রঘু রাইকে মনে আছে? ফটোগ্রাফার। একাত্তরের সেই অসাধারণ সাদা কালো ছবিগুলো যাঁর তোলা। পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামগঞ্জ থেকে জোয়ান বুড়ো বোঁচকা বুঁচকি ঘটিবাটি নিয়ে গ্রাম ছাড়ছে। দুস্থ শরণার্থী কংক্রিটের পাইপে বসত গড়েছে। রাস্তার ধারে ভাত ফুটছে। ভাতের পাতিলের সামনে কাত হয়ে শুয়ে আছে গর্ভবতী মলিন কিশোরী। এক বুড়িকে ডুলিতে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুটো লোক। রঘু রাইয়ের সেইসব ফটোগ্রাফ আমাকে রাতের পর রাত জাগিয়ে রাখতো। কাল সেই রঘু রাইয়ের ফটোগ্রাফ প্রদর্শনী দেখতে গেলাম দিল্লির আইআইসিতে। প্রদর্শনীর নাম দেওয়া হয়েছে, লঙ্গিং টু বিলং। বিভিন্ন দেশের যে শরণার্থীরা ভারতে রয়েছে, তাদের ছবি। প্রদর্শনীর উদ্বোধন হলো জুনের কুড়ি তারিখে, আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবসে।
রঘু রাইয়ের এবারের ছবিগুলো সাদা কালো নয়। সব রঙিন। একাত্তরের মানুষগুলোর মতো বিমর্ষ, বিধ্বস্ত নয়। এবারের মানুষগুলোর চোখে হতাশা আর দীর্ঘশ্বাসও তত নেই।
ভারতে একসময় বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন জাতের ধর্মের মানুষ আশ্রয় নিত। ভারতের উদার বক্ষ সবাইকেই আলিঙ্গন করতো। ইহুদিরা তাড়া খেয়ে ভারতে এসেছে, সে কী আজ! পারস্য দেশ থেকে জোরোয়াস্ট্রিয়ান এসেছে। দশম শতাব্দীতে যখন জোরোয়াস্ট্রিয়ান গুজরাটের নদীর তীরে নেমে রাজার কাছে আশ্রয় চেয়েছিল, লোকে বলে, রাজা কানায় কানায় পূর্ণ করে এক পাত্র দুধ পাঠিয়ে দিয়েছিল, ওটাই নাকি কায়দা করে বলা যে আমার রাজ্যে তোমাকে জায়গা দেওয়ার কোনও জায়গা নেই। তারপর এক জোরোয়াস্ট্রিয়ান পুরোহিত ওই দুধে এক চিমটি চিনি ঢেলে দিয়ে বলেছিল যে জোরোয়াস্ট্রিয়ানরা তোমাদেরই একজন হয়ে উঠবে, তোমাদের জীবনে আরও মিষ্টতা দেবে। সেই জোরোয়াস্ট্রিয়ানরা আজ পার্সি। ভারতের সমাজে সম্পূর্ণ মিশে যাওয়া শরণার্থী। ভারতের জন্য তাদের অবদান অসামান্য। ভারতবর্ষ আজ তাদের পার্সি সম্প্রদায় নিয়ে গৌরব বোধ করে।
ভারতে সবচেয়ে বেশি শরণার্থী এসেছে ভারত ভাগের পর, উনিশশ সাতচল্লিশে। পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্বপরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে এক কোটি চল্লিশ লক্ষ মানুষ ভারতে চলে এসেছিল। এর পঁচিশ বছর পর একাত্তরের যুদ্ধের সময় ভারত আশ্রয় দিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের এক কোটি শরণার্থীকে। আজকাল শরণার্থীর সংখ্যা ভারতবর্ষে আগের মতো অত নেই। তারপরও যা আছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় শরণার্থীর দলটি তিব্বত থেকে এসেছে। তিব্বত থেকে দালাই লামার সঙ্গে এক লক্ষ তিব্বতী এসেছিল, ১৯৫৯ সালে। সবাইকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালা থেকে চালানো হচ্ছে নির্বাসিত তিব্বত সরকার। ভারতে এখন তিব্বতী শরণার্থীর সংখ্যা এক লক্ষ দশ হাজার। নির্বাসিত তিব্বতীদের আশি ভাগই বাস করছে ভারতে।
রঘু রাইয়ের প্রদর্শনীতে ভারতবর্ষের শরণার্থী তিব্বতীদের জীবনযাপনের ছবি আছে। ছবি আছে শ্রীলংকার তামিলদের। তামিলরা ১৯৮৩ সালে শ্রীলংকা থেকে চলে এসেছিল ভারতে। এখন মোট ষাট হাজার শ্রীলংকার তামিল বাস করছে ভারতের তামিলনাড়ুতে। শরণার্থী ক্যাম্পগুলোয় সবরকম সুবিধে পাচ্ছে ওরা। ২০০৯ সালে এলটিটিইর পতনের পর কিছু তামিল অবশ্য ফিরে গেছে শ্রীলংকায়। বাকি তামিলরা ফিরে যাবে, যদি না যেতে চায়, না হয় থেকেই যাবে। মায়ানমারের শরণার্থীও আছে ভারতে। জম্মু, দিল্লি, হায়দারাবাদে বাস করছে নয় হাজার রোহিঙ্গা। অন্য অনেক দেশের মতোই ভারত সই করেছিল জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশন ১৯৫১ এ। ওতে শর্তই আছে, যে কেউই রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলে তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে হবে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলে দিয়েছে যে, ২১ আর ১৪ ধারা মতে ভারতে যারাই বাস করছে, তাদের সবারই সাংবিধানিক অধিকার এক। ভারতের ক’জন মানে এ কথা! জাতিসংঘ রোহিঙ্গা মুসলিমদের সকলকেই শরণার্থী বলে স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু ভারত কতটা স্বীকার করছে, সেটাই দেখার বিষয়। ভারতে রোহিঙ্গাদের সাহায্য করছে কিছু মুসলিম সংস্থা। সাধারণ মানুষের মধ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য সহানুভূতি খুবই কম। রোহিঙ্গাদের অনেক সময় রুমানিয়ার জিপসিদের মতো মনে হয় আমার। যেখানেই যায়, সেখানেই লোকে তাদের ঘৃণা করে। সব জায়গা থেকেই তাদের দূর দূর করে তাড়ানো হয়।
ভারতে আফগান শরণার্থী আসা শুরু করেছে ১৯৭৯ সাল থেকে, সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করার সময় থেকে। মোট বারো হাজার আফগান শরণার্থী এখন ভারতে বাস করছে। পাকিস্তানের হিন্দু শরণার্থী আছে এক লক্ষ। ২০১২ সালে পাকিস্তানের কিছু হিন্দু নালিশ করেছিল যে, পাকিস্তানের মুসলিমরা তাদের জমিজমা কেড়ে নিয়েছে। তাদের ওপর শারীরিক আক্রমণ করেছে, তাদের অপহরণ করেছে, জোর করে ধর্মান্তরিত করেছে। এখন পাকিস্তানের হিন্দুরা ভারত সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইছে। হয়তো আশ্রয় তারা পাবে, যেমন বাংলাদেশের হিন্দুরা পেয়েছে। রঘু রাইয়ের এই প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের কারোর কোনও ছবি নেই। না হিন্দুর ছবি, না মুসলমানের। বাংলাদেশের মুসলমানদের বলা হয় ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’। ওরা কি শরণার্থী নয়? ওদের বেশির ভাগই হয়তো রাজনৈতিক শরণার্থী নয়, কিন্তু তারা তো অর্থনৈতিক শরণার্থী। অর্থনৈতিক দুরবস্থা কি রাজনৈতিক নয়? নিশ্চয়ই রাজনৈতিক। তবে অর্থনৈতিক শরণার্থীদের রাজনৈতিক শরণার্থী না বলে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলা হয় কেন?
শুধু উপমহাদেশ থেকেই নয়, আফ্রিকার দেশ থেকেও লোক ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চায়। সাতশ পঞ্চাশ জন সোমালি শরণার্থী বাস করছে ভারতে। সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধ চলাকালীন চলে এসেছিল। সোমালিরা ভারতের সমাজে বরণীয় আদরণীয় কোনওটাই নয়। প্রধান কারণ তারা কালো। কালো লোকদের ভারতীয়রা পছন্দ করে না। কালো আফ্রিকানদের ভারতের পথে ঘাটে হেনস্থা করা হয়। নিজেদের বোঁচা-নাক নাগরিককেই লোকে পছন্দ করে না। মনে করে ওরা ভারতীয় নয়। নিডো তানিয়া নামের এক ছেলেকে তো সেদিন দিল্লিতে মেরেই ফেললো কিছু লোক, একটিই কারণ, ছেলেটা দেখতে ভিন্ন। নিডো তানিয়া ছিল ভারতের অরুণাচল প্রদেশের ছেলে। ভারতবর্ষে একটি বাক্যের বেশ চল ছিল কোনও এক কালে : অতিথি দেব ভবো। এখন সেই বাক্যটি কেবলই একটি বাক্য। ওতে আজকাল খুব বেশি লোকের বিশ্বাস নেই। সেই আগের ভারত আর এখনকার ভারতে এখন অনেক পার্থক্য বটে। সাদা ইওরোপীয় আর আমেরিকার লোকদের প্রতি আনুগত্য এখনও ঢের। কালো, বাদামী, মুসলিম, প্রতিবেশী, দরিদ্র, উপজাতি–এসবের প্রতি অনীহা সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যে প্রচুর।
জাতীয়তাবাদ আর বর্ণবাদ এই দুটো দ্বারা মারাত্দক রকম আক্রান্ত এরা। রাজনৈতিক নেতারাও চান এসব নিয়ে জনতা পড়ে থাকুক। সবার জন্য অন্ন আর বাসস্থান, স্বাস্থ্য আর শিক্ষা নিয়ে ব্যস্ত না হোক, দারিদ্র্য দূরীকরণ নিয়ে না ভাবুক।
রঘু রাইয়ের সম্ভবত অনেক বয়স এখন। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় জন্ম, হবেই তো বয়স। কাল দেখা হয়নি তাঁর সঙ্গে। আমি যখন ঢুকেছি প্রদর্শনী হলে, কেউ ছিল না। একটা লোক একটা ল্যাপটপ নিয়ে দরজার পাশে একটা টেবিলে বসে ছিল। কেউ এলে তাঁকে একটা খাতায় মন্তব্য লিখতে বলাটাই তাঁর কাজ। বেরোনোর আগে আমিও মন্তব্য লিখে এসেছি। আমার মন্তব্যটা এরকম : ‘রঘু রাইকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছি একাত্তরের তাঁর তোলা বাংলাদেশ যুদ্ধের ছবি দেখতে দেখতে। এখনও তাঁর সেই ছবিগুলো দেখলে চোখে জল আসে। রঘু রাই এখনও শরণার্থীর ছবি তুলে যাচ্ছেন। এখনও তিনি মানবতার জন্য কাজ করছেন। তবে যাদের ছবি তিনি তুলেছেন, তাদের আমি শরণার্থী বা রিফুজি বলি না, তাদের আমি মানুষ বলি। কোনও মানুষকেই আসলে শরণার্থী বলা উচিত নয়। সবাই এই পৃথিবীর সন্তান। এই পৃথিবীর যেখানে খুশি সেখানে যাওয়ার স্বাধীনতা সবারই থাকা উচিত। পৃথিবীর যে জায়গায় বাস করতে ইচ্ছে হয়, সেই জায়গায় বাস করার অধিকার সবার থাকা উচিত। এই মানুষই আমরা পৃথিবীকে ভাগ করেছি, কাঁটাতার লাগিয়েছি। এই মানুষই আমরা ধর্ম, জাত তৈরি করেছি। এই মানুষই আমরা তৈরি করেছি দারিদ্র্য আর প্রাচুর্য, তৈরি করেছি মানুষে মানুষে বৈষম্য আর বিভেদ। এই মানুষগুলোর জীবনযাপনের মান উন্নত হোক। এ দেশের নাগরিক যে সুযোগ সুবিধে পায়, যে সম্মান পায়, একই সুযোগ সুবিধে, একই সম্মান এই রিফুজি ক্যাম্পে পড়ে থাকা মানুষদের দেওয়া হোক। মানবতার অপমান আর কতকাল সওয়া যায়।’ আমি নিজে একজন রাজনৈতিক শরণার্থী। আমার দেশের সরকার আমাকে আজ কুড়ি বছর হল আমার দেশ থেকে তাড়িয়েছে, যেহেতু আমি যা লিখি আমার বইয়ে, আমার গল্প উপন্যাসে, প্রবন্ধে, কবিতায়, তা বাংলাদেশ সরকারের পছন্দ নয়। আজও বেআইনিভাবে এবং অন্যায়ভাবে আমাকে দেশে ঢুকতে দিচ্ছে না কোনও সরকারই। আমার বাংলাদেশ পাসপোর্ট বাংলাদেশের কোনও সরকারই কখনও মেয়াদউত্তীর্ণ করছে না। আমার বিদেশি পাসপোর্টেও কখনও ভিসা দিচ্ছে না। আমার বেলায় হাসিনা সরকার, খালেদা সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার_ সকলেরই এক চরিত্র। আমাকে কি কম ভুগতে হচ্ছে নির্বাসন জীবনে? লেখক হয়ে বিদেশ বিভুঁয়ে জীবন যাপন করা সহজ জিনিস নয়, তার ওপর আবার বাঙালি লেখক হয়ে। ভারতবর্ষে বাস করি, ভারতবর্ষের সঙ্গে নিজের দেশের কিছু মিল পাই বলে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমাকে তাড়িয়েছে। দিল্লিতে আমি একটি সরু সুতোয় ঝুলে আছি। যে কোনওদিন সরকার বলে দিতে পারে, অনেক হয়েছে এবার পাততাড়ি গুটোও। তারপর কোথায় যাবো, কোনদিকে, জানি না। গরিব শরণার্থীরা জীর্ণ তাঁবুতে বাস করে, আমি কোনও তাঁবুতে বাস করি না, কিন্তু অনিশ্চয়তা আমাদের একই। আমাদের দেশ বলে কোথাও কিছু নেই। আমাদের ঘর বলে সত্যিকার কিছু নেই, মাথার ওপর ছাদ বলে কিছু নেই। আমাদের নিশ্চয়তা, নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। মানবতার অপমান যারা করছে, তারা আজ দেশে দেশে দেশ নিয়ে বড়াই করছে। ছি:!