রঙ্কা
শম, ছন্দ, পুলহ আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। ভগ বলল— আকাশ, নদী, বাতাস তোমাদের মঙ্গল করুন।
বনভূমিতে হেমন্ত এসেছে। কিছু কিছু গাছের পাতা ঝরছে, ঝরে যাচ্ছে, ঝরে গেছে। আবার কিছু কিছু বৃক্ষ পুরনো পাতার সজ্জা নিয়ে গম্ভীর দাঁড়িয়ে আছে। ধন্যা শীর্ণা হয়ে গেছে, বাতাসে ছুরির ধার এবং এবং —অদূরে সোনার মাঠ। —শম ছন্দের দিকে চায়, ছন্দ চায় পুলহর দিকে, পুলহ আবার শমের দিকে। তাদের হাত নিশপিশ করছে। নিজেদের হাতে গড়া সৃষ্টি ডাকছে, আনন্দে আকুল হয়ে ডাকছে। তাদের মনের মধ্যেটা সাড়া দিয়ে উঠছে— যাই, যাই, এই যে যাই সোনালি শস্য, আমরা আসছি। মন, মুখ চেপে ধরে তিনজনে।
ধোঁয়ার মতো কুয়াশা উঠছে দূর পাহাড়ের ওপর। নীলাভ কুয়াশা। আর একটু রোদ উঠলে সে কুয়াশাকে তাড়া করবে।
তোমরা তৈরি—? গম্ভীর স্বরে বলল দলপতি।
মাথা নাড়ে তিনজন।
—তা হলে বাকিদের নিয়ে এসো।
লোকগুলি বোকা। যে ছোরা দিয়ে শিকার করে সেইগুলি নিয়ে শস্য কাটতে এসেছে। হাসি এসেছিল, হাসি চাপে শম। —এইগুলিতে হবে না।
গাছের কোটরে রাখা তাদের পাতলা বাঁকা ছোরা নিয়ে আসে তারা। উপায় নেই, নইলে শস্যগুলি নষ্ট হবে। এক হাতে মুঠো করে ধরা অন্য হাতে শস্য কাটার কায়দা শিখতে এদের কত চাঁদ কত সূর্য কাবার হয়ে যাবে! তারা চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে, নিজেদের মনে কেটে যায়। হাত ভরে ওঠে। শুকনো ডাঙায় রাখা শস্য চিকচিক করে রোদের ছটার মতো। সারাদিন হাত চলে। বি-গোষ্ঠীর বোকা লোকগুলি গোছাগুলি পরপর সাজিয়ে রাখে। কাটার কাজ করতে পারে না।
সারাদিন কাজ চলে, সূর্য মাথায় উঠলে আধ-ঝলসানো হরিণ মাংস পায় ওরা। এইরকম আধপোড়া মাংস খাওয়ার অভ্যাস তাদের কবেই চলে গেছে। মুখ বিকৃত করে শম, অলম্বুষ। অন্যরা মুখ নিচু করে দাঁত দিয়ে টেনে ছিঁড়তে থাকে ছিবড়ে মাংস। দলপতি লক্ষ করে— কী হল? তোমরা যেন ভাল করে খাচ্ছ না!
—বেশ খাচ্ছি— শম জানায়।
অর্যা বলে— হ্যাঁ, বেশ তো।
নিভৃত মধ্যাহ্নে মাংস চিবোবার শব্দ ওঠে। চবৎ, চবৎ, চবৎ। চ্যাৎ, চ্যাৎ। চবৎ চবৎ—
নিমেষ এখানে নেই। সূর্যকে ধান্য-কাটার দলপতি করে দিয়েছে সে। তার আরও অনেক কাজ আছে। প্রধান কাজ এই ধান্য রাখবার ব্যবস্থা করা। দূরের পাহাড়ে গুহা আছে বটে, কিন্তু তা তেমন ভাল নয়। অনেকটা দূরেও বটে। কেউ কেড়ে নিতে চাইলে রক্ষা করা শক্ত হবে। তারা অবশ্য অশ্বে চড়ে ওখানে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যেতে পারে। কয়েকজনকে পাহারা রেখে দিলেও হয়। কিন্তু এরা কী ভাবে রাখত? নিমেষ ও মধুরা ভাবে ভাবে, ভাবতে ভাবতে একদিন বনের মধ্যে প্রবেশ করে, গাছগুলি ঘেঁষাঘেঁষি। এখানে অশ্ব ঢুকবে না। ধান্যভূমির আশপাশে কিছুই চিহ্ন নেই। শস্যগুলি কী ভাবে রাখা হত? জিজ্ঞেস করলে হয়, কিন্তু তাতে লোকগুলির চোখে বিদ্রুপ ঝিলিক দেয়। ধান্যজয় হয়েছে, এবারে রক্ষার ব্যবস্থা তাদেরই করতে হবে।
ক্রমশ আরও গহন হচ্ছে জঙ্গল। বড় বড় গাছের শাখাপ্রশাখা পত্রজালের মধ্য দিয়ে সূর্যকিরণ বৃষ্টির মতো ঝিরঝির করে ঢুকছে। পায়ের কাছে ঝোপঝাড়। সাপ চলে গেল এঁকেবেঁকে। কে জানে সাপটি নিমেষকে চেনে কি না। একবার ফণা তুলে যেন দেখে নিল, তারপর চলে গেল। সাপ সহসা আক্রমণ করে না, করে ভালুক, ভয় পেয়ে, বরাহও অতি রাগি এবং জেদি জন্তু। সিংহ কখন লাফিয়ে পড়বে, তিরের মতো ধেয়ে আসবে তুমি বুঝতে পারবে না। এই হয়তো দেখলে সিংহীটি শাবক নিয়ে শুয়ে রয়েছে, তোমাকে দেখে বেড়ালের মতো চোখ মিটমিট করল, তুমি পাশ দিয়ে চলে গেলে, তার ভ্রূক্ষেপ নেই। আবার অন্য সময়ে হঠাৎ পিছন থেকে নিঃশব্দে ছুটে এসে তোমার ঘাড় কামড়ে ধরল। আসলে সিংহ খিদে না পেলে আক্রমণ করে না। কখন তাঁর খিদে পেয়েছে, কখন পায়নি সে হিসেব করা কি সোজা? এই সব অশ্বও বনেরই জন্তু, হরিণের মতো ছোটে। বহু চেষ্টায় কতকগুলিকে বশ করেছে মধুরা, শব্দ আর সে। খোলা জায়গায় নদীনালা পাহাড়-পর্বত হলে আর দেখতে হয় না। কিন্তু এইরকম ভারী জঙ্গলে তারা অচল। হাতে কুঠার নিয়ে পথ চলতে হয় এসব জায়গায়। বন্যজন্তুর মোকাবিলা করবে, ঝোপজঙ্গল কেটে সাফ করে এগোনোও যাবে।
মধুরা হঠাৎ শিস দিয়ে উঠল। খুব অবাক হলে বা আনন্দ হলে মধুরা শিস দেয়। —কী হল?
—আরে দেখ দেখ নিমেষ, ঝোপঝাড় কেটে চমৎকার একটি পথ কে কেটে রেখেছে। তাই তো! পরিষ্কার পথ। কোথাও কোনও বড় ঝোপ নেই। শুধু কিছু বুনো ফুল, ঘাসে সবুজ রঙিন হয়ে আছে পথটি। তবে কোনও রংই বেশি নয়। কেননা এই পথে নিয়মিত যাতায়াত হয়। দুধারে উঁচু গাছ। ওপরে বানর দোল খাচ্ছে।
শিস দিতে দিতে মধুরা আগে আগে যায়। নিমেষ পেছনে। হঠাৎ সে কর্কশ গলায় বলে উঠল— শিস থামাও মধুরা।
—ওহ্। তাই তো!
আর তার পরই তারা দেখল বনভূমির মধ্যে একটি পরিষ্কৃত স্থান, ঝোপঝাড়, বড় বড় গাছ রয়েছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে, কিন্তু স্থানটি পরিষ্কৃত। এবং এবং এবং… সেখানে ইতস্তত কতকগুলি লতাপাতার গুহা। ওপরে ছাওয়া, চারদিকে ছাওয়া, এক দিকে একটি চওড়া ফাঁক। গুহাটির সামনে লম্বাচওড়া একটি উঁচু সমতল স্থান।
পায়ের শব্দ থামাতে পারেনি তারা, খুব সতর্ক ছিল না। এইরকম একটি পত্রগুহা থেকে বেরিয়ে এল— রঙ্কা।
সে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এল, তার হাতে একটি বড় পাতায় সিদ্ধ ধান্য। সে খাচ্ছে। তাদের দেখেই নিমেষে ভেতরে চলে গেল রঙ্কা। পরমুহূর্তে বেরিয়ে এল, দু হাতে দুটি বল্লম। বলল— এক পা এগিয়ো না, ঘৃণিত বি-গোষ্ঠী, খুনি, নৃশংস— দুটি বল্লম দুটি দেহে বিঁধে যাবে এক্ষুনি।
তারা হতচকিত হয়ে গিয়েছিল। বিশেষত নিমেষ। এই ক’ মাসে অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে রঙ্কার। সে যে কোনও সময়ে মারাত্মক আহত হয়েছিল বোঝবার জো নেই। শুভ্র বর্ণ, তাতে রক্তের আভা, পিঙ্গল কেশ পিঠের ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে। একটি বল্কল কোমরে আঁটা তাতে লাল নীল হলুদ ফুল আঁটা। রঙ্কার কেশে একটি রক্তবর্ণ ফুল গোঁজা। সে আরও লম্বা হয়েছে, চক্ষে নীল আভা। ছুরির ধার চোখে এবং আশ্চর্য প্রশান্তি তার দাঁড়িয়ে থাকায়। দৃঢ়, আত্মস্থ, সংকল্পে অটল।
নিমেষ বলল— আমরা শত্রু নই। আমি আর আমাদের নেত্রী মধুরা সবার জন্য ফলমূল সংগ্রহে বেরিয়েছি। ওদিকে ধান্য-কাটা হচ্ছে তো! তোমাদের লোকেরাই কাটছে, তাদের তো আমরা মুক্তি দিয়েছিই, বলো মধুরা?
মধুরা সতর্ক ভাবে তাকিয়ে বলল— ভগ তাদের ক্ষত সারিয়ে দিয়েছে। তারা ধান্য পালন ও কাটার কাজ শেখাচ্ছে আমাদের। আমরা বন্ধু।
—চলে যাও। —তীব্রস্বরে বলল রঙ্কা। রঙ্কার কণ্ঠস্বর যেন বনভূমিতে হিল্লোল বইয়ে দিল, অন্তত নিমেষের তাই মনে হল।
—আমাদের কুটির থেকে, পাড়া থেকে চলে যাও, যাও বলছি! সে একটি বল্লম নিমেষের মাথা লক্ষ্য করে ছুড়ল। ভাগ্যে নিমেষ বসে পড়েছিল তাই। তারা সভয়ে দেখল বল্লম নিমেষের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে একটি গাছকে এফোঁড় ওফোঁড় করে ফেলেছে। আবার ঢুকে গেল রঙ্কা, তিরধনুক নিয়ে বেরিয়ে এল। মধুরা মৃদুস্বরে বলল— ফিরে চলো নিমেষ। পরে আসা যাবে। এই পাড়া, কুটির ও এই মেয়েটিকে আমাদের দরকার হবে। এ যোদ্ধী।
পিছু হঠতে হঠতে যতক্ষণ না নিশানার বাইরে চলে গেল তারা, উদ্যত ধনুর্বাণ নামাল না রঙ্কা। পেছন ফিরে বনের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে দেখল, অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল রাখল, তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে অস্ত্র নামিয়ে ঘরে গিয়ে তার অসমাপ্ত আহার শেষ করল। রঙ্কাদের গ্রামে বহু ধান্যবীজ সঞ্চিত আছে। একেবারে সিদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত, সে তার শিকার করা খরগোশটি ভাল করে ঝলসে নিয়েছিল, বনের লবণক্ষেত্র থেকে লোনা মাটি এনে মিশিয়েছিল। খাবারটা ভালই হয়েছে কিন্তু বি-গোষ্ঠীর লোক দুটি তার স্বাদ নষ্ট করে দিয়ে চলে গেল। আজ আক্রমণ করল না ঠিকই, কিন্তু দেখে গেল তাদের পল্লি, তাদের পর্ণকুটির, তাদের শস্যঘর, শস্য আছড়াবার ঝাড়বার জন্য শুকোবার জন্য বেদিগুলি। এবং পুরো পল্লিতে সে একা। যদিও তার ঘরে অন্য আরও ঘর থেকে নিয়ে আসা অজস্র তির, বল্লম, কুঠার। সে চমৎকার স্বাধীনভাবে এই ক’মাস বিচরণ করেছে, আপন মনে শিকার করেছে, রেঁধেছে, খেয়েছে, কুটিরগুলি পরিষ্কার করেছে, শস্যগুলি রোদে দিয়েছে, পাছে কোনও পোকা লাগে। আশ্চর্য তার পোষা হরিণ নন্দ তো কোনও সূচনা দিল না! নন্দকে ওরা মেরে ফেলেনি তো? মেরে ফেললে আরও নন্দ তৈরি করে নিতে তার কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু সে একা এই পুরো পল্লি রক্ষা করবে কী করে? কত দিন? এই অসভ্যগুলি শস্য বুনতে জানে না, বিকটাকৃতি জানোয়ারে চড়ে, এদের হাত থেকে সে নিজের পল্লি কী করে বাঁচাবে? কী বলে গেল, তাদের আহতরা সেরে গেছে? তারা এখন শস্য তুলছে! তবে কি সবাই হার মেনে গেল? হায় মাতঙ্গী, সিংহ, দেখো কী অবস্থা হল তোমাদের গোষ্ঠীর। তোমাদের সন্তানদের। মাতঙ্গী-ই… তার ডাক বন চিরে দেয়। সে রাগে উন্মত্ত হয়ে নিজেকেই আঘাত করে। চুল ছেঁড়ে, উপুড় হয়ে পড়ে থাকে মাটির ওপর, কলকল করে জল বেরোয় চোখ দিয়ে। এই জলধারা সে খুব কৌতূহলের সঙ্গে দেখে। আঘাত লাগলে, খুব জোর আঘাত, ধরো তির বিঁধে গেল, কুঠারের আঘাত লাগল, কি বন্যজন্তু মাংস খুবলে নিল, তখন এই জলধারা বেরিয়ে আসে চোখ থেকে। এখন তো কোনও চোট নেই, ক্ষত নেই, কেন এরকম হচ্ছে তার? মাতঙ্গী বাতাসে মিশে যাবার সময় থেকেই এরকম হচ্ছে। তবে কি কোথাও ক্ষত আছে? কোথাও শরীরের গভীরে, সে আঁতিপাঁতি করে দেখতে থাকে; এবং নিশ্চিত হয়, নেই। শরীর অটুট, তা হলে? শরীরের ভেতরে কোথাও ক্ষতটি আছে ঠিকই। এবং তা মাতঙ্গীর অদৃশ্য হয়ে যাবার সঙ্গে যুক্ত।
হঠাৎ তার মনে পড়ে শুক্কো বলে বালকটিকে যখন তরক্ষু নিয়ে গেল! মাতঙ্গী সবাইকে বকছিল অসাবধান হবার জন্য, সেই সময়ে তার চোখ দিয়ে এমনি জলধারা নেমেছিল। তার মানে কারও অদর্শন হয়ে যাবার সঙ্গে যুক্ত এই ক্ষত। এই কান্না, চোখের ভেতর থেকে, শরীরের যেসব অংশ দেখতে পাওয়া যায় না সেখান থেকে, ক্ষতমুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে জলধারা। এই ক্র ক্র করে ক্রন্দন।
রষ্কার আশঙ্কা অচিরেই সত্য হল। কিন্তু সে যা ভেবেছিল সে ভাবে নয়।
ঠিক দু সূর্য পরে রঙ্কার দরজার সামনে এসে দাঁড়াল শম।
—শম তুই?
—আমরা সবাই আছি রঙ্কা, বেরিয়ে আয়।
বেরিয়ে রঙ্কা দেখল সত্যিই তাদের গোষ্ঠীর শম, দম, অলম্বুষ, অর্যা— ইত্যাদি সবাই উপস্থিত।
অর্যা বলল— আমরা দুই গোষ্ঠী মিলে গেছি রঙ্কা। আর আমাদের মধ্যে কোনও বিভেদ নেই। আমরা ওদের ধান্য লালনপালন, তার থেকে বীজ বার করে শুকনো সব কায়দা শিখিয়ে দিয়েছি, ওরা আমাদের অশ্বের পিঠে চড়তে দিচ্ছে। কী ক্ষতি বল যদি আমরা মিলে এক হয়ে যাই।
দম বলল— দেখ ওরাও শ্বেত, আমরাও শ্বেত। ওরা তুষারের মতো, আমরা অত সাদা নই। ওদেরও কেশ পিঙ্গল, আমাদেরও। ওরাও উচ্চনাস, আমরাও তাই। শুধু ওরা দূরে, বহু দূরে ছিল বলে পরস্পরের মধ্যে জানাশোনা হয়নি। আমাদের এই যেমন ধান্য আছে, ওদের তেমন অশ্ব আছে। ওরা আমাদের চেয়েও তীক্ষ্ণ ফলা তৈরি করতে পারে।
—আর মাতঙ্গী… সিংহ… অদ্রি… যারা বিনা কারণে নিহত হল!
রঙ্কার চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে।
এই সময়ে পেছনে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একটি লোক, সকলে পথ ছেড়ে দিল, সে আস্তে আস্তে এগিয়ে এল যেন যুদ্ধে পরাজিত, আত্মসমর্পণ করবে। খুব ধীর গম্ভীর মধুর গলায় লোকটি বলল— আমি ভগ, শুনেছি তুমি রঙ্কা। আমি ক্ষত সারাই। বহু গাছ-গাছড়ার গুণাগুণ জানি, আরও একটা কথা জানি। এই তুমি, মধুরা, শব্দ, অর্যা, রোধিনী— আর এই আমি, নিমেষ, শম, দম, অলম্বুষ, কৌর… আমাদের ভেতরে কোনও তফাত নেই। প্রত্যেকের দুটো হাত দুটো পা দুটো চোখ দুটো কান। দুই নাসাছিদ্র, রক্ত এক রঙের— নারীদের দুটি অতিরিক্ত অঙ্গ আছে। তাদের প্রজনন অঙ্গও ভিন্নরূপ, কিন্তু সব নারীরই এক। তা হলে? —আমি এই মহান কথা জানতে পেরেছি— আমরা সবাই একরূপ। আমাদের মিলে যেতে হবে। যখন কিছু পাওয়ার স্বার্থে যুদ্ধ করি, হত্যা করি, নিজেদের প্রতিরূপকেই করি।
রঙ্কা একটু থমকে গেল। লোকটি অতি শ্বেত, তার চুলগুলিও সাদা, যদিও সে বৃদ্ধ নয়। এই সর্বশ্বেতত্ব তাকে কেমন একটা মহত্ত্ব, বিশেষতা দিয়েছে, সে যেন আকাশ বাতাস থেকে নেমে এসেছে, জলের ভেতর থেকে উঠে এসেছে। সমীহ চোখে নিয়ে রঙ্কা তার দিকে তাকিয়ে রইল। বাক্যহীন।
ভগ বলল— জানি তোমাদের গোষ্ঠীর অনেককেই আমরা হত্যা করেছি। ভুল করেছি। আমি ওদের বারণ করেছিলাম। বলেছিলাম দেখো ওরা আমাদের মতো দেখতে, আমরা পরস্পরের কথা বুঝতে পারি। এ হত্যা এ যুদ্ধ কোরো না। আমি ওদের হয়ে তোমার কাছে শাস্তি নিতে এসেছি। কী শাস্তি দেবে দাও। এই নাও কুঠার, বল্লম, এই সব তিরধনুক। মারো। —ভগ হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে বসে পড়ল।
রঙ্কা কথা বলল না। ভেতরে চলে গেল। তার ভেতরে কল্লোল জাগছে। কেন? কেন? এমন লোক সে কখনও দেখেনি, এমন কথাও কখনও শোনেনি। সবাই এক! ভুল করেছে! মেরে ভুল করেছে! শাস্তি নিতে চায়! বাইরে তাকালে সে দেখতে পেত নিমেষ, মধুরা… এবং বি-গোষ্ঠীর আরও সব লোক আস্তে আস্তে বনের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসছে। তারা কুটিরগুলিতে ঢুকে যাচ্ছে। ধান্যের বোঝা মাথায় নিয়ে আসছে, ওই কিছু ধান্যঘাস বেদির ওপর চড়াত শব্দ করে আছড়ে ফেলল। শমের নির্দেশে একটি মোটা বেঁটে যষ্টি দিয়ে ওরা ধান্য প্রহার করছে। সূর্য আকাশ পরিক্রমা করছে। কোলাহল শুরু হয়ে গেল। কুটিরগুলি ভাগ ভাগ হচ্ছে। দু’তিনজন করে একেকটিতে থাকবে। ধান রাখার গর্তগুলি পরিষ্কার করছে কেউ কেউ। আগুন-চক্র তৈরি করার জন্য কাঠকুটো বয়ে আনছে কেউ কেউ, কাছাকাছি ঝরনাটি দেখিয়ে দিচ্ছে একজন। চক্ চক্ গব্ গব্ করে জল পান করছে সব।
—তোমরা মধুরাকে নেত্রী বলে মানবে। —মধুরা বলল।
নিমেষ বলল— মধুরা, নিমেষ তোমাদের রক্ষা করবে, তোমরা নিশ্চিন্তে ধান্য-উৎপাদন করো, মৃত্তিকা থেকে পাত্র তৈরি করো, তোমরা পশুগুলিকে চরাও, পশুলোম কাটো। হরিণ ইত্যাদির চামড়াগুলি পেটো, গাভিগুলিকে ঘাস খাওয়াও, ওরা দুধ দেবে, কে কী করবে আমরা বলে দিচ্ছি।
রঙ্কা বুঝতে পারছিল বাইরে কোলাহল হচ্ছে। কিন্তু তার কানে যেন কিছু ঢুকছিল না। সে একটি সর্বশ্বেত মানুষকে দেখছিল। শ্মশ্রু ও কেশ এমনকী ভ্রূ ও চোখের পাতা পর্যন্ত শ্বেত, কিন্তু বৃদ্ধ নয়। বলিষ্ঠ সুন্দর মানুষ, তার চোখ দুটি কেমন আকাশের মততা। বক্ষ যেন বনস্পতির প্রাচীর। তার ভেতরটা ক্রমশ শান্ত হয়ে যাচ্ছিল, কেমন ঘুম আসছিল। কেননা অনেক দিন সে শুধু নিষ্ফল ক্রোধে ফুঁসেছে। সম্পূর্ণ একা কাটিয়েছে। এতটা একা থাকা তার অভ্যাস ছিল না। মাতঙ্গীর ঊর্ধ্বনেত্র, দৃষ্টিহীন চোখ, মৃদু প্ৰাণবায়ুর সেই রঙ্কা… আ আ বলে ডাক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া, শুকনো কঠিন দেহ নিশিদিন তার চোখে ভাসছিল। সে সবচেয়ে দুর্বল বলে তাকে এবং ছন্দ সবচেয়ে সবল বলে তাকে ভালবাসত মাতঙ্গী। সে স্পষ্ট বুঝতে পারত। কী ভাবে খেলার সময়ে তার দিকে তাকাত মাতঙ্গী। কীভাবে সে তার ফুল তোলা বাকলগুলি দেখে প্রশংসা করত। তিরধনুকের শিক্ষায় সে যখন প্রথম লক্ষ্যভেদ করল পরপর তিনবার, মাতঙ্গী তাকে প্রায় পিষ্ট করেছিল বক্ষে, বলেছিল কে বলে রঙ্কা আনমনা? সে তো লক্ষ্য বিঁধল! প্রথম হরিণটা যখন শিকার করল! সে কী আনন্দ মাতঙ্গীর। সে এখন বুঝতে পারে মাতঙ্গীর গর্ভে যে যে জন্মেছিল, সে, ছন্দ, শুক্কো, বদ্রি, অন্যা… এদের সবার জন্য মাতঙ্গীর বিশেষ ভালবাসা ছিল। ভালবাসা মানে একরকম টান। সে আর মাতঙ্গী বলে মাতঙ্গীকে ভাবে না, যে মাতঙ্গী গোষ্ঠীনেত্রী, শিকারে, যুদ্ধে, বিতরণে, পরামর্শে অগ্রণী, যার কাছে সব শিশু বালকই সমান, তার ভেতর থেকে এক স্নেহশীলা, কারও কারও প্রতি বিশেষ টানযুক্তা মাতঙ্গী বেরিয়ে এসে তার স্মৃতিতে বসবাস করছে। সে মাতঙ্গীর কথা ভাবলে এখন নিজেকে মাতঙ্গীর নিম্নদেশের ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে তারপর কোলে-পিঠে উঠে তার স্তন্য পান করা একটি শিশু হিসেবে দেখতে পায়। মাতঙ্গীর মুখের কোমল হাসি, তার উন্নত কপালে তার জন্য নিশ্চিন্ত আশ্রয়, তার দেহ মনের বলিষ্ঠ প্রশান্তি বোঝে, এবং কেন কে জানে ‘মাতঙ্গী’ নয়, শুধু ‘মা’ ডাকটিই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে।
ক্রমশ ছায়া লম্বা হতে থাকে। ধূসর অপরাহ্নের দিকে রঙ্কা কেমন এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। পাখিদের কলকাকলিতে যেন বহু ধন্যার জল বইছে চারদিকে। গোলাপি কমলা আলো নেমে আসছে আকাশ থেকে। কুটিরগুলোতে কুলোচ্ছে না। আরও কয়েকটি গড়া শুরু হয়ে গেছে। শম, দম, অৰ্যা নেতৃত্ব দিচ্ছে, সবাই মিলে তৈরি করছে। সন্ধে নেমে যাওয়ার আগেই আরও কয়েকটি কুটির তৈরি হয়ে গেল। আর করতে হলে আরও বন কাটতে হবে— এখন ক্ষান্ত দেওয়াই ভাল। পাড়া ঘিরে আগুনের ব্যবস্থা হচ্ছে। তিনটি বরা ও প্রচুর খরগোশ পোড়ানো হচ্ছে। রঙ্কা বহু দিনের টান-টান পাহারাদারি, ক্রোধ, শোক থেকে আজ বোধহয় মুক্তি পেয়েছে। সে ঘুমোচ্ছে। শমেরা নোনা মাটি থেকে লবণ বার করে মাংসে মিশিয়ে দেয়। অপূর্ব তার স্বাদ। মধুরা গোষ্ঠীর লোকেরা খেতে খেতে মুখে নানারকম প্রশংসাসূচক শব্দ করছিল— ‘আহ্, বাহ্। ওহ।’