রইল বাকি পাঁচ

রইল বাকি পাঁচ

রিও ডি জেনেইরো। ষোলোই সেপ্টেম্বর

পর্তুগাল ভাষায় ‘রিও ডি জেনেইরো’ মানে ‘জানুয়ারির নদী।’ ব্রাজিল নামের দেশটির অন্যতম প্রধান শহর রিও ডি জেনেইরোকে সারা বিশ্ব জানে ‘রিও কার্নিভালো’-এর জন্যে।

এই বছরের রিও কার্নিভালো শুরু হবে ১৭ সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ আগামীকাল। চলবে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এই সময়ে লক্ষ লক্ষ বিদেশি টুরিস্ট রিওতে আসে।

সেই রকম এক টুরিস্ট রিও-র ‘সান্তোস ডুমন্ট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ থেকে বেরোল। জিন্‌স, টি শার্ট, স্নিকার, সানগ্লাস আর ফেস মাস্ক পরা মেয়েটির চেহারা ভারির দিকে। গায়ের রং বাদামি, চুলের রং বার্গান্ডি। কাঁধে ব্যাকপ্যাক। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে সে চলে গেল স্থানীয় বাস স্ট্যান্ডে। গুগল ট্রান্সলেটর ব্যবহার করে বাসের কন্ডাক্টরকে জানাল গন্তব্য। রিওতে মেট্রো রেল, অ্যাপক্যাব, এক্সিকিউটিভ বাস—সব আছে। কিন্তু সব জায়গাতেই সিসিটিভি কভারেজ! মেয়েটি জানে আজকের পৃথিবীতে ক্যামেরার লেন্সকে এড়ানো অসম্ভব। সে চেষ্টা করছে রাষ্ট্রের নজরদারি থেকে যতটা পারা যায় দূরে থাকতে।

রাষ্ট্রের নজরদারি এড়ালেও মানুষের নজরদারি এড়াতে পারছে না মেয়েটি। এয়ারপোর্ট থেকে বেরোনো ইস্তক তার গতিবিধি দামি ক্যামেরায় ভিডিও রেকর্ড হচ্ছে। মেয়েটি যখন লোকাল বাসে চেপে যাচ্ছে, তখন পিছনে দৌড়োচ্ছে একটি চারচাকা। রিও-র মানুষ জানেও না কার্নিভালের প্রথম দিন কী ভয়ানক কাণ্ড ঘটতে চলেছে…

দিল্লি। ছব্বিশে জানুয়ারি

রাত আটটার সময় সাউথ ব্লকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রঞ্জিত গগৈয়ের অফিসে ঢুকে প্রথমা দেখল বস টিভি দেখছেন। প্রথমা চেয়ারে বসে দেওয়ালে মাউন্ট করা টিভির দিকে তাকাল। দিল্লির যন্তর-মন্তরে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আজ সারাদিন যে বিক্ষোভ চলেছে তার পুনঃপ্রচার দেখানো হচ্ছে। বিরোধী নেতা কৃষ্ণলাল বলছে, ‘প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রধান অতিথি হিসেবে দিল্লি এসেছেন ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি জাইর লোবোসোনারো। বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা-র মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে করবেন প্রধানমন্ত্রী বীরেন্দ্র মেহতা। এই চুক্তি সাক্ষরিত হলে আমরা আমরণ অনশন করব।’

প্রতিবেদক বললেন, ‘চুক্তিতে আপত্তিকর কী আছে?’

‘ “বিশ্বের ফুসফুস” বলা হয় “আমাজন বৃষ্টি-বনানী”-কে। লোবোসোনারো সেই অরণ্যকে প্লেটে করে তুলে দিয়েছেন “সক্রেটিস” নামের বহুজাতিক সংস্থার হাতে যার হেড অফিস ব্রাজিলে। এই চুক্তি বিশ্বকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে। আমরা সেটা চাই না।’

পর্দায় এখন বীরেন্দ্রর মুখ। তিনি বললেন, ‘ব্রাজিলের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ দিনের সুসম্পর্ক। তাকে কাজে লাগিয়ে বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য ক্ষেত্রে সফল হওয়া আমাদের অগ্রাধিকার।’

এই অবধি শুনে প্রথমা বলল, ‘আমাজন রেন ফরেস্ট নিয়ে আমার কোনও আইডিয়া নেই।’

টিভি মিউট করে রঞ্জিত বললেন, ‘মানবজাতির বেঁচে থাকার জন্যে পৃথিবীতে রোজ যত অক্সিজেন লাগে তার কুড়ি শতাংশ আসে আমাজন থেকে। এই জঙ্গল গোটা বিশ্বের আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে। একে কেটে সাফ করলে আমাদের দেশে দূষণ বাড়বে, খরা দেখা দেবে। আমাজনের ধ্বংসের জন্যে অনেক দেশ দায়ী। তাদের মধ্যে এক নম্বরে আছে ব্রাজিল। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী লোবোসোনারো ভোটে দাঁড়িয়ে বলেছিল বৃষ্টি-বনানীর উন্নয়ন ঘটাবে। ভোটে জিতেই বলতে শুরু করেছে, ব্রাজিলের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে গেলে আমাজন সাফ করতে হবে। বিপুল খনিজ ভাণ্ডার তুলতে মাইনিং শুরু হয়ে গেছে। এবং শুরু হয়েছে ‘ম্যান মেড’ দাবানল। তিন সপ্তাহের দাবানলে বিস্তীর্ণ এলাকার গাছপালা সাফ হয়ে গেছে। তা ছাড়া ব্রাজিল ‘সি ও পি ছাব্বিশ’ বা ‘কোপ ছাব্বিশ’ চুক্তিতে সাক্ষর করেনি।’

‘সেটা আবার কী?’

রঞ্জিত উত্তর দেওয়ার আগেই প্রথমার পিছন থেকে পুরুষকণ্ঠ বললেন, ‘ “সিওপি” হল “কনফারেন্স অফ পার্টিজ”-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। কয়েক বছর আগে গ্লাসগোতে বিশ্ব জলবায়ু নিয়ে ছাব্বিশতম সম্মেলন হয়। তাই ওই কনফারেন্সের নাম কোপ ছাব্বিশ।’

প্রধানমন্ত্রী বীরেন্দ্র মেহতার কণ্ঠস্বর! চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল প্রথমা এবং রঞ্জিত।

রিও ডি জেনেইরো। ষোলোই সেপ্টেম্বর

বাস থেকে নেমে ‘অ্যাটলান্টিকো সেন্ট্রো অ্যাপার্টমেন্ট’ হোটেলে ঢুকল মেয়েটি। এই হোটেলে যারা আসে, তারা এক বা দু-ঘণ্টার জন্যে রুম ভাড়া নেয়। প্রতিদিন কত ছেলেমেয়ে ঢোকে আর বেরোয় তার হিসেব নেই। হোটেলে সিসিটিভি নজরদারির ব্যবস্থা ইচ্ছে করেই রাখা হয়নি।

মেয়েটি চেক ইন করেছে। গাড়িটি রাস্তায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। পোশাক বদলে, ব্যাকপ্যাক লটকে মেয়েটি বেরিয়ে এল এক ঘণ্টার মাথায়। এখন তার পরনে চেকার্ড স্কার্ট আর ব্লাউজ। সানগ্লাস আর ফেস মাস্কের সঙ্গে যোগ হয়েছে স্ট্র হ্যাট।

বাস ধরে মেয়েটি চলে এল কোপাকাবানা সমুদ্র সৈকতে। গ্লোবো বিচ কিয়স্কে বসে অর্ডার করল হ্যামবার্গার। সেটায় কামড় দিয়ে কাউকে ফোন করল।

মেয়েটির পাশের টেবিলেই বসেছে এক অনুসরণকারী। গাড়ির চালকের আসনে বসে দ্বিতীয় অনুসরণকারী দামি ক্যামেরা জুম করে মেয়েটিকে দেখেছে, ছবি তুলছে। সমুদ্র স্নানের পোশাক পরা প্রথম অনুসরণকারী উদাসীন ভাবে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার হাতে আলগোছে ধরা স্মার্টফোনে ভিডিও রেকর্ড হয়ে চলেছে। প্রথম অনুসরণকারী শুনতে পেল মেয়েটি বলছে, ‘হাই! দিস ইজ প্র্যাট ফ্রম গ্লোব বিচ কিয়স্ক, কোপাকাবানা। আই নিড মাই ডকুমেন্টস।’

প্র্যাট নামের মেয়েটি ফোন কেটে দিলেও কোনও ভাবে তার মোবাইল নম্বর জেনে ফেলেছে গাড়িতে বসে থাকা দ্বিতীয় অনুসরণকারী। কাউকে ফোন করে সে ফোনালাপের ট্রান্সক্রিপ্ট ইমেলে আনিয়ে নিচ্ছে। সেটা পড়ে বুঝতে পারছে, কেউ একজন আধঘণ্টার মধ্যে আসছে।

প্র্যাট নামের মেয়েটির খাওয়া শেষ। মোবাইল সুইচ অফ করে সে ব্রাজিলিয়ান কফি অর্ডার করল। ঠিক আধ ঘণ্টার মাথায় এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক সামনের চেয়ারে বসে বলল, ‘এই নাও তোমার পাসপোর্ট, টুরিস্ট ভিসা, নতুন স্মার্টফোন আর সিমকার্ড। সব ডকুমেন্ট ডরোথি সিং-এর নামে।’

‘সিং পদবি কেন দিলে?’ আপত্তি করে প্র্যাট।

‘তোমার চেহারার মধ্যে ইন্ডিয়াননেস আছে। সেটাকে না লুকিয়ে ফোকাসে রাখা হয়েছে। তুমি যাদের হয়ে কাজ করবে, তারা অত্যন্ত বুদ্ধিমান। মিথ্যে বললে ধরা পড়ে যাবে।’

‘বেশ।’

‘ডরোথির, আই মিন তোমার ব্যাকস্টোরি শুনে নাও। তোমার বাবা ভারতীয় আর মা ব্রাজিলিয়ান। ব্রাজিলে জন্ম হলেও তোমার পাঁচ বছর বয়সে বাবা-মায়ের সঙ্গে ইংল্যান্ড চলে যাও। এখন তুমি গ্রেট ব্রিটেনের নাগরিক। কখনও ভারতে যাওনি। বাবা-মা মারা গেছেন। স্বামী ড্রাগ অ্যাডিক্ট, ছেলে খুন হয়েছে। তুমি ব্রডওয়ের ব্যর্থ অভিনেতা। এই মুহূর্তে রোজগার নেই বলে এই কাজটা নিয়েছ।’ টানা কথা বলে থামল যুবক। হাত বাড়িয়ে বলল, ‘পুরোনো স্মার্টফোন আর সিমকার্ড দাও।’

‘ব্যাকস্টোরিটা কনভিন্সিং নয়।’ পুরোনো মোবাইল যুবকের হাতে তুলে দিল প্র্যাট। এই মুহূর্ত থেকে তার নাম ডরোথি হয়ে গেল।

‘তোমার কাজ অভিনয় করা। স্ক্রিপ্ট সংশোধনের দায়িত্ব তোমাকে দেওয়া হয়নি।’ হাতের মোচড়ে মোবাইল ফোন আর সিমকার্ড নষ্ট করে দিল যুবক।

‘আমার পারিশ্রমিক?’

‘আপাতত দশ হাজার রিয়েল অ্যাডভান্স রাখো। কাল নাটক শেষ হলে বাকি নব্বই হাজার রিয়েল পাবে।’ কথাগুলো বলে ছেলেটি চলে গেল। একটু পরে ডরোথিও উঠল। খাবারের দাম মিটিয়ে চলল আইবিস হোটেলের দিকে। ইন্টারনেট ঘেঁটে পকেট-ফ্রেন্ডলি এই হোটেলটি আগে থেকেই পছন্দ করা আছে। পাসপোর্ট দেখিয়ে চেক ইন করে, স্নান-খাওয়া সেরে, নতুন সিমকার্ড ও স্মার্টফোন হাতে নিয়ে প্রথম ফোনটা করে বলল, ‘ডরোথি ফ্রম আইবিস হোটেল।’

ও প্রান্তের পুরুষকন্ঠ বলল, ‘গিভ মি হাফ অ্যান আওয়ার।’

আইবিস হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে বসে থাকা দ্বিতীয় অনুসরণকারীর কাছে নতুন মোবাইল ফোনের নম্বর এবং সেখান থেকে প্রথম ফোনালাপের ট্রান্সক্রিপ্ট আবারও কোনও ভাবে চলে এসেছে। প্রথম অনুসরণকারী আইবিস হোটেলের সার্ভার রুমে ঢুকে সিসিটিভি ফুটেজ দেখছে। হোটেল কর্মীরা আপত্তি করছে না।

দিল্লি। ছাব্বিশে জানুয়ারি

হাতের ইশারায় দুজনকে বসতে বলে, সোফায় বসে প্রথমার দিকে তাকিয়ে বীরেন্দ্র বললেন, ‘আর কী জানতে চাও?’

প্রথমাকে বলতে না দিয়ে রঞ্জিত বললেন, ‘আপনি বলুন স্যর, আমরা শুনছি।’

বীরেন্দ্র বললেন, ‘ছাব্বিশতম জলবায়ু সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল বৃষ্টি-বনানী উজাড় করে উন্নয়ন হবে না। অন্য দেশ সই করলেও ব্রাজিল করেনি। আমরাও করিনি।’

সাহস সঞ্চয় করে প্রথমা বলল, ‘ব্রাজিল সই করেনি, ঠিক আছে। কিন্তু আমরা কেন সই করিনি?’

‘কূটনীতি, প্রথমা!’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বীরেন্দ্র, ‘ব্রাজিলের বহুজাতিক সংস্থা ‘সক্রেটিস’ হল ভারতের এক নম্বর বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। ফুড প্রসেসিং, কোল, স্টিল, বেভারেজ, টেলিকম—সব জায়গায় ওদের বিনিয়োগ। এইসব সেক্টরে লাখ লাখ ভারতীয় ছেলেমেয়ে চাকরি করে। সক্রেটিসকে চটালে ওরা সমস্ত কোম্পানি গুটিয়ে আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যাবে।’

‘সক্রেটিসকে না চটানো এক জিনিস আর লোবোসোনারোর সঙ্গে চুক্তি করা অন্য জিনিস। প্রথমটা কোম্পানির সঙ্গে ডিল করা, পরেরটা সরকারের সঙ্গে। দুটোর মধ্যে কী সম্পর্ক?’

রঞ্জিত নিচু গলায় বললেন, ‘ব্রাজিলের ক্ষেত্রে কোম্পানি আর সরকার সমার্থক। বলা ভালো, কোম্পানিই সরকার চালায়। পরিবার নিয়ন্ত্রিত বহুজাতিক সংস্থাটি সক্রেটিসের একান্ন পারসেন্ট শেয়ারের মালকিন হল মনিকা গ্রাহাম। বৃষ্টি-বনানী উজাড় করার জন্যে মনিকাই দায়ী।’

‘কী ভাবে?’ সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞাসা করল প্রথমা।

‘মনিকার স্বামী হ্যামিল্টন মুরাও অতীতে পেশাদার পাইলট ছিল। সে এখন ব্রাজিল সেনেটের সভাপতি। বিয়ের পরে মনিকা শ্বশুরবাড়ি যায়নি। উল্টে হ্যামিল্টনকে নিয়ে এসেছে নিজের কাছে। আমাদের ভাষায় “ঘরজামাই”। কোম্পানির দশ পার্সেন্ট শেয়ারের মালিকানা দিয়ে হাতের পুতুল করে রেখেছে। রিওতে মনিকার পৈত্রিক সম্পত্তি “গ্রাহাম প্যালেস”-এর একটা লগহাউসে থাকে হ্যামিল্টন। লোবোসোনারোর সঙ্গে মনিকার ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে, সেটা জানে। আশা করি, কী বললাম বুঝতে পারছ?’

বীরেন্দ্র মেহতার সামনে এর বেশি বলা যায় না। প্রথমা নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল। রঞ্জিত বললেন, ‘লোবোসোনারোর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ককে ব্যবহার করে মনিকা সরকার চালায়। ওকে দিয়েই বৃষ্টি-বনানী ধ্বংস করাচ্ছে মনিকা।’

‘আমাকে কী করতে হবে?’ পেশাদার গলায় প্রশ্ন প্রথমার।

তার প্রশ্ন শুনে বীরেন্দ্র ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তিনি যাওয়ার পরে রঞ্জিত বললেন, ‘আমরা চাইছি মনিকা গ্রাহামের অ্যাসাসিনেশান। সাতাশতম জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে রিওতে। এই বছরের ১৭ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে। সেই অনুষ্ঠানে সারা পৃথিবী থেকে মন্ত্রী, এনজিও-র প্রধান, প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদরা আসছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মনিকা যখন বক্তব্য রাখছে, ঠিক তখন ওকে মারতে হবে। এইটাই আমার একমাত্র শর্ত। কাজ কীভাবে করতে হবে সেটা ভাবার দায়িত্ব কাইমেরার।’

প্রথমা চুপ করে বসে আছে দেখে রঞ্জিত বললেন, ‘কী ভাবছিস?’

প্রথমা বলল,

‘হারাধনের ছয়টি ছেলে

চ’ড়তে গেল গাছ,

একটি ম’ল পিছলে পড়ে

রইল বাকি পাঁচ।’

মনিকাকে কী ভাবে মারব, সেটা ভাবছি।’

প্রথমার হাতে একটা ফাইল তুলে দিয়ে রঞ্জিত বললেন, ‘সক্রেটিস কোম্পানি, লোবোসোনারো, মনিকা এবং হ্যামিল্টন সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য এখানে আছে। বাকিটা তোদের খুঁজে নিতে হবে। হাতে অনেক সময়। কোনও সলিড প্ল্যান মাথায় এলে বলিস।’

ঘাড় নেড়ে ঘর থেকে বেরোল প্রথমা।

রিও ডি জেনেইরো। সতেরো সেপ্টেম্বর

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ব্যাকপ্যাক নিয়ে রুম থেকে বেরোল ডরোথি। একতলার ডাইনিং এরিয়ায় ব্রেকফাস্ট করার সময় মোবাইলে মেসেজ ঢুকল, ‘হাই! আই অ্যাম ফ্রেডি!’

চোখ তুলে ডরোথি দেখল এক শ্বেতাঙ্গ যুবক তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। চোখের ইশারায় ফ্রেডিকে অপেক্ষা করতে বলে দ্রুত খাওয়া শেষ করল ডরোথি। আইবিস হোটেল থেকে চেক আউট করে রাস্তায় নেমে দেখল হোটেল থেকে একটু দূরে একটি ‘ফিয়াট স্ট্রাডা’-র পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফ্রেডি।

ডরোথি গাড়িতে উঠতেই ফ্রেডি চালকের আসনে বসে ইঞ্জিনে স্টার্ট দিল। শহরের ভিড় থেকে বেরিয়ে ফাঁকা রাস্তায় পড়ামাত্র স্ট্রাডা ছুটল শোঁ শোঁ করে। এই গাড়ি চলেছে রিওর উপকণ্ঠে অবস্থিত ‘পালাসিও ডি গ্রাহাম’ বা ‘গ্রাহাম প্যালেস’-এর উদ্দেশে।

সমুদ্রের ধারে দু’মানুষ সমান পাঁচিল ও কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা গ্রাহাম প্যালেস। সিকিয়োরিটির লোক সিসিটিভিতে ওদের দেখে বিশাল বড় গেট খুলে দিল। ম্যানিকিয়োর করা বাগানের মধ্যেকার রাস্তা দিয়ে পনেরো মিনিট গাড়ি চালানোর পরে যে প্রাসাদটি ডরোথি দেখল, বৈভবে তার সমতুল্য জীবনে কিছু দেখেনি। বিস্ময়ে তার চোখ কপালে উঠেছে।

গাড়ি অবশ্য প্রাসাদে ঢুকল না। ফ্রেডি জানাল, ‘ওখানে সবার প্রবেশাধিকার নেই।’ বাঁদিকের রাস্তায় কিছুটা গিয়ে একটা লগহাউসের সামনে দাঁড়াল গাড়ি। কাঠের তৈরি দোতলা বাড়িটিও ঐশ্বর্যে ঝলমল করছে, তবে গ্রাহাম প্রাসাদের কাছে সেটা কিছুই না। ফ্রেডি বলল, ‘এসো।’

ফ্রেডির সঙ্গে লগহাউসের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে ডরোথি দেখল কোমরে এবং পিঠে একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দানবের মতো চেহারার এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকে পাত্তা না দিয়ে একটি দরজা খুলল ফ্রেডি।

ভিতরে ঢুকে ডরোথি অভিব্যক্তিহীন মুখে সবার সঙ্গে করমর্দন করলেও মনে মনে উত্তেজিত। এখানে রয়েছে জাইর লোবোসোনারো, মনিকা গ্রাহাম, হ্যামিল্টন মুরাও এবং আদ্রিয়ানা।

আদ্রিয়ানা দিল্লিতে অবস্থিত ব্রাজিল দূতাবাসের কর্মচারী। আসলে ও ব্রাজিলের সিক্রেট সার্ভিস এজেন্সি ‘এজেন্সিয়া ব্রাসিলেরিয়া দে ইনটেলিজেন্সিয়া’-র এজেন্ট।

মনিকাকে দেখে একটাই কথা মনে হল ডরোথির। কাগজের ছবিতে বা টিভি নিউজে রোগা লাগলেও মনিকা আসলে বেশ মোটা।

ফ্রেডি সবার সঙ্গে ডরোথির আলাপ করিয়ে চুপ করল। প্রথমে কথা বলল আদ্রিয়ানা। ‘আজ সন্ধেবেলা জলবায়ু সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সেখানে মনিকা গ্রাহাম বক্তব্য রাখবেন। আমাদের কাছে খবর আছে যে ইন্ডিয়া থেকে একজন প্রফেশনাল অ্যাসাসিন ব্রাজিলে ঢুকে পড়েছে মনিকাকে মার্ডার করার জন্যে। কিলার ইজ আ লেডি, অ্যান্ড হার নেম ইজ প্র্যাট। খুনটা হবে মনিকার ভাষণের সময়। বাইরে তখন রিও কার্নিভালো পুরোদমে চলছে। রাস্তায় লক্ষ লক্ষ লোক। মনিকার কিছু হয়ে গেলে বাই রোড হাসপাতালে নিয়ে যেতে সমস্যা হবে। আমরা যদিও এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রেখেছি।’

আদ্রিয়ানা চুপ করতে ডরোথি বলল, ‘আমাকে কী করতে হবে?’

এই প্রথম মুখ খুলল মনিকা। ডরোথির চোখে চোখ রেখে বলল, ‘হ্যামিল্টন তোমাকে জোগাড় করেছে আমার বডি ডাবল হিসেবে। তোমার ডিটেল্‌ড ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করেই ডাকা হয়েছে। তুমি আজ কোপ সাতাশের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমি অর্থাৎ মনিকা গ্রাহাম সেজে যাবে। বক্তৃতা দেবে। এখানে ফিরে মা-র কাছ থেকে নব্বই হাজার রিয়েল নিয়ে আজই ইংল্যান্ডে ব্যাক করবে।’

দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ডরোথি বলল, ‘আমি যদি মরে যাই?’

‘মরার সম্ভাবনা কম। কারণ তুমি বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরে যাবে। ইনফ্যাক্ট, অনেক মেয়ের মধ্যে তোমাকেই হ্যামিল্টন বেছেছে। কারণ তুমি আমার থেকে একটুখানি হলেও কম মোটা। বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরলে দুজনের চেহারা একদম এক রকম হয়ে যাবে। বাকি রইল ওয়াক অ্যান্ড টক। সেটা শিখতে তোমার বেশি সময় লাগবে না। কারণ তুমি থিয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছ।’

ডরোথি অবাক হয়ে মনিকার দিকে তাকাল। মনিকা খটখট করে হেসে বলল, ‘তোমার স্বামী ড্রাগ অ্যাডিক্ট, তোমার ছেলে ইউকে-র স্কিনহেডদের গুলিতে মারা গেছে। তুমি ব্রডওয়ের ফেইল্‌ড অ্যাক্টর। কানাকড়ি উপার্জন নেই বলে বডি ডাবলের কাজটা নিয়েছ। তোমার জীবনে কিছু নেই ডরোথি। তুমি মরে গেলে কারও কিছু যাবে আসবে না। তবে বেঁচে গেলে হাতে এক লাখ রিয়েল থাকবে। তাই দিয়ে নতুন জীবন শুরু কোরো।’

‘প্লিজ, আরও একটু বেশি রিয়েল দিন,’ চোখের জল মুছল ডরোথি। ‘স্বামীকে ড্রাগের চক্কর থেকে ফেরাতে পারলে, সেটাই হবে নতুন জীবন।’

‘ইউ লাভ ইয়োর হাজব্যান্ড? রিয়্যালি?’ হা-হা করে হাসছে মনিকা, ‘হ্যামিল্টন, ওর প্রফেশনাল ফি ডাবল করে দাও।’

হ্যামিল্টন নীরবে ঘাড় নাড়ল। কাজ শেষ বুঝতে পেরে ফ্রেডি বলল, ‘চলো ডরোথি।’ ডরোথি সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ওরা চলে যাওয়ার পরে সবার আগে মুখ খুলল হ্যামিল্টন। উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘ডরোথি মরে গেলে তার কনসিকুয়েন্স আমরা ডিল করতে পারব তো? জনগণ জানবে যে তুমি খুন হয়েছ।’

‘জনগণকে নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না।’ এই প্রথম কথা বলল লোবোসোনারো, ‘জনগণকে আমি বুঝে নেব।’

‘ব্রেভ ম্যান!’ লোবোসোনারোর পিঠে হাত বুলিয়ে হ্যামিল্টনের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকায় মনিকা, ‘ডরোথি মরে গেলে যাবে। ও শরীরে ব্রাজিলের রক্ত আছে। আমরা ধরে নেব ও ব্রাজিলের জন্যে প্রাণ দিল। ওকে শহীদের মর্যাদা দেব।’

অসহায় ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে হ্যামিল্টন বলল, ‘তুমি সক্রেটিসের মালকিন মনিকা, ব্রাজিলের নও।’

লোবোসোনারোর দিকে তাকিয়ে মনিকা বলল, ‘সক্রেটিসই ব্রাজিলকে চালাচ্ছে। সক্রেটিসকে ভালোবাসা মানে দেশপ্রেম। সক্রেটিসের জন্যে মৃত্যুবরণ করা মানে শহীদ হওয়া। নিজেকে দেখে বুঝতে পারো না?’

মনিকার দিকে প্রেমের দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল লোবোসোনারো।

দিল্লি। ছাব্বিশে জুন

কাইমেরার অফিসে বসে রয়েছে প্রথমা আর আয়েশা। রঞ্জিতের কাছ থেকে যে ফাইলটা পাওয়া গিয়েছিল, সেটা এখন মুখস্থ দুজনের। সরকারি মহাফেজখানা ঘেঁটে পাওয়া গেছে কিছু ক্লাসিফায়েড ফাইল, ভিডিও আর অডিও ক্লিপ। ডার্ক ওয়েব ঘেঁটে পেয়েছে আরও অনেক তথ্য। আয়েশা আর প্রথমা এখন জানে সক্রেটিস কী ভাবে চলে। জানে কী ভাবে নাকে দড়ি দিয়ে ব্রাজিল সরকারকে দৌড় করায় সক্রেটিস।

‘জুন মাস প্রায় শেষ। হাতে বেশি সময় নেই। কিছু ভেবে উঠতে পারলি?’ মনিকার বক্তৃতার ভিডিও ক্লিপ দেখছে আয়েশা।

‘একটা ভেগ আইডিয়া মাথায় এসেছে…’ বীরেন্দ্র মেহতার সেপ্টেম্বর মাসের সফরসূচী দেখছে প্রথমা, ‘যেদিন রিওতে জলবায়ু সম্মেলন শুরু হচ্ছে, ঠিক সেই দিন অনাবাসী ভারতীয়দের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বীরেন্দ্র মেহতা ইংল্যান্ডে থাকবেন।’

‘তো?’ অবাক হয়ে বলল আয়েশা।

‘হ্যামিল্টন মুরাও অতীতে পেশাদার পাইলট ছিলেন…’ আপনমনে বলে প্রথমা।

‘কী বলতে চাইছিস?’ আয়েশা বিরক্ত।

‘শোন তা হলে।’ আয়েশার দিকে তাকিয়ে প্রাথমিক আইডিয়া বলে প্রথমা। সেটা শুনে হাসিতে ফেটে পড়ে আয়েশা বলে, ‘তুই কি পাগল? এটা জাস্ট অসম্ভব!’

‘ভালো করে আবার শোন।’ বলে প্রথমা। হাসি থামিয়ে প্রাথমিক আইডিয়াটি আবার শুনছে আয়েশা। প্রতিটি ধাপে হাজারটা ভুল বার করছে। সেগুলো সংশোধন করা হচ্ছে। করা না গেলে ‘প্ল্যান বি’ নিয়ে কথা হচ্ছে। সেই প্ল্যানেও সমস্যা থাকছে। কথা হচ্ছে ‘প্ল্যান সি’ নিয়ে। রাত বাড়ছে। বাড়ি ফেরার সময়েও ওরা আলোচনা আর তর্ক করছে। পরের দিন সকালে নতুন প্ল্যানের কথা ভাবা হচ্ছে। এই করে আরও এক মাস কেটে যাচ্ছে। জুলাই মাস আসছে…

রিও ডি জেনেইরো। সতেরোই সেপ্টেম্বর।

‘রিওসেন্ট্রো একজিবিশান অ্যান্ড কনভেনশান সেন্টার’-এর বাইরের বাগানে সন্ধে ছ’টার সময় বৃক্ষরোপণ করে জলবায়ু সম্মেলনের উদ্বোধন করল লোবোসোনারো। খোলা আকাশের নীচে, হাজার ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বাল্বের মধ্যে দাঁড়িয়ে চোখ ঝলসে যাচ্ছে ডরোথির। সেন্টারের বাইরেই প্রধান সড়ক। সেখান থেকে আসা রিও কার্নিভালের বাজনায় কান ফেটে যাচ্ছে। সেন্টারে ঢোকার পরে শব্দদূষণ বিদায় হল। মঞ্চে বসেছে লোবোসোনারো, মনিকা সেজে ডরোথি এবং ব্রাজিলের এক মন্ত্রী। আমেরিকা, গ্রেট ব্রিটেন, কানাডা, রাশিয়া আর চিনের প্রতিনিধিও রয়েছে। লোবোসোনারোর বক্তব্য শেষ হতে সঞ্চালক আমন্ত্রণ জানাল ব্রাজিল সরকারের মন্ত্রীকে।

ডরোথির পাশে বসে নিচু গলায় লোবোসোনারো বলল, ‘এখনও পর্যন্ত কোনও ট্রেসপাসিং-এর খবর নেই। এর মানে একটাই!’

ডরোথি মুখে প্লাস্টিকের হাসি লেপ্টে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী?’

‘আমাদের সিকিয়োরিটি সিস্টেম প্র্যাট নামের অ্যাসাসিনকে চিনতে পারেনি। আমি সিয়োর ও এখন এই সেন্টারেই আছে। তুমি বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরে আছ তো?’

‘প্র্যাট যে আমার বুক লক্ষ্য করেই গুলি করবে তার কোনও গ্যারান্টি আছে?’

‘বড় জায়গায় মারতে সুবিধে হয়। মাথা তাক করে মারা রিস্কি। খুব নড়ে।’ হাসল লোবোসোনারো। ব্রাজিলের মন্ত্রীর বক্তব্য শেষ হতেই সঞ্চালক ডেকে নিল মনিকা গ্রাহামকে।

নিজের আসন থেকে উঠে পোডিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে টেলিপ্রম্পটারের দিকে তাকাল ডরোথি। এখানে আসার আগে প্রস্থেটিক মেকআপ করতে অনেকক্ষণ সময় গেছে। সেই সময়ে তাকে মনিকার হাঁটাচলা আর আদবকায়দা শিখে নিতে হয়েছে। শিখে নিতে হয়েছে মনিকার কায়দায় গলা খাঁকারি দেওয়া বা কাঁধ ঝাঁকানো। গলা খাঁকরে ডরোথি বলতে শুরু করল।

ডরোথি আর মনিকার চেহারায় যেটুকু তফাৎ ছিল, সেটা বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরার পরে চলে গেছে। প্রস্থেটিক মেকআপের পরে ডরোথিকে বোঝা অসম্ভব যে সে মনিকা নয়। টেলি প্রম্পটার না দেখেই ডরোথি বক্তৃতা দিতে পারত। কিন্তু মনিকা সেটা করে না বলে ডরোথিও করছে না। ক্যামেরার লেন্সের সামনে কোনও ভুল করা যাবে না।

বক্তৃতা শেষ করে আসনে ফিরল ডরোথি। লোবোসোনারো বলল, ‘আর পনেরো মিনিট। তারপরেই তোমার ছুটি।’

কানাডার প্রতিনিধির বক্তব্য শুনতে শুনতে ডরোথি বলল, ‘আমার ওপরে অ্যাটাক না হলেও আপনারা টাকা দেবেন তো?’

‘ওই নিয়ে চিন্তা কোরো না।’ বলল লোবোসোনারো।

অনুষ্ঠান শেষ হতেই সিকিয়োরিটির লোকেরা ডরোথিকে ঘিরে ফেলে নিয়ে গেল পিছনের গেটে। সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে পেল্লাই ল্যান্ডরোভার ডিসকভারি স্পোর্ট, ব্রাজিলের সব চেয়ে দামি গাড়ি। এই এসইউভিতে ডরোথি এখানে এসেছিল। গাড়িতে ব্যাকপ্যাক ছিল। সেটা কোলে নিল ডরোথি।

ফ্রেডি সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছে। রিও কার্নিভালের জন্যে প্রধান সড়ক বন্ধ। গলি দিয়ে গাড়ি চালিয়ে শহরের বাইরে এল ফ্রেডি। এখন সামনেই হাইওয়ে। আধঘণ্টার মধ্যে ওরা পৌঁছে গেল হ্যামিল্টনের লগহাউসের দোতলায়।

বসার ঘরে মনিকা ছাড়া কেউ নেই। তার ইশারায় ফ্রেডি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বুলেটপ্রুফ ভেস্ট খুলে সোফায় রেখে ডরোথি বলল, ‘মেকআপ তোলার জন্যে বাথরুমটা ব্যবহার করব? আমার ব্যাকপ্যাকে সব সরঞ্জাম আছে।’

মনিকা নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল।

মেকআপ তুলতে মিনিট পনেরো লাগল। সেখান থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে এসে ডরোথি বলল, ‘আমার বাকি পারিশ্রমিক দিন। ফ্লাইটের বেশি দেরি নেই।’

কথা না বলে মনিকা রিমোট টিপে টিভি চালু করল। ডরোথি দেখল টিভির পর্দায় একটা ফুটেজ চলছে। মোবাইল ক্যামেরা, সিসিটিভি ফুটেজ, ওয়েব ক্যামের রেকর্ডিং, স্টিল ফোটো, মোবাইলের অডিও কলের রেকর্ডিং জুড়ে বানানো ভিডিও ক্লিপে কী দেখা যাচ্ছে?

ডরোথি গ্যালিয়েও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে বেরোনো থেকে ক্লিপিং শুরু হল। সে বাসে উঠল। বাস থেকে নেমে অ্যাটলান্টিকো সেন্ট্রো অ্যাপার্টমেন্টে চেক ইন করল। এক ঘণ্টা পরে পোশাক বদলে চেক আউট করল। কোপাকাবানা বিচের গ্লোবো বিচ কিয়স্কে বসে ফোন করল। ‘হাই! দিস ইজ প্র্যাট ফ্রম গ্লোব বিচ কিয়স্ক, কোপাকাবানা। আই নিড মাই ডকুমেন্টস।’ ব্রাজিলিয় যুবকের সঙ্গে সাক্ষাৎপর্বটি পুরোই রয়েছে। আইবিস হোটেলে চেক ইন করা, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা, ফ্রেডির গাড়িতে গ্রাহাম প্যালেসে আসা—সব রয়েছে।

ব্যাকপ্যাক আর বুলেটপ্রুফ ভেস্ট হাতে নিয়েছে ডরোথি। বলছে, ‘আপনার কাজ তো হয়ে গেছে। তা হলে আমার ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে ভাবছেন কেন?’

‘তোর নামই প্র্যাট!’ ঠান্ডা গলায় বলল মনিকা, ‘ইন্ডিয়া থেকে এসেছিস আমাকে খুন করার জন্যে। তোর প্ল্যান ছিল এখানে এসে আমাকে খুন করবি। তাই জলবায়ু সম্মেলনে আমার খুন হওয়ার গল্পটা হ্যামিল্টনকে খাইয়েছিলি। বোকা বরটা ঘাবড়ে গিয়ে তোকেই হায়ার করেছে আমার বডি ডাবল হিসেবে। নাইস প্ল্যান!’

‘আমার নাম ডরোথি সিং। আমি প্র্যাট নই। প্লিজ আমার বাকি পারিশ্রমিকটা দিন।’ কাঁদছে ডরোথি।

সোফা থেকে কোল্ট ওয়ান নাইন ওয়ান ওয়ান তুলে ডরোথির দিকে তাক করে মনিকা বলল, ‘আজ পর্যন্ত কাউকে গুলি করিনি। কিন্তু আজ করব। গুড বাই প্র্যাট!’

ডরোথি পালানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি। পনেরো ফুট দূর থেকে গুলি এসে লেগেছিল বুকের বাঁ-দিকে। বুলেটের অভিঘাতে ছিটকে পড়ে যায় ডরোথি। কোল্ট হাতে নিয়ে লগহাউস থেকে দৌড়ে পালায় মনিকা। খেয়াল করেনি, দরজার ফাঁক দিয়ে পুরো ঘটনাটা মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করছে হ্যামিল্টন।

লগহাউসের পিছনেই রাখা ছিল সেস্‌না স্কাই-হক হেলিকপ্টার। ওটায় করেই ডরোথিকে ব্রাসিলিয়াতে নিয়ে এল প্রাক্তন পাইলট হ্যামিল্টন। ভর্তি করল সান্তা মার্তা হাসপাতালের ট্রমা কেয়ার সেন্টারে। তারপর মনিকার গুলি চালিয়ে খুন করার ভিডিওটি বিশ্বের তাবড় সংবাদমাধ্যমের কাছে পাঠিয়ে দিল। পাঠিয়ে দিল ব্রাজিলের পুলিশ প্রধানের কাছেও।

তৎক্ষণাৎ আসতে শুরু করেছে মেসেজ, অডিও কল আর ভিডিও কল। রয়টার বা পিটিআই-এর মতো বৃহৎ নিউজ এজেন্সি ছাড়াও প্রিন্ট মিডিয়া, টিভি, সোশাল নেটওয়ার্কিং মিডিয়া থেকে যোগাযোগ করছে। সেই পর্ব চোকাতে তিনটি ঘণ্টা লাগল। তারপরে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করল হ্যামিল্টন। ডাক্তার জানাল, ‘বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরে থাকার জন্যে ওঁর মেজর কিছু হয়নি। তবে বুকের একাধিক হাড়ে চিড় আছে। দিন তিনেক পরে ছুটি দেওয়া হবে।’

হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। তিরিশে সেপ্টেম্বর

দোহার হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কফিশপে পাশাপাশি বসে রয়েছে এক প্রৌঢ় আর এক কমবয়সি মেয়ে। দুজনেই কফি পান করছে। দুজনেরই মুখে মাস্ক ও চোখে সানগ্লাস। ওরা যে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, সেটা পাশের লোকের পক্ষে বোঝা অসম্ভব।

প্রৌঢ় বলল, ‘আমি কাতার হয়ে দুবাই যাব। ‘সক্রেটিস অয়েল’-এর বোর্ড মিটিং আছে। দোহায় স্টপ-ওভারের সময়টা কাজে লাগালাম। সামনা-সামনি কথা বলাই ভালো। মোবাইল ফোনে প্রাইভেসি থাকে না।’

মেয়েটি বলল, ‘আমি যাচ্ছি কানাডা। ওখানে কোনও কাজ নেই। আসল উদ্দেশ্য আপনার সঙ্গে দেখা করা। এনিওয়ে, আপনি যা বলার বলুন।’

‘খুনের অভিযোগে মনিকা এখন জেলে। ট্রায়াল যাতে কয়েক দশক ধরে চলে তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সক্রেটিস কোম্পানির আইন অনুযায়ী খুনের কেসে অভিযুক্ত কেউ শেয়ার হোল্ডার হতে পারে না। মনিকার হাজব্যান্ড হিসেবে আমি ওর ভাগের একান্ন শতাংশ শেয়ারের মালিক হয়েছি। প্লাস নিজের দশ পার্সেন্ট শেয়ার আছে। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।’

‘জুলাই মাসে সাও পাওলোতে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে কী বলেছিলাম মনে আছে?’

‘আছে। তুমি বলেছিলে যে তুমি ইন্ডিয়ার এজেন্ট। আমাকে সক্রেটিসের ম্যাক্সিমাম শেয়ার হোল্ডার করে দেওয়ার ব্যাপারে হেল্প করবে। বিনিময়ে আমাকে সক্রেটিসের পলিসি চেঞ্জ করে বৃষ্টি-বনানীর উজাড় বন্ধ করতে হবে। তুমি তোমার কথা রেখেছ। এবার আমি আমার কথা রাখব।’

‘ধন্যবাদ।’

‘তবে এত জটিল প্ল্যান যে সফল হবে এটা আমি ভাবতে পারিনি।’

‘প্ল্যানটা আদৌ জটিল নয়। কারণ প্ল্যান বানানো হয়েছিল আপনাদের তিনজনের মানসিকতা মাথায় রেখে। আপনি আগাগোড়া আমাদের টার্গেট ছিলেন। আপনার মাধ্যমেই ওই দুজনের মাথায় ঢোকানো গেল যে প্র্যাট নামের পেশাদার খুনি মনিকাকে মারতে জলবায়ু সম্মেলনে আসবে। আপনার থ্রু দিয়েই ওদের বোঝানো গেল বডি ডাবলের প্রয়োজনীয়তা। আপনি সাহায্য না করলে প্র্যাট রিওতে ডরোথি সেজে আসতে পারত না। আপনি আগাগোড়াই প্র্যাটের দুটি মোবাইল নম্বর জানতেন। আপনার দুই সঙ্গী গাড়িতে প্র্যাটকে ফলো করেছিল বিমানবন্দর থেকে অ্যাপার্টমেন্টে, কিয়স্ক থেকে হোটেলে। আপনার স্যাঙাত, কৃষ্ণাঙ্গ যুবকটিই ভিডিওটা বানিয়েছিল। যেটা আপনি জলবায়ু সম্মেলনের উদ্বোধনের সময়ে মনিকাকে লগহাউসে ডেকে দেখান। তারপর লগহাউস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অভিনয় করে ফিরে আসেন।’

‘আমি তোমার প্ল্যানমাফিক পাশের ঘরে লুকিয়েছিলাম। কিন্তু প্র্যাটের যদি কিছু হয়ে যেত? ও তো বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট খুলে ফেলেছিল।’

‘কিছু হতো না। কারণ সান্তোস ডুমন্ট বিমানবন্দরে নামার পরে প্র্যাট বাথরুমে ঢোকে। আপনার দয়ায় সেখানে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট রাখা ছিল। সেটা পরে ও বাইরে বেরোয়। সেই জন্যে তখন থেকেই ওকে অল্প মোটা লাগছিল। দুটো ভেস্ট পরার পরে মনিকার চেহারার সঙ্গে একদম মিলে যায়।’

‘প্র্যাটকে হাসপাতাল থেকে এক সপ্তাহ আগে ছেড়ে দিয়েছে। সে এখন কোথায়?’

‘আপনাকে যেটুকু বলা হল, সেটুকুই জানুন। বুলেটপ্রুফ ভেস্টগুলো নষ্ট করে দিয়েছেন তো?’

‘দিয়েছি। তবে ছোটখাটো ভুলত্রুটি নিয়ে ভাবার প্রয়োজন নেই। রিও কার্নিভালের সময় এত বড় ঘটনা ঘটায় লোবোসোনারোর অবস্থা ঢিলে। সে গোঁয়ারের মতো সবকিছু ধামাচাপা দিয়েছে। ডরোথির মেডিকাল রেকর্ড নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ওর খোঁজ কেউ করছে না। ব্রাজিল সরকার শুধুমাত্র মনিকাকে জেলে রাখতে চায়। দ্যাটস অল। তবে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার চাপ আছে। এখানকার বিরোধীরাও রাস্তায় নেমেছে। এত সহজে লোকটা ছাড়া পাবে না।’

‘আমি উঠি,’ কফি শেষ করে বলল মেয়েটি।

মাথা নিচু করে হ্যামিল্টন বলল, ‘তুমিই কি ডরোথি সেজে রিওতে এসেছিলে? সুস্থ হয়ে ইন্ডিয়ায় ফিরে গিয়ে আবার এসেছ আমার সঙ্গে দেখা করতে? সাও পাওলোতে বলেছিলে তোমার নাম প্র্যাট। সেটা ঠিক না ভুল?’

মেয়েটি কিছুক্ষণ হ্যামিল্টনের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপরে মোবাইল বার করে ফক্স টিভির নিউজ চ্যানেলে গিয়ে সতেরোই সেপ্টেম্বর সন্ধে সাতটার খবরে গেল। হ্যামিল্টন দেখল, ইংল্যান্ডে অনাবাসী ভারতীয়দের কনভেনশান উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী বীরেন্দ্র মেহতা। তাঁর ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই মেয়েটি।

হ্যামিল্টন বলল, ‘তুমি প্র্যাট হলে ডরোথি কে?’

‘জাদুকররা বলে না।’ মিষ্টি হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠল প্রথমা।

দিল্লি। চৌঠা অক্টোবর

রঞ্জিতের ঘরে ঢুকে প্রথমা বলল, ‘মিশন সাকসেসফুল।’

রঞ্জিত বললেন, ‘কোথায় সাকসেস? আমার নির্দেশ ছিল মনিকার অ্যাসাসিনেশান। সেটা হয়নি। সেকেন্ডলি, এই অপারেশানে তোর কোনও ভূমিকা নেই। একবার সাও পাওলো গেলি। একবার আয়েশাকে ডরোথি সাজিয়ে রিও পাঠালি। একই সময়ে তুই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে লন্ডনে ঘুরে এলি। বেচারি আয়েশা পাঁজরে চিড়ের কারণে এখনও ভালো করে নড়তে পারছে না। একটা ফেক ভিডিও ক্লিপ বানানো আর একটা মার্ডার ভিডিও মিডিয়ার কাছে লিক করানো ছাড়া এই মিশনে তোর কোনও ভূমিকা আছে?’

মৃদু হেসে প্রথমা বলল, ‘সাও পাওলোতে হ্যামিল্টনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম বলেই দ্বিতীয়বার রিও যাইনি। হ্যামিল্টন যদি কোনও কারণে পুলিশের সামনে মুখ খুলত, তা হলে আমার কাছে অ্যালিবাই ছিল যে আমি সেই মুহূর্তে ইংল্যান্ডে ছিলাম। তা না হলে, কবে আমাকে মিডিয়ার সামনে দেখা গেছে? আমি মিডিয়াকে প্লেগের মতো অ্যাভয়েড করি।’

‘তাই বলে মিথ্যে ভিডিও বানাবি?’

‘ “উত্তর সত্য” জমানায় “ট্রুথ” ম্যানুফ্যাকচার করতে হয় স্যর। সেটা আপনিও জানেন। ওই ফেক ভিডিও আর ওই আসল মার্ডার ক্লিপের জন্যে বৃষ্টি-বনানীর ধ্বংস বন্ধ হয়েছে, ব্রাজিল সরকার চাপে আছে। হারাধনের ছ’নম্বর ছেলের মতো মনিকা উচ্চাশার মগডালে চড়তে গিয়েছিল। পিছলে পড়ে মরল তো?’

ভুরু কুঁচকে রঞ্জিত বললেন, ‘মরল আর কোথায়?’

‘ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশানও এক ধরনের অ্যাসাসিনেশান,’ বলল প্রথমা, ‘বাংলায় বলে চরিত্রহনন। হননের বাংলা কী স্যর?’

উত্তর দিতে না পেরে রঞ্জিত অসহায় ভাবে কাঁধ ঝাঁকালেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *