ্ছিলাম। প্লিজ গণেশ, অন্য কোনও পথ বাতলে দে। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার দরকার নেই। এমনিতেই বিপদের মধ্যে আছি। কী যে একটা ছেলেবেলা ঘাড়ে চেপে বসল! বুড়ো বয়সে ভয়ে মরছি।

গণেশ চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, অত উতলা হোস না। একটা পথ ঠিক পাওয়া যাবে। হয়তো অসুখটসুখ কিছুই নয়, তোর এই ঘটনার মধ্যে একটা সুপারন্যাচারাল ব্যাপার থাকতে পারে। যাকে বলা হয়, ভৌতিক কাণ্ড।

ভূত! ভুতুড়ে ব্যাপার বলছিস?

গণেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন, অবশ্যই ভুতুড়ে। ভুতুড়ে ছাড়া আবার কী হবে? এই একজনকে বড় দেখছিস, তাকেই আবার ঝাঁ করে ছোট দেখলি, ভুতুড়ে ব্যাপার বলব না তো কী বলব মানুষের ব্যাপার? কোনও মানুষের এরকম হয় নাকি?

রজনীবাবু আতঙ্কিত গলায় বললেন, সে কী রে গণেশ, আমি ভেবেছিলাম, তোর সঙ্গে কথা বললে সাহস পাব। তুই তো দেখছি আরও ঘাবড়ে দিচ্ছিস। এই বিজ্ঞানের যুগে ভূতটুত আবার কী! তুই নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছিস!

কেন, ঠাট্টা করব কেন? অন্য লোকের ছেলেবেলা দেখতে পাওয়াটা কোন বিজ্ঞানের মধ্যে পড়ে? দাঁড়া, আমাকে একটু ভাবতে দে। আমার কাছে যখন এসেছিস, একটা কিছু করতে হবে। তোর ঘাড়ের ভূত ঝেড়ে নামাতে হবে।

কথা শেষ করে গণেশ হালদার থুম মেরে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। তারপর ড্রয়ার টেনে একটা কৌটো বের করে বললেন, নে, কয়েকটা কুচো নিমকি খা। আমি সবসময় কাছে কুচো নিমকির কৌটো রাখি। কিছু না-খেলে মাথা কাজ করবে না। নে ধর।

রজনীবাবু কথা না-বাড়িয়ে কয়েকটা নিমকি হাতে নিলেন, কিন্তু মুখে পুরতে পারলেন না। এই অবস্থায় পারবার কথাও নয়। গলা শুকিয়ে গেছে। এ কী ভীষণ বিপদের মধ্যে তিনি পড়লেন! ভূতের কথাটা তার মাথায় আসেনি। গণেশ ঢুকিয়ে দিল। সুপার ন্যাচারাল কথাটার মানে কী? বাস্তবের চেয়েও বেশি? যা ঘটছে তাকে শুধু বেশি বললে কম বলা হবে। মারাত্মক বেশি। ছেলেবেলায় দেশের বাড়িতে ভূতে ধরা শুনেছেন। আজকালকার দিনে আবার এরকম হয় নাকি? এখন মনে হচ্ছে, গণেশের কাছে আসাটা ঠিক হয়নি। পুলিশের মতো সাহসীরা এরকম ভূতেটুতে বিশ্বাস করে কে জানত!

গণেশ হালদার চোখ বুজে নিমকি চিবোতে লাগলেন। মিনিট পাঁচেক পর চোখ খুললেন। টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়লেন। হাসিহাসি মুখে বললেন, পেয়েছি। তোর মন থেকে ভূত ছাড়ানোর লোক পেয়ে গেছি। দেখলি তো, বললাম না, খেলে মাথা ঠিক কাজ করবে। সামান্য কটা কুচো নিমকিতেই কেমন কাজ দিল! আর চিন্তা নেই। সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।

হয়ে গেছে? রজনীবাবু উৎসাহের সঙ্গে বললেন।

হ্যাঁ, হয়ে গেছে। আমার মেজ পিসিমার এক ননদ থাকে কল্যাণী। ওদের চেনা একজন সাধুবাবা আছেন। আমি নিজে কখনও দেখিনি। তবে মিসেসের কাছে গল্প শুনেছি, সেই সাধুবাবা নাকি অনেক উদ্ভট সমস্যার সমাধান করতে পারেন। সেইজন্য ওঁর নামও উদ্ভটবাবা।

রজনীবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, শেষ পর্যন্ত সাধু!

গণেশ হালদার বিরক্ত হয়ে বললেন, কেন, সাধুতে তোর আপত্তি কীসের? তোর সমস্যাটাও তো উদ্ভট। আমি মিসেসের কাছে শুনেছি, উদ্ভটবাবার কাছে গিয়ে কে যেন বায়না করেছিল, আমাকে একটু লম্বা করে দিন গুরুদেব। উনি তাকে তিন সেন্টিমিটার লম্বা করে দিয়েছিলেন। ইনি নিশ্চয়ই ভূত তাড়ানোর কাজও পারবেন।

এসব তুই বিশ্বাস করিস? কাউকে কখনও লম্বা করে দেওয়া যায়?

গণেশ হালদার মুখ গম্ভীর করে বললেন, না, বিশ্বাস করি না। কিছু মনে করিস না রজনী, তোর ঘটনাও কি বিশ্বাস করা যায়? মানুষের জীবনটা তো আর ভিডিও ক্যাসেট নয় যে, ইচ্ছেমতো এগিয়ে পিছিয়ে দেখব। এবার তুই ভেবে দ্যাখ, কী করবি? এই নে, আমি ওই সাধুবাবার ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। তারপর তোর ব্যাপার। আমি চাই, তুই তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে ওঠ।

রজনীবাবু উঠে পড়লেন। সিদ্ধান্ত তাঁর নেওয়া হয়ে গেছে। আর যাই হোক, তিনি ভূতের ওঝার কাছে যেতে পারবেন না। সে বড় ঠাট্টার ব্যাপার হবে। মুখে কিছু বললেন না। গণেশ তাঁর মতো চেষ্টা করেছেন। ঠিকানা লেখা কাগজটা পকেটে পুরে বললেন, চলি গণেশ। তোর অনেকটা সময় নষ্ট করলাম।

গণেশ হালদার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, দ্যাখ রজনী, আমার মনে হয়, তোর সমস্যাটা যখন ভুতুড়ে, তখন ওঝা ধরনের কারও কাছে যাওয়াটাই তোর পক্ষে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আজকালকার দিনে ওঝাটকা পাওয়া খুব মুশকিল। একজনকে যখন পাওয়া গেছে, তার কাছে একবার চুপিচুপি গিয়ে দেখতে পারতিস। ক্ষতি তো কিছু নেই।

রজনীবাবু শুকনো হেসে বললেন, দেখি, পরে তোকে জানাব। যাওয়ার আগে তোর ওই চিমসে লোকটার সঙ্গে একবার দেখা করা যাবে নাকি? ওকে বলে যাই। লোকটা বেশ ইন্টারেস্টিং। হয়তো ওর সঙ্গে আর কোনওদিন দেখা হবে না।

চিমসে এই গরমে তেলচিটে একটা কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। শুয়ে পাশে-রাখা ট্রানজিস্টার চালিয়ে গান শুনছে। এটা ওর চুরি-করা ট্রানজিস্টার নাকি? ওদের দেখে ট্রানজিস্টার থামিয়ে, ধড়মড় করে উঠে এল।

গণেশ হালদার হাসতে হাসতে বললেন, এই যে চিমসে, তোমার সঙ্গে আমার বন্ধু দেখা করতে এসেছে। যাওয়ার আগে বলে যেতে চায় তোমাকে।

রজনীবাবু বললেন, চলি ভাই, যদি কখনও সুযোগ হয় আবার দেখা হবে।

গরাদের ওপার থেকে চিমসে হাত জোড় করে বলল, প্রণাম জানবেন স্যার।

রজনীবাবুর মাথাটা সামান্য দুলে উঠল। তিনি নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলেন। চোখের সামনে চিমসে ছোট হয়ে গেল! সাদা জামা, কালো প্যান্ট। পায়ে বুট জুতো। ঠিক যেন স্কুলের ইউনিফর্ম। একটা স্টেজের উপর দাঁড়িয়ে আছে চিমসে। ঠিক এইরকমভাবে হাত জোড় করা। পাশে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক। মুখ হাসিহাসি। হাতে একগাদা বই। বইয়ে লাল ফিতে বাঁধা। সেই বই তিনি এগিয়ে দিলেন ছেলেটার দিকে। মাইকে গমগম করে ভেসে এল—এখন বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার জন্য বিদ্যালয়ে প্রধানশিক্ষকের হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছে পঞ্চম শ্রেণির…।

লকআপের গরাদ ধরে নিজেকে সামলালেন রজনীবাবু। তিনি নিশ্চিত হলেন, গণেশ ঠিকই বলেছে। ভূত ছাড়া আর কিছু নয়। তাঁর মধ্যে ভূত ঢুকেছে। ছেলেবেলার ভূত।

রজনীবাবু প্রথমে ভেবেছিলেন, ভবানীপুরে যাবেন না। তারপর ঠিক করলেন, যাবেন। ন-গেলে গিন্নি সন্দেহ করতে পারে। সেটা বোকামি হবে। তার চেয়ে ঘুরে আসাটাই ভাল। এখন যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকতে হবে।

সুধাময়ীদেবীর দূর সম্পর্কের এক বোন থাকে হনলুলু। জামাইবাবু সেখানে বিরাট ব্যাবসা করেন। গত সপ্তাহে জামাইবাবু স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে দেশে এসেছেন মাত্র কয়েক দিনের জন্য। হাতে সময় খুবই কম। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে আলাদা আলাদা করে দেখা করা সম্ভব নয়। তাই আজ সন্ধেবেলা সকলকে নেমন্তন্ন করেছেন। ভবানীপুরে, সুধাময়ীদেবীর সেই হনলুলু-বোনের বাড়িতে সবাই যাচ্ছে।

রজনীবাবু ধুতি পরতে পরতে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার বলো তো সুধাময়ী? আমার যেন কেমন কেমন ঠেকছে। তোমার এই জামাইবাবু তো আগে কখনও আমাদের ডেকে খাওয়াননি। এমন নয় যে, এই প্রথম দেশে বেড়াতে এলেন। এর আগেও বহুবার এসেছেন। আজ হঠাৎ সকলের সঙ্গে দেখা করবার জন্য এত খেপে উঠলেন কেন? কোনও মতলবটতলব নেই তো?

সুধাময়ীদেবী রেগে গিয়ে বললেন, এ আবার কেমন কথা? বিদেশ থেকে এসে জামাইবাবু সকলকে খাওয়াবেন বলে ঠিক করেছেন। তাতে তোমার আপত্তি কীসের?

না, আপত্তি ঠিক নয়। তবে কিনা, উনি কখনও হাত থেকে পয়সা বের করেননি তো, তাই কেমন সন্দেহ হচ্ছে।

সন্দেহটা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। কৃপণ হিসেবে সুধাময়ীদেবীর এই জামাইবাবু খুবই নামডাক করেছেন। তবু আত্মীয় বলে কথা! সুধাময়ীদেবী বললেন, তোমার অত সন্দেহের কী আছে? জামাইবাবুর যে-মতলবই থাকুক, নেমন্তন্ন বাড়িতে সকলের সঙ্গে দেখা হবে সেটাই বা কম কীসের? কোথাও তো যাও না। শুধু বাড়ি আর অফিস, অফিস আর বাড়ি। চলোই না, সকলের সঙ্গে দেখা হলে ভাল লাগবে।

রজনীবাবু ভেবে দেখলেন, কথাটা সুধাময়ী খারাপ বলেনি। লোকজনের সঙ্গে দেখা হলে ভালই লাগবে। বিপদের কথাটা খানিকক্ষণ ভুলে থাকা যাবে।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরলেন রজনীবাবু। সুধাময়ীদেবী বললেন, ইস, অনেক টাকা খরচ হয়ে যাবে!

রজনীবাবু হেসে বললেন, হোক গে।

সুধাময়ীদেবী স্বামীর দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললেন, তোমার আজ হয়েছেটা কী বলো তো? অফিসের ব্যাগ খুলে দেখলাম, টিফিন খাওনি। যেরকম গুছিয়ে দিয়েছিলাম, সেরকমই ফিরিয়ে এনেছ। এখন আবার ট্যাক্সি চেপে বসলে? তোমার ব্যাপারটা কেমন কেমন ঠেকছে!

রজনীবাবু চমকে উঠলেন। সত্যি তো, টিফিনের কথাটা একেবারে ভুলে গিয়েছিলেন। ইস, খুব বোকামি হয়েছে। গণেশের ওখান থেকে বেরিয়ে টিফিনের একটা হিল্লে করে আসা উচিত ছিল। কোনও পার্কেটার্কে বসে চট করে খেয়ে নিলেই হত! বড় বোকামি হয়ে গিয়েছে। তিনি আমতা আমতা করে বললেন, আসলে কী জানো, আজ তোমার জামাইবাবুর নেমন্তন্ন বলেই টিফিনটা খেলাম না। খিদেটাকে বেশ জমিয়ে রাখতে হবে না?

সুধাময়ীদেবীর মুখ দেখে মনে হয় না, কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করছেন। বেশ কিছুক্ষণ তিনি রজনীবাবুর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন।

ভবানীপুরে পৌছে হনলুলু-জামাইবাবুর নেমন্তন্ন-রহস্য আরও জটিল হল।

আয়োজন একেবারে এলাহি। বাড়িতে আলোটালো লাগিয়ে একাকার কাণ্ড। খাবারের মেনু দুর্দান্ত। টেবিলের উপর থরে থরে সাজানো। ফিশফ্রাই থেকে শুরু করে কুলপি পর্যন্ত সব আছে। কানাঘুষোয় খবর পাওয়া গেল, হনলুলু স্পেশাল একটা আইটেমও তৈরি হচ্ছে। সেটা ঝালও হতে পারে, মিষ্টিও হতে পারে। আগে থেকে কিছু জানানো হচ্ছে না। গোপন রাখা হয়েছে। খাবার সময় পরিবেশন করে অতিথিদের নাকি চমকে দেওয়া হবে।

বাড়িতে ঢুকতেই সকলের হাতে একটা করে গোলাপ দেওয়া হল। ঠিক যেন বিয়েবাড়ি! দু’পা এগোতেই কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল সাজানো। পাশে গরম কফির ব্যবস্থা। যত খুশি খাও। হনলুলু-দিদি ঘুরে ঘুরে সব তদারকি করছেন। আপ্যায়নে যেন কোনও ত্রুটি না থাকে। বিদেশের জল-হাওয়ায় তিনি খুবই মোটা হয়ে গিয়েছেন। সেজেছেনও বিস্তর।

রজনীবাবু ঘাবড়ে গিয়ে সুধাময়ীদেবীকে ফিসফিস করে বললেন, ব্যাপারটা কী বলো তো? আমার কিন্তু নার্ভাস লাগছে।

সুধাময়ীদেবীর অবস্থাও একইরকম। ঘটনা দেখে ঘাবড়ে গেছেন তিনিও। বাকি আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবও যে স্বস্তি পাচ্ছেন এমন নয়। সকলেই বোকা বোকা মুখ করে হাসছে। একজন তো বলেই ফেলল, গিফ্ট আনা উচিত ছিল। কিন্তু কার জন্য আনা উচিত ছিল সেটাই তো বুঝতে পারছি না। জামাইবাবুকে তো দেখতে পাচ্ছি না! উনি গেলেন কোথায়? দেখলে একবার জিজ্ঞেস করতাম।

জামাইবাবুকে দেখতে না-পেলেও ভিড়ের মাঝখানে একটা চোয়াড়ে লোককে দেখতে পেয়ে রজনীবাবু চমকে উঠলেন। আরে, অসিত দত্ত না? হ্যাঁ, অসিতই তো! অফিসের পাজি অসিত সোফায় বসে বসে স্ট্র দিয়ে কোল্ড ড্রিঙ্কস খাচ্ছে। ও এখানে এল কী করে? হনলুলু-জামাইবাবুর দূর সম্পর্কের আত্মীয় নাকি? নাকি বন্ধুবান্ধব হবে? কেলেঙ্কারি কাণ্ড। দেখতে পেলেই পাজিটা এখনই এদিকে চলে আসবে। হয়তো সুধাময়ীর সামনেই জিজ্ঞেস করে বসবে, আরে রজনীদা যে, কখন এলেন? আজ অফিস যাননি কেন? শরীরটরির খারাপ নাকি? একেবারে সর্বনাশ হয়ে যাবে। একেই টিফিনের ব্যাপারটায় ধরা পড়ে আছেন, তারপরে যদি সুধাময়ী শোনে, অফিস যাননি, তা হলে যে কী ঘটবে কল্পনাও করা যাচ্ছে না। কী করবেন এখন? পেটব্যথা বলে বাড়ি চলে যাবেন? সেটাই বা কেমন দেখাবে! ছেলেমানুষি হয়ে যাবে।

নিজেকে লুকোনোর জন্য রজনীবাবু আড়াল খুঁজতে লাগলেন।

একটু পরেই উপর থেকে জামাইবাবু নেমে এলেন। তিনি আজ পরেছেন বাদামি রঙের ধুতি, কালো রঙের পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির গায়ে সাদা সুতোর কাজ। গদগদভাবে বললেন, সবাই যদি একটু ছাদে যান, খুব ভাল হয়। ছাদে একটা ছোট্ট গানবাজনার আয়োজন করেছি। গানবাজনা শেষ হলে খাওয়াদাওয়া করা যাবে।

সবাই যথেষ্ট খুশি হয়ে ছাদে চলল। খাওয়ার আগে গান খুবই ভাল জিনিস। খিদে বাড়ে। তা ছাড়া জামাইবাবুর কথা শুনেই বোঝা গেল, খাওয়ার আগে ছাদে যাওয়াটা আবশ্যিক। ইচ্ছে থাকুক আর না-ই থাকুক, যেতে হবেই। তবে খাওয়া জুটবে।

ছাদেও অনেক আলোর ব্যবস্থা। বসবার জন্য বড় বড় শতরঞ্চি। একেবারে সামনে একটা হারমোনিয়াম আর তবলা। অতিথিরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে শতরঞ্চিতে বসে পড়ল। সুধাময়ীদেবী ফিসফিস করে বললেন, ভালই হল। অনেকদিন ফাংশানে গিয়ে গান শোনা হয় না। চলো, সামনে গিয়ে বসি।

রজনীবাবু সাবধানে আছেন। নজর রেখেছেন অসিত দত্তর দিকে। বেশি সময় এ-বাড়িতে থাকা মানে ওর চোখে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি। তিনি বিরক্তির সঙ্গে বললেন, আবার গানবাজনা কীসের? তোমার জামাইবাবু তো ঝামেলায় ফেললেন দেখছি! গোড়াতেই সন্দেহ হয়েছিল। না না, সামনে বসে কাজ নেই। চলো, পিছনেই বসে পড়ি। একটু পরেই উঠে পড়ব।

সুধাময়ীদেবী গুছিয়ে বসতে বসতে বললেন, উঠে পড়ব কেন? তোমার উঠতে ইচ্ছে করলে ওঠো। নিশ্চয়ই বড় কোনও গায়কটায়ক আসবেন। জামাইবাবু যা বড় ব্যবস্থা করেছেন, তাতে তো মনে হচ্ছে, গায়কের ব্যাপারটাও বড় হবে। হ্যাঁগো, হনলুলুর কোনও শিল্পী নয় তো?

ভাগ্য খুবই খারাপ, অসিত দত্ত কাছাকাছিই এসে বসেছে। শুধু বসেছে না, ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দেখছেও। রজনীবাবু চিন্তিত হয়ে বললেন, রাখো তোমার হনলুলুর শিল্পী। এসব ফ্যাচাং হবে জানলে মোটেই আসতাম না।

শিল্পী সত্যি সত্যি হনলুলুর! তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং সুধাময়ীদেবীর হনলুলুনিবাসী বোন!

জামাইবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার স্ত্রী বেলাকে আপনারা সকলেই চেনেন। সে আপনাদের কয়েকটি গান গেয়ে শোনাবে। গত কয়েক বছর ধরে বেলা হনলুলুতে সংগীতচর্চায় বিশেষ মনোনিবেশ করেছে। ছেলেবেলা থেকেই ওর গানবাজনার প্রতি বিশেষ ঝোঁক। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদের গান গেয়ে অজস্র প্রশংসা কুড়িয়েছিল। হনলুলুতে বসে সেই গানকেই সে নিয়ে গেছে নিজের পথে। এবার সে নিজে গানের কথা লিখে, নিজেই সুর দিয়েছে। নিজেই সৃষ্টি করেছে নিজের গান। ওর বহুদিনের শখ ছিল, দেশে এসে আত্মীয়-বন্ধুদের সেই সৃষ্টি শোনায়। সেই শখ মেটাতেই আজকের এই ছোট্ট আয়োজন। আপনাদের সকলকে নিমন্ত্রণ।

হারমোনিয়াম বেজে উঠল। তবলা তাল ঠুকল। তবলায় বসেছেন জামাইবাবু নিজে। সবাই নড়েচড়ে বসল। রজনীবাবু বুঝতে পারলেন, পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। মাঝপথে উঠে পড়া যাবে না। তিনি কোনওরকমে দু’জনের আড়ালে গুটিসুটি মেরে বসে রইলেন। দূর থেকে খেয়াল রাখলেন অসিত দত্তর উপরে। দত্ত যেন দেখতে না-পায়।

গান শুরু হতেই একতলা থেকে ভেসে এল ফিশফ্রাই ভাজার গন্ধ। শ্রোতারাও মাথা নাড়তে শুরু করল। কেউ কেউ অতি উৎসাহে বলেও ফেলল, বাঃ, বাঃ। সেটা গানের তালে, না ফিশফ্রাইয়ের গন্ধে বোঝা গেল না। তবে গান দু’-এক লাইন এগোতে-না-এগোতেই মাথা নাড়া বন্ধ। সবাই এ ওর দিকে তাকাচ্ছে। এটা গান! এ তো ভয়ংকর! হনলুলু-বোন চোখ বুজে তারস্বরে চিৎকার করছেন। তাতে সুরই বা কোথায়, তালই বা কোথায়? এই সুর দিয়েছেন নিজে! কথাও যে ভাল করে বোঝা যাচ্ছে না! আসলে তেমন কোনও কথাই নেই। একটা লাইনই বারেবারে ফিরে আসছে ফাটা রেকর্ডের মতো—সাগর পেরিয়ে এসেছি আমি। সাগর পেরিয়ে এসেছি…।

এই আসার ফল যে কী মারাত্মক তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সকলে। এতক্ষণে বোঝা গেল, হনলুলু-জামাইবাবুর নেমন্তন্নর কারণ কী? কেনই বা এত খাতির-যত্ন। ভাল-মন্দ খাওয়ানোর ব্যবস্থাই কী উদ্দেশ্যে। সবটা জলের মতো পরিষ্কার হল। কেউ লুকিয়ে কানে আঙুল দিল। কেউ মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসল। একটা বাচ্চা ভয় পেয়ে কেঁদে উঠল। সেটাই স্বাভাবিক। বড়দেরই ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, বাচ্চা তো কাঁদবেই।

তবে শিল্পীর কোনও খেয়াল নেই। একটার পর একটা গেয়েই চলেছেন তিনি। থামার লক্ষণ নেই কোনও।

প্রতিটি গানের ফাঁকে সকলে জোরে হাততালি দিচ্ছে। না-দিয়ে উপায় নেই। প্রতিটা গানের শেষে নীচ থেকে এক-এক রকমের খাবারের গন্ধ ভেসে আসছে যে! প্রথমে ফিশফ্রাই। ফিশফ্রাইয়ের পর কড়াইশুঁটির কচুরি, তারপর চিকেন তন্দুরি, ইলিশ মাছের ভাপা, পুডিং। এমনকী আনারসের চাটনির গন্ধও পাওয়া গেল যেন। ব্যবস্থা মনে হচ্ছে এরকমই হয়েছে। একটা করে গান শেষ হবে, এক-একটা খাবারের গন্ধ পাওয়া যাবে! সকলে উসখুস করছে। এই গান-যন্ত্রণা কখন শেষ হবে?

শুধু শান্ত হয়ে বসে আছেন রজনীবাবু!

শুরুতে গুটিসুটি মেরে থাকলেও, এখন বসে আছেন সোজা হয়ে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে। সকলের চোখে বিরক্তি, তাঁর চোখে শুধু মুগ্ধ ভাব!

হারমোনিয়াম বাজিয়ে ওই যে ছোট্ট, রোগাপাতলা মেয়েটা গান করছে, ও কে? সুধাময়ীর দূর সম্পর্কের বোন না? তাই তো মনে হচ্ছে। মুখের গড়নটা ঠিক ওর মতোই! মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে মেয়েটা গাইছে, মোমের পুতুল মমির দেশের মেয়ে…। বাঃ, কী সুন্দর গাইছে! সুধাময়ীর হনলুলুর বোন ছেলেবেলায় এমন চমৎকার গাইত বুঝি? বিশ্বাসই হয় না। এত সুন্দর গলা, এত চমৎকার সুর কোথায় হারিয়ে গেল তার?

বাকিরা সকলেই যখন তাল কেটে যাওয়া বেসুরো গান শুনছে, রজনীবাবু তখন শুনতে পাচ্ছেন, একটা ছোট্ট মেয়ের মিষ্টি গলা, মেঘের কোলে রোদ হেসেছে…!

এ-বাড়িতে বাকি সময়টুকু রজনীবাবু একটা ঘোরের মধ্যে কাটালেন। খেতে খেতে সবাই গানবাজনার কত প্রশংসাই না করল। যে যত বেশি খেল সে তত বেশি প্রশংসা করল।

রজনীবাবু কিছুই শুনতে পেলেন না। এমনকী অসিত দত্তর রজনীদা, ও রজনীদা, বলে ডাকও তার কানে ঢুকল না।

বাড়ি ফেরবার সময় গোটা রাস্তাটা চুপ করে রইলেন।

রজনীবাবু ঘরে ঢুকে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। উদ্ভটবাবা কানের কাছে একটা ছোট্ট সাদা রঙের নরমুন্ডু নিয়ে বসে আছেন! একটু ধাতস্থ হতে বুঝতে পারলেন নরমুণ্ডুটা আসলে একটা মোবাইল ফোন। বাবাজি মোবাইল ফোনে কথা বলছেন।

টেবিলের এপাশে বসে কথা পুরোটা শুনতে পাচ্ছেন না রজনীবাবু। তবে ছেঁড়া ছেঁড়া যেটুকু ভেসে আসছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, কথা হচ্ছে গুড়ের ব্যাবসা নিয়ে। আখের গুড় না ভেলি গুড়, কোনটায় লাভ বেশি তাই নিয়ে আলোচনা চলছে।

গুড় নিয়ে আলোচনা করলেও বাবাজির পোশাক কিন্তু সাধুর মতো। পা পর্যন্ত টকটকে লাল রঙের পোশাক। মাথায় জটা। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। কানে বড় মাকড়ি। সামনের বিশাল চকচকে টেবিলের এক পাশে একটা কমণ্ডলু রাখা। অন্য পাশে একটা ল্যাপটপ কম্পিউটার। সেই কম্পিউটারের পরদায় অং, বং, চং ধরনের জটিল সব মন্ত্র ভেসে বেড়াচ্ছে। কথা শেষ হলে নরমুন্ডুটা টেবিলের উপর রেখে বাবাজি রজনীবাবুর দিকে তাকালেন।

ফাঁসফেঁসে গলায় বললেন, বাইরে সেক্রেটারির কাছে নাম লেখানো হয়েছে?

রজনীবাবু মাথা নাড়ালেন। বললেন, হ্যাঁ, হয়েছে।

প্রণামী দিয়েছেন?

রজনীবাবু আবার মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, দিয়েছি।

দাঁড়ান, একটু চেক করে নিই। কলিযুগে যে কত কাণ্ড হচ্ছে। গত সপ্তাহে এক দর্শনার্থী একশো টাকার নোট জমা দিয়ে কথা বলে চলে গেল। পরে দেখা গেল, সেই নোট জাল। কলিযুগে মানুষকে বিশ্বাস করা বড় কঠিন। মানুষের মধ্যে চোর প্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আমার মতো একজন নির্লোভ সাধুকে ঠকাতেও আজকাল আর হাত কাঁপে না। এই দেখুন না, ভেলি গুড়ের ব্যবসায় সামান্য কিছু অর্থ বিনিয়োগ করেছিলাম। লাভের অংশ নিয়ে এখন গোলমাল পাকিয়েছে। আমিও ছাড়ছি না। যাক, সাধু মানুষ, আমার সবই লাভ, সবই লোকসান। ভবতাং ভনিভা বিরহিয্যে তবচ্ছায়া। এই কথার মানে জানেন?

রজনীবাবু ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, না, জানি না।

বাবাজি শব্দ করে হাসলেন। সেই হাসির আওয়াজও ফ্যাঁসফেঁসে। বললেম, না-জানাটাই স্বাভাবিক। তারপরে পাশে ইন্টারকম তুলে নম্বর টিপলেন। সেক্রেটারিকে বললেন, বৎস্য, তুমি কি এই দর্শনার্থীর নোটটি পরীক্ষা করে নিয়েছ? নোট জাল নয় তো? বাঃ, সাধু, সাধু। তারপর রজনীবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার প্রণামী যথার্থ। এবার আপনি আপনার কথা বলতে পারেন। দাঁড়ান, কথা শোনার আগে এসি মেশিনটা একটু বাড়িয়ে নিই। বিষুবরেখার উপর সূর্যের তাপ বাড়ছে। অনিষ্ট মিষ্টং গরমং ত্রিবিধং কৰ্ম্মণঃ ফলং। এই কথার মানে জানেন?

রজনীবাবু আবার মাথা নেড়ে জানালেন, না জানেন না। বাবাজি ফের হাসলেন। কিন্তু মানে বললেন না। রিমোট টিপে এসি মেশিন বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, নিন, এবার আপনার কথা শুরু করতে পারেন। আবহাওয়া ঠান্ডা হয়েছে।

রজনীবাবুর বলতে ইচ্ছে করছে না। এখানে আসার পর থেকে তাঁর যেন কেমন লাগছে। সুবিধের ঠেকছে না। মনে হচ্ছে, কাজটা ঠিক হয়নি। না-এলেই ভাল হত। বাবাজির পাল্লায় পড়া কি উচিত হল? কাল রাতে ভবানীপুরের ঘটনায় নতুন করে ভয় পেয়ে গেলেন। গানের অনুষ্ঠান শুনতে শুনতেও যদি চোখের সামনে শিল্পীর ছেলেবেলা ভেসে আসে, তা হলে ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। বাড়ি ফিরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, গণেশের পরামর্শটাই একবার শুনে দেখবেন। সত্যি কথা বলতে কী, খানিকটা অসহায় হয়েই ঝোঁকের মাথায় আজ এখানে চলে এসেছেন।

কল্যাণী পৌঁছে জায়গা চিনতে অসুবিধে হয়নি। বাস থেকে নেমে রিকশা নিয়েছিলেন। বাবাজির বাড়ির বাইরে গ্লোসাইন বোর্ডে বড় বড় করে লেখা—

উদ্ভটবাবার আখড়া।
স্বল্প খরচে, যত্ন সহকারে বিভিন্ন সমস্যার
সমাধান করা হয়।
পরীক্ষা প্রার্থনীয়।

বাড়ির ভিতর ঢুকলে অবাক হতে হয়। বাবাজির আখড়া কোথায়? এ তো মনে হচ্ছে, কোনও বড় কোম্পানির অফিস! ঝাঁ-চকচক করছে।

কী হল, চুপ করে আছেন কেন? বলুন। বলতে শুরু করুন। বাইরে যে দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়ছে। দূরদূরান্ত থেকে তারা এসেছে। শুধু আপনাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেই তো হবে না। তাদের সেবাতেও আমাকে নিয়োজিত হতে হবে। দেরি করলে হবে কী করে?

অনিচ্ছা সত্ত্বেও রজনীবাবু ধীরে ধীরে তাঁর বিপদের কথা বলতে শুরু করলেন।

কথা যত এগোতে লাগল, সাধুবাবাজির চোখ তত বড় হতে লাগল। কথা শেষ হলে তিনি চোখ বুজে ফেললেন। ডাইনে, বাঁয়ে দুলতে লাগলেন। তারপর চোখ খুলে নিজের জটায় হাত বোলাতে লাগলেন। বোলাতে বোলাতে বললেন, অনাশ্রিতঃ কৰ্ম্মফলং কার্যস্য কৰ্ম্ম করোতি সঃ। এর মানে জানা আছে?

রজনীবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, না, জানি না।

গুড। কফি খাবেন? বাবাজি এমনভাবে ‘গুড’ বললেন, যেন না-জানাটা ভাল কোনও ব্যাপার।

রজনীবাবু আরও বিরক্ত হলেন। বললেন, না, খাব না।

খান। এক কাপ কফি খান। সঙ্গে চিকেন পকৌড়া খান।

এরপর বাবাজি রজনীবাবুর সম্মতির অপেক্ষা না-করে ইন্টারকম তুলে সেক্রেটারিকে কফি আর পকৌড়ার অর্ডার দিলেন। বললেন, আপনার কি বিশ্বাস হয় যে, সত্যি সত্যি আপনি মানুষের ছেলেবেলা দেখতে পাচ্ছেন?

রজনীবাবু খানিকটা ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, না, বিশ্বাস হয় না। মানুষ যেমন ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না, তেমনই অন্যের অজানা অতীতও দেখতে পায় না।

ও, তা হলে আপনি আমার কাছে এসেছেন কেন?

সত্যি কথা বলতে কী, আমি যে খুব আসতে চেয়েছিলাম, তা নয়। আমার এক বন্ধু আপনার কথা বলল। তাই চলে এলাম।

ভাল করেছেন। আপনার সেই বন্ধু আপনার কতটা উপকার করেছে জানি না, কিন্তু আমার উপকার করেছে।

রজনীবাবুর এসব কথা হেঁয়ালির মতো লাগল। তিনি সরাসরি কাজের কথায় এলেন। গলা ঝেড়ে বললেন, শুনেছি, আপনি নাকি অনেক উদ্ভট উদ্ভট সমস্যার সমাধান করেছেন। আমার এই সমস্যাটা কি আপনার উদ্ভট মনে হচ্ছে না?

উদ্ভটবাবা ফ্যাঁসফেঁসে করে হাসতে শুরু করলেন। হাসির দমকে মাথার জটা, কানের মাকড়ি দুলতে লাগল। একসময় হাসি থামিয়ে বললেন, হ্যাঁ, আপনার সমস্যা খুবই অদ্ভুত। কিন্তু আমি এর সমাধান করব না।

রজনীবাবু অবাক হয়ে বললেন, সমাধান করবেন না।

না, করব না। কেন করব না সেটা বলছি। কফি আর পকৌড়া এসে গিয়েছে, আগে খেয়ে নিন। জ্ঞাতং অময়া সকলস্য বেদভিরম্ব। মানে বুঝতে পারলেন?

রজনীবাবু এবার হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না। লোকটা যে সুবিধের নয় তা গোড়া থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। এখন আরও স্পষ্ট হচ্ছে। মাঝে মাঝে কীসব অং বং চং বলে ঘাবড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এক চুমুক খেয়ে কফির মগ সরিয়ে রাখলেন রজনীবাবু। এখানে কিছু খাওয়া ঠিক হবে বলে মনে হয় না। এবার মানে মানে চলে গেলেই হয়। একশো টাকা গচ্চা গিয়েছে, যাক।

বাবাজি নিজের হাতের পকৌড়াটার দিকে তাকিয়ে বললেন, রজনীবাবু, এবার কাজের কথায় আসা যাক। আপনি আমার সঙ্গে চলে আসুন। আমার এই চেম্বারেই আপনি বসবেন। সাজানো চেম্বার। এসি, টেলিফোন, টিভি সব আছে। কোনও অসুবিধে আপনার হবে না। চেম্বারের সঙ্গে অ্যাটাচড্ রেস্ট রুমও রয়েছে। কাজ করতে করতে ক্লান্ত লাগলে বিশ্রাম করে নেবেন। আগের যুগে সাধু, বাবাজিদের এসব লাগত না। এখন কলি যুগ, ঘোর কলি। ঘোর কলি যুগে একটু আরাম করলে ক্ষতি হয় না। আপনি শুরুতে বসবেন সপ্তাহে তিন দিন, পরে ভিড় বাড়লে চার দিন। আমি বলব ভবিষ্যৎ, আপনি বলবেন অতীত। আপনি বলবেন সমস্যা, আমি বলব সমাধান। এখন এক বাবাজির আখড়া রয়েছে, আপনি এলে ডবল বাবাজির আখড়া হয়ে যাবে। একেবারে জমজমাট আখড়া।

রজনীবাবু অবাক হয়ে বললেন, মানে! আপনি কি আমাকে সাধু হয়ে যেতে বলছেন নাকি?

সাধুবাবাজি ঝুঁকে পড়ে বললেন, হ্যাঁ, তাই বলছি। আপনার নাম হবে ছোটবাবাজি। ছেলেবেলা দেখতে পারেন বলেই ছোটবাবাজি। আপনার কোনও চিন্তা নেই, পাবলিসিটির খরচ আমার। প্রণামীটা একটু চড়ার দিকে রাখব। এই ধরুন, পার হেড দেড়শো টাকা। আমার একশো, আপনার পঞ্চাশ। আচ্ছা, ঠিক আছে, আপনি দশ টাকা আরও বেশি নেবেন।

লোকটা বলছে কী? তাকে সাধু বানিয়ে দিতে চাইছে! এ তো ডেঞ্জারাস লোক। বিপদ কমাতে এসে বিপদ যে আরও বেড়ে গেল!

রজনীবাবু আমতা আমতা করে বললেন, আপনি কী বলছেন ঠিক বুঝতে পারছি না।

উত্তেজনায় বাবাজির চোখ চকচক করছে। বললেন, আপনাকে কিছু বুঝতে হবে না। আমার মতো পোশাক পরবেন। একটা ফল্স জটা, গলায় মালা, কানে মাকড়ি। তার সঙ্গে কয়েকটা মন্ত্রতন্ত্র মুখস্থ করিয়ে দেব। সেই মন্ত্রের মানে আমি যেমন জানি না, আপনিও জানবেন না। বিপদে পড়ে যারা এখানে ছুটে আসবে, তারাও জানবে না। কিন্তু শুনে ঘাবড়ে যাবে। ব্যস, তাতেই ব্যাবসা গড়গড়িয়ে চলবে। এই দেখুন, আমার জটাটাও কেমন ফল্স, মিথ্যে।

এই বলে সাধুবাবাজি সত্যি সত্যি নিজের মাথা থেকে জটা খুলে ফেললেন। মাথায় তেল দেওয়া কাঁচা-পাকা চুল পাট পাট করে আঁচড়ানো।

রজনীবাবু ভাবছেন, কীভাবে পালাবেন। ছুটে পালানোটা কি ঠিক হবে? এ-ধরনের লোকের হাতে নিশ্চয়ই গুন্ডা-বদমাশ থাকে। তারা ধরে ফেলবে না তো?

বাবাজি ফ্যাঁসফ্যাঁস করে হাসতে হাসতে বললেন, ভয় পাবেন না। ঝামেলাটামেলা সব আমার লোকজনই সামলাবে। ঝামেলা সামলাতে ওরা দারুণ ওস্তাদ। আপনি এখন আমাদের দলের লোক, তাই বলতে অসুবিধে নেই। আমার চেলা-চামুণ্ডাদের মধ্যে অন্তত তিন জন জেল-পালানো কয়েদি আছে। আপনার মতো একজন গুণীকে সঙ্গে পেয়ে আমরা গর্বিত।

এরকম একটা ভয়ংকর সময় রজনীবাবু উদ্ভটবাবাজির ছেলেবেলা দেখতে পেলেন!

অন্ধকার রাত। ছেলেটা এত রাতে বাড়ির বাইরে কী করছে? রজনীবাবু মন দিয়ে দেখতে চেষ্টা করলেন। অন্ধকারে ভাল দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে আজ অমাবস্যা। মন দেওয়ার চারপাশ কিছুটা স্পষ্ট হল। ছেলেটার গায়ে চপচপে তেল। মালকোঁচা দিয়ে ধুতি পরা। কিন্তু হাতে ওটা কী? সিঁধকাঠি না! তাই তো! ঠিক যেমন চোরদের সঙ্গে থাকে! চারপাশ দেখে নিয়ে এবার দেওয়ালের গায়ে সিঁধ কাটতে শুরু করল ছেলেটা। আওয়াজ হচ্ছে ঠং ঠং ঠং…।

গরমকালের দুপুরে ময়দানের এই দিকটা ফাঁকা থাকে। রজনীবাবু একটা গাছের তলায় বেঞ্চে এখন বসে আছেন।

বাবাজির হাত থেকে কীভাবে রক্ষা পেলেন পুরোটা মনে পড়ছে না রজনবাবুর। শুধু এইটুকু মনে পড়ছে, দু’দিন পরে এসে কথা পাকা করব বলে কোনওরকমে বেরিয়ে এসেছিলেন। বড় রাস্তায় পৌঁছে সামনে যে বাসটা দেখেছিলেন, উঠে পড়েছিলেন তাতেই। ভাগ্যিস, বাসটা কলকাতার দিকেই আসছিল। ময়দানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলেন, মোটে দুপুর তিনটে। এই দুপুরে বাড়ি ফিরলে সুধাময়ীর হাজার প্রশ্নের সামনে পড়তে হবে। তাড়াহুড়ো করে নেমে পড়লেন বাস থেকে। নেমে খেয়াল হল, হাতের ছাতাটা ফেলে এসেছেন।

যাক গে, সামান্য ছাতার জন্য চিন্তা করে লাভ নেই। যে-বিপদে আজ পড়েছিলেন, তার কাছে ছাতা অতি তুচ্ছ বিষয়। প্রাণ নিয়ে যে ফিরতে পেরেছেন সেটাই অনেক। এখনও শরীর কাঁপছে। কে জানে, লোকটা হয়তো ধরেবেঁধে সাধু বানিয়ে ছাড়ত। লাল পোশাক পরে, মাথায় জটা নিয়ে ফিরতে হত। উফ, জোর বেঁচে গিয়েছেন।

কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না। নিজের ভিতরের বিপদটা সারাতে না-পারলে, এরকম ঘটনা একটার পর-একটা ঘটতেই থাকবে। আজ না হয় পালিয়ে বাঁচলেন! তাই বলে রোজ যে পালাতে পারবেন তার কোনও ঠিক নেই। না, ডাক্তারের কাছে যাওয়াটাই উচিত। কিন্তু কোন ডাক্তারের কাছে যাবেন? চোখের ডাক্তার? নাকি মাথার ডাক্তার? ছোট দেখার ভুলটা কে করছে? চোখ না মাথা? ভাবতে হবে, মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে হবে।

মাথা ঠান্ডা করে ভাবা হল না। পাঁচ মিনিট যেতে-না-যেতেই কোথা থেকে একটা মাঝবয়সি লোক সামনে এসে হাজির। মুখ-ভরতি গোঁফদাড়ি, গায়ে ছেঁড়া জামাকাপড়। বোটকা গন্ধও আসছে। ভিখিরি নাকি? উফ, কোথাও যে শান্তিতে দু’মিনিট বসে চিন্তাভাবনা করবেন তার উপায় নেই। রজনীবাবু বিরক্ত হলেন। এবার নিশ্চয়ই লোকটা ভিক্ষেটিক্ষে চেয়ে জ্বালাতন করবে। রজনীবাবু অন্যদিকে মুখ ঘোরালেন। তবে তাতে কোনও লাভ হল না। লোকটা এক পাশে বসে পড়েছে। ভুরু কুঁচকে উঠে পড়লেন রজনীবাবু। না, অন্য কোনও দিকে বসা যাক। মুখ ঘুরিয়ে কড়া চোখে তাকালেন একবার। লোকটা হাসল না? হ্যাঁ, হাসলই তো! সাহস তো কম নয়। নিশ্চয়ই কোনও ফন্দিটন্দি আছে। রজনীবাবু পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিলেন। না, মানিব্যাগ ঠিক আছে। বিপদ যখন আসে তখন একের পর এক আসতেই থাকে। বাবাজির আখড়ায় একশো টাকা আর ছাতা চলে গেছে। এবার মানিব্যাগটা না পকেটমারের হাতে চলে যায়। লোকটা খুব সন্দেহজনক। একেই তো গায়ের উপর এসে বসল। তার উপর আবার হাসে।

রজনীবাবু দু’পা এগোতেই লোকটা বলে উঠল, যা বাবাঃ, চলে যাচ্ছেন? আপনাকে দেখেই তো এদিকে এলাম। আর আপনিই চললেন স্যার?

রজনীবাবু অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, আমাকে বলছেন?

লোকটা একগাল হেসে বলল, যদি কিছু মনে না-করেন, তা হলে একটা প্রশ্ন করতে পারি স্যার?

রজনীবাবু সাবধান হলেন। খারাপ মতলবের লোকেরা সব সময়ই আগে হেসে আলাপ করে। জামার পকেট আরও শক্ত করে চেপে ধরলেন রজনীবাবু। বললেন, বলুন, কী বলবেন?

আপনার স্যার, দুপুরের খাওয়া হয়েছে? লাঞ্চ?

রজনীবাবু খেয়াল করলেন, মতলব যতই খারাপ হোক, মানুষটার হাসিটা কিন্তু সুন্দর। কেমন যেন অন্যরকম। একবার দেখলে আর-একবার দেখতে ইচ্ছে করে।

রজনীবাবু ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, হ্যাঁ, হয়েছে। কেন বলুন তো?

লোকটা আবার হাসল। বলল, না, তেমন কোনও কারণ নেই। এমনই বললাম। আচ্ছা স্যার, আসুন। আপনার দেরি করিয়ে দিলাম বলে দুঃখিত।

রজনীবাবু চলে যেতে যেতে পিছন ফিরে দেখলেন, বেঞ্চে পড়ে-থাকা শুকনো পাতা সরিয়ে লোকটা শুয়ে পড়বার তোড়জোড় করছে। তাঁর হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আরে, ব্যাগে টিফিনটা রয়ে গিয়েছে না? তাই তো! সর্বনাশ, একদম মনে ছিল না! আজও যদি টিফিন বাড়িতে ফেরত যেত তা হলে আর দেখতে হত না। চিৎকার করে সুধাময়ী বাড়ি মাথায় তুলত। লোকটাকে দিলে কেমন হয়? তিনি নোংরা জামার লোকটার কাছে এলেন।

আপনি কিছু খাবেন? খিদে পেয়েছে আপনার?

খাবারের কথা শুনে লোকটার চোখ চকচক করে উঠল। বলল, কেন, খাওয়াবেন নাকি স্যার?

ভিখিরি লোকটা সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চে বাবু হয়ে বসে রজনীবাবুর টিফিন খাচ্ছে। আজ সুধাময়ীদেবী টিফিন একটু বেশির দিকেই দিয়েছেন। লুচি, আলুর দম। সঙ্গে দরবেশও আছে। লোকটা মনে হয় দরবেশ জিনিসটি অনেকদিন খায়নি। নইলে এতবার তুলে তুলে দেখবে কেন?

রজনীবাবু একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি খাওয়া দেখছেন। তবে এই খাওয়া নয়, অন্য এক খাওয়ার দৃশ্য দেখছেন তিনি!

গ্রামের বাড়ি। মাটির দাওয়া। দাওয়ায় চার-পাঁচটা ছেলেমেয়ে পিঁড়ি পেতে খেতে বসেছে। বয়স খুব বেশি হলে আট থেকে দশ বছরের মধ্যে। তাদের সামনে থালা। থালায় ভাত। ছেলেমেয়েগুলো মহাআনন্দে সেই ভাত খাচ্ছে আর পাশে রাখা আস্ত আস্তে পেঁয়াজ তুলে কামড় দিচ্ছে, কচকচ। পান্তা ভাত নাকি? মনে হচ্ছে, এরা ভাইবোন, আর খুব দুষ্টু। খাচ্ছে, আর একজন অন্যজনকে খ্যাপাচ্ছে। সকলেই খুব হাসছে। মাঝে-বসা ছেলেটা হাসছে বেশি, খাচ্ছেও বেশি। রজনীবাবু খেয়াল করে দেখলেন, এই ছেলেটার হাসিটা কেমন যেন অন্যরকম। একবার দেখলে আবার দেখতে ইচ্ছে করে!

রজনীবাবুর শরীর কেঁপে উঠল। মনে হচ্ছে, এখনই ঝেঁপে জ্বর আসবে। তিনি টিফিন বাক্সর কথা ভুলে গেলেন। হনহন করে হাঁটতে শুরু করে দিলেন রেড রোডের দিকে। ওখানে গেলে নিশ্চয়ই বাড়ি ফেরার জন্য একটা ট্যাক্সি পাওয়া যাবে।

রজনীবাবু ট্যাক্সির সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন।

ধুম জ্বর নিয়ে বাড়ি ঢুকেছেন রজনীবাবু। সোজা চলে গেছেন বিছানায়।

সুধাময়ীদেবী উদ্বিগ্ন হয়ে লাফালাফি শুরু করে দিলেন, কী হল তোমার? মাথা ব্যথা করছে? গা বমি বমি? এক গেলাস লেবুর শরবত খাবে? ও মা, গা যে পুড়ে যাচ্ছে। আমি এখনই উপরে গিয়ে রমাকে টেলিফোন করছি। অবিনাশবাবুকে ডেকেও আনি। মাথায় জল ঢালতে হবে যে!

রজনীবাবুর খুব ইচ্ছে করল, বলেন, কাউকে খবর দিতে হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

বলতে পারলেন না। কথা বলবার মতো অবস্থা তাঁর শরীর বা মনের নেই। তিনি কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। গভীর ঘুম। সেই ঘুম ভাঙল সন্ধের মুখে।

রজনীবাবু যখন ভাক্তারের কাছে গেলেন, তখন গায়ে জ্বর নেই বটে, তবে শরীর দুর্বল। ডাক্তার মান্না প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বললেন, জ্বর কমানোর আর একটা ঘুমের ওষুধ লিখে দিলাম। রাতে শোবার আগে খেয়ে নেবেন।

আমার কী হয়েছে ডাক্তারবাবু?

ডাক্তার মান্না চমৎকার মানুষ। রোগীকে খুব ভরসা দিতে পারেন। তাতেই আদ্দেকটা অসুখ সেরে যায়। তখন বাকি আদ্দেকটার জন্য ওষুধ দেন।

একটু আগেই তিনি গভীর মনোযোগের সঙ্গে রজনীবাবুর ভয়ংকর বিপদের ঘটনা শুনেছেন। রজনীবাবু সবটাই বলেছেন, শুধু বাদ দিয়েছেন, উদ্ভটবাবাজির অংশটুকু। বলতে লজ্জা করছে। এরকম একটা বিজ্ঞানের যুগে খুঁজেপেতে একজন ভূতের ওঝার কাছে চলে যাওয়াটা খুবই লজ্জার বিষয়। এটা কাউকে বলা যায় না।

ডাক্তারবাবু হেসে বললেন, মনে হচ্ছে না, কিছু হয়েছে। টেনশনে মানুষ অনেকসময় উলটোপালটা ভাবে। সেই ভাবনা থেকে এমন কিছু দেখতে পায়, যেগুলো আসলে সত্যি নয়। আপনার সেরকমই একটা কিছু হয়েছে। অফিসে নিশ্চয়ই কাজের চাপ বেড়েছে। ছুটি নিয়ে দুটো দিন রেস্ট নিন। দেখবেন, আর হবে না। বড়কে বড়ই দেখবেন। তবে আরও আগে আমার কাছে এলে ভাল করতেন।

রজনীবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। কথাটা সত্যি। আগেই আসা উচিত ছিল। যাই হোক, বেটার লেট দ্যান নেভাব। বললেন, ডাক্তারবাবু, সব ঠিক হয়ে যাবে তো।

নিশ্চয়ই হবে। আচ্ছা, আপনার শেষ ইনসিডেন্টটা কখন ঘটেছে? আজ দুপুরে পার্কে ভিখিরির ঘটনাই তো শেষ? তারপর তো আর কাউকে ছোট অবস্থায় দেখতে পাননি?

পেয়েছি, তার পরেও দেখতে পেয়েছি।

ডাক্তার মান্না একটু অবাক হলেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, তার পরেও পেয়েছেন।

একটু আগে যখন আপনার কাছে আসব বলে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি, তখন আবার ঘটল। আমার বাড়িওলা অবিনাশবাবু স্ত্রীর কাছে অসুস্থতার খবর পেয়ে আমাকে দেখতে এসেছিলেন। বৃদ্ধ মানুষটি বড় ভাল। একা থাকেন। এমন মানুষ আজকাল খুব বেশি দেখা যায় না ডাক্তারবাবু। কতবার ভাড়া দিতে দেরি করে ফেলেছি, কোনওদিন মুখ ফুটে কিছু বলেননি। উলটে বলেছেন, থাক না, সময় সুযোগ হলে দিয়ে। বছর কয়েক হল, উনি কঠিন অসুখে ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারেন না। বাড়ি থেকে বেরোতে পারেন না। তবু দোতলা থেকে লাঠি হাতে কষ্ট করে আমাকে দেখতে এলেন। ওঁর সঙ্গে দু’-একটা কথা বলবার পরই হঠাৎ দেখতে পেলাম।

কী দেখতে পেলেন?

রজনীবাবু মাথা নামিয়ে অন্যমনস্কভাবে বললেন, দেখলাম, বৃদ্ধ মানুষটি সাত-আট বছর বয়সের হয়ে গেছেন। মাঠ দিয়ে পাঁইপঁই করে দৌড়োচ্ছেন, ইচ্ছেমতো পাঁচিল টপকাচ্ছেন, পেয়ারা গাছে উঠে পড়ছেন তরতর করে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। যে-মানুষটা একসময় এত লাফিয়ে ঝঁপিয়ে বেড়াতেন, তিনি এখন একেবারে ঘরবন্দি।।

ডাক্তারবাবু চেয়ারে হেলান দিলেন। বললেন, আচ্ছা রজনীবাবু, আপনি কি ইচ্ছেমতো কারও ছেলেবেলা দেখতে পাবেন? এই ধরুন, আমার ছেলেবেলা। আমার ছেলেবেলা দেখতে চাইলে দেখতে পাবেন আপনি?

না, পাব না। ঘটনাগুলো নিজের মতোই ঘটছে। ইচ্ছেমতো ভেসে উঠছে চোখের সামনে। আমার কোনও হাত নেই।

টেলিফোন বেজে উঠল। ডাক্তার মান্না বেশ খানিকটা সময় ধরে টেলিফোনে কথা বললেন, কথা শেষ হলে রজনীবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, যদি আপনি ইচ্ছেমতো কারও ছেলেবেলা দেখতে পান, তা হলে একটা সুবিধে হত। তখন তাকে জিজ্ঞেস করে মিলিয়ে দেখা যেত, সেটা সত্যি কিনা। আর-একটা কাজও করা যায়। এরপর যদি কখনও এরকম ঘটে, আপনি যার ছেলেবেলা দেখতে পেলেন, তাকে সরাসরি ঘটনাটা বলবেন। জানতে চাইবেন, সত্যি সত্যি তার জীবনে এরকম কোনও ঘটনা ঘটেছিল কিনা। আমার স্থির বিশ্বাস, দেখা যাবে, ঘটনা মিলছে না। যাক, আপনি চিন্তা না-করে বাড়ি যান রজনীবাবু। ক’টা দিন বিশ্রাম করুন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। আমি একটা ভিটামিন ক্যাপসুল দিয়ে দিচ্ছি। নিজের মনকে শক্ত করুন! এটাই আসল। ভাবুন, কারও ছেলেবেলা কিছুতেই দেখব না। দেখবেন, সমস্যা মিটে গেছে।

বাড়ি ফেরার সময় রজনীবাবুর মনটা খচখচ করতে লাগল। শুধু বাবাজির ঘটনা নয়, ডাক্তার মান্নার কাছে তিনি আরও একটা জিনিস লুকিয়েছেন। উনি যখন টেলিফোনে কথা বলছিলেন, তখন দেখতে পেয়েছেন, একটা ছেলে হারিকেনের আলো জ্বেলে দুলে দুলে পড়ছে। ছেলেটার চুল ডাক্তার মান্নার মতোই খোঁচা খোঁচা। কথাটা ডাক্তারবাবুকে বলতে সাহস হয়নি। যদি তিনি বলতেন, হ্যাঁ, ঘটনা সত্যি। ছেলেবেলায় অনেক অভাবের মধ্যে থেকে কষ্ট করে লেখাপড়া শিখে বড় হতে হয়েছে আমাকে।

তা হলে কী হত!

সুধাময়ীদেবী যা করবার তা করে ফেলেছেন। বারণ করা সত্ত্বেও তিনি রজনীবাবুর অসুখের খবর যতটা পেরেছেন, প্রচার করেছেন। প্রতিবেশীদের বলেছেন, বাড়িওলার ঘর থেকে টেলিফোন করে ভবানীপুরের হনলুলু-জামাইবাবুকে জানিয়েছেন, মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে টেলিফোন করেছেন। মেয়ের ফোন ছাড়ার পর মনে পড়েছে, ছাতা হারানোর কথাটা মনে করে বলা হলেও, টিফিন বাক্স হারানোর কথা তো বলা হল না। অন্যের বাড়ি থেকে ফোন করছেন, টিফিন বাক্সর জন্য তো আবার ফোন করা যায় না।

টেলিফোনে রমা তার মায়ের কথার পুরোটা বুঝতে পারেনি। শুধু জ্বরটুকু বুঝেছে। কিন্তু ছেলেবেলা, বড়বেলার অংশটা তার একেবারেই মাথায় ঢোকেনি। রমা প্রশ্ন করলেও সুধাময়ীদেবী তেমন কোনও উত্তর দিতে পারেননি। কারণ, বিষয়টা তিনিও বুঝতে পারছেন না। তবে মনে হয় না, বড় কোনও ব্যাপার। কর্তা যখন তাঁকে এসব অদ্ভুত কথা বলছিলেন, তখন তাঁর গায়ে খুব জ্বর। জ্বরে মানুষ ভুল বকে। তাঁর স্বামীও বকেছেন। তবে ঝুঁকি নেননি। রমাকে বলেছেন, দেরি না-করে এখনই যেন চলে আসে। এরকম রোগী একা সামলানো সম্ভব নয়।

মায়ের কথামতো রমা চলে এসেছে। সঙ্গে তার ছ’বছরের ছেলে বিল্টুও এসেছে।

ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে মেয়ে এবং নাতিকে দেখে রজনীবাবু খুশি হলেন। ভাক্তারবাবু কিছু হয়নি বলেছেন শুনে মা-মেয়ে নিশ্চিন্ত। তারা দু’জনে তখনি মোচার ঘণ্টর রন্ধনপ্রণালী নিয়ে জোর আলোচনা শুরু করে দিল।

ঘণ্টা দুয়েক কেটে গিয়েছে, সত্যি রজনীবাবুর আর জ্বর আসেনি। খিদে খিদেও পাচ্ছে। বিন্টুর সঙ্গে তাকেও খানকতক গরম লুচি দেওয়া হয়েছে। লুচির সঙ্গে কাঁচালঙ্কা দেওয়া ঝলঝাল আলুর দম। চমৎকার লাগছে। তিনি খাটের উপর আরাম করে বসে নাতির সঙ্গে লুডো খেলতে শুরু করলেন। গায়ে একটা হালকা চাদর। চাদর না-দিলেও চলত। দুধাময়ীদেবী রাগারাগি করবেন বলে দিয়ে রেখেছেন। বিল্টুর সঙ্গে লুডো খেলার একটা কঠিন শর্ত আছে। খেলার অবস্থা যাই হোক কেন, শেষ পর্যন্ত তাকে জেতাতেই হবে।

ঝালের চোটে বিন্দু বারবার নাক টানছে। দু’বার নাক টেনে বলল, দাদু, তোমার নাকি ছেলেবেলা-অসুখ হয়েছে?

নাতির কথা শুনে রজনীবাবু হেসে ফেললেন, ছেলেবেলা-অসুখ! সেটা কী জিনিস বিল্টবাবু?

সেটা আমি জানি না। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা-ও বলল, জানে না। শুধু বলল, তোমার দাদু বড় বড় লোকদের ছেলেবেলাগুলো সব দেখে ফেলছেন। সত্যি দাদু, তুমি সকলের ছেলেবেলা দেখতে পাচ্ছ?

রজনীবাবু বললেন, না, দেখছি না। ডাক্তারবাবু বলেছেন, সত্যি নয়, মনের ভুল। আমিও জানি সত্যি নয়।

বিল্টু মুখে চুকচুক আওয়াজ করে বলল, ইস, সত্যি হলে খুব মজা হত। আমি তোমার কাছ থেকে অসুখটা নিয়ে নিতাম, তারপর বসে বসে আমিও সকলের ছেলেবেলা দেখতাম। দিদিমণি, বাবা, মা, এমনকী, তোমার ছেলেবেলাও দেখতাম। হি, হি, খুব মজা হত। তাই না?

রজনীবাবু অবাক হয়ে বললেন, মজা হত! কেন, মজা হত কেন? এর মধ্যে মজার কী পেলে বিল্টু? আমি তো ভয়ানক ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ভয় পেয়েছিলাম প্রচণ্ড। যদি অসুখটা না সারে!

বিন্টু লাল ঘুঁটি তিন ঘর এগিয়ে দিয়ে বলল, আমি কিন্তু ভয় পেতাম না। পরীক্ষা করে দেখতাম, বড়রা ছেলেবেলায় যা শিখেছেন, যা করেছেন, সেগুলো সব তাঁদের মনে আছে কিনা!

সেটা কেমন জিনিস? রজনীবাবু আরও অবাক হয়ে গেলেন।

এই ধরো, মাকে সতেরোর ঘরের নামতা ধরতাম। তারপর ধরো, তোমাকে লেকে নিয়ে গিয়ে বলতাম, জলের মধ্যে ঢিল ছুড়ে ব্যাঙাচি খেলা করো তো। দেখি, কেমন মনে আছে। তা ছাড়া দেখতাম, বড়রা ছেলেবেলায় কেমন ভূতের ভয় পেতেন। দারুণ হত! হি হি।

রজনীবাবু চুপ করে গেছেন। এই মুহূর্তে তিনি বিন্দুর কোনও কথা আর শুনতে পাচ্ছেন না। চারপাশের সবকিছু যেন এক মুহূর্তের জন্য ভ্যানিশ হয়ে গেল। তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, একটা ছেলে চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাহসী একটা ছোট ছেলে। সে অন্ধকারকে ভয় পাচ্ছে না। ভূত দেখবে বলে রাতের অন্ধকারে পা টিপে টিপে ছাদে উঠে যাচ্ছে। আরে! পুঁচকে ছেলেটার শেখবার ইচ্ছেও তো অনেক। শিখবে বলে কী কাণ্ডই না করছে! ওই তো, ছেলেটা খাটের তলায় বসে লুকিয়ে লুকিয়ে বাবার টেবিল ঘড়িটা খুলে ফেলেছে! ঘড়ি তৈরি শিখবে নাকি? সাহস তো খুব!

ছেলেটাকে খুব চেনা চেনা লাগছে রজনীবাবুর। ছেলেটা কে? কে ছেলেটা?

বিল্টু ডাকল, দাদু, ও দাদু, কী হল? অমন থম মেরে গেছ কেন? কী হয়েছে তোমার! খেলবে না?

লুডোর বোর্ডে ছক্কা ফেলতে ফেলতে রজনীবাবু মুচকি হেসে বললেন, না, কিছু হয়নি। আমি চিনতে পেরেছি।

বিল্টু অবাক হয়ে বলল, কাকে চিনতে পেরেছ?

রজনীবাবু চোখ নাচিয়ে বললেন, সে আছে একজন। এইমাত্র তাকে চিনতে পেরেছি। নে খেল!

সকালে ঘুম ভাঙতেই রজনীবাবু বুঝতে পারলেন, শরীর একেবারে ঝরঝরে। দুর্বলতার লেশমাত্র নেই। মনটাও হালকা লাগছে। ডাক্তার মান্নার ওষুধ খুব ভাল কাজে দিয়েছে। তিনি বিছানা ছেড়ে চট করে উঠে পড়লেন। এখনও কেউ ওঠেনি। না উঠুক। মা আর মেয়ে নিশ্চয়ই অনেক রাত পর্যন্ত জেগে গল্প করেছে। নিজেই রান্নাঘরে ঢুকে ঝটপট চা বানিয়ে, কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন রজনীবাবু।

বাঃ, আজকের সকালটা চমৎকার। ফুরফুরে একটা হাওয়া দিচ্ছে। সে-হাওয়া না ঠান্ডা, না গরম। বাড়ির সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটায় ফুল আসছে। পাতার ফাঁকে একটা লাল লাল ভাব। মনে করে বিল্টুকে দেখাতে হবে। গাছে ফুল ফোটা দেখা একটা মজার ব্যাপার।

চা শেষ করে রজনীবাবু বাজারের থলি হাতে বেরিয়ে পড়লেন। নাতির জন্য আজ ভাল-মন্দ বাজার করতে হবে। আর হ্যাঁ, ভাল দেখে একটা মোচা চাই। মা-মেয়ে দু’জনেই চমকে যাবে। কাল যে তিনি মা-মেয়ের মোচার ঘন্টর আলোচনা শুনে ফেলেছেন, সে-কথা তো ওরা জানে না।

মনের মতো গুছিয়ে বাজার করলেন রজনীবাবু। মোচা কেনার সময় ঘোষবাবুর সঙ্গে দেখা। অন্যদিন হলে উলটো দিকে পালাতেন। আজ রজনীবাবু এগিয়ে গিয়ে বললেন, ভাল আছেন?

ঘোষবাবু ভুরু কুঁচকে ঝগড়ার ঢঙে বললেন, হঠাৎ এ-কথা কেন রজনী? রোজই তো দেখা হয়, কোনওদিন তো জানতে চাওনি ভাল আছি কিনা! আজ হঠাৎ কেন চাইছ? মতলবটা কী বলো তো!

বোঝা যাচ্ছে, বাজারে এসে ঘোষবাবু ঝগড়ার মেজাজে আছেন। রজনীবাবু গায়ে মাখলেন না। হেসে বললেন, যতই ঝগড়া করুন না কেন ঘোষবাবু, আসলে আপনি একজন শান্তশিষ্ট মানুষ। আমি সে-কথাটা কিন্তু জেনে গিয়েছি। ভাল থাকবেন।

চোখ বড় হয়ে যাওয়া ঘোষবাবুকে আর কথা বলবার সুযোগ না দিয়ে রজনীবাবু এগিয়ে গেলেন। টেলিফোনের বুথ থেকে একটা ফোন করতে হবে। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় মনে করে নম্বর নিয়ে এসেছেন। বুথে ঢুকে গণেশ হালদারের নম্বর টিপলেন।

গণেশ মনে হয়, দাঁত মাজতে মাজতে ফোন ধরল। প্রতিটা কথার শেষে একটা গপগপ ধরনের আওয়াজ হচ্ছে।

রজনী! এত ভোরে কী ব্যাপার রে? আবার কিছু ঘটেছে নাকি?

না না, কিছু ঘটেনি। মনে হচ্ছে না, আর কিছু ঘটবে। তোকে একটা খবর দিতে ফোন করছি। খবরটা দেরি করে দিলে চলবে না, তাই ভোরবেলা ফোন করলাম। হ্যাঁরে, গণেশ, লোকটা কেমন আছে?

লোকটা! ওহ ওই ট্রানজিস্টর চোরের কথা বলছিস? হ্যাঁ, কেমন আছে সে?

সে তো জানি না। সেদিনই ছোকরাকে খানিকটা ধমকধামক দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। ছাড়বার আগে একটা করে চিকেন কাটলেট খেয়েছি দু’জনে। ছোকরা কাঁদতে কাঁদতে কাটলেট খেল আর বলল, কোনওদিন চুরিটুরির কাজ করবে না।

খুব ভাল করেছি গণেশ। দারুণ করেছিস। আমি জানতাম, তুই এরকম একটা ভাল কাজ করবি। যে অত নিজে খেতে আর অন্যকে খাওয়াতে ভালবাসে, সে ভাল কাজ না করে পারে না। এই কাজের পুরস্কার হিসেবে তোর কাছে আর-একজন ভাল খাওনদার মানুষকে পাঠিয়ে দেব। সেদিন ময়দানে দেখা হয়েছে। দেখবি, লোকটাকে খাইয়ে আরাম পাবি। তবে তোকে আর-একটা ভাল কাজ করতে হবে গণেশ।।

কী কাজ?

কল্যাণীতে একদল ক্রিমিনালের খোঁজ পেয়েছি। বেটারা আস্তানা গেড়ে লুকিয়ে আছে। ওদের মধ্যে সিঁধেল চোর যেমন আছে, তেমনই জেল পালানো কয়েদিও রয়েছে। তুই ওখানকার পুলিশকে এখনই বলে ওদের ধরবার ব্যবস্থা কর, নইলে সবকটা মিলে পগার পার হবে। নে, ঠিকানাটা চট করে লিখে নে। আরে বাবা, অত তাড়াহুড়ো কীসের? আস্তানার নাম বললেই চিনতে পারবি, চমকেও উঠবি। তবে একটা শর্ত আছে। উদ্ভটবাবাজির আখড়া থেকে চোর-ডাকাত পাকড়াবার সময় আমার ছাতাটা উদ্ধার করে দিতে হবে। গিন্নি খুব রাগারাগি করছে।

ডাক্তার মান্না ক’টা দিন বাড়িতে শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিতে বলেছিলেন। তবু রজনীবাবু অফিস যাওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলেন। দু’দিন কামাই হয়ে গিয়েছে। আজ আর লেট করা যাবে না। বেরোবার সময় মেয়েকে বললেন, আরও দুটো দিন থেকে যা রমা। ভাল করে মোচার ঘন্ট করে রাখিস। রাতে খাব। বিন্দুকে বললেন, সন্ধেবেলা তোকে সার্কাস দেখাতে নিয়ে যাব। তৈরি হয়ে থাকবি কিন্তু! আর তোর দিদাকে বল, এবার থেকে আমাকে যেন একটু বেশি করে টিফিন দেয়। কী ব্যাপার বল তো বিল্টু, বুড়ো বয়েসে খিদেটা হঠাৎ বেড়ে গেল নাকি? হা হা।

অনেকদিন পর প্রাণ খুলে হাসলেন রজনীবাবু।

নিজের টেবিলে বসতেই পাশ থেকে অসিত দত্ত ঝুঁকে পড়ে বলল, শরীর ভাল তো দাদা? তার মুখে ফিচ্কে ধরনের হাসি।

রজনীবাবু ঠান্ডা গলায় বললেন, কেন, শরীর খারাপ হবে কেন?

অসিত দত্ত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, না, ভবানীপুরে অত খেলেন তো! তাই বলছিলাম। বয়সটা তো দেখতে হবে।

টেবিলের কাগজপত্র গোছাতে গোছাতে রজনীবাবু নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, হ্যাঁ ভাই, শরীর ভাল। খুবই ভাল। সেদিন খাওয়াটা কিন্তু জব্বর হয়েছিল। অবশ্য সে আর উপায় কী বলো অসিত! গানবাজনা অত খারাপ শোনালে, ভাল করে খাওয়াতে তো হবেই।

অসিত দত্ত আরও ঝুঁকে পড়ে বলল, দাদা, কানাঘুষোয় যা শুনলাম, তা কি সত্যি?

কী শুনলে ভাই?

আপনি নাকি ইয়ে, মানে আপনি নাকি সকলের ছেলেবেলা দেখতে পাচ্ছেন? সত্যি পাচ্ছেন নাকি?

রজনীবাবু মোলায়েম হেসে বললেন, হ্যাঁ ভাই, পাচ্ছি।

অসিত দত্ত ফিক করে হেসে ফেলল। চোখ নাচিয়ে বলল, কী করে পাচ্ছেন? টাইম মেশিন কিনলেন বুঝি? দাম কত পড়ল? ইনস্টলমেন্ট হলে আমার জন্যও একটা বলুন না। রবিবার রবিবার বাড়িতে বসে ছেলেবেলা দেখব।

রজনীবাবু হাসলেন, আমার কিন্তু মেশিনটেশিন কিছু লাগছে না ভাই। মনে হয়, মাথার মধ্যে কোনও মেশিন চালু হয়ে গেছে।

তাই নাকি? বাঃ, খুব মজা তো! আচ্ছা, আমার ছেলেবেলা দেখতে পাচ্ছেন রজনীদা?

রজনীবাবু উঠে পড়লেন। একগাল হেসে বললেন, অবশ্যই পাচ্ছি। কেন পাব না? এই তো ঘরে ঢুকতে ঢুকতে দেখতে পেলাম, ক্লাসের পড়া পারোনি বলে স্কুলের মাস্টারমশাই তোমাকে শাস্তি দিয়েছেন। তুমি কান ধরে বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে আছ। আরও শুনতে চাও? দাঁড়াও ভাই, আগে একটু সুখময় সামন্তর ঘর থেকে ঘুরে আসি। বড়সাহেবের সঙ্গে দুটো জরুরি কথা আছে।

অপমানে অসিত দত্তর মুখ লাল হয়ে গেছে। বুড়ো লোকটার হঠাৎ খুব সাহস বেড়েছে মনে হচ্ছে। বেঞ্চের উপর দাঁড়ানো না হয় ঠিক আছে, তা বলে কান ধরবার কথাটা ফাঁস করলেন কেন?

বোকাসোকা ভিতু রজনীবাবুকে আজ বুক চিতিয়ে গটমট করে বড়সাহেবের ঘরে ঢুকতে দেখে পিয়োন ক্ষিতীশ এতই ঘাবড়ে গেল যে, বাধা দেওয়ার কথাটাও মনে পড়ল না তার।

সুখময় সামন্ত বিরক্ত মুখে বললেন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া এসেছেন কেন? যা বলবার তাড়াতাড়ি বলুন।

তাড়াতাড়িই বলছি স্যার। ভেবে দেখলাম স্যার, চাকরি শেষের ক’টা বছর জঙ্গলে কাঠালে মন্দ হয় না। ছেলেবেলায় ভূতকেই ভয় করিনি স্যার। এখন বাঘ, ভল্লুক আর কী করবে? ছেলেবেলার সাহসের কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম। কাল রাতে নাতির সঙ্গে লুডো খেলতে বসে হঠাৎ মনে পড়ে গেল। ক্লাস সেভেনে পড়বার সময় ভূত দেখতে অন্ধকারে একা একা ছাদেও গেছি! এবার কাণ্ডটা ভেবে দেখুন স্যার। আমার মতো ভিতু লোক কিনা…! আমি তো নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

সুখময় অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। এই মানুষটা এত কথা বলতে পারেন? কই, তাঁর জানা ছিল না তো!

রজনীবাবু হাসলেন। বললেন, স্যার, আর-একটা আবেদন আছে। কম্পিউটারটা শিখে ফেলবার জন্য আর-একবার সুযোগ আমাকে দিতে হবে স্যার। দেখি না চেষ্টা করে। যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি তো জীবনে কম করিনি। এটাও স্যার একেবারে খেয়াল ছিল না। মনেই ছিল না মোটে। ছেলেবেলার কত কী যে মানুষ ভুলে যায়! ছেলেবেলায় খাটের তলায় লুকিয়ে বসে একবার বাবার টেবিলঘড়িটা পর্যন্ত খুলে ফেলেছিলাম। তখন কত সাহস ছিল। ছেলেবেলা বলে কথা! যাই বলুন স্যার, ছোটরা কিন্তু বড়দের চেয়ে অনেক বেশি সাহসী হয়। আমাকে দেখেই বুঝতে পারছি এখন। একবার খুব পরীক্ষা করে দেখতে ইচ্ছে করছে, সেই সাহসের ছিটেফোঁটাও এই বুড়ো বয়সে আছে কিনা! কম্পিউটারটায় যদি একবার সড়গড় হয়ে যাই, তা হলে স্যার, ওটা বগলদাবা করেই না হয় জঙ্গলে চলে যাব। তখন কিন্তু না বলতে পারবেন না। অফিসের কাজে আর ভুল হবে না।

সুখময় সামন্তর ঘাবড়ানো চোখের সামনে দিয়েই গটমট করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন রজনীবাবু।

এর একটু পরেই ক্ষিতীশ এসে রজনীবাবুর টেবিল থেকে ভাঙা টাইপরাইটার সরিয়ে নিয়ে গেল। অসিত দত্তর চোখ একেবারে ছানাবড়া করে দিয়ে টিফিনের সময় সেই টেবিলে বসে গেল ঝকঝকে নতুন একটা কম্পিউটার।

আজকাল আর রজনীবাবু কারও ছেলেবেলা দেখতে পান না। তবে কম্পিউটারে কাজ করছেন বেশ। সব যে পারছেন এমন নয়। কিন্তু আটকে গেলেও অসুবিধে হচ্ছে না। সহকর্মীদের কাছে জিজ্ঞেস করে নিচ্ছেন। আশ্চর্যের বিষয়, সুখময় সামন্ত আজকাল দু’-একটা গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্র অন্য কাউকে না দিয়ে রজনীবাবুর টেবিলেই পাঠাচ্ছেন। ক্ষিতীশ গম্ভীর মুখে এসে সেগুলো দিয়ে যাচ্ছে। বলছে, স্যার আপনাকে দিলেন।

কলা টোস্ট খেতে খেতে রজনীবাবু বলছেন, রেখে যাও, টিফিন সেরে ঝটপট করে ফেলছি।

রজনীবাবুকে একটা নতুন ছাতা আর টিফিন বাক্স কিনে দিয়েছেন সুধাময়াদেবী। ছাতাটা ঠিকই কিনেছেন, তবে টিফিন বাক্সর বেলায় গোলমাল করেছেন। ভুল করে স্কুলের ছেলেদের জিনিস কিনে ফেলেছেন। টিফিন বাক্সর ঢাকনায় একটা ছোট ছেলের ছবি। ছেলেটা দাঁত বের করে হাসছে। রজনীবাবু ছবিটার দিকে তাকান, আর ভাবেন, কী কাণ্ড! এরকম টিফিন বাক্স নিয়ে বুড়ো বয়সে কেউ অফিসে আসে? তবু তিনি নিয়ে আসেন।

সব মিলিয়ে রজনীবাবু ভালই আছেন। রবিবার বিকেলে বুদ্ধ বাড়িওলাকে ধরে ধরে নিয়ে পার্কে বেড়াতে যান। কোনও কোনও দিন গণেশের থানায় গিয়ে চা খেয়ে আসেন। ফাংশনে ছোট ছেলেমেয়েরা গানটান করছে খবর পেলে, গিন্নিকে নিয়ে সন্ধেবেলা শুনতে যান। মাঝেমধ্যে মনে হয়, ভাগ্যিস ভয়ংকর বিপদটার মধ্যে পড়েছিলেন। নইলে বড় হওয়ার পর ছেলেবেলাটা কোনওদিন আর ফিরে দেখাই হত না। অনেক আনন্দ, দুঃখ, মজা আর সাহসের কথা মনেও পড়ত না। হারিয়ে যেত সব!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *