রক্তের রং বেগুনী

রক্তের রঙ বেগুনী

কাল রাতে ভামটা আবার এসেছিল, প্রায় প্রতিরাতেই আসে। এত দীর্ঘদিন ধরে ও আমার স্বপ্নে আসে, এখন তো মনেও করতে পারি না ঠিক কতদিন আগে ওকে প্রথম স্বপ্নে দেখেছিলাম।

অন্ধকার ঘরের মধ্যে যখন শুয়ে থাকি, খুট করে কোথাও একটা দরজা খোলার আওয়াজ হয়। সঙ্গে সঙ্গে ভামটা হেলতে দুলতে আমার ঘরে ঢোকে, পায়ের পাতার কাছে এসে গন্ধ শোঁকে। ওর শরীরে একটা আঁশটে গন্ধ আছে, যেটা আমি ঘুমের মধ্যেও পরিষ্কার বুঝতে পারি। লেজটাকে উঁচুতে তুলে বেশ কয়েকবার তারপর পায়চারি করে, একটুখানির জন্য ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়, মুখে করে নিয়ে আসে একটা জ্যান্ত মাছ। তারপর আমার সামনে থাবড়া মেরে বসে মাছটার গলায় একটা কামড় বসায়। আমি বুঝতে পারি, মাছটা ছটফট করছে, ওর তেল চুকচুকে শরীরটা পিছলে পিছলে বেরোতে চাইছে ভামটার মুখ দিয়ে। ভয়ে আমি চিৎকার করে উঠি, আর আমার চিৎকার শুনে ভামটা স্থির চোখে আমার দিকে তাকায়। ওর সবুজ মণিগুলো কী বিদ্রুপ করে ওঠে আমায় দেখে! ঠিক এই সময়ই আবার দরজায় আওয়াজ হয়, আর ঘরের মধ্যে ঢুকতে থাকে একের পর এক ভাম, এক… দুই… তিন… দশ… একশ… হাজার… ওদের পায়ের শব্দে— শ্বদন্তের চকচকে সাদাটে ভাবটায়— খুব দম্ভ। পায়ের থাবাগুলোয় নখগুলো ভীষণ বড়, খুব সরু আর সূঁচালো। ওদের মধ্যে কেউ কেউ নখগুলো মেঝেতে ঘষে। শুকনো মেঝেতে শব্দ হয় খচ…খচ… খচ। তারপর দল বেঁধে ওরা একটাই মাছের উপর ঝাপিয়ে পড়ে, কামড়ে কামড়ে ছিঁড়ে খায় মাছটার অস্থি, মাংস, মজ্জা। অবিকল মানুষের মত ওদের মুখের হাঁ করা কালো গহ্বর দেখতে পাই আমি। রক্ত মাখা মুখের চারধার, জিভ বার করে চেটে নেওয়া বাকিটুকুও। সেই মুহূর্তে মনে হয় আমার চোখের পাতা কে যেন জোর করে বন্ধ করে রাখে, আর আমার চোখের বন্ধ পাতার নীচে আমার স্বপ্নেরা নিজেদের মত করে নিজেদের গড়ে, ভাঙে। ওদের কারুর উপরই আমার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। ওরা ঘোরে, ফেরে, আসে, আর হ্যাঁ… ভয় দেখায়।

এ স্বপ্নের শেষ নেই, প্রতি দিনে বা রাতে ঘুমপাড়ানি গানের মতই এই স্বপ্নরাই আমার ছায়াসঙ্গী। যদিও তমাল বলে, ভয়ের এই স্বপ্নগুলো আমি নাকি আগে দেখতাম না, চারমাস আগের অ্যাক্সিডেন্টটার পর থেকে এরা আমার প্রতি রাতের সঙ্গী। অ্যাক্সিডেন্ট মানে সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে গিয়ে মাথায় ভালো মতন চোট পেয়েছিলাম। আমার স্মৃতিও আমার জন্যে খুব কম বরাদ্দ করেছে, অ্যাক্সিডেন্টের আগের কথা আমার কিছুই মনে নেই। আমি তমালকে অবিশ্বাস করি না ঠিকই, কিন্তু কেন যেন মনে হয় এই স্বপ্নগুলো আমি আগেও দেখেছি, প্রায়শই দেখতাম। কখনও একই স্বপ্ন বারবার, কখনও আচমকা নতুন স্বপ্ন, দিনে এক বার বা একাধিক বার, গতে বাঁধা কোনও ফর্মুলা নেই আমার স্বপ্নদের। কখনও রাস্তার মাঝে যেতে যেতে হঠাৎ হঠাৎ মাথাটা দুলে ওঠে, আমার চারপাশটা মোবাইল অ্যাপের ব্লারড ব্যাকগ্রাউন্ডের মত ধোঁয়াটে হয়ে যায়। তখন শুধু আমি থাকি, আর আমার স্বপ্নেরা। শিউরে উঠে, আঁতকে উঠে, চিৎকার করে উঠি। আমার মনে হয়, আমি ঠিক স্বাভাবিক নই। না মনে হয় না, আমি জানি আমি অস্বাভাবিক। শুধু যখন হুঁশ ফেরে, চোখের সামনে পরিচিত মুখগুলোকে দেখতে পাই, তখন মনে হয় পাগলামিটা খুব অল্প সময়ের জন্য বাসা বাঁধে আমার মধ্যে। আবার আমি স্বাভাবিক হয়ে যাই।

কাল রাতে ভামগুলোর মুখগুলো আমার খুব কাছেই ছিল, এতটাই কাছে যে ওদের সবুজ মণির চারপাশে জমাট বাঁধা লাল রক্তবিন্দুদের দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। আঁশটে গন্ধটা নাকের মধ্যে ভক ভক করে লাগছিল। ওদের লম্বাটে শরীরটায় ছোট ছোট পাগুলো কেমন যেন বিকৃত লাগে আমার। সাদা সাদা সরু সরু দাঁতের ফাঁকে ছটফট করতে থাকা মাছটাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খেয়ে নিল ওরা। মাছটার গায়ে কোনও আঁশ নেই, পাঁকাল মাছের মত শরীরটার কিছুক্ষণ পরে আর কোনও অস্তিত্ব থাকল না। চিৎকার করে উঠেছিলাম, হঠাৎ মুখের উপর একটা হাত চাপা পড়ায় আমার চিৎকারটা গোঙানি হয়ে মুখের মধ্যেই আটকে থাকল। ঘুম থেকে উঠে দেখি, মিতুল আমার পাশে বসে আছে। ওর চোখে ভয়, আমার পাশে এতদিন ধরে শুয়ে শুয়ে ও হয়তো জেনে গেছে মা কখন কীভাবে ভয় পায়! আসলে, স্বপ্ন আর বাস্তবের বাউন্ডারিটা আমার কাছে খুব ক্লোজ! কোথায় তারা মিশে যায়, কখন তারা দূরে সরে এ আমিও ঠিক করে বলতে পারি না।

আমি মীনাক্ষি, বয়েস বত্রিশ, মাঝারি গড়ন, শ্যামবর্ণা, সাধারণ মুখশ্রী। আমার একমাত্র অসাধারণত্ব আমার স্বপ্নেরা। ওরা আমার বর্তমান আর ওরাই আমার অতীতের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষীণ সূত্রও বটে। আমার স্বপ্নেরা আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে। ওদের অসাধারণত্বটুকুই আমার। আর ওদের মুখোমুখি না হওয়াটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

লখনউতে এখন যে জায়গায় আমরা আছি সেটা সুবিখ্যাত লক্ষ্ণৌ রেসিডেন্সির কাছেই, গোমতী নদীর ক্ষীণ রেখা আর বড়া ইমামবাড়ার সুউচ্চ মিনার আমার বাড়িটার ছাদে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে। এ শহরের স্কাইলাইন কলকাতার থেকে অনেকটাই আলাদা, আকাশচুম্বী ফ্ল্যাটগুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে অনেকগুলো নাম না জানা সৌধের কারুকার্যময় চূড়া উঁকি দেয়। আমার অবশ্য এখনও কোনও জায়গাতেই যাওয়া হয়নি, সবে তো তিন মাস হল এসেছি এ শহরে। যতটুকু এ শহরটা সম্পর্কে জেনেছি, পুরোটাই বই পড়ে। বই পড়তে আমার ভীষণ ভালো লাগে, যদিও বেশিক্ষণ একটানা পড়লে মাথার পিছনের ব্যথাটা আবার ফিরে আসে। একটা পিন ফোটানোর মত অনুভূতি, দপদপে ব্যথা, আর তার সাথে ধাঁধিয়ে দেওয়ার মত আলো হঠাৎ করে এসে চোখের সামনে উজ্জ্বল একটা পর্দা ফেলে দেয়। আর তারপর… তারপর সেই পর্দা সরিয়ে যতই দেখতে চাই, মাথাটা কিছুতেই সঙ্গ দেয় না। অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছিল কলকাতাতেই। শুধু মনে আছে, হাসপাতালে যখন চোখ খুলেছিলাম. মুখের দিকে কতগুলো উদ্বিগ্ন মুখ তাকিয়ে ছিল একভাবে। কারা তারা তখনও ঠিক চিনি না। তবে, ভাসা ভাসা চোখের এক ছোট্ট মেয়ে সেই যে জড়িয়ে ধরল আমায়, সেই যে আমার বুকে মাথা ঠেকাল, সেই তখন থেকে বুঝেছিলাম আমি ওর মা। তার দৌড়ে এসে আমায় জাপটে ধরার মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল, যে মনে হয়েছিল, তার নিঃশ্বাসটুকু সে যেন এইসময়টার জন্যই রোধ করে রেখেছিল। আস্তে আস্তে পুনর্পরিচয়ের পালা সাঙ্গ হল। তমাল মিত্র, আমার স্বামী। মিতুল, আমার কন্যা। আমার বাবা, মা, থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত আমার দাদা এদের সঙ্গেও দেখা হল বটে তবে খুব বেশি সময় পেলাম না ওদের সাথে। হাসপাতালে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সমবেদনায় জড়ানো কটা শব্দ ছাড়া আমার মায়ের কাছে আর বিশেষ কিছু শুনতে পেলাম না। ভদ্রমহিলা আরও কাঁদতেন যদি না নার্স এসে তাকে চুপ করার জন্য বলত। আমার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছিল।

কান্নাকাটি, চিৎকার-চেঁচামেচি, যেকোনও জোরালো শব্দ আমি এখনও সহ্য করতে পারি না। টিভি সিরিয়ালের উচ্চগ্রাম শব্দেও আমার কষ্ট হয়। ডাক্তার বলেছেন, সময় লাগবে।

এই ঘটনার প্রায় পরপরই তমালকে কলকাতা থেকে চলে আসতে হল লখনউতে, পোস্টিংয়ের চিঠিটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। কলকাতা থেকে সব পাট মিটিয়ে আমরা তিনজন অনির্দিষ্টকালের জন্য লখনউয়ের বাসিন্দা হয়ে গেলাম। এই শহরে পছন্দের মত এলাকা আর পছন্দের বাড়ি খুঁজে বার করতে একটু সময় লেগে গেল। ওর হট্টগোল একেবারে পছন্দ নয়, তাই এই পাড়াটা ও কেন আরও হাজারটা অপশন বাতিল করে বেছে নিয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি আমার। লখনউয়ের এই পাড়াটা ভীষণ একটেরে। একটা নিরালা গলির মধ্যে সেকেলে কটা ইতস্ততঃ ছড়ানো ছিটানো গম্বুজ খিলানআঁটা বাড়ির মধ্যে একটা, আমার এই নতুন আস্তানা। বাড়িগুলোর নামও অদ্ভুত! প্রায় দুমানুষ উঁচু পাঁচিলে মার্বেলের ট্যাবলেটে লেখা নামগুলো পড়লে বেশ নবাবী আমলের মেজাজটা ঘুরে ফিরে আসে। মোড়ের মাথার বাড়িটা মোতি মহল, তার পাশেরটা ফিরোজ মঞ্জিল, ডানদিকে বেশ খানিকটা দূরে রুহানে অমন, আর আমার দোতলা আস্তানাটির নাম নীলামহল। একটু সেকেলে নাম, কিন্তু আমার বেশ পছন্দই হয়েছে।

তমাল মিত্র, মানে আমার স্বামী, অতিরিক্ত দায়িত্বশীলতার মোড়কে মোড়া আদ্যোপান্ত কেজো মানুষ। ৯/এ বেণীনন্দন স্ট্রিটের ছোট্ট চৌহদ্দির বাইরে এসে সম্ভবত ওর কাজের চাপ আরও খানিকটা বেড়ে গেছে। বুঝতে পারি, মিতুল আর আমাকে নিয়ে ও খুব প্রোটেক্টিভ। উপরন্তু আমার এই আধা-অসুস্থ অবস্থায়, এই অনাত্মীয় জায়গায় ওর অনুপস্থিতিতে আমরা দুজন কীভাবে থাকব, কীভাবে দৈনন্দিনের রুটিনটা সেট হবে সেটা নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছে। তমালের চাকরিটায় প্রচুর ট্র্যাভেল, মাসে দু থেকে তিন বার, পাঁচ থেকে সাত দিনের জন্য। কলকাতার চাকরিটা ছাড়তে না হলে, হয়তো এই পরিস্থিতি হত না। কিন্তু ওর পক্ষে ব্রেন কনকাশনের রুগীকে চাকরিবাকরি সামলে দেখাশোনা করা সম্ভব হচ্ছিল না। আমার মায়ের পক্ষেও, দাদাকে ফেলে আমাকে দেখাটা অসম্ভব ছিল।

তাই লখনউয়ের এই চাকরিটা যখন ও পেল, তখন আমিই সাহস দিলাম। ঘটনার বেশ কদিন হয়ে গেছে, এখন নিশ্চয়ই সামলে নিতে পারব আমি। মিতুলকে তমাল চোখে হারায়, এখানে এসে থেকে তাই অন্তত ছজন হাউসমেডকে নাকচ করে শেষে আবিদা বলে এক আধাবয়স্ক মহিলাকে ঠিক করেছে আমার আর মিতুলের দেখভালের জন্য। তার অবশ্য দশ ঘন্টার ডিউটি। সাতটায় তমালের অফিস বেরোনোর আগে সে ঢোকে আর ঘড়ি ধরে পাঁচটায় বেরিয়ে যায়। মিতুলটা ছোটো, সবে চারবছর বয়স। এখন এখানে নতুন স্কুলে ভর্তির সময়ও পেরিয়ে গেছে। বেশিরভাগ স্কুলেই অক্টোবরের মধ্যে নেক্সট সেশনের অ্যাডমিশনের প্রসিডিওর সমাপ্ত হয়ে গেছে। অতএব, গোটা একটা বছর অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। এখানে আসার আগে ও একটা নার্সারি স্কুলে পড়ত। আমি অসুস্থ হওয়ার পর বেচারীর সেখানে যাওয়াও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে মিতুল ওর পুরোনো স্কুলের গল্প করে না। ইন ফ্যাক্ট, মিতুল নতুন, পুরোনো কোনও গল্পই করে না। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলে ও হাত ছাড়িয়ে ছুটে পালায়।

দুই

লক্ষ্ণৌতে প্রবল শীত পড়েছে। তমাল বলছিল কুয়াশার চোটে ট্রেন, ফ্লাইট সবই দেরীতে চলছে। কদিন পর আবার ও অফিসের কাজে দিল্লী যাবে। অনেক বেলা অবধি কুয়াশার চাদরে মোড়া থাকে এই মহল্লাটা। আজ সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ ঘুম ভেঙেছিল। বেডরুমের দরজা খুলে বাইরে দাঁড়ালেই ব্যালকনিতে কুয়াশারা মেঘের মত ঘিরে ফেলে মানুষকে। বেলার দিকে বাড়িটার দোতলা থেকে এমনিতে সামনের গলিগুলো পরিষ্কার দেখা যায়। উৎকট গাম্ভীর্য এই পাড়াটায়। বাড়িগুলোর বিশাল বিশাল ফাটকগুলো শক্ত করে আটকানো। পেছনের পাড়াটা থেকে বাঁদিকে ঢুকতে যে রাস্তাটা বাঁক নিয়েছে, ওখানে একটা অর্ধসমাপ্ত শপিং কমপ্লেক্স আছে। তিনতলা স্ট্রাকচার। আপাতত একতলাটায় কটা ছড়ানো ছিটানো দোকান রয়েছে, মুদির, স্টেশনারির, ওষুধের, জামাকাপড়ের। দোতলা তিনতলা সম্পূর্ণ ফাঁকা, এখনও কনস্ট্রাকশন চলছে বোধ হয়। মাঝে মাঝে তমালের সঙ্গে ওখানে গিয়েছি, খুব ভালো চাল পাওয়া যায় একটা দোকানে। সুগন্ধী চাল। বিরিয়ানি থেকে পায়েস সবই ফার্স্ট ক্লাস হবে ওই চালটায়। তমাল আর মিতুল বিরিয়ানি খেতে ভালোবাসে, মানে, সেটাই শুনেছি তমালের কাছে। আমি শেষ কবে বিরিয়ানি রেঁধেছি মনে নেই আমার। আর বাইরের খাবার আমার বাড়িতে ঢোকে না। তমাল একেবারেই পছন্দ করে না। কিন্তু আজকাল এত অন্যমনস্ক থাকি, সোজা বা জটিল যে কোনও ধরণের রান্না করতে আমার হাত কাঁপে। আত্মবিশ্বাসটাই যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। ওই শপিং মলটা বাদে পাড়ায় আর কোথাওই যাওয়া হয়নি, নিজে যেচে আলাপ করার মত কাকীমা, পিসিমা গোছের কাউকে দেখতে পাই না। তমাল বাড়িতে থাকলে যা একটু হাঁকডাক করে, ও না থাকলে সব নিশ্চুপ। মিতুল বড্ড শান্ত, এতটাই যে মাঝে মাঝে আমার মনে হয় যে ওর বয়স যেন চার নয়, চল্লিশ। মাঝে মাঝে জানালার ধারে বসে এমন পাকা বুড়ির মত বাইরে তাকিয়ে থাকে যে মনে হয় কত গভীর চিন্তা করছে। এমনিতে সঙ্গে সঙ্গে ছায়ার মত এঁটে থাকে, কিন্তু এত কম কথা কেন যে বলে! শুধু শরীর খারাপ হলে আমাকে আঁকড়ে ধরে, তখন বুঝি, মাকে ওর ঠিক কতটা প্রয়োজন!

গতকাল সারাদিন মিতুলের শরীরটা ভালো ছিল না। তমালের দিল্লী ট্রিপ এক সপ্তাহের। যতদিন না ও ফেরে, ততদিন ও আবিদাকে রাতে থাকতে বলেছে। আবিদা বেগমের বাড়ি তহশীনগঞ্জ এলাকায়, সেটা নাকি এখান থেকে পাঁচ ছয় কিলোমিটার দূরে। অটোয় যাওয়া আসা করে। বাড়িতে একপাল ছেলেপুলে নাতিনাতনী। এক চিলতে ঘরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা পায় না। ওকে দেখে মনে হয় রাতে এই বাড়িতে থাকতে পেয়ে ও একপ্রকার নিশ্চিন্তই হয়েছে। আবিদা এমনিতে কীরকম চরিত্রের ঠিক বুঝতে পারি না। এমনিতে আমার বিশেষ কথা বলা বারণ, ডাক্তার বলে দিয়েছেন যে আমার প্রচুর মানসিক ও শারীরিক বিশ্রামের প্রয়োজন। সেদিক থেকে দেখলে আবিদা কাজে কর্মে খুব পটু, কোনও অভিযোগ জানানোর জায়গা নেই। কিন্ত মাঝে মাঝে. আমার গলার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ও। আমার গলার সোনার চেনে একটা পান্নার লকেট ঝোলে, হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসার পর ড্রয়ারে খুঁজে পেয়েছিলাম। খুব দামী হওয়া সত্ত্বেও আমি ওটা সবসময় পড়ে থাকি। কখনও ভীষণ ভয় পেলে, চমকে উঠলে অজান্তে ওটাকে আঁকড়ে ধরি। আবিদার মুগ্ধ চাউনিটা লকেটটায় এসে স্থির হয়ে যায়। একবার ঠারেঠোরে দাম জিজ্ঞাসা করেছিল আমায়। আবিদাকে দেখলে আমার মায়া লাগে। যদি কোনওদিন সম্ভব হয়, খুলে দিয়ে দেব লকেটটা।

মিতুল হাঁটতে হাঁটতে বেডরুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে চলে এসেছে, কালকের শরীর খারাপের ধকল এখনও চোখে মুখে লেগে আছে ওর। চোখের তলাটা কালচে ধরেছে। খুব আস্তে নেতিয়ে নেতিয়ে হাঁটছে। মিতুলকে ডাক্তার দেখাতে হবে, বাড়িতে যে ওষুধপত্র আছে তাতে সারবে বলে মনে হচ্ছে না। তমালকে কিছু বলতেও ইচ্ছা করছে না, হয়তো ব্যস্ত হয়ে দিল্লী যাওয়াটাই বন্ধ করে দেবে ও। তাই ঠিক করেছি, ও চলে গেলে আবিদার সঙ্গে কোনও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব ওকে। মিতুলের জন্য কাল রাতে জেগে অন্তত একটা লাভ হয়েছে আমার, কাল কোনও স্বপ্ন দেখিনি আমি। পেটে ব্যথায় কাতরাতে থাকা সন্তানের কষ্ট অবশ্য কোনও অংশে কম যায় না। মিতুলের হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে এসেছে, খুব প্রিয় ব্যাগটা ওর। গোলাপী, নীল ডোরাকাটা ডিজাইন। একটা ছোট্ট টেডি চেনের সাথে ঝুলছে, ওরই ছোটবেলার ব্যাগ হয়তো। ব্যাগে কিছু পুরোনো জামাকাপড় আছে, বাচ্চাদের জামাকাপড়। ওরই ছোটবেলার হবে নিশ্চয়ই। মিতুলের এই স্বভাবটা অদ্ভুত। শরীর খারাপ হলেই ব্যাগটা থেকে পুরোনো জামাকাপড়গুলো বার করে বারবার গন্ধ শোঁকে। ব্যাগটা থেকে জামাকাপড়গুলো বার করতে দেয় না, বালিশের কাছে নিয়ে শোয়। ঘটনাটা অস্বাভাবিক, কিন্তু তমাল পাত্তা দিতে চায় না। আমি নাকি মিতুলকে নিয়ে ওভারথিংকিং করি। ব্যাগটাকে মিতুল সামলে রাখে খুব। যখন কলকাতায় ছিল, তখনও দেখেছি, কোনওসময়ে হাত দিতে দেয়নি ব্যাগটায়। ওর বাবা নিতে চাইলেও না।

লখনউতে যেদিন আসব, সেদিনের ঘটনা। বিকেলের ট্রেন, বাক্সপ্যাটরা বোঁচকা বাঁধা কমপ্লিট। মিতুলকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খোঁজার পর যখন ভাবছি পাড়ায় খোঁজ করতে যাব, দেখি চিলেকোঠার ঘর থেকে ব্যাগটা হাতে নিয়ে নামছে ও। অপ্রয়োজনীয় জিনিস বলে তমাল সরিয়ে রেখেছিল হয়তো, ঠিক খুঁজে নিয়ে এসেছে। তমালের কাছে এটা একটা মজার বিষয়, কিন্তু আমার কাছে নয়। কেন জানি না, আমার মনে হয়, মিতুল নিজেই নিজের মনের একটা চোরা কুঠুরিতে বসবাস করে। আমার স্বপ্ন দেখে আঁতকে ওঠা, আমার ভয় পাওয়া এসব ওর কাছে খুব স্বাভাবিক, আমার অন্ধকার স্বপ্নগুলোকে ও যেন আমার মত করেই চেনে। আমি যে হাজার চেষ্টা করেও ওর মনের আঁধারের তল পাই না! কী যে অসহায় লাগে! নয় মাস গর্ভের আঁধারের থেকেও বেশী গভীর এ আঁধার।

“কী ভাবছ মিতুল?” ওর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।

ওর শান্ত ভাবটা আমার কাছে অসহ্য লাগছিল। ওর ঘন লম্বা চুলগুলোকে পিঠের উপর মেলে ও রান্নাঘরের জানালার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। আমার প্রশ্ন শুনে মিতুল আমার দিকে তাকাল। ওর চোখের দৃষ্টি শূন্য। ও হাতের মুঠোতে কী যেন ধরে আছে। অরেঞ্জ আর গ্রীনের শেড। মিতুলকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ওটা কী মিতুল?”

কোনও উত্তর দিল না ও। বদলে একটা গান গেয়ে উঠল, “ল্যাভেন্ডারস ব্লু, ডিলি ডিলি… ল্যাভেন্ডারস গ্রিন… ইফ আই ওয়্যার অ কিং ডিলি ডিলি… আই উড নিড অ কুইন…”

কিচেনের জানালাটায় একটা উইন্ড চাইম ঝুলছিল… মিতুলের গলার সুরটা উইন্ড চাইমের টুংটাং শব্দটার সাথে মিশে গিয়ে হাওয়ায় ভাসতে লাগল। সুরটা যে ঠিক কোথায় গিয়ে আমায় ধাক্কা দিল জানি না, আমার সারা গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। ওর মাথায় হাত বুলালাম, ওর চোখের দৃষ্টি আজ শূন্য নয়। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। হাসলে মিতুলের ছোট্ট রোগা মুখটার বাঁদিকের গালে টোল পড়ে। সেই টোলটা দেখতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। মিতুল আবার গাইল… “ল্যাভেন্ডারস ব্লু… ডিলি ডিলি… ল্যাভেন্ডারস গ্রিন”, একটু থেমে আমার জন্য অপেক্ষা করল। আমি ওর গলায় গলা মেলাতে গিয়েও আটকে গেলাম। জানালা দিয়ে একটা দমকা হাওয়া এসে আমায় কাঁপিয়ে দিল। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে বোধহয়, ভেজা জোলো হাওয়া। শীত আরও বাড়বে!

“বৃষ্টি হচ্ছে কোথাও একটা আপা!” আবিদা ব্যস্ত হয়ে জানালাটা বন্ধ করতে এল। জোরে পাল্লাটা টানায় ধমাস করে একটা শব্দ হল, আর দমকা বাতাস বন্ধ জানালার পিছনে গুমরিয়ে গুমরিয়ে ধাক্কা মারতে লাগল।

মিতুলের হাত থেকে ঝুনঝুন শব্দে হাতে ধরা জিনিসটা পড়ে গেল, পড়ে গিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে অনেকদূর চলে গেল। একটা খেলনা, প্লাস্টিকের তৈরী ডুগডুগি। চোখে একরাশ অনুযোগ নিয়ে ও আমার দিকে তাকাল… আমি সেদিকে তাকিয়ে থমকে গেলাম। মিতুল কাঁদছিল, নিঃশব্দ কান্না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলে যেটুকু শব্দ হয় সেটুকুও নয়। তমাল নীচ থেকে ডাকছিল, ওর বোধহয় অফিসে বেরোতে দেরী হয়ে যাচ্ছে। ওর ডাকে সাড়া দিয়ে নীচে চলে গেলাম। যাওয়ার সময় একবার আবিদার দিকে চোখ পড়ল। মিতুলের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।

তিন

লখনউতে প্রায় প্রতিটা বাড়িরই সামনে পিছনে কেয়ারী করা বাগান, আর তাতে এই শীতকালে হাজারো চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, কসমস, পিটুনিয়া, গ্ল্যাডিওলাস ফুটে স্বর্গ হয়ে থাকে। আমার বাড়ির চারধারে প্রায় দশ ফুট জায়গা ছেড়ে পাঁচিল দেওয়া, আর পেছন দিকটায় প্রচুর ফাঁকা জমিও পড়ে রয়েছে। যত্নের অভাবে কিছু আগাছা গজিয়েছে এখানে ওখানে। সামনের দিকে কয়েকটা বাড়ি ইতিউতি দেখা গেলেও, বাড়ির পেছন দিকটা ধু ধু ফাঁকা। বাড়িটা সে অর্থে আশেপাশের অন্যান্য বাড়িগুলোর থেকে অপেক্ষাকৃত নতুন, তার কারণ দোতলা বাড়ির এই প্যাটার্নটা এই পাড়ার একতলা বাংলো ধরণের সবকটা বাড়ির থেকে একদম আলাদা। বাড়ির মালিক বিদেশবাসী। তমালের অফিস থেকেই বাড়িটার খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল শুনেছি। বাড়িতে সাকুল্যে সাতটা ঘর, নীচে চারটে আর উপরে তিনটে। ঢুকতেই একতলার বিরাট হলঘর দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলার ডাইনিং হলে। ডাইনিং হলটাকে মাঝখানে রেখে দুদিকে দুটো বেড রুম, লাগোয়া টয়লেট আর একটা রান্নাঘর। আমরা তিনজন মানুষ, কতটুকুই বা জায়গা লাগতে পারে। নীচের ঘরগুলো অব্যবহৃতই পড়ে থাকে। দোতলার একটা বেডরুমের সঙ্গে লাগোয়া একটা ব্যালকনি থেকে বাড়ির পিছন দিক, আর অন্য বেডরুমটায় লাগোয়া ব্যালকনি থেকে বাড়ির সামনের রাস্তাটা দেখা যায়। পেছন দিকের জমিটায় হরেক রকমের বাগান করা যেতে পারে, আপাতত কটা ফুলাগাছ লাগাব।

তমাল আজ সকালে বেরিয়ে গেছে। মিতুলের শরীরটা ভালোর দিকে। তবু আর একটা ওষুধ ডাক্তারকে ফোন করে জেনে নিয়েছিলাম। সেটা আনতেই শপিং কলপ্লেক্সটায় আসা। এই প্রথম বার একা। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে আজ একতলার দোকানগুলো বন্ধ। একটা ছোট মুদী আর কী ভাগ্যি ওষুধের দোকানটা খোলা। মিতুলকে নিয়েই আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আবিদা বলল অসুস্থ অবস্থায় নিয়ে বেরোলে যদি বাড়াবাড়ি হয়! তাই ওকে বাড়িতেই রেখে এসেছি। শপিং মলটা আজ ফাঁকা, হয়তো দোকানপাট বন্ধ বলেই। ওষুধের দোকানটা একটা প্যাসেজের একদম শেষ প্রান্তে, ওর পাশ দিয়েই দোতলায় যাওয়ার সিঁড়িটা উঠে গেছে। সিঁড়ির মুখটায় জমাট অন্ধকার। ল্যান্ডিংটাতে কাচের বিরাট জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের রাস্তার আলো আসছে, কিন্তু তাতে ল্যান্ডিংয়ের মেঝেটাই আলোকিত হয়েছে, নীচের সিঁড়ি অবধি আলো পৌঁছায়নি। আলোটার দিকে তাকাতেই কেমন যেন লাগল, কাচের ফাঁক দিয়ে বাইরের চড়া হ্যালোজেন আলোর বৃত্তটা ভেঙে গিয়ে ছোট ছোট বৃত্তের মত ঢুকছে ল্যান্ডিংটায়, অবিকল তারাবাজির ফুলকির মত। ফুলকিগুলো নাচছে আর নেচে নেচে কোনও একটা প্যাটার্ন তৈরি করছিল চোখের সামনে। আলো আঁধারিতে নিজের মনে নাচতে থাকা ফুলকি… আমার মনে হল, ওরা আমায় ডাকছে! আমার মাথার মধ্যে কী যেন হল। ভাবতে লাগলাম, সিঁড়ি বেয়ে যদি ওপরে উঠি তবে কোনও অদ্ভুত জগতের অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পাব। এমন কোনও দৃশ্য, যেটা আগেও কখনও দেখেছি। কত আগে মনে করতে পারি না। শুধু মাথার বাঁপাশে দপদপ করতে থাকা স্নায়ুগুলো আবার সেই দৃশ্যগুলোর অনুভূতি তৈরী করছিল মনের মধ্যে। অথচ, অনুভূতিটা কেমন খাপছাড়া! আমার মেরুদণ্ড বেয়ে ঘামের বিন্দু টপটপিয়ে নামছিল। বাইরের হাড় কাঁপানো শীতকে উপেক্ষা করে আমার শরীর ঘামছিল। মস্তিষ্ক বলছিল সিঁড়ি টপকে গেলেই দৃশ্যটাকে পরিষ্কার দেখতে পাব। শরীর কিন্তু বিদ্রোহ করছিল। অবশেষে শরীরের উপর মনের নিয়ন্ত্রণটাই প্রবল হল, আস্তে আস্তে আমি উপরের দিকে উঠতে থাকলাম।

সিঁড়িতে রাফ ঢালাই দেওয়া, এদিক ওদিক থেকে শিক বেরিয়ে আছে। খসখসে মেঝেটায় আমার জুতোর শব্দটা টক টক করে কানের মধ্যে একটানা বাজছিল। উঠতে উঠতে আরও আরও অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। একজন ডাকছিল আমায়, চেনা স্বর… মিতুলের নয়, তমালের নয়… অন্য কারুর। মাথার মধ্যে হঠাৎ দপ দপ করে কতগুলো বাল্ব জ্বলে উঠল। পরক্ষণেই চুর চুর হয়ে ভেঙেও গেল। অসহায়ের মত দেখলাম সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে চিলেকোঠার ঘরটায় এসে পৌঁছেছি। মস্ত বড় শাটার দিয়ে চিলেকোঠার দরজাটা আটকানো। পিছন ফিরে দেখি একতাল অন্ধকারের সমুদ্রে দাঁড়িয়ে আছি। সব তালগোল পাকিয়ে গেল, উপরে উঠছিলাম না নীচে নামছিলাম। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল, সারা শরীরের ঘাম টুপ টুপ করে পা বেয়ে পায়ের পাতা স্পর্শ করছিল। আমার মনে হল, ঐ যে সিঁড়িগুলো, ওগুলো আর নেই, বদলে তাল তাল অন্ধকারে ঝাঁপ দিলেই নীচে নামব আবার। গলার আওয়াজ আরেকবার শুনলাম, খুব মৃদু। মাথার বাঁপাশে আবার দপদপ করছিল, কে যেন আমার জন্য নীচে অপেক্ষা করছে! কী যেন বেশ নাম! ম…ম দিয়ে শুরু! অন্ধকারের ওপার থেকে সে ও আমায় ডাকছে। কোনটা সত্যি, অন্ধকারের এপার না ওপার— গুলিয়ে গেল। শুধু মনে হল, একটা ঝাঁপ দিতে পারলেই সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাব আমি। পা-টা বাড়ালাম, ল্যান্ডিংয়ের শেষ সীমানা যেখানে নিশ্ছিদ্র ঘন কালো অজানায় মিশেছে সেই দিকে। মাথাটা দুলে উঠল, আর ঠিক তখনই মাথার মধ্যে আবার একবার বাল্ব জ্বলে উঠল। নামটা মনে পড়ে গেল, মিতুল… মিতুল অপেক্ষায় আছে আমার। কিন্তু ততক্ষণে টাল সামলাতে পারলাম না, পা-টা বেঁকে গিয়ে অতলের মধ্যে পড়ে যেতে লাগলাম। একবারের জন্য অনুভব করলাম, কে যেন তার হাতে আমার শরীরের ভারটা নিয়ে নিয়েছে।

জ্ঞান ফিরল খানিকক্ষণ পরে, মাথায় একটা চাপচাপ ব্যথা নিয়ে। চোখ মেলতে পারছিলাম না। শুধু এটুকু বুঝতে পারছিলাম, সিঁড়ির ধাপে বসে আছি আমি। একটা সুরেলা স্বর পাশ থেকে বলে উঠল, “আপনি ঠিক আছেন?” অদ্ভুত রিনরিনে গলাটা আমায় জোর করে চোখ মেলতে বাধ্য করল। একটি অল্পবয়স্ক মেয়ের সুন্দর মুখ হিজাবের নীচে উঁকি মারছিল। টানা টানা চোখে অনেকটা মমতা মাখা। অদ্ভুতভাবে সে চোখের মণির রঙ নীল। সে আবার প্রশ্ন করল, “আপনি ঠিক আছেন তো? এভাবে অন্ধকারের মধ্যে মাথা ঘুরে পড়েছিলেন কেন?” অপরিচিত মেয়েটার গলার স্বরে উদ্বিগ্ন ভাব।

আমি কোনও উত্তর দিলাম না। আমার স্বপ্নের বাস্তব আর পরাবাস্তব আবার একাকার হয়ে গিয়েছিল। বাউন্ডারিলেস ওই জায়গাগুলোয় কতবার যে ঘুরে এসেছি, মেয়েটাকে সেটা বোঝানো সম্ভব নয়। তমাল যেমন হাসে, ঠিক তেমনই হাসবে ও। বলবে, জেগে জেগেও কি কেউ স্বপ্ন দেখে! ওদের বোঝানো যায় না সব কথা। হাতের উপর ভর দিয়ে উঠতে গেলাম, মেয়েটা আমার কনুইয়ের কাছটা ধরে উঠতে হেল্প করল। খেয়াল করলাম, মেয়েটার গা থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে। স্নান করে বুকের মাঝখানে সুগন্ধ লাগালে যেমন সারা শরীর থেকে একটা ভেজা ভেজা মিষ্টি বাষ্প ছিটকে আসে, অনেকটা সেরকম। ওর বড় বড় চোখ দুটোয় একটু দুশ্চিন্তার প্রভাব। বললাম, “আমি ঠিক আছি। এবার একা চলে যেতে পারব।”

মেয়েটা হেসে হাত বাড়িয়ে আমার হাত স্পর্শ করল। বলল, “আমি আরশিন অদা, কাছেই থাকি। তোমার নাম?”

“মীনাক্ষি, মীনাক্ষি মিত্র।”

“একা চলে যেতে পারবে?”

বললাম,“হ্যাঁ।”

আরশিনের সাথে শপিং কমপ্লেক্সটার বাইরে বেরিয়ে এলাম। সবকটা দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। বাইরে প্রবল শীতের মধ্যে একটা জনমানুষের দেখা নেই। কতক্ষণ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি কে জানে, মিতুলের মুখটা মনে পড়ল।

“লখনউতে নতুন?” আরশিন ভাব জমাতে চাইছিল। কিন্তু আমি বিরক্ত হচ্ছিলাম, ওর প্রশ্নের উত্তরে দায়সারা হুঁ হাঁ করে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। আরশিন পেছন থেকে বলে উঠল, “আবার দেখা হবে।”

সে রাতে আবিদার কী একটা কাজ থাকায় বাড়ি চলে গিয়েছিল। পরের দিন কাজ করতে এল অনেক দেরীতে। খালি বাড়িতে সকালে বিশেষ কাজ ছিল না, মিতুলও ঘুমাচ্ছিল। হাতের কাছে লক্ষ্ণৌর ইতিহাসের উপর লেখা একটা বই উল্টে পাল্টে দেখছিলাম। আসার সময় স্টেশনের হুইলার থেকে কিনেছিলাম। লক্ষ্ণৌর ইতিহাস বড় প্যাঁচালো, পদে পদে শাহজাদা নবাবদের বিচিত্র জীবনপঞ্জি যে কোনও এ গ্রেড থ্রিলারকেও হার মানাবে। লখনউয়ের শেষ নবাব ওয়াজিদ আলির পূর্বপুরুষ সুজা-উদ-দৌলার জীবনের একটা অংশে চোখ আটকে গেল। এই সেই সুজা-উদ-দৌলা যিনি বক্সারের যুদ্ধে মীরকাশেমের সঙ্গে একজোট হয়ে ব্রিটিশ কোম্পানির বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। পরাজিত নবাব খুব অল্প বয়সেই লক্ষ্ণৌর ফৈজাবাদে মারা যান। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তাঁর মৃত্যু নিয়ে বেশ রহস্যময়তা আছে। শোনা যায়, বক্সারের যুদ্ধে হেরে কোম্পানীকে বার্ষিক পঞ্চাশ লাখ টাকা তোলা দিতে স্বীকৃত হয়েছিলেন নবাব। ততদিনে তোষাখানার অবস্থা সঙ্গীন। রোহিলাখন্ড তখন ছিল অওয়ধের অধীনে। সুজা-উদ-দৌলা কোম্পানীকে খেসারত দেবেন বলে রোহিলাখন্ডের নবাব হাফিজ রহমত খাঁর কাছে প্রচুর পরিমাণ নজরানা দাবি করেন। হাফিজ রহমত খাঁ দিতে অসম্মত হলে ব্রিটিশদের সাথে মিলে রোহিলাখন্ড আক্রমণ করেন। রোহিলাখন্ডের যুদ্ধে রহমত খাঁর প্রাণ যায়। রমণ বিলাসী সুজা-উদ-দৌলা রহমত খানের চৌদ্দ বছর বয়সী কন্যাকে বলপূর্বক নিজের শয্যাসঙ্গিনী করেন। সেই মেয়েটি পিতৃহত্যার প্রতিশোধের আগুন বুকে জ্বালিয়েই নবাবের বিছানায় নিজেকে সঁপে দেয়। তার মখমলি জালিদার কুর্তির নীচে লুকানো ছিল বিষ লাগানো খঞ্জর, সেটি সে নবাবের উরুতে আমূল বসিয়ে দেয়। রক্তে দ্রুত বিষ মিশে নবাবের ওখানেই পরকাল প্রাপ্তি হয়। গল্পটা পড়ে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। প্রতিশোধস্পৃহা ঠিক কীরকম মানসিক অনুভূতি! কতটা রাগ একসাথে জমলে তবে রাগের কারণটাকে ছুরি দিয়ে ফালা ফালা করা যায়! অনেকখানি মানসিক প্রস্তুতি লাগে নিশ্চয়ই। আবিদা কাছেই ঘর মুছছিল, সুজা-উদ-দৌলার ঘটনাটা ওকে পড়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “এই রেসিডেন্সিতেও অনেক গল্প লুকানো আছে, না আবিদা? তুমি জানো?”

আবিদা অবাক হয়ে চোখ তুলল, তারপর বলল- “না, আপা। আমরা পড়াশুনা না জানা গরীব আনপড় আছি, আমরা কী জানি এখানকার সম্পর্কে! তবে শুধু নবাব বাদশাহদের কেন দোষ ধরছেন, ফিরিঙ্গি সাহেবরা কি মেয়েবাজিতে কিছু কম ছিল নাকি? লক্ষ্ণৌতে কত মেয়ের দেখা পাবেন, শরীরে বিদেশী রক্ত বইছে। হয়তো কোনও কালে কোনও তওয়াফের সাথে কোনও ফিরিঙ্গির প্রেমের ফসল সব। আগে এদের নসিবে কোঠাব্যবসাই লেখা থাকত, কিন্তু আপা… এখন তো সমাজ বদলেছে।”

আবিদার কথায় একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। মনটা হঠাৎ পুরোনো লক্ষ্ণৌর কল্পিত সন্ধ্যায় চলে গেল। টুংটাং পেয়ালার আওয়াজ, চমকদার ঝাড়বাতিতে দুলতে থাকা আলোর রোশনাই, ঠুমরি, দাদরা, কত্থকের বোল, হাজার গলার কলতান… অতীতের জমজমাট লক্ষ্ণৌ। শুনেছি, সে আমলের বাঈজীদের ঠাঁটবাটই আলাদা ছিল, কোনও কোনও গণিকা বাড়িতে রীতিমত মহফিল বসাতেন। লখনউ শহরের আভিজাত্যময় ক্লাব ছিল সেগুলি। ঠিক দেহোপজীবিনীর দলে তাদের ফেলা যাবে না। নাচ, গান, কবিতার শহর লখনউ এমনি এমনি এত বর্ণাঢ্য হয়নি। কিন্তু প্রদীপের তলার অন্ধকারের মত হয়তো আপাত চেকনাইয়ের আড়ালে এইসব অনাম্নী অঙ্গনাদের জীবনের ক্লেদ, দ্বন্দ্ব, আর সম্পর্কের বিষাক্ত অধ্যায় কেউ উল্টে পাল্টে দেখার সময় পায়নি, সবই কি আর ইতিহাসে লেখা থাকে!

আবিদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কাল যে বাড়ি চলে গেলে? তমাল শুনলে রাগ করবে কত জানো তো? কী কাজ ছিল বাড়িতে?”

ও হেসে বলল, “আমার মেয়ের নিকাহ হবে আপা। সেই নিয়ে খুব ব্যস্ত। জেবর, বরতন, কপড়া সবই তো চাই। বাড়িতে কামকাজ করা লোক তো দুজন, আমি আর আমার বড় ছেলে। সে কাজ সেরে ফেরে অনেক রাতে, তাই একটু শলা পরামর্শ করতে গিয়েছিলাম। গরীবদের তো একটা সূচঁ এদিকে ফুঁড়ে তো অন্যদিকে ফালা হয়ে বেরোয়। আপনার মত ভাগ্য তো সবার নয়… কত বড় ঘর… বর… পয়সা জেবর সবই তো পেয়েছেন।”

আবিদার কথা শুনে রাগের বদলে খুব হাসি পেল। ওর চুলে মেহেন্দির কটকটে কমলা রঙ, ওর খয়েরের রঙে রাঙানো ঠোঁট, কুতকুতে চোখের তলায় চামড়ার ভাঁজ, দৌড়ঝাপ করে কাজকর্ম করে ফেলা, ছোটখাট শক্তপোক্ত গড়ন বলে দেয় মানুষ হিসাবে কতটা আত্মবিশ্বাসী ও।

অথচ আমার আত্মবিশ্বাসটাই যে নেই! সারা দিন রাত কাঁটা হয়ে থাকি, কবে কোথায় আবার মাথার কোনও এক কোনায় ঘাপটি মেরে থাকা কিছু শব্দ, কিছু দৃশ্য সচল হয়ে ওঠে! সেইরাতের কথা মনে করে মেরুদণ্ড দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে এল। কী যেন বেশ নামটা বলেছিল মেয়েটা… আরশিন। আমার পরিষ্কার মনে আছে, প্রায় সাত আট ফুট উঁচু ল্যান্ডিংয়ের মেঝে থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে নীচে পড়ে যাচ্ছিলাম অথচ কীভাবে যে সেদিন বেঁচে গেলাম! পড়ে যাওয়ার অনুভূতিটা ছোটবেলার নাগরদোলায় চাপার মত, পেটের ভিতরটা হুশ করে খালি হয়ে যায়। অথচ মেয়েটা বলল আমি নাকি সিঁড়ির উপর মাথা ঘুরে পড়েছিলাম। আমার পড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কি গোটাটাই স্বপ্নের মধ্যে হল! সারা শরীরে কতবার তন্ন তন্ন করে ক্ষতচিহ্ন খুঁজেছি, পাইনি একটাও!

মিতুলের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ওর ঘুম ভাঙাটা অন্য বাচ্চাদের মত নয়। কোনও বায়না নেই, ঘ্যানঘ্যান নেই। ঘুমাতে ঘুমাতে হঠাৎ চোখ মেলে জেগে পড়ে। আর ওর সেই শূন্য দৃষ্টি… চোখের মণিটা সিলিংয়েই আটকে থাকে বেশ খানিকক্ষণ। তারপর ডাকলে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। ওর তাকানোটা বুকের মধ্যে একটা বরফের ছুরি বিঁধিয়ে দেয়। আমি বেশিরভাগ সময়েই নিতে পারি না। ঘুম থেকে উঠলে ওকে অনেকক্ষণ সময় দিই স্বাভাবিক হওয়ার জন্য, সামনে থাকি না। আজ টয়লেট পেয়েছিল। আবিদাকে ওর কাছে থাকতে বলে আমি টয়লেটে গেলাম। মিনিট পাঁচেক হবে, হঠাৎ আবিদার ভয়ার্ত গলার চিৎকার শুনে ছিটকে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি, আবিদা হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। ওর বাঁহাতের কব্জিতে ছোট্ট একটা ক্ষত, তাজা। মিতুলের হাতে একটা আধফুট সাইজের সরু পয়েন্টার পেনসিল। আবিদার মুখটা ব্যথায় কাতর আর মিতুলের চোখেও জমাট বাঁধা ভয়। চট করে ওর মুখটাকে কোলের মধ্যে লুকালাম। আবিদা বলে উঠল, “আপা, বেবির মাথায় হাত দিতে গেছি, আমার হাতের দিকে তাকিয়ে কেমন একটা করে উঠল, আর… আর ওই পেনসিলটা বালিশের তলা থেকে বার করে হাতে ফুটিয়ে দিল। খুব দর্দ হচ্ছে আপা।”

আবিদার হাতের দিকে তাকালাম। এতক্ষণ খেয়াল করিনি, ওর হাতের চেটো, আঙুল পুরোটাই মেহেন্দিতে লালচে খয়েরী হয়ে আছে। মিতুলের মুখটাকে জোর করে আমার শরীর থেকে আলাদা করলাম। মিতুল কাঁদল না, শুধু শক্ত হাতে পেনসিলটাকে ধরে রইল আর ওর নীচের ঠোঁটটাকে দাঁত দিয়ে এমন ভাবে শক্ত করে কামড়ে ধরল যে আমার মনে হল, এক্ষুণি রক্ত বেরিয়ে যাবে। বালিশের তলায় ও পেনসিল নিয়ে শোয় এতদিন খেয়াল করিনি। বালিশটা সরিয়ে দেখলাম, অন্য আর কিছু নেই।

চার

আজ ভোরবেলা অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম। আমার দোতলার বেডরুমটার লাগোয়া ব্যালকনির দরজাটা এমনিতে বন্ধই থাকে। ভারী পর্দা ঝুলিয়ে বাইরের আলো ঢোকা বন্ধ করেছে তমাল। চোখে আলো পড়লে নাকি ওর ঘুম আসে না। তমালের সঙ্গে সম্পর্কটা ঠিক এখনও স্বাভাবিক হয়নি আমার। হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে যদি কোনও মেয়েকে বলা হয়, এই নাও— এই পুরুষমানুষটি তোমার স্বামী, তাহলে তার যতটা অস্বস্তি হবে ঠিক ততটা না হলেও, এখনও বাধো বাধো ব্যাপারটা রয়ে গেছে। তমাল এখন না থাকায়, কদিন পর্দাগুলো ফাঁক করে রেখেছিলাম। কাল অনেক রাত জেগে বই পড়ার ফলে আমিও বেলা অবধি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে একটা টুং টাং শব্দ শুনলাম যেন। একবার মনে হল, আবিদা রান্নাঘরে চায়ের কাপ প্লেট সাজাচ্ছে। তারপরেই মনে হল, শব্দটা ঠিক কাপ প্লেটের টুং টাং শব্দের মত নয়। তার থেকেও অনেক মৃদু। বেশ কয়েক সেকেন্ডের অন্তরালে এক একবার বেজে উঠছে। প্রতিবার স্বপ্নের মধ্যে একটা শ্বাসরোধকারী ভয় চেপে ধরে আমায়। এতটাই যে আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও একশভাগ সজাগ হয়ে থাকি, অথচ নড়াচড়া করার ক্ষমতা সেভাবে থাকে না। বইতে পড়ে দেখেছি ব্রেন কনকাশন ইনজুরির পর হ্যালুসিনেট করাটা কমন ব্যাপার, তবে আমার যেন মনে হয় স্বপ্নগুলো দেখার সময় আমার প্যারালাইজড রুগীর মত দশা হয়। যে বুঝতে পারছে সব কিছু, কিন্তু কোনও অভিব্যক্তি দিতে পারছে না। এটাকে মেডিক্যালি কোন টার্ম দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় কিনা জানি না।

পর্দার জোড়ের মুখটা থেকে হাল্কা হাল্কা আলো আসছিল। সিলিংয়ের বন্ধ পাখাটা কটকট করে ঘুরে গেল একবার। আমার মনে হল, আমার শরীরটা ছেড়ে অনেক উঁচুতে হাওয়ায় ভাসছি আমি। বিছানায় আমার ঘুমন্ত শরীর, আমার দিকে পিছন করে শুয়ে থাকা কাঠ কাঠ শিশু শরীরের মিতুল, এমনকি খাটের পাশে টিপয়ের উপর রাখা জলের বোতলটাও পরিষ্কার দেখতে পেলাম। ব্যালকনির দরজাটা খুট করে খুলে গেল। আমার শরীরের দ্বৈত সত্ত্বাটিও যেন সঙ্গে সঙ্গে পর্দা সরিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। বারান্দায়, রাস্তায় তখন আকাশ থেকে মাটি অবধি কুয়াশার পুরু চাদর ঝুলিয়ে রেখেছে কেউ। কটা গাড়ি গেল, তাদের হেডলাইটগুলো জ্বলছিল। দু একটা সাইকেল ঘন্টি বাজিয়ে আমাদের নীলামহলের সামনে দিয়ে চলে গেল। একটা নীলচে বেগুনী রঙের পোষাক পরা একটি দীর্ঘাঙ্গী শরীর হেঁটে হেঁটে আমার বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে যেতে যেন চকিতে একবার আমার দোতলার ব্যালকনির দিকে তাকালো। আবছা মুখ, আবছা শরীর কিন্তু বড্ড ঝলমলে তার পোষাক। মেয়েটির মিলিয়ে যাওয়া শরীরটার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকলাম। ভোরবেলার হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় আমি ঠকঠক করে কাঁপছিলাম।

এই অনুভূতিটা অনেকক্ষণ রইল। ধীরে ধীরে আবার নিজের শরীরের সঙ্গে একাত্ম বোধ করছিলাম। কিন্তু চোখ খুলতে ভয় লাগছিল, যদি সুখানুভূতির রেশটা শেষ হয়ে যায়। একটা ভীষণ প্রিয় হারিয়ে যাওয়া গান অনেকদিন পর বাজতে বাজতে থেমে গেলে যেমন হয় ঠিক সেরকমই লাগছিল আমার।

পুরো ঘটনাটাই ভোরের মিঠে স্বপ্ন বলে চালিয়ে দিতাম যদি না দুপুরে বাইরের গেটটা খুলতেই একটা জিনিস চোখে পড়ত। একগুচ্ছ বেগুনী ফুল ছড়িয়ে রয়েছে গেটের একপাশে। মখমলের মত পাপড়িগুলোয় সূর্যের আলো পড়ে ঝিকমিক করছে। একেবারে সকালে স্বপ্নে দেখা অপরিচিতার পোশাকের মত। আবিদাকে ডেকে দেখালাম, ওকে স্বপ্নের কথাটা বললাম। ও অবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে দেখল। এই আদ্যন্ত নাগরিক পাড়াতেও এত শৌখিন ধরণের ফুল আগে কোথাও চোখে পড়েনি। আবিদার আপত্তি সত্ত্বেও ফুলগুলো তুলে এনে ঘরে সাজিয়েছি। আবিদার বক্তব্য ফুলগুলো ইবলিসানা, ওদের ভাষায় ভূতুড়ে। উফ! কতগুলো ফুল নিয়েও যে মানুষের কত সংস্কার থাকতে পারে!

তমালের ফিরতে এখনও চারদিন বাকি। প্রতিদিনই ফোনে কথা হচ্ছে, নিয়ম করে তিন চার বার। তমাল শুধু আমার সাথে নয়, আবিদার সঙ্গেও কথা বলে খোঁজখবর নেয়। ওর অনুপস্থিতিতে আমাকে আর মিতুলকে দেখে রাখার দায়িত্ব যে আবিদারই সে কথা মনে করিয়ে দেয়। এর মধ্যে যে আবিদা একদিন রাতে আমাদের একা রেখে বাড়ি চলে গিয়েছিল, তা আমি তমালকে বলিনি। মিতুল যে আবিদাকে ব্যথা দিয়েছে সেকথা আবিদা তমালকে জানায়নি দেখলাম। না হলে তমাল উদ্বিগ্ন হয়ে যেত ঠিক, সেটা আমি ওর গলার স্বরে ধরতে পারতাম। মিতুল বা আমার খাওয়াদাওয়া, যত্নআত্তি নিয়ে তমাল যতটা চিন্তিত, মিতুলের স্কুলে ভর্তির ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয়। মিতুলের অস্বাভাবিকত্ব নিয়ে আমাদের মধ্যে খুব কম কথা হয়, তমাল এড়িয়ে যেতে চায় ব্যাপারটাকে। অথচ মিতুলের একা একা গম্ভীরভাবে থাকা, ওর বয়সের সাথে বেমানান শান্তভাব, একটুও দুষ্টুমি না করা, নিশ্চুপ কান্না দেখলে আমার বুকের রক্ত জল হয়ে যায়। স্কুলে ভর্তি হলে, ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে মিশলে হয়তো এটা কেটে যেত। তমালের ধারণা, মিতুল আমার মতনই কল্পনাপ্রবণ, বড় হলে নিজে থেকে সমস্যাটা সেরে যাবে। কিন্তু আমি জানি, এটা সারার নয়। তমালকে সে কথা বোঝাতে পারছি না। মনটা খাপছাড়া চিন্তাভাবনা করছে। আর খাপছাড়া চিন্তা যেদিন বেশি করি, সেদিনই স্বপ্নে ওরা বড় বেশি ভয় দেখায় আমায়।

রাতের দিকে মিতুল একবার আইসক্রিম খেতে চাইল। বহুদিন পরে ও নিজে থেকে কিছু একটা খেতে চাইল। আবিদা রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত ছিল। নটা বেজে গিয়েছিল, তাও মিতুলকে নিয়ে শপিং কমপ্লেক্সটায় গেলাম। ভাগ্যক্রমে দোকানটা খোলাই ছিল। ওর প্রিয় ব্র্যান্ডের চকোলেট আইসক্রিম কিনে ফিরছি, রাস্তার মোড়ে থেকে হঠাৎ আরশিনের সাথে দেখা। সেদিন তাড়াহুড়োর মাথাতেও খেয়াল করেছিলাম আরশিন খুব সুন্দর। আজ দেখলাম, শুধু সুন্দর বললে কম বলা হবে। মায়াময় চেহারা, ওর উত্তরভারতীয় কাটা কাটা নাক চোখ মুখের সঙ্গে বাঙালী কমনীয়ত্ব জুড়লে যেমন দাঁড়াবে একদম তাই। তার উপর ওর গোলাপি মুক্তোর মত গায়ের রঙ, আর নীলাভ চোখের মণি। লক্ষ্ণৌকে তো বলেই সিটি অফ নবাবস, কবাবস, অ্যান্ড শবাবস। মেয়েটাকে আমার না জানি কেন ভীষণ ভালো লেগে গেল। আরশিনও দেখলাম চিনতে পেরেছে আমায়। মৃদু হেসে আমার দিকে এগিয়ে এল। মিতুল নতুন কাউকে দেখলে জড়োসড়ো হয়ে যায়। কিন্তু আরশিনকে দেখে সহজ ভাবেই থাকল। আরশিন হেসে বলল, “শরীর ঠিক আছে আপনার? সেদিন তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম! আপনার মেয়ে? বহত নুরানি চেহরা হ্যায়!” ওর কথার উত্তর না দিয়ে বললাম, “সেদিনের জন্য দুঃখিত আরশিন। আপনি কাছেই থাকেন?” ও হেসে বলল, “আমাকে আপনি না বললেও চলবে। মনে হয় আমি আপনার থেকে ছোটই হব। ”

জিজ্ঞাসা করলাম, “কাছেই থাকো?” উত্তরে ও কাছেই একটা সরু গলির দিকে দেখিয়ে বলল, “হ্যাঁ, ওই গলিটার একেবারে শেষের বাড়িটা। আসবে একদিন, আমার বাড়ির নাম রুহানিয়ত। মস্ত বড় পাঁচিল, দেখলেই চিনতে পারবে।“

ভদ্রতা করে বললাম, “যাব।”

আরশিন হেসে বলল, “আজ তো অনেক রাত হয়ে গেছে। নাহয় আজই নিয়ে যেতাম। কিন্তু তাও আমার সঙ্গে চল, তোমাকে দেখিয়ে দিই। অবশ্যই আসবে কিন্তু।” ওর আগ্রহটা খুব ছোঁয়াচে ছিল, না করতে পারলাম না। তমাল জানলে রাগ করবে জানি, তবুও আমি আর মিতুল ওর সাথে সাথে হাঁটতে শুরু করলাম। ইট বাঁধানো ছোট গলিপথটায় হ্যালোজেন জ্বলে নরম সোনালি আলোয় মুড়ে দিয়েছিল চারধার। বড় বড় ল্যাম্পপোস্টগুলোর মাথায় লাগানো হ্যালোজেন বাল্বের চারপাশে জমাট ধোঁয়াশা কুণ্ডলী পাকাচ্ছিল। ইঁটের উপর আরশিনের নাগরাইয়ে শব্দ হচ্ছিল, টক… টক… টক । চার পাঁচটা মোড় ঘুরতেই বাড়িটার সামনে এসে পড়লাম। এ তো বাড়ি নয়, প্রাসাদ! আরশিন দরজার কাছে গিয়ে থামল, তার পর মিতুলের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “এই আমার বাড়ি শাহজাদী! পছন্দ হয়েছে?”

মিতুল অবাক হয়ে বিরাটাকার বাড়িটার দিকে তাকাল। আরশিন আবার বলল, “এই বাড়িটায় তোমার মত শাহজাদীরা থাকতে ভালোবাসে। দেখেছো তো কেমন মহলের মত? পরের দিন আসলে দেখবে ভিতরে অনেক জাদু দরজা আছে, জাদুই ঝরণা আছে, পরী আছে। আসবে তো মায়ের সাথে?”

মিতুল জিজ্ঞাসা করল, “পরী মানে কি অ্যাঞ্জেল মা?” বললাম, “হ্যাঁ।”

মিতুল একটু চুপ করে থেকে বলল, “আমার কাছেও একটা জাদু দরজা আছে। মায়ের কাছেও আছে। কিন্তু অ্যাঞ্জেল নেই, ডেমন আছে।” মিতুলের কথা শুনে অস্বস্তি বোধ করলাম। আরশিন কিছু বুঝল কিনা জানি না, হেসে মিতুলের গাল টিপে বিদায় নিল। পুরোনো মজবুত গুল বসানো দরজাটা ক্যাঁচ আওয়াজ করে খুলে যেতেই ভেতরবাড়িটা চোখের সামনে ফুটে উঠল। আরশিন ভেতরে ঢুকে গেল, ভেতরে ঢোকার আগে আবার বলে গেল, “আসতেই হবে কিন্তু।” ভেতর থেকে ক্ষীণ আলোর রেখা আসছিল। লোডশেডিং নাকি! কিন্তু রাস্তায় তো দিব্যি আলো জ্বলছে!

মিতুলকে নিয়ে বাড়ি চলে এলাম। আসার সময় জিজ্ঞাসা করলাম, “দরজা! ডেমন? মিতুল তুমি কি ভয়ের স্বপ্ন দেখ?” উত্তর না দিয়ে ও চুপচাপ হাঁটছিল। বাড়ির প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে ওর হাতের মুঠোয় আলতো চাপ দিয়ে আাবার প্রশ্ন করলাম, “তুমি স্বপ্নে ডেমন দেখ?” ও শান্ত স্বরে উত্তর দিল, “না, আমি সত্যি সত্যি ডেমন দেখি মা।” আর কোনও প্রশ্ন করার অবকাশ পেলাম না। ও দৌড়ে বাড়ি ঢুকে গেল।

রাতে স্বপ্ন দেখলাম। আমার বেডরুমের মেঝে খুঁড়ে ওরা উঠে আসছে। প্রথমে মেঝেতে একটা হাল্কা চিড় ধরল। তারপর ফাটলটা বাড়তে লাগল। প্রথমে মুখ বাড়াল একটা গোদা, মোটা শরীরটাকে ঠেলে ঠুলে ফাটলটা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। কালো কাদা মাখা গা, ড্রেন থেকে সবে উঠে এসেছে ও। চোখদুটো আমার লকেটটার মত চকচক করছিল। ওর পিছন পিছন এলো সারি সারি ওরই প্রজাতি। ওদের সরু লেজগুলো ডানদিক বাঁদিক নাড়িয়ে ওরা ঘরের মেঝেতে মুহূর্তে ছড়িয়ে গেল। বিছানার চাদরের নীচ থেকে ওদের কিচ কিচ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। একটা লাফ দিয়ে ওদের মধ্যে একটা মিতুলের পায়ের উপর চেপে বসল। আমি জানি, এর পর কী হতে চলেছে। মেঠো ইঁদুরটা ওর ধারালো দাঁত বসিয়ে দেবে মিতুলের নরম চামড়ায়। ওর সূঁচালো দাঁত যেখানে বসবে, সেখানে একটা ফুটো তৈরী হবে। আর সেই ফুটো দিয়ে ভলকে ভলকে কাঁচা রক্ত বেরিয়ে আসবে। সেই রক্তের গন্ধে বাকিরাও একে একে… আস্তে আস্তে বিছানায় শুয়ে থাকা দুটো মনুষ্য শরীর ঢেকে ফেলবে কালো রোঁয়া ওঠা অসংখ্য চারপেয়ের দল। আমি মড়ার মত শুয়ে শুয়ে শুধু সেই পরিণতি দেখব, আমার কিচ্ছু করার থাকবে না। চিৎকার করে বাস্তবে ফিরে আসার মত ক্ষমতাটুকুও নয়। মনে মনে গুনলাম, দশ… নয়… আট… সাত… ছয়… পাঁচ… আর কত সেকেন্ড বাকি স্বপ্নটা শেষ হতে? টাইম আউট হবে আর… আর মিতুল আর আমি খাদ্য হয়ে যাব। মিতুলের মিষ্টি মুখটায়, ওর গালের টোলটায় ইঁদুরগুলো খুবলে খুবলে ভাগ বসাবে। আর আমি, চোখ মেলে দেখব। এতটাই কাছ থেকে দেখব, একবারের জন্যও চোখের পলক পড়বে না আমার। ঈশ্বরের নাম স্মরণ করতে পারতাম. কিন্তু ব্যালকনির দরজাটা খুট করে খোলার আওয়াজ পেলাম। কে যেন ব্যালকনি থেকে ঢুকেছে ঘরে। তার পায়ের পাতার খসখস শব্দ শুনতে পাচ্ছি অথচ তাকে দেখতে পাচ্ছি না। আবার সেই টুংটাং শব্দ! ইঁদুরগুলো ছোটাছুটি বন্ধ করে হঠাৎ স্থির হয়ে গেছে। ওরাও তার পায়ের শব্দ শুনেছে, মাথা উঁচু করে নাক উঁচিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে আগন্তুকের স্বরূপ। কয়েকটা যেন এক পা এক পা করে গর্তে ঢোকার চেষ্টা করছে। একটা মিষ্টি গন্ধ কোথা থেকে হাওয়ায় উড়ে এল। গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে গন্ধটাকে বুকের মধ্যে ভরলাম।

আমার বুকের ধড়াস ধড়াস শব্দটাকে জোর করে শাসন করলাম। ধমনী শিরায় দৌড়াদৌড়ি করা উদ্বেগগুলো নিস্তেজ হচ্ছিল আস্তে আস্তে। চোখ মেলে দেখলাম বিছানায় শুয়ে আছি। মেঝেতে কোনও ফাটল নেই। কিছুক্ষণ আগের অন্ধকার স্বপ্নটা মিষ্টি গন্ধটার সঙ্গে ভেসে কোথায় যেন চলে গেছে! সিলিং ফ্যানটা আবার কটকট শব্দে ঘুরে গেল। যিনি এসেছিলেন, তিনি কি চলে গেলেন! একই ভাবে বারবার কি আসবেন? চোখটা বন্ধ করলাম, বাঁ চোখের কোল থেকে হুড়হুড় করে জল নেমে এল।

পাঁচ

সামনে তাকালেই ঘন গাছগাছালির মধ্যে মস্ত এক বাড়ি। বিলিতি ধাঁচের গড়ন। গথিক থাম, খিলান আর ভিক্টোরিয়ান আর্চে সজ্জিত সার সার জানালা। দোতলায় চওড়া ঢাকা বারান্দা। বাড়ির বাইরে দিয়ে সিঁড়িটা উপরে উঠে গেছে। আলোর ডোম বসানো গেটে, বাগানে, সদরে, সর্বত্র। বাইরে বহু পুরোনো মডেলের ওয়েলার গাড়ি রাখা। একেই বোধ হয় এখানকার ভাষায় খানদানি রইস বলে। আরশিনের বাড়িতে মিতুলের জন্যই আসা। এ কদিন বার বার বলেছে, অ্যাঞ্জেল দেখতে যাবে। আমি নানাভাবে ব্যাপারটা এড়ানোর চেষ্টা করলেও সে ভোলেনি। অতএব বিকেলবেলা হাঁটতে বেরিয়ে ঠিক করলাম আরশিনের বাড়ি যাব। বাড়িটার লোকেশন মোটামুটি আন্দাজ ছিল, তাছাড়া বিশাল পাঁচিলের ব্যাপারটা তো খেয়াল ছিলই। পাঁচিলের গায়ে উর্দু ক্যালিগ্রাফিতে ইংরাজী হরফে লেখা ‘রুহানিয়ত’। গেটটা খোলাই ছিল, আমি ঠেলতেই হাট হয়ে খুলে গেল। একটু অদ্ভুত লাগল, এত বড় বাড়িতে গেটে কোনও সিকিউরিটি নেই! নীচতলার ঘরগুলোয় কারা বাস করে কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। জানালাগুলোয় খড়খড়ি ফেলা। মৃদু আলো জ্বলছে খড়খড়ির জানালার ফাঁক দিয়ে। একটু হকচকিয়ে কী করব ভাবছি ঠিক তখনই আরশিনের গলার আওয়াজ পেলাম উপর থেকে। দোতলার বারান্দা থেকে আমাদের দেখতে পেয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসছে ও। একটা অদ্ভুত সুন্দর সাদা রঙের লম্বা কুর্তি পড়েছে আরশিন। মিতুল একবার তাকিয়েই বলল, “অ্যাঞ্জেল।”

আরশিনের বাড়ির ড্রয়িং রুমটা দেখলে কোনও বিদেশী ভিন্টেজ সিনেমার সেট থেকে তুলে আনা মনে হয়। ঘরটা পিছনের বাগানের দিকে মুখ করা। দরজার মত সাইজের জানালাগুলোয় ভারী ভারী সিল্কের পর্দা ঝুলছে। আরশিন হাত দিয়ে পর্দাগুলো আরও খানিকটা সরিয়ে দিল। বাইরের বাগান থেকে আলোর হাল্কা রেখা ঘরে ঢুকে ঘরটাকে একটু উজ্জ্বল করে তুলল। দেওয়ালগুলোতে অসংখ্য অয়েল পেইন্ট, বেলজিয়ান গ্লাসের আয়না লাগানো। সিলিং থেকে ঝুলন্ত ঝাড়বাতিটা দেখে মনে হল রীতিমত পরিচর্যা করা হয়। মিতুল এই পরিবেশে একেবারে চমৎকৃত হয়ে গেছে। আমাদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে আরশিন উঠল। আমাকে বলল, “মীনাক্ষি, একটু বসবে? আমি একটু ভেতর থেকে আসি।” মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। ড্রইং রুমের চারধারে চোখ বোলাতে বোলাতে একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল। লং সোলজর কোট, নি ব্রিচেস, সিল্কের স্টকিংস পরা নীলচক্ষু সুদর্শন পুরুষের ছবি। গর্বিত, উজ্জ্বল দৃষ্টি। বহু পুরোনো তৈলচিত্র, পাকা হাতের কাজ। শিল্পীর নামটা ঝাপসা হয়ে গেছে। সারা ঘরে ওই একটিই পোর্ট্রেট, বাকি প্রাকৃতিক নৈসর্গের ছবি।

পেছন থেকে মিতুল আর আরশিনের গলার আওয়াজ পেলাম। বিরাট ট্রেতে করে খাবার নিয়ে ঢুকেছে বেয়ারা। রূপোর পেয়ালা পিরিচে আলো পড়ে চিকচিক করছে। আরশিন বলল, “খেয়ে নাও একটু মীনাক্ষি।”

খাবারদাবারের এলাহি আয়োজন। এক মাংসের পদই কত রকমের। এত ধরণের কাবাব, তার কোনওটার না নাম জানি, না আগে কোনওদিন খেয়েছি। বিলিতি কায়দাদুরস্ত ন্যাপকিন হোল্ডার থেকে শুরু করে ঝকঝকে কাটলারি। মনে হল, ফাইভ স্টারে বসে স্ন্যাকস খাচ্ছি। নানা কথার মধ্যে মাঝে মাঝেই অশোভনীয় কৌতূহল খোঁচা মারছিল, শেষে প্রশ্নটা করেই ফেললাম, “তুমি এত বড় বাড়িতে একা থাকো?”

মহার্ঘ্য চেয়ারের পাশে মাটির তৈরী একটি সুদৃশ্য হুঁকো আর একখানি গড়গড়ার নল শোভা পাচ্ছিল। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে আরশিন ওটা ফুরুক ফুরুক করে টানছিল। ওটায় নাকি এক বিশেষ ধরণের তামাক আছে, খানিরা আর খুশবু মেশানো। আমার প্রশ্ন শুনে গড়গড়ার নল টানতে টানতে আরশিন হাসল, বলল, “না, আমার বাড়ির সবাই অনেক দূরে থাকেন, মাঝেমাঝে আসেন।”

“তুমি যাও না?”

“লখনউ ছেড়ে বেশিদিন কোথাও ভালো লাগে না। আমার কথা ছাড়ো, তুমি বলো তো তোমার সেদিন কী হয়েছিল? কোনও কারণে মাথা ঘুরে গিয়েছিল?”

ভদ্রতার খাতিরে হ্যাঁ বললাম। আরশিন এদিক ওদিকের নানা কথা জিজ্ঞাসা করল, বাড়ি কোথায়, কে কে আছে বাড়িতে, সময় কী করে কাটাই। নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হল, শেষে দেওয়ালের পোর্ট্রেটের দিকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “উনি কে? তোমার পরিবারের কেউ?”

প্রশ্নটা করার সঙ্গে সঙ্গে জানলা নিয়ে একঝাঁক ঠাণ্ডা হাওয়া এসে আমার কানের লতিটাকে হিমশীতল করে দিল। বরফের সূঁচের মত কিছু যেন চামড়ায় ফুটছিল আমার। আরশিন চেয়ার থেকে উঠে পোর্ট্রেটটার কাছে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল।

বলল, “হ্যাঁ, আমার পরিবারেরই বলতে পার। এক হতভাগ্য মানুষ। আর এক হতভাগিনীর প্রেমিক এবং স্বামী।” আরশিনের উত্তর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কারেন্ট চলে গেল। মনে হল, এক ফুঁ দিয়ে জন্মদিনের বাতি নেভার মত করেই কারেন্ট উবে গেল। ফস করে দেশলাই জ্বালিয়ে আরশিন পোর্ট্রেটটার সামনে একটা মোমবাতি জ্বালালো, সেই আলোয় দেখলাম নীলচক্ষু ইংরেজ ওর দিকে তাকিয়ে যেন হেসে উঠল একবার।

বাতির শিখাটা বারবার কাঁপছিল, ঘরের মধ্যে বিশালকায় ফার্নিচারগুলোর ছায়া জল্লাদের মত চোখের সামনে ভিড় করছিল। মিতুল এতক্ষণ ঘোরাঘুরি করছিল, কারেন্ট চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর ছোট্ট বুক থেকে বেরোনো নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। একটু দূরে ছবির সামনে মোমবাতি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আরশিন, মস্ত বড় বড় দেরাজ, জানালা থেকে ঝুলন্ত ভারী পর্দা, মনে হচ্ছিল সমস্তটাই যেন কোনও নিখুঁত একটা ছবির অংশ। অস্বস্তি কাটানোর জন্য বললাম, “এই বাড়িটার মতনই পুরোনো কোনও গল্প মনে হচ্ছে।”

আমার কথায় আরশিন পিছন ফিরল। মনে হল মন্ত্রবলে স্থির হয়ে যাওয়া এক সময়কাল থেকে আবার জেগে ও ফিরে এসেছে বাস্তবে। মোমবাতিটাকে সামনের গোল টেবিলটার উপর রেখে ও বলল, “হ্যাঁ, গল্পই! সত্যি গল্প, অতীতের সত্যি কখনও কখনও বর্তমানের থেকেও বেশি রোমাঞ্চকর হয় মীনাক্ষি। এতটাই যে বর্তমানকে অনন্তকাল তার দায়ভার বয়ে নিয়ে চলতে হয়।”

“কীরকম?” জিজ্ঞাসা করলাম।

আরশিন খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। মিতুল আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। মিতুলের দিকে তাকিয়ে আরশিনের মুখটায় নরম একটা হাসি ফুটল। আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। প্রথমদিনই অস্বাভাবিক কৌতূহল দেখিয়ে নাড়িনক্ষত্র জিজ্ঞাসা করে ফেলেছি, সেটা স্বাভাবিক শালীনতার গন্ডি পেরিয়েছে। তাও মুখ ফুটে বললাম, “খুব ব্যক্তিগত বিষয় হয়তো তোমার পরিবারের, থাক না হয় আরশিন।”

আরশিন শব্দ করে হাসল। বলল, “মেজর জেনারেল ক্লড মার্টিনের নাম শুনেছ?”

মনে পড়ল লখনউয়ের উপর লেখা বইটায় এমন একটা নাম পেয়েছিলাম বটে। নামটা মনে ছিল অন্য এক কারণে। বললাম, “খুব সামান্যই জানি। জাতিতে ফ্রেঞ্চ ছিলেন, নবাব সাদাত আলির সাথে ঘনিষ্ঠতার কারণে সম্ভবতঃ অনেক টাকা কামিয়েছিলেন ভদ্রলোক। তোমাদের লখনউয়ের অনেক ইমারতের নক্সাটক্সা বানিয়েছিলেন যদ্দূর মনে পড়ছে।”

“যেরকম সেরকম ইমারত নয় মীনাক্ষি। ফারহাদ বক্স, হায়াত বক্স, কনস্ট্যানশিয়া…কী না বানিয়েছে লোকটা। কিন্তু, ও তো গেল ওর বাইরের পরিচয়, লোকটার নিজি জিন্দেগি কেমন ছিল জানো?”

“এক মুসলিম মহিলার সাথে থাকতেন, কী যেন বেশ নাম…?”

“বোলানের কথা বলছ?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, বোলান… আর অনেক অনাথ শিশুদের দেখাশোনা করার জন্য নিজের বাড়িতে রাখতেন।”

আরশিন মুখে হাত দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। ওর হাসির দমকে মোমবাতিটা আবার একবার কেঁপে উঠল। হাসতে হাসতে ওর ফ্যাকাশে ফরসা মুখটা গোলাপি হয়ে যাচ্ছিল। হাসতে হাসতেই বলল, “দেখাশুনা! বহত মজাদার কথা বললে মীনাক্ষি।”

সাপের মত হিসহিসিয়ে আরশিন বলে উঠল, “বলাৎকার বোঝো? ধরো বারো-তেরো বছরের কোনও মেয়ে, তার শরীর সবে তখন জেগে উঠতে শুরু করেছে, মনে মনে সে শুধু ইশক মোহব্বতের কথা কল্পনা করতে পারে। মনে মনে সে শুধু ভাবতে পারে যে হায়! নাজানি কত নাজুক হবে সেই প্রথম স্পর্শের অনুভূতি! তারপর একদিন হঠাৎ এতদিন সে যাকে অব্বাজানের জায়গায় দেখেছে, সে একদিন রাতে জোর করে তার পাজামার দড়ি খুলে নিজের নাপাক পৌরুষ ঢুকিয়ে দিয়েছে তার শরীরে… রক্তে ভেসে যেতে যেতে সে ভাবছে… ইয়া আল্লা… পেয়ার মহব্বত তাহলে এরকমই হয়! ভালোবেসে ছুঁলে শরীরও নাপাক হয়, মনও নাপাক হয়! আল্লার রহমত চাইতে চাইতে সে বিছানায় রোজ চোখের জল ফেলছে… অ্যায়সা পেয়ার হমে অওর না দে খুদা!”

“বারো তের বছরের বাচ্চাদের! মানে যাদের ঘরে পুষতেন তাদেরই…!”

“তাদেরই বিছানায় তুলতেন। পুরুষ, নারী কিছু ভেদ ছিল না। আর আল্লা রসুলেরও কেমন বিচার দেখো, এমন আদমিকে সব দিলেন, কিন্তু রক্তে পৌরুষের আসল বীজ দিলেন না। জনাব ক্লড মার্টিনের বাচ্চা পয়দা করার ক্ষমতা ছিল না, ছিল শুধু কোনও বাধা ছাড়াই এতিম বাচ্চাগুলোর শরীরকে ছিঁড়ে খাওয়ার ক্ষমতা।”

“এই বাচ্চাগুলোকে কোথায় পেতেন ক্লড মার্টিন?”

“অংরেজ অফসরদের সাথে মুসলিম অওরতদের নাজায়েস সম্বন্ধের ফসল বলতে পারো…না তো এদের মায়ে নিত… না বাপে দেখভাল করত… এদেরকেই তুলে এনে…”

“ওই ছবিটা ক্লড মার্টিনের?”

“না, ওটা এই গল্পের নায়কের।”

“ওহ!”

“এই গল্পের নায়ক নায়িকা লেফটেন্যান্ট হিউ রিচার্ডস আর বেগম মেরীজান।”

“মেরীজান? ভারতীয়? ”

“হ্যাঁ, আধা ফিরঙ্গি, আধা মুসলিম। চোখের রঙ নীল ছিল ফিরিঙ্গিদের মত, তাই ওই নামেই সবাই তাকে ডাকত। আরও একটা নাম ছিল অবশ্য, কিন্তু মেরীজান নামেই পরিচয় পেলেন বেশি।”

“পরিচয় পেলেন মানে?”

“আওয়াধের পাঁচবা নবাবে-ওয়াজির সাদাত আলি খানের দরবারে ওর লেখার অনেক কদরদান ছিল, লখনউ শহরের প্রথম মহিলা কবি বলতে পারো।”

“কিন্তু মেরীজান আর হিউ রিচার্ডসের গল্পের সঙ্গে ক্লড মার্টিনের সম্পর্ক কী?”

“আছে, খুব গহরা সম্পর্ক আছে মীনাক্ষি। বলা যায়, জনাব ক্লড মার্টিন না থাকলে এই গল্পটাই জন্মাত না। মেরীজান ওনারই দেখভালে বড় হয়েছিলেন যে!”

মোমবাতিটা গলতে গলতে ছোট হয়ে এসেছিল। সামনের সোফায় বসে থাকা আরশিনকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম না। কোথা থেকে হাওয়ায় একটা টুংটাং আওয়াজ হল, ঝাড়বাতির কাচের ঝালরগুলো একসঙ্গে নড়ে উঠল বুঝি! অজানা কারণে আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। বাড়ি ফেরার সময় হয়ে এসেছে। তমালও ওদিকে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে হয়তো। গল্পটা অন্যদিন শুনব বলে আরশিনের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

মিতুল আরও খানিকক্ষণ থাকবে বলে বায়না করছিল, আমি একপ্রকার জোর করেই ওকে নিয়ে উঠে এলাম। দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় এক প্রান্তের রাউন্ড একটা টেবিলে চোখ আটকে গেল। মোমাবাতির হাল্কা আলোতেও মীনা করা ফুলদানিতে একগুচ্ছ নীলচে বেগুনী ফুল দেখতে পাচ্ছিলাম। অবাক হয়ে গেলাম, এই ফুলগুলোই সেদিন আমার বাড়ির বাইরে ছড়িয়ে ছিল। মীনাক্ষিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী এই ফুলগুলো? আগে দেখিনি কখনও!”

আরশিন বলল, “হ্যাঁ, লখনউতে এই ফুল আর পাবে না। তমাম হিন্দুস্তানেও খুব কম জায়গায় এই ফুল হয়। এই বাড়িতে এই ফুল হিউ রিচার্ডসের লাগানো।”

“কী নাম?”

“অ্যাকোনিটাম ন্যাপেলাস।”

“আমায় কটা দেবে? লাগাব!”

আরশিন হাসল। বলল, “ভীষণ জংলি গাছ, সারা বাড়িতে ছড়িয়ে যাবে, তখন বিরক্ত লাগবে দেখো।”

“তাও প্লিজ দিও।”

আরশিন আবার শব্দ করে হাসল। বলল, “সঠিক সময়ে পাবে মীনাক্ষি, প্রচুর পাবে, বেশুমার পাবে।” মেয়েটার গলার স্বরটা অদ্ভুত রিনরিনে, হঠাৎ শুনলে মনে হয় অল্পস্রোতা কোনও ঝরণা গুহার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে। ওর শরীর থেকে সুন্দর গন্ধ আসে, কাছে দাঁড়ালে সেটা বোঝা যায়। গন্ধটা মিষ্টি, আতরের। এত সুন্দর মেয়ের এমন নিঃসঙ্গ জীবন কেন! ওর গায়ের রঙ, ওর চোখের নীল মণি জানান দিয়ে যায় ওর শরীরে বিদেশী রক্ত আছে। মেরীজানের গল্পটা যে ওর নিজের পরিবারেরই গল্প তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু দুশ বছর আগের ঘটনায় দায়, এতদিন পরেও কেন কেউ বয়ে বেড়াবে! নানা কথা ভাবতে ভাবতে আরশিনকে বিদায় দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। অনেকটাই দেরী হয়ে গেছে। সাড়ে ছটা নাগাদ বেরিয়েছিলাম, এখন বাজে প্রায় নটা। নির্জন, সম্পূর্ণ অন্ধকার রাস্তায় মাঝে মাঝে দু’ একটা হ্যালোজেনের আলো সোনালী বৃত্ত তৈরী করেছে। সামনের বাড়িটার গ্যারেজ থেকে একটা লোক বাইক বার করছিল, আমাদের আরশিনের বাড়ি থেকে বেরোতে দেখে বারবার ভুরু কুঁচকে তাকাতে লাগল। তাড়াতাড়ি বাড়ির পথে হাঁটা লাগালাম।

ছয়

তমাল ফিরে এসেছে গতকাল। আজ ছুটি ছিল, কাল থেকে আবার অফিস। আমাদের নিস্তরঙ্গ জীবন আবার উদ্দাম হয়ে উঠেছে। তমাল আসলে সাংসারিক কাজকর্মের বাইরে অন্য কিছু চিন্তা করার সময় পাই না, কিন্তু এবার আরশিনের গল্পটা শোনা হয়নি বলে মন টানছিল ওর দিকে। এদিকে আবিদার মেয়ের বিয়ে নিয়ে বেজায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। বেচারী আজ কাঁদছিল। কাল রাতে বাড়ি গিয়েছিল, তখন জানতে পেরেছে ছেলেপক্ষ তাদের টাকাপয়সার দাবি অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন বিয়ের জোগাড় প্রায় শেষ, এই মুহূর্তে অতিরিক্ত টাকা কোথা থেকে আসবে সেটা বুঝতে পারছে না। আমাদের কাছে সাহায্য চাইত, কিন্তু মাত্র এক মাসের পুরোনো কাজের লোককে আমরা বিশ্বাস করে টাকা দেব না— এ হয়তো ও একপ্রকার জানে। তাই সাহায্য চায়নি। তবে অন্যমনস্ক হয়ে আছে ভীষণ। মিতুল ওর কাছে সেদিনের পর থেকে একেবারেই যেতে চায় না। মিতুলকেও আবিদা যেন একটু ভয় পায়।

দুপুরবেলা ইজিচেয়ারটায় বসে বই পড়ছিলাম। ওপরের বেডরুমে মিতুল ওর বাবার কাছে ঘুমাচ্ছিল। আমার বইটার নাম, দ্য মাইন্ড উইদিন। ম্যাথিউ গডম্যানের লেখা। ভীষণ প্রাঞ্জল ভাষা, আর জীবনের বিভিন্ন স্তর থেকে উঠে আসা মানুষের সাইকিক কেস স্টাডি। আমি এখনও পর্যন্ত আমার বা মিতুলের মত কোনও কেস স্টাডি পাইনি। বইটা অবশ্য বেশ মোটা, সাড়ে চারশ পাতার। পড়া হয়েছে মাত্র দেড়শ পাতা। পড়তে পড়তে কখন চোখ লেগে গেছে, ঘুম ভাঙল আবিদার ডাকে। ওর চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। দরদর করে ঘামছে। প্রশ্ন করলাম, “কী হয়েছে?” বলল, “আপা মিতুল নেই ঘরে। আমি আর ভাইসাব একতলা, দোতলার সবকটা ঘর খুঁজলাম কিন্তু কোথাও নেই। কী হবে আপা?” আবিদা হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। আমার বুকটায় একটা গরম লোহার শিক বিঁধিয়ে দিল কেউ। দুপুরে খাওয়ার সময়ে অদ্ভুত চুপচাপ ছিল। ওর সেই পুরোনো জামাকাপড়ের ব্যাগটা বগলে জাপটে ধরে চুপ করে বসে ছিল। অনেক সাধ্যসাধনা করে একটু খাওয়াতে পেরেছিলাম। ব্যাগটা কাছে রাখা মানেই মিতুলের শরীর খারাপ।

ইজিচেয়ার থেকে লাফ দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ধড়ফড় করে দোতলায় উঠতে যেটুকু সময় লাগে সেইটুকু সময়ের মধ্যে আমার মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেল যে মিতুল মারা গেছে। ওর শরীরটা কোথাও একটা রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে। কোথায় আঘাত পেয়ে মরল মিতুল! মাথায়? নিজেই নিজের সাংঘাতিক নেগেটিভ এই চিন্তাটায় ঘেন্না পাচ্ছিলাম।

আবিদা উদভ্রান্তের মত ছোটাছুটি করছিল। তমাল মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে ছিল। হঠাৎ চিলেকোঠার ঘর থেকে কাঠের দরজার পাল্লাটা নিজে নিজেই খুলে গেল। তমাল অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকাল।

আবিদা দৌড়ে উপরে উঠে গেল। মানে, ও আশা রাখে মিতুলকে পাওয়া যাবে। আমার পা দুটো সিঁড়িতেই আটকে গিয়েছিল। বার বার মনে হচ্ছিল, এগোব না। ছাদ থেকে আবিদার চিৎকার শুনলাম, “আপাআআআ।”

শুনতে পেলাম ও ডাকছে আমায়। একবার দুবার নয়, কতবার যে ডাকল! দম বন্ধ করে দেওয়া চিন্তাটা মাথায় নিয়ে আমি চিৎকার করে বললাম, “নীচে নামিও না ওকে আবিদা। আমি দেখতে চাই না।”

আবিদা চিৎকার করল, “আপা, মিতুল বেবি ওপরে ট্যাঙ্কিতে… আসুন তাড়াতাড়ি।”

লক্ষ্ণৌর এই বাড়িটার ছাদে দুটো রিজার্ভয়ার। একটা বড়, সেটার নাগাল মিতুল পায় না। আরেকটা ছোট, চার ফুট হাইটের। জলের আকালের কথা ভেবে জল জমিয়ে রাখার জন্য তৈরী। দেখতে অবিকল আমাদের বেণীনন্দন স্ট্রিটের বাড়ির চৌবাচ্চার মত। মিতুল ওটায় নেমে গিয়েছিল। জলের মধ্যে শ্বাস নিতে না পেরে হাঁকপাক করছিল। আবিদা ওকে জল থেকে তুলে বাইরে এনেছে, আর খুব বকছে। মিতুলের কোনও বিকার নেই। ওর চুলের গুছিগুলো তলার দিকে ভিজে গেছে, আর জামা থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। মিতুলের ঠান্ডা লাগছিল। মুখ ফ্যাকাশে, ঠোঁট সাদা। মিতুলকে ধরে বুকের মধ্যে জাপটালাম। হৃদপিন্ডের শব্দ, ওর শরীরে বইতে থাকা রক্তেরা আমায় আশ্বস্ত করল মিতুল আছে… ও যায়নি। কোলের থেকে মুখ তুলে মিতুল আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “জলের তলায় গেলে ওই গানটা আবার শুনতে পাব মা। সেই যে সেই গানটা… তুমি, আমি… ”

মিতুলকে কথা শেষ করতে না দিয়ে তমাল ওর মুখটাকে পেটের কাছে চেপে ধরল। মিতুল ওর বাবার শরীরে লেপটে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল। তমালের সঙ্গে ভীষণ ঝগড়াঝাটি করলাম। এখনও কি ও বুঝতে পারছে না যে মিতুলকে ডাক্তার দেখানোর দরকার? তমাল রাগারাগি করল না, শুধু আমার কথা চুপ করে শুনতে শুনতে একটার পর একটা সিগারেট ধরাল। ওর চোয়াল শক্ত হচ্ছিল, ঠোঁট সরু। বুঝতে পারছিলাম, ভেতরের চাপা টেনশন প্রকাশ করতে পারছে না। আমি বেশিক্ষণ চিৎকার করতে পারি না, করলেই মাথায় ব্যথা হয়। আমার হাতটা চেপে ধরে তমাল সোফায় বসাল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমার অস্বস্তি হচ্ছিল, অজানা আশঙ্কা হচ্ছিল মনে।

হাতটাকে শক্ত করে চেপে রেখেই তমাল বলল, “মিনু! সত্যিটা চেপে রেখেছিলাম এতদিন, কিন্তু আজ আর পারছি না। সিঁড়ি থেকে কেন পড়ে গিয়েছিলে জানো?”

“কেন?”

“মিতুলকে সেদিন খুব বকেছিলে! ও ছুটে তোমার হাত ছাড়িয়ে দোতলা থেকে একতলায় পালাচ্ছিল। ওর পেছনে ছুটতে গিয়ে পা স্লিপ করে তুমি…”

“বকেছিলাম! কত বকেছিলাম যে ও… এতদিন বলোনি কেন?”

“তোমাকে ওই ভাবে রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে থাকতে দেখার পর থেকে ও অমন বদলে গেছে… মানে ও ঠিক স্বাভাবিক নয়। এই নিয়ে আলোচনা করতে চাইনি, বেচারি এমনিতেই শক পেয়েছে। তুমি একটু সময় দাও ওকে, তবে পুরোনো কথা জিজ্ঞাসা কোরো না। আর আজকের ঘটনা নিয়েও নয়, ট্রমার এপিসোডগুলো ওর ভুলে যাওয়ার দরকার।”

“তমাল! ও কি ভাবে ও আমার অ্যাক্সিডেন্টের জন্য দায়ী?”

তমাল কোনও উত্তর দিল না। আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নামছিল। আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “জলের নীচে ও কী ভেবে গেল তমাল?”

নিঃশ্বাস চেপে ধরে চোয়াল শক্ত করে ও উত্তর দিল, “জানি না।”

মিতুল ঘুমিয়ে পড়েছিল, ওর ক্লান্ত অবসন্ন মুখটা দেখে বুকটা যন্ত্রণায় ভরে গেল। না জানি কত অপরাধবোধে ভুগেছে আমার আত্মজা। জল, চৌবাচ্চা, জলের তলায় শ্বাসরোধ করে বসে থাকা… মৃত্যু নিয়ে এই খেলাগুলো কেন খেলছে ও! তমাল যাই বলুক, মিতুলের মেডিক্যাল হেল্প লাগবে। ঠিক করলাম লখনউ শহরের কোনও কাউন্সেলরের সঙ্গে যোগাযোগ করব। সারা দিন গুমরিয়ে গুমরিয়ে থেকে বিকেলের দিকে মিতুলের মুডটা ঠিক হল। বললাম, “অ্যাঞ্জেলের কাছে নিয়ে যাব।” তমালকেও আরশিনের অসম্পূর্ণ গল্পটা বলেছিলাম। হাসতে হাসতে বলল, “যাক, বেশ এক নবাবীচালের শাহজাদী বন্ধু জুটিয়েছ তাহলে!” ওকে বললাম, “ফিরতে দেরী হবে।”

আরশিনের বাড়িতে যখন পৌঁছালাম তখন অন্ধকার নামেনি। সূর্য ডোবার আগের নরম আলো চারিদিকে। ওর বাড়ির পাঁচিলের গায়ের গেটটা বেশ কয়েকবার ঠেললাম। কে যেন বন্ধ করে রেখেছে শক্ত করে। এতটাই উঁচু পাঁচিল যে দেখার উপায় নেই ওপারে কী আছে। ফেরত আসার আগে মিতুলও দরজায় আলতো করে একটা ধাক্কা মারল, আর কী আশ্চর্য! দরজাটা অবলীলায় খুলে গেল হাট হয়ে।

সেদিন অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় ভালো করে খেয়াল করিনি। আজ গেট ক্রস করে ভেতরে পা রাখতেই থমকে গেলাম। বাড়িটার সামনে ডান দিকে একটা ছোট্ট কৃত্রিম পুকুর, আর তার চারধারে ঘন হয়ে নীলচে বেগুনী ফুলের দল মাথা তুলেছে। এতটাই ঘন তাদের বসতি, যে দূর থেকে দেখে মনে হয় কে যেন জমিতে মখমলী গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে। সরু সরু গাছ, তাদের সবুজ লকলকে ডগায় লেগে থাকা ফুলগুলো হাওয়া দিলে বারবার নুইয়ে যায়। নরম গাছ, এতটাই নরম যে ফুল ছিঁড়তেও ইচ্ছা করে না। মনে হয়, সে ব্যথা বুঝি বা গাছটা সহ্য করতে পারবে না।

আরশিনের আজ শরীর খারাপ ছিল। প্রশ্ন করলাম, কিন্তু কেমন যেন প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল। মিতুলের দিকে একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। মিতুলের আরশিনকে দেখলে অদ্ভুত পরিবর্তন হয়, আগেও দেখেছি। ওর চোখের তারায় চার বছরের বাচ্চা সুলভ ছটফটানি দেখা যায়, ও ঘুরে ঘুরে সবকিছু নেড়ে ঘেঁটে দেখে।

মিতুলকে আরশিন কাছে ডাকল। আরশিনের শরীর কাঁপছিল। মনে হল ওর জ্বর হয়েছে। টেবিলের নীচ থেকে একটা বাক্স বার করে ও মিতুলের হাতে দিল। বলল, “তোমাকে বলেছিলাম না একটা জাদু দরজা দেখাব? এটা খোলো, দেখবে একটা জাদু দরজা আছে। তার ওপারে তুমি যত জাদু দেখতে চাও সব দেখতে পাবে।”

মিতুল অবাক হয়ে বাক্সটা হাতে নিল। বাক্সের ঢাকনা খুলতেই টুং টাং শব্দে দুটো স্প্রিং দেওয়া ছোট্ট পরী ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল। আরশিন হাল্কা হাতে বাক্সের ভেতর ছোট্ট কব্জা ঘোরাল। একটা ছোট কাঠের পার্টিশন আলগা হয়ে গেল। তার ভেতরে একটা আয়না লাগানো। মিতুল এত খুশি হল, যে হাতে তালি দিয়ে উঠল।

আরশিন বলল, “পসন্দ হুয়া, শাহজাদী ?”

সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মিতুল বলল, “যা চাই… সঅঅঅব?”

আরশিন আবার শব্দ করে হাসল। আমি বললাম, “তোমার শরীরটাতো ভাল নেই মনে হচ্ছে, আজ উঠি? পরে আসব।” আরশিন কোনও ওজর আপত্তি শুনল না। বাচ্চাদের কাছে থাকলে ওর নাকি শরীর ভালো হয়ে যায়। এলাহি খাবারদাবার খেতে খেতে একপ্রস্থ আড্ডা হল। মনটা উসখুশ করছিল। হিউ রিচার্ডসের ছবিটার দিকে তাকালে এত অদ্ভুত অনুভূতি হয় কী বলব! মনে হয় নীল চোখদুটো এক্ষুনি হেসে উঠবে। মেরীজানকে দেখার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তার পোর্ট্রেট আরশিনের বাড়ির অন্দরমহল ছাড়া পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। সেখানে এখনও আমার প্রবেশ অধিকার হয়নি। আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আরশিন মুচকি মুচকি হাসছিল, মনে হয় আমার মনের কথা বুঝতে পারছিল। চা খেতে খেতে ও এমন একটা প্রশ্ন করল, যার উত্তর দিতে গিয়ে আমি হকচকিয়ে গেলাম।

আরশিন বলল, “মীনাক্ষি, তুমি মিতুলের ঠিক করে খেয়াল রাখতে পারো?” চা খাচ্ছিলাম, প্রশ্নটা শুনে বিষম খেয়ে চা ছিটিয়ে একাকার হল। বললাম, “হঠাৎ এই প্রশ্ন!”

“জানি না, কেন যেন মনে হয়, মিতুল খুশি নয়। আর কেউ খুশি না থাকলে আমি চট করে ধরতে পারি। বাচ্চারা ফুলের মত হয়, কোনও কষ্ট হলে চোখে মুখে স্পষ্ট ফুটে ওঠে। বাবা মাকে যথাসময়ে সেটা বুঝতে হয়।”

“সব বাবা-মাই বোঝে আরশিন।”

“সবাই বোঝে না, মেরীজান বোঝেনি!”

“মেরীজানের সন্তান ছিল?”

“হাঁ, ছিল। লেকিন বেশিদিন বাঁচেনি। এক সাল বয়স যখন, মারা যায়। লোকে বলে মেরী বুকের দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে ঘুমিয়ে পড়েছিল, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে বাচ্চাটা…”

“ইস!”

দূরে থেকে কোথাও লাউডস্পিকারে আজানের বুলি শোনা যাচ্ছিল। ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে হাতের দুপাতা চোখের উপর বুলিয়ে আরশিন বলে উঠল, “আউযুবিল্লা-হি মিনাশ শাইত্বা-নির রাজীম। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।” মুসলিমদের এই আজানের ডাকটি আমার খুব ভালো লাগে। পৃথিবীর সর্বত্রই ঈশ্বরকে মনপ্রাণ দিয়ে ডাকার ধ্বনিটার বোধহয় একটাই সুর, এক নাদ। যে সুরাটি আরশিন পড়ল, তার অর্থ জিজ্ঞাসা করলাম।

আরশিন আমার দিকে তাকিয়ে কেটে কেটে বলল, “সমস্ত শয়তানি, ইবলুসি তাকত থেকে আমাদের বাঁচান মহান আল্লা। তোমার মেয়ের জন্য প্রার্থনা করলাম মীনাক্ষি।”

“মিতুলের জন্য?”

“হুম।”

আরশিনের চোখমুখ শক্ত হয়ে যাচ্ছিল। অদ্ভুত রিপালসিভ লাগছিল ওকে। ভীষণ অন্যায় করে ফেলেছি যেন একটা। অস্বস্তি হচ্ছিল আমার, তীব্র অস্বস্তি। প্রশ্ন করলাম, “মেরীজানের সাথে হিউ রিচার্ডসের দেখা হল কোথায়?”

“বহত লম্বি দাস্তান হ্যায় মীনাক্ষি। মেরীজানের সাথে যখন হিউ রিচার্ডসের দেখা হল তখন মেরীজানের বয়স ষোল আর হিউয়ের তেইশ। জনাব ক্লড মার্টিন তখন সবে মারা গিয়েছেন, মেরীজানের স্থান হয়েছে কায়জারবাগের কাছে এক কোঠায়। কোঠাবালী এক কাঞ্চন, নাম নার্গিস খানম।”

“কাঞ্চন কাদের বলে আরশিন?”

“কাঞ্চনরা পহলা দরজার তওয়ায়েফ। একদম কায়দাদুরস্ত জেনানা। শাহজাদা, রাজা, বাদশাদের মন মজাতে উস্তাদ তারা। লখনউতে তখন নবাব আসাফ-উদ-দৌলা আর তার ভাইজান সাদাত আলির দৌলতে তওয়ায়েফদের রমরমা। ফৈজাবাদ থেকে নবাব আসাফ-উদ-দৌলা রাজধানী নিয়ে এলেন লখনউতে, দিল্লীতে তখন মুঘল সুলতানত শেষ নিঃশ্বাস গুনছে। দিল্লী আর পঞ্জাব থেকে হাজারে হাজারে তওয়ায়েফ লখনউতে এসে জুটল। ওদেরকে কাঞ্চন বলা হত।

আরশিনের চোখের দিকে তাকালাম, বিলিতি বংশগতি দুশ বছর পরেও তার ছাপ রেখে যেতে ভোলেনি। প্রশ্ন করলাম, “তুমি এই ব্যাপারে কী করে এত ডিটেলসে জানলে?”

আরশিন গড়গড়া টানছিল, আমার প্রশ্ন শুনে হেসে ফেটে পড়ল। তারপর বলল, “খুন বাত করতা হ্যায় মীনাক্ষি! তুমি না শুনতে চাইলেও তোমাকে তো সে শোনাবেই। গুস্তাকী মাফ কর, এমনিই মজা করলাম। মেরীজানের লেখা ডায়েরি আছে একটা, তাতে মেরীজান সব লিখে গেছেন বুঝলে?”

“তোমার কাছে আছে সে ডায়েরি?”

আরশিন উঠে গিয়ে একটা চেষ্ট অফ ড্রয়ারের মধ্য থেকে একটা মোটা চামড়ায় বাঁধানো ডায়েরি নিয়ে এল। খুলে দেখলাম খুব শৈল্পিক ভঙ্গীতে ঘন ফিরোজা রঙের কালিতে পাতার পর পাতা লেখা। প্রশ্ন করলাম, “এটা উর্দুতে লেখা?”

আরশিন পাতাগুলো খুব যত্নে উল্টাচ্ছিল, খুব মমতামাখা গলায় উত্তর দিল,“না, আরবিতে।”

“তারপর?”

“মেরীজান যখন কোঠাওয়ালি হল, তখন লক্ষ্ণৌতে নবাব বাহাদুর হয়েছেন সাদাত আলি খান। লখনউ তখন নাচ, গান, কবিতায় হিন্দোস্তানে সেরাদের আড্ডা। রাস্তায় একটা লোকও খুঁজে পাবে না যে শের শায়রী বোঝে না, গজল শোনেনি, লয়দারী বোঝে না। ক্লড মার্টিনের বানানো দোজখ থেকে বেরিয়ে মেরীজান অন্য একটা জগৎ খুঁজে পেলেন। কোঠাতে গান, বাজনা, কবিতা কীসের না তালিম হত! সেই সময় লখনউয়ের রেসিডেন্ট জেনারেলের ফার্স্ট অফিসার হয়ে ব্রিটেন থেকে এলেন হিউ রিচার্ডস। ভারতে আসার অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই বড়াখানায় নিমন্ত্রণ পেলেন হিউ, আর সেখানে তাঁর দেখা হল মেরীজানের সাথে।”

“বড়াখানা?”

“হুম বড়াখানা। তুমি নাম শোনোনি আগে? অনেক ইনফ্যান্ট্রিতে তো শুনেছি এখনও হয়।”

“না, শুনিনি গো। আমায় কি তুমি বিরাট জ্ঞানীট্যানী ঠাওরালে?”

আরশিন আমার কথায় হাসল। তারপর বলল, “বড়াখানা হল লখনউ রেসিডেন্ট জেনারেল আর ব্রিটিশ অফিসারদের সৌজন্যে দেওয়া নবাব বাহাদুরের ভোজসভা। লখনউয়ের বিখ্যাত তওয়ায়েফরা মুজরো করত সেখানে। আলিশান ব্যাপার, খাওয়া দাওয়া ফুর্তির এলাহি ব্যবস্থা। নার্গিস তখন মধ্যবয়সে, কোঠির ব্যবসা ধরে রাখার উত্তরাধিকার তার দলের অন্য বাঈদের। মেরীজান তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়, আর সবচেয়ে খুবসুরত। নার্গিস খানম জানতেন বড়াখানার মজলিশে একবার মেরীজানকে নামাতে পারলেই কেল্লাফতে, লখনউয়ের ইতিহাসে নার্গিস খানমের কোঠির ব্যবসার টক্কর দেওয়ার মত অন্য কোনও তওয়ায়েফের হিম্মত বা তাকত কোনওটাই থাকবে না।“

“মেরীজান নাচগান শিখলেন?”

“শুধু নাচ বা গান নয় মীনাক্ষি, তওয়ায়েফদের শায়েরি থেকে শুরু করে আরবি, ফারসি রেখতি, গজল সবই পড়তে হত নিয়ম করে। রান্নাবান্না বা অন্য কোনও ঘরকন্নার কাজ করার কোনও তালিমই হত না, ফলে প্রচুর সময় পড়ে থাকত নাচ গান কবিতা সাহিত্য চর্চার জন্য। লোকে বলত কোঠাওয়ালিদের কোঠাতে চুলা জ্বলে না। মেরিজানের মন কিন্তু নাচগান নয়, রেখতি শায়েরিতে বেশি মজল।”

“রেখতি কী? গান কোনও ধরণের?”

“উঁহু, গান নয়, কবিতা। রেখতি হল মেয়েদের নিয়ে লেখা কবিতা। লখনউ তওয়ায়েফদের সুখ, দুঃখ, নিঃসঙ্গতা নিয়ে লেখা কবিতা। মেয়েদের নিয়ে লেখা বলে লখনউয়ের লোকেরা বলত বেগমতী জুবান।”

“বাহ!”

নার্গিস খানমের কাছে তার গুণমুগ্ধ এক কবি আসতেন, তাঁর নাম ছিল সাদত ইয়ার খান। তিনি অপূর্ব রেখতি লিখতেন, সেই রেখতির শব্দ ব্যবহার করে নার্গিস খানম অনেক গজলের মহ্ফিল সাজিয়ে তুলতেন। আদমি আর অওরতের জিসমানি ভালোবাসা, শরীরের ভাষা, তাদের পাওয়া না পাওয়া, সাদাত ইয়ার খান কলমের আগায় সব ব্যথা বেদনা এমন করে ফুটিয়ে তুলতেন যেন মনে হত কলম থেকে কালি নয়, চোখের জল ঝরছে। একটা শুনবে?”

“শোনাও।”

আরশিন বাচ্চাদের মত খুশী হল।“ ডায়েরি থেকে পড়ল, “উন কো দেখে সে যো আ যাতি হ্যায় চেহরে পর রৌনক,

উয়ো সমঝতে হ্যায় কি বিমার কা হাল অচ্ছা হ্যায়।”

“দারুণ।“

“শুধু দারুণ না, মীনাক্ষি, বেহতরীন! সাদাত ইয়ার খাঁ নিজের ছদ্মনাম দিলেন রঙ্গীন, তার লেখা রেখতি আস্তে আস্তে কোঠা ছাড়িয়ে পৌঁছাল লখনউয়ের রইস মহলে। তার দেখাদেখি আরও অনেক পুরুষ কবি রেখতি লেখা শুরু করলেন। নিশাত, জানসাহিব, ইনশা, জুরত… কত রকম তাদের ছদ্মনাম। সাদাত ইয়ার খান-রঙ্গীনের রেখতি শুনে শুনে মেরীজানও রেখতি লেখা শুরু করলেন, নিজেই লিখতেন, নিজেই সুর দিতেন, নিজেই গাইতেন।

রেখতি মেরীজানকে মুক্তি দিল। একদম কমসিন বয়সে যে ধাক্কাটা খেয়েছিলেন, ভোলা নামুমকিন ছিল। শরীরকে নিয়ে মেরীজানের বড় অস্বস্তি ছিল। নাপাক শরীরকে আল্লাহ রসুল দয়া করবেন কি! কোনওদিন কি কোনও জিসমানি সম্পর্ক মেনে নিতে পারবেন! কিন্তু রেখতির কথা আর সুরে যত মজলেন, ততই বুঝলেন অল্লাতালাহ তার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। তাঁর রহমতের বারিশ যখন কারুর উপর হয়, তখন সেই খুদার বান্দা জানতে পারে সেই নওয়াজিসের নূর তার জীবন কতটা বদলে দিতে পারে। কত সুকুন থাকতে পারে সেই ইনায়তের মধ্যে! কত শিদ্দত থাকতে পারে জিন্দেগির! এই তামাম জাঁহা, তমাম কায়নাতের অনেক উপরে উঁচা আসমান আছে একটা, মেরী ওই আসমানে পরিন্দাদের মত ভাসতে লাগলেন। কবিতা আবার তার মুঠোর মধ্যে এক ঝলক জিন্দেগির রোশনাই ধরিয়ে দিল।”

“তারপর?”

“লখনউতে গজল গায়িকাদের কদর ছিল। কিন্তু গজল তো শুধু শব্দ নয়, শব্দের যে ঠমক আছে তা মানুষের দিলদিমাগ পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য আরেকটা জিনিস লাগে, তা হল অদাকারী, নজাখত। মেরী শখে কবিতা লেখেন কিন্তু নজাখত বা অদা কোনওটাই তার নেই। সকলের সামনে সে পাথরের মূর্তির মত বসে, তার অন্যভস্ত গলায় যে স্বর ওঠে তাতে মহফিল সাজানো দূর… মনও ভরে না। নার্গিস খানমের কোঠায় আসা নতুন মেয়েটার এই শখের কথা নার্গিস খানম জানতে পারলেন, তিনি বাধা দিলেন না ঠিকই কিন্তু মেরীজানকে এটুকুও বলে রাখলেন যে যতই শেরশায়েরি লেখো না কেন বাপু শেষ পর্যন্ত কিন্তু শখে পেট ভরবে না, মুজরো শিখতেই হবে। নার্গিসের কোঠায় ছোট থেকেই তওয়ায়েফদের তালিম হয়, মেরীজানেরও কিছু কম হল না! কিন্তু নাচতে গেলে তার পা সরে না, যে গানের কথায় মশগুল থাকেন সারাদিন, তাকেই সকলের সামনে কন্ঠে তুলতে তার গলা সরে না। তার চেয়ে ছোট মেয়েরা মুজরার তালিমে কোঠা কাঁপিয়ে দিল। নার্গিসকে ডেকে সরেঙ্গীদার, তবলচি সবাই একটাই কথা বললেন… মেরী ফুল হতে পারে কিন্তু তাতে সুগন্ধ নেই। আর যে ফুলে সুগন্ধ থাকে না… তাতে ভ্রমর এসে বসে না।

যে লেখা তার ইমান সেই লেখাই মেরীজানকে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি করে দিল। জিন্দেগিকে লিয়ে লিখনা ইয়া লিখনেকে লিয়ে জিন্দগি! মুগ্ধ দৃষ্টিতে তিনি অন্যদের অদাকারী দেখতেন। দোজখ থেকে বেরিয়ে মানুষ যেভাবে বেহেস্তের পরীদের দেখে! দেখতেন কী করে মেহেন্দি লাগানো নিখুঁত হাতের ভঙ্গিতে, দুচোখের ভুরুর ওঠানামায়, চাউনির রকমফেরে কত রুখাসুখা মরুভূমিতে মিষ্টি জলের তালাও বানানো যায়। দেখতে দেখতে একটা কথা বুঝতেন, যে কাজে ভালোবাসা আছে, সে কাজেই আল্লার রহমত আছে। হয়তো নিজেও জানতেন একদিন সব ছেড়ে তাঁকে নাচগানের দিকে যেতে হবে… আখির সির্ফ রেখতি লিখে তো কারুর পেট ভরে না। তাও মনে মনে স্বপ্ন দেখতেন, নবাব সাদাত আলি খানের দরবারে রেখতি পড়ে শোনাচ্ছেন, আশপাশ থেকে লোকে বাহবাই দিচ্ছে। কায়জারবাগে, পরীমহলে, লখনউয়ের রাস্তায় রাস্তায় লোকে তার রেখতিতে সুর দেওয়া গজল গাইছে, মহরমের মরসিয়্যাতে তার কথায় সুর চড়ছে। কিন্তু স্বপ্ন তো স্বপ্নই হয়, মেরীজান নার্গিস খানমকে খুব ভালো করেই চিনতেন। নার্গিস খানম বহত কড়া ধাঁচের মানুষ ছিলেন, গান বাজনা করেই যে তাঁকে এতবড় কোঠা চালাতে হবে, এতগুলো লোকের পেট পালতে হবে তা তিনি খুব ভালো করেই জানতেন। অবশ্য রোজগারের আরেকটা উপায়ও ছিল… তওয়ায়েফদের গুণপনায় কখনও কখনও কোনও কোনও রইসজাদা এত খুশি হতেন যে তাদের নজরানা দিয়ে মহলে নিয়ে যেতেন। তখন তাদের নজরানা দেওয়া অশরফি দিয়ে কোঠার দেখভাল চলত। কিন্তু তার জন্যও মহফিল বসানো দরকার, তওয়ায়েফের নিজের গুণপনা জাহির করার দরকার।”

“হিউ রিচার্ডস কি মেরীজানকে কোনও মহফিলে দেখলেন?”

“হাঁ, মেরীজানের সাথে হিউয়ের দেখা হল বড়াখানায়। সাল আঠেরোশো চার। ষোল বছরের মেরীর পরনে সেদিন সিল্কের পেশওয়াজ, স্বচ্ছ ওড়না। মেরীজানকে শেখানো হল, মঞ্চে ঘুঙরুর বোল তুলে উপস্থিত সবার দিলদিমাগে একেবারে বেহেস্তের শহনাই বাজিয়ে দিতে হবে।”

“তারপর?”

“নার্গিস খানমের আদেশের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস কারুর ছিল না, তার নিজের মেয়েদেরও নয়। মেরী জানতেন সেদিনের পর থেকে তার পেশাদার বাঈজী জীবন শুরু… মনে মনে ভীষণ অরাজি হলেও মেরী প্রকাশ্যে কোনওরকম অসন্তোষ দেখাতে পারলেন না, কিন্তু বড়াখানায় গিয়ে অত মানুষের সামনে একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। তার চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল, তার ঘুঙুর পরা পা এত তালিমের পরও একবারও ছন্দে নাচল না। নার্গিস খানম তাকে মুজরো করার জন্য ইশারায় ভঙ্গিতে অনেকভাবে বাধ্য করার চেষ্টা করলেন… কিন্তু মেরীজান নাচলেন না। মহফিলের এক কোনায় মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। নার্গিস খানমের দলের অন্য মেয়েরা ফিকা মুজরা করে মহফিল শেষ করল, কারুর মনে কোনও কিছুই দাগ কাটল না। কোঠার ভবিষ্যৎ কল্পনা করে নার্গিসের মাথায় হাত পড়ল। তিনি তিরিশ পেরিয়েছন, তার যৌবন শুকিয়ে যাওয়া গুলদস্তার মত, তিনি কতদিন আর মহফিল সাজিয়ে বসবেন? মাথায় আগুন জ্বলে উঠল… গিয়ে মেরীজানকে ঠাসিয়ে এক চড় কষালেন। মহফিলের এক পাশে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ্য করলেন হিউ, সেই দিনই নার্গিস খানমের দলবলের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে পরদিন পৌঁছে গেলেন মেরীর খোঁজে।”

আরশিনের গল্প বলায় ছেদ পড়ল। ওর ঘরের গ্রান্ডফাদার ক্লকটায় ঢং ঢং করে আটটা বাজল। আমাকে এবার উঠতে হবে, অনেকটাই রাত হয়ে গেছে। মেরীজান আর হিউয়ের গল্পটা শোনার জন্য মন উতলা হয়ে রইল, মনে হল আজই বসে বাকিটা শুনে যাই। মিতুলকে পাকড়াও করে বেরিয়ে এলাম আরশিনের বাড়ি থেকে। সিঁড়ি দিয়ে যখন নামছি, আরশিন পেছন থেকে ডাকল। বলল, “তোমার ঘাড়ে এটা কীসের দাগ মীনাক্ষি?” অজান্তেই হাতটা ঘাড়ে উঠে এল। আরশিনকে সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার ঘটনাটা বললাম। যখন পড়েছিলাম তখন ওখানেই লেগেছিল।

সাত

দুজোড়া নীল চোখ পরস্পরের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল। স্বচ্ছ ওড়নার আড়ালে প্রেয়সীর সৌন্দর্য অকৃপণভাবে পান করছিলেন হিউ রিচার্ডস। নার্গিসকে অনেক টাকা মাহর দিয়ে কোঠার উপরতলায় উঠে এসেছেন তিনি। যার জন্য এসেছেন সে নিশ্চুপ। শুধু সে তার দুখানি আঙুল দিয়ে মাঝে মাঝে তার সামনে রাখা খাতার পাতা অন্যমনস্কভাবে উল্টে যাচ্ছে। হিউও চুপ ছিলেন, তারপর ভাঙা ভাঙা উর্দুতে বললেন, “একটা পড়ে শোনাও মেরীজান!” মেরী সংকুচিত হচ্ছিলেন, কবিতা পড়তে তার অসুবিধা নেই, কিন্তু এই বিদেশীর তা পছন্দ হবে কেন? মেহমানের খাতিরদারি করাই তওয়ায়েফের ধর্ম, কিন্তু নার্গিস খানম তাকে সমস্যায় ফেলে দিয়েছেন। অংরেজ অফিসারের গায়ের রঙ, তার ভাঙা ভাঙা উর্দু মেরীকে তার ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। অতিথির সামনে চুপ করে থাকা উচিত নয়, কিন্তু কিছুতেই মেরীজান সহজ হতে পারছিলেন না। তাকে অবাক করে দিয়ে হিউ বলে উঠলেন, “আপকে জ্যায়সি কোই তসবির বনানি থি মুঝে, পর মেরে অন্দর সে সভি রঙ আপকে নিকলে,

তসবির বনানে বৈঠে কোরে কাগজ পর…

পর পলকো সে চাঁদ পর নাম লিখ বৈঠে”

“আপনি উর্দু কবিতা পড়েন?” মেরী প্রশ্ন করলেন।

“না। তোমার কবিতা ভালো লাগে শুনে মুখস্থ করে এসেছি।” হিউ হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন।

“আপনি শুধু আামার কবিতার জন্য এসেছেন? আমি কিন্তু ভালো গজল গাইতে পারি না, শুধু লিখতে পারি।”

হিউ রিচার্ডস কী উত্তর দিচ্ছিলেন, হঠাৎ তার মুখটা তমালের মত হয়ে গেল। মেরীজানের ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে থাকা মুখটা অস্পষ্ট হতে হতে বিলীন হয়ে গেল। তারপরেই গাল ধরে কে যেন নাড়াতে লাগল আমায়। চোখ খুলে দেখি, তমাল! বলল, “কী সব বলছ স্বপ্নে! হাসছ, কতগুলো উর্দু শব্দ বলছ। এ কী হল তোমার?”

আমার মাথার মধ্যে তখনও সদ্য শোনা শব্দগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল। একটা খাতা পেলে হয়তো লিখেও ফেলতে পারতাম। তমালকে বললাম, “স্বপ্ন! আমি যে একেবারে সত্যির মতনই দেখলাম তমাল।” তমাল বিরক্ত হচ্ছিল। রাতের বেলা ঘুম ভেঙে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনতে কারই বা ভালো লাগে। মুখটা কুঁচকে ও বলল, “শুয়ে পড়ো। এত ভেবো না।”

শুয়ে পড়লাম ঠিকই কিন্তু ঘুম এল না। নানা টুকরো টুকরো কথা মনে পড়ছিল। মেরীজানের মুখটা কত নরম লাগছিল, ভোরের প্রথম রোদের মত। হিউ রিচার্ডসও সুপুরুষ। মেরীজানকে ভালোবাসেন, বেশ একট রবিনহুড টাইপের ব্যাপার রয়েছে গল্পটায়। আরশিনের পূর্বপুরুষের প্রেমকাহিনী মনে এত প্রভাব ফেলেছে, আগে বুঝতে পারিনি তো। ওর সাথে দেখা হলে বলতে হবে। পাশের দেওয়ালে ক্যালেন্ডারটা ফর-ফর করে উড়ছিল। কোনও একটা বাচ্চাদের কোম্পানির দেওয়া ক্যালেন্ডার। বেবী বটল, ফিডার, বিব এসবের ছবি। আরশিন বলেছিল, মেরীজানের বাচ্চা দুধ খাওয়াতে গিয়ে মারা গিয়েছিল। আমি মিতুলকে দুধ খাওয়াতাম কিনা একদম মনে পড়ছে না। দুধের গন্ধ… দুধের ভারে বুকে ব্যথা… তারপর বাচ্চাকে খাওয়ালে অস্বস্তি কমে যাওয়া, হাল্কা লাগা… এসবই মনে আছে, শুধু ছোট্ট মিতুলের মুখটা মনে পড়ছে না কেন? জেদ চেপে গেল, চোখ বন্ধ করে মিতুলের একদম শিশু বয়সের মুখটা মনে করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আবার সেই আলোর পর্দাটা চোখের উপর নেমে আসল। মাথাটা ঝিম ধরে এল, চোখের পাতায় ঘুম নেমে এল। ভোর রাতের দিকে আবার ভীষণ ভয়ের একটা স্বপ্ন দেখলাম।

ঘুমের মধ্যে রুহানিয়তকে দেখলাম। শোঁ শোঁ করে হাওয়া দিচ্ছিল, বেগুনী অ্যাকোনিটাম ন্যাপেলাসের ঝাড়গুলো মাথা নুইয়ে নত হয়ে একমনে শুনছিল সে শব্দ। নুড়ি ঢালা রাস্তায় টকটক শব্দ করে আমার দিকে পিছন করে হেঁটে যাচ্ছিল সে। তার দুই হাতের মধ্যে পাঁজাকোলায় করে কী যেন ধরা ছিল। পেছন থেকে হাজার চেষ্টা করেও দেখতে পাচ্ছিলাম না।

চাঁদের আলো তার পায়ের পহজেবে পড়ে ঠিকরে উঠছিল বারবার। কোথা থেকে একদল মেয়ে এসে খিলখিল করে এসে তাকে ছুঁয়ে দিয়েই আবার মিলিয়ে গেল হাওয়ায়। তাদের স্পর্শে চমকে উঠে সে থমকে দাঁড়াল… যেন খিলখিল হাসির শব্দ, জীবনের স্বাভাবিক উচ্ছ্বাস থেকে অনেক দূরে তার বাস্তব। ভরা পূর্ণিমার চাঁদ মাথায় করে রাত তখন পূর্ণযৌবনা। সেও আমার মতই চাঁদের দিকে তাকাল… তারপর নাজানি কী ভেবে হাঁটু মুড়ে বসে হু হু করে কেঁদে উঠল। আমার মনে হচ্ছিল, এ বড় আপনার কেউ। এগিয়ে গিয়ে তার শরীর ছুঁতে চাইছিলাম। স্পর্শে অনেক দুঃখ সেরে যাওয়ার চাবিকাঠি রয়েছে। কিন্তু কী যেন আমায় চুম্বকের মত টেনে রাখছিল, পারলাম না, কিছুতেই পারলাম না সেই মরণ আকর্ষণ এড়িয়ে ছুটে যেতে তার কাছে! অজান্তে চিৎকার করে উঠলাম… “আরশিইইইইন”। জানি না কেন, সেই মুহূর্তে ঘুমের মধ্যে আরশিনের কথাই মনে এল! সেই অপরিচিতা ধীরে ধীরে মাটি থেকে উঠে সামনে এগোতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। আমার দিকে পিছন ফিরে তাকাল। তার মুখ বিকৃত, বিবর্ণ, বেরঙ। দেখলাম সে তার কোলে এক শিশুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শিশুটির শরীর নীল, চোখ উল্টানো। তার চেহারাও নীলচে বেগুনী, তার মুখের চামড়া গলে গলে পড়ছে, চোখ বিস্ফারিত। মেরীজান আর তার সন্তান!

এক হাতে সন্তানকে আঁকড়ে বেগম মেরীজান আমার দিকে এক আাঙুল তুলে দেখাল, আর তার পরেই অ্যাকোনিটাম ন্যাপেলাসের ছোটছোট গাছগুলো সমুদ্রের ঢেউয়ের মত মেরীজান আর তার সন্তানকে ঘিরে ধরল। সেই সমুদ্রের মধ্য দিয়ে মেরী আবার পিছন ফিরে হাঁটা শুরু করল। মাথায় রাতের কালো আকাশের চাঁদোয়া, হু হু করে বইতে থাকা হাওয়া, আর তার মধ্যে অজানা কোনও দিগন্তের দিকে হাঁটতে থাকা বেগম মেরীজান… রুহানিয়তের বিশাল ইমারতখানি সেই ভয়ংকর দৃশ্যের সামনে পুড়তে থাকা মোমবাতির মতই আয়তনে ছোট হতে লাগল… শেষে একটি জ্বলন্ত ধূপকাঠির আগায় যেটুকু লালচে আগুন জ্বলে সেইটুকু হয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল একপ্রান্তে। আমার চোখের সামনে শুধু জেগে রইল এক আকাশ হিমশীতল জ্যোৎস্নার মধ্যে দিয়ে মৃত্যুর দিকে এগোতে থাকা এক নারী। তার যেন কিছু বলার ছিল আমায়। চোখ বুজে শুনলাম, জগৎব্যাপী নিসর্গ, ভূপৃষ্ঠ, অন্তরীক্ষ, তাতে ভাসমান জ্যোতির্মণ্ডলী সবাই এক হয়ে আমার কানে কানে বলছে… এই সে, এই সে… জাআআআআগতে রহো! আমার কানের ছিদ্র দিয়ে সেই আওয়াজ আমার রক্তে মিশল, সারা শরীরের রক্ত উত্তপ্ত হয়ে চলাচল করছিল।

ঘুম ভেঙে উঠে দেখলাম আমার ঘরের জানালায় সেই একই চাঁদ উঁকি মারছে, হাওয়া এসে পরদাগুলোকে এমন এলোমেলো ভাবে ওড়াচ্ছে যেন নাম না জানা কোনও দস্যু! পর্দার দিকে চোখ মেলে রাখতে রাখতেই মাথায় একটা বিস্ফোরণের মত হল। পর্দা ধরে ধরে কে যেন বেশ হাঁটত! ধুপ করে পড়ে যেত… আবার হাঁটত… আবার পড়ত। তার পায়ের পাতাগুলো ছোট ছোট, ওই ওই যে পর্দার ফাঁক দিয়ে সে চিৎকার করে ডাকল… ‘টুউউউকি।’ ধুপ ধুপ শব্দে কে যেন দৌড়ে আসছিল, দেখে সে আবার পর্দার পিছনে লুকিয়ে পড়ল! মাথা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছিল আমার। চিৎকার করে তমালকে ডাকলাম “তমাআআআল”। ও পাশেই শুয়েছিল, ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠল। ওকে সবটা বললাম। কী যে নতুন উপসর্গ শুরু হল আমার! তমাল ভয় পেয়েছিল, ঢক ঢক করে বোতল থেকে জল খেল। স্বাভাবিক! মনে হয়েছিল যে সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। যখনই সব ঠিকের পথে যায়, তখনই যে আবার কেন সবকিছু গোলমাল হয়ে যায়।

আমার দিকে তাকিয়ে শুকনো হেসে ও বলল, “ডাক্তারের সাথে কথা বলে ঘুমের ওষুধের ডোজটা বাড়িয়ে নেবে? তোমার ঘুম হচ্ছে না ঠিক করে?”

ওকে জড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কাকে দেখলাম তমাল? কাকে?”

ওর হাতটা আমার পিঠে ঘুরতে ঘুরতে সান্ত্বনা দিচ্ছিল, আমার প্রশ্ন শুনে স্থির হয়ে গেল। একটা কাজ চালানোর মত উত্তর দিল ও, “মিতুলের ছোটবেলা মনে পড়েছে তোমার। বাহ্, দারুণ ব্যাপার মিনু।” তারপর থেকে সেই যে ও গম্ভীর হল, পরেরদিন সকালেও সেই গাম্ভীর্য কাটল না। অফিসে বেরোনোর আগে একবার থমকে দাঁড়িয়ে বলল, “অহেতুক মাথায় চাপ পড়ছে মীনাক্ষি। তোমার নিজেরই মেন্টাল ব্যালান্স ঠিক নেই, তার মধ্যে তুমি এই মেরীজানের কমপ্লিকেটেড গল্পটা নিয়ে রাতদিন ভাবছ। ভুলভাল হ্যালুসিনেট করছ। ইমিডিয়েটলি ওখানে যাওয়াটা বন্ধ কর, টেক রেস্ট।” শেষ কতগুলো বলার সময় ওর গলার আওয়াজ অন্যরকম শোনাচ্ছিল। ঠিক উদ্বিগ্ন নয়, বিরক্ত হয়েছিল তমাল।

তবে এতসব ঝামেলার মধ্যেও আজ একটা ভালো কাজ করেছি। লকেটসহ সোনার চেনটাকে খুলে আবিদাকে দিয়ে দিয়েছি। ওর টাকার সমস্যা মিটছিল না। প্রথমে ভীষণ অবাক হল, তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আমার হাতটাকে ওর হাতের মধ্যে ধরে নিঃশব্দে কাঁদছিল। ওর চোখ দিয়ে গড়ানো টপটপে উষ্ণ জল আমার হাতের পাতায় পড়ে হাত ভেজাচ্ছিল। চোখ মুছে আবিদা বলল, “আপা, মিতুল বেবিকো ডক্টর দেখাবেন। নিজের মনে কার সাথে যেন খেলা করে, গান গায়, জড়িয়ে ঘুমায়। বেবি একদম একা থাকতে ভালোবাসে। কোনও জ্বিনটিনের ছায়া পড়ল নাকি একটু দেখবেন আপা! আমাদের ইসলামে আমরা আয়াতুল কুর্সি পড়ি… আমি মাঝেমাঝে পড়ব ওর জন্য?”

বললাম, “পড়ো।”

আবিদাকে আজ তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলাম, ওর বাড়িতে অনেক কাজ। আমার হাতের তালুতে চুমু খেয়ে ও চলে গেল। সন্ধে করে আসছিল, বিকেল সাড়ে চারটে মানেই লখনউতে অন্ধকার হয়ে আসে এখন। গরমে তো শুনেছি রোদের দাপটে বাড়ির বাইরে পা রাখা দায় হয়। ব্যালকনির দরজা খুলে পিছনের জমিটার দিকে গিয়ে দাঁড়ালাম। এই জমিতেই গাছটা পুঁতব ভেবেছিলাম। কাল রাতের পর সেই একই গাছে এত ভয় ধরল আমার!

তমাল যতই বলুক, আরশিনের সঙ্গ মিতুলকে অনেক স্বাভাবিক করেছে। আজকাল ও ওর জাদু দরজাওয়ালা বাক্সটা নিয়ে মেতেই থাকে। আবিদা বলছিল, এত ছোট বাচ্চা তাও কেন এত একা একা থাকে! কিন্তু, আমি জানি, বাক্সটা পাওয়ার পর মিতুল একটু একটু করে পাল্টাচ্ছে। পরশু, ওর ঘরে গিয়ে দেখি, জানালার সামনে চুপটি করে বসে আছে। খোলা জানালা দিয়ে সকালের নরম রোদ এসে পড়েছে ঘরে, তার খানিকটা বাক্সের মধ্যে থাকা আয়নাটায় লেগে মিতুলের মুখ চোখে ঠিকরাচ্ছে। গোলাপী জামা পরা পরীদুটো ব্যালে ডান্সের ভঙ্গিতে এক পা ফোল্ড করে ঘুরে যাচ্ছে নিজে নিজে। মিতুলকে যেন হাসতে দেখলাম! বাক্সটা দামী এবং অ্যান্টিক। ওটাকে আমি খুঁটিয়ে দেখেছি, কাঠের গায়ে এনগ্রেভ করা রয়েছে ওর জন্মস্থান— “মেইড ইন ইংল্যান্ড”, কিন্তু সত্যি যদি মিতুল ভেবে থাকে, ওই বাক্সে কোনও জাদু দরজা আছে তবে ওই বাক্সটার দাম টাকায় গোনা যায় না। একা হয়তো এখনও থাকছে, কিন্তু ও নিঃসঙ্গ নয়, সেটা আমি বুঝি।

বিকেলের দিকে নীচের বেলটা বাজল, কে যেন এসেছে। নীচে গিয়ে দেখি হাতে একটা খাম নিয়ে ক্যুরিয়র বয় দাঁড়িয়ে আছে। সই করে খামটা খুলে দেখি, কলকাতা থেকে চিঠি এসেছে। এল আই সির চিঠি, কোনও একটা ক্লেমের জন্য ইনসাফিসিয়েন্ট ডকুমেন্ট লিখে পাঠিয়েছে। তমালের পুরোনো অফিসের ঠিকানা থেকে রি ডাইরেক্ট হয়ে এসেছে। পিফের সেটলমেন্ট বাকি, তমাল হয়তো নতুন অ্যাড্রেসটা ছেড়ে এসেছিল ওখানে। কিন্তু চিঠি কেন! দরজা বন্ধ করে উপরে উঠছি, আবার বেল বাজল। খুলে অবাক! আরশিন দাঁড়িয়ে। আগেরবার আসার সময় ওকে বাড়ির অ্যাড্রেসটা বলে নিমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছিলাম, হয়তো অনেকদিন যাইনি বলে খুঁজতে খুঁজতে চলে এসেছে। ফোন নম্বরটাও দিয়ে এসেছিলাম, কেন যে ফোন করেনি। ওর চেহারাটা আগের বার যেমন খারাপ দেখেছিলাম, আজ যেন তার চেয়েও খারাপ লাগছে। চোখের তলায় কালি, চোখ মুখ বসা। জিজ্ঞাসা করাতে বলল, “দাস্ত হয়েছিল”। প্রায়ই নাকি হচ্ছে, সঙ্গে বমিও হচ্ছে। ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খেয়েছে, তবে খুব একটা লাভ হয়নি।

আরশিনের আসাতে অস্বস্তি হচ্ছিল। তমালের আসার সময় হয়ে যাচ্ছিল। ও এসেছে, তমাল দেখলে রাগ করবে। কালকের স্বপ্নটা মাথার মধ্যে খচখচ করে বিঁধছিল। কী যেন ছিল স্বপ্নটায়, আমার সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেওয়ার মত কোনও উপাদান, কেন সে বলল, “জাআআআআগতে রহো!” যেন এতদিন কোনও গভীর সুপ্তির মধ্যে তলিয়ে ছিলাম, আমায় উঠতে বলে ডাক দিচ্ছে কেউ! আরশিনের বাকি গল্পটা শোনার আমার একটুও ইচ্ছা ছিল না। অথচ, ওকে চলে যেতে বলতেও ইচ্ছা করছিল না।

আরশিনকে বললাম, “আমায় একটু বেরোতে হবে আরশিন। শরীরটাও ভালো নেই। তাড়া আছে আজ।”

আরশিন যেন শুনতেই পেল না, বলল, “আজ তো তুমি গল্প শোনাবে মীনাক্ষি!”

“আমার বলার মতন কোনও গল্প নেই আরশিন!” তটস্থ হয়ে বললাম।

আরশিন অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। ওর দৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে যেতে লাগলাম।

সামনে একটা মশা মারার কয়েল জ্বলছিল, কয়েল পুড়ে পুড়ে শুকনো ছাই জমছিল আরশিনের পায়ের কাছে। তারই ধোঁয়া ঘন হয়ে কয়েলের মুখটায় জমাট বাঁধছিল। আবার সেই শব্দটা কানে শুনতে পেলাম, “জাগতে রহোওওওও।” এবার আর স্বপ্নে নয়, বুকের ভেতর থেকে সেই আওয়াজ আমায় ডেকে উঠল, সারা শরীর শিরশিরিয়ে উঠল, প্রবল শীতের মধ্যেও অজান্তে কপালে ঘাম জমল বিন্দু বিন্দু।

আমাকে চমকে দিয়ে আরশিন বলল, “তাহলে আমারটা শোনো!”

আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল। আরশিনকে বললাম, “আরেকদিন শুনব প্লিজ।”

আরশিন ঠান্ডা গলায় বলে উঠল, “নাহ! অভি শুনোগি তুম মীনাক্ষি! এখনই শুনতে হবে! আল্লাহর দরবারে গুণাহর শাস্তি কী হয় সেটা যে তোমায় জানতেই হবে মীনাক্ষি।” আমার গা ছমছম করে উঠল। পাপ! শাস্তি! আরশিনের দিকে তাকিয়ে কথা বললাম, গলা দিয়ে অদ্ভুত খসখসে স্বর বেরোলো! “আমি ভীষণ ভয় পাই আরশিন। আমার মনে হয়, তোমার গল্পটায় মৃত্যুর গন্ধ লেগে আছে। আমার দম বন্ধ লাগে।”

“কভি কভি লোগোকো দুবারা জিনে কে লিয়ে কয়ামতকে পাস সে গুজরনা অচ্ছা হোতা হ্যায়, মীনাক্ষি। গল্পটা শোনো।“

সোফায় হেলান দিয়ে আরশিন গল্পটা বলা শুরু করল, “সাল আঠারোশ পাঁচ, হিউয়ের সাথে মেরীজানের নিকাহ হয়ে গেল। দুজনে দুজনের প্রেমে পড়েছিলেন। এর আগেও লখনউ শহরে অনেক মুসলিম অওরতের সাথে অনেক অংরেজের নিকাহ হয়েছে। তবে রেসিডেন্সির কোনও অফসরের সেই হিম্মত ছিল না, যে বুক ঠুকে দিশী বিবি রাখবে। সবটাই চলত গোপনে গোপনে। মেরীকে নিকাহ করে হিউ রেসিডেন্সির কোম্পানি কোয়াটার্স ছেড়ে, লখনউয়ের এক রইসের কাছ থেকে রুহানিয়ত কিনে সেখানে উঠে আসলেন। কেউ কেউ বলল, গোপনে শিয়া হয়েছেন রিচার্ডস। আবার কেউ বলল, অনেক অশরফির বিনিময়ে মেরীজানকে ছাড়তে রাজি হয়েছিলেন নার্গিস খানম। কোম্পানির অন্য অফিসাররা ক্ষুব্ধ হলেন, বিলায়েত থেকে এসে হিউয়ের মাথাটা যে হিন্দোস্তানি অওরতের কাছে বাঁধা পড়েছে সেই নিয়ে রেসিডেন্সিতে হিউয়ের আড়ালে হাসাহাসিও হল। কিন্তু এই নিকাহটা নিয়ে খুব বেশি তোলপাড়ও হল না। সবাই ধরেই নিল, মেরী হল হিউ রিচার্ডসের মনপসিন্দা খিলোনা, দুদিন পরে দিল যখন মন ভরে যাবে, আবার কোঠাতে লোটাপুটি খাবে মেরীজান। ”

“তারপর?”

“হিউয়ের মনে তখন বিরাট ফূর্তি। হলই বা তওয়ায়েফ, তিনি নিজে তো জানেন যে তিনি কোনওদিন মেরীজানকে ছেড়ে যাবেন না। মেরীজান তখন তার ইমানে মিশে গেছেন। মুসলিম তওয়ায়েফকে বিবির স্থান দিলেন হিউ। মনে মনে ঠিক করলেন, দু তিন বছর হিন্দোস্তানে কাটিয়ে মেরীকে নিয়ে ইংল্যান্ডে যাবেন। ক্যাথলিক ধর্মমতে নিকাহ করবেন মেরীকে।”

“হিউ এদেশ থেকে চলে যাবেন ভেবেছিলেন?”

“এখানে কোন অংরেজ থাকতে চাইবে মীনাক্ষি? পয়সার জন্য ওরা আসত, তারপর পয়সা জমিয়ে ফেরত চলে যাবে এটাই ঠিক করত।”

“আচ্ছা, তারপর কী হল?”

আরশিনের মুখ চকমকিয়ে উঠল। ঠোঁটের কোণে যে হাসিটা ফুটে উঠল, তা নেহাতই ব্যঙ্গের।

“নিকাহর রাতের জন্য হিউ অনেকদিন ধরে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন। অত বড় মহলে শুধু হাজার হাজার মোমবত্তি জ্বালালেন, কাচের বত্তিদানির আলো না বেগমের মুখের রোশনাই, কোনটা বেশি জোরদার… হিউ অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন। দস্তরখানে তখন চামেলি ফুলের গালিচা বিছানো, সফেদ পংকুরির মধ্যে মাঝে মাঝে লাল গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো। শোওয়ার ঘরে একটাই বত্তিদান, তাতে তিনটে মোমবত্তি জ্বলছে। জানলার বাইরে আকাশে মেঘের উপর চাঁদ ভাসছে, যেন মেঘের সমুদ্রে ভেসে চলা পালতোলা কস্তি। সেদিকে তাকিয়ে বসে মেরী হিউয়ের ইন্তেজার করছিলেন। তার নিজেরই লেখা শব্দেরা তার মাথায় ভিড় করছিল…”

“কোন শব্দ?” চিত্রার্পিতের মত আমি প্রশ্ন করলাম।

‘জিসকি আর্জুমে হম খোয়ে থে তমাম উমর, আজ উনকে পাস হোনে কি তক্কলুফ সে জি ঘবড়ায়ে! শোচতে হ্যায় কওন জাদা মেহেরবান হ্যায় আজ রাত, ইয়ে ইশক ইয়া ইশক কি রুসবাই!’ আরশিন থেমে থেমে বলছিল।

“সেই রাতটা খুব অন্যরকম ছিল, মীনাক্ষি। ধর, তুমি খুব সাধারণ মেয়ে, তোমার চাওয়া পাওয়া সবটাই খুব সাধারণ। হঠাৎ করে তোমার একজনের সঙ্গে দেখা হল, যে তোমার মধ্যে অসাধারণ কিছু খুঁজে পেল। তখন তোমার কী মনে হবে! তুমি কী চাইবে? তোমার কাছে তোমার নিজস্ব যেটুকু সম্পদ আছে সবটাই তাকে উজাড় করে দিয়ে দিতে, তাই না?”

“হুম!”

“মেরীজানও নিজেকে তৈরী করেছিলেন। বুকের মাঝখান আতরে ভিগা, ঢিলি চুড়নিতে লাজলিহাজ ছাড়ার আগের আগুন, আর সুর্মালাগা চোখে বেহত ঈশক। চোখ বুজে মেরীজান তালিমের দিনের কথা ভাবছিলেন। নার্গিস খানম বলতেন “জিস্ম, পেয়ারকা এক বহত কমসিন সলাহিয়ত হোতা হ্যায়।” এর আগে এতদিন যখন কোঠায় থাকতেন, কোনওদিন হিউয়ের সামনে নিজেকে এভাবে সাজিয়ে তোলার ইচ্ছা হয়নি! অথচ সেদিন! অশরফির সওদা যার সাথে হয়েছে, তার সাথে মনের সওদা খুব কম তওয়ায়েফেরই নসিব হয়। সেদিনের সেই বিশেষ রাতে মেরীজান পৃথিবীর সবথেকে বেহতরীন গুলদস্তা হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন হিউয়ের কাছে। তার যৌবন ইস্তক শেখা সব কলাকায়দা উজাড় করে দেবেন বলে হিউয়ের জন্য বসে রইলেন মেরী।”

আমার মাথায় আবার দপদপে যন্ত্রণাটা হচ্ছিল। বিয়ের রাত, ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত, অনেক আশা-আকাঙ্খা… এসব তো আমার জীবনেও নিশ্চয়ই ছিল। কোনও সুখানুভূতি চাইলেও মনে করতে পারছি না কেন? অন্যের সাথে নিজের অনুভূতিকে রিলেট করতে পারছি না কেন? এতটাই ব্লান্ট আমার মেমোরি?

আরশিন বলতে থাকল, “হিউ ঘরে ঢুকলেন, মেরীজান তার হাতে শরাবের পেয়ালা ধরালেন, একই পাত্র থেকে দুজনে পান করলেন। মেরীজানের দুখানি হাতের আঙুল তার উষ্ণ হাতের মধ্যে নিয়ে হিউ তার চোখে চোখ মেলালেন। দুজনে খুব কাছে এসে দাঁড়ালেন, মেরীজানের তখন নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ। শরীর মোমের মত গলে যাচ্ছে। হিউ বত্তিদান কাছে নিয়ে আসলেন, মোমের নরম আলোয় বেগমকে দেখবেন বলে। মোমের আলো মেরীজানের মুখের উপর পড়ল আর হিউয়ের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। এ কী সেজেছেন মেরীজান! কোথায় সেই কমসিন মজবুর কোমল মুখ, এ তো সুর্মা, কাজল আর খয়ের মুখে লেপা এক বাঈজী! এদের মতই কাউকে না কাউকে নার্গিস খানমের কোঠায় দেখে এতদিন ঘেন্না পেয়েছিলেন হিউ। এই মেয়ে এমন সেজেছে কেন? মোমবত্তিটাকে শক্ত করে ধরলেন তিনি। পিঘলতা হুয়া মোম বুঁদ বুঁদ করে তার হাত পুড়িয়ে দিতে লাগল। হিউ ঘেন্নায় শিউরে উঠে বললেন, “নট লাইক দিস… নট লাইক দিস।” অবাক হয়ে মেরী চোখ খুললেন, ঠোঁটের সাথে ঠোঁট মেলার আগে এ কেমন কথা বলছেন তার শোহর। হিউ তখন মুখ বিকৃত করে অন্যদিকে তাকিয়ে আাছেন। মেরী কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। আতরের গন্ধে হিউয়ের নাক বন্ধ হয়ে আসছিল। কোনওমতে বলে উঠলেন, “ইউ লুক স্ট্রেইট ফ্রম ব্রথেল। তুমি… তুমি হিউ রিচার্ডসের স্ত্রী, কোনও হিন্দোস্তানি বদসলুক অওরত নও। তোমাকে তোমার বেইজ্জতির জীবন থেকে, জিল্লতের জীবন থেকে অনেক দূরে নিয়ে এসেছি। এখন থেকে আমার পরিচয়, তোমার পরিচয়। এসব সুর্মা, খয়ের, কাজল কিচ্ছু চলবে না। এই সব জালিদার কুর্তা পরে, শরীরে আতর লাগিয়ে তুমি আমার কাছে আসবে না। ইউ নিড টু এনহ্যান্স ইওর লাইফস্টাইল লাইক অ ট্রু ব্রিটিশ লেডি।’

মেরীজান শোহরের কথা একমনে শুনছিলেন, কিন্তু শেষ কথাগুলোয় চমকে উঠলেন। হাত সরিয়ে বললেন, “আমার জিন্দগি তো জিল্লতের ছিল না, হুজুর। আমরা অদাকারা, তা সে নাচই হোক, গানই হোক বা কবিতাই হোক। অদাকারার জিন্দেগিতে কোনও জিল্লত নেই, নার্গিস খানমের কোঠায় কারুর কোনও দুঃখ নেই… সবাই নিজের পছন্দের কাজই করে। জিল্লতের জিন্দেগি তো তাদের যারা অওলাদের জন্ম দিয়ে অস্বীকার করে, খুদা তালাহর রহমতকে মানে না। নাপাক রিস্তে হোতে হ্যায় জনাব, ইন্সান তো নাপাক নেহি হোতে হ্যায়।”

শেষের কথাগুলো খোঁচার মত হিউ রিচার্ডসের বুকে গিয়ে বিঁধল। এত অশরফি খরচা করে, এত হাসিমস্করা সহ্য করে তিনি বেগম এনেছেন… নিজের ঘৃণ্য অতীতকে নিয়ে সে লজ্জিত নয়! তিনি নিজে যে এত রকম ব্যঙ্গ বিদ্রুপ সহ্য করে, নিজের মর্যাদার বিন্দুমাত্র খেয়াল না করে মেরীজানকে বিয়ে করে আনলেন, তার কী দাম দিল বেগম? বাজারো অওরতের দল, খয়েরের লালে ঠোঁট রাঙ্গিয়ে, আতর সুর্মা লাগিয়ে, একদম বদনের সাথে চেপে বসা পেশোয়াজ পরে হয় গান গাইত কোঠায়, বা নাচের তালিম নিত। এদিক ওদিকে সারেঙ্গি খোলা পড়ে থাকত, তবলচির তবলায় জমে থাকত সফেদ গুঁড়া। তবু সব বিরক্তি ছাপিয়ে যখন একটা মুখ ফুটে উঠত চোখের সামনে, হিউ সব ভুলে যেতেন। একটা কমসিন মজবুর মুখ, চোখের জলে ভেসে যাওয়া সুন্দর বদন, নীল চোখের মণিতে বেহত মাসুমিয়ত। এই নাজুক ফুলের কলিকে পচাগলা দোজখ থেকে বার করে আনার এই নতিজা! সে নিজেই জানে না সে কোথায় পড়ে ছিল!

বেগমের দিকে তাকিয়ে হিউ ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন। বললেন, “তাহলে বড়াখানায় মুজরার সময় কাঁদছিলে কেন? এতই যখন ইজ্জতের জীবন তোমাদের?” মেরীজান আকাশ থেকে পড়লেন, বললেন, “নর্গিস খানম আপনাকে কিছু বলেননি! আমি তো নাচ নয়, কবিতাতেই জিন্দেগি খুঁজে পেয়েছিলাম হুজুর। গুস্তাকি আমার… কোঠার নিয়ম ভেঙেছিলাম। আমার দ্বারা নাচগান হবে না জানতাম, কিন্তু তাতে পেট তো চলে না! নার্গিস খানম এতদিন টেনেছেন… এত বড় কোঠা এরপর কে চালাবে?” একটু থেমে মেরীজান হিউয়ের হাতটাকে আবার নিজের হাতের মধ্যে জড়িয়ে চুম্বন করলেন। “এই সময়ে আপনি ফেরেস্তার মত আমার জিন্দেগিতে এলেন… আমার কবিতা শুনলেন, আমাকে শোনালেন। আমি কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি আমার শখ এভাবে পুরা করবেন আল্লাহ রসুল। আপ মুঝসে নিকাহ কিয়ে, আপনার জিন্দেগি আমি তমাম খুশিতে ভরিয়ে তুলব… যতদিন আপনি আমায় রাখবেন ততদিন আপনার কোনও খিদমতগারির কোনও কসুর হবে না জনাব। অদা, নজাখত, তহজিবে আপনি কোনও কমতি পাবেন না।” মেরীজানের কথা শুনে হিউ ঘেন্না পেলেন। অদা, নজাখত, তহজিব লোকে বাজারের মেয়েতে খোঁজে, নিজের বউয়ের মধ্যে সেই বাজারি গুণগুলো থাকা বড় ঘেন্নার, বড় শর্মিন্দগির ব্যাপার।”

আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল। জিল্লতের জীবন… অপমানের জীবন, কষ্টের জীবন থেকে কে যেন আমাকেও মুক্তি দেবে বলেছিল! তমাল কি? মাথার মধ্যে একটা বাল্ব চিড়িক চিড়িক করে উঠল। একটা পুরোনো বাড়ির টিনের পুরোনো চালওয়ালা ঘরে যেমন ষাট ওয়াটের বাল্বটা মাঝে মাঝে চিড়িক চিড়িক করে উঠত। মুখগুলো অস্পষ্ট মনে পড়ছে। হাসপাতালে দেখা মুখগুলো। মা জোরে জোরে বাবাকে বলছে, “শুনছ… এটাও কাটবে খুব শিগগিরি।” বাবা শুনেও না শোনার ভান করে মন দিয়ে সাইকেলের চাকায় তেল দিচ্ছে। আমি লাইব্রেরী থেকে তুলে আনা বই পড়ছি, ভেতরের ঘরে দাদা মাথার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ওর আওয়াজ শুনতে পাই এখনও চোখ বন্ধ করলে। বলছে, “মীনু, সামনের মাসে আবার রক্ত লাগবে দিতে। পারবি তো জোগাড় করতে?” থ্যালাসেমিয়ায় ভোগা ওর শীর্ণমুখ, ঠোঁটের কষের পাশে শুকিয়ে থাকা লালা, ওর জ্বলজ্বলে চোখ, সরু কন্ঠা… আর ঠোঁটের ফাঁক থেকে উঁকি মারা দাঁতগুলো… ওকে কাউন্ট ড্রাকুলার মত লাগছে। প্রায় প্রতি দু তিন মাস অন্তর লাল রঙের ঘন তরলটাকে ওর শরীরে সুঁচ বিধিয়ে ঢোকাতে হয়। মায়ের হাতে একটা জগন্নাথের ছবি ছাপা পার্স, তার ভেতর থেকে জল, ঘাম লেগে দুমড়ে থাকা কটা পঞ্চাশ একশ টাকার নোট। রোজ রাতে একবার করে গোনে আর রাখে। কখনও কখনও রাতের বেলা ঘুম ভেঙে দেখি আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমার শক্তপোক্ত শরীরের গড়ন, সবল মাংসপেশী সেই দৃষ্টিতে গলতে থাকে। কোন জাদুবলে ছোট থেকে বাড়িতে আসা একটামাত্র মাছের টুকরো, এক গ্লাস দুধ খেয়েও দাদার হাড়গোড়গুলো এমন শুকনো প্যাকাটির মত, চামড়ার তলায় বইতে থাকা রক্তের ধারা এমন ঘুণ লাগা, সেটাই বোঝার চেষ্টা করে হয়তো।

মাথার মধ্যে বাল্বটা সমানে অন অফ হচ্ছিল। তারপর হঠাৎ অপারেশন থিয়েটারের সামনে জ্বলতে থাকা বাল্বের মত কটকটে লাল হয়ে জ্বলতেই থাকল। আমার মাথায় ঝনঝন শব্দ হচ্ছিল। স্টিলের র্যাক থেকে একসাথে অনেকগুলো বাসন পড়ে যাচ্ছিল, অনেকগুলো লাল বল মাটির মধ্যে নিজেদের মত ছোটাছুটি করছিল, ছেঁড়াখোড়া কত কাগজ মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল… এত অগোছালো, এত পরিষ্কার কেন চারপাশ! নোংরা কাদা, পিচ্ছিল ড্রেনের পাঁকের মধ্যে আমার পা আটকে যাচ্ছিল। ফ্যাসফেসে গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, “তারপর কী হল মেরীজানের?”

“মেরীজান হারিয়ে গেল। আকাশে যে তারারা ঘর বেঁধে থাকে… তাদের মধ্যে অনেক ফাসলা থাকে, লখনউ জুবানে আমরা বলি কহেকশা। মেরীজান আর হিউ রিচার্ডস শায়দ এমনই কহেকশা দূরে চলে গেলেন… যে আর কাছে আসা নামুমকিন হয়ে গেল। যে নাপাক জীবনকে সে পিছনে ফেলে এসেছিল, রেখতির সুরে, গজলের লয়কারীতে ভুলে পুরোনো যে জীবনকে সে ভেবেছিল হারিয়ে দিতে পেরেছে… কয়ামতের মত আবার ফেরত এল সে জীবন। আকাশে উড়তে থাকা পরিন্দার পায়ে বেড়ি পরিয়ে তাকে যতই বলো, জিন্দেগি খুবসুরত হ্যায়, বেহতরীন হ্যায়… তার বুঝতে কি কিছু বাকি থাকে অসলিয়ত কী! তার বদ-নসিবি তাকে খিদমদগার হতে শিখিয়েছিল, বিবি নয়। হিউ রিচার্ডসের বেগম হতে গেলে যে তাকে তার সবকিছু ছেড়ে দিতে হবে, পোষাক বদলানোর মত তার নিজের চামড়ার ভেতরে বাস করা রুহ্কেও বদলে দিতে হবে, ধীরে ধীরে মেরীজানও সেটা বুঝতে পারল। কোশিশ করেছিল, শোহরের মত করে নিজেকে গড়ার… কিন্তু যখন মানুষের অন্তর বিষিয়ে যায়, তার খুন বিষিয়ে যায়, ইমান বিষিয়ে যায়… তখন কোনও ওষুধ কাজে লাগে না।”

“হিউকে ছেড়ে চলে গেলেন না কেন? তুমি যে বলেছিলে নবাব সাদাত আলি খানের দরবারে তার লেখা রেখতির প্রশংসা হত? তার অন্য একটা জীবন গড়ে তোলার সুযোগ ছিল?”

আরশিন বলতে থাকল, “হ্যাঁ হত, সাদাত ইয়ার খান নবাবকে মেরীজানের লেখা পড়িয়ে শুনিয়েছিলেন। নবাব বাহাদুরের দরবারে তার রেখতি তখন কদর কুড়াচ্ছে। বড়াখানায় দাওত পেয়েছেন রেখতি পড়ে শোনানোর। লেকিন তমাম দুনিয়াকি অওরতোকো কিসনে মারা মালুম? ইশক নে নহি, ইশক কী উমিদ নে। সময় খারাপ যাচ্ছিল। মেরী তখন দর্দমন্দা কাটানোর জন্য আরও বেশি বেশি করে আঁকড়ে ধরছেন রেখতি, ভাবছেন যে কবিতা কাছে এনেছে সেই সব ফাসলা কমিয়ে দেবে। কিন্তু কিসমত! নিকাহর আগে যে রেখতি শুনে মুগ্ধ হতেন হিউ, এখন বেগম সেগুলো পড়ে শোনালে মনে হত কেউ বিষ ঢালছে কানে। সোজাসুজি বেগমকে বলতে পারেন না, যে রেখতি লিখো না। মেরীর চোখে ছোটও হতে চান না, আবার তাকে সহ্যও করতে পারেন না।”

…সহ্য করতে পারে না… আমিও কাকে বেশ সহ্য করতে পারতাম না! কাকে যেন ধাক্কা মেরে… তারপর প্রচুর রক্ত… ব্যথা… অন্ধকার। আলোর পর্দাটা আস্তে আস্তে উঠছিল চোখের সামনে থেকে। ভয়ানক কোনও সত্যের মুখোমুখি হতে গিয়ে আমার গলা শুকাচ্ছিল।

আরশিন বলতে থাকল, “বেগমের সঙ্গে হিউ যখন হমবিস্তর হতেন, মনে করতেন আরও পয়সাআলা কোনও রইস এলে অবলীলায় মেরীজান তার সাথে পালিয়ে যাবে। শেরশায়েরি, রইস ইয়ার… গুলচ্ছরা… বদসলুকি সব তখন একই শব্দের আলাদা নাম। রেসিডেন্সির অফিসাররা তখন তার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসবে। মনে মনে বলবে, ‘দ্য ফুলিশ অফিসার’! কত টাকা বেওকুফ হিন্দোস্তানী বজারি অওরতের পিছনে খরচা করেছে! হয়তো তাদের মধ্যে কেউ কেউ মেরীজানের আশিকও হয়ে যেতে পারে। রাতের বেলা দুঃস্বপ্ন দেখতেন, ভরা মহফিলে নঙ্গা হয়ে মেরীজান নাচ দেখাচ্ছে, হাজারো আশিক তার আশে পাশে ঘুরঘুর করছে। বেগম কবিতা পড়ছে, গান গাইছে… হজার হজার অসরফি পায়ের কাছে জমা হচ্ছে তার। দিনরাত বদখোয়াব দেখতে দেখতে হিউ পাগল হয়ে গেলেন। মেরী সুরাপানের সময় খিলখিলিয়ে হেসে উঠলে… হিউ চোখ কুঁচকে তাকাতেন। চারপাশে কারা যেন ভিড় করে তাকাচ্ছে তার বেগমের দিকে! কারা যেন চোখ দিয়ে চেটেপুটে নিচ্ছে তার শরীর। পল্লু হাওয়ায় সরে গেলে ভাবতেন বেপর্দা নারীর বদতমিজ আদত! হাল এমন হল, একটা অওলাদ হওয়ার পরও পরিস্থিতি পাল্টাল না।”

“মেরীজানের বাচ্চাটার কী হয়েছিল আরশিন? দুধ খেতে গিয়ে মারা গিয়েছিল?” গলাটা অজান্তেই কেঁপে উঠল আমার।

আরশিন আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই ঘড়িতে ঢং ঢং করে নটা বাজল। আর নটা বাজার সাথে সাথেই কারেন্ট চলে গেল। আরশিন আসার পর থেকেই মিতুল এদিক ওদিক ঘুরছিল। ওকে চুপ করে আরশিনের পাশে বসিয়ে রেখে ভূতগ্রস্থের মত ক্যান্ডল খুঁজে আনতে গেলাম। কিচেনে সার সার দেওয়া জলের বোতলে জল ভরা, মোবাইলের লাইটে একঝলক সেদিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। জল নয়, কে রক্ত ভরে রেখেছে ওদের ভিতর। মাথার ভিতর বাল্বটা আবার নিষ্ঠুরের মত দপদপ করছিল। শিশুচোখ, খিলখিল হাসি, উচ্চস্বরে গাওয়া নার্সারি রাইমস, আর তারপর হঠাৎ কানফাটানো শব্দ, বধির করে দেওয়ার মত কান্নার আওয়াজ… চাপচাপ রক্ত, ঝুরো ঝুরো মাটি… আমার পৃথিবী টলছিল। কোনওমতে ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে নিয়ে ফিরতে গিয়ে নাকে একটা গন্ধ এসে ঠেকল। মিঠা আতরের গন্ধ। মেরীজান আমার পাশে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন কি! অবশ্য আরশিনের শরীর থেকে একই গন্ধ আসে! কানে একটা পরিচিত টুংটাং শব্দ এল। মনে হয়, মিতুল আরশিনকে ওর জাদু বাক্স খুলে দেখাচ্ছে। ঘরে চওড়া আলমারিটার পাশের সোফাটায় আরশিন মিতুলকে নিয়ে বসেছিল। মোমবাতির আলো আঁধারিতে মাটিতে আলমারিটার ছায়া পড়েছিল। মনে হচ্ছিল যেন সাক্ষাৎ জল্লাদ দাঁড়িয়ে আছে ঘরে। আলমারির ছায়াটা পেরিয়েই দেখলাম আরশিন নেই, মিতুল একা সোফায় বসে আছে। বাইরের গেটটা খোলার আওয়াজ পেলাম। জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম, তমাল ঢুকছে। মিতুল বাক্সটার আয়নায় কী যেন দেখে আলতো হাসছিল। জিজ্ঞাসা করলাম, “মিতুল, অ্যাঞ্জেল কোথায়?” মিতুল উত্তর দিল না, সামান্য হেসে বাক্সের ভেতরকার আয়নার দিকে তাকাল। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল! আবার ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “মিতুল, আরশিন কোথায়?” মিতুল হাত বাড়িয়ে টেবিলটার দিকে তাকাল। বেগম মেরীজানের ডায়েরিটা সেখানে খোলা পড়েছিল। সেটায় চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম, যে ডায়েরির পাতায় পাতায় মেরীজানের নিজের হাতের লেখা অসংখ্য শব্দ দেখেছি, কবিতা দেখেছি, সেই ডায়েরি ফাঁকা, একদম শূন্য। হাওয়ায় পাতাগুলো ফরফর করে উড়ে গেল, একটা শুকনো বেগুনী ফুল পাতার মাঝখান থেকে ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল। মিতুল পাশ থেকে বলে উঠল, “অ্যাঞ্জেলরা সত্যি থাকে মা! জাদুই দরজা খুলে ওরা যখন তখন আসতে পারে!”

আট

বিছানাটায় যেন কেউ বরফ ঢেলে দিয়েছে আমার। বহুক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম। শিরশিরানি অনুভূতিটায় ঘুম ভেঙে গেছে। মাথার কাছে আরশিনের ডায়েরিটার পাতা ফর ফর করে উড়ছে। পুরোনো কালি, আতর আর মাথার তেলের একটা গন্ধ মেশানো একটা মেয়েলি গন্ধ ডায়েরিটার পাতায় পাতায়। পাশেই মিতুলের জাদু বাক্স রাখা। দূরে কোথা থেকে একটা একঘেয়ে তানে কে অনেক কথা বলে যাচ্ছে… চেনা সুর, চেনা শব্দ। মাথার স্নায়ুগুলো এমন জট পাকিয়ে আছে যে বুঝতে পারছি না! মনে পড়েছে… নামাজের আজান ভেসে আসছে হাওয়ায়। কটা বাজে… ফজরের আজানের সময় হল কী! গায়ে হাতপায়ে অসহ্য ব্যথা। কেউ কোথা থেকে যেন জোরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে আমায়। ‘আহ্, মাথায় বড্ড কষ্ট।’ একতাল ব্যথা দপদপিয়ে আমার ঘাড়ের কাছে, কাঁধের কাছে রাজত্ব করছে। ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিটাও চাগাড় দিয়ে উঠছে, কবেকার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে! স্মৃতিদের ঠিকানাগুলো বড় বিচিত্র না! ম্যাথিউ গডম্যানের বইটায় লেখা আছে, আমরা জোর করে, পরিশ্রম করে যা মনে রাখতে চাই তা আদৌ আমরা মনে রাখি না। আর যা চাই না? থাক, সে কথায় নাহয় পরে আসা যাবে।

সিলিংয়ের পাখাটা কটকট করে ঘুরে উঠল। খাটের পাশে দেরাজের উপর রাখা জলের বোতলের জল অস্বাভাবিক ঠান্ডা। আমার বেণী নন্দন স্ট্রিটের বাড়ির চৌবাচ্চার জলটাও ঠান্ডা ছিল ওরকম। পুরোনো দিনের বাড়ি, নাহলে আজকাল চৌবাচ্চায় কে জল রাখে? আমার অবশ্য ভালোই লাগত। গরমকালে চৌবাচ্চার জমানো ঠান্ডা জলে স্নান করে কত সুখ! বিয়ের পর পর বেশ কয়েকবার ওই জলে স্নান করে শরীরের জ্বালা জুড়িয়েছি। পরে অবশ্য ওটা অন্য কাজে লাগত। তারপর থেকে সেই যে ঠান্ডা জলে ভয় ধরল, এখনও অবধি গেল না। তবে ভয় পেয়েও যে মানুষ বাঁচতে শেখে, ভয়ের কারণকে প্রতিরোধ করতে শেখে তা আমার চারবছরের সন্তান আমায় সেদিন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। মেহেন্দি রঞ্জিত হাতের সাথে রক্ত লাগা হাতের কোথাও মিল খুঁজে পেয়েছিল নিশ্চয়ই। মেহেন্দির রঙের সাথে রক্তের যে কোনও সম্পর্ক নেই, সেটা কি আর কোনওদিন বুঝবে আমার সন্তান? তার জীবনের ক্যানভাস থেকে লাল রঙ চিরদিনের মত বাদ দিতে হবে? তবে, আবিদার হাতে পেনসিল ফুটিয়ে দিয়ে সে সেদিন আমায় বুঝিয়েছে, বিপদের একটু গন্ধ পেলেও কেমন করে ঝাঁপিয়ে নিজেকে বাঁচাতে হয়।

বিছানার কনকনে ভাবটা বাড়ছে। পাশেই মিতুল নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। ওর নিশ্চয়ই এতটা ঠান্ডা লাগছে না, যতটা আমার লাগছে। আমার সন্তান কি জানে তার মায়ের স্বপ্নে সেই ডেমনিক ডোর দিয়ে আসা ডেমনেরা বিদায় নিয়েছে চিরতরে! হয়তো ওর স্বপ্নেও ডেমনরা ভিড় করে না আর। কী জানি! মিতুলকে কোনওদিন সাহস করে জিজ্ঞাসা করতে পারিনি, ‘মিতুল ওরা তোমায় কীভাবে ভয় দেখায়?’ রক্তমাখা মুখের ভামটা তোমায় গিলে খেতে আসে মিতুল? নাকি নরম তুলতুলে মাছটাকে চিবাতে চিবাতে তোমার দিকে বরফঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থাকে? আর, মাটির তলা থেকে গলিজ ইঁদুরগুলো, ওরাও কি আমার স্বপ্নের মতনই তোমার হাতপায়ে ধারালো দাঁত বসিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে তোমার শরীর? তুমি চিৎকার করো না কেন, মা? নাকি জানো, চিৎকার করলে ডেমন আরও রেগে যাবে? তারপর সিঁড়ির কাছটায় গিয়ে… জানি না সোনা মা! তুমি ঘুমাও, এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাও।

স্বপ্নগুলো বিদায় নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওদের কাছে আমার অনেক ঋণ। ওরা না আসলে আমার অতীতের সাথে আমার বর্তমানের যে সূক্ষ্ম সংযোগটা ছিল, তা তো বুঝতেই পারতাম না। অবশ্য তার চেয়ে অনেক বেশী ঋণ আরশিনের কাছে। ও না থাকলে হয়তো আজ…

একটু পরেই সিঁড়ি দিয়ে একটা আলতো পায়ের শব্দ পাব, ধীরে ধীরে পোষাকের খসখস শব্দে, আতরের গন্ধে ভরে উঠবে আমার বেডরুম। তার আর তার সন্তানের খিল খিল হাসির শব্দে আমার ঘুমের ঘোর কেটে যাবে। পর্দার ফাঁক গলে দুধের সরের মত চাঁদের আলো পড়বে আমার বিছানায়। নিজে থেকেই মিতুলের জাদু বাক্সের ঢাকনা খুলবে। তারপর মিতুলের মত আমিও চার বছরের মেয়েটি হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত বায়োস্কোপ দেখব। নির্বাক নয়, সবাক ছবি। কাল যেমন স্পষ্ট অনুভব করেছিলাম, তার মাথা ভর্তি লালচে চুলে বিনুনি হয়ে নেমে এসেছে কোমরের নীচ অবধি। জড়োয়ার লম্বা দুল কানের লতি থেকে ঝুলে কাঁধ ছোয় ছোয়। সলমা চুমকির পোষাকের রঙ গাঢ় বেগুনী। এ বেগুনী আমি চিনি… এর আগেও এই পোষাকে তাকে আমি দেখেছি স্বপ্নে, বেগুনী পেশওয়াজ পরে জমাট কুয়াশার মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে থমকে দাঁড়িয়েছে আমার বাড়ির সামনে। তার মুখ পরিষ্কার দেখিনি কখনও, শুধু কুয়াশার অপর পার থেকে তার দুখানি সুর্মা লাগা চোখের দৃষ্টি জ্বলজ্বল করে উঠেছে। কত কী যে সে আমায় বলতে চেয়েছে! আজ শুধু মুখ নয়, তার সম্পূর্ন অবয়ব দেখতে পাচ্ছি আয়নায়। স্পষ্ট, আয়নায় সূর্যের আলো লেগে ঝিকমিক করে ওঠা জলের ফোঁটার মত। তার কফিনে তখন শেষ পেরেক পোঁতা হয়ে গেছে।

লখনউয়ের রেসিডেন্ট হিউয়ের সম্পর্কে লর্ড ওয়েলেসলীকে জানিয়েছেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সর্বেসর্বা মোটেই ভালোভাবে নেননি ব্যাপারটা। নবাবের ফৌজে ইংরেজ অফিসার নিয়োগ বারণ যেখানে, আওয়াধের রাজপরিবারের সঙ্গে ব্রিটিশ সামরিকবাহিনীর মেলামেশা নিষেধ যেখানে, সেখানে সামান্য ফার্স্ট অফিসারের কী করে সাহস হয় মুসলিম এক মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য রেসিডেন্সি ছেড়ে চলে যাওয়ার! নবাবী দরবারের সাথে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কেন হিউ রিচার্ডসের বেগমের? হিউ ফুঁসছেন, রেসিডেন্সিতে প্রতিনিয়ত তাকে প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার হতে হচ্ছে। কোর্টমার্শালের সম্ভাবনা আছে নাকি বুঝতে পারছেন না। দিন দিন মেরীজান অসহ্য হয়ে উঠছেন। হিউ যে তাকে পছন্দ করেন না, তিনি কি তা বুঝতে পারেন না? একবছরের ছেলেটার চোখে সুর্মাকাজল লাগিয়ে তওয়ায়েফের ছেলেদের মত সাজিয়ে রাখেন। তাকে কবিতা পড়ে শোনান… পোয়েট্রি! হর্স শিট! কোনও এক কালে হিউ তার সন্তানকে ব্যাপটাইজ করার স্বপ্ন দেখেছিলেন, বেশিদিন এই মহিলার সঙ্গে থাকলে ছেলেটাও এই নোংরা দেশের নোংরা লোকগুলোর মত চোখে কাজল লাগিয়ে, হাতে মেহেন্দি আর চমেলীর মালা নিয়ে ঘুরে বেড়াবে রাস্তায় রাস্তায়। মেরীজানকে ছেড়ে দিলে তার সঙ্গে বাচ্চাটাও যে… আর ছেড়ে দিলে তারপর কী! কনকিউবাইনের পেশাটাকে বেছে নেওয়া ছাড়া আর কীই বা উপায় আছে ওর কাছে? হিউ রিচার্ডস… দ্য একস্ হাসব্যন্ড অফ মেরী রিচার্ডস, দ্য ফেমাস হোর ইন দ্য টাউন! কোনটা সম্মানের বেশি, চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরে যাওয়া নাকি এদেশেই থেকে এই অপ্রতিরোধ্য নিয়তিকে মেনে নেওয়া? আর এই সম্ভাবনার মধ্যে যদি কোনওটাই পছন্দ না হয় তবে কী করবে মানুষ?

উত্তরটা আমি জানি । জানলেও… আজ তার আসার জন্য আরেকটু অপেক্ষা করি… বাতাসে তার শরীরের গন্ধ আরেকটু মিশুক। জ্যোৎস্নার টুপটাপ ঝরে পড়ার মত তার বলা শব্দেরা আমার চারপাশে ঘুরে বেড়াক। দোতলার জানালার ফাঁক দিয়ে বিরাট দেবদারু গাছের পাতার আড়ালে ছায়াকীর্ণ জ্যোৎস্নায় আধো আবছা…আধো স্পষ্টভাবে সে দেখা দিক আমায়। আরশিন অদা উর্ফ বেগম মেরীজান… কাছে, দূরে যেখানেই তুমি থাকো, ক্ষণে ক্ষণে একটাই বাক্য কানে বাজুক আমার, “ইশক সে জাদা ইশক কী উমিদ নে মারা হামকো”। তোমার দীর্ঘশ্বাসের শীতলতায় আমার হাত পা ঠান্ডা হোক, আমি বাকরহিত হই। হঠাৎ হাওয়ার দমকে ডায়েরির পাতাগুলো উল্টেপাল্টে যাক। তারপর নাহয় সুস্থিরে জাদু বাক্সের ঢাকনা খুলে বায়োস্কোপ দেখব। কিন্তু এত দেরী করছ কেন আজ তুমি? শেষ প্রতিশ্রুতি পালন করে যাওনি এখনও পর্যন্ত। কাল ফিসফিস করে কানে বলে গিয়েছিলে, “আর সময় নেই মীনাক্ষি! তুমি তোমার কথা রেখেছ, আমি আমারটা রাখব।” কিন্তু কোথায় তুমি! সিঁড়িতে ও কার পায়ের শব্দ শোনা যায় তবে? ভীতসন্ত্রস্থ তটস্থ ভঙ্গিতে সে পাদুটো এগিয়ে আসছে আমার ঘরে।

“আপা!” আবিদার গলার শব্দ। চাপা গলায় ও ডাকছে আমায়। দরজা খুলে বেডরুমের বাইরে দাঁড়াই ওর কথা শোনার জন্য। “পুলিশ এসেছে, আপনাকে ডাকছে।” আবিদা দুদিন ধরে আমার কাছেই আছে, বাড়ি যায়নি। “পুলিশ? কোথায়? নীচে?” মিথ্যা বলব না, গলাটা একটুর জন্যও কেঁপে উঠল আমার। খুন করে লোকে বড় তাড়াহুড়ো করে ফেলে, কই আমি তো তা করিনি! অবশ্য আবিদা না থাকলে হত না। ধীরে সুস্থে তমালের ছোটখাট শরীরটাকে দুজনে মিলে টানতে টানতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামিয়ে নিয়ে গেছি দুজনে। তমালের মুখটা তখনও হাঁ করে ছিল, হয়তো ছয় বছরের পুরোনো বৌয়ের হঠাৎ খুন করার দুঃসাহস কী করে গজাল, সেই ভেবে মুখটা বন্ধ করেনি ও! কিছু করার ছিল না, এবারের বেলায় মিতুলকে নাহলে বাঁচাতে পারতাম না। ঠিক চারমাস আগেই আরেকজনকে হারাতে হয়েছে যে আমায়। ওই যে যার ব্যবহার করা জামাকাপড়, খেলনা যত্নে গুছিয়ে গোলাপি নীল ডোরাকাটা ব্যাগটায় ভরে মিতুল আগলে রাখে, ওই যে যার জন্য মিতুল আর আমি একসঙ্গে ল্যাভেন্ডারস ব্লু ডিলি ডিলি গাইলে সে সদ্য ফোঁটা সূর্যমুখীর মত মাথা নেড়ে নেড়ে মাথা দোলায়… দোলায়? না, ভুল বলছি। দোলাত! হাসি, কান্না, আনন্দ, সব অনুভূতিই বড় মুখর ছিল তার। না হলে, তমালের পাঁচ আঙুলের চাপে যখন দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার, হয়তো রিফ্লেক্সেই হাতটা পড়ে গেছে রান্নাঘরের বাসনগুলোর উপর, ঝনঝন শব্দে কেঁপে উঠেছে পুরোনো দোতলা বাড়িটার কড়িবর্গা, তখন তিন বছরের হাতটা কখনও তুলে নেয় সরু খুন্তিটা? কখনও জন্মদাতার পিঠে বার কয়েক মেরে মুখ দিয়ে শব্দ করে বলে, “গুপ, গুপ, গুপ?” চৌবাচ্চার ঠান্ডা জলে শীতের রাতে ওকে চোবাতে চোবাতে তমাল কেমন শীতল চোখে দেখত আমায়। নির্বাক শাস্তি আমার! অপরাধের ছুতো অনেক, শাস্তির পদ্ধতি ওই একটাই! ঘুম থেকে বাচ্চাদের তুলে চৌবাচ্চার ঠান্ডা জলে… মুখরতা কোনও দিনই বেশি পছন্দ ছিল না তমালের। ছোটটার জেদ ছিল খুব, হার মানেনি সে। তাই সেদিন তমালের শক্ত হাতের মুঠোয় ওর নরম হাতদুটো চেপে পিষে গিয়েছিল, না, তবে বেশীক্ষণ কষ্ট পেতে হয়নি। দম নিতে নিতে রান্নাঘর থেকে শুনলাম একখানা শব্দ, “দমাস”। তারপর… তারপর কিছু মনে নেই আর… শুধু সিঁড়ির নীচে থোলো থোলো রক্ত, ল্যান্ডিং এ দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকা রক্তচক্ষুর তমাল, ওর পায়ের কাছে বিস্ফারিত চোখে বসে থাকা মিতুলকে ছাড়া। তারপরেই সিঁড়ি দিয়ে ছুটতে ছুটতে নামতে নামতে একটা বিশাল জোরে ধাক্কা… কখন যেন অন্ধকার নেমে এসেছিল আমার চোখে!

সেদিন এল আই সির কাগজটা খুব শান্ত ভাবে ওর হাতে ধরিয়েছিলাম। ক্লেম সার্টিফিকেটে জ্বলজ্বল করছিল একটা নাম, সুতীর্থ মিত্র, সান অফ তমাল অ্যান্ড মীনাক্ষি মিত্র। বারিয়াল গ্রাউন্ডের কাগজ ছাড়া ক্লেম সেটল করা যাচ্ছে না, জানিয়েছে এল আই সি। পলকের মধ্যে মুখোশটা খুলে ফেলেছিল ও! অবশ্য মুখোশ শুধু আমার সামনেই পরত ও। মিতুলকে ভুলিয়ে ভালিয়ে দূরে নিয়ে গিয়ে ভয় দেখানো চলত বহুদিন ধরেই।

“মাকে ঠেলে ফেলে দেব আবার! মাথা থেকে অনেক রক্ত বেরোবে, এবার আর হসপিটাল থেকে ফিরবে না! বল, ভাইয়ের কথা বলবি না তো মাকে? নইলে কিন্তু…” কাল রাতে ডেমনটাকে চোখের সামনে মরতে দেখে মিতুল তার দেখা সত্যি ডেমনের বলা কথাগুলো বলেছে আমায়। আমি সিওর মিতুলকে কথাগুলো বলেই ওর পৈশাচিক সেই হাসিটা হাসত তমাল। যে হাসিটার ভয়ে মিতুল সিঁটকে থেকেছে এ কদিন, বলার ইচ্ছা থাকলেও ভয়টা পাথরের মত বুকে চেপে বসেছে ওর… সেই হাসিটাই দিনের পর দিন সহ্য করে তমালের মুখটাকে ভামের মত লাগত আমার। আমার স্বপ্নে ভামেরা আসত অনেক আগে থেকেই। সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে গিয়ে আমার অতীতের নিরুদ্দেশ হওয়ার অনেক আগে থেকেই। ও হাসলে পরে মনে হত, খাবলিয়ে খাবলিয়ে খাওয়া মাছমাংসের টুকরো লেগে আছে ওর দাঁতের ফাঁকে। মিতুল আর বুবলাই, আমার ছোটটা কেমন যেন পিছলে পিছলে যেতে চাইছে ওর মুখের ভেতর থেকে… উফ! কী দুর্গন্ধ চারিদিকে! মিতুল চুপ করে থাকতে শুরু করল একদম, আমার মতন সতর্ক, সজাগ ঘুমে অভ্যস্ত হয়ে গেল ও ও। কে বলতে পারে, চোখের পাতা লেগে গেলে, কখন অজান্তে গলায় বসে যায় কোনও হিংস্র পশুর দাঁত!

নীচের বেলটা বারবার বাজছিল। অধৈর্য হয়ে পড়েছেন অফিসার। কোনও কাজকে নিখুঁতভাবে পরিণতি দিতে হলে, তাড়াহুড়ো নৈব নৈব চ। আবিদা বলেছিল ছ-ফুট গর্ত খুঁড়লেই হয়ে যাবে। দফনের মাটি কত গভীর হয় তার সম্পর্কে ওর ধারণাটা কাজে লেগেছিল খুব। সারা রাতের চেষ্টায় দুজন মিলে গর্ত একটা বানিয়ে ফেললাম ঠিকই, কিন্ত তমালকে কবর দিতে দিতে ভোর হয়ে গেল। কুয়াশাঘেরা সেই সকালে তাও যে কে দেখে ফেলল! পুলিশ কত তৎপর, সত্যি! ভেবে হাসি পাচ্ছিল। নাহলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর একটা মিনিমাম পুলিশ কমপ্লেন তো হয়েছিল নিশ্চয়ই । কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল ঘটনাটাকে… জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট বলে? যাক… এ পৃথিবীতে সব ঘটনাই ‘জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’। আবিদার আমার প্রতি সমব্যথী হয়ে ওঠাটাও যেমন একটা অ্যাক্সিডেন্ট। তমাল তো বেশ কিছু টাকা দিয়ে ওকে রেখেইছিল আমার আর মিতুলের উপর নজর রাখার জন্য। কলকাতায় থাকাটা নিশ্চয়ই সেফ ছিল না, কে জানে কখনও কোনওভাবে যদি জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্টের থিয়োরির ময়নাতদন্ত করে কেউ। যদি কখনও, মিতুল স্কুলে মুখ খুলে ফেলে।

মিতুলকে ভয়ই পেত তমাল। এত শাসানিতেও যদি ও না ঘাবড়ায়। তাই চৌবাচ্চার কাছে নিয়ে গিয়ে কোনওভাবে লোভ দেখানোর চেষ্টা করেছিল কি? বলেছিল কি, জলের নীচে সাত রাজার ধন, এক মাণিকের মত গুপ্তধন লুকিয়ে আছে! একবার নিঃশ্বাস চেপে ডুব দিলেই, হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের কাছে পৌঁছে যাবে মিতুল! মিতুলকে জিজ্ঞাসা করিনি সেকথা। ওর গায়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে খালি অনুতাপে পুড়ে ছাই হয়েছি… পালাইনি কেন আমি আগে? কেন আমিও সব ঠিক হয়ে যাওয়ার মিথ্যে আশা বুকে নিয়ে দিনের পর দিন আমার সন্তানদের জীবনের সাথে ছিনিমিনি খেলেছি? আরশিন বলেছিল, পাপের শাস্তি! তা পেয়েছি বটে! কলকাতার কোনও নাম না জানা বারিয়াল গ্রাউন্ডের চারফুট মাটির নীচে শুয়ে বুবলাই নিশ্চয়ই এখন তার সুগন্ধ বিলোয়। আর সেই সুগন্ধে মাতাল হয়ে সুড়ঙ্গ থেকে হাজারে হাজারে মেঠো ইঁদুরের দল উঠে আসে তার কবরে, তার গমরঙা নরম চামড়ায়, ছোট্ট গোল নাকে, গোলাপী ঠোঁটে, বোজা চোখের পাতায় কামড় বসায় অক্লেশে। আর হয়তো তাদেরই কেউ কেউ আমার স্বপ্নে ভিড় করে, আর আমার রক্ত চামড়া ভেদ করে আমার পাপের বিষ ঢুকিয়ে দেয় শরীরে। ইঁদুরের স্বপ্নটা সারাজীবন এখনও দেখে যেতে হবে আমায়।

নয়

‘ইন্সপেক্টর ইমরান আহমেদ’— বুকের নেমপ্লেটটা আলো পড়ে চিকচিক করছিল। সুদর্শন পুরুষ, ভুরু কুঁচকে প্রচুর প্রশ্ন করলেন। পিছনের জমিটা সরেজমিনে তদন্ত করতে চান। ওয়ারেন্ট নিয়ে এসেছেন একেবারে। বুক ঢিপ ঢিপ করছিল আমার। পিছনের বাউন্ডারি ওয়ালের থেকে সামনে চার পা হাঁটলেই বুঝতে পারবে মাটিটা তাজা খোঁড়া হয়েছে। তারপর কোদাল গাঁইতির শাই শাই ঠং ঠং শব্দে ঝুরো ঝুরো মাটি সরিয়ে তমালের দুদিনের বাসি শরীরটা উঠে আসবে। বুকের পাঁজরের হাড়ের কাছে বিঁধে থাকা ছুরিটা আর টেনে খুলিনি আমি। আরও রক্তপাত হত নইলে… কী দরকার পরিশ্রম বাড়িয়ে!

ইমরান আহমেদের সঙ্গে আরও দুজন আছেন, একজন এস-আই, আরেকজন কনস্টেবল। আমাকে সঙ্গে নিয়ে ওরা পেছনের জমিটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আরশিন আমায় করা প্রতিশ্রুতি শেষ পর্যন্ত রাখতে পারল না যে। ভয়ে বুক ঢিপ ঢিপ করছিল। আরশিন… কেন সাহস যোগালে… কেন বললে তবে, “যো গুজারি না যায়ে হামসে, হামনে উহ জিন্দেগি গুজারি হ্যায়, বহত শোচকে ফিরভি ইসে গলে লগানা চাহি হ্যায়… মওত কা ইলাজ হো শায়েদ, পর অ্যায় জিন্দেগি তেরি কোই ইলাজ নহি…”

বেঁচে থাকার ইচ্ছাটার যে সত্যিই কোনও ওষুধ নেই আরশিন। তপসিয়ার কবরখানার কাগজটা দেখার পর তমালের চোখে আবার সেই খুনীটাকে দেখলাম। রেগে গেলে ওর রাগটা সবার আগে গিয়ে পড়ত অসহায় বাচ্চাগুলোর উপর। আর রাগ! তার কি কোনও নির্দিষ্ট কারণ ছিল নাকি! কখনও সব্জিতে নুন কম, কখনও ভাত কম সিদ্ধ, কখনও টাকার হিসাব না মেলা, কখনও বাচ্চাদের হইহুল্লোড়ে অসময়ে ঘুম ভেঙে যাওয়া… বড়ই মামুলি কারণ! এবার, মিতুলের মাথাটা নিয়ে গিয়ে দেওয়ালে ঠুকে দিতে চাওয়ার আগেই তাই ছুরিটা ওর বুকে বিঁধিয়ে দিতে একটুও কষ্ট হয়নি আমার।

“জনাব! জনাব!” পুলিশ কনস্টেবল ডাকছে ইমরান আহমেদকে। গলায় বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট। আমাদের আগে আগে এগিয়ে ও পৌঁছে গেছে পিছনের জমিটায়। হয়তো দুর্গন্ধ পেয়েছ কোনও, সদ্য পোঁতা মানুষের শরীর তো! কিন্তু দুর্গন্ধ কোথায়, আমার নাকে পরিচিত গন্ধ আসছে… ঠিক যেমন আরশিনের শরীর থেকে আসত। ইনসপেক্টরের ঘাড়ের উপর দিয়ে অবাক হয়ে দেখি, মাটি কই? খালি জমি কই? দুধসাদা জোৎস্নায় ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে সুরভি ছড়াচ্ছে বেগুনী রঙের অ্যাকোনাইট ল্যাপেলাস, লখনউ জুবানে যাকে বলে মিঠা জহর। আরশিনের প্রতিশ্রুতি মনে পড়ল। “সঠিক সময়ে ফুল পাবে মীনাক্ষি। প্রচুর পাবে, বেশুমার পাবে।” গুগল সার্চ করে দেখেছি, এ গাছের মূল বড়ই বিষাক্ত। সম্ভবতঃ নেপাল সীমান্ত ফেরত কোনও সৈনিকের কাছ থেকে চারাটা নিয়ে এসে লাগিয়েছিলেন হিউ। নবাবী দরবারে স্ত্রীয়ের পরিচিতি থাকলে একটু সাবধানতা অবলম্বন করতে হয় বৈকী! গাঁটের ব্যথা, শরীরের যে কোনও পুরোনো ব্যথা সারাতে সেনাবাহিনীর দেশী জওয়ানরা ব্যবহার করত খুব। তবে বিষক্রিয়া সম্পর্কে কোথা থেকে জেনেছিলেন, তা এতদিন পরে বলা মুশকিল। হয়তো কোনও অভিজ্ঞ সৈনিক সাবধান করেছিলেন তাকে।

“জনাব! এ তো ফুলের বাগিচা আছে! কোথাও মাটি খোড়ারও নামনিশান নেই। ইঞ্চ দর ইঞ্চ ফুলোকা গালিচা বিছায়া হুয়া হ্যায়। উস বুঢ্ঢানে গলত দেখা হোগা সাব। এই জমির পেছনে এত পরিশ্রম করবেন?”

ইমরান আহমেদ ঘুরে ঘুরে দেখছিল চারধার, আমার আর আবিদার দিকে বেশ অনেকবার তাকিয়ে দেখেছে। তবে সবথেকে মজার উত্তর দিয়েছে মিতুল। ঘুম ভেঙে নীচে নেমে এসেছিল ও। ইন্সপেক্টরের প্রশ্নের উত্তরে ও ঠোঁট টিপে হেসে বলেছে, “বাবাকে দেখবে? দেখো না, এই বাক্সের আয়নাটায় চোখ রাখো, ঠিক দেখতে পাবে।” ইমরান ওর গাল টিপে আদর করে দিয়েছে অনেক।

দশ

কাল চলে যাব আমরা লখনউ থেকে। পুলিশের ঝামেলা ঝঞ্ঝাট মিটতে মিটতে একমাস হয়ে গেল। বহু তল্লাশ তদন্ত করেও তমালের দেহের কোনও হদিশ পাওয়া যায় নি, পুলিশের খাতায় তমাল এখন নিরুদ্দেশ। রুহানিয়তের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম আমি! বহুদিন পরে উত্তপ্ত জলের ধারা গাল বেয়ে নেমে আসছিল আমার। দুই শতাব্দীর ইতিহাস বুকে চেপে রুহানিয়তের ভাঙাচোরা ঘরগুলো থেকে দীর্ঘশ্বাসের মত শোঁ শোঁ হাওয়া বইছিল। খড়খড়ি দেওয়া জানালাগুলো হাট করে খোলা, ভেতরে ঘন কালো অন্ধকার ঘুম পাড়ানি গানের মত শান্ত, আলোড়নহীন। বিরাট উঁচু গম্বুজে, খিলানে বট অশ্বত্থের পাতা গজিয়েছে। মজবুত বাড়ি, তাই এখনও স্থানে স্থানে পলেস্তরা খসে পড়েনি। এই বাড়ির গায়ে গায়ে তার হাতের স্পর্শ লেগে আছে। এই বাড়িরই কোনও একটা ঘরে বেগম মেরীজান সেদিন নিজের ছেলেকে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন। তার দুগ্ধগ্রন্থির থেকে নিঃসৃত অমৃতে মিশেছিল বিষ, জানতেও পারেননি তিনি। কয়েক ঘন্টা আগেই হুকোর খানিরার জলে মিশেছিল অ্যাকোনাইটের মূলের গুঁড়ো, আর সেখান থেকে রক্তে, স্নায়ুতে, গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে। অ্যাকোনাইট, যুগে যুগে নিরুচ্চার খুনীদের ব্যবহৃত প্রিয়তম বিষ। বিষক্রিয়ার কোনও চিহ্ন ছাড়ে না যে। হিউ সুযোগ ছাড়েননি কোনও। গোটা ছয়েক মূলের গুঁড়ো মিশিয়েছিলেন জলে। শুধু দুধে যে সে বিষ মিশে সন্তানের শরীরে পৌঁছাবে, এই সূক্ষ্ম হিসাবটা ভুলে গিয়েছিলেন। হৃদপিন্ডের গতি স্তব্ধ হয়ে সঙ্গে সঙ্গেই চিরঘুমে ঢলে পড়েছিল মেরীজানের ছেলে, আর তার দশ মিনিটের মধ্যে তিনি নিজে।

আরশিন অদা উর্ফ মেরীজান চলে গেছে। সঙ্গে নিয়ে গেছে রুহানিয়তের ‘রুহ্’ কে। শতাব্দীপ্রাচীন সময়রেখার দিক পরিবর্তন করে মাত্র কদিনের জন্য মীনাক্ষি মিত্রের বন্ধু হতে এসেছিল সে। ওর ছেড়ে যাওয়া বাড়ি, ওর সাধের সংসার সব আরেকবার ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল বাঙালিনীর তরে। মৃত্যুর গন্ধকে চিনে নিতে ভুল করেনি এবার ও।

রুহানিয়তের গুল দেওয়া পুরোনো দরজাটা ঠেলে বাইরে আসলাম। অনেকদিন আগে শোনা এক গজলের দুকলি মনে পড়ে গেল,

“যো ম্যায় লিখু এক গজল,

তো পড়ভি লেনা ক’ভি…

কে পড়তি রহি হুঁ ম্যায়,

যো তুনে কভি লিখা হি নহি।”

বিদায় আরশিন! আমার না বলা বাণী বুঝে নিতে আবার আসবে কি তুমি! আবার কি দেখা হবে আমাদের! আকাশে ভাসমান নক্ষত্রপুঞ্জের পারে হয়তো আবার একদিন… ততদিন ভালো থেকো! কবিতায় থেকো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *