রঙরেজিনী

শঙ্করলাল দিগ্‌বিজয়ী পণ্ডিত।
           শাণিত তাঁর বুদ্ধি
                   শ্যেনপাখির চঞ্চুর মতো,
    বিপক্ষের যুক্তির উপর পড়ে বিদ্যুদ্‌বেগে–
                   তার পক্ষ দেয় ছিন্ন করে,
                       ফেলে তাকে ধুলোয়।
রাজবাড়িতে নৈয়ায়িক এসেছে দ্রাবিড় থেকে।
    বিচারে যার জয় হবে সে পাবে রাজার জয়পত্রী।
        আহ্বান স্বীকার করেছেন শঙ্কর,
এমন সময় চোখে পড়ল পাগড়ি তাঁর মলিন।
           গেলেন রঙরেজির ঘরে।
 
কুসুমফুলের খেত, মেহেদিবেড়ায় ঘেরা।
        প্রান্তে থাকে জসীম রঙরেজি।
মেয়ে তার আমিনা, বয়স তার সতেরো।
        সে গান গায় আর রঙ বাঁটে,
               রঙের সঙ্গে রঙ মেলায়।
বেণীতে তার লাল সুতোর ঝালর,
        চোলি তার বাদামি রঙের,
           শাড়ি তার আশমানি।
বাপ কাপড় রাঙায়,
        রঙের বাটি জুগিয়ে দেয় আমিনা।
 
শঙ্কর বললেন, জসীম,
        পাগড়ি রাঙিয়ে দাও জাফরানি রঙে,
               রাজসভায় ডাক পড়েছে।
কুল্‌ কুল্‌ করে জল আসে নালা বেয়ে কুসুমফুলের খেতে;
আমিনা পাগড়ি ধুতে গেল নালার ধারে তুঁত গাছের ছায়ায় বসে।
ফাগুনের রৌদ্র ঝলক দেয় জলে,
        ঘুঘু ডাকে দূরের আমবাগানে।
    ধোওয়ার কাজ হল, প্রহর গেল কেটে।
পাগড়ি যখন বিছিয়ে দিল ঘাসের ‘পরে
    রঙরেজিনী দেখল তারি কোণে
        লেখা আছে একটি শ্লোকের একটি চরণ–
           “তোমার শ্রীপদ মোর ললাটে বিরাজে’।
        বসে বসে ভাবল অনেক ক্ষণ,
    ঘুঘু ডাকতে লাগল আমের ডালে।
রঙিন সুতো ঘরের থেকে এনে
    আরেক চরণ লিখে দিল–
        “পরশ পাই নে তাই হৃদয়ের মাঝে’।
 
        দুদিন গেল কেটে।
    শঙ্কর এল রঙরেজির ঘরে।
শুধালো, পাগড়িতে কার হাতের লেখা?
           জসীমের ভয় লাগল মনে।
        সেলাম করে বললে, “পণ্ডিতজি,
               অবুঝ আমার মেয়ে,
                   মাপ করো ছেলেমানুষি।
           চলে যাও রাজসভায়–
সেখানে এ লেখা কেউ দেখবে না, কেউ বুঝবে না।’
    শঙ্কর আমিনার দিকে চেয়ে বললে,
           “রঙরেজিনী,
অহংকারের-পাকে-ঘেরা ললাট থেকে নামিয়ে এনেছ
    শ্রীচরণের স্পর্শখানি হৃদয়তলে
        তোমার হাতের রাঙা রেখার পথে।
           রাজবাড়ির পথ আমার হারিয়ে গেল,
                   আর পাব না খুঁজে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *