রক্ত পাথারের সাঁতারু
এক । আদিকথা
আমেরিকা শ্বেতাঙ্গদের স্বদেশ নয়। তিন-চারশো বৎসর আগেও তারা সেখানে বাস করত বিদেশির মতো।
প্রথম যুগের মানুষও আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করেনি। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকায় যখন আদিম মানুষরা বিচরণ করত, আমেরিকা তখন জনমানবহীন।
তারপর এই অমানুষের দেশে প্রথম যে মানুষদের দেখা পাওয়া যায়, তারাও এখানে মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়নি।
তারা কোন দেশের মানুষ, তা নিয়েও যথেষ্ট মাথা ঘামানো হয়েছে। শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে এইটেই দাঁড়িয়েছে যে, আমেরিকার আদিবাসীরা এসেছিল এশিয়া মহাদেশ থেকে। তাদের জন্মভূমি ছিল বৃহত্তর ভারতের কোনও দ্বীপে, এটাও অনেকে অনুমান করেন।
কিন্তু কোথায় এশিয়া আর কোথায় আমেরিকা, মাঝখানে প্রবহমান দুস্তর প্রশান্ত মহাসাগর। সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে ছোট ছোট পলকা ডিঙায় চেপে দলে দলে মানুষ কি তরঙ্গভয়াল প্রশান্ত মহাপাথারে পাড়ি দিয়ে এশিয়া থেকে সুদূর আমেরিকায় গিয়ে উপনিবেশ স্থাপন করতে পারত?
লোকে বললে,—’অসম্ভব!’
পণ্ডিতরা অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন উত্তর এশিয়ার প্রান্তদেশ যেখানে উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে কাছে গিয়ে পৌঁছেছে, সেই দিকে। দুই মহাদেশের মাঝখানে বইছে বেরিং প্রণালী। অতিরিক্ত শীতের সময়ে প্রণালীর জল জমে নিরেট হয়ে যায়, তখন তার উপরে অনায়সে পদব্রজে ভ্রমণ করা চলে। সেই সময় মাত্র চল্লিশ মাইল পদচালনা করলেই যে-কোনও মানুষ এশিয়া থেকে সোজা আমেরিকায় গিয়ে হাজির হতে পারে। এবং ‘এ নহে কাহিনি, এ নহে স্বপন’,—এ হচ্ছে প্রমাণিত সত্য।
সেই প্রাগৈতিহাসিক অ্যাডভেঞ্চারের কালনিরূপণ নিয়েও বিস্তর কথা কাটাকাটি হয়েছে। তবে পুরাতত্ববিদরা আন্দাজ করেন যে সময়টা হচ্ছে পনেরো হাজার থেকে বিশ হাজার খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দীর মধ্যেই।
সেই দুঃসাহসী মানুষগুলি বিদেশে গিয়ে যে নতুন স্বদেশ প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তারাই হচ্ছে আমেরিকার আদিবাসী। আরও অনেক পরে যে হাঘরে শ্বেতাঙ্গরা ইউরোপ থেকে আমেরিকায় আড্ডা গাড়তে আসে, তাদের পূর্বপুরুষরা তখন সভ্যতার কোনও ধারই ধারত না এবং বনে বনে হিংস্র পশুর মতো অসভ্য জীবনযাপন করত।
আমেরিকার প্রথম যুগের আদিবাসীরা নিশ্চয়ই তাদের অতীতের ঐতিহ্য ভুলতে পারেনি, কিন্তু তাদের বংশধররা ক্রমে ক্রমে অতীতকে ভুলে নিজেদের উপযোগী এক নতুন সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিল্প ও সমাজ গঠন করে তুললে। তাদের জীবনযাত্রার ধারা নতুন, সামাজিক বিধিনিষেধ নতুন, ধর্মের নিয়ম নতুন এবং স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রের আদর্শও নতুন। সে-সবের উপরে এশিয়ার কোনও প্রভাবই আর রইল না।
বড় বড় আকাশছোঁয়া মন্দির, বিরাট বিরাট প্রাসাদ, প্রশস্ত প্রশস্ত রাজপথ দিয়ে সাজানো জনবহুল নগরীর পর নগরী ছিল তাদের দেশে। আজও সেই অভাবিত ঐশ্বর্যের ধ্বংসাবশেষ দেখে আধুনিক সভ্যতা বিস্মিত ও সম্মোহিত না হয়ে পারে না।
প্রথম যুগের আগন্তুকরা ছিল প্রধানত শিকারি, কিন্তু তার বংশধররা কৃষিকার্যেও বিলক্ষণ বিচক্ষণ হয়ে উঠেছিল। তারা এমন অনেক রকম ফল-ফসলের মালিক ছিল, ইউরোপ ও এশিয়া যার খবরও রাখত না। প্রত্যেক জিনিসের নাম করতে গেলে ফর্দ বেড়ে যাবে, তার প্রধান কয়েকটির নাম এখানে উল্লেখ করছি : তামাক, আলু, রাঙা আলু, বিলাতি কুমড়ো, লাউ, মুগ, চিনাবাদাম, আনারস, রবার, কোকেন, স্ট্রবেরি ফল, শিমুল আলু ও কুইনিন প্রভৃতি।
এই আদিবাসীদের মধ্যে ভারতীয়দের কোনও কোনও বিশেষত্বও দেখা যায়। তারাও ছিল পৌত্তলিক, মন্দিরের মধ্যে দেবতার মূর্তি প্রতিষ্ঠিত করে তারাও দিত নরবলি এবং তারাও মেনে চলত পুরোহিতদের বিধান। ভারতীয়দের মতো তাদেরও মধ্যে উপজাতির সংখ্যাবাহুল্য ছিল যথেষ্ট—মোট প্রায় ছয়শত। তাদের গায়ের রং প্রায় শ্যামবর্ণ বললেই চলে।
শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে যখন আমেরিকার আদিবাসীদের প্রথম মুলাকাত হয়, সেই ঐতিহাসিক কাল থেকেই আমাদের কাহিনির সূত্রপাত। সে সময়ে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে যথাক্রমে অ্যাজটেক ও ইনকা সাম্রাজ্য।
কলম্বাসের ভ্রমের জন্যে আদিবাসীদের ‘রেড ইন্ডিয়ান’ বা ‘লাল ভারতীয়’ নামে ডাকা হয়। কিন্তু তারা তো ভারতসন্তান নয়, কাজেই আমরা তাদের শুধু ‘লাল মানুষ’ বলেই ডাকব।
দুই । কলম্বাসের শয়তানি
জার্মানির কুখ্যাত হিটলার ইহুদি জাতিকে সমগ্রভাবে ধ্বংস করবার চেষ্টা করেছিলেন বলে নিন্দিত হন।
অশ্বেত জাতিদের উপরে পাশবিক অত্যাচার করা হচ্ছে বলে দক্ষিণ আফ্রিকার কর্তৃপক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকার অন্যান্য শ্বেতাঙ্গরাও কি চরম নিরীহ ও পরম সাধু? সাম্য ও মৈত্রীর উপাসক?
আমেরিকা হচ্ছে লাল-মানুষের স্বদেশ। শ্বেতাঙ্গরাই এই সেদিন সেখানে উড়ে গিয়ে জুড়ে বসেছে। কিন্তু তাদের ঠকামি, নির্লজ্জতা ও নিষ্ঠুরতার কাছে হিটলার ও দক্ষিণ আফ্রিকার বুয়ররাও হার মানবে। লাল-মানুষদের স্বদেশের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা তাদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করবার চেষ্টা করেছে। এবং তাদের সে পৈশাচিক চেষ্টা প্রায় সফলও হয়েছে। বললে একটুও অত্যুক্তি হবে না যে, অধিকাংশ লাল-মানুষকেই জোর করে পরলোকে পাঠানো হয়েছে অকালে।
আর এই অত্যাচার আরম্ভ হয়েছে কলম্বাসের সময় থেকেই। সে হচ্ছে পনেরো শতাব্দীর শেষ দশকের কথা।
ভারতবর্ষে যাত্রা করতে গিয়ে কলম্বাস পথ ভুলে আমেরিকার প্রত্যন্ত দেশের বাহামা দ্বীপপুঞ্জে এসে উঠলেন। তিনি আন্দাজে স্থির করলেন, সেই-ই হচ্ছে ভারতবর্ষ। এই ভুলের জন্যে আজও তিনি অমর।
কলম্বাসের নিজের মুখেই প্রকাশ—লাল-মানুষরা হচ্ছে সুখসম্পদে নিশ্চিন্ত, বুদ্ধিমান, সাধু ও ধর্মভীরু। তাদের সঙ্গে নিরাপদেই মেলামেশা করা চলে।
কলম্বাস ও তাঁর সঙ্গের লোকজনদের তারা খুব আদর-আপ্যায়ন ও সাহায্য করলে এবং অতিথিসৎকারে কোনওই ত্রুটি হল না।
প্রতিদানে কলম্বাস করলেন কী?
স্বদেশ যাত্রার সময়ে হাতের কাছে যাদের পেলেন সেই লাল-মানুষদের বন্দি করে জাহাজে না তুলে ছাড়লেন না। তারপর ইউরোপে ফিরে তাদের বিক্রি করে ফেললেন। শ্বেতাঙ্গদের দেশে তারা আমরণ ক্রীতদাসের জীবনযাপন করতে বাধ্য হল।
রস পেয়ে ঘুঘু কলম্বাস আবার আমেরিকায় গিয়ে হাজির হন। তার অত্যাচারের ভয়ে নিজেদের দেশে বসে লাল-মানুষরা পরিত্রাহি ডাক ছাড়তে লাগল।
অথচ এই লাল-মানুষরাই প্রথম প্রথম কলম্বাস ও তাঁর সঙ্গীদের দেখে ভাবত, তাঁরা হচ্ছেন স্বর্গ থেকে আগত পূজনীয় দেবতা, তাদের মঙ্গলের জন্যেই ভগবানের নির্দেশে মর্ত্যে পদার্পণ করেছেন। শ্বেতবর্ণের মোহ? পরে এই দেবতারাই মুখোশ খুলে হয়ে দাঁড়াল আস্ত দানব।
কলম্বাসকে শয়তানির শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল। আমেরিকা আবিষ্কারের পর প্রথমে তাঁর নামে জয়ধ্বনি ওঠে দিকে দিকে এবং স্পেনের রাজসভায় তাঁর যত্ন-আদরের সীমা থাকে না। উৎসাহিত হয়ে কলম্বাস তারপর আরও দুই-দুই বার জাহাজ ভাসিয়ে আমেরিকায় গিয়ে হাজির হন এবং বলা বাহুল্য, কোনও বারই সরলপ্রাণ লাল-মানুষদের উপরে বর্বরের মতো নিষ্ঠুর অত্যাচার করতে ছাড়েননি।
কিন্তু নিয়তি তাঁকেও ক্ষমা করেনি। রাজনৈতিক চক্রান্তের ফলে শেষের দিকে তাঁকে রাজার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায়। শেষ পর্যন্ত তাঁকে কারাগারে জীবন কাটাতে হয়নি বটে, কিন্তু রাজসভা থেকে নির্বাসিত হয়ে অত্যন্ত অবহেলা ও অনাদরের মধ্যে তিনি অন্তিম নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
পরে আমরা আরও দুই শয়তানের চরম দুর্দশা দেখতে পাব।
তিন । আমেরিকায় জালিয়ানওয়ালাবাগ
রাজা হুকুম দিলেন,—তুমি মেক্সিকোয় গিয়ে সেখানে স্পেনের জয়পতাকা উড়িয়ে দাও। শুনেছি সেখানে নাকি মণি-মানিক, সোনা-রুপোর ছড়াছড়ি।
হার্ন্যান্ডো কোর্টেস মাথা নত করে রাজার আদেশ মেনে নিলেন।
মেক্সিকো হচ্ছে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যবর্তী প্রদেশ। সেখানে লাল-মানুষদের বিশাল ও গৌরবময় অ্যাজটেক সাম্রাজ্য সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে জাহাজে চেপে কোর্টেস এল অ্যাজটেক সাম্রাজ্য দখল করতে।
অ্যাজটেকদের দেশ তখন সুখ, সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের চরমে উঠেছে। তাদের রাজধানীর নাম ছিল টেনোচিটিলীন, আজ তারই ধ্বংসাবশেষের উপরে দাঁড়িয়ে আছে মেক্সিকো নগরী। কিন্তু অ্যাজটেকদের বাড়বাড়ন্ত অন্যান্য বহু জাতির লাল-মানুষদের কাছে ছিল চক্ষুশূলের মতো।
কোর্টেস দলবল নিয়ে ডাঙায় এসে নামল। অতিথিসৎকারের জন্যে লাল-মানুষরা কোনওদিনই অপ্রস্তুত ছিল না, তারা ছিল রীতিমতো সভ্য—এখনকার দুর্দশাগ্রস্ত লাল-মানুষদের চেয়ে সব দিক দিয়েই উন্নত। কলম্বাসের আগমন ও অমানুষিক অত্যাচারের পর এক শতাব্দীরও বেশি কাল কেটে গিয়েছে, আরও নানা জাতের শ্বেতাঙ্গ এসে তাদের উপর এমন অকথ্য নির্যাতন করেছে যে, এক-একটা দেশ থেকে লাল-মানুষদের চিহ্ন পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তা সত্বেও লাল-মানুষদের দেশে দস্যু কোর্টেসের সাদর অভ্যর্থনার অভাব হল না।
কারণ তাদেরও বিশ্বাস হয়েছিল যে, এই শ্বেতকায় আগন্তুকরা হচ্ছেন দেবতাদের জাতি। তারা আগে কখনও সাদা চামড়ার মানুষ দেখেনি।
লাল-মানুষদের এক সরদার এসে সুধোলে, ‘হে মহামনা, আপনাদের এখানে আগমনের কারণ?’
কোর্টেস বললে, ‘আমরা এক কঠিন বুকের অসুখে ভুগছি। তারই ওষুধের খোঁজে এসেছি তোমাদের দেশে।’
সরদার জানতে চাইলে, ‘ঔষধটা কী?’
কোর্টেস বললে, ‘স্বর্ণঘটিত মহৌষধি।’
সরদার বললে, ‘যথা আজ্ঞা। দুদিন সবুর করুন। সম্রাটের কাছে খবর পাঠাচ্ছি।’
রাজধানীতে সম্রাট মন্টেজুমার কাছে খবর পাঠানো হল।
শ্বেতাঙ্গরা দেবতার জাতি হলেও যে অত্যাচারী এবং হত্যাকারী, লাল-মানুষদের দেশে দেশে তখন সে কথাটা রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল। কারণ কলম্বাসের পর তখন ইউরোপের নানা দেশ থেকে আরও বহু শ্বেতাঙ্গ দস্যু আমেরিকার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্তাক্ত লুণ্ঠনকার্য চালিয়ে গিয়েছে। কাজেই সম্রাট মন্টেজুমা বুঝলেন যে, এই রকম অনাহূত ও বিপদজ্জনক অতিথিদের রাজধানীতে আসতে দেওয়া মোটেই নিরাপদ নয়। তাদের খুশি করে মানে মানে দূর থেকেই বিদায় করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
সম্রাট মন্টেজুমা আদেশ দিলেন, ‘ওদের মন রাখবার জন্য ভালো ভালো সোনা-রুপো ভেট পাঠাও। সেই সঙ্গে জানিয়ে দাও, ওষুধের খোঁজে আর আমার রাজধানীতে আসবার দরকার নেই।’
সম্রাটের নির্দেশে একশোজন বাহক তাল সোনা-রুপো বহন করে স্পানিয়ার্ডদের কাছে এসে হাজির হল।
সরদার কোর্টেসের কাছে গিয়ে জানালেন, ‘হে মহামনা, সম্রাট আপনাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছেন। ওষুধ তো পেলেন, এখন আপনারা নিজেদের দেশে ফিরে গেলেই তিনি সুখী হবেন।’
যে দেশ এক কথায় একশোজন মুটের মাথায় এত সোনা-রুপো পাঠায়, না জানি তার রাজধানীতে আছে ঐশ্বর্যের কত বড় ভাণ্ডার!
এই ভেবে কোর্টেসের লোভ যারপরনাই বেড়ে উঠল। সে দেখলে তার নিজের দল গুনতিতে কয়েক শত বটে, কিন্তু দলের হাতে আছে বন্দুক এবং লাল-মানুষগুলো আগ্নেয়াস্ত্রের কোনও ধারই ধারে না। বন্দুকের সঙ্গে দলে ভারী হলেও তির-ধনুক ও বল্লম প্রভৃতি নিয়ে পাল্লা দেওয়া সম্ভবপর নয়।
অতএব সৈনিকগণ, অগ্রসর হও, অগ্রসর হও—রাজধানীর দিকে অগ্রসর হও!
কোর্টেস মানা মানলে না, রাজধানীর দিকে এগিয়ে চলল সদলবলে।
পথে দেখা হল আর এক জাতের লাল-মানুষদের সঙ্গে, তাদের নাম হচ্ছে ‘তল্যাক্সকালান্স’। কোর্টেসের দলের কাছে খুব সহজেই তারা হেরে গেল। কিন্তু তারা ছিল অ্যাজটেকদের শত্রু, তাই তারাও যোগ দিলে স্পানিয়ার্ডদের সঙ্গে। ঘরের শত্রু এই বিভীষণদের পেয়ে কোর্টেসের দল ও শক্তি বাড়ল।
ওদিকে অ্যাজটেকদের সম্রাট মন্টেজুমা পড়ে গেলেন মহা ফাঁপরে। দেবতাদের জাতির সঙ্গে মারামারি করবার ইচ্ছা তাঁর হল না। বাধ্য হয়ে তাঁকে করতে হল স্বাগত সম্ভাষণ!
পথে আসতে আসতে ‘চলুলান’ লাল-মানুষদের দেশ। দেখে কোর্টেসের চক্ষুস্থির! এমন দেশ, এত বড় উন্নত শহর সে কল্পনাতেও আনতে পারেনি। সে যে চত্বরের উপর দাঁড়িয়ে ছিল, তার চারিদিক ঘিরে আছে বাড়ির গায়ে বাড়ি—সংখ্যায় বিশ হাজার!
কোর্টেস সেই চাতালেই চলুলান সরদারদের আহ্বান করলে কথাবার্তা কইবার জন্যে; কিন্তু তার আগেই সে চাতালের চারদিকে সশস্ত্র সৈনিক দাঁড় করিয়ে রাখলে।
দেবতাদের জাতের সঙ্গে আলাপ করবার আগ্রহ নিয়ে সরদারদের সঙ্গে সঙ্গে এল হাজার হাজার কৌতূহলী লাল-মানুষ। তারা সবাই এসেছিল নির্ভয়ে নিরস্ত্র হয়ে নিশ্চিন্ত প্রাণে। দেবতাদের কাছে মানুষ পায় বরাভয়, সেখানে প্রাণভয় থাকবে কেন?
কিন্তু কোথায় বরাভয়? নিরপরাধ নিরস্ত্র ভক্তরা পেলে মৃত্যুদণ্ড।
অশ্রান্ত বজ্রনাদের মতো গর্জন করে উঠল শ্বেত-মানুষদের বন্দুকগুলো। (ঠিক তিনশত বৎসর পরে শ্বেতবর্ণগর্বিত ইংরেজরাও ভারতের জালিয়ানওয়ালাবাগে অবিকল এই দৃশ্যেরই পুনরাভিনয় করেছিল) কাতারে কাতারে অসহায়, অস্ত্রহীন লাল-মানুষ ছিন্নমূল বৃক্ষের মতো মাটির উপরে লুটিয়ে পড়তে লাগল।
এবং তারপরই আরম্ভ হল নির্বিচারে নগরলুণ্ঠন ও আবালবৃদ্ধবনিতার হত্যাকাণ্ড!
এই বিশ্বাসঘাতকতা ও বর্বরতার পরেও নির্বোধ সম্রাট মন্টেজুমার চোখ ফুটল না এবং তার ফল পেলেন তিনি হাতে হাতেই।
তাঁর আমন্ত্রণে কোর্টেস এসে হাজির হল রাজধানীতে এবং প্রথম সুযোগেই বন্দি করলে স্বয়ং মন্টেজুমাকেই! তাঁর পায়ে পড়ল লোহার শিকল।
দায়ে পড়ে মন্টেজুমা বশ্যতা স্বীকার করলেন বটে, কিন্তু তারপরেই তাঁকে বেঁকে দাঁড়াতে হল।
কোর্টেস বললে, ‘খ্রিস্টান হও।’
মন্টেজুমা বললেন, ‘প্রাণ দিতে রাজি, স্বধর্ম ছাড়তে রাজি নই।’
এমনি কথা চালাচালি চলতে লাগল। মন্টেজুমার অধীনস্থ লোকজনদের অবস্থা অতিশয় অসহায়। সম্রাট বিপক্ষের হস্তগত, সকলেই কিংবর্তব্যবিমূঢ়!
এমনি সময়ে অ্যাজটেকদের এক বড় পর্ব এসে পড়ল। শ্বেতাঙ্গদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে প্রকাণ্ড এক দেবমন্দিরে দলে দলে পূজারি ও হাজার হাজার পূজার্থী এসে সমবেত হল। তাদের কারুর হাতেই অস্ত্র ছিল না, এ সত্য শ্বেতাঙ্গ ঐতিহাসিকরাই স্বীকার করেছেন।
সেখানকার ফৌজের ভার ছিল কোর্টেসের এক সহযোগী সেনানির উপরে।
আচম্বিতে সে হুকুম দিলে, ‘জনতার উপরে গুলিবৃষ্টি করো।’
গুড়ুম, গুড়ুম, গুড়ুম, গুড়ুম…
বোঁ বোঁ বোঁ বোঁ গুলির পর গুলি চলছে আর ধপাধপ মাটির উপরে আছড়ে পড়ছে মানুষের পর মানুষ। দিকে দিকে রক্তস্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পূজার্থীদের পূজার উপচার। কেবল পূজার্থীদের নয়, স্পানিয়ার্ডরা মন্দিরের মধ্যে ঢুকে গুলি করে মেরে ফেললে পূজারিদেরও। ভগবানের উদ্দেশে ঊর্ধ্ব শূন্যে উঠে গেল অসংখ্য কণ্ঠের অন্তিম আর্তনাদ।
ভগবান তা শুনলেন কিনা জানি না, কিন্তু সেই আর্তনাদ শুনে রাজধানীর প্রত্যেক অ্যাজটেক বীর ধৈর্যের সীমা হারিয়ে বজ্রকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল—প্রতিশোধ, প্রতিশোধ!
যেখানে যত অ্যাজটেক যোদ্ধা ছিল—কাছ থেকে, দূর থেকে সবাই অস্ত্র তলে বেগে ছুটে আসতে লাগল দেবতার রূপধারী এই শয়তান শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে। সকলেরই মুখে একই হুংকার—’হত্যা কর, হত্যা কর, হত্যাকারীদের হত্যা কর! দেশের শত্রু, ধর্মের শত্রুদের হত্যা কর!’
যেদিকে যতদূরে তাকায় সেইদিকে ততদূরেই অসংখ্য সশস্ত্র যোদ্ধার আস্ফালন দেখে কোর্টেস বেশ বুঝল যে, এই বিরাট শত্রুসাগরের প্রচণ্ড তরঙ্গ রোধ করা তার পক্ষে আপাতত অসম্ভব। তখন সে বন্দি সম্রাট মন্টেজুমাকে এনে পুরোভাগে স্থাপন করে বললে, ‘ওদের শান্ত হতে বলুন।’
মন্টেজুমার তখনও শিক্ষা হয়নি। তিনি কোর্টেসের পক্ষ নিয়ে ওকালতি করতে গেলেন।
কিন্তু তখন মন্দিরের উপাস্য দেবতা ও উপাসক পুরোহিত এবং সমাগত ভক্তবৃন্দের উপরে অযথা আক্রমণে অ্যাজটেকদের সমগ্র জনতা উন্মত্ত হয়ে উঠেছে, সম্রাটের এই ঘৃণ্য তোষণ-নীতি তাদের আরও বেশি ক্রুদ্ধ করে তুলল, এমনকী তারা সম্রাটকেও প্রাণঘাতী আক্রমণ করতে ছাড়লে না।
মন্টেজুমার মৃত্যু হল সেইখানেই এবং মন্টেজুমার শ্বেত দেবতারাও আগ্নেয়াস্ত্রে সাহায্য নিয়েও যুদ্ধ জয় করতে তো পারলেই না—কেবল হতাবশিষ্ট সহচরদের নিয়ে ভীষণ মৃত্যুপাথারে কোনওক্রমে পথ কেটে পৃষ্ঠভঙ্গ দিয়ে কোর্টেস সে যাত্রা প্রাণরক্ষা করলে।
কিন্তু কোর্টেস নাছোড়বান্দা। কিছুদিন যেতে না যেতেই বেশি সৈন্য ও আরও বেশি বন্দুক আর কামান পেয়ে আবার ঘটনাক্ষেত্রে দেখা দিলে এবং অ্যাজটেকদের রাজধানী অবরোধ করে বসল। ১৫২১ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা।
প্রাণপণে বাধা দিয়েও অ্যাজটেকরা এবারে আর আগ্নেয়াস্ত্রকে ঠেকাতে পারলে না, রাজধানীর পতন হল।
কোর্টেসের হুকুমে নতুন সম্রাট গুয়াতেমোজিনকে ঝুলিয়ে দেওয়া হল ফাঁসিকাঠে। তাঁর প্রধান অপরাধ ছিল, নিদারুণ যন্ত্রণা দিয়েও তাঁর কাছ থেকে গুপ্ত ধনভাণ্ডারের ঠিকানা আদায় করা যায়নি।
স্পেনের অধীন হয়ে অ্যাজটেকরা কেবল তাদের স্বাধীনতাই হারালে না, বিলুপ্ত হল তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতিও। বেশিদিনের কথা নয়, কিন্তু এর মধ্যেই তাদের কথা অতীত স্মৃতিতে পরিণত।
তবে স্পেনের অধিপতির কৃপালাভের জন্যে এত নরহত্যা এবং একটা প্রাচীন সভ্যতাকে ধ্বংস করেও কোর্টেসের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সফল হল না। তার শত্রুরা রাজার কাছে গিয়ে কোর্টেসের বিরুদ্ধে করলে গুরুতর নিন্দাবাদ। সেই চক্রান্তের ফলে পদচ্যুত হয়ে সে স্পেনে ফিরে গেল এবং কলম্বাসের মতোই চরম অবহেলা ও অনাদরের মধ্যে প্রাণত্যাগ করলে। ভেঙে পড়ল তার স্বপ্নে দেখা সোনার পাহাড়!
একেই কি বলে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে?
চার । ইনকা সভ্যতার পতন
তারপর একযুগ গত হতে না হতেই দেখি পট পরিবর্তন এবং রঙ্গমঞ্চে আর এক সাংঘাতিক অভিনেতার প্রবেশ।
এবারে ঘটনাক্ষেত্র দক্ষিণ আমেরিকার পেরুপ্রদেশে। সেখানে ইনকাদের সাম্রাজ্য, যাদের স্থান উত্তর আমেরিকার অ্যাজটেকদের পরেই। ইনকারাও পূর্বকথিত অ্যাজটেকদের মতো অতীতের আর এক প্রাচীনতম সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী হয়েছিল।
দ্বিতীয় বারের মারাত্মক নাট্যাভিনয়ের নায়কের নাম হচ্ছে ফ্রান্সিস পিজারো। সেও স্পেন থেকে প্রেরিত আর এক নষ্টামির অবতার। অর্থ ও খ্যাতির লোভে সেও কোর্টেসের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে।
অ্যাজটেক সামাজ্যের পতনের পর লাল-মানুষদের দেশে আর একটিমাত্র উল্লেখযোগ্য সাম্রাজ্য অবশিষ্ট ছিল ওই পেরুর ইনকাদের। সেখানেও উন্নতির সমুন্নত শিখরে গিয়ে উঠেছিল তাদের ঐশ্বর্যময় নাগরিক সভ্যতা।
লোকমুখে খবর শোনা যেতে লাগল, ইনকাদের ধনভাণ্ডারে মণি-মানিক ও সোনা রুপো আর ধরছে না, তার সর্বত্র প্রভূত ঐশ্বর্যের ছড়াছড়ি। পিজারো স্থির করলে, এই দেশ সে জয় করবে।
পিজারো যে দুঃসাহসী ছিল, সে কথা স্বীকার করতেই হবে। তার তাঁবে পুরো দুশো সৈনিকও ছিল না, কিন্তু এই তুচ্ছ ফৌজ নিয়েই সে অসংখ্য যোদ্ধাদের দ্বারা রক্ষিত ইনকা সাম্রাজ্য আক্রমণ করবার জন্যে প্রস্তুত হতে লাগল।
এটা দুঃসাহস বলে মনে হয় বটে, কিন্তু পিজারোর পক্ষে ছিল একটা অকাট্য যুক্তি। সে হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্রে বলীয়ান, ইনকারা যা নয়। তারা লোহার ব্যবহার পর্যন্ত জানত না। লাল-মানুষরা আগ্নেয়াস্ত্রের ও লৌহের ব্যবহার শিখেছিল শ্বেতাঙ্গদের আগমনের পরেই।
তখন সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিকার নিয়ে ইনকাদের দুই ভাই হুয়াম্ভার ও আতাহুয়াল্পার মধ্যে ঘরোয়া বিবাদ চলছিল। এটা একটা মস্ত সুযোগ বুঝে ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে পিজারো করলে ইনকাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা।
আতাহুয়াল্পা গায়ের জোরে সিংহাসন দখল করেছে বটে, কিন্তু তখনও হুয়াম্ভাকে পরাজিত করতে পারেনি। দুই পক্ষই শেষ-যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে।
এত দেখে-শুনে এবং ঠেকেও সরল প্রাণ লাল-মানুষদের ঘটে সুবুদ্ধির উদয় হয়নি। এবারেও পিজারো ও তার সহচরদের শ্বেতবর্ণ দেখে লাল-মানুষরা মনে করলে, তাঁরা হচ্ছেন স্বর্গের দেবতা, তাদের মঙ্গলবিধানের জন্যেই ধরায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
ইনকা সাম্রাজ্যের রাজধানীর নাম ছিল কাক্সামাল্কা। সেখানে সম্রাট আতাহুয়াল্পার কাছে পিজারোর আগমন-সংবাদ পৌঁছোতে দেরি হল না। আগন্তুকদের সংখ্যা মোটে একশত আটষট্টি জন শুনে সম্রাট চিন্তার কোনও কারণও খুঁজে পেলে না, কারণ তাঁর অধীনে তখন রণবেশে সজ্জিত ছিল চল্লিশ হাজার সৈনিক।
ঐতিহাসিকরা বলেন, ইনকা সাম্রাজ্যের কর্তারা যদি গোড়া থেকে সাবধান হতেন, তাহলে পিজারোর নগণ্য ফৌজ বন্দুকের সাহায্য নিয়েও কোনওক্রমেই আত্মরক্ষা করতে পারত না। এক মাইল পথ পার হওয়ার আগেই তাদের যেতে হত ইহলোকের পরপারে। কিন্তু আগন্তুকদের দেবতা বলে ধরে নিয়েই ইনকারা খুলে দিয়েছিল নিজেদের সর্বনাশের রাস্তা।
অবাধে রাজধানীতে পৌঁছে পিজারো দেখলে, সম্রাট তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে চান। এমনকী তাদের বাস করবার জন্যে ছেড়ে দিলেন মস্ত মস্ত বাড়ি।
ইনকাদের প্রসাদে বাদশাহি চালে অধিষ্ঠিত হয়ে পিজারো আমন্ত্রণ করলে স্বয়ং সম্রাটকেই।
নির্বোধ সম্রাট আতাহুয়াল্পা নিজের বিরাট বাহিনীর চালকদের ডেকে বললেন, ‘আমি যাচ্ছি বন্ধুর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে সুতরাং সঙ্গে সশস্ত্র ফৌজের দরকার নেই। সৈন্যদের নিয়ে তোমরা দূরে অপেক্ষা করো।’
তাই হল। ফৌজের ছাউনি পিছনে ফেলে রেখে বাহকদের স্কন্ধের উপরে এক প্রকাণ্ড স্বর্ণসিংহাসনে আসীন হয়ে সম্রাট চললেন বন্ধু সন্দর্শনে, রাজকীয় জাঁকজমক বজায় রাখবার জন্যে তাঁর সঙ্গে রইল মাত্র এক হাজার অনুচর।
সম্রাট আতাহুয়াল্পাকে স্বাগত সম্ভাষণ করবার জন্যে পিজারোর বদলে অপেক্ষা করছিল এক পাদরি।
এ হচ্ছে শ্বেতাঙ্গদের চিরকালের চলতি চাল। ভারত ও আফ্রিকারও নানা দেশে অমঙ্গলের আয়োজন করবার আগে লোকের চোখে ধাঁধা দেওয়ার জন্যে অগ্রদূত রূপে পাঠানো হয়েছে খ্রিস্টানদের পাদরি। তিনি প্রথমে বীজবপন করেন। তারপরই দেখা দেয় বিষবৃক্ষ।
পাদরি বললে, ‘সম্রাট তোমাকে খ্রিস্টান হতে আর স্পেনের রাজার আনুগত্য স্বীকার করতে হবে।’
সম্রাট বললেন, ‘অসম্ভব।’
গুপ্তস্থান থেকে পিজারো নির্দেশ দিলে—’পৌত্তলিকটাকে বন্দি করো!’ এবং তৎক্ষণাৎ একদল শ্বেতাঙ্গ সৈনিক এসে সম্রাটকে লৌহশৃঙ্খলে বেঁধে ফেললে।
তারপর বনবন শব্দে বাতাস কেটে ছুটতে লাগল বন্দুকের গরম গরম গুলি; আর সম্রাটের অনুচররা পপাতধরণীতলে হল দলে দলে। সৈনিকরাও খবর পেয়ে ছুটে এসে বন্দুকের প্রভাবে কাবু হয়ে পড়ল, পৃথিবীকে রাঙা করে ঝরতে লাগল রক্তের ঝরনা। দিকে দিকে শোনা গেল আর্ত ক্রন্দন। আকাশ ছেয়ে ডানা ঝটপটিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এল শবজীবী শকুনের দল।
সম্রাটকে জামিন রেখে বলা হয়, ‘নিষ্ক্রয়ের অর্থ দাও, তবেই মুক্তি পাবে।’
ধনকুবেরের দেশ, অর্থের অভাব হল না। এল কোটি কোটি টাকার সোনার তাল।
সমস্ত হস্তগত করে মূর্তিমান শয়তান পিজারো বললে, ‘আতাহুয়াল্পা জাল সম্রাট, গলায় ফাঁস লাগিয়ে ওকে বধ করো।’
সারা দেশে হত্যাবিভীষিকা, হাহাকার, লুণ্ঠন, অরাজকতা, পথঘাট রক্তপিছল।
কিন্তু এবারেও ধর্মে সইল না। ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দে পিজারো শ্বেতাঙ্গ চক্রান্তকারীরই অস্ত্রে নিহত হয়।
তারপর হতভাগ্য লাল-মানুষদের উপরে পোর্তুগিজ, ওলন্দাজ ও ইংরেজরাও অবিচার ও অত্যাচার করতে ছাড়েনি—তারাও যেখানে-সেখানে লাল-মানুষদের প্রাণ নিয়েছে কথায় কথায়।
স্যার রিচার্ড গ্রেনভিল মানী ইংরেজ। একজন গরিব লাল-মানুষ তাঁর ছোট একটি রুপোর বাটি চুরি করেছিল বলে চোরের গোটা গ্রামকেই তিনি আগুনে পুড়িয়ে ছাইগাদায় পরিণত করেছিলেন।
পাঁচ । স্যাঙাত আমেরিকানদের কীর্তি
ইউনাইটেড স্টেটস হচ্ছে আজকালকার পৃথিবীর এক মহাপরাক্রান্ত দেশ! ‘আমেরিকান’ বললে সাধারণত তারই বাসিন্দা বলে মনে করা হয়। ইংলন্ড থেকে, ফ্রান্স থেকে, ইতালি, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশ থেকে উপচে পড়া দলে দলে লোক সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং কিছুদিন পরেই কেবল ‘আমেরিকান’ নামেই আত্মপরিচয় দেয় আর আইনও তা মেনে নেয়।
স্পেন, পোর্তুগিজ ও ইংরেজদের পরে আমেরিকানরাই লাল-মানুষদের মহাশত্রু হয়ে দাঁড়াল এবং তার কারণও বোধহয় ওইসব জাতের রক্তই তাদের ধমনির ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। লাল-মানুষরা যে মৃত্যুন্মুখ জাতি, তাদের সংখ্যা যে দিনে দিনে কমে আসছে, এজন্যেও দায়ী করা যায় আমেরিকানদের।
তাদের ভয়াবহ অত্যাচার এবং নৃশংসতার সব কাহিনি এখানে বর্ণনা করবার জায়গা নেই। তবে কিছু কিছু বললেই বাকিটুকু অনুমান করা কঠিন হবে না।
আমেরিকানরা যখন স্বাধীন হয়নি, তখন থেকেই ‘চেরোকি’ উপজাতিভুক্ত লাল-মানুষরা তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। এমনকি তারা যখন বিদ্রোহী হয়ে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়, তখনও তাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে অস্ত্র ধরেছিল ওই চেরোকি লাল-মানুষরা।
কিন্তু সেই উপকারের পরিবর্তে তারা আমেরিকানদের কাছ থেকে কী ব্যবহার পেয়েছিল?
তারা চেরোকিদের সঙ্গে আবদ্ধ ছিল সন্ধিসূত্রে। কিন্তু সে কথা বেবাক ভুলে চেরোকিদের জায়গা দখল করতে তখনকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকসন অম্লানবদনে হুকুম দিলেন—চেরোকিদের দূর করে দাও একেবারে মিসিসিপি নদীর ওপারে।
চেরোকিরা আদালতে গিয়ে অভিযোগ করলে এবং সুপ্রিম কোর্ট থেকে রায় দিলেন ধর্মাধ্যক্ষ বা প্রধান বিচারক তাদের পক্ষেই।
কিন্তু ধর্মাধ্যক্ষ রায় দিলে কী হবে,—’চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি’। আমেরিকার প্রেসিডেন্টও মানলেন না বিচারপতির রায়।
জেনারেল স্কট ছুটলেন সাত হাজার সুসজ্জিত সৈনিক নিয়ে চেরোকিদের মুল্লুকে। তাদের গৃহস্থালির জিনিসপত্তর লুট করা হল। তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হল। তারপর তাদের নির্বাসিত করা হল বহু দূরদেশে।
ছয় । শ্বেতাঙ্গদের শ্বেতপতাকা
উত্তর আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে আছে ফ্লোরিডা প্রদেশ। সেখানে ছিল ‘সেমিনোল’ জাতের লাল-মানুষদের বসতি। জায়গাটা আগে ছিল স্পেনের দখলে। স্পানিয়ার্ডদের কাছ থেকেই সেমিনোলরা পুরুষানুক্রমে ফ্লোরিডায় বাস করবার মৌরসিপাট্টা লাভ করে। পরে স্পানিয়ার্ডদের সঙ্গে আমেরিকা যখন সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হয়ে ফ্লোরিডার শাসনভার পায়, তখন এ কথাও স্পষ্ট ভাষায় মেনে নেয় যে, সেমিনোলদের অধিকারের উপরে কোনওদিন হস্তক্ষেপ করা হবে না।
এ হচ্ছে কথার কথা মাত্র! সন্ধির শর্ত না মানলে যখন কারুর কিছু করবার ক্ষমতা নেই, তখন ওসব বাজে ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানো বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমেরিকানরা দল বেঁধে ফ্লোরিডায় আস্তানা গাড়তে এসে আবিষ্কার করলে ভালো ভালো জায়গাগুলোই দখল করে আছে আদি বাসিন্দা সেমিনোলরা।
তাদের সহ্য হল না। ঘুষ দিয়ে এবং অন্যান্য ছলে-কৌশলে শ্বেত মহাপ্রভুরা সেমিনোলদের বাস্তুহারা করে অন্যত্র যেতে বাধ্য করলে।
সেমিনোলরা ভালো মানুষের মতো ভালোয় ভালোয় সরে গেল—কিন্তু না গেলেও পারত। কারণ তখন তারাও আগ্নেয়াস্ত্রের মালিক হয়েছে।
তবু তারা গোলমাল না করে নতুন জায়গায় গিয়ে নতুন জমি পেয়ে নতুন ঘরবাড়ি তৈরি করলে।
কিছুকাল যায়। আমেরিকানরা আবার দলে ভারী হয়ে ওঠে। সেমিনোলদের কাছে আবার বার্তা পাঠানো হয়—’ওখানকার জমিও আমাদের দরকার। তোমরা পথ দেখ।’
বার বার কি অন্যায় আবদার রাখা চলে? এবারে সেমিনোলরা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলে—’না, আমরা যাব না।’
আমেরিকানরা বললে—’তাহলে জোর করে তোমাদের তাড়িয়ে দেব।’
এসময়ে সেমিনোলদের দলপতি ছিলেন ওস্কেওলা। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ লোক। বললেন—’কাপুরুষের মতো নিজেদের স্বত্ব ছেড়ে আমরা অজানা দেশে যেতে রাজি নই। তোমাদের বন্দুক আছে? আমাদেরও বন্দুক আছে। তোমাদের গুলি-বারুদ আছে? আমাদেরও গুলি-বারুদের অভাব নেই। তোমরা লড়াই করবে? আমরাও লড়ব, শেষ রক্তবিন্দু থাকতে হাতিয়ার ছাড়ব না। আমরা শ্বেতাঙ্গদের রক্তে জমি লাল করে ফেলব। তারপর তাদের মড়াগুলোর মাংস খুবলে খাবে শকুনির ঝাঁক, আর অস্থি চর্বণ করবে নেকড়েদের পাল। আমরাই এখানকার সব ভিটার মালিক, আমরা তা ছাড়ব না!’
লড়াই শুরু হল ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে।
ওস্কেওলার দর্প চূর্ণ করবার জন্যে একদল সৈন্যের সঙ্গে মেজর ফ্রান্সিস ডেভকে পাঠানো হল।
এমন এক জায়গায় আমেরিকান সৈন্যেরা এসে হাজির হল যেখানে সামনের দিকে সূর্যের তীব্র কিরণ চক্ষু ধাঁধিয়ে দেয় এবং পিছন দিকে জেগে আছে দুর্গম জলাভূমি।
ওস্কেওলার পরামর্শ অনুসারে সেইখানেই ঝোপের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে অপেক্ষা করছিল লাল-মানুষরা।
আমেরিকানদের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই লাল-মানুষরা ঝোপের বাইরে আত্মপ্রকাশ করলে দুঃস্বপ্নমূর্তির মতো এবং পরমুহূর্তে তাদের মুখে ফুটল উচ্চ জয়নাদ—’ও-হো-চি’ এবং হাতের বন্দুকে ফুটল কর্ণভেদী বজ্রনাদ—ধ্রুম ধ্রুম ধ্রুম ধ্রুম!
প্রথম আক্রমণেই লাল-মানুষদের অব্যর্থ লক্ষ্যে অধিকাংশ শ্বেত-সৈনিক হল ধরাতলে লম্বমান।
সামলাবার আগেই হল আবার দ্বিতীয় আক্রমণ। এবারে সব শেষ! কেউ ভগ্নদূতরূপেও পালিয়ে যেতে পারলে না। অমেরিকার ইতিহাসে এই প্রথম হল এক যুদ্ধে সমগ্র ফৌজের পতন।
তারপর কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই সফল হল ওস্কেওলার ভবিষ্যদবাণী। মৃত আমেরিকানদের মাংস খুবলে খাওয়ার জন্যে আকাশপথে উড়ে আসতে লাগল ঝাঁকে ঝাঁকে শকুনি!
সেইদিনেই আর এক জায়গায় ওস্কেওলার হাতে প্রাণ দিলেন আমেরিকার জেনারেল টমসন।
তারপর সাত-সাতটা বৎসর কেটে গেল একে একে, তবু যুদ্ধ থামবার নাম নেই। বিদ্রোহী হয়ে আমেরিকানরা ইংরেজদেরও হারিয়ে দিয়েছে, কিন্তু এই মুষ্টিমেয় স্বাধীনতার সেবক লাল-মানুষদের কিছুতেই বশে আনতে পারল না।
মারা পড়ল আমেরিকার দেড় হাজার সৈনিক। সেমিনোলদের জমির উপরে উপনিবেশ স্থাপন করে যারা ভোগদখল করতে এসেছিল, তাদেরও কত লোক যে মৃত্যুমুখে পড়ল তার কোনও হিসাব পাওয়া যায় না। খরচ হতে লাগল কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।
শেষটা বীরের মতো বৈধ উপায়ে যুদ্ধ জয়ের আশা ছেড়ে দিয়ে অমেরিকার রাজ-সরকার একান্ত অবৈধ উপায় অবলম্বন করতেও কিছুমাত্র ইতস্তত করলে না।
যুদ্ধবিরতির শ্বেতপতাকা উড়িয়ে সন্ধির শর্ত নির্ধারণের জন্যে ওস্কেওলাকে আমন্ত্রণ করা হল। সেটা খুব বেশি দিনের কথা নয়—আজ থেকে মাত্র একশো চব্বিশ বৎসর আগেকার ঘটনা।
শ্বেতাঙ্গদের শ্বেতপতাকা যুদ্ধবিরতির জন্যে নয়, বিপক্ষকে ভুলিয়ে কবলগত করবার জন্যে। নিঃসংকোচে ওস্কেওলা এলেন, সবিস্ময়ে বন্দি হলেন এবং ভগ্নহৃদয়ে পরবৎসরেই কারাগারে প্রাণত্যাগ করলেন।
কিন্তু ওস্কেওলার মৃত্যুর পরেও যুদ্ধ থামল না এবং ধরতে গেলে আজও তা চলছে, কারণ সেমিনোলরা আজও শঠতার অবতার শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করেনি। তারা ওস্কেওলার কথা অক্ষরে অক্ষরে রক্ষা করছে, তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে যতক্ষণ দেহে থাকে শেষ রক্তের ফোঁটা!
সেমিনোলরা শ্বেতাঙ্গ সৈনিকদের সঙ্গে লড়তে লড়তে দক্ষিণে—আরও দক্ষিণে এমন সব জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে যেখানে গভীর অরণ্যের পর অরণ্যের পর অরণ্যের ঘনবিন্যাস ছায়াতিমির সৃষ্টি করে সূর্যালোকের পথ বন্ধ রাখে; যেখানে বিষাক্ত সর্পরা ফোঁস ফোঁস করে এবং গর্জন করতে থাকে হিংস্র পশুর দল; যেখানে দুষ্প্রবেশ্য জলাভূমির পর জলাভূমির বাষ্পময় পরিস্থিতির মধ্যে দৃষ্টি হয় ঝাপসা ও প্রায় অচল; যেখানে স্থানীয় বাসিন্দারাও নৌকোর সাহায্য বিনা পদব্রজে পথ চলতে পারে না এবং পথ জানা থাকলেও যেখানে সেটুকু গতিবিধিও অসম্ভব।
গাছের তলায় বসে সেমিনোলরা মনের সুখে স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করে এবং সেখানে শ্বেতাঙ্গ পদার্পণ করলে আর প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারে না। সেমিনোলরা আজও অপরাজিত এবং আমেরিকায় বাস করেও আমেরিকানদের অধীন নয়।
সাত । শিরস্তক-সংগ্রাহক
এবারে সাতানব্বই বৎসর আগেকার কথা বলছি। ধরতে গেলে আধুনিক যুগেরই কথা।
আমেরিকার পশ্চিমদিকে কোলেরাডো প্রদেশ।
লিয়ন কেল্লার কাছাকাছি একটা পোড়ো জায়গায় একদল অশ্বারোহী সৈন্য এসে আচমকা থেমে দাঁড়িয়ে পড়ল।
দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেরিয়ে এল তিনজন লোক।
প্রথম ব্যক্তি আকারে প্রকাণ্ড—যেমন লম্বায়, তেমনি চওড়ায়। তার নাম শিভিংটন। এই সওয়ারদের নায়ক।
দ্বিতীয় সওয়ার হচ্ছে সাধারণ সৈনিক। তৃতীয় ব্যক্তি বর্ণসংকর জাতির লোক—অর্থাৎ তার দেহে আছে শ্বেতাঙ্গ ও আদিবাসীর রক্ত। ঘোড়ার উপরে সে আসীন বটে, কিন্তু তার দুই হাত দড়ি দিয়ে বাঁধা। সৈনিকের হাতে রয়েছে সেই দড়ির অপর প্রান্ত।
কর্নেল শিভিংটন ক্রুদ্ধকণ্ঠে খেঁকিয়ে বলে উঠল, ‘নিকুচি করেছে। হঠাৎ থামলি কেন?’
সৈনিক বললে, ‘হুজুর, বন্দি আর এগুতে নারাজ।’
প্রাক্তন ধর্মপ্রচারক শিভিংটন এখন হয়েছে শখের সাদি সেনাদলের কর্নেল। অর্থাৎ ধর্মপ্রচারকের পেশা ছেড়ে সে এখন শৌখিন সেনানীর পদ গ্রহণ করেছে। এরন্ড যখন নিজেকে বৃক্ষ বলে প্রচার করতে চায়, তখন সৃষ্টি হয় বিষম গণ্ডগোল।
শিভিংটন গর্জন করে নিজের রিভলভারের উপরে হাত রেখে বলে উঠল, ‘অ্যাই দোআঁশলা ব্যাটা! আমি এখনও সকালের খানা খাইনি। তুই যদি আর না এগুতে চাস, তাহলে এখনই তোকেই আমি খেয়ে ফেলে পেট ঠান্ডা করব।’
বন্দি গত রাত্রেই কর্নেলকে বলতে শুনেছে, ‘লাল-মানুষদের রক্তে পা ডুবিয়ে আমি হাঁটতে চাই; হ্যাঁ, পা ডুবিয়ে লাল-মানুষদের রক্তে!’
আজ আবার এই কথা শুনে সে মুখ তুলে দেখলে, শিভিংটনের দুটো চক্ষেই ক্ষুধিত দৃষ্টি। সে আবার এগিয়ে চলল ভয়ে ভয়ে বিনা বাক্যব্যয়ে।
শিভিংটন চেঁচিয়ে বললে,—’আমার দরকার শিরস্তক!’
শিরস্তক অর্থাৎ একগোছা চুলসুদ্ধ মাথার চাঁদির ছাল!
লাল-মানুষদের এক প্রথা ছিল। তারা বিজিত ও মৃত শত্রুদের শিরস্তক অস্ত্র দিয়ে কেটে নিত। শিভিংটনের সাধ, সেও সেই প্রথা অবলম্বন করবে। প্রতিশোধ—দাঁতের বদলে দাঁত!
হুহু করে বইছে বরফ-জমানো কনকনে বাতাস। দুই ফুট পুরু তুষারে ঢাকা পথঘাট। এই অবস্থায় অশ্বারোহীরা দশদিনে তিনশত মাইল পথ অতিক্রম করে এসেছে। সৈনিকরা একান্ত পরিশ্রান্ত, তাদের সর্বাঙ্গ শীতার্ত।
শিভিংটন আবার চিৎকার করলে, ‘বিদ্রোহী লাল-মানুষগুলোকে হত্যা করো—আবালবৃদ্ধবনিতা কারুকে বাদ দিও না! কেটে নাও তাদের শিরস্তক! চাঁদির ছাল না নিলে চলবে না!’
বন্দি পথপ্রদর্শক অবশেষে তাদের যেখানে পৌঁছে দেয় সে হচ্ছে পর্বতপৃষ্ঠ। সেখানে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকালে নজরে পড়ে, জঙ্গলের মধ্যে গ্রামের দৃশ্য। সেখানে বাস করে ‘শিয়েন’ জাতের লাল-মানুষরা। জায়গাটার স্থানীয় নাম, বালির খাঁড়ি।
শিয়েনদের অপরাধ, অমানুষিক অত্যাচার সইতে না পেরে তারা শ্বেতপ্রভুদের কর্তৃত্ব আর মানতে প্রস্তুত নয়, ঘুষি মারলে উলটে মারে ঘুষি! স্পর্ধা!
বিদ্রোহ দমন করবার জন্যে অন্যত্র নিযুক্ত করা হয়েছে পেশাদার সৈনিকগণকে। কিন্তু বালির খাঁড়ির লাল-মানুষদের শায়েস্তা করবার জন্যে পাঠানো হয়েছে এই শৌখিন নবীন সৈনিকদের! তারা স্থির করেছে, ঝানু পেশাদারদের দেখিয়ে দেবে শৌখিন নয়া-জোয়ানদের জারিজুরি!
শিভিংটন হুকুম দিলে, ‘যাও, আক্রমণ করো, হত্যা করো, নির্বিচারে হত্যা করো,—কে পুরুষ, কে নারী, কে শিশু কিছুই বাছবিচার করবার দরকার নেই!’
শীতার্থ প্রভাত, ঘুমন্ত পল্লি। নিস্তব্ধ সবাই।
শিয়েনদের এক নারীর ঘুম হঠাৎ ভেঙে গেল। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে সে শুনতে পেলে, অনেকগুলো ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ উঠেছে খটাখট, খটাখট, খটাখট।
তার চ্যাঁচামেচি শুনে চারদিক থেকে পুরুষরা দৌড়ে এসে বিপুল বিস্ময়ে দেখলে, পাহাড়ের উপরে আকাশরেখায় আবির্ভূত হয়েছে প্রায় এক হাজার অশ্বারোহী সৈনিক। তারা শ্বেতাঙ্গ। তাদের পূর্ববর্তী দল ঘোড়া ছুটিয়ে নীচের দিকে নেমে আসছে দ্রুতবেগে!
শিয়েনদের সরদার এই দৃশ্য দেখেও ভীত না হয়ে বললে, ‘কিছু ভয় নেই! আমরা তো আগেই ওদের বলে দিয়েছি আমরা যুদ্ধ করতে চাই না, আমরা সন্ধিপ্রার্থী।’ তার কথামতো তৎক্ষণাৎ আমেরিকার সুবৃহৎ জাতীয় পতাকার সঙ্গে একটা ক্ষুদ্র শ্বেতপতাকা উড়িয়ে দেওয়া হল।
সরদার কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে শ্বেত ঘোড়সওয়ারদের অভ্যর্থনা করবার জন্যে হাস্যমুখে অগ্রসর হল।
কিন্তু তাদের অগ্রগতি রুদ্ধ হল মধ্যপথেই।
শিভিংটন হুকুম দিলে, ‘চালাও গুলি!’
পরমূহূর্তে বন্দুকের ধুমধাম!
লাল-মানুষরা চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল থমকে, তারপর দৌড় মারলে সভয়ে।
চারিদিকে উঠল আর্ত চিৎকার। আকাশ-বাতাস ভরে গেল নারীদের ক্রন্দনরোলে। মায়েরা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কোলের শিশুদের টেনে নিলে বুকের মাঝখানে।
ধকধক জ্বলে বন্দুকের বিদ্যুৎবৎ অগ্নি, সশব্দে বাতাস কেটে উড়ে আসে তপ্ত লৌহবর্তুল, মৃত্যুযন্ত্রণায় ফুকরে উঠে মাটির উপরে ঠিকরে পড়ে দলে দলে লাল-মানুষ। এবং পৈশাচিক আনন্দে অট্টহাস্য করতে থাকে মানবপ্রেমিক খ্রিস্টদেবের তথাকথিত শ্বেত শাকরেদগণ। কেবল বন্দুক নয়, লাল-মানুষদের হাতের কাছে পেলে তাদের শাণিত কৃপাণগুলোও সূর্য করে ঝকমকিয়ে মরণখেলা খেলতে লাগল। কেবল তাই নয়, তার উপরে চার-চারটে কামানও আনা হয়েছিল, প্রচণ্ড অগ্নিবমনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতপ্ত ধাতুপিণ্ড বর্ষণ করবে বলে; সুতরাং তারাও মৃত্যুখেলায় যোগ দিতে ছাড়লে না। এইভাবে বেড়ে উঠল আমেরিকার জাতীয় পতাকা তথা শান্তিসূচক শ্বেতপতাকার মর্যাদা!
বালির খাড়ির লাল-মানুষরা যুদ্ধ করতে চায়নি, তবু তারা রেহাই পেলে না। অকস্মাৎ আক্রান্ত হয়ে তারা প্রস্তুত হওয়ার সময়ও পায়নি—অধিকাংশই নিরস্ত্র অবস্থায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মারা পড়ল, কেবল কয়েকটা দল মরিয়া হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে খাড়া হয়ে শ্বেত পিশাচদের বধ করতে করতে নিজেদের প্রাণ সমর্পণ করলে।
কিন্তু তাদের বৃদ্ধ দলপতি লড়াইও করলে না এবং পালাবার পথ থাকতেও পালালে না, উদাত্ত কণ্ঠে লাল-মানুষদের পুরাতন মৃত্যুসংগীত গাইতে গাইতে স্থিরভাবে আত্মদান করলে।
স্ত্রীলোকরা বক্ষলগ্ন শিশুসন্তান নিয়ে করুণস্বরে জীবনভিক্ষা করলে—’আমরা নারী! আমরা নারী!’
কে শোনে তাদের কথা? তৎক্ষণাৎ বন্দুকগুলোর মুখে জেগে উঠল আগ্নেয় ধমক এবং নারীর পর নারী ভূতলে পড়ে হয় মরে আড়ষ্ট হয়ে গেল, নয় ছটফট করতে লাগল রক্তাক্ত আহত দেহে!
একটি ছোট শিশু—বয়স তার তিন বছরের বেশি নয়। ভীষণ গোলমাল শুনে ও সবাই পালাচ্ছে দেখে সেই দুধের বাচ্চাও ঘরের বাইরে গিয়ে সভয়ে ছুটতে লাগল অনভ্যস্ত টলোমলো পায়ে।
জনৈক সৈনিক তাকে লক্ষ করে বন্দুকের ঘোড়া টিপলে, ভূপতিত হল বুলেট বিদ্ধ শিশুর কোমল, নিষ্পাপ দেহ।
একটা ঘরের ভিতরে ভয় পেয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কান্নাকাটি করছিল অনেকগুলি শিশুসন্তান। একদল শ্বেতাঙ্গ বীরপুরুষ সেইসব কচি কণ্ঠের কান্না থামাবার জন্যে বারংবার বন্দুক ছুঁড়ে ফাটিয়ে দিলে তাদের মাথার খুলি।
নারী নয়, শিশু নয়, বৃদ্ধ নয়, পঙ্গু বিকলাঙ্গ নয়—হত্যা করো হত্যা করো, হত্যা করো প্রত্যেক লাল-মানুষকে।
কেবল একজন মাত্র নবীন লেফটেন্যান্ট উপরওয়ালার আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিল, ‘স্যার, পতাকা—জাতীয় পতাকার সঙ্গে শ্বেত পতাকা! ওরা যুদ্ধবিরতি চায়, তবু কেন যুদ্ধ হবে?’
উত্তরে শিভিংটনের মুখ থেকে তাকে শুনতে হল নোংরা ভাষায় কুৎসিত গালাগালি।
এবং পূর্বকথিত শিরস্তক! দুরাত্মার সে বাসনাও অপূর্ণ রইল না। শ্বেতাঙ্গ রাক্ষসরা বিপুল উৎসাহে লাল-মানুষদের মৃতদেহের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছুরি বা তরবারি দিয়ে চুলসুদ্ধ মাথার চাঁদির ছাল কেটে দিতে লাগল। কেবল মৃতদেহ থেকে নয়—মরণোন্মুখ জীবন্ত দেহ থেকেও! পৃথিবীর সভ্যজাতির ইতিহাসে এমন বীভৎস ব্যাপার আর কখনও লিপিবদ্ধ হয়নি।
সেদিন শিভিংটন নিজের আর এক প্রতিজ্ঞাও রক্ষা করেছিল। রক্তে দুই পা ডুবিয়েই সে হাঁটতে পেরেছিল। রাঙা রক্তনেশায় পাগল হয়ে সে যেদিকে দৃষ্টিপাত করেছিল সেইদিকেই দেখেছিল কেবল রক্ত আর রক্ত আর রক্ত! গ্রামের পথে রক্ত, নদীর তটে রক্ত, নদীর জলে রক্ত—তার উপরে ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়ে খুলে দেওয়া হল অগ্নিদেবের রক্তনেত্র। আজ যেন রক্তময়ী পৃথিবী! এমন ভয়াল ও জমাট শোণিতবর্ণের রক্তিমা নেই সূর্যের অস্তাচলপটেও।
যারা পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিল তাদের সংখ্যা জানা যায়নি; তবে যারা প্রাণ দিয়েছিল, শিভিংটন নিজেই তার হিসাব দাখিল করেছিল এবং প্রকাশ পেয়েছে মৃত লাল-মানুষদের সংখ্যা পাঁচশো। উপরন্তু তাদের একশো তিরিশখানা বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে ভস্মসাৎ করা হয়েছে।
সর্বশেষে শিভিংটন হুকুম দিলে, ‘সেই দোআঁশলা পথপ্রদর্শকটাকে আমার সামনে নিয়ে এসো।’
বন্দি পথপ্রদর্শককে নিয়ে আসা হল। সে তখন আতঙ্কে কম্পমান।
বিনা বাক্যব্যয়ে শিভিংটন তার উপরে করলে গুলিবৃষ্টি। নিরপরাধ হতভাগ্যের দেহ ঘাসজমির উপরে পড়ে হাত-পা ছুঁড়তে লাগল।
দেহ লক্ষ করে আরও দুটো বুলেট চালিয়ে শিভিংটন ঘোড়ার পিঠে বসেই তাকিয়ে দেখলে, ছিন্নভিন্ন শবদেহে রক্তপিছল ভূপৃষ্ঠ সমাচ্ছন্ন এবং জ্বলন্ত গ্রামের ঊর্ধ্বদেশে বহুদূরব্যাপী নৃত্যশীল আরক্ত অগ্নিশিখা! তারপর হুকুম দিলে, ‘ফিরে চলো, এখানে আর কিছু করবার নেই!’
পরে এই নরকের দূত বেহায়া শিভিংটন আবার ধর্মপ্রচারকের পদ অধিকার করবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এখনও আমেরিকার কারুর কারুর কিঞ্চিৎ চক্ষুলজ্জা আছে, তাই তার সেই অপচেষ্টা ফলপ্রদ হয়নি।
আজ আর কোনও লাল-মানুষই শ্বেতাঙ্গদের স্বর্গদূত বলে ভ্রম করে না। ধ্বংসাবশিষ্ট আদিবাসীদের কতক কতক লোক দায়ে পড়ে শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে মৌখিক সম্পর্ক বজায় রাখতে বাধ্য হয়েছে বটে, কিন্তু বাকি সবাই বনে বনে বন্যপশুদের সঙ্গে বনিবনা করে অবাধ স্বাধীন জীবনযাপন করে, তবু পাশ্চাত্য সভ্যতার ছায়া স্পর্শ করতে প্রস্তুত নয়। সাদা চামড়ার লোক তাদের এলাকায় পদার্পণ করলেই মৃত্যু তার অবধারিত।