রইল বাকি সাত
এখন
দিল্লি থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে, লোকসভার নির্বাচনী এলাকা কালিকাপুরোমে ভোট প্রচারে বেরিয়েছেন নম্রতা গোয়েল। বয়স সাতান্ন, পরনে শাড়ি আর মশাল পার্টির নির্বাচনী চিহ্নওয়ালা উত্তরীয়, পায়ে স্নিকার। দীর্ঘ রাস্তা হাঁটার জন্যে স্নিকার খুব কাজের।
প্রতিদিন ভোরবেলা মশাল পার্টির নেতা এসে সারাদিনের কাজের ফিরিস্তি ধরিয়ে যান। আজ রয়েছে কুড়ি কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে পদযাত্রা, ওই এলাকার এক হাজার ভোটারের বাড়ি গিয়ে ভোট ভিক্ষা, যাত্রাপথে কুড়িটি ছোট জনসভা, হাঁটতে হাঁটতে সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দেওয়া। এবং এই সবের মধ্যে রঘু এবং মনুয়া প্রজাপতির ঝুপড়িতে বসে মধ্যাহ্নভোজ।
ফিরিস্তির কাগজটা এক পলক দেখে ফেলে দিলেন চারবার একই নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে লোকসভা নির্বাচনে জয়ী নম্রতা। এসব মনে রাখার দায়িত্ব তাঁর নয়। মশাল পার্টিই পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করবে। পেশাদারি দক্ষতায় পদযাত্রা ও জনসভা চলবে।
সকাল আটটায় শুরু হয়ে প্রচার চলল দুপুর একটা পর্যন্ত। এবার ক্লান্ত লাগছে নম্রতার। তিনি একটু বিশ্রাম চাইছেন। এসি গাড়িতে বসে ঝিমিয়ে নিতে চাইছেন।
কিন্তু সেটা হওয়ার নয়। এখন তাঁকে দুপুরের খাবার খেতে হবে রঘু আর মনুয়া প্রজাপতির সঙ্গে, ওদের ঝুপড়িতে।
এগুলো পার্টির নিজস্ব প্রোগ্রাম। দিল্লি পুলিশ এই দুই গ্রামবাসীর অতীত সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করেছে গত কয়েক মাস ধরে। এবং আজকের অনুষ্ঠানের আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে ঝুপড়ির দখল নিয়েছে। রঘু আর মনুয়াকে রান্না করতে হয়েছে পুলিশের নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে।
রঘু-মনুয়ার ঝুপড়িতে বসে ভয়ের চোটে ঘামছেন নম্রতা। তাঁর মাথায় ঘুরছে পনেরো দিন আগে সাংবাদিক রেশমির বলা কথাগুলো। ‘অ্যাজ পার মাই সোর্স, মশাল পার্টি তোমাকে খুন করার চেষ্টা করছে। হ্যাঁ, তোমার পার্টি তোমাকে খুন করতে চাইছে। এবং সেটা ভোটের ক্যাম্পেনের সময়।’
যে পার্টির জন্যে নম্রতা নিজের জীবনের প্রায় সবটা ব্যয় করেছেন, সেই পার্টি আজ তাঁর মৃত্যু চাইছে। নম্রতা কাঁধ ঝাঁকালেন। এই রকম কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি তিনি অতীতে হয়েছেন। সামলেও নিয়েছেন। এটাও সামলে নেবেন।
রেশমির কাছ থেকে খবরটা নম্রতা পেয়েছেন পনেরো দিন আগে। তিনি নিশ্চিত, আজ দুপুরের খাবারে বিষ মেশানো থাকবে। পার্টির নিজস্ব প্রোগ্রাম। বাইরের লোক দেখে ফেলার কোনও সম্ভাবনা নেই। রঘু আর মনুয়াকে ঢাল করে নম্রতাকে খুন করা হবে। পরে ওদের ঘাড়ে খুনের দায় চাপানো হবে। নিখুঁত প্ল্যান।
নম্রতা দেখলেন, এক গলা ঘোমটা দিয়ে মনুয়া খাবারের থালা নিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। তাঁর সামনে টিভি চ্যানেল আর খবরের কাগজের গাদাগাদা চিত্র সাংবাদিক। থালা নেওয়ার জন্যে মনুয়ার দিকে হাত বাড়ালেন নম্রতা।
ছ’মাস আগে
সাউথ ব্লকে নিজের অফিসে বসে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রঞ্জিত গগৈ বললেন, ‘প্র্যাট, তিন নম্বর মিশনের জন্যে কাইমেরা রেডি তো?’
প্র্যাট ওরফে প্রথমা বলল, ‘হ্যাঁ স্যর।’
রঞ্জিত বললেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বীরেন্দ্র মেহতার নির্দেশ হল, কাজটা সাবধানে করতে হবে। খুব সেনসিটিভ সাবজেক্ট।’
কাইমেরা নামের গোপন এলিট ইনটেলিজেন্স উইং-এর এখনকার লক্ষ্য হল পৃথিবী জুড়ে যে সমস্ত সংস্থা, রাষ্ট্র বা ব্যক্তি ভারতের সার্বভৌমত্বের পক্ষে বিপজ্জনক, তাকে বা তাদের সরিয়ে দেওয়া।
কাইমেরার এজেন্ট মাত্র দুজন। আয়েশা আর প্রথমা। ওরা থাকে দিল্লির নিজামুদ্দিন স্টেশানের কাছে একটি বাড়িতে। বাড়িটি যে সরকারি, সেটা বোঝার উপায় নেই। বাড়ির চব্বিশ ঘণ্টার নজরদারিতে আছে দিল্লি পুলিশের আটজন জাঠ কনস্টেবল। ওরা জানে, মেয়েদুটি ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকাল উইং’-এ চাকরি করে।
‘এবারে কে?’ জিজ্ঞাসা করল প্রথমা।
‘কিষাণ বায়োটেকের মালকিন, সোনালি চালের আবিষ্কর্তা, নম্রতা গোয়েল।’ বললেন রঞ্জিত।
‘ “হারাধনের দশটি ছেলে” কবিতার তিন নম্বর পংক্তি মনে পড়ে গেল স্যর,’ বলল প্রথমা,
‘হারাধনের আটটি ছেলে
বসলো খেতে ভাত,
একটির পেট ফেটে গেল
রইল বাকি সাত।’
‘খারাপ বলিসনি। ভাতের জন্যেই এত সমস্যা। না হলে নম্রতার মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কৃষিবিজ্ঞানীকে মরতে হয়?’
গলা নামিয়ে প্রথমা বলল, ‘উনি তো আপনাদের পার্টির…মানে মশাল পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।’
ঠান্ডা গলায় রঞ্জিত বললেন, ‘হ্যাঁ। সেই জন্যেই এটা খুব সেনসিটিভ বিষয়। সাধারণ মানুষ বা অন্য পার্টি না জানলেও আমরা জানি যে ছ’মাস পরে লোকসভার ভোট। তার আগেই কাজটা সেরে ফেলতে হবে। যাবতীয় তথ্য আমি তোদের মেল আইডিতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। দুজনে মিলে আগে স্টাডি কর। তাড়াহুড়ো না করে সময় নে। আমাকে প্ল্যান অফ অ্যাকশান জানা। আমি অ্যাপ্রুভ করলে তবেই এগোবি।’
‘ইয়েস স্যর!’ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে স্যালুট করল প্রথমা।
ছ’মাস আগে
দিল্লির পাহাড়গঞ্জ এলাকায় ‘মহাবীর ট্রাভেলিং এজেন্সি’ হল কাইমেরার ফ্রন্ট অফিস। দিল্লি পুলিশের যে আট কনস্টেবল নিজামুদ্দিনের বাড়ি সামলায়, তারাই ট্রাভেলিং এজেন্সি সামলায়। ওরা জানে, এটা ‘র’-এর গোপন অফিস। কাইমেরার অফিসে লাইব্রেরি, কিচেন, অস্ত্রাগার, বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা—সব কিছু আছে।
সকালবেলা অফিসে বসে কাজ করছে আয়েশা আর প্রথমা। রঞ্জিতের পাঠানো মেলের সঙ্গে গাদাগাদা অ্যাটাচমেন্ট রয়েছে। খবরের কাগজের কাটিং, টিভি নিউজের ভিডিও ক্লিপ, পডকাস্ট, ব্লগ—কী নেই? সঙ্গে রয়েছে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের ক্লাসিফায়েড ফাইল, মিটিং-এর মিনিট, গাদাগাদা এফ আই আর এবং পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট। সব তথ্য এক জায়গায় করছিল আয়েশা। কাজ শেষ করে বলল, ‘খুব ঝামেলার ব্যাপার। তুই পড়ে দেখ।’ তারপরে একগাদা প্রিন্ট আউট এগিয়ে দিল।
প্রথমা বসে বসে ভিডিও আর অডিও ক্লিপগুলো মগজস্থ করেছে। এবার কাগজের তাড়া নিয়ে বসল।
নম্রতা গোয়েলের জন্ম কলকাতার আলিপুরে। পড়াশুনো শ্রীশিক্ষায়তন স্কুল এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন বায়ো-টেকনোলজি নিয়ে পড়াশুনো করতে। সেখানেই আলাপ হয় কলকাতার মেধাবী ছাত্র বরুণ বসুর সঙ্গে। তিনি একই বিষয় নিয়ে পড়াশুনো করতে কলকাতা থেকে দিল্লি এসেছিলেন।
বায়ো-টেকনোলজি নিয়ে পড়াশুনো করার সময় থেকেই ‘জেনেটিকালি মডিফায়েড ফুড’ নিয়ে নম্রতার আগ্রহ জন্মায়। এই নিয়ে তাঁর থিসিসও ছিল। জিনের গোড়ার কথাগুলো পড়ছে প্রথমা।
জিন বা বংশানুর মধ্যে জীবদেহের সমস্ত গঠন, ক্রিয়া ও ক্রমবিকাশের নির্দেশ লেখা থাকে। গাছের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি, ফলন, কম বৃষ্টিতে বেঁচে থাকার ক্ষমতা, ক্ষতিকর জীবাণুদের থেকে নিজেদের রক্ষা করা—এসবও জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কোনও একটা গাছের জিনগত পরিবর্তন করা হয় তার মধ্যে অন্য গাছের জিন ঢুকিয়ে, যাকে বলা হয় জিন ট্রান্সফার। জিনগত পরিবর্তনের ফলে যে খাদ্য তৈরি হয়, তাকে বলে ‘জেনেটিকালি মডিফায়েড ফুড।’
পড়াশুনোর পাট চুকিয়ে দিল্লি থেকে নম্রতা আর বরুণের ফেরা হয়নি। তার আলাদা আলাদা কারণ আছে।
নম্রতা কলকাতা ফেরেননি কারণ সেই সময়ে কেন্দ্রে রয়েছে মশাল পার্টির সরকার। পার্টির নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বকে ব্যবহার করে নম্রতা নয়ডায় গড়ে তুলেছেন বিশাল বায়ো-টেকনোলজি ফার্ম, যার নাম ‘কিষাণ বায়োটেক।’ উনিশশো ছিয়ানব্বই সালে, একত্রিশ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন বরুণকে। বিয়ের এক বছরের মাথায়, সাতানব্বই সালে তাঁদের ছেলে হয়। নাম রাখা হয় বিষাণ।
কিষাণ বায়োটেকের রিসার্চ ল্যাবে তৈরি হয়েছিল জেনেটিকালি মডিফায়েড ‘সোনালি চাল’ বা ‘গোল্ডেন রাইস’। আবিষ্কর্তা বরুণ। তিনি ভুট্টার একটি জিন চালের জিনে ট্রান্সফার করেন। ওই নির্দিষ্ট জিনটি ‘বিটা ক্যারোটিন’ উৎপাদনে মূল ভূমিকা রাখে।
এতদূর পড়ে প্রথমা বলল, ‘জ্ঞানের কথা পড়ে আমার মাথা ঘুরছে। যাই, একবার বসের সঙ্গে কথা বলে আসি। তা হলে মাথাটা খুলবে।’
কম্পিউটারে ব্যস্ত আয়েশা মাথা না তুলে বলল, ‘কথা বলে ফেরার সময় কনট প্লেস থেকে মশলা মুড়ি নিয়ে আসিস তো!’
ছ’মাস আগে
রঞ্জিত বললেন, ‘এক রাতের মধ্যে রিসার্চ কমপ্লিট?’
‘মোটেই না!’ আপত্তি করল প্রথমা, ‘আমি সোনালি চালের ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। খুব শক্ত! সহজ করে বুঝিয়ে দিন।’
‘দেখ, মোদ্দা কথা হল, “বিটা ক্যারোটিন” থেকে “ভিটামিন এ” তৈরি হয়। তুই কি জানিস যে প্রতি বছর ভিটামিন এ-র অভাবে গোটা বিশ্বে প্রায় সাত লাখ শিশু মারা যায় এবং পাঁচ লাখ শিশু অন্ধ হয়ে যায়?’
‘জানতাম না।’
‘এটা তো জানিস যে ভারতে মানুষের প্রধান খাদ্য হল ভাত?’
‘জানি।’
‘সেই ভাতে যদি ভিটামিন এ থাকে তা হলে কত উপকার বল তো! শিশুমৃত্যু এবং অন্ধত্ব দ্রুত কমে যাবে, তাই না? এই চিন্তা থেকেই বরুণ তৈরি করেন সোনালি চাল।’
‘চালের নাম সোনালি কেন?’
‘ভাতের স্বাভাবিক রং সাদা হলেও বিটা ক্যারোটিন যুক্ত চালের রং সোনালি। তাই এই নাম।’
‘এবার মূল বিষয়ে আসুন। অত আইনি কাগজ পড়ার জন্যে একটু ভূমিকা প্রয়োজন।’
‘কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ মন্ত্রকের অনুমোদন পাওয়ার পরে দু-হাজার সাল থেকে খোলা বাজারে সোনালি চাল বিক্রি শুরু হয়। কিষান বায়োটেকের শেয়ারের দাম আকাশ ছোঁয়া। দু-হাজার দুই সালে মশাল পার্টির হয়ে কালিকাপুরোম থেকে ভোটে জিতে নম্রতা পার্লামেন্টে যোগদান করেন। ওঁর কেরিয়ারগ্রাফ যখন রকেটের মতো ওপরে উঠছে তখন ত্রিপুরায় দুটি, অসমে পাঁচটি এবং বাংলায় তেরোটি শিশু ক্ষুদ্রান্ত্র পচে মারা যায়। শিশুমৃত্যুর এই ঘটনা মিডিয়ায় সাড়া জাগালেও সেটা সীমাবদ্ধ ছিল পূর্ব ভারতে।’
‘অন্ত্র পচে যাওয়া কি সোনালি চালের সাইড এফেক্ট? যদি তাই হয়, তা হলে কৃষি মন্ত্রণালয় একে বাজারজাত করার অনুমতি দিল কেন?’
‘যা বলছি চুপ করে শোন। বাংলার গবেষকরা বলতে শুরু করেন, সোনালি চালের ভাত খাওয়ার সঙ্গে ক্ষুদ্রান্ত্র পচে যাওয়ার সম্পর্ক আছে। কিন্তু সেই কথা কেউ শোনেনি। ছ’বছর কেটে গেল। দু-হাজার আট সালে শিশুমৃত্যু শুরু হয় উত্তর ভারতের একাধিক রাজ্যে। শতাধিক মৃত্যুর পরে কেন্দ্রীয় সরকার নড়েচড়ে বসে। তিন সদস্যের ‘ইনভেস্টিগেটিং কমিটি’ তৈরি হয়। একাধিক মিটিং-এর পরে সেই কমিটি সোনালি চালকে বাজার থেকে তুলে নেওয়ার সুপারিশ করে। মিটিং চুকিয়ে বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় তিন সদস্যই এক সঙ্গে মারা যান। কমিটির সুপারিশ ধামাচাপা পড়ে। চাল বিক্রি বন্ধ হয় না। শিশুমৃত্যু চলতে থাকে।’
‘নম্রতাই কি কমিটির সদস্যদের খুন করিয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ। নম্রতাই ওই তিনজনকে খুন করিয়েছিলেন। আর নিজের হাতে খুন করেছিলেন বরকে। কারণ বরুণ মিডিয়ার সামনে মুখ খুলতে চেয়েছিলেন। বলতে চেয়েছিলেন, জেনেটিকালি মডিফায়েড রাইসের দীর্ঘকালীন কুফল হল ক্ষুদ্রান্ত্রের পচন। নম্রতা ব্যবসার ক্ষতি চাননি। আমাদের পার্টিও নম্রতার মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বকে চটাতে চায়নি। তাই মিডিয়ার চাপে মাঝামাঝি রাস্তা নেওয়া হয়। দু-হাজার বারো সালে কেন্দ্রে আমাদের সরকার গঠিত হওয়ার পরে আর একটি তিন সদস্যের কমিটি তৈরি হয়। এই কমিটি কিষাণ বায়োটেকের কাছে দশটি বিষয়ের ব্যাখ্যা চায়। তথ্য-প্রমাণসহ আটটি বিষয়ের ব্যাখ্যা দেন নম্রতা। বাকি দুটি বিষয় নিয়ে মুখ না খুলে মশাল পার্টির ফান্ডে দশ কোটি টাকা দান করেন। পার্টি এবং তার সরকার চুপ করে যায়। পরের পাঁচ বছরে কমিটির তিন সদস্যর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। সব এফ আই আর এবং পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট তোদের মেল করা আছে।’
‘এবারে পড়ব। বুঝতে সুবিধে হবে।’
‘দু-হাজার সতেরো সালে আবার ভোট হল। আবার মশাল পার্টি ক্ষমতায় এল। আবারও নম্রতা কালিকাপুরোম থেকে জিতলেন। দু-হাজার উনিশ সালে আবার নতুন কমিটি তৈরি হল। কারণ ক্ষুদ্রান্ত পচে শিশুমৃত্যু এত বেড়ে গেছে যে সেটি আন্তর্জাতিক মিডিয়ার স্ক্যানারে চলে এসেছে। বিভিন্ন সেলেব্রিটি এবং ইনফ্লুয়েন্সার এই নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় ভারত সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় বিশ্বের কাছে আমাদের নাম ধুলোয় মিশে যাচ্ছে। আমরা চুপ করেছিলাম এই আশায় যে জনগণের স্মৃতি খুবই সংক্ষিপ্ত। সবাই সব ভুলে যাবে।’
‘গুড স্ট্র্যাটেজি।’
‘এটা দু-হাজার বাইশ। ভোটের বছর। আমাদের কপাল খারাপ যে দিল্লি ঘেরাও আন্দোলন শুরু হয়েছে। পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তর প্রদেশের কৃষকরা মাসের পর মাস রাস্তা অবরোধ করে বসে আছেন। তাঁদের একটাই দাবি। শিশুমৃত্যুর সঙ্গে সোনালি চালের সম্পর্ক নিয়ে তদন্ত হোক। কিষাণ বায়োটেকের ভূমিকা নিয়েও তদন্ত হোক।’
‘আপনারা কি ওঁকে পরের ভোটে দাঁড় করাবেন? ইলেকশান কমিশান এখনও নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেনি। কিন্তু আপনারা তো ভিতরের খবর জানেন।’
‘জানি। এবং আমাদের প্রার্থী তালিকাও তৈরি। নম্রতা ওঁর পুরোনো কেন্দ্র কালিকাপুরোম থেকেই ভোটে দাঁড়াবেন। পার্টিতে ওর বিশাল লবি। ওঁকে ভোটে না দাঁড়াতে দিলে তারা বিদ্রোহ করবে। প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পেরেছেন শিশুমৃত্যুকে গুরুত্ব না দেওয়াটা বিরাট বড় ভুল হয়েছে। পুরোনো পাপের বোঝা আর টানা যাবে না। নম্রতাকে ভোটে দাঁড় করানোর পরে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য উপায় নেই।’
পুরো ছবিটা পরিষ্কার হয়েছে প্রথমার কাছে। সে বলল, ‘নম্রতার ছেলে বিষাণ এখন কোথায়?’
‘ছেলেটা সদ্য পঁচিশ পেরিয়েছে। কলেজের পাট চুকিয়ে বাড়িতে বসেছিল। ছেলে যে মাথামোটা সেটা নম্রতা জানেন। তাই পার্টিতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। বিষাণ এখন সব সময় মায়ের সঙ্গে থাকে। মিছিলে যায়, আন্দোলন করে, মিডিয়ার সামনে বক্তব্য রাখে।’
চেয়ার থেকে উঠে প্রথমা বলল, ‘বেশ। এবারে রিসার্চ শুরু করি।’
‘সময় নে। ভাব। তাড়াহুড়ো করিস না। হাতে অনেক সময় আছে।’
চার মাস আগে
গ্রেটার কৈলাশের প্রাসাদোপম বাড়ির নিজের ঘরে বসে মোবাইলে চ্যাট করছিল বিষাণ। এমন সময়ে ঘরে ঢুকলেন নম্রতা। বিষাণ মায়ের দিকে ফিরেও দেখল না।
‘আমার সঙ্গে অভদ্রতা করাটা অভ্যাসে এনে ফেলেছিস, তাই না?’ শ্লেষের সঙ্গে বললেন নম্রতা।
বিষাণ উত্তর দিল না।
‘আমি তোর মা বিশু!’
‘আমাকে বিশু বলে ডাকবে না।’ মোবাইল থেকে চোখ না সরিয়ে বিষাণ বলল, ‘মায়ের নাম করে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলও করবে না। ওটা আমার ক্ষেত্রে কাজ করে না।’
‘কার সঙ্গে চ্যাট করছিস?’
‘একটা মেয়ের সঙ্গে। আপত্তি আছে?’
‘কী নাম ওর? বাড়িতে একদিন ডাক না!’ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন নম্রতা।
মায়ের হাতের স্পর্শে আড়ষ্ট হয়ে গেল বিষাণ। বলল, ‘সোশাল মিডিয়ায় মাস দেড়েক আগে আলাপ হয়েছে। দেখা হয়েছে বার চারেক। এখনও ভালো করে চিনি না। কী করে আলাপ করাই তোমার সঙ্গে?’
ছেলের সঙ্গে কথাবার্তা স্বাভাবিক হওয়ায় খুশি নম্রতা। তিনি বললেন, ‘নির্বাচনের দিন এখনও ঘোষণা করেনি নির্বাচন কমিশন। কিন্তু আজ আমাদের পার্টির প্রার্থী তালিকা প্রকাশ হয়েছে। আমি কালিকাপুরোম থেকে চতুর্থবারের জন্যে ভোটে দাঁড়াচ্ছি। তুই খুশি তো?’
‘তোমার যে-কোনও রকম ধান্দাবাজিতেই আমি খুশি। হাজার হোক তুমি আমার মা!’
ছেলের কথা শুনে এত রেগে গেলেন নম্রতা যে গালে এক থাপ্পড় কষালেন। পরমুহূর্তে নিজের ভুল বুঝে বললেন, ‘সরি! এক্সট্রিমলি সরি!’
বিষাণ কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে বসে রইল। তার চোখ দিয়ে আগুন ছুটছে। শ্বাস পড়ছে ঘনঘন। ভুরু কুঁচকে আছে। কিছুক্ষণ পরে শান্ত কন্ঠে বলল, ‘তুমি যে ভোটে দাঁড়িয়েছ এতে আমি খুশি। কী করতে হবে বলো।’
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় নম্রতা খুশি। তিনি বললেন, ‘ভোটের ক্যাম্পেন শুরু হবে নির্বাচনের দিন ঘোষণার পরেই। প্রচারের সময় তুই আমার সঙ্গে থাকবি। এই ভোট আমার কাছে খুব ক্রুশিয়াল।’
উত্তর না দিয়ে আবার চ্যাটে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বিষাণ।
তিন মাস আগে
‘কাইমেরার কাছ থেকে এখনও কোনও কংক্রিট প্ল্যান পেলাম না।’ নিজের অফিসে বসে বললেন রঞ্জিত।
‘একটা প্ল্যান মাথায় এসেছে স্যর।’ রঞ্জিতের সামনে বসে রয়েছে প্রথমা।
‘বলে ফেল।’
‘মশাল পার্টির নির্বাচনী প্রচারের পুরোনো ভিডিও দেখতে গিয়ে একটা প্যাটার্ন খেয়াল করলাম। ভোট প্রার্থীরা প্রচারে বেরিয়ে কোনও একজন ভোটদাতার বাড়িতে বসে ওঁদের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়ে থাকেন।’
‘হ্যাঁ। এটা করা হয়। জাতপাতের রাজনীতি এদিকে খুব বেশি। যে এলাকায় যে জনজাতি সংখ্যাগরিষ্ঠ তাদের কারও বাড়িতে বসে দুপুরের খাওয়া সারেন প্রার্থী। রবি ঠাকুরের ভাষায়, “আমি তোমাদেরই লোক।”’
‘কালিকাপুরোম জায়গাটা দ্রুত গ্রাম থেকে মফস্সলে বদলে যাচ্ছে। রোজ নতুন নতুন লোক এসে থাকতে শুরু করছে। আমাদের তৈরি করা কোনও পরিবারে নম্রতা দুপুরের খাবার খেতে পারেন না?’
‘বুঝলাম…’ মনে মনে প্ল্যানটার ভালো এবং খারাপ দিক ভেবে নিচ্ছেন রঞ্জিত, ‘একটা বর আর একটা বউ লাগবে। একটা বাচ্চা থাকলে ভালো হয়। তাদের যাবতীয় ডকুমেন্ট বানিয়ে ফেলতে হবে। কারণ দিল্লি পুলিশ এবং ন্যাশনাল সিকিয়োরিটি গার্ড সে সব ক্রস চেক করেই ওখানে খেতে যাওয়ার অনুমতি দেবে। তা ছাড়া স্থানীয় লোকেরাই বা নতুন বাসিন্দাকে হুট করে মেনে নেবে কেন?’
‘সে সব দেখার জন্যে আপনার গাদাগাদা এজেন্সি আছে।’ রঞ্জিতের আপত্তি ফুৎকারে উড়িয়ে দিল প্রথমা, ‘ভোটার কার্ড, আধার কার্ড আর একটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট লাগবে রঘু আর মনুয়া প্রজাপতির নামে। ওই চত্বরে একটা ঝুপড়ি আর একটা পুরি-সবজির দোকান বানিয়ে ফেলতে হবে। বাচ্চার দরকার নেই। রঘু প্রজাপতি হিসাবে আমাদের পুরোনো এজেন্ট ষষ্ঠীকে কয়েক মাসের জন্যে কাইমেরায় ফিরিয়ে আনতে হবে।’
‘রঘু আর মনুয়া প্রজাপতি…’ দ্রুত কাগজে লিখছেন রঞ্জিত, ‘বয়স সাতাশ আর পঁচিশ, বাবার নাম, ডেট অফ বার্থ, ঠিকানা… রঘু আর মনুয়ার পাসপোর্ট সাইজের ছবিতে ষষ্ঠী আর তোর মতো দেখতে কারও ফোটো লাগানো হবে তো?’
‘অত ডিটেলের প্রয়োজন নেই,’ প্রসঙ্গ পাল্টে প্রথমা বলল, ‘আপনার তরফে এই প্ল্যানে যখন গ্রিন সিগনাল পেয়ে গেছি, তখন বাকিটা বুঝে নিচ্ছি।’
দু’মাস আগে
কালিকাপুরোমে রঘু আর মনুয়া প্রজাপতি কবে থেকে থাকতে শুরু করেছে এটা গ্রামের আদি বাসিন্দারা খেয়াল করেনি। অতীতে গ্রাম থাকত গ্রামের মতো। শহর থেকে অনেক দূরে চুপচাপ পড়ে থাকত। বছরের পর বছর, দশকের পর দশক। কিন্তু ঝাঁ চকচকে হাইওয়ে দিল্লি আর গুরুগ্রামকে জুড়ে দিতেই রাস্তার পাশে পড়ে থাকা কালিকাপুরোমের মতো গ্রামগুলো দ্রুত বদলাতে শুরু করল। ভিন রাজ্য থেকে শ্রমিক এসে থাকতে শুরু করল।
রঘু আর মনুয়াও এদের সঙ্গেই এসেছে হয়তো। ওরা নিজেদের মতো থাকে। স্থানীয় শ্রমিকদের জন্যে পুরি-সবজির দোকান চালায়। ছুটির দিন দোকান বন্ধ থাকলে, রঘু চুপ করে ঝুপড়ির বাইরে বসে থাকে। মনুয়াকে দেখা যায় না। ওরা আছে না নেই, এই নিয়ে কালিকাপুরোমের কেউ কোনও দিনও মাথা ঘামায়নি।
মাথা ঘামাল, যখন ইলেকশান কমিশন নির্বাচনের দিন ঘোষণা করল। মাথা ঘামাল, যখন সব পার্টির প্রার্থী প্রচার শুরু করে দিলেন। মাথা ঘামাল, যখন কালিকাপুরোমে মশাল পার্টির প্রার্থী হয়ে দাঁড়ালেন নম্রতা গোয়েল। এবং খবরের কাগজ মারফত জানা গেল, নির্বাচনী প্রচারে এসে নম্রতা দুপুরের আহার করবেন রঘু-মনুয়ার ঝুপড়িতে।
কালিকাপুরোমের আদি বাসিন্দারা রেগে লাল! বর-বউ দুটো কোথা থেকে উড়ে এসে ভূমিপুত্রদের বিখ্যাত হওয়ার সুযোগ কেড়ে নিল। ওরা না থাকলে খবরের কাগজে ছবি বেরোত যে নম্রতার সঙ্গে কালিকাপুরোমের কোনও বাসিন্দা দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। টিভিতে তার বাইট নেওয়া হতো। সোশাল মিডিয়ায় সেইসব ছবি আর ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হতো। সব ভেস্তে গেল।
ওদেরকে কালিকাপুরোম থেকে বার করে দেওয়াই যায়। কিন্তু সে গুড়ে বালি। দিল্লি পুলিশের অফিসাররা দিনে দুবার ঝুপড়ি ঘুরে যাচ্ছে। ওদের ঝুপড়ির আশেপাশে যাওয়া যাচ্ছে না এমন নিরাপত্তার বহর। দেখেশুনে কমবয়সি ছেলেপুলেরা খচে গেল।
বয়স্করা ওদের বোঝালেন। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করতে নেই। চুপচাপ মেনে নেওয়া ছাড়া গতি নেই। ভোট-পর্ব চুকে বুকে গেলে ওদের কালিকাপুরোম থেকে তাড়িয়ে দিলেই হল। চাই কি মেরেও ফেলা যেতে পারে।
এই আলোচনা এক সন্ধেবেলা গাছতলায় বসে চলছিল। ঝুপড়ির বাইরে বসে রঘু আর মনুয়া সেটা শুনতেও পাচ্ছিল।
পনেরো দিন আগে
নির্বাচনী প্রচার পুরো দমে শুরু হয়ে গেছে। বাড়ি থেকে সকাল সাতটার মধ্যে বেরিয়ে পড়ছেন নম্রতা। সঙ্গে বিষাণ। নম্রতা জেড ক্যাটিগরির সুরক্ষা পান। তাঁকে সব সময় ঘিরে থাকে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে কম্যান্ডোরা। মানব বন্ধনের মধ্যে হেঁটে চলেন নম্রতা, রাস্তার দুদিকে তাকিয়ে নমষ্কার করেন, দোতলা বাড়ির বারান্দার দিকে মুখ উঁচু করে বলেন, ‘ক্যায়সি হো?’ বাচ্চা দেখলে কোলে নিয়ে চকলেট দেন, গরিব মানুষের দাওয়ায় বসে গপ্পোগাছা করেন। এত বছর ধরে ভোটে দাঁড়িয়ে এগুলো রুটিন হয়ে গেছে।
এই সবের মধ্যে কানের কাছে মুখ এনে বিষাণ বলল, ‘মা, তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল।’
‘বল,’ দ্রুত হাঁটছেন নম্রতা।
‘রেশমি তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চাইছে।’
‘এখন এসব আলোচনার সময় নয়।’
‘এখনই এসব আলোচনার সময়। রেশমি ‘হিন্ডিয়া’ নিউজ পোর্টালে চাকরি করে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক। ওর কাছে খবর আছে, তোমার ওপরে ভোটের আগেই অ্যাটাক হবে।’
ওপর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছেন নম্রতা, মুখে হাসি। বজ্র কঠিন গলায় বললেন, ‘আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলা। এক্ষুনি।’
বুলেট প্রুফ কাচ লাগানো গাড়িতে উঠে বসেছেন মা আর ছেলে। বিষাণ ফোন এগিয়ে দিয়েছে নম্রতার দিকে। ফোন কানে দিয়ে নম্রতা শুনলেন রিনরিনে গলার আওয়াজ, ‘হ্যালো আন্টি!’
‘খুশ রহো বেটা!’ ঠান্ডা গলায় বললেন বটে নম্রতা, আসলে তিনি এই মেয়েটিকে মাপছেন। কে এ? কী ভাবে এল বিষাণের জীবনে? বড়লোক বাড়ির ছেলে পাকড়াও করাই কি উদ্দেশ্য? নাকি অন্য কোনও প্ল্যান?
‘অ্যাজ পার মাই সোর্স, মশাল পার্টি তোমাকে খুন করার চেষ্টা করছে। হ্যাঁ, তোমার পার্টি তোমাকে সরিয়ে দিতে চাইছে। এবং সেটা ভোটের ক্যাম্পেনের সময়।’
‘তোমার সোর্স কে?’
‘সেটা কোনও জার্নালিস্টই বলে না আন্টি। এটা ওয়ার্ক এথিক্স।’
‘তুমি শুধুমাত্র জার্নালিস্ট নও, তুমি আমার ছেলের বউ হতে চলেছ।’ খবর সংগ্রহের জন্যে মুখে কিছুই আটকায় না নম্রতার।
রেশমি নিজের জায়গা থেকে সরল না। সোজাসাপটা বলল, ‘পেশা আর জীবন গুলিয়ে ফেললে চলবে না আন্টি। তবে আমি যে কথাটা বললাম, সেটা ভুলো না। ইয়োর লাইফ ইজ অ্যাট স্টেক।’
ফোন কেটে চুপ করে বসে আছেন নম্রতা। বিষাণ বলল, ‘মা, রেশমি ভালো মেয়ে। তোমার ভালো চেয়ে বলল। ওর কথা শোনো।’
‘দিনের মধ্যে পনেরো-ষোলো ঘণ্টা পাবলিকের সঙ্গে রাস্তায় কাটছে। কী করে নিজেকে বাঁচাব বলতে পারিস?’
‘যে তোমাকে মার্ডার করবে, তার মতো করে ভাবো। তুমি খুনি হলে এই পরিস্থিতিতে কী ভাবে খুন করতে?’
নম্রতা চোখ নামিয়ে নিলেন। জীবনে তিনি একটিই খুন করছেন। বরুণের খাবারে বিষ মিশিয়ে দিয়েছেন। বিভিন্ন সরকারি কমিটির সদস্যদের খুনের দায়িত্ব কনট্র্যাক্ট কিলারকে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলো ভেবে লাভ নেই। তাঁর মাথায় ঘুরতে লাগল নিজের অপরাধের কথা। খাবারে বিষ!
মাথা চিন্তামুক্ত করার জন্যে গাড়ি থেকে নামলেন নম্রতা, ‘আমাকে একটু ভাবতে দে। তোর আপাতত একটাই দায়িত্ব। সারাক্ষণ আমার পাশে থাকা। আর রেশমির সঙ্গে যোগাযোগ রাখা।’
‘আচ্ছা মা!’ গাড়ি থেকে নেমেছে বিষাণও।
এক দিন আগে
‘হ্যালো স্যর!’ ফিশফিশ করে বলল প্রথমা। ‘সব কিছু ঠিকঠাক চললে…’
‘কালকেই ঘটনাটা ঘটবে। তাই তো?’ বললেন রঞ্জিত।
‘হ্যাঁ স্যর।’
‘ষষ্ঠী কেমন অ্যাকটিং করছে?’
‘হি ইজ ব্রিলিয়ান্ট!’ মৃদু হাসল প্রথমা, ‘কিন্তু আগামিকাল ঘটনাটা ঘটার পরে ওকে ঝুপড়ি থেকে সরিয়ে সেফ হাউসে নিয়ে যেতে হবে অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল। হিজ লাইফ উইল বি ইন ডেঞ্জার। পুলিশের থেকে এবং কালিকাপুরোমের বাসিন্দাদের থেকে।’
‘তোর নিজেকে নিয়ে চিন্তা নেই?’
‘না স্যর!’ আবারও হাসল প্রথমা। ‘আমার কিছু হবে না।’
এখন
মনুয়ার হাত থেকে খাবারের থালা নিলেন বটে নম্রতা কিন্তু মুখে কিছু দিলেন না। টিভি চ্যানেল আর খবরের কাগজের সাংবাদিকরা যতক্ষণ ছবি তুলল, ততক্ষণ খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করলেন, কথা বললেন মনুয়া আর রঘুর সঙ্গে। কথা দিলেন, নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্যে সরকার যে আবাসন তৈরি করেছে, এই ঝুপড়ি থেকে ওদের সেখানে স্থানান্তর করা হবে। তবে সে সব ভোটের রেজাল্ট বেরোনোর পরে।
সাংবাদিকরা চলে যেতেই খাবারের থালা সরিয়ে রাখলেন নম্রতা। মনুয়া আর রঘু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওদের পাত্তা না দিয়ে নম্রতা বিষাণকে বললেন, ‘খেতে দে!’
বিষাণ টিফিন কৌটো এগিয়ে দিল। এর মধ্যে ভাত, ডাল, আলুভাজা আর মাছের ঝোল রাখা আছে। আজকের লাঞ্চে এটাই খাবেন নম্রতা। তারপরে আবার প্রচার শুরু করবেন।
দেড় ঘণ্টা পরে
‘আমার কাছে অনেক কিছু ক্লিয়ার নয় প্র্যাট,’ ফোনে ধমকাচ্ছেন রঞ্জিত। ‘তুই কি এই প্ল্যানটাই করেছিলি? উত্তর যদি ‘না’ হয়, তা হলে এইভাবে ঘটনাগুলো ঘটল কেন? উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তা হলে আমাকে আগে জানাসনি কেন? সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা। তুই এখন কোথায়?’
‘সামনাসামনি কথা হলে এত ধমক খেতে হতো না,’ অভিমানী সুরে বলে প্রথমা, ‘কিন্তু এখন আপনার কাছে যাওয়া সম্ভব নয়। ষষ্ঠী আর আয়েশাকে কালিকাপুরোমের ঝুপড়ি থেকে সরিয়ে আমি সেফ হাউসে নিয়ে যাচ্ছি।’
‘মনুয়া যে তুই না, ওটা যে আয়েশা, এটা আগে বলিসনি কেন?’
‘বলিনি, কারণ বলতে চাইনি। এই অপারেশানের অন্যতম শক্তি এবং দুর্বলতা হচ্ছে ‘ফেথ’ বা ‘বিশ্বাস।’ নম্রতা তাঁর স্বামীকে বিশ্বাস করতেন না বলে খুন করেছিলেন। বিষাণ তার মাকে বিশ্বাস করে না কারণ তিনি বিষাণের বাবাকে খুন করেছেন। মশাল পার্টি নম্রতাকে বিশ্বাস করে না কারণ তিনি এখন আর যথেষ্ট লাভজনক নন। নম্রতাও মশাল পার্টিকে বিশ্বাস করেন না। এত বিশ্বাস আর বিশ্বাসভঙ্গের মাঝখানে আমাকে ব্যালান্স করে চলতে হচ্ছিল বলে আমিও কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনি। ষষ্ঠী, আয়েশা বা বিষাণ—কেউ মাস্টার প্ল্যান জানত না। প্রত্যেকে নিজের অংশটুকু জানত। মাস্টার প্ল্যান শুধু আমি জানতাম। আপনাকেও পুরোটা বলিনি।’
‘কেন? সেটাই তো জানতে চাইছি।’
‘আপনার কাছ থেকে এই অপারেশানের ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার অনেক আগে, মানে আজ থেকে পাঁচ মাস আগে আমি এক্সপেরিমেন্টালি ফেসবুকে ফেক প্রোফাইল বানাই রেশমি নামে। এবং সেই পরিচয়ে বিষাণের সঙ্গে আলাপ করি। দেখাও করি বার কয়েক। প্ল্যানটা এত দ্রুত ক্লিক করে যাবে, এটা ভাবিনি। আমার পক্ষে তাই মনুয়া সাজা সম্ভব ছিল না।’
রঞ্জিত নিচু গলায় বলেন ‘রেশমি আসলে তুই? আমি মেয়েটার এতগুলো ছবি দেখলাম। তাও চিনতে পারলাম না কেন? বয়স হয়ে যাচ্ছে!’
‘কাউকে সনাক্ত করাটা মস্তিষ্কের কাজ। আপনার ব্রেন ভেবে রেখেছে যে আমি মনুয়া সেজে ঝুপড়িতে আছি। তাই রেশমির ফোটো দেখে আমার কথা মনে হয়নি। অ্যাকচুয়ালি, মনুয়া সেজে ঝুপড়িতে দিন কাটানোটা সোজা কাজ, কারণ কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হচ্ছিল না। কিন্তু বিষাণের সঙ্গে আলাপ করা, বিশ্বাস অর্জন করা, তার সঙ্গে শক্ত মানসিক বন্ধন গড়ে তোলা, তার মায়ের বিশ্বাস অর্জন করা—এগুলো শক্ত কাজ। ইন্ট্রোভার্ট আয়েশা এগুলো পারত না। আমরা তাই কাজ ভাগ করে নিয়েছিলাম।’
‘হুম!’
‘আমার উদ্দেশ্য খুব সিম্পল ছিল। মনুয়া আর রঘুর দেওয়া খাবার যাতে নম্রতা না খান। তার বদলে উনি খেলেন আমার রান্না করা ভাত, ডাল, আলুভাজা আর মাছের ঝোল। দেখুন স্যর, আবার সেই বিশ্বাস! এবার নিজের ছেলেকে।’
‘ভাতে কী মিশিয়েছিলি? লাঞ্চ সেরে কালিকাপুরোম থেকে বেরিয়েই নম্রতার পেটে ব্যথা শুরু হয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে নানান পরীক্ষা করে ডাক্তার বলেন নম্রতার অন্ত্র পচে গেছে। এক ঘণ্টার আগেই সব শেষ।’
‘ওঁর খাবারে সোনালি চাল মেশাইনি, এটা সিয়োর।’ হাসল প্রথমা।
‘মশাল পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব জানিয়েছেন, নম্রতার অকালমৃত্যুর কারণে কালিকাপুরোমের নির্বাচন স্থগিত হল। লোকসভা নির্বাচনের পরে ওখানে নতুন করে ভোট হবে। সেই ভোটে ওখানকার প্রার্থী হবে নম্রতার ছেলে, পার্টির তরুণ তুর্কি, বিষাণ গোয়েল।’
প্রথমা চুপ।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রঞ্জিত বললেন, ‘বিষাণ তো জানে যে ওর দেওয়া খাবার খেয়েই নম্রতা মারা গেছেন। বিষাণ জানে যে রেশমি ওরফে তুই রান্না করেছিলি। ও যদি পুলিশকে বলে দেয়?’
‘আমি ওর জীবন থেকে ভ্যানিশ হয়ে গেছি স্যর। রেশমিকে আর কোনও দিনও খুঁজে পাওয়া যাবে না।’