রক্তের রং

রক্তের রং

‘বাড়ি তাহলে পছন্দ হয়েছে আপনার?’

‘হ্যাঁ, আমার এজেন্ট নিজে দেখে যে-রকম বাহবা দিয়েছে আপনার বাড়ির, কে না তা পছন্দ করবে? ইংল্যান্ডে গিয়ে যখন থাকতেই হচ্ছে কয়েক বছর, ওইরকম বাসস্থানই আমার দরকার একটা। আমি সলিসিটারকে বলে দিয়েছি কাগজপত্র তৈরি করে ফেলবার জন্য।’

কথা হচ্ছিল ওয়াশিংটনে বসে। ফোনে।

ফোনের এক মাথায় ইংল্যান্ড থেকে আগত লর্ড এভারডেল, অন্যপ্রান্তে বিখ্যাত মার্কিন শিল্পপতি হ্যারল্ড নিকলসন।

‘তাহলে আপাতত আর কিছু কথা নেই তো?’— লাইন ছেড়ে দেওয়ার আগে শেষ প্রশ্ন করলেন নিকলসন।

ঠিক তখন তখনই কোনো জবাব এল না ওদিক থেকে। নিকলসন একটু অবাক হচ্ছেন। শেষ মুহূর্তে কোনো বায়নাক্কা তুলবেন নাকি লর্ড এভারডেল? বাড়ি পছন্দ হয়েছে, একথা শুনবার পরে প্যাঁচ কষবেন কোনোরকম, দামটা বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য?

না, তা সম্ভব নয়। মোটেই নয়। লর্ড এভারডেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছে দুই দুইবার। তাঁকে অতি সৎ লোক মনে হয়েছে নিকলসনের। সারা জীবন মানুষ চরিয়েছেন নিকলসন। কে কেমন লোক এক আঁচড়েই তা বুঝতে পারেন।

তবে? মিলর্ড ভাবছেন কী?

যা ভাবছিলেন এভারডেল, তা প্রকাশ পেল এইবার। ও মাথা থেকে কথা কয়ে উঠলেন তিনি, ‘দেখুন বন্ধু, একটা ব্যাপার আছে। সেটা খুলে না-বলে বাড়ি আপনাকে গছিয়ে দিতে বিবেকে বাধছে আমার। অর্থাৎ, কথাটা শুনবার পরে আপনি যদি— মানে ওটা কেনার মতলব বাতিল করেই দেন আপনি, আমি কিচ্ছু মনে করব না।’

‘আরে ব্বাস, এমন কী কথা? বলুন, বলুন—’ বলে উঠলেন নিকলসন।

‘কথাটা এই যে, আমার ওই বাড়িটা, ওতে ভূত আছে মশাই—’

‘কী বললেন? ভূ-উ-উ-ত?’— প্রশ্ন করতে গিয়ে হেসে উঠলেন নিকলসন।

‘হ্যাঁ মশাই, দস্তুরমতো ভূত। আপনি বুঝি ভূত বিশ্বাস করেন না?’

‘বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনোটাই করিনে। আপনি বুঝি করেন বিশ্বাস? দেখেছেন নাকি তাকে?’

‘তা মশাই দেখেছি। একা আমি নই, আমার বাড়ির লোক সবাই দেখেছে। আগে আমরা বছরের অর্ধেকটাই, ধরুন ওই পল্লিভবনে কাটাতাম ভূতের সঙ্গে সহাবস্থান করেই। কিন্তু গত বছর আমার স্ত্রীর একটা অসুখ হয়। তারপর থেকে আশেপাশে ভূতের গতিবিধির আঁচ পেয়েও উদাসীন থাকার মতো স্নায়ুর শক্তি আর নেই তাঁর। বাড়ি আমায় বেচতে হচ্ছে সেইজন্যই। এটা বেচে অন্য একটা পল্লিভবন কিনব। তা নইলে, সাত পুরুষের বাড়ি, অমন অপরূপ সুন্দর বাড়ি, কেনই-বা বেচব বলুন! অন্য বাবদে তো পয়সার অভাব আমার নেই। প্রকাণ্ড ধনী না-হলেও মোটামুটি সচ্ছল অবস্থা আমার।’

এবার চুপ করার পালা নিকলসনের। তারপরে তিনি আস্তে আস্তে বললেন, ‘দেখুন মিলর্ড, আমার কথা আমি আগেই বলেছি। ভূতে বিশ্বাস বা ভূতে অবিশ্বাস, কোনোটাই নেই আমার। ভাবিনি ওদের কথা কখনো। যেমন, ভাবিনি ইয়েটিদের কথা। থাকে থাকুক, না-থাকে নেই। যতক্ষণ না আমার চেয়ার দখল করে আমায় দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করছে, বা আমার প্লেটের খাবারগুলো গোগ্রাসে গিলে ফেলে আমায় দেখাচ্ছে বুড়ো আঙুল, ততক্ষণ ওরা থাকতে চায় যদি থাকুক! আমার কোনো ক্ষতি নেই তাতে। কিন্তু বাড়ি কিনে তাতে আমি একা তো বাস করব না। করবেন আমার স্ত্রীও তাঁর ছেলেমেয়ে নিয়ে। কাজেই, মানে ভূত নিয়ে আলোচনা তাঁর সঙ্গে এই কুড়ি বছরের দাম্পত্য-জীবনে কোনোদিন করেছি বলে তো মনে পড়ে না। আজ একবার করতে হবে।’

‘তাহলে আমি কাল খবর পাওয়ার আশা করতে পারি, কী বলেন?’— বললেন এভারডেল। তারপরই কথা শেষ করলেন এই বলে, ‘আগেই জানিয়ে রাখি, আমি একটুও অবাক হব না, যদি আপনার স্ত্রী ভূতের বাড়িতে বাস করতে মোটেই উৎসাহবোধ না-করেন।’

পরের দিন আবার ফোন ধরলেন নিকলসন, ‘মিলর্ড! বাড়ি আমি নেবই। আমার স্ত্রীর একটু দোনোমনা ভাব ছিল বটে, কিন্তু তিনটি ছেলে-মেয়ের কাকুতিমিনতি একেবারে পেড়ে ফেলেছে তাঁকে। ওরা ক্ষেপে উঠেছে ভূত দেখবার জন্য। ভূতের সঙ্গে দহরম-মহরম করবার দিকে ওদের দেখছি বেজায় ঝোঁক।’

একটু হেসে এভারডেল জবাব দিলেন, ‘ছেলে-মেয়েরা আপনার খুবই অসাধারণ তো!’

‘শুধু অসাধারণ নয়, ন্যায়নিষ্ঠও বটে’— এই বলে নিকলসনও হাসলেন, ‘বলে কী জানেন? বলে যে ভূত তো বড়োলোকের বাড়ির দামি বৈশিষ্ট্য একটা। রীতিমতো সম্পদই বলা চলে। ওটার দরুন অন্তত দুই হাজার ডলার বেশি দাম পেতে পারেন লর্ড এভারডেল।’

অতঃপর ফোনের দুই প্রান্তেই অট্টহাসি, তারই ভিতরে আলোচনার সমাপ্তি হল।

ছয় মাস পরের কথা। নিকলসনেরা মার্কিন মুলুকের মায়া কাটিয়েছেন। আটলান্টিক পেরিয়ে এসে গৃহস্থালি পেতে বসেছেন জ্যানাডুতে। নামটা আশ্চর্য লাগছে? চীন সম্রাট কুবলা খাঁর প্রাসাদপুরী ছিল জ্যানাডু। সেই নামটিই ধার করেছিলেন এভারডেলের কোনো পূর্বপুরুষ।

ভোর বেলায় নতুন বাড়িতে স্ত্রী, কন্যা, পুত্রদের ঢুকিয়ে দিয়েই নিকলসন ছুটলেন লন্ডনে। বৃহৎ জাগুয়ার গাড়ি আগে থেকেই কিনে রেখেছে এজেন্ট। জ্যানাডু— লন্ডনের মাঝখানে ওই যে বেয়াল্লিশ মাইল ব্যবধান, পুলিশের শত বাধানিষেধ সত্ত্বেও তা মেরে দেবে আধঘণ্টায়। লন্ডনে বিরাট ব্যাবসা খুলতে যাচ্ছেন নিকলসন, খোশখেয়ালে বেড়াবার জন্য তিনি দেশান্তরী হননি।

জাগুয়ার নিয়ে নিকলসন বেরিয়ে গেলেন লন্ডন পানে। নিকলসন-গিন্নি লেগে গেলেন ঘর-গৃহস্থালি গুছিয়ে নিতে, চাকর-দাসীদের বিরাট পল্টনটার সঙ্গে আলাপ পরিচয় করে নিতে। ছেলে-মেয়ে তিনটি বেড়াতে বেরুল লাইমোসিন গাড়িখানা নিয়ে। এটা আমেরিকা থেকে ওদের সঙ্গেই এসেছে। সমুদ্রে পাহাড়ে পাইন বনের আশ্চর্য সমন্বয়ে নয়ন মনোহর জ্যানাডুর সৌন্দর্য তারা আশ মিটিয়ে উপভোগ করতে চায়।

তিন ভাই-বোন— এঞ্জেলা, রিচার্ড ওরফে ডিক আর রবার্ট ওরফে বব। বয়স ষোলো, চোদ্দো আর বারো। ছেলে দু-টি এটনে ভরতি হবে, ঠিক হয়েই আছে। এঞ্জেলা আশা রাখে অচিরেই অভিজাত সমাজে সিংহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার। সবে ষোলো বয়স, অসম্ভব রূপসি, আবার যথাসম্ভব বিদূষীও। ক্ষুরধার রসনা কারও কোনো দুর্বলতাকেই রেহাই দেয় না যেমন, মলিন নেত্রের কোমল দৃষ্টি থেকে সমবেদনাও তেমনি অঝোরে ঝরে পড়ে কারও কোনো দুঃখের কথা শুনলে। এই মেয়েটিই নিকলসন পরিবারের সূর্য, এর চারদিকেই ঘোরে-ফেরে তার বাপ-মা আর ভাই দু-টি। এরই হাসির আলো থেকে উষ্ণতার সঞ্চার হয় তাদের প্রাণে।

রিচার্ড আর রবার্ট, ডিক আর বব বেড়িয়ে ফিরল যখন, বাড়িটার ছাদকে মাটির তলায় ঢুকিয়ে দিয়ে ভিতটাকে আকাশে ঠেলে তুলবার চেষ্টাতেই মেতে গেল যেন। দুরন্ত ডানপিটে বেপরোয়া— এসব কোনো কিছু বলেই এদের স্বভাবের ষোলো আনা পরিচয় দেওয়া যায় না।

দিনটা তারা কাটিয়ে দিল বাড়িময় দাপাদাপি করে। ভূত খুঁজছে তারা। কোথায় ভূত, তা অবশ্য চাকরদের জিজ্ঞাসা করা যায় না। তাতে খেলো হয়ে যেতে হবে তাদের কাছে। ছাদ থেকে মাটির তলার ঠান্ডি-গুদাম সব তারা তন্নতন্ন করে খুঁজল, তারপরে বাবার ফিরে আসার সময় হচ্ছে দেখে সাজপোশাক বদলে তৈরি হয়ে বসল ডিনারের জন্য।

ফিরল জাগুয়ার। সন্ধ্যা হল।

ডিনারের জন্য নেমে এসেছে সবাই। শীত প্রচণ্ড, গনগনে আগুন জ্বলছে ঘরে, তবু গরম জামার নীচেও গুরগুর করে ওঠে বুকের ভিতরে। খানসামারা ডিশের পরে ডিশ সাজিয়ে যাচ্ছে টেবিলে, সাজাতে থাকুক। বব আর ডিক ছুটে চলে গেল আগুনের ধারে, হাত-পা সেঁকে আসা যাক ততক্ষণ।

আর অমনি হেড খানসামা হ্যারিস আর্তনাদ করে উঠল, ‘হুজুর, হুজুর’ বলে।

‘কী হয়েছে? অমন করে উঠলে কেন তুমি?’ অবাক হয়ে কৈফিয়ত চাইলেন মিসেস নিকলসন। ছুটোছুটির বাচালতা এ বয়সে তাঁকে আর মানায় না বলেই নিজে তিনি বসে পড়েছেন টেবিলে। তা নইলে এক মিনিট আগুন-তাতের কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর শখ তাঁরও কম হয়নি।

কর্ত্রী কৈফিয়ত তলব করতেই হ্যারিস ওদিকে থতোমতো খেয়ে গিয়েছে দারুণভাবে। হাত কচলে, একবার ডাইনে ফিলিপসের দিকে, আর একবার বাঁয়ে রবসনের দিকে করুণ নেত্রে তাকিয়ে অবশেষে সে বলল, ‘আগুনের কাছে যে সেই ইয়েটা আছে হুজরাইন, মানে সেই রক্তের দাগটা।’

‘রক্তের দাগ?’ আকাশ থেকে পড়লেন যেন কর্ত্রী।

‘রক্তের দাগ?’ উৎকর্ণ হয়ে উঠল বব আর ডিক।

‘কার রক্ত? ভূতের?’ হাই তুলে প্রশ্ন করল এঞ্জেলা। স্বয়ং নিকলসন এখনও ঢোকেননি ঘরে। ওই বুঝি তাঁর পায়ের শব্দ শোনা যায় করিডোরে। ঢোকার পরে তিনিও কোনো না প্রশ্ন করবেন একটা।

মরিয়া হয়ে হ্যারিস বলল, ‘রক্তের দাগ মানে, আপনারা কি কিছুই শোনেননি নাকি? রক্ত মানে লেডি ম্যান্ডেভিলের রক্ত। লেডি ম্যান্ডেভিল এই বাড়িরই কর্ত্রী ছিলেন অনেক অনেক যুগ আগে।’

‘এইখানটায় দাগ আছে রক্তের?’ ভারি উৎসুক হয়ে মেঝের এখানে-ওখানে চোখ বুলোতে লাগল বব আর ডিক।

বেশিক্ষণ হল না বুলোতে, সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল দুই ভাই, ‘ইউরেকা! ইউরেকা! পেয়েছি! দেখেছি! এই যে মাম্মি! এঞ্জা! ড্যাডি! সত্যিই রক্ত! দেখবে এসো!’ তাথৈ তাথৈ নাচতে লাগল দুই ভাই আনন্দে আর উত্তেজনায়।

নিকলসন ততক্ষণে এসে পড়েছেন ও দুই-এক কথায় স্ত্রীর মুখ থেকে শুনে নিয়েছেন বৃত্তান্তটা। নিঃশব্দে তিনি এগিয়ে গিয়ে আগুনের কাছে দাঁড়ালেন এবং পা দিয়ে ঘষে ঘষে রক্তের দাগটা তুলে ফেলবার চেষ্টা করতে লাগলেন। তারপর তিনি বব ডিককে ডেকে নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসলেন আর হ্যারিসকে বললেন, ‘দাগটা কাল যেন আর না-থাকে। ঝাড়ুদারকে বলবে জল ঢেলে ঝাঁটা চালালে কোনো রক্তই জমাট বেঁধে থাকতে পারে না বেশিক্ষণ। ভূতের রক্তও না।’

খাবার পরিবেশন করতে করতে হ্যারিস কাঁদো কাঁদো ভাবে নিবেদন করল, ‘হজুরের হুকুম তামিল হবে, ঝাড়ুদার ঢালবে জল, ঢলোবেও ঝাঁটা, কিন্তু দাগ বোধ হয় উঠবে না, ওঠেনি আজ তিন-শো বছরের ভিতর। তা ছাড়া দাগটা আছে বটে, কিন্তু ক্ষতি করছে না কিছু। তিন-শো বছর ধরে ওই রক্ত সমান নিয়েই এভারডেল ম্যান্ডেভিলেরা ডিনার খাচ্ছেন এই ঘরে।’

‘লেডি ম্যান্ডেভিলটি কে? এতকাল তো শুনেছি বাড়িটার মালিক ছিলেন এভারডেলেরা।’ প্রশ্ন তুলল এঞ্জেলা।

তাকে বুঝিয়ে দিলেন নিকালসনই, ‘গোড়ায় এ বাড়ির মালিক ছিলেন ম্যান্ডেভিলেরাই। তাঁরা নির্বংশ হয়ে যাওয়ার ফলে ভাগনে বংশ এভারডেলরা এর অধিকারী হন। এটা আমি লর্ড এভারডেলের মুখেই শুনেছি, মানে বর্তমানের লর্ড এভারডেলের।’

‘তবু, লেডি ম্যান্ডেভিল, এক সময়ে যিনি এ বাড়ির কর্ত্রী ছিলেন, তাঁর রক্ত এখানে ঝরল কেন? কে খুন করল তাঁকে?’

নিকলসন মাথা নাড়লেন, ‘এসব কথা আমি শুনিনি। হ্যারিস বলতে পারে হয়তো।’

হ্যারিস এতক্ষণে কাঁদো কাঁদো ভাবটা কাটিয়ে উঠেছে। সে এখন মনিবকে গল্প শোনাবার সুযোগ পেয়ে স্ফীত হয়ে উঠেছে নিজের গুরুত্বে। গলায় একটা মৃদু খাঁকারি দিয়ে সে যা বলল, তা সংক্ষেপে এই দাঁড়ায়—

স্যার জর্জ ম্যান্ডেভিল ছিলেন দারুণ রাগী মানুষ, নির্ভেজাল গোঁয়ার। একটু বেশি বয়সেই তিনি বিয়ে করেন। স্ত্রী ছিলেন অতি সুন্দরী। স্যার জর্জ সন্দেহ করতে শুরু করেন যে— যাক গে সে কথা। একদিন ডিনারে বসেই স্যার জর্জ ভৃত্যদের তাড়িয়ে দেন এই ঘর থেকে, আর তিরস্কার করতে থাকেন স্ত্রীকে চরিত্রহীনা বলে। স্ত্রীও কড়া মেজাজে জবাব দেন, ঝগড়া জমে ওঠে।

বলা বাহুল্য ভৃত্যেরা কেউ কেউ আড়াল থেকে শুনছিল সে ঝগড়া।

হঠাৎ একটা আর্তনাদ।

তারপরই ভৃত্যেরা ছুটে এল ঘরের ভিতর। দেখতে পেল, রক্ত মাখা ছোরা হাতে নিয়ে স্যার জর্জ দাঁড়িয়ে রয়েছেন আগুনের ধারে, আর তাঁর সমুখে মেঝেতে গড়াগড়ি যাচ্ছেন লেডি ম্যান্ডেভিল।

সেই রাত্রেই স্যার জর্জও নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন, উবে গেলেন যেন হাওয়ায়।

‘অতি জোলো গল্প।’— মন্তব্য করল এঞ্জেলা, সবটা শোনার পরে।

গভীর রাত। নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছেন নিকলসনেরা যে-যার ঘরে। বব আর ডিক দুই ভাইই অবশ্য একটা বড়ো ঘরে শুয়েছে। বরাবরই তাই শোয় তারা গল্পগুজবের সুবিধার জন্য।

ওরা ছাড়া আর সবাইয়েরই আলাদা আলাদা ঘর। এঞ্জেলার তো একারই তিনখানা। শোবার ঘর একটা, বিশ্রামের একটা, প্রসাধনের আরও একটা।

হ্যাঁ, অন্য সবাইয়ের মতো এঞ্জেলাও ঘুমোচ্ছে বই কী! তবে শোবার ঘরে নয়, বুডোয়ারে অর্থাৎ বিশ্রামের ঘরে। পোশাক-পরা অবস্থায় সোফার উপরে ঘুমিয়ে পড়েছে একখানা আধুনিক উপন্যাস পড়তে পড়তে।

পোশাক-পরা অবস্থায় যে ঘুম, তার ভিতরে অবচেতন অস্বস্তি একটা থাকে, সহজেই তা ভেঙে যায়। এঞ্জেলারও তাই গেল। একটা আওয়াজ কানে এসেছে তার। সে সোফাতেই সোজা হয়ে বসে কান খাড়া করল। কীসের আওয়াজ?

ঝন-ঝন-ঝন-ঝন।

ঘুমন্ত এঞ্জেলার বুকের ওপরেই উপন্যাসখানা ছিল, উঠে বসার সময় হাতে নিয়েছে সেটা। এইবার সেটা রেখে দিল এক পাশে, উঠে দাঁড়াল আস্তে আস্তে।

নিঃশব্দে দরজা খুলে ঈষৎ একটু ফাঁক সে বার করল, আর উঁকি দিল তারই ভিতর দিয়ে। করিডোরে ঢিমে আলো একটা জ্বলছে। তারই আলোতে সে দেখল, একটা লম্বা-চওড়া মানুষ। কোট প্যান্টালুনই পরা অবশ্য, কিন্তু এ-ধরনের আজগুবি ঢং-এর সব পোশাক এ-দেশের কোনো লোক যে পরে, তা জানা ছিল না এঞ্জেলার।

লোকটা আস্তে আস্তে পা টেনে টেনে এগুচ্ছে। আর অবাক কাণ্ড, তার দুই পায়ে শিকল বাঁধা, লোহারই মোটা শিকল। সেই শিকলেরই আওয়াজ শোনা যাচ্ছে— ঝন— ঝন— ঝন— ঝন—

লোকটা চলে যাচ্ছে এঞ্জেলার তিনখানা ঘর একে একে পেরিয়ে, চলে যাচ্ছে সেই বড়ো ঘরের দোরের সামনে দিয়ে, যে ঘরে দুই খাটে দুই ভাই ঘুমিয়ে আছে, বব আর ডিক।

ঘুম না ছাই! হড়াৎ করে দোরটা ঘুলে গেল সেই বড়ো ঘরের, আর এক-এক লাফে ওরা দুই ভাই করিডোরে বেরিয়ে পড়ে পথ আগলে দাঁড়াল ওই লোকটার। শুধু আগলানো নয়, একজন এক কুঁজো জল ঢেলে দিল তার মাথায়, আর একজন সেই ভিজে মাথার উপরে ছুড়ে মারল একটা কোট।

সঙ্গেসঙ্গে আজব ব্যাপার! বেলুন ফেঁসে গেলে তার ভিতরকার হাওয়া যেমন ভস করে বেরিয়ে আসে, তেমনি ভস করে আওয়াজ হল একটা ঠিক সেইখানটাতে, যেখানে শিকল-পরা মানুষটা দাঁড়িয়েছিল এই মুহূর্তেই। আর তারপরই হাওয়া! অবাধ ফাঁকা হাওয়া শুধু সেখানে। না আছে মানুষটা, না-আছে শিকল।

ওদিকে বব-ডিক, এদিকে এঞ্জেলা পিটপিট করে তাকায় শুধু সেই জায়গাটার দিকে। বাবা, মাকে এখন এ কথা বলে কাজ নেই সেইখানে দাঁড়িয়েই ঠিক করে ফ্যালে তারা।

পরের দিন ডিনারে হ্যারিস দেখলে— রক্তের দাগটা একদম ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে ঝাড়ুদারের ঝাঁটার মুখে। নিকলসন স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বিজয় গর্বের হাসি হাসলেন, ‘এসব ওই চাকরগুলোর কারসাজি। ওরাই লাল রং ঢেলে রাখত আগের মনিবদের ভয় দেখাবার জন্য। ভয় দেখিয়ে লাভ কী ওদের, তা অবশ্য বলা শক্ত।’

কিন্তু কী আশ্চর্য! নিকলসনের গর্বকে খর্ব করে দিয়ে সেই বিলুপ্ত রক্তের দাগ পরের দিন আবার জাজ্বল্যমান হয়ে দেখা দিল ঠিক আগের জায়গাটতেই। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠেই রাগে ফেটে পড়লেন নিকলসন, হুকুম দিলেন, ‘ধোও আবার। দেখি লেডি ম্যান্ডেভিল কত রক্ত ঢালতে পারেন রোজ রোজ। হুকুম রইল, প্রতিদিন ঝাড়ুদার ধুয়ে দেবে জায়গাটা।’

তাই হতে থাকল। ঝাড়ুদার ধুয়ে পরিষ্কার করে দিয়ে যায় একদিন, পরের দিনই ডিনারের সময় দেখা যায় যে যথা পূর্বং রক্তের দাগ আবারও ফুটে বেরিয়েছে সেই একই স্থানে।

তবে হ্যাঁ, অন্য কেউ লক্ষ না-করুক, এঞ্জেলার চোখে একটা জিনিস ধরা পড়ে যাচ্ছে দিনের দিন। সেটা এই যে, দিন যত যাচ্ছে, রক্তটা রক্তিমার দিক দিয়ে খেলো হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।

হ্যাঁ, ফিকে হয়ে আসছে লাল রংটা। দিনের দিন ফিকে হয়ে আসছে। অবশেষে একদিন সে আবিষ্কার করল, রক্তটা মোটে লালই নেই আর, গোলাপি হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। অবশেষে, তাজ্জব ব্যাপার! লেডি ম্যান্ডেভিলের রক্তটাকে মালুম হচ্ছে নীল বলে।

তা নীল রক্ত বলে একটা কথা আছে দেশে। অভিজাত বংশের লোকেরা নাকি নীল রক্তের অধিকারী। সে হিসেবে লেডি ম্যান্ডেভিলের ধমনী থেকে নীল রঙের রক্ত বেরুনো আশ্চর্য নয় কিছু।

কিন্তু কথা এই, নীল থেকে আবার সবুজ বা কালো রংও যদি একের-পর-এক ধরতে থাকে ওই রক্তটা, তার কোনো অর্থই তো দেশের প্রবাদ বা অভিধান থেকে বার করতে পারবে না কেউ।

অন্য কাউকে অবশ্য রক্তের বর্ণ পরিবর্তন সম্পর্কে এ-যাবৎ কিছু বলেনি এঞ্জেলা। মজাটা একা একাই উপভোগ করছে।

বব-ডিকের ছুটি ফুরোতেই তারা এটনে চলে গিয়েছে। এঞ্জেলা একাই রাত্রে শিকলের ঝনঝন শোনে, আর আরাম করে পাশ ফিরে শোয় লেপ চাপা দিয়ে। এ ভূত থেকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই— এইটাই সে বুঝিয়েছে নিজেকে। আর এটাও মনে মনে ঠিক করে রেখেছে যে, ভূত-বাবাজিকে সে একদিন ভালোরকম শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে। যেদিন ইচ্ছে ও দিতে পারে শিক্ষা, ভূত ওর কবজার মধ্যেই আছে।

জিনিসটা কিন্তু হঠাৎই ঘটে গেল। এঞ্জেলা সে-রাতে শোবার সময়ও এমন কিছু মন স্থির করেনি যে, আজই সে বোঝাপড়া করবে ভূতের সঙ্গে। কিন্তু ঘুম যখন ভাঙল, আজকের আওয়াজটা বিদঘুটে একেবারে। বিকট ঝনঝনানির সঙ্গে চেয়ার ওলটানোর শব্দ, দুই-একটা পেয়ালা-গেলাস ভাঙার শব্দ, তুলকালাম ব্যাপার বলা যায়।

ঘুম ভেঙে যেতেই এঞ্জেলা তড়াক করে উঠে পড়ল। বেজায় রেগেছে সে। ভূতটা নেহাত ভূত, কোনো আক্কেল নেই ওর। এমন করে কারও ঘুম ভাঙায় কোনো ভদ্রলোক? বব আর ডিক স্কুলে চলে যেতেই ভূতটার সাহস বেড়ে গিয়েছে। ভেবেছে মেয়েছেলে এঞ্জেলা তো আর তার মাথায় কুঁজোর জল ঢালতে বা কোট চাপা দিতে আসবে না।

আসে কী না-আসে— আজ দেখুক ভূতবাবাজি!

তাড়াতাড়ি পোশাকটা কোনোরকমে পরে নিল এঞ্জেলা, তারপরই—

পাশের দরজা দিয়ে প্রসাধনের ঘরে যাওয়া যায়। ওই ঘরেই ভূত এসেছে। প্রায় রাত্তিরেই ওইখানেই আসতে হয় তাকে রং চুরি করবার জন্য। এঞ্জেলা ছবি আঁকে। তার রং-এর বাক্স ওই ঘরেই থাকে। ডিনার-ঘরের রক্তের দাগ মেরামতের জন্য একদিন বাদে একদিন ভূতকে ওখানে আসতেই হয়। রং চুরি করবার জায়গা তো এ বাড়িতে ওই একটাই!

সশব্দে দরজা খুলে ফেলে দিয়ে এঞ্জেলা হাঁকল, ‘গুড ইভনিং মিস্টার গোস্ট! রং নিচ্ছেন নিন, কিন্তু এ আপনার কীরকম ব্যবহার? এমন তুমুল গোলমাল কেন? আর তাও বলি, লাল রং ফুরোলো তো গোলাপি নিতে শুরু করলেন, গোলাপি ফুরোলো তো নীল। ঝাড়ুদারটা চোখে দেখে না, কিন্তু আমি দেখে থাকি মশাই! আপনার দৌড় কদ্দূর, তাই দেখবার জন্যই লাল রং আমি আর আনাইনি লন্ডন থেকে। এবার তো কালো ছাড়া আর কোনো রং অবশিষ্ট নেই বাক্সে।’

ভূতটা কাঁচুমাচু হয়ে হাত কচলাচ্ছে। এঞ্জেলার কথা শেষ হতেই সে মিনমিন করে বলতে শুরু করল, ‘ওই রক্তটা, ওটা ধুয়ে না-ফেললে কি চলতই না তোমাদের? ওইটি যতদিন ছিল, একটা সান্ত্বনা ছিল আমার। পাপিষ্ঠা স্ত্রীকে যে উচিত সাজা দিতে পেরেছিলাম, সেই স্মৃতিই এত কষ্টের মধ্যেও আনন্দ দিত আমাকে।’

‘ওঃ, আপনিই বুঝি স্যার জর্জ ম্যান্ডেভিল?’— এঞ্জেলা আলো দেখতে পেল এই রহস্যের মধ্যে।

ফাৎ করে একটা নিশ্বাস ফেলল ভূত।— ‘বুঝতে পেরেছ তাহলে। হ্যাঁ, আমি সেই অভাগা ম্যান্ডেভিল। একটা পাজি মেয়েকে ঘরে এনে যার ইহ-পরকাল দুইই গেল। কী নিদারুণ কষ্ট পেয়ে আমায় মরতে হয়েছিল, তা জানলে তোমার চোখ ফেটে জল বেরুবে। তার তুলনায় আমার স্ত্রীর মৃত্যু আর কী? সে তো এক মিনিটে শেষ হয়ে গিয়েছিল।’

‘নিদারুণ কষ্ট কী বলছেন?’— এঞ্জেলার কথার সুর সহানুভূতিতে কেমন হয়ে এল তার অজান্তেই। মনটা তার বড়োই ভালো কিনা!

‘ওঃ, অসহ্য, অসহ্য কষ্ট আমায় দিয়েছিল আমার স্ত্রীর ভাই দুটো। ওরা সেদিন এই বাড়িতেই অতিথি ছিল কিনা! স্ত্রীকে খুন করবার সময় রাগের মাথায় ওদের কথা ভুলে গিয়েছিলাম আমি। ভুলে না-গেলে সে-দিনটা আর ও-কাজ করতাম না বোধ হয়। লোক দুটো ষণ্ডাও ছিল যেমন, গোঁয়ারও ছিল তেমনি।’

‘কিন্তু ওরা কী কষ্ট দিয়েছিল, তা তো বলছেন না?’— তাগিদ দিল এঞ্জেলা।

‘বলে কেমন করে বোঝাব? তার চেয়ে তুমি এক কাজ করবে? তুমি আমার সঙ্গে আসবে? বাইরে কোথাও নয়, এই বাড়িরই ভিতরে। আমি তোমায় চাক্ষুষ দেখিয়ে দেব কী কষ্ট দিয়ে ওরা মেরেছিল আমায়। ভগবানের নাম নিয়ে বলছি, তোমার কোনো অনিষ্ট আমি করব না।’

এঞ্জেলা বিলক্ষণ জানে যে, ভূতকে সে ভয় পায় না, ভূত তার অনিষ্টও কিছু করতে পারে না। তা ছাড়া ব্যাপারটা তলিয়ে বুঝবার জন্য কৌতূহলও তার অসীম। একটুখানি দোনোমনা ভাব না-এসেছিল তার, এমন নয় অবশ্য, তবে সেটা কাটিয়ে উঠতেও তার দেরি হল না। সে বলল, ‘বেশ চলুন, কোথায় যেতে হবে।’

দালানের করিডোরের দিকে দরজা বন্ধই আছে। ভূতের আসা-যাওয়ার জন্য খোলা দরজার দরকার হয় না, এমনকী পায়ে শিকল থাকলেও না। ভূতের হয় না দরকার, কিন্তু মানুষের হয়। এঞ্জেলা দরজা খুলে বেরুল। ভূত আগেই বেরিয়েছে।

আগে আগে ভূত, পিছনে এঞ্জেলা।

এ-করিডোর থেকে ও-করিডোর, এ-সিঁড়ি থেকে ও-সিঁড়ি, অনেক ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ভূত এঞ্জেলাকে এনে ফেলল একটা নিশ্ছদ্র দেওয়ালের সামনে। সেখান থেকে ফিরে পিছিয়ে যাবার পথ ছাড়া অন্য কোনো দিকে যাওয়ারই পথ নেই। ভূত বলল, ‘আমি অবশ্য দেওয়ালের ভিতর দিয়েই যেতে পারি, কিন্তু তুমি তো পারবে না। দেয়ালের এই জায়গাটাতে ধাক্কা দাও দেখি।’

এঞ্জেলা গোটা দুই ধাক্কা দিতেই দেওয়ালের গায়ে বেরুল গোপন দরজা একটা। ভূত তার ভিতর দিয়ে ওদিকে চলে গেল, এঞ্জেলাও পিছু নিল তার। গোপন দরজা আবার বেমালুম জুড়ে গেল দেওয়ালের গায়ে।

এ একটা ছোট্ট ঘর। ওই গোপন দরজা ছাড়া অন্য কোনো দরজা নেই এর। জানালা তো নেইই। ঘরের ভিতরে আসবাব বলতে একটা সিন্দুক, আর সেই সিন্দুকের আংটার সঙ্গে শিকল দিয়ে বাঁধা।

আরে সর্বনাশ! মেঝেতে লম্বালম্বি পড়ে আছে একটা গোটা কঙ্কাল, তার গায়ে এখনও জীর্ণ বসনের অবশেষ একটু একটু রয়েছে। ভূতের গায়ের কোট-প্যান্টালুনের সঙ্গে সে-বসনের আকারগত মিল এখনও চোখে ধরা পড়ে।

কী একটা কথা জিজ্ঞাসা করবার জন্য ভূতের দিকে চোখ তুলে চাইল এঞ্জেলা। ভূত বিষণ্ণ নয়নে তাকিয়ে আছে কঙ্কালের দিকে। এঞ্জেলার ভাষাহীন প্রশ্নেরই উত্তর দিয়ে সে বলল, ‘অবশ্যই বুঝতে পেরেছ ওই কঙ্কাল আমারই কঙ্কাল। ওই যে সিন্দুক, ওটার ভিতরে কমসে-কম দুই লক্ষ পাউন্ডের হিরে জহরত মজুত আছে। ওসব আমারই।

‘আমার অভ্যেস ছিল কী জানো? রোজ রাতে শোবার আগে এই গুপ্ত গৃহে এসে সিন্দুকটা খুলে দেখা। খুনের রাত্রেও তার অন্যথা করিনি আমি। কিন্তু আমি টের পাইনি যে আমার সেই দুই শ্যালক সে রাতে আমার পিছু পিছু আসছে। আমি যেই ঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেছি, ওরাও অতর্কিতে ঢুকে পড়ল, আর দুইজনে মিলে পিছন থেকে জাপটে ধরে পেড়ে ফেলল মাটিতে। তারপর মুখে পুরে দিল কাপড়, যাতে আমি চ্যাঁচাতে না-পারি।

‘শিকল ওরা সঙ্গেই এনেছিল, সিন্দুকের আংটার সঙ্গে আমার দুই পা ওরা শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলল। তারপরে উপুড় করে আমায় মেঝেতে শুইয়ে ঠিক আমার শিয়রে রেখে দিল এক বাটি জল আর কয়েকটা রুটি। শিয়রে, কিন্তু ঠিক নাগালের বাইরে। এক ইঞ্চির জন্য নাগালের বাইরে।

‘তারপর ওরা আমার জামা হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে লাগল সিন্দুকের চাবি। কোথায় পাবে তা? চাবি আমার সঙ্গে কোনোদিন থাকত না। দেয়ালের ওই জায়গাটাতে টিপ দিলে একটা ফোকর বেরুবে, চাবি তার ভিতরেই থাকত, আছে এখনও।

‘কিছুতেই চাবি না-পেয়ে তারা বেদম মারতে লাগল আমায়। মুখের কাপড় বার করে নিল, যাতে আমি বলে দিতে পারি কোথায় আছে চাবি। তবু শত মার খেয়েও আমি মুখ বুজে রইলাম, প্রাণ গেলেও আমি বলব না তা।

‘ওরা আর এ-বাড়িতে থাকতে পারে না। ওদের ভয় পাছে একথা কোনোরকমে ফাঁস হয়ে যায়, যে ওরাই গুম করে রেখেছে আমায়। ওরা সেই রাত্রেই পালাল, আমায় রেখে গেল এইভাবে শিকলে বেঁধে। সে শিকল ভূত হয়েও আমি টেনে বেড়াচ্ছি তিন-শো বছর।

‘কীভাবে মরেছিলাম? না-খেয়ে। মাথার কাছে রুটি-জল। চোখে দেখছি, কিন্তু হাত বাড়িয়ে নাগাল পাচ্ছি না। এক ইঞ্চির জন্য পাচ্ছি না নাগাল। লোহার শিকল, প্রাণপণ টেনেও এক ইঞ্চি এগুতে পারছি না খাবারের দিকে। বোঝো সে কী যন্ত্রণা। ক্ষিধেয় নাড়ি জ্বলে যাচ্ছে, দিনের পর দিন, হপ্তার পরে হপ্তা। জল সম্মুখে, রুটি সম্মুখে দেখেছি, হাত বাড়াচ্ছি, হাতখানা আর এক ইঞ্চি লম্বা করতে পারলেই পেয়ে যাই খাবার, কিন্তু কেমন করে পারব লম্বা করতে?

‘চিৎকার? কত যে চিৎকার করেছি দিনের পর দিন! প্রথমে তারস্বরে, তারপরে গুঙিয়ে গুঙিয়ে। কেউ শুনতে পায়নি। দরজা বন্ধ থাকলে এ ঘরের কোনো আওয়াজ বাইরে বেরোয় না।’

‘অবশেষে আমি মরে গেলাম—’

ভূত গল্প শেষ করল এই বলে, ‘তুমি লক্ষ্মী মেয়ে। আমার এই নরক যন্ত্রণার অবসান তুমিই ঘটাতে পারো। এই কঙ্কালটাকে যথাশাস্ত্র কবর দিয়ে গির্জায় আমার আত্মার জন্য একদিন উপাসনা করাও যদি, আমি মুক্তি পেয়ে যাই। করাবে কি সেটা? আমার সিন্দুকের চাবি ওই জায়গাতে আছে, সিন্দুকের সব ঐশ্বর্য আমি তোমায় দিয়ে গেলাম। তুমি আমায় মুক্ত করে দাও, মুক্ত করে দাও মা আমার—’

ভূতটাকে আর দেখা গেল না।

না, এত সব কাণ্ডের মধ্যেও মূর্ছা যায়নি এঞ্জেলা। ঘর থেকে বেরিয়ে সে ছুটে গেল বাবার কাছে। সেই রাতে তাঁকে টেনে এনে গুপ্ত ধনাগারের বীভৎস রহস্য তাঁকে দেখাল। ভোর বেলাতেই লর্ড এভারডেলকে ফোন করলেন নিকলসন। এভারডেলও ইতিমধ্যে দেশে ফিরে এসেছেন।

স্যার জর্জের কঙ্কালকে কবর দেওয়া হল যথাশাস্ত্র তাঁর মৃত্যুর তিন-শো বছর পরে। উপাসনাও প্রত্যহ হতে লাগল গির্জায় তাঁর সদগতির জন্য। তখন নিকলসন বললেন, ‘জর্জ এভারডেল, মান্ডেভিলদের উত্তরাধিকারী আপনি, সিন্দুকের ঐশ্বর্য আপনি নিন। এঞ্জেলা ও অভিশপ্ত অর্থ নেবে না।’

লর্ড এভারডেল বললেন, ‘এ-বাড়ির সবকিছু আমি আপনাকে বিক্রি করেছি ও আপনার।’

কেউ যখন নিতে চাইল না, গির্জার হাতে ওটা তুলে দেওয়া হল ধর্মকার্যে ব্যয় করবার জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *