রক্তাক্ত হাতের দুঃস্বপ্ন
মূল গল্প A Dream of Red Hands (Bram Stoker)
কুলি-মজুরদের মুখে জ্যাকব সেটেলের সম্পর্কে প্রথম যে কথাটা শুনেছিলাম সেটা হল এই যে লোকটা নাকি বেজায় মুখচোরা আর খামখেয়ালি গোছের৷ প্রয়োজনের বেশি একটা বাক্য তার মুখ থেকে বের করবে এমন মাতব্বর এ বস্তিতে নেই৷ কিন্তু আমি নিজে সেটেলের সঙ্গে মেলামেশা করে দেখেছি কথাটা যতটা ঠিক আবার ততটাই ভুল৷
প্রথমবার তাকে দেখলে মনে হবে সারাক্ষণই চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছে৷ যেন কোনওরকমে সবার মাঝখানে থেকে সময়টা কাটিয়ে দিতে পারলেই বাঁচে৷ ফলে এখানে তার তেমন বন্ধুবান্ধব বলে কিছু হয়ে ওঠেনি৷ কিন্তু তাও, তাকে ভালো করে লক্ষ করলে কেমন যেন খটকা লাগে আমার, আমি কুলিমজুর কম দেখিনি, কিন্তু তাদের সবার থেকে কোনও একটা জায়গায় সেটেল আলাদা৷ খনি শ্রমিকরা যে পরিমাণ কাজ করে তার তুলনায় মাইনে সাধারণত কমই পেয়ে থাকে, তা সত্ত্বেও দিনের শেষে শ্রান্ত-ক্লান্ত শরীরে মদের ফোয়ারা ছুটিয়ে গোটা বস্তি জুড়ে দেদার নাচা-গানা করে তারা, কিন্তু সেসবের মধ্যেও দেখা যায় না সেটেলকে৷ প্রথমে ভেবেছিলাম লোকটা কিপটে, কিন্তু পরে বুঝলাম কারওর হুট করে টাকার দরকার পড়লে সে সেটেলের কাছে গিয়েই উপস্থিত হয়, এবং সেও দিলদরিয়া হাতে উধারি এগিয়ে দেয় সাহায্যপ্রার্থীর দিকে৷ রুক্ষ-শুষ্ক বদমেজাজি খনি শ্রমিকের মধ্যে এতটা উদারতা চোখে পড়ার মতো৷ আরেকটা ব্যাপারও মনে হয়ছে আমার৷ মহিলা আর শিশুদেরকে এড়িয়ে চলে সে, একমাত্র কেউ কোনও কঠিন রোগে আক্রান্ত হলে বা রাস্তাঘাটে আহত হলে তখনই তাদের এগিয়ে এসে সাহায্য করে৷ সব মিলিয়ে বলা যায় সবার মাঝে থেকেও বেশ একাকিত্বে দিন কাটায় সেটেল৷ খনির বাইরের দিকে বেশ খানিকটা জলাভূমি আছে৷ তারই একপাশে একটা এক-কামরার কটেজে থাকে সে৷ সেদিকে খুব একটা যায় না কেউ৷ আমার সঙ্গে দেখা হলে একটা স্মিত হাসি হেসে কাজে এগিয়ে যায় সেটেল৷ মাঝে-মাঝে মনে হয় লোকটা শ্রমিক হবার আগে হয়তো ফাদার কিংবা বিশপ জাতীয় কিছু একটা ছিল৷
এর মাঝে সেটেল কয়েকবার আমার থেকে বই ধার নিয়েছে৷ বলা বাহুল্য তার প্রতিটাই সময়মতো ফিরিয়ে দিয়েছে, কথার নড়চড় করেনি৷ বেশ কিছুদিন এরকম বই আদান-প্রদান করতে-করতে খানিকটা বন্ধুত্বই তৈরি হয়ে গেছিল আমাদের মধ্যে৷ কয়েকদিন জলাভূমি পার হয়ে আসার সময় গল্প করার জন্য ডেকেওছিলাম সেটেলকে৷ কিন্তু আমার সামনে দাঁড়িয়ে সে এতটাই কুণ্ঠা বোধ করত যে আমি আর এখানে দাঁড়াতাম না৷
দিনটা ছিল রবিবার৷ বিকেলবেলা অন্যদিনের মতোই জলার ধার দিয়ে ফিরছিলাম৷ সেটেলের কটেজের পাশে আসতেই ইচ্ছা করল তাকে একটু হাঁক দিয়ে যাই৷ দরজা বন্ধই ছিল৷ মন বলে উঠল এই মুহূর্তে সেটেল কটেজ ছেড়ে কোথাও গেছে, দরজায় একটা টোকা দিয়ে ফিরে আসতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু ভিতর থেকে মৃদু গলার শব্দ আসতে থেমে গেলাম৷ কথাগুলো ভালো করে শুনতে পেলাম না৷ অস্পষ্ট ধরা গলার কয়েকটা বিক্ষিপ্ত উচ্চারণ৷ দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে এলাম৷ আর ঢুকতেই যে দৃশ্য দেখলাম তাতে আশঙ্কায় আমার নাড়ির গতি বেড়ে গেল৷ বিছানার উপর প্রায় শবদেহের মতো শুয়ে আছে সেটেল, তার সমস্ত শরীর ফ্যাকাসে হয়ে আছে৷ চোখ দুটো আতঙ্কে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে কোটর থেকে, ডুবন্ত মানুষ জলের উপর হাত বাড়িয়ে যেভাবে খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চায় ঠিক সেইভাবে বিছানার চাদরটা আঁকড়ে ধরেছে সে৷ আমি তার কাছে এগিয়ে আসতে খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে সে উঠে বসল৷ চোখ দুটো এখনও আতঙ্কে স্থির হয়ে আছে৷ যেন এইমাত্র ভয়ংকর কোনও দৃষ্টি সরে গেছে সেখান থেকে৷ আমাকে ধীরে-ধীরে চিনতে পারল সে৷ খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে নীচু স্বরে ফোঁপাতে-ফোঁপাতে আবার বিছানার উপর ঢলে পড়ল৷ আমি দু-মিনিট ঠায় সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম৷ তারপর সেটেল চোখ মেলে তাকাল৷ মনে হল এই প্রথম সে কোনও জীবিত মানুষকে দেখেছে৷ আমি বিছানার একপাশে বসে পড়লাম, অনেকটা সময় পেরিয়ে যেতে তার মুখ থেকে ফ্যাকাসে ভাবটাও মিলিয়ে এল৷ সেটা লক্ষ করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখন ভালো লাগছে খানিকটা?’
কিছুক্ষণ সে কোনও উত্তর দিল না, তারপর কনুইতে ভর দিয়ে উঠে বসে বলল, ‘আপনি কী ভাবছেন আমি জানি স্যার, কিন্তু বিশ্বাস করুন কোনও শারীরিক বা মানসিক রোগ নেই আমার, অথবা… অথবা হয়তো এটাও একটা রোগই, সব রোগের কথা কি ডাক্তাররা জানে?’ খানিক চুপ করে থেকে সে আবার বলতে লাগল, ‘আপনি যখন দেখেই ফেলেছেন তখন আজ সব কথা বলব আপনাকে, কিন্তু কথা দিন, এসব কথা আপনি আর কাউকে বলবেন না৷’
‘না-না, আমার আর বলার মতো আছে কে? তুমি নিশ্চিন্তে বলতে পার৷’ আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম৷
একটু ভেবে নিয়ে সে বলল, ‘আমার… আমার রোগটা হল একটা দুঃস্বপ্ন৷’
‘দুঃস্বপ্ন!’ মনে-মনে একটু যেন হাসিই পেল আমার৷ এরকম রোগ হয় বলে জানা ছিল না৷
বললাম, ‘এতে রোগের কী আছে? দুঃস্বপ্ন তো আমরা সবাই…’
আমার কথা শেষ হবার আগেই সে বাধা দিয়ে উঠল৷ ‘না-না… সব কথা আপনি জানেন না৷ আমার প্রতিটা রাত অভিশপ্ত, ঘুমের ঘোরে ভয়ংকর সেই স্বপ্নটা দেখে চোখ খোলে আমার, রাতের অন্ধকার তখনও আমার চোখের সামনে কালো পর্দা ঝুলিয়ে রাখে, মনে হয় সেখানেই আবার দেখতে পাব স্বপ্নটা৷ সেই মৃদু ফিসফিসানি, সেই ভয়ানক চিৎকার, সব যেন কানে শুনতে পাই তখনও৷ আপনি জানেন না, রাত্রিবেলা ঘুমাতে পারি না আমি কেবল মাত্র ভয়ে৷ আমাদের অতীত যে কত ভয়ংকর রূপে ফিরে আসতে পারে তা আপনি ভাবতেও পারবেন না৷’ কথাগুলো বলে আবার যেন ভেঙে পড়ল সেটেল৷
আমি আর কিছু বললাম না তাকে, পুরনো কথাগুলো আবার মনে পড়ল আমার৷ হয়তো সেটেলের অতীতে কিছু একটা আছে৷ যেটার কথা আমরা জানি না, সেই অতীতটাই বারবার ফিরে এসে ভয় দেখায় তাকে৷
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সেই আবার বলতে লাগল, ‘শেষ দু-রাত দেখেছি স্বপ্নটা, প্রথম দিন ঘুম ভেঙে যাবার পরে জেগেছিলাম সারারাত, কিন্তু দ্বিতীয়দিন আর সহ্য করতে পারলাম না৷ একটুকরো আলোর খোঁজে হাতড়ে বেড়ালাম গোটা ঘরময়, কিন্তু টর্চটাও খুঁজে পেলাম না৷ অন্ধকারে সেইভাবে তটস্থ হয়ে বসে থাকতে-থাকতে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ ভোররাতে আবার দেখলাম স্বপ্নটা৷ ভেবেছিলাম মরে গেলেই হয়তো সব যন্ত্রণার সমাধান হবে, কিন্তু তারপরেই মনে হল মৃত মানুষ যে স্বপ্ন দেখে না তাই বা কে বলতে পারে…’
অচিরেই শেক্সপিয়ার মনে পড়ে গেল আমার, ‘ইন দ্যাট স্লিপ অফ ডেথ, ওয়াট ড্রিমস মে কাম৷’ মনের ভিতর কৌতূহলটা বেড়ে উঠছিল, কিন্তু ভেবে দেখলাম এই মুহূর্তে তার পেট থেকে কথা বের করার থেকে তাকে উৎসাহ দেওয়াটাই বেশি দরকার৷ তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললাম, ‘ওসব ভেবে আর কাজ নেই, রাতে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়, তাহলেই দুঃস্বপ্নের অত্যাচার বন্ধ হয়ে যাবে৷ খনির ভিতর নেমে কাজ করাটা এমনিই দুঃস্বপ্নের, ভালো করে রেস্ট নাও, সব ঠিক হয়ে যাবে৷’
সেটেলের কটেজ থেকে বাড়ি আসার পথেই ঠিক করে নিয়েছিলাম যে আজ রাতটা আমি তার কটেজেই কাটাব৷ আমার হিসেব মতো সে যদি সন্ধের পরেই শুয়ে পড়ে তাহলে বারোটার কাছাকাছি ঘুম ভাঙবে তার৷ ঠিক এগারোটার সময় কাঁধে একটা ছোট ব্যাগে রাতের খাবার-দাবার নিয়ে তার কটেজের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি৷ আকাশে ভরাট পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে৷ তার আলোয় ভেসে যাচ্ছে জলাভূমিটা৷ তার মাঝেই খানিকটা জায়গা কালো মেঘের মতো আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে৷ সেটেলের কটেজটাও তেমনি দেখাল৷ দরজায় হালকা চাপ দিয়ে ভিতরে ঢুকে এলাম আমি৷ বিছানার উপর সোজা হয়ে শুয়ে আছে সেটেল৷ বেশ বুঝতে পারলাম এখনও সারা শরীর ঘামে ভিজে আছে তার৷ মনে-মনে ভাবার চেষ্টা করলাম ওই বন্ধ চোখ দুটোর নীচে কী দৃশ্য এখন দেখছে সে, যেগুলো সারারাত জেগে থাকতে বাধ্য করে তাকে৷ অনেক ভেবেও কিছু আন্দাজ করতে পারলাম না৷ ঘরের একপাশে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম তার ঘুম ভাঙার জন্য৷ বেশ কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতার পরে একটা গোঙানির আওয়াজ আমার কানে এল৷ সেটেলের খোলা ঠোঁটের ভিতর থেকে আসছে শব্দটা৷ তার কোমরটা ধীরে-ধীরে বেঁকে যাচ্ছে, যেন যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠছে সে৷
‘এটাই যদি স্বপ্নটা হয়৷’ আমি মনে-মনে ভাবলাম, ‘তাহলে যে ঘটনাটা নিয়ে সে স্বপ্নটা দেখে সেটা অতীতে তার জীবনেই ঘটেছিল৷ বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেটেলের ঘুম ভেঙেছে৷ স্বপ্ন ভেঙে হঠাৎ জেগে উঠলে সাধারণত আমরা কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে থাকি৷ কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা বাস্তব সেটা ঠিক করে নিতে একটু সময় লাগে, সেটেলের ক্ষেত্রে তেমন কিছুই হল না, সে যেন এতক্ষণ বাস্তবেই ছিল এইভাবে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে আমার দিকে এগিয়ে এসে চেপে ধরল আমার হাত দুটো৷ বেশ বুঝতে পারলাম তার কম্পমান হাত দুটো ঘামে ভেজা৷ আমি তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলাম, ‘আরে ঠিক আছে, এত ভয় পাবার কিছু নেই, আজ রাতটা আমি এখানেই আছি, দেখা যাক দু-জনে মিলে তোমার স্বপ্নটাকে তাড়াতে পারি কি না৷’
সে আমার হাত দুটো ছেড়ে দিয়ে আবার বিছানার উপর গড়িয়ে পড়ে চোখ ঢেকে ফেলল৷ ‘তাড়াতে!’ সে ধরা গলায় বলল, ‘না স্যার, কোনও জীবিত মানুষের পক্ষে এ স্বপ্নের সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব নয়, আমি… আমি অভিশপ্ত… সে অভিশাপ কোনওদিন ছেড়ে যাবে না আমাকে, অহহ ঈশ্বর… প্রতিদিন… প্রতিরাত… ওই একটাই স্বপ্ন, বারবার… বারবার ক্ষতবিক্ষত করে আমাকে৷’
‘ঠিক কী দেখ বলতো স্বপ্নে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম৷ ভাবলাম সেটা বলতে পারলে হয়তো তার মন খানিকটা হালকা হবে৷ প্রশ্নটা শুনে সে আমার থেকে খানিকটা দূরে সরে গেল, বড়সড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘না থাক, ওটা কাউকে না বলাই ভালো৷ হয়তো আর দেখব না৷’
বেশ বুঝতে পারলাম সে কিছু লুকাতে চাইছে আমার থেকে৷ বললাম, ‘ঠিক আছে, মেনে নিলাম৷ যদি আর না দেখ স্বপ্নটা তাহলে তার থেকে ভালো আর কিছু হয় না৷ কিন্তু যদি আবার দেখ তাহলে সবার আগে আমার কাছেই খুলে বলবে সব, ঠিক আছে? নিজের কৌতূহলের জন্য বলছি না, তবে মনে হয় কথাগুলো আমাকে বলতে পারলে তোমার মনের অন্ধকার খানিকটা ঝাপসা হবে৷’
সেটেল আমার দিকে তাকিয়ে ধীরে-ধীরে মাথা দুলিয়ে বলল, ‘যদি আবার দেখি তাহলে নিশ্চয়ই বলব আপনাকে৷’
আমি এটা-সেটা নিয়ে কথা বলা শুরু করলাম তার সঙ্গে৷ পিঠের ব্যাগে যে খাবার-দাবার ছিল সেগুলো দুটো প্লেটে ভাগ করে একটা এগিয়ে দিলাম তার দিকে, একটা নিজে নিলাম৷ ফ্লাস্কে খানিকটা কফি এনেছিলাম সেটাও এগিয়ে দিলাম তার দিকে৷ এতে খানিকটা স্বাভাবিক হল সে৷ দুটো সিগার ধরিয়ে টানতে লাগলাম দু-জনে৷ ধীরে-ধীরে তার অর্ধমৃত শরীরে যেন প্রাণ ফিরে এল৷ তার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল ক্লান্ত চোখের পাতায় আস্তে-আস্তে ঘুমের ছোঁয়া লাগছে৷ আবার আগের মতো বিছানায় শুয়ে পড়ল সে, বলল, ‘আজ রাতে আর কিছু হবে না, আপনি ফিরে যান স্যার৷’
আমি মাথা নাড়লাম, ‘হোক না হোক, সকালের আলো ফোটার আগে আমি এখান থেকে নড়ছি না৷’
অগত্যা সে পাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করল৷ আমিও এককোণে একটা মোমবাতি জ্বেলে তার আলোয় বই পড়তে লাগলাম৷
বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়ছিলাম বইটা, এতক্ষণ খেয়ালই হয়নি, এখন মনে হল ঘুমের মধ্যে কিছু যেন আওড়াচ্ছে সেটেল৷ কান পেতে ভালো করে শোনার চেষ্টা করলাম, ‘লাল হাত… না৷ না… ওই হাত দুটো…’ আমি তার বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ঘুম ভেঙে গেল তার৷ মুখ দেখে মনে হল যেন এতক্ষণ জেগেই ছিল সে৷ আমি বিছানার একপাশে বসে পড়ে বললাম, ‘স্বপ্নটা আমার থেকে লুকিও না সেটেল, তাতে খারাপ বই ভালো হবে না, আমি কথা দিচ্ছি আজ তুমি যা বলবে সেটা এই কটেজের বাইরে যাবে না, আমরা যতদিন বেঁচে আছি সে কথাগুলো কাউকে বলব না আমি৷’
প্রায় একমিনিট চুপ করে থেকে মুখ খুলল সেটেল, বলল, ‘বলব৷ কিন্তু স্বপ্নটা জানার আগে অন্য একটা কথা জানা দরকার আপনার৷’
আমি আর কিছু বললাম না, বুঝলাম এতকালের জমানো কথা গুছিয়ে নিতে খানিকটা সময় দরকার তার৷
‘তখন আমার অল্প বয়স৷ এখানে খনিমজুর হয়ে আসার আগে ওয়েস্ট কান্ট্রির একটা স্কুলে মাস্টারি করতাম৷ স্কুলটা তেমন বড় নয়, ছোটদের স্থানীয় স্কুল৷ তো পড়াতে-পড়াতে সেখানকার একটা মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় এবং কিছুদিনের মধ্যে তাকে ভালোও বেসে ফেলি আমি৷’ কিছুক্ষণের নীরবতা, তারপর আবার বলতে থাকে সেটেল, ‘তখন সবে চাকরিতে ঢুকেছি, হাতে টাকাপয়সা বেশি নেই, দু-জনে ঠিক করেছিলাম কয়েক বছরে চাকরিতে একটু থিতু হলে তারপর বিয়ের কথা ভাবা যাবে৷ এভাবেই দিন কাটছিল৷ হঠাৎ আমাদের ভালোবাসার মাঝে আরেকটি ছেলে এসে উপস্থিত হল৷ বয়সে আমার মতোই হবে, মেয়েরা ঠিক কী ধরনের পুরুষকে সুদর্শন মনে করে তা এখনও আমার আন্দাজের বাইরে, যাই হোক আমার মতে তাকে দেখতে-শুনতে খারাপ ছিল না৷ সেই সঙ্গে টাকার জোরও ছিল তার৷ এরকম সুদর্শন, ধনী উচ্চবিত্ত পুরুষরা মেয়েদের মন জয় করার স্বভাবটা বোধহয় জন্মগত পেয়ে থাকে৷ এ ক্ষেত্রেও তাই হল৷ সর্বনাশ হল আমার৷ আমি যখন স্কুলে পড়াতাম ওরা দু-জনে জেলে বোট নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে যেত৷ অনেকবার ওকে বুঝিয়েও কোনও লাভ হল না৷ বললাম, চল যা টাকাপয়সা আছে তাই নিয়ে বিয়ে করে অন্য কোথাও চলে যাই৷ কিন্তু কোনও কথাই কানে গেল না তার৷ দিন-দিন লোকটার প্রতি ওর টান বাড়তেই লাগল৷ শেষে ঠিক করলাম ওকে বুঝিয়ে যখন লাভ হচ্ছে না, লোকটার সঙ্গেই দেখা করি৷ হয়তো ঠিক করে বোঝাতে পারলে সে নিজে থেকেই ছেড়ে দেবে৷ জলার ধারে একটা ফাঁকা জায়গায় লোকটাকে ডাকলাম, সেও সময়মতো এসে পৌঁছাল সেখানে৷’
এতদূর বলে আবার খানিকটা চুপ করে থাকল সেটেল৷ তার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে, যেন স্বপ্নটাই যেন আবার দেখতে চলেছে সে৷
‘ভগবান সাক্ষী আছে স্যার, সেদিন তাকে বোঝানো ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য ছিল না আমার৷ মেবেলকে খুব ভালোবাসতাম আমি—সবটুকু না হোক, তার খানিকটা ভালোবাসা পেলেও আমার চলে যেত৷ কিছুটা তো বুঝতেই পেরেছিলাম যে আমার আগের মেবেলকে কোনওভাবেই আর ফিরে পাব না৷ হয়তো সেদিন হেরে গিয়ে ফিরেই আসতাম, কিন্তু সেই লোকটা, সে কদর্য ভাষায় অপমান করল আমাকে৷ তাতেও কিছু মনে করিনি আমি৷ কিন্তু কিছুক্ষণ কথা বলেই বুঝলাম লোকটার উদ্দেশ্য ভালো নয়৷ আমার মেবেলের সঙ্গে শুধু কিছুটা সময় কাটাতে চায় সে, তার বেশি কিছু নেই৷ সন্দেহটা তাকে জিজ্ঞেস করতেই লোকটা এমন পিশাচের মতো হেসে উঠল যে আমার মাথায় খুন চেপে গেল৷ ভাবলাম, এ কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না৷ আমি নিজের খুশির জন্য ভাবি না কিন্তু মেবেলের জীবনটা নষ্ট হতে দেব না কিছুতেই৷ আমার সঙ্গে কথা বলে ফিরে যাচ্ছিল লোকটা, আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ হঠাৎ চোখে পড়ল পথের ধারেই পড়ে আছে একটা জলাভূমি পরিষ্কারের লাঠি, সেটা তুলে নিয়ে গায়ের সমস্ত জোর একত্র করে মারলাম তার মাথায় এক বাড়ি৷ তারপর কী হয়েছিল মনে নেই৷ জ্ঞান হতে দেখলাম রক্তের পুকুর হয়ে আছে চারপাশটা, আমার হাত দুটো ভিজে আছে টকটকে লাল রক্তে৷ দুটো লাল… জমাট লাল রঙের হাত৷ জলার পাশটায় কেউ খুব একটা যেত না৷ সে জায়গাটা ছেড়ে তড়িঘড়ি করে পালিয়েছিলাম সেদিন৷ কেউ সন্দেহ করেনি, শুধু আমার মেবেল ছাড়া৷ তার সঙ্গে আর কথা বলার সাহস হয়নি আমার৷ প্রেমিকের মৃত্যুর শোকে কি না জানি না, কিছুদিন পর গ্রামে ফিরে শুনলাম মেবেলও আর বেঁচে নেই৷ প্রথমে ভেবেছিলাম লোকটাকে খুন করে হয়তো মেবেলের ভবিষ্যৎটা যন্ত্রণার হাত থেকে উদ্ধার করেছি আমি, কিন্তু সে নিজেই আর থাকল না৷ সেই থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি৷ দুটো… হ্যাঁ দুটো খুন করেছি আমি… আমার ক্ষমা নেই৷ স্বর্গের দরজা চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে গেছে আমার জন্য৷ সেই বীভৎস খুনের যন্ত্রণা প্রতি রাতে তাড়া করে বেড়ায় আমাকে৷ তার হাত থেকে এ জীবনে মুক্তি নেই আমার… কোনওদিন না…’
একটু থেমে জামায় চোখ মুছল সেটেল৷ আমি তার পিঠে একটা হাত রাখলাম, কী বলব বুঝতে পারলাম না৷ ও ধরনের ঘটনা সত্যি ঘটে থাকলে তার জেরে দুঃস্বপ্ন দেখাটা অস্বাভাবিক নয়৷ তবে সে যে ঠিক কী দেখে সেটা এখনও জানতে পারিনি৷ একটু ধাতস্থ হয়ে সেটাই বলতে লাগল সে৷
‘এই নিয়েই দেখি স্বপ্নটা৷ মনে হয় চোখের সামনে একটা সুবিশাল দরজা দেখতে পাচ্ছি৷ স্বর্গের দরজা৷ তার লোহার বিরাট পাল্লাগুলোর খাঁজে-খাঁজে হাজার আলোর রোশনাই৷ দরজার মাথাগুলো সটান মেঘের রাজ্যে গিয়ে ঢুকেছে৷ স্ফটিকের মতো ঝলমল করে তারা৷ তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আশ্চর্যরকম হালকা লাগে শরীরটা৷ আরেকটু এগিয়ে গেলে চোখে পড়ে দু-জন দেবদূত, দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকে তারা৷ তাদের পিঠে ডানা, এক হাতে একটা ঝকঝকে তলোয়ার আরেক হাতে একটা লম্বা ফিতে৷ হাওয়ায় যেন অল্প দোল খায় ফিতেটা৷ আমি ধীরে-ধীরে এগিয়ে যাই তাদের দিকে৷ ভিতরে ঢোকার জন্য মন ছটফট করে ওঠে আমার৷ স্বর্গের ভিতরে কী আছে তা এতদিন বইতেই পড়ে এসেছি৷ খানিকটা এগোতেই কিন্তু আমার পথ আগলে দাঁড়ায় দেবদূতরা৷ আমার হাত দুটো দেখতে চায় তারা৷ আমি অজ্ঞাতেই হাত দুটো এগিয়ে দিই তাদের দিকে৷ কিন্তু তখনই চোখে পড়ে রক্ত লেগে আছে আমার হাতে৷ টকটকে লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে আমার হাত দুটো৷ দেবদূতের মুখ মুহূর্তে বদলে যায় ভয়ংকর পিশাচের রূপে৷ হাতের তলোয়ার ছিন্নভিন্ন করে দেয় আমার শরীর৷ সে যে কী যন্ত্রণা তা আর কেউ জানে না৷ ওহ ভগবান, মৃত্যুর পরেও সে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি নেই আমার৷’
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম লোকটার দিকে৷ তার বিক্ষিপ্ত কথাগুলো যেন বহুদুর থেকে আসছে৷ মনে হল এইমুহূর্তে আমাদের চারপাশের পরিবেশ পালটে গেছে৷ এক অনন্ত প্রসারিত শূন্যতার মধ্যে বসে আছি দু-জনে৷ নিজের হাত দুটো দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলেছে সেটেল, মোমের অল্প আলোয় লালচে দেখাচ্ছে হাতগুলোকে৷ বেশ কিছুক্ষণ আমার মুখে কোনও শব্দ এল না৷ কীরকম যেন ভয় লাগছিল আমার৷ এমন একটা খুনের কথা আমি এখন জানি যা পৃথিবীতে কোনও তৃতীয় মানুষ জানে না৷ মনে হল যে পাপ জ্যাকব সেটেল করেছে, তার থেকে বেশিই যন্ত্রণা সহ্য করেছে সে৷ ক্ষমা পেয়েছে কি না তা বিচার করার ক্ষমতা আমার নেই৷ এই মুহূর্তে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার থেকে বেশি কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷
‘ভেঙে পড়ো না জ্যাকব৷ ভগবানের কাছে সব দোষেরই ক্ষমা আছে৷ আরও বেশি করে নিজের কাজে মন দাও, একদিন হয়তো দেখবে নিজেই নিজেকে ক্ষমা করে দিয়েছ৷’ কথাগুলো বলে আমি থামলাম৷ গভীর ঘুম নামছে সেটেলের চোখে৷ হয়তো শান্তির ঘুম৷ ‘বাকি রাতটা ঘুমিয়ে নাও৷ আমি এখানেই আছি৷ আর আসবে না স্বপ্নটা৷’
সে হেসে বলল, ‘আপনাকে যে কীভাবে ধন্যবাদ দেব তা আমি নিজেই জানি না৷ আজ একটা রাতে অনেক হালকা হল আমার মনটা৷ বাকি রাত নিশ্চিন্তেই ঘুমাব, আপনি বরং ফিরে যান৷ দেখা যাক নিজেই নিজের কষ্টটা কাটিয়ে উঠতে পারি না৷’
‘ঠিক আছে, বলছ যখন বিদায় হচ্ছি৷ কিন্তু এরকম লোকজন এড়িয়ে একা-একা আর থেকো না৷ লোকজনের সঙ্গে মেশো৷ মেয়েদের সঙ্গেও মেলামেশা করো৷ তাদের সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নাও, দেখবে রাতে শান্তির ঘুম আসবে৷’
‘নিশ্চয়ই চেষ্টা করব স্যার৷’
দরজার কাছে এগিয়ে গেছিলাম আমি৷ আবার ফিরে এলাম, তার বিছানার কাছে এগিয়ে এসে একটা হাত বাড়িয়ে দিলাম তার দিকে, ‘আমার মন বলছে চিরকাল তোমার হাত দুটো লাল হয়ে থাকবে না৷ একদিন না একদিন মুক্তি পাবে তুমি৷’
কাজকর্মের চাপে ভুলেই গেছিলাম সেটেলের কথা৷ এক সপ্তাহ পরে তার কটেজের কাছে গিয়ে দেখলাম সেটা খালি৷ লোকের কাছে শুনলাম সে এখানকার কাজ ছেড়ে উত্তরে চলে গেছে৷ তার স্বপ্নটা তাকে ছেড়ে গেছে কীনা তা অবশ্য জানতে পারিনি৷
এর দু-বছর পরের কথা৷ গ্লাসগোতে আমার বন্ধু ডক্টর মুনরোর সঙ্গে কিছুদিন থাকছিলাম৷ মুনরো এমনিতে ব্যস্ত মানুষ৷ আমার সঙ্গে শহরে ঘোরাঘুরির সময় তিনি মোটে পান না৷ ফলে আমি একাই ক্যাট্রিন লেকের ধারে ঘুরে বেড়াই৷ দ্বিতীয়দিন বাড়ি ফিরতে সন্ধে পার হয়ে গেছিল আমার৷ এই সময় সাধারণত মুনরো ফিরে আসে৷ আজ কিন্তু তাকে দেখতে পেলাম না৷ তার ভৃত্যের থেকে খবর পেলাম যে হসপিটালে গ্যাস অ্যাক্সিডেন্টের একটা জরুরি কেস এসেছে৷ সেটাতেই আটকে গেছে ডাক্তারবাবু৷ ফিরতে ঘণ্টাখানেক দেরি হবে৷ আমার বাড়িতে বসে থাকতে ইচ্ছা করল না৷ ঠিক করলাম হসপিটালে গিয়ে একেবারে ডাক্তারের সঙ্গেই ফিরব৷ সেখানে গিয়ে দেখলাম কাজকর্ম শেষ করে মুনরো হাত পরিষ্কার করছে৷ আমাকে দেখে একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ একদম হসপিটালে? ব্যাপার কী?’
‘চলে এলাম৷ আচ্ছা কী একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে শুনলাম?’
ডাক্তার হাত ঝাড়তে-ঝাড়তে বললেন, ‘ওই যেমন হয় আরকী… জীবন খুব ঠুনকো হে, বুঝলে? গ্যাসমিটারের ট্যাঙ্কে দু-জন কাজ করছিল৷ এমন সময় ট্যাঙ্কের দড়িটা ছিঁড়ে যায়, লোকদুজনও পড়ে যায় ফুটন্ত জলের মধ্যে৷ ট্যাঙ্কটা বেশ বড়সড়, ফলে উঠে আসা প্রায় অসম্ভব৷ জলের ভিতর আবার ডাই ছিল, সেসব লেগে-টেগে লাল হয়ে আছে চারিদিক৷ সেখানেই প্রাণ গেছে একজনের, কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল অতক্ষণ ওই লাল জলের ভিতরে থেকেও একজন বেঁচে গেছে৷’
আমি অবাক হয়ে গেলাম, ‘বেঁচে গেছে! বলেন কী?’
‘বাঁচত না, আর একজন তাকে তুলে না ধরলে৷ দু-জনের পক্ষে বাঁচা অসম্ভব দেখে একজন অপরজনকে দু-হাতে জলের উপর তুলে ধরে৷ নীচের লোকটার সমস্ত শরীরটাই পুড়ে গেছে, শুধু হাত দুটো ছাড়া৷’
কথা বলতে-বলতে দু-জনে এসে দাঁড়ালাম মৃতদেহটার সামনে৷ সাদা চাদরের উপর শোয়ানো আছে৷ মুখের দিকে চোখ পড়তেই আমার হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে এল৷ পোড়া মুখের আড়ালে সবই অস্পষ্ট কিন্তু তাও চিনতে পারলাম মৃতকে৷ জ্যাকব সেটেল৷ ডাক্তার ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘জলের উপর তোলা ছিল বলে হাত দুটো সেভাবে পোড়েনি৷ বাকি সবই জ্বলে গেছে৷’
আমি ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেলাম সেদিকে৷ সেটেলের সাদা হাত দুটো বুকের উপর জড়ো করা আছে৷ তার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল এই মুহূর্তে সেই বিরাট সাদা দরজাটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে, তার পোড়া লাল শরীরটা এইবার এগিয়ে গেল দেবদূতের সামনে৷ এইবার সে তুলে ধরল হাত দুটো৷ নাহ, এখন আর তাতে রক্ত লেগে নেই৷ সেই রক্তাক্ত হাতের ভয়ানক স্বপ্নটা চিরকালের মতো নিষ্কৃতি দিয়েছে তাকে৷
অনূদিত