রক্ত স্বাক্ষর – হীরেন চট্টোপাধ্যায়

রক্ত স্বাক্ষর – হীরেন চট্টোপাধ্যায়

সিঁদুরে মেঘ

আগুন জ্বলছে সারা দেশে-দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন৷ অসন্তোষের আগুন, প্রতিশোধের আগুন, দেশপ্রেমের আগুন৷

লকলকে শিখা ছড়িয়ে পড়ছে হু-হু করে৷ বাংলা থেকে মুম্বাই, মুম্বাই থেকে দিল্লি, দিল্লি থেকে পাঞ্জাব৷ সেই আগুনের হলকায় পবিত্র হয়ে অসংখ্য যুবক কিশোর সম্মিলিত কন্ঠে হুংকার দিয়ে উঠছে-আমার দেশ আমায় দাও!

ঘরে ফিরে যাও লালমুখো সাহেব!

বন্দে মাতরম! মেরে ওয়তন!

সেই আগুনের হলকা এসে লাগে গায়ে-কিছুই বুঝতে পারে না রতন৷

অবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে চায়৷

রুটির টুকরো ভেঙে মুখে দিতে দিতে বাবা বোঝায় অনেক কিছু৷ এই দুশমন ইংরেজকে আগে চেনা যায়নি-মনে হয়েছিল বড়ো ভালোমানুষ৷ ভালো কথায় ভুলিয়ে তারা বহুত আশা দিয়েছিল আমাদের৷ আমরা আরও বড়ো চাকরি পাব, আরও সুখশান্তি পাব, আর আজাদি পাব৷ তাইতো ইংরেজের পক্ষ নিয়ে আমাদের জওয়ানরা ওরকম জবর লড়াই করল জার্মানির সঙ্গে৷

সাহেবদের ভালো বোঝে না, জার্মানদেরও না-তবু রতনের বুক কাঁপে যুদ্ধের কথা মনে হলে৷ চোখের তারা বিস্ফারিত হয়ে যায়৷ হওয়াটাই স্বাভাবিক, কতোই-বা বয়স ওর৷

ওর বাবার কিন্তু খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়৷ হাত মুঠো করে বোঝাতে বসে জওয়ানদের বীরত্বের কথা৷

সত্যিকারের মরদের বাচ্চা আমরা৷ শত্রুর সঙ্গে কেমন করে মোকাবিলা করতে হয় আমরা জানি৷ তাই ইংরেজের কথা বিশ্বাস করে আমরা প্রাণপণ শক্তিতে আমাদের খুন দিয়ে ওদের শত্রুকে আটকেছি৷ লড়াই তো শেষ হল, কিন্তু শুরু হয়ে গেল দুর্ভিক্ষ৷ এই তো আগের বছরের কথা, বেশিদিন তো হয়নি এখনও-

চোখ ছলছল করে আসে রতনের৷ মনে আছে অক্ষরে অক্ষরে, ভোলেনি কিছুই৷ বয়স তার যত অল্পই হোক৷ সে সব দিনের কথা কি ভোলা যায়!

উনিশ-শো আঠারো সালের দুর্ভিক্ষ৷ প্রচণ্ড খরা-এক ফোঁটা জল নেই কোথাও৷ খেতের ফসল খেতেই শুকিয়ে গেল সব৷ শ্মশান হয়ে গেল মাঠের পর মাঠ৷ মনে পড়লেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে এখনও৷ বাড়ির সবাই হাঁ করে তাকিয়ে আছে, বাবা কখন ফিরবে৷ ফিরল যখন, একটা দানা নেই হাতে৷

রতনের বাবা আবার একটুকরো রুটি ছিঁড়ে মুখে দিয়, বলে-তবু কি পিছপা হয়েছি আমরা!-মুখ বুজে সহ্য করেছি৷ শুধু এই কথা ভেবে আমরা মনকে বুঝিয়েছি-আফশোস কোরো না, ইংরেজ রাজারা আমাদের সুখ দেবে, শান্তি দেবে৷

কিন্তু কী হল শেষ পর্যন্ত! কী দিল আমাদের ইংরেজ!

রতন বাবার মুখের দিক তাকায়৷ কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারে, বাবার মন তখন চলে গেছে সেই বিষাক্ত দিনগুলির দিকে৷ সেই কথাই ভাবছে বাবা৷

ইংরেজের সেই চূড়ান্ত বিশ্বাসহীনতা৷

রাজ্যসচিব মন্টেগু সাহেব অনেক আশ্বাস দিয়েছিলেন৷ তেমনি করেই সান্ত্বনা দিয়েছিলেন গভর্নর জেনারেল চেমসফোর্ড৷ সেই অনুসারে মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্টও বার হয়েছিল৷

কিন্তু কতটুকু পাওয়া গেল সেই রিপোর্ট থেকে৷

সামান্য একটু প্রলোভন-যেন ভিখারিকে সন্তুষ্ট করা হচ্ছে কয়েক দানা চাল, গম দিয়ে৷

সেই বিরোধের সূত্রপাত৷

কংগ্রেসের একদল, এই সামান্য ভিক্ষার দানেই খুশি, কিন্তু খুশি হতে পারেনি বাপুজি-

হাত জোড় হয়ে আসে৷ রতন বাবার ভক্তি দেখে চোখ বড়ো বড়ো করে৷

ওর মাথা নুয়ে পড়ে৷ বাবা বোঝায়-যে-সে লোক নয় এই বাপুজি! আমাদের সবার বাপুজি৷ সবার ওপরে যাঁর স্থান৷ সেই বাপুজি আমাদের শিখিয়েছেন, ওসব কথায় বিশ্বাস কোরো না৷ ওদের কাউকে বিশ্বাস নেই৷ যত দিন ওরা এখানে থাকবে, আমরা আমাদের সংগ্রাম, আমাদের জেহাদ চালিয়ে যাব-হাতিয়ারহীন জেহাদ৷

হাতিয়ার না হলে জেহাদ হয় কী করে? বুঝতে পারে না রতন৷ অবাক হয়ে যায়৷

হয়, হাতিয়ার ছাড়াও জেহাদ ঘোষণা করা যায়৷

ওদের অস্ত্র আছে, ওরা তাই দিয়ে যত পারে অত্যাচার করুক, কিন্তু আমাদের অস্ত্র না থাক-ভাই আছে, বহিন আছে, সাথি আছে লাখ লাখ-কত ওরা মারতে পারে আমরা দেখব৷ আমরা ওদের আইন মানব না, ওদের জিনিস কিনব না, ওদের জিনিস বেচব না-

কিন্তু-

রতন বুঝতে চায় না৷ কিছুতেই সংশয় ঘোচে না মনের৷

‘আমরা পারব ওদের সঙ্গে-এই ইংরেজ সাহেবদের সঙ্গে? ওদের কত অস্ত্র, কত শক্তি-‘

‘আমাদের শক্তিও কি কিছু কম নাকি? এতগুলো মরদ আমরা যদি রুখে দাঁড়াই একসঙ্গে! শুধু এই অমৃতসর শহরেই কত লোক আছে জানিস?’

রতন ভালো বোঝে না৷ কথা বলতে পারে না৷

খাওয়া শেষ করে বাবা উঠে পড়ে৷ পাগড়িটা মাথায় ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বলে, দেখে নিস, আমরা একদিন আজাদি পাবই৷

‘আজাদি!’

‘হুঁ৷ স্বরাজ পাব আমরা৷’

রতনের মন যেন কিছুতেই বুঝতে চায় না, শুধু ডাগর ডাগর চোখ দুটো বড়ো হয়ে যায়৷ বলে, ‘সাহেবরা থাকবে না এখানে?’

‘না৷’

-‘কোথায় যাবে ওরা?’

-‘ওদের দেশে ফিরে যাবে৷ আমাদের দেশ থেকে ওদের চলে যেতেই হবে৷’

-‘সত্যি বলছ?’

রতনের চোখ ঝকঝক করে ওঠে৷ ওর বাবাও যেন সেই দেখে উল্লসিত হয়ে ওঠে, বলে- ‘সত্যি রতন, সত্যি৷’

ন্যায়ের আহ্বান

-‘সাচ বলছ তো ভাইজান?’

লালা সুন্দর উত্তেজনায় লাল হয়ে যায়, এইরকম নিয়ম করেছে ওই ইংরেজ সরকার?

‘হ্যাঁ৷ জিজ্ঞেস করো না আলি মিয়াকে৷’ আঙুল দিয়ে মিয়া সিকান্দার আলিকে দেখিয়ে নিজেও হাঁপাতে থাকে রতনের বাপ৷

লালা সুন্দরকে দেখে মনে হয় বিশ্বাসই করতে পারছে না, সিকান্দার আলির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কি আলি সাহেব, সাচ?’

-‘হ্যাঁ, লালাজি-যা শুনছ সব সত্যি৷’

-‘কবে এই নিয়ম হয়েছে!’

-‘গতকাল৷ হবার সঙ্গেসঙ্গে চারদিকে আগুন জ্বলে উঠেছে৷’

ঘরে একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছিল-লালা সুন্দর উঠে গিয়ে কালি দিয়ে তারিখটাকে গোল করে ঢেকে দেয়৷ অসহ্য আক্রোশে তারিখটার ওপর দাগ দিতে থাকে৷

তেইশে মার্চ, উনিশ-শো উনিশ৷

সত্যিই কলঙ্কিত অধ্যায়৷ ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না৷ ইংরেজ সরকারের কুখ্যাত রাওলাট অ্যাক্ট প্রচারিত হয়েছিল এই দিনই৷

সরকার পক্ষের যেকোনো ধরনের সমালোচনা, ধর্মনৈতিক যেকোনো কলহ, অথবা হিন্দু-মুসলমানের ঝগড়া-সমস্ত কিছু ধরা হবে ‘বিপ্লবী আন্দোলন’ হিসেবে৷ এই বিপ্লবী আন্দোলনে ধৃত আসামীর আদালতে কোনো বিচার প্রার্থনা করার অধিকারও থাকবে না৷ সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াও যেকোনো লোককে এই বিধি অনুসারে শাস্তি দেবার অধিকার সরকারের থাকবে৷

-‘তার মানে?’ এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি লালা জ্ঞানচাঁদ, এবার আর না বলে পারল না৷

-‘তার মানে, সাহেবরা যা খুশি তাই করবে?’

-‘হ্যাঁ লালাজি৷’

-‘কিন্তু তা আমরা করতে দেব না!’ গর্জে ওঠে লালা সুন্দর৷ এদেশ আমাদের৷ আমরা যা চাইব তাই হবে৷ ওদের কথা আমরা শুনব না৷

-‘ঠিক বলেছ লালাজি৷’ মিয়া সিকান্দার আলির চোখ দুটো অসন্তোষের আগুনে যেন ঝলসে ওঠে৷ দেশ আমাদের৷ আমরা যা চাইব তাই হবে৷ বাপুজিও তাই বলেছেন৷

-‘বাপুজি? কী বলেছেন বাপুজি?’

-‘বাপুজি বলেছেন আমরা আমাদের সত্যাগ্রহ আন্দোলন চালিয়ে যাব৷ তারই পহেলা কাজ হিসাবে একহপ্তা পরে আমরা হরতাল পালন করব৷’

-‘তিরিশে মার্চ, না আলি ভাই?’

‘হ্যাঁ৷’

-‘আমার ভাইপোও তাই বলছিল’, লালা জ্ঞানচাঁদ আবার কথা বলল৷’ পাগড়িটা হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে বললে, ‘ও বলছিল বাপুজি ওইদিন সারা দেশের লোককে হরতাল পালন করতে বলেছেন৷’

-‘হ্যাঁ৷ দোকানপাট সব বন্ধ থাকবে৷ আমরা রাস্তায় জমায়েত হয়ে আমাদের আর্জি পেশ করব৷’

লালা সুন্দর উত্তেজিত ভাবে বলে, ‘ব্রিটিশ রাজ আমরা চাই না৷ হ্যাঁ, বলব-সাহেব, তোমরা নিজেদের দেশে ফিরে যাও৷ দেশ আমাদের৷ তোমরা কে?’

বেলা চড়ছিল৷ সকালের রোদে ঝাঁঝ নেই৷ রোদ বাড়লে একটু অস্বস্তি লাগে৷ রানী বাজারের একটা চালার মধ্যে বসে কথা হচ্ছিল৷ রাস্তায় লোক চলাচল এর মধ্যেই কমতে শুরু করেছে৷ মাথায় করে মাল নিয়ে যাচ্ছে সোহম লাল৷ নিশ্চয়ই কুচা কৌড়িয়ানওয়ালার দিকে যাচ্ছে৷ মশলা পট্টির ওধারে একটা বয়েল জাবর কাটছে৷

-‘এবারের মেলাটা বোধ হয় তেমন জমবে না৷’ কথাটা বলার সঙ্গেসঙ্গে রতনের কথা মনে পড়ে গেল ওর বাবার৷ ছেলেটা বড়ো ভালোবাসে এই মেলা দেখতে৷

-‘হ্যাঁ, এবার মেলা ভালো হবে না৷’ লালা সুন্দর ওর কথায় সায় দিলে৷

-‘এখনও বহুত দেরি আছে৷’ লালা জ্ঞানচাঁদ বলে ওঠে, তেরোই এপ্রিল, বহুত দেরি৷

-‘লালা রামগোপালের ঘোড়াটা দেখেছ-‘ রতনের বাবা অন্য প্রসঙ্গে আসতে পেরে একটু যেন শান্তি পায়৷ বহুত তাগড়াই হয়েছে৷ এবারে মেলায় ওর ঘোড়াটাই পহেলা ইনাম মেরে দেবে৷

-‘না ভাই সায়েব, ওসব আর ভালো লাগছে না এখন-‘ সেকেন্দার আলি অস্বস্তিতে মাথা নাড়ে৷ ওসব আর ভালো লাগে না এখন, মাথায় খুন টগবগ করে ফুটছে৷

-‘যা বলেছ আলিজান৷’

এর পর কেমন যেন কথা ফুরিয়ে যায়৷ মাথার ওপর জ্বলন্ত সূর্য৷ তামাদের দোকানের বুড়িটা কল থেকে জল নিচ্ছে৷

-‘লালা রামগোপালকে দু-দিন দেখিনি৷’ লালা জ্ঞানচাঁদ বললে৷

-‘আমার ভাইপো বলছিল পার্টির অফিসে গিয়েছিল তার আগের দিন৷’

আবার চুপচাপ৷ শেষ পর্যন্ত রতনের বাবাই উঠে পড়ল৷

-‘যাই, খেতিটা একবার চক্কর দিয়ে আসি৷’

-‘এত বেলায়?’

-‘হ্যাঁ, লালাজি-একবার দেখে আসি৷’

বাজার থেকে বেরিয়ে একবার মধ্যগগনের সূর্যের দিতে তাকাল৷ উজ্জ্বল প্রদীপ্ত, পূর্ণ মহিমায় সুস্থির৷ কী মনে করে চোখ নামিয়ে হঠাৎ বাড়ির দিকেই পা চালিয়ে দিল৷

ছন্দিত স্ফুলিঙ্গ

ছটফট করছিল রতন৷

দুপুর পর্যন্ত ভরসা ছিল-হয়তো ফিরবে এবার৷ কিন্তু কোথায় কী৷ দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল-

তড়িৎ পায়ে জানলার কাছে ছুটে এল রতন৷

দরজায় আওয়াজ হল না? নাঃ, কিছু না-মনের ভুল৷

বাবা অবশ্য আগেই বলেছিল৷ ‘আজ আমার ফিরতে দেরি হতে পারে৷ তুই আজ আগেই খেয়ে নিস, আমার জন্যে অপেক্ষা করিস না৷’

-‘কত দেরি হবে?’ রতন জিজ্ঞাসা না করে পারেনি৷

-‘সে কথা কি আগে থেকে বলা যায়? আজ যে আমাদের হরতাল৷’

-‘হরতাল!’

-‘হ্যাঁ, আমাদের লড়াই-এর দৌড়ান আজই শুরু হয়ে গেল৷’

কিন্তু-রতনের বুক কেঁপে ওঠে৷ বলে, ‘সায়েবরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করবে না তো বাপজান?’

-‘চেষ্টা করতে পারে-শয়তানগুলোকে আমরা তাড়াবার চেষ্টা করছি তো, সহজে ওরা এদেশ ছাড়বে না৷’

-‘তবে?’

-‘তবে কী-আমরা কৌশিশ করব না?’ এগিয়ে এসে এবার রতনের মাথায় হাত রেখেছিল ওর বাপ৷

-‘এখন এরকম কথা বললে চলে? সারা দেশের লোক যে-কাজের জন্যে ছুটে যাচ্ছে, আমি মরদ হয়ে-‘

চোখ ছলছল করে এসেছিল, কিছু বলতে পারেনি৷

নীরবে বিদায় নিয়েছিল সকালে৷ সেই থেকে অস্থির পদচারণা৷

চুল্লি ধরাতে গিয়ে হাত কেঁপেছে আজ, রুটি বানাতে গিয়ে পুড়ে গিয়েছে অর্ধেক৷ এসব কাজ রতনকেই করতে হয় এখন সংসারে আর তো কেউ নেই৷ দুর্ভিক্ষেই তো সব খতম হয়ে গিয়েছে৷

আজ দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল-

জানলার কাছ থেকে সরছিল না-লালা সুন্দরের ছেলেকে দেখতে পেল রাস্তায়৷

-‘এই, শোন৷’

এগিয়ে এল জানলার নীচে-ডাকছ রতনদাদা?

-‘আয় না ঘরে, একটু বোস না৷ একলা আছি, বাপজান এখনও ফেরেনি তো৷’

দুয়োর খুলে দিয়ে ভেতরে বসল রতন৷

-‘রুটি খাবি?’

-‘না, দেরি হলে মা ভাববে বসে বসে৷’

-‘কীসের দেরি?’

-‘মা বললে কি, রাস্তার খানিকটা দেখে আয় বাবা আসছে কি না৷’

-‘তোর বাবাও এখনও ফেরেনি তাহলে?’

-‘না, সেই জন্যেই তো মা পাঠাল৷’

-‘কোথায় গিয়েছে রে তোর বাবা?’

-‘তুমি দেখছি কিছুই জানো না-আজ যে ওদের হরতাল৷’

-‘হরতাল মানে?’

লালা সুন্দরের ছেলে হেসে গড়িয়ে পড়ে মাটিতে, ‘নাঃ রতনদা তুমি এক্কেবারে বোকা, আরে আমরা যে হরতাল করে দেশ থেকে সায়েবদের তাড়াব!’

রতন উঠে গিয়ে ভেতর থেকে একটু লেবুর আচার নিয়ে আসে৷ যা তুই সাহেব তাড়া এখন৷ ছেলেটা একটু হতভম্ব হয়ে আচার নিয়ে চলে যায়৷

দুয়োরটা বন্ধ করেছে কি করেনি-খট খট খট৷

-‘কে?’

-‘খোল, দুয়োর খোল৷’

অতি পরিচিত গলা৷ দৌড়োতে দৌড়োতে এসে দুয়োর খুলে দেয় রতন৷ ঝড়ো কাকের মতো চেহারা হয়েছে যেন৷ সারাদিন স্নান নেই, খাওয়া নেই-পা-ভরতি ধুলো৷

ভেতরে ঢুকতেই হাত দু-খানা চেপে ধরে রতন৷ ‘কোনো ঝামেলা হয়নি তো বাপজান? সায়েবরা তোমাদের আটকায়নি?

‘নাঃ৷ আমরা দলে কত ছিলাম জানিস৷ সারা শহরের লোক জমায়েত হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে রাস্তায় রাস্তায়৷’

‘লুঠতরাজ কিছু হয়নি তো?’

-‘কে করবে লুঠতরাজ? ওরা আমাদের ব্যারিস্টার সাহেবকে আটকে রেখেছে- সেই কিচলু সাহেবের মুক্তির কথা আমরা বলে বেড়িয়েছি শুধু৷ তবে নিজেদের রাগ আমরা তেমন করে বুঝতে দিইনি ওদের৷’

রতন ভয় পেয়ে যায়৷ ওর মুখ-চোখ শুকিয়ে আসে৷

‘শুধু কিচলু সাহেবকে নয়, পণ্ডিত কটুমলজিকেও৷ কিন্তু কতদিন এভাবে আটকে রাখতে পারবে ওরা৷ দু-দিন, চার দিন, দশ দিন!’

উত্তেজনা খানিকটা সামলে নিয়ে বলে, ‘বাপুজির এক সাকরেদ এসেছিলেন সেদিন-স্বামী সত্যদেও৷ কী বললেন জানিস? বললেন, হর আদমির মধ্যে যে শক্তি আছে, যে তাকত আছে, তাকে জাগিয়ে তুলতে পারলে সারা জমানা আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখবে৷ লাল রঙের সাহেবরা ওদের ফৌজ নিয়ে যতই ভয় দেখাক-আমাদের কাছে একদিন ওদের হার হবেই হবে-‘

রতন ভালো বোঝে না৷ বাবার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়৷ বলে, ‘ওসব কথা পরে হবে, খানাপিনা তো সেরে নাও আগে৷ সারাদিন ভুখা আছ৷’

খেতে খেতে আবার সব কথা মনে পড়ে যায় রতনের বাবার৷

ডক্টর সত্যপালের সেই সব কথা৷ ওঃ, কথা তো নয়, চাবুক মেরে খুন চড়িয়ে দেয় মাথায়৷

সাহেবরা বলে দিয়েছে, বন্দিদের ওরা মুক্তি দেবে না৷ তার মানে আজাদি নিতে হবে লড়াই করে৷

চিরকালই তাই হয়ে এসেছে-সত্যপালজি সেই কথাই বুঝিয়েছিলেন, আজাদি চাইলেই সুড়সুড় করে তা কেউ ফিরিয়ে দেয় না৷ লড়াই করতে হবে এর জন্যে৷ জান দিতে হয় দরকার হলে৷ করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে৷

রুটির শেষ টুকরো মুখে পুরে দিয়ে বলে, ‘কাল ঘড়িঘরে টাঙানো হবে আমাদের ইস্তাহার৷ শহর ছেয়ে যাবে আমাদের ইস্তাহারে৷’

-‘কীসের ইস্তাহার?’

-‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে৷ আমরা আজাদি আদায় করব, জান কবুল৷ পিছিয়ে আসা চলবে না৷’

রতন সভয়ে তাকায় বাবার দিকে৷

‘ছিঃ রতন-, এই সময় তুই এমনি করে ডরপুক হতে শুরু করলি? আজাদির জন্য লড়াই করে যদি মরি-‘

-‘থাক থাক, ও কথা থাক৷’

-‘কেন থাকবে রতন? লালা রামগোপাল মিয়া, মহম্মদ শরিফ, আলিজান-সকলেই তো ছিল আজকের হরতালে৷ সকলেই তো বললে, জান কবুল-এ আজাদি আমাদের পেতেই হবে৷ জিন্দেগিতে এত বড়ো কাজ করার সুযোগ আর পাওয়া যাবে না৷ বল তুই, ওরা কি মানুষ নয়? ওদের শরীরে খুন নেই?’

‘কিন্তু-‘

‘কোনো কিন্তু নেই রতন৷ যদি বাঁচতেই হয়, কুত্তা হয়ে বাঁচব কেন? এ দেশ আমার- আমাদের এ দেশ ওদের ছেড়ে দিতেই হবে৷’

রতন কথা বলতে পারে না৷ শুধু বাবার কাছাকাছি সরে আসে৷

বাইরে দিনের আলো কমে গিয়েছে ততক্ষণে৷ আবছা অন্ধকারের চাদর নেমে আসে আস্তে আস্তে৷

বাবার কাছ থেকে সরে আসে রতন৷

সন্ধ্যা হয়ে গেছে, বাতি জ্বালাতে হবে এবার৷ ঘরে ঘরে বাতি জ্বলবে এবার৷ কড়া রোশনাই-এ সারা মুলুক ভরে যাবে৷

এমন দিন কি এগিয়ে আসছে সত্যিই! বাপ তো তাই বলে৷ আর বাবা তো ঝুট বলতে ঘেন্না করে৷ তাহলে! রতনের চোখে ঘোর লাগে৷

দিন বদলের পালা

আর প্রতিবাদ নয়, এবার বদলা!

অনেক বলা হয়েছে৷ নীরবে হরতাল করার চেষ্টা হয়েছে৷ জমায়েত হয়ে ওদের কাছে কাকুতি-মিনতি করা গেছে৷ আর নয়৷ কালকের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে৷

সত্যপালজিই বলেছিলেন, রামনবমী বড়ো পবিত্র দিন৷ এই দিনে যেন কোনো খুন-খারাবি না হয়৷

সেই মতো দশ তারিখেই সব জমায়েত হয়েছে বল বাজারে৷ কাতারে কাতারে লোক৷ মুখে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা-

করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে৷ মধ্যপন্থা নেই৷

হয় আমাদের জান নাও, না হয় আমাদের আজাদি দাও৷ কুত্তার মতো বহুকাল, তোমাদের পায়ের নীচে পড়েছিলাম৷ আজ ঘুম ভেঙেছে৷ খোয়াব টুটে গেছে আজ-বুঝতে পেরেছি৷ তোমরা আমাদের বন্ধু নও, তোমরা আমাদের দুশমন৷

যাত্রা শুরু হল বাজারের ফটক দিয়ে গিয়ে, পড়ল ওরা ব্রিজের ওপর৷ মুখে উত্তেজিত শ্লোগান৷ করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে৷ হমারা আজাদি লৌটা দো৷

দলনেতারা বললেন, ‘পহেলা দফায় আমরা যাব ঘোড়সওয়ার পুলিশের কাছে৷ ডাক্তারজিকে ফিরিয়ে দিতে হবে৷’

জনতা উত্তেজিত৷ আজাদি পাবার নেশায় বুঁদ হয়ে রয়েছে৷ টগবগ করে ফুটছে মাথার খুন৷

কিন্তু যত সহজে সমস্ত ব্যাপার সমাধা হয়ে যাবে ভেবেছিল দলনেতারা, তত সহজে কিছু হল না৷

পুলিশ ফোর্সে তখন বাঘা বাঘা লোকজন সব৷ ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট মিস্টার প্লমার৷ ডেপুটি কমিশনার মিস্টার মাইলস আরভিং৷ দু-জন সিভিল সার্জন ম্যাসি সাহেব আর স্মিথ সাহেব৷ তার ওপরে রয়েছে পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট রোহিল সাহেব৷ জাঁদরেল লোক হিসেবে সাহেব-সুবোরাও নাকি তাকে সমীহ করে৷

দলবল পুলিশ স্টেশনের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই একদল সাহেব ঘোড়া হাঁকিয়ে সামনে এল৷ সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে আর চারজন পুলিশ৷ ভারতীয় মুসলমানও দেখা গেল একজন৷

-‘ও হল বেকেট সাহেব-অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার!’ লালা জ্ঞানচাঁদ ফিসফিস করে বললে৷

সামনে ওরা এগিয়ে আসার আগেই সারা দল চিৎকার করে উঠল-‘বন্দিদের ফিরিয়ে দাও!’

-‘ডাক্তারজির মুক্তি চাই৷’

-‘সইফউদ্দিন কিচলুকে ছেড়ে দিতে হবে৷’

দুর্দম গোঁয়ারের মতো এগিয়ে এল বেকেট৷ সরে যাও৷ সরে যাও সব অসভ্য জংলিরা৷

-‘কক্ষনো না-বন্দিদের মুক্তি দাও৷’

-‘তোমরা হটে যাও এখান থেকে! গর্জে উঠল বেকেট৷’

কিন্তু তার কন্ঠকে ছাপিয়ে হাজার হাজার কন্ঠ একসঙ্গে ধ্বনিত হয়ে উঠল৷ সেই প্রচণ্ড কলরোলে ভয় পেয়ে পেছিয়ে এল চারটে পুলিশের ঘোড়া৷ উলটো মুখ ধরলে তারা৷

একমাত্র বেকেটই অবিচল৷

ওদিকে রামবাগের দিক থেকে জনতার তাড়া খেয়ে পেছিয়ে এসেছে ম্যাসি সাহেব৷ উপায়ান্তর না দেখে আরভিং কিছু সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে এগিয়ে এল সাহায্য করতে৷

-‘সরে যাও, নইলে গুলি করা হবে!’ চিৎকার করে উঠল বেকেট৷

-‘বন্দিদের মুক্তি চাই!’ ওরাও গর্জন করে উঠল৷

জনতা তখন ক্ষিপ্ত৷ কে যেন দুটো পাথর ছুড়ে মারল ওদের দিকে৷

সঙ্গেসঙ্গে কয়েক রাউন্ড গুলি চালাল ওরা৷

কয়েকজন লোক পড়ে গেল চোখের সামনে৷

থমকে গেল ওরা৷

দুজনের আঘাত গুরুতর৷ তাদের কাঁধে করে নিয়ে চলল কয়েকজন ডাক্তার বসির-এর কাছে ফরিদ বাজারে৷

কিন্তু জনতা তেমনি অনড় অটল৷ তারা কিছুতেই সরবে না বন্দিদের না নিয়ে৷

বেকেট-এর মতো লোকও যেন একটু দ্বিধায় পড়ে গেল৷

বেলা একটা নাগাদ অতিরিক্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার কনর সাহেব এল লেফটেন্যান্ট ডিকিকে নিয়ে৷ ডিকি রগচটা লোক-কনরের নির্দেশে আবার গুলি চালাল সে৷

জনতা একটু চঞ্চল হল৷ কিন্তু পালাল না, পালাতে কেউ আসেনি৷

আবার ধ্বনি উঠল, ‘বন্দিদের ফিরিয়ে দাও!’

অগণিত জনতা৷ সামনে কিছু সংখ্যক উদ্ধত সশস্ত্র পুলিশ৷

বেলা বাড়তে লাগল৷ কোনো পক্ষই নমনীয় নয়৷ গ্রীষ্মের প্রখর তাপ৷ সমস্ত অমৃতসর যেন পুড়ছে৷ সকাল থেকে মানুষগুলো দাঁড়িয়ে আছে ঝলসানো রোদ্দুরে৷

-‘বন্দিদের ফিরিয়ে দাও৷’

-‘ডাক্তার সাহেবের মুক্তি চাই!’

অসম্ভব-অসম্ভব! খেপে উঠল বেকেট৷ নির্দেশমতো প্লমার এসে পড়ল বাইরে থেকে অনেক পুলিশ নিয়ে৷

এক রাউন্ড গুলি চালাতেই পিছিয়ে এল জনতা৷

সংখ্যায় পুলিশ বেশ ভারী৷ একবার গুলি চালানো মানেই-

ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত মানুষগুলো খেপে উঠল৷

সামনে এগোনোর উপায় নেই৷

-‘চলো ভাই, পিছিয়ে চলো,’ হাঁক দিয়ে উঠল মিয়া মহম্মদ শরিফ৷

উন্মত্ত ক্রোধে পিছনে হটে গেল সবাই৷ মাথায় আগুন জ্বলছে৷

রেলস্টেশনে এসে শুরু হল লুঠতরাজ৷ শহরে পথঘাটও বাদ গেল না৷ দু-একটা সাহেবি দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হল৷

সামনেই জেনানা হাসপাতাল৷

হাসপাতালকে নিশ্চয়ই এড়িয়েই যেত ওরা৷ কিন্তু মুশকিল বাধাল এসডন সাহেব নিজে৷ হাসপাতালের ছাদে উঠে অশ্রাব্য গালাগালি শুরু করল৷ একেই খেপে ছিল৷ আরও খেপে গেল৷

‘মারো সাহেবদের!’ খতম করে দাও জানে একেবারে!

হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল একদল হাসপাতালের মধ্যে৷ কোথায় কে-মুহূর্তের মধ্যে যেন জাদুমন্ত্রে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে সবাই৷ রাগে অন্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে এল সব৷

তখনই একটি অন্যায় ব্যাপার ঘটে গেল৷ সাইকেলে করে আসছিলেন সিটি মিশন স্কুলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট-মিস শেরউড৷

‘সাদা চামড়া! মারো উসকো!’

জনতার একাংশ ছুটল পেছন পেছন৷

ভয় পেয়ে মিস শেরউড সাইকেলের গতি প্রাণপণ বাড়িয়ে দিলেন৷ কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে আত্মরক্ষা করা যায় না৷ পেছনে এতগুলো উন্মত্ত লোক!

কুচা কৌড়িয়ানওয়ালাতে এসে খোলা দরজা দেখতে পেয়ে শেরউড চিৎকার করে উঠলেন, ‘আমায় বাঁচাও!’

মুখের সামনে দরজা বন্ধ হয়ে গেল৷

আর শক্তি ছিল না প্রতিরোধ করবার মতো৷ উন্মত্ত জনতা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল মিস শেরউডের ওপর৷

মৃতপ্রায় দেহটাকে ক্ষতবিক্ষত করে যখন তারা চলে গেল, গলি তখন জনশূন্য৷

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই যদি হিন্দু পরিবারের বৃদ্ধটি এসে না পড়ত, শেরউডকে জীবন ফিরে পেতে হতো না৷ অমৃতসরের উন্মত্ত জনতা ভুল করে যাকে আঘাত করল-অমৃতসরেরই এক বয়স্ক অধিবাসী তার শুশ্রূষার ভার গ্রহণ করল৷

কিন্তু জনতার রাগ তখন মোটেই শান্ত হয়নি৷ সাদা চামড়ার মানুষকে নিগৃহীত করে তা আগুনের মতো লেলিহান শিখা বিস্তার করেছে৷

এবার সাহেবদের পরিচালিত ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক৷

উন্মত্ত মানুষগুলো এখন চিন্তাশক্তি হারিয়েছে৷ তছনছ করে দিল সবকিছু৷ উঠে এলে ওপরে৷

ম্যানেজার স্টুয়ার্ট আর তার সহকারী স্কট ভয় পেয়ে পালাতে যাচ্ছিল৷ সে সুযোগ তারা পেল না৷ নির্মম ভাবে তাদের হত্যা করে মানুষগুলো লাফিয়ে উঠল৷ সাদামানুষ খতম করো! ওদের জিনিস ধ্বংস করো! পুড়িয়ে দেওয়া হল ব্যাঙ্ক৷

জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ল এবার দি অ্যালায়েন্স ব্যাঙ্কে৷

ম্যানেজার টমসন পালাতে পারত৷ কিন্তু সঙ্গে রিভলভার ছিল-সেই সাহসে এগিয়ে এল সামনে৷ এতবড়ো ক্ষিপ্ত জনতার সামনে বাষ্পের মতো উড়ে গেল কয়েকটা রিভলভারের গুলি৷ সারাদিনের রোদে পোড়া মানুষগুলো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলল টমসনের দেহ৷ কেরোসিনের আগুনে দাউ দাউ করে পুড়তে লাগল দি অ্যালায়েন্স ব্যাঙ্ক৷

দিন গড়িয়ে চলে৷ মানুষগুলোর আক্রোশ কমে না৷ এবার চার্টার্ড ব্যাঙ্ক৷ তার ভাগ্যেও ঠিক একই দশা ঘটল৷

পাওয়া গেল সার্জেন্ট রোলান্ডকে৷ বেচারি ইলেকট্রিকের মিস্ত্রি৷ কিন্তু সাদা চামড়ার মানুষ৷ খতম করে দাও একদম!

তখনও ফুঁসছে জনতা রাগে৷ খুনকা বদলা খুন! আমরা চাইতে গিয়েছিলাম আমাদের প্রিয় নেতাকে-তার বদলে আমরা পেয়েছি গুলি৷

সন্ধ্যা হয়ে আসে৷ ক্লান্ত অবসন্ন মানুষগুলো কেমন ঝিমিয়ে পড়ে৷ টলতে টলতে বসে পড়ে ময়দানে৷

দলনেতা চিৎকার করে বলে, ‘কালকে আবার আমরা জমায়েত হব ভাইসব৷ আজকের কাম শেষ হয়েছে৷’

লালা জ্ঞানচাঁদের ভাইপো এগিয়ে আসে, ‘চলো চাচা, বাড়ি চলো৷’

রতনের কথা মনে পড়ে যায়৷ ওর বাবা দ্রুত পা চালায়৷

সমস্ত শহর জুড়ে মৃত্যুর হিমশীতলতা নেমে আসে৷

তরঙ্গ রোধিবে কে?

এ তো কেবল শুরু!

নিরীহ মানুষ যতদিন নিরীহ থাকে ততদিন তারা খুবই শান্ত৷ কিন্তু ধৈর্য্যের বাঁধ যেদিন ভেঙে যায়, সেদিন আর কোনোকিছুরই সাধ্য নেই তাকে থামায়৷

অমৃতসর শহরের শান্ত মানুষগুলো খেতি দেখত, বালবাচ্চা সামলাত-অবসর সময়ে নাচগানের আসর বসাত৷ বুড়ি ভুট্টাওয়ালিকে নিয়ে মাঝে মাঝে মজাক করত৷

মিয়া সিকদার আলির মতো লোক! লালা সুন্দরের মতো লোক! গোলমালের ভয় থাকলে নিজে গিয়ে তারা ফয়সালা করে দিয়ে আসত৷ আর আজ!

মানুষগুলো দাউ দাউ করে জ্বলছে৷ অত্যাচারের আগুনে পুড়ে মানুষগুলো হয়ে উঠেছে ইস্পাত৷

রেলের গার্ড রবিনসন উদ্ধতভাবে কিছু বলতে এসেছিল৷ পরের দিন বদলা তার নেওয়া হল জমায়েত হবার পরই৷

সাদামানুষদের কোনো ঔদ্ধত্যই আর ক্ষমা করা হবে না৷

স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে ওরা সামনে পেল রিলিজিয়াস বুক সোসাইটি৷ আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল তাতে৷ হল-ভরতি মূল্যবান বই অনেকটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল৷

ওদিকে অন্য পক্ষও চুপচাপ বসে ছিল না৷

আগের দিন ব্যাঙ্ক লুটের ঘটনা, জীবনহানির খবর পুলিশ মহলের উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক গুণে৷ জনতা বেশিদূর এগোবার আগেই আড়াই-শোর কিছু বেশি গুর্খা সৈন্য বাধা দিল তাদের৷ বাইরে থেকে আনা হয়েছে এই সব সৈন্যদের-ভেতরের পুলিশকে সাহায্য করবার জন্য৷

জনতা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একমুহূর্ত শুধু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ভাবল-তারপরই তারা চিৎকার করে এগিয়ে গেল৷

খুন কা বদলা খুন!

বন্দিদের মুক্তি চাই!

সৈন্যদের হাতের বন্দুক গর্জে উঠল৷ আঠারো রাউন্ড গুলি চলল৷ কিন্তু গুলির ভয় একবার কেটে গেলে-আর সে মানুষকে রুখবার কিছুই থাকে না৷

গুর্খা সৈন্যও হার মেনে গেল৷ নিরস্ত্র জনতা উন্মত্তের মতো ছিঁড়ে ফেলতে লাগল টেলিগ্রাফের তার-যোগাযোগের সমস্ত ব্যবস্থা৷

দলনেতারা এবার চিন্তায় পড়লেন৷ ঘটনার গতি এখন এমন হয়ে পড়েছে যে তীব্র হিংস্রতায় মানুষগুলো বিচারশক্তি হারিয়ে কাজ করছে৷ অথচ মাথা ঠান্ডা না থাকলে লড়াই ফতে করা যায় না৷ তা ছাড়া, বাপুজি আমাদের কী শিক্ষা দিয়েছেন! এই কি আমাদের প্রকৃত পথ!

চিৎকার করে উন্মত্ত জনতাকে থামালেন দুই দলনেতা, উকিল মকবুল মামুদ আর গুরুদয়াল সিং৷ এ পথ ঠিক পথ নয়৷ আমরা অসহযোগ করেই ওদের তাড়াতে পারি৷ এতগুলো মানুষকে ঠান্ডা করা কঠিন কাজ৷ কিন্তু কাজ হল৷ নেতাদের অশ্রদ্ধা করতে ওরা শেখেনি৷

শান্ত জনতার হয়ে দরবার করতে গেলেন পুলিশের কাছে এই দু-জন নেতা৷

কিন্তু ভুল করল পুলিশ কর্তৃপক্ষ৷

শান্ত নিরীহ জনতার ওপর অতর্কিতে আবার গুলি চালাল ওরা৷

আর্তনাদ করে অনেক মানুষ লুটিয়ে পড়ল ধুলোয়৷ সবাই পিছিয়ে এল নিরাপদ জায়গায়৷

আসলে ওরা মানতেই চেয়েছিল দলনেতার নির্দেশ৷ পুলিশের তরফ থেকে বেপরোয়া গুলি চালানো সত্ত্বেও৷

কিন্তু ভুল করল শাসকমণ্ডলী৷

বিকেলে লাহোরের কমিশনার কিচিন চলে এল অমৃতসরে৷ অমৃতসরের দায়িত্ব দেওয়া হল সেনা বিভাগের জেনারেল ডায়ারকে৷ এককথায় হিংসার আগুন নিবে যাওয়ার পর নতুন উদ্যমে শহরকে ধ্বংস করার-মানুষগুলোকে কুকুরের মতো মেরে ফেলার সব ব্যবস্থাই প্রস্তুত রাখলেন তদানীন্তন লেফটেন্যাস্টি গভর্নর স্যার মাইকেল ও’ ডাইয়ার! স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সম্ভবত বীভৎসতম নাম৷

কলঙ্কিত অধ্যায়

তারপর!

তারপর! তারপর ঐতিহাসিক তেরোই এপ্রিল৷ অমৃতসর শহরের নিরীহ মানুষের রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছে সেদিনের ইতিহাস৷ জালিয়ানওয়ালাবাগের সেই হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দিতে গিয়ে ইতিহাসও বোধহয় শিউরে ওঠে৷ অথচ কোনো প্রয়োজন ছিল না, প্ররোচনাও ছিল না কোনো৷ মানুষগুলো শান্ত হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই৷ বিশেষ করে দিনটা ছিল বেশ পবিত্র৷ বার্ষিক পশুমেলা৷ লোকজনও খানিকটা উৎসবের আনন্দেই ছিল-গত কয়েকদিনের তাণ্ডব সত্ত্বেও৷

ওপক্ষের প্রস্তুতি অবশ্য জানা গিয়েছিল আগেই৷ আগের দিন অমৃতসর শহরের ভার নিয়েছিল জেনারেল ডায়ার৷ সকালে তার নোটিশও পড়া হয়েছিল শহরের তেরো জায়গায়৷ কেউ যদি সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি করার কোনো চেষ্টা করে তবে তাকে গুলি করা হবে৷

কিন্তু সেসব কেউ খেয়াল করেনি অত৷ সকলেই মোটামুটি তৈরি হয়েছিল বাপুজির নির্দেশ মেনে চলবার জন্য৷ তা ছাড়া উৎসবের আনন্দেও মেতে ছিল সবাই৷

এরই মধ্যে অসহযোগ আন্দোলনের নীতি সকলকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য জালিয়ানওয়ালাবাগে জমায়েত করা হয়েছিল অনেককে৷ জমায়েত ভালোই হয়েছিল৷ পশুমেলা থাকার জন্য দূর থেকেও অনেক লোক মেলা দেখতে এসেছিল৷ তারাও যোগ দিয়েছিল জমায়েতে৷ সব মিলিয়ে হাজার পঁচিশ লোক হবে৷

চারদিক উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা জালিয়ানওয়ালাবাগ৷ একটি মাত্র সরু পথ দিয়ে ঢুকতে হয়৷ সেইটিই বেরোবার পথ৷ কথামতো মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়েছিল৷ ভাষণ দিচ্ছিলেন হংসরাজ৷ অকস্মাৎ দেখা গেল ভীষণ দৃশ্য৷

খোলা গাড়িতে করে সামনে অফিসাররা৷ পেছনে দু-জন ঘোড়সওয়ার পুলিশ৷ তার পেছনে দু-গাড়ি ভরতি প্রায় শ-খানেক সশস্ত্র পুলিশ৷ কেউ কিছু বোঝবার আগেই সরু প্রবেশপথে পুলিশরা দাঁড়িয়ে গেল৷

হংসরাজ বক্তৃতার মধ্যেই বলে উঠলেন, ‘ভয় পাচ্ছ কেন ভাইসব-নিরীহ নিরস্ত্র মানুষদের ওরা কিছু করবে না৷’

সাদা রুমাল তুলে পুলিশদের দিকে দেখানো হল৷

অঃতপর শুরু হল গুলি৷

হংসরাজ আরও একবার বলবার চেষ্টা করলেন, ‘তোমরা চঞ্চল হয়ো না-এসব ফাঁকা আওয়াজ৷’

কিন্তু ফাঁকা আওয়াজ করতে জেনারেল ডায়ার সেখানে আসেনি৷ বিনা প্ররোচনায়, বিনা সাবধানবাণীতেই শুরু হয় গেল নারকীয় হত্যাকাণ্ড!

ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসছে অবিরাম৷ প্রত্যেকটি মানুষ খুন করবার জন্য৷ একটিও নীচের দিকে লক্ষ করে নয়৷

ভেতরে নিরস্ত্র, অসহায়, উৎসবমুখী বিরাট মানুষের দল৷ পালাবার জন্য হুড়োহুড়ি লেগে গেল৷ কিন্তু পালাবার রাস্তা কোথাও নেই৷ উপায় নেই, তবু তো উপায় বার করতে হবে৷

ওই অবস্থাতেই গিরিধারীলাল আর হংসরাজ দেওয়ালের ওপর উঠে পড়লেন৷ বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে লাফ মারলেন উলটোদিকে৷ দেখাদেখি লালা রামগোপাল ওই ভাবেই ঝাঁপ দিল৷

কিন্তু ততক্ষণে পাঁচিলের ওপরও নজর পড়েছে ডায়ারের৷ ডাক্তার মণিরাম পাঁচিল থেকে লাফ দেবার পরই উঠতে যাচ্ছিল জ্ঞানচাঁদ৷ পায়ে বুলেট এসে লাগল৷ পড়ে গেল নীচে৷ হাঁটুতে মুখ গুঁজে পড়ে রইল কিছুক্ষণ৷

যা থাকে বরাতে-দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় উঠে বসল জ্ঞানচাঁদ৷

কেমন করে পাঁচিলে উঠল, কেমন করে লাফ দিল, কেমন করে দৌড়োতে লাগল রাস্তায়- সে কথা ও নিজেও ভালো করে জানে না৷

কিছুদূর এসে হঠাৎ খেয়াল হল-ভাইপোও তো গিয়েছিল বাগে৷ শুধু ভাইপো নাকি-বড়দা করণচাঁদ, নিজের ছেলে! ফিরে গিয়ে কোনো লাভ নেই! অপেক্ষাই করতে হবে-যদি ফিরে পাওয়া যায় ওদের৷

ফিরে অবশ্য পেয়েছিল জ্ঞানচাঁদ তার ভাইপোকে, কিন্তু অনেক পরে৷ তার মাথার খুলি তখন চূর্ণ-বিচূর্ণ! ঠিক নাকের নীচে একটা গুলি৷ নাকের বাঁ-পাশে আরও দু-টি গুলি৷ ঘাড়ের বাঁ- ধারে একটা গুলি, তিনটি গুলি ঊরুতে-আর মাথায় অন্তত দুটো!

জ্ঞানচাঁদ বেঁচে গেল প্রাণে৷ বেঁচে গেল মিয়া মহম্মদ শরিফও-কিন্তু বড়ো আশ্চর্যভাবে৷

পাঁচিলের দিকে এগোতেই ঊরুতে গুলি এসে লাগল শরিফের৷ সঙ্গেসঙ্গে পড়ে গেল মাটিতে৷ কিন্তু যেখানে পড়ল তার সামনে তখন মৃতের স্তূপ৷ তারাই বাঁচিয়ে দিল শরিফকে৷ এপাশে গুলি, ওপাশে গুলি-সামনে মৃতের স্তূপ-শরিফ সে স্মৃতির যন্ত্রণায় বহুদিন পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছে৷

শেঠ লক্ষ্মীরামও বেঁচে গেল-কিন্তু একটা পা তার কেটে বাদ দিতে হল পরে৷

বাইরের লোকও তো কম ছিল না৷ যেমন বেচারা প্রতাপ সিং৷ সামান্য ছুতোর মিস্ত্রি- ছেলেদের নিয়ে বৈশাখি মেলা দেখতে এসেছিল৷ গুলি আরম্ভ হবার সঙ্গে সঙ্গে দিশাহারা হয়ে ছেলেদের হাত চেপে ধরল প্রতাপ৷

পাশেই ছিল রামশরণ সিং-মিলিটারি চাকরি থেকে রিটায়ার করা লোক৷ সে-ই বলল, ‘শুয়ে পড়ো-ওরা ওপরে গুলি করছে-কুত্তার মতো মারতে চায় আমাদের৷’

হাত শক্ত করে ধরা, প্রতাপ শুয়ে পড়ল৷

কতক্ষণ গুলি চলেছিল প্রতাপ জানে না৷ একটা বিরাট দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয় সবকিছু৷

গুলি থামল একসময়৷

সঙ্গেসঙ্গে লোকের প্রচণ্ড চাপ৷ ছিটকে গেল ছেলেদের হাত-প্রতাপ উন্মত্তের মতো চাইতে লাগল এধার-ওধার৷ কোথায় কে-ঠেলতে ঠেলতে ওরা তাকে এনে ফেললে রাস্তায়৷ অবশ্য প্রতাপ রাস্তাতেই খুঁজে পেয়েছিল তার ছেলেকে৷ তা ছাড়া তাকে ভাগ্যবানই বলতে হবে৷ যে ক-জন অসম্ভব ভাগ্যবান সেদিন গুলিতে আহত হয়নি, সে-ও তাদের একজন৷ তবু বেচারিকে শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল পুরো এক মাস৷

কতক্ষণেরই বা ব্যাপার-জালিয়ানওয়ালাবাগের বুকে ঘটে গেল অমানুষিক হত্যাকাণ্ড৷ এর কোনো যুক্তি নেই-কারণ নেই৷ একদল শাসক, অন্যদল শোষিত-এ ছাড়া সান্ত্বনা পাবার কোনো রাস্তাই খোলা নেই৷

কতজন মারা গেল এই তাণ্ডবলীলায়! সঠিক হিসাব জানা যায় না-ডায়ারের নিজেরই মতে তিন-শো উনআশি জন৷ আর আহত বারো-শো৷ অর্থাৎ, যে আহতদের উদ্ধার করা গেছে-যে মৃতদেহ শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেছে, এ তাদেরই হিসাব৷ গুলির হিসাব দিয়েছে ডায়ার ঠিক আন্দাজ করে-মানে, সাড়ে ষোলো-শোর মতো৷ কিন্তু জ্ঞানচাঁদের ভাইপোই তো অন্তত আটটি গুলির চিহ্ন দেহে এঁকে নিয়েছে-এলোমেলো গুলি চালানোর এর চেয়ে বড়ো দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে!

ওদিকে সেরকম বিভীষিকাময় রাত রতনের জীবনে আর কখনো আসেনি৷ জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে বেশি দূরে নয় এদের বাড়ি৷ সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল৷ বাবা বলেই গিয়েছিল, ফিরতে দেরি হবে, বাগে একটা জমায়েত আছে৷ হঠাৎ গুলির শব্দ৷ চমকে উঠেছিল রতন৷ তারপর আবার-অবিশ্রাম গুলির শব্দ৷ কোনো ভুল নেই, বাগেই গুলি চালানো হচ্ছে৷ হায় রাম! আর্তনাদ করে উঠেছিল রতন৷ কী করবে সে এখন! গুলির শব্দ থামছে না-রতন চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে দিল৷ পাশের বাড়িতে ছুটে গেল, ‘আমার বাপজান যে আছে ওখানে৷’

-‘আমাদেরও আদমি আছে৷ রামজিকে ডাকো৷’

-‘কিন্তু যদি-‘

-‘তাই বলে এই গুলির মধ্যে কোথায় যাবে? সবুর করো, গুলি থামুক৷’

গুলি থামল একসময়৷

পাগলের মতো ছুটে গেল রতন বাগে-সঙ্গে পাশে বাড়ির সেই দু-টি মেয়ে৷ তাদেরও নিজের লোক আছে যে সেখানে৷

জালিয়ানওয়ালাবাগে নারকীয় দৃশ্য! নিহত আর আহত মানুষের পাহাড় পড়ে আছে যেন৷ রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারদিক-চোখ চেয়ে তাকানো যায় না৷

কিশোর ছেলেটি যেন পাথর হয়ে গিয়েছে কয়েক মুহূর্তের অভিজ্ঞতায়৷ মৃতের স্তূপ ঘেঁটে খুঁজতে লাগল সে তার বাবাকে এবং একসময়-চিনবার উপায় নেই-রক্তের সমুদ্রের মধ্যে যেন ডুবে আছে দেহটা৷ একবার শুধু থরথর করে কেঁপে উঠল রতনের শরীর৷ তারপর অকম্পিত হাতে দেহটা ছুঁয়ে দেখল৷

গুলি আরম্ভ হবার প্রথম দিকেই মারা গেছে৷ ঠান্ডা হতে আরম্ভ করেছে শরীরটা৷ অশ্রু জমে কঠিন হয়ে গিয়েছিল-রতন পরিচিতের সন্ধানে তাকাল৷ পাশেই ছলছল চোখে দাঁড়িয়েছিল লালা সুন্দর দাসের দুই ছেলে৷

-‘রতনদা, আমরা খুঁজে পেয়েছি বাবাকে৷’-চোখের জল বাধা মানল না তাদের৷

-‘কেঁদো না ভাইয়া-রতন নির্বিকারভাবে কথা বলছিল, ‘তোমরা যদি পার বাড়ি থেকে খাটিয়া নিয়ে এসো একটা৷’

ছেলেরা চলে গেল৷ মেয়ে দু-জনও থাকল না আর৷ কোনো অভিযোগ নেই রতনের৷ না, কারো বিরুদ্ধে নয়৷ অভিযোগ জানাবে কার কাছে!

অন্ধকার জাপটে ধরছে জালিয়ানওয়ালাবাগকে৷ অনেকক্ষণ তো গেছে ওরা-কখন আসবে? রতন ছটফট করতে লাগল৷ দূরে পেটা-ঘড়িতে আটটা বাজল৷ আর কোনো সম্ভাবনা নেই আসার-কারফিউ শুরু হয়ে গেল!

নিজেই দু-একবার চেষ্টা করল রতন যদি অন্তত মৃতদেহটা সরিয়ে একটা শুকনো জায়গায় রাখা যায়৷ না! অসম্ভব৷ রক্ত মাখামাখি হয়ে গেল কাপড়ে৷ এত ভারী শরীর কি তুলতে পারে ও!

-‘ভাইজান!’

রতন ফিরে তাকাল৷ একটা শক্ত সমর্থ শিখ যুবক সামনে দাঁড়িয়ে৷

-‘একটু হাত লাগাও না ভাই-লাশটা সরিয়ে দাও ওধারে৷’

দু-জনের চেষ্টায় মোটামুটি একটা শুকনো জায়গায় আনা গেল মৃতদেহটা৷

-‘বহুত শুক্রিয়া ভাই সাহাব৷ তুমি এবার যাও৷’

নিস্পন্দের মতো মৃতদেহ আগলে বসে রইল রতন৷ বাগ ততক্ষণে নীরব হয়ে এসেছে৷ রাস্তাঘাটে একটা বেড়াল-কুকুরেরও দেখা পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও৷ থমথম করছে চারদিক৷ মৃতের স্তূপ সামনে৷ দশটা বেজে গেল ঘড়িতে৷ একটা কিছু করা দরকার৷ অথচ-

মৃতদেহ ছেড়েই বেরিয়ে পড়ল রতন৷ সামনেই আবলোয়া কাটরা৷ ওদিকে গেলে ঠাকুরদ্বারার ছাত্রদের সাহায্য পাওয়া যেতে পারে৷ এখানে একা একা বসে থাকার কোনো অর্থ হয় না৷

সব ঘরের বাতি নিভে গেছে৷ সমস্ত রাস্তা অন্ধকার৷ হঠাৎ রতনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে৷ সামনের বাড়ির জানলায় কয়েকজন বসে রয়েছে৷ সাহায্যের জন্য চিৎকার করে ওঠে রতন৷

-‘ভাইয়া, এখন পারব না যেতে, কিছু মনে কোরো না৷’ ওপর থেকে সাড়া দেয় ওরা৷ ‘একজন জখমি লোককে সেবা করছি এখন৷ তা ছাড়া রাস্তায় যাব কী করে এখন-কারফিউ আছে না?’

আস্তে আস্তে জানলার নীচ থেকে চলে এল রতন৷

সামনে আর একজন লোক৷ যেন ছুটে আসছে কাটরার দিকে৷

-‘ভাই সাহাব, মেহেরবানি করে-‘

-‘মাপ চাইছি ভাই’, কথা শেষ করার আগেই লোকটা বলে ফেলে, ‘কোনো সাহায্য আমি করতে পারব না৷’

শ্রান্ত দেহে টলতে টলতে এগিয়ে যাচ্ছিল-চোখে পড়ল এক বৃদ্ধ বসে তামাক খাচ্ছে৷ বারান্দায় কয়েকজন যুবক৷ হাতজোড় করে রতন আর্জি পেশ করল৷

বৃদ্ধ ওর হাত চেপে ধরল, ‘ওঠো বেটা, ওঠো৷ আমি সব বুঝতে পেরেছি, তুমি বসো৷’

হাঁকডাক করে যুবকদের ডেকে তুলল বৃদ্ধ, কিন্তু আশ্চর্য, সবাই নারাজ৷ কারফিউ আছে৷ কিছুতেই রাজি করা গেল না ওদের৷

বৃদ্ধের চোখে জল৷ বললে, ‘নিজের শরীরে তাগদ থাকলে কোনো বাত ছিল না, কিন্তু পায়ে আমি কিছুই জোর পাই না এখন৷ কী করব বেটা, আমারই বদ-নসিব৷’

নিজের শরীরটাকে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে এল রতন বাগে৷ রাত দুটো তখন৷

একটা কঞ্চি হাতে করে বসল৷ ভীষণ কুকুরের উৎপাত৷

তারপর কী করে রাত কাটল, সেকথা রতন মনে করতে পারবে না-মনে পড়লে ও পাগল হয়ে যাবে৷

আহতের চাপা কান্না সমস্ত মাঠে৷ একটি বাচ্চা ছেলে কেঁদে উঠল, ‘কওন হ্যায় উধার?’

রতন এগিয়ে যেতে চাইল সামনে যেখানে বাবার মৃতদেহ আছে৷

তুমি যেয়ো না ভাইসাব, আমার ভয় করছে৷

কত আর বয়স-বছর বারো হবে৷ রতন ওর কপালে হাত বুলিয়ে দিল৷

-‘গায়ে চাপা দিয়ে দেব কিছু?’

-‘না৷ একটু পানি, বড়ো প্যাস লেগেছে৷’

উঠে গেল রতন৷ কোথায় জল! সমস্ত জালিয়ানওয়ালাবাগে রক্ত খুঁজলে অনেক পাওয়া যাবে-টাটকা তাজা রক্ত৷ কিন্তু জল কোথায় পাওয়া যায়!

একটু এগিয়ে একটা আর্ত চিৎকার শুনতে পেল৷

-‘কে যায়?’

রতন এগিয়ে এল৷ মুখমণ্ডল রক্তাক্ত৷ মৃতের স্তূপের মধ্যে পা ঢোকানো৷

‘আমার পা দুটো বার করে দাও না মেহেরবানি করে৷’ অনুরোধটা কাকে করা হল সে কথা বোঝাবার অবস্থায় সে ছিল না৷

কাজটা করে রতন ফিরে এল৷ মৃতদেহ আগলাতে লাগল৷ প্রায় ছ-টার সময় এল লালা সুন্দরদাস৷ সঙ্গে ছেলেরা৷ খাটিয়ায় করে নিয়ে যাওয়া হল মৃতদেহ৷ বাড়ির মধ্যে পৌঁছে যেন এই প্রথম চিনতে পারল রতন তার বাপজানকে৷ বুকের ওপর আছড়ে পড়ে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল ও৷

সমস্ত জালিয়ানওয়ালাবাগ জুড়েই ব্যথিতের কান্না৷ শিশুর চিৎকার, বড়োদের চাপা কান্নায় মনে হচ্ছিল এই অভিশপ্ত প্রান্তর কি কখনো বিস্মৃত হতে পারবে এসব-কখনো কি এর প্রতিশোধ নেবে না ওরা! ইতিহাস কি ভুলে যাবে একে? কাল কি এ বীভৎসতাকে ক্ষমা করবে! জালিয়ানওয়ালাবাগের রক্ত দিয়ে আজাদির ঋণ শোধ হবে না?

কে উত্তর দেবে এর?

কালের বিচার

ইতিহাসই এর উত্তর দিয়েছে৷ কাল কাউকে ক্ষমা করে না৷ আজাদি একদিন কেনা হয়েছে আরও অনেক মূল্য দিয়ে৷ কিন্তু জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রতিশোধ নেমে এসেছে তার আগেই৷

জেনারেল ডায়ার অবশ্য মারা গিয়েছিল সাধারণ ভাবেই-১৯২৭ সালের ২৩ জুলাই৷ কিন্তু ১৯৪০ সালের তেরোই মার্চ ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি স্মরণীয় দিন৷

বিরাট অধিবেশন ছিল লন্ডনের ক্যান্টন হলে৷ এটি আহ্বান করেছিল যুগ্মভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন আর রয়্যাল সেন্ট্রাল এশিয়ান সোসাইটি৷

বহু মাননীয় অতিথি ছিলেন সভাতে-লর্ড জেটল্যান্ড, লর্ড ল্যামিংটন, স্যার লুইস ডেন, এবং-

সেই কুখ্যাত শাসক সার মাইকেল ও ডাইয়ার৷

অধিবেশন শেষ হবার সঙ্গেসঙ্গে গুলি ছুটে গিয়েছিল ডাইয়ারকে লক্ষ্য করে৷

ডাইয়ারের প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পড়েছিল মাটিতে৷

পালাবার চেষ্টা করেনি উধম সিং৷ বলেছিল, ‘আমার নাম সিং আজাদ৷ এই দিনটার অপেক্ষায় এতদিন আমি প্রস্তুত হচ্ছিলাম৷ জালিয়ানওয়ালাবাগের বদলা নিলাম আমি৷’

প্রায় কুড়ি বছর আগে জালিয়ানওয়ালাবাগের রক্তাক্ত প্রান্তরে ইতিহাসের যে অধ্যায় শুরু হয়েছিল, লন্ডনের এই হত্যাকাণ্ডে সেই অধ্যায়ের ওপর যবনিকা নেমে এল৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *