রক্তের ফোঁটা – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

রক্তের ফোঁটা – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ পা হড়কে পড়ে যাচ্ছিল অনিমেষ৷ মুহূর্তে রেলিংটা ধরে ফেলে সামলাল নিজেকে৷

নিজের দিকে তাকাল৷ কই কিছুই পড়ে-টড়ে নেই তো! কলার খোসা, আমের চোকলা, নারকেলের ছোবড়া—কিছু নেই তো! জলও তো নেই এক ফোঁটা৷ শুকনো খটখটে সিঁড়ি৷ জুতোর তলাটাও দেখল একবার৷ সেখানেও কিছু লেগে নেই৷

মনে মনে হাসল অনিমেষ৷ খুব তাড়াতাড়ি করছিল বলেই হয়তো পা বেচাল হয়ে পড়েছিল৷ ছন্দ রাখতে পারেনি ঠিকমতো৷

চক্ষের পলকে কী দুর্ঘটনাই না হতে পারত৷ ভাঙতে পারত হাড়গোড়, মাথা, মেরুদণ্ড৷ এতক্ষণে তাহলে রেল স্টেশনের পথে না হয়ে হাসপাতালের পথে৷ ট্যাক্সিতে না হয়ে এ্যাম্বুলেন্সে৷ সত্যি, এক চুলের ফারাক একটা সূতোর এদিক-ওদিক৷

এত তাড়াহুড়োর কোনো মানে হয় না৷ অনিমেষের এখন বয়স হয়েছে৷ তার ধীর-স্থির হওয়া উচিত৷

কিন্তু কী আশ্চর্য, ঠিক সময়ে, সমর্থ হাতে রেলিংটা ধরে ফেলতে পারল৷ ঠিক অত দূরে রেলিং, পড়বার সময় হাতের হিসেব থাকল কী করে? মনে হল কে যেন হাতের কাছে রেলিংটা এগিয়ে এনে দিয়েছে৷

কিছু বলেনি, তবু ট্যাক্সিটাও ছুটেছে প্রাণপণ৷ যেন ড্রাইভারেরও ভীষণ তাড়া৷ কিন্তু বেগে ছুটলেই আগে পৌঁছুনো যায় না সব সময়৷

মনে হচ্ছিল, ট্যাক্সিটাই অ্যাকসিডেন্ট করে বসবে৷ হয় কাউকে চাপা দেবে নয়তো হুমড়ি খেয়ে পড়বে কোনো গাড়ির উপর, নয়ত কোনো মুখোমুখি সংঘর্ষ৷ অত শত না হয়, নির্ঘাৎ জ্যাম হবে রাস্তায়৷ ট্যাক্সিটা পৌঁছুতে পারবে না৷ ট্রেন ছেড়ে দেবে৷

যেন এত সুখ সহ্য করবার নয়৷ ভাগ্য ঠিক বাদ সাধবে৷ বাগড়া দেবে৷ না, হন্তদন্ত ট্যাক্সি শেষে পর্যন্ত এসে পৌঁচেছে৷ ট্রেনটা ছাড়েনি৷ কামরার খোলা দরজার উপর অনীতা দাঁড়িয়ে৷

‘বাবাঃ আসতে পারলে!’ অনিতা খুশিতে ঝলমল করে উঠল৷

‘কত বাধা, কত বিপদ—’

‘বাঃ, আর বাধা-বিপদ কোথায়! সব তো খোলসা হয়ে গিয়েছে!’ অনীতা নির্মুক্ত মনে হাসল : ‘এখন তো ফাঁকা মাঠ৷’

‘যাকে বলে, লাইন ক্লিয়ার৷’ অনিমেষও হাসল স্বচ্ছন্দে৷

হঠাৎ ইঞ্জিনটা হুইসল দিয়ে উঠল৷

অনিমেষ বুঝি উঠতে যাচ্ছিল, অনীতা ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললে, ‘আর উঠে কি হবে?

না, ওটা অন্য প্ল্যাটফর্মের ইঞ্জিন৷

‘যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিল!’ বললে অনিমেষ৷

‘তোমার সবতাতেই ভয়৷’ একটু-বা ব্যঙ্গ মেশাল অনীতা৷

‘না, ভয় আর কোথায়?’ কামরাতে উঠল অনিমেষ৷ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, সামান্য কয়েক মিনিট বাকি আছে৷ বললে, ‘কিছুক্ষণ বাকি৷’

‘কিন্তু কতক্ষণ?’

‘ধরো এক বছর৷’ কথাটাকে অন্য অর্থে নিয়ে গেল অনিমেষ৷

‘না না, অতদিন কেন? এ কি আমরা ডিভোর্সের পর বিয়ে করতে যাচ্ছি যে এক বছর অপেক্ষা করতে হবে!’

‘না, তা নয়, তবে’—অনিমেষ আমতা-আমতা করতে লাগল৷

‘তবে-টবে নয়৷’ অনীতা অসহিষ্ণু হয়ে বললে,—‘শ্রাদ্ধ-শান্তি হয়ে গিয়েছে, এখন আর তোমার দ্বিধা কী?

‘তবু লোকে বলে, এক বছর অপেক্ষা করা ভালো৷’

‘ছাই বলে, কেউ বলে না৷ আমি কত বছর অপেক্ষা করে আছি বলো তো!’ কণ্ঠস্বরে অভিমান আনল অনীতা : ‘আরি আমি দেরি করতে প্রস্তুত নই৷’’

‘কিন্তু চলেছ তো কলকাতার বাইরে৷’

‘কী করব! হঠাৎ বদলি করে দিল! তাতে কী হয়েছে, তুমি দিনক্ষণ ঠিক করে চিঠি লিখলেই আমি ঝপ করে চলে আসব৷’ লঘুভার হাসল অনীতা : বিয়ে করতে আর হাঙ্গামা কী!’

‘শুনছি আমাকেও নাকি বাইরে ঠেলে দেবে৷’

‘দিক না৷ তাহলে মফঃস্বলে যাব৷ আর যদি না দেয়, কলকাতায়ই থাকো, চলে আসব এখানে৷ মোট কথা, চোখে তীক্ষ্ন আকুতি নিয়ে তাকাল অনীতা : ‘শুভস্য শীঘ্রম৷’

‘লোকে কী বলবে!’

‘লোকের কথা ছেড়ে দাও৷’

‘লোকে বলবে বউ মারা যাবার এক মাস পরেই বিয়ে করল৷’

‘এক বছর পরে করলেও বলবে৷’ একটু-বা তপ্ত হল অনীতা : ‘লোকের হাতে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের ভার নেই৷ লোকে কী জানে আমার তপস্যার কথা!’

‘তপস্যা?’

‘হ্যাঁ, প্রতীক্ষা আর প্রার্থনাই তপস্যা৷’ অনীতা ঘড়ির দিকে তাকাল : ‘তোমার বিয়ের প্রায় দু’বছর পর আমাদের দেখা৷ তুমি আমাকে বললে, তুমি আমার পরম হয়ে এলে তো প্রথম হয়ে এলে না কেন? সেই থেকেই প্রার্থনা করছি, প্রতীক্ষা করে আছি, কবে সে চরম দিন আসবে, কবে পথ পরিষ্কার হবে৷ তিন বছরের পর সেই সুযোগ আজ এল৷ এই তিন বছর সমানে আকাঙ্ক্ষা করে এসেছি আমাদের স্বাধীনতা৷’

অর্থাৎ গত তিন বছর ধরেই অনীতা সুরভির মৃত্যুকামনা করে এসেছে৷

বুকের মধ্যে একটা ঘা মারার শব্দ শুনল অনিমেষ৷ সে শব্দ কি তারও আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি!

না, তা কি করে হয়! সুরভি বেঁচেছিল বলেই তো অনীতার প্রতি তার আকর্ষণ এত জ্বলন্ত ছিল জীবন্ত ছিল৷ সুরভি আজ বেঁচে নেই, তাই কি অনীতাও আজ স্তিমিত, নিষ্প্রভ?

‘এ কী, ট্রেন ছাড়ছে না কেন?’ সময় কখন হয়ে গেছে, তবু ছাড়বার নাম নেই৷ ছাড়বার ঘণ্টা পড়লেই তো অনিমেষ নেমে যেতে পারে৷ রুমাল নেড়ে দিতে পারে বিদায়৷

কি একটা গোলমালে ট্রেনটা থেমে আছে, ছাড়ছে না৷ দীর্ঘতর হচ্ছে এই নিষ্ফল সান্নিধ্য৷

সব ট্রেনই ছাড়ে, ছেড়ে যায়, শেষ পর্যন্ত অনীতাটারও ছাড়ল৷

নামতে গিয়ে অনিমেষ আবার পড়ল নাকি পা হড়কে? না, সে অত অপোগণ্ড নয়৷ তার পায়ের নিচে মোলায়েম প্ল্যাটফর্ম কে ঠিক পৌঁছে দিয়েছে৷

মফঃস্বলে বদলি হয়ে এসেছে অনিমেষ৷

ভালোই হয়েছে৷ বদল হয়েছে পরিবেশের৷ মেঝেতে পায়ে-পায়ে আলতার দাগ ফেলা নেই, নেই আর স্মৃতির রক্তাক্ত কন্টক৷

ছোট ছাতওলা বাড়ি, উপরে দুখানা মোটে ঘর৷ একটা শোবার আরেকটা বসবার৷ নিচে বাবুর্চি-চাকর৷ এর চেয়ে আরো ছোট হলে চলে কি করে? তবু অনিমেষের যেন কি রকম ফাঁকা-ফাঁকা লাগে৷ এদিক-ওদিক প্রতিবেশীদের বাড়িঘরগুলি কেমন দূর-দূর মনে হয়৷ মনে হয় বাড়িটাকে ঘিরে যেন অনেক গাছপালা, অনেক হাওয়া, অনেক অন্ধকার৷ গাড়িঘোড়ার আওয়াজ অনেক পর-পর শোনা যায়, ফিরিওয়ালারা এদিকে কম আসে৷ অথচ নদী কত দূরে, মধ্যরাত্রে একটু হাওয়া উঠলেই শোনা যায় গোঙানি৷

কাজে-কর্মে লোকজন আসে কিন্তু তাদেরও আসার মানেই হচ্ছে চলে যাওয়া৷ সমস্ত ভিতর-বার আশ-পাশ একটা শূন্যতার শ্বাস দিয়ে ভরা৷

না, আসুক অনীতা৷ ঘরদোর ভরে তুলুক৷

আশ্চর্য সেই রকমই চিঠি লিখেছে অনীতা৷ এই মফঃস্বল শহরেই সে একটা উচ্চতর চাকরির জন্যে আবেদন করেছে৷ কদিন পরেই ইনটারভিউ৷

হ্যাঁ, কোথায় আর উঠবে, অনিমেষেরই অতিথি হবে অনীতা৷

চিঠি লিখে বারণ করল অনিমেষ৷ তুমি এস, থাকো, চাকরি করো কিন্তু আমার বাড়িতে উঠো না৷ অন্তত এখন নয়, একেবারে আজকেই নয়৷ জানোই তো, আমার বাড়িতে মেয়েছেলে কেউ নেই৷ তোমার অসুবিধে হবে৷ তা ছাড়া আমি দুর্বার একা৷

আগে অধিষ্ঠিত হও, পরে প্রতিষ্ঠিত হবে৷

পাল্টা জবাব দিল অনীতা৷ প্রায় তিরস্কারের ভঙ্গিতে৷ লিখলে, আমি একজন সম্ভ্রান্ত, পদস্থ শিক্ষিকা, একটা চাকরির সম্পর্কেই তোমার কাছে একদিনের সাময়িক আশ্রয় চাইছি, অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়৷ আর, নিজেকে অত দুর্বার বলে স্পর্ধা করো না৷ ভাববে আমার প্রতিরোধও দুঃসাধ্য৷ অন্তত যতক্ষণ আমি সম্ভ্রান্ত, পদস্থ শিক্ষিকা৷

না, তুমি এস৷ ঝগড়াঝাঁটির কী দরকার! তুমি এলে কত গল্প করা যাবে৷ কত হাসা যাবে মন খুলে৷ স্তব্ধতাকেও কত মনে হবে রমণীয়৷

আজ সন্ধের ট্রেনে আসবে অনীতা৷ শুধু রাতটুকু থাকবে৷ কাল সকালে ইন্টারভিউ দিয়েই দুপুরের ট্রেনে ফিরে যাবে নিজের জায়গায়৷

সকাল থেকেই মেঘ-মেঘ বৃষ্টি-বৃষ্টি৷ দুপুরে ঘনঘোর করে বর্ষা নেমেছে৷ সন্ধের দিকে তোড়টা কমলেও হাওয়াটা পড়েনি৷ চলেছে জোলো হাওয়ার ঝাপটা৷

স্টেশনে এসে অনিমেষ শুনল গাড়ি তিন ঘণ্টার উপর লেট৷

ভীষণ দমে গেল শুনে৷ বাইরে দুর্যোগ থাকলেও অন্তরে বুঝি একটা আগুনের ভাণ্ড ছিল৷ সেটা নিবে গেল ধুঁইয়ে ধুঁইয়ে৷

রাস্তায় জনমানব নেই৷ দোকানপাট বন্ধ৷ শুধু একলা এক পথহারা হাওয়া এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে৷

সাইকেল রিকসা করে বাড়ি ফিরল অনিমেষ৷

সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দেখল, এ কী! তার শোবার ঘরে আলো জ্বলছে৷ দরজা তালাবন্ধ৷ হাওয়ার দাপটে দরজার পাল্লা দুটো ফাঁক হয়েছে, তারই মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে আলো৷ তবে কি ঘর বন্ধ করে বেরুবার আগে ভুলে সুইচটা অন করি রেখেছিল? তাই হবে, নইলে আলো জ্বলে কী করে? পথে আসতে দেখছিল, স্টেশনেও তাই, ঝড়ের উৎপাতে সারা শহরের কারেন্ট অফ হয়ে গিয়েছিল৷ কে জানে, কারেন্ট হয়তো ফিরে এসেছে এতক্ষণে৷ বারান্দার সুইচটা টিপল, আলো জ্বলল না৷ হয়তো বারান্দার বালবটা ফিউজ হয়ে গিয়েছে৷

দরজার তালা খুলে ঘরে ঢুকতেই ঘরে আর আলো নেই৷

মুখস্থ জায়গায় হাত রেখে সুইচ পেল অনিমেষ৷ সুইচ টিপল৷ আলো জ্বলল না৷ না, আসে নি কারেন্ট৷ কিংবা এসে এখন আবার অফ হয়েছে৷

হাতের টর্চ টিপল অনিমেষ৷ মনে হল ঘরের মধ্যে অন্ধকার যেন নড়ছে-চড়ছে, ঘোরাঘুরি করছে! অন্ধকার কোথায়! একটা লোক৷

‘কে?’ ভয়ার্ত চিৎকার করে উঠল অনিমেষ৷

দরজা খোলা পেয়ে লোকটা পালিয়ে গেল বুঝি! অনিমেষ প্রবল শক্তিতে দরজা বন্ধ করল৷ প্রায়ই কারেন্ট বন্ধ হয় বলে ক্যান্ডেল আর দেশলাই হাতের কাছে মজুত রাখে৷ তাই জ্বালাল এখন৷ হোক মৃদু, একটা স্থির অবিচ্ছিন্ন আলো দরকার৷

কই, লোকটা যায় নি তো! খাটের বাজু ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে!

‘এ কে?’ একটা বোবা আতঙ্ক অনিমেষের গলা টিপে ধরল৷ ‘এ যে সুরভি!’

পরনে কস্তাপাড় শাড়ি, সিঁথিতে ডগডগে সিঁদুর, খালি পায়ে টুকটুকে আলতা, ঠোঁট দুখানি চুনে-খয়েরে রঙিন করা—সুরভি ডান হাতের তর্জনী তার ঠোঁটের উপর রাখল৷ যেন ইঙ্গিত করল, অনিমেষ যেন না চেঁচায়, না কথা বলে৷

তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে দেয়ালের দিকে সরে গেল সুরভি৷ সরে গেল যেখানে একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছে৷ একটা তারিখের উপর আঙুল রাখল৷ দুই চোখে ক্রুদ্ধ ভর্ৎসনা পুরে তাকাল অনিমেষের দিকে৷

সেই চিহ্নিত তারিখে টর্চের আলো ফেলল অনিমেষ৷ দেখল, আঙুলের ডগায় করে এক ফোঁটা রক্তের দাগ রেখেছে তারিখে৷

কোন তারিখ? এ তো আজকের তারিখ৷ বাংলা আঠাশে আষাঢ়৷ বেস্পতিবার৷

আঠাশে আষাঢ় কী? আঠাশে আষাঢ় অনিমেষ-সুরভির বিয়ের দিন৷ একদম ভুলে গিয়েছিল৷ আর আর বছর সুরভিই মনে করিয়ে দিত, এবারও তেমনি মনে করিয়ে দিতে এসেছে৷

অদূরে দাঁড়িয়ে হাসছে সুরভি৷ কেমন মজা৷ যেতে না যেতেই মুছে দিয়েছ মন থেকে৷ মুছে দিয়েছ দেয়াল থেকে৷ ঘুরে ঘুরে চারদিকের দেয়ালের দিকে তাকাতে লাগল৷ আমার একটা ছবিও কোথাও রাখ নি৷

‘সুরভি:’ তাকে ব্যাকুল হাতে ধরতে গেল অনিমেষ৷

হা-হা-হা করে একটা বাতাস ছুটে গেল ঘরের মধ্যে৷ বন্ধ দরজা-জানলা ঝরঝর ঝরঝর করে উঠল৷ সিঁড়িতে শোনা গেল নেমে যাবার পায়ের শব্দ৷ শুধু যেন সুরভি একা নয়, তার সঙ্গে আছে আরো অনেকে৷ একসঙ্গে নেমে যাচ্ছে৷ কেবল নেমে যাচ্ছে৷ ভারী পায়ে ক্লান্ত পায়ে নেমে যাচ্ছে৷

ভয়ে আপাদমস্তক ঘেমে উঠল অনিমেষ৷

হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল৷ মনে হল এ আলো নয়, কে যেন সহসা হেসে উঠেছে খিলখিল করে৷

তাড়াতাড়ি অল্প-স্বল্প খেয়ে শুয়ে পড়ল অনিমেষ৷ টর্চ, ছাতি, ওয়াটারপ্রুফ দিয়ে চাকরকে পাঠালো স্টেশনে৷ যত টাকা লাগুক যেন রিক্সা ঠিক রাখে৷ যত দেরিই হোক, ঠিকমতো আসতে পারে যেন অনীতা৷

ঘড়িতে রাত বেশি হয় নি, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন অনন্ত রাত৷ গাছগাছালির মধ্যে বাড়িটাকে মনে হচ্ছে যেন রুদ্ধশ্বাস কবরের স্তূপ৷ কেবল বাতাসের হা-হা, ডালপালার কাতরতা৷

বিছানায় জেগে বই পড়ছে অনিমেষ৷ জাগ্রত সমর্থ বন্ধুর মতো আলোটা রয়েছে চোখের উপর৷

খট-খট খট-খট৷ দরজায় কে আঙুলের শব্দ করল৷

চমকে উঠল অনিমেষ৷ নিশ্চয় মানুষ৷ অন্য কেউ হলে আলো নিবে যেত, হাওয়া উঠে দরজা-জানলা কাঁপাত, সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হত, নয়ত কুকুর কোথাও কাঁদত মরাকান্না৷ মানুষ বলেই বারান্দার আলোটাও নেবে নি৷

ভয়ের জন্যে লজ্জা হতে লাগল অনিমেষের৷ বালিশের নিচে হাত দিয়ে রিভলবারটা একবার অনুভব করল৷

ধীরে ধীরে খুলে দিল দরজা৷

‘এ কী! তুমি—অনীতা?’

‘উঃ, কী ভীষণ লেট তোমাদের গাড়ি৷ আর তারপর কী জঘন্য বৃষ্টি!’

‘তোমার জন্যে স্টেশনে চাকর পাঠিয়েছিলাম, সে কোথায়?’

‘কই কারু সঙ্গে দেখা হয় নি তো৷ একাই চলে এলাম৷’ ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল অনীতা৷

‘তোমার মালপত্র কোথায়?’

‘সব স্টেশনে পড়ে আছে৷ শোনো, আমি ভীষণ ক্লান্ত৷ এক গ্লাস জল খাব৷’

টেবিলের উপর ঢাকা গ্লাসে জল ছিল, তাই ঢক ঢক করে খেয়ে নিল অনীতা৷ বললে, ‘শোবার জায়গা করেছ কোথায়?’

‘পাশের ঘরে৷’

‘আমি যাই, শুয়ে পড়ি গে৷ দাঁড়াতে পারছি না৷’ ম্লানরেখায় হাসল অনীতা : ‘নিদারুণ ঘুম পেয়েছে৷’

‘বাঃ, সে কী! খাবে না?’

‘না, পথে অনেক খাওয়া হয়েছে৷ আচ্ছা আসি৷’ পাশের ঘরে গিয়ে দ্রুত হাতে দরজায় খিল চাপাল অনীতা৷

তবু দরজায় মুখ রেখে বলল অনিমেষ, ‘ঘরের আলোটা জ্বেলে রেখো৷ আর দেখো, নতুন জায়গায় যেন ভয় পেয়ো না৷ ভয় পেলে আমাকে ডেকো৷’

অনীতার যেন আর কিছুতে ভয় নেই, তার বুঝি অনিমেষকেই ভয়৷

কেন, কেন দুজনে আজ ঝড়ের রাতে একসঙ্গে একঘরে থাকবে না? থাকলে জীবন্ত লোকের সংস্পর্শে পরস্পরের আর ভয় থাকত না৷ আর যে ভয়ের কথা অনীতা ভেবেছে সে যে কত অবাস্তব গায়ের উত্তাপে বুঝিয়ে দিত৷

তখন কত রাত কে জানে? দু’ঘরের মাঝের দরজায় টুক করে একটা শব্দ হল৷ সে শব্দ স্পষ্ট চিনল অনিমেষ৷ সে খিল খোলার শব্দ৷

রুদ্ধ নিশ্বাসে বিছানায় বসে রইল অনিমেষ৷

কই অনীতা এল না এ ঘরে৷

না, অনিমেষকেই ডাকছে অনীতা৷ এক নির্জনতা ডাকছে এক নিঃসঙ্গতাকে৷ এক ভয় আরেক ভয়কে৷

পা টিপে টিপে অনিমেষই উঠে গেল৷ খোলা দরজায় ঠেলা দিয়ে ঢুকল ওঘরে৷

দেখল, আলোতে দেখল, একি, অনীতা কোথায়? তার বদলে খাটে পাতা বিছানায়, বিলোল ভঙ্গিতে সুরভি শুয়ে আছে!

‘অনীতা, অনীতা কোথায়?’ চিৎকার করে উঠল অনিমেষ৷ টলে পড়ে গেল মাটিতে৷

পরদিন সকালে হাসপাতালে অনিমেষের জ্ঞান হল৷ একটু সুস্থ হলে শুনল গতরাত্রে ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে অনীতা মারা গেছে আর ক্যালেন্ডারের তারিখে যে রক্তবিন্দুটা দেখেছিল সেটা আসলে লালকালির চিহ্ন, মরবার অনেক আগেই তারিখটা দাগিয়ে রেখেছিল সুরভি৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *