রচনার রহস্য
ট্যাক্সিটা যেই বড় রাস্তায় পড়েছে, অমনি দেখি সামনে ভোম্বলদা। হাত বাড়িয়ে বললে, এই দাঁড়া, দাঁড়া একটু। আমিও তোর সঙ্গে যাব।
বলতে যেটুকু দেরি। তারপরেই টুক করে উঠে এল গাড়িতে। ট্যাক্সি চলতে আরম্ভ করল।
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, তুমি আবার কোথায় যাবে?
কেন, তুই যেখানে যাচ্ছিস। মানে, দেওঘরে।
আরও আশ্চর্য হয়ে গেলাম আমি। রাঙামাসির বিয়েতে আমি যে দেওঘরে যাচ্ছি সে-খবরটা পাড়ায় কারও অজানা নেই, সাতদিন ধরে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বলে বেড়াচ্ছি সকলকে। এমন কি ভোম্বলদাকেও। কিন্তু সেও যে আজকেই, এই ট্রেনেই, দেওঘরে যাবে–মাত্র এই মুহূর্তেই, আমি সেটা জানতে পারলুম।
বললুম, তুমিও কি রাঙামাসির বিয়েতে যাচ্ছ নাকি?
তোর রাঙামাসির বিয়েতে আমি কেন যেতে যাব? আমার বুঝি ফুলুপিসি থাকতে নেই?
তোমার ফুলুপিসির বিয়ে? দেওঘরেই?
ভোম্বলদা নাক কুঁচকে বললে, কেন, তোর রাঙামাসি ছাড়া দেওঘরে আর বুঝি কারও বিয়ে হতে নেই? আবদার তো দেখছি মন্দ না।
শুনে আমি একটু দমে গেলুম। তারপর খানিকটা ভেবে-চিন্তে বললুম, কিন্তু কই, আগে থাকতে তুমি তো কিছু বলেনি।
আমি কি তোর মতো হাঁদারাম যে একমাস ধরে পাড়ায়-পাড়ায় ফিরিওলার মতো চেঁচিয়ে বেড়াব? স্রেফ চেপে রেখেছিলুম। দ্যাখ না–কেমন সারপ্রাইজ দিলুম তোকে।
আমি আবার মাথা চুলকোতে লাগলুম।
কিন্তু ভোম্বলদা
থামলি কেন, বলে যা।
বিয়েবাড়ি যাচ্ছ–সঙ্গে তো জিনিসপত্র কিচ্ছু দেখছি না।
আমার পিসিবাড়ি তোর মাসিবাড়ির মতো নাকি?–খুব অহঙ্কার করে, নাকটাকে কপালে তুলে দিয়ে ভোম্বলদা বলল, সেখানে কিছু নিয়ে যেতে হয় না। জামা কাপড় বাক্স–স্রেফ কিছু না।
সব রেডি থাকে?
সব–সব। বলতে বলতে ভোম্বলদা টক করে পকেট থেকে একটা লেবেনচুস বের করে খেল।
আমি জুলজুল করে চেয়ে দেখলুম, কিন্তু আমাকে দিলে না।
একটু পরে ভোম্বলদা বললে, তুই আগে কখনও দেওঘরে গেছিস?
বললুম, নিশ্চয় আরও তিনবার। তুমি?
সাতবার।
কই, কখনও তো…।
তোকেই কি যেতে দেখেছি এর আগে? তুই যে চালিয়াতি করে মিথ্যে করে বলছিস না–কেমন করে তা জানব?
ভীষণ রাগ হল আমার।
আমি মিথ্যে কথা বলছি? বেশ, জিজ্ঞেস করো আমাকে।
ভোম্বলদা গম্ভীর হল।
আচ্ছা বেশ, যাচাই করে নিচ্ছি তোকে। আচ্ছা, বল দেখি কী কী পাড়া আছে দেওঘরে?
আমি বললুম, এ আর শক্তটা কী! বমপাস টাউন, উইলিয়মস টাউন, কাস্টোয়ার্স টাউন, বিলাসী টাউন
থাক থাক, এতেই যথেষ্ট হবে।–ভোম্বলদা একবার যেন নিজে নিজে আউড়ে নিলে : বমপাস টাউন, উইলিয়মস টাউন, কাস্টমরুক গে, বিলাসী টাউন–হ্যাঁ, ঠিক আছে।
আমি খুব খুশি হয়ে বললুম, বিশ্বাস হল এবারে?
কী করে বিশ্বাস হবে? ও তো লোকের মুখে-মুখেই শোনা যায়।
চটে বললুম, কক্ষনো না। তুমি আরও জিজ্ঞেস করো না।
আচ্ছা বল তো, দেওঘর জায়গাটা কী রকম?
খুব ভালো। খাসা জায়গা। বাড়িগুলো সব ফাঁকা ফাঁকা, কত গাছপালা, কত পাখি। কেবল বাজারটা একটু ঘিঞ্জি, আর মন্দিরটা।
দেওঘরে কিসের মন্দির আছে বল তো?
আমি হেসে উঠলুম।
এ আর কে না জানে? বাবা বদ্যিনাথের মন্দির।
মন্দিরটা কেমন দেখতে?
কেমন আবার? ছোট মতন শিবের মন্দির। ভিতরটা বেশ অন্ধকার, ভীষণ ভিজে ভিজে, আর খুব ভিড় হয়। একবার তো মেজোমামা ধুম করে একটা আছাড়ই খেয়ে গেলেন।
হুঁ, বদ্যিনাথের মন্দির। শিবের মন্দির। অন্ধকার ভিজে ভিজে, লোকে ধুম করে আছাড় খায়। কারেকট। ঠিক বলেছিস।
আমি আরও খুশি হলুম।
কেমন, বিশ্বাস হল এবার?
কী করে হবে? মাসি-পিসিমাদের মুখেও তো এসব গল্প শোনা যায়। আচ্ছা, আর একটুখানি বাজিয়ে নিই তোকে।
আমার ভীষণ অপমানবোধ হল।
বেশ, আরও জিজ্ঞেস করো। যত ইচ্ছে তোমার।
আচ্ছা–বল দিকি, লোকে মন্দিরে কেন যায়?
কেন যায় আবার? বদ্যিনাথ নাকি সকলের অসুখ-বিসুখ ভালো করে দেন। তা ছাড়া মন্দিরের গলিতে খুব ভালো ক্ষীরের প্যাঁড়া পাওয়া যায়। তাই কিনতেও যায় অনেকে।
তুই বদ্যিনাথের প্যাঁড়া খাস?
পেলেই খাই।–বলতে বলতে আমার জিভে জল এসে গেল; না পেলেও খেতে ইচ্ছে করে। যেমন বড়বড়, তেমনি খেতে খাসা।
হুঁ , বদ্যিনাথের ক্ষীরের প্যাঁড়া। খেতে খাসা। না পেলেও খেতে ইচ্ছে করে।–ভোম্বলদা আবার কথাগুলো আউড়ে নিলে : বল দিকি, আর কী খেতে ভালো লাগে ওখানে?
কেন, আতা? যেন রাবড়ি! তাই দিয়ে আবার ফাস্ট-কেলাস পায়েস হয়।
বলতে গিয়ে আবার আমার জিভে জল এল। ভোম্বলদা লেবেনচুসটা গালে নিয়ে খানিকক্ষণ ভাম হয়ে বসে রইল–যেন আমারই মতো সে মনে-মনে আতার পায়েস খাচ্ছিল।
একটু সামলে-টামলে নিয়ে ভোম্বলদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
থাক গে, খাওয়ার কথা ছেড়ে দে। মন উদাস হয়ে যাচ্ছে।
মন আমারও উদাস হচ্ছিল। বড় মাসিমার তৈরি পায়েসের গন্ধ যেন এই চলতি ট্যাক্সিতেই নাকে ভেসে আসছিল আমার।
ভোম্বলদা লেবেনচুসটার শেষ অংশটুকু কুড়মুড় করে চিবোতে লাগল। তারপর বললে, আচ্ছা, এবারে বরং একটু প্রকৃতিট্রকৃতির কথা জিজ্ঞেস করা যাক। বল তো, দেওঘরে নদী আছে কি না?
আলবাত আছে। ধারোয়া।
কী নাম বললি?
কেন? ধারোয়া! ভোম্বলদার অবিশ্বাসে আমার রাগ হয়ে গেল : কক্ষনো আমার ভুল হয়নি, আরও তিনবার আমি গেছি না ওখানে? কত বেড়িয়েছি ধারোয়ার বালির ওপর দিয়ে। এই তো একটুখানি জল–হেঁটে পার হওয়া যায়, ছোট-ছোট মাছ চিকচিক করছে। তার ব্রিজের ওপর দিয়েই তো জসিডি যাওয়ার রাস্তা।
কোথায় যাবার?
কেন, জসিডি।–
হুঁ, ঠিক বলেছিস।–ভোম্বলদা তেমনি আউড়ে যেতে লাগল : নদীর নাম ধাবোয়া। বালির ওপর দিয়ে বেড়ানো যায়। অল্প জল, মাছ চিকচিক করে। তার ব্রিজের ওপর দিয়ে জসিডি যাওয়ার রাস্তা হুঁ।
হু কী আবার? ঠিক বলিনি?
তাই তো মনে হচ্ছে।–ভোম্বলদা বললে, তুই যে সত্যিই দেওঘরে গেছিস তাতে আর সন্দেহ নেই।-বলেই ধাঁই করে বেমক্কা আমার পিঠে একটা চাঁটি বসিয়ে দিলে। বেশ জোরেই লাগল, কিন্তু এতক্ষণে ভোম্বলদাকে বিশ্বাস করাতে পেরেছি ভেবে আমি ওইটুকু সহ্য করে গেলুম।
ভোম্বলদ বললে, তুই দেখছি বাহাদুর ছেলে। খুব ভালো মেমারি তোর। আচ্ছা, ওয়ান মোর কোয়েশ্চেন–মানে আর-একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব। বল দেখি, দেওঘরে পাহাড় আছে কি না?
বা রে, পাহাড়েরই তো জায়গা।
হুম। দুটো পাহাড়ের নাম কর।
কেন, নন্দন পাহাড়? সে তো শহরের ভেতরেই। সেখানেই তো জলের ট্যাঙ্ক, আর কটা মন্দির। তারপরে তপোবনের পাহাড় আছে, ছোট্ট, খুব সুন্দর। আর সবচেয়ে ভালো হচ্ছে ত্রিকূট-তেরো মাইল দূরে।
ঠিক।–ভোম্বলদা মাথা নাড়ল : নন্দন পাহাড়, কটা মন্দির আর জলের ট্যাঙ্ক। তপোবনের পাহাড়–ছোট্ট, খুব সুন্দর। আর কী বললি?
বাঃ, ত্রিকূট।
বিরাট। তাতে ত্রিকুটেশ্বর শিবের মন্দির, সেখান থেকে একেবারে ওপরে উঠতে প্রায় দু ঘণ্টা লাগে।-সবজান্তার মেজাজ নিয়ে আমি বকবক করতে লাগলুম : তবে তার প্রায় সবটাই ঘন জঙ্গল–ভালুক-টালুকও নাকি আছে। তবে মন্দিরের দিকটায় ওসব কিছু নেই, খালি বাঁদর আছে বিস্তর।
হুঁ, বাঁদর। তোর দলের, কী বলিস? ভোম্বলদা খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসল।
আমার বিরক্ত লাগল এবার। চুপ করে রইলুম।
ট্যাক্সি এতক্ষণে হাওড়া স্টেশনে এসে গিয়েছিল। দুজনেই নেমে পড়লুম, ট্যাক্সির ভাড়াটাও মিটিয়ে দিলুম আমি। তখন হঠাৎ ভোম্বলদা বললে, চলি তা হলে প্যালা, টা-টা
আমি বললুম, টা-টা আবার কেন? এক ট্রেনেই তো যাব। একসঙ্গেই যাচ্ছি।
ভোম্বলদা মুখ ব্যাজার করে বললে, ট্রেনে যেতে বয়ে গেছে আমার। পরশু টেস্ট পরীক্ষা না? আমি বাড়ি ফিরছি।
সে কী। তোমার ফুলুপিসির বিয়েতে যাবে না?
কে ফুলুপিসি?–যেন মুখের সামনে থেকে মাছি তাড়াচ্ছে, এইভাবে কথাটা উড়িয়ে দিলে ভোম্বলদা : কোনও পিসিই নেই আমার। এক মাসি আছে, সে তো থাকে শ্যামবাজারে।
তা হলে তুমি দেওঘরে—
কে যেতে যাচ্ছে দেওঘরে। এদিকে চুঁচড়ো, ওদিকে কাঁচড়াপাড়া, এর বাইরে কোথাও আমি পাই বাড়াইনি।
আমার কীরকম ভ্যাবাচ্যাকা লেগে গেল। কিছু বুঝতে পারলুম না। সুটকেস হাতে আর বিছানা বগলে নিয়ে আমি ভোম্বলদার দিকে চেয়ে রইলুম।
ভোম্বলদা বললে, অমন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছিস কেন গোরুর মতো? এই সোজা কথাটা বুঝতে পারচ্ছিস না? পরশু থেকে টেস্ট পরীক্ষা আরম্ভ ক্লাসের ছেলেরা বলছিল, বাংলায় নির্ঘাত এবার এসে আসবে ভ্রমণকাহিনী। আমার ভ্রমণ তো চুঁচড়ো পর্যন্ত–সে কাহিনী লিখলে কুড়ির মধ্যে পাঁচ দেবে, তিন-টিনও দিতে পারে।
আমি ঠিক তেমনি তাকিয়েই রইলুম। বেশ বুঝতে পারছিলুম, মুখটা হাঁ হয়ে যাচ্ছে আস্তে-আস্তে। মুচকে হেসে ভোম্বলদা বললে, তাই কায়দা করে তোর কাছ থেকে দেওঘর-ভ্রমণ শুনে নিলুম। বেশ মজা করে ট্যাক্সিতে বেড়ানোও গেল খানিকটা। তুই দেখিস প্যালা—‘এসে’তে এবার অন্তত বারো মেরে দেব। বমপাস টাউনবিলাসী টাউন–আতার পায়েস–ক্ষীরের প্যাঁড়া–ধারোয়া নদীর জল, চিকচিকে মাছ, নন্দন পাহাড়, ত্রিকূটের বানর, কিচ্ছুটি বাদ যাবে না। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ–আর, এই নে তোর রিয়োয়ার্ড–এই বলে, আমার হাঁ করা মুখের ভেতরে একটা লেবেনচুস গুঁজে দিয়ে ছিটকে চলে গেল সামনে থেকে আর তিড়িং করে নীল রঙের দোতলা বাসটায় লাফিয়ে উঠল।