রক্তগন্ধা রহস্য

রক্তগন্ধা রহস্য

বৃদ্ধ পরাণ চাটুজ্যে ভয়ার্ত চোখে চতুর্দিকে একবার লক্ষ্য করে নিয়ে চাপা কণ্ঠে কইলাে “যাই বলাে, আমার মনে হয় এ নিশ্চয়ই কোনও রাক্ষুসে আকৃতির সরীসৃপ জাতীয় কিছুর কাজ। নাহলে এমন সৰ্ব্বনাশা দেহবল আর কার?” সুখলাল প্রতিবাদ করে বললাে – “নাহঃ চাটুজ্যে মশায়, সাপটাপ কিছু নয়, এ নিশ্চিত কোনও বাদুড় ধরনের বিরাট দানবাকৃতির জীব। অতর্কিতে আক্রমণ করে।”

আষাঢ় সবে পা রেখেচে দিন দুয়েক। ভােরের দিকে নিজের খড়ে ছাওয়া মেটে বাড়ির দাওয়ায় বসে উদ্বিগ্ন মুখে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে তামুক খাচ্চিলাে দীননাথ। এই সময়টা এমনিতে তার বড়াে পছন্দের সময়। হাঁসের ডিমের কুসুমের মতাে রক্তবর্ণ সূৰ্য্য সবেমাত্র নিদ্রার আলস্য পরিত্যাগ করে পৃথিবীর সাথে আলাপ শুরু করেছে। হাঁস মুরগীগুলাে ইতিউতি ঘুরে ঘুরে পােকা খুঁজচে। গােরুগুলাে তাদের প্রভু পত্নীদের কাছে বাইরে নিয়ে যাবার জন্য ‘ওও মাআআ’ করে ডাকচে। গাছে গাছে নানান সুরে পাখ-পাখালি চেঁচিয়ে চলেছে। শীতল মিঠে বাতাস এসে লাগচে চোখে-মুখে। কিন্তু দীননাথের চিত্তে আজ এসব সৌন্দর্য্যকে আত্মস্থ করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নাই। তার মন অত্যন্ত চঞ্চল এবং উদ্বেল হয়ে রয়েছে। অন্যমনস্কভাবে দুই তিনবার হুঁকায় টান দেবার পর পিছনের পথের দিক থেকে কানে এল, “মাস্টার, জেগে রয়েচো নাকি?”

দীননাথ তড়িঘড়ি জবাব দিলে, “কে ও, রবীন নাকি?”

-“হাঁ মাস্টার, আমরা”, পিছনের দিক থেকে সামনে এসে ধকরে দীননাথের পাশে বসে পড়লাে রবীন, সুখলাল আর পরাণ। রবীন চণ্ডীতলা ইস্কুলের কেরাণী। বয়সে আন্দাজ চল্লিশের ওপরেই, অর্থাৎ দীননাথের প্রায় সমবয়সীই। কৃশ, পরিশ্রমী গড়ন। সুখলাল মুর্মু হলাে রটন্তী গাঁয়ের চৌকিদার, বয়সে এঁদের চাইতে বচ্ছর দশেকের প্রবীণ, আর পরাণ চাটুজ্যের কি যেন একটা ব্যবসা রয়েছে। এনার বয়স পঁয়ষট্টির উর্ধ্বেই হওয়া সম্ভব। পঁচাত্তরও হতে পারে।

তাদের বসার ধরণ দেখে দীননাথ চিন্তিত স্বরে কইলাে-

– “ও রবীন, তােমরা আবার অমন চিত্তির করে বসে পড়লে কেন? ফের কি সংবাদ আনলে এই সকালে? হে মধূসুদন! আবার নাকি…?”

রবীন কাতর, ভগ্ন স্বরে উত্তর দিলে, “হ্যাঁ মাস্টার, আবার। তুমি কিচ্ছুটি টের পাওনি রাতে?”

দীননাথ সােজা হয়ে বসে সভয়ে জানালাে। “কিছুমাত্র না! হা ভগবান! আবার কোথা?”

-“ধন্যি ঘুম তােমার। ফের আফিম টেনে ঘুমিয়েছো নাকি? ভাের রাত্তিরে আবার সেই রাক্ষস জেগেছিলাে। এইবারে আমতলি গাঁ। একটা গাছ, একখানা চালা অবধি আস্ত রাখেনি। আমতলির প্রায় অর্ধেকটাই তার পেটে গিয়েছে। সেইসাথে হরিহর আচার্য্যের বাড়িখানাও। তুমি কিচ্ছুটি ঠাহর পাওনি? কালকে অনেকক্ষণ ধরে মাটি কেঁপেচিলাে। আলাে ফুটতেই আমরা শ’খানেক লােকজন জড়াে হয়েচি আমতলির পশ্চিমে। আগেরগুলাের মতােই অত বড় গ্রামখানি যেন পলকের ঝক্কায় উড়ে গিয়েছে স্রেফ।”

দীননাথ করুণ চক্ষে কিছু সময় তার দিকে চেয়ে থেকে ধীরে ধীরে শুধােলাে,

“এই বয়সে কইতে লজ্জা করে, কিন্তু ভয়ে আমার অন্তরাত্মা শুষ্ক হয়ে উঠছে চাটুজ্যে মশায়! এ কোন দেশী অজানা আতঙ্ক এসে হাজির হলাে আমাদের সব্বোনাশ করার জন্য? সেই প্রথমে জয়ন্তী গাঁ, তারপর ঐ কেশবতলা, তার পরেরবার হলাে গিয়ে… বলাে না…”

-“ভীমনাগপুর” বিষন্নভাবে কইলাে সুখলাল।

-“পরপর তিনখানা বর্ধিষ্ণু পল্লী এইভাবে এক রাত্তিরের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল মাস্টার। তুমিও তাে দেখেছো জায়গাগুলি, তুমিই বলাে, দেখে মনে হয় যেন রাতারাতি গ্রামগুলাের মাটি দশ হাত বসে গিয়েচে। ঘর বাড়ি ভেঙে, টুকরাে টুকরাে হয়ে, মাটিতে গেঁথে গিয়েচে। জীবন্ত একখানাও প্রাণী অবশিষ্ট নাই। রাতের ঐ তুফান আর তার দোসর ভয়ানক ভূমিকম্প জীব জড় নির্বিশেষে ওলটপালট করে কাদার পিণ্ডে পরিণত করেছে। আর আজ, এই আমতলি গাঁ। সে দৃশ্য চোখে দেখা যায় ? উল্টোদিকের থেকে সূয্যির আলাে পড়ে জায়গাটাকে একেবারে যেন মহাশ্মশান মনে হচ্ছে। শুধুমাত্তর অতাে বিশাল তছনছ হয়ে যাওয়া জায়গাটার উপর দিয়ে হাজারে হাজারে পাখির দল আতঙ্কে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। কুকুরগুলাে প্রাণভয়ে চেঁচামেচি করেই চলেছে। তাদের ভয় দেখে মনে হচ্ছে তারা নিশ্চয়ই সেই জীবটাকে চোখে দেখেচে।” এক নিঃশ্বাসে এতগুলি কথা বলে সুখলাল হাঁপাতে থাকলাে।

দীননাথের হাত কাঁপছিলাে। হুঁকোটা দাওয়ায় ঠেস দিয়ে রেখে বাকরুদ্ধ বক্তার কথার খেই ধরেই বলে উঠলাে, “এতখানি বয়স হয়ে গেল এই পাহাড়ী গ্রামগঞ্জের কোলে মানুষ হলেম আমরা, কিন্তু বাপ ঠাকুর্দার মুখেও কখনও এমন অপয়া ভূমিকম্পের কথা শুনিনি, যা কিনা এতটুকু একটা ছােটো পরিধির মধ্যেই জন্মায়, আবার সব ছারখার করে দিয়ে লহমার মধ্যে মিলিয়ে যায়! তােমরা শুনেচো কক্ষনাে?নিজেদের মধ্যে নুকোচুরি করে লাভ কি বললাে, আমিও জানি এবং তােমরাও বিলক্ষণ বুঝেছো এসব কেন হচ্চে। বলাে বােঝােনি?”

কেউ রা কাড়লাে না। পরাণ চাটুজ্যে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কইলাে,

– “সেসব কথায় লাভ কি মাস্টার, ধনুক থেকে বাণ ছুঁড়লে তা আর ধনুকে ফেরৎ আসে কি? এখন এই অজানা দানবের সর্বগ্রাসী ক্ষুধার থেকে বাঁচবার কোনও পন্থা জানা রয়েচে তাে বললা। এইভাবে তাে গােটা চণ্ডীতলা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে কদিন পর। এর প্রতিকার কিছু থাকলে তা ভগবানই জানেন। কি সর্বনাশা পরিণতি যে আমাদের অদৃষ্টে রয়েছে তা ভাবলেও আত্মা শিউরে ওঠে। এক রাতের মধ্যে এক একটা গাঁ উজাড় হয়ে চলেছে। আততায়ী কে? চিনি নে। কোথা থেকে আসছে? জানি নে। এই অবস্থায় তার প্রতিকার কেউ করবে কেমন করে বলাে তােমরা? নিশ্চিন্দির মধ্যে এক, এই সর্বনাশা মৃত্যু এত দ্রুত লহমায় আসে যে মরণ যন্তন্না হয়তাে টের পাবাে না।

আমার আশঙ্কার কথা চিঠিতে লিখে মেজেস্টর সায়েবকে একখানা খবর পাঠিয়েছিলাম রঘুয়াকে দিয়ে, তাে হতভাগা লালমুখাে সায়েব নাকি তাকে হাঁকিয়ে দিয়েছে। কয়েচে, ওসব আজগুবি তত্ত্বে তারা বিশ্বাস করে না। এ নিশ্চয়ই কোনও জীবাণু ঘটিত অজানা মহামারী, অথবা প্রাকৃতিক কারণ, যার ফলে বসতিগুলি ধ্বংস হয়ে যাচ্চে দ্রুতহারে। আচ্ছা আপনিই বলুন মাস্টার মশায়, এ কোনও কাজের কথা? ইংরাজরা এত এত শিক্ষা লাভ করে শেষে কিনা এই বিচার? ছ্যাঃ। মহামারী ঢের দেখা রয়েছে, কিন্তু এমন কোন কাল-জীবানু পৃথিবীতে রয়েছে, যে জাগা মাত্র ভুমিকম্প আরম্ভ হয়? যে বাড়ি ঘর, লােহা, কাঠ, প্রাণী, অপ্রাণী নির্বিশেষে এইভাবে মরণ ঘূর্ণির আবর্তে ফেলে দুমড়ে মুচড়ে ছিবড়ে করে ফেলে? ওসব ভুল তথ্য হে। আমার সন্দেহ। হয় এ নিশ্চয়ই কোনও দানবাকৃতি সাপের কাজ। নচেৎ..”

-“না না খুড়াে, সাপটাপ নয়, আমার বড়াে সন্দ হয় সেখানা একটা রাক্ষুসে বাদুড় ধরণের জীব। সেটা অতর্কিতে উড়ে এসে আক্রমণ করে, আর তার পাখার ঝাপটেই ঐ ভয়াবহ ঝড় জন্ম নেয়। সাপ হলে ধ্বংসপের আশপাশে অন্তত অতাে বিশাল দেহটা ঘষটাবার দাগও তাে পড়বে।”

ভাসাভাসা অনুমানই সার। এই ভয়াল রহস্য কিছুতেই ভেদ হলাে না।

**********

আসল কথাটা বলতে গেলে কিন্তু মাসখানেক পিছিয়ে যেতে হয়। এই চন্ডীতলা তালুকটা বাঙ্গালাদেশেরই একখানা ভূখণ্ড বটে, কিন্তু সেই একেবারে বেহার প্রদেশের কাছে। পুরুলিয়া যেইখেনে শেষ হয়ে বেহারের সীমানা শুরু হয়েচে, সেইখানে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেহাত মিলিত হয়ে একটা গােটা তালুক বসিয়েছে। তার নাম চণ্ডীতলা। এই তালুকের কিন্তু কোনও ভূস্বামী নাই। এর অধীনস্থ গ্রামগুলির পরিচালনা করে কিছু গ্রামপ্রধানেরা মিলে। সেই প্রধানদের সর্দার হলাে রতনলাল। নিবাস বড়তলি গাঁ।

রতনলাল যদিও এই পাহাড়ী প্রদেশের আদি বাসিন্দা নয়। তাঁর পিতামহ দক্ষিণ বাঙ্গালায় কিছু ভূমি কিনে বসত গড়েন। রতনলালের পিতা হরলাল বিবাহ করেছিলেন এই বড়তলি গাঁয়ের সর্দার সুধামােহন রায়ের কন্যা রাধাসুন্দরী দেবীকে। হরলালের দুই পুত্রের মধ্যে রতনলাল জ্যেষ্ঠ। সুধামােহনের দেহান্তের পরপরই এক দুর্ঘটনায় হরলালেরও মৃত্যু হয়। আকস্মিক এই বিপর্যয়ের পর রতনলাল সম্পত্তির দেখভালের জন্য মায়ের অনুমতি নিয়ে স্বল্প বয়সেই চলে আসে এই চন্ডীতলার বড়তলি গাঁয়ের মাতামহীর গৃহে, আর ছােটো ছেলেকে নিয়ে রাধাসুন্দরী রয়ে যায় স্বামী ভিটেতেই। সুধামােহনের জমিজমার দখল নিয়ে রতনলাল এই তালুকেই স্থায়ী হয়ে গেল, এবং প্রধানের পদ লাভ করল।

চন্ডীতলার ছােট্ট ছােট্ট পাহাড়ের কোলে ঝুলে থাকা বসতি গুলিকে বাদ দিলে বড়াে গ্রাম বলতে রয়েচে জয়চন্ডীগড়, ভীমনাগপুর, আমতলি, বড়তলি, বাঁকড়াে, শিয়ালঝােরা, কেশবতলা, রটন্তী আর জয়ন্তী। এই গ্রামপ্রধান বা সর্দারদের আর্থিক সঙ্গতিও তত কিছু অধিক নয়। এরা সাধারণ, স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রাতেই অভ্যস্থ।

সবকয়টি পল্লীই কমবেশি পাথুরে, অসমতল। এর মধ্যে বড়তলি আর রটন্তী গাঁ দুটি রাঙী নামের একখানা বিশাল পাহাড়ের এক্কেবারে পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এইসব এলাকায় চাষ যে হয় না তা নয়, কিন্তু তাতে স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষুধা নিবারণ করা গেলেও বাইরে বিক্রি করা চলে না। এদের মূল অর্থোপার্জনের উপায় হলাে পশুপালন, পাথরের শিল্পকর্ম আর চামড়ার সামগ্রী। খুব দরিদ্র প্রায় কেউই নেই চন্ডীতলায়। মােটামুটি স্বচ্ছলভাবেই দিনপাত হয় সবার। কেউ কেউ চাকুরীও করেন বটে, কিন্তু আশপাশের তল্লাটের মধ্যেই।

এই রাঙী পাহাড়খানার থেকে মাইলখানেক দূরে গড়পেটার ঘন বনের ভিতরে একটি ছােটো জরাজীর্ণ মন্দির রয়েছে। ভগবান শিবের মন্দির বলেই মানা হয় সেটাকে। কবে তৈরি হয়েছে, কে তৈরি করেছে তার কোনও ইতিহাস নাই। মন্দিরের গর্ভে একখানা বিরাট আকৃতির কৃষ্ণবর্ণ পাথরের খণ্ড শায়িত রয়েছে। প্রবাদ আছে, ইনিই হলেন স্বয়ম্ভু ভগবান শিবের একশিলা লিঙ্গ। এই মন্দিরের কক্ষণও সংস্কার হয় না, কারণ ঐ অতিকায় লিঙ্গ না সরিয়ে সারাই করা একরকম অসম্ভব। ইতিপূর্বে যে কয়বার সংস্কারের চেষ্টা হয়েছে, ততবারই ঐ প্রস্তর লিঙ্গকে অন্যত্র সরাবার চেষ্টা করা মাত্র অতি ভীষণ বজ্রপাতে সেই হতভাগ্যরা বেঘােরে মারা পড়েছে। একবার সায়েবদের একটা দল এসেও একই চেষ্টা করেছিলাে এবং গােটা দলটা ভয়ঙ্কর বজ্রাঘাতে ছাই হয়ে গিয়েছিলাে। সেই থেকে আর কেউ এমন সাহস করেনি এবং ঘন বনের অন্ধকারে ভগবান একশিলা নিজেকে সমাহিত করে রেখেছেন অনন্তকাল ধরে।

মাইল তিনেক দূরে চাঁদকাটি পাহাড়ের নীচে একখানা রেলগাড়ির ইস্টেশান। সেইখানে খুব ভােরে, দুপুরে এবং সন্ধ্যার মুখে তিনখানি রেলগাড়ি দাঁড়ায়। ঐ সন্ধ্যার সময় অবধি দুই একখানা ভাড়ার গাে-যান যদিও বা পাওয়া যায়, কিন্তু তার পরেই গােটা এলাকাটা নিষ্প্রণ, নিষ্প্রদীপ হয়ে পড়ে।

গাছে যখন পােকা লাগে তখন তা চোখে পড়ে এবং প্রতিরােধ করা যায়, কিন্তু যে পাকা ফলের অভ্যন্তরে আপনিই পােকা জন্মায় সেই ফলের গায়ে কীটদংশনের চিহ্নমাত্র থাকে না, ফলে বিপদ যে কতখানি ছড়িয়েছে তার আভাস মাত্র পাওয়া যায় না। এই তালুকেও তাই ঘটলাে।

চন্ডীতলার একেবারে উত্তরে প্রায় আট দশ বিঘে জমি নিয়ে বাস করতাে হিমু পালােয়ান। বামুনের সন্তান হলেও বাল্যকাল থেকেই তার আকৃতি ছিল পেল্লায়। দশাসই শারীরিক গঠন এবং গাঁ গঞ্জের অনুপাতে পর্যাপ্ত সঙ্গতি সত্ত্বেও তার আচরণটি ছিলাে অত্যন্ত বিনম্র, ফলে গাঁয়ের লােকেরা তাকে যথার্থই পছন্দ করতাে। এই হিমু চাটুজ্যের একটিই সন্তান। নাম মৈনাক। চাটুজ্যে। বাপের আকৃতিটুকু ব্যতীত অপরাপর সকল ক্ষেত্রেই মৈনাক ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত ধারার। গাঁয়ে সামান্য পড়ালেখার পর তার নষ্টামি এবং দুর্দান্ত আচরণে বিরক্ত হয়ে হিমু তাকে পাঠিয়ে দেয় সদরে শ্যালিকার গৃহে।

অপুত্রক মাসিমার স্নেহে তার বদবুদ্ধিতে বাধা তাে পড়লােই না, বরং তার চরিত্রের হিংস্র দিকগুলি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলাে। হঠাৎ হঠাৎ কারুকে না জানিয়েই দিনকতকের জন্য অদৃশ্য হয়ে যেতাে, আবার ফিরেও আসতাে। কখনও কোনও শ্মশানচারী কাপালিকের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাে, তাে কখনও আবার প্রাচীন কোনও পুঁথির সন্ধান পেয়ে আদাড়ে বাদাড়ে ছুটে চললাে। মাসিমা এইসব ছন্নছাড়া জীবনযাপনে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলেও মুখে কিছু কইতাে না, কারণ ফলের সম্ভাবনা ছিল বাস্তবেই শূন্যের চাইতে অধিক নয়।

মৈনাকের বয়ঃক্রম যখন আটাশ, সেই সময় হঠাৎ একদিনের সান্নিপাতিকের আক্রমণে হিমু পালােয়ান মারা পড়লাে। এর দিনকতক পর তার পুত্র পাকাপােক্ত ভাবে চন্ডীতলায় এসে বসলাে। গাঁয়ের ছেলে গাঁয়ে ফিরেছে বলে গ্রামবাসীরা প্রথমে প্রথাগত শােক এবং পরে আহ্বাদ প্রকাশ করল বটে, কিন্তু তারা বেশ টের পেলে যে এই নবাগত মানুষটি একেবারেই সম্পর্কের মাখামাখিতে আগ্রহী নয়।

কিছুদিন অতিবাহিত হলে পর মৈনাক চাটুজ্যের চালচলন নিয়ে সবার মনে একটা ধন্ধ উপস্থিত হলাে।

অতাে বড়াে গৃহে একলা একলা রয়, এতখানি বয়স অবধি দারপরিগ্রহ করেনি, সারাদিন পাগলের মতাে ঘুরে ঘুরে নুড়ি, পাথর, শেকড়-বাকর সংগ্রহ করে চলে। এক বুড়ী ঠিকে ঝি লাটুর মা বিকেলে একবেলা এসে টুকিটাকি ঘরােয়া কাজকর্ম করে দিয়ে যায়।

তার মুখেই লােকেরা জানতে পারলাে, বাবু’ সারাদিন ধরে কি সব পরীক্ষা করে চলে। হিমুর ছেলে গাঁয়ে ফিরে পৈতৃক গৃহের লাগােয়া একটি একটেরে লম্বা দালান তুলেচে। সেইখেনে সমস্ত দিন রাত কি সব করে সে। কেউ কেউ ধারণা করল লােকটি নিশ্চয়ই অত্যন্ত পণ্ডিত লােক, আর কেউ বা সেফ উন্মাদ বলে উড়িয়ে দিলে। তােমরা যারা গাঁ গঞ্জে থেকেচো তারা বিলক্ষণ জানবে যে এইসকল ক্ষেত্রে কি হয়। একদিন চন্ডীমন্ডপে লাটুর মাকে নিয়ে বসলাে চন্ডীতলার মুরুব্বীরা।

রতনলাল শুধােললা, “হ্যা রে লাটুর মা, বলি পাখির পালক, কুকুরের মাথা, পাথর, নুড়ি সব কুড়িয়ে কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে হিমুর ছেলেটা কি এমন রাজযজ্ঞি করে? বলি কাপালিক টাপালিক নয়তাে? সায়েব হলে তাও বুঝতুম কিন্তু বাঙ্গালী বামুনের সন্তান হয়ে এসব কী?”

লাটুর মায়ের বয়স সত্তরের নীচে কখনওই নয়। বুড়ী কাঁপা গলায় কপালে নিজের শীর্ণ হাত স্পর্শ করে বললে “কি আর বলবাে বাবা ঠাকুর, সে এক যজ্ঞিই বটে। পেটের দায়ে সেথায় কাজ করি তােমরা পাঁচজন ভালােমানুষ তা জানাে। এমন নিঘিন্যি কাজকারবার এতখানি বয়সে চক্ষে দেখিনি। বাইরের নূতন ঘরটায় রাজ্যির আবর্জনা রয়েছে আর তেমনি তার গন্ধ। কুকুরের কাটা মুন্ডু, এই এত্তোগুলান ভেঁয়াে পিঁপড়েতে ভরা একটা কৌটা, কেরােসিনের উনুন, সেইদিন ঘরে ঢুকে দেখি একটা লম্বাপানা মাছের মতাে কি একটার কাটা মাথা পড়ে রয়েছে। বিরাট বােয়াল মাছের মতাে তার মাথা। দেখেই আমার পা কাঁপতে শুরু করলে। তাকিয়ে দেখি বাবু খিলখিল করে হাসছে। আমি শুধােলুম – ‘এই পচা আঁশ গন্ধের মধ্যে থাকতি তােমার সমিস্যে হয় না বাবু?’ তাে উত্তরে বাবু চাপা কণ্ঠে হেসে উঠে চিবিয়ে চিবিয়ে কইলাে

– না, হয় না। ঘ্রাণশক্তি ভগবানের দান। চোখের দৃষ্টি, কানের শােনা ভুল হতে পারে, কিন্তু গন্ধ কখনাে ধোঁকা দেয় না।

আমি সেসব পাগলের কথায় কান দিইনি। আরেকদিন তাড়াহুড়ায় আমার জাঁতিটা ফেলে এসেছিলেম, তা মাঝপথে হঠাৎ খেয়াল হলাে পর আমি সন্ধ্যার মুখে ঐ বাড়িতে গিয়ে দেখি তখনও ঐ নূতন দালানটা থেকে তেল বাতির আলাে বেরুচ্চে। আমি একটু উঁকি মেরে যা দেখলুম তাতে বাবু যে সত্যই পাগল তা পরিষ্কার বুঝলুম।

দেখি দালানের ছাতের থেকে অনেকগুলি সুতা না দড়ি ঠিক বুঝলাম না, কিছু একটা ঝুলিয়ে তাতে কয়েকখানা নুড়িপাথর বেঁধে ঝুলিয়ে রেখেছে। ঝুলন্ত পাথরগুলাে এদিকে ওদিকে নড়ছে আর সেদিকে চেয়ে বাবু ভূতে পাবার মতাে করে হেসে চলেছে। বাবু হঠাৎ হঠাৎ একেক দিন বাইরে কোথায় চলে যায়। একদিন আমার ছােটো ছেলে কইলাে সে নাকি বাবুরে পিরিন্ডির জঙ্গলে ঘুরঘুর করতে দেখেচে। এইবারে তােমরা পাঁচজনেই বলাে, আমি কি ভাবে কষ্ট সয়ে কাজ করে চলেচি হােথায়। বিশ্বেস করে বললেম, এসব যেন আবার বাবুরে বললানি বাবা ঠাকুরেরা, নয়তাে আমার কাজ থাকবে নে।”

**********

পরদিন বটুকেশ্বরকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে পর সে জানালাে, “আমি ঝারােদা গাঁ থেকে ফিরচিলুম, হঠাৎ পথে দেখি ঐ দাদাবাবু অতি চুপিসারে কোথাও যেন চলেচে। আমিও পা চেপে চেপে অনেকদূর গিয়ে দেখি বাবু পিরিন্ডির জঙ্গলে, যেখানে অনেকগুলাে ছােটো বড়াে পাহাড় রয়েছে, সেইখানে ঢুকে পড়লাে। আমি আর ভিতরে যাইনি। দেবতা একশিলার দালান অবধি গিয়ে প্রাণটা কেমন কেঁপে উঠলাে আমার। ওর পরে তাে পাহাড়ী বন শুরু হচ্চে, একবার পথ হারালে আর ফিরবাে না। কিন্তু এরপরেও কয়েকবার আমি তক্কেতক্কে থেকে দেখেচি বাবু মাঝেমধ্যেই হােথায় যায়। কি করতে যায় দেবতাই জানে, ওইখেনে তাে পাহাড়, টিলা আর বন ছাড়া কিছুই নাই।”

অনুমান করা গেল, কিছু একটা আবিষ্কার অথবা পরীক্ষার। এরপর একদিন খবর এল, হিমুর ছেলে গােরুর গাড়ির কয়েক গাড়ি চুনা মাটি কিনেচে। পরের দিন লাটু বটুর মা সংবাদ আনলাে মৈনাক চাটুজ্যে ঘরে ঠাকুর বানানাে আরম্ভ করেছে। কেবল মাতব্বররাই নয়, গাঁয়ের প্রতিটি মানুষ এইবার হাসতে শুরু করল। পাগলামি আর কারে কয়, বামুনের ছেলে নাকি কুমারের কাজ করছে। একদিন মাস্টার দীননাথ নিজেই ডেকে শুধােলাে, “বলি ও হিমুর পাে, তা তুমি নাকি ঠাকুর গড়তে লেগেচো? সে উত্তম কথা, কিন্তু চুনাপাথরে গড়া মূর্তিতে প্রাণপিতিষ্ঠে করা যাবে কি? ও ঠাকুর কিনবে কে?”

মৈনাক চাটুজ্যে দীননাথের চোখে নিজের পাষাণবৎ চোখের মণি স্থির করে শীতল কণ্ঠে উত্তর দিলে, “ও বিগ্রহ বিক্রির জন্য নয়। আর প্রাণপ্রতিষ্ঠা? সেই চেষ্টাই তাে করে চলেছি। প্রাণ দেওয়া কি অতােই সহজ? তবে প্রাণ দেবার বিদ্যে জানলে জড় বস্তুতেও প্রাণ আসে মশায়। সে প্রাণ আমার তােমার চেয়ে অনেক জীবন্ত। অনেক বেশি ভয়াবহ। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ…”।

দূর্বোধ্য কথাগুলি বােধগম্য না হলেও সেই হাসির দাপটে দীননাথ ভীষণ চমকে উঠলাে। এমন হাড়ে ভয় ধরানাে হাসি যে কেউ হাসতে পারে তা দীননাথ কখনও শােনেনি। লােকটি হয় উন্মাদ, নয়তাে বড়াে বিপজ্জনক। ছােটো চাটুজ্যেকে নিয়ে পড়শীদের যত আগ্রহ বা সমস্যাই থাকুক, তাতে কারুর ক্ষতিই ছিল না, কিন্তু আসল সমস্যা শুরু হলাে এর পরেই।

একশিলা পাহাড়ের ওইপাশে রটন্তী গাঁয়ে একটা কুঁড়েঘরে মাথা গুঁজে দিন কাটায় মীনাবিবি। মীনার স্বামী বদরুদ্দোজা মজুর খাটতে গিয়ে খুব অল্প বয়সে। মারা পড়ে। ছেলে অছিমকে অনেক কষ্টে বড়াে করার পরে একদিন যখন সদরের সড়ক মেরামতির কাজ চলছে, তখন অছিম আর তার বৌ সাকিনা সেই সরকারী তাঁবুতে জন খাটতে ঢুকে পড়ে এবং তিন দিনের মাথায় গভীর গর্তে পা পিছলে পড়ে তারা সমেত আট দশজন মজুর প্রাণ হারায়। জীবনের আর কোনও উদ্দেশ্য বাকি না থাকলেও কেবলমাত্র ছােট্ট দুটি নাতি নাতনীর মুখের দিকে চেয়ে বৃদ্ধা বেঁচে রইলাে। একদিন বিকেলের মুখে বৃদ্ধা মীনাবিবি এসে পাশের গায়ের রতনলালের বাড়ি কাঁদতে কাঁদতে আছাড় খেয়ে পড়লাে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে জানা গেল তার নাতি নাতনী দুটি খেলতে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি। রটন্তীর চতুর্দিকে খুঁজেও পাত্তা পাওয়া যায়নি। এই বৃদ্ধার প্রতি প্রত্যেকের মনেই একটা করুণা ছিল। রতন তড়িঘড়ি এখানে ওখানে লােক পাঠিয়ে দিলাে এবং সন্ধ্যার সময় বাকিরা ভগ্নদূত হয়ে ফিরে এলেও দ্বারবান সত্যবান এসে খবর দিলাে, বিকেলের একটু আগে কাঠুরে গােবিন্দ নাকি রটন্তী গাঁ পেরিয়ে গড়পেটা বনের কাছে মীনাবিবির নাতিদের সঙ্গে ছােটো চাটুজ্যেকে কথা কইতে দেখেছে।

অন্য কারুর সম্বন্ধে একথা শুনলে কেউ তেমন একটা গা করতাে না। হয়তাে, কিন্তু মৈনাক চাটুজ্যের চালচলন বড় ধোঁয়াচ্ছন্ন, বড়াে সন্দেহজনক। এই মানুষটা কতটা হানিকর তা না জানলেও সে যে খুব একটা সুবিধের নয় তা বুঝতে কারুর কোনও বাধা ছিল না। চন্ডীতলার প্রধানেরা কিছুকালের মধ্যেই এসে হাজির হলাে রতনলালের গৃহে। রতনলাল, চাঁদপাল রায়, কেশব নন্দী, কেশব ভটচায্যি আর হরিহর আচাৰ্য, এই পাঁচ প্রধান এবং তাদের পিছনে পিছনে বহু উৎসুক গ্রামবাসীদের দল রওয়ানা দিলাে পার্শ্ববর্তী গাঁ রটন্তীর পানে। হিমু চাটুজ্যের গৃহের দেউড়িতে দাঁড়িয়ে কিঞ্চিৎ ইতস্ততঃ করে রতন দরজার শিকলি ধরে নাড়া দিলাে।

সামান্য সময় পরেই ভারী কাঠের কপাট খুলে ছােটো চাটুজ্যে বাইরে এসে দাঁড়ালাে। এতগুলি মানুষকে এই অসময়ে একত্রে জটলা করতে দেখে বিস্মিত হয়ে শুধােলাে, “একী? কিছু হয়েছে নাকি? এত লােকজন! ব্যাপারখানা কী?”

হরিহর আচার্য গলাটা একটু খাঁকারি দিয়ে কইলাে, “হয়েচে কি, আমরা এই মীনাবিবির নাতি নাতনী দুজনাকে খুঁজে পাচ্চি না সেই বিকেল থেকে, তাই ভাবলাম যদি ঘুরতে ঘুরতে এদিগড়ে এসে পড়ে…

-“আর আমি অমনি তাকে খপ করে ঘরে আটক করে রাখবাে?”

-“আহা, তা নয়, তুমি দেখেছো কি তেমন কারুকে তাই বলাে?”

– “আজ্ঞা না। পরের ঘরের ছােটো ছােটো শিশুদের আটকে রাখা আমার কাজ নয়। আপনারা আসুন। আমার বিস্তর কাজ রয়েছে।” এই বলে সে উলটো মুখে সবে ঘুরচিলাে, হঠাৎ কেশব নন্দী প্রশ্ন করল, “আচ্ছা চাটুজ্যে, তুমি তাে বাছা এ গাঁয়ের কাউকেই চেনাে টেনে না, তবে বুঝলে কেমন করে যে মীনার নাতি নাতনী দুটি শিশু না ধাড়ি? আচায্যি মশায় তাে সে কথা তােমাকে একবারও কয়নি। তাছাড়া আজ একজন বিকেলে তােমাকে ওদের সাথে কথা কইতে দেখেছে।”

এ কথায় মৈনাক চাটুজ্যে মহা খাপ্পা হয়ে উত্তর করল,

-“হ্যাঁ কয়েচি, তাে? তাতে কী প্রমাণ হয় আমি বাচ্চা দুটিকে হরণ করেছি? এই প্রমাণ হয় ?”

কি প্রমাণ হয় আর কি হয় না তা ভগবানই হয়তাে ভালাে জানতেন। এই মারমুখী আচরণের পর লােকজন হয়তাে ফিরেই যেতাে, কিন্তু হঠাৎ লােকজনের গুঞ্জনকে ছাপিয়ে কানে ভেসে এল বাচ্চাদের কণ্ঠস্বর, আর তা কানে আসা মাত্র মীনাবিবি ডুকরে উঠলাে, “ওই, ওই তাে ওরা!”

***********

আওয়াজটা আসচিলাে নতুন দালানের ভিতর থেকে। দু চারজন বলিষ্ঠ লােক পদাঘাতে কপাট ভেঙে ফেলতেই চোখে পড়লাে এক ভয়ানক দৃশ্য। শিশু দুটির হাত পিছমােড়া করে গ্রন্থি দেওয়া, তাদের মাথা ঢােকানাে রয়েছে দুইখানি হাঁড়িকাঠের ভিতরে, দুইজনের মুখেই ঠেসে দেওয়া হয়েচে খড়ের গােলা, যার একটি খুলে যাওয়াতেই মেয়েটি চিৎকার করতে সক্ষম হয়েছিলাে। ঘরের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে রয়েছে নানান পশুপাখির করােটি, কঙ্কাল, চামড়া আরও নানা অদ্ভুত উপকরণ।

এতক্ষণ ক্ষিপ্ত হয়ে থাকা মৈনাক চাটুজ্যে ধরা পড়ে গিয়ে উন্মত্ত হয়ে উঠলাে। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে কইলাে,

– “শােনাে, শােননা তােমরা, হ্যা আমি চুরি করেচি এদের। এক বিরাট পৌরাণিক আবিষ্কারের একেবারে সম্মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি। বহু বৎসর অমানুষিক পরিশ্রম করে এই হারিয়ে যাওয়া শক্তি খুঁজে পেয়েছি আমি। সবার তাক লেগে যাবে সব জানার পর। বিশ্বাস করাে তােমরা।”

পাগলের মতাে দীননাথের দিকে এগিয়ে তাকে দুই হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে পাগলপ্রায় স্বরে বললাে, “ও মাস্টার, মাস্টার, তােমাকে সেইদিন কয়েচিলাম না যে সঠিক উপায় জানলে পরে জড় বস্তুর মধ্যেও প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব! মনে আছে তােমার? আজ সেই উপায় আমি পেয়েছি। ঝড়, ঝঞ্ঝা, আকাশ, বাতাস সব কিছুতেই প্রাণ ভরে দেওয়া যায়, শুধু তার জন্য চাই অপর একটি জীবন। বিশ্বাস করাে, এই প্রথা আজকের নয়। ইতিহাস সাক্ষী, সড়ক থেকে প্রাচীর, সেতু থেকে সুড়ঙ্গ, সব কিছু নির্মাণের পূর্বে আগে নরবলি দেওয়া হতাে। সেই প্রেতাত্মার থেকে জীবন পেতে ঐ সকল জড় বস্তু। সেই হিসেবে এই দুটি ভিখিরিপ্রায় শিশুর জীবনের মূল্য কত? একখানা অচল পয়সার অধিক নয়। আমার কাজে বিঘ্ন ঘটালে সব ছারখার করে দেবাে আমি। কাণাকড়িও মূল্য নাই এমন দুইখানি শিশুর বাঁচা মরায় ইতর বিশেষ নাই, এর বদলে বরং আমি এই বুড়ীকে অনেক অনেক..”

রটন্তী গাঁয়ের কামার গঙ্গাধর এই পাষন্ডের ধৃষ্টতা আর সহ্য করতে না পেরে হাতের ছড়িখানা দিয়ে সজোরে প্রহার করল। উপস্থিত লােকেরা এই বাতুলের স্পর্ধা দেখে এমনিই ভিতরে ভিতরে ফুঁসচিলাে, এইবার গঙ্গাধরের ছড়ির আঘাত তাদের ক্রোধানলে ঘৃত সিঞ্চন করল। হৈ হৈ করে চিৎকার করতে করতে কেউ মুষ্টাঘাত, কেউ পদাঘাত করে শয়তানটাকে ধরাশায়ী করে ফেললাে। প্রচণ্ড আর্ত চিৎকার এবং ক্রুদ্ধ মানুষের আস্ফালনের মধ্যে শিশু দুটিকে বন্ধন মুক্ত করে বাইরে নিয়ে আসা হলাে। শরীরে একরাশ বেদনা নিয়ে গােঙাতে গােঙাতে, টলতে টলতে ঘরে ঢুকে আগল দিলাে ছােটো চাটুজ্যে।

সবাই মিলে সবেমাত্র চাটুজ্যেদের বসত জমিটুকুই পার করেছে কি করেনি, একটা অস্ফুট চিৎকারে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাে সর্বনাশ উপস্থিত হয়েছে। দালানের ভিতরের অংশ দাউদাউ করে জ্বলচে। দৌড়ে এসে জানালায় মুখ বাড়িয়ে দেখা গেল ছােটো চাটুজ্যে নিজেই অপমানের দংশনে নিজের গৃহে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তার শরীরেও আগুনের ছোঁয়া লেগেছে, কিন্তু কি আশ্চৰ্য্য! অন্য অন্য অগ্নিদগ্ধদের মতাে সে ছটফট বা ছুটোছুটি করছে না! চিৎকার করছে না! বরং জানালার গরাদ ধরে মৃত্যুশীতল হিংস্র দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে বাইরের ভিড়টার দিকে। সে ভয়ানক চাহনি দেখলে প্রাণ উড়ে যায়। তার গােটা শরীরে রক্তের ধারা বয়ে চলেচে, পােশাক আশাকে আগুন ছড়িয়ে পড়েচে, মাথার কোঁকড়ানাে চুলের রাশি পুড়ে গিয়ে ব্রহ্মতালু দেখা যাচ্ছে, কালসর্পের ন্যায় আঙুলগুলি চেপে বসেচে জানালার গরাদে, আর দক্ষিণ হস্তের তর্জনীটি উঁচিয়ে রয়েছে বাইরের দলটার দিকে। মৈনাক চাটুজ্যে হঠাৎ উন্মত্তের মতাে খলখল করে হেসে উঠলাে, যে হাসি একমাত্র কোনও পাগলেই তার মৃত্যুকালে হাসতে পারে, তারপর ক্লিষ্ট, ক্ষীণ স্বরে তাদের উদ্দেশে বলে উঠলাে, “মূখের দল… তােরা ভেবেচিস ঐ কাঙাল শিশুদুটোকে কেড়ে নিলেই আমার যজ্ঞ পন্ড হয়ে যাবে তাই না? আমার আবিষ্কার বিনষ্ট হয়ে যাবে তাইতাে? মহা মূখ তােরা… আমার দানব জাগচে। প্রাণঘাতী রূপে জেগে উঠছে সে। ওর শ্বাস প্রশ্বাসের ধ্বনি টের পাচ্ছি আমি। আআআআঃ। আজকেই হবে তার প্রাণপ্রতিষ্ঠা। আর কারুর নয়, আমার নিজের জীবন বায়ু দিয়েই আমি তাকে জাগাবাে। তার মারণশক্তির মােকাবেলা করা কোনও মানুষের সাধ্যি কি! তােদের নষ্ট বুদ্ধিই আজ তােদের সাক্ষাৎ শমন ডেকে আনলাে। দরজায় আগল দিয়ে বসে থাক, মাটির তলায় লুকিয়ে বসে থাক, স্বর্গ মর্ত রসাতল যেথায় খুশী আত্মগােপন কর, যেখানে ইচ্ছে পালিয়ে যা, কিন্তু বাঁচবি নে। আমার পাঠানাে যমদূত তােদের ঠিক খুঁজে নেবে। সব ছারখার, তছনছ, লন্ডভন্ড করে দেবে হেলায় ফেলায়। ও দেখতে পায় না, শুনতেও পায় না, শুধু গন্ধ পায়। গন্ধ কখনও ধোঁকা দেয় না। হাঃ হাঃ হাঃ। বড়াে ভয়ানক গন্ধ… বড়াে ভয়ানক গন্ধ… বড়াে ভয়ানক গন্ধ…।”

গলার স্বর ক্ষীণ হতে হতে ধপ করে মৈনাক চাটুজ্যের ভারী শরীরটা মেঝেতে লুটিয়ে পড়লাে। পাঁচজন প্রধান মিলে মৃতদেহের দগ্ধাবশেষ উদ্ধারের উদ্দেশ্যে তার বাড়ির দরজার কাছে যাওয়া মাত্র কোথাও থেকে একঝাঁক রাক্ষুসে মশার পাল ঝাঁপিয়ে পড়লাে তাদের উপর। হুলের দংশনে অতিষ্ঠ হয়ে ছত্রভঙ্গ দলটা এইদিক ওইদিক দৌড়ে পালিয়ে গেল। হিমু পালােয়ানের উন্মাদ ছেলে মারা গিয়েছে বটে কিন্তু বাড়ি ফেরার পথে প্রতিটি মানুষের কর্ণকুহরে সেই জীবৎকালের ভয়াল অভিশাপ ঘুরে ফিরে ধ্বনিত হয়ে চললাে… দানব জাগচে, সব ছারখার হয়ে যাবে, কেউ রক্ষে পাবে না। দানব জাগছে…।

ছােটো চাটুজ্যের দন্ডবিধান সকলেই চেয়েছিলাে কিন্তু মরণ কামনা কেউই করেনি। তার অপঘাত মৃত্যুতে কেউই বিশেষ খুশী হয়নি। কিন্তু যে আত্মঘাতী হয় তার মৃত্যু রােধ করবে কে? কাজেই দুইদিনেই এই আলােচনার প্রাবল্য হ্রস্ব হয়ে এল, কিন্তু মুখ ফুটে না কইলেও সকলেরই মনের মধ্যে একটা অসােয়াস্তি লুকিয়ে ছিলাে। পাগলাটে ঐ মানুষটি মরণকালে কিসের জোরে কথাগুলি বললাে! কোন দানব জাগতে চলেচে? সে কিসের পরীক্ষা করতে ঘরে?

অপঘাতে যারা নিপাত হয় তাদের পরিণতি নিয়ে লােকসমাজে একটা ধোঁয়া ধোঁয়া ধারণা রয়েছে। কেউ ভাবে মৃত্যু স্বাভাবিক না হলে প্রেতাত্মা মুক্ত হয়, কেউ ধারণা করেন প্রেতাত্মা থাকলেও তাদের জীবিত প্রাণীর ক্ষতি সাধনের শক্তি থাকা সম্ভব নয়, আবার কারুর কারুর মতামত অনুযায়ী ঐসব আত্মা টাত্মা দূর্বল হৃদয়ের কষ্ট কল্পনা মাত্র। একেক ধর্মে, একেক জাতিতে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে লক্ষ্য করা যায়, বহু বহু দূরত্ব, বহু পার্থক্য সত্ত্বেও পৃথিবীর প্রত্যেকটি প্রদেশের প্রতিটি জনজাতির মধ্যে কিন্তু এই অপঘাতের অপ-পরিণতির কথা বলা রয়েছে। সেই পুরাকালের যুগে কোনও রকম যােগাযােগ বা পারস্পরিক মতবিনিময় ছাড়াই দেশ কাল নির্বিশেষে এই অপঘাত মৃত্যুর হিংস্র পরিণামের উল্লেখ করে গিয়েছেন শাস্ত্রকারগণ। কিন্তু কেমন করে এটি সম্ভব হলাে? কাল্পনিকভাবে কেউ কিছু গপ্পো ফাঁদলে তা সমগ্র চরাচরের প্রতিটি জনজাতির মানুষ পারস্পরিক যােগাযােগ ছাড়াই কেমন করে জেনে গেল? কী করে হুবহু একই বর্ণনা প্রতিটি দেশে ছড়িয়ে পড়লাে? উত্তর একটাই। দিনের বেলায় আকাশে সূর্যের ওঠা যেমন সব দেশের মানুষ চোখে দেখে বিশ্বাস করে, ফলে সূর্যের বর্ণনা দেশ দেশান্তরে একই হয়, ঠিক তেমনি অপঘাতের ভয়ঙ্করী রূপ নিয়েও সব ধর্মের সিদ্ধান্ত এক। কোনও বিতর্ক নাই। অর্থাৎ.. সূৰ্য্য, চন্দ্র, গ্রহ, গ্রহাণুর মতােই প্রেতাত্মাও হয়তাে সত্য। সেই আপ্তবাক্য যে ঠিক কতােখানি যথার্থ হতে পারে তার চাক্ষুস প্রমাণ হাতেনাতে টের পেলাে তালুক চণ্ডীতলা।

যেই দিনের কথা বলচি, সেইদিন ছিল বাংলা বৎসরের প্রথম দিন। সারাদিন বাঙালি নিয়ম মেনে গােটা গাঁয়ের বাড়িতে বাড়িতে আমের পাতা ঝােলানাে হয়েছে, পাটকাঠির আঁটি জ্বালানাে হয়েচে, গােরুকে পূজা করা হয়েছে। বিকেলে জয়ন্তী গাঁয়ের প্রধান চাদপাল রায়ের উদ্যোগে ছােটোখাটো একটা গ্রামীণ জলসার আয়ােজন করা হয়েছিলাে অন্যান্য বৎসরের মতােই। লােকে কীর্তন এবং পালাগান শুনে একটু রাতের দিকে যে যার গৃহাভিমুখে রওয়ানা হলাে। গ্রামগঞ্জে এসব ক্ষেত্রে লােকজন দলবদ্ধ ভাবে যাতায়াত করে। সেসব ভারী আমােদের ব্যাপার। মিঠে চাদের আলােয় মেঠো পথ ধরে পঞ্চাশ ষাটজন লােক গপ্পো করতে করতে একসাথে হেঁটে আসার যে মাধুর্য, তা গােরুর গাড়ি অথবা মােটরগাড়িতে কখনওই পাওয়া চলে না। যাই হােক, এই দলগুলি যখন মােটামুটি জয়ন্তীর গন্ডী পেরিয়ে অনেকটা দূরে চলে এসেছে, আচমকা বাতাস বইতে লাগলাে। হঠাৎ করেই যেন বিশাল ঝড় ধেয়ে আসছে চারদিক থেকে। প্রচণ্ড হাওয়ার দাপটে লােকজন কাছাকাছি গাছের গুড়িগুলােকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরলাে। সমস্ত এলাকার পাখির দল, বানরের দল, কুকুর বেড়ালের দল একসাথে, একযােগে ভয়ার্তভাবে আর্তনাদ করা শুরু করল। সেই মিশ্র আতঙ্কের চেঁচামেচি শুনে পথ ফিরতি মানুষগুলাের বুকের রক্ত জল হয়ে এল, আর ঠিক তখনই একটা কান-ফাটানাে শব্দের সঙ্গে সঙ্গে পায়ের তলের মাটি ভয়ঙ্করভাবে লাফিয়ে উঠে লােকজনকে দশ হাত দূরে ঠিকরে ফেলে দিলাে।

যে যেখানে পড়েছিলাে সেখানেই পড়ে রইলাে। ভীষণ ত্রাসে দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে যখন একে অপরের মুখের দিকে চাইচে, তখন আরেকটা ঝড় এসে ঝাপিয়ে পড়লাে এবং একটু পরেই সব থেমে গেল। এমন ঘটনা কেউ কক্ষনও প্রত্যক্ষ করেনি, ফলে প্রতিটি মানুষই ভীত এবং আশ্চর্য হয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে, এমন সময়ে অনেক দূর থেকে একটা ক্ষীণ আর্তনাদ ভেসে এল। পরিষ্কারভাবে বােঝা যায় না, তবে বহু দূরে অনেকগুলি মানুষ যেন ভীষণ ভয়ে পরিত্রাহি কলরব করচে। গাঁয়ের বৃদ্ধ মতিলাল এই দলের সর্বাপেক্ষা অভিজ্ঞ ব্যক্তি। সে একসময় সওদাগরি, মানােয়ারী জাহাজের দিশারুর কাজ করতাে। বৃদ্ধ নিজের শীর্ণ হাতের পাতা কানে ঠেকিয়ে কিছুসময় নিবিষ্ট চিত্তে শব্দগুলি শুনলাে এবং যারপরনাই বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে কইলাে, “সর্বনাশ! জয়ন্তী গাঁয়ে বােধহয় দানব এসেছে”।

**********

সকালে প্রত্যেকেই হতবিহ্বল হয়ে দেখলাে জয়ন্তী গাঁয়ের দক্ষিণ পানে, যেইদিকে চাঁদপাল প্রধানের বাড়ি, অর্থাৎ যেইখানটায় রাতে জলসা হচ্চিলো, সেই স্থানে বিঘের পর বিঘে জমি সেই প্রচণ্ড তুফানের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েচে। ঘরবাড়ি, জমিজমা, গাছপালা, পথঘাট কিচ্ছুটির আর চিহ্নমাত্র নাই। গােটা তল্লাটটা খাঁ খাঁ করচে শূন্য জমি। ঝড়ের আর সূকম্পের অভিঘাতে পুরাে এলাকাটা ভূমিতল থেকে অনেকটা নাবাল হয়ে ধ্বসে গিয়েছে যেন। কোনও এক মরণ ঘূর্ণিঝড় নিজের মারণপাকে বেঁধে সমগ্র এলাকাটাকে টুকরাে টুকরাে, ছারখার করে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েচে। ওই মৃত্যুপুরীর আওতার বাইরে যারা ছিল, তাদেরও ওই ফিরতি দলটার মতােই অভিজ্ঞতা হয়েছে। এ কেমন প্রলয় যা নির্দিষ্ট একটি এলাকাতেই নিজের করাল থাবা বসায়? তবে কি সত্যিই সেই দানব জেগে উঠলাে, যার কথা ঐ পাগল শয়তানটা মরার সময়ে বলে গিয়েছিলাে?

জবাব দেবার কেউ নাই। ওই অভিশপ্ত গাঁয়ের যারা সেই সাক্ষাৎ শমনকে হয়তাে বা একঝলক দেখেওচিলাে, তারা কেউই আর জীবিত নাই। তাদের কোনও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাজেই নববর্ষের রাত্তিরের সেই নৃশংস তান্ডবলীলার সত্যতা অধরা, অজ্ঞাতই রয়ে গেল। এরপর ঐ হপ্তা দুয়েক পর চন্ডীতলা পরগণার কেশবতলা সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। সেই রাতে বড়াে বেশি গুমােট হয়ে ছিল আকাশ। প্রায় সকলেই অসহ্য গরমে ছটফট করে চলেচে আর অন্তর থেকে বৃষ্টির কামনা করচে। এই তালুকে ভয়ানক মশার উপদ্রব। গুমােট গরমে সেই উৎপাত আরও বেড়ে গিয়েছে। বিরক্ত হয়ে দীননাথ মাস্টার গােহালে বেরিয়ে ছােট্ট এক আঁটি খড় জ্বেলে নিভিয়ে দিলাে ধোঁয়া করার জন্য। সে সবে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছে, এমন সময় আকাশ গুড়গুড় করে উঠলাে। এই মাঝ বােশেখের রাত্তিরে ঝড় বৃষ্টি আসাটা নিতান্তই স্বাভাবিক, কিন্তু বেশ কিছু সময় যাবার পরে উৎফুল্ল গ্রামবাসীদের মনে খটকা লাগলাে। ঝড়ের সঙ্গে একটা শোঁ শোঁ করে অস্বাভাবিক শব্দ আসছে, ঠিক যেন বিশাল দেহধারী কোনও অতিকায় জন্তু নক্ষত্র বেগে ধেয়ে আসচে এইদিকে। হঠাৎ ভয়ানক তীব্রতায় মাটি থরথর করে লাফিয়ে উঠলাে, যে যার শয্যা থেকে ছিটকে পড়লাে, গােরু বাছুরগুলি পাগলের মতাে রঞ্জুবন্ধন ছিড়ে দিগ্বিদিকে দৌড় দিলাে। দীননাথ ভারসাম্য হারিয়ে দেউড়িতে পড়ে গেল। মাসপয়লার ঘটনায় এমনিতেই প্রত্যেকেই ভয়ে, ধন্ধে ছিল, তায় আজকে আবার তার অবিকল পুনরাবৃত্তিতে তারা ভীত এবং আশঙ্কায় অস্থির হয়ে উঠলাে। আগের মতােই বেশ কিছুক্ষণ পর আবার একটা ঝড় উঠলাে, আর তারপর সব নির্জনতায় ডুবে গেল। সশঙ্ক চিত্তে দীননাথ তাকিয়ে রইলাে প্রায় পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া খড়ের আঁটিটার শেষ ধোঁয়াটার দিকে। চন্ডীতলার ভাগ্যেও তখন একরাশ ধোঁয়াশা।

রাতজাগা মানুষগুলাের ভীষণ আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হলাে ভােরের আলাে ফোটার সঙ্গে সঙ্গে। লােকমুখে বয়ে এল এক মর্মান্তিক সংবাদ। প্রধান কেশব নন্দী আর নেই। কেশবতলাও আর নেই। রাত্তিরের ঐ মরণ ঝড় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে গােটা গ্রামের আশী ভাগ অংশ। পরিণতি একই। ঘরবাড়ি, মন্দির, কূয়া, সব যেন এক প্রচণ্ড বিস্ফোটের ফলে ধূলার ন্যায় মাটিতে চিত্রবৎ মিশে গিয়েছে। জমি অনেকটা নিচে ঢুকে গিয়েছে। কোনও সর্বনাশা দানব বুঝি গ্রামটাকে ধরে অন্ধকার পাতালের দিকে টান মেরে বসিয়ে দিয়েছে।

রহস্য নিরসন হলাে না। এই আক্রমণ প্রতিবারেই হয় গভীর রাত্তিরে এবং অকস্মাৎ। খেটে খাওয়া মানুষগুলাে রাতের পর রাত জাগ্রত হয়ে প্রহরা দিতে পারে না, আর তাছাড়া এই দূর্ঘটনাগুলির কোনও নির্দিষ্ট সময়কাল দিনক্ষণ নাই যে সেই দিনটি সতর্ক হয়ে থাকা যাবে। জয়ন্তীর পরে কেশবতলা ধ্বংস হয়েছিলাে দিন পনরাে পর, আর কেশবতলার পর ভীমনাগপুর মুছে গেল ঠিক এক মাস পর। প্রধান কেশব ভটচা আদতে শিয়ালঝােরার প্রধান। সেই রাতে একটি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে সে এসেছিলাে তার বােনাই জগদীশের গৃহ। ভীমনাগপুরে। সেই জগদীশের ঘরবাড়ি সমেত গােটা এলাকা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল রাতের সেই কাল-দানবের থাবায়। আবার এই ঘটনার দিন সতরাে পরেই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলাে হরিহর আচার্য্যি মশায়ের গাঁ আমতলী, সে মর্মান্তিক ঘটনা তােমরা আগেই শুনেছো।

প্রধানদের প্রতি আক্রোশ থেকেই যে এই পরিণাম, তা বুঝতে কারুর আর বিশেষ বাকি ছিলাে না। আক্রান্ত গ্রামগুলির রক্ষা পাওয়া অংশগুলি ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতে থাকলাে। এইবার আসি রতনলালের কথায়। অভিশাপ পাওয়া প্রধানদের মধ্যে সেও রয়েছে, কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে বড়তলি গ্রামে কিন্তু সেই আক্রমণ নামলাে না। তবে চেষ্টা যে হয়নি তা একেবারেই নয়। হয়েছে। বার তিনেক হয়েছে। কিন্তু এই মাঝারি মাপের সামান্য গ্রামখানি কি ভাবে যেন বেঁচে গিয়েছে প্রতিবার।

মধ্য রাত্রে সেই শোঁ শোঁ ঝড় আর দুলুনি শুরু হবা মাত্র রতনলাল ইষ্ট স্মরণ করে বসে পড়লাে, কিন্তু হঠাৎ মনে হলাে সেই দানব যেন কোনও কারণে ঠিক সুবিধে করে উঠতে পারছে না। কিসের যেন রাগে সে ছটফট করচে, তথাপি ঝাঁপিয়ে পড়তে বিফল হচ্চে। এইরকম পরপর তিনবার ঘটলাে। রতনলালের আশপাশের প্রতিবেশিরা ইতিমধ্যেই বাড়ি ছেড়ে সরে গিয়েছে, কিন্তু এইবার তারা একে একে ফেরা শুরু করল।

এইখানে রতনলালের স্ত্রী মােক্ষদাসুন্দরীর কথা একটু কয়ে রাখা প্রয়ােজন। গাঁয়ের মধ্যে অন্যান্য মেয়ে মানুষেরা যতদূর সম্ভব এই দজ্জাল এবং ততােধিক কটুভাষিনী মেয়েটিকে এড়িয়ে চলে। রতনলাল বাস্তবিকই একজন নিরীহ আর শান্তিপ্রিয় মানুষ, ফলে সে যদুর সাধ্য মােক্ষদার মন জুগিয়ে চলার চেষ্টা করে চলে। মনে মনে এই কলহপ্রবণা স্ত্রীকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। এই পরিস্থিতিতে একদিন বড়তলির বাড়িতে এসে উঠলাে রতনলালের ছােটো ভাই। স্বভাবতই এহেন টালমাটাল সময়ে দেবরটিকে আতিথ্য গ্রহণ করতে দেখে মােক্ষদা রাগে ফেটে পড়লাে। আড়ালে স্বামীকে ডেকে কইলাে “এই হতভাগা কি আর সময় পেলে না গা দাদার বাড়িতে ঠাই নেবার? তা, কয়দিন থাকার মতলবে আসা হয়েছে শুনেছো কিছু?”

রতনলাল মহা আতান্তরে পড়ে ফিসফিসিয়ে বললাে,

-“আহ আহ, আস্তে বল, শুনতে পাবে যে। শুনলি নে, মা অসুস্থ হয়েচেন তাই…”

মােক্ষদার কণ্ঠ হ্রস্ব হবার বদলে নূতন তেজে জ্বলে উঠলাে, “তাই এই অকালে সংবাদ বয়ে এনেছেন উনি? শুনতে পেলেন তাে ভারী ভয় পেলুম কিনা, এই মােদা কারুকে উচিৎ কইতে ছাড়ে না এই জেনে রেখাে। চন্ডীতলার এই বেপদের কথা আমি প্রথমেই তাকে কয়েচি, কিন্তু এত বড় একটা খপর শুনেও তার না রাম না গঙ্গা! একটু আশ্চৰ্য্যি অবধি হলে না সে। মুখে যেন একটু বাঁকা হাসিও দেখলুম। জুলজুল করে তাকিয়ে আমাকে কইলাে, ‘ও! তবে তাে এইবার আপনাদের পালা।

তুমি বেশ করে ভেবে দেখাে দিকি একবার, এ তােমার ভাইই তাে? কত কাল তাে চক্ষেই দেখােনি তারে, এখন চেহারা চরিত্তিরও নিশ্চয়ই বদলেছে, কিন্তু আমি হলপ করে বলছি এ কখনাে তােমার ভাই নয়। এ নির্ঘাত কোনও ভয়ঙ্কর লােক। কেমন টিপটিপ করে চেয়ে থাকে, কেমন পাষাণের মতাে গতর, কৈ তােমার মায়ের একখানা কিছু তাে সঙ্গে আনলে না সে প্রমাণের জন্যি? এই অপয়া আপদকে যত শীগ্রই সম্ভব কুলাের বাতাস দিয়ে বিদেয় করাে। আমার কিন্তু একদম ভালাে ঠেকছে না গাে।”

বলতে কি, খটকা যে রতনেরও লাগেনি তা নয়, কিন্তু এই সন্দেহের লেশমাত্র স্ত্রীয়ের কাছে প্রকাশ পেলে আগুনে ঘৃতাহুতি দেওয়া হবে বৈ তাে তাই মনের দ্বিধা মনেই চেপে রাখলাে রতন। মনে হাজারাে প্রশ্ন আছাড় খাচ্চে। রটন্তী গাঁ আর তার নিজের বড়তলিতে কোনও কারণে এখনও বিপদ নামেনি, কিন্তু নামবে না তা বলা যায় না। রটন্তীর কামার গঙ্গাধর ব্যাপার বুঝে শয্যা গ্রহণ করেছে। ঘর থেকে বাইরে বেরুনাে বন্ধ করেছে, কিন্তু রতনলালকে গৃহবন্দী হয়ে থাকলে চলে না। আরেকটি প্রশ্নে রতনের চিত্তে শান্তি ছিল না। এই যে রাক্ষুসে ঝড় আর ভূমিকম্প অতর্কিতে এসে সব বিনষ্ট করে দিয়ে চলে যায়, এর আসল স্বরূপ কি? সে কোথা থেকে আসে, এসে কী করে, সেই ঝড়ের তান্ডব কতােটা ভয়াবহ, এইসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য উতলা হয়ে উঠলাে সে। তখনও অবধি রতনলাল ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে এসবের জবাবের জন্য তাকে আর বেশি সময় প্রতীক্ষা করতে হবে না। আজ রাতে তার সব প্রশ্নের জবাব সে পাবে। এইবার অভিশাপের শেষ লক্ষ্যে থাকা রতনলালের উপরে কী ভাবে আক্রমণ হলাে তাই বলি শােনাে।

**********

সেইদিন দুপুরে আহারের সময়ে মােক্ষদা নিজেই দেবরকে বেশ দু-চারটে কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দিলাে এবং সেই ভাষা শুনে রতনলাল অত্যন্ত মর্মাহত হয়েচে বুঝে ক্ষিপ্ত হয়ে স্বামীকেও কিছু সুতীক্ষ্ণ বাক্য শেল ছুঁড়ে দিয়ে কইলাে

-“যেমনি অপদার্থ দাদা, তার দোসর ভাই। ভাইকে ঠাই দিয়ে মন্ডা গন্ডা খাওয়ানাে চলচে চৌপর ভর। আপনি পায় না খেতে আবার শঙ্করারে ডাকে। ভাই সেইদিন একখানা চিঠি লিখে দিলাে, অমনি বাবু দৌড়ােলেন সেখানা ডাকে ফেলতে, বলি চিঠিপত্তর একটিবার খুলে দেখেছো কি কোন সাপ ব্যাঙ লেখা আছে তাতে? নিজে গিয়ে ডাকে দেওয়া গেল না? দাদাকে ঘর থেকে সরানাের কুমৎলব আমি বুঝিনে? আর বলি মায়ের অসুখ তাে তার একখানা হাতী ঘােড়া প্রমাণও তাে হাতে করে আনতে হয়। চিনিনে, জানিনে, সাত জন্মে দেখিনে, হঠাৎ এসে কি, না আমি আপনার ভাই। মরণ, মরণ অমন ভাইয়ের কপালে।”

সন্দেহ রতনলালেরও যথেষ্ট ছিল, কিন্তু মেয়ে মানুষের মুখে এমন নির্লজ্জ উক্তি শুনে তার মনে হলাে ধরণী দ্বিধা হও। মধ্যাহ্নের আহার কোনও ক্রমে সমাধা করে রতন বিকেলে এসে হাজির হলাে চাঁদকাটি ইস্টেশনের আপিসঘরে। সদরের ইংরেজ বডােকর্তাকে সব জানিয়ে সে একখানা চিঠি লিখেচে সকালে। রতনলালের সঙ্গে সায়েবের কিঞ্চিৎ পরিচিতি রয়েছে, অন্ততঃ দীননাথদের মতাে তার কথাকে উড়িয়ে দেবে না কর্তারা। বিকেলের রেল গাড়ি সবেমাত্র একটু আগেই ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সামান্য আগে আসতে পারলে এই গাড়িতেই পত্রখানা চলে যেতাে। এখন কাল সকালের পূর্বে গাড়ি নাই। ইস্টেশান থেকে বেরুবার মুখেই ভয়ানক জোরে বৃষ্টি এসে পড়লাে। শ্রাবণ বিদায়ের পূর্বে তার শেষ অস্তিত্ব জানান দিচ্চে। চতুর্দিক আঁধার করা বৃষ্টি যখন সামান্য কমে এল তখন রতন অনুভব করল আঁধারের বাস্তবিকই আর বেশি বাকি নাই। প্রায় সন্ধ্যার মুখে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে তার চোখে পড়লাে টুংটাং শব্দ করে শেষ গাে-যানটি বেরিয়ে যাচ্চে। ছপছপিয়ে দৌড়ে গাড়ির সামনে এসে রতন কইলাে, “কে ও, বলাই নাকি! চললি ক’নে?”

—“পেন্নাম কর্তা, আপনার ভাগ্যি ভালাে আজ। উঠে আসেন ছই’তে। একখানা সওয়ারি পেয়ে সবেমাত্তর গাড়ি ছাড়তে যাচ্চি, এমন কালে চেপে বাদলা এল। আমি জলের জন্যিই এগােইনি আর। আপনারে বড়তলির মুখে নামিয়ে দেবাে’খন।”

রতন মাথাটুকু ছইয়ের ভিতরে রেখে গাড়ির পিছনদিকে পা ঝুলিয়ে বসলাে। এই জল কাদা মাখা পা এখন গাড়িতে তােলা উচিৎ নয়। তখনও রতনলাল ঘুণাক্ষরেও আঁচ পায়নি যে বিপদ স্বয়ং তার জন্য ওৎ পেতে বসে রয়েছে। গাড়ি চলতে শুরু করল এবং ইস্টিশানের চত্বর পার করে বাঁ দিকে ঘুরে চাঁদকাটি পাহাড়ের পাদদেশের জঙ্গলের মাঝখানের বড় পথটা যখন ধরলাে ততক্ষণে মেঘ কেটে গিয়ে আবছা চাদ বেরিয়েছে, তার ক্ষীণ আলােয় জঙ্গলের দিকে আনমনা হয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ রতনের মনে পড়লাে গাড়ােয়ানের কথাগুলি। বলরাম বললাে সে নাকি সওয়ারি পেয়ে গাড়ি ছাড়বার উদ্যোগ করছিলাে, কিন্তু সেই লােক তাহলে গেল কোথা? নীচু হয়ে ছইয়ের ভিতরে উঁকি মেরে রতন একটু অসােয়াস্তি বােধ করল। সেখানে একটা অচেনা মুখ এক্কেবারে নিশ্ৰুপ হয়ে অন্ধকারে গা মিশিয়ে সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে বসে রয়েছে, কিন্তু তার স্থির চক্ষু দুটি আঁধারের ভিতর থেকে তীক্ষ্ণ ভাবে চেয়ে রয়েচে রতনেরই দিকে। একটু অন্যরকম মনে হলেও রতন সেদিক থেকে মনকে ফিরিয়ে অন্য কথা চিন্তা করতে লাগলাে।

গাড়ি জলকাদা ভেঙে যখন জঙ্গল চেরা পথের মাঝ বরাবর এসেচে হঠাৎ একঝলক দমকা হাওয়া সবেগে রতনের মুখে এসে লাগলাে। ভালাে করে তার কারণ উপলব্ধি করার আগেই ক্ষণিকের মধ্যে হু হু করে বাতাসের বেগ বাড়তে বাড়তে ঝড়ের রূপ নিতে থাকলাে। চারপাশের গাছপালাগুলি মড়মড় শব্দে দুলচে, দূরে কোথাও ডাল মটকে ভেঙে ভেঙে পড়চে, বাসা ভাঙা পাখিগুলি পরিত্রাহি কলরব করচে। গুড়গুড় শব্দে মেঘ গর্জনের সঙ্গে আবার প্রচণ্ড বেগে থেমে যাওয়া বৃষ্টিটা সজোরে ঝাঁপিয়ে পড়লাে। রতন মুখ বাড়িয়ে উপরের দিকে চেয়ে দেখলাে আকাশে আবার একরাশ অন্ধকার মেঘ জমা হয়েচে। চাঁদের অংশটুকু আবৃত হয়নি বটে কিন্তু মাথার ঠিক উপরেই পুঞ্জীভূত সেই মেঘের ঘন কালাে পিন্ড যেন ধীরে ধীরে বড়ড়া, আরও বড়াে হয়ে চলেচে। শাঁই শাঁই করে একটা একটানা শব্দ আসছে, যেন কেউ ভয়ানক জোরে সমস্ত শক্তি দিয়ে এইদিকেই দৌড়ে আসছে। গাড়ােয়ান ভীষণ ভয়ে গায়ের জোরে গােরুগুলিকে চাবুক হাঁকালাে। অবলা জীবদুটিও অস্বাভাবিক এই পরিস্থিতি পুরােদমে উপলব্ধি করেছে। প্রাণের ভয়ে ভয়ানক জোরে তারা ছুটতে শুরু করল। পলকা গােরুর গাড়িটা থরথর করে কাঁপছে। রতনের বুঝতে বাকি রইলাে না যে আজ তার দিন ফুরিয়েচে, মরণ তার শিয়রের ঠিক উপরেই ঐ যে, ঐখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে! কিন্তু তার দোষে গাড়ােয়ানের ক্ষতি হবে কেন? সে কম্পিত হৃদয়ে নারায়ণ স্মরণ করে অস্ফুট স্বরে চিৎকার করে উঠলাে, “বলাই, এক্ষুনি গাড়ি বাঁধ। আমি, আমি নামবাে।”

গাড়ােয়ানের তরফ থেকে একটাও উত্তর এল না, আর সে থামাতে চাইলেও জীবদুটি দাঁড়াবে না।

-“বলাই গাড়ি থামা এখুনি…। আমি নামবাে.। আমি বলচি এখুনি থামা, নয়তাে তুইও…।”

রতনের মুখের কথা শেষ হবার পূর্বেই এক অস্বাভাবিক অপ্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে তার হৃদযন্ত্র স্তব্ধ হয়ে এল। তাদের ফেলে আসা রাস্তার একেবারে ওই মাথা থেকে গাছপালার উপর দিয়ে বাতাসে ভর করে ভেসে আসছে ওইটা কী? রতন চোখের থেকে বৃষ্টির জল মুছে ঠাহর করল সেটা এক ভয়ঙ্কর পিশাচ মূর্তি। তার মুণ্ডু নাই। দেহ নিকষ কৃষ্ণবর্ণ। চাদের ফিকে আলােকে আঁধার করে দিয়ে সেই অতিকায় পিশাচ উড়ে এল গােরুর গাড়ির উপরের আকাশে। রতন ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে গাড়ােয়ানকে নির্জীব কণ্ঠে শুধােলাে, “হা ঈশ্বর! ওইটে… ওইটে কী বলাই!”

মূর্তিটা অদ্ভুতভাবে ঠিক মাথার উপরে ভেসে ভেসে যেন গাড়িটার পানেই তাকিয়ে কারুর আদেশ বা নির্দেশের প্রতীক্ষায় লােলুপ হয়ে রয়েছে। এইবার গাড়ির ছইয়ের ভিতর থেকে হিসহিসে চাপা স্বর ভেসে এল- “পলাল ধূম শঙ্কাসং, তারা গ্রহ বিমৰ্দকম/ রৌদ্রং রৌদ্রাত্মকং ক্রুরং, ত্বং কেতুং প্রণম্যহম” আর সেই উচ্চারণ মাত্র ঐ বিরাট মূর্তি কানফাটানাে গর্জন করে ঝড়ের বেগে গাড়িটাকে ঘিরে একটা প্রবল ঘূর্ণন তৈরি করল। আঁতকে উঠে রতন দেখলাে ভিতরের সেই অন্ধকারের অচেনা যাত্রী সােজা হয়ে উঠে বসে তার দিকে নির্নিমেষ নজরে চেয়ে রয়েছে। অসহায় রতনলাল শুষ্ক স্বরে শুধােলাে,

“কে! কে তুমি?”

জলদগম্ভীর কণ্ঠে প্রত্যুত্তর এল– “ব্রাহ্মণ। নাম কালীপদ মুখুজ্জে। নিবাস রায়দীঘড়া। আমি বড়তলি গাঁয়ের কানাইলালের কাছে যাচ্চি। সে আমাকে পত্র লিখেচিলাে।”

রতন কাঁপা গলায় বিস্মিত হয়ে উত্তর দিলাে –“আজ্ঞা ঠাকুরমশায়, আমি তার বড়াে ভাই রতনলাল।”

**********

ধীরে ধীরে ঝড়বৃষ্টি প্রশমিত হয়ে এল। রতনের বিস্ময় তখনও কাটেনি। সে সাহস করে শুধােলাে। “ঠাকুর, এসব কি ছিলাে? ঐ ভয়ঙ্কর দানবটা কে?”

– “উনি কেতু। তােমার শিয়রে শমন দেখে নিতান্তই বাধ্য হয়ে তাঁকে স্মরণ করতে হয়েছে আজ। উনিই আপাততঃ আজ তােমাকে বাঁচালেন। কানাই অবশ্যি কিছুটা কিছুটা চিঠিতেই কয়েচে আমাকে, কিন্তু তােমাকে মারতে কী বা কে এসেছিলাে তা আমারও ঠাহর হলাে না।”

-“ঠাকুরমশায়, আপনি কি তন্তর মন্তরও কিছুটা জানেন নাকি! মানে, আপনি কি…।”

– “কী আমি? দেব, দানব, যক্ষ, কিন্নর? আমি তােমার মতােই রক্ত মাংস কাঠামাের মানুষ, তায় খাঁটি বাঙালি” বলেই কালীপদ হােঃ হােঃ করে হেসে উঠলাে। মুগ্ধ রতনের মনে হলাে এতক্ষণ এর চাপা ভয়ের পরিবেশটা মন্ত্রবলে কোথায় যেন উবে গিয়েছে এক লহমায়।

পরের দিন সকালে কানাই সর্দার আর রতন সর্দার দুইজনে মিলে কালীপদকে নিয়ে চললাে তালুকের চন্ডীমন্ডপে। নামেই চন্ডীমন্ডপ, কিন্তু এই গরীবের দেশে তেমন একটা পূজা পার্বণের বালাই নাই। এই স্থানটি পরগণার আলাপ, আলােচনা, বিচারের জন্য ব্যবহৃত হয়। সবকয়টি গাঁয়ে ভােরেই সংবাদ দেওয়া হয়েছিলাে, ফলে একটু বেলা হতেই প্রচুর মানুষ এসে উপস্থিত হলাে সেইখানে। কালীপদ রাত্তিরে দুই ভাইকে প্রশ্ন করে করে বেশ কিছু তথ্য জেনে নিয়েছিলাে, ফলে আজ গাঁয়ের লােকেদের প্রশ্ন করার মতাে বেশ কিছু রসদ তার রয়েচে। খুঁটিনাটি কোনও কিছু বাদ না দিয়ে সকলের সমস্ত কথা শুনলাে কালীপদ। লাটুর মায়ের বক্তব্য এবং সে প্রভুর পরীক্ষাগারে কী কী দেখেচিলাে, সে সব শুনলাে মন দিয়ে। লাটু, বটু দুই ভাইকেই শুধােলাে, “তােমরা মৈনাক চাটুজ্যেকে কতদূর অবধি অনুসরণ করেছিলে?”

বটু উত্তরে বললে “আমি বড়াে রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের ভিতর অবধি ঢুকে দেখলুম বাবু পিরিন্ডির বনে সেঁধুলাে। আমি একশিলার দেউল অবধি গিয়ে আর এগােইনি। ওর পরে…”

—“একশিলা কে?”

চন্ডীমন্ডপের ছেলে বুড়া কপালে হাত ঠেকিয়ে সমস্বরে বললাে – “সে বড়াে জাগ্রত দেওতা ঠাকুরমশায়, সাক্ষাৎ কাঁচাখেগাে। ওই মন্দিরের শিব ঠাকুরকে একেবারে নড়ানাে যায় না। যে চেষ্টা করে সে বজ্রাঘাতে ছাই হয়ে যায়।”

কালীপদ অবাক প্রশ্ন করল, “সে কি? সত্য নাকি? এমনটা হয় তােমরা দেখেচো, নাকি শুনে শুনেই…

গাঁয়ের বুড়ী ছিতামণি আবেগের স্বরে বললে “না ঠাকুর, আমি ছেলেবেলায় নিজের চক্ষে দেখেচি গােরা সায়েবদের ছাই হয়ে যেতে।”

কালীপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে পরম জাগ্রত মহাদেব একশিলার উদ্দেশ্যে বললাে –“হে প্রভু, হে স্বয়ম্ভু, তােমার প্রতি এই সরল মানুষগুলির বিশ্বাস যেন না টলে। আমাকে শক্তি যােগাও ভগবান।”, তারপর জনতার উদ্দেশে শুধােললা, “তােমাদের মধ্যে একজনও কেউ এমন আছাে, যে দুর্ঘটনার রাতে কোনও ক্রমে ঘরের বাইরে ছিলে?”

দীননাথ মাস্টার উপর নীচে ঘাড় নাড়লাে। নিজের পরিচয় দান করে সে যখন আপন অভিজ্ঞতা কইছে তখন তাকে মাঝপথেই থামিয়ে কালী বললাে,

—“ভালাে করে স্মরণ করাে মাস্টার, সে রাতে অস্বাভাবিক কিছু কি চোখে পড়েচিলাে?”

দীননাথ মাথা নেড়ে বিষন্ন মুখে বললে, “মনে পড়ছে না ঠাকুর। তবে তেমন কিছু দেখিনি তাে।”

-“তুমি তখন বাইরে কি ভয় পেয়ে বেরিয়েচিলে?”

-“আজ্ঞা না। আমি মশার উৎপাতের জন্য খড়ের আঁটি জ্বালতে বেরিয়েছিলাম”।

কালীপদ কিঞ্চিৎ উৎসাহিত হয়ে বললে, “জ্বেলেচিলে সেখানা?”

-“আজ্ঞা হাঁ”।

– “আর যখন দানবের উপদ্রব থেমে গেল, তখন সেখানা জ্বলচিলাে?”

এসব প্রশ্ন কী কাজে লাগতে পারে কারুর বুদ্ধিতে কুলালাে না। দীননাথ একটু অবাক হলেও উত্তর দিলাে “হ

যদুর মনে পড়ে জ্বলচিলাে, কিন্তু প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলাে।”

– “তুমি আমাকে হুবহু ঐ আকৃতির একখানা আঁটি বানিয়ে দিতে পারবে মাস্টার? এখনও কোনও কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি, কিন্তু মন বলচে এই জিনিসটা ভবিষ্যতে কাজে আসতেও পারে।”

দ্বিপ্রহরে আহার সমাধা করে বেশ কয়েকজন লােককে নিয়ে কালীপদ উপস্থিত হলাে হিমু পালােয়নের পােড়া বাড়িতে। রতন বললাে, “বেশি কাছে এগােবেন না ঠাকুর, নয়তাে সেই রাক্ষুসে মশার পাল আবার তেড়ে আসবে।”

কালীগুণীন অবাক হয়ে কইলাে, “মশার দল?”

-“হাঁ কর্তা, সেইদিন আমরা ঢুকতে যেতেই সেগুলাে আক্রমণ করেছিলাে। কি তাদের কামড়। বাপ রে।”

কালী স্মিত হাস্য করে বললাে, “ভয় নাই, তারা আজ হয়তাে আসবে না। তােমরা কপাট ভেঙে ফেলাে।”

দ্বার ভাঙতেই একটা বিকট পচা গন্ধে সকলের নাড়ী পাক দিয়ে উঠলাে। বাইরের পােড়া দালান ঘরটার ভূমিতে পড়ে রয়েছে মৈনাক চাটুজ্যের আধপােড়া, গলিত শব। মেঝেতে উঁই করে রাখা উদ্ভট কিছু কঙ্কাল। তার একখানা কুকুরের চেনা গেল, কিন্তু অপর একখানা অতিকায় মাছের মুন্ডুর মতাে কি রয়েচে কেউ চিনলাে না। কালীপদ সমুদুরের এলাকার মানুষ। সে কঙ্কালটাকে দেখেই কইলাে, “আরে! কী আশ্চর্য! এ যে হাঙরের করােটি।”

আরও বিভিন্ন আজেবাজে জিনিসে ঘরখানা ভর্তি হয়ে রয়েচে। একটি কাচের শিশি ভর্তি লাল পিঁপড়ার দল, হাড়গােড়, শেকড়বাকড় ইত্যাদি। সবচাইতে আশ্চর্যজনক হলাে এই ঘরের ছাদটা। এ মাথা থেকে ওই মাথা অবধি নিচ্ছিদ্র ভাবে আয়নার কাচ লাগানাে ছাত। কিছুটা ঐদিনের আগুনের কালিঝুলি মেখে গেলেও তাতে পরিষ্কার প্রত্যেকের মুখ দেখা যাচ্চে। কড়ি, বরগা কিচ্ছু নাই সেই ঘরে। নিটোল সেই ছাতের দিকে চেয়ে রতনের উদ্দেশ্যে কালীগুণীন কইলাে, “দেখেছো, একটা কড়ি বরগাও নাই ঘরে। এই ঘরে যদি কেউ গলায় দড়ি দিতে চায়, তবে দিতে পারবে না, তাইনা? আমি হলেও পারতুম না।”

দীননাথ রতনের দিকে চেয়ে ভ্রু নাচালাে। রতনও হেসে ইশারায় বােঝালাে যে সেও কিছুই বােঝেনি।

**********

পরের দিন ভােরে কালীপদ কয়েকজনকে নিয়ে দুর্ঘটনার শিকার গ্রামগুলিতে গিয়ে বিশাল দৈর্ঘ্যের রজ্জ্ব নিয়ে নানান রকম মাপজোক করে, ঐ দড়ির ঠিক মাঝখানে একটা গিট দিয়ে, বিকেলে হাজির হলাে চন্ডীমন্ডপে। সেখানে অনেকগুলি মানুষ আগ্রহের সঙ্গে জড়াে হয়েছে। কালী ধীরে ধীরে মুখ খুললাে,

-“আজ সবকয়টি ধ্বংসপ ঘুরে ফিরে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। যতবার যতগুলি এলাকা নিশ্চিহ্ন হয়েছে, তাদের পরিসর কিন্তু কমবেশি প্রায় অবিকল একই, আর প্রতিবারেই তার মধ্যস্থলে রয়েছে প্রধানদের বাড়িগুলি। একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল, ওই অপদেবতা যে রূপেই আসুক, তার ধ্বংসলীলা ওই নির্দিষ্ট বেঁধে দেওয়া পরিসরেই সীমাবদ্ধ থাকে, প্রতিবারই ওইটুকু এলাকাতেই সে থাবা বসায়। ঝড় বৃষ্টির আকৃতি নিয়ে এলে তার চারণভূমি কিন্তু একটা বাঁধাধরা গণ্ডীতে নিখুঁতভাবে আটকে রইতাে না। তবে কি শয়তানটার একটা নির্দিষ্ট আকার রয়েছে? সে ইচ্ছে মতাে পরিবর্তিত হতে পারে না? কিন্তু আরও আশ্চর্য কথা হলাে আততায়ীর লক্ষ্য কিন্তু কেবলমাত্র তাদের নির্দিষ্ট বাড়িগুলি নয়, কারণ কেশব নন্দী তাে সেই রাত্তিরে তার ভায়রার গৃহে ছিল, এবং সেইখানেও কিন্তু ঐ ঘরটিকে কেন্দ্রস্থলে রেখেই আক্রমণ ঘটেছে। অর্থাৎ এই দানব নিজের বুদ্ধিতে প্রধানদের বর্তমান উপস্থিতি জানতে এবং চিনতে পারে। এখন সবচাইতে আগে এইটা ধরা আবশ্যক যে ঐ শয়তান ঠিক কোন পদ্ধতিতে, কোন পন্থায় অবস্থানগুলি চিহ্নিত করে। এইটে না জানলে কিচ্ছুটি করা যাবে না।

তারপর গতকালের আরও একটা কথা রয়েছে। মৈনাক চাটুজ্যে পরীক্ষার ঘরে ঐ উদ্ভট প্রাণীগুলিকে জড়াে করেছিলাে কেন? এইখানে একটা বিরাট খটকা রয়েছে। হাঙর, কুকুর এবং পিঁপড়া তিনটি সম্পূর্ণ আলাদা জীব হলেও তাদের মধ্যে কোথাও যেন একটা মিল রয়েছে। কোথাও যেন শুনেছিলাম, এখন আর কিছুতেই স্মরণ হচ্চে না।”

কানাইয়ের ঘরে বসে কালীগুণীন গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে রইলাে। প্রশ্ন অনেকগুলিই অধরা। এই যে অজানা দানব অকস্মাৎ হাজির হয়ে গ্রামগুলিকে ছারখার করে দিয়ে চলে যায়, সে আক্রমণ করে কেমন করে? সে কী গ্রামেই লুকিয়ে থেকে সহসা আত্মপ্রকাশ করে? কী তার রূপ? ঝড়? ঘূর্ণী? নাকি অন্য এমন কোনও অকল্পনীয় চেহারা, যার অনুচর হিসেবে ঝড়, ভূমিকম্প দেখা দেয়, যাতে তাকে আড়াল করে রাখা যায়? সেই আসল রূপখানা একবার ধরতে পারলে তবেই না প্রতিরােধের উপায় ভাবা যাবে।

সব প্রধানদের উপরে আক্রমণ হলেও রটন্তীর গঙ্গা কামার আর বড়তলার রতনলালের উপরে কিন্তু মৃত্যু নামেনি। কেন? চেষ্টা যে হয়নি তা নয়, কিন্তু সেই রাক্ষস সুবিধা পায়নি। কেন? অন্যান্য আক্রান্ত এলাকার সঙ্গে এই দুইটি গাঁয়ের একটাই তফাৎ খেয়াল করেচে কালীপদ, তা হলাে, এই গাঁ দুটি একটা ছোটো রাঙী নামের পাহাড়ের গােড়ায় অবস্থিত। কিন্তু এ কেমন শয়তান যে কিনা সমতলের পল্লীগুলির কাছে পরম শক্তিধর আর হিংস্র, অথচ পাহাড়ের গায়ে থাকা এলাকায় সে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে না, বরং বাধা পায়! তবে কি পাহাড়টাই বাধার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্চে? পাহাড়টা তাকে বাধা সৃষ্টি করে কি কারণে? কালীপদর ভ্রুকুটি কুঞ্চিত হয়েই থাকলাে।

রাতে কালীপদকে দুই ভায়ে মিলে শতবার অনুরােধ করা সত্ত্বেও সে যৎসামান্য আহার করেই উঠে পড়লাে। মাথায় তার চিন্তা জটা বেঁধে রয়েছে। সেগুলির সমাধান না হলে বড়াে ভয়ানক বিপদ এগিয়ে আসচে চন্ডীতলার কপালে। বিরস মনে কালীপদ শয়নকক্ষে প্রবেশ করে দেখলাে মােক্ষদা খাটের ছত্রীতে মশারি বাঁধচে। কালীপদকে দেখে মাথায় ঘােমটা টেনে দিয়ে কইলাে—

“আপনি তাে কিছুই আহার গ্রহণ করলেন না ঠাকুরমশায়। রান্না কি ভালাে

হয়নি?”

কালী হেসে জবাব দিলাে, “ছিঃ ছিঃ মা। খেতে পারিনি সে তােমার এই বুড়াে ছেলের দোষ। রাঁধার কোনও ত্রুটি নাই ”

মােক্ষদার রুক্ষ আচরণ এই ক’দিনের মধ্যে অনেকখানি বদলে গিয়েছে। যে দেবরকে চোখের বালি ভেবে অকারণেই অসংখ্য গালমন্দ সে করেছে, সেই কানাই আজ বিপদের দিনে তার মনিব এই ব্রাহ্মণকে ডেকে এনে তার শাখা নােয়া রক্ষে করেছে, এই ভেবে মনে মনে সে শতেক বার মাথা খুঁড়েচে আর নিজের দুর্বুদ্ধিতে নিজেই মনমরা হয়ে থেকেচে এই কয়দিন। মােক্ষদা যত্ন করে কালীপদকে মশারি খাটিয়ে দিতে দিতে কইলাে, “নিন বাবা, এইবার শুয়ে পড়ুন। মশারি ভালাে ভাবে বিছানায় তুলে নিন। এই পরগণায় ভীষণ মশা মাছির উপদ্রব।”

কালীপদ চুপচাপ শয্যা প্রান্তে বসে প্রশ্ন গুলির জবাব হাতড়াচ্চিলাে, হঠাৎ মােক্ষদার এই কথায় সটান লাফিয়ে উঠে সােজা হয়ে দাঁড়িয়ে উচ্ছসিত স্বরে বলে উঠলো – “ঠিক তাে মা। তাইতাে। তােমার বুড়াে খােকাটার মাথায় এতক্ষণ ধরে এই কথাটা ধরাই পড়েনি। আজ তুমি আমার জ্ঞানচক্ষু খুলে দিলে। দীর্ঘজীবী হও বাছা।”, এই বলে হতভম্ব মােক্ষদাকে আশীর্বাদ করে হন্তদন্ত হয়ে কালীপদ বাইরে এসে আওয়াজ দিলাে – “রতনলাল, কানাই, শীঘ্র সাে তােমরা, প্রথম প্রশ্নটার জবাব হয়তাে পেয়েছি।”

কানাই সর্দার, রতন সর্দার আর কালীপদ দাওয়ায় এসে বসেচে। মোক্ষদা এক বুক আশ্বাস নিয়ে দ্বারের আড়ালে বসে রয়েছে। বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। চালতা ফুলের পাগল করা গন্ধ চারদিক আমােদিত করে তুলেছে। রতন অকৃত্রিম বিস্ময়ের সুরে প্রশ্ন করলাে –“ঠাকুর মশায় কোন প্রশ্ন ধরতে পেরেচেন? কে এই দানব তা জানতে পেরেছেন? দোহাই আপনার, অমন চুপ করে থাকবেন না। বলুন আমাদের।”

কালীপদ আপন মনে উত্তর দিলাে,

-“নাঃ। তার পরিচয় এখনও অজ্ঞাত, কিন্তু সেইটে ছিল দ্বিতীয় প্রশ্ন। প্রথম প্রশ্নটি ছিলাে, ঐ অজানা দানব কি উপায়ে তােমাদের বর্তমান উপস্থিতি নির্ভুল ভাবে জানতে পারে? এইটে ঠিকঠাক জানতে পারলে তবেই আততায়ীকে ধরা না গেলেও আক্রান্তর প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব।”

রতনলাল অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে শুধােলাে, “ঠাকুর! আপনি কি তবে সত্যিই ধরতে পেরেছেন সেই রহস্য? দয়া করে এখুনি বলুন আমাদের, কোন্ অজানা উপায়ে সেই নরহন্তা নৃশংস যমদূতটা আমাদের খুঁজে বের করচে? কী সেই শক্তি?”

কালীপদ একবার বুক ভরে চালতা ফুলের সুমিষ্ট আঘ্রাণ নিয়ে রতনের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাে, “গন্ধ”।

হতবিহ্বল তিন জোড়া চোখের দিকে চেয়ে কালীপদ ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, “শােননা বাছা, এই ধন্ধটার উত্তর হয়তাে আমি এত সহজে কিছুতেই পেতুম না, কিন্তু আজ মশারি খাটাবার সময়ে বউমার কথা শুনে সব পরিস্কার হয়ে গেল আমার কাছে। ঐ শয়তান চাটুজ্যের পাঠানাে সেই ভয়ংকর কালরাক্ষস তােমাদের গন্ধ চিহ্নিত করে একে একে খুঁজে বের করচে। এইবার কথা হলাে কিসের গন্ধ ? শরীরের? নিঃশ্বাসের ? স্বেদবিন্দুর? সেসব যদি হয়ও তবে কথা হলাে সেইসব গন্ধ মৈনাক চাটুজ্যে সংগ্রহ করল কোন পথে তার পােষা শয়তানকে চিনিয়ে দেবার জন্য? এইখানেই আমার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্চিলাে, এমন সময়ে বউমার কথায় আমার হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল।

তােমরাই কয়েচো যে তােমরা যখন চাটুজ্যের বাড়িতে ঢুকতে যাচ্চিলে, তখন তার পাঠানাে রাক্ষুসে মশার দল তােমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাে। এইটেই ছিলাে ঐ মৈনাক চাটুজ্যের সকলের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অথচ চূড়ান্ত গােপন পন্থা। তার পাঠানাে সেই বিধ্বংসী মৃত্যুদূত তােমাদেরই রক্তের গন্ধে তােমাদের চিনে নেয়। মানুষে মানুষে সাদৃশ্য থাকে, মানুষে মানুষে কণ্ঠস্বরের মিল থাকে, কিন্তু গন্ধ কখনও ধোঁকা দেয় না। তােমার শিরায় শিরায় বয়ে চলা উষ্ণ রক্তের ধারার গন্ধ তাকে চিনিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিজেকে লুকানাের কোনও উপায় আর তােমাদের নাই রতনলাল।

আমার সেইদিন থেকেই মনে পড়ি পড়ি করেও পড়েনি, কিন্তু আজ স্মরণ হয়েছে, পৃথিবীর বুকে হাঙর, কুকুর এবং পিঁপড়ার মধ্যে একমাত্র সাদৃশ্য হলাে, তারা প্রত্যেকেই ঘ্রাণশক্তিতে অদ্বিতীয়। তাদের এই অপরাজেয় শক্তি। সঞ্চালন করা হয়েছে তােমাদের সেই শত্রুর শরীরে, ফলে গন্ধ বিচারে তার ক্ষমতা হয়ে উঠেচে অমােঘ।

এখন ভবাণীর কাছে প্রার্থনা জানাই যাতে এই রক্তগন্ধা দানবকে শীঘ্রই চিনে উঠতে পারি আমরা। আমার মন কেন যেন বলছে, এই ঘূর্ণিঝড়, বৃষ্টি, ভূমিকম্প কিন্তু তার আসল রূপ নয়। তার চেয়েও বহু গুণ ভয়াবহ কিছুকে ঢেকে রাখা হয় এইসকল উপসর্গের আড়ালে। সেই কারণেই তার আবির্ভাব ঘটে রাতের আঁধারে লুকিয়ে। পরিস্থিতি বড়াে একটা স্বস্তির ঠেকচে না রে কানাই। মনে হচ্চে ভীষণ কিছু একটা ভয়ের মুখে পড়তে চলেছি আমরা।”

***********

পরের দিন দীননাথ মাস্টারের গৃহে ফলাহারের নিমন্ত্রণ ছিল কালীপদ, রতনলাল এবং কানাইয়ের। তারা এইটা মােটামুটি বুঝেছে যে দিবালােকে তেমন কোনও ভয় নাই। চন্ডীতলার আরও কিছু মানুষ নিমন্ত্রিত ছিল সেইখানে। এই তল্লাটে উঁচু নীচু, বড়াে ছােটো দেখে চলে না কেউ। সবাই প্রায় সমান ভাবেই সমাজে বিচরণ করে। খাওয়া দাওয়াটা মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না কারুরই, কিন্তু একত্রে বসে এই বিষয়ে একটু কথাবার্তা চালানােও আবশ্যক, তাই প্রায় সকলেই এসে হাজির হয়েছিলাে। বিচার বিবেচনা করে এইটুকুমাত্র ঠিক হয়েছিলাে যে আগামী বেশ কিছুদিন গঙ্গাধর কামার এবং রতনলাল সর্দার গাঁ ছেড়ে বাইরে যাবে না, কারণ যে কারণেই হােক না কেন, এরা গাঁয়ের ভিতরে থাকলে প্রাণহানি হবার সম্ভাবনা কম। এতে স্থায়ীভাবে সুরাহা কিছু হয় না বটে, কিন্তু মন্দের ভালাে।

বাড়ি ফেরার পথে প্রায় দশ বারােজন মিলে মেঠো পথ ধরে চলচিলাে। সঙ্গে দীননাথ অবধি তাদের সঙ্গে কথা কইতে কইতে চলেচে। দূরে কাঠুরিয়ার দল গাছ কাটচে, কয়েকজন জেলে পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরছে, যদিও এসব এলাকায় মাছের চাহিদা তততা অধিক নয়। কালীপদরা কিছুটা দূর এগােতেই পিছন থেকে কাঠুরিয়াদের মহা হৈচৈ কানে এল। কয়েকজন কাঠুরে পাশ দিয়ে দৌড়ে পালাবার সময়ে চিৎকার করে বললাে, “ছত্তা টুটিগা”। কানাই অত্যন্ত বিচলিত হয়ে কালীকে কইলাে, “শীগগির কোথাও লুকিয়ে পড়তে হবে কর্তাবাবা, কাঠুরেদের আঘাতে মৌমাছির চাক ভেঙে পড়েছে।”

কানাইয়ের কথা ভালাে করে শেষ হবার পূর্বেই সেইদিকের আকাশে চারদিক কালাে করা মৌমাছিদের ক্রুদ্ধ গুঞ্জন কানে পৌছালাে। এই ভয়ঙ্কর বিপদকে এগিয়ে আসতে দেখে সঙ্গের লােকজন ঝপাৎ ঝপাৎ করে পুকুরে নেমে পড়লাে। তারা কালীপদদের চিৎকার করে বললাে, “শীগগির জলে নেমে পড়ুন ঠাকুর, জলে কিছুসময় ডুব দিলে মৌমাছিরা আর খুঁজে না পেয়ে আপনিই চলে যাবে। ওদের হাত থেকে বাঁচার এইটেই উপায়।”

কালীপদ ভ্রু কুঁচকে কি যেন মনে করার আপ্রাণ চেষ্টা করে আপন মনে বিড়বিড় করে কইলাে,

-“জল? জলের তলায় লুকাবাে? তাহলে খুঁজে পাবে না?”

কথা না বাড়িয়ে কানাই আর রতনলাল কালীকে নিয়ে জলে নেমে পড়লাে। কিছুক্ষণ ডুবে থাকার পর মৌমাছির হিংস্র দল একটিও মানুষের সন্ধান না পেয়ে যখন প্রায় চলেই গিয়েছে, আচমকা কালীপদ উদভ্রান্তের মতাে বলে উঠলাে, “সৰ্ব্বনাশ! তাই তাে! হা ঈশ্বর! এও কি সম্ভব?” বলেই পাড়ে উঠে বিভ্রান্তর ন্যায় ধপাস্ করে বসে পড়লাে। উপস্থিত জনতা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়লাে। রতন একটু ভয়ে ভয়ে কালীপদকে শুধালাে – ‘কেন! জলে কী হয়েচে ঠাকুরমশায়?”

কালী তার দিকে চেয়ে কইলাে, “তােমাদের সেই অপরাজেয়, অতিকায় দানবকে আমি এতক্ষণে চিনতে পেরেচি সর্দার। তােমরা যে কার পাল্লায় পড়েচো তা নিজেই বােঝােনি তােমরা। বিপদ যে এত ভয়াল তা আমি ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করতে পারিনি। এর মােকাবেলা স্বয়ং ভগবান করলেও হয়তাে করতে পারেন, কিন্তু আমি ক্ষুদ্র মানুষ মাত্র তা কেমন করে পিরবাে বাছা!”

রতন শুকনাে মুখে জিজ্ঞাসা করল, “কে ঠাকুর? কে আমাদের সেই শত্রুর? তার নাম কি?”

“মৈনাক…”

– “মৈনাক চাটুজ্যে? সেই হিমু পালােয়ানের…

– “না রতন, সে নয়। এ অন্য মৈনাক। গিরিরাজ হিমালয় আর মেনকার পুত্র মৈনাক পৰ্ব্বত। কেবলমাত্র হিন্দু পুরাণেই নয়, পৃথিবীর বহু জাতির বহু পুরাণে কথিত আছে সে সময়ের এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়ের কথা। সে কালে বেশ কিছু পাহাড় নাকি উড়তে পারতাে ইচ্ছে মতাে। যােজনের পর যােজন জুড়ে ছিলাে তাদের বিশালাকৃতির ডানা। তারা হঠাৎ হঠাৎ উড়ে একেক জায়গায় গিয়ে চেপে বসতাে, আর সেই প্রচণ্ড ভারে জনপদগুলি এক লহমায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতাে। প্রাচীন চীন প্রদেশের কিছু পুঁথিতেও এই পাহাড়দের হাতে আঁকা ছবি সমেত বর্ণনা দেওয়া রয়েছে। পুরাণােক্ত মতে আমাদের দেশেও এই ধ্বংসলীলা ঘটেছে বহুবার। গিরিরাজের পুত্র মৈনাক এবং তার কিছু ত্রুর সহচর মিলে হঠাৎ হঠাৎ গিয়ে নেমে পড়তাে একেক প্রদেশে, এবং সেই এলাকাকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে আবার উড়ান দিতাে অপর অঞ্চলে।

একদিন এই ভীষণ অত্যাচারের কথা গিয়ে পৌঁছালাে দেবরাজ ইন্দ্রের দরবারে। ক্রুদ্ধ বাসব তার লােকপালগণকে নিয়ে আপৎকালীন দরবারে বসলেন, এবং যম, কুবের, অগ্নি, পবন, ঈশানদেব প্রভৃতি সকলের মতে সহমত হয়ে রণবেশ ধারণ করে, পৰ্বতাকৃতি ঐরাবতের পৃষ্ঠে আরােহণ করে যুদ্ধযাত্রায় চললেন একলা মহাবীর দেবরাজ। হাতে দধীচির পঞ্জর গঠিত মহাবজ্র। অন্তরীক্ষ থেকে সেই শয়তান পাহাড়দের চোখে পড়া মাত্র বজের আঘাতে তাদের ডানা ছিন্ন করে দিতে শুরু করলেন ইন্দ্র। একটি একটি করে যখন সব পাহাড়ের ডানা নির্মূল হয়ে গিয়েছে, তখন দেবরাজ শক্রর ভয়ঙ্কর মারমুখী রূপ দেখে প্রাণের ভয়ে সমুদ্রের তলায় গিয়ে লুকালাে মৈনাক। শক্রর বজ্র তার সন্ধান পেলাে না বটে, কিন্তু প্রাণের ভয়ে অত্যাচারী মৈনাক আর কখনও জলের থেকে মাথা তুললাে না। মৌমাছির ভয়ে জলে নামতেই। সর্বপ্রথম এই কথাটাই আমার মনে এসেছিলাে।

আগে থেকেই একটা এ ধরনের সন্দেহ আমার মাথায় ছিলােই, কারণ একটা কথা তােমরা সবাই ভুলে গিয়েচো, কিন্তু আমি ভুলিনি। লাটুর মা নামের বুড়িটা কয়েচিলাে সে নাকি মৈনাক চাটুজ্যের পরীক্ষার ঘরে দেখেচিলাে কতকগুলি পাথরের খণ্ড দড়ি দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে, কিন্তু আমি ঘরে ঢুকে ছাত জোড়া নিরেট আয়নার দিকে তাকিয়ে বুঝলুম অনেকগুলি দড়ি তাে দূরস্ত, একগাছি দড়িও সেইখানে ঝুলাবার মতাে কোনও অবলম্বন নাই। কড়ি, বরগা, এমনকি একখানা কীলক অবধি নাই সেই ছাতে। তবে মৈনাক দড়িতে পাথর ঝােলালাে কোন উপায়ে? পাথরগুলাে আদৌ কিছুতে ঝুলছিলাে না রতন। বয়স্থ বৃদ্ধা দুর্বল চোখের জ্যোতিতে ঠাহর পায়নি, নচেৎ সে বুঝতে পাথরগুলাে বাতাসে ভাসছে। উড়চে।

কোনও হারিয়ে যাওয়া পন্থায় এই সৰ্বনেশে বিদ্যে পুনরুদ্ধার করেছিলাে ঐ শয়তান। মৈনাক নয়, তবে অন্য কোনও ছােটো পাহাড়কে উড়বার শক্তি দান করেছে সে। সেই পাহাড়ের অতর্কিত আক্রমণেই গ্রামকে গ্রাম পিষ্ট, দলিত হয়ে মাটির নীচে দশ হাত বসে যায়। বিপদ যে অন্য কোনও দিক নয়, বরং আকাশ থেকেই নামে সে বিষয়ে আমি ছিলাম নিশ্চিত। তবে প্রশ্ন ছিল বড়তলি আর রটন্তী পাহাড়ের কোলে অবস্থিত বলে সেগুলি রক্ষা পায় কী করে? পাহাড়ে বাধা পায় কে? আজ উত্তর পেয়েছি। পাহাড়ে বাধা পায় স্বয়ং পাহাড়। সেই কারণেই ঐ রাক্ষুসে পাহাড় কিছুতেই নেমে আসতে পারে এই দুই গাঁয়ে। অথচ মৈনাক চাটুজ্যের দেওয়া ক্ষমতায় সে তােমাদের রক্তের আঘ্রাণ পায়। অবস্থান বুঝতে পারে। এইবার বুঝতে পারচো বিপদ কতখানি বিভীষণ রূপে থাবা পেতে দাঁড়িয়ে রয়েছে? মৃত্যু তােমাদের মাথার ঠিক উপরেই ঘুরচে রতনলাল। এর থেকে উদ্ধার করা কি সামান্য মানুষের পক্ষে সম্ভব?”

রতন হাউহাউ করে কেঁদে উঠলাে।

কানাই সদ্দার অবিচলিত স্বরে বললে, “আমি জানি কর্ত্তাবাবা, আপনি যখন ভিটেয় রয়েচেন তখন উপায় কিছু একটা হবেই। হেরে যাওয়া আপনার শােভা দেয় না। মন্তরে না তােক বুদ্ধিতে আপনি ঠিক একটা সুরাহা বের করবেন, এ আমি বেশ জানি।”

কালীপদ একটু বিষন্ন হেসে কইলাে, “আমার উপরে এত ভরসা তাের কানাই? সত্যিই ধর যদি এ যাত্রা কিছু উপায় না পাই? তবে?”

কানাই স্থিরভাবে উত্তর করল, “ভরসা নয় কৰ্ত্তাবাবা, ভরসার চেয়েও যা বড়াে, সেই আস্থা রয়েছে আপনার প্রতি। আপনিই তাে গল্প বলেছিলেন, আপনার গুরুদেব নাকি আশ্রম থেকে আপনার চলে আসার সময়ে বলেছিলেন আপনি জীবনে কোনওদিনই হারবেন না। নিজের কর্তব্য থেকেও কখনাে বিচ্যুত হবেন না। তবে সেই গুরুবাক্যে ভরসা রাখুন কৰ্ত্তা।”

কালীপদ মুখ নীচু করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আস্তে আস্তে বললাে, “গুরুই তাে ভরসা রে কানাই। সেই কথাই তাে রেখে চলেছি নিরন্তর। নিজের কর্তব্যের অবস্থানে যতই বিপদ থাকুক, আমি জগদ্দল পাথরের মতাে অনড় হয়েই থাকি। তার থেকে একচুল নড়ানাের সাধ্য…” কালীপদর কথা অসমাপ্ত রয়ে গেল। এক ঝটকায় মুখ তােলা মাত্র কানাই নিজের প্রভুর চোখে সেইবহু প্রতিক্ষিত বিদ্যুতের ঝলক দেখতে পেয়ে উচ্ছাসের সাথে বলে উঠলাে,

“উপায় হয়েছে, তাই না কর্তা? আমি জানতুম।”

***********

ভয়ঙ্কর মারণ-ব্যাধির সামান্য উপশমের পথ দেখলে মুমূর্ষ রােগী যেমন চনমনে হয়ে ওঠে, তেমনি প্রাণঘাতী বিপর্যয়ের দোরগােড়ায় পৌঁছে উপস্থিত প্রতিটি মানুষের মধ্যেই অসম্ভব উত্তেজনার সঞ্চরণ হয়ে পড়েলাে। রতনলাল আবেগপূর্ণ স্বরে কালীপদর হাত ধরে বলে উঠলাে “ধন্য আপনার বিদ্যে বুদ্ধি, ধন্য আপনার চতুরতা। আপনি কেবলমাত্র বলুন এই যুদ্ধে আপনার কি চাই। দেহপাত করেও আমরা সমস্ত কিছু উপকরণ জোগাড় করে দেবাে।” কালীপদ খর চক্ষে রতনের পানে চেয়ে কইলাে, “রক্ত চাই, রক্ত। তােমার তাজা রক্ত চাই আমার। পারবে দিতে?”

সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসার ঠিক আগের মুহূর্তে রতনলাল এবং গঙ্গা কামার বাদ দিয়ে প্রায় দেড়শ দুইশাে গাঁয়ের লােক কালীপদর নির্দেশে জড়াে হলাে ভগবান একশিলার মন্দিরের এক্কেবারে গা ঘেঁষে। রতন আর গঙ্গা নিজের নিজের গৃহেই রয়ে গিয়েছে। যে বিশাল রঞ্জু দিয়ে কালীপদ সেইদিন আক্রান্ত স্থানগুলির বেড় মাপতে গিয়েছিলাে, সেই রঞ্জু দিয়েই মন্দির থেকে অনেকটা দূরে নানান মাপজোক করে একটা স্থান বেছে নেওয়া হলাে। দড়ির একেবারে মধ্যস্থলে যেইখানে গিট দিয়ে রাখা হয়েছিলাে, সেই কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হলাে একটি ক্ষুদ্র মাটির সরা। তাতে কালচে হয়ে শুকিয়ে রয়েছে রতনলাল এবং গঙ্গা কামারের কিছুটা রক্ত।

একটু পরেই হাতে টানা ঠেলাগাড়িতে করে একদল গ্রামবাসী একখানা প্রকাণ্ড ভারী এবং প্রায় একশত হাত দীর্ঘ লােহার শিকল নিয়ে উপস্থিত হলাে। তার মাথায় একখানা ততােধিক ওজনদার গজাল গাঁথা রয়েছে। এই শিকলখানা এক রাত্তিরের মধ্যে সকলে মিলে গঙ্গা কামারের কামারশালে বসে তৈরি করেছে। সেই শিকলের সঙ্গে বাঁধা হয়েছে সারা রাত্তির ধরে প্রতিটি গৃহের থেকে জোগাড় করা মােটা দড়ি দড়া। তার সঙ্গে বাঁধা হলাে মাপ নেওয়ার সেই দীর্ঘ রঙ্কুটি, যেটি কানাই সর্দার কালীপদর জন্য কোথাও থেকে জোগাড় করে দিয়েছিলাে। এই তল্লাটে জালের দড়ি অথবা নৌকার রশির দেখা মেলা দুষ্কর, তাই এই ব্যবস্থা। ভগবান একশিলাকে করজোড়ে প্রণাম করে কালীপদ অস্ফুট সুরে বললাে, “এই দুর্দিনে আমাদের অপরাধ নিও না প্রভু। আমাদের ধৃষ্টতা মার্জনা করাে ভগবান।” এই বলে গলা চড়িয়ে হাঁক দিলাে, “এইবার তােরা এগিয়ে আয়। এই শিবলিঙ্গকে আষ্টেপৃষ্ঠে দড়িখানা দিয়ে জড়িয়ে ফেল, কিন্তু পর্দার, ভগবানের বিগ্রহ যেন এক চুলও না নড়ে।”

অতি সাবধানে কয়েকজন নারী পুরুষ মিলে একটু একটু করে সেই আদি অনন্ত শিবলিঙ্গের চতুর্দিকে দড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে ফেললাে, আর অপর দিকের শিকলের প্রান্তটি গুটিয়ে রাখা রইলাে মন্দিরের দ্বারে। কালীপদ আবার নির্দেশ দিলাে, “শােননা তােমরা, সেই দানবের আবির্ভাবের হয়তাে আর অধিক বিলম্ব নাই, কিন্তু যেই মাত্তর ঐ কালা পাহাড় ভূমিতে এসে স্থির হবে, তৎক্ষণাৎ তােমরা কয়েকজন হাতুড়ি আর শিকলের প্রান্তটি নিয়ে পাহাড়ের একটু উপরে চড়ে, যে কোনও একটি পাথরের খাঁজে শক্ত করে শিকলের মাথায় লাগানাে গজালটা পুঁতে ফেলবে, আর সঙ্গে সঙ্গেই নেমে আসবে। মনে রেখাে, এই কাজের জন্য খুব কম সময়ই তােমরা পাবে।”

পরাণ চাটুজ্যে একটু ইতস্ততঃ করে শুধােলাে,

-“তুমি যেমনি কয়েচো, এরা তেমনিই করবে ঠাকুর, নড়চড় হবে না, কিন্তু এইটেও তাে জানা প্রয়ােজন যে মােটামুটি কতােটা সময় পাওয়া যাবে এই কাজে? আমাদের হাতে ভাসাভাসা অনুমান ব্যতীত এই সময়সীমার বাঁধাধরা কোনও প্রমাণ তাে নাই।”

-“রয়েচে চাটুজ্যে মশায়, আমার কাছে রয়েছে”, দৃঢ় কণ্ঠের প্রত্যুত্তরে সকলকে হতবাক করে দিয়ে কালীগুণীন নিজের ধুতির খুঁট থেকে বের করল দীননাথ মাস্টারের তৈরি করে দেওয়া একখানা খড়ের আঁটি।

**********

লােকজন ফিসফিস করে আসন্ন বিভীষিকার সম্ভব অসম্ভব রূপ নিয়ে কল্পনাচরণ করছিলাে। যাদের উপরে গজাল পোঁতার কর্তব্য ন্যস্ত হয়েছে তারা নিজেদের মধ্যে নানান পরিকল্পনা করে চলেচে, এমন সময়ে আকাশ গুড়গুড় শব্দে আন্দোলিত হয়ে উঠলাে। লােকজন হুড়মুড় করে বাইরে উঁকি মেরে দেখতে পেলাে সাঁঝের অন্ধকারকেও ছাপিয়ে আকাশে আরও ঘন মসীকৃষ্ণ মেঘের রাশি জমা হয়েছে। চারদিকের বাতাস কিসের আগমন টের পেয়ে ঘূর্ণিঝড়ের আকার নিতে শুরু করেছে। একটু বাদেই তীক্ষ্ণ শরের ফলার মতাে বৃষ্টি এসে দশ দিক অন্ধ করে দিলাে, হাওয়ার বেগ মাত্রা অতিক্রম করে সব উড়িয়ে ছিন্নভিন্ন করে তােলার আয়ােজন করে তুলেচে। কালীগুণীন চিৎকার করে উঠলাে, “আর এক মুহূর্ত দেরি নয়, এক্ষুনি সকলে মাটিতে শুয়ে পড়াে।”

কথা শেষ হওয়া মাত্র সবকয়টি নারীপুরুষ ভূমিতে আশ্রয় নিলাে, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভয়ঙ্কর বেগে পৃথিবী লাফিয়ে উঠে সঙ্কেত পাঠালাে,

– “সে উপস্থিত”।

একদল লােক বিস্ময় ঝেড়ে ফেলে এক দৌড়ে শিকল নিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে, অপর দলটি কাঁপা কাঁপা পদক্ষেপে বাইরে এসে দেখলাে কালীগুণীনের মাপ অনুমানে একতিলও ভুল হয়নি। মন্দির থেকে আন্দাজ একশাে হাত দূরে খাড়াই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক ধূসর পাহাড়। পাথরের তৈরি জড় বস্তু হলেও তার দিকে একটিবার চাইলেই মনে হয় সে নিতান্ত নির্জীব, ক্লীব পদার্থ নয়। তার ভিতরে টগবগ করচে প্রাণশক্তির প্রকাশ। তার বেড় আন্দাজি আড়ে-বহরে হাজার হাতেরও বেশি। সেই প্রকাণ্ড যমদূতকে ঘিরে পাক খেয়ে চলেচে ঘূর্ণি আর বৃষ্টি, আর সেই দুর্যোগকে তৃণজ্ঞান করে তার পাদদেশের একটু উপরে দাঁড়িয়ে হাতুড়ির প্রচণ্ড আঘাতে আঘাতে গজাল পুঁতে চলেচে একদল নির্ভীক মানুষ। কালীপদ স্থির দাঁড়িয়ে রয়েছে মন্দিরের দ্বারের কাছে। আর তার হাতের থেকে ধূয়া ছড়াচ্চে এক আঁটি খড়।

নীচের থেকে হৈহৈ করে সবাই উৎসাহ দেওয়া আরম্ভ করল উপরের লােকগুলির উদ্দেশে। হাতুড়ির আঘাত, ঝড়ের তান্ডব, বৃষ্টির গর্জন আর মানুষের চিৎকার মিলিত হয়ে এক ভৌতিক পরিবেশের সৃজন করেছে আজ। কালীপদর হাতের খড় যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তার মধ্যেই পড়িমরি ছুটে মন্দিরে ঢুকে পড়লাে সবাই। সাহসী গাঁয়ের মানুষগুলাের বীরগাথা কখনওই কোনও দেশের ইতিহাসে ছাপা হয়নি, কিন্তু সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের শরীরে উঠে তারা জয়ের চিহ্ন প্রােথিত করে এসেচে সফলভাবে।

ক্ষণিকের মধ্যে পাহাড় দুলে উঠলাে। সবাই মাটি ঘেঁষে শুয়ে পড়া মাত্র দানব পাহাড়ের দুইপাশ থেকে বেরিয়ে এল দুইখানি গুটিয়ে রাখা বিপুল মেঘের মতাে ডানা, আর একবার তা ঝাপটানাে মাত্রই পৃথিবীর থেকে অনেকখানি উপরে উঠে পড়লাে সেই চলমান বিভীষিকা। ঝনঝন করে একটা শব্দ উত্থিত হওয়ার সাথে সাথে টান পড়লাে শিকল বাঁধা দড়ির প্রান্তভাগে। ভগবান একশিলার চিরস্থায়ী বিগ্রহ নড়ে উঠলাে সেই আকর্ষণে এবং এক মুহূর্তেরও বুঝি কম সময়ে আবহমান কাল ধরে লােকমুখে চলে আসা প্রবাদকে সত্য প্রমাণিত করে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কাঁপিয়ে একখানা বজ্রের চোখ ঝলসানাে রেখা ঝাঁপিয়ে পড়লাে উড়ন্ত পাহাড়ের শিখরদেশে। পাহাড় মাটির বুকে আছড়ে পড়লাে। কালীপদ চোখের জল মুছে সেইদিকে তাকিয়ে দেখলাে পাহাড়ের সেই প্রাণশক্তির লক্ষণগুলি কোথায় যেন অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছে। পুরাকালের সব প্রবাদ অলীক হয় না। একশিলা মহাদেব নিজের স্থান থেকে একচুলও নড়েননি। তাঁর বর্ষিত অনলচক্রের শিখা এই পামর, দুর্দান্ত পাহাড়ের জীবন হরণ করেচে চিরকালের মতাে।

***********

পরদিবসে একটু তাড়াতাড়িই দ্বিপ্রহরের আহার সম্পন্ন করে কানাই এবং কালীপদ রতনলালের গৃহের বাইরে এসে দাঁড়ালাে। সামনে একখানা বলদে টানা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। চালক বলরাম সসম্ভ্রম নজরে কালীপদর দিকে চেয়ে রয়েছে। এই গাড়িটা তাদের দুপুরের রেলগাড়িতে চাপিয়ে ফিরে আসবে। গাড়ির পিছনে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য গাঁয়ের লােক। মােক্ষদা গলায় বসন দিয়ে কালীপদকে প্রণাম করতে এসে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাে। অন্যান্য সময়ে কালীগুণীন কখনও কারুকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে দেয় না, কিন্তু এই অবস্থায় বাধা দিতে তার মন চাইলাে না।

চালতা ফুলের মিষ্টি গন্ধটা তখনও নাকে আসছে। গাড়িতে ওঠার ঠিক আগে আকাশ ভেঙে বর্ষার বৃষ্টি নামলাে। রতনলাল উদ্বিগ্ন হয়ে কইলাে,

-“এ যে খুব জোরেই জল এল ঠাকুর। একটু সময় অপেক্ষা করে গেলে হয় না?”

কালীগুণীন বৃষ্টির ধারাপাতের দিকে তাকিয়ে পরিতৃপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলাে,

-“ভয় কী? বৃষ্টিই তাে নামচে, পাহাড় তাে আর নয়।”

উপস্থিত প্রতিটি মানুষ এতদিন পর আজ প্রাণ খুলে হেসে উঠলাে।

-: সমাপ্ত :-

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *