রক্ত নিশান
এই বাড়িতে থাকে অব্রে ডেয়ার? অবাক!
এ যে রাজবাড়ি একটা! ভেঙেচুরে পড়ছে, তা ঠিক। তবু রাজবাড়ি ছাড়া অন্য কিছু বলে একে ভাবাই যায় না। অব্রের মতো নিঃসম্বল পটুয়া এ প্রাসাদ বাগাল কী করে? আরে বাগিয়ে লাভই বা কী হয়েছে তার? এমন বিশাল বিপুল হর্ম্যমালা— একা মানুষ চিত্রকরের কোন কাজে আসবে?
তা ছাড়া, এর ভিতরের অবস্থাও যদি বাইরের মতনই জীর্ণ ভগ্ন চিড়-খাওয়া আজ-পড়ি-কাল-পড়ি গোছের হয়ে থাকে, তাহলে তো এখানে বাস করাই বিপজ্জনক! মাথার উপরে ছাদ ধসে পড়লে মরণ আর নিজে কোনো ভাঙা সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়লেও তাই। পক্ষান্তরে এমন যদি হয় যে, ভিতর দিকটা এখনও তেমন বাসের অযোগ্য হয়নি, তাহলেই বা একা একা এই রাজ্যি-জোড়া বাড়িতে মানুষ টেকে কেমন করে? আমি হলে তো পাগল হয়ে যেতাম!
অথচ অব্রে আজ এক বৎসর কাল এখানে রয়েছে। বেশ বহালতবিয়তে আছে, যদি তার চিঠির বয়ানকে সত্যি বলে ধরে নিতে হয়। মাসে একখানা করে চিঠি সে আমাকে দিতে ভোলে না। গত বারো মাসের বারোখানা চিঠিতে বারো আনা অংশই এই বাড়িটির প্রশস্তি গানে পরিপূর্ণ। এমন বাড়ি বহু ভাগ্যে মেলে, এ বাড়িতে এসে অবধি তার প্রত্যেকটি ছবি আশ্চর্যরকম উতরে যাচ্ছে। এর ঐতিহ্য, এর পরিবেশ, এর আবহাওয়া তার অন্তর্নিহিত প্রতিভাকে স্ফুরিত করে তুলছে দিনের পর দিন— ইত্যাদি ইত্যাদি।
ওই বারোখানা চিঠির প্রত্যেকটাতেই ইতি টানবার আগে একটা করে সর্নিবন্ধ অনুরোধ জানিয়েছে অব্রে, ‘তুই চলে আয় এখানে তোর কাগজ কলম নিয়ে। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, এই বাড়ির গুণেই দেখতে দেখতে তুই ডিকেন্স বা ডস্টয়েভস্কি বনে যাবি। লেখক চিত্রকরদের পক্ষে আদর্শস্থান এটা।’
প্রথম তিনখানা চিঠির উত্তরে এ-সম্বন্ধে রা কাড়িনি আমি, অনুরোধটা অবাস্তব মনে হয়েছিল এতই। তার পরের তিনখানাতে বলেছি, ‘দেখা যাক কী করি!’ শেষ ছয়খানায় সময় নিয়েছি ক্রমাগত, ‘হাতের কাজগুলো মিটিয়ে ফেলতে পারলেই আসছি, ব্যস্ত হলে চলবে কেন?’
যখন কোনো অজুহাতই আর মাথায় এল না, তখন বাধ্য হয়েই খাতাপত্র গুছিয়ে নিয়ে যাত্রা করতে হল বন্ধুবরের স্বর্গরাজ্যের উদ্দেশে। নিজের একটা ট্যু-সিটার গাড়ি আছে, তাইতেই শুয়ে বসে আস্তে আস্তে অতিক্রম করেছি দেড়শো মাইল পথ। কাজেই কবে কখন পৌঁছবো অব্রের আস্তানায়, কিছুই আগে থেকে জানাতে পারিনি তাকে। সে টের পেল, যখন—
প্রসাদপুরীর চারিদিক বেষ্টন করে পরিখা ছিল আগে, সেটা পার হতে হত পুলের উপর দিয়ে। ভেঙেচুরে গেলেও সে পুলই কাজ দিচ্ছে এখনও। আমি যখন তারই উপর দিয়ে গড়গড় করে গাড়ি চালাচ্ছি, তখন জানালা দিয়ে মুখ বাড়াল অব্রে, অন্তত আধ ফার্লং দূর থেকে। তোরণ থেকে বাড়িটার দূরত্ব ওইরকমই।
বত্রিশপাটি দাঁত বিকশিত করে নেমে এলেন শ্রীমান অব্রে, ‘এসেছিস তা হলে?’ বলে হাত ধরে অ্যায়সা ঝাঁকুনি দিল গোটাকতক যে, আমার সঙ্গেসঙ্গে ভয় হল সে হাতে আর কলম ধরতে পারব না অন্তত এক মাস।
অব্রে সেইখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আঙুল ঘোরাতে লাগল চারিদিকে, ‘ওই যে নতুন নতুন বাড়ি গজিয়ে উঠেছে বা উঠছে, ওসব জায়গাই এই ওয়েলিংডন হলের ছিল সেদিন পর্যন্ত। পার্ক ছিল ওখানে। জমিদারদের নিজস্ব পার্ক। হরিণ চরত। ইংল্যান্ডে হরিণ শিকার করা, রাজার বিশেষ অনুমতি না-নিয়ে কেউ করতে পারত না। ওয়েলিংডনদের ছিল সে অনুমতি।’
গর্বে ফেটে পড়ছে অব্রে। ওয়েলিংডনদের গৌরবের একটা বৃহৎ অংশ ভাড়াটের উত্তরাধিকার সূত্রে তার উপরেই বর্তাল নাকি? আমার কেমন সন্দেহ হতে লাগল, বন্ধু আমার ঠিক প্রকৃতিস্থ নেই।
‘গাড়িটা কোথায় রাখি?’ অব্রের অন্তহীন উচ্ছাসের এক ফাঁকে প্রশ্ন করলাম, ‘গাড়িটা রাখি কোথায়? ওয়েলিংডনদের যুগে তো গ্যারাজ থাকত না বাড়ির সঙ্গে!’
‘কিন্তু আস্তাবল থাকত’— সদম্ভে উত্তর দিল অব্রে, ‘দু-শো ঘোড়া রাখবার মতো আস্তাবল আছে আমার।’ হঠাৎ যেন একটু ম্রিয়মাণ মনে হল তাকে, ‘আস্তাবলের অবস্থা বরং আমার শোবার ঘরের চেয়ে ভালোই আছে।’
গাড়িখানা ঢুকিয়ে দিলাম আস্তাবলে। নিজেরা ঢুকলাম বাড়িতে। হলঘর সামনেই। কী বিরাট কলেবর তার! কিন্তু অবস্থা সসেমিরে। ছাদের নীচে কাঠের আস্তরণ ছিল, তা খুলে পড়েছে। এক কোণ দিয়ে সিঁড়ি উঠেছে, তার ওক-কাঠের রেলিং লোপাট। অব্রে জানাল, এস্টেটের যারা অছি এখন, তারাই বেচে দিয়েছে নগদ দামে।
উপরে কত যে ঘর! সবই ভগ্ন, জীর্ণ বাসের যোগ্য তো নয়ই, দেখলে ভয়-ভয় করে। এই বুঝি মাথায় ভেঙে পড়ে ছাদ, এই বুঝি মেঝের ফাটল দিয়ে নীচে গলে পড়ি। তারই ভিতর দিয়ে নিপুণ পাইলটের মতো অব্রে আমায় চালিয়ে নিয়ে গেল, ‘আমি থাকি মাঝের মহলে। ওখানে কয়েকখানা ঘর আস্ত আছে।’
সত্যিই তাই। শুধু আস্ত নয়, এখনও দেয়ালে কাগজ লাগানো রয়েছে সে-যুগের, বিবর্ণ হয়ে গেলেও ছেঁড়েনি। কী করে এমন অঘটন ঘটল, অব্রের ধারণা নেই। সবচেয়ে বড়ো ঘরখানায় বসে সে ছবি আঁকে। গত এক বছরে যত ছবি সে এঁকেছে, নানা জায়গায় নানা ভঙ্গিতে তা সাজানো আছে। দুই-একখানার দিকে দুই-এক নজর দেখেই আমি মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলাম, ভাঙা রাজবাড়ি সত্যিই উঁচুদরের প্রেরণা জাগাতে পেরেছে বন্ধুকে, তার প্রতিভা স্ফুরণের মুখে।
কিন্তু ছবি দেখার সময় পরে পাওয়া যাবে। অব্রে তার রাজ্যসীমা আগে দেখিয়ে দিতে চায় আমাকে। একখানা অব্রের শোবার ঘর, একখানা রান্নাঘর। আর একটা ঘর সে আজ এক বছর ধরে রোজ ঝাঁট দিচ্ছে, আমি এসে থাকব বলে। একটু যেন অভিভূতই হলাম তার স্নেহের এই নতুন পরিচয় পেয়ে।
‘রান্না ভাই সকালেই একবার হয়। পিছনের বস্তি থেকে এক বুড়ি এসে কাজকর্ম করে দিয়ে যায় কিনা, তাকে দিয়েই ওটা সমাধা করে রাখি। তা সেটা লাঞ্চেতেই কাজে লাগে। ডিনার সারতে হয় টিনের খাবার খেয়ে। তাতে তোমার অরুচি নেই তো?’
অরুচি নেই আবার! কিন্তু সেকথা আর বলি কী করে বন্ধুকে? যেভাবে ঘাড় নাড়লাম, তার অর্থ হাঁ-না দুইরকমই হতে পারে। যেরকম খুশি বুঝুক ও, আমি তো আর বলছি না কিছু।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ‘কাল সব দেখাব এখন’— বলে আলো জ্বেলে খাঁটি হয়ে বসল অব্রে রাত্রির মতো। রান্নাঘরেতেই সে খায় এবং ছবি-আঁকার ঘরেই সে ওঠা-বসা করে। আমায় বসাল রান্নাঘরেই। কারণ রাত্রির খাওয়ার একটা পর্ব আছে, তা সে টিনের মাংসই হোক, আর যাই হোক।
খেতে খেতে গল্প চলছে। ব্যবহারে আসে খান চার-পাঁচ ঘর, কিন্তু বলতে গেলে এন্তার এস্টেট অব্রেরই খাসমহল। ভাড়া নিয়েছে সে গোটা ওয়েলিংডন হল। মাসিক ভাড়া দশ শিলিং। আমি হেসে ফেলতেই ও গম্ভীর হয়ে বলল, ‘অছিরা ব্যবসায়ী লোক রে! দশ শিলিংয়ের দাম যে পুরো দশ শিলিং, তা তারা বোঝে। আমায় ভাড়া না-দিলে এই ইটের গাদার দরুন এক পেনিও তো আদায় হত না কারও কাছে।
তার কাছেই শুনলাম সব— পাঁচ-সাত-শো বছরের পুরোনো জমিদারবাড়ি। ওয়েলিংডনেরা প্রথম শ্রেণির অভিজাত ছিলেন এদেশে। রাজার সঙ্গেও দহরম-মহরম ছিল এ-বংশের অনেকের। প্রথম চার্লস, যাঁর মুণ্ডু কাটা গেল শেষপর্যন্ত ক্রমওয়েলের সৈনিকদের হাতে, তিনি কয়েক দিন এসে বাসও করেছিলেন এ-বাড়িতে। ‘যে-ঘরে আমি ছবি আঁকি, সেই ঘরেই রাজা চার্লস যে বিশ্রাম করেননি দুই-একঘণ্টা সে সব দিনে, একথা জোর করে কে বলতে পারে?’
আমি হালকা সুরে মন্তব্য করলাম, ‘এত পুরোনো, এমন ভাঙা বাড়ি, তাতে আবার এতখানি ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে এর পিছনে, এ-অবস্থায় দুই-চারটি ভূত তো বাপু এখানে থাকা একান্তই উচিত।’
‘আছে, হয়তো’— তেমনই হালকা সুরেই জবাব দিল অব্রে, ‘যদিও আমি দেখিনি এ যাবৎ, ওই ন্যানসি বুড়ি অনেক কিছু জানে। আমাকে মাঝে মাঝে শোনাবার চেষ্টা করে, আমি ওকথা উঠলেই ওকে বিদায় করি। তবে একটা কথা ও আমাকে গোড়াতেই বলে রেখেছে, সন্ধ্যার পরে ও কোনো কারণেই এ এস্টেটের হাতার মধ্যেই ঢুকবে না। সে অনুরোধ যেন ওকে কখনো না-করা হয়।’
শ্রান্ত ছিলাম, টিনের খাবার যথাশক্তি গলাধঃকরণ করে সোজা চলে গেলাম নিজের ঘরে। দুই-একখানা চিঠি না-লিখলেই নয়, সে কর্ম তাড়াতাড়ি শেষ করে শয্যায় অঙ্গ ঢেলে দিলাম। রাত্রে ঘুম যে হয়নি, তা নয়। তবে মাঝে মাঝে স্বপ্নও দেখেছি। দুঃস্বপ্ন ঠিক বলা যায় না। সেকেলে বড়োলোকদের ছবি অনেক দেখেছি, একশ্রেণির ছবিতে পুরুষগুলিকে আঁকা হয়েছে, একাধারে বীর ও বিলাসী হিসেবে। আমি স্বপ্ন দেখলাম, সেই ধরনেরই এক প্রৌঢ় পুরুষকে সে রাতে। অন্তত তিনবার, এক একবার এক এক পোশাকে, এক একরকম ভঙ্গিতে।
শেষবার যা দেখলাম, দেখার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম ভেঙে গেল। সেই ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন যেন এই বাড়িরই প্রাঙ্গণে, আর তাঁর বিশ ফুট দূরে এক লাইন সৈনিক তাক করে আছে তাঁর দিকেই।
বিশটা বন্দুকের মিলিত নির্ঘোষ এই বুঝি শুনতে হয়, এই বুঝি শুনতে হয়— এই ভয়েই ঘুম ছুটে গেল চোখ থেকে। জেগে উঠে দেখি শার্সিহীন জানালার চটের পর্দার পাশ দিয়ে ভোরের আলো উঁকি দিচ্ছে ধূসর বিরস মুখে। উঠে বসে দু-চোখ রগড়ে নিলাম একবার, তারপর আবার শুয়ে পড়ে চাদর টেনে দিলাম গায়ে।
অব্রের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল আটটা নাগাদ। ধূমায়মান কফি হাতে নিয়ে সে এসে বলছে, ‘সকাল সকাল এক চক্কর বেড়িয়ে আসি চল। হোটেল আছে ওইদিকটাতে, প্রাতরাশ সেখানেই সেরে আসব। রোজই আমি তাই আসি।’
প্রাতরাশের কথা থাকুক, সুপ্রভাত জানাবার পরই আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এ বাড়িতে সৈনিকেরা কাকে গুলি করে মেরেছিল, বল তো।’
‘স্যার পিটার ওয়েলিংডনকে। কাল রাজা চার্লসের কথা হচ্ছিল না? তাঁরই সমসাময়িক এবং তাঁরই একান্ত অনুগত। যুদ্ধও করেছিলেন রাজার পক্ষে। শেষকালে রাজা যখন মারা পড়লেন, স্যার পিটার হলেন পলাতক। তবে পলাতক অবস্থাতেও মাঝে মাঝে গভীর রাতে বাড়ি আসতেন লুকিয়ে। তাঁর আপনার জনই কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করে খবরটা দিয়ে দেয় ক্রমওয়েলের কদমছাঁট সৈনিকদের—’
‘কদমছাঁট?’— জিজ্ঞাসা না-করে পারলাম না, কারণ শব্দটা অদ্ভুত লাগছিল।
‘ওরা চুল ছাঁটত এত ছোটো করে যে মাথাটা দেখাত কদমফুলের মতো’— বলল অব্রে, ‘ওই কদমছাঁটেরা অতঃপর তক্কে তক্কে রইল। একদিন ধরেও ফেলল স্যার পিটারকে। তিনি বাড়িতে ঢোকামাত্র সেই আত্মীয়টি তেতলার জানালা দিয়ে উড়িয়ে দিল এক লাল পতাকা। সেইটিই হল সংকেত। লাল পতাকা উড়তে দেখেই কদমছাঁটেরা ছুটে এল, স্যার পিটারকে টেনে বার করে ওই আস্তাবলের সামনের উঠোনেই গুলি করে মারল তাঁকে। কাল তুই যেখান দিয়ে গাড়ি তুললি আস্তাবলে, খুব সম্ভবত সেইখানেই কোথাও একদিন রক্তপাত হয়েছিল স্যার পিটারের।’
পোশাক পরতে পরতে আমি বললাম, ‘তা হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু সেই চার-শো বছর আগের খুনোখুনির ব্যাপার আমাকে চাক্ষুষ দেখানোর জন্য স্যার পিটারের এ আগ্রহ কেন, তা বুঝলাম না। এইভাবেই কি সেকেলে বড়োলোকেরা অতিথির আপ্যায়ন করতেন?’
মনটা খিঁচড়েই গিয়েছিল। অনেক ঘুরে ফিরে এবং হোটেলে ভালো-মন্দ অনেক কিছু উদরস্থ করেও সে বিরক্তিটা ঠিক কাটল না। কাটাবার জন্যই ক্রমাগত চক্কোর দিতে থাকলাম। দেখতে বাকি রইল না কিছু। পরিষ্কার বাইরে বিস্তীর্ণ পার্ক ছিল সেকালে, এখন মাঝে মাঝে দুই-একটা প্রাচীন মহীরুহ ছাড়া সে পার্কের আর কোনো চিহ্ন নেই। লাল শুরকির রাস্তা বেরিয়েছে অগুন্তি। সম্ভব-অসম্ভব সব দিকে, সব কোণে নাসিকা প্রবেশ করিয়েছে তারা। আর সেইসব রাস্তার দুইধারে নতুন নতুন ছোটো ছোটো বাড়ি। অছিরা এক ইঞ্চি জায়গা ফেলে রাখেননি।
মোটের উপর দেখলাম, ওয়েলিংডনের ভগ্ন দীর্ণ প্রসাদকে বেষ্টন করে নতুন এক আধুনিক শহর গজিয়ে উঠেছে নব যুগের চাহিদা অনুযায়ী। পরিখার ভিতরে রাত্রিগুলো থাকে নিষ্প্রদীপ, বাইরে থাকে বিজলি আলোকের মালায় উদ্ভাসিত। কখনো-সখনো পেচকের ঘুৎকার ছাড়া কোনো আওয়াজ ওঠে না প্রাচীন প্রাসাদ থেকে, কিন্তু অর্বাচীন ভিলাগুলি তখন মুখরিত হতে থাকে রেডিয়োর গানে বা পিয়ানোর বাজনায়। বাইরে থেকে পরিখার ভিতরে ঢুকতে মনটা চাইছে না একদম। কিন্তু অব্রের কাছ থেকে সে-মনোভাব গোপন রাখতে হচ্ছে সযত্নে।
না-রেখে করি কী? বেচারি তার পড়ে-পাওয়া ভাঙাবাড়ি নিয়ে পরম সুখে আছে, আমি হঠাৎ এসে কুডাক ডেকে সে সুখের হন্তারক হই যদি, সেটা বন্ধুজনোচিত হয় না। এসেছি যখন বাহ্যত খোশমেজাজ বজায় রাখতে আমি বাধ্য।
দু-জনে বাড়ি ফিরলাম প্রায় লাঞ্চের সময়। বুড়ি রান্নাবান্না সেরে ঢেকেঢুকে রেখে স্বস্থানে প্রস্থান করেছে। আমরা এসে গরমাগরম খেতে বসে গেলাম। খাওয়ার পরে অব্রে গেল আঁকার ঘরে। কারণ কাজ বন্ধ রাখবার মতো মহোৎসব কিছু হচ্ছে না। এ-বাড়িতে, আমার আগমন উপলক্ষ্য করে।
আমিও নিজের ঘরে এসে কাগজ কলম বার করলাম, লেখা-টেখা আসে কিনা, দেখা যাক চেষ্টা করে। চেষ্টা করতে করতে বেলা পড়ে গেল, অব্রের সাড়া পেলাম রান্নাঘরে, সে চা তৈরিতে ব্যস্ত মনে হল। আমিও উঠে গেলাম, তার সাহায্য করবার জন্য।
চা-পর্ব সমাধা করেই আমায় বাড়িটা দেখিয়ে আনবার জন্য উৎসাহিত হয়ে উঠল অব্রে। সকালে দেখা হয়েছে, ওয়েলিংডন কী হয়েছে, তাই। বিকালে দেখা হোক যে, কী ছিল ওয়েলিংডন একদা। অব্রের উৎসাহের ছোয়াচ খুব বেশি লেগেছিল আমার মনে— একথা বললে মিছে কথা বলা হবে। কিন্তু আমার পূর্ব সংকল্প অটুট রয়েছে, পারতপক্ষে ওকে বুঝতে দেব না যে, ওয়েলিংডন-প্রবাসের ফলে আনন্দ যদিও আমি পেয়ে থাকি, সে আনন্দ কোনোমতেই অবিমিশ্র নয়।
কত যে ঘুরলাম! বৈচিত্র্য আছে বই কী! কোনো ঘর ষোলো আনা ভাঙা, কোনোটা ভাঙা চার আনা। কোনো বারান্দায় চার ফুট খদ লাফিয়ে পেরুতে হল, কোনো সিঁড়িতে ধাপের অভাববশত দড়ি ধরে ঝুলতে ঝুলতে উপরে উঠতে হল। দড়ি অবশ্য অব্রেই খাটিয়ে নিয়েছে নিজের সুবিধার জন্য।
এইভাবে নানা ধকলের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে করতে ছাদে গিয়ে উঠলাম যখন, বেলা তখন এক ঘণ্টা আছে কী নেই। অব্রে বলল, ‘ছাদে একটা, তেতলায় একটা, এই দুটো জিনিস দেখিয়ে আজকের মতন রেহাই দেব তোকে। প্রথমেই দেখ, ছাদে একটা ক্ষুদে গির্জা। এতে মার্বেলের বেদিতে ওই যে ক্রশ দেখছিস, ও নাকি খাস বেথলিহেমের বস্তু। জানিস তো? বেথলিহেমের এক আস্তাবলে প্রভু যিশু জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ঘোড়াদের জাবনা খাওয়াবার এক কাঠের চাড়ির ভিতরে মা মেরি তাঁকে শুইয়ে রেখেছিলেন। সেই চাড়ির কাঠ দিয়ে কালক্রমে কয়েকখানি ক্রসশ তৈরি করেন যিশুর অন্তরঙ্গ শিষ্যেরা। তারই একখানি এই—’
বিশ্বাস করি বা না-করি, শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে এল। কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে ভুললাম না, সে-ক্রশ জেরুজালেম থেকে এখানে এল কী করে!
‘কেন? ওয়েলিংডনেরা যে ক্রুশেডে1 গিয়েছিলেন কেউ কেউ! ফিরবার সময় জেরুজালেম থেকে ওই পবিত্র ক্রশ সংগ্রহ করে এনে নিজেদের প্রাসাদশিখরে স্থাপন করবেন, এ তো স্বাভাবিক।’
‘শুনতে ভালো লাগে’— উত্তর দিলাম আমি।
সে-সংক্ষেপ উত্তরে খুশি হল না অব্রে। আমাকে পুরোদস্তুর বিশ্বাসীতে পরিণত করবার আশায় বলতে লাগল, ‘আমার ন্যানসি বুড়ি ওই ক্রশ সম্বন্ধে অনেক গল্প বলে। এ অঞ্চলের আদিবাসিন্দারা এখনও নাকি বিপদে পড়লে এইখানে চলে আসে ক্রশধোয়া জল নেবার জন্য। সেই জল খেলে আধিব্যাধি সেরে যায়, সেই জলে স্নান করলে ভূতাবিষ্ট লোক সুস্থ হয়ে ওঠে।’
কথা কইতে কইতে আমরা তেতলায় নেমে এসেছি। ‘এখানে আবার কী আছে?’— জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
‘একটা জানালা তোকে দেখাব। এ ধারটাতে নয়, একদম পিছন দিকে। সেই জানালা দিয়েই নাকি স্যার পিটারের বিশ্বাসঘাতক আত্মীয় লাল নিশান দেখিয়েছিল কদমছাঁটদের।’
অনেক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তেতলার পিছনমহলে অব্রে নিয়ে এল আমায়, দাঁড় করিয়ে দিল একটা জানালার পাশে। বলতে বাধা নেই, গা-ছমছম করে উঠল সেখানে দাঁড়াতে গিয়েই। পাল্লা নেই, লোহার গরাদগুলো মরচে-ধরা, গোড়ার সিমেন্ট খুলে আলগাও হয়েছে খানিকটা।
বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। পরিখার ওপারে খানিকটা খোলা মাঠ। পার্ক ছিল, এখনও দুই-পাঁচটা গাছের গুঁড়ি গড়াচ্ছে মাটিতে। বিক্রি হয়ে গিয়েছে এসব জমি, ক্রেতারা বাড়ি তুলতে পারেনি এখনও। বাড়ি উঠেছে একটু দূরে, সারি সারি ছোটো ছোটো বাড়ি, ছোটো ছোটো ফুলবাগানের ভিতর যত্ন করে সাজানো। সেদিকে তাকিয়ে কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না যে, ওইখানে ছিল ঘন বনানী, তার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে কদমছাঁটেরা গভীর নিশীথে চড়াও হয়েছিল এই বাড়িতে, স্যার পিটারকে গুলি করে মেরেছিল তাঁর নিজের উঠোনে।
গরাদের গোড়ায় সিমেন্ট নেই, দুই ইঞ্চি পরিমাণ গর্ত হয়েছে বৃষ্টির ছাঁটে। আমি সেই গর্তে আঙুল ভরে দিয়ে খোঁচাচ্ছি। হঠাৎই বড়ো একটা চাঙড় খুলে এল জমাট সিমেন্টের। আর তার নীচেই বেরুল একটা মাঝারি আকারের ফোকর।
অবাক হয়ে দেখলাম, ফোকরটাও খালি নয়, একটা কাপড়ের মতো জিনিস তার ভিতরে। ‘কী আবার এটা?’— বলতে বলতে সেটা টেনে বার করলাম। ধুলোয় ভরতি, ঝাড়বার জন্য জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম।
‘আরে, আরে, আরে—’ অব্রেও তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে দিল আমারর হাত চেপে ধরবার জন্য। কিন্তু তার আগেই কর্ম শেষ! পর পর দুই বার কাপড়খানা জোরে জোরে ঝাড়া দিয়েছি আমি খোলা হাওয়ায়।
‘সর্বনাশ! সর্বনাশ করেছিস তুই!’— বলে ককিয়ে উঠল অব্রে। আর আমার হাত থেকে কেড়েই নিল কাপড়খানা, জোর করেই কেড়ে নিল।
আমি রেগে উঠলাম, ‘তোর হল কী? সর্বনাশটা কীসে হল, শুনি?’
‘দেখছিস না, এ সেই রক্তনিশান?’— আহত জন্তুর মতো যুগপৎ কাতর আর ক্রুদ্ধ গর্জন করে উঠল অব্রে।
এতক্ষণে লক্ষ করলাম, ঝাড়া খেয়ে ধূলি-জঞ্জালমুক্ত হয়েছে জীর্ণ কাপড়খানা, সেটার রং যে এককালে লাল ছিল, তা বুঝতে এখন আর কিছুমাত্র কষ্ট হচ্ছে না।
একটা অজানা ভয়ে মনটা দমে যাচ্ছে, তবু মুখে সাহস দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হয়ই যদি সেই রক্ত নিশান, তাতে সর্বনাশের কী আছে? তুই অমন করছিস কেন, বল তো?’
‘এই সন্ধ্যে বেলা, ওই অলক্ষুণে রক্ত নিশানের সংকেত, এর পরিণাম যে কী না-হতে পারে, জানি না।’— থেমে থেমে ভয়ার্তকণ্ঠে জবাব দিল অব্রে, ‘একবার ওই সংকেতে প্রাণ গিয়েছিল স্যার পিটারের, এবারে—’
বাধা দিলাম অসহিষুভাবে, ‘যারা স্যার পিটারকে মেরেছিল, তারা নিজেরা কবে মরে ভূত হয়ে গিয়েছে।’
আমার মুখের কথা কেড়ে নিল অব্রে, ‘ঠিক বলেছিস, মরে ভূত হয়েছে! ভূতেরা ভূত হওয়ার পরেই জীবৎকালের হিংসা-ক্রোধগুলো ভুলে গিয়ে একদম সাধু বনে যায়— এ কথা তুই কার থেকে শুনেছিস?’
‘ভূত হয়ে যাওয়ার কথাটা বলছিলাম কথার কথা হিসেবেই।’— অপ্রসন্নভাবে বলে উঠলাম আমি, ‘আসলে ভূতে আমার বিশ্বাসই নেই।’
‘তোর অবিশ্বাসে কোনো ক্ষতি হবে না তাদের।’— এই বলে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে সে তাড়াতাড়ি দোতলায় নেমে এল। লাল নিশান পড়ে রইল তেতলার মেঝের ধুলোতে।
রান্নাঘরে আগুন জ্বলছে। ‘তাড়াতাড়ি খেয়ে নিই আয়’— বলল সে।
‘কেন? এক্ষুনি খাব কেন?’— ওর ভাবগতিক দেখে বিরক্ত তো হচ্ছিই, ভয়ও একটু একটু করছে।
‘পরে হয়তো আর সময় মিলবে না খাওয়ার’— বলল সে। ‘সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে দেখছিস না? আঁধারের শক্তি এখন ক্রমেই জোরালো হতে থাকবে। নরকের গহ্বর থেকে উঠে আসবে অভিশপ্ত আত্মারা। আমরাই সংকেত পাঠিয়েছি তাদের কাছে। আমাদের কাছেই আসবে তারা।’
অব্রে যে এমন ভাবালু মানুষ, তা তো জানতাম না। কী একটা তুচ্ছ ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে কী এ কুসংস্কারের জাল বুনে তুলছে তার নিজের এবং আমার চারদিকে?
খেয়ে নিলাম। কিন্তু তারপরই টুপি আর কোট পরে ফেললাম, ‘চল, বেরিয়ে যাই এ পুরী থেকে। তোর যখন অতই ভয় করছে, রাতটা হোটেলে গিয়ে কাটাই চল—’
‘মন্দ কথা নয়’— বলে অব্রে একমুহূর্ত আমারই জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, তারপরই খটখট করে হেসে উঠল একটা অত্যন্ত শুকনো ভয়াবহ হাসি।
‘কী হল রে?’— বলে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমিও।
‘কী দেখছিস বাইরে?’— প্রশ্ন করল সে।
‘দেখছি? ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না।’— দিলাম জবাব।
‘তবেই বোঝ। কাল তুই সন্ধ্যার আগেই এসেছিলি। কাল অবশ্যই অন্তত একবারও বাইরে তাকিয়েছিলি এই জানালা দিয়ে। কী দেখেছিলি? কী শুনেছিলি?’
‘দেখেছিলাম? হ্যাঁ, দেখেছিলাম অসংখ্য আলো, ওইসব নতুন বাড়ির। শুনেওছিলাম সে সব বাড়ির গান-বাজনার শব্দ—’
‘তবেই বোঝ! শুধু কাল বলে নয়, আলো সারা বছর জ্বলছে, আমি দেখেছি। রেডিয়ো সারা বছর বাজছে, আমি শুনেছি। কাল পর্যন্ত চলেছে এইরকম। আজ হঠাৎ সব বন্ধ। আলো নেই, শব্দ নেই, অর্থাৎ বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি আমরা। নরকের দূতেরা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে আমাদের। তুলে দিয়েছে অদৃশ্য এক অপশক্তির প্রাচীর। আলো গান সবই আছে, শুধু আমরাই তা দেখতে শুনতে পাচ্ছি না, সেই প্রাচীরটার দরুন—’
বলেই সে প্রায় ছুটে চলে গেল নিজের ঘরে, আর টুপি কোট গায়ে চড়িয়ে আমায় ডাক দিল, ‘আয়, আয়, দেখি এখনও পথ আছে কিনা পালাবার—’
দুইজনে তরতর করে নেমে এলাম সিঁড়ি দিয়ে, লণ্ঠনটা হাতে নিয়েই। এমন কাণ্ড। হলঘরের দরজাতে এসেই লণ্ঠনটা দপ করে জ্বলে উঠল একবার, তারপরই নিভে গেল।
‘হয়েছে আর কী!’— বলে লণ্ঠন দোরগোড়ায় নামিয়ে রাখল অব্রে।
অন্ধকারেই দুইজনে হেঁটে হেঁটে গিয়ে সদর দরজায় দাঁড়ালাম। খুলেও ফেললাম সেটা। তারপর বেরুবার চেষ্টা করলাম দুইজনে।
বেরুবো? সামনে একটা দুর্লঙ্ঘ্য দেয়াল আমাদের। কীসের দেয়াল, তা দেখতে পারছি না, কিন্তু তাতে বাধা যে পাচ্ছি, তাতে কোনো ভুল নেই। নিরেট, কঠিন, হাত বাড়িয়ে কোনোদিকে তার শেষ খুঁজে পাই না। নিশ্ছদ্র, তার ভিতর দিয়ে গলে বেরিয়ে যাওয়ার ফাঁক কোথাও মেলে না।
তবু চেষ্টা করছি, সেই অদৃশ্য দেয়ালে কাঁধ লাগিয়ে ঠেলছি। ও কী ও? একটা কালো বিদ্যুৎ যেন চমকে গেল। যতদূর নজর চলে ডাইনে-বাঁয়ে, একটা ত্রস্ত চকিত গতিশীলতা ওধার থেকে এধার পর্যন্ত নাচিয়ে দিয়ে গেল সেই জমাট অন্ধকারকে। আর সেইক্ষণেই একটা ক্রুদ্ধ সংক্ষিপ্ত অনুচ্চ হুংকার আমরা স্পষ্ট শুনলাম সেই আঁধার সমুদ্রের কোনো এক দূরবর্তী কোণ থেকে।
ভয়ে আমরা কাঁপছি নাকি? বোধ হয় কাঁপছি। কাঁপি বা না-কাঁপি, দু-জনেই একসাথে পিছিয়ে এলাম গেটের ভিতরে, প্রাণপণে চেপে ধরে বন্ধ করলাম গেট। কয়েক সেকেন্ড দেরি হলে আর পারা যেত না বন্ধ করতে। বাইরে থেকে বিক্ষুব্ধ সমুদ্র যেন এসে আছড়ে পড়ল সেই দরজার উপরে।
আমরা দুদ্দাড় ছুটে ফিরে এলাম সেই হলঘরেই। দেশলাই জ্বেলে লণ্ঠনটা জ্বেলে ফেললাম। ওদিকে তখন সেই লোহার গেট মড় মড় শব্দে ভেঙে পড়ছে।
আমরা ছুটলাম উপরে। ভগ্ন বিচূর্ণ গেট দিয়ে তখন পিল পিল করে কারা যেন ছুটে আসছে ভিতরে। ত্রু«দ্ধ গর্জন শত শত কণ্ঠের, ‘মার! মার! মার!’ শব্দ শুধু!
আমরা ছুটছি উপরে। পিছনে সিঁড়িতে দুপদাপ, দুপদাপ, দুপদাপ! তারাও আসছে। ধরবেই আমাদের। ‘ধর! মার! ধর! মার’ হুংকার উপরে উঠে আসছে, আমাদের পায়ে পায়ে। আমি নিজের ঘরের দিকেই যাচ্ছিলাম, অব্রে আমার হাত ধরে টানল, ‘কোথাও গিয়ে রেহাই পাবি না। ওরা স্যার পিটারকে নতুন করে হত্যা করবে আজ আবার। আজকের পিটার তুই আর আমি। একমাত্র ভরসা—’ এই বলে সে উপরের দিকে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল আবার। কয়েক ফুট পিছনেই অসংখ্য ধাবমান পদশব্দ, তুমুল শাসানি গর্জানির অট্টরোল।
আমরা ছুটতে ছুটতে ছাদে উঠে এলাম, ছুটতে ছুটতে আছড়ে এসে পড়লাম সেই বহু শতাব্দীর পরিত্যক্ত ক্ষুদে গির্জার ভিতরে, দুইজনে দুইদিক থেকে জাপটে ধরলাম ক্রশখানা, আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘যিশু, রক্ষা করো!’ বলে।
তারপরই অজ্ঞান হয়ে গেলাম আমরা। চেতনা হারাতে হারাতেও হাজার কণ্ঠের নারকীয় উল্লাসের প্রমত্ত চীৎকার কানে আসছিল আমাদের নীচে থেকে, দোতলা তেতলা থেকে, সিঁড়ির উপর থেকে। কিন্তু সিঁড়ির এদিকে আর নয়, ছাদে তারা ওঠেনি।
জ্ঞান যখন এল, রাত ভোর হয়ে গিয়েছে। সমস্ত বাড়িটা নিস্তব্ধ। ক্রশখণ্ডকে প্রণতি জানিয়ে প্রার্থনা করলাম সেইখানে বসে। তারপর সাহসে ভর করে নেমে এলাম। কী সর্বনাশা ধ্বংসলীলা! ভাঙবার জিনিস যা-কিছু, সব গুঁড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে ওরা। কাপড়জামা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করেছে। সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতি করেছে অব্রের ছবিগুলি, দুমড়ে মুচড়ে ছিঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে বাইরে, আর আমার গাড়িখানাকে বানিয়ে রেখে গিয়েছে একটা তালগোল পাকানো লৌহপিণ্ড।
নিশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এলাম ওয়েলিংডন হল থেকে। আজ আর পথ আটকাল না কেউ। আকাশে সূর্য উঠেছে, চারিদিকে নতুন বাড়িগুলো থেকে মানুষ বেরিয়ে আসছে দুই-একজন করে, যে যার দিনের কাজ শুরু করবে এবার। রাত্রিতে ওয়েলিংডনে কী ঘটেছে কেউ কিছু টের পায়নি।
আমরা হোটেলের দিকে যাচ্ছি। বাস পাওয়া যাবে ওখানে।
1. আরবদের হাত থেকে জেরুজালেম উদ্ধার করবার জন্য ইউরোপের খ্রিস্টান রাজা কয়েক বারই যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন। সেইসব অভিযানই ‘ক্রুশেড’ নামে অভিহিত