রক্তে অমানুষ – অনীশ দেব

রক্তে অমানুষ – অনীশ দেব

১ মে

তন্দ্রাকাকিমা মারা গেলে তাঁর মফঃস্বলের বাড়িটা উত্তরাধিকারসূত্রে আমিই পেলাম। আমিই ছিলাম তাঁর একান্ত আত্মীয়। তাঁর মৃত্যুতে তেমন দুঃখ পাইনি, কারণ তাঁকে আমি প্রায় চিনতামই না। আর বাড়িটা পেয়ে যে আমার খুব একটা আনন্দ হয়েছে, তাও নয়। কারণ বাড়িটা প্রাচীন, কুৎসিত, জীর্ণ এবং অস্বস্তিকর। হয়তো সময়কালে বাড়িটার চেহারা ভালোই ছিল। স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর তন্দ্রাকাকিমা বহু বছর ধরে বাড়িটায় একাই ছিলেন। কোনোওরকম সংস্কারের চেষ্টা করেননি বাড়িটাকে। তাঁর সামান্য পাগলামির লক্ষণ ছিল, হয়তো সেই কারণেই বাড়িটা ছেড়ে কখনও কোথাও যাননি। বাড়ি ও তন্দ্রাকাকিমা একই সঙ্গে কালের প্রকোপে জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হতে শুরু করলেন। কখনও কখনও তাঁকে দেখা যেত বাইরের উঠোনে ইজিচেয়ারে বসে আছেন, হাসছেন আপনমনে, অথবা শোনা যেত তাঁর একটানা করুণ বিলাপ। সে—বিলাপের সুর অদ্ভুত—তার কোনোও তুলনা নেই। তিনি সত্যিই পাগল ছিলেন কিনা কেউ জানত না—জানার চেষ্টাও করত না। তাঁকে দেখেশুনে শান্ত বলেই মনে হত। আর কেউ তাঁকে বিরক্তও করত না। সুতরাং, অবশেষে, তাঁর বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়া শরীর একদিন নিষ্প্রাণ হল। তিনি মারা গেলেন। আর বাড়িটার মালিক হলাম আমি।

এক মেঘলা বিকেলে বাড়িটায় গেলাম।

বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়ার আগে ওটা আমি ঘুরেফিরে দেখব। বলা যায় না, হয়তো এমন কিছু পেয়ে যাব যা আমি ভালোবেসে রাখতে চাই। কিন্তু না, পছন্দ হওয়ার মতো বা কাছে রাখার মতো কিছুই সেখানে পেলাম না। মিনিট দশেকের মধ্যেই আমার অনুসন্ধানের কাজ সেরে বেরিয়ে পড়ছিলাম, কিন্তু বৃষ্টি নামল অঝোরে। গায়ের হালকা সোয়েটারে শীত বাঁধ মানতে চায় না। তাই বৃষ্টি শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। কিন্তু অঝোর বর্ষণের পাগল করা ছন্দের কোনোও পরিবর্তন নেই। সুতরাং সময় কাটাতে বাড়ির নোংরা স্যাঁতসেঁতে ঘরগুলো ঘুরে দেখতে লাগলাম।

একতলায় কৌতূহল জাগিয়ে তোলার মতো কিছুই পেলাম না। দোতলার দিকে উঠতে যাব, নজরে পড়ল সিঁড়ির পাশেই একটা দরজা। অন্যান্য দরজার তুলনায় বেশ মজবুত—তবে প্রাচীনতার স্বাক্ষর তার প্রতি অঙ্গে। দরজাটা খুলতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ ছিটকে এল নাকে।

ভেতরটা অন্ধকার। তবে স্পষ্ট নজরে পড়ল, কয়েক ধাপ সিঁড়ি দরজার কাছ থেকে নেমে গেছে নীচে। তাহলে কি নীচে কোনোও পাতালঘর রয়েছে? যেমনটা থাকত আগেকার দিনের জমিদারবাড়িতে? কিছুটা ভয় ও কিছুটা সেই দুর্গন্ধের কারণে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিলাম। নীচের পাতালঘরে আর যাই থাকুক, কোনোও দামি জিনিস নেই।

তারপর দোতলায় উঠে এলাম।

দোতলায় একটিমাত্র ঘরেই কিছু ভাঙাচোরা আসবাবপত্র রয়েছে। অন্যগুলো নিছকই ঘরের কঙ্কাল। বুঝলাম, এই ঘরটাতেই তন্দ্রাকাকিমা থাকতেন। চলে আসছিলাম, কিন্তু কী খেয়াল হল ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারগুলো খুলে দেখলাম। তারই একটা ড্রয়ারে বইটা পেলাম।

সময়ের ভারে বইটা স্যাঁতসেঁতে, জীর্ণ। ওটা খুলতেই আশ্চর্য ব্যাপারটা নজরে পড়ল। বাঁধানো হলেও গোটা বইটা হাতে লেখা। অর্থাৎ একটা পাণ্ডুলিপিকে কেউ বইয়ের মতো করে বাঁধিয়ে নিয়েছে। হয়তো তন্দ্রাকাকিমাই। বইয়ের কোনোও কোনোও পাতা ছিঁড়ে যাওয়ায় সেলোটেপ দিয়ে জোড়া। পাতা ওলটাতেই অদ্ভুত খসখস শব্দে বইটা যেন আর্তনাদ করে উঠল। কিছু কাগজের গুঁড়ো উড়ে পড়ল মেঝেতে। পাতাগুলোয় অসংখ্য ভাঁজ ও নোংরা থাকা সত্ত্বেও লেখা এখনও পড়া যায়। ছোট ছোট পরিষ্কার অক্ষরে কোনোও পুরুষালি হাতে সযত্নে লেখা। জিনিসটা মনে হল, ডায়েরি অথবা দিনলিপি গোছের। প্রথম দু—একটা লাইন পড়লাম।

বইটা আবার ড্রয়ারে রাখতে গিয়ে আরও একটা লাইন চোখে পড়ল। তখন মাঝে মাঝে পাতা উলটে কিছু কিছু জায়গা পড়ে দেখলাম। তারপর বইটা বন্ধ করে নিয়ে এলাম নীচের ঘরে। বাইরের ঘরে জানলার পাশে একটা সাবেকি আমলের চেয়ার নিয়ে বসলাম। আলো অত্যন্ত ঝাপসা, পৃষ্ঠাগুলোও ভঙ্গুর, কিন্তু তবুও সেই বিস্ময়কর দিনলিপি পড়তে শুরু করলাম। একটুও না থেমে, এতটুকু বিশ্রাম না নিয়ে পড়ে চললাম….চেয়ারে আমি যেন অঙ্গাঙ্গিভাবে বসে আছি। আমার শিরদাঁড়া অচল, অনড়। আর আমার মাংস যেন কোনোও ঠান্ডা তরল, শিরদাঁড়াকে ঘিরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে বয়ে চলেছে। আলো ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসে, কিন্তু আমার দু—চোখ বইয়ের পাতায় স্থির। আলো জ্বালতে গিয়ে দেখি লোডশেডিং। অগত্যা খুঁজে পেতে একটা আধজ্বলা মোমবাতি নিয়ে এলাম। পকেট থেকে দেশলাই বের করে সেটা জ্বাললাম। বসিয়ে দিলাম জানলার তাকে। আলোর সমস্যা আংশিক দূর হল। জানলার কাচে বৃষ্টির ছাঁটের অবিরাম বিলাপ, আকাশ মেঘে মেঘে অন্ধকার। বাইরের খোলা উঠোনে এলোমেলো ঝোড়ো বাতাসে ঝরাপাতা উড়ে যায়। এরকম বই পড়ার উপযুক্ত পরিবেশই বটে। বইয়ের শুরু মে মাসের চার তারিখের রোজনামচা দিয়ে….

৪ মে

ওঃ ভগবান! কাল কী ভয়ঙ্করই না একটা রাত গেছে!

এতদিনের মধ্যে গতরাতেই সবচেয়ে খারাপ অবস্থা গেছে। অন্যান্য দিনের কথা স্পষ্ট মনে থাকলে ভালো হত। এখন মনে হচ্ছে, এই ডায়েরি আমার আরও আগে থেকে লেখা উচিত ছিল। কিন্তু নিজের স্বরূপ যে—বইয়ের প্রধান বিষয়, সে—বই লিখতে শুরু করাটা এক প্রচণ্ড দুঃসাহসের কাজ। তাই আরও আগে এ—সাহস হয়নি। সে যাই হোক, গত রাতের মতো খারাপ অবস্থা যে অন্য কোনোও রাতে হয়নি, সে—বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই। হয়তো সেই কারণেই মনে হচ্ছে, আজই এ—ডায়েরি শুরু করা দরকার। আমার মনের বিভিন্ন অনুভূতির বহিঃপ্রকাশের জন্যেও এর প্রয়োজন আছে। এখন শুধু ভাবছি, সামনের মাসে পাতালঘরে নেমে যেতে নিজেকে জোর করে রাজি করাতে পারব তো?

কিন্তু রাজি আমাকে হতেই হবে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই, এবং অরাজি হওয়ার সপক্ষে কোনোরকম যুক্তি—তর্ক খাড়া করতে আমি কখনও চেষ্টাও করব না। কোনোরকম অজুহাত চলবে না। বরং সামনের মাসে আরও আগে আমি পাতালঘরে নেমে যাব। বেশি দেরি করাটা কখনওই ঠিক হবে না। কে জানে কোত্থেকে কী বিপদ ঘটে বসে! হয়তো আমি নিজেকে সামলাতে পারব, কিন্তু তবুও….গত রাতে পাতালঘরে যেতে বোধহয় একটু দেরি করেছি। দেরি করতে চাইনি, কিন্তু কী করে বুঝব? যখন টের পাই যে ওটা হতে চলেছে, তখন আমি ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়ি আর প্রাথমিক লক্ষণগুলো ধরবার চেষ্টা করি। কিন্তু সবসময়ে ঠিক স্পষ্ট করে ধরতে পারি না। অদ্ভুত এক অস্বস্তি—আশঙ্কার মধ্যে পরিবর্তনটা শুরু হয়, এবং যখন আমি বেশ ভয় পেয়ে যাই তখন ভালোমতো বুঝে ওঠার আগেই ওটার সূত্রপাত হয়। আমার ভীষণ ভয় করে। ভবিষ্যতে আমাকে আরও সাবধান হতে হবে।

এখন আমি আমার ঘরে বসে আছি। সমস্ত খুঁটিনাটি মনে করবার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। যদি সঠিক তথ্যই না লিখতে পারি তাহলে এই ডায়েরির প্রয়োজন কী হয়? তখন আমার বা অন্য কারও কাছে এর কোনো দামই থাকবে না। জানি না, অন্য কাউকে কখনও এটা দেখাব কিনা। বর্তমান পরিস্থিতিতে সে—সিদ্ধান্ত নেওয়া রীতিমতো বিপজ্জনক। কারণ, যদি কাউকে এটা দেখাই, তাহলে সেইসঙ্গে আমাকে যথাযথ প্রমাণও হাজির করতে হবে। সেটাই তো আমার সমস্ত আশঙ্কার কারণ। আমি চাই না, কেউ আমাকে পাগল ভাবুক।

গতরাতে খাওয়াদাওয়ার পর আমার স্ত্রী একটু অস্থির হয়ে পড়ে। আমরা বাইরের ঘরে বসে ছিলাম। ও মাঝে মাঝে টেবিল—ঘড়ির দিকে দেখছিল, আর আড়চোখে আমাকে লক্ষ করছিল। মাথা না ঘুরিয়ে চোখের কোণ দিয়ে ওর এই লক্ষ করাটা আমার মোটেও ভালো লাগেনি। অবশ্য ওকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, আর আমিও সেটা না দেখার ভান করে বসে রইলাম। পাতালঘরে যাওয়ার কথা শুনলেই আমার ভীষণ ভয় করে। সেইজন্যেই যতক্ষণ পারি ওটাকে ভুলে থাকতে চাই। রাত তখনও খুব বেশি হয়নি। কিন্তু বাইরের আকাশ স্পষ্ট নক্ষত্রময়। জানলার পাশেই আমি বসে ছিলাম, যাতে সময় হলেই বুঝতে পারি। খবরের কাগজে মগ্ন থাকার ভান করে বসে থাকলেও আমার মন অত্যন্ত অস্থির। অস্থির মন নিয়ে পড়া যায় না। খবরের কাগজের সমস্ত খবর আমার কাছে এক ঝাপসা আস্তরণ। না, এটা সেই প্রতীক্ষিত লক্ষণ নয়—অন্তত আমার তাই ধারণা। ঘরের সবকটা আলোই জ্বলছে। সুতরাং সতর্কভাবে তন্দ্রার চোখ এড়িয়ে মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে বাইরে দেখছিলম। ওর দুশ্চিন্তার বোঝা আমি আর বাড়াতে চাই না। বেচারা তন্দ্রা! কিন্তু ওর চোখে ত্রাসের ইশারা আমার শরীরে এক অদ্ভুত আনন্দ জাগিয়ে তুলল। যেন সুখ—ভালোবাসার চরম তৃপ্তির আনন্দ। ঠিক জানি না। হয়তো আমার অসুখের এটাই প্রাথমিক লক্ষণ, অথবা কোনো পুরুষের সুস্থ—স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। বলতে পারছি না, কারণ আমি অন্যান্য মানুষের মতো নই। কিন্তু তবুও সেই অনুভূতি চিনতে পারামাত্রই নিজের ওপরে আমার ঘৃণা হল। সুতরাং বুঝলাম, পরিবর্তনটা তখনও সত্যি—সত্যি শুরু হয়নি।

তখন সবচেয়ে যেটা খারাপ লাগে, তা হল পরিবেশের তফাত। আরামের প্রলেপ মাখানো বাইরের ঘর, উজ্জ্বল আলো, শৌখিন নরম চেয়ার—এর মাঝে আমি বসে আছি, অথচ একই সঙ্গে জানি, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এই পরিবেশের কী অমানুষিক পরিবর্তনই না ঘটে যাবে….মনে পড়লে আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। বেশিরভাগ সময় সাধারণ জীবনযাপন করে এবং কোনো—কোনো সময় সাধারণ জীবনযাপনের ভান করার চেষ্টায় পরিবর্তনটাকে আমার আরও বেশি ঘেন্না করে। নিজের ওপর বিতৃষ্ণা আসে, রাগ হয়—যদিও জানি, এটা একটা রোগ। এতে আমার কোনো দোষ নেই। এর জন্য কাকে দোষ দেব? হয়তো আমার কোনোও পূর্বপুরুষই এই অদ্ভুত রোগের জন্যে দায়ী, জানি না। তবে হলফ করে বলতে পারি, এতে আমার কোনোও হাত নেই। তা যদি থাকত, তাহলে আমি কবে আত্মহত্যা করতাম। তাতে কোনো সন্দেহ নেই….।

দেওয়ালে টাঙানো সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো আয়নার দিকে অবিরাম চোরা—চাউনিতে দেখতে লাগলাম—যদি কোনো পরিবর্তনের লক্ষণ নজরে পড়ে। অবশ্য জানি, এত তাড়াতাড়ি কোনো চিহ্ন নজরে পড়বে না। কিন্তু তাড়াতাড়ি নজরে পড়াই ভালো, নইলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। প্রথমদিকটায় আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারলেও তন্দ্রা সে ভয়াবহ দৃশ্য সইতে পারবে না। আমি নিজে হলেও হয়তো সইতে পারতাম না। যদি সত্যিই চেয়ে থাকি ওই সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো আয়নার দিকে, এবং নিজেকে দেখি, তাহলে….।

এই কারণেই পাতালঘরে কোনোও আয়না নেই।

নটার সময় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বাইরের আকাশ এখন আরও পরিষ্কার, আর নক্ষত্রময়। জানলায় লেসের কাজ করা পরদা—তন্দ্রার হাতের কাজ। ও চকিতে আমার দিকে তাকাল, পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নিল। অতি সন্তর্পণে খবরের কাগজটা ভাঁজ করে চেয়ারে রাখলাম। এই মুহূর্তে আমি অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং শান্ত।

‘সময় হয়ে গেছে—’ আস্তে আস্তে বললাম।

‘হুঁ—’ ছোট্ট করে উত্তর দিল তন্দ্রা, স্বস্তির ভাবটাকে বেশ কষ্ট করেই ও গোপন রাখল।

আমরা বাইরের ঘর ছেড়ে পাতালঘরের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। তন্দ্রাই প্রথম নেমে গেল নীচে। ভিজে স্যাঁতসেঁতে ধাপ সোজা নেমে গেছে। তার ডানদিকে নোনাধরা দেওয়াল, আর বাঁদিকে একটা রেলিং।

আমাদের বাড়িটা পুরোনো। ওপরতলাগুলো জোড়াতালি দিয়ে পরিষ্কার রাখলেও পাতালঘর ও তার সিঁড়ি সেই একই রকম আছে—প্রাচীন ও ছমছমে। যখন সুস্থ থাকি তখন চেষ্টা করেও নীচে যেতে পারি না। বর্তমান পরিস্থিতিতে তার কারণ সহজেই বোঝা যায়। আর, ইচ্ছে করেই পাতালঘর ও তার চারপাশকে এরকম কুৎসিত রাখা হয়েছে—তাই রাখা উচিত। এতে এই পরিবেশের সঙ্গে আমার অদ্ভুত রোগটা তবু খাপ খেয়ে যায়।

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ তার প্রতিধ্বনির সঙ্গে মিশে গিয়ে এক বিচিত্র ফাঁপা শব্দের জন্ম দিল। নীচের বদ্ধ মৃত হাওয়া সিঁড়ি বেয়ে ছুটে এল আমাদের কাছে। হঠাৎ মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল। নোনাধরা দেওয়ালে এক হাত দিয়ে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করলাম। সিঁড়ির ধাপে পা পিছলে গেল। অন্য হাত দিয়ে আচমকা আঁকড়ে ধরলাম সিঁড়ির রেলিং। মোটামুটি সামলে নিলেও আমার পা এক ধাপ ছাড়িয়ে সশব্দে আছড়ে পড়ল পরের ধাপে। শব্দ শুনে আমার স্ত্রী ঘুরে তাকাল। ওর মুখের অভিব্যক্তি এককথায় অপার্থিব। দু—চোখ সাদা এবং বিস্ফারিত। মুখ হাঁ করা। এক সুদীর্ঘ মুহূর্ত ওর অভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন হল না। কারও মুখে এর চেয়ে বেশি আতঙ্ক ও ত্রাসের উলঙ্গ ছাপ আমি কখনও দেখিনি। অন্তত অকারণে তো নয়ই। আর ওর ভয় পাওয়ারও কোনো কারণ নেই। ওর অন্তত জানা উচিত যে, আমি কখনও ওর কোনোও ক্ষতি করব না। তবুও, ভয় পাওয়ার জন্যে ওকে আমি দোষ দিই না। কিন্তু ওই আতঙ্কের ছাপ আমাকে কষ্ট দিল। যাকে আমি ভালোবাসি সেও যে আমাকে দেখে এতখানি ভয় পেতে পারে সে—কথা ভেবে নিজের ওপরেই ঘৃণা হল। আর ততক্ষণে সেই অভিব্যক্তি মিলিয়ে গিয়ে তন্দ্রা হাসল : ঠোঁট কামড়ানো ছোট্ট হাসি। হয়তো মনের ভয়কে মুখে প্রকাশ করায় ও লজ্জা পেল। আমিও হাসলাম। এবং তখনই বুঝলাম, আজ অনেক দেরি করে ফেলেছি। আমার মুখ শক্ত হয়ে উঠেছে, আর দাঁতগুলো যে অস্বাভাবিক বড় হয়ে গেছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। জানি, নিজেকে সামলে রাখার ক্ষমতা ক্রমশ আমি হারিয়ে ফেলছি।

সিঁড়ির শেষেই কোণ ঘেঁষে সেই পাতালঘর। ওকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম। নিজেই খুললাম পাতালঘরের দরজা। ও একটু পিছিয়ে দাঁড়াল। ভেতরে ঢুকে ওর দিকে তাকালাম। আবার হাসলাম। ওর মুখ পাণ্ডুর, যেন অন্ধকার পাতালঘরের পরিবেশে সাদা আলোর ছোঁয়া পেয়ে উদ্ভাসিত। ও সামনে এগিয়ে এল। ওর মুখটা যেন হাওয়ায় ভেসে চলে এল। ওর গলার শুভ্রতা তুলনাহীন। সেই গলায় নীল শিরার আঁকাবাঁকা রেখা স্পষ্ট নজরে পড়ল আমার। শিরার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। দরজা বন্ধ করার সময়ে একটা কষ্টকৃত অনিচ্ছায় ভরা দুঃখের ভাব ফুটিয়ে তুলল ও। হয়তো সত্যিই কোনো দুঃখ ওর হচ্ছে। তারপর দরজা বন্ধ হল। শুনতে পেলাম তালা দেওয়ার শব্দ। দরজায় কান পেতে আরও শুনতে চেষ্টা করলাম। কয়েক মুহূর্ত নীরবতা। জানি, ও বাইরে অপেক্ষা করছে। কল্পনায় দেখলাম, ও দাঁড়িয়ে আছে, অপলকে চেয়ে আছে খিল দেওয়া দরজার দিকে, ওর উজ্জ্বল মুখে স্বস্তি ও দুঃখের অদ্ভুত মিশ্র অভিব্যক্তি। আর তারপরই শুনতে পেলাম ওর হালকা পায়ের শব্দ : ও সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। অবশেষে কানে এল ওপরের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ। আমাদের দু’জনের কথা ভেবেই দুঃখ পেলাম।

ঘরের এক কোণে বসে দু—হাতে মুখ ঢাকলাম। মুখটা এখনও আমার নিজেরই। তবে ভীষণ খসখসে ও শক্ত লাগছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আর দেরি নেই। প্রত্যেক মাসে পরিবর্তনটা ক্রমশ তাড়াতাড়ি এবং সহজ হচ্ছে। আগের মতো আর যন্ত্রণা হয় না। জানি না, এ—লক্ষণ ভালো না খারাপ। শুধু এইটুকু বুঝতে পারছি, সমস্ত খুঁটিনাটি লিখে রাখা অত্যন্ত কষ্টের ব্যাপার হবে। যেমন কষ্ট হয় আমার পাতালঘরে যেতে। কী যন্ত্রণা সেখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে, সেই কথা ভেবে।

ভোরবেলা আমার স্ত্রী যখন দরজায় টোকা মারল তখনও নিজেকে ভীষণ দুর্বল লাগছিল। কিন্তু এমনিতে আমি ঠিক আছি। এর মধ্যেই সকাল হয়ে গেছে দেখে অবাক লাগছে। পাতালঘরে সময় ঠাহর করা যায় না। আমিও ঘড়ি নিয়ে যাই না।

প্রথমবারে আমার সাড়া পায়নি তন্দ্রা। তাই দরজা খোলার আগে দ্বিতীয়বার শব্দ করল। দরজা সামান্য ফাঁক করে উঁকি মারল ও। দেখলাম, দরজার ফাঁকে ওর কৌতূহলী আয়ত চোখ। যখন দেখল সব ঠিক আছে, তখন দরজাটা হাট করে খুলে দিল। ওর সাবধানতা দেখে আশ্বস্ত হলেও কোথায় যেন একটা দুঃখের কাঁটা খচখচ করছে। এই হতচ্ছাড়া অসুখ নিয়ে আর পারি না!

ও একবারও জিগ্যেস করল না আমি কেমন ছিলাম। ও জানে, সে নিয়ে কোনো কথা আমি বলতে পারি না। সত্যি, ওর কি জানতে কৌতূহল হয় না? নিশ্চয়ই হয়। ও জানে না যে আমি এই ডায়েরি রাখছি। এটা আমার পড়ার ঘরের ড্রয়ারে চাবি দিয়ে রাখব। এখন টেবিলে বসে আছি, জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছি বাইরের গাছপালার দিকে। সবকিছু আজ শান্ত, অথচ গতকাল রাতটা এক দুঃস্বপ্নের রাত গেছে। আজকের স্মৃতির চেয়েও ভয়ঙ্কর। যদি সত্যিই ওটা দুঃস্বপ্ন হত! আশ্চর্য, আমি যখন আবার ‘আমি’তে ফিরে আসি তখন সমস্ত স্মৃতি কেমন অদ্ভুতভাবে একই সঙ্গে ফিরে আসে। এ নিয়ে ভেবেচিন্তে পরে কিছু লেখার চেষ্টা করব। কেন করব জানি না। কেনই বা ডায়েরি লিখতে ইচ্ছা করে, তাও জানি না। হয়তো এটাই মনের সমস্ত ভাব প্রকাশের একটা পথ। যাই হোক, এখন বেশ আরাম লাগছে। ভাবছি, একটু বিশ্রাম করব। ওই জিনিসটা নিজেকে যেসব আঘাত করেছে, আমার শরীরে সেইসব আঘাতের দাগ ও যন্ত্রণা। শরীর আমাদের একটাই। ফলে ভীষণ শ্রান্ত লাগছে। পরে আবার লিখব।

৬ মে

অসুখটার কথা ভাবছিলাম। কাল সারাটা দিন ওটার কথাই ভেবেছি। এভাবে ভাবতে বেশ অসুবিধে ও কষ্ট হয়। আমি যখন….’আমি’ থাকি না….তখন কোনো চিন্তাও আমার মনে থাকে না। যদিও বা থাকে, পরে সুস্থ হওয়ার পর সেগুলো আর মনে পড়ে না। বোধহয় সেই সময়টা আমার মন অনেকটা পশুর মতো কাজ করে। তখন আমার কীরকম লাগছিল সেই সম্পর্কে শুধু একটা অস্পষ্ট মোটামুটি স্মৃতি থেকে যায়। মানে, তখন ওটার কীরকম লাগছিল। জানি না, আমি আর ওই প্রাণীটা একই কিনা, তবে আমরা একই শরীরে ভাগাভাগি করে থাকি।

যাই হোক, পরিবর্তনের পর আমার মনে যুক্তি বা কারণের কোনো জায়গা থাকে না। ওই প্রাণীটা নেহাতই খেয়ালখুশি মতো কাজ করে। যে—খেয়ালখুশি মানুষের মস্তিষ্কের ছকে ঠিক খাপ খায় না। না কি আমার মস্তিষ্কই তখন পালটে যায়? তবে স্মৃতির কিছু কিছু অংশ খুব জোরালো ছাপ রেখে যায়। কতকগুলো প্রায় স্পষ্ট মনে পড়ে। কিন্তু সেগুলো নিছকই ওটার ভাবনা সম্পর্কে। ওটা কী করছিল বা কেমন দেখতে, তার স্মৃতি ফিরে আসে না। অনেকটা যেন পরিবেশ ও ঘটনাকে ভুলে গিয়ে শুধু মনের অনুভূতিকে মনে করতে চেষ্টা করা। কিন্তু কী সাঙ্ঘাতিক জোরালো সেই অনুভূতি! সে—অনুভূতিকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এতই জটিল।

মনে হয়, ওই প্রাণীটার বেশিরভাগ অনুভূতিই প্রয়োজন থেকে জন্ম নেয়। প্রয়োজন ও ক্ষুব্ধ হতাশা। কিন্তু সঙ্গে মেশানো থাকে ভয়ানক হিংস্রতা, ঘৃণা ও লিপ্সা। কোনো সুস্থ—স্বাভাবিক মানুষের মনে কখনও এই মিশ্র অনুভূতি ঠিক এভাবে জন্ম নেয় না। হয়তো বিচারবুদ্ধির বাঁধন না থাকলে খেয়ালখুশিতে যে—আবেগ তৈরি হয়, তার চরিত্র এরকমই তীব্র। অন্তর মথিত করে সেটা উঠে আসে, সত্যিকারের দৈহিক কার্যকলাপের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক থাকে না। অদ্ভুত জিনিসটার ভেতরে সেটা নরকের আগুনের মতো জ্বলতে থাকে। সেইজন্যেই ওটা বন্য হিংসায় পাগল হয়ে ওঠে। তখন ওটার মনে ওই মিশ্র অনুভূতিই কাজ করে।

পাতালঘরে সত্যি সত্যি যা ঘটে, তা হল….সমস্ত আবেগ, স্মৃতিকে, পাশে সরিয়ে, আমি শুধু ঘটনার বিচারে দেখতে চেষ্টা করছি। যেন আমি এক তৃতীয় ব্যক্তি, পাতালঘরে দাঁড়িয়ে সমস্ত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। (ঈশ্বর না করুন, কারও যেন সে—দৃশ্য দেখার দুর্ভাগ্য না হয়। তাহলে নিশ্চয়ই সে পাগল হয়ে যাবে….অবশ্য জানি না, পাতালঘরে ওই অদ্ভুত জিনিসটার সঙ্গে একসঙ্গে বন্দি থাকতে পাগল হওয়ার সময়টুকুও পাওয়া যাবে কিনা। সেটুকু সময় আমার দ্বিতীয় স্বরূপ কি দেবে?)

পাতালঘরের দৃশ্যটা আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। ওটা ঝাঁপিয়ে পড়ে গদি—আঁটা দেওয়ালে, বাঁকানো নখে ও ভয়ঙ্কর শ্বদন্তে ছিঁড়ে ফালা ফালা করে দেয় দেওয়ালের গদি। ওটা ছিটকে পড়ে মেঝেতে ঘাপটি মেরে বসে থাকে এক মুহূর্ত, দাঁত খিঁচিয়ে অদ্ভুত গর্জন করে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে দেওয়ালে। এক সর্বনাশা রাগ ওটাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়, বারবার করে আরও তীব্র করার জন্যে, তারপর আগের চেয়েও হিংস্রভাবে উন্মত্ত আক্রোশে লাফিয়ে পড়ে। অবশেষে একসময় ওটা হাঁফিয়ে পড়ে, সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে শ্রান্ত হয়ে বসে থাকে প্রতীক্ষায়। গত রাতে ওটা দরজা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পাতালঘরের দরজা অনেক ভারী, অনেক শক্ত।

জানি না, ওটা দেওয়ালে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় যে—শব্দ হয়, সেগুলো তন্দ্রা শুনতে পায় কিনা। তার চেয়ে খারাপ, অনেক খারাপ ওটার হিংস্র ঠোঁট চিরে বেরিয়ে আসা বিকৃত গর্জন। সেগুলোও কি তন্দ্রা শুনতে পায়? সে বড় বীভৎস হবে। ওই শব্দের নৃশংসতায় মানুষের বুক কেঁপে উঠবে।

গত রাতে, খাওয়ার সময়, তন্দ্রাকে অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। ও নিজে হাতে মাংস রেঁধে দিয়েছিল। ও জানে, মাংস আমি ভালোবাসি। কিন্তু ও এমনভাবে আমার দিকে চেয়ে রইল যেন এক্ষুনি কোনোও বন্য পশুর মতো আমি মাংসের টুকরোগুলো ছিঁড়ে খেতে শুরু করব। হয়তো পাতালঘরের শব্দগুলো ও শুনতে পায়….ঈশ্বরের ধন্যবাদ যে, সে—দৃশ্য দেখতে পায় না। এমনিতেই সহজ হয়ে উঠতে ওর তিন—চারদিন লেগে যায়….তারপর ধীরে ধীরে ও সুস্থ হয়ে ওঠে।

অবশ্য আমিও এখন পুরোপুরি সুস্থ।

৭ মে

আমি সম্পূর্ণ সুস্থ এবং স্বাভাবিক।

হঠাৎই মনে পড়ল, এই কথাটা আমার বলা হয়নি। এটা জানিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে, তাই জানিয়ে রাখলাম। যদি কখনও কেউ এ—লেখা পড়ে, তাহলে ওদের জানা উচিত, আমি পাগল নই। আমার অসুখটা মনের অসুখ নয়, দেহের অসুখ। এ রোগ পুরোপুরি শারীরিক। নিশ্চয়ই তাই, নইলে সে—সময় শুধুমাত্র শারীরিক পরিবর্তন হবে কেন?

পরিবর্তনের কথা আমি এখনও লিখিনি। সেটা লেখা খুব কঠিন। কিন্তু শরীরের কিছু কিছু অংশ আমি দেখতে পাই। হাত, পা, বুক—কিন্তু মুখটা দেখতে পাই না। কারণ সেখানে কোনো আয়না নেই। মুখটা কেবল স্পর্শে অনুভব করতে পারি। জানি না, পরিবর্তনের পর আমার মুখের যা চেহারা হয়, সে—স্মৃতি মনে থাকলে আমি তা সহ্য করতে পারতাম কিনা। এও জানি না, সে—মুখের নিখুঁত বর্ণনা আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব কিনা। দেখি, একদিন রাতে এই ডায়েরি সঙ্গে নিয়ে পাতালঘরে যাব, তারপর যতক্ষণ পারি লিখব—যেমন যেমন পরিবর্তন হবে সেগুলোর বর্ণনা তেমন তেমন দেওয়ার চেষ্টা করব। অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত আমার সুস্থ মন সেই—পরিবর্তনের সঙ্গে যুঝে স্থির থাকতে পারবে….যতক্ষণ পর্যন্ত আমি ‘আমি’ থাকব।

যে—প্রশ্নটা সর্বক্ষণ আমার মাথায় ঘোরে সেটা হল অন্য কোনো মানুষ কখনও এ—রোগে ভুগেছে কি না। যদি জানতে পারতাম আমি একাই এই অসুখের শিকার নই, তাহলে হয়তো কিছুটা স্বস্তি পেতাম। এটা ঠিক সমব্যথী খুঁজে পাওয়ার স্বস্তি নয়; এতে আমি অন্তত এটুকু আশ্বাস পেতাম, এ—রোগ থাকাটা কোনো অস্বাভাবিক—অসম্ভব ব্যাপার নয়। আমি যে এ—অসুখে ভুগছি, তার দোষ আমার নয়। এ—অবস্থাতেও আমি ধৈর্য ধরে থাকতে পারি, যদি জানতাম, এ—রোগের কোনো ওষুধ নেই, এ—রোগ যার হওয়ার তার হবেই, কারও কারও ক্ষেত্রে এ—রোগ অনিবার্য।

আমার মতো অসুস্থ কোনো মানুষের ঘটনা খুঁজে বের করার অনেক চেষ্টা আমি করেছি। লাইব্রেরিতে গিয়ে এ নিয়ে গবেষণা করেছি….শেষদিকে লাইব্রেরিয়ান মহিলাটিও হয়তো আমাকে সন্দেহ করত। ভদ্রমহিলা মধ্যবয়েসি, অদ্ভুত রকমের মোটা, আর সাজগোজও উগ্র। হয়তো এ—ধরনের চাকরিতে এ—ধরনের সাজগোজই কর্তৃপক্ষ পছন্দ করেন। এ ছাড়া, তার মুখে আছে এক অদ্ভুত উপোসী ভাব। তার ধারণা, যে—জিনিস নিয়ে আমি গবেষণা করি, অর্থাৎ লাইক্যানথ্রপি, সেটা মথ ও প্রজাপতির পর্যবেক্ষণবিজ্ঞান। শত গবেষণাতেও কোনোও ফল আমি পাইনি। প্রাচীন সব মোটা মোটা বই, চামড়ায় বাঁধানো বিভিন্ন মনস্তত্ত্বের বই ইত্যাদিতে একদিকে যেমন সব উপকথা কিংবদন্তির উল্লেখ আছে, তেমনই অন্যদিকে রয়েছে বিকৃত মানসিকতার কথা। এ—ধরনের অসুখের অনেকগুলো ঘটনারই উল্লেখ সেসব বইয়ে রয়েছে, কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রেই রোগী মানসিক দিক থেকেও অসুস্থ ছিল। সত্যিকারের কোনো দৈহিক পরিবর্তন তার হত না। শুধু মাঝে মাঝে সেই উন্মাদ রোগীর মনে হত, তার শরীরে একটা পরিবর্তন আসছে….কিন্তু কিংবদন্তিরও তো একটা ভিত্তি থাকতে হবে। প্রত্যেক কিংবদিন্তরই কিছু না কিছু সত্যের ভিত্তি আছে। এই ধারণা আর বিশ্বাসকেই আমি ভীষণভাবে আঁকড়ে ধরি। কিছুটা একটা আমাকে যে আঁকড়ে ধরতেই হবে।

শুনেছি, আমার ঠাকুর্দার প্রপিতামহ নাকি অভিযাত্রী ছিলেন এবং কোনও একটা অভিযানে গিয়ে এক বলকান মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। ট্রানসিলভ্যানিয়ার আল্পস—এর পার্বত্য অঞ্চলে বহুদিন ছিলেন তিনি। জানি না, এর মধ্যে আমার অসুখের কার্যকারণের গোপন বীজ লুকিয়ে আছে কিনা। কিন্তু এ—জাতীয় বেশিরভাগ কিংবদন্তিরই জন্ম ওই ট্রানসিলভ্যানিয়া অঞ্চলে। জায়গাটা নিশ্চয়ই এ—রোগের এক বিশাল ঘাঁটি। আর, এও আমার মনে হয়, রোগটা বংশগত। অন্য কারও থেকে এ—রোগ আমার শরীরে সংক্রামিত হয়েছে, এ আমি বিশ্বাস করি না। বরাবরই আমি পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন থাকি। সব জিনিসেই আমার সংযম রয়েছে। আমি মদ—সিগারেট খাই না, নারী সংসর্গ করাটাও আমার নেশা নয়, স্বাস্থ্যও আমার বরাবরই ভালো। সুতরাং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ—রোগ আমার শরীরে উত্তরাধিকার সূত্রে বর্তেছে। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে আমার পূর্বপুরুষের পাপ আমাকে বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে। একজনের অপরাধে শাস্তি পেতে হচ্ছে একজন নিরপরাধকে, আমাকে।

আমার অসুখটা নিশ্চয়ই রক্তে অথবা শরীরের কোশে মিশে আছে। আমার ধারণা, বংশপরম্পরায় ওটা রক্তে বয়ে চলে। কিন্তু থাকে সুপ্ত অবস্থায়, অপেক্ষা করে, প্রচ্ছন্নভাবে ঘাপটি মেরে বসে থাকে পুরুষ থেকে পুরুষে। অবশেষে একদিন….হয়তো একশো বছর পর পর….কিংবা হাজার বছর পর পর….অসুখটা জেগে ওঠে। ঘুম ভেঙে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আর তারপর, যত দিন খায়, ওটা হয়ে ওঠে আরও ভয়ঙ্কর, আরও তীব্র। যার এই অসুখ, সে যত বড় হতে থাকে ততই শক্তিশালী হয়ে ওঠে অসুখটা। শরীর থেকে ক্রমশ শক্তি শুষে নিয়ে পৈশাচিক রূপ নেয়, এবং মেতে ওঠে ধ্বংসের তাণ্ডবে….।

এই আমার বিশ্বাস। এ—বিশ্বাস না করে আমার উপায় নেই।

এই অসুখের জন্যে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, কোনোরকমেই আমি দায়ী নই। এ আমার জীবনে এক অভিশাপ—জন্মগত অভিশাপ। এই অভিশাপের বীজ কবে রোপিত হয়েছে? যেদিন আমার সেই পূর্বপুরুষ এক ভয়ঙ্কর নোংরা খেলায় মেতে উঠে এই রোগের বীজাণুকে আলিঙ্গন করেছিলেন, সেদিন? এই কারণেই পূর্বপুরুষদের আমি ঘৃণা করি। এ—কথা ভাবতে ভালো লাগে, এ—পাপ তাদের, আমার নয়। যদি আমার কোনো কাজ এ—রোগের জন্যে দায়ী হত তাহলে আমি হয়তো দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে যেতাম। আমার মন পঙ্গু হয়ে যেত। এজন্যে আমার ভয় হয়। এ—ভয়ের যথেষ্ট কারণও আছে। যে—রোগে আমি ভুগছি, সে—রোগ যে—কোনো লোককে পাগল করে দিতে পারে….।

২ জুন

গত সপ্তাহে সত্যি সত্যি একজন ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু সে—প্রশ্ন কখনওই ওঠে না। প্রথম থেকেই অবশ্য সেটা জানি, কিন্তু তা সত্ত্বেও এ—চিন্তা যে—আমার মনে এসেছে, তাতেই বোঝা যায় আমি কতখানি মরিয়া হয়ে উঠেছি। এখন আমি খড়কুটো আঁকড়ে ধরতেও প্রস্তুত—প্রস্তুত নিজেকে বাঁচানোর সামান্য সুযোগের জন্যে যে—কোনো ঝুঁকি নিতে। এটুকু জানি, সুস্থ আমাকে হতেই হবে—আর সে—সুস্থতা আসবে ভেতর থেকে—আমার শরীরের গভীর থেকে।

ডাক্তারের কাছে যাওয়ার বুদ্ধিটা তন্দ্রাই আমার মাথায় ঢুকিয়েছে। অবশ্য খুব কায়দা করে, পরোক্ষভাবে। মনস্তত্ত্ববিদ সম্পর্কে কী একটা কথা যেন ও তুলেছিল যে—কাগজে তাঁদের সম্পর্কে কীসব লেখালিখি হচ্ছে—অর্থাৎ, কোনোওরকমে ‘মনস্তত্ত্ববিদ’ শব্দটা বারবার আমার কানে ঢোকানো এবং খোলাখুলি উপদেশ না দিয়ে আমাকে ডাক্তারের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। ওর মতলব সফলও হয়েছিল, কারণ সত্যিই আমি ডাক্তার দেখানোর কথা ভাবতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু তা একেবারেই অসম্ভব।

সাধারণ ডাক্তারের কথা না বলে ও যে মনস্তত্ত্ববিদের কথা বলেছে, তাতে আমি বেশ আঘাত পেয়েছি। ও আমার মতোই ভালোভাবে জানে, এ—রোগটা দেহের—মনের নয়। বহুবারই ওকে সে—কথা বলেছি। কিন্তু ওর কথাতেও যুক্তি আছে। কোনো সাধারণ ডাক্তার আমার কথা বিশ্বাস করবে না। আমাকে পাগল ভাববে এবং শেষ পর্যন্ত সে—ই পাঠাবে কোনো মনস্তত্ত্ববিদের কাছে। আর, মনস্তত্ত্ববিদ ডাক্তারও ব্যর্থ হবেন, কারণ তিনি এমন একটা মানসিক রোগের চিকিৎসা করাতে চাইবেন যার কোনো অস্তিত্বই নেই। আমার কথা তাঁদের বিশ্বাস করানোর একমাত্র পথ আমার পরিবর্তনটা সত্যি সত্যি দেখতে দেওয়া, আর সে আমি মরে গেলেও পারব না।

সে—কথা চিন্তা করে বহুদিন পর আবার প্রাণখোলা হাসি হেসে উঠলাম। কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি, সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে আমি বসে আছি। সময়টা রাত। সেই বিশেষ রাত। তাঁর নির্দেশমতো আমি গদি—আঁটা বিছানায় শুয়ে পড়লাম। তিনি আমার পাশেই চেয়ারে বসে। একটু আগেই আমার অসুখের খুঁটিনাটি সব তাঁকে বলেছি। তিনি ধৈর্য ধরে শুনেছেন আর মাঝে মাঝে মাথা নেড়েছেন। আমার কথা শেষ হলে তিনি আত্মবিশ্বাসে ভরা মার্জিত মৃদু স্বরে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর মাথায় টাক, চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা, মুখে পেশাদারি অভিজ্ঞতার ছাপ, পায়ের ওপর পা তুলে তিনি বসে আছেন, হাঁটুর ওপর নোটবই। কথা বলার সময় আমার দিকে তিনি তাকিয়ে নেই, তাঁর চোখ নোটবইয়ের দিকে। আমিও তাঁর দিকে দেখছি না। আমার চোখ জানলায় নিবদ্ধ।

সমস্ত দৃশ্যটা আমার মনে নিখুঁত ছবির মতো স্পষ্ট। এমনকি দেওয়ালে আঁটা তাঁর বিদেশি ডিগ্রিসমেত নেমপ্লেটও আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। জানলা দিয়ে আসা চাঁদের আলো সেই নেমপ্লেটে ঠিকরে পড়ছে। বিশাল টেবিল, ভারী ভারী একগাদা বইয়ের সারি। সব দেখে আমার চোখ আবার ফিরে যায় জানলার দিকে। পাতালঘরে থাকার চেয়ে যখন আমি চাঁদ দেখতে পাই তখন পরিবর্তনটা অনেক তাড়াতাড়ি এবং সহজে আসে। বুঝতে পারি, পরিবর্তন শুরু হয়েছে। ডাক্তারবাবু কথা বলে যান হালকা স্বরে। হয়তো বলছেন, এ—সবই আমার মনের ভুল, উদ্ভট কল্পনা, এ অসম্ভব, রোগগ্রস্ত দুর্বল মনের চিত্র—প্রলাপ। সে—কথা ভালো করে বোঝাবার জন্যে আমার দিকে ফিরলেন তিনি। তাকালেন আমার চোখে। আর তাঁর মুখ….তাঁর মুখ দেখেই আমার প্রচণ্ড হাসি পেল….সে—মুখ যেন টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়বে। সেই শীতল, বিজ্ঞানীর, বুদ্ধিদীপ্ত মুখ অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে অতীতের অতলে, হয়ে ওঠে প্রাগৈতিহাসিক, কুসংস্কারে বিশ্বাসী এক ভয়ার্ত মুখ। তাঁর ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে আসে দুনিয়া কাঁপানো এক ভয়ঙ্কর চিৎকার। আর তারপর….।

জানি না, ব্যাপারটা হয়তো হাসির নয়, কিন্তু তবুও, আবার হাসতে পেরে ভালো লাগছে।

৩ জুন

আজ রাতে আমাকে পাতালঘরে যেতেই হবে।

কারণ অসুখটা হবে বলে ভয় করছে। আমার স্ত্রীও ভয় পাচ্ছে। গত রাতেই ওকে একটু অস্থির ও চিন্তিত দেখেছি। ক্রমশ ওর অবস্থা খারাপ হচ্ছে। আবারও ও আকারে—ইঙ্গিতে বলেছে, আমার ডাক্তারের সাহায্য নেওয়া দরকার। সাহায্য! কে আমাকে সাহায্য করবে? কী সাহায্যক রবে? ও কিছুতেই বুঝতে চায় না। হয়তো ভয়ঙ্কর চরম সত্যটাকে ও বিশ্বাস করতে চায় না, মন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। তার চেয়ে আমি পাগল হলেই ও যেন স্বস্তি পেত। কিন্তু মাঝে মাঝে নিজের চেয়ে ওর সুস্থতা নিয়ে আমার চিন্তা হয়। আর নিজের কথা ভেবে শুধু ভগবানকে ডাকি যে, অসুখটা যেন আরও খারাপের দিকে না যায়, যেন প্রতি মাসে ওই একটা ভয়ানক রাত নিয়ে আমি স্বাভাবিকভাবে জীবন কাটাতে পারি….কিন্তু ওই একটা রাতকেই আমি ভয় পাই। ভয় পাই পাতালঘরটাকেও। পরিবর্তনের পরেও আমার মধ্যে কিছু স্মৃতি, কিছু আবেগ থেকে যায়। আমি কষ্ট পাই। আজ, একমাস পরেও, সে—অনুভূতি আমার স্পষ্ট মনে আছে। পশুটার প্রচণ্ড দাপাদাপির সঙ্গে মনে পড়ে যায় বুকের ভেতরে এক তীব্র যন্ত্রণা, অতীতের যন্ত্রণা। মনে পড়ে, সেই ছোটবেলায়, এক পূর্ণিমার রাতে একটা শিকারি হাউন্ডকে আমি মেরে ফেলেছিলাম। কুকুরটা আমাকে আক্রমণ করতে আসছিল….সে—কথায় পরে আসব। কিন্তু তখন আজকের এই ভবিষ্যতের কথা আমি ভাবিনি। বর্তমানকে আমি সহ্য করতে পারি, কিন্তু ভবিষ্যতের ভাবনা আমাকে পাগল করে তোলে। যত দিন যাবে, ততই যদি সে—ভবিষ্যৎ ক্রমে খারাপের দিকে যেতে থাকে….।

বলা যায় না, হয়তো অসুখটা ভালোও হয়ে যেতে পারে। সেটা একেবারে অসম্ভব নয়। অনেক রোগ নিজে থেকেই সেরে যায়, শরীরে নিজে থেকেই তৈরি হয় প্রতিরোধের ক্ষমতা। শুধু সেই আশাতেই বুক বেঁধে থাকি। ভাবি, কোনো এক মাসে সেই বিশেষ দিনটা পার হয়ে যাবে, অথচ এই অসুখটা আর হবে না। তখন স্পষ্ট বুঝব, আমি সেরে উঠছি।

আমি ছেলেমেয়ে চাই না। সেরে উঠলেও চাই না। এই রোগের পরিসমাপ্তি আমাকে দিয়েই হোক। আমার বংশধরদের মধ্যে এই রোগ আমি ছড়িয়ে দিতে চাই না। তন্দ্রা এতে দুঃখ পেয়েছে! ও যে মা হতে চায়। এটা বুঝতে চায় না, কেন তা অসম্ভব, কী আতঙ্কময় পরিণতি লুকিয়ে রয়েছে সে—ইচ্ছের পেছনে। হয়তো আমি পাগল হলেই ওর পক্ষে ছিল ভালো। কখনও কখনও মনে হয়, ও হয়তো ভাবে আমার কিছু একটা হয়েছে….হ্যাঁ, সে—কথা আমি অস্বীকার করি না….কিন্তু পাগল তো আমি হইনি। সুতরাং, এই ডায়েরিতে লিখে রাখার জন্যেই এ—কথা উল্লেখ করলাম। জানি না, সবটা আমার মনের ভুলও হতে পারে।

গত এক মাস কিছু লিখিনি। লেখার মতো কিছু ছিল না। রোগটা যত কাছে আসে ততই লিখতে ইচ্ছে করে। সেই কারণে প্রথম প্রতিদিন লিখব ঠিক করলেও কাজে তা হয়ে উঠছে না। যতক্ষণ পারি সমস্ত আমি ভুলে থাকতে চাই। কিন্তু পারি কই? নইলে, এখনও আমার মনে পড়ে কেন সেই মাতালটার কথা? যার সঙ্গে এক পূর্ণিমার রাতে এক নির্জন হোটেলে আমার দেখা হয়েছিল। কেনই বা মনে পড়ে বৃষ্টিঝরা রাতের সেই আগন্তুকের কথা? আমার অসুখের এক ভয়ঙ্কর রাতে যে এসে আশ্রয় নিয়েছিল আমাদের বাড়িতে। তারপর….। সে—কথায় মনে পড়ে যায়, ওই ভয়ঙ্কর রাত আবার ফিরে আসবে—প্রতি মাসেই ফিরে আসবে। ইচ্ছে আছে, আজ রাতে ডায়েরিটা পাতালঘরে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। যতক্ষণ পারি, যতটুকু পারি, কাগজে—কলমে ধরে রাখার চেষ্টা করব….হয়তো একদিন এই ডায়েরি সত্যিকারের কাজে আসবে। হয়তো লিখতে গিয়ে নিজের ওপর আমার ঘেন্না করবে। কিন্তু চেষ্টা আমাকে করতেই হবে। যতখানি সম্ভব আমাকে জানতে হবে। হয়তো সেই তথ্য থেকেই পেয়ে যাব এ—রোগকে নির্বাসন দেওয়ার কোনো অদ্ভুত পথ।

এখন বিশ্রাম করা দরকার। আজ রাতে অনেক পরিশ্রম হবে, কষ্ট হবে। আজকের দিনটা ভারি চমৎকার। আকাশ পরিষ্কার। জানি, রাতও পরিষ্কার থাকবে। দেখা যাবে গোল রুপোর থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদকে বাইরে রেখে বদ্ধ পাতালঘরে যেতে ভীষণ কষ্ট হবে। কিন্তু উপায় কি….।

৩ জুন, রাত

যাক, দরজা বন্ধ করে খিল দেওয়া হয়ে গেছে। শুনতে পেলাম, তন্দ্রার পায়ের শব্দ সিঁড়ি বেয়ে উঠছে, অবশেষে ওপরের দরজাটাও বন্ধ হয়ে গেল। এখন পাতালঘরে আমি একা। এখনও ঠিকই আছি। আজ রাতে একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে আমার ভয় করছিল। ডায়েরিটা সঙ্গে নিয়ে এসে ভালোই হয়েছে। কিছু একটা কাজ নিয়ে অন্তত মেতে থাকতে পারব। অপেক্ষার সময়টুকু আর ক্লান্তিকর মনে হবে না। চুপচাপ সেই ভয়ঙ্কর পরিবর্তনের প্রতীক্ষায় বসে থাকার চেয়ে কিছু একটা করা তবু ভালো।

লিখতে লিখতে হাতের দিকে তীক্ষ্ন লক্ষ রাখছি। লক্ষ রাখছি আঙুলের নখের দিকে। এখনও নখগুলো ঠিকই আছে। এখনও কিছু শুরু হয়নি। আমার আঙুলগুলো লম্বা, সরু। নখ ছোট করে কাটা। খুব সাবধানে আমাকে লক্ষ রাখতে হবে, যাতে পরিবর্তনের প্রাথমিক লক্ষণগুলো চোখ এড়িয়ে না যায়। সমস্ত কিছুর নিখুঁত বিবরণ ডায়েরিতে আমি লিখে রাখতে চাই।

পাতালঘরে কোনো আসবাবপত্র নেই। থাকলে তো নেহাতই চুরমার হত। ঘরের এক কোণে উবু হয়ে বসে হাঁটুর ওপর ডায়েরি রেখে লিখছি। পাতাগুলো যেন সামান্য রঙিন মনে হচ্ছে। একটা বেশি পাওয়ারের বালব লাগালে ভালো হত। আলোটা পাতালঘরের ছাদের গায়ে গর্ত করে বসানো, ওপরে জালের ঢাকা দেওয়া। জালটা একটু তোবড়ানো মনে হচ্ছে, কিন্তু সেটা আমারই কীর্তি বলে মনে পড়ছে না। অবশ্য মনে না পড়ারই কথা। পাতালঘরটা স্পষ্ট দেখতে পাওয়ার পক্ষে আলোটা যথেষ্ট নয়। আগে কখনও এটা খেয়াল করে দেখিনি। অন্যান্য সময় নিজের ভাবনাতেই এত ব্যস্ত থাকি যে, চারপাশের কথা ভুলে যাই। কিন্তু আজ যে অনেক তাড়াতাড়ি এসে পড়েছি….।

পাতালঘরটা কংক্রিটের তৈরি। দেওয়ালগুলো বেশ পুরু এবং দরজাটায় বড় বড় লোহার বল্টু লাগানো। ঘরের চার দেওয়ালেই পুরু গদি আঁটা। তন্দ্রা আর আমি মিলেই গদিগুলো লাগিয়েছি। মাটির তলায় ঘর তৈরি করছি কেন, রাজমিস্ত্রিকে এ—প্রশ্নের উত্তর দিতেই আমরা হিমশিম খেয়েছি, তার ওপর দেওয়ালে গদি লাগানো! সুতরাং, সে—কাজটুকু কষ্ট করে নিজেরাই সেরে নিয়েছি। পাতালঘর তৈরির সময় মিস্ত্রিকে বলেছিলাম, ঘরটা আমাদের পোষা কুকুরের জন্যে। সে সন্দেহ করে বহুরকম প্রশ্ন করেছে, আমাদের অদ্ভুত খেয়ালের কথা চিন্তা করে উপদেশও দিয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তৈরি করে দিয়েছে ঘরটা। আমাদের কোনোও কুকুর নেই। কুকুররা আমাকে ঠিক পছন্দ করে না। আমাকে দেখলে ভয় পায়। মনে হয়, আমি সুস্থ থাকার সময়েও ওরা আমার ওই অদ্ভুত রোগের গন্ধ পায়। আমার রোগটা যে শুধুই দেহের, এটা তার একটা বড় প্রমাণ। আবার মনে পড়ছে সেই শিকারি হাউন্ডটার কথা।

এই ঘরে একটা অদ্ভুত ভ্যাপসা গন্ধ রয়েছে। দমবন্ধ হয়ে আসছে। মনে হয়, গদির নীচে দেওয়ালগুলো স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে। গদির তুলোগুলো ক্রমশ জমাট বেঁধে গেছে। ওগুলো শিগগিরই পালটাতে হবে। ঘরটাকে যতটা সম্ভব আরামের করে তুলতে হবে। জায়গায় জায়গায় গদি ছিঁড়ে গেছে, তুলো ছড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে। গদিটা শক্ত মোলায়েম রেক্সিনে মোড়া। সুতরাং বুঝতে পারছি, আমার….মানে ওটার….নখগুলো খুব শক্তিশালী এবং ধারালো। ওগুলো গদিতে বসে যায় খুব সহজে, যেন মাখনে ছুরি কেটে বসছে। অন্ধ আক্রোশে দেওয়ালে থাবা বসানোর সময় কখনও কি আমার নখ ভেঙে যায়নি? ছেঁড়া জায়গাগুলো ভালো করে খুঁজে দেখতে হবে। সেটাই হবে পরিবর্তনের জলজ্যান্ত অকাট্য প্রমাণ। পরে তন্নতন্ন করে খুঁজব। হয়তো কিছু না কিছু পেয়ে যাব। ওটা যে—ভয়ঙ্কর শক্তিতে প্রচণ্ড ক্রোধে দেওয়ালে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাতে ওই শক্ত বাঁকানো নখও ভেঙে যাবে। আমি জানি। আমার চেয়ে কে আর ভালো জানবে!

ওই নৃশংস বাঁকানো নখগুলো! ওগুলোর কথা মনে পড়লেই আমি শিউরে উঠি। চামড়া টান টান হয়ে কুঁচকে যাওয়া বাঁকানো আঙুলের ডগায় ওগুলো নড়েচড়ে বেড়ায়। যেভাবে এই শক্ত গদিতে ওগুলো কেটে বসে, ছিঁড়ে ফালা ফালা করে দেয়, তাতে ভাবি, মাংসের মতো কোমল জিনিস পেলে তার কী অবস্থা হবে! কোনো মানুষের নরম গলার কী অবস্থা হবে! এ—কথা ভাবলেও আমার শরীর কেঁপে ওঠে। নরম মাংসের স্পর্শ আমি স্পষ্ট অনুভব করি, আর সে—অনুভূতি আমার মনে ঘৃণার জন্ম দেয়। কিন্তু তবু সে—অনুভূতি থেকে মুক্তি নেই। ওটা আমাকে বারবার নিজের পরিচয় দিতে চায়। স্পষ্ট দেখতে পাই, কীভাবে সেই থাবা আঁকড়ে বসে যায় গলায়, নখের তীক্ষ্ন অগ্রভাগ ফরসা চামড়ায় আঁচড় কেটে এগোয়, অবশেষে চামড়া কেটে গলায় ঢুকে যায় দশ আঙুল, গলার শিরা কাঁপতে থাকে দপদপ করে। বাঁকানো নখগুলো এখন অদৃশ্য, আঙুলের ডগায় রক্তের উষ্ণ স্পর্শ, রক্ত ফিনকি দিয়ে ছিটকে আসে আমার মুখে। টের পাই উষ্ণ নোনতা স্বাদ। রক্তের গন্ধে আমার মাথা ঘুরতে থাকে, সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে, শুধু পড়ে থাকে একটা আতঙ্কবিকৃত থরথর মুখ। সে মুখের ক্রমশ পরিবর্তন হয়, চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসে, গলার ভেতরে মৃত্যুর ঘড়ঘড় শব্দ হয়, আমার তীক্ষ্ন শ্ব—দন্ত নেমে আসে—আমি ঝুঁকে পড়ি সেই মুখটার ওপর….নরম ফরসা গলায় আমার শ্ব—দন্ত….বসে যায়….নরম উষ্ণ মাংসে ওরা ডুবে যায়, অদৃশ্য হয়….একটানে ছিঁড়ে নেয়….গলার নলি….।

৪ জুন

এইমাত্র ডায়েরি মেরামতের কাজ শেষ করলাম। ছেঁড়া জায়গাগুলো সেলোটেপ দিয়ে জুড়ে দিয়েছি। নিশ্চয়ই গত রাতে পৃষ্ঠাগুলো আমিই ছিঁড়েছি—ওই অসুখের সময়। কিছুই আমার মনে নেই। হয়তো ইচ্ছে করে ছিঁড়িনি, ওই অন্ধ রাগের সময় হাতের কাছে যা কিছু থাকে তাই তছনছ হয়ে যায়। ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলো দু—ভাগে বা চারভাগে সমান করে ছেঁড়া নয়, এলোপাতাড়িভাবে ছিঁড়ে তছনছ করা। ওপরের মলাটটা ছিঁড়ে একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, কিন্তু পৃষ্ঠাগুলো এখনও পড়া যাচ্ছে। পেনটাও শুকনো ডালের মতো ভেঙে দু—টুকরো হয়ে গেছে। এত শক্তি, এত ক্ষমতা, কল্পনা করা যায় না। আমি বরাবরই শক্তিশালী, নিয়মিত ব্যায়ামও করি। কিন্তু পরিবর্তনের মাধ্যমে যে বন্য শক্তি আমার মধ্যে আসে তা দুঃস্বপ্নের বাইরে। যেন আমার পেশি, তন্ত্রী সবই বদলে যায়। বাইরের মতো ভেতরে ভেতরেও একটা পরিবর্তন ঘটে। হয়তো শুধুমাত্র একটা শরীরের আমরা শরিক নই, ছোট্ট মস্তিষ্কেও আমরা দুজনেই জায়গা করে নিই। এটা আশার কথা যে, ওটাকে আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্তা বলে ভাবতে পারছি। অথচ আমার নিজের শরীরেই ওটার আঘাত ও ক্ষতের চিহ্ন থেকে যায়। একইসঙ্গে দুটো শরীরের অস্তিত্ব কখনওই থাকতে পারে না। ব্যাপারটা বড় গোলমেলে, আমার যুক্তির নাগালের বাইরে—কিন্তু আমি অনেকের চেয়েই বেশি বুদ্ধিমান এবং যুক্তিবাদী। এ—অদ্ভুত রোগের মোকাবিলা করে, তার সঙ্গে নিয়ত লড়াই করে ক’জন মানুষ আমার মতো নিজের সুস্থতা বজায় রাখতে পারত? এজন্যে আমার গর্ব হয়। আমি ব্যর্থ হইনি। নিজের মনের জোর সত্যিই আমার গর্বের কারণ।

পরিবর্তনের কথা আমার লেখা হয়নি। মনে আছে, ওটার শুরু হওয়াটা স্পষ্ট টের পেয়েছিলাম। তখন আমি নিশ্চয়ই লিখছিলাম, কিন্তু যে—কোনো কারণেই হোক ডায়েরিতে সে—কথা লেখা নেই। লেখার শেষ কয়েকটা লাইন জড়ানো, অস্পষ্ট আঁচড় মাত্র। আমার হাতের লেখা বলে চেনা যায় না। মনে হয়, সেটাই পরিবর্তনের একটা লক্ষণ। জিনিসটার হাত দুটোর অমানুষিক শক্তির কথা লিখছিলাম, তখনই হঠাৎ লেখা শেষ হয়েছে। একেবারে মাঝপথে। আমার ধারণা, হাতের আঙুল, চামড়া, টান টান হয়ে বেঁকে যাওয়ার ফলেই ওই অদ্ভুত জড়ানো লেখার জন্ম হয়েছে। কিন্তু তারপর আর কিছু লেখা নেই।

গত রাতে পরিবর্তনটা একটু অন্যরকম মনে হয়েছে। আগের চেয়ে জোরালো না হলেও একটু অন্যরকম। মনে হয়, আমি এখন অসুখটার এক নতুন ধাপে এসে পৌঁছেছি….অসুখটা এখন পালটাচ্ছে….হয়তো ভালোর দিকে যাচ্ছে।

ওটার চিন্তাশক্তি আগের চেয়ে বেড়েছে। অথবা আমার স্মৃতিশক্তি আরও প্রখর হয়েছে। দুটোর যেটাই হোক, এখন টুকরো ঘটনা ছাড়াও বেশ কিছু চিন্তাভাবনা আমি স্পষ্ট মনে করতে পারছি। সমস্ত হতাশা, খিদে, ঘৃণা, এসবের কথা আমার মনে আছে। কিন্তু সে ছাড়াও মনে পড়ছে ঝাপসা ছেঁড়া ছেঁড়া চিন্তার অংশ। আমার চিন্তা নয়, ওটার চিন্তা। সে—চিন্তা অনেকটা মানুষের চিন্তার মতো। তাই তো হওয়া উচিত। ওই ভয়ঙ্কর জিনিসটার শরীরে মানুষের মতো চিন্তার ক্ষমতা আছে, এ—কথা কল্পনা করাটাও এক দুঃস্বপ্ন। এক দুশ্চিন্তা। ওটাকে আমার মনের ভাগ আমি দিতে চাই না। কিন্তু বেশ মনে আছে, ওটা যুক্তি দিয়ে চিন্তা করে দেখছিল, কী করে পাতালঘর থেকে বেরোনো যায়। মনে আছে, ওটার দাপাদাপির মাঝে এক নীরব মুহূর্ত। তখন ওটা ঘাপটি মেরে মেঝেতে বসে সাদা চোখ দুটো ঘুরিয়ে চারদিকে দেখছিল, খুঁজে বেড়াচ্ছিল দেওয়ালে বা দরজায় কোনো পলকা জায়গা। হয়তো তন্দ্রাকে ফাঁকি দিয়ে ভুলিয়ে দরজা খোলাবার কথাও ওটা ভাবছিল। অবশ্য ও—ঘর থেকে বেরোনোর কোনো রাস্তা নেই। সবরকমেই আমরা সাবধান হয়েছি। যদি ওটা আমার মতো বুদ্ধিমানও হয়ে ওঠে, তবুও পাতালঘর থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ খুঁজে পাবে না।

এটাই হল অসুখের পরিবর্তন : জিনিসটার ক্রমশ বুদ্ধিমান ও যুক্তিবাদী হয়ে ওঠা। হয়তো ওটা এভাবে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে….মানুষের মতো। হয়তো আমি ও সে ক্রমশ কাছাকাছি চলে আসছি। কাছে কে এগিয়ে যাচ্ছে, আমি না সে, তা বলা অসম্ভব। হয় অসুখটা ক্রমেই আমাকে দখল করে নিচ্ছে, অথবা আমি বোধহয় সেরে উঠছি। জানি না, এই নতুন পরিবর্তনটা ভালো না খারাপ….আমি ভয়ে কেঁপে উঠি, শরীর ঘেমে যায়, পাকস্থলীতে টের পাই কোনো বরফের শক্ত মুঠির অস্তিত্ব। সব মিলিয়ে অন্ধ ত্রাস।

এখন আমি অনেক শান্ত। কিছুক্ষণের জন্যে শুয়ে পড়লাম। ঠোঁটে এখনও রক্ত ও ফেনার স্বাদ, যদিও অনেকবার দাঁত মেজেছি। গত রাতে ঠোঁটে কামড় বসিয়ে দিয়েছিলাম। ঠোঁট ফুলে গেছে, সেইসঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণা। জিভে কোনো স্বাদ পাচ্ছি না—হয়তো সবটাই আমার মনের অনুভূতি। আজ সকালে স্বাভাবিক হয়ে ঢোক গিলতেই কেমন বমি বমি ভাব এল। তন্দ্রা যতক্ষণ না দরজা খুলে দিচ্ছে ততক্ষণ দাঁত মেজে মুখ ধুতে পারব না ভেবে গা গুলিয়ে উঠল। তন্দ্রার অপেক্ষায় সময় আর কাটতে চায় না। অবশ্য পাতালঘরে সময় বোঝার উপায় নেই। সময় সেখানে যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমার অসুখের সঙ্গে কি এর কোনো সম্পর্ক আছে? সময়টা মাপতে পারলে বেশ হত।

গত রাতে যে অসুখটা বেশিক্ষণ ছিল তাতে কোনোও সন্দেহ নেই। অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। অবশ্য এবারে বেশি ঘটনা, বেশি স্মৃতি মনে থাকার ফলে অসুখটা অপেক্ষাকৃত দীর্ঘস্থায়ী বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আমার স্ত্রী বলেছে, রোজকার সময়ে ও যখন দরজায় এসে ধাক্কা দেয় তখন কোনোও সাড়া পায়নি। প্রতিদিন ও দরজা খোলার আগে আমি চেঁচিয়ে সাড়া দিই, বলি, ‘সব ঠিক আছে, তন্দ্রা, দরজা খোলো।’ অথচ আজ সকালে আমি সে—সময়ে সাড়া দিইনি। তন্দ্রা বলছে, ও নাকি কীসব….অদ্ভুত আওয়াজ শুনেছে….কিন্তু কোনো উত্তর পায়নি। শব্দগুলো ঠিক কীরকম, তা ও ভেঙে বলেনি।

সুতরাং ও ওপরে ফিরে গিয়ে আরও এক ঘণ্টা অপেক্ষা করেছে। বেশ বুঝতে পারছি, ওই একটা ঘণ্টা ওর কী আতঙ্কে, কী উৎকণ্ঠায় কেটেছে। খালি ভেবেছে, আমার কী হল। বেচারি তন্দ্রা! ও আমাকে এত ভালোবাসে, অথচ বুঝতে চায় না। বিয়ের সময় আমার অসুখের কথা ও জানত না। পরে সেটা জানতে পেরে ও এক বিরাট আঘাত পেয়েছে। সে—তীব্র আঘাত যে ও সইতে পেরেছে, তাতে আমি ওর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আমার মতোই দুশ্চিন্তা ও আশঙ্কায় এখন ওর দিন কাটছে।

এক ঘণ্টা পর ও আবার নেমে এসেছে, ধাক্কা দিয়েছে পাতালঘরের দরজায়। এবারে আমি সাড়া দিয়েছি, তারপর ও দরজা খুলেছে। খুব ধীরে ধীরে ও দরজার পাল্লা ফাঁক করে ঘরে উঁকি মেরেছে। স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি ওর আচমকা শ্বাস টানার শব্দ। আমার জন্যে ভয়ে ও যেন পাগল হয়ে গেছে। অথচ মনে হয় না, আমাকে ও ভয় পায়।

প্রথমবার ওর দরজায় ধাক্কা দেওয়া আমি শুনতে পাইনি—অথবা মনে নেই। যখন ও সে—কথা বলল, তখন বেশ অবাক হয়ে গেছি। অস্পষ্ট আভাসে মনে পড়ছে, আমি ঘাপটি মেরে দরজার ঠিক পাশে বসেছিলাম, আমার দু—ঊরুর পেশি টানটান, দু—হাত সামনে বাড়ানো খোলা অবস্থায়, যেন কারও দরজা খোলার জন্যে অপেক্ষা করছি। কিন্তু সে—স্মৃতি ভীষণ ঝাপসা। কখন যে ওভাবে বসে ছিলাম, মনে নেই। তবে এটুকু জানি, তন্দ্রার জন্যে ওভাবে কখনও আমি অপেক্ষা করব না। করতে পারি না।

৬ জুন

ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। অসুখটা এ—মাসে এত বেশিক্ষণ ছিল কেন সেই কথা ভাবছি। যতদূর মনে পড়ে, আগে অসুখটা এতক্ষণ থাকত না। আমার এ—অসুখের শুরু থেকে গুছিয়ে লিখতে চাই। তাতে অসুখটার উন্নতি, অবনতি অথবা পরিবর্তনগুলো অনেক স্পষ্ট হবে। মনে মনে বেশ বুঝতে পারছি, নতুন একটা পরিবর্তন আসছে। সেইজন্যেই ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, এটা যেন অসুখ সেরে ওঠার প্রথম লক্ষণ হয়। এ—পর্যন্ত দিনের পর দিন ওটা ক্রমশ খারাপের দিকে গেছে। এ—মাসে অসুখটা আরও বেশিক্ষণ স্থায়ী হওয়ায় মনে হতে পারে আমার অদ্ভুত রোগটা অবনতির দিকে আরও এক ধাপ নেমে গেছে, কিন্তু একই সঙ্গে এ—কথাও তো ভাবতে হবে, এবারে সুস্থ হওয়ার পর ওটার চিন্তাগুলো পর্যন্ত আমার মনে ছিল। এরকমটা আগে কখনও হয়নি। অন্তত পুরোপুরি পরিবর্তনটা যেদিন থেকে শুরু হল তারপর তো নয়ই। একেবারে প্রথমে অসুখটা যখন শুরু হয়, তখনও এরকম অসুখের সময়ের চিন্তা আমি মনে রাখতে পারতাম। আমি যে আবার সুস্থতার দিকে ফিরে চলেছি, এটা হয়তো তারই ইঙ্গিত। আমি হয়তো ক্রমে সেরে উঠছি। এবারে অসুখের প্রকোপটা হয়তো কম ছিল, যার জন্যে সারতে সময় বেশি লেগেছে। বুঝতে পারছি না, এখন যে—অবস্থায় আছি তার চেয়ে আর কত খারাপের দিকে আমি যেতে পারি….।

পুরোনো কথা ভাবতে গিয়ে টের পেলাম, অসুখটা ঠিক কবে শুরু হয় আমার মনে নেই। নিশ্চয়ই খুব ধীরে ধীরে ওটা প্রভাব বিস্তার করেছে আমার শরীরের ওপর। হঠাৎ একদিনে যদি এ—রোগ আমাকে গ্রাস করত তাহলে দিনটা নিশ্চয়ই স্পষ্ট মনে থাকত। দুর্বল মনের কোনোও মানুষ হয়তো সে—স্মৃতিকে মন থেকে মুছে ফেলতে চাইত, কিন্তু আমি পুরুষের মতোই তার মুখোমুখি হতাম।

যদি তখন আসল ব্যাপারটা ধরতে পারতাম, তাহলে নিশ্চয়ই যে করে হোক এ—রোগকে প্রতিরোধ করতাম। জানি না কীভাবে, কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করতাম। কিন্তু কী করে বুঝব? কুসংস্কারে কোনোকালেই আমি বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করি না ওই—ওই জিনিসটাকেও….যাতে আমি পরিণত হই মাসে একদিন। স্বর্গ, দেবতা, পরি, ডাইনি, শয়তান, এসবেও আমার বিশ্বাস নেই। আমার বাবা—মাও বিশ্বাস করতেন না। তাঁরা সবসময় সত্যি কথাটাই আমাকে বলতেন : মানুষের ভাগ্য মানুষের নিজের হাতে, ঈশ্বরের হাতে নয়। সুতরাং, কী করে আমি বিশ্বাস করি….নামটা আর উচ্চারণ করব না….ওই অদ্ভুত জিনিসটার অস্তিত্বে? জানি, এভাবে আমি সত্যকে অস্বীকার করতে চাইছি, যেন সেটা স্বীকার করলেই আমি হেরে যাব, আরও দুরারোগ্য হয়ে উঠবে আমার ব্যাধি। কিন্তু শত চেষ্টাতেও কাগজে—কলমে সে—কথা আমি লিখতে পারছি না। এমন নয় যে, এ কোনো দুর্বল মানুষের জখম মস্তিষ্কের সত্য অস্বীকারের প্রয়াস, বরং বলা যায়, এ আমার নীরব জেহাদ—ওই অসুখের প্রতি। অসুখের নামটা আমি জানি। ভালোমতোই জানি। নামটা আমার চিন্তায় ঘূর্ণির মতো পাক খায়, কখনও তলিয়ে যায়, কখনও ভেসে ওঠে। তার চরিত্র আমি জানি। কিন্তু তাকে কখনও অস্বীকার করি না। সেটুকু মনের জোর আমার আছে। সবকিছু জেনেশুনেও আমি সহজ—স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি। এ—রোগ জন্ম—মুহূর্ত থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে আমার রক্তে মিশে রয়েছে। রক্তের স্রোতের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে শরীরের প্রতিটি শিরায়, প্রতিটি ধমনীতে। আমি বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অসুখটাও তেজিয়ান হয়ে উঠছে….ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করেছে আত্মপ্রকাশের মাহেন্দ্র মুহূর্তের….আজ এসব বুঝতে পারছি। আগে বুঝতে পারিনি। বোঝা সম্ভবও ছিল না। না, এ দোষ আমার নয়।

ছোটবেলায় আমি একটু রাগী ছিলাম। কথায় কথায় চিৎকার করে হাত—পা ছুড়ে রেগে উঠতাম। কিন্তু বহু ছেলেই ছোটবেলায় ওরকম করে থাকে। ব্যাপারটা নেহাতই সাধারণ। কিন্তু কখনও আমার শারীরিক পরিবর্তন হয়েছিল বলে মনে পড়ে না। তার কোনোরকম আভাসও পাইনি। কিন্তু তবুও….হঠাৎ হঠাৎ হিংস্র হয়ে ওঠা….যখন ঝগড়া করতাম অন্য ছেলেদের সঙ্গে, কিংবা প্রিয় খেলনা আছাড় মেরে ভেঙে ফেলতাম টুকরো—টুকরো করে….সেই সময় অমানুষিক ওই রাগের যুক্তিসঙ্গত কোনোও কারণ খুঁজে পেতাম না। এমন নয় যে ওইসব ছেলেদের দেখে আমার রাগ অথবা বিরক্তি হত। অথবা মন খারাপ থাকত, তাও নয়।

মনে আছে, একবার আমাদের পাশের বাড়ির একটা ছেলে, আমারই বয়েসি তবে চেহারায় ছোটখাটো, আমার কপালে ঢিল ছুড়ে মেরেছিল। ভীষণ ব্যথা পেয়েছিলাম। কপাল ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল আমার মুখ বেয়ে। ছেলেটো ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ভয় পাওয়ার প্রথম কারণ, ঢিলটা ও অকারণেই মেরেছে। আর দ্বিতীয় কারণ, ওর চেয়ে আমার গায়ে জোর অনেক বেশি। ইচ্ছে করলেই আমি প্রতিশোধ নিতে পারি। কিন্তু তা করিনি। এমনকি আমার রাগও হয়নি। এতে ছেলেটা ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিল। কারণ ও জানত, বদরাগী বলে আমার কুখ্যাতি আছে। রক্তাক্ত মুখে আমি শুধু ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মন ছিল শান্ত। মনে আছে, জিভ দিয়ে ঠোঁটের কোণ থেকে রক্ত চেটে নিয়েছিলাম। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছিল। হয়তো কপালে আঘাত পাওয়ার জন্যেই। সুতরাং চুপচাপ দাঁড়িয়ে রক্ত চাটতে লাগলাম জিভ দিয়ে।

ওর আঘাতের প্রতিবাদ না করায় ছেলেটা নিশ্চয় ভেবে থাকবে আমি ওকে ভয় করি, কারণ ওই ঘটনার পর থেকেই ও সর্বদা আমার পেছনে লাগত। স্কুল ছুটির পর আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকত। ঢিল ছুড়ত, কখনও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিত, কখনও বা ঘুসি মারত। কিন্তু ওর ওপর কখনও আমার এতটুকু রাগ হত না। কখনও ইচ্ছে হত না ওকে পালটা ধাক্কা দিই বা ঘুসি মারি। ওর সমস্ত অত্যাচার আমি বিনা দুঃখকষ্টে মেনে নিতাম। ও বুক ফুলিয়ে অন্য ছেলেদের বলে বেড়াত আমি ওকে কী ভীষণ ভয় পাই। সবাই এ নিয়ে আমাকে ঠাট্টা করত, রাগাত। কিন্তু সেসবে আমি কান দিতাম না। অন্য লোকে কী ভাবে না ভাবে সে নিয়ে আমি কোনোওদিনই মাথা ঘামাই না। যখন রাগ হওয়াটা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত এবং প্রয়োজন, তখন আমার যে একটুও রাগ হত না, এ তারই একটা উদাহরণ।

আর অন্য সময়ে….কোনো কারণ ছাড়াই….একটা দিনের কথা মনে পড়ে। তখন সন্ধে হয়ে আসছে। আমি খেলা করছিলাম আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলনা নিয়ে। খেলনাটা একটা দম দেওয়া রেলগাড়ি। অনেকক্ষণ ঘরে ওটা নিয়ে খেলছিলাম, মনমেজাজ বেশ খুশিই ছিল। কিন্তু তারপর, হঠাৎই, ওটা হাতে তুলে নিয়ে প্রচণ্ড আছাড় মারলাম মেঝেতে। বিরাট ধাতব শব্দ তুলে ওটাকে ধ্বংস করতে লাগলাম। যতক্ষণ না ওটা টুকরো টুকরো হয়ে গেল, অফুরন্ত ক্রোধে ওটাকে চুরমার করে চললাম। এমন সময় মা ঘরে এলেন। খেলনাটা ভেঙেছি বলে ভীষণ রাগ করলেন, বললেন, আর কোনোদিনও আমাকে খেলনা কিনে দেবেন না, কিন্তু সেকথা আমি কানেই তুললাম না। এমনকি পরে, তার পরদিন, রেলগাড়িটা ভেঙে ফেলেছি বলে কোনো দুঃখও আমার হল না। যখনই ওটার কথা মনে পড়ল, তখনই মনে হল জিনিসটা ভাঙার পক্ষে বেশ জুতসই ছিল। ওটা ভেঙেছি বলে বেশ আনন্দ হল। এক অদ্ভুত তৃপ্তি।

এ ধরনের খাপছাড়া আচরণ আমাকে অন্যান্য রাগী ছেলেমেয়ের থেকে আলাদা করে তুলল। এখন বুঝতে পারছি, ওইরকম রাগ নির্দিষ্ট দিন পর পর হত, ঠিক এই অসুখটার মতো। কিন্তু তখন সেটা টের পাইনি, টের পাওয়ার কোনোও কারণও ছিল না। আমার মা—বাবাও সেটা বুঝতে পারেননি। তাঁরা ভেবেছিলেন, এ শিশুসুলভ আবেগ ছাড়া কিছু নয়। এ নিয়ে বিশেষ দুশ্চিন্তাও তাঁদের হয়নি। আর হবেই বা কেন?

মায়ের কথা আমার বিশেষ মনে নেই। হয়তো বাবার ব্যক্তিত্বের ছায়ায় মা হারিয়ে গিয়েছিলেন। বাবা ছিলেন বিশাল চেহারার পুরুষ, লম্বা—চওড়া, কঠোর প্রকৃতির। সেই সঙ্গে নীতিবাগীশ ও ধার্মিক। আমাকে সবরকম অন্যায় ছায়া থেকে বাঁচিয়ে তিনি মানুষ করেছিলেন। কখনও কখনও আমার বুকের দিকে আঙুল উঁচিয়ে গম্ভীর গলায় তিনি বক্তৃতা দিতেন। বেশিরভাগই উপদেশ। কীভাবে তিনি অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন, সবরকম কুসঙ্গ এড়িয়ে চলেছেন ইত্যাদি। বাবাকে আমি ভীষণ ভয় পেতাম। চেষ্টা করতাম ঠিক পথে চলতে। যাতে তাঁদের মুখ উজ্জ্বল হয়। আজও, এই মুহূর্তে, আমি সেই পথ থেকে সরে আসিনি—শুধু আমার এই অসুখটা ছাড়া। ভাবতে অবাক লাগে, বাবাও এই ভয়ঙ্কর অসুখটা নিজের রক্তে বয়ে বেড়িয়েছেন। সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে সেই নীতিবাগীশ, জ্ঞানী, ধার্মিক ব্যক্তিটি অভিশাপের বোঝা তুলে দিয়েছেন তাঁর পুত্রের মাথায়, মিশিয়ে দিয়েছেন আমার রক্তে। এ—অসুখ যে আমার নিজের দোষে নয়, এটা তার আরও একটা অকাট্য প্রমাণ। কারণ বাবার মতো ভালোমানুষও এই অসুখে প্রতি মাসে আক্রান্ত হতেন, আমারই মতো। আর অবাক হতেন সেই ভয়ঙ্কর রূঢ় সত্যকে আবিষ্কার করে—যেমনটা আমি হয়েছি।

মাত্র একবার বাবা আমার সঙ্গে অন্যায় করেছিলেন। নিছক অকারণেই। আমার ওপর এই একবারই তিনি রাগ করেছিলেন। কারণ পাশের বাড়ির কুকুরটাকে আমি মেরে ফেলেছিলাম। আর বাবা বুঝেও বুঝতে চাননি যে, সেই কাজটা আমাকে নিরুপায় হয়েই করতে হয়েছিল।

যে—ছেলেটি সবসময় আমার পেছনে লাগত, ঢিল ছুড়ত, আমার সেই প্রধান শত্রুরই কুকুর ছিল সেটা। ছেলেটার নাম আমার মনে নেই। ও নেহাতই সাধারণ ছিল, মনে রাখার মতো নয়। কিন্তু কুকুরটাকে আমার স্পষ্ট মনে আছে। একটা হাউন্ড। বিশাল ভয়ঙ্কর এক শিকারি জন্তু। ছেলেটা যখনই আমার পেছনে লাগত, কুকুরটা ওর সঙ্গে থাকত। মালিকের নিষ্ঠুর খেলার সঙ্গে যুক্ত হত ওটার হিংস্র গর্জন ও দাঁতখিঁচুনি। ছেলেটা আমাকে যখন বিরক্ত করত, তখন কুকুরটা হলদে চোখ মেলে আমাকে লক্ষ করত। ওটার লম্বা জিভ ঝুলে থাকত বাইরে, ধারালো দাঁত বসানো চোয়াল নড়ে উঠত এদিক—ওদিক—যেন আমার হেনস্থা দেখে মনে মনে ভীষণ খুশি হচ্ছে। সে সময় কুকুরটার দিকে তেমন মনোযোগ কখনও আমি দিইনি। কুকুরটাকে বা ছেলেটাকে, কাউকেই আমি বিশেষ আমল দিতাম না। তবে ঘৃণা করতাম বেশি জন্তুটাকেই। জানি, কুকুর যে মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু সেটা একটা প্রবাদে দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু তা নিতান্তই আবেগপ্রবণ মূর্খ ব্যক্তিদের নির্বোধ ধারণা। ভয়ঙ্কর পশুগুলোর ছলনাময় আচরণই এ—ধারণার কারণ। আর বিশেষ করে এই কুকুরটা এক নৃশংস ভয়ানক প্রাণী। তার বহুরঙা গায়ের চামড়া ও হলদে দাঁত তাকে আরও বেশি ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। ওটা কখনও আমাকে আক্রমণ করেনি, কিন্তু বলতে পারি, আমার শরীরে দাঁত বসাতে পারলে কুকুরটা খুশিই হত।

একদিন রাতে অনেক দেরি করে বাড়ি ফিরছিলাম। শহর থেকে আমাদের বাড়ি বেশ কয়েক মাইল দূরে, গ্রামে। অত রাতে বাইরে কী করতে বেরিয়েছিলাম মনে নেই, তবে বাড়ি ফেরার সময় রাত যে অনেক হয়েছিল তা স্পষ্ট মনে পড়ে। সে—রাতে আকাশে নিশ্চয়ই চাঁদ ছিল, কারণ সবকিছুই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। ওই ছেলেটার বাড়ির পাশ দিয়েই আমাদের বাড়ির পথ, কারণ একই রাস্তায় আমরা থাকতাম। ওদের বাড়িকে এড়িয়ে যেতে গেলে আমাকে জঙ্গল দিয়ে অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হয়। বিনা কারণে জঙ্গলের ঘুরপথ দিয়ে যেতে চাইনি বলেই সেই ঘটনার সূত্রপাত।

যাই হোক, আপনমনে ওদের বাড়িটা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি, কোথা থেকে উদয় হল আমার শত্রু। বরাবরের মতোই আমাকে লক্ষ্য করে পাথর ছুড়তে লাগল, আর আমিও ওকে তেমন গুরুত্ব দিলাম না। হেঁটে চললাম। ও একটা বড় পাথর সজোরে ছুড়ে মারল আমার পিঠে। প্রচণ্ড ব্যথা লাগল। বুঝলাম, পিঠে বেশ খানিকটা কেটে গেছে। কিছুটা পথ গিয়ে আমি সম্ভবত রাস্তার ধারে বসে পড়েছিলাম। ভাবছিলাম, ছেলেটা আমাকে এত ঘৃণা করে কেন, এবং একটু পরে আমিও ওকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতে শুরু করলাম। এর আগে ওর সম্পর্কে এ—ধরনের মনোভাব আমার কখনও আসেনি, হয়তো এতদিনের অত্যাচার অবিচারের যোগফল আজকের এই পুঞ্জীভূত ঘৃণা ও ক্রোধ। বসে বসেই ওর প্রতি আমার ঘৃণা ক্রমশ বাড়তে লাগল। মনে পড়ল প্রথমবারের কথা, যেবার ও আমার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল, আর আমি পেয়েছিলাম নিজের রক্তের স্বাদ। যে—কোনো কারণেই হোক, সেই রক্তের স্বাদ এখন আরও তীব্রভাবে টের পেলাম। জানি, যদি এসবের ইতি না টানি তবে ওই ছেলেটা চিরকাল আমাকে বিরক্ত করবে। সুতরাং উঠে দাঁড়িয়ে ফিরে চললাম ওদের বাড়ির দিকে।

ছেলেটা উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল—একটা ভাঙা টালির ঘরের ঠিক পাশে। আমাকে দেখতে পেয়ে ও একটা পাথর তুলে নিয়ে গালাগাল দিতে শুরু করল। নোংরা কথাগুলো শুনে আমার অসহ্য রাগ হল। এই প্রথম বুঝলাম, ছেলেটা কতখানি ছোটলোক। এতদিন কী করে যে ওর বদমাইশি সহ্য করেছি কে জানে! আমাকে বিরক্ত করার জন্যে ইচ্ছে হল ওকে শাস্তি দিই, কিন্তু শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছেটা আরও বেশি হল ওর নোংরা স্বভাবের জন্যে, কুটিল মনের জন্যে। এরকম একটা মানুষের শিক্ষা হওয়া খুব দরকার।

সোজা এগিয়ে গেলাম ওর কাছে। খুব কাছে না যাওয়া পর্যন্ত ওর গালাগাল দেওয়া বন্ধ হল না। তারপর ওর ধীর আচ্ছন্ন বুদ্ধি দিয়ে ছেলেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারল ব্যাপারটা ঠিক অন্যান্যবারের মতো হচ্ছে না, কারণ ও পেছোতে শুরু করল। আমি ওর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলাম, অত্যন্ত ধীর পায়ে। পাথরটা যখন ও ছুড়ে মারল সেটা সোজা আমার মুখে এসে লাগল, কিন্তু সে—আঘাত আমি টেরই পেলাম না। ও দৌড়ে পালাল টালির ঘরের দিকে, আর আমি চকিতে টালির ঘর ও বাড়ির মাঝে গিয়ে দাঁড়ালাম। মনে আছে, কীভাবে ওর চঞ্চল চোখ এদিক—ওদিক ছিটকে তাকাচ্ছিল সাহায্যের জন্যে, পালানোর পথ খোঁজার জন্যে।

চেহারায় আমি ওর তুলনায় অনেক বড়সড়, শক্তিও আমার বেশি—স্কুলে সমবয়েসিদের সকলের চেয়েই আমি চেহারায় বড়—সুতরাং ও ভীষণ ভয় পেল। ওর এই ভয় পাওয়া আমাকে খুশি করল না। বরং প্রতিশোধের ইচ্ছেটা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল….বুঝলাম, ও স্পষ্ট জানতে পেরেছে ওকে শাস্তি পেতে হবে, বুঝতে পেরেছে ও খারাপ। আজ যদি ওকে শাস্তি না দিই, ও ভাববে কোনো অন্যায় ও করেনি। সে আমি সহ্য করতে পারব না। ওর দিকে আরও এক পা এগিয়ে যেতেই ও পালাতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। এখন আমি অত্যন্ত ক্ষিপ্র এবং তৎপর, আর তখন তো আমার গতি ছিল শিকারি বেড়ালের মতো। দু—হাতে ওকে আঁকড়ে ধরলাম। গলা টিপে ধরে ওকে ছুড়ে ফেললাম মাটিতে। ও আমাকে লাথি মারার চেষ্টা করল, কিন্তু ওর পা দুটো একপাশে সরিয়ে আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওর দেহের ওপর। ছোট্ট হাতে আমার মুখে ঘুসি চালাতে লাগল ছেলেটা, কিন্তু সে—আক্রমণ পোকার কামড়ের চেয়েও তুচ্ছ। শক্ত দু—হাতে ওর গলা টিপে ধরলাম। শুরু হল ওর শাস্তি। ইচ্ছে ছিল, ওর পাপ অনুযায়ী ভয়ঙ্কর শাস্তিই ওকে দেব। ওর গলায় আমার হাতের চাপ ক্রমশ বাড়তে লাগল, ওর চোখজোড়া বিস্ফারিত হতে হতে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম করল। মনে মনে খুশি হলাম। উঁহু, খুশির তুঙ্গে এগিয়ে চললাম—যেন চরম এক আনন্দ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। আমার আঙুলের চাপ যত বাড়ছে, তত তাড়াতাড়ি সেই আনন্দ এগিয়ে আসছে কাছে। যেন আমার আঙুল বেয়ে উঠে আসছে কাঁধে, তারপর চুঁইয়ে চুঁইয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। ওর ঘুষি চালানো একসময় থেমে গেল। ওর ছোট ছোট হাত আমার কবজি চেপে ধরল, কিন্তু নিষ্ফল চেষ্টায়। শরীরের সমস্ত শক্তি দু—হাতে ঢেলে আমি ক্রমশ চাপ বাড়িয়ে চললাম।

ঠিক সেই মুহূর্তে নৃশংস জন্তুটা আমাকে আক্রমণ করল।

ওটা কখন যে গুড়ি মেরে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করিনি। কুকুরটা ধূর্ত এবং ভয়ঙ্কর। আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে ওকে আমার নজরে পড়েনি। ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে কুকুরটাকে নিয়ে আমি গড়িয়ে পড়লাম মাটিতে। কুকুরটা শক্তিশালী, কিন্তু সমান সমান যুদ্ধে আমার কাছে নিতান্তই শিশু। ওটাকে নীচে ফেলে চেপে বসলাম ওর শরীরে, দু—হাতে গলার বেল্টটা আঁকড়ে ধরে মোচড় দিতে লাগলাম। ক্রমে পশুটার দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। কুকুরটার ধারালো দাঁতে আমার হাতের মাংস ছিঁড়ে গেছে হাত বেয়ে রক্ত ঝরে পড়ছে কুকুরটার লোমশ শরীরে।

রক্ত দেখে আমার সবকিছু গোলমাল হয়ে গেল। মাথায় বেজে উঠল অমানুষিক তীব্র এক টঙ্কার। তখনই বুঝলাম, পশুটা কত ভয়ঙ্কর এবং ওটাকে ধ্বংস করা কতখানি প্রয়োজন। গলার বেল্টে মোচড় বাড়াতেই বেল্টের চামড়া কেটে বসল ওটার লোমশ নরম গলায়। কুকুরটার লম্বা জিভ চোয়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে বাইরে। ওটার মাথা প্রচণ্ড জোরে ঠুকে দিলাম মাটিতে—যাতে পশুটার দাঁতগুলো ঢুকে যায় ওর নিজের হাসি মাখানো জিভে।

কুকুরটার মুখে বিশ্রী ধূর্ত হাসিটা এখন আর নেই। আর ওর চোখের দৃষ্টিরও কোনো তুলনা নেই। বুঝলাম, কুকুরটা মরতে চলেছে। আর, নিজেও বুঝেছে, ওর নৃশংসতার শাস্তি ওকে এইভাবে পেতে হচ্ছে। ওটার চোখ দুটো হলদে সেদ্ধ ডিমের মতো পাক খেয়ে বেরিয়ে আসতে চাইল কোটরের বাইরে। আমার হাসি পেল, কিন্তু সেরকম হাসলাম না। কারণ, তাতে আমার হাতের বাঁধন আলগা হয়ে যেতে পারে। তাই, পুরোপুরি মরে না যাওয়া পর্যন্ত ওটাকে ছাড়লাম না।

অবশেষে যখন উঠে দাঁড়ালাম, দেখলাম, ছেলেটা সামলে উঠে পালিয়েছে। সম্ভবত বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। হয়তো ওকে অনুসরণ করতাম, কিন্তু যে—কোনো কারণেই হোক ওর প্রতি আর আমার কোনো ঘৃণা নেই। হয়তো ভেবেছি, অপরাধের যথেষ্ট শাস্তি ও পেয়ে গেছে। হলফ করে বলতে পারি, আর কখনও আমাকে বিরক্ত করবে না। চাঁদের আলোয় কুকুরটাকে দেখাচ্ছে তেলকালি মাখানো নরম ন্যাকড়ার মতো। আমার ভালো লাগল। কাজটা বেশ নির্ঝঞ্ঝাটে শেষ হয়েছে। খুশি মনে ফিরে চললাম বাড়িতে। হাতের ব্যথা সেদিন অনেক দেরিতে টের পেয়েছিলাম।

পরদিন সকালে ছেলেটার বাবা এলেন আমাদের বাড়িতে। কীসব কথাবার্তা বললেন আমার বাবার সঙ্গে। তিনি চলে গেলে বাবা আমাকে ডাকলেন। দেখলাম, বাবা ভীষণ রেগে গেছেন। তাঁকে বুঝিয়ে বললাম, আত্মরক্ষার জন্যে ওই কাজ আমাকে করতে হয়েছে, নয়তো কুকুরটাই আমাকে মেরে ফেলত। কিন্তু বাবার ধারণা আমি ছেলেটাকে প্রথমে মারধোর করেছি এবং কুকুরটা ওকে বাঁচাতে গিয়ে মারা গেছে। এমনকি বাবাও ওইসব আজগুবি কথা বিশ্বাস করতেন যে, কুকুর অত্যন্ত প্রভুভক্ত প্রাণী। আর আমি তাঁকে বোঝাব সাধ্য কী! হাতের কাটা জায়গাগুলো বাবাকে দেখালাম, কিন্তু কোনো ফল হল না। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, আমি ছেলেটাকে মারতে গেছি। কী অদ্ভুত! ওই একবারই বাবা আমার ওপর অবিচার করেছিলেন। এবং কিছুদিনের মধ্যেই সে—ঘটনা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন।

এরপর আর কখনও কেউ আমাকে ঠাট্টা করেনি বা পাথর ছোড়েনি।

৭ জুন

আজ খুব সকাল সকাল উঠেছি। ইচ্ছে আছে দুপুরে খাওয়ার আগে পর্যন্ত এই ডায়েরি লিখব। কুকুরটার বিষয়ে গতকালের লেখাটা আর একবার পড়লাম। মনে হয় না অসুখটার সঙ্গে এ—ঘটনার কোনো সম্পর্ক আছে। বলতে গেলে নিজেকে বাঁচানোর জন্যেই কুকুরটাকে সেদিন আমি মেরে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলাম। অন্য কেউ হলেও তাই করত। কিন্তু এ থেকে আমার শারীরিক ক্ষমতার কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়। এ ছাড়া স্বাভাবিক অবস্থায় আমার সহ্যশক্তি যে কতখানি তারও আন্দাজ পাওয়া যাবে। সুতরাং কাগজে—কলমে এর উল্লেখের প্রয়োজন আছে। এখন অসুখের শুরুর সময়কার ঘটনাগুলো মনে মনে আবার ঠিক করে নিয়ে স্পষ্টভাবে লেখার চেষ্টা করব। সময়ের সঙ্গে অসুখটার তীব্রতা কীভাবে বেড়ে চলেছে তাও আমি ভালোভাবে গুছিয়ে লিখে রাখতে চাই—যাতে বুঝতে পারি, এরপরের পরিবর্তনটা কীভাবে আমার জীবনে আসতে চলেছে।

ওই সময়কার যে—ছবিটা আজও আমার মনে জোরালো ও স্পষ্ট তা হল বন—জঙ্গল। গ্রামে এক বিশাল জীর্ণ বাড়িতে আমরা থাকতাম। তার পেছনেই ছিল গভীর জঙ্গল। বাড়িটায় হাওয়া—বাতাস ছিল প্রচুর, আর ছিল এক অদ্ভুত ঠান্ডা স্যাঁতসেঁতে ভাব। সেটা আমার একটুও ভালো লাগত না। কিন্তু জঙ্গলে আমার সবসময় ভালো লাগত—শুধু ওই অদ্ভুত সময়গুলো ছাড়া। আর ভালো লাগত একা—একা জঙ্গলে যেতে। নির্জন জায়গায় নিজেকে কেমন যেন নিরাপদ মনে হয়।

জঙ্গলের ছবিটা এখনও আমার মনে আছে। অবশ্য চাঁদের আলো ছাড়া সে—ছবি আমি কল্পনায় আনতে পারি না। দিনের আলোয় দেখা জঙ্গলের দৃশ্য আমার মনে ধূসর, অস্পষ্ট। হতে পারে দিনের আলোয় অন্যান্য আকর্ষণই এই অস্পষ্টতার কারণ, এ ছাড়া নির্দিষ্ট কোনো স্মৃতি সবসময়েই তাৎক্ষণিক অনুভবের শিকার হয়ে পড়ে। কিন্তু রাতে! একটা রাতের কথা আমার মনে আছে….না কি অনেক রাতের স্মৃতি একই রকম হওয়ায় সেগুলো একটা রাতের স্মৃতিতে মিশে গেছে?

চারপাশের লম্বা লম্বা শালগাছের মাঝে একটু খোলা জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। জঙ্গলটা একটা ছোট পাহাড়ের ওপর, আর পাহাড়ের নীচে ঘন অন্ধকার ছায়ায় লুকিয়ে রয়েছে আমাদের বাড়িটা। উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে বাড়ির ছাদটা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। জায়গাটা অন্ধকার হলেও গাছের মাথাগুলো চাঁদের আলোয় রুপোর মতো চকচক করছে। হাওয়ায় দুলছে অসংখ্য রুপোর পাত। চারদিক ভীষণ শান্ত, কয়েক টুকরো পেঁজা তুলোর মতো মেঘ চাঁদকে পাশ কাটিয়ে ভেসে যাচ্ছে দূরে। ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে এক আকুল আকাঙ্ক্ষা আমাকে গ্রাস করল, কিসের যেন এক অস্পষ্ট অদ্ভুত ইচ্ছে। বসন্তকালে যেমনটা হত, অনেকটা সেইরকম। স্কুলে বসে জানলা দিয়ে আকুল চোখে চেয়ে থাকতাম বাইরের কচি ঘাস আর রঙিন ফুলের দিকে। কী যেন একটা করতে ইচ্ছে করত।

কিন্তু এ—ইচ্ছে তার চেয়েও অনেক বেশি তীব্র। কী যেন আমাকে করতে হবে অথচ করতে পারছি না। তখন ভেবেছিলাম এ হয়তো কোনো যৌন কামনা। হয়তো সেই জন্যেই জামা—প্যান্ট সব খুলে ফেলেছিলাম—এমনকি জুতো—মোজা পর্যন্ত। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম বনের মধ্যে। ঠান্ডা ছিল না, কিন্তু আমার কাঁপুনি আসছিল। চাঁদের আলোর এক তীক্ষ্ন রুপোলি বর্শা গাছের ঘন পাতা ভেদ করে এসে ঠিকরে পড়েছে শুকনো পাতা ছাওয়া মাটিতে। তার শীতল দ্যুতি আমাকে যেন বরফ করে দিল। আর আমি শুধু দাঁড়িয়ে রইলাম। মাথা পেছনে হেলিয়ে, মুখ হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁপতে লাগলাম। যেন আমার শরীরের প্রতিটি শিরায়, প্রতিটি স্নায়ুতে ভয়ঙ্কর এক তড়িৎপ্রবাহ ছুটে চলেছে। কতক্ষণ ওইভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ, কারণ তখন রাত ভোর হয়ে এসেছে। হঠাৎ সব কিছু শেষ হয়ে গেল। সেই ইচ্ছেটাও আচমকা গেল মিলিয়ে। খেয়াল করলাম, আমি চিৎকার করছি। ঠিক চিৎকার নয়—অনেকটা কোনো পশুর গর্জনের মতো, যেন কোণঠাসা কোনো জন্তুর আর্তনাদ। একসময় থামলাম। চারদিক নিস্তব্ধ ছায়া ছায়া অন্ধকার। কেমন অদ্ভুত লাগছে। নিজেকে ভীষণ নগ্ন লাগছে, একা লাগছে। এইসব করেছি বলে লজ্জা করছে।

তখনও আমার ধারণা ছিল এর সবটাই যৌন কামনা। কিন্তু একটা বিচিত্র স্বস্তিও পেলাম। জামাকাপড় পরে ফিরে এলাম বাড়িতে। সে—মাসে আর তেমন কিছু হয়নি। সবকিছুই ঠিকঠাক চলেছিল। মনে ফিরে এসেছিল প্রশান্তি। যা বলছিলাম, এটা কোনো বিশেষ স্মৃতি, না কি বহু মাস বহু রাতের একই স্মৃতির যোগফল, তা জানি না। তখন আমি নিশ্চয়ই খুব ছোট ছিলাম….।

এইমাত্র যা লিখেছি তাই নিয়েই ভাবছিলাম। মনে হয় এ—ঘটনা একবার নয়, বহুবারই ঘটেছে। টুকরো টুকরো স্মৃতি মনে পড়ে : আমি নগ্ন হয়ে জঙ্গলে দৌড়চ্ছি, গুড়ি মেরে বসে আছি গাছপালার আড়ালে, ওত পেতে রয়েছি কোনো পাথরের পেছনে। ঘটনাগুলোই শুধু আমার মনে আছে, সে—সময়কার ভাব—অনুভূতি কিছু মনে নেই। যেমন মনে আছে বন্ধ পাতালঘরে ওটার দুরন্ত দাপাদাপির স্মৃতি। মনে হয় না, জঙ্গলে আমি কারও ভয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিলাম বা লুকিয়ে ছিলাম গাছপালার আড়ালে। শুধু এটুকু বলতে পারি, জঙ্গলে আমি একা ছিলাম—একেবারে একা।

তখন কোনোরকম শারীরিক পরিবর্তন যে আসেনি সেটা স্পষ্ট মনে পড়ে। কোনোরকম সন্দেহ তাতে নেই। আর আশ্চর্য, কবে যে প্রথম পরিবর্তনটা এল তা আমার মনে নেই। পরিবর্তনটা সম্পর্কে কীভাবে সচেতন হলাম তাও জানি না। এটা নিশ্চয়ই অত্যন্ত ধীরে ক্রমে ক্রমে এসেছে। যার ফলে কোনোরকম স্পষ্ট দাগ আমার স্মৃতিতে নেই।

পরিবর্তনের প্রথম যে—স্মৃতি মনে পড়ে সেটা হয়েছিল আমার শোওয়ার ঘরে, জঙ্গলে নয়। সম্ভবত এটা অসুখ শুরু হওয়ার অনেক পরের ঘটনা। আমি সেদিন বিছানায় বসেছিলাম, ঝুঁকে পড়ে পরীক্ষা করছিলাম আমার হাত দুটো। বিছানাটা জানলার ঠিক পাশে। জানলায় তাকালে সরাসরি চোখে পড়ে রুপোলি চাঁদ, শোওয়ার ঘরে চাঁদের আলোয় ছায়ার লুকোচুরি।

হাত দুটো রাখা ছিল আমার কোলে, আলোর এক তীক্ষ্ন ফলা ঠিকরে পড়েছে তাদের গায়ে। আমি সম্পূর্ণ নগ্ন। শরীরের তুলনায় আমার শিরদাঁড়াকে আরও বেশি নগ্ন লাগছে। যেন সেখান থেকে চামড়া পর্যন্ত ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। বসে বসে লক্ষ করছি নিজের হাত দুটো। এ প্রথমবারের ঘটনা হতেই পারে না, কারণ আমি যেন জানতাম কিসের প্রত্যাশায় আমি অধীরভাবে অপেক্ষা করছি। মনে আছে, আমার হাতের নখগুলো কীভাবে বাড়তে শুরু করল, হাত কাঁপতে লাগল, চামড়া খসখসে হয়ে কুঁচকে এল, আঙুলগুলো ক্রমশ বেঁকে যেতে লাগল কোনো পশুর….।

তারপর কী করেছি মনে নেই।

৮ জুন

তন্দ্রা বউ হিসেবে খুব ভালো।

ও যা সহ্য করে আর কোনো মেয়ে করত কিনা জানি না। মিথ্যে কথা বলব না, ওকে দেখতে তেমন একটা সুন্দরী নয়। হয়তো প্রেম—ভালোবাসার নদীতে শেষ কুটো হিসেবেই ও আমাকে আঁকড়ে ধরেছে, কিন্তু আমি তা মনে করি না। আমি বিশ্বাস করি ও আমাকে ভালোবাসে। আমার অসুখের কথাটা ও মাঝে মাঝে বুঝতে চায় না দেখে আমি বিরক্ত হই, কিন্তু এ ছাড়া ও খুব ভালো মেয়ে। ওর বোঝা উচিত আমি কখনও ওর ক্ষতি করব না। ওর কেন, কারও ক্ষতি করব না। কারও যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্যে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি। আসলে আমি ভীষণ লাজুক এবং শান্ত। এই কারণেই আমার অসুখটাকে নিছক শারীরিক বলে বুঝতে না পারলে লোকের চোখে ওই দু—রকম ব্যাপারটা প্রকট হয়ে ওঠে। লোকে বোঝে না, তখন আমি অন্য কিছু হয়ে যাই, হয়ে উঠি বিপজ্জনক। কিন্তু তবুও নিজেকে কোনোরকম আমি সামলে নিয়েছি, আর সেইজন্যেই কাউকে কখনও আমি আঘাত করিনি, কারও কোনো ক্ষতি করিনি।

তন্দ্রাকে কথা দিয়েছি আজ ওকে বাইরে খাওয়াতে নিয়ে যাব। শুনে ও ভীষণ খুশি হয়েছে। আমরা খুব একটা বেরোই না। জমকালো জীবন আমার ভালো লাগে না। আমি ঘরে থাকতেই ভালোবাসি। কিন্তু মাঝে—মধ্যে বেরোলে মন্দ কী! তন্দ্রাও বেড়াতে ভালোবাসে, তবে আমার সঙ্গে এ—বিষয়ে ও একমত যে, এ—ধরনের বেড়ানো—টেড়ানো বছরে দু—তিনদিনের বেশি না হওয়াটাই ভালো। ও জামাকাপড় পরে তৈরি হচ্ছে। যদি রাত না হয়ে যায় ফিরে এসে আবার লিখতে বসব।

উঃ আজকের সন্ধেটা কি বিচ্ছিরিই না কাটল!

এইমাত্র আমরা ফিরেছি, আর তন্দ্রা সোজা ওর ঘরে গিয়ে ঢুকেছে। হয়তো আমার ওপর রাগ করেছে। আজ বেরোনোর আগে আমার দশবার ভাবা উচিত ছিল। মেয়েদের মরজি স্বয়ং ভগবানও বুঝতে পারেন না। ওরা জীবন সম্পর্কে ভীষণ অবুঝ।

সন্ধের শুরুতেই গোলমাল। তন্দ্রা এমন একটা ব্লাউজ গায়ে দিল যেটা ও জানে আমি ভীষণ অপছন্দ করি। ব্লাউজটা কাঁধ খোলা হাতকাটা, কদর্য রুচির। এটা পরলে ওকে বেশ্যার মতো দেখায়। প্রথমে ভালো কথায় বলতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু সহজ সত্যিটা শুনে ও বিরক্ত হল। মেয়েরা কেন যে সত্যি কথা শুনলে রাগ করে, আর মনভোলানো প্রশংসায় খুশি হয়, কে জানে! আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখলেই আমার কথাটা যে কতখানি সত্যি তা ও বুঝতে পারত। এত বছর বিয়ে হওয়ার পর অন্তত জানা উচিত বিনা কারণে তোষামোদ করা আমার স্বভাব নয়, আর নিজের বউয়ের কদর্য বেশবাস আমি কখনও বরদাস্ত করি না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই ব্লাউজটা ও পরল, এবং বাড়ি থেকে বেরোনোর আগেই সে নিয়ে একপ্রস্থ ঝগড়া হয়ে গেল। অবশেষে ওর কাছে হার মানলাম। কিন্তু সেটাই হল আমার ভুল। এনিয়ে সারাটা রাত যে আমার মেজাজ তিরিক্ষে হয়ে থাকবে সেটা আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল।

রেস্তোরাঁয় ঢুকে একটা খালি টেবিল দেখে বসতেই লক্ষ করলাম বেশ কয়েকজন লোকের নজর তন্দ্রার দিকেই। কিন্তু ও সেটা খেয়াল করেছে বলে মনে হল না। ও হাসিখুশি হয়ে বসল, দেখতে লাগল ঘরের চারদিকে। আমার বিশ্বাস, ঘরের প্রতিটি লোক নির্ঘাত ভেবেছে ও ফষ্টিনষ্টি করার জন্যে কাউকে খুঁজছে। ওর ওই পোশাক দেখে আর কী—ই বা তারা ভাববে? অপমানে মাটিতে মিশে গেলাম। লোকগুলোর মনের ভাব আমি সহজেই অনুমান করতে পারছি। তন্দ্রাকে দেখে ওরা ভেবেছে কোনো বেশ্যাকে আমি রাস্তা থেকে তুলে এনেছি। লিপস্টিকের কল্যাণে ওর ঠোঁটজোড়া টুকটুকে লাল, সামনে ঝুঁকে বসায় বুকের উপত্যকা উন্মুক্ত। টেবিল ছেড়ে উঠে যেতে নেহাত লজ্জা হল, নইলে সেই মুহূর্তেই রেস্তোরাঁ ছেড়ে বেরিয়ে পড়তাম। প্রতিজ্ঞা করলাম, বাড়ি ফিরেই ওই ব্লাউজটা জ্বলন্ত উননে গুঁজে দেব। তাহলে আর কোনোদিন আমাকে এরকম লজ্জায় পড়তে হবে না। আর আশ্চর্যের কথা, বেচারা তন্দ্রা টেরও পাচ্ছে না ওকে নিয়ে সবার মনে কী কাণ্ডটাই না হয়ে চলেছে। ও এতই সরল আর নিষ্পাপ! খুশি হয়ে ও চারপাশে দেখতে লাগল, আর আমি কাউকে না দেখার ভান করতে লাগলাম। যদিও নজরে সবাইকেই পড়ছিল। রেস্তোরাঁয় আরও ক’জন মেয়ে ওই ধরনের কি তার চেয়েও বাজে পোশাক পরে এসেছে। তখনই বুঝলাম, রেস্তোরাঁটা বিশেষ সুবিধের নয়। এখানে আমাদের আসা ঠিক হয়নি। এখানে আগে কখনও আসিনি। কিন্তু রেস্তোরাঁটার নাম আছে। আর সেই নাম শুনে আমি ঠকেছি। রেস্তোরাঁর দেওয়ালের রং গোলাপি। ঘরের আলো প্রয়োজনের তুলনায় কম উজ্জ্বল। সেই অল্প আলোতেও দেওয়ালে আঁটা স্তনসর্বস্ব অভিনেত্রীদের নোংরা ছবিগুলো স্পষ্ট চোখে পড়ছে। মেনু কার্ডে দেখলাম, খাবারের দাম অত্যন্ত বেশি। স্বাভাবিক।

বেয়ারা এসে তন্দ্রার পেছন থেকে টেবিলে ঝুঁকে পড়ল। একটু বেশিই। হলফ করে বলতে পারি, ব্যাটা তন্দ্রার লো—কাট ব্লাউজের ভেতরে উঁকি মারার চেষ্টা করছে। লোকটার সেই আঠালো হাসিটা মনে পড়লে এখনও আমার রাগ হচ্ছে। বেয়ারাটার সরু গোঁফ ও কোঁকড়ানো বাবরি চুল। কথাবার্তার ভঙ্গিও কেমন অদ্ভুত। সুতরাং সে যদি অর্ডার ভুল করে অন্য খাবার নিয়ে আসে তাহলে আমার ধৈর্যের বাঁধ যে ভেঙে পড়বে তাতে আর আশ্চর্য কী।

এমনিতে বিদেশি খাবার আমি খুব একটা পছন্দ করি না। কিন্তু তন্দ্রার কথা মনে রেখেই অপছন্দের কাজ আমাকে করতে হয়। বেয়ারাকে বলেছিলাম ফ্রায়েড রাইস আর চিলি প্রন নিয়ে আসতে। তন্দ্রা চিংড়ি মাছ ভালোবাসে। যখন সে ফিরে এল, তার হাতে চাও—মিন আর সুইট অ্যান্ড সাওয়ার প্রন। দেখলে বমি আসে। শুরু থেকে এত দেখে এটা আর হজম করা যায় না। রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক, কিন্তু তা হলেও নিজেকে সংযত করা উচিত ছিল। তন্দ্রাও বলছে, প্লেট দুটো আমার বেয়ারার মুখে ছুড়ে মারা উচিত হয়নি। কিন্তু তাতে আমার বিন্দুমাত্রও দুঃখ নেই। এই হ্যাংলা মানুষগুলোর স্পর্ধা অসহ্য। রাগের মাথায় কোনো ভাবনাচিন্তা না করেই যা করার করে ফেলেছি। দু—হাতে দুটো খাবারের প্লেট তুলে নিয়ে চকিতে বসিয়ে দিয়েছি বেয়ারাটার দু—গালে। লোকটা সামনের দিকে ঝুঁকে নোংরাভাবে হাসছিল। খাবারে মাখামাখি মুখ নিয়ে সটান পড়ে গেল মেঝেতে। এরকম পরিস্থিতিতে বোধহয় এর চেয়ে ভদ্র ব্যবহার করা যায় না। আমি চিৎকার করে গালিগালাজও করিনি, লোকটাকে কোনো কথাও বলিনি, আর হাত—পা ছুড়ে ভিড়ও জমাইনি। শুধু প্লেট দুটো ওর মুখে ছুড়ে মেরেছি।

তারপর আমরা বেরিয়ে এসেছি। কেউ আমাদের বেরিয়ে যেতে বলেনি। আমরা নিজে থেকেই চলে এসেছি। নোংরা ব্যবহারের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ায় রেস্তোরাঁর লোকগুলো মনে হয় আমার ওপর খুশিই হয়েছে। বেরিয়ে আসার সময় তন্দ্রা কাঁদছিল। চারপাশে তাকিয়ে দেখি সকলেই আমাদের দিকে তাকিয়ে। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে তারা তন্দ্রার শরীরের দিকে তাকিয়ে। কেউ কেউ ক্রুদ্ধভাবে এই ঘটনা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা কাটাকাটি করছে, কেউ বা হাসাহাসি করছে। কিন্তু আমি সেসব গায়ে মাখলাম না। মাথা সোজা রেখে সদর্পে রেস্তোরাঁ ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। এতটুকু সময়ের জন্যে নিজেদের সম্মান আমি নষ্ট হতে দিইনি।

তন্দ্রা কিছুতেই বুঝবে না, এর সবটাই ওর দোষ। ও সোজা ওর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। দরজায় খিল দেওয়ার শব্দ আমি শুনেছি। একে মেয়েলিপনা ছাড়া আর কী বলব। আমি কখনও ওর ঘরে যাই না।

যাই হোক, আজ সন্ধের ঘটনায় তন্দ্রার অন্তত একটা শিক্ষা হবে। এবারে ও হয়তো বুঝবে এত ঘন ঘন বাইরে বেরোনোটা ঠিক নয়।

৯ জুন

আজ সকালেও তন্দ্রার রাগ পড়েনি। কিছুক্ষণ তো আমার সঙ্গে কথাই বলেনি। তাতে ক্ষতি নেই, কারণ তখনও আমার মনে ঘুরছে সেই সন্ধেটার কথা, মনে পড়ছে বীভৎস রেস্তোরাঁটার কথা। কিন্তু ও একবার বলে বসল, অমন বিনা কারণে আমার নাকি রেগে ওঠাটা ঠিক হয়নি। বিনা কারণে! এমনকি এরকম ইঙ্গিতও দিল যে, এটা আমার রোগের একটা লক্ষণ! মাসের এই মাঝামাঝি সময়ে! এতেই বোঝা যায়, রোগটাকে তন্দ্রা এখনও ঠিক চিনে উঠতে পারেনি। টেবিলের কানা আঁকড়ে ধরে নিজেকে সংযত করেছি, ওকে কোনো কথা বলিনি। কিন্তু আমার মুখে সম্ভবত ভয়ঙ্কর রাগ ফুটে উঠেছিল, কারণ তন্দ্রা কোনো কথা না বলে উঠে চলে গেল। ওকে দেখে মনে হল যেন শাস্তি পেয়েছে।

ওর বোকামোর ব্যাপারে আমাকে আরও ধৈর্য ধরতে হবে। কোনো সুস্থ—স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে জিনিসটা বুঝে ওঠা বেশ কষ্টকর। তন্দ্রাকে যেদিন অসুখটার কথা সমস্ত খুলে বলেছি, তখন ও যা আঘাত পেয়েছে তা বলার নয়। মাঝে মাঝে মনে হয় ওই আঘাত ওকে মানসিক দিক থেকে অসুস্থ করে তোলেনি তো? সেরকম না হলেও কিছুটা অসুস্থ ও হয়েছে। নইলে মাঝে মাঝে অমন যুক্তিহীন কাজ করে বসে কেন? যেমন ওর ধারণা ওই বেশ্যা—মার্কা ব্লাউজটায় ওকে দারুণ মানায়, তারপর বাচ্চা মেয়ের মতো রোজ সন্ধেয় বেড়াতে বেরোনোর বায়না, আর যুক্তিসঙ্গত সত্যিকারের রাগকে আমার রোগের লক্ষণ বলে মনে করা। নাঃ, ওর ব্যাপারে আমাকে আরও ধৈর্য ধরতে হবে। বেচারা!

যখন আমাদের বিয়ে হয় তখন পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিল না। আরও পরে, অনেক পরে, অসুখটা খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই খারাপের দিকে যাওয়াটা এত ধীরে হয়েছে যে, আমি আগে থেকেই তা অনুমান করতে পেরেছি, এবং কোনোরকম দুর্ঘটনা যাতে না হয় তার বন্দোবস্ত করেছি। অবশ্য তখন পাতালঘরটা হয়নি—তৈরি করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। প্রয়োজন যখন হল, তখন ওটা তৈরির জন্যে হাতে প্রচুর সময়ও ছিল।

হ্যাঁ, পরিবর্তন আমার একটা হত। তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এখনকার মতো এতটা হত না। পুরোটা তো হতই না। তখনও আমাকে মানুষের মতোই দেখাত। প্রথমদিকে, যখন আয়নায় তাকাতে ভয় পেতাম না, নিজের চেহারা আমি দেখেছি। স্পষ্ট মনে আছে, আমার মুখ দেখে মনে হত যেন সপ্তাহখানেক দাড়ি—গোঁফ কামাইনি। ব্যস, আর কিছুই নয়। দাঁতগুলো ছিল লম্বা, কিন্তু তখনও পর্যন্ত সেগুলো ঠোঁট দিয়ে ঢাকা দিতে পারতাম। দেখে মনে হত আমার দাঁত উঁচু। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল চোখ দুটোর। সে দুটো নিঃসন্দেহে ছিল কোনো জন্তুর চোখ—অন্তত মানুষের চোখ তো নয়ই। কিন্তু যে আমার অসুখের কথা জানে না, জানে না স্বাভাবিক সময়ে আমাকে কেমন দেখায়, তার চোখে মোটেও অস্বাভাবিক কিছু ধরা পড়বে না। তারা শুধু ভাববে আমাকে দেখতে অত্যন্ত কুৎসিত।

নিজেকে সামলে রাখার ক্ষমতা সে—সময়ে আমার ছিল। অসুখটার দাপটে কখনও কাবু হতাম না। শুধু শরীরের ভেতর ওটা জ্বরের মতো আগুন জ্বালিয়ে দিত। আর আমিও মোটামুটিভাবে ‘আমি’তেই থাকতাম। এসব পাতালঘরের দরকার হয়ে পড়ার অনেক আগের ঘটনা। তন্দ্রাকেও তখন এ—অসুখের কথা বলিনি। সব গোপন রেখে ওকে বিয়ে করাটা হয়তো আমার অন্যায় হয়েছে, কিন্তু কখনও ভাবিনি অসুখটা আরও খারাপের দিকে মোড় নেবে। আর আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, তন্দ্রাকে সব জানিয়েও কোনো লাভ হত না। আমাকে ও বিয়ে করতই।

সেইসব রাতে, যখন অসুখটা হত, আলো নিভিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তাম। অবশ্য আমাদের শোওয়ার ঘর আলাদা। তন্দ্রাকে বলতাম, আমার শরীরটা ভালো নেই—ও আর আমাকে বিরক্ত করত না। ক্রমে ক্রমে অসুখের মাসিক নিয়মটা নিশ্চয়ই ও খেয়াল করেছিল, কারণ একবার এই মাসিক অসুখ নিয়ে ও বেশ একটা স্থূল রসিকতা করে আমার সঙ্গে। আর আমিও স্বামীকে কী বলা উচিত না বলা উচিত, তার ওপরে এক জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে ফেলেছিলাম।

কিন্তু ক্রমে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে লাগল। অবশেষে ঠিক করলাম, আর ঝুঁকি নেওয়া ঠিক নয়, তাই মাসে একবার করে শহরের বাইরে চলে যেতে লাগলাম। ওকে বলতাম ব্যবসার কাজে যেতে হচ্ছে। আমার ধারণা, ও অবিশ্বাস করত না। ওর কথাবার্তায় সন্দেহের কোনো সুর ছিল না, আর এই বাইরে যাওয়া নিয়ে অশ্লীল কোনো ঠাট্টাও করত না। ও জানত, রক্ষিতা পোষা অথবা মাসে একটা রাত পয়সা দিয়ে ফুর্তি লুটতে যাওয়া আমার চরিত্রের বাইরে। সুতরাং ও আমাকে বিশ্বাস করত। কোনো প্রশ্ন করত না।

আমি চলে যেতাম তিরিশ—চল্লিশ মাইল দূরের কোনো ছোট টাউনে। প্রতি মাসে এক নতুন টাউন বেছে নিতাম। গিয়ে উঠতাম কোনো ছোট সস্তা হোটেলে। কারণ, সস্তার হোটেলে খোঁচা খোঁচা দাড়িওলা কুৎসিত কোনো লোককে কেউ খেয়াল করবে না। সেখানে একটা ছোট্ট নোংরা ঘরে কাটিয়ে দিতাম ভয়ঙ্কর সেই দীর্ঘ রাত। অবস্থা যত খারাপই হোক না কেন, সারাটা রাত ঘর ছেড়ে এক মুহূর্তের জন্যেও বেরোতাম না। আর অবস্থা খারাপ কাকে বলে! ভীষণ ইচ্ছে করত বাইরে বেরিয়ে পড়তে। কী যেন একটা….করতে ইচ্ছে করত….হয়তো নগ্ন হয়ে জঙ্গলে ছুটে বেড়ানোর ইচ্ছেটা আবার মাথাচাড়া দিত। কিন্তু প্রচণ্ড যুদ্ধ করে সে—ইচ্ছেকে দমন রাখতাম। ঘর ছেড়ে বেরোতাম না। ভেতর থেকে সবসময় দরজায় তালা দিয়ে রাখতাম। কেউ আমাকে বাইরে থেকে তালা দিয়ে রাখলে হয়তো আরও ভালো হত, কিন্তু হোটেলের কোনোও বেয়ারাকে তো সে—অনুরোধ করা যায় না! তাতে লোকের সন্দেহ হত। সুতরাং নিজের মনের জোরের ওপর ভরসা করতেই হত। সৌভাগ্যবশত আমার মন অত্যন্ত শক্ত, তাই কোনোরকমে সব সামলে নিতাম। সময়ে সময়ে অবস্থা ভীষণ খারাপ হয়ে পড়ত, কিন্তু তাও হার স্বীকার করিনি।

আরও পরে যখন বুঝলাম ব্যাপারটা ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন পাতালঘরের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। এ—পরিকল্পনা অনেকদিন ধরেই মাথায় ঘুরছিল। সুতরাং তন্দ্রাকে অসুখের কথা সব খুলে বললাম। সে যে কী কষ্ট! তন্দ্রা বুদ্ধিতে দুনিয়ার সেরা নয়, তাই প্রথমটায় পুরো ব্যাপারটা ইয়ার্কি মেরে উড়িয়ে দিল। বিশ্বাসই করতে চাইল না। ভাবল, আমি ঠাট্টা করছি। কিন্তু যখন কন্ট্রাক্টর ডেকে পাতালঘর তৈরির কাজ শুরু করলাম, তখন ও বুঝতে পারল আমি ঠাট্টা করছি না। হয়তো ভাবল, আমার মাথার ঠিক নেই। নাঃ, সে—কথা ও মুখে কখনও বলেনি। তবে ওর চাউনিতে, সেটা স্পষ্ট বোঝা যেত। যখন পাতালঘরের দেওয়ালে গদি মোড়ার কাজ শুরু হল, তখন ও আপনমনেই গজগজ করত আর মাথা নাড়ত। যেন বলতে চাইত, এ—পাগলামির কোনো মানে হয়! কোনো মানে হয় এসব পণ্ডশ্রমে সময় নষ্ট করার? এ—মনোভাব হওয়াটাই স্বাভাবিক। ওকে একটুও দোষ দেওয়া যায় না।

অবশ্য এখন ও বোঝে। ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে। যদিও মাঝে মাঝে বোকার মতো ভুল করে, শরীরের আর মনের অসুখের পার্থক্যটা বুঝতে চায় না, বুঝতে চায় না স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিকের তফাত। পারবে, সময় হলেই পারবে।

পাতালঘর তৈরি হয়েছে আজ ছ—মাস। প্রতি মাসেই সে—ঘরে আমাকে যেতে হয়েছে, আর তন্দ্রাও বিনা প্রশ্নে ওর কর্তব্য পালন করেছে। ও বউ হিসেবে খুব ভালো। মাঝে মাঝে ওর নির্বুদ্ধিতায় বা অবুঝ ব্যবহারে আমি যে সামান্য বিরক্ত হই সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। সংসারে এমনটা হয়েই থাকে—বিশেষ করে যখন স্বামী—স্ত্রীর মধ্যে বুদ্ধির তফাতটা এত বেশি।

আমার বউকে নিয়ে আমি খুশি। ওর দোষ—ত্রুটির ব্যাপারে আমাকে আরও ধৈর্য ধরতে হবে। অবুঝ বলে ক্ষমা করতে হবে। ওর মনে কোনোরকম আঘাত দিলে চলবে না। আঘাত আমি কাউকে কখনও দেব না….।

৯ জুন, দুপুর

প্রতি মাসের সেই বিশেষ রাতে তন্দ্রার আড়ষ্ট ব্যবহারকে আমি কখনও দোষ দিইনি। এর সূত্রপাতের জন্যে আমিই দায়ী। যদিও আমার ভূমিকা ছিল নিরুপায় দর্শকের মতো। কারণ আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি, কেউ কখনও এসে মাঝরাতে পাতালঘরের দরজা খুলে আমাকে স্বাধীনতা এবং মুক্তি দেবে। তখন আমি—কিংবা সেই ভয়ঙ্কর—আকস্মিক সেই ঘটনায় বিহ্বল, হতচকিত। তারপর পাতালঘরের সিঁড়ির ধাপে আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি লোকটাকে। তার দু—চোখে উদগ্র কৌতূহল, ক্রমে ক্রমে সেটাকে ঠেলে সরিয়ে নিঃসীম গাঢ় আতঙ্ক সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে….তারপর….।

না, প্রথম থেকে গুছিয়ে শুরু করাই ভালো।

পাতালঘরটা তৈরির পর সেটা দ্বিতীয় মাস। নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে পরিবর্তনটা তখনও আমার ভালো করে সয়ে ওঠেনি। পাতালঘরে যাওয়ার সময় হয়ে এলেই মনটা কেমন অস্থির হয়ে পড়ে, মেজাজ হয়ে ওঠে রুক্ষ। তখনও পর্যন্ত তন্দ্রা বেশ সহজভাবেই আমার কাছাকাছি থাকত। সেদিনও ছিল।

দিনটা সকাল থেকেই ছিল মেঘলা। তার ওপরে ডিসেম্বরের শীত, সন্ধে হতেই অঝোরে বৃষ্টি নামল। সে—বৃষ্টির বিরাম নেই। মনে আমার মিশ্র অনুভূতি। একই সঙ্গে বাইরের বৃষ্টির কথা, তন্দ্রার কথা ও আমার অসুখটার কথা ভাবছিলাম। চিন্তার সূত্র হঠাৎ টুকরো টুকরো হয়ে ছিঁড়ে গেল দরজায় প্রচণ্ড করাঘাতের শব্দে। ভীষণ ব্যস্ততায় কেউ দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে।

আমার বিরক্তি আচমকা বেড়ে উঠল। সাধারণত পাতালঘরে যাওয়ার আগে আমি চুপচাপ থাকি, তন্দ্রার সঙ্গেও বেশি কথা বলি না। কিন্তু এ তো দেখছি অপ্রত্যাশিত উপদ্রব!

তন্দ্রা ঘরে এল। একবার দরজার দিকে তাকিয়ে আমার দিকে তাকাল। অর্থাৎ দরজা খুলবে কি না। আমি সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে কিছুক্ষণ হয়তো দ্বিধাগ্রস্ত থেকেছি। সংবিৎ ফিরে দেখি তন্দ্রা দরজা খুলে দিয়েছে এবং দরজায় দাঁড়িয়ে বছর পঁয়তিরিশের একজন পুরুষ। গায়ে বর্ষাতি, হাতে ব্রিফকেস। মাথার চুল ভিজে লেপটে আছে কপালের ওপর। গাল বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।

‘এ অসময়ে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত।’ কপালের ভিজে চুল সরিয়ে সে বলল, ‘কিন্তু কী করব বলুন, ঝড়—বৃষ্টিতে পথ হারিয়ে ফেলেছি—’ তন্দ্রার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ঘরে—বসে—থাকা আমাকে দেখল আগন্তুক।

তন্দ্রা আমার দিকে একপলক তাকিয়ে ভদ্রলোককে লক্ষ করে বলল, ‘আসুন—ভেতরে আসুন।’

আগন্তুক ভেতরে ঢুকল। তার বর্ষাতি থেকে জল ঝরতে লাগল। তন্দ্রা এগিয়ে গিয়ে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিল।

‘নমস্কার।’

তাকিয়ে দেখি লোকটি আমার খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি নির্লিপ্তভাবে একটা হাত তুলে প্রতি নমস্কারের ইঙ্গিত করলাম। তারপর মনোযোগ দিলাম একটা বইয়ের দিকে। আড়চোখে লক্ষ করলাম, তন্দ্রা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আমার অসহযোগী মনোভাব আগন্তুক ও তন্দ্রাকে বিব্রত করে তুলল। ও লোকটিকে ইশারায় ডেকে নিয়ে গেল ভেতরের ঘরে। যাওয়ার সময় ব্রিফকেসটা আমার চেয়ারের পাশে নামিয়ে রেখে তন্দ্রাকে অনুসরণ করল সে। তার বিদায়ী হাসির উত্তর জানাতে সামান্য হাসতে চেষ্টা করেছি, এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছি। আমি সহজভাবে হাসতে পারছি না। ঠোঁটে টান লাগছে।

ওরা চলে যেতেই হাতের বই রেখে ঝটপট উঠে দাঁড়ালাম। মুখের ওপর হাত বুলিয়ে চিৎকার করে ডাকতে চাইলাম তন্দ্রাকে। কথা জড়িয়ে গেল। বাইরের বজ্রপাতের শব্দে, বৃষ্টির শব্দে সে—চিৎকার আরও অস্পষ্ট শোনাল। কিন্তু দেখি, তন্দ্রা হঠাৎই আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যেন ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের কোনো ইশারা ওকে জানিয়ে দিয়েছে—আর সময় নেই। কার্যকারণহীন ভয় ফুটে উঠেছে ওর চোখেমুখে।

‘চলো—’ ধীর স্বরে ওকে বললাম।

‘চলো—’ ও পাতালঘরে নামার সিঁড়ির কাছে এগিয়ে গেল। ওকে অনুসরণ করে আমি সিঁড়ি ধরে নামতে শুরু করলাম। তখন হঠাৎ পেছন ফিরে দেখি, সেই অচেনা আগন্তুক বিস্ময় এবং কৌতূহল নিয়ে দূর থেকে আমাদের লক্ষ করছে।

পাতালঘরের দরজা বন্ধ করার ঠিক আগে শান্ত গলায় তন্দ্রা বলল, ‘ভদ্রলোক সেলসম্যান—বলছেন, কাল সকালেই চলে যাবেন—রাতটা বসবার ঘরেই কাটিয়ে দেবেন—।’

উত্তর দিলাম না। উত্তর দেওয়ার মতো শারীরিক অবস্থা আমার নেই। কিন্তু মনে মনে বললাম, তোমাকে আমি বিশ্বাস করি, তন্দ্রা। তারপর শেষবারের মতো ওর চোখে তাকালাম। অথচ অবাধ্য দৃষ্টি যে ওর গলার আঁকাবাঁকা নীল শিরার দিকে ছুটে যেতে চায়!

দরজা বন্ধ করে খিল দিয়ে দিল তন্দ্রা। তালা দিতে যাবে, সিঁড়ির দরজা থেকে কেউ যেন ওকে ডাকল। হয়তো আমাদের অতিথি তন্দ্রাকে বা আমাকে খোঁজার ভান করে পাতালঘরের কাছে নেমে আসতে চায়। কানে এল তন্দ্রার দ্রুত পায়ের শব্দ। তালা না দিয়েই ও সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। সুতরাং ঘরের এক কোণে বসে সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তের প্রতীক্ষায় রইলাম….।

এর পরের ঘটনা স্মৃতির পাতায় বিক্ষিপ্ত, ঝাপসা অথচ ইঙ্গিতময়। রাত হয়তো তখন অনেক হবে—ওটা পাতালঘরের ভেতরের বন্য আক্রোশে দাপাদাপির চূড়ান্ত করছে—হঠাৎ শোনা গেল দরজার খিল খোলার শব্দ। ওটা চকিতে থেমে যায়। ওত পেতে বসে….পাতালঘরের দরজা ধীরে—ধীরে খুলে যায়….দরজায় দাঁড়িয়ে এক পুরুষের ছায়ামূর্তি। প্রথম নজরে সে কিছু দেখতে পায়নি। তাই কী ভেবে ফিরে যায় সিঁড়ির দিকে। এমন সময় ভয়ঙ্কর জিঘাংসা পাতালঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। মুক্তি। আগন্তুক থমকে দাঁড়ায় সিঁড়ির ধাপে। ফিরে তাকায়। তার দু—চোখে নিঃসীম গাঢ় আতঙ্কের বন্যা। চিত্রার্পিত শ্লথ ভঙ্গিতে সে দাঁড়িয়ে আছে। আমি যখন খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, তখন তার মানসিক ভারসাম্য পুরোপুরি লোপ পেয়েছে….

সকালবেলায় পাতালঘরের বাইরে আমাকে আবিষ্কার করে তন্দ্রা ভীষণ অবাক হল।

ওপরে এসে ‘পাতালঘরের খিল কে খুলল’ সে নিয়ে প্রশ্ন তোলায় আমি প্রথমে নিস্পৃহ ভাব দেখালাম। পরে বললাম, ‘ওই সেলসম্যান ভদ্রলোক হয়তো চলে যাওয়ার আগে খুলে দিয়ে থাকবেন।’

উত্তরে তন্দ্রার চোখে যে—ভয় ও দ্বন্দ্ব ফুটে উঠল তা আমার চিরদিন মনে থাকবে। ও আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে চেয়ারের পাশে রাখা অক্ষত ব্রিফকেসটার দিকে একটা আলতো দৃষ্টি ছুড়ে দিল। কিন্তু আমি জোর গলায় বলতে পারি, আমার স্ত্রী ওই আগন্তুকের অন্তর্ধানের আসল কারণ তখনও বুঝে উঠতে পারেনি। ওর, ভয়, সন্দেহ, দ্বিধা—সবই ছিল অনুমাননির্ভর।

মাঝরাতের ঘটনার ধারাবাহিকতা আমার স্মৃতির নাগাল এড়িয়ে গেলেও নির্দিষ্ট দূরত্বে সে তার মাইলফলক গেঁথে রেখে গেছে। নইলে এখনও আমার মনে পড়ে কেন সেই বৃষ্টিঝরা রাতের কথা? যেন স্পষ্ট দেখতে পাই, আমি মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে এগিয়ে চলেছি, আর আমার ঠিক সামনেই কারও ছুটন্ত পায়ের শব্দ….দুঃস্বপ্নের ঘোরে কেউ মরণপণ ছুটে চলেছে। আমি নিজেকে নিবৃত্ত করতে চাইলেও ওটা বাঁধ মানে না। তীব্র আবেগের প্ররোচনায় এগিয়ে চলে। অবশেষে সেই আগন্তুক অন্ধকার ভিজে পথে দিক ঠাহর করতে পারে না। আগাছা ও জঙ্গলের সীমা শেষ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে অতল খাদে। তার চিৎকার আমি শুনতে পাইনি। চিৎকার করার ক্ষমতা তার ছিল না। অন্ধ ক্রোধ ও হতাশায় ওটা ফুঁসে উঠতে লাগল। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে ক্রুদ্ধ গর্জন করে উঠল। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে চলল….।

বাড়িতে ফিরে এসেও ওই প্রাণীটার রাগ কমেনি। সারা বাড়ি টহল দিয়ে বেড়িয়েছে। বেশ মনে পড়ে, তন্দ্রার শোওয়ার ঘরের দরজার বাইরে ঘাপটি মেরে বসে ওটা অপেক্ষা করছিল….একবার দরজায় চাপ দিয়ে পর্যন্ত দেখেছে….দরজা খোলেনি….বন্ধ। অথচ আমি জানি, তন্দ্রার কোনো ক্ষতি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু ওটা সবসময় তো আমার কথা শোনে না। অস্থির হয়ে পড়ে।

অবশেষে আবার সচেতন হয়ে উঠলাম। আকাশ তখন পরিষ্কার হয়ে আসছে। বৃষ্টিও থেমে গেছে। পাতালঘরে ফিরে গিয়ে এক কোণে শ্রান্ত শরীরে বসে রইলাম। তন্দ্রা এসে আমাকে খোলা ঘরে আবিষ্কার করল…।

এ—ঘটনায় আমি সাবধান হইনি….হওয়ার কথাও নয়। অন্যের গোপনীয়তায় কেউ এসে আচমকা অধিকার জাঁকিয়ে বসুক এ আমি একটুও পছন্দ করি না। পাতালঘরে কাউকে আমি আসতে বলিনি, খিলও খুলতে বলিনি। তবে কেন এসেছিল সেই আগন্তুক? অসুখের সময়ে কেউ আমাকে দেখবে, এ আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। তা ছাড়া তার গায়ে আমার আঁচড়টি পর্যন্ত পড়েনি….সে নিজেই নিজের মৃত্যু ডেকে এনেছিল। এত সব চিন্তা করে মনে হয়, যতটা প্রয়োজন ততটা গুরুত্ব বোধহয় অসুখটাকে আমি দিইনি।

৯ জুন, সন্ধ্যা

না, সব কথা এখনও খুলে বলিনি। তাই অস্বস্তি হচ্ছে। কোনো মিথ্যে ঘটনা লিখেছি তা নয়, তবে হোটেলের সেই মাতালটার কথা এখনও আমি বাদ রেখে দিয়েছি। সব কথাই তো আমাকে লিখতে হবে, নইলে এই ডায়েরি লেখার মানে কী! সুতরাং তার কথাই এখন লিখব। অবশ্য তার সঙ্গে এমন কিছু হয়নি যার জন্যে আমাকে দোষ দেওয়া যায়।

এ—ঘটনা ঘটে পাতালঘর তৈরির আগে। শেষ যে—রাতটা আমি শহরের বাইরে হোটেলে কাটিয়েছিলাম সেই রাতে। তখন পাতালঘর তৈরির কথা ভেবেছি, কিন্তু তন্দ্রার জন্যে ঘর তৈরির কাজে হাত দিতে পারিনি। কারণ, তাহলে ওকে আমার অসুখের সব কথাই খুলে বলতে হয়। মনে হয়, ওই মাতাল লোকটার ঘটনাই শেষ পর্যন্ত আমাকে মনস্থির করতে বাধ্য করে। সেই ঘটনা থেকেই বুঝতে পারি, পরিস্থিতি—বিশেষে আমি কীরকম বিপজ্জনক হয়ে উঠি। আমার নিজেকে সামলানোর ক্ষমতা কীরকম পলকা হয়ে যায়। মোটের ওপর, ভগবান যা করেন তা মঙ্গলের জন্যে, কারণ সেইজন্যেই তো সাত তাড়াতাড়ি তৈরি হল পাতালঘর। তা ছাড়া এখনও বলব, আমি নির্দোষ। সে—রাতে যা হয়েছে তার জন্য আমি দায়ী নই। দায়ী ছিল ওই মাতালটা নিজেই। ঠিক বৃষ্টিভেজা রাতের সেই আগন্তুকের মতো….।

সেটা ছিল একটা রেল—স্টেশনের কাছাকাছি একটা সস্তা দরের নোংরা হোটেল। অন্যান্য যেসব হোটেলে উঠতাম সেগুলোর মতোই—বেশ মনে আছে। একটা সরু গলির মধ্যে হোটেলের ঢোকার দরজা। দরজায় পুরোনো একটা সাইনবোর্ড। রং চটে গেলেও বোঝা যায় এককালে হোটেলের নামটাই লেখা ছিল। ঢুকতেই চোখ পড়ে ফাটলধরা ময়লা বারান্দা। ডান দিকে চুন—বালি খসা একটা ছোট্ট ঘর : অফিসঘর। আরও এগিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। বিভিন্ন অসমান ধাপে ঘুরপাক খেয়ে উঠে গেছে সিঁড়িটা। অফিসঘরে ঢুকে দেখি কেউ নেই। দু—চারবার ‘কেউ আছেন নাকি?’ বলে চিৎকার করতেই ঢুলু ঢুলু চোখে একটা রোগা চেহারার লোক সিঁড়ির নীচের ফোকর থেকে বেরিয়ে এল। পরনে ময়লা পাজামা, আর চেক চেক ছাপা শার্ট। আমার মুখের কাছে এসে হাই তুলে প্রশ্ন করল লোকটা, ‘কী চাই?’

বমি পেল। হাইয়ের সঙ্গে ভেসে এল দিশি মদের কদর্য গন্ধ। তখনই আমার বোঝা উচিত ছিল সেটা কী ধরনের হোটেল। কারা রাত কাটাতে আসে সেই হোটেলে। সেই মাতালটাও এসেছিল। এসব লোকের মরে যাওয়াই ভালো।

লোকটা টেবিলের পেছনে গিয়ে কোত্থেকে একটা ময়লা খাতা বের করে তাকাল আমার দিকে।

শান্ত স্বরে বললাম, ‘রাতটা থাকতে চাই।’

লোকটা এক হাত পেতে অন্য হাতে খাতাটা খুলে এগিয়ে দিল আমার দিকে। একশোটা টাকা দিয়ে নাম সই করলাম খাতায়। লোকটা জড়ানো গলায় বলল, ‘আরও পঞ্চাশ টাকা দিন।’

বুঝলাম গলা কাটছে, তবুও আপত্তি করলাম না। আমার হাতে নষ্ট করার মতো বেশি সময় নেই।

আমার মুখে তিন—চারদিনের খোঁচা—খোঁচা দাড়ি। কোনো হোটেলে গিয়ে ওঠার আগে দু—তিনদিন আমি দাড়ি কামাতাম না। কারণ অসুখের সময় কেউ যদি আচমকাই আমাকে দেখে ফেলে, তাহলে অবাক হয়ে ভাববে এত তাড়াতাড়ি, মাত্র দু—তিন ঘণ্টায় কী করে কোনো লোকের মুখময় দাড়ি গজায়! ব্যাপারটা ছোট্ট হলেও মারাত্মক। তাই আমি সাবধান থাকি। কেউ আমাকে কখনও সন্দেহ করেনি। অবশ্য আজকের যুগে কেই বা এসব নিয়ে মাথা ঘামায়! আজ মনস্তত্ত্ববিদদের যুগে আমি এক কিংবদন্তি।

লোকটা নিজেও দাড়ি কামায়নি। হয়তো এই হোটেলের কেউই দাড়ি—টাড়ি কামায় না। দেড়শো টাকা পকেটে ঢুকিয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে আমাকে একটা চাবি দিল সে।

‘রুম নম্বর তিন। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁ দিকে।’

তারপর আমাকে একা রেখেই টলতে—টলতে বেরিয়ে গেল।

ওপরে ঘরে গিয়ে হাতের সুটকেসটা এক কোণে রাখলাম। ভেতর থেকে খিল—ছিটকিনি দিয়ে দরজা ভালো করে বন্ধ করলাম। সমস্ত আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। জামাকাপড় ছাড়লাম না। ঘরে জানলা একটাই। ছোট। সবকটা গরাদ নেই। জানলা দিয়ে পাশের বাড়ির দেওয়াল চোখে পড়ে। সুতরাং চাঁদ দেখতে পেলাম না। চাঁদ না দেখলে পরিবর্তনের সময় ভীষণ কষ্ট হয়, যন্ত্রণা হয় অমানুষিক। আর সেইজন্যেই চাঁদটাকে আমি সবসময় কল্পনা করে নিই : অন্ধকার আকাশে বিশাল হলদে থালার মতো। ওই নোংরা ছোট্ট ঘরটা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে কী ইচ্ছেটাই না করছিল! মনে আছে, কী ভয়ঙ্কর ধৈর্য নিয়ে আমি প্রতীক্ষায় থেকেছি। ভগবানকে ডেকেছি, যাতে পরিবর্তনটা তাড়াতাড়ি এসে আবার তাড়াতাড়ি চলে যায়। বারবারই উঠে জানলার কাছে গেছি, ঘরে পায়চারি করেছি, এক কোণে রাখা কুঁজোর নোংরা জল নিয়ে চোখেমুখে ঝাপটা মেরেছি। তারপর নিশ্চয়ই আবার বিছানায় শুয়ে পড়েছিলাম, কারণ পরের যে—ঘটনা মনে পড়ে তাতে আমার শরীরে পরিবর্তন এসে গেছে। আমি চিৎ হয়ে বিছানায়া শুয়ে আছি, খালি এপাশ—ওপাশ করছি, সেইসঙ্গে অধীর ক্রুদ্ধ গর্জন। সারা শরীর আমার ঘামে ভিজে গেছে। বিছানাও ভিজে। শরীরের তলায় বিছানার সস্তা ছাপা চাদর কুঁচকে গেছে। এক হাতে চেপে ধরে আছি খাটের মাথার কাছে কাঠের বাজু। সে—হাত আর আমার হাত নয়—পালটে গেছে। অবস্থা ভীষণ খারাপ। যেন প্রচণ্ড জ্বরে ভুল দেখছি। কিন্তু শরীরের শক্তি আমার কমেনি, তাই কোনোরকমে সে—যন্ত্রণা সহ্য করছি আর ভাবছি এত খারাপ অবস্থা আগে কখনও হয়নি।

তার ঠিক পরেই শুনতে পেলাম বারান্দা ধরে হেঁটে আসা মাতালটার পায়ের শব্দ। মাতালদের আমি বরাবরই ভীষণ ঘৃণা করি—শুধু মাতাল কেন, যারা ওষুধ বা মাদকদ্রব্য ছাড়া সুখী হয় না, সন্তুষ্ট হয় না, কিংবা যারা জীবনধারণের জন্যে কৃত্রিম সাহায্যের আশ্রয় নেয়, তাদেরও। এই মাতালটা তারস্বরে চিৎকার করে গান গাইছিল আর পায়ে বিচিত্র শব্দ তুলে এগিয়ে আসছিল।

সে যখন আমার ঘরের দরজার কাছে এগিয়ে আসতে লাগল তখনও আমি নিশ্চল নিস্পন্দভাবে শুয়ে। নিশ্চয়ই লোকটা ঘর ভুল করে থাকবে, কারণ সে এসে থামল আমারই দরজার সামনে। ঠেলে খুলতে চেষ্টা করল দরজা। তারপর দুম দুম ধাক্কা মারতে শুরু করল। আর জড়ানো গলায় বিস্ময় প্রকাশ করতে লাগল বারবার যে, তার ঘরে কোন হতভাগা এসে ঢুকেছে।

সব শুনেও আমি নিজের জায়গায় নিথর। আমার চোখ কোটরে অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় ঘুরছে, ঠোঁটে আমার ফেনার রাশি। লোকটার অশ্রাব্য গালিগালাজে তার প্রতি এক প্রলয়ঙ্কর ঘৃণা আমাকে পেয়ে বসল। এ রকম ঘৃণা আমি কখনও কাউকে করিনি। একটা বীভৎস ভয়ঙ্কর চিন্তা আমার মনে খেলে গেল….যদি মাতালটার প্রচণ্ড ধাক্কায় এই সস্তা দরজার পলকা খিল ভেঙে পড়ে? যদি ঘরে ঢুকে লোকটা আমার এই অবস্থা দেখে? ক্রোধে আতঙ্কে আর চুপচাপ শুয়ে থাকতে পারলাম না। বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠলাম, ছুটে গেলাম দরজার কাছে, দরজায় কান পেতে ঝুঁকে পড়লাম। শুনতে চেষ্টা করলাম।

লোকটার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ ও চাপা জড়ানো স্বগতোক্তি স্পষ্ট শুনতে পেলাম। দরজাটা চেপে ধরলাম, যাতে মাতালটার আক্রমণে সেটা ভেঙে না পড়ে। আমার গায়ে এখন অমানুষিক শক্তি, কারণ আমি এখন আর ‘আমি’ নই, পালটে গেছি। খিল ভেঙে দরজা খোলে কার সাধ্যি! গালের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ও খসখসে হাতে দরজাটা বড় মোলায়েম ও গরম ঠেকল।

দরজার ধাক্কা ক্রমে প্রচণ্ডতা ও কম্পাঙ্কে বাড়তে লাগল। ভয় পেলাম, এই শব্দে হোটেলের সবাই হয়তো জেগে উঠতে পারে, তারপর ঝঞ্ঝাট হতে পারে। হয়তো সেই পাজামা পরা ম্যানেজারটা—হয়তো ম্যানেজারই হবে—এসে বলবে, দরজা আমাকে খুলতেই হবে। তখন? নিঃশব্দে প্রতীক্ষায় রইলাম। শরীরের ভেতর রক্ত ফুটছে টগবগ করে, উথলে উঠছে গলা দিয়ে। লোকটা শব্দ করেই চলল।

মনে হয়, সেই মুহূর্তেই আমি দরজা খুলেছিলাম।

না, লোকটাকে কোনোওরকম আঘাত আমি করিনি। কিন্তু আমাকে দেখার পর তার সেই চোখের দৃষ্টি আমি কোনোওদিন ভুলব না। তার চোখ, মুখ,….লোকটা চকিতে এক পা পিছিয়ে গেল। আমারও ভীষণ ইচ্ছে হল এগিয়ে যাওয়ার, কিন্তু জানি, সেটা কোনোমতেই ঠিক হবে না। হয়তো জায়গায় দাঁড়িয়েই বিদ্যুৎঝলকের মতো লোকটাকে আক্রমণ করেছিলাম, ভালোমতো মনে নেই। কারণ আচমকাই লোকটা লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। যেন ভেজা কাপড়ের এক পুঁটলি। আর তা থেকে অ্যালকোহল ও রক্তের মিশ্র বীভৎস গন্ধ বেরোচ্ছে।

এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলাম। আমার আঙুল বাতাস আঁকড়ে ধরছে। তারপর নিজেকে সামলে নিলাম। সজোরে দরজা বন্ধ করে আবার খিল ও ছিটকিনি এঁটে দিলাম ভেতর থেকে। মনে আছে, দরজায় হেলান দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাঁফিয়েছি। নিশ্চয়ই ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, জেগে উঠে মাতালটা আরও লোকজন ডেকে আনবে এবং তারা দরজা ভেঙে আমার ঘরে ঢুকবে। তার মধ্যেই আমাকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে হবে, হয়তো এই ভয়ই অনুঘটকের কাজ করে থাকবে, কারণ সঙ্গে সঙ্গেই আমি আবার বিছানায় শুয়ে পড়েছি, আর যখন চোখ খুললাম, দেখি আমি আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছি।

পরদিন সকালে সেই ম্যানেজারকে ভীষণ উত্তেজিত দেখলাম। শুনলাম, একটু আগেই মাতালটার দেহ সরানো হয়ে গেছে। ম্যানেজার আমাকে জিগ্যেস করল, ‘রাতে কোনো গোলমাল শুনেছেন?’

‘হ্যাঁ, বাইরের বারান্দায় কেউ যেন গান গাইছিল—মাতাল অবস্থায়।’

এবার সে বলল, ‘হোটেলের একজন বোর্ডার গত রাতে মারা গেছে। আপনার ঘরের দরজার কাছে তার ডেডবডি পড়ে ছিল।’

আমি ভীষণ অবাক হয়ে সে—বিষয়ে আরও প্রশ্ন করলাম।

ম্যানেজার বলল, ‘দেখে মেনে হয় ভদ্রলোক হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। এ ছাড়া অন্য কারণ তো দেখছি না। একজন বেয়ারা আমাকে বলছিল ভদ্রলোক নাকি নীচে খাওয়ার ঘরে বসে বোতলের পর বোতল মদ গিলছিলেন। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে নিশ্চয়ই তাঁর অনেক পরিশ্রম হয়েছে। সেই ধকলটাই তিনি আর সইতে পারেননি। জানেন তো, মদ খেলে হার্টের কীরকম ক্ষতি হয়? একেবারে শেষ করে দেয়। তা ছাড়া ভদ্রলোকের কপালের পাশে, ঠিক রগের কাছটায়, একটা বড় কাটা দাগ ছিল। সেটা হয়তো পড়ে যাওয়ার সময় হয়ে থাকবে।’

এবং মৃত্যুর ব্যাপারটা যাতে ধামাচাপা পড়ে সে—বিষয়ে মোটামুটি ব্যবস্থা তাঁরা নিয়েছেন।

এই হল হোটেলের সেই মাতালের কাহিনি। এতে আমার কোনো দোষ ছিল না। আমি তাকে কোনো রকম আঘাত করিনি।

১১ জুন

লাইব্রেরিয়ান মহিলাটি আজকাল আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। এ—বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ভীষণ ভয় পেয়েছি। কোনো কিছু সন্দেহ করার মতো বুদ্ধি তার আছে বলে কখনও ভাবিনি, কিন্তু এখন দেখছি, না ভেবে ভুল করেছি….যেসব ব্যাপার বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা নিছক হেসে উড়িয়ে দেয়, এ—মহিলা সে সব বিশ্বাস করতে রাজির চেয়েও বেশি। অর্থাৎ আমার পক্ষে দারুণ বিপজ্জনক। জানি না এখন কী করব। লাইব্রেরিতে আর যাব না, কিন্তু সে যদি ইতিমধ্যেই আমায় সন্দেহ করে থাকে….কী জানি। এরকম একটা বোকা মেয়েছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো মানে হয়!

আজ লাইব্রেরিতে গিয়েই মহিলাটি সম্পর্কে আমার সন্দেহের সূত্রপাত। তার টেবিলকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় রোজকার মতো সৌজন্যের হাসি বিনিময় হল, কিন্তু লক্ষ করলাম, তার টেবিলে একটা ক্যালেন্ডার রয়েছে। সকলের চোখের সামনে প্রকট ক্যালেন্ডারটা, যেন সে কোনো তারিখ খুঁটিয়ে দেখছে। আগে ওখানে কোনো ক্যালেন্ডার ছিল না। তাহলে এখন, আজ, হঠাৎ কেন এল? লাইব্রেরির কোনো বই মেম্বাররা নিয়ে ক’দিন করে আটকে রাখছে এ যদি জানা প্রয়োজন হয় তাহলে ক্যালেন্ডার তো বরাবরই তার কাছে থাকবে। তাছাড়া, বইয়ের পেছনে তো তারিখের ছাপ মারা থাকে। উহুঁ, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কবে কবে পূর্ণিমা আছে সেটা দেখার জন্যেই ক্যালেন্ডারটা আনা হয়েছে।

ওটা দেখামাত্রই এ—কথা আমার মনে এসেছিল, কিন্তু তখনও এতটা নিশ্চিত হতে পারিনি। হয়তো মহিলাটি নির্দোষ হলেও হতে পারে। সন্দেহের অবকাশে সবাইকেই আমি রেহাই দিতে চেষ্টা করি। কিন্তু যখন সে পেছনের অন্ধকার ঘর পর্যন্ত আমাকে অনুসরণ করে এল….।

লাইব্রেরির পেছনের ঘরটা অন্ধকার অন্ধকার। বড় বড় গবেষণার বইগুলো ওই ঘরেই থাকে। ও—ঘরে খুব একটা কেউ যায় না। সেখানে পুরোনো একটা বই দেখছি, হঠাৎ লাইব্রেরিয়ান সে—ঘরে এল। দু—হাত ভরতি বই। যেন তাকে রাখতে এসেছে এ রকম ভান করতে লাগল। কিন্তু আমার চোখে ধুলো দেবে একটা মেয়েছেলে!

সে আমাকে লক্ষ করছিল। ঘুরে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকাতেই সে বোকা বোকা হাসল। আবোল—তাবোল কী একটা বলল—আমি একদৃষ্টে তাকিয়েই আছি—তারপর বইগুলোকে উলটোপালটা জায়গায় কোনোরকমে ঠেলেঠুলে ঢুকিয়ে দিয়ে ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে গেল। মহিলাটি হাঁটে ভারী বিশ্রীভাবে। চলার সময় তার পেছনটা অশ্লীল ইশারায় খারাপভাবে দুলতে থাকে। তার চেহারা মোটাসোটা অথচ নোংরা। বয়েস হয়েছে, তবে সে রকম ছাপ পড়েনি। বহুবার দেখেছি, অল্পবয়েসি ছেলেরা টেবিলের সামনে ঝুঁকে পড়ে তার সঙ্গে কথা বলছে। এমন ভান করছে, যেন কয়েকটা বই সম্পর্কে তাদের ভীষণ কৌতূহল। মেয়েটা যে বদ স্বভাবের তা আমি ভালোই জানি। সে যে এখনও আইবুড়ি তাতে আর আশ্চর্য কী! দেখে তো সতী বলেও মনে হয় না। কিন্তু ও যে সন্দেহ করছে, তাতে আমি ভয় পাচ্ছি। মেয়েটি বিপজ্জনক। জানি না, হুট করে কী করে বসবে….।

বেরোনোর সময় সে আমার সঙ্গে গায়ে পড়েই আলাপ করতে চাইল। আমি কেন তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছি সে—কথা জিগ্যেস করল। অর্থাৎ জোর করে আমার কাছে থেকে কিছু শুনতে চায়, গাঢ় করতে চায় পরিচয়—সৌজন্যের সূক্ষ্ম রেখা। সংক্ষেপে ও নীরবে তার কথায় সায় দিয়ে বেরিয়ে এলাম। পেছনে না তাকালেও বুঝতে পারলাম তার লোভী চোখ আমার শরীরে এখনও আমূল বিদ্ধ।

এবারে বুঝেছি ভদ্রমহিলা কেন আমার সঙ্গে আলাপ করতে চায় : যাতে সে আমার সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে পারে। সে ভান করছে যেন আমার সঙ্গে ছেনালি করছে, কিন্তু তার উদ্দেশ্য অন্য। আরও অনেক গভীর। কিন্তু ছেনালি নষ্টামি করার জন্যে আমার মতো মানুষকে বেছে নিয়ে সে বিরাট ভুল করেছে। তার বোঝা উচিত ছিল।

অবশ্য এর পরেও স্বীকার করব, ভদ্রমহিলা হয়তো সত্যিই আমার সঙ্গে আলাপ জমাতে চায়। জানি, মেয়েদের কাছে আমার চটক আছে। আর এ তো সামান্য এক নষ্ট মেয়েছেলে! হয়তো এর একগাদা পুরুষবন্ধুও আছে। কিন্তু তাকে দেখে তন্দ্রার চেয়েও সাদাসিধে মনে হয়। তা যদি হয়, তাহলে আর ভয়ের কিছু নেই। অবশ্য তা বলে কোনো মেয়ে এভাবে কোনো বিবাহিত সুখী পুরুষের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টির চেষ্টা করবে এ অত্যন্ত জঘন্য। এ—ধরনের মেয়েদের মরে যাওয়াই উচিত। এদের বেঁচে থাকা ঠিক নয়, সমাজকে এরা দূষিত করে।

নাঃ, হঠাৎ করে লাইব্রেরিতে যাওয়া বন্ধ করাটা মোটেও ঠিক হবে না। এতে তার সন্দেহ আরও বাড়বে। বরং মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে দেখি, ও আমার সম্পর্কে ঠিক কতটুকু জানে….।

১৫ জুন

আজ আবার লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম। আবারও মেয়েটা আলাপ জমানোর চেষ্টা করেছে। এবার তার সঙ্গে মিনিট দুয়েক কথা বলেছি। তার হাবভাব বোঝার জন্যে। কিন্তু সে যে কী ভাবে, তা বলা মুশকিল। এ—ধরনের মেয়ে সম্পর্কে খুব একটা অভিজ্ঞতা আমার নেই। এ—মেয়েটা যেন আমাকে লোভ দেখাচ্ছে। কী সাঙ্ঘাতিক! কিন্তু আমার সন্দেহ একেবারে হয়তো অমূলক নয়। এমন কোনো প্রশ্ন আমাকে সে জিগ্যেস করেনি যাতে মনে হতে পারে যে, সে আমাকে সন্দেহ করে। কিন্তু যেভাবে জোর করে সে আলাপের জের টেনে চলেছে তা দেখলে রীতিমতো ঘেন্না হয়। নিজের ভয়ঙ্কর রাগ চেপে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। এরপর মেয়েটা যখন পেছন নাড়িয়ে বুক ঝুঁকিয়ে বসল তখন আর একটু হলেই রাগে চিৎকার করে উঠেছিলাম।

মুখে দুষ্টু হাসি হেসে সে চোখ ঠেরে কথা বলছে। পরনে তার আঁটোসাঁটো বুক খোলা একটা ব্লাউজ (তন্দ্রা সেদিন যেরকম পরেছিল?)। তাতে যে—কারণে ব্লাউজ পরা সেই কারণ নিজেই অর্ধেকের বেশি প্রকট। একটা মেয়ের যুবতী শরীরকে ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে টেনে বের করে নিলে কীরকম হয়? ক্যালেন্ডারটা আজও টেবিলে রয়েছে, কিন্তু আড়চোখে চেয়ে দেখি তাতে চাঁদের হ্রাসবৃদ্ধির পালা দাগ দেওয়া নেই। সুতরাং মনে হয় না, একে আর ভয় পাওয়ার কোনো কারণ আছে। আমি যতটা ভেবেছিলাম মেয়েটা তার চেয়েও বেশি বোকা।

এরপর কবিতার বই নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলাম, কয়েকটা কবিতা পড়ার ভানও করলাম, যাতে তাকে ভুল পথে ঠেলে দেওয়া যায়। কবিতা আমার একটুও ভালো লাগে না। যতসব বাজে জঞ্জাল। কিন্তু মেয়েটাকে বোকা বানানো গেছে। এখন শুধু ভগবানকে ডাকছি, যেন কেউ মেয়েটার সঙ্গে আমাকে কথা বলতে না দেখে থাকে। তাতে লোকে আমাকে ভুল বুঝবে। আমি লম্পট নই।

২৪ জুন

আজ লাইব্রেরিয়ানের আসল মতলব বোঝা গেল। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই—মেয়েটা নষ্ট চরিত্রের। আমার অসুখ নিয়ে কোনো সন্দেহ সে করেনি। সে নেহাতই আমাকে চায়। আমার ধারণা, পুরুষদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করাটাই তার পেশা। তাকে দেখে এ—ব্যাপারে প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে বলেই মনে হয়।

আজ বিকেলে আবার আমার পেছন পেছন মেয়েটা আঁধারি ঘরটায় এসেছে। তখন লাইব্রেরি প্রায় বন্ধ হওয়ার সময়, তাই গোটা লাইব্রেরিতে শুধু আমরাই একা ছিলাম। তার ঘরে ঢোকার শব্দ আমি শুনতে পাইনি। কারণ আমি একমনে পড়ছিলাম। উঁচু উঁচু র‌্যাকের মাঝে ঠিকরে আসা আলো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, সুতরাং চোখের নজরেও অস্বাভাবিক তীক্ষ্নতার প্রয়োজন। হঠাৎই দেখি ভদ্রমহিলা আমার ঠিক পাশটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। চমকে উঠে সরে যেতেই খিলখিল করে হেসে উঠল সে। জিগ্যেস করল, ‘আমাকে দেখে ভয় পেয়েছেন বুঝি?’ চোখে এক অশ্লীল ইঙ্গিত। আমি কিছু বলে ওঠার আগেই আরও বলল, ‘আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, অন্তত আপনার।’

তার চোখের বদ ঝিলিকে নষ্ট আত্মার ছায়া। চিকচিক করে জ্বলছে সেই চোখ। আর তাদের ভয়ঙ্কর রূপের দিকে মুগ্ধ আমি তাকিয়ে আছি। যেন চঞ্চল কোনো আগুনের শিখা আমার সামনে দপদপ করছে….কী অদ্ভুত তার সম্মোহনী শক্তি! কিন্তু কেন? কোনো নীতিবাগীশ লোককে নীচ প্রবৃত্তি ও অশুভ কেন এমনভাবে টানে? কেন সে পারে না চোখ ফিরিয়ে নিতে? পাপকে দেখার আতঙ্ক কি এতই প্রবল? শত চেষ্টা করেও পারলাম না অন্যদিকে চোখ ফেরাতে, আর অসভ্য মেয়েছেলেটা আমার ঘৃণাকে লিপ্সা বলে ভুল করল। আরও কাছে এগিয়ে এল আমার। কীসব বলল মনে নেই। আজেবাজে কিছু কথা। অশ্লীল হেসে কিছু একটা বলতে হয়, তাই বলল। মনে হয় জিগ্যেস করেছিল আমি কেন এত লাজুক আর শান্ত।

আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি। চেষ্টা করেও তার সঙ্গে কোনোও কথা বলতে পারিনি। মনে আছে, তাকে দেখে আমার কী প্রচণ্ড ঘেন্না করছে সে—কথা বলতে মুখ খুলেছিলাম, কিন্তু মুখে কথা আসেনি। আর তারপর সে হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল আমার হাত। তার আঙুল আলতো করে ছুঁয়ে গেল আমার বাহু, কিন্তু তাতেই মনে হল সে—স্পর্শ যেন স্বয়ং শয়তানের। একটা বরফ—শীতল ঘৃণার স্রোত বাহু বেয়ে চলে গেল হৃৎপিণ্ডে, সব কিছু ঝাপসা হয়ে এল। বই, বইয়ের র‌্যাক, দেওয়াল—সব কিছু মিলিয়ে গেল এক লাল কুয়াশায়। শুধু দেখা যায় তার জঘন্য মুখ—ক্রমশ আমার দিকে এগিয়ে আসছে।

মেয়েটা কি আমাকে চুমু খেতে আসছে? যদি ওই চড়টা না মারতাম তাহলে আমার বিশ্বাস যে সত্যি সত্যিই আমাকে চুমু খেত। চড় যে মারব, সেটা কখন ঠিক করলাম জানি না। এ নিশ্চয়ই শুধুমাত্র প্রতিবর্তী ক্রিয়া। আত্মরক্ষার তাগিদে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কখন কীভাবে কাজ করে কেউ বলতে পারে না। সুতরাং সেই কারণেই তাকে থামাতে হল। ভদ্রমহিলার গালে সর্বশক্তিতে এক প্রচণ্ড চড় কষিয়ে দিলাম। আগে কখনও কোনো মেয়ের গায়ে হাত তুলিনি, কিন্তু এতে আমার দুঃখ নেই। এ—প্রাণীটা মেয়েছেলেরও অধম, মানুষেরও অধম। নিজের জীবনের কাছেই সে এক ঘৃণার বস্তু, পুরুষের শরীর শুষে বেঁচে থাকা এক জীবাণু।

চড়টা মেরেই আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে এসেছি ঘর থেকে। সে আর আমার পেছন—পেছন আসেনি। একটা কথাও বলেনি। মনে হয় আমার হাতে চড় খেয়ে হতভম্ব হয়ে গেছে। হয়তো পড়ে গেছে মাটিতে। সেটা দেখার জন্যে আর অপেক্ষা করিনি। সোজা লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে চলে এসেছি বাড়িতে। আমার হাত এখনও কাঁপছে। এ এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। জানি, এ কখনও ভুলব না। মনে শুধু এইটুকু আশা যে, ভালো কিছু অন্তত করতে পেরেছি। আমার বিচারবুদ্ধি ও আচরণ দেখে মেয়েটা বুঝবে যে, দুনিয়ার সব লোককেই বিকৃত কামের ফাঁদ পেতে নষ্ট করা যায় না।

২৪ জুন, রাত

সত্যি কথা বলতে কী এইমাত্র ভীষণ এক আঘাত পেয়েছি। অত্যাশ্চর্য কাকতালীয় সন্দেহ নেই। একটু আগে বিকেলের ডায়েরি লেখা শেষ করে নীচে গিয়েছিলাম রেডিয়োতে খবর শুনতে। লাইব্রেরিয়ানকে কেউ খুন করেছে মনে হয়। খবরে বলল, লাইব্রেরির পেছনের ঘরে ভদ্রমহিলাকে পাওয়া গেছে। দুটো উঁচু বইয়ের র‌্যাকের মাঝে তার দেহটা পড়ে ছিল। মাথায় পাওয়া এক প্রচণ্ড আঘাতে তার ঘাড় ভেঙে গেছে। মাথাটা সম্পূর্ণ ঘুরে গেছে পেছনদিকে। যে—জায়গায় দাঁড়িয়ে মেয়েটা আমার সঙ্গে নোংরা মতলব হাসিল করার চেষ্টা করেছিল, মনে হয় এ—ঘটনা ঠিক সেই জায়গাতেই ঘটেছে। আমার ধারণা, হয়তো একই রকম পরিস্থিতিতে ঘটেছে। পুরুষ দেখলেই পেছনের ঘর পর্যন্ত অনুসরণ করা তার স্বভাব ছিল, আর সেই জর্জর কাম অনুসরণে সভ্যতা—ভব্যতার লেশমাত্র থাকত না। মনে হয়, আমার কাছে প্রত্যাখ্যান পেয়ে সে হতাশ হয়ে পড়ে, অথবা মরিয়া হয়ে ওঠে। জানি না, মনের জোর আছে এমন পুরুষের মুখোমুখি হলে এসব ইতর মেয়েছেলেরা কী করে। আমার অনুমান যে, সে আমার পরের পুরুষটিকে কবজা করে ফাঁদে ফেলার জন্যে আরও বেশি পরিশ্রম করে। আর সেই লোকটি, অর্থাৎ খুনি, নিশ্চয়ই কোনো আদর্শবাদী মানুষ ছিল, আমারই মতো। মেয়েটার কদর্য ইঙ্গিতে নিজের রাগ সে আর সামলে রাখতে পারেনি। হয়তো সে মেয়েটাকে মারতে চায়নি—যদিও মরে গিয়ে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে—শুধু আমারই মতো এক বিরাশি সিক্কার চড় বসিয়ে দিয়েছিল। শুধু নিজেকে সংযত করতে না পারায় তার আঘাত হয়ে গেছে মারাত্মক। আমার ধারণা, এইরকমটাই হয়ে থাকবে। অবশ্য আমার ভুলও হতে পারে। সে যাই হোক, ওই নোংরা মেয়েছেলেটার জন্যে আমার এতটুকু দুঃখ নেই। সে মারা গেছে ভালোই হয়েছে। বাঁচা গেছে।

আমার স্ত্রীও শুনল খবরটা, তারপর আমাকে জিগ্যেস করল, ‘যে—সময়ে মেয়েটা খুন হয় ওই সময়ে তুমি লাইব্রেরিতে ছিলে না?’

‘মনে হয় আমি বেরিয়ে আসার পরে পরেই খুনটা হয়েছে।’

তন্দ্রাকে বললাম না যে, আমি জানি খুনটা কেন কীভাবে হয়েছে। তাতে ওর অস্বস্তি আরও বাড়ত। এ—ধরনের মেয়েছেলেও যে থাকতে পারে তা ও কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারবে না, বরং শুধু দুশ্চিন্তার শিকার হয়ে পড়বে।

‘তুমি তাহলে পুলিশে যাও।’ তন্দ্রা বলল, ‘তুমি হয়তো ওদের কোনো সাহায্য করতে পারবে।’

‘কী করে করব?’ বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘লাইব্রেরিতে তখন অন্য কোনো লোককে আমি দেখিনি। সুতরাং, শুধু শুধু পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার কোনো মানে হয় না।’

কিন্তু খুনিকে আমি মনে মনে সমর্থন করি। খুন করা এক বীভৎস পাপ, মানছি, কিন্তু কিছু কিছু পরিস্থিতিতে এর প্রয়োজন আছে। যখন কারও আদর্শ, নীতি বিপন্ন হয়, তখন খুব সহজেই মানুষ নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, করে বসে এমন কাজ, স্বাভাবিক অবস্থায় যে—কাজের কথা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। তন্দ্রাকে এসব খুলে বলা যায় না। সময়ে সময়ে যে আইনের নীতি ঠিক নাও হতে পারে সে কথা বোঝার মতো বুদ্ধি ওর নেই।

সুতরাং আমার উত্তর শুনে ও একমত হল। যদিও জানি, মনে মনে ও ভাবছে, সমাজের প্রতি কর্তব্য আমি পালন করছি না।

নিঃসন্দেহে পুলিশ আজ নয় কাল অপরাধীকে ধরবেই। হয়তো খুনি নিজেই তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে। বুঝবে, নেহাত আত্মরক্ষার তাগিদে প্রয়োজনে পড়ে খুনটা সে করেছে, এবং তার কাহিনি শুনে আদালত তাকে এমন কিছু কঠিন শাস্তি দেবে না। শাস্তি তাকে পেতে হবেই, কারণ সেটাই আইন, কিন্তু আমি ভাবছি তাকে শাস্তি না দিয়ে প্রশংসা করা উচিত। তার একমাত্র অপরাধ, নিজেকে সে সংযত করতে পারেনি—যে—অবস্থা আমার হয়েছিল। কিন্তু আমার কথা আলাদা। সবাই যে আমার মতো শক্ত মনের সংযমী মানুষ হবে এটা কী করে আশা করি!

২৭ জুন

আজ সকালে চা খাওয়ার সময় তন্দ্রার সঙ্গে বড় অদ্ভুত কথাবার্তা হল। কয়েক মিনিট ধরেই মনে হচ্ছিল ও কী একটা বলবে, কিন্তু ইতস্তত করছে। আমি আন্দাজ করলাম ও হয়তো মাসের তারিখ নিয়ে, (দিনটা যে আবার কাছে এগিয়ে আসছে) অথবা পাতালঘর নিয়ে, বা হয়তো কোনোও ডাক্তার দেখানো নিয়ে কিছু বলবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল তা নয়।

‘ওরা এখনও খুনিকে ধরতে পারেনি।’ ও বলল।

অর্থাৎ লাইব্রেরিয়ানকে যে খুন করেছে তন্দ্রা তার কথাই বলেছে। আপাতদৃষ্টিতে পুলিশ কোনোও সূত্র খুঁজে পায়নি। ঝোঁকের বশে হয়ে যাওয়া খুনের সমাধান করা সহজ কাজ নয়। কারণ সেক্ষেত্রে খুনের কোনো উদ্দেশ্য থাকে না, আর এক্ষেত্রে খুনি সম্ভবত লাইব্রেরিয়ানের সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। প্রার্থনা করতে লাগলাম খুনি যেন কাগজ—কলমের আইনকে ফাঁকি দিতে পারে। সে যা করেছে তা আদর্শ ও নীতির মহৎ আইনের নির্দেশেই করেছে।

মৃদু স্বরে বললাম, ‘হয়তো কোনোদিনই ধরতে পারবে না।’

‘তুমি যে সে—সময়ে ওখানে ছিলে সে কথা ওদের গিয়ে বললে ভালো হয় না?’ তন্দ্রা প্রশ্ন করল।

‘কেন?’

‘না….মানে, খুনি যখন খুন করে তখন তুমি হয়তো ওই লাইব্রেরিতেই ছিলে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, তুমি বাড়িতে আসার আগেই খুনটা হয়েছে। হয়তো তুমি তাদের কোনো সূত্র দিলেও দিতে পারবে….’

‘তোমাকে তো বললাম, আমি কিছুই দেখিনি।’

‘পুলিশে যেতে কি তোমার….ভয় করছে?’ ইতস্তত করে ও প্রশ্ন করল। প্রশ্নটা করার সময় ও অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। কী করে এ—ধারণা ওর মাথায় এল বলতে পারি না। পুলিশে যেতে আমার কিসের ভয়? আরও বললাম, আমি কিছুই জানি না। আমি চাই লোকটা যেন সাজা না পায়, কারণ লাইব্রেরিয়ানটা নষ্ট চরিত্রের মেয়েমানুষ ছিল। এ—কথা বললাম না যে, ওই মেয়েই আমাকে ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু তন্দ্রা হয়তো আন্দাজ করে থাকবে, কারণ ও ভীষণ অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকাল, তারপর টেবিল ছেড়ে চলে গেল নিজের ঘরের দিকে।

ওর কাছ থেকে এ—আচরণ বড় বিচিত্র। মানুষের জীবনে পরিবেশের প্রভাব সাঙ্ঘাতিক। হয়তো তন্দ্রার বেলায়ও তাই হয়েছে। মধ্যবিত্তদের এক অদ্ভুত ধারণা আছে যে, মানুষের তৈরি আইনের ক্ষমতা মানুষের চেয়েও অনেক বেশি। বুঝি না মানুষ কী করে এত সহজে অন্যের নির্দেশে চলে। সমাজের নিয়মকে তারা ঈশ্বরের নিয়ম বলে কেন মনে করে? সাধারণ আইন ও পরিস্থিতি—নির্ভর আইনের কোনো তফাত তারা বোঝে না। বোঝে না প্রকৃতির চিরন্তন আইন, ঈশ্বর ও আদর্শবাদের সূক্ষ্ম পার্থক্য। নিজেদের তৈরি আইনের হেরফের অথবা কখনও ভুল আইন তাদের নিজেদের পথেই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। সংস্কার থেকে এসবের উৎপত্তি এবং এ দেখে আমার সত্যি কষ্ট হয়। শুধু একবার ভাবুন, আমার নিজের বেলায় ব্যাপারটা কীরকম দাঁড়াবে….যদি কেউ আমার এই অসুখের কথা জানতে পারে তাহলে তারা আমাকে ঘৃণা করবে, শাস্তি দেবে। দেশের হর্তাকর্তারা হয়তো এ—অসুখ হওয়াটা বেআইনি বলে একটা আইন পাশ করিয়ে দেবেন। কিন্তু তাতে লাভটা কী হবে? অসুখ—বিসুখ তো আর সরকারি নিয়ম মেনে চলে না! সুতরাং অক্ষম নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও আমাকে লোকে অপরাধী ভাববে। এ—কারণেই অসুখটার কথা কাউকে আমি জানতে দিতে চাই না। পুরোনো, প্রায় ভুলে যাওয়া সংস্কার, আতঙ্ক ও কুসংস্কার একসঙ্গে হাত মেলাবে সরকারি আমলাদের নতুন শক্তির সঙ্গে, তারপর আমাকে ধ্বংস করবে। এ বড় ভয়ঙ্কর রোগ। সমস্ত খুঁটিনাটি জানা সত্ত্বেও এর বিরুদ্ধে লড়ার ক্ষমতা কারও নেই। মাঝে মাঝে ভীষণ আফসোস হয়। তিনশো বছর আগে হলে লোকে আমার এই ক্ষমতাকে অন্তত স্বীকার করত, ভয় পেত। কিন্তু আজ শুধু আমার বিরুদ্ধে আইন তৈরি হবে। আমার মানসিক ভারসাম্য যে এখনও বজায় আছে সে নেহাতই আমার সৌভাগ্য। নইলে এসব চিন্তায় আমি পাগল হয়ে যেতাম।

ওই সময়টা কাছে এগিয়ে এলেই আমার আজেবাজে চিন্তা হয়। নিষ্ফল আক্রোশ আর হতাশা আমাকে কুরে কুরে খায়। পাতালঘরটাকে আমি ঘেন্না করি….ভীষণ ঘেন্না করি…. বিশ্বাস করুন….।

১ জুলাই

আগামীকাল আবার আমাকে পাতালঘরে যেতে হবে।

বারবার সে—কথা না ভাবতে চেষ্টা করেছি। অন্য চিন্তায় মেতে থাকব বলে এই ডায়েরি লেখাও বন্ধ করে দিয়েছিলাম, কিন্তু অসম্ভব। সে—চিন্তা আমার মন থেকে যাচ্ছে না, বরং শরীরে মনে ঢেউয়ের মতো উথালপাতাল করে। এই স্নায়বিক চাপ আর বেশিদিন সইতে পারব বলে মনে হয় না। এখন লিখতে বসে আমার হাত কাঁপছে, শরীর ঘামছে। অসুখ হয়েছে বলে এভাবে নিজেকে শাস্তি দেওয়াটা ভাষণ অন্যায় হচ্ছে। অবুঝ স্বার্থপর এক সমাজের জন্যে নিজেকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া নিতান্তই অবিচার। সময়টা এগিয়ে এসেছে বলে এসব ভাবছি, না কি এটাই বাস্তব সত্য, তা জানি না। অসুখের সময়—চক্র শুরুর সঙ্গে সঙ্গে আমার চিন্তারও যে পরিবর্তন হয়, তা জানি। সে—কথা অস্বীকার করি না। তা সত্ত্বেও আমার যুক্তিতে কোনো ফাঁক নেই।

পাতালঘরটা অসুখটাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে না তো? এ নিয়ে আগে কখনও ভাবিনি। মনে হয়তো কথাটা এসেছে, কিন্তু যুক্তিহীন চিন্তা ভেবে আমল দিইনি। অথচ এ—কথাও তো সত্যি যে, পাতালঘরে যাওয়া শুরু করার আগে অসুখটা এতটা খারাপ ছিল না। তখনও নিজের ওপর আমার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ছিল। হোটেলে মাতালটার মৃত্যুই ছিল পাতালঘর তৈরিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রধান কারণ। কিন্তু এখন পেছনে তাকিয়ে বুঝতে পারছি তার মৃত্যুতে আমার কোনো হাত ছিল না, এবং সেই প্রধান কারণ পুরোপুরি মিথ্যে। ঠিকমতো বিচার—বিবেচনা না করেই আমি কাজ করেছি। এ—কথা ভেবে দেখিনি পাতালঘর আমার অসুখটাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে, আমাকে নিরাপদ রাখার বদলে আমার ক্ষতি করতে পারে। এর একটা প্রমাণ বর্ষার রাতে সেই আগন্তুকের ঘটনা। তাই এখন ভাবছি, ওই ঘরই হয়তো আমার অসুখকে ক্রমশ বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ—ভাবনার যুক্তিগত কারণও আছে। আকাশ দেখতে পেলে আমার কষ্ট বরাবর কম হত, আর এখন বদ্ধ ঘরে নিজেকে বন্দি রাখার ফলে অবস্থা হয়ে উঠেছে আরও মারাত্মক। এ—সবই আমার অনুমান। সত্যি—মিথ্যে জানি না। তবে যাই হোক, একটিবার পরখ করে দেখতে দোষ কী!

সাহস করে কালকের রাতটা পাতালঘরের বাইরে কাটালে কেমন হয়। পারব….?

৩ জুলাই, সকাল

লিখে আমার মনের ভাব বোঝানো যাবে না। আমি হতাশ হয়ে পড়েছি। নিজের ওপর ঘেন্না হচ্ছে। জানি, ব্যাপারটা আমার দোষ নয়, কিন্তু তাতে মনের লজ্জা তো দূর হয় না, আর বীভৎসতাও কমে না। এত যন্ত্রণা কোনো মানুষের শরীর সহ্য করতে পারে না। আমার হৃৎপিণ্ড ফেটে চুরমার হয়ে যাবে, গলে জল হয়ে যাবে মস্তিষ্ক। তাহলে সমস্ত স্মৃতি তরল হয়ে চুঁইয়ে পড়বে, এবং আমিও মারা যাব। কিন্তু কই, আমি তো এখনও বেঁচে আছি। এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো ছিল। আত্মহত্যার কথাও ভেবেছি। সত্যি সত্যি ক্ষুর বের করে তাকিয়ে থেকেছি আমার কবজির নীল শিরাগুলোর দিকে। কিন্তু পারিনি। কারণ ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা তাজা রক্ত আমাকে ওই ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেবে। শরীর থেকে ধীরে ধীরে আত্মার নিষ্ক্রমণের মুহূর্তেও আমার মনে পড়বে সেই নৃশংস রাতের কথা….ওভাবে আমি মরতে পারব না। ঘুমের ওষুধ সঙ্গে থাকলে এই মুহূর্তে খেয়ে সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতাম। কিন্তু নেই। কখনও ঘুমের ওষুধ আমি ব্যবহার করিনি। ওষুধপত্র খাওয়াটা আমি পছন্দ করি না।

এখন একটু ভালো লাগছে। এতক্ষণ শুয়ে ছিলাম। বিশ্রামের পর আরও স্পষ্টভাবে ঘটনাগুলো দেখতে পাচ্ছি। অবশ্য তার মানে এই নয় যে, সেসবের জন্যে আমিই দায়ী। আত্মহত্যা করলে আমি শাস্তি পাব, কিন্তু যে—অসুখটা আমাকে ভয়ঙ্করে পরিবর্তন করে অমানুষিক অপরাধ করিয়ে নিল, সে তো শাস্তি পাবে না!

নিজের প্রতি ঘৃণায় আমার মনে আগুন জ্বলছে, এ—ঘৃণা অতলান্ত। ইস, যদি কাল রাতটা পাতালঘরে থাকতাম….কিন্তু কী করে জানব? কল্পনায় কী করে বুঝব কী ঘটতে চলেছে? আমি খুব শান্তশিষ্ট মানুষ। আমার দেহ যে….এ—ধরনের কাজে ব্যবহার হতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে। মনে হচ্ছে, মাংসকাটা ছুরি নিয়ে নিজের হাত দুটো কবজি থেকে কেটে ফেলি, দাঁতগুলো উপড়ে ফেলি গোড়াসমেত। ঈশ্বর জানেন, যদি অতীতকে পালটে ফেলা সম্ভব হত তাহলে এ—প্রশ্ন উঠত না। ওই ঘটনা ঘটবার আগে নিজেকে আমি খুন করে ফেলতাম। কিন্তু এখন সে—প্রশ্ন অবান্তর। যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। কিন্তু আমার এত লজ্জা করছে….।

আজ সকালে বাড়ি ফিরে এসে স্বাভাবিকভাবে চলার চেষ্টা করেছি। ভীষণ কষ্ট হলেও এমন ভাব করেছি যেন কিছুই হয়নি। আমার স্ত্রী মুখে কোনোও কথা না বললেও দেখেছি, অবাক চোখে আমাকে খুঁটিয়ে লক্ষ করছে। সারাটা রাত কোথায় কাটিয়েছি সে—কথা পর্যন্ত জিগ্যেস করল না। তবুও ওকে বললাম ব্যবসার কাজে হঠাৎই আমাকে চলে যেতে হয়েছিল। জানি না আমার কথা ও বিশ্বাস করল কিনা। কাল রাতটা যে….’সেই’ রাত ছিল সে—কথা দুজনের কেউই মুখ ফুটে উচ্চারণ করলাম না। হয়তো ও ভাবছে, এ—মাসে সেরকম কিছু হয়নি, অথবা ভাবছে অসুখটা আমি সামলে উঠতে শিখেছি। অথবা হয়তো….অনিচ্ছাসত্ত্বেও এ—কথা আমাকে লিখতে হচ্ছে….হয়তো ও ভাবছে অসুখটার কথা আমি ভুলে গেছি এবং এ—অসুখ নিতান্তই মনের অসুখ। কী জানি, জানি না। ওর চালচলনে মনে হল যেন আমাকে কিছু জিগ্যেস করবে, কিন্তু করল না। এ—ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে হবে….পরে, যখন আরও স্পষ্টভাবে চিন্তা করতে পারব। আমার মনে এখনও আগুন জ্বলছে। গত রাতের কথা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না….মেয়েটার মুখ সর্বক্ষণ চোখের সামনে ভাসছে….এখন কাজের মধ্যে শুধু বারবার দাঁত মেজেছি, আর নখের ভেতরগুলো জলে ধুয়ে পরিষ্কার করেছি।

গায়ের জামাটা আমাকে পুড়িয়ে ফেলতে হয়েছে।

৩ জুলাই, বিকেল

ঘটনাটা সব খবরের কাগজেই বেরিয়েছে।

শেষ শহর সংস্করণে শেষ রাতের ঘটনাও খুঁটিনাটি সমেত প্রকাশিত হয়। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। একথা আমি আগে ভাবিনি। নিজের চিন্তায় এত বেশি মগ্ন ছিলাম যে, সেই দুশ্চিন্তায় পৃথিবীর বাকি লোকের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই খবরটা প্রতি কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় বেরিয়েছে, আর ওরা সমস্ত ঘটনাটা ভুল ব্যাখ্যা করেছে!

দুপুরে খেতে বসেই খবরের কাগজ আমার প্রথম চোখে পড়ে। সারা সকাল নিজের দুশ্চিন্তায় কাগজ দেখে উঠতে পারিনি। তন্দ্রা খাওয়ার টেবিলের একপাশে কাগজগুলো ভাঁজ করে সাজিয়ে রেখেছিল। প্রথম পৃষ্ঠার খবর হওয়ার ফলে ভাঁজ করা অবস্থাতেও ওই খবরটা স্পষ্ট চোখে পড়েছে। সুতরাং খাওয়া শুরু করার আগে ওগুলো পড়তে শুরু করলাম। সে—সময়টা তন্দ্রা চেষ্টা করে অন্যমনস্ক থাকার ভান করল। একদিক দিয়ে ভালোই হল, কারণ মনের ক্ষোভ বা রাগ লুকিয়ে রাখতে পারলাম না। কাগজের রংচড়ানো খবরের ঢং যে—কোনোও সংযমী শক্ত মানুষকেও ধৈর্য হারাতে বাধ্য করবে। তন্দ্রা জানে আমি কীরকম শক্ত ধাতের মানুষ। আমার শুধু একটাই আশা, ও যেন অন্তত বুঝতে পারে কাগজের খবরগুলো কীরকম মিথ্যে করে লেখা। ওরা কল্পনায় ফুলিয়ে— ফাঁপিয়ে ঘটনাটাকে যা—নয়—তাই করে সাজিয়েছে। এতটা বাড়িয়ে লেখা ওদের ঠিক হয়নি।

বাড়িতে আমি দুটো কাগজ রাখি। সে দুটোতেই যখন প্রথম পাতায় ওই খবর জায়গা পেয়েছে তখন বুঝতে আর বাকি থাকে না অন্যান্য কাগজ কী করেছে। ওরা লিখেছে, এ—কাজ নিঃসন্দেহে কোনো পাগল খুনির! পাগল খুনি! যতরকম ভয়ঙ্কর বীভৎস শব্দ আছে, যতরকম সস্তা চমক আছে, যতরকম নৃশংস কথা হতে পারে, সমস্ত জঘন্য খুঁটিনাটি বিবরণসমেত তাতে লেখা। আর প্রত্যেকটা কাগজেই (নিজের দুটো কাগজ শেষ হওয়ার পর বাইরে তৃতীয় ও চতুর্থ কাগজও কিনে পড়ে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে) এ—ঘটনাকে উন্মত্ত ব্যক্তির কাজ বলে উল্লেখ করেছে। কাগজের কাজ হল প্রকৃত ঘটনাকে শুধুমাত্র তথ্যসমেত তুলে ধরা। যে—জিনিস তারা জানে না তা নিয়ে উলটোপালটা তত্ত্ব কেউ তাদের কাছে শুনতে চায়নি। কিন্তু কাগজ বিক্রির দিকে ওদের এত ঝোঁক যে, তার জন্যে আজেবাজে অশ্লীল কথা লিখতেও ওরা পেছপা হয়নি। কী সাঙ্ঘাতিক নোংরা চরিত্রের ইতর লোকগুলো! এমনকী এ—কথারও ইঙ্গিত দিয়েছে যে, খুনটা যৌনতাভিত্তিক! এটাই সবচেয়ে খারাপ লাগল। প্রত্যেকটা কাগজেই ইঙ্গিত করেছে যে, মেয়েটিকে ধর্ষণ করা হয়েছে! আমার ভীষণ বমি পাচ্ছে। ওরা লিখেছে যে, মেয়েটির বেশবাস ছিল অগোছালো বিস্রস্ত, ছিন্নভিন্ন ঊরু রক্তাক্ত, নাড়িভুঁড়ি বের করে নেওয়া হয়েছে পেট চিরে, গায়ের ব্লাউজ, ব্রা, আর শায়া শতচ্ছিন্ন হয়ে টুকরো টুকরো এবং গোপন অঙ্গ—প্রত্যঙ্গ পাশবিক আক্রমণে নৃশংসভাবে বিধ্বস্ত! সমস্ত তথ্যই এমনভাবে সাজানো যাতে মনে হয় মেয়েটিকে বলাৎকার করা হয়েছে। মেয়েটা যেরকম ধস্তাধস্তি করেছিল তাতে যে বেশবাস বিশৃঙ্খল হয়ে পড়তে পারে তা কী ওরা বোঝে না? না কি লোকগুলো এমনই বিকৃত মনের যে, প্রতিটি কাজকেই যৌনতার ব্যাখ্যা ছাড়া ভাবতে পারে না? না কি ওরা সত্যকে এড়িয়ে যাচ্ছে—বেশি কাগজ যাতে বিক্রি হয় সেইজন্যে?

রাগে আমার সর্বশরীর জ্বলছে! কাগজগুলো যে এত দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে পারে তা আমার জানা ছিল না! আর জনতাকেও বলিহারি যাই….কাগজের বিক্রি বাড়াতে কিছু চটকদার আগাপাস্তালা মিথ্যে খবর দিলেই হল, লোকে হু হু করে কাগজ কিনবে। আমাদের সমাজটার হল কী যে নারী—পুরুষ নির্বিশেষে এ—ধরনের খবর পড়ে খুশি হয়! এ—ধরনের সমাজে কোনো অসুস্থ মানুষ কী করে আশা করবে যে, সে ভালো হয়ে উঠবে? ভীষণ দুঃখ পেলাম। মনে এখন শুধু দুঃখ আর হতাশা।

কাগজগুলো সব আমার ঘরে রয়েছে। সবকটার চেহারা একই রকম। শিরোনামে সামান্য তফাত থাকলেও মিথ্যেগুলোর কোনোও তফাত নেই। ‘জঙ্গলে উন্মত্ত খুনির হাতে যুবতীর মৃত্যু’ থেকে শুরু করে ‘আসক্ত শয়তানের হাতে তরুণী নিহত’ ও ‘লাভার্স লেনে যুবতীর ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ’ পর্যন্ত সবরকম শিরোনামই রয়েছে। আর কোনো গল্পেই শারীরিক অসুখের কোনো উল্লেখ পর্যন্ত নেই। ওরা সবাই কি অন্ধ? না কি সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে ভয় পায়? নির্দোষ ব্যক্তির চেয়ে মানসিক রোগী ওরা কি বেশি পছন্দ করে? এখন আমি কী করি? ভেবেছি প্রত্যেকটা কাগজের সম্পাদকীয় দপ্তরে চিঠি লিখব, জানাব আসলে গত রাতে কী ঘটেছিল, আমার অসুখটাই বা আসলে কী। চিঠিগুলো ওরা নির্ঘাত ছাপবে, তা সে বিক্রি বাড়াবার জন্যে হলেও। কিন্তু কে জানে, কলম চালিয়ে চিঠির এখানে—ওখানে আবার ইচ্ছেমতো পালটে দেবে কি না। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, যেটুকু সত্যি ওই চিঠিতে থাকবে সেটুকু ওরা নষ্ট করে ছাপবে। খবরের কাগজের সম্পাদকদের বিশ্বাস নেই, এ—কথা অনেক ঠেকে শিখেছি। এই নোংরা কাগজের সম্পাদকগুলোকে যদি কোনো বন্ধ ঘরে একা পেতাম….বদ্ধ পাতালঘরে, মাসের সেই ভয়ঙ্কর রাতে…? সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ওদের মুখের চেহারাগুলো কিরকম পালটে যায় সেটা একবার দেখতে ইচ্ছে করে। তখন ওরা বুঝবে পারতে আমার নামে নোংরা কুৎসা ছড়িয়ে কী ভুলই না ওরা করেছে। ওদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার সময় এই একমাত্র উপায়। নিজেদের ভুলের মাসুল কীভাবে দিতে হয় ওরা সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাবে। এতে ভুল শোধরানোর কোনোও পথ থাকবে না, তবে এ—শাস্তি ওদের পাওয়া উচিত। ওরা….

না, এসব ভাবা ঠিক হচ্ছে না। শুনতে পাচ্ছি, বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডের দ্রিমিদ্রিমি শব্দ, শিরা দিয়ে টালমাটাল গতিতে ছুটে চলেছে উষ্ণ রক্ত। মনে হয় এ গত রাতেরই কোনো প্রতিক্রিয়া, অসুখের পরবর্তী প্রভাব। নিজের ভাবনাকে এভাবে বলগাহীনভাবে এগোতে দেওয়াটা হয়তো ঠিক নয়। এতে অসুখটার সঙ্গে যুদ্ধ করার বদলে আমার মন তার আবেগের শিকার হয়ে পড়েছে। বিনা প্রয়োজনে কখনও এটাকে প্রভাব বিস্তার করতে দেব না। কিন্তু আমার মনের বর্তমান অবস্থা একেবারে অযৌক্তিক নয়। অচেনা—অজানা লোকেরা, যারা সত্যের ‘স’—ও জানে না, আমার গায়ে বিনা কারণে মিথ্যে কলঙ্ক লেপে দিয়েছে। তারা সত্যের পরোয়া করে না। ওদের শাস্তি পাওয়া দরকার। এসব লোক মরে গেলেই ভালো।

আমার ভীষণ বিরক্তি এবং রাগ হচ্ছে। আর লিখতে পারছি না। পরে কাগজওলাকে বলব, ওইসব আজেবাজে নোংরা কাগজ আমাকে যেন আর না দেয়….।

৩ জুলাই, রাত

শত কষ্ট হলেও সত্যি কী ঘটেছিল তা বলতে আমি বাধ্য। সমস্ত ঘটনা, সমস্ত সত্য—সব আমাকে লিখতে হবে। এভাবে আত্মশুদ্ধি হলে হয়তো আমি স্বস্তি পাব, অথবা আমার হতাশা হয়তো আরও বাড়বে….কিন্তু সেসব না ভেবেই আমাকে এ—কাজ করতে হবে। সেটা যে কোনো অসুস্থ লোকের কাজ, কোনো বিকৃতকামীর নৃশংস অপরাধ নয়, তা আমি প্রমাণ করবই। আমি একজন বিকৃত মানসিকতার পুরুষ, এই আখ্যাটাই আমাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে। আমি একজন বিকৃতকামী! এত লোক থাকতে সবাই আমাকেই এরকম ভুল বুঝল!

আমার একমাত্র প্রার্থনা, তন্দ্রা যেন খবরের কাগজগুলোর কথা বিশ্বাস না করে। কোনো ব্যাপারে নিজস্ব চিন্তার ক্ষমতা ওর নেই। নিজের মতো গড়ে তোলার বদলে ও যা পড়ে তাই বিশ্বাস করে। ও আমাকে ওই চোখে দেখবে, মিথ্যা রটনায় বিশ্বাস করবে, সে—কথা ভাবতে গেলে আমি পাগল হয়ে যাই। ও যদি বিশ্বাস করে বসে যে, সত্যিই আমি একটা অল্পবয়েসি মেয়েকে ধর্ষণ করেছি, তাহলে ওর মনের অবস্থাটা কী হবে? আমি এরকম নোংরা নৃশংস কাজ করতে পারি এ—কথা কেউ ভাবতে পারে মনে হলেই আমি স্থবির হয়ে যাই। যে এ—কথা বিশ্বাস করবে তাকে আমি ঘেন্না করি, ভীষণ ঘেন্না করি। বরাবরই শরীরে ও মনে আমি অত্যন্ত পবিত্র। এমনকি স্ত্রীর সঙ্গেও যৌনসংসর্গ যথাসম্ভব কম রাখতে আমি চেষ্টা করেছি। যৌন ক্ষুধায় অস্থির হওয়ার মতো অপরাধও কোনোওদিন আমি করিনি। যা করেছি শুধু তন্দ্রাকে তৃপ্তি দেওয়ার জন্যেই করেছি। আমার ধারণা ও একটু বেশি কামপ্রবণ, কিন্তু ওকে আমি শাসনে রাখতে পেরেছি। উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে পেরেছি সংযমই স্বাস্থ্য ও পবিত্রতার মূলমন্ত্র। যৌনসংসর্গে উচ্ছৃঙ্খল হওয়া মাদকদ্রব্যের নেশা করা, মাতলামির মতোই নোংরা রুচির কাজ।

হয়তো প্রেমিক—প্রেমিকাদের গোপন মিলনের জায়গায় ওই ঘটনাটা ঘটার ফলেই খবরের কাগজওলাদের মনে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তা নিতান্তই কাকতালীয় যোগাযোগ। শপথ করে বলতে পারি, নোংরাভাবে মেয়েটাকে আমি স্পর্শ পর্যন্ত করিনি। পরিবর্তন হলেও যদি আমার মনে সে—লোভ আসত, তাহলে তাকে দমন করার মতো ক্ষমতা আমার নৈতিক আদর্শ দেখাতে পারত। কিন্তু সে—লোভ আমার হয়নি। তার সামান্য ইশারাও পাইনি। মেয়ের জায়গায় কোনো পুরুষ হলে যেমনটি হত, ঠিক তাই। প্রথমত মেয়ে, তার ওপর যুবতী, সুন্দরী। চোখে—মুখে সস্তা চটকের সাজ। বিশ্বাস করুন, যা ঘটে গেছে তার সঙ্গে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই। দিব্যি করে বলছি। কারণ আমি জানি, কোনো অবস্থাতেই কোনো মেয়ের ওপর অবস্থার সুযোগ আমি নেব না।

ওরা যে ব্যাপারটা ভুল বুঝেছে তাতে একদিক দিয়ে মনে হয় ভালোই হয়েছে। এতে পুলিশ ভুল পথে এগোবে। ওরা কোনোও পাগল বিকৃতকামী মানুষকে খুঁজবে। আমাকে সন্দেহ করার কোনো উপায় নেই। আমার চালচলন, জীবনযাত্রায় কোনোদিন নিন্দের আঁচ পর্যন্ত লাগেনি। ওরা যতই তদন্ত করবে, ততই সত্য থেকে দূরে সরে যাবে। একটু আগে রাতের খবরে বলল, এই খুনের সঙ্গে লাইব্রেরিয়ানের মৃত্যুর কোনো যোগসূত্র থাকলেও থাকতে পারে। বেচারা অন্ধ গর্দভগুলো! এ—কথা ওরা ভাবল কেমন করে? আমার তো মাথায় কিছু আসছে না। মনে হয়, দুটো খুনকে একই খুনির কাজ বলে ওরা নিজেদের পরিশ্রম বাঁচাচ্ছে। সে যাই হোক, অন্তত এটুকু নিশ্চিত যে, সত্যের খোঁজ ওরা কোনোদিনই পাবে না।

সমস্ত ঘটনা গুছিয়ে লেখার মতো মনের অবস্থা এখনও ফিরে পাইনি। খবরের কাগজওলাদের ওপর আমার বিরক্তি, রাগ একটুও কমেনি। তা ছাড়া গত রাতের ঘটনায় মন অত্যন্ত বিচলিত। আসলে কী হয়েছিল সব কাল লিখব। খুব ঠান্ডা মাথায় কোনো কিছু বাদ না দিয়েই লিখব।

৬ জুলাই

শান্ত মনে যতক্ষণ না সব কিছু গুছিয়ে লিখতে পারব বলে মনে করেছি ততক্ষণ অপেক্ষা করেছি। এর আগে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু এখন আমি তৈরি। সে—রাতে কী হয়েছিল সমস্ত এখন বলব, প্রমাণ করে দেব খবরের কাগজওলারা কী মারাত্মক ভুল করেছিল।

সেদিন বিকেলে বহুদূর পর্যন্ত বেড়াতে গিয়েছিলাম। পায়ে হেঁটে। বিকেলের টিফিন সেরে যখন বেরিয়েছি তখনও সূর্য অস্ত যেতে অনেক দেরি। সে—রাতটা যে কোনো রাত তা তন্দ্রার হয়তো খেয়াল ছিল না, অথবা হয়তো ও ভেবেছিল, আমি একটু পরেই ফিরে আসব। অন্তত বেরোনোর সময় কোনো কথা ও জিগ্যেস করেনি। রাতটা যে কোথায় কাটাব তার ছিটেফোঁটা বুদ্ধিও মাথায় আসেনি, তবু এটুকু জানি, ওই অসহ্য পাতালঘর থেকে আমাকে চলে যেতে হবে অনেক দূরে। ওই ঘরে ফিরে যাওয়ার যন্ত্রণা আমি সইতে পারব না। আমাকে পালিয়ে যেতে হবে শহর ছেড়ে, লোকালয় ছেড়ে। কোনোরকম ঝুঁকি আমি নিতে চাই না। আমার ধারণা….তখন সে—ধারণা একেবারে বদ্ধমূল….সত্যিই আমার বিশ্বাস, পাতালঘরে বন্দি থেকেই গত কয়েক মাসে পরিবর্তনের ধাপগুলো এত দ্রুতগতিতে খারাপের দিকে মোড় নিয়েছে। বাইরের হাওয়া—বাতাস, আকাশ, চাঁদ, এসব থেকে আড়ালে থাকায় পরিবর্তন আনতে শক্তি দরকার হয় আরও বেশি। সুতরাং, স্বাভাবিক কারণেই পরিবর্তনের চরিত্রও হয়ে উঠেছে আরও মারাত্মক। এখন জানি, আমার সে বদ্ধমূল ধারণা পুরোপুরি ভুল। যে—পরিশ্রম করে পরিবর্তনটা আসে তার সঙ্গে তার ভয়ঙ্করতার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তখন আমার বিশ্বাস এটাই ছিল। কোনো বিপদের আভাস আমি পাইনি।

উদ্দেশ্যহীনভাবে কিছুক্ষণ পথে পথে ঘুরে বেড়ালাম, তারপর সন্ধে হয়ে আসতেই লোকালয় ছেড়ে রওনা হলাম। হেঁটে চললাম শহরের পশ্চিম দিকে। ধীরে অথচ অবিচলিত পদক্ষেপে এগিয়ে চললাম। খুব শিগগিরই শহর, লোকালয় পড়ে রইল পেছনে। হঠাৎই দেখি, আমি দাঁড়িয়ে খোলা রাস্তায়। চওড়া সড়কে প্রচণ্ড শব্দ তুলে ধুলোর মেঘ উড়িয়ে মাঝে মাঝে ছুটে যায় মোটরগাড়ি। কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। গাড়ি আমি কোনোদিনই পছন্দ করি না, বরং হাঁটতে অথবা ট্রেনে চড়তে ভালো লাগে। হয়তো আমি একটু সেকেলে, কিন্তু তাতে ক্ষতিটা কী? আজকের দিনে, আজকের মতো অলস শিথিল যুগে, সেটাই হয়তো নীতি ও পবিত্রতার লক্ষণ। একসময়ে আঁধার নেমে এল, রাস্তা দিয়ে ছুটে যাওয়া গাড়ির হেডলাইট জ্বলে উঠল। বুঝলাম, এবার আমাকে একেবারে নির্জনে যেতে হবে, সুতরাং প্রথম মেঠো পথটা চোখে পড়তেই বড় রাস্তা ছেড়ে সেদিকে পা বাড়ালাম।

রাস্তাটা সরু, এবড়োখেবড়ো। এগিয়ে গেছে উত্তর দিকে। রাস্তার দু—ধারে বড়—বড় গাছ। আরও দূরে তাকালে দেখা যায় গাছের ঘন সারি। বড় রাস্তার শব্দ ক্রমে আমার কানে মিলিয়ে আসে। এ—রাস্তায় গাড়ি নেই। কোনো পথচারীও নেই আমার মতো। কিন্তু ধুলোময় পথে ভালো করে তাকালে চোখে পড়ে গাড়ির চাকার দাগ। তখনও বুঝিনি, এ—পথে গাড়ি—ঘোড়া লোকজন আসার সময় তখনও হয়নি। বিশ্বাস করুন, দিব্যি করে বলছি, তখনও আমি জানতাম না। এ—পথ এগিয়ে গেছে এখানকার ‘প্রেমকুঞ্জের’ দিকে। এ—কথা আমার মনেও আসেনি। এ—সব আমি পছন্দও করি না। না, আমি কচি খোকা নই। আমি জানি, বিয়ের আগেই ছেলেমেয়েদের মধ্যে কত নোংরা কাজ এখানে হয়। দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির ভেতরে। জঙ্গলে। কিন্তু তখনও বুঝিনি, সেরকম একটা জায়গার দিকেই আমি এগিয়ে চলেছি।

রাস্তাটা চড়াই। সাপের মতো এঁকেবেঁকে উঠে গেছে ওপরে। প্রায় ঘণ্টাখানেক হাঁটার পরও কোনো লোকজনের দেখা পেলাম না। বারকয়েক দু—একটা কুকুর চোখে পড়ল। ওরা আমাকে দেখে দাঁত খিঁচিয়ে চিৎকার করতে লাগল। আমি তেড়ে যেতেই লেজ গুটিয়ে পালাল। পালানোর সময় বারবার পেছন ফিরে দেখতে লাগল আমাকে। কুকুররা বরাবরই আমাকে দেখলে ভয় পায়। ভয়ঙ্কর চেহারার সাহসী কুকুরও আমাকে দেখলে ছুটে পালায়। এতে বেশ মজা লাগে। এমনটা কেন হয়, কেউই বুঝতে পারে না। হঠাৎ একটা বিশাল হাউন্ড রাস্তার ঠিক মাঝে আমার সামনে রুখে দাঁড়াল। কোত্থেকে ওটা এল কে জানে। কার—ই বা কুকুর? একের পর এক এত কুকুর আসছে, কোথা থেকে? ওরা কি আমার গন্ধ পায়?

হাউন্ডটার ছুঁচলো দাঁত প্রকট। এই আঁধারেও স্পষ্ট চোখে পড়ে। আমি এক অদ্ভুত শব্দ করে চকিতে এগিয়ে গেলাম ওটার দিকে। কুকুরটা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে পালাল। ব্যাপারটা এত মজার যে, আমার ভীষণ হাসি পেল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই টিলার মাথায় পৌঁছে গেলাম। রাস্তাটা শেষ হয়েছে এক বিশাল গর্তের কাছে। হয়তো কোনো কারণে এখানে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছিল, সঠিক বলতে পারি না। তবে লোকজন কেউই নেই। নিস্তব্ধ। নির্জন। অন্ধকার ইতিমধ্যে আরও জাঁকিয়ে বসেছে। আমি বিশ্রাম নিতে থাকলাম। একটা চ্যাপটা পাথরের ওপর বসে জামার দুটো বোতাম খুলে দিলাম। বেশ গরম লাগছে। এতটা পথ উঠে এসে রীতিমতো ঘামছি। এখন এই খোলা জায়গায় একা একা বসে ভালো লাগছে। মনে পড়ছে ছোটবেলার কথা। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হয়ে ভাবলাম পরিবর্তন খুব সামান্যই হবে এবং পুরোনো দিনের মতো এই জঙ্গলে ছোটাছুটি করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। একবারের জন্যেও মনে হয়নি অন্য কোনো মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হতে পারে। চারদিক এত নির্জন, এত শান্ত। শহরের শব্দ আর জঙ্গলের শব্দ এক নয়। এ—শব্দে এক অদ্ভুত মায়া আছে। যেন সঙ্গীতের মূর্ছনার মতো। চোখ বুজে বসে থাকতে ভীষণ ভালো লাগছিল। আমার ধারণা, ওভাবেই সারাটা রাত আমি কাটিয়ে দিতাম, আর নৃশংস কোনো ঘটনাও সেখানে ঘটত না—যদি না কালো গাড়িটা হঠাৎই এসে হাজির হত….।

বহুদূরে থাকতেই গাড়িটার ইঞ্জিনের শব্দ আমার কানে এল। প্রথমে ভেবেছিলাম গাড়িটা হয়তো বড় রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে, কিন্তু ক্রমে সে—শব্দ কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। বিরক্ত হলাম। এ—সময়ে কেউ এসে পড়ুক, আমি চাই না। এই নির্জন খাদের দিকে গাড়ি নিয়ে কে—ই বা আসবে? কেন আসবে? গাড়িটা যে এ—পথেই আসছে সে—বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম, তারপর পাথর ছেড়ে ধীরে—ধীরে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকলাম। ঝোপের আড়ালে বেশ কিছুটা ঢুকে আত্মগোপন করলাম। জানি, বাইরে থেকে কেউ আমাকে আর দেখতে পাবে না। আস্তে হাঁটুগেড়ে বসলাম। হাঁটুর তলায় ঝরাপাতা, মাটি শুকনো ও ভঙ্গুর। তবু কেমন এক অদ্ভুত আস্বাদ হাঁটু দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে আমার শরীরে ঢুকতে লাগল। অন্ধকার এখনও ঘন হয়নি। সুতরাং সামনের কাঁচা রাস্তা আমার চোখের সামনে স্পষ্ট। এখানে ঘাপটি মেরে বসে রাস্তার শেষে গর্তটাও দেখতে পাচ্ছি। একটু পরেই ধুলোর মেঘ উড়িয়ে গাড়িটা উঠে এল। রাস্তার একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে থামল। অপেক্ষায় রইলাম। ভাবলাম, গাড়ির ড্রাইভার এখনই দেখতে পাবে যে, সামনে আর পথ নেই এবং গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যাবে। কিন্তু তা হল না। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হল। মনে মনে প্রচণ্ড রাগ হল। যেন আমার গণ্ডি দেওয়া জমিতে কেউ অনধিকার প্রবেশ করেছে। নীচু হয়ে ঝোপের ফাঁক দিয়ে গাড়িটাকে দেখতে লাগলাম। আর তখনই বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা ঠিক কী হচ্ছে।

গাড়িতে একটা মেয়ে রয়েছে। দুটো ছেলে আর একটা মেয়ে। গাড়িতে কী হচ্ছে তা স্পষ্ট দেখতে না পেলেও যথেষ্ট শব্দ, খিলখিল হাসি ও টুকরো টুকরো কথা আমার কানে এল। এবার বুঝলাম গাড়িতে কী কাণ্ডটা হচ্ছে। শরীরের ভেতর রাগ উথলে উঠল। আমার হাতের আঙুল বসে গেল শুকনো মাটিতে, গলা দিয়ে বেরিয়ে এল চাপা গর্জন। খালি ভাবছি, এই বোধহয় ওরা চলে যাবে। ওরা এখনও যাচ্ছে না কেন? কিন্তু ওরা গেল না। হঠাৎই জমাট হয়ে এল অন্ধকার এবং মেঘের আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করল পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ল গাড়িটার কালো চকচকে শরীরে। আর তার ভেতর থেকে ভেসে আসছে ইতর নোংরা শব্দ। ইচ্ছে হল চলে যাই, যত জোরে পারি ছুটে পালিয়ে যাই। কিন্তু কী একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আমাকে বেঁধে রাখল। যেতে আর পারলাম না। এমনকী গাড়িটার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারলাম না। মনে হয় পরিবর্তনটা তখনই এসে থাকবে, কিন্তু কখন যে ওটা শুরু হল আর শেষ হল, টেরই পাইনি। এমনকী শেষ হওয়ার পরও বুঝতে পারিনি আমি অমানুষ হয়ে গেছি।

আর তখনই ওরা গাড়ি থেকে নেমে এল! মেয়েটা খিলখিল করে খুব হাসছে, বেশবাস মোটামুটি বিস্রস্ত। ও প্রথমে নেমে গাড়িটার একপাশে দাঁড়াল। নিজের শাড়ি, ব্লাউজ ঠিকঠাক করতে লাগল। লোক দুটো এবার গাড়ি থেকে নামল। একজনের হাতে একটা বড় চাদর। সেটা সে পথের ধারে শুকনো পাতার ওপর ছড়িয়ে দিল। অন্য লোকটার হাতে একটা বোতল। সম্ভবত মদের বোতল। সে বেরিয়ে এসেই এক হাতে মেয়েটাকে জাপটে ধরে চুমু খেল। দেখলাম, তার ঠোঁট পিষে যাচ্ছে মেয়েটার ঠোঁটে।

স্পষ্ট বুঝতে পারছি, মেয়েটার মুখে ফুটে উঠেছে তৃপ্তির আমেজ। না, মেয়েটা ভালো নয়।

ঝোপের আড়ালে গুড়ি মেরে বসে সবই দেখলাম। ওরা তিনজনে চাদরটার ওপরে ঘন হয়ে বসল। দ্বিতীয় লোকটা টেনে খুলে নিল মদের বোতলের ছিপি। তারপর দুজনে মিলে ঢকঢক করে মদ খেতে লাগল। একবার বোতল থেকে এ এক চুমুক খায়, তারপর ও খায় এক চুমুক। আর ফাঁকে ফাঁকে চলল মেয়েটাকে নিয়ে ফষ্টিনষ্টি। চলল ওর বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ নিয়ে বিচিত্র খেলা। একে একে খসে গেল ওর গায়ের শাড়ি, কুশলী হাতের প্রচেষ্টায় খুলে গেল ব্লাউজ। অবশেষে উন্মুক্ত হল ব্রা। মেয়েটা শুয়ে পড়ল চাদরের ওপর। ধীরে ধীরে তুলে ধরল শেষ অন্তর্বাস।

এবার শুরু হল তিনটে শরীরের মিলিত শ্রম। চাঁদের আলো পিছলে যায় তিনটে অর্ধ অনাবৃত সরীসৃপ—শরীরে….প্রথমে একজন….তারপর আর একজন….ওঃ, আমি আর লিখতে পারছি না। এমন কিছু কিছু জিনিস আছে স্বাভাবিক সুস্থ মানুষ যার মুখোমুখি হতে পারে না। ওরা কীসব করতে লাগল, আমি গুড়ি মেরে বসে রইলাম ঝোপের আড়ালে, সমস্ত একে একে দেখলাম….।

নিজেকে সংযত করলাম। হয়তো সামনের বীভৎস দৃশ্য আমাকে সম্মোহিত করে রেখেছিল। সেই কারণেই মনে সংযম এসেছে বিনা আয়াসে। ইচ্ছে হল নখ—দাঁত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি জঘন্য নোংরা কীটগুলোর ওপর, ওদের চরম শাস্তি দিই, শেষ করে দিই ওদের অশ্লীল নষ্টামির। কিন্তু অপেক্ষায় রইলাম। অনেকক্ষণ পর কামতৃপ্ত দুটো মানুষ উঠে বসল, নিজেদের জামাকাপড় পরতে লাগল। মেয়েটা তখন আধশোয়া অবস্থাতেই হাসছে। দুষ্টু হাসি।

কিছুক্ষণ ও চাদরের ওপরে শুয়ে রইল। ওকে দেখে পরিতৃপ্ত বলেই মনে হল। যেন এই বদ কাজে ভীষণ আনন্দ পেয়েছে। মেয়েটার দিকে তীক্ষ্ন চোখে তাকালাম। দেখলাম ওর ঠোঁটে শয়তানির বাঁকা হাসি। হাঁটু মুড়ে মাথা এলিয়ে ও আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। দেখলাম ওর নরম গলা, ঢেউ খেলানো পিঠ, সাদা ধবধবে ঊরু। মেয়েটার সবই যেন দূষিত কদর্য। চাঁদের আলোর এক রুপোলি বর্শা বিদ্ধ করেছে ওর নগ্ন শরীর এবং নিজের দেহকে আবৃত করতে একটুও ব্যস্ত নয় ও। ওর দুধ—সাদা দুটো পা দু—পাশে ছড়ানো, সমস্ত পোশাক—আশাক স্তূপীকৃত একপাশে। এত নীচ অশ্লীল নোংরামি আমি কখনও কল্পনাও করিনি।

এরপর এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। কী হল ঠিক বুঝতে পারলাম না। লোক দুটো আচমকাই উঠে বসল গাড়িতে। ওরা কর্কশভাবে হাসছে। তারপর দু’জনের একজন জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে মেয়েটাকে কী যেন বলল। মেয়েটা চমকে উঠে বসল, সোজা হয়ে দাঁড়াল এক লাফে। চিৎকার করে ছুটে গেল গাড়ির দিকে। চেষ্টা করল দরজা খুলে গাড়িতে উঠতে, কিন্তু ততক্ষণে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। মেয়েটার মুখে ফুটে উঠেছে অসহায় ত্রস্ত ভাব, আর লোক দুটো খুশি খুশি। গাড়িটা ঘুরিয়ে ওরা যে—পথে এসেছে সেই পথে রওনা হল। মেয়েটা গাড়িতে ওঠার জন্যে কাতর স্বরে ওদের কাছে অনুনয়—বিনয় করতে লাগল। কিন্তু ওদের মন ভিজল না। গাড়িটা চলে গেল। যাওয়ার সময় জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একজন হাত নেড়ে বিদায় জানাল মেয়েটাকে। আর ও অভদ্র নোংরা ভাষায় ওদের গালাগালি দিতে লাগল। সেসব শব্দ দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করা কোনো ভদ্রলোকের পক্ষে সম্ভব নয়।

মেয়েটা দাঁড়িয়েই রইল, চোখের নজর ঢালু রাস্তা ধরে এগিয়ে চলা গাড়িটার দিকে, আর আপনমনেই কীসব বিড়বিড় করতে থাকল। ওর হাত দুটো কোমরের পেছনে, পাছায়। ওর বিড়বিড় করে বলা কথাগুলো মাঝে মাঝে শুনতে পেলেও তার অর্থ বিন্দুমাত্রও বুঝলাম না, কারণ কোনোদিন ওসব কথা শুনিওনি। অথচ আমার বয়েস নেহাত কম নয়। কিন্তু এটুকু বুঝলাম যে, শব্দগুলোর সম্পর্ক শুধুমাত্র যৌনতার সঙ্গে। কারণ রাগ হলেও মেয়েটার নোংরা চরিত্র বদলায়নি। বদলাতে পারে না। এর চেয়ে বড় পাপী আমি জীবনে দেখিনি। আমার ধারণা, নিজেদের বাসনা চরিতার্থ হলে পর লোক দুটো হঠাৎই ভয় পেয়ে যায়, এবং নিজেদের পাপের জন্যে, অন্যায়ের জন্যে মেয়েটাকে দায়ী করে ওকে শাস্তি দিতে ফেলে পালায়। এ ছাড়া অন্য কোনো ব্যাখ্যা আমার মাথায় আসছে না। তবে চলে যাওয়ার সময় ওরা অমন হাসছিল কেন কে জানে। নারী—পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে সমস্ত ব্যাপার আমার মাথায় ঢোকে না। কিন্তু এটুকু বুঝি কোনটা পাপ, অন্যায়, এবং এই মেয়েটা পাপী। একে শাস্তি দেওয়া উচিত।

মেয়েটাকে আঘাত করার ইচ্ছা আমার ছিল না। কী ইচ্ছে ছিল তাও জানি না। মেয়েটা চাদরের কাছে ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তারপর উঠে দাঁড়ালাম, বেরিয়ে এলাম খোলা জায়গায়। মেয়েটা তখন নীচু হয়ে শায়াটা তুলছিল। আমি নিঃশব্দে ঠিক ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মেয়েটা শায়াটা সবে মাথা গলিয়ে গলায় পরেছে, নামাতে যাবে কোমর পর্যন্ত—এমন সময় আমি হয়তো অস্ফুট কোনো শব্দ করে থাকব—হঠাৎ ও চকিতে ঘুরে দাঁড়াল আমার দিকে।

ও চিৎকার করেছিল কিনা ঠিক মনে নেই। ওর মুখ ত্রাসে বিস্ময়ে বিস্ফারিত, কিন্তু কোনো শব্দ আমার কানে এল না। হয়তো আতঙ্কে ওর চিৎকার গলায় আটকে গেছে, কিংবা আমার কান হয়তো তখনকার মতো স্থবির হয়ে পড়েছিল। টলতে টলতে কয়েক পা পিছিয়ে গেল মেয়েটা—হাতদুটো ওপরে তোলা, হাতের তালু সামনে এগিয়ে আমাকে বাধা দেওয়ার কাল্পনিক প্রচেষ্টায় রত। শায়াটা নেমে গেছে ওর পা পর্যন্ত, সেখানে জট পাকিয়ে রয়েছে। ওর মুখে অদেখা অচেনা বিকৃত ভয়ের অসংখ্য রেখা। আমি ধীরে ধীরে ওকে লক্ষ্য করে এগিয়ে চললাম। আমার নখর হাত সামনে থাবার মতো বাড়ানো, দাঁতের ওপর থেকে সরে গেছে ঠোঁটের আবরণ।

আরও কাছে যেতেই মেয়েটা শায়া পায়ে জড়িয়ে পড়ে গেল মাটিতে। ওর চোখ আমার মুখ থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও সরল না। ওর শরীরে উবু হয়ে যখন ঝুঁকে পড়লাম তখন ও সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে। ওর আতঙ্ক আমাকে যেন আরও উৎসাহ জোগাল। শপথ করে বলছি, আমি শুধু ওকে ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আতঙ্কের মধ্যে কী যেন একটা নেশা আছে….আতঙ্কের অদ্ভুত গন্ধ, আমেজ….আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। ভয় ও রক্তের গন্ধ অনেকটা একই রকম। পারলাম না নিজেকে সংযত করতে। এ—সবই ওই মেয়েটার দোষ। ওই লোক দুটোর মতো আমাকেও সে বাধ্য করল এই নৃশংস কাজে। দেখলাম ওর সাদা ঊরুর ঝলক, নড়ে উঠল ওর রঙিন ঠোঁট, আর আমার মনে জেগে উঠল ছিন্নভিন্ন করার ইচ্ছে, ফালা ফালা করে ধ্বংস করার ইচ্ছে। মনে হল ধারালো নখ বসিয়ে দিই ওর নরম মাংসে, যাতে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে উষ্ণ রক্ত, শেষ হয়ে যায় ওর কলঙ্কিত নোংরা জীবন।

আর তখনই আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম মেয়েটার ওপর।

সর্বক্ষণ ও সরাসরি চেয়ে রইল আমার চোখে। অবশেষে ওর চোখ হয়ে এল আচ্ছন্ন, ঘোলাটে। অস্বাভাবিক সময় পর্যন্ত বেঁচে ছিল মেয়েটা।

পরে কী হয়েছিল মনে নেই। মনে নেই ওর মৃতদেহের ওপর কতক্ষণ আমি উবু হয়ে বসে ছিলাম, কিংবা কী করেছি ওর দেহ নিয়ে। খবরের কাগজে মেয়েটার মৃতদেহের যে—অবস্থার কথা লিখেছে তা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমি নিশ্চয়ই বেশ কিছু সময় ওখানে বসে কাটিয়েছি। কিন্তু আর কিছু ওরা ঠিক লেখেনি। এসব যে গুছিয়ে লিখতে পারলাম তার জন্য আনন্দ হচ্ছে। অন্তত সত্যি ঘটনাটুকু তো কাগজে—কলমে লেখা রইল।

এই হল আসল ঘটনা—ঠিক যেভাবে সব ঘটেছিল।

২০ জুলাই

গত দু—সপ্তাহ আর ডায়েরি লিখিনি। এমনকী ওটা পড়িওনি। মনে হয় ওই শেষ ঘটনাটা লেখার পর আমি নিস্তেজ, ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। অসুখটার কথা কিছুদিন ভুলে গিয়ে আরাম করতে বেশ ভালোই লেগেছে। এই হল আধুনিক সভ্যতার এক বিরাট দোষ : এখানে আরাম বা বিশ্রামের সময় নেই। সৌভাগ্যক্রমে কোনোদিনই অর্থ, যশ অথবা সুখের পেছনে দৌড়নোর নেশা আমার ছিল না। নিজের ইচ্ছেয় তারা কেউ আমার কাছে এলেই আমি সন্তুষ্ট, না এলেও অসন্তুষ্ট নই। আমি যুক্তিবাদী, সুখ—দুঃখে নির্বিকার এবং নিঃসন্দেহে কালের ইতিহাসে কয়েকশো বছর পরে জন্মগ্রহণ করেছি। কিন্তু তার জন্যে আমার কোনো অভিযোগ নেই। অহঙ্কার প্রকাশ করা আমার স্বভাব নয়, তবে এটুকু বেশ বুঝতে পারছি, ক্রমে ক্রমে এই অসুখটাকেও জীবনের অন্যান্য ঘটনার মতো আমি মানিয়ে নিতে পারব। হাজার হলেও মাসে একটা মাত্র রাত তো! বছরে মাত্র বারোটা রাত আমাকে কষ্ট পেতে হবে। এর চেয়েও খারাপ অসুখ তো আমার হতে পারত! অনেকেরই তো হয়। কিন্তু সে—অসুখগুলো সবার কাছে সাধারণ ও পরিচিত বলে বিশেষ কোনো গুরুত্ব পায় না। আর আমার অসুখটা যেহেতু অপরিচিত, সেহেতু সত্যিকারের যত না তার চেয়েও বেশি লোকে ভয় পায়। ক্যানসার, কুষ্ঠরোগ কিংবা অন্ধ হয়ে যাওয়ার চেয়ে নিশ্চয়ই এ—অসুখ ভয়ঙ্কর নয়! একমাত্র নিজের অহঙ্কারই আমাকে ভাবতে শিখিয়েছিল এ—অসুখ নৃশংস, ভয়ানক। সেসব চিন্তাকে এখন দূরে সরাতে পেরেছি বলে ভালো লাগছে। অসুখটাকে আমি চরিত্র অনুযায়ী যথাযথ বিচার করতে শিখেছি। এ যদি আমার পরীক্ষা হয়ে থাকে তাহলে সে—পরীক্ষায় আমি সসম্মানে পাশ করেছি। এখন আমি অনেক সুখী, অন্তত আগের চেয়ে। কারণ এই প্রথম আমি গুছিয়ে ভাবতে পারছি—অন্যান্য জিনিস সম্পর্কে যেরকম গুছিয়ে চিন্তা করতে পারি, অসুখটা নিয়েও সেরকম পারছি। ছোট ছোট সুখ, ছোট ছোট আনন্দ—খুশির মতো এই যন্ত্রণাকেও আমি মেনে নিয়েছি। নিষ্ঠুর সমাজকে নিয়ে যেমন বাঁচতে শিখেছি, তেমনই এই অসুখকে নিয়েও আমি বাঁচতে পারব। তন্দ্রার স্বল্পবুদ্ধি যদি আমাকে ধৈর্যের সীমা অতিক্রম না করায়, তাহলে এই অসুখও পারবে না।

সেই রাতের কথা যা লিখেছি সবই পড়ে দেখেছি। ও—লেখার সবটাই বাস্তব এবং সত্যি। আমার ধারণা, ওই লেখার ফলে আমি নিজেকে আরও স্পষ্ট চোখে নিখুঁতভাবে দেখতে পাচ্ছি। একটা জিনিস আমার নজরে পড়েছে। ক’দিন আগে হলেও এ নিয়ে আমি দুশ্চিন্তায় পড়তাম। কিন্তু এখন নিজেকে আরও বেশি করে বুঝতে পারছি….ব্যাপারটা হল, সেই রাতের ঘটনা লেখার সময়ে আমি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমাকে ‘আমি’ বলেই উল্লেখ করেছি। কখনও ‘ওই প্রাণীটা’ বা ‘অমানুষটা’ বলে উল্লেখ করিনি। স্পষ্টই বোঝা যায়, ওই শব্দগুলো সত্যের মুখোমুখি না হয়ে আত্মরক্ষার নিষ্ফল মিথ্যে প্রচেষ্টা মাত্র। কারণ ‘ওই প্রাণী’ বা ‘অমানুষ’—যাই বলি, সেটা আসলে আমিই। আমরা এক ও অদ্বিতীয়—বাইরের রূপ আমাদের যাই হোক না কেন আসলে আমরা একই। এ—কথা স্বীকার করতে আমি এতটুকু ভয় পাচ্ছি না। এতেই বোঝা যাচ্ছে আমার চিন্তা কীরকম সুষম পথে চলেছে। কী সুন্দর গুছিয়ে ভাবতে শিখেছি আমি। কিন্তু আমার লেখার ধরনটা হঠাৎ পালটে গেল কেন? সে কি ওই ঘটনার খুঁটিনাটি মনে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি বলে? না কি সেই ভয়ঙ্কর অমানুষটা ক্রমশ আমার শরীর ও মনের কাছাকাছি এগিয়ে আসছে, এবং আমিও ওটার দিকে এগিয়ে চলেছি? অথবা নিছকই লেখার সুবিধের জন্যে? কারণ যাই হোক না কেন, লক্ষণটা খারাপ নয়, ভালো। এতে অস্বীকারের গোঁয়ার্তুমির চেয়ে সততা বেশি দেখা যাচ্ছে। অবশ্য সে—রাতটা এক অস্বাভাবিক রাত ছিল….এক বিস্ময়কর রাত….পাতালঘরের ভয়ঙ্কর রাতগুলোর চেয়ে ওই রাতের স্মৃতি যে অন্যভাবে মনে পড়বে এতে আর আশ্চর্য কী! এখন ধৈর্য ধরে দেখতে হবে পাতালঘরে এ—রাতটা কেমন যায় : বন্দি রাত। ডায়েরিটা তখন সঙ্গে করে নিয়ে যাব। এবারে প্রচুর সময় হাতে নিয়ে যেতে হবে। বাইরে থাকার ঝুঁকি আর নেব না। নতুন কোনোও দুর্ঘটনাকে আর কখনও প্রশ্রয় দেব না। কিন্তু….এখন ঠিক বুঝতে পারছি না সে—রাতে বাইরে থেকে খারাপ হয়েছে না ভালো হয়েছে। হয়তো ভালোই হয়েছে। কথাটা নির্মম মনে হলেও আমি নিরুপায়। বাস্তব সব সময়েই নির্মম। আর যদি কেউ ভেবে দেখে যে, কত নিষ্পাপ তরুণকে ওই মেয়েটা নষ্ট করত, কীভাবে তাদের ঠেলে দিত পাপ, অন্যায় আর ধ্বংসের পথে….হ্যাঁ, তাহলে হয়তো বলা যায় অনেক ভালো মানুষকে আমি রক্ষা করেছি। আর মেয়েটা মরে গিয়ে ভালোই হয়েছে। ওর বেঁচে থাকার কোনো প্রয়োজন ছিল না। বয়েসে কম হলেও পাপের ভারে ও বৃদ্ধা। দুশ্চরিত্র কলুষিত জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে ও মোটেই সুখী হত না….।

ওই ঘটনার পরের দিন আমি সত্যি সত্যি আত্মহত্যার কথা ভাবলাম কী করে? তখন মনে আবেগ বেশি ছিল, তাই স্বভাববিরুদ্ধ আচরণ করেছি। কিন্তু এখন সব ঠিক আছে। অনেক—অনেকদিন পরে গত দুটো সপ্তাহ ভীষণ ভালোভাবে কেটেছে। এর কারণ বলা মুশকিল, তবে ব্যাপারটা যেন অনেকটা, আমি কোনো কাজে সফল হয়েছি….যেন হঠাৎই কিছু পেয়েছি, অনেক দিন ধরে মনের অজান্তে যে—জিনিসটা আমি খুঁজছিলাম যেন হঠাৎই সেটা আমার হাতে এসে গেছে। অথচ তবুও কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না। কী পেলাম তা জানি না। সেটা চোখেও দেখতে পাচ্ছি না। নিশ্চয়ই জিনিসটা অদৃশ্য, অস্পৃশ্য—হয়তো আমার মনের কোনো হতাশা—যার অস্তিত্ব আছে বলে জানতাম না—চিরকালের মতো দূরে সরে গেছে। হয়তো সেই রাতের ঘটনার আঘাতে আমার মনের আড়াল—আবরণ চুরমার হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই এরকমই কিছু একটা হয়ে থাকবে। মনের চিন্তাভাবনা আবেগের পথ ধরে আমি ঠিকঠাক এগোতে পারছি না, তবে সেটা অনুভব করতে পারছি। এ কোনো নতুন অনুভূতি নয়, এ আমার তৃপ্তিকে এক নতুন গভীরতায় পৌঁছে দিয়েছে। মনে পড়ে, ছোটবেলায় এরকম হত। আমার সুন্দর আদরের খেলনাটা যখন ভেঙে ফেলি তখন অনেকটা এরকম লেগেছিল। যে—নৃশংস কুকুরটা আমাকে আক্রমণ করেছিল, তাকে মেরে ফেলার সময়ও এরকম হয়েছিল। এ বড় অদ্ভুত ব্যাপার। সবচেয়ে আশ্চর্য হল, তিন—তিনটে বিচ্ছিন্ন ঘটনা কী করে একই অনুভূতির জন্ম দেয়! আমার ভারি অবাক লাগছে….।

২৮ জুলাই

দিনটা এগিয়ে আসছে। আমি একেবারে নির্বিকার। আমার শরীর পুরোপুরি সুস্থ, মনও পরিষ্কার। আমি পবিত্র জীবন যাপন করি। তা সত্ত্বেও যদি আমাকে একটা রাত কষ্ট পেতে হয় তাহলে সে নিয়ে অনুযোগ করার কিছু নেই। শুধু আমার বউ যদি এরকম অদ্ভুত ব্যবহার করাটা বন্ধ করত! সারাটা মাস ওকে বড় বেশি দূরের মানুষ বলে মনে হয়েছে। হয়তো খবরের কাগজের মিথ্যে খবরগুলোর কিছু কিছু বিশ্বাস করে ও আমার ওপর রাগ করে থাকবে। কিন্তু সে—কথা ও মুখে বলেনি। ওই ব্যাপারে একটা কথা পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি। খবরটা এখন আর প্রথম পাতায় নেই, নতুন কেচ্ছাকাহিনি, মিথ্যে গপ্পো তার জায়গা নিয়েছে। কিন্তু প্রতিদিনই ভেতরের পাতায় ছোট্ট করে এক প্যারায় প্রকাশিত হচ্ছে পুলিশি তদন্তের অগ্রগতির কাহিনি। প্রত্যেকদিনই ওরা বলে, অপরাধী গ্রেপ্তার হল বলে! আমার হাসি পায়। ভগবান করুন, ওরা যেন নির্দোষ ছাপোষা লোককে গ্রেপ্তার না করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার বিশ্বাস, যদি ওরা কাউকে গ্রেপ্তার করে, তাহলে সে কোনো দাগি বিকৃতকাম অপরাধী হবে এবং সে হয়তো আমার অপরাধের চেয়েও বড় কোনো অপরাধের জন্যে দায়ী—সুতরাং আমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই! ভুল পাপে শাস্তি পেলে কোনো অবিচার হয় না, যদি সে—পাপী অন্য কোনো পাপ করে থাকে। আর আমার কথা যদি ওঠে—বা সেই লোকটির, যে লাইব্রেরিয়ানকে খুন করেছে….তাহলে বলব, কোনো অন্যায় হয়েছে বলে মনে করি না।

২৯ জুলাই

বিকেলে বেড়াতে বেরিয়ে যখন ফিরে আসছি দেখি একজন মিস্ত্রি আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে। বাইরে একটা লরি দাঁড়িয়ে ছিল। লরিটা যেন আমার খুব চেনা। পাতালঘর তৈরির সময় এই লরিতেই কি মালপত্র ইট—সিমেন্ট সব এসেছিল? কিন্তু মিস্ত্রিটাকে চিনতে পারলম না। হয়তো নতুন কোনো লোক।

তন্দ্রাকে এ—বিষয়ে প্রশ্ন করতেই ও চমকে উঠল, তারপর অস্বীকার করে বলে উঠল, ‘না তো, কেউ তো আসেনি!’

প্রথমে কৌতূহল হল। তারপর ভাবলাম, ও আমার প্রতি অবিশ্বাসী হয়ে উঠছে না তো? নইলে চমকে উঠে এত নার্ভাস হয়ে পড়বে কেন? কিন্তু এ—চিন্তা ভয়ঙ্কর। এ—ভাবনা মনে আনা আমার উচিত হয়নি। এ—জিনিস চিন্তা করাও পাপ। আসল ব্যাপারটা যে কী সেটা এখন অনুমান করতে পারছি। নিশ্চয়ই পাতালঘরটাকে আরও আরামের করে তোলার জন্যে নতুন কিছু ও করে থাকবে। হয়তো নতুন গদি লাগিয়েছে আরও পুরু করে, অথবা লাগিয়েছে বেশি পাওয়ারের আলো। এ ছাড়া আর কী হতে পারে জানি না। হয়তো তন্দ্রা আমাকে চমকে দিতে চায়, তাই এখন কিছু বলছে না। ওর ধারণা, পাতালঘরে গিয়ে সেটা হঠাৎ দেখলে আমি ভীষণ খুশি হব। বলা যায় না, হতেও পারি। মিস্ত্রিটা যদি পাতালঘরে গিয়ে থাকে তাহলে দেওয়ালে গদি লাগানোর একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ তন্দ্রা তাকে গুছিয়ে বলতে পেরেছে তো? বোকাসোকা রাজমিস্ত্রিরাও সময়ে—সময়ে চালাক হয়ে ওঠে, সব বুঝতে পারে। আমার ধারণা, ওদের অনেকে হয়তো খবরের কাগজও পড়ে। সে যাই হোক, নিজেদের ঘরের দেওয়ালে গদি লাগাব, এতে কার কী বলার থাকতে পারে? আমাদের খুশি, তাই লাগিয়েছি।

এখন আবার ভাবছি, লোকটা পাতালঘরের দরজায় আরও জবরদস্ত তালা লাগাতে আসেনি তো? তন্দ্রাকে ক’দিন ধরে বড় অদ্ভুত লাগছে….যেন অনেক দূরের মানুষ। সম্ভবত ও ভয় পেয়ে থাকবে। বেচারা! এরকমটা কেন হয়েছে বেশ বুঝতে পারছি। ওর সঙ্গে আরও মিষ্টি ব্যবহার আমাকে করতে হবে, ক্ষমা করতে হবে ওর দুর্বলতা। ওকে ভালোবাসার কোনো প্রমাণ দেওয়া প্রয়োজন। দেখি, আজ রাতে ওর ঘরে যাব। ওর সঙ্গে শোব। আমি গেলে ও বরাবরই খুশি হয়, চোখেমুখে ফুটে ওঠে কৃতজ্ঞতার ছাপ। ওর কাছে যাইনি আজ অনেক দিন। কিন্তু সে ওর দোষ। ও আমাকে হাবভাবে এটা কখনও জানায় না। জানে না, আমি এসব যা করি সব ওরই সুখের জন্যে। হয়তো ও ভাবছে, যতটা সম্ভব এসব কামনা—বাসনা এড়িয়ে চলাই ভালো….।

৩০ জুলাই

তন্দ্রা ভীষণ পালটে গেছে।

মেয়েমানুষের মনের হদিস কে বুঝতে পারে?

সবচেয়ে সরল ও নির্বোধ মেয়েরও মনের গভীরতার তল পাওয়া যায় না। আমার ধারণা, মনের কথা বোঝার ব্যাপারে কোনো মানুষের চেয়ে আমি কম নই। আমার যুক্তিবাদী মন যে—কোনো যুক্তিবাদী গভীরতা পরিমাপ করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তন্দ্রার ব্যবহারে এতটা পরিবর্তন কী কারণে এল তা আমি তলিয়ে উঠতে পারছি না। বেশ কিছুদিন ধরে এটা লক্ষ করছি, কিন্তু কাল রাতে ব্যাপারস্যাপার চরমে পৌঁছেছে। হয়তো কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই এরকমটা হচ্ছে। হয়তো স্ত্রী—মনের অণু—পরমাণুর গতি এরকমই চঞ্চল, বিক্ষিপ্ত, অস্থির। এ—কথা ভাবতেও আমার খারাপ লাগছে। আমি নিয়মবদ্ধ সুশৃঙ্খল জীবন পছন্দ করি। তা বলে অন্যান্য সম্ভাবনাকেও অস্বীকার করি না। বরং খোলা মনে মেনে নিই। খোলা মন না থাকলে আমার মতো পরিস্থিতিতে কোনো মানুষ বাঁচাতে পারে না। যদি জানতে পারি যে, এ—ধরনের অসুখ নিয়ে মানসিক ভারসাম্য একমাত্র আমিই বজায় রাখতে পেরেছি, তাহলে এতটুকুও অবাক হব না। হয়তো এ—উক্তির কোনোও মূল্য নেই, কিন্তু তবুও মূলধন করার জন্যে নিজের নৈতিক উৎকর্ষগুলো কোনোও মানুষের জানা দরকার। অহঙ্কারকে আমি কখনও প্রশ্রয় দিই না।

গত রাতে ওর ঘরে গিয়েছিলাম। ও সকাল সকাল শুয়ে পড়েছিল। তার একটু পরই ঠিক করলাম, ওর ঘরে যাই। কিন্তু সবই অন্যরকম ঠেকল। ওর ঘরের দরজা খুলতেই চকিতে উঠে বসল তন্দ্রা : গায়ের চাদরটা গলার কাছে আঁকড়ে ধরা, বিস্ফারিত দু—চোখ আমার দিকেই তাকিয়ে। যেন অন্ধকারে শুয়ে ও এই মুহূর্তটারই অপেক্ষা করছিল। ভাবছিল, কখন আমি আসব। এতেই আমার অবাক লেগেছে। আর যেভাবে ও আমার দিকে তাকিয়ে ছিল….হ্যাঁ, অস্বীকার করব না, সে—চাউনি উলঙ্গ আতঙ্কের। ওর গায়ে হাত রাখতেই ও কুঁকড়ে গেল। কোনো কথা না বললেও ওর শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল, ওর হাত খুঁজতে লাগল আমার মুখ। ওর মুখের অভিব্যক্তিতে, চোখের চাউনিতে আমার ঘেন্না হল। যেন ও ভাবছে এ রাতটাই আমার অসুখের রাত। হয়তো দিনক্ষণের হিসেব ও হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এটা তো ওর জানা উচিত যে, দিনের হিসেবে আমার কোনোও ভুল হবে না! আমার বউ কেন আমাকে ভয় পাবে? এ কি খবরের কাগজের সেই নৃশংস মিথ্যে গল্পগুলোর পরিণাম? না কি পরিস্থিতির চাপে ও ভেঙে পড়েছে? আমার প্রতি সহানুভূতিতে আমার সঙ্গে তন্দ্রাও হয়তো কষ্ট পাচ্ছে? না, এ একেবারে অসম্ভব নয়। আমার পাতালঘরে যাওয়ার রাতটা এগিয়ে এলে ওকে দেখে সত্যি একটু অন্যরকম মনে হয়। শুনেছি ভালোবাসার মানুষের জন্যে অনেকে কষ্ট পায়। এমনও শোনা গেছে, স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হলে স্বামী প্রসব বেদনা অনুভব করে। এটাও হয়তো অনেকটাই সেইরকম। এ—কথা ভাবতেই আমার ভালো লাগছে, কারণ তন্দ্রা আমাকে ভয় পায়—এ—চিন্তা মনে আনতেও আমার কষ্ট হয়।

আমাদের বিয়ের প্রথম প্রথম তন্দ্রা আমাকে ভীষণ ভালোবাসত। এমনকী আদর—সোহাগও করত। সে—আদর—ভালোবাসা ছিল বলগাহীন, উত্তাল। সত্যি বলতে কী, সংযমী হওয়ার জন্যে ওকে কয়েকবার মুখ ফুটে পর্যন্ত আমি অনুরোধ করেছি। ইন্দ্রিয়গত মাৎসর্যে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া কোনও মেয়ের পক্ষেই ঠিক নয়। সঠিক জানি না, ইন্দ্রিয়গত মিলনে সুখ—তৃপ্তি অনুভব করাটা পাপ কিনা, তবে তাতে গা ভাসিয়ে দেওয়া নিশ্চয়ই পাপ। একবার তন্দ্রা চেষ্টা করেছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে প্রধান ভূমিকা নিতে। কয়েকবার সরাসরি এসে আমাকে জিগ্যেস করেছিল আমি ওর সঙ্গে এখন শুতে যাব কিনা এ নিয়ে ওকে কঠোরভাবে এক বক্তৃতা দিয়েছি। সত্যি, ওকে দোষ দেওয়া যায় না। ও তো নিষ্পাপ, অনভিজ্ঞ—বুঝতে পারে না ওর আচরণে দোষটা কোথায়। ওর অতিরিক্ত কামনা, উলঙ্গ তৃষ্ণা দিয়ে ও আমাকেই খুশি করতে চেয়েছিল। মনে হয়, সত্যিকারের একজন তরুণীর এটুকু বোঝা উচিত যে, এটা পাপ। কিন্তু আমি বিচার করার কে? নিজেকে নীতিবাগীশ বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা কখনও আমি করিনি। আমি শুধুই একজন নীতিবাদী মানুষ, জীবনযাপনের প্রকৃত পথ সবাইকে দেখানোর চেষ্টা করি। তন্দ্রার প্রতি ব্যবহারে একটু কঠোর আমাকে হতে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সে ওর ভালোর জন্যেই।

গত রাতের ব্যাপারটা অবশ্য একেবারে অন্যরকম। ওর মধ্যে এতটুকু ইচ্ছে কিংবা আকুতি দেখিনি। সবকিছু হয়ে যাওয়ার পর যখন আমি চলে আসছি, তখন ও যেন খুশি হল, স্বস্তি পেল। তার আগে সারাটা সময় ও শুয়ে শুয়ে চোখ তুলে অদ্ভুত ভাবে চেয়ে থেকেছে আমার মুখের দিকে। এতে ভীষণ অস্বস্তি লাগছিল। স্বামীর দায়িত্ব পালনের সময় কখনওই আমি ঠিক সহজ হতে পারি না, স্বস্তি পাই না। কিন্তু এ আরও খারাপ। একে ঠিক….’অস্বস্তি’ বলা যায় না, কিন্তু অন্য কোনো প্রতিশব্দও আমার জানা নেই। এ যেন ক্রমে বেড়ে ওঠা এক বিপজ্জনক অনুভূতি। ও যেন আমার দিকে এমন করে আর না তাকায়! ভয়, ত্রাসের মধ্যে কী যেন একটা আছে….জানি না সে কী….এতে মনে হয়….কল্পনায় ভেসে ওঠে….অস্পষ্ট সব ছবি। সঠিক বুঝিয়ে বলা মুশকিল। আমার মনের শান্ত পর্দার ঠিক নীচেই যেন গুড়ি মেরে লুকিয়ে থাকে অস্পষ্ট, অনিশ্চিত সব ইচ্ছে—ঝাপসা, নোংরা, অন্ধকার। এবং কোনো কারণে নৃশংস, ভয়ঙ্কর। পর্দায় ঢাকা বিভিন্ন ছবি। এর চেয়ে ভালোভাবে আর বলতে পারব না।

৩১ জুলাই

বরাবরের মতো ভয় ও বিরক্তি নিয়ে আগামীকালের অপেক্ষায় আছি, অবশ্য সঙ্গে একটু কৌতূহলও হচ্ছে। জানতে ইচ্ছে করছে, অসুখটার ওপর গত মাসের প্রভাব কতটা পড়েছে। গোটা জুলাই মাসটা এত শান্তিতে কেটেছে। নিজের সঙ্গে অনেক ভালোভাবে আমি বোঝাপড়া করতে শিখেছি। সুতরং অসুখটায় যদি সত্যিই কোনো পরিবর্তন দেখতে পাই তাহলে আমি এতটুকু অবাক হব না। ওটার রাসায়নিক গঠনে পরিবর্তন নিয়ে আসতে গত মাসটা হয়তো অনুঘটকের কাজ করে থাকবে….হয়তো ভালোর দিকেই। যাই হোক না কেন, আমার ধারণা, সে—পরিবর্তন আমি নির্বিকারভাবে মেনে নিতে পারব।

তন্দ্রাকে যদি এতটা অস্বাভাবিক বা দূরে দূরে মনে না হত তাহলে ওকে হয়তো আগ্রহ নিয়েই আমার আশা ও অনুমানের কথা বলতাম। তবে এখন বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না, অন্তত যতক্ষণ না আমি নিজে জানতে পারছি। মিথ্যে আশা—আনন্দ জাগিয়ে কোনো লাভ নেই। আজ সকালেও ও বড় অদ্ভুত ব্যবহার করল। রুমালটা বসবার ঘরে ফেলে এসেছিলাম। সেটা আনতে গেছি, নজরে পড়ল তন্দ্রা আড়ালে থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে দেখছে। শুধু ওর কপাল ও কাজল—কালো চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। চকিতে ও সরে গেল।

এগিয়ে গেলাম ওর কাছে। জিগ্যেস করলাম, ‘কী ব্যাপার, তন্দ্রা? কী খুঁজছ?’

না—মানে, কিছু না—’ তারপর কী ভেবে ও বলল, ‘তুমি কী এখন ওই ঘরে যাচ্ছ?’

অবাক হলাম।

‘কোন ঘরে?’

তন্দ্রা চোখ নামাল। অস্ফুট কণ্ঠে বলল, ‘ইয়ে—পাতালঘরে….।’

ওর অভিব্যক্তি আমাকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল কী বলতে চায়। বিরক্তি ও রাগে উত্তর দিলাম, ‘হঠাৎ এ—কথা মনে হওয়ার কারণ?’

আশ্চর্য! এ—কথা হঠাৎ ও ভাবছে কেন? ও তো জানে, পাতালঘরটাকে আমি কী অসম্ভব ঘৃণা করি। নিতান্ত প্রয়োজন না পড়লে সেখানে আমি যাই না। সুতরাং নিশ্চুপ তন্দ্রার দিকে তাকিয়ে কঠোর স্বরে বললাম, ‘তুমি জানো না, নেহাত দরকার না পড়লে আমি ওখানে যাই না?’

ও যেন একটু আশ্বস্ত হল।

দিনটা যত কাছে এগিয়ে আসছে, ওর মানসিক চাপ তত বেড়ে উঠছে। হয়তো ভয় পেয়ে ভাবছে, সময় হওয়ার আগেই অসুখটা শুরু হতে পারে। আমাকে হয়তো পাতালঘরে আরও বেশি সময় কাটাতে হতে পারে—এক রাতের জায়গায় দু—রাত। দু—রাত! ঈশ্বর করুন, তা যেন কোনোদিন না হয়।

বুঝতে পারছি, তন্দ্রা কেন এত চিন্তিত হয়ে পড়ছে। ও যে আমাকে ভালোবাসে এ তারই একটা প্রমাণ। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও প্রমাণিত হয়, আমার অসুখটাকে ও একেবারেই বুঝে উঠতে পারেনি। এ আমারই দুর্ভাগ্য।

১ আগস্ট

শরীরে শক্তি আমার টগবগ করে ফুটছে। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর অনেকটা পথ চটপট হেঁটে এসেছি। একটা খোলা মাঠে বাচ্চাদের খেলতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। ওদের বাঁচার উৎসাহের অংশ নিতে চেয়েছি। তখনই মনে পড়ল, আমার কখনও ছেলেমেয়ে হবে না। কোনো সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে আমি পারব না। পারব না এ ভয়ঙ্কর অভিশাপের বোঝা তাদের মাথায় তুলে দিতে। ভীষণ দুঃখ পেলাম। বাচ্চাগুলো আনন্দ—খুশিতে এত প্রাণবন্ত, এত উচ্ছল যে, ভাবতে কষ্ট হয়, প্রকৃতির নিয়মে ওদেরও বড় হতে হবে, মুখোমুখি হতে হবে জীবনের জটিল সমস্যার। আমার ছোটবেলাটা সুখের ছিল না। অন্তত আমার তা মনে পড়ে না—অবশ্য দু—একটা বিশেষ ঘটনা ছাড়া। তা বলে অন্য কাউকে আমি হিংসে করি না, কারণ আমার শৈশব আমাকে পৌঁছে দিয়েছে সত্যিকারের পৌরুষের দিকে। আমার গোটা অতীত জীবনটার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলতে পারি, এমন কোনো কাজ আমি কখনও করিনি যার জন্যে আজও আমার দুঃখ হয়। যা কিছু আমার দুঃখ, সব অন্য কারণে। যে—কারণ আমার সৃষ্টিরও আগে নিহিত। যদি কেউ নিজের জীবনধারাকে এক অবিচ্ছিন্ন অব্যাহত রেখায় দেখতে পায়, যাতে কোনো জটিলতা নেই, কোনো কলঙ্ক নেই, কোনো লজ্জা নেই, যেমনটি সে চেয়েছিল ঠিক তেমনটি, তাহলে সেটা হল তার জীবনের চরম শান্তি।

আজ রাতের দিকে উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছি। কখন পরিবর্তনটা আসবে। আমার স্থির বিশ্বাস, আজ একটা না একটা উন্নতির লক্ষণ দেখবই….না কি আমি জানি যে, উন্নতির কোনো প্রয়োজন নেই, যতটা ভাবতাম আমার অসুখ ততটা খারাপ নয়! আশা করি ওই অমানুষটার মনোভাবও আমারই মতো স্থির, শান্ত থাকবে।

থাকবে কিনা সেটা জানা যাবে আজ রাতে। পাতালঘরে।

১ আগস্ট, রাত

যাক, দরজায় খিল দেওয়া হয়েছে। তন্দ্রা ওপরে চলে গেছে। পাতালঘরে আমি একা। তন্দ্রা আমার সঙ্গে আজ খুব মিষ্টি ব্যবহার করেছে। যেসব খাবার আমি ভালোবাসি বেছে বেছে সেগুলো রান্না করেছে। আর খাওয়ার সময় আমার সামনে বসে এ—কথা সে—কথা নিয়ে শুধু বকবক করে গেছে, খুশিতে মুখ উজ্জ্বল। সম্ভবত ও চেষ্টা করেছে আমার মনটাকে অন্যদিকে নিয়ে যেতে, পাতালঘর থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে ওর এই অবুঝ চেষ্টার প্রশংসা করতে হয়। সুতরাং ওকে নিশ্চিন্ত করে হাতে প্রচুর সময় নিয়ে নীচে নেমে এলাম। ভেবেছিলাম ও হয়তো নার্ভাস হয়ে পড়বে, ভয় পাবে, তাই ওকে সঙ্গে না নিয়েই আমি চলে এসেছি পাতালঘরে। ওর আতঙ্কবিকৃত মুখ আমি সামনাসামনি দাঁড়িয়ে দেখতে পারব না। জানি একটু পরেই ও নেমে আসবে। বাইরে থেকে খিল দিয়ে দেবে দরজায়। সত্যি তাই হল। আমি নেমে আসার প্রায় মিনিট পাঁচেক পর ও এল। দরজায় খিল দিয়ে ফিরে গেল ওপরে।

পাতালঘরে নতুন কিছু চোখে পড়ল না। কিন্তু ভেবেছিলাম, নতুন কিছু অবশ্যই দেখতে পাব। তন্দ্রা হয়তো মিস্ত্রি দিয়ে সে—কাজ করিয়ে থাকবে। কিন্তু কই? তালাও সেই একই আছে। দেওয়ালের গদিও সেই একই—জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। হয়তো মিস্ত্রি ডেকে ও ঘর সারাবার এবং গদি সারাবার হিসেব নিতে চেয়েছিল। হয়তো পরের মাসে সারাইয়ের কাজ হবে। ভাবছি একটা বেশি পাওয়ারের আলো ঘরে লাগালে ভালো হত। এই আলোতে ডায়েরি লিখতে বেশ কষ্ট হয়। বিশেষ করে ঘরের কোণে আলো প্রায় পৌঁছোয় না। যদি….।

এইমাত্র একটা ভয়ঙ্কর জিনিস আমার নজরে পড়েছে। এর মানে বুঝতে আমি হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। একটা ঠান্ডা ইস্পাতের ছুরি যেন আমার শিরদাঁড়া কেটে নেমে যাচ্ছে। শরীরের মাংস জমাট বেঁধে গেছে বরফে। একটু আগেও লিখছিলাম। লিখতে লিখতে হঠাৎ চোখ পড়েছে দেওয়ালে, আর….দেওয়ালে একটা ফুটো রয়েছে! ছোট্ট ফুটো। প্রথমটায় আমার চোখে পড়েনি। ছোট হলেও একজনের দেখবার পক্ষে যথেষ্ট….অন্তত পাতালঘরটুকু দেখবার পক্ষে। ফুটোটা আগে ছিল না। তা ছাড়া মেঝেতে এখনও সিমেন্ট—বালির গুঁড়ো পড়ে রয়েছে। সুতরাং বুঝতে অসুবিধে নেই যে, ফুটোটা নতুন করা হয়েছে। হয়তো এইজন্যেই সে—মিস্ত্রিটা এসেছিল। কিন্তু দেওয়ালে ফুটো করিয়ে তন্দ্রার কী লাভ? ওকে কি ভূতে পেয়েছে? এরকম নিষ্ঠুর অমানুষিক কাজ ও করবে কেন? নিশ্চয়ই ও পাগল হয়ে গেছে! পরিবর্তন হওয়ার পর ও নিশ্চয়ই পাতালঘরে উঁকি মেরে দেখবে! কিন্তু সে দেখে ওর লাভ কী? এ আমি বিশ্বাস পর্যন্ত করতে পারছি না। তন্দ্রা! তন্দ্রা পারল এমন নৃশংস পাশবিক কাজ করতে! ও আমাকে দেখবে….পালটে যেতে দেখবে….মানুষ থেকে একটা অমানুষে….এ আমি ভাবতেও পারছি না। যে—দেওয়ালে ফুটোটা আছে এখন আমি সেখানে উবু হয়ে মাথা নীচু করে বসে আছি। জানি, ফুটো দিয়ে এখন আমাকে দেখা যাবে না, কিন্তু পরে কী করব? পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার পর? ওটার তো এত বুদ্ধিসুদ্ধি নেই, বুদ্ধিসুদ্ধির পরোয়াও করে না। সে কি তখন পারবে এই দরজার কাছে গুড়ি মেরে তন্দ্রার দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে থাকতে? একবার ভেবেছিলাম গায়ের জামাটা খুলে ফুটোতে গুঁজে দেব, কিন্তু ভয় হয় অসুখের মধ্যে ভয়ঙ্কর দাপাদাপির সময় জামাটা হয়তো ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়বে মেঝেতে। কিংবা তন্দ্রা হয়তো কোনো কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে জামাটা ফেলে দেবে ঘরের ভেতর। আমার কিছুই করার নেই। আমাকে ও দেখবেই!

ভয়ে, আশঙ্কায় আমার শরীর খারাপ লাগছে। ভীষণ বমি পাচ্ছে। মাথাও ঘুরছে। তন্দ্রা আমার সঙ্গে কেন এমন করছে? এ কি নিছকই অসুস্থ কৌতুহল? ওর মনে এমন কি কোনো বিকৃতি আছে যা আমার আগে নজরে পড়েনি? না কি এখনও ও আমাকে অবিশ্বাস করে? তাই প্রমাণ চায় যে, আমি পাগল নই—এ সবই আমার কল্পনা নয়, সত্যি। জানি না। ও আমাকে ধীরে ধীরে পালটে যেতে দেখবে এ সাঙ্ঘাতিক চিন্তা আমি মনেও আনতে পারছি না। ভগবান জানেন, দেখার পর ওর মনের অবস্থা কী হবে! আমার একমাত্র কামনা, ও যেন এটাকে অসুখ বলে বুঝতে পারে, সত্যের মুখোমুখি হয়ে ও যেন পাগল না হয়ে যায়। কিন্তু ওর মন তেমন শক্ত নয়, আর আমার ভয় হচ্ছে….আমাকে অন্য চেহারায় দেখার সময় অন্যান্যদের চোখের দৃষ্টি আমার স্পষ্ট মনে আছে। ওই সেলসম্যান লোকটা, মাতালটা, মেয়েটা….ওদের মুখে ফুটে উঠেছিল বিকৃত মানসিকতার ছায়া। আর তন্দ্রার সেরকম মনের জোর কোথায়? স্বাভাবিক অবস্থাতেই দেখেছি আমার দিকে চেয়ে ওর চোখের পাতায় উলঙ্গ আতঙ্ক থরথর করে কাঁপছে। খবরের কাগজে মৃতদেহ ছিন্নভিন্ন করার, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করার ওই মিথ্যে গল্পগুলো পড়ার পর….সে—রাতে বিছানায়….ওর চোখেমুখে ছিল আতঙ্ক….মুখ চাঁদের মতোই চকচকে সাদা….কাঁপছে, বিকৃত হয়ে চেনা চেহারা পালটাচ্ছে অতি ধীরে….আর অবশেষে আমি দেখতে পাচ্ছি শুধু নগ্ন আতঙ্ক….অন্যান্য অভিব্যক্তি মিলিয়ে গেছে কোন অতলে….আমি তাকিয়ে থাকি….মনে হয়….খালি মনে হয় এ—আতঙ্ককে বাঁচতে দেওয়া ঠিক নয়….একে বিনাশ করতে হবে….স্বাভাবিক হওয়ার পর কী করে আমি ওর মুখোমুখি দাঁড়াব….যখন….।

ওপরের দরজা বন্ধ করার শব্দ পেলাম।

মনে হয় তন্দ্রা সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে।

নেমে আসছে পাতালঘরে….আমাকে দেখতে….।

২ আগস্ট

মনে হয় সকাল হয়েছে। এখন ঠিক আছি—যদিও খুব ক্লান্ত। আমার জামাকাপড় ছিঁড়ে টুকরো টুকরো। শিগগিরই তন্দ্রা দরজা খুলতে নেমে আসবে। গত রাতের পর কী করে ও আমার মুখোমুখি হবে?

ওকে কত করে চলে যেতে বলেছি কিন্তু ও আমার কথার উত্তর পর্যন্ত দেয়নি, শুধু পাতালঘরের ভেতরে চোখ রেখে অপেক্ষা করেছে। উত্তেজিত থাকার ফলে অসুখটা সময়ের আগেই শুরু হয়ে গেছে, এবং সমস্ত সংযম আমি হারিয়ে ফেলেছি। ও স—ব দেখেছে। ওকে আমি ঘেন্না করি। ও যা করেছে তার কোনো ক্ষমা নেই। রাগে, লজ্জায়, ঘেন্নায় আমার শরীরে আগুন জ্বলছে। যখন ও দরজা খুলবে তখন আমাকে ভীষণ শান্ত সংযত থাকতে হবে। নইলে হয়তো ওর গায়ে হাত তুলে বসব। হাত তোলাই উচিত। আরও খারাপ শাস্তি ওকে দেওয়া উচিত। ও যা অন্যায় করেছে তাতে কোনো শাস্তিই যথেষ্ট নয়। ওর জন্যেই অসুখটা কাল আরও খারাপের দিকে গেছে। স্পষ্ট মনে আছে, আমি গর্জে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছি দেওয়াল থেকে দেওয়ালে, চেয়েছি দাঁতে নখে সব কিছু ছিন্নভিন্ন করে পাতালঘর থেকে মুক্তি পেতে, চেষ্টা করেছি ফুটোটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার করে দিতে, আর সারাটাক্ষণ তন্দ্রা দাঁড়িয়ে ছিল ফুটোটার কাছে, অবিনাশী দেওয়ালের ওপাশে। দেখছিল পাতালঘরের প্রতিটি ঘটনা। ও একটা পিশাচ, ডাইনি, শয়তান! ভাষায় ওকে বর্ণনা করা যায় না….।

২ আগস্ট ?

আজ তারিখ কত, জানি না। সময় বোঝারও কোনো উপায় নেই। মনে হয় যেন এক যুগ কেটে গেছে। এই ডায়েরি নিয়ে আর মাথা ঘামাচ্ছি না। কারণ এখন ডায়েরি লেখা অনর্থক। পেনের কালিও শেষ হয়ে এসেছে। আলোটাও হয়ে এসেছে ক্ষীণ, নিষ্প্রভ। হয়তো একটু পরেই সব অন্ধকার হয়ে যাবে। শরীরের রক্ত দিয়ে হয়তো এই ডায়েরি লেখা যাবে, কিন্তু সে—কষ্ট স্বীকারে কোনো লাভ আছে বলে মনে হয় না,….রক্ত আমার একটুও ভালো লাগে না। রক্ত আমাকে বহু স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। এখনও, কিছু একটা লিখতে হবে, এই চিন্তাটা আমার মন জুড়ে রয়েছে। পাগল হয়ে যাওয়ার পথে এ এক প্রতিবন্ধক, আমার বন্ধু। খিদে—তেষ্টা আমি সইতে পারি, কিন্তু মানসিক সুস্থতা হারিয়ে আমি বাঁচতে পারব না।

এখনও বুঝতে পারছি না তন্দ্রা কেন আমার সঙ্গে এমনটা করল। ওর প্রতি এতটুকুও রাগ আমার নেই, কেন জানি না। কখনও—সখনও ও নেমে এসে উঁকি মারে এই পাতালঘরে। দিনে একবার, সপ্তাহে একবার….কী জানি? আমার কাছে কোনো তফাত নেই। কখনও কোনো কথা ও বলে না। কথা বললে তার উত্তরও দেয় না। কখনও কখনও এক অদ্ভুত শব্দ করে ও, অনেকটা যেন খলখল হাসির শব্দ। ও কি পাগল হয়ে গেছে? যখন ওকে অনুনয়—বিনয় করে কিছু বলি, ও চলে যায়….।

ভীষণ খিদে পাচ্ছে।

দেওয়াল থেকে গদিগুলো ছিঁড়ে খেতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। উলটে তেষ্টা আরও বেড়েছে। আলোটা এখন একেবারে নিভু নিভু। ওটার ঠিক নীচে দাঁড়িয়ে কোনোরকমে লিখতে পারছি। চোখের নজরও ঝাপসা হয়ে এসেছে। শরীর দুর্বল, মাথা ঝিমঝিম করছে। আর বেশি লিখতে পারব বলে মনে হয় না।

এখন বুঝেছি, এখানেই আমাকে মরতে হবে। তার জন্যে আমার কোনোও দুশ্চিন্তা নেই। আমি মারা যাব ঠিক, তবে নিজের দোষে নয়। এটুকুই আমার সান্ত্বনা। এ পরিণতির জন্যে আমি দায়ী নই। যেমন আমার জীবনের যত দুঃখ যত কষ্ট সবকিছুর জন্যে দায়ী আমার পূর্বপুরুষদের পাপ। আমি নির্দোষ। আর এখন আমি মরতে চলেছি আমার স্ত্রীর পাগলামির শিকার হয়ে। এ অন্যায়, তবে ভালোই হয়েছে। এখন শুয়ে পড়ব। আর কিছু বোধহয় লেখার নেই।

বুঝতে পারছি রাত হয়েছে। কামড় বসিয়ে দিলাম হাতে….।

এখানেই ডায়েরি শেষ। অবশ্য এর পরের কয়েকটা পাতায় কিছু অসংলগ্ন দুর্বোধ্য আঁচড়ের দাগ আমার চোখে পড়ল। সেগুলো হয়তো অন্ধকারে ডায়েরি লেখার চেষ্টায়, অথবা মানুষের হাত—ওলা কারও অসতর্ক হিজিবিজি। ধীরে ধীরে বাঁধানো ডায়েরিটা বন্ধ করে জানলা দিয়ে তাকালাম বাইরের বৃষ্টির দিকে। ভীষণ শব্দে কোথাও বাজ পড়ল, বাইরের উঠোনে বিশাল দেবদারু গাছ ঝড়ে টলোমলো, আকাশে ঘন মেঘ অচঞ্চল, স্থির। দূরে শোনা গেল কোনো কুকুরের আর্ত চিৎকার।

বহুক্ষণ একভাবে বসে রইলাম। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ডায়েরিটা পকেটে রাখলাম। ক্রমশ রাত বাড়ছে। দোতলার সিঁড়ির কাছে এগিয়ে গেলাম। সামনেই সেই প্রাচীন দরজা। পাতালঘরে যাওয়ার পথ। আমাকে সেখানে যেতে হবে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করলাম, কিন্তু আমাকে যেতেই হবে। খুলতেই সেই ভ্যাপসা গুমোট হাওয়া আমাকে ঘিরে ধরল। সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলাম। যেন কোনো অন্ধকার কবরে নেমে চলেছি।

ডায়েরির কথামতো পাতালঘরটা একটা কোণে দাঁড়িয়ে। সিমেন্টের মেঝেতে আমার পায়ের শব্দ অস্বাভাবিক সোচ্চার। পাতালঘরের দরজায় খিল দেওয়া। কোনো কিছু না ভেবেই চটপট খিল খুলে ফেললাম। বিচিত্র শব্দ তুলে খিলটা খুলল। মরচের গুঁড়ো, ধুলো, মাটি ঝরে পড়ল মেঝেতে। দরজাটা খুলতে চেষ্টা করলাম কিন্তু খুলল না। তখনই নজরে পড়ল দরজায় এক বিরাট তালা। সময়ের প্রকোপেও সে তালা দুর্বল হয়নি। আর দরজাটাও নেহাত পলকা নয়। কোণের দিকে সরে দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম ফুটোটা। ফুটোর চারপাশে সিমেন্ট— বালি খসে পড়েছে। চোখ রাখলাম ফুটোতে, কিন্তু কিছুই নজরে পড়ল না। শুধু অন্ধকার। সুতরাং অত্যন্ত শান্তভাবে ফিরে এলাম সিঁড়ির কাছে, ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করলাম। ওপরে গিয়ে ওই তালার চাবিটা খুঁজে দেখতে হবে। ওটা তন্দ্রাকাকিমার কাছে যখন ছিল, তখন এই বাড়িতেই কোথাও না কোথাও আছে। খুঁজে আমাকে দেখতেই হবে। সিঁড়ির ওপরের ধাপে পৌঁছোতেই গোটা সিঁড়িটা কেঁপে উঠল আমার ভারে। তারপর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে লাগল। প্রচণ্ড এক লাফে আমি ছিটকে গেলাম দরজার বাইরে। উলটে পড়লাম মেঝেতে। উঠে দাঁড়িয়েই উন্মাদের মতো ছুটতে শুরু করলাম। সদর দরজা খুলে ঝড়—বৃষ্টির মধ্যে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে আমি ছুটে চললাম।

আমার সাহস আছে, শক্তিও কম নেই, কিন্তু সেদিন আমি শুধু ছুটেছি। ওই বাড়ি থেকে চলে গেছি অনেক দূরে। বৃষ্টিতে আমার শরীর ভিজে সারা। হু হু বাতাসে কেমন শীত শীত করছে। জ্যাকেটটা আমি ভুলে ফেলে এসেছি।

এসব বেশ কিছুদিন আগের কথা। তন্দ্রাকাকিমার ওই বাড়িতে আর ফিরে যাইনি। কিন্তু একদিন যাব। প্রায়ই কৌতূহল হয় পাতালঘরে এখন কী আছে, কে আছে? ভয় পাওয়ার মতো নিশ্চয়ই কিছু নেই। কারণ সেসব ঘটনা তো বহুদিন আগের। আর তন্দ্রাকাকিমা নিশ্চয়ই পরে একসময় ওই ঘরে গিয়েছিলেন, নইলে ডায়েরিটা পেলেন কী করে? পুরোনো খবরের কাগজ ঘেঁটে দেখেছি। একটা অমীমাংসিত খুনের ঘটনা আমার নজরে পড়েছে। হতে পারে এই খুনটার কথাই হয়তো ডায়েরিতে উনি লিখেছিলেন। কিংবা নাও হতে পারে। উনি নিশ্চয়ই পাগল ছিলেন, এর সবটাই হয়তো তাঁর কল্পনা। কল্পনা না হয়ে পারে না। কিন্তু তবুও….খালি ভাবি, সে—রাতে তন্দ্রাকাকিমা পাতালঘরে কী দেখেছিলেন? তখনই কি তিনি প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর স্বামী পাগল, আর সেইজন্যেই তাঁকে বন্দি রেখে চলে গেছেন? না কি তিনি অন্য কিছু দেখেছিলেন? এমন কিছু, যা দেখে তিনি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন?

সে যাই হোক, কোনোদিন আমি জানতে পারব না। তন্দ্রাকাকিমা নিজে কোনো ডায়েরি রাখতেন বলে মনে হয় না। এতে অবশ্য আমার দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কী—ই বা থাকবে। অলৌকিকে আমি বিশ্বাস করি না। কোনোদিন করিনি।

কাকার ডায়েরিটা আমার কাছে রয়েছে, সময় পেলেই ওটা বারবার পড়ি, চেষ্টা করি আসল সত্যকে খুঁজে বের করতে। কোনো—কোনো দিন উজ্জ্বল পূর্ণিমার রাতে ডায়েরিটা পড়ি, একা বসে থাকি জানলার পাশে, আর মাঝে মাঝে তাকিয়ে থাকি রুপোলি থালার মতো চাঁদের দিকে। রাত যেন আর কাটতে চায় না। আমি একেবারে একা। তাই বড় একঘেয়ে লাগে। তাই ভাবছি সময় কাটানোর জন্যে ওইসব রাতে ডায়েরি লিখব। সবকিছু কাগজে—কলমে লিখে রাখব। যেমন এই মুহূর্তে আমি চুপচাপ বসে আছি, তাকিয়ে আছি গোল ধবধবে চাঁদের দিকে, আর মাঝে মাঝে লক্ষ করছি আমার হাত দুটো….আঙুল….আঙুলের নখ….।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *