রক্তপিশাচ
বেচারি ফ্রেড!
আজ দুই মাস সে শয্যাগত। অসুখটা গোড়ায় এমন কিছু গুরুতর ছিল না। সাধারণ প্লুরিসি মাত্র। ভালো ডাক্তারের হাতে পড়লে দিন দশেকের বেশি তাকে ভুগতে হত না সম্ভবত। কিন্তু এই যে লেন্টিনডেল গাঁয়ের একমেবাদ্বিতীম চিকিৎসক ডাক্তার অক্সহ্যাম, সৌজন্যের খাতিরে তাঁকে ভদ্র, অমায়িক, কৃপালু প্রভৃতি বিশেষণে যতই মণ্ডিত করুক না-কেন গ্রামবাসীরা, ভুলক্রমেও ‘ভালো ডাক্তার’ বলে সার্টিফিকেট দিয়ে বসে না কখনো।
আশ্চর্য! ভালো ডাক্তার যে নন অক্সহ্যাম, এটা খুব ভালোরকম জানা সত্ত্বেও অন্য কোনো ডাক্তারকে অন্য কোনো স্থান থেকে এই লেন্টিনডেলে এনে বসাবার কথা চিন্তাও করে না কেউ। আজ বলে নয়, চার পুরুষ ধরে এই অক্সহ্যামেরা ডাক্তার এই গ্রামের। ওই চার-শো বছরের পুরোনো আইভি-ঢাকা ছোট্ট গির্জটাকে বাদ দিয়ে যেমন কল্পনা করা যায় না লেন্টিনডেন গ্রামের কথা। ঠিক তেমনই যায় না, ডাক্তারের চেম্বারে শিশি-বোতলে স্টেথিসকোপে সুপরিবেষ্টিত কোনো-না-কোনো অক্সহ্যাম-পুঙ্গমকে বাদ দিয়ে। অক্সহ্যাম নামের বর্তমান অধিকারী আবার এমন মানুষই নন, গ্রামে যাঁর উপস্থিতিকে যথোচিত স্বীকৃতি না-দিয়ে কেউ পারবে না কখনো। হ্যাম খেয়ে খেয়ে অক্স-এর মতোই স্ফীত এবং পুষ্ট হয়েছেন ভদ্রলোক। সারা অঙ্গ রাঙা টসটস করছে রক্তের আতিশয্যে। দুর্মুখ কোনো এক বদরসিক কবে নাকি বলেছিল, ‘হবে না কেন? গাঁয়ের ছেলেবুড়ো সবাইয়ের রক্তই তো ওদেরই পেটে গিয়ে ঢুকছে! ওই অক্সহ্যাম গোষ্ঠীর!’
কিন্তু গল্পটা অক্সহ্যামের গল্প নয়, প্লুরিসি রোগী ফ্রেডের। বলছিলাম যে, লেন্টিনডেলের ডাক্তার অক্সহ্যামের হাতে না-পড়ে ফ্রেড যদি থাকত বিকফোর্ডের ডাক্তার ফিডারশ্যামের বা এলমগ্রোভের ডাক্তার র্যামসবোথামের হাতে, সে এতদিন কবে ড্যাঙ ডেঙিয়ে উঠে আসত প্লুরিসিকে কদলী দেখিয়ে এবং মাঠে মাঠে ঘুরপাক খেত পৈতৃক খামারের গোরু ভেড়া ঘোড়ার পিছনে লাঠি উঁচিয়ে।
কিন্তু বিধি বাম, অক্সহ্যামের হাতেই সে পড়েছে। জন্মসূত্রেই তা পড়তে বাধ্য। লেন্ডিনডেলে জন্মাবে অথচ অক্সহ্যামের দাওয়াই খাবে না, এ তো আর হতে পারে না! ভুগেই চলেছে ফ্রেড। না-ভুগে উপায় কী!
বিদ্রোহ করলেন ফ্রেডের মা। প্রিয় পুত্রটি চোখের সামনে শুকিয়ে যাচ্ছে দিন দিন, তার কিছু করতে পারছে না উজবুক ডাক্তার, কেবল মোটা মোটা বিল পাঠাচ্ছে, হপ্তাওয়ারি ওষুধের দাম? ডাক্তার যখন এল পরদিন, তিনি একখানা বক্তৃতা ঝাড়লেন বার্ক সুলভ ওজস্বিনী ভাষায়। তা শেষ করলেন এই বলে, ‘তোমার থলিতে যদি ওষুধ না-থাকে, সাফ বলে দাও তা।’
সাফ বলে দেবে? ডাক্তার? বিশ্বজগতে কোনো দেশে কোনো ডাক্তার তা বলেছে কোনোদিন? বলেছে যে রোগটা কী? বলেছে যে তা সারবে কিনা? ভুলক্রমেও স্বীকার করেছে যে, ‘আমি ঠিক ঠাহর পাচ্ছি না যে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল?’
কেউ না! কেউ না! একা অক্সহ্যামকে দোষ দিলে হবে কী, অতখানি স্পষ্টভাষিতা নিয়ে কেউ ডাক্তারি করতে বসে না।
যাহোক, ফ্রেডের মায়ের তড়পানি তিনি শুনলেন, ওই অক্সহ্যাম ডাক্তার। সমান জোর গলায় উত্তর দিলেন, ‘আমার থলিতে ওষুধ আছে বলেই তোমার ছেলে টিকে আছে এখনও। কিন্তু ঝগড়ায় কাজ নেই, তোমাকেও এ-গাঁয়েই বাস করতে হবে, আমাকেও এই গাঁয়েই ডাক্তারি করতে হবে। একটা ব্যবস্থা আমি করব বলেই মনস্থ করে এসেছি আজ। শোনো বলি, ওষুধ ঠিকই চলছে, তবে পথ্যটা বদলে দেবার দরকার দেখা দিয়েছে। এক কাজ করো আজ থেকে। একটা করে মুরগি কাটবে রোজ। সুরুয়া? তা দিতে পারো মেজার গেলাসের এক গেলাস। ক্ষতি হবে না। কিন্তু সুরুয়ার জন্যে মুরগি কাটার কথা আমি বলিনি। মুরগির গলা থেকে যে-রক্ত ঝরবে, তারই এক আউন্স পরিমাণ ধরবে গেলাসে, আর গরম গরম খাইয়ে দেবে ছেলেকে। দেহে রক্তের অভাব হয়েছে ওর, সেই জন্যেই এই ব্যবস্থা। টাটকা রক্ত, পাতলা রক্ত, হজম হবে সহজে, বল পাবে, চাঙা হয়ে উঠবে দু-দিনে। তবে বেশি দিও না। এই দুই চামচ দিয়ে শুরু করবে। সাত দিনের মাথায় চার চামচ পর্যন্ত উঠতে পারো। তার চেয়ে বেশি কক্ষনো না, যতক্ষণ আমি না-বলছি।’
চলেই যাচ্ছিলেন, হঠাৎ ফিরে এসে নীচু গলায় বললেন, ‘ছেলে যেন কদাপি জানতে না-পারে তাকে রক্ত খাওয়াচ্ছ। হলেই-বা মুরগির রক্ত, হলেই বা টাটকা, পাতলা, সহজপাচ্য। ওর ঘেন্না করতে পারে হয়তো। কাজ কী! গোপনে কাটবে, ওষুধ বলে খাওয়াবে।’
ফ্রেডের মা খুব খুশি। ব্যবস্থা তো জব্বর হয়েছে! এখন ভাগ্যে থাকলে ছেলে দু-দিনেই চাঙা হয়ে উঠবে।
চাঙা? দু-দিনেই ছেলে টেঁসে গেল একদম। শেষদিনে আর অক্সহ্যামকে আনা গেল না বাড়িতে। তিনি ভিনপাড়ায় ব্যস্ত হয়ে রইলেন সারাদিন।
ফ্রেড যখন খাবি খাচ্ছে, তখন তার কানে গেল মা যেন ডুকরে উঠছে তার বিছানার পাশে বসে, ‘অলপ্পেয়ে ডাক্তার রক্ত খাইয়েই মেরে ফেলল আমার ছেলেটাকে—’
র-ক্ত! রক্তো-ও-ও! হ্যাঁ, বটেই তো! ও-জিনিসটা রক্ত তাহলে? যা এই শেষের কয়েক দিন তার মা অত যত্ন করে তাকে খাওয়াত? রক্ত কি এত ভালো লাগে খেতে? ঈষৎ নোনতা, ঈষৎ ঝাঁঝওয়ালা। ঠিক যে কীরকম, তা বলে বোঝানো যায় না— কিন্তু খেতে বেশ, খেতে বেশ—
আর বেশ চিন্তা করার সময় হল না ফ্রেডের। সে চোখ বুজল। চিরতরেই বুজল।
ফ্রেডের বাবা কড়কে দিল স্ত্রীকে, ‘ডাক্তারে আর তোমাতে মিলে সাবড়ে তো দিলে ছেলেটাকে এখন এক কাজ করো, একদম চেপে দাও ব্যাপারটা। টু-শব্দটির দরকার নেই। লাভ হবে না শব্দ করে, ডাক্তার স্রেফ অস্বীকার করবে। সব দোষ চাপিয়ে দেবে তোমার ঘাড়ে।’
ভয় পেয়ে গেল গেঁয়ো স্ত্রীলোকটি। সত্যিই তো! যা হবার, তা তো হয়েই গেল। কেন আর এই শোকের সময় অশান্তি ডেকে আনা? তা ছাড়া, ডাক্তার বড়োলোক। ফ্রেডরা চাষিমাত্র। ধাতুপাত্রে মৃৎপাত্রে টক্কর লাগলে কোনটা ভাঙবে, তাও কি আর জানে না ফ্রেডের মা?
যথারীতি কবর হয়ে গেল ফ্রেডের। অনেক কান্নাকাটি, কিছু খাওয়া-দাওয়া, তারপর সব চুপচাপ—
কেবল একজন থাকে থাকে, কেঁদে ওঠে। কখনো ডুকরে ডুকরে, কখনো গুমরে গুমরে। বলা বাহুল্য সে অন্য কেউ নয়, অভাগি মা। ফ্রেডের মা! তার কেবলই মনে হয়, ডাক্তারকে থলির ওষুধের কথা তুলে না-ধমকালে সে রক্ত খাওয়ানোর ব্যবস্থা দিত না। আর সেই ছিষ্টিছাড়া ব্যবস্থামাফিক রক্ত যদি সে না খাওয়াত, কচি ছেলেটা তার মারাও পড়ত না বেঘোরে। মনস্তাপে নিজের হাত নিজে কামড়ায় মা। আর সাধ মিটিয়ে গালিগালাজ দেয় অক্সহ্যামকে।
সংসার ওদের ছোটো ছিল ইদানীং। সে অনুপাতে বাড়িটা বড়ো। বাড়ি বড়ো করতে হয়েছিল ফ্রেডের ঠাকুরদাকে, কারণ তাঁর ছেলে-মেয়ের সংখ্যা ডজন অতিক্রম করে গিয়েছিল। কালক্রমে সেসব ছেলে-মেয়ে উভয় গোলার্ধের যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু পিতৃ-গৃহত্যাগের সময় কেউ তার শোবার ঘরখানা সঙ্গে নিয়ে যায়নি। কাজেই সাতখানা শোবার-ঘর সমেত গোটা বাড়িটা একদিন একা মানুষ ফ্রেডের বাবার দখলে এল। তিনি অত ঘর করেন কী? নিজের চারটি ছেলে-মেয়ে, তাদের দুধের দাঁত পড়বার আগেই এক একখানা নিজস্ব ঘর গছিয়ে দিলেন তাদের। অবশ্য পাশ্চাত্য মুলুকে সেইটাই রেওয়াজ। প্রাচ্যের মতো সেখানে ভাই-বোনরা সার্ডিন-গাদা হয়ে একঘরে বাস করে না।
হ্যাঁ, দুধের দাঁত পড়বার পর থেকেই একখানা বড়োসড়ো ঘরের একেশ্বর ছিল অধুনা-বিগত ফ্রেড। সে বিদায় নেবার পরে ঘরখানায় চাবি পড়েছে, এইটুকুই হয়েছে পরিবর্তন। নইলে, ঘরের ভিতর যেখানে যা স্থায়ীভাবে ছিল ফ্রেড থাকতে, হুবহু সেইভাবেই আছে তা। কাজের লোক আছে দু-টি মেয়ে। বাড়িটা ধোয়া-মোছা ঝাঁটপাট ছাড়াও তারা অনেক অনেক কাজে সাহায্য করে ফ্রেডের মাকে। চাষি পরিবার। অনতিক্ষুদ্র খামারের মালিক। পশুপাখি দেদার, খোঁয়াড়ে, গোয়ালে ও চিড়িয়াঘরে। সে-সবের পরিচর্যা, গাই দোয়া, মাখন তোলা— কাজ অনেক। হ্যাঁ, লোক রাখতেই হয়। বার্থা আছে এখন, আর আছে সুজান।
বার্থাটা ভীতু। ফ্রেড চলে গিয়েছে। সে আর ফ্রেডের ঘরে ঢোকেনি তারপর। কিন্তু সুজান ঢুকেছে, তার অমন দিনদুপুরে গা-ছমছম করে না ভূতের ভয়ে। আর সে-ই তো তাদেরই মাস্টার ফ্রেড! ক-তো দৌড়ঝাঁপ করেছে তার সঙ্গে সেদিন পর্যন্ত। অমন কথা বলতে নেই, কিন্তু সত্যি সত্যি ভূতও যদি হয়ে আসে ফ্রেড, সুজান বুক ঠুকে বলতে পারে যে, সে কক্ষনো ভয় পাবে না ফ্রেডের ভূতকে। ওইখানে বিছানায় তাকে বসিয়ে, নিজে গ্যাঁট হয়ে ওই চেয়ারখানায় বসবে আর ভূতের দেশের গল্প শুনে নেবে তার কাছে। বলবে না? ই-স-স! ফ্রেডের সঙ্গে চিরদিন ভাব ছিল সুজানের, মাঠে যাবার সময় তাকে সুজানই হেঁশেল থেকে স্যান্ডউইচ বার করে দিত বরাবর। গিন্নিকে লুকিয়ে।
কী কথা হচ্ছিল যেন? ওঃ, সুজান ভয় পায় না। সময় পেলেই ফ্রেডের ঘরের শিকল খুলে মেঝেতে গিয়ে দাঁড়ায় বা বসে। শূন্য বিছানার পানে তাকিয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে। এক এক সময় কেমন ভুল দেখে চোখে। যেন ও দেখতে পায়, ফ্রেড শুয়ে আছে এখনও তার রোগশয্যায়, তার ফ্যাকাসে ঠোঁট দু-টিতে ক্ষীণ হাসি, সুজানেরই কোনো নির্দোষ রসিকতার জবাবে।
তা সেই সুজানই প্রস্তাব করেছিল, মিসাস যদি বলেন, বিছানাটা কেচে-কুচে আবার ভালো করে পেতে দিই।
‘না, না, না’— ঝাঁঝিয়ে উঠেছিলেন পুত্রহারা জননী, ‘খবরদার না, এখনও আমি তার গায়ের গন্ধ পাই ওই বিছানায়! কেচে ফেললে আর তো তা পাব না!’
গায়ের গন্ধ? কথাটা সুজানের মাথায় যে ঢুকল, আর বেরুতে চাইল না। বাসা বেঁধে রইল পাকাপাকিরকম। গায়ের গন্ধ! ফ্রেডের গায়ের গন্ধ কীরকম ছিল, সুজান না-জানে, তা নয়। সত্যিই কি সেই ফ্রেডের গায়ের গন্ধ এখনও গিন্নি পান তার পরিত্যক্ত বিছানায়? হবেও বা! না-যদি পাবেন, কেনই বা বিছানাটা কেচে ফেলার প্রস্তাবে উনি খেঁকিয়ে উঠবেন ওরকম?
আচ্ছা, তাই যদি হয়, সে-গন্ধ মিসাসের একার একচেটিয়া অধিকারে থাকার পক্ষে যুক্তি কী আছে? তিনি মা, আর সুজান দাসী, এই তো তফাত! কিন্তু সুজানও মানুষ তো! ইশকুল মাস্টার মিস্টার রবীনের বাড়িতে কাজ করার সময় তাকে সে একটা কবিতার দুই লাইন আওড়াতে শুনেছিল একদিন। শুধু আওড়ানো নয়, তার অর্থও তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন এক ছাত্রকে তখন, তাও শুনেছিল সুজান। শুনেছিল, আর ভুলতে পারেনি।
‘আভিজাত্য বস্তুটা কী? না, গিনির উপরে রাজার মুণ্ডুর ছাপ। ছাপ না-থাকলেও সোনাটা সোনাই। তার দাম এক ফার্দিং কমবে না। তেমনি আভিজাত্য না-থাকলেও মানুষের মনুষ্যত্বের দাম— আহা-হা—’
মনে মনে নানা যুক্তিতত্ত্বের অবতারণা করে সুজান স্থির করল, ফ্রেডের শয্যায় ফ্রেডের গায়ের গন্ধ যদি এখনও পাওয়া সম্ভব হয়, তবে মিসাসকে একা তা পেতে দিচ্ছে না সুজান। একদা ভাব ছিল? এই সুবাদে সুজানও নেবে গন্ধের অংশ।
ওরা ওই বাড়িতেই থাকে রাত্রেও। সুজান আর বার্থা। আলাদা আলাদা ঘর ওদেরও। রাত্রে চুপিচুপি নিজের ঘর থেকে বেরুল সুজান। সবগুলো খালি ঘরেরই দোরে তালা বন্ধ হয় সন্ধ্যা বেলায়। বন্ধ সুজানই করে। আজ সন্ধ্যায় ফ্রেডের ঘরে শুধু শিকলটা তুলে দিয়েছিল সে, তালাটা বন্ধ করেনি।
এখন নিশুতি রাতে ঘর খুলে ফ্রেডের ঘরে সে যদি ঢোকে, কে তাকে আটকাবে? কে আটকাবে? ঘটনাটাই তো জানে না কেউ! আটকে যেতে পারত নিজে সুজান অমন ডানপিটে না-হলে। যে নিজে নির্ভীক, ভূত তার কিছু করতে পারে না। পিশাচ? ওঃ, হ্যাঁ, পিশাচে পারে হয়তো। সেই কথাই হচ্ছে এর পরে। অবশ্য ভূতসমাজে পিশাচ বলে যে আলাদা একটা শ্রেণি আছে, একথাটি জানা ছিল না সুজানের।
সুজান গিয়ে আলো জ্বাললো ফ্রেডের ঘরে। যেমনকার শূন্য শয্যা, শূন্যই পড়ে আছে। সুজান বড়ো আশা নিয়ে বসে পড়ল সেই পালঙ্কের নীচে, বিছানার চাদরে মুখ গুঁজে। একটু পরেই তার দু-চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল। গন্ধ? গন্ধের কথা তখন আর তার মনে নেই। খেলার সাথি আর যে তার সঙ্গে খেলতে আসবে না কোনোদিন, এই রিক্ততা বোধেই তার বুকের ভেতরটা হু-হু করে উঠল সহসা। সে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।
শুনতে আশ্চর্য লাগবে, সেইসময় নীচের আকাশে উড়ছে একটা বাদুড়। অন্য কোথাও নয়। লেন্টিনডেল গ্রামের চার-শো বছরের পুরোনো আইভি-ঢাকা গির্জাটার লাগোয়া কবরখানার ঠিক উপরে। বাদুড়টা যেন মনস্থির করতে পারছে না, সে যাবে কোন দিকে। ঘুরপাক খাচ্ছে, খানিকটা হয়তো এগিয়ে যাচ্ছে জোর-জোর ডানা ছটফটিয়ে, তারপরই হয়তো একেবারে পালটে ফেলছে তার গমনপথ। দুই-একবার নেমেও এল মাটিতে। যেন অজানা শূন্য আবিষ্কার অভিযানে বেরুবার সংকল্প আজকের মতো সে বর্জনই করল।
রাতদুপুরে লেন্টিনডেল গাঁয়ের ঝোপেঝাড়ে দুর্গম কবরখানাটা শৌখিন নৈশবিহারীদের বেড়াবার জায়গা নয়, বেড়াতে কেউ সে-রাতে আসেওনি সেখানে। আসত যদি, সে অবাক হত এই দেখে যে, একটা অতিসম্প্রতি ভরাট করা সমাধির উপরকার মাটির ঢিবিটাতেই বাদুড়টা বার বার আসন নিচ্ছে আকাশ থেকে নামার পরে। বিস্ময়ের মাত্রা বেড়ে যেত আরও অনেক গুণ, বাদুড়টা পুনরপি আকাশে উড্ডীন হওয়ার পরে সেই নৈশবিহারী সাহস করে যদি দাঁড়াতে পারত একেবারে কবরের গা ঘেঁষে। বিস্ময়ের কারণ? কারণ এই সে, কবরটার বুকের উপরে এধার থেকে ওধার একটা লম্বা চিড়। বাদুড়টা যখন বসেছিল, ওই চিড়টার দু-ধার উড়েই সে বসেছিল।
হ্যাঁ, হত সে অবাক, সেই নৈশবিহারী। বাদুড় বসে না কোথাও পারতপক্ষে, গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে হেঁটমুণ্ডে ঝোলে নিবাত নিষ্কম্প অবস্থায়। এ-জীবটার কী সবই সৃষ্টিছাড়া?
কিন্তু এতক্ষণে বুঝি মনস্থির করতে পেরেছে ও, ওই বাদুড়। আকাশ-বাটে সে উড়ে যায় দ্রুতবেগে। অতখানি দ্রুত বাদুড়েরা ওড়ে না সচরাচর। কে জানে এর এত তাড়া কীসের?
সোজা উড়ছে বাদুড়, মাঠ পেরিয়ে নিকেলবির আঙুল খেতের মাথার উপর দিয়ে, ফোয়ারার ধারের জোড়া-সেডার গাছের পাশ কাটিয়ে—
এ-বাড়িটা মিস্টার জয়েস্টের না? ফ্রেডের বাবার? যে-বাড়ির একখানা ঘরে সুজান নামে একটা দুঃসাহসিকা কিশোরী এক মৃত কিশোরের পরিত্যক্ত শয্যায় মুখ গুঁজড়ে পরে আছে, প্রয়াত বন্ধুর গায়ের গন্ধ পাওয়ার লোভে?
একটা জানলা খোলাই থাকে ঘরের। গরাদও থাকে না ওদেশের সেই জানলাগুলোর, নাম যাদের ফ্রেঞ্চ উইন্ডো। বাদুড়টা সোজা সেঁধিয়ে গেল ঘরে। নির্দ্বিধায়। অতি ব্যগ্রভাবে। তৃষিত মরুপথচর যেন মরুদ্যানে জলধারা দেখতে পেয়েছে। তৃষ্ণা! বড়োই তৃষ্ণা তার। জলের নয় অবশ্য। অন্য একটা তরল পদার্থের। সেই পদার্থের নোন্তা স্বাদ রসনায় নিয়ে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল সে—
বাদুড় এসে ভেসে রইল পালঙ্কের তিন ফুট উপরে। এদিকে পালঙ্কের উপর দুই বাহু জড়িয়ে দিয়ে তখন সুজান ঢলে পড়েছে গভীর ঘুমে।
তৃষ্ণা! রক্তের তৃষ্ণা মেটেনি মৃত্যুর আগে। বাদুড়টা ধীরে ধীরে নেমে এল, ইঞ্চি ইঞ্চি করে। সুজানের মুখখানা কাত হয়ে আছে পালঙ্কের কাঁধায়। একটা গাল চাপা পড়েছে, অন্যটা বাদুড়ের ঠিক ঠোঁটের নীচে। কিন্তু তাতে নয়, কর্ণমূলের নীচে, গলায়—
বাদুড় তার ঠোঁট বসিয়ে দিয়েছে, দাঁতও ক্রমশ। সুজানের কণ্ঠনালী থেকে ধারায় এসে বাদুড়ের মুখে ঢুকছে তাজা, গরম রক্ত। রোগশয্যায় শুয়ে শেষের কয়েক দিন যেমন রক্ত সে ফোঁটা ফোঁটা পেত মায়ের কৃপণ কর থেকে— তেমনই স্বচ্ছ, তেমনই ঝাঁঝালো, তেমনিই সঞ্জীবনী। তৃপ্তি! তৃপ্তি! তৃপ্তি!
বাদুড় উড়ে চলে গেল ঘর থেকে। যে-পথে এসেছিল, সেই পথে, ফোয়ারার ধারের জোড়া সেডার গাছের পাশ কাটিয়ে, বুড়ো নিকেলবেরির আঙুর খেতের মাথার উপর দিয়ে, মাঠের পরে মাঠ পেরিয়ে—
কবরখানায় সম্প্রতি ভরাট করা বুকের উপরে সেই চিড়টা, তারই উপরে বসল গিয়ে বাদুড়, ধীরে ধীরে তার অত বড়ো দেহটা তলিয়ে গেল সেই সরু চিড়টার ভিতরে।
কবরখানায় কবর-খনক থাকেই দুই-একজন, মাইনে করা। এ-গির্জাতেও আছে। সদ্য ভরাট কবরগুলোর তদবির করা তাদের অন্যতম কাজ। দেখতে হয়, কোনো কবরে ধস নামছে কিনা। নামতে দেখলে নতুন মাটি চাপাতে হয় সেখানে। ফ্রেডের কবরও পরদিন পরীক্ষা করল খনক। না, ধস-টস নয়। তবে একটা লম্বা চিড়, দুই ইঞ্চি পরিমাণ চিড়। এটা কেন হল? হবার তো কথা নয়! হয় না তো কোথাও! দেখা যাক আজকের দিনটা। যদি এটা আরও চওড়া হতে দেখা যায় কাল, তখন করা যাবে যাহোক ব্যবস্থা। মাটির বদলে কিছু পাথর কুচিও ভরে দেওয়া যেতে পারে ফাঁকের ভিতর। সোজা হবে সেইটাই।
এদিকে জয়েস্ট-বাড়িতে হুলুস্থুল বেলা ন-টা নাগাদ। বাড়ির সবাই কোন সকালে ঘুম থেকে উঠেছে, লেগে পড়েছে যে যার কাজে। কিন্তু সুজান? সুজান কই? বার্থা একা একা কাজ করছে। আর ঝগড়া করছে তারস্বরে, ‘মিসাসের আদুরি ঝি তো ঝি নন, রাজকন্যে। ঘুমই তাঁর ভাঙল না এখনও। একা একা এতবড়ো খামারটার সব কাজে ঠেক দিচ্ছি আমি।’
তার কলহের ঝংকার যখন গৃহিণীর কানে গেল, তিনি বললেন, ‘সুজান ওঠেনি? দ্যাখ, দ্যাখ। অসুখ করেছে নাকি! সে তো বেলা পর্যন্ত ঘুমোবার মেয়ে নয়।’
বার্থা গিয়ে সুজানের ঘরের দরজা ঠেলল। দরজা তো ভিতর থেকে বন্ধ নয়। ঠেলতেই হাট হয়ে গেল। সুজান তো নেই ঘরে। বার্থা তারস্বরে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে এল আবার, ‘ও মিসাস, মিসাস গো, দ্যাখো, তোমার আদুরি ঝি রাতারাতি হাওয়া দিল কিনা! বাসন-কোসন ঠিক আছে কিনা দ্যাখো! নিজের ঘরে সে নেই। সারারাতে সে যে একবারও ঢুকেছিল বিছানায়, এমন তো মনে হল না বিছানা দেখে।’
হইহই, তোলপাড়।
ফ্রেডের ঘরে তাকে পাওয়া যাবে, এমনটা ভাবেনি কেউ। ঘরটা খোলা হয়েছিল, কারণ আলোবাতাস ঢোকাবার জন্য খুলে তো হবেই রাখতে দু-চার ঘণ্টা!
হ্যাঁ, খোলা হয়েছিল এমনিই। সুজানকে ওখানে পাওয়া যাবে, এমন আশায় নয়। খুলেছিলেন মিসেস জয়েস্টই! আর খুলেই—
বিস্ময়ে, ভয়ে তিনি কাঠ হয়ে গেলেন কয়েক মিনিটের জন্য। সুজান নেতিয়ে পড়ে আছে মেঝেতে, মরে গিয়েছে? না, শুধু অজ্ঞান হয়ে রয়েছে? কাছে যেতে ভরসা পান না মিসেস, কারণ তার গলায়-মুখে রক্ত, গাউনে ব্লাউজে রক্ত, সে পড়ে আছে যেখানে, তার কাছাকাছি অনেকখানি জায়গাতে মেঝেও রক্তারক্তি। শুকিয়ে আছে রক্ত, তার মানে, রক্তটা ঝরেছিল প্রথম রাতে বা মাঝরাতে।
এলেন ফ্রেডের বাবা। দেখলেন। সুজানকে পরীক্ষা করলেন উপরি-উপরি। ঠি-ক-ক! এত রক্ত সবই সুজানেরই রক্ত। ওই যে গলায় একটা কাটা দাগ সরুপানা। ভিতরের শিরা কেটে গিয়েছে নির্ঘাৎ, তা নইলে অমন অতিমাত্র সরু ক্ষতমুখ দিয়ে কখনো অত রক্ত পারে ঝরতে? ক্ষত? কামড়ের ক্ষত নয় ও? সাপের? দূর! সাপ কোথায় এখানে? খুবই রহস্যজনক ঠেকছে।
ডাক্তার ডাকতেই হয়। ডাক্তার না-দেখিয়ে সুজানকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না এ-ঘর থেকে। কম রক্ত বেরিয়ে যায়নি ওর দেহ থেকে। হয়তো খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। নাড়াচাড়া করতে গেলে মরেও যেতে পারে। মেঝেতে পড়ে আছে, তাই থাকুক। অজ্ঞান হয়ে আছে। তা আসুক ডাক্তার। ততক্ষণ স্মেলিং সল্ট শোঁকাও। হাতে-পায়ে সেক দাও। ডাক্তার? লেন্টিনডেলে ডাক্তার চাইলেই ডাক্তার পাওয়া যায় না। সবে-ধন অক্সহ্যাম তখন রোঁদে বেরিয়েছেন, তেরোটা রোগী না-দেখে তাঁর ফেরা সম্ভব নয়। তারপর লাঞ্চ, তারপর বিশ্রাম—
অক্সহ্যাম জয়েস্টদের বাড়িতে যখন এলেন, বেলা প্রায় চারটে তখন। জ্ঞান সুজানের হয়েছে, কিন্তু কথাবার্তা কইছে না, কেমন যেন বুঁদ হয়ে আছে কীসের নেশায়। নড়াচড়া তাকে করা হয়নি, ফ্রেডের ঘরের মেঝেতেই সে পড়ে আছে। তবে একটা বালিশ এনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে তার মাথায় তলায়।
রক্ত? রক্তটা কেন ঝরল, এখনও ঝিরঝির করে ঝরছে কেন, জয়েস্ট-এর আনাড়ি হাতে বাঁধা ব্যান্ডেজটা সত্ত্বেও। অক্সহ্যাম কিছুই ঠাহর পান না। একটা মলম লাগিয়ে দিলেন সুজানের গলায়। পাকারকম ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন একটা, কী যেন ইনজেকশানও দিলেন ভয়ে-ভয়ে, তারপর, ‘রাত ন-টা নাগাদ আবার আসব, মেয়েটার অবস্থা ভালো বুঝছি না’— বলে সন্ধ্যা নাগাদ চেম্বারে ফিরলেন তিনি।
শুনেছেন। বার্থা, জয়েস্ট গিন্নি, নিজে জয়েস্ট, যে যেটুকু জানে ঘটনার, সবই ডাক্তার জেনে নিয়েছেন প্রশ্ন করে করে। সব কিছু জানার পরেও রহস্যের কোনো সমাধান করতে পারেননি। রক্তটা কেন ঝরছে মেয়েটার? সে রক্ত বন্ধই বা কেন হচ্ছে না?
গাড়ি আছে ডাক্তারের। ফোয়ারার ধারের জোড়া সেডারের পাশ কাটিয়ে, বুড়ো নিকেলবেরির আঙুর খেত পেরিয়ে, মাঠের পরিচ্ছন্ন রাস্তা দিয়ে গড়গড়িয়ে চলেছে সেই গাড়ি। ওই তো কবরখানা! ফ্রেডকে সবে পরশু কবর দিয়ে গিয়েছে ওইখানে। এঃ, ছেলেটা বাঁচল না কিছুতেই। তাজা রক্ত খাওয়ানো সত্ত্বেও বাঁচল না। ওর মা-বাপের পাপের সাজা আর কী! অক্সহ্যাম ডাক্তারের চিকিৎসায় কোনো ভুল হয়েছিল— একথা কেউ বলুক না একবার। ডাক্তার ডুয়েল লড়বেন তার সঙ্গে।
ওই কবরটাই ফ্রেডের বটে! ঢিবির উপরে কালোপানা কী ওটা? পড়ে আছে অনেকখানি জায়গা জুড়ে, কী ওটা? ওহ, ক্রাইস্ট! ওটা উড়ছে যে! বা-দুড়! তাই বলো। হ্যাঁ। কবরখানায় বড়ো বড়ো গাছ ঢের। সন্ধ্যা বেলায় বাদুড় তো আসতেই পারে।
ডাক্তারের গাড়ি চলেছে মাঠ পেরিয়ে ডাক্তারের মাথার বেশ কিছুটা উপরে সন্ধ্যার আকাশে নিঃশব্দে উড়ে চলেছে সেই বাদুড়টাও। রক্তের পিপাসা তার মেটেনি। ডাক্তারের গলার রং টকটকে লাল, মনে আছে ওর। একবার দাঁত বসাতে পারলে হয়, অ-ঢেল অ-ঢেল রক্ত মিলবে ওখানে।
দু-চারজন রোগী সেই সন্ধ্যা বেলাতেও রয়েছে ডাক্তারখানায়। তাদের কোনোরকমে বিদায় করে শ্রান্ত, অবসন্ন দেহে ডাক্তার চেয়ারে এলিয়ে দিলেন দেহ। সারাদিন কী খাটুনিটাই গিয়েছে। এখনও শেষ হয়নি খাটুনির। নয়টা পর্যন্ত চেম্বারে থাকা তাঁর রুটিন। তারপর আবারও যাবেন জয়েস্ট-বাড়ি। সুজানটাও টেঁসে যাবে কিনা, সেটা তিনি বুঝতে চান, দিনের কাজ শেষ করে ঘরে ফেরার আগে। কী হল মেয়েটার? গলায় ও ক্ষতটা কী? এত রক্ত কেন ঝরে ওইটুকু ছিদ্র দিয়ে?
আঃ, চেয়ারে গা এলিয়ে দেওয়ামাত্রই কাল-ঘুম নেমে এল অক্সহ্যামের চোখে। দেখতে দেখতে নাক ডাকতে লাগল। তা উনি নিতে পারেন দু-ঘণ্টা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে। দারোয়ান জাগিয়ে দেবে ঠিক সময়ে।
ডাক্তার ঘুমিয়েছেন। খোলা জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকল সেই বাদুড়। নিঃশব্দে উড়ে এসে এমনভাবে বসল চেয়ারের হাতলে, যাতে তার ঠোঁট পড়ে ডাক্তারের গলায়। আঃ, তাজা রক্ত, গরম রক্ত! সঞ্জীবনী রক্ত! ধারায় এসে ঢুকছে বাদুড়ের মুখে— তৃপ্তি! তৃপ্তি! আঃ!
ইনজেকশানের জন্যেই সুজান বেঁচে উঠল। ডাক্তারকে ইনজেকশন আর দেবে কে! দুই দিন ক্রমাগত রক্ত ঝরার পরে তিনি ফ্রেডের কবরের পাশেই কবরস্থ হলেন।
অনেক দিন পরে সুজান একদিন কী যেন আবেগের বশে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল মিসেস জয়েস্টকে, ‘বাদুড়ের মতোই বটে, কিন্তু মুখখানা অবিকল মাস্টার ফ্রেডের মতো। সে যদি আবারও আমার রক্ত খেতে আসে, আসুক।’