সাত
সোফিয়ার কপালে, কনুইয়ে সার্জিকাল টেপ লাগিয়ে দিল হুয়াং অভ্যস্ত হাতে জায়গাগুলো ভাল করে ডেটল দিয়ে ধুয়ে নিয়ে। তারপর হাতকড়া পরিয়ে দেয়া হলো। মিসেস গুপ্তের হাতেও হাত কড়া। ভয়ে পাংশু হয়ে গেছে ওর মুখ, সপ্রতিভ ভাবটা সম্পূর্ণ মুছে গেছে ওর চেহারা থেকে। পরিষ্কার টের পেয়েছে সে আসন্ন অবধারিত মৃত্যু। ব্লটিং পেপার দিয়ে কেউ যেন শুষে নিয়েছে ওর শরীর থেকে সমস্ত রক্ত।
গোটা কয়েক করিডর পেরিয়ে নিয়ে আসা হলো ওদের একটা বন্ধ ঘরের সামনে। দরজায় চাবি লাগাল একজন, বাকি তিনজন পিস্তল হাতে প্রস্তুত থাকল পিছনে। ধাক্কা দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকানো হলো রানাকে, ওর পিঠের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল মিসেস গুপ্ত, তার উপর সোফিয়া।
দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা আবার।
ধড়মড় করে খাটের উপর উঠে বসল বার্মিজ পোশাক পরা একজন প্রৌঢ়। আধ হাত লম্বা দাড়ি, শতকরা দশ ভাগ তার পাকা। চোখ দুটো ঈষৎ বাঁকা। মংগোলিয়ান। কিন্তু দীর্ঘদেহী। বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। চোখে মুখে দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের ছাপ। ছোট হলেও চোখ দুটো তীক্ষ্ণ, উজ্জ্বল, বুদ্ধিদীপ্ত। চেহারার মধ্যে দলপতি সুলভ আভিজাত্য লক্ষ্য করল রানা। এই লোক আদেশ করতেই অভ্যস্ত, আদেশ পালিত হচ্ছে কিনা দেখার প্রয়োজন বোধ করে না, কারণ ও জানে, অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে ওর আদেশ, অমান্য করা হবে না। তড়াক করে একলাফে খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে সোফিয়াকে দেখা মাত্রই। দুই পা এগিয়েই থমকে দাঁড়াতে হলো ওকে, কারণ ঝাঁপিয়ে পড়েছে সোফিয়া ওর বুকের উপর।
মিনিট দুয়েক দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদল, দুজনই এক সাথে অনর্গল কথা বলে চলল আরাকানী ভাষায়, কেউ কারও কথা শুনছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। একবর্ণও বুঝতে পারছে না রানা ওদের কথা, কিন্তু অনুস্বর প্রধান ভাষাটা নেহায়েত মন্দ লাগছে না ওর কানে। মাঝে মাঝে বাংলার মত এক-আধটা শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে, কিন্তু সেটার মানে বুঝে ওঠার আগেই আরও অসংখ্য বিচিত্র শব্দের তোড়ে গুলিয়ে যাচ্ছে সব।
সোফিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, মাঝে মাঝে পচাৎ পচাৎ করে চুমো খাচ্ছে ওর অশ্রু ভেজা গালে, সেইসাথে অনর্গল কথা বলছে লোকটা। মিনিট তিনেক পরে দুজনেই শান্ত হলো কিছুটা, হঠাৎ খেয়াল হলো, আশে পাশে আরও লোকজন আছে। হাতকড়া পরা হাত দুটো বের করে আনল সোফিয়া বাপের মাথা গলিয়ে, ফাঁস মুক্ত হয়েই দুই হাতে রানা ও মিসেস গুপ্তের হাত ধরে টেনে এনে খাটের উপর বসিয়ে দিল প্যাপন মং লাই। যেন পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে এমনি ভঙ্গিতে সোফিয়ার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘আমার মেয়ে।’ তোশকের নিচ থেকে দুটো ইয়া মোটা চুরুট বের করে ধরিয়ে দিল জোর করে দুজনের হাতে। ‘কিছু মনে কোরো না, ব্যাপারটা আগে শুনে নিই ওর কাছে।
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল প্যাপন মং লাই। মেয়েকে ইঙ্গিত করল রানার পাশে বসতে। কথা শুরু করল সোফিয়া। এবার আর একটি কথাও বলছে না বৃদ্ধ, চুপচাপ শুনে যাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে রানার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে অনর্থক হাসছে। বার কয়েক নিজের নাম শুনতে পেল রানা সোফিয়ার মুখে, সেটুকু ছাড়া বাকি সবকিছুই দুর্বোধ্য। কথা শেষ হতেই উঠে এসে রানার কাঁধে হাত রাখল প্যাপন মং লাই।
‘আমাদের জন্যে আপনি যা করেছেন, সেজন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।’ ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল প্যাপন মং লাই। ‘ভুল ইংরেজির জন্যে কিছু মনে করবেন না। আমি অশিক্ষিত মানুষ, যেটুকু বলতে পারছি তা ওর মায়ের কল্যাণে। যাই হোক, গেল তো সব ফেঁসে। এখন? এখন কি ভাবছেন?’
‘দেখা যাক,’ বলল রানা। ‘যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ।’
‘তা ঠিকই, কিন্তু খুব একটা আশা দেখতে পাচ্ছি না আমি। সবচেয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার লোকজনদের জন্যে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই অস্ত্রশস্ত্র সহ আমাদের এলাকায় পৌঁছে গেছে ওই একশো ছেলে, হয়তো কিভাবে ওগুলো ব্যবহার করতে হয় গোপনে তারও ট্রেনিং দিতে শুরু করে দিয়েছে সবাইকে—কিন্তু অর্ডার দেবে কে? আমার বা সোফিয়ার আদেশ ছাড়া যুদ্ধ করবে না কেউ। আমরা দুজনই মারা যাচ্ছি এখানে। ফলটা দাঁড়াচ্ছে এই যে, ভয়ানক অত্যাচার হবে এবার আমার লোকের ওপর। মার খাবে কিন্তু প্রতি- আক্রমণ করবে না কেউ আমার আদেশ ছাড়া। অস্ত্র পাওয়া যাবে সবার কাছেই, কাজেই অত্যাচারের পরিমাণটা নিশ্চয়ই আঁচ করতে পারছেন?’ বিষণ্ণ মুখে চুপ করে থাকল সে কিছুক্ষণ। ‘এটা জানে বলেই আমাকে বন্দী করেছে উ-সেন। ওর জানা ছিল না যে সোফিয়া আমার একমাত্র মেয়ে, আমি মারা গেলে ও পাচ্ছে সর্দারি। ওর ধারণা ছিল আমাকে আটকে রাখলেই আদেশ দেয়ার লোকের অভাবে চুপ করে সমস্ত নির্যাতন সহ্য করবে আমার লোক। এখন যখন জেনে গেছে, আমার বা সোফিয়ার নিস্তার তো নেই-ই, ভয়ানক খারাবি আছে আমার বারো হাজার লোকের কপালে।
‘আপনি ওদের বিরুদ্ধে গেলেন কেন?’ প্রশ্ন করল রানা। ‘ওরা কি ক্ষতি করছিল আপনাদের?’
‘কি ক্ষতি করছিল মানে?’ খেপে উঠল প্যাপন সর্দার। আমার লোক ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওরা, জোর জুলুম শুরু করেছে গেরিলা ট্রেনিং নেবার জন্যে, ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে যুবতী মেয়েদের—আর আমি ওদের বিরুদ্ধে যাব না? আমার এলাকায় ট্রেনিং সেন্টার করেছে, বাংলাদেশ আর ভারতের এয়ার ফোর্স যখন বোম ফেলবে, কারা মারা যাবে? আমার লোক মারা যাবে না? শুধু শুধুই গিয়েছি আমি উ-সেনের মত হারামী লোকের পিছনে লাগতে? আমার লোককে যদি রক্ষা না করতে পারি, তাহলে কি দরকার আমার সর্দারি করার?’
‘কাজেই দেখা যাচ্ছে, আপনার মারা যাওয়া চলবে না। তাহলে ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে আপনার লোকদের। এখান থেকে বাঁচবার কোন উপায় চিন্তা করেছেন?’
‘চিন্তা অনেক কিছুই করেছি, কিন্তু বাঁচবার চিন্তা করিনি, কারণ আমি জানি আমার ক্ষমতা নেই এদের হাত থেকে ছুটে বেরোবার। ভরসা ছিল, সোফিয়া হয়তো গোষ্ঠীকে রক্ষা করার কোন উপায় খুঁজে বের করতে পারবে, কিন্তু দেখছি, বাপকে উদ্ধার করার চিন্তাই ওর মধ্যে বেশি কাজ করেছে। ফলে লাভের মধ্যে শুধু একটাই হয়েছে, মরার আগে শেষ দেখা হয়ে গেল বাপ- বেটিতে।’ সোফিয়ার থুতনি ছুঁয়ে চুমো খেল প্যাপন আঙুলের মাথায়। রানার দিকে ফিরল। ‘তুমি কি ভাবছ? কোন পথ দেখতে পাচ্ছ বাঁচবার?’
‘এখনও কিছুই দেখতে পাইনি। তবে আমি জানি কোন না কোন পথ আছেই, কোন না কোন সুযোগ পাবই আমরা। যদি সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারি তাহলে নিজেদের মুক্ত করতে পারব।’
‘সুযোগ আসবেই?’
‘হ্যাঁ, আসবেই। আমরা তাকে চিনে নিতে পারব কিনা সেটা আলাদা কথা। কিন্তু অন্তত একটা দুটো সুযোগ যে আসবে তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই।’
তুমি আশাবাদী মানুষ। ভাল। আশাবাদী মানুষ আমি পছন্দ করি। ছাড়া পেয়েই প্রথম কি কাজ হবে আমাদের?’
হাসল রানা। চুরুটটা ধরাল। কড়া ধোঁয়া বুকের মধ্যে টেনেই কাশল কিছুক্ষণ। সোফিয়ার মতই রানার প্রতিটি কথা বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে প্যাপন মং লাই। ধরেই নিয়েছে যেন ছাড়া পেয়ে গেছে। রানার উত্তরের প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করছে। রানা বলল, ‘অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করব।
‘আমার দেশে যাবে? ওই শয়তানগুলোকে শায়েস্তা করবে না?’
আমার একার কাজ নয় ওটা।’
‘তোমার যত লোক দরকার আমি দেব। অস্ত্র আছে, লোক আছে, চেষ্টা করে দেখবে না একবার?’
‘সেসব পরের কথা পরেই ভাবা যাবে। অবস্থার গতি-প্রকৃতি বুঝে চলতে হবে আমাদের। যেমন সুবিধা বুঝব তেমনি ব্যবস্থা নেব।’
‘ঠিক।’ মাথা নাড়ল বৃদ্ধ। বোঝা যাচ্ছে অতি-আশাবাদী নও তুমি। অর্থাৎ অসাবধান নও। এইটাই দরকার। যারা কেবল গাল-চালাকি করে তাদের আমি পছন্দ করি না। তোমার ওপর ভরসা আসছে আমার। কিন্তু এখন আর আলোচনা নয়, বাইরে পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।’
চাবি ঘোরানোর আওয়াজ পাওয়া গেল। ক্লিক করে খুলে গেল তালা। খাবার আনা হয়েছে ওদের জন্যে। মোটাসোটা এক খানসামার পিছনে চারজন পিস্তলধারী প্রহরী। মিসেস গুপ্তকে চিনতে পেরে সামান্য মাথা নেড়ে হাসল খানসামা। টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিচ্ছে সে। প্রহরীদের আড়াল করে চাপা কণ্ঠে বলল মিসেস গুপ্ত, ‘আমাকে মেরে ফেলা হবে, জোসেফ।
‘শুনেছি।’ ফিসফিস করে জবাব দিল জোসেফ।
‘কোন সাহায্য পাব না তোমার কাছে, জোসেফ?’
‘সাহায্য করতে গিয়ে মরব নাকি?’
‘তোমার ভাইঝির জন্যে দুঃখ করেছিলে তুমি একদিন। ওকেও খুন করেছিল…’
‘আমাকে তো করেনি।’ কথাটা বলেই সরে গেল জোসেফ। আস্তে করে বলল, ‘দুঃখিত, ম্যাডাম।
জোসেফ বেরিয়ে যেতেই আবার দরজা বন্ধ করে দিল প্রহরী। বন্ধ করবার আগে মুখটা বাড়িয়ে বলে গেল, ‘দশ মিনিটের মধ্যে যে যা পারো খেয়ে নাও। ডিনার সেরেই নামবেন উ-সেন।’
মিসেস গুপ্ত খেল না কিছুই। একেবারে মুষড়ে পড়েছে মহিলা। রানা, সোফিয়া আর প্যাপন মং লাইয়ের আন্তরিক আলাপে অংশগ্রহণ করতে পারছে না, বাধো বাধো ঠেকছে রানা ও সোফিয়ার প্রতি ওর আচরণের কথা ভেবে। বার কয়েক চেষ্টা করল রানা ব্যাপারটা সহজ করবার, কিন্তু কিছুতেই সহজ হতে পারল না সে।
নাড়ীভুঁড়ি জ্বলে যাচ্ছিল রানার খিদেয়। হাপুস হুপুস খেয়ে চলেছে ও, আর এরই মধ্যে যতটা সম্ভব হালকা কথাবার্তা দিয়ে সবাইকে খুশি রাখবার চেষ্টা করছে। যদি মারা যেতেই হয়, মুখ ভার করে মরতে চায় না ও। মনে মনে পরিষ্কার বুঝতে পারছে রানা, সব দিক থেকে সতর্ক হয়ে গেছে উ-সেন, এবার তার হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে, তবু মৃত্যুর কথা ভুলে খুশি থাকতে চায় সে। যখন সব আশা নিভে যায়, যখন করবার কিছুই থাকে না ভাগ্যকে মেনে নেয়া ছাড়া, তখনও মুখ ভার করবার কোন মানে হয় না।
‘লাই ডিটেকটর ছাড়াই উ-সেন যে কথাটা বলল, সেটা কতদূর সত্যি?’ প্রশ্ন করল রানা।
লজ্জা পেল সোফিয়া। মাথা নিচু করে হাসতে হাসতে বলল, ‘দূর। বাজে কথা।
‘তাহলে গুলি করলে না কেন? ওইটাই উ-সেনকে হত্যা করার শেষ সুযোগ ছিল।
‘তোমাকে, মানে, আপনাকে মেরে ফেলত তাহলে ওরা।’
‘এখন কি বাঁচিয়ে রাখবে মনে করছ?’
‘না, মানে, তবু তো কিছুটা সময় পাওয়া গেল হাতে। বলুন তো, গুলি করতে বলছিলেন কেন তখন?’
‘তোমার আঙুল দেখেই আমি বুঝতে পারতাম ঠিক কখন গুলিটা বেরোচ্ছে তোমার পিস্তল থেকে। আমি তৈরি ছিলাম লাফ দেয়ার জন্যে। ডিগবাজি খেয়ে পড়তাম প্রহরীর ঘাড়ে। তারপর কি হত বলা যায় না। হয়তো এতক্ষণে সব কয়জনকে খতম করে দিয়ে দেশে রওনা হওয়ার জন্যে মালপত্র গুছাতাম আমরা।’
‘তাহলে তো দেখছি গুলি না করাটা ভুলই হয়েছে!’
‘ভুল কি ঠিক বলা যায় না।’ হাসল রানা। ‘হয়তোর কথা বলছি আমি। হয়তো জখম হতাম, হয়তো মারাও পড়তে পারতাম। নিশ্চিত করে বলা যায় না। এখন যখন নিশ্চিত জানি কি হতে চলেছে, তখন তা জানতাম না। এইটুকুই লাভ হয়েছে।’
‘এখন নিশ্চিত জানো?’ প্রশ্ন করল মিসেস গুপ্ত।
‘জানি।’ উত্তর দিল রানা।
‘কি হতে চলেছে?’
এখন আর তৃতীয় সম্ভাবনাটা নেই। জখম হব না। হয় মরব, নয় বাঁচব। বাঁচবার ইচ্ছেই বেশি, কাজেই ওদিকেই চেষ্টাটা রাখব বেশি। এখন যা করে আল্লায়।
হো হো করে হেসে উঠল প্যাপন মং লাই। তুমি তো দারুণ ছেলে হে! সত্যিকার পুরুষ মানুষ তুমি। সোফিয়া বোধহয় চান্স দেবে না, দিলে আমিই তোমার প্রেমে পড়ে যেতাম।’
‘পড়ো না, মানা করছে কে তোমাকে?’ কপট কোপ দৃষ্টি হানল সোফিয়া পিতার প্রতি।
‘পড়বই তো। দেখিস। এখান থেকে বেরিয়ে নিই না আগে। তুই আর সুযোগ পাবি না তখন ‘
‘ওহ্-হো, ভুলে গিয়েছিলাম,’ বলল রানা, ‘গাড়িটা অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যাওয়ার পর তোমার অজ্ঞান হওয়ার প্ল্যানটা মাথায় এসেছিল, তাই না সোফিয়া? নাকি ইচ্ছে করেই ঘটিয়েছিলে অ্যাক্সিডেন্ট?’
‘পাগল নাকি! ইচ্ছে করে অতবড় অ্যাক্সিডেন্ট করবার সাহস আছে বুঝি আমার? ভেবেছিলাম কোনমতে মার্সিডিসটা থামাতে পারলে তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে পালিয়ে যাব। হঠাৎ মোড় নিল বলে তাল সামলাতে না পেরে এমনিই অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। আর স্টার্ট করতে পারলাম না গাড়িটা। চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল মার্সিডিস। তখনই প্ল্যানটা এল। আমি জানতাম, আমাকে ধরবার জন্যে প্রথমেই ওখানে লোক পাঠানো হবে। ঠিক পনেরো মিনিটের মধ্যেই দেখি গিয়ে হাজির হয়েছে। চুপচাপ মটকি মেরে পড়ে থাকলাম। কিছুই চিনি না আমি মান্দালয়ের, খুঁজে পেতাম না কিছুতেই এদের আড্ডা। কৌশলটা বেশ কাজে লেগে গেল।
হঠাৎ কথা বলে উঠল মিসেস গুপ্ত বিরস বদনে
‘আপনারা বেশ হাসি খুশি আছেন কিন্তু।’ রানার দিকে ফিরল সে। ‘আমার সাংঘাতিক ভয় লাগছে, রানা। তোমার লাগছে না?’
‘লাগছে। মরতে কার ভাল লাগে বলো?’
‘কিন্তু নিজেকে এত ছোট লাগছে কেন? আমি জানি-তোমাদের তা লাগছে না। আমার লাগছে কেন?’
‘আত্মপ্রেমের জন্যে।‘
‘তার মানে?’
‘মানে খুবই সহজ।’ একবিন্দু টিটকারি প্রকাশ পেল না রানার কণ্ঠে। ‘তুমি আজ পর্যন্ত যা করেছ সব নিজের জন্যে। তোমার দোষ নেই। আসলে আত্মকে ত্যাগ করবার সুযোগ পাওনি তুমি কোনদিন। এই শিক্ষাটা পরিবেশ আর পারিপার্শ্বিকতা থেকে আসে। তোমার সুযোগ হয়নি এ শিক্ষা গ্রহণের। তুমি আত্মপ্রেমেই মগ্ন।
‘আর একটু পরিষ্কার করে বলবে?’ গম্ভীর মিসেস গুপ্ত। ‘তোমরা নিজেকে ভালবাস না?’
‘বাসি। কিন্তু আমরা হাসতে পারছি, তুমি পারছ না। আমাদের চারজনের এখানে আসবার উদ্দেশ্য খতিয়ে দেখলেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে তোমার কাছে। আমি কেন এসেছি? দেশের শত্রুকে ধ্বংস করতে। প্যাপন মং লাই কেন এসেছেন? ওঁর লোকেদের সর্বনাশের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে, নিজের ব্যক্তিগত লাভের জন্যে নয়। সোফিয়া কেন এসেছে? দেশের লোকদের জন্যে তো বটেই, ওর বাবাকে, এবং সেই সাথে মাসুদ রানা নামের এক বিদেশী প্রায় অপরিচিত লোককে উদ্ধার করতে। কিন্তু তুমি? তুমি এসেছ শুধু মাত্র নিজের জন্যে। তাই না?’
‘হ্যাঁ। কেবল তাই নয়, যাকে বাঁচাবার জন্যে প্রায় অপরিচিতা একটি মেয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করতে দ্বিধা করছে না, তাকে আমি ধরে নিয়ে এসেছি আমার ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে। বুঝতে পারছি এখন। ঠিকই বলেছ, আত্মপ্রেম। কিন্তু এর ঊর্ধ্বে উঠতে পারি না কেন?
‘এটা অভ্যাস। চেষ্টা করলে এই অভ্যাস ভাঙতে পারবে।’
‘এই জন্যেই কি মরতেও গ্লানি বোধ করছি?’
‘বোধহয়।’
‘তোমাদের মত সহজ সরল মনে মরতে পারলে সুখী হতাম।
মিসেস গুপ্তের ছলছলে চোখের দিকে চেয়ে কেমন যেন বেদনা বোধ করল রানা। বলল, ‘আমরা মরবই এমন প্রতিজ্ঞা তো করিনি, ফ্যান সু।’
‘আমি অন্তর থেকে অনুভব করছি, আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে।
উ-সেনকে আমি ভাল করেই চিনি। নিস্তার নেই আমাদের। আমি জানি কতখানি ভয়ঙ্কর লোক ও।’
আমরাও ভয়ঙ্কর লোক, ফ্যান সু। একটু সুযোগ দিয়ে দেখুক না উ-সেন, এক লাফে ডিঙিয়ে যাব ওকে।’
হাসল মিসেস গুপ্ত। বলল, ‘মনটা হালকা লাগছে অনেকটা। অসংখ্য ধন্যবাদ, রানা। যদি বাঁচি, আমার প্রথম কাজ হবে নিজেকে নিজের হাত থেকে উদ্ধার করা। আমি বাঁচতে চাই, রানা।’
এমনি সময় খুব কাছ থেকে হেলিকপ্টারের আওয়াজ শোনা গেল। সামান্য একটু কেঁপে উঠল যেন দালানটা। রানার চোখে প্রশ্ন দেখে বলল মিসেস গুপ্ত, ‘ও কিছু না। ফিরে এল উ-সেনের হেলিকপ্টার। ছাতের ওপর ওটার ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড।