রক্ত-খদ্যোত
সন্ধ্যার সময় প্রাত্যহিক অভ্যাসমত গুটিকয়েক সভা ক্লাবঘরের মধ্যে সমবেত হইয়াছিলাম।
বরদা সিগারেটের ক্ষুদ্র শেষাংশটুকুতে লম্বা একটা সুখটান দিয়া সেটা সযত্নে অ্যাশ্-ট্রের উপর রাখিয়া দিল। তারপর আস্তে আস্তে ধোঁয়া ছাড়িতে ছাড়িতে বলিল, “ভূতের গল্প তোমরা অনেকেই শুনেছ, কিন্তু ভূতের মুখে ভূতের গল্প কেউ শুনেছ কি?”
অমূল্য এক কোণে বসিয়া একখানি সচিত্র বিলাতি মাসিকপত্রের পাতা উল্টাইতেছিল। বলিল, “অসম্ভব একটা কিছু বরদার বলাই চাই।”
বরদা বলিল, “আপাতদৃষ্টিতে ঘটনাটা অসম্ভব বলে মনে হতে পারে বটে, কিন্তু বাস্তবিক তা নয়। তবে বলি শোন—”
অমূল্য তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, “না, না, আজ যে আমাদের সাহিত্য-সভার অধিবেশন। অতুল, তোমার ‘সাহিত্যে বস্তুতন্ত্র’ প্রবন্ধটা তাহলে—”
হৃষী বলিল, “কাল হবে। বস্তুতন্ত্রের চেয়ে বড় জিনিস আজ এসে পড়েছেন। বরদা, তোমার গল্প আরম্ভ হোক।”
অমূল্য অস্থির হইয়া বলিল, “আজ তাহলে বরদার কতকগুলো মিথ্যে কথা শুনেই সন্ধ্যেবেলাটা কাটাতে হবে?”
প্রশান্তকণ্ঠে বরদা বলিল, “কথাটা শুনে তারপর সত্যি-মিথ্যে বিচার করা উচিত। তাহলে আরম্ভ করি। গত বৎসর—”
অমূল্যর নাসারন্ধ্র হইতে একটা সশব্দ দীর্ঘশ্বাস বাহির হইল।
বরদা বলিল, “গত বৎসর আমার প্ল্যাঞ্চেটে ভূত নামাবার শখ হয়েছিল, বোধ হয় তোমাদের মনে আছে। যারা জানে-শোনে, তাদের পক্ষে ভূত-নামানো অতি সহজ ব্যাপার। দরকারী আসবাবের মধ্যে কেবল একটি তেপায়া টেবিল।”
অমূল্য বিড় বিড় করিয়া বলিল, “আর একটি গুলিখোর।”
বরদা ওদিকে কর্ণপাত না করিয়া বলিতে লাগিল, “একদিন একটা ছোট দেখে তেপায়া টেবিল যোগাড় করে সন্ধ্যের পর আমাদের তেতলার সেই নিরিবিলি ঘরটায় বসে গেলুম—আমি, আমার বউ, আর পেঁচো—”
অমূল্য বলিল, “এই বয়স থেকেই ছোট ভাইটির মাথা খাওয়া হচ্ছে কেন? বউয়ের কথা না হয় ছেড়ে দিই, কারণ যেদিন তোমার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সেদিনই তার যা হবার হয়ে গেছে—”
বরদা বলিল, “পেঁচোকে নেবার কারণ, তিনজনের কমে চক্র হয় না। তাছাড়া সে ছেলেমানুষ, সুতরাং মিডিয়ম হবার উপযুক্ত। সে যাক, মেঝের উপর টেবিল ঘিরে তো বসা গেল—কিন্তু ভাবনা হল কাকে ডাকি! ভূত তো আর একটি-আধটি নয়, পৃথিবীর আরম্ভ থেকে আজ পর্যন্ত যত লোকের ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটেছে সকলের দাবি সমান। এখন কাকে ফেলে কাকে ডাকি?”
কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বরদা বলিল, “আমাদের সুভাষকে চেনো তো—জুনিয়র উকিল? তার ভগ্নীপতি সুরেশবাবু হাওয়া বদলাতে এসে গত শীতকালে নিউমোনিয়ায় মারা যান, বোধ হয় তোমাদের স্মরণ আছে। …অমূল্য, তুমি তো পোড়াতে গিছলে? হঠাৎ সেই সুরেশবাবুকে মনে পড়ে গেল। তখন তিনজনে আলোটা কমিয়ে দিয়ে টেবিলের উপর আঙুলে আঙুল ঠেকিয়ে সুরেশবাবুর ধ্যান শুরু করে দিলুম। বেশীক্ষণ নয় ভাই, মিনিট পাঁচেক চোখ বুজে থাকবার পর চোখ চেয়ে দেখি পেঁচোটা কেমন যেন জবুথবু হয়ে গেছে,—কশ বেয়ে নাল গড়াচ্ছে, চোখ শিবনেত্র, বিজ বিজ করে কি বকছে! ‘কি রে?’—বলে তাকে একটা ঠেলা দিলুম—কাৎ হয়ে পড়ে গেল। বউ তো ‘বাবা গো!’ বলে আমাকে খুব ঠেসে জড়িয়ে ধরলে।”
হৃষী বলিল, “বস্তুতন্ত্র এসে পড়ছে। এবার আসল গল্পটা আরম্ভ হোক।”
বরদা বলিল, “বুঝলুম ভূতের আবির্ভাব হয়েছে। পেঁচোকে অনেক প্রশ্ন করলুম, কিন্তু সে জড়িয়ে জড়িয়ে কি যে উত্তর দিলে বোঝা গেল না। বড়ই মুশকিল। তখন আমার মাথায় এক বুদ্ধি গজাল। কাগজ-পেনসিল এনে পেঁচের হাতে ধরিয়ে দিলুম। পেনসিল হাতে পেয়ে পেঁচো সটান উঠে বসল। উঠে বসে লিখতে আরম্ভ করে দিলে। সে এক আশ্চর্য ব্যাপার! পেঁচোর চোখ বন্ধ, মুখ দিয়ে লাল গড়াচ্ছে, আর প্রাণপণে কাগজের ওপর লিখে যাচ্ছে।”
পকেট থেকে একতাড়া কাগজ বাহির করিয়া বরদা বলিল, “আবার হাতের লেখা দেখে অবাক হয়ে যাবে, দস্তুরমত পাকা হাতের লেখা। কে বলবে যে পেঁচো লিখেছে?”
অমূল্য লেখাটা তদারক করিয়া বলিল, “পেঁচো লিখেছে কেউ বলবে না বটে, কিন্তু তোমার লেখা বলে অনেকেরই সন্দেহ হতে পারে।”
বরদা বলিল, “এই লেখা হাতে পাবার পর আমি সুভাষের বাড়ি গিয়েছিলুম। সুরেশবাবুর পুরনো একখানা চিঠির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলুম,—অবিকল তাঁর হাতের লেখা। বিশ্বাস না হয় তোমরা যাচিয়ে দেখতে পারো।”
অমূল্য বলিল, “অবশ্য দেখব।”
হৃষী বলিল, “সে যাক্। এখন তুমি কি বলতে চাও, ঐ কাগজের তাড়াটা সুরেশবাবুর প্রেতাত্মার জবানবন্দি?”
বরদা বলিল, “এটা হচ্ছে তাঁর মৃত্যুর ইতিহাস। পুরোপুরি সত্যি কি না সে কথা কেউ বলতে পারে না, কিন্তু গোড়ার খানিকটা যে সত্যি তা সুভাষ সেদিন স্বীকার করেছিল।”
“এইবার তবে আসল গল্পটা শোন”—এই বলিয়া বরদা কাগজের তাড়াটা তুলিয়া লইয়া পড়িতে আরম্ভ করিল।—
যাঁহারা মুঙ্গের শহরের সহিত পরিচিত তাঁহারা জানেন যে, উক্ত শহরে পিপর-পাঁতি নামক যে বিখ্যাত বীথিপথ আছে, তাহার পশ্চিম প্রান্তে গঙ্গার কূলে মুসলমানদের একটি অতি প্রাচীন গোরস্থান আছে। বোধ করি এই গোরস্থানের সব গোরগুলিই শতাধিক বর্ষের পুরাতন। স্থানটি অনাদৃত। কাঁটাগাছ ও জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে অস্থিপঞ্জর প্রকট করিয়া এই কবরগুলি কোনও রকমে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখিয়াছে।
এই গোরস্থানের এক কোণে একটি কষ্টিপাথরের গোর আছে। এই গোরটি সম্বন্ধে শহরে অনেক ভূতুড়ে গল্প প্রচলিত ছিল। এই সব আজগুবি গল্প শুনিয়া আমি কৌতূহলী হইয়া উঠিয়াছিলাম। আমার জ্যেষ্ঠ শ্যালক বলিলেন যে, গোরটা সজীব। পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে নাকি এক সাহেব ঐ গোর লক্ষ্য করিয়া গুলি ছুঁড়িয়াছিল। গুলির আঘাতে পাথর ফাটিয়া ঝলকে ঝলকে রক্ত উঠিয়াছিল। সে রক্তের দাগ এখনও মিলায় নাই, গোরের গায়ে তেমনি শুকাইয়া গড়াইয়া আছে। আর, যে নাস্তিক সাহেব গুলি করিয়াছিল সেও প্রাণে বাঁচে নাই, সেই রাত্রেই ভয়ংকরভাবে তার মৃত্যু হইয়াছিল।
একদিন শীতের সন্ধ্যায় শ্যালককে সঙ্গে লইয়া গোরটি দেখিতে গেলাম। শ্যালক আমারই সমবয়সী, প্রেতযোনিতে অটল বিশ্বাস। আমি কিছুদিন যাবৎ মুঙ্গেরে আসিয়া শ্যালক মন্দিরেই বায়ুপরিবর্তন করিতেছিলাম। সঙ্গে স্ত্রী ছিলেন।
গোরস্থানের নিকটে গিয়া দেখিলাম স্থানটি কাঁটাগাছের বর্মে প্রায় দুর্ভেদ্য হইয়া আছে। অনেক যত্নে অনেক সাবধানে পা ফেলিয়া এবং কাপড়-চোপড় বাঁচাইয়া সেই ভূতুড়ে গোরটির সম্মুখীন হইলাম। কালো পাথরের গোর, আপাতদৃষ্টিতে ভৌতিকত্ব কিছুই চোখে পড়িল না।
হঠাৎ, যখন আমরা গোরটির একেবারে নিকটে আসিয়া পৌঁছিয়াছি, তখন সেই শলো পাথরের উপর শায়িত আরও কালো একটা জন্তু বোধ হয় আমাদের পদশব্দে জাগিয়া উঠিয়া, একবার আমাদের মুখের উপর তাহার চক্ষু দুটা মেলিয়া ধরিয়া, আস্তে আস্তে গোরের অন্তরালে মিলাইয়া গেল।
দেখিলাম একটা কুকুর। রং কুচকুচে কালো, শরীর যে হিসাবে লম্বা সে হিসাবে উঁচু নয়—পা-গুলা বাঁকা বাঁকা এবং অত্যন্ত খর্ব। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ তাহার চক্ষু দুটা—হল্দে রঙের সহিত ঈষৎ রক্তাভ এবং মণিহীন। পলক ফেলিলে মনে হয় যেন অন্ধকার রাত্রে খদ্যোত জ্বলিতেছে।
শ্যালক বলিলেন, “লোকে বলে ওই কুকুরটাই সাহেবের টুঁটি ছিঁড়ে মেরে ফেলেছিল।”
আমি বলিলাম, “পঞ্চাশ বছর আগে? কিন্তু কুকুরটাকে তো অত প্রাচীন বলে বোধ হল না।”
আমরা কবরটার একেবারে পাশে গিয়া দাঁড়াইলাম। দেখিলাম কুকুরটা যে-স্থানে শুইয়াছিল ঠিক সেই স্থানে পাথরের খানিকটা চটা উঠিয়া গিয়াছে এবং তাহারই চারি পাশে লাল রঙের একটা পদার্থ শুকাইয়া আছে—হঠাৎ রক্ত বলিয়া ভ্রম হয়। যেন ঐ কুকুরটা সমাধির রক্তাক্ত ক্ষতটাকে বুক দিয়া আগলাইয়া থাকে।
শ্যালক জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি রকম বোধ হচ্ছে?”
আমি বলিলাম, “আশ্চর্য বটে। আমার মনে হয় খুব গরম একটা ধাতু দিয়ে এই পাথরে আঘাত করা হয়েছিল, তাতেই এই রকম হয়েছে।”
আমার মন্তব্য শুনিয়া শ্যালক আধ্যাত্মিকভাবে একটু হাসিলেন। বলিলেন, “তা হবে।” কিন্তু তাহা যে একেবারেই হইতে পারে না তাহা তাঁহার কণ্ঠস্বরের ভঙ্গিতে বেশ বুঝা গেল।
কোনও একটা তর্কাধীন বিষয়ের আলোচনায় মানুষ যখন উচ্চ অঙ্গের হাসি হাসিয়া এমন ভাব দেখায় যেন অপর পক্ষের সঙ্গে তর্ক করাটাই ছেলেমানুষী, তখন অপর পক্ষের মনে রাগ হওয়া স্বাভাবিক। আমারও একটু রাগ হইল। কিন্তু যে-লোক তর্ক করিতে অসম্মত, তাহাকে প্রত্যক্ষ প্রমাণ দ্বারা বুঝাইয়া দেওয়া ছাড়া অন্য পথ নাই। তাই আমি বলিলাম, “আচ্ছা, এক কাজ করা যাক, আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। এই পাথরটা ভেঙেই দেখা যাক না, ঝলকে ঝলকে রক্ত বেরোয় কি না। প্রত্যক্ষের বড় তো আর প্রমাণ নেই—”
নিকটেই একখণ্ড পাথর পড়িয়া ছিল, আমি সেটা তুলিয়া লইয়া গোরে আঘাত করিতে উদ্যত হইয়াছি, এমন সময় সেই কুকুরটা কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া একটা বিশ্রী রকমের চিৎকার করিয়া উঠিল এবং সমস্ত দাঁত বাহির করিয়া অত্যন্ত হিংস্রভাবে আমাকে শাসাইয়া দিল।
শ্যালক আমার হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে বলিলেন, “চলে এসো, চলে এসো, কি যে তোমার পাগলামি—”
কুকুরটার আকস্মিক আবির্ভাবে আমার শ্যালক মহাশয় যতটা অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিলেন, বাস্তবিকপক্ষে আমি ততটা হই নাই। অথচ একটা হিংস্র কুকুরকে অযথা ঘাঁটানো বিশেষ যুক্তির কাজ নয়। তাই পরীক্ষা-কার্য অসম্পূর্ণ রাখিয়া আমরা যখন গৃহে ফিরিয়া আসিলাম তখন তুমুল তর্ক বাধিয়া গিয়াছে; কুকুরের জীবনের স্বাভাবিক দৈর্ঘ্য সম্বন্ধে বিজ্ঞানের শাণিত যুক্তিগুলি শ্যালকের কুসংস্কারের বর্মের উপর আছড়াইয়া পড়িয়া ভগ্নোদ্যমে ফিরিয়া আসিতেছে।
বাড়ি ফিরিতেই আমার শালাজ এবং যাঁহার সম্পর্কে শালার সহিত সম্বন্ধ তিনি আসিয়া যুদ্ধে যোগ দিলেন। দু’জনেই নবীনা, বিদুষী—প্রতীচ্যের আলোক তাঁহাদের চোখে সোনার কাঠি স্পর্শ করাইয়াছে—তাঁহারা আসিয়াই আমার পক্ষে যোগদান করিলেন। শ্যালক বেচারীর বর্ম তীক্ষ্ণ অস্ত্রাঘাতে একেবারে ক্ষতবিক্ষত হইয়া উঠিল।
তর্কে যে ব্যক্তি হারে তাহার জিদ বাড়িয়া যায়। যুক্তির দিকে তখন আর তাহার ভ্রূক্ষেপ থাকে না। শ্যালক শেষে চটিয়া উঠিয়া বলিলেন, “মানতে না চাও, মেনো না; কিন্তু দুপুর রাত্রে একলা ঐ জায়গায় যেতে পারে এমন লোক তো কোথাও দেখি না।”
শালাজ উৎসাহদীপ্ত চক্ষে কহিলেন, “আচ্ছা, এমন লোক যদি পাওয়া যায় যে যেতে পারে, তাহলে তো মানবে যে, তোমার ভূত শুধু তোমার ঘাড়েই ভর করে আছে—আর কোথাও তার অস্তিত্ব নেই?”
শ্যালক গাম্ভীর্য অবলম্বন করিয়া কহিলেন, “একলা রাত্রে সেখানে যেতে পারে এত সাহস কারুর নেই; আর যদি বা কেউ যায়, সে যে ফিরে আসবে এমন কোনও সম্ভাবনা দেখি না।”
আমি বলিলাম, “সকলের সাহস এবং সম্ভাবনা সমান নয়। আমি যেতে প্রস্তুত আছি।”
শ্যালক অতি বিস্ময়ে কিছুক্ষণ নির্বাক থাকিয়া বলিলেন, “তুমি—প্রস্তুত আছ? রাত বারোটার সময় একলা—”
তাঁহার মুখে আর কথা সরিল না।
আমি হাসিয়া বলিলাম, “নিশ্চয়। খোট্টার দেশে বেশী দিন থাকিনি বলেই বোধ হয় আমার সে সাহসটুকু আছে। তাহলে আজই ভাল। আজ বোধ হয় অমাবস্যা। শাস্ত্র অনুসারে রাজ্যের ভূতপ্রেত দৈত্যদানা আজ সবাই এই মর্ত্যভূমিতে ফিরে এসে দিগ্বিদিকে নৃত্য করে বেড়াবেন। অতএব এ সুযোগ ছাড়া অনুচিত।”
শ্যালক ভীত চক্ষে চাহিয়া বলিলেন, “গোঁয়ার্তুমি করো না সুরেশ, ভারি খারাপ জায়গা। এ সব বিষয়ে তোমার অভিজ্ঞতা নেই—”
তীব্র হাস্যোচ্ছসিত কণ্ঠে শালাজের নিকট হইতে প্রতিবাদ আসিল, “ভয় পাবেন না সুরেশবাবু, আপনার জন্যে একটা খুব ভাল প্রাইজ ঠিক করে রাখলুম। আপনি জয় করে ফিরে এলেই এ-বাড়ির কোনও এক মহিলা তাঁর বিম্বাধরের রক্তিমরাগে আপনার কপালে ললাটিকা পরিয়ে দেবেন। ভূতজয়ী বীরের সেই হবে রাজটিকা।”
আমি উৎসাহ দেখাইয়া বলিলাম, “লোভ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। মহিলাটি কে শুনি?”
তিনি হাসিয়া বলিলেন, “তাঁর সঙ্গে কারুর তুলনাই হয় না।”—বলিয়া আমার গৃহিণীর দিকে কটাক্ষপাত করিলেন।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলাম, “ঐ জাতীয় প্রাইজ যদিও আমার ভাগ্যে খুব দুর্লভ নয় (গৃহিণী জনান্তিকে,—‘আঃ—কি বকছ—দাদা রয়েছেন!’), তবু অধিকের প্রতি আমার বিরাগ নেই। তাহলে চুক্তি পাকা হয়ে গেল—আজ রাত্রেই যাব। কিন্তু আমি যে সত্যি সত্যিই কবরের কাছে গিয়েছি, এদিক-ওদিক ঘুরে ফিরে আসিনি, এ কথা শেষকালে আপনাদের বিশ্বাস হবে তো?”
শালাজ অতি দূরদর্শিনী, বলিলেন, “আপনার মুখের কথা আমরা বিশ্বাস করব নিশ্চয়, কিন্তু যাঁকে বিশ্বাস করানো দরকার তিনিই হয়তো করবেন না। অতএব আপনাকে একটি কাজ করতে হবে। খড়ি দিয়ে গোরের ওপর নিজের নাম লিখে আসতে হবে।”
“তথাস্তু!” গৃহিণীর দিকে ফিরিয়া বলিলাম, “তোমার দাদার প্রেততত্ত্বের মাথায় বজ্রাঘাত করে দিয়ে আসা যাক—কি বলো?”
অল্প দ্বিধাজড়িত হাসি ভিন্ন আর কোনও জবাব পাওয়া গেল না।
শ্যালক বলিলেন, “ফাজলামি ছাড়ো। আমি তোমাকে কিছুতেই যেতে দিতে পারি না।”
শ্যালকের কথা শুনিলাম না। কারণ অনেক ক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়া যত সহজ, পশ্চাৎপদ হওয়া তত সহজ নয়।
রাত্রি সাড়ে এগারোটার সময় গরম জামায় আপাদমস্তক আবৃত করিয়া একটা কড়া গোছের বর্মা চুরুট ধরাইয়া বাহির হইলাম। এতক্ষণে গৃহিণীর মুখ ফুটিল। প্রতীচ্য বিদ্যায় জলাঞ্জলি দিয়া বলিলেন, “থাক্, গিয়ে কাজ নেই।”
আমি হাসিয়া উঠিলাম, “পাগল! ভাই-বোন দু’জনকার ধাত একই রকম দেখছি।”
শ্যালক নিরতিশয় ক্ষুব্ধস্বরে কহিলেন, “তুমি এমন একগুঁয়ে জানলে কোন্ শালা তর্ক করত!”
এমন বিশ্রী অন্ধকার বোধ করি আর কখনও ভোগ করি নাই। একটা গুরুভার পদার্থের মতো অন্ধকার যেন চারিদিকে চাপিয়া বসিয়া আছে। পথ চলিতে চলিতে পদে পদে মনে হয় বুঝি পরমুহূর্তেই এক চাপ অন্ধকারে ঠোকর লাগিয়া হুমড়ি খাইয়া পড়িয়া যাইব।
চুরুটে লম্বা টান মারিয়া মনে প্রফুল্লতা ও উৎসাহ সঞ্চয় করিতে লাগিলাম। সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলি অজ্ঞাতসারে এমন সতর্ক ও সন্দিগ্ধ হইয়া উঠিল যে, নিজের পদধ্বনি শুনিয়া নিজেই চমকিয়া উঠিলাম, মনে হইল কে যেন চুপি চুপি পিছন হইতে আমার অত্যন্ত কাছে আসিয়া পড়িয়াছে।
কিন্তু তথাপি অকারণে ভয় পাইবার পাত্র আমি নই। মনে মনে বেশ বুঝিতে পারিলাম, দ্বিপ্রহর রাত্রির এই অন্ধকার, এই স্তব্ধতা, এই বিজনতা সকলে মিলিয়া আমার আন্তরিক সাহসকে দুশ্ছেদ্য একটা ষড়যন্ত্রের জালে ধীরে ধীরে জড়াইয়া ফেলিবার চেষ্টা করিতেছে। একটা অলৌকিক মায়া যেন আমার চেতনাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিতেছে। মাকড়সা যেমন শিকারকে প্রথমে সুক্ষ্ম তন্তুর সহস্র পাকে জড়াইয়া পরে ধীরে ধীরে জীর্ণ করিয়া ফেলে, তেমনি এই অদৃশ্য শক্তি আমার সহজ সত্তাকে ক্রমে ক্রমে অভিভূত করিয়া ফেলিতেছে।
ক্রমে পিপর-পাঁতি রাস্তার পূর্বপ্রান্তে আসিয়া পড়িলাম। ইহারই অপর প্রান্তে কবরস্থান। রাস্তার দুই পাশে বড় বড় গাছ, মাথার উপর বহু ঊর্ধ্বে তাহাদের শাখা-প্রশাখা মিলিয়াছে। অন্ধকার আরও জমাট বাঁধিয়া আসিল।
হঠাৎ ঘাড়ের কাছে ঠাণ্ডা নিঃশ্বাসের মতো একটা স্পর্শ পাইলাম। শরীরের সমস্ত রোম শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া উঠিল। পরক্ষণেই একটা খুব লঘু পদার্থ পিঠের উপর দিয়া খড়্ খড়্ শব্দে নীচে গড়াইয়া পড়িল। বুঝিলাম, ভয় পাইবার মতো কিছু নয়, মাথার উপর যে-ঘনপল্লব শাখাগুলি আলিঙ্গনকে নিবিড় বিচ্ছেদবিহীন করিয়া রাখিয়াছে, তাহারই একটি শুষ্ক পাতা ঝরিয়া পড়িয়াছে। আরামের নিঃশ্বাস ফেলিয়া চলিতে লাগিলাম।
লম্বা টানের চোটে চুরুটটা প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছিল। অন্য সময়ে হইলে ফেলিয়া দিতাম, কিন্তু আজ সেটাকে কিছুতেই ছাড়িতে পারিলাম না। তাহার অগ্নিদীপ্ত প্রান্তটুকুতে যেন একটু প্রাণের সংস্রব ছিল। এই নিঃসঙ্গ অন্ধকারের মধ্যে আমার সমস্ত অন্তরাত্মা যখন সঙ্গীর জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিতেছিল, তখন ওই ক্ষীণ রশ্মিটুকুই জীবন্ত সঙ্গীর মতো প্রাণের মধ্যে ভরসা জাগাইয়া রাখিয়াছিল। ওটাকে ফেলিয়া দিলে যে অনেকখানি সাহসও চলিয়া যাইবে তাহা বেশ বুঝিতেছিলাম।
কিন্তু ক্রমে যখন আঙুল পুড়িতে লাগিল তখন সেটাকে ফেলিয়া দিতেই হইল। একবার বেশ ভাল করিয়া টানিয়া লইয়া সম্মুখের দিকে কিছু দূরে ফেলিয়া দিলাম।
ফেলিয়া দিবা মাত্র মনে হইল, যে-আঙুল দুটা দিয়া চুরুট ধরিয়াছিলাম তাহাদের মধ্যে কোনও ছিদ্র পাইয়া খানিকটা ঠাণ্ডা বাতাস শরীরের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। আমার দৃষ্টি ছিল নিক্ষিপ্ত চুরুটটার উপর—সেটা মাটিতে পড়িবামাত্র আগুন ছিটকাইয়া উঠিল। তারপর এক আশ্চর্য ব্যাপার ঘটিল। ছিটকানো আগুনটা মধ্যপথে দুটা আকৃতি ধরিয়া পাশাপাশি একসঙ্গে নড়িতে আরম্ভ করিল। মাটি হইতে প্রায় এক হাত উপরে থাকিয়া পরস্পরের চারি আঙুল ব্যবধানে এই ক্ষুদ্র অগ্নিগোলক দুটা একজোড়া লাল জোনাকির মতো সম্মুখ দিকে চলিতে আরম্ভ করিল এবং মাঝে মাঝে মিট্মিট্ করিতে লাগিল।
আমার মাথা বোধ হয় গরম হইয়া উঠিয়াছিল। কি জানি কেন, আমার ধারণা জন্মিল যে, ওই মিট্মিট্ করা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দুটা আর কিছুই নয়, দুটা চক্ষু আমার পানে তাকাইয়া আছে; এবং এই চক্ষু দুটার পশ্চাতে একটা খর্বাকৃতি কুকুরের কালো রং যে অন্ধকারে মিশাইয়া আছে তাহা যেন মনে স্পষ্ট অনুভব করিলাম।
চলিতে চলিতে কখন দাঁড়াইয়া পড়িয়াছিলাম লক্ষ্য করি নাই, চক্ষু দুটাও সম্মুখে কিছু দূরে দাঁড়াইল। তারপর কতক্ষণ যে নিষ্পলকভাবে আমার মুখের দিকে দৃষ্টি ব্যাদান করিয়া রহিল জানি না, মনে হইল বহুক্ষণ পরে সেই চক্ষুর পলক পড়িল। তখন সেটা আবার চলিতে আরম্ভ করিল। আমিও পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলাম। দেহের উপর তখন কোনও অধিকারই নাই। স্বপ্নে বিভীষিকার সম্মুখ হইতে পলাইবার ক্ষমতা যেমন লুপ্ত হইয়া যায়, আমিও তেমনি নিতান্ত নিরুপায়ভাবে ওই চক্ষুর পশ্চাদ্বর্তী হইলাম। স্বাধীন ইচ্ছা তখন একেবারে জড়ত্বপ্রাপ্ত হইয়াছে, আছে কেবল সমস্ত চেতনাব্যাপী দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য ভয়।
কতক্ষণ এই অগ্নিচক্ষুম্মান আমাকে তাহার আকর্ষণ প্রভাবে টানিয়া লইয়া গিয়াছিল আমার ধারণা নাই। একবার চেতনার অন্তরতম প্রদেশে যেন ক্ষীণ অনুভূতির ছায়া পড়িয়াছিল যে, পাকা রাজপথ দিয়া চলিতেছি না; আর একবার মনে হইয়াছিল বুঝি একটা গাছের মোটা শিকড়ে ঠোক্কর খাইলাম; কিন্তু সে-সব আমার ইন্দ্রিয়-উপলব্ধির বাহিরে।
হঠাৎ একটা বড় রকমের ঠোক্কর খাইলাম। এটা বেশ স্মরণ আছে। তারপর হুমড়ি খাইয়া পড়িয়াই নীচের দিকে গড়াইতে শুরু করিলাম। কোথায় পড়িতেছি কোনও ধারণাই ছিল না; অন্ধকারে দেখাও অসম্ভব; কিন্তু এই পতন যে অনন্তকাল ধরিয়া চলিতে থাকিবে এবং পতনের লক্ষ্যও যে একটা অতলস্পর্শ স্থানে লুকাইয়া আছে তাহা মনের মধ্যে বদ্ধমূল হইয়া গেল। অথচ কি নিদারুণ সেই পতন! গড়াইতে গড়াইতে এক ধাপ হইতে অন্য ধাপে পড়িতেছিলাম এবং প্রত্যেক স্তরে অবরোহণের সঙ্গে সঙ্গে দেহের অস্থিগুলা যেন একবার করিয়া ভাঙিয়া যাইতেছিল।
এই অবরোহণের শেষ ধাপে যখন আসিয়া পৌঁছিলাম তখন জ্ঞান বিশেষ ছিল না, কিন্তু একটা অনন্ত যন্ত্রণার পথ যে অতিক্রম করিয়া আসিয়াছি তাহা সমস্ত শরীর দিয়া অনুভব করিতে লাগিলাম।
অনেকক্ষণ পরে চক্ষু মেলিলাম। সেই দেহহীন লাল চক্ষু দুটা আমার মুখের অত্যন্ত নিকটেই ঝুঁকিয়া পড়িয়া কি যেন নিরীক্ষণ করিতেছে। দেহের রক্ত তো জল হইয়া গিয়াছিলই, এবার তাহা একেবারে বরফ হইয়া গেল। একটা অসহ্য শীতের শিহরণ সমস্ত দেহটাকে যেন ঝাঁকানি দিয়া গেল। তারপর আর কিছু মনে নাই।
সূর্যোদয়ের কিছু পূর্বে জ্ঞান হইল। কল্যকার রাত্রি যে স্বাভাবিকভাবে কাটে নাই এই চিন্তা লইয়া চক্ষু মেলিলাম। ঘাসের উপর শুইয়া আছি দেখিয়া তাড়াতাড়ি উঠিতে গেলাম—উঃ! গায়ে দারুণ বেদনা। আবার শুইয়া পড়িলাম। তখন ক্রমশ সব মনে পড়িল। ঘাড় না নাড়িয়া যতদূর সাধ্য দেখিয়া বুঝিলাম, পিপর-পাঁতি রাস্তার পাশে পাশে কেল্লার যে শুষ্ক গড়খাই গিয়াছে তাহারই তলদেশে বাবলা গাছের ঝোপের মধ্যে পড়িয়া আছি।
সূর্য উঠিল। এখানে সমস্ত দিন পড়িয়া থাকিলেও কেহ সন্ধান পাইবে না ইহা স্থির। শরীরে তো নড়িবার শক্তি নাই। প্রচণ্ড এক হেঁচকা মারিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম; চক্ষু হইতে আরম্ভ করিয়া দেহের সমস্ত রোম বেদনায় টন্টন্ করিয়া উঠিল। কিন্তু বাড়ি গিয়া পৌঁছিতেই হইবে। অসীম বলে মৃতপ্রায় দেহটাকে টানিতে টানিতে কি করিয়া বাড়িতে পৌঁছিলাম তাহা প্রকাশ করিবার আমার সাধ্য নাই। বাড়ি যাইতেই সকলে চারিদিক হইতে ছুটিয়া আসিল এবং উৎকণ্ঠিত প্রশ্নে আমার ক্ষীণ চেতনা আবার লুপ্ত করিয়া দিবার যোগাড় করিল। শ্যালক সকলকে সরাইয়া দিয়া আমাকে একটা ইজি-চেয়ারে বসাইয়া ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সারা রাত কোথায় ছিলে? আমরা সকলে তোমার জন্যে—”
উত্তর দিতে গেলাম, কিন্তু কি ভয়ানক! গলার স্বর একেবারে বন্ধ হইয়া গিয়াছে। প্রাণপণে চেষ্টা করিয়া একটা কথাও উচ্চারণ করিতে পারিলাম না। শ্যালক আমাকে দুধ ও ব্রান্ডি খাওয়াইয়া ডাক্তার ডাকিতে গেলেন।
ডাক্তার যখন আসিলেন, তখন বিছানায় শুইয়া আছি—ভয়ানক কম্প দিয়া জ্বর আসিতেছে। স্ত্রী ও শ্যালক মলিন মুখে মাথার শিয়রে বসিয়া আছেন।
ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, “দুটো লাংসই অ্যাফেক্ট্ করেছে—নিউমোনিয়া।”
তারপর আবার অচেতন হইয়া পড়িলাম।
ঘুম ভাঙিয়া দেখি শরীর বেশ ঝর্ঝরে হইয়া গিয়াছে—কোথাও কোনও গ্লানি নাই।
কে একজন পিছন হইতে জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন বোধ হচ্ছে?”
ফিরিয়া দেখি বিনোদ,—আমার ছেলেবেলার স্কুলের বন্ধু। অনেক দিন পরে তাহাকে দেখিয়া বড় আনন্দ হইল। বলিলাম, “বেশ ভালই বোধ হচ্ছে, ভাই। বুকের ওপর যে একটা ভার চাপানো ছিল সেটা আর টের পাচ্ছি না।”
বিনোদ মৃদু হাসিয়া বলিল, “প্রথমটা ঐ রকম বোধ হয় বটে। আমার যখন কলেরা হয়—”
হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল—তাই তো! বিনোদ তো আজ দশ বৎসর হইল কলেরায় মরিয়াছে; আমি স্বহস্তে তাহাকে দাহ করিয়াছি। তবে সে এখানে আসিল কি করিয়া! মহাবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিলাম, “বিনোদ, তুমি তো বেঁচে নেই—তুমি তো অনেক দিন মারা গেছ!”
বিনোদ আসিয়া আমার দুই হাত ধরিল। কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে বলিল, “তুমিও আর বেঁচে নেই, বন্ধু!”
১৯২৯